1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৮

আটাশ

‘একটা জরুরি কথা,’ ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠল জেসিকা। ‘আমরা কি তোমার গাড়িতে করে যাব? কারণ আমারটায় করে গেলে পৌছুবার অনেক আগেই শীতে জমে যাব।’

জবাব না দিয়ে দশমিনিট ড্রাইভ করে নিজের টয়োটার কাছে পৌঁছুল রানা। ল্যাণ্ড রোভার থেকে নেমে আধুনিক গাড়িটাতে চাপল ওরা। ইঞ্জিন চালু করে হিটার ছেড়ে দিল রানা। তপ্ত হাওয়া গায়ে লাগতেই নরম সিটে হেলান দিয়েছে জেসিকা। নরম সুরে বলল, ‘প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। গোয়েন্দাগিরি করে তুমি বোধহয় ভাল রোজগার করো। আমি পুলিশের চাকরি করে কোনদিনই এত দামি গাড়ি কিনতে পারব না।’

‘এই গাড়িটা আমার না,’ বলল রানা।

চট্ করে ওকে দেখল জেসিকা। ‘চুরিটুরি করোনি তো?’

‘না। ভাড়া নিয়েছি।’ হাতঘড়ি দেখল রানা। গাড়ি বদল করতে গিয়ে ব্যয় হয়েছে কয়েক মিনিট। এখন বাজে দুপুর দুটো চব্বিশ। সময় নিয়ে ভাবতে যেতেই মিরাণ্ডার কথা মনে পড়ল রানার। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের কাছে অভিযোগ করবে সে। দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ এসবে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই খুঁজে বের করতে হবে বেনকে। সেটা হয়তো সম্ভব। কারণ জেসিকার কাছ থেকে জানা গেছে কোথায় পাওয়া যাবে স্যামন-পোচার বিলি ম্যাকগ্রাকে। আশা করা যায় অনেক কিছুই জানাতে পারবে সে।

তুষারভরা পথে ঝড়ের বেগে চলেছে রানার টয়োটা। আবারও মুখ ভারী করেছে ধূসর আকাশ। যে-কোনও সময়ে শুরু হবে তুমুল তুষারপাত। উইণ্ডশিল্ডে এসে পড়ছে তুলার মত নরম কিছু তুষারকণা।

‘তোমাদের দেশ খুব ঠাণ্ডা,’ মন্তব্য করল রানা।

মাথা দোলাল জেসিকা। ‘ক্রমেই বাড়ছে ঠাণ্ডা। অথচ পরিবেশবাদীরা বলছে কয়েক বছর পর গরমে রোস্ট হব।’

‘আমার এক ফিযিসিস্ট বন্ধু তোমার সঙ্গে একমত হবে,’ বলল রানা।

বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখল জেসিকা। ‘সোলার ফিযিসিস্টও তোমার বন্ধু? কত ধরনের বন্ধু আছে তোমার?’

‘নানান ধরনের,’ হাসল রানা।

দুপুর আড়াইটায় দূরে গ্রাম দেখল রানা। একটা চৌরাস্তায় পৌঁছে ওকে পথ দেখাল জেসিকা। গ্রামের কিনারার দিকে গেছে সরু রাস্তা। ‘বামে মোড় নাও, তারপর পাবে ডানে মাঠ।’

মিনিটতিনেক পর দূরে বরফে ছাওয়া মাঠে ট্রেইলারটা দেখতে পেল রানা। লম্বাটে মোবাইল হোমের একপাশে পুরনো এক সুবারু ফরেস্টার গাড়ি। রানা ও জেসিকা বুঝে গেল ট্রেইলারের ভেতরেই পাবে বিলি ম্যাকগ্রাকে।

‘মিথ্যা নয়,’ বলল রানা। ‘যেখানে বলেছ, সেখানেই আছে লোকটার ট্রেইলার।’

‘তবে পরে আর মিথ্যা না বলে উপায় ছিল না,’ মুচকি হাসল জেসিকা। ‘তোমাকে বোকা বনতে হয়েছে, তাই না?’

‘তোমার সাহায্য না পেলেও ঠিকই ওকে খুঁজে নিতাম।’

‘তা পারতে।’

মাঠের চারপাশে গাছের সারি। একদিকে চওড়া দরজা, উল্টোদিকে আরেকটা। ট্রেইলারের কাছে গেছে গাড়ির চাকার তাজা দাগ। পুরনো চিহ্নেরও অভাব নেই। বছরের পর বছর মাঠে

জন্মেছে ঝোপঝাড় ও জংলা গাছ, পরিষ্কার করেনি কেউ। তুষারের নিচে এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমি। গর্তে পড়ে ঝাঁকি খেয়ে খেয়ে এগিয়ে চলছে টয়োটা। মাঠের চারদিকেই পাইনের বনের তৈরি প্রাচীর। শ্বেত তুষারের প্রান্তরে তৃতীয় কোনও গাড়ি নেই।

কাছাকাছি পৌঁছে ট্রেইলারের চারপাশে আবর্জনা দেখল ওরা। সেসব পাশ কাটিয়ে মোবাইল হোমের কাছে গিয়ে থেমে গেছে ম্যারুগার গাড়ি। কাছেই পড়ে আছে গ্যাসের কয়েকটা খালি সিলিণ্ডার। জংধরা এক লোহার সিঁড়ি উঠে গেছে মোবাইল হোমের দরজায়। গাড়ির ছাতে চার ইঞ্চি পুরু তুষারের চাপড়া। সুবারু গাড়িটা ছাড়া চারপাশের সবই তুষারে ছাওয়া। পড়ছে পেঁজা তুলার মত বরফকণা। মাত্র কয়েক মিনিট হলো ফিরে এসেছে বিলি ম্যাকগ্রা মোবাইল হোমে।

ম্যাকগ্রা যেন ভেগে যেতে না পারে, তাই সুবারুর পেছনে টয়োটা রাখল রানা। ওর মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময়ে মোবাইল হোম থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে লোকটা। তবে আপাতত চারপাশে কিছুই নড়ছে না। ইঞ্জিন বন্ধ করে নিচু গলায় বলল রানা, ‘ঠিক আছে, চলো, গিয়ে কথা বলি ওর সঙ্গে।’ দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ও।

কিন্তু তখনই ঘটল একইসঙ্গে দুটো ঘটনা।

প্রথমে ট্রেইলার থেকে এল করুণ এক ভয়াবহ আর্তনাদ। একসেকেণ্ডের জন্যে বরফের মূর্তি হলো রানা। পরস্পরের দিকে তাকাল জেসিকা আর ও। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে মেয়েটা। একই কথা ভাবছে ওরা। কুঁচকে গেছে ভুরু। জেসিকা আগে এই ধরনের আওয়াজ না শুনলেও রানা শুনেছে। চরম ব্যথা পেয়ে মৃত্যুর মুখে পড়েছে কেউ।

ওই আওয়াজটা সতর্ক করে তুলেছে রানাকে।

পরের সেকেণ্ডে ঠাস্ করে খুলল মোবাইল হোমের দরজা। ম্যাকগ্রার বদলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল দুই লোক। তাদের পরনে কালো কুইন্টেড উইন্টার জ্যাকেট। মাথায় উলের বেনি হ্যাট। হাতে কালো লেদার গ্লাভ্স্। শরীরের নিচের অংশে কালো কমব্যাট ট্রাউজার গুঁজে নিয়েছে মিলিটারি বুটে। এদেরকে সেই স্যামন চোর বিলি ম্যাকগ্রা বলে মনে হলো না রানার। কারও পেটে চর্বি নেই। ভয়ঙ্কর খারাপ কিছুতে জড়িত ছিল এরা। রানার গাড়ির আওয়াজ পেয়ে চমকে গেছে। তাদের মুখ আর বাহুতে চকচক করছে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত। দু’জনের হাতে দীর্ঘ রক্তাক্ত ছোরা। ট্রেইলার থেকে লাফিয়ে নেমে এল তারা। ততক্ষণে রানা বুঝে গেছে, ওই রক্ত আসলে কার!

ম্যাকগ্রা আর ওর গাড়ি ছাড়া আশপাশে কোনও গাড়ি নেই। অর্থাৎ, দূরের গাছগুলোর ওদিকে ট্র্যান্সপোর্টেশন রেখে হাজির হয়েছে এরা। সুবারুর ওপর তুষারের হালকা পরত আর গাড়ির চাকার দাগ বলে দিচ্ছে, ওটা এখানে বেশিক্ষণ হয়নি থেমেছে। মোবাইল হোমে গিয়ে উঠেছিল ম্যাকগ্রা। আর আগে থেকেই ওখানে অপেক্ষা করছিল লোকদু’জন। হাতের নাগালে পেয়েই ছোরার আঘাতে খুন করে ফেলেছে পোচারকে।

শুধু ছোরা হাতে আসেনি এরা। সিঁড়ি থেকে নেমেই মাঠের ওদিকের গেট লক্ষ্য করে ছুটল দ্বিতীয় লোকটা। প্রথমজন ছোরা ফেলে জ্যাকেট থেকে বের করল কালো একটা বড়সড়ো পিস্তল। রানা আর জেসিকার দিকে অস্ত্রটা তাক করেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গুলি শুরু করল সে।

এদিকে একলাফে টয়োটা গাড়ির ওদিকে চলে গেছে জেসিকা। গাড়ির গায়ে বিঁধল কয়েকটা গুলি। খোলা ড্রাইভারের দরজার আড়ালে সরে গেছে রানা। তবে জায়গাটা নিরাপদ নয়। যে-কোনও সময়ে পাতলা স্টিল ভেদ করে গায়ে লাগবে বুলেট। গাড়ির ভেতর হাত ভরে পেছন সিট থেকে ব্যাগ টেনে নিল রানা। ওদিকে পিস্তলের নল ঘুরিয়ে ড্রাইভিং দরজা লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল লোকটা। ভাঙা কাঁচের টুকরো ঝরঝর করে ঝরল রানার মাথা ও কাঁধে। দেরি না করে ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়ল রানা। দ্রুত সরে গেল গাড়ির নিচে। দরজায় লেগে ওর মাথার একইঞ্চি ওপর দিয়ে গেল দুটো গুলি। একের পর এক গুলি করছে লোকটা। চারপাশ ভরে উঠেছে বিকট আওয়াজে।

টয়োটার চাকা উঁচু হলেও মাঠে প্রচুর তুষার। একগাদা সফেদ কণা নাকে-মুখে ঢুকতেই কয়েক মুহূর্তের জন্যে অন্ধ হয়ে গেল রানা। ক্রল করে সরে গেল গাড়ির অন্যদিকে। বেরিয়ে এল তলা থেকে। গাড়ির পাশে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের দিকে টেনে নিল ওর ব্যাগটা। তিনফুট দূরে বসে কোথায় কাভার পাবে সেটা ভাবছে জেসিকা। গাড়িটা ঘুরে ওদের দিকে এগিয়ে এল আততায়ী। দু’হাতে ধরেছে পিস্তল। টার্গেট দেখামাত্র একে একে খুন করবে রানা ও জেসিকাকে।

ব্যাগে হাত ভরে কাটা বন্দুকটা ধরল রানা। ওটার চেম্বারে আছে বারো গেজের বাকশট। হ্যামার তুলে কক করলেও অস্ত্রটা বের করার সময় নেই। দ্বিধা না করেই হাত-কামানের মত বন্দুকটার নল ওপরে তুলেই ট্রিগার টিপে দিল রানা। পিস্তল হাতে সামনে বেড়ে ওর হাতে ব্যাগটা লাফিয়ে উঠতে দেখেছে আততায়ী। পরক্ষণে সরাসরি তার বুকে বিঁধল হরিণ মারা এক থোক গুলি।

বজ্রপাতের আওয়াজ তুলেছে বন্দুক। দূর পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে এল প্রতিধ্বনি। অবশ্য আগেই ঝাঁঝরা বুক নিয়ে পিছিয়ে তুষার ছাওয়া মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেছে মৃত আততায়ী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *