1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ২৬

ছাব্বিশ

একটু আগে ধরা পড়েছে বেন হ্যানন।

‘লোকটা কি মারা গেছে?’ জানতে চাইল রন স্টুয়ার্ট। ছাত ধসে পড়া পরিত্যক্ত চ্যাপেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দলের কয়েকজন। ঘিরে ধরেছে অচেতন বেনকে। ঝুঁকে তার পাল্‌স্‌ দেখল বাক ওয়াকি। মুখ তুলে তাকাল। ‘না, মরেনি।’

‘লোকটার সমস্যাটা কী? কারণ ছাড়াই কাত হয়ে পড়ে গেল!’

‘হার্টে প্রবলেম,’ বলল বাক ওয়াকি।

তার দিকে তাকাল রন স্টুয়ার্ট। ‘তুমি জানলে কী করে? কবে আবার ডাক্তারি পাশ করলে?’

জবাব না দিয়ে বেনের পকেটে পাওয়া ওষুধের শিশিটা দেখাল বাক ওয়াকি। তার হাত থেকে ওটা নিয়ে নিজের কাশ্মীরী কোটের পকেটে রাখল বিলিয়নেয়ার স্টুয়ার্ট। ‘এর কাছ থেকে আরও কিছু পাওয়া গেছে? ওর ফোনটা দাও।’

ফোনটা তার হাতে দিল বাক ওয়াকি। মনোযোগ দিয়ে স্মার্টফোন দেখতে লাগল রন স্টুয়ার্ট। কয়েক মুহূর্ত পর ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা!’

‘কিছু জানলেন?’ জিজ্ঞেস করল বাক ওয়াকি।

‘এই ফোন এর নয়। এটার মালিক বিলি ম্যাকগ্রা নামের এক লোক। এই যে ফেসবুক পেজ।’ স্ক্রিনে স্ক্রল করছে সে। আরও কুঁচকে গেল দুই ভুরু। ‘হুম। ইন্টারেস্টিং।’ ওয়াকির হাতে ফোনটা ফেরত দিল সে।

স্ক্রিন দেখে নিয়ে তার দিকে তাকাল ওয়াকি। স্ক্রিনে মোটা এক লোকের ছবি। আগে কখনও তাকে দেখেনি সে। লোকটা আছে স্কটল্যাণ্ডের কোনও লকের তীরে। পেছনে পাহাড়। মোটকুর পরনে ওঅটারপ্রুফ পোশাক। হাতে সদ্য ধরা বড় একটা স্যামন মাছ।

আবারও রন স্টুয়ার্টের হাতে ফোন ফেরত দিল ওয়াকি। ‘শুয়োরের মত মোটা এক লোকের ছবি। হাতে মরা স্যামন।’

‘ঠিক, ওয়াকি। তবে এ থেকে বেরিয়ে এসেছে আরও কিছু জরুরি তথ্য।’

বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে এসব ভাবতে বয়ে গেছে বাক ওয়াকির। কাজ শেষ করতে এখানে এসেছে। অর্ধেক কাজ হয়েও গেছে। এখন বেন হ্যাননকে খতম করে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়।

‘এবার?’ জানতে চাইল অ্যালান কোয়ার্ট। ওয়াকির ডাকে একটু আগে লণ্ডন থেকে এসেছে সে। ওয়াকির মতই চাইছে কাজ শেষ করতে। আর সেটা হয়ে গেলেই বড় অঙ্কের একটা চেক পকেটে পুরে বাড়ি ফিরে যেতে।

‘গুলি করো বেন হ্যাননকে,’ নির্দেশ দিল বাক ওয়াকি।

‘নিশ্চয়ই,’ বেন হ্যাননের দেহের পাশে থামল অ্যালান কোয়ার্ট। ঝুঁকে পিস্তল ঠেকাল মানুষটার মাথায়।

অস্বস্তিতে পড়ে গেছে ইন্সপেক্টর মুরে। রবার্ট উইলসনকে পানিতে ডুবিয়ে মারার সময় বা পিটার হ্যাননকে আহত করার সময় নিজে উপস্থিত থাকলেও সরাসরি খুনে সে অভ্যস্ত নয়। পেটের ভেতর কী যেন মুচড়ে উঠছে। স্টুয়ার্টের দলের অন্যরা চেয়ে নেই তার দিকে। সবাই ভাল করেই জানে, তাদের মতই এসবে নাক তক ডুবিয়ে রেখেছে পুলিশ অফিসার।

বেনের মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দেবে অ্যালান কোয়ার্ট, এমনসময় হাত তুলে মানা করল রন স্টুয়ার্ট। ‘অপেক্ষা করো।’

সোজা হয়ে বাক ওয়াকির দিকে তাকাল কোয়ার্ট। বসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি না ভাবছে বাক ওয়াকি। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনি বলেছিলেন একে খতম করতে হবে। যাতে আর কোনও ঝামেলা পাকাতে না পারে।’

কড়া চোখে তাকে দেখল রন স্টুয়ার্ট। ‘আমাকে কিছু মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়াকি। ভাল করেই জানি কী বলেছি। তবে এখন ভাবছি, সুবিধা হবে একে খুন না করলেই।’ ফোনটা ওপরে তুলে দেখাল সে। ওটা যেন জরুরি প্রমাণ। ‘বেন হ্যানন বুড়ো আর অসুস্থ হলেও বোকা নয়। আমাদের মতই একই কথা ভেবেছে। খুঁজে বের করতে চেয়েছে সেই পোচারকে। যাতে খুনের সাক্ষীকে হাতে পায়। আর এখন এই ফোন দেখে বুঝতে পারছি, ওই লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার। এ থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে, আরও বহু কিছুই জেনে নিয়েছে বেন হ্যানন। কাজেই সুযোগ যখন আছে, উচিত তার মুখ থেকে সব জেনে নেয়া। আহত হওয়ার আগে হয়তো আরও বহু কিছু চাচাকে বলেছে পিটার হ্যানন। হয়তো এ-ও জানিয়ে দিয়েছে, কোথায় আছে রবার্ট উইলসনের সেই গুপ্তধন। অথচ, ওগুলো আমার পারিবারিক সম্পদ। কাজেই আমি চাই ওসব ফেরত পেতে।’

স্টুয়ার্টের চোখে জেদ দেখল বাক ওয়াকি। তার মনে পড়ে গেল, এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, তার পেছনে ছিল সেই গুপ্তধনের লোভ। সোনার কয়েন পাওয়ার জন্যে এমন কিছু নেই যা করবে না স্টুয়ার্ট। সে বুদ্ধিমান মানুষ। আগে কখনও তার চেয়ে সতর্ক কাউকে দেখেনি ওয়াকি। তবে এটাও ঠিক, হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন উদ্ধারের জন্যে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছে লোকটা।

‘সত্যিই হয়তো ওই গুপ্তধন কেউ খুঁজে পায়নি,’ মন্তব্য করল ওয়াকি।

‘সেটা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে খোঁজ নেয়া। কাজেই এখনই খতম করা যাবে না বেন হ্যাননকে।’

চুপ করে থাকল ওয়াকি। তার দলের লোক অসন্তুষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে স্টুয়ার্টের দিকে। ভাবছে, অর্ধেক কাজ সমাপ্ত হলেও বাকি অংশ শেষ না হওয়ায় পুরো টাকা পাবে না তারা।

‘ভেবো না,’ বলল রন স্টুয়ার্ট। ‘বেন হ্যানন খুন হোক বা বেঁচে থাকুক, পুরো ফি-ই পাবে তোমরা। শুধু তাই নয়, এর মুখ থেকে জরুরি তথ্য বের করতে পারলে প্রত্যেকে পাবে আরও পাঁচ হাজার পাউণ্ড। আর সেটা না পারলে বাড়তি কোনও টাকা পাবে না।’

মৃদু মাথা দোলাল ওয়াকি। তার দলের প্রায় সবাই সন্তুষ্টি নিয়ে মাথা দোলাল। তবে নার্ভাস বোধ করছে ইন্সপেক্টর জন মুরে। বুঝে গেছে, বেন হ্যাননকে কিডন্যাপ করে নিয়ে নির্যাতন করা হবে। রন স্টুয়ার্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে ক্রমেই বড় হচ্ছে তার অপরাধের তালিকা। একবার ধরা পড়লে জেল হবে অন্তত বিশ বছরের।

‘এ ছাড়া, আমার হয়ে করে দেবে আরও একটা কাজ, ‘ বলল রন স্টুয়ার্ট। ‘এখন ভাল করেই জেনে গেছি বিলি ম্যাকগ্রা রবার্ট উইলসনের খুনের সাক্ষী। কাজেই বুজে দেবে তার মুখ।’ ইন্সপেক্টর মুরের দিকে না চেয়েই হাতের ইশারা করল সে। ‘মুরে জানিয়ে দেবে কোথায় বাস করে ওই লোক।’

ম্যাকগ্রা খুনের সাক্ষী কি না সেটা নিয়ে মাথা-ব্যথা নেই ওয়াকির। ‘আপনি চান তার পেট থেকে সব কথা বের করা হোক?’

‘না। স্রেফ খুন করলেই হবে। এরই ভেতর বহু ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে সে।’

কেউ কিছু বলার আগেই গুঙিয়ে উঠল বেন হ্যানন। অ্যালান কোয়ার্ট বলে উঠল, ‘এর জ্ঞান ফিরছে।’

তার দিকে ওষুধের বোতল ছুঁড়ল ওয়াকি। ‘দরকার হলে দু’তিনটে বড়ি গিলিয়ে দেবে। তারপর ভ্যানে তুলে সোজা নিয়ে যাবে দুর্গে।’

চমৎকারভাবে কাজে লেগেছে ফাঁদ। মিচ ম্যাকডোনাল্ড আগেই জানিয়ে দিয়েছিল পিটার হ্যাননের গাড়ি নিয়ে ঘুরছে তার চাচা। পুলিশ স্টেশনে সকালে ঢুকেই গাড়িটা দেখেছে মুরে আর রিড। তখনই যোগাযোগ করেছে স্টুয়ার্টের সঙ্গে। এরপর লোকটাকে ধরতে তৈরি করা হয়েছে প্ল্যান। দুর্গ থেকে বেরিয়ে ভ্যানে চেপে সবাইকে নিয়ে এখানে এসেছে ওয়াকি। তাদের সঙ্গেই রুপালি রোদ্ রয়েসে চেপে এল স্টুয়ার্ট। ঝামেলা হলো না বেন হ্যাননকে বাগে পেতে। আর এখন জেনে নেবে কোথায় পাবে সেই পোচারকে। তাকে খতম করে দিলেই মিটে যাবে বড় একটা ঝামেলা।

আপাতত প্ৰথম কাজ বেন হ্যাননকে দুর্গে নিয়ে বন্দি করা। মুখে রুমাল গুঁজে, হাত-পা বেঁধে তাকে ভ্যানে তুলল বাক ওয়াকির লোক। আগেই বৃদ্ধকে গিলিয়ে দিয়েছে দুটো বড়ি। মুক্ত হওয়ার জন্যে হাত-পা ছুঁড়লেও শরীর এত দুর্বল যে বাধা দিতে পারেনি বেন হ্যানন। ভ্যানে চেপে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার আগেই আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। কাঁপাভাবে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস। ঠিক করা হয়েছে দুর্গের নিচে বিশেষ এক ঘরে রাখা হবে তাকে। বাকি জীবনেও আর ওখান থেকে বেরোতে পারবে না সে।

.

আধঘণ্টা পর বেন হ্যাননকে দুর্গের নিচের কক্ষে নিল বাক ওয়াকির লোক। ওই একইসময়ে নিজের স্টাডিতে ফিরল রন স্টুয়ার্ট। ঘরের দরজা বন্ধ করে খুলে ফেলল কোট। ঢিলা করে নিল টাই। আরো ফুয়েন্টে সিগার জ্বেলে বসল আরামদায়ক আর্মচেয়ারে। মুখে তৃপ্তির হাসি। সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ আছে তার। চমৎকারভাবে চলছে সব। মনে পড়ল, দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে সে। মা ছিল খেপাটে প্রায় অশিক্ষিত এক মহিলা। বারবার বলত, তার পরিবার আসলে রাজবংশীয়। ডায়েরিতে শতবার লিখত একই কথা। যদিও রাজ কোনও পরিবারের সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক কোনদিনও ছিল না। কিন্তু স্টুয়ার্টের মনে হতো মা-র কথা সত্যি হলেই ভাল হতো। আর তারপর কখন যেন নিজেই বিশ্বাস করতে লাগল, প্রিন্স চার্লস্ এডওয়ার্ড স্টুয়ার্ট বা বনি প্রিন্স চার্লির বংশেরই লোক সে। বনি প্রিন্সের হওয়ার কথা ছিল স্কটিশ রাজা। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে ইংলিশরা তা হতে দেয়নি।

বড় হয়ে ইতিহাসের বইয়ে সবই পড়েছে স্টুয়ার্ট। হাজার বার ভেবেছে, সে হয়তো সত্যিই কোনদিন হবে স্কটল্যাণ্ডের রাজা। তখন বনি প্রিন্সের মত ভুল করবে না সে। দখল করে নেবে গোটা ব্রিটেন। এবং সেটা হবেই বা না কেন, তার শিরায় তো বইছে নীল রক্ত!

লেখাপড়ায় প্রতিটি পরীক্ষায় ভাল করেছে সে। এমবিএ শেষে চাকরি করেছে দু’বছর। তারপর নিজেই খুলে বসেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এরপর আর পেছনে চেয়ে দেখতে হয়নি তাকে। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে হয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে কমবয়সী বিলিয়নেয়ার। বহুদিন ধরেই ভাবছে, যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই ফ্রান্সের রাজার কাছ থেকে পাওয়া তিন সিন্দুক সোনার মোহর কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল বনি প্রিন্স। এখন সেসব পেলে প্রমাণ করে দেয়া যাবে, স্কটল্যাণ্ডের সত্যিকারের রাজা আসলে আর কেউ নয়, এই রন স্টুয়ার্ট!

মা-র মানসিক জটিল রোগটা গেড়ে বসেছে তার মগজে। নিজেকে ধরে নিয়েছে স্কটল্যাণ্ডের রাজা হিসেবে। চুরুটে টান দিয়ে আনমনে ভাবল: সময় হয়েছে লক আরডাইকের তীরে পাইন জঙ্গলের সেই গুপ্তধন হাতের মুঠোয় নেয়ার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *