একুশ
কুয়াশামাখা পশ্চিম স্কটল্যাণ্ডের পুব দিগন্তে দেখা দিয়েছে লালচে ফুটবল আকৃতির ম্লান সূর্য। বিলি ম্যাকগ্রা এবং বেন হ্যাননের আলাপ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরের ঘটনা।
গ্লাসগো থেকে দেড় শ’ মাইল দূরে দুই হাজার একর জমি সামনে নিয়ে রাজকীয় বিশাল এক দুর্গ। দেখলে মনে হবে শত শত বছরের পুরনো। তবে ওটা তৈরি করা হয়েছে মাত্র দশ বছর আগে। দুর্গের পেছনে আকাশছোঁয়া পাহাড়। দক্ষিণে যত দূর চোখ চলে সফেদ বরফে ঢাকা মস্ত এস্টেট।
আজ জরুরি ভিত্তিতে চিফ সিকিউরিটি অফিসার বাক ওয়াকিকে দুর্গে ডেকে এনেছে বিলিয়নেয়ার রন স্টুয়ার্ট। সেজন্যে কোরিয়ান মোবাইল ফোন কোম্পানি স্যাংরেং-এর মালিক জিয়াং হুনকে খুনের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছে। রন স্টুয়ার্টের ব্যক্তিগত জিফাইভ জেট বিমানে চেপে পাঁচ হাজার মাইল দূর থেকে স্কটল্যাণ্ডে ফিরেছে জাতখুনি বাক ওয়াকি। ভাল করেই জানে, দায়িত্বে অবহেলা পছন্দ করে না তার চাকরিদাতা। তাই আপাতত বিশ্রামের সুযোগ তার নেই। গ্লাসগো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রুপালি রোলস রয়েসে চেপে সোজা হাজির হয়েছে দুর্গে।
এই দুর্গ বাদেও আরও মেলা বাড়িঘর ও সম্পত্তি আছে বিলিয়নেয়ারের। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মণ্টি কার্লোর দারুণ এক পেন্টহাউস, বাহামার বিলাসবহুল ভিলা এবং ব্রিটানির বড় এক শ্যালে। অবশ্য স্কটল্যাণ্ডের দুর্গটা তার বেশি পছন্দ। এখানে প্রথমতলায় একটা প্রশস্ত কোয়ার্টার বরাদ্দ করা আছে বাক ওয়াকির জন্যে। যদিও সারাবছর সে দুনিয়ার এদিকে-ওদিকে ছুটছে বলে বেশিরভাগ সময় ফাঁকাই থাকে ওই কোয়ার্টার। আজ রন স্টুয়ার্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ হলে ওখানে ফিরে অন্তত দশঘণ্টা ঘুমাবে বলে স্থির করেছে সে।
মধ্যযুগীয় কায়দায় সাজানো করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে বাক ওয়াকি। সিঁড়ি বেয়ে উঠল চতুর্থতলায়। স্টাডিরুমের দরজার সামনে থেমে টোকা দিল। দীর্ঘ বিমান যাত্রার ধকলে কিছুটা ক্লান্ত দেখালেও যে-কেউ বলবে তার বয়স বড়জোর পঁচিশ। বাস্তবে চলছে তেত্রিশ। নিয়মিত ব্যায়াম করা চওড়া কাঁধ ও সরু কোমরের জন্যে চমৎকারভাবে গায়ে ফিট করেছে গাঢ় খয়েরী ডিযাইনার সুট।
দরজায় দ্বিতীয়বার টোকা দিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকল বাক ওয়াকি। পেছনে নিঃশব্দে বন্ধ করল দরজা। স্টাডিরুমের দেয়ালে কারুকাজ করা কালচে ওক কাঠের প্যানেল। পুবের বিশাল জানালা দিয়ে সোনালি রোদ এসে পড়েছে ঘরে। চকচক করছে গাঢ় সবুজ রঙের চামড়ামোড়া দামি সোফা ও চেয়ার। ঘরে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরনো আমলের অ্যান্টিক সব অস্ত্র। একদেয়ালে কাঁচির আকৃতি তৈরি করেছে দুটি ক্লেমোর তলোয়ার। ওগুলোর প্রতিটি দুই হাতে ধরে চালাতে হয়, এতই ভারী। ওপরের দেয়ালে দুর্গ মালিকের পারিবারিক ক্রেস্ট ও রঙিন ছক-কাটা পশমী পতাকা। শেষেরটা বুঝিয়ে দিচ্ছে অভিজাত পরিবারের মানুষ রন স্টুয়ার্ট। পতাকার নকশায় লেখা: VIRECIT VULNERE VIRTUS—আহত হলে আরও বেড়ে যায় সাহস।
স্টুয়ার্ট কতটা সাহসী বা কখনও আহত হয়েছে কি না, জানা নেই বাক ওয়াকির।
জানালার উজ্জ্বল সোনালি আলোর পটভূমিতে আবছা দেখা যাচ্ছে চামড়ামোড়া বিশাল এক সুইভেল চেয়ার। ওটা ঘুরিয়ে ডেস্কের দিকে পিঠ রেখে এস্টেটের শোভা দেখছে স্টুয়ার্ট। ডেস্কের সামনে গিয়ে থামল বাক ওয়াকি। দু’হাত পেছনে বেঁধে নিয়ে শান্ত, নরম সুরে বলল, ‘আমাকে ডেকেছেন।’
ধীরে ধীরে ঘুরে গেল সুইভেল চেয়ার। রন স্টুয়ার্টকে খুব ক্লান্ত বলে মনে হলো বাক ওয়াকির। বিলিয়নেয়ারের চোখের চারপাশে গভীর কালো ছোপ। বোধহয় ঘুমাতে পারেনি কয়েক দিন। সব কাজ ফেলে অর্ধেক দুনিয়া পেরিয়ে এখানে এসেছে বলে তাকে ধন্যবাদ দিল না বিলিয়নেয়ার। অন্য কেউ এমন আচরণ করলে পিটিয়ে তার হাড়গোড় ভাঙত বাক ওয়াকি।
‘হ্যাঁ, ওয়াকি। ডেকেছি। স্কটল্যাণ্ডের কাজটা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘আমার ধারণা কোরিয়ার কাজটাও জরুরি,’ নির্বিকার সুরে বলল ওয়াকি। ‘আমাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলে সিউলের লোকটাকে সরাতে চেয়েছেন আপনি। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সিকিউরিটি দলের প্রধান হিসেবে দুনিয়া থেকে তাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছি, এমনসময় এল আপনার মেসেজ।’
‘তা ঠিক। তবে আপাতত জিয়াং হুনের কথা ভুলে যাও। আগে খুঁজে বের করবে এক স্যামন-পোচারকে। চিরকালের জন্যে গায়েব করে দেবে তাকে। এ ছাড়া, আমার মাথা-ব্যথা হয়ে উঠেছে বুড়ো হাবড়া এক লোক। তার নাম বেন হ্যানন। আমাদের কাজে নাক গলাচ্ছে সে। সুতরাং জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সরিয়ে দেবে তাকেও।’
স্কটল্যাণ্ডের বিষয়ে এরই ভেতর ব্রিফ করা হয়েছে বাক ওয়াকিকে। ধৈর্যের সঙ্গে বলল সে, ‘স্যর, আমার মনে হয়নি মাল্টি মিলিয়ন ডলারের প্রপার্টি ইনভেস্টমেন্টের সঙ্গে বেন হ্যানন বা ওই পোচারের কোনও সম্পর্ক আছে। অথচ, কোরিয়ায় গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যা খুশি করাচ্ছে জিয়াং হুন।’
বিরক্ত হয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল স্টুয়ার্ট। ‘আমি ভাল করেই জানি কোন্ কাজের কতটা গুরুত্ব, ওয়াকি। আমার ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে বেন হ্যানন আর ওই স্যামন-পোচার। এখন আগে নিজেদের ঘর সামলাতে হবে।’
‘ওই পোচারকে নিয়ে ভাববেন না,’ বলল ওয়াকি। ‘খুঁজে বের করে আপনার কথামত সরিয়ে দেব। সহজ কাজ।’
‘গুড। ওদিকে পিটার হ্যাননের চাচা, মানে ওই বুড়ো কিন্তু বড় ধরনের ঝামেলা। ওই পোচার স্থানীয় তেলাপোকা হলেও বেন হ্যানন সহজ লোক নয়। ভাবতেও পারিনি আমাদের বিরুদ্ধে জড়িয়ে যাবে সে।’
‘শুনেছি গ্রামের ছোকরারা চোখ রাখছে তার ওপর,’ বলল ওয়াকি। ‘ম্যাকডোনাল্ড বা তার বন্ধুরাই তো এই কাজে যথেষ্ট ছিল, তাই না?’
‘ম্যাকডোনাল্ডকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তা হয়তো ভাল করিনি। তবে ওকে উপযুক্ত বলে মনে হয়নি আমার। গায়ে পড়ে ঝামেলায় জড়ায়। ওদিকে পুলিশে আমাদের চরদের কাছ থেকে জেনেছি, একসময় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল বুড়ো বেন হ্যানন। যখন-তখন মিচ ম্যাকডোনাল্ডকে দেখে ফেলত। আর সেক্ষেত্রে তার সময় লাগত না গাধাটার মুখ খোলাতে। ওটা আমরা হতে দিতে পারব না।’
মাথা দোলাল ওয়াকি। ‘আশা করি আপনার মনে আছে, ম্যাকডোনাল্ডকে কাজে নেয়ায় প্রথমেই আপত্তি তুলেছিলাম। ওই একই কথা খাটে গ্রামের গাধাগুলোর ক্ষেত্রেও। এত বেশি নিরেট মূর্খ পুষলে ঝামেলায় না জড়িয়ে উপায় থাকে না।’
‘ঠিক আছে, এখন ওসব বাদ দাও।’
‘ম্যাকডোনাল্ড শুধু গণ্ডার নয়, একজন কাপুরুষও। আপনি ঠিকই বলেছেন, হয়তো বড় ঝামেলা করবে বুড়ো হ্যানন। ম্যাকডোনাল্ডকে হাতে পেলে হামান-দিস্তা দিয়ে ছেঁচে ফেলবে। তবে আড়াল থেকে তার ওপর চোখ রাখলে তো বিপদ হওয়ার কথা নয়। … আপনি কি জানেন এখন কোথায় আছে বেন হ্যানন? ‘
হতাশা নিয়ে হাত নাড়ল স্টুয়ার্ট। ‘কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। হাল ছেড়ে ইতালিতে ফিরলে জানতে পারতাম। আমরা শুধু এটা জেনেছি, ভাতিজার ক্যাম্পার ভ্যান নিয়ে এই এলাকাতেই ঘুরছে সে। পিটার হ্যাননের বাড়ি থেকে তাকে বেরোতে দেখেছে ম্যাকডোনাল্ড। তারপর থেকেই উধাও সে।’
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার মত লোককে ওই কাজের জন্যে বিশেষ ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে।’
‘ওই ট্রেইনিং তো তোমারও আছে। তুমি তাদেরই একজন। তোমার তো বোঝার কথা এখন কী করবে সে।’
খুব কম মানুষই জানে বাক ওয়াকির অতীত। ‘আগে তাদের একজন ছিলাম,’ ভুল ধরিয়ে দিল সে। ‘ছিলাম তাদের সেরা। এখনকার কথা জানি না।’
‘সেজন্যেই ঝুঁকি না নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি। আপাতত খুশি থাকুক স্যাংরেং-এর মালিক জিয়াং হুন। পরে ব্যবস্থা নেব। এখন মন দাও এদিকের সমস্যার দিকে। পারবে না তুমি সব সামলে নিতে?’
স্টুয়ার্টের চোখে তাকাল পেশাদার খুনি। বুঝতে চাইল বস্ ঠিক কতটা সিরিয়াস।
কতটা সিরিয়াস। দুনিয়ার ধনী বিশজন বিলিয়নেয়ারের মধ্যে স্টুয়ার্ট না থাকলেও তার যত টাকা আছে, তাতে কিনে নিতে পারবে সাধারণ যে-কাউকে। কিছু করতে চাইলে কখনও পিছিয়ে যায় না সে। তার সবচেয়ে কাছের লোক বাক ওয়াকি। সহজেই বলতে পারে বহু কথা। আরও কয়েক মুহূর্ত ভেবে মাথা দোলাল সে। ‘আশা করি সমস্যা মিটিয়ে দিতে পারব।’
‘ভেরি গুড।’
‘তবে আগে নাগালে পেতে হবে বেন হ্যাননকে। আপনি যা বলেছেন, তাতে পশ্চিম হাইল্যাণ্ডের যে-কোনও জায়গায় থাকতে পারে সে। এদিকে আমাদের এত লোকবল নেই যে হাজার বর্গ মাইল জুড়ে তাকে খুঁজব। তাই মনে হচ্ছে…’ চুপ হয়ে গেল সে।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখল রন স্টুয়ার্ট। ‘কী মনে হচ্ছে?’
‘আগে বলুন ওই লোককে কতখানি খুঁজতে চান।’
‘আমি বলেছি, কাজটা জরুরি। টাকা খরচ হোক, তবে যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাতে পেতে চাই।’
‘সেক্ষেত্রে লোকবল যেমন লাগবে, হুড়মুড় করে খরচ হবে মেলা টাকা। লাগবে ইকুইপমেন্ট আর ট্র্যান্সপোর্টেশন।’
‘টাকা এখানে বড় বিষয় নয়,’ বলল তিক্ত স্টুয়ার্ট। ‘প্রয়োজনে খরচ করবে মিলিয়ন পাউণ্ড। আমার তাতে আপত্তি নেই।’
মৃদু মাথা দোলাল ওয়াকি। ‘ঠিক আছে। তা হলে দলে নেব চেনা একদল যোদ্ধাকে। আজই ফোন দেব তাদেরকে।’
সেক্ষেত্রে কবে আসবে তারা?’
‘আপাতত লণ্ডনে আছে চারজন। আশা করি দু’দিনের ভেতর পৌছাতে পারবে।
‘আরও আগে আসতে পারবে না?’
‘ওরা ব্যস্ত,’ বলল ওয়াকি, ‘বহু টাকা দিয়ে ভাড়া করতে হবে।’
‘তাতে সমস্যা নেই। তুমি যে সঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই কি ওটারই সদস্য?’
‘হ্যাঁ,’ বলল ওয়াকি, ‘একইরকম ব্যাকগ্রাউণ্ড সবার। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে। আমি বেছে নেব অ্যালান কোয়ার্ট, হ্যারি অ্যাণ্ডারসন, গ্রেগরি বেল আর লিয়ন বেনেটকে।’
‘তো ডাকো। তারা রেডি হলে আনার জন্যে পাঠিয়ে দেব আমার জেট বিমান।
‘কী ধরনের কাজ সেটা ওরা জানতে চাইবে। কতটা বলব তা নির্ভর করে আপনার ওপর। বেন হ্যাননকে পেয়ে যাওয়ার পর কী করব আমরা?’
‘তাকে সরিয়ে দেবে খেলা থেকে। মুখ যেন খুলতে না পারে, তা নিশ্চিত করবে। কেউ যেন খুঁজে না পায় তাকে।’
‘কাজ হতে হবে নিখুঁত,’ বলল ওয়াকি, ‘উইলসনের বেলায় দায়িত্বে চরম অবহেলা করা হয়েছে। আরও বাজে কাজ করেছে ওরা বেন হ্যাননের ভাতিজার বেলায়।’
‘স্বীকার করছি মস্ত ঝুঁকি নিয়েছি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রন স্টুয়ার্ট। ‘আবারও ওরকম হলে সত্যিই বিপদ হবে।’
দ্বিতীয়বারের মত মাথা দোলাল ওয়াকি। ‘আমাকে দায়িত্ব দিলে আমি কি ধরে নেব কাজটা করতে পারব আমার ইচ্ছেমত? আপনার তাতে কোনও আপত্তি থাকবে না তো?’
‘আপত্তি নেই।’ বাক ওয়াকি হাত বাড়িয়ে দেয়ায় সুইভেল চেয়ার ছেড়ে উঠে হ্যাণ্ডশেক করল রন স্টুয়ার্ট।
স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত কোয়ার্টারের দিকে চলল বাক ওয়াকি। একটু পর ফোন দেবে লণ্ডনে বন্ধুদের কাছে। তার ডাকে এবং কাঁচা টাকার গন্ধে হাজির হবে হ্যারি অ্যাণ্ডারসন, অ্যালান কোয়ার্ট, গ্রেগরি বেল আর লিয়ন বেনেট। ওয়াকি ভাবল: বেন হ্যানন জানেও না কত বড় গাড্ডায় পড়েছে সে। ধরে নেয়া যায় খুন হয়ে গেছে বুড়ো হাবড়াটা!