1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৩০

ত্রিশ

আজ দু’দিন হলো বিলিয়নেয়ার রন স্টুয়ার্টের দুর্গের পাতাল ডানজনে বন্দি বেন হ্যানন। তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করা যায়নি। নানানভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে শেষমেশ হতক্লান্ত হয়ে গেছে কিডন্যাপাররা। দফায় দফায় জেরা করতে গেছে ওরা, কিন্তু ওই বুড়ো যেন পেরেকের চেয়েও কঠিন। ওদিকে গতরাতে লকের তীরে যে-লোক গিয়েছিল, সে. বিলি ম্যাকগ্রা ছিল না। দক্ষ সেই কমাণ্ডো হয়তো নাগাল পেয়ে যাবে ম্যাকগ্রার। সেক্ষেত্রে বাজে ধরনের বিপদ হবে। এসব ভেবেই স্যামন-পোচারকে খুন করতে অ্যালান কোয়ার্ট আর হ্যারি অ্যাণ্ডারসনকে নির্দেশ দিয়েছে বাক ওয়াকি। তবে তার দলের লোক গ্রাম্য মস্তানদের সঙ্গে কাজ করবে, তা ভাবতে গিয়ে খচ খচ করছে তার মন।

প্রথম থেকেই সে জানে, কঠিন হবে বেন হ্যাননের মুখ থেকে কিছু বের করা। তা ছাড়া, রবার্ট উইলসন সোনার কয়েন পেলেও নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই, পিটার ওই বিষয়ে জরুরি কিছু বুড়োটাকে বলেছে কি না।

দ্বিতীয় কথা: মরে গেলেও সোনার খোঁজ দেবে না বুড়ো হ্যানন। তার কাছে গুপ্তধনের ম্যাপ নেই, সার্চ করে দেখেছে ওরা। এসএএস ফোর্স… মানে, প্রশিক্ষিত যোদ্ধা সে। ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা হলেও নীরবে সব সহ্য করবে।

অর্থাৎ, এটা বড় ধরনের ঝামেলা। তার কাছ থেকে তথ্য পেলে স্টুয়ার্টের কাছ থেকে বোনাস পাবে দলের সবাই। কাজেই মারধর করতে গিয়ে বুড়োটাকে খুন করতে পারে ওরা। হয়তো মনেই থাকবে না বুড়ো অসুস্থ। ওদিকে নরম আচরণ করেই বা কীভাবে কাজ হবে? না খাইয়ে রাখা বা পানি দেয়া বন্ধ করা যাবে না বুড়োকে। মারধর করলেও হার্ট ফেল করে বসবে।

এসব ভাবতে গিয়ে দমে গেছে বাক ওয়াকি। ঝামেলার শেষ নেই। বুড়োর ওষুধ সম্পর্কে বোতলের সবই লেখা আছে ইতালিয়ান ভাষায়। বহুৎ কষ্ট করে ওসব অনুবাদ করার পর থেকে তার খাবারে ওষুধের গুঁড়ো মেশাচ্ছে সে। শালা বেমক্কা মরে গেলে তার চলবে না। আর সেটা ভাবতে গেলেই মনে পড়ছে: বোতলের ওষুধ শেষ হলে তখন কী হবে? ওষুধ না পেলে চোখের সামনে ছটফট করে মরবে বুড়ো। তখন তার লাশের পেট থেকে কিছুই বেরোবে না।

তিক্ত মনে ভাবল ওয়াকি, দলের সবার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেবে ঘোষণা দিয়ে নিজে মজায় আছে স্টুয়ার্ট। সে ব্যবসায়ী হিসেবে জিনিয়াস হলেও বহু কিছুই মগজে ঢুকতে চায় না।

কোনভাবেই নির্যাতন করা চলবে না। বুড়োর সঙ্গে নরম আচরণ করতে হবে। দুর্গে ব্যক্তিগত কোয়ার্টারে বসে এসব কথাই ভাবছে ওয়াকি। আর সেজন্যেই মনে হলো কীভাবে লোকটার কাছ থেকে খবর বের করা যায়।

দেরি না করে মোবাইল ফোনে স্টুয়ার্টের সঙ্গে আলাপ করল সে। তার পরিকল্পনায় রাজি হলো বিলিয়নেয়ার। ফোন রেখে হাতঘড়ি দেখল বাক ওয়াকি এখন বাজে দুপুর আড়াইটা। একটু পর বন্দির সঙ্গে কথা বলতে নিচতলার প্যাসেজ ধরে চলল সে। চারপাশে মাকড়সার জালের মত প্যাসেজ। এখানে-ওখানে অ্যাণ্টিক ও বাতিল মালের স্টোররুম। আরও একতলা নেমে শক্তিশালী বোমার আঘাতে কিছুই হবে না এমন পুরু একটি লোহার দরজার সামনে থামল। একে একে কড়া থেকে খুলল চারটে ভারী প্যাডলক। দরজা পেরিয়ে ঢুকল পরের ঘরে। পেছনে বন্ধ করে দিল দরজা। নতুন করে লক করল চারটে তালা। দেয়ালের আংটা থেকে খুলে জ্বেলে নিল ইলেকট্রিক লণ্ঠন। উজ্জ্বল আলোর ধাওয়া খেয়ে মুহূর্তে উধাও হয়েছে ঘুটঘুটে আঁধার। একটু দূরের সিঁড়ি বেয়ে আরও একতলা নামল সে। মোটা লোহার রডের দরজা খুলে ঢুকল পাথুরে প্যাসেজে। শেষমাথায় ডানজনে নামার লোহার রডের ট্র্যাপ ডোর। এই মুহূর্তে পুরু বল্টু দিয়ে আটকে রাখা আছে ওটা। স্যাঁতসেঁতে প্যাসেজ ও ডানজনে বিরাজ করছে ফাঁপর লেগে যাওয়ার মত বদ্ধ পরিবেশ। এখানে এলে শ্বাস আটকে আসে বাক ওয়াকির। শীতল ভেজা নরকে কেউ বন্দি ভাবতে গেলেই গলা শুকিয়ে যায়। লণ্ঠন মেঝেতে রেখে ট্র্যাপ ডোরের বল্টু খুলল সে। ট্র্যাপ ডোর তুলে গর্তে নামিয়ে দিল অ্যালিউমিনিয়ামের মই। ওটা ছাড়া কারও সাধ্য নেই নামবে বা বেরোবে ডানজন থেকে।

লণ্ঠন হাতে মই বেয়ে নামতে লাগল বাক ওয়াকি। তার মনে হলো, পা রাখছে হিংস্র জানোয়ারের গুহায়। নিচেই কোথাও আছে বেন হ্যানন। হয়তো হঠাৎ করেই হামলা করতে পারে। ছায়ায় কাউকে দেখল না বাক ওয়াকি। ওপরের ছাত থেকে টুপ-টুপ শব্দে পড়ছে পানি। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই আওয়াজ। হোলস্টার থেকে নিয়ে ডানহাতে পিস্তল রাখল সে। চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘বেন হ্যানন? তুমি কি জেগে আছ?’

জবাব দিল না কেউ।

পানি পড়ার টুপ-টুপ শব্দ ছাড়া চারপাশ নীরব।

মই থেকে নেমে সতর্ক পায়ে চলল সে। এই ডানজনের চেয়ে খারাপ জেল দেখেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশে। অবশ্য সেজন্যে বুড়োর প্রতি তার মনে বিন্দুমাত্র করুণা নেই। তাকে দেখতে না পেলে দুরু দুরু কাঁপে ওয়াকির বুক—মরে গেল নাকি আবার শালা?

‘বেন হ্যানন?’ আবারও গলা ছাড়ল সে।

এবার দেখল বন্দিকে। লণ্ঠন আর পিস্তল দুহাতে ধরে সাবধানে এগোল বাক ওয়াকি। থামল বন্দির আট ফুট দূরে। পেছন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পাথরের মূর্তির মত বসে আছে বেন হ্যানন। দুর্বলভাবে শ্বাস নিচ্ছে চোখ বুজে।

ব্যাটা কি শয়তানের ধ্যান করে নাকি?—ভাবল ওয়াকি। মুখে বলল, ‘জানি যে আমার কথা শুনতে পাচ্ছ।’

এবারও জবাব দিল না বেন হ্যানন। নড়ল না একতিল।

‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, তুমি আমাকে খুব হতাশ করেছ, বলল বাক ওয়াকি, ‘ভেবেছিলাম সব বুঝে সহায়তা করবে। সেটা নিজের জন্যে নয়, কাছের আত্মীয়-স্বজনকে নিরাপদে রাখতে। এত অবুঝ হলে চলে? তুমি কিন্তু স্বার্থপরের মত আচরণ করছ।’

বেন হ্যাননের তরফ থেকে কোনও কথা নেই।

নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে নামল বাক ওয়াকি। ‘তুমি হয়তো ভাবছ, তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না? তা কিন্তু নয়। ভাল করেই জানি ইতালির কোথায় তোমার খামার। এটাও অজানা নয় যে ওখানে আছে তোমার স্ত্রী।’

মূর্তির মত চুপ করে বসে আছে বেন হ্যানন।

চিন্তার নাটাইয়ের সুতো ছেড়ে ঘুড়িটাকে আরও দূরে পাঠাল বাক ওয়াকি। ‘তুমি জানো না, চাইলেই ওই মহিলাকে আমরা ধরে আনতে পারি। যে-কোনও সময়ে ওখানে পাঠিয়ে দিতে পারি দলের কয়েকজনকে। আর তুমি মুখ না খুললে ঠিক সেটাই করব। তুমি কি সেটাই চাও?’

বন্দি নীরব।

‘শোনো কী করব,’ জানাল ওয়াকি। ‘প্রথমে এখানে আনব ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ। স্ক্রিনে তুমি দেখবে ইন্টারনেট ফিড: আমার একলোক নির্যাতন করছে তোমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। চাইলেও চোখ সরাতে পারবে না ওই দৃশ্য থেকে। আগেই বলেছি, আমরা পেশাদার। তাই তোমার স্ত্রী জানেও না কী ঘটবে তার জীবনে। ধীরে ধীরে খুন হবে। ডানজনে রাখব শক্তিশালী স্পিকার। ফুল ভলিউমে স্ত্রীর আর্তনাদ শুনবে তুমি।’

এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই বন্দির।

তার ভয় পাওয়ার কথা, ভাবল বাক ওয়াকি। পরক্ষণে কু ডাকল মন: মরে যায়নি তো লোকটা?

না বোধহয়!

এইমাত্র গভীর শ্বাসের আওয়াজ শুনেছে সে।

পুরো সচেতন আছে লোকটা।

প্রতিটা কথা শুনছে চুপচাপ।

‘তোমার স্ত্রীকে খুন করার পর তোমাকে এখানে ফেলে রাখব,’ বলল ওয়াকি। ‘খাবার বা পানি দেয়া হবে না। ঘুম এলেও ঘুমাতে পারবে না। কারণ, দিন-রাত স্পিকারে চলবে তোমার স্ত্রীর আর্তনাদ। করুণ আর্তচিৎকার শুনতে শুনতে একসময় মৃত্যু হবে তোমার। বারবার ভাববে: চাইলেই বাঁচাতে পারতে স্ত্রীকে। শুধু বলতে হতো মাত্র কয়েকটা কথা। আসলে স্ত্রীকে নিজের হাতেই খুন করছ। আমার কথাগুলো কি বুঝতে পেরেছ?’

এবারও জবাব দিল না বন্দি। অবশ্য বড় করে একবার শ্বাস নিল। আরও কিছু বলতে গিয়ে বাক ওয়াকি দেখল, খুলে গেছে বৃদ্ধের দুই চোখ। লণ্ঠনের আলোয় চকচক করছে কঠোর দুটো চোখের মণি। তা এতই শীতল ও কঠিন, আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল তার।

কারও চোখ দেখে আগে এভাবে বুক কাঁপেনি বাক ওয়াকির। জোর করে নিজেকে শান্ত করল।

বুড়োর চোখে জ্বলছে নরকের লেলিহান আগুন। ওটার তাপে পুড়ে ছাই হবে কেউ না কেউ!

কঠোর গলায় বলল ওয়াকি, ‘মনে রেখো, হাতে সময় পাবে না।’

পিছিয়ে মই বেয়ে ডানজন থেকে উঠল সে। অন্ধকার থেকে মই তুলে খটাং শব্দে বন্ধ করল ট্র্যাপ ডোর। ঠিকভাবে শ্বাস নিয়ে টের পেল: ওই বুড়ো সত্যিই খুব বিপজ্জনক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *