দুই
নিখোঁজ রবার্ট উইলসনের লাশ লক আরডাইকের তীরে পানিতে ভাসতে দেখার পর আজ পঞ্চম দিন। ধূসর মেঘ কেটে গিয়ে আয়নার মত ঝিকঝিক করছে নীল আকাশ। অবশ্য মোটেই হ্রাস পায়নি শীতের প্রকোপ। গির্জা থেকে বেরিয়ে কিনলোকার্ড গ্রামের কবরস্তানে জড় হয়েছে ক’জন পরিচিত মানুষ, শুকনো মুখে দেখছে রবার্টের কফিন। একটু পর মাটির সরু গর্তে নামানো হবে ওটাকে।
হাসিখুশি রবার্টের বেশ সুনাম ছিল কিনলোকার্ড গ্রামে। ছেলেটা কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি কারও সঙ্গে। সবাই জানে, ওকে ঠকিয়ে আধবুড়ো এক লম্পট ডাক্তারের সঙ্গে উধাও হয়েছে ওর বউ লোপা। সবার মনে পড়ছে রবার্টের মৃত্যুর আগের দুটো দিনের কথা। কেন যেন হঠাৎ করেই . ফুর্তি এসে গিয়েছিল ওর জীবনে। কীসের এই আমোদ, তা জানে না কেউ। সবাই ভেবেছে, যাক, স্ত্রীর বেইমানির ধাক্কাটা এত দিনে সামলে নিয়েছে রবার্ট। কিন্তু এর পর পরই ঘটল মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা।
লক আরডাইকের তীর থেকে কয়েক ফুট দূরে লাশটা প্রথমে দেখেছে গ্রামের পক্ষী-পর্যবেক্ষক এডি ক্লার্ক। উপুড় হয়ে ভাসছিল মৃতদেহ। ওই গা ছমছমে দৃশ্য দেখে ভয় পায় এডি। দেরি না করে কল দিয়েছে হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে। এরপর পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা গেল: এডি যখন লাশ দেখেছে, তারও অন্তত এক দিন আগে মারা গেছে রবার্ট।
লক আরডাইকের তীরে হাঁটতে গিয়েই বোধহয় পা পিছলে পানিতে পড়ে সে। ওর গাড়িটা ছিল হাইল্যাণ্ড ডেভেলাপার কোম্পানির ঘিরে রাখা উঁচু তারের বেড়ার এদিকে। কেউ কেউ নানান সন্দেহ প্রকাশ করেছে। যেখানে কাজ করার কথা, সেখান থেকে কমপক্ষে সিকি মাইল দূরে ছিল রবার্টের লাশ। তবে হতে পারে, অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আনমনে অতটা দূরে গেছে সে। সাঁতার জানত না, তাই বরফ-ঠাণ্ডা জলাশয়ে পড়ার পর বাঁচার উপায় ছিল না ওর। আগেও গভীর লক আরডাইকে ডুবে মারা গেছে বেশ কয়েকজন।
শোকসন্তপ্ত যারা এসেছে রবার্টকে কবর দিতে, তাদের মধ্যে রয়েছে ওর ব্যবসায়িক পার্টনার পিটার হ্যানন। এখন তিক্ত মুখে মাটির দিকে চেয়ে রয়েছে সে। প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে খাঁ-খাঁ করছে ওর বুকটা। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে বলে পরস্পরের হাঁড়ির খবর ভাল করেই জানত ওরা। নোনা জলে বারবার জ্বলছে পিটারের দুই চোখের কোণ।
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বিশ্বাসঘাতিনী লোপা আসেনি বলে অবাক হয়নি কেউ। এখন কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সার্ভেয়ার অফিসের ক্লার্ক অ্যানি ক্যাম্পবেল। তার পেছনে গ্রামের একমাত্র পাব ডাবল আর্মের মালিক জনি রস ও গ্যারি ওয়াটসন। একটু দূরে গাড়ির মেকানিক রাস্টি মরিসন। প্রাথমিক স্কুল থেকেই রবার্ট ও পিটারকে চেনে সে। এ ছাড়া, কবরের কাছে আছে পক্ষী-বিশারদ এডি ক্লার্ক ও পুলিশের কনস্টেবল জেসিকা থমসন। দুই চোখের জলে বারবার গাল ভিজে যাচ্ছে এডির।
বয়সে রবার্ট ও পিটারের চেয়ে বছরখানেকের ছোট হলেও ওদের সঙ্গেই ঘুরত জেসিকা থমসন। একইসঙ্গে লেখাপড়া করেছে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে। পরে চলে গেছে বড় শহরে। কলেজে গ্র্যাজুয়েশন শেষে যোগ দিয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। তিন মাস হলো ফিরে এসেছে কিনলোকার্ড গ্রামে। এ এলাকায় সে একমাত্র পুলিশ অফিসার। আজ ছুটি নিয়েছে। পরনে ইউনিফর্ম নেই। লালচে দুই চোখ ঢেকে রেখেছে কালো সানগ্লাস দিয়ে। শোক সইতে গিয়ে সামনে ঝুঁকে গেছে ওর দুই কাঁধ।
তিক্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর বৃত্তাকার হয়ে দাঁড়াল সবাই কবর ঘিরে। নিচু গলায় আলাপ করছে নিজেদের ভেতর। কারও কারও চোখে এখনও অশ্রু। প্ৰায় অচেতন হয়ে গেছেন রবার্টের মা। পিটার ও মরিসন মিলে তাঁকে তুলে দিল মিস্টার উইলসনের গাড়িতে। ছোটবেলার সহপাঠী জেসিকা থমসন কবরস্তানে এসেছে বলে ধন্যবাদ জানাতে চাইল পিটার। কিন্তু চারপাশে চেয়ে বুঝল, কখন যেন বিদায় নিয়েছে মেয়েটা। পিটারের কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বলল গাড়ির মেকানিক মরিসন, ‘খুব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ, তাই না, পিটার?’ জলদস্যুর মত দাড়ি মরিসনের গালে। কানে ঝুলছে রুপার দুল। দেখতে আস্ত ডাকাতের মত হলেও মনটা ওর, খুব নরম। অশ্রু আড়াল করতে গিয়ে বারবার চোখ পিটপিট করছে।
‘না, ঠিকই আছি,’ মিথ্যা বলল পিটার।
আবারও চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়ল মেকানিক ‘আসলে মেনে নিতে পারছি না। এই তো সেদিনও রবার্ট আমাদের সঙ্গে ছিল। অথচ এখন নেই। ওকে আর কখনও দেখব না!’
‘আমারও ভাবতে কষ্ট হচ্ছে,’ এবার অসত্য বলল না পিটার। কী যেন দলা পাকিয়ে উঠছে গলার ভেতর। মানতে পারছে না, আর কখনও ফিরবে না ওর বন্ধু।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রাস্টি ও পিটার, তারপর ফিরে চলল যার যার গাড়ির দিকে।
কবরস্তানের ধারে ধূসর পাথুরে গির্জার উঠানে নিজেদের সার্ভেয়ার ফার্মের ভ্যান রেখেছে পিটার। ওটার দরজায় সোনালি লোগো। দ্বিতীয় ভ্যানটা নিয়ে কাজে গিয়েছিল রবার্ট। ওটা বোধহয় এখনও রয়ে গেছে আগের জায়গায়। নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি বলতে পিটারের আছে পুরনো প্রায়- বিধ্বস্ত এক ক্যাম্পার ভেহিকেল। ওটা রেখেছে ওর বাড়ির পেছনে। হাতে কিছু টাকা এলে মেরামত করবে ভেবে রেখেছে।
বাড়ির দিকে রওনা হয়ে একই চিন্তা বারবার ঘুরপাক খেল ওর মনে। লকের তীরে কেন গেল রবার্ট? হারিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। সবাই চিনত ওই জায়গা। এ-ও অসম্ভব যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকর্ষণে ওখানে গেছে ও। রবার্ট তেমন মানুষই ছিল না। লোপা উধাও হওয়ায় কয়েকবার ওর মুখে মদের গন্ধ পেয়েছে পিটার। পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে ভেবে কিছুই বলেনি। অথচ তখনই উচিত ছিল ওকে সময় দেয়া। এখন পিটারের মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল রবার্ট। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ও। আর তাই বাকি জীবন নিজের বিবেকের কাছে দায়ী হয়ে গেল—মহাবিপদে বন্ধুর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।
আসলে সত্যিই কি আত্মহত্যা করেছে রবার্ট?
মনে তো হয় না!
অতটা নরম মানুষ ছিল না ও।
কিন্তু এ-ও ঠিক, প্রচণ্ড চাপে ভেঙে পড়বে যে-কেউ!
রবার্ট হয়তো আর বাঁচতে চায়নি?
মৃত্যুর দু’দিন আগেও নানান বিষয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছে।
অথচ, সর্বক্ষণ হয়তো লোপার জন্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল ওর হৃদয়ে!
প্রিয় বন্ধুর অন্তর বুঝতে পারেনি পিটার। বিড়বিড় করে বলল সে, ‘হায়, ঈশ্বর! কিছুই বুঝলাম না! রবার্ট, এখন তো মনে হচ্ছে আমিই তোর খুনি!’
ছোট্ট বাড়িটাতে ফিরে সোজা কিচেনে গিয়ে ঢুকল পিটার। গত বছর ক্রিসমাসে এক ক্লায়েন্ট একবোতল স্কচ উইস্কি উপহার দিয়েছিল ওকে। এখন ওটার ছিপি খুলে গ্লাসের কানা পর্যন্ত সোনালি তরলে ভরল পিটার। চেয়ার টেনে ধপ করে বসল টেবিলের ধারে। মদ খাওয়ার অভ্যেস না থাকলেও তিন চুমুকে শেষ হলো গ্লাস। পিটারের মনে ঘুরপাক খেল হাজারো চিন্তা। ব্যবসা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল ওরা দু’জন। এবার একা এত কাজ কীভাবে সামলাবে? বোধহয় ছেড়ে দিতে হবে গল্ফ প্রজেক্ট। আসলে রবার্ট নেই বলেই মনে হচ্ছে, চারপাশ থেকে বিশাল এক গহ্বর গিলে নিচ্ছে ওকে।
পাঁচদিন আগে রবার্টের মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর থেকে কোনও কাজ করতে পারেনি পিটার। আগামীকাল অফিসে যেতেও সায় দিচ্ছে না মন। তার পরের দিনটাও হয়তো বাড়িতে বসে মদ গিলবে। দ্বিতীয়বারের মত তিন পেগ উইস্কি গিলে নেয়ার পর কমল ওর মনের কষ্ট। তখনই ভাবল, তৃতীয় গ্লাস হয়তো দেবে মানসিক স্থিরতা। অবশ্য মদের প্রভাবে ঘুম থেকে ওঠার পর শুরু হবে প্রচণ্ড মাথা-ব্যথা। তবে এখন আর এসব ভেবেই বা কী হবে ওর!
বহুক্ষণ পর লিভিংরুমে ফিরে সোফায় শুয়ে পড়ল পিটার। জানল না কখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভাঙল ওর ঘুম। কাছেই ক্রিং- ক্রিং শব্দে বাজছে টেলিফোন। পিটারের জানতে ইচ্ছে হলো এখন কয়টা বাজে। হাতুড়ি দিয়ে ধুম-ধুম করে বাড়ি দেয়া হচ্ছে ওর মাথার তালুর ওপর। শিরিস কাগজ দিয়ে চেঁছে দেয়া হয়েছে জিভ। আগে কখনও এত মাতাল হয়নি পিটার। টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে তাকাল চারপাশে। হাত বাড়িয়ে দেয়ালে সুইচ পেয়ে জ্বেলে নিল বৈদ্যুতিক বাতি। নাক-মুখ কুঁচকে ঘরের কোণে ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভাবছে: এত রাতে… কে হতে পারে?
রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’ নিজেই চমকে গেল গলা চিরে দুটো ব্যাঙের ডাক বেরোতে শুনে।
ওদিক থেকে জবাব দিচ্ছে না কেউ।
আবারও ব্যাঙের ডাক ছাড়ল পিটার, ‘হ্যালো?’