উনিশ
নিশুতি রাত।
ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে কিনলোকার্ডের শীতার্ত গ্রামবাসী। মাঝে মাঝে একটা-দুটো কুকুরের প্রলম্বিত করুণ কান্না হাহাকার ছড়াচ্ছে দূর-দূরান্তরে।
তৈরি হয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে টয়োটা নিয়ে পুবের পথে চলল রানা। তারপর ঘুরল উত্তর দিকে। আরও একবার বামে বাঁক নিয়ে এবার চলল আরডাইক লকের পশ্চিম তীরের দিকে। এখানে এঁকেবেঁকে সর্পিল আকৃতি নিয়েছে পথ। শুরু হয়ে গেছে পাইনের জঙ্গল। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উত্তর তীরের জঙ্গলের শেষ মাথায় পাইনের আড়ালে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল। পিঠে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়ে হেঁটে চলল পশ্চিম তীর লক্ষ্য করে। পায়ের নিচে মৃদু মুড়মুড় শব্দে ভাঙছে কঠিন বরফ। বারবার ফোনের জিপিএস কোঅর্ডিনেট দেখছে রানা।
মিনিট পনেরো হেঁটেই পৌঁছে গেল ও ঘন জঙ্গলে ছাওয়া লকের পশ্চিম তীরে। পাইন গাছগুলোর মাথায় চেপে বসেছে সফেদ তুষারের ভারী ছাতা। একটু দূর থেকে এল পেঁচার কর্কশ ডাক। সতর্ক পায়ে প্রায় নিঃশব্দে লকের তীরে গিয়ে থামল রানা। জলের সঙ্গে মিতালি করেছে ধূসর কুয়াশা, অদৃশ্য করে দিয়েছে আকাশের মিটমিটে তারাগুলোকে। পাইন বনের ঝিরঝিরে হাওয়া আর তীরে এসে লাগা পানির কুল কুল আওয়াজ ছাড়া চারপাশ একদম নীরব।
অন্ধকারের ভেতর আরও একটু বেশি গাঢ় ছায়ার মত লকের পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণ দিকে চলল রানা। মাঝে মাঝে থেমে বুঝে নিচ্ছে আশপাশে কেউ আছে কি না। দুই মাইল হেঁটেও কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে বিরক্ত হলো রানা। বৃথা কষ্ট করছে? আরডাইক লক এদিকে চওড়া হয়েছে কয়েক শত গজ। এরপর আরও পশ্চিমে হয়েছে সরু ঝর্নার মত। দু’দিক থেকে জায়গাটাকে ছেয়ে নিয়েছে পাইনের ডালপালা। জলে ভাসছে পচা আবর্জনা। আর না এগিয়ে আবার উত্তর দিকে চলল রানা। কুয়াশার ভারী চাদর পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে জঙ্গল ও আরডাইক লকটাকে। চারপাশে কালিগোলা অন্ধকার।
লকের তীর ঘেঁষে আধঘণ্টা উত্তর দিকে হাঁটার পর হঠাৎ করেই পঞ্চাশ গজ দূরে দুটো আলো দেখতে পেল রানা। এদিকে-ওদিকে রশ্মি ফেলে কী যেন দেখছে একাধিক লোক। ঝোপের ধারে বসে তাদের ওপর চোখ রাখল রানা। একটু পর বুঝল, দলে তারা তিনজন। ঝোপঝাড় পাশ কাটিয়ে আসছে এদিকেই। ঘন কুয়াশার কারণে রানার দিকে পৌঁছাচ্ছে না টর্চের আলো। ওর ধারণা হলো, এদের সঙ্গে নেই খুনের সাক্ষী সেই পোচার। এরা হয় চোরাই মাছ- শিকারি নয়তো ফিশারির লোক। অবশ্য হঠাৎ অন্য একটা চিন্তা আসতেই সতর্ক হয়ে উঠল রানা। এরা হয়তো সেই খুনি দলের সদস্য! হতে পারে না?
উঠে ছায়ার মত বাতির দিকে চলল রানা। মিনিটতিনেক পর বুঝল, এদের কাছে মাছ ধরার সরঞ্জাম নেই। অর্থাৎ, এরা পোচার নয়। একজনের হাতে ধরা একটা ডাবল- ব্যারেল শটগানের নল থেকে ঠিকরে এল টর্চের আলো। হঠাৎই অস্বস্তিতে পড়ল রানা। বড়বেশি কাছে পৌঁছে গেছে ও! ওর ওপর দিয়ে বামে গেল টর্চের আলো। আবারও ফিরে এল। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল রানার। আলোটা সরে যেতেই ঝুপ করে বসে পড়ল ও মাটিতে। ওদিক থেকে উত্তেজিত, কর্কশ গলায় বলল কেউ: ‘ওই যে! বোধহয় দেখেছি শালাকে!’
শুয়ে পড়ে ক্রল করে ঘন ঝোপে ঢুকল রানা। ওর পিছু নিয়েছে সাদা আলো। পরমুহূর্তে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ভারী ‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল বন্দুক। কাছের পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে এল প্রতিধ্বনি। আবারও গর্জন ছাড়ল বন্দুকটা। প্রথম গুলি দূর দিয়ে গেলেও পরেরটা লেগেছে রানার পেছনের গাছে। ভেঙে গেছে একটা মোটাসোটা ডাল। ঝরঝর করে ওর ওপর ঝরল পাইনের শুকনো কাঁটা ও পাউডারের মত তুষার। রানা এখন নিশ্চিত: এরা পোচার বা সরকারি লোক নয়। ফিশারির সদস্যরা আক্রান্ত না হলে গুলি করে না কোনও পোচারকে।
তীর ঘেঁষে দশ গজ ক্রল করার পর ভারী পাথরের মত ঝোপের ভেতর পড়ে থাকল রানা। একটু দূর থেকে শুনতে পেল একজনের কণ্ঠ। উচ্চারণ স্থানীয়।
‘আমার মনে হয় সত্যিই শালাকে গেঁথে ফেলেছি!’
‘কোন্ দিকে গেছে?’
বেশ আওয়াজ তুলে হেঁটে আসছে লোকগুলো। তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমরা জানি তুই এদিকেই আছিস, শুয়োরের বাচ্চা! বেরিয়ে আয়, ঠোঁটকাটা, পেটমোটা শালা!’
রানার ঠোঁটে কাটাচিহ্ন নেই। মোটাও নয় ও। বুঝে গেল, ওকে নয়, অন্য কাউকে খুন করতে এসেছে এরা।
আরেকজন বলল: ‘ছড়িয়ে এগোও! বেশি দূরে নেই।’ তাদের সঙ্গে রয়েছে মাত্র দুটো টর্চ, তাই দু’জন সরে গেল ডানদিকে। যাচ্ছে রানার কাছ থেকে দূরে। নানান ঝোপে তাক করছে আলো। তৃতীয়জন এল সরাসরি ওর দিকে। পায়ের নিচে মুটমুট শব্দে ভাঙছে বরফ ও সরু শুকনো ডাল। রানার পাঁচ ফুট দূরে এসে থামল সে। খড়াৎ আওয়াজে খুলল ব্রিচ। মৃদু আওয়াজে ছিটকে পাশের ঝোপে পড়ল খালি খোসা দুটো। নতুন করে চেম্বারে ভরা হলো গুলি। ক্লিঙ্ক আওয়াজে আটকে গেল দুই ব্যারেল। রানার খুব কাছ থেকে বলে উঠল লোকটা, ‘আমি জানি তুই এদিকেই আছিস, মোটা শুয়োর! জানে বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে আয়! নইলে কিন্তু সরাসরি গুলি চালাব!’
তার শেষ কথাটা খুবই অপছন্দ হয়েছে রানার। লোকটা অন্ধের মত ঝোপে গুলি ছুঁড়লে মহাবিপদ! যখন-তখন গুলি লাগবে ওর গায়ে। প্রাণের ভয়ে ক্ষিপ্র চিতা হয়ে গেল রানা। নিঃশব্দে পৌছে গেল লোকটার পেছনে। একহাতে মুখটা চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে পেছনে নিল তার মাথা। অন্যহাতে মুচড়ে কেড়ে নিল বন্দুক। বন্দিকে পিছিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল ঝোপের ভেতর। বেকায়দায় পড়ে বুজে গেছে লোকটার জবান। একটা গাছের পাশে বন্দুক ফেলে চোকহোল্ডে তার গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা। বন্ধ করে দিয়েছে মগজের অক্সিজেন সরবরাহ। মিনিটখানেক পর জ্ঞান হারিয়ে শিথিল হয়ে গেল লোকটা।
অবশ্য কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফিরবে তার। রানা আশা করল, ততক্ষণে আরও দূরে সরে যাবে অন্যদু’জন। তখন এর মুখ থেকে জেনে নেবে কে সে, কাকে ধরতে এসেছে, এবং কার হয়ে কাজ করছে। আপাতত কিছু করার নেই। টর্চটা তুলে নিয়ে হাতের তালু দিয়ে আলো চেপে ধরে লোকটার কাছে ফিরল রানা। ওর আঙুল লালচে দেখাচ্ছে জোর আভায়। আবছা আলোয় লোকটার মুখ ও কাঁধ দেখল রানা। বয়স ত্রিশের মত। বড়সড়ো দেহ। টাক পড়ছে মাথায়। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গালে ব্রণের অগভীর অজস্র গর্ত। বাম কানে ছোট্ট এক দুল। পরনে কোঁচকানো ক্যামোফ্লেজ প্যাটার্নের শীতের জ্যাকেট। কোমরে শটগানের কার্তুজের বেল্ট।
একে গ্রামের পাবে ম্যাকডোনাল্ড ও ম্যাককার্টারের সঙ্গে দেখেছে রানা। কৌতূহলী হয়ে উঠল ও। শটগানের কার্তুজের বেল্ট খুলে ঝুলিয়ে নিল নিজের কাঁধে। জ্যাকেট সার্চ করে পেল সরু একটা ওয়ালেট। ওটা খুলে পরিচয় জেনে নেবে ভেবেছে, এমনসময় কানের পাশ দিয়ে কী যেন গেল। পরক্ষণে ঠক্ শব্দে বিধল পাশের গাছের কাণ্ডে। রানার মুখে ছিটকে লাগল একরাশ কাঠের কুচি। সেকেণ্ডের দশ ভাগ সময় পেরোবার আগেই এল সুপারসনিক বুলেটের চাপা খুক্ শব্দ।
ওই রাইফেলের মুখে আছে সাইলেন্সার!
ব্যাগ ও শটগান দু’হাতে নিয়ে পাশের ঝোপে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। আধসেকেণ্ড পর থক্ শব্দে ওর কানের দুই ইঞ্চি দূরে বিঁধল দ্বিতীয় বুলেট। বাস্! ছিটকে উঠেছে তুষার ও মাটি। পরের বুলেট হয়তো গাঁথবে ওর শরীরে!
এখন নিঃশব্দে সরে যাওয়ার সময় নেই! উঠে বাঁকা এক পথে ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে লেজে আগুন লাগা কবুতরের মত এঁকেবেঁকে উড়ে চলল রানা। সরে যাচ্ছে টর্চওয়ালা দুই লোকের কাছ থেকে। ওর দিকেই টর্চ তাক করল তারা। পরিষ্কার শুনছে বুট পরা পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ। রানার ডানে ত্রিশ গজ দূরে আছে লোকগুলো। একজনের হাতে টর্চ, অন্যজন জঙ্গলের ভেতর রানার দিকে তাক করল বন্দুক। নিজেকে অসহায় কাঠবিড়ালী বলে মনে হলো রানার। ‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল বন্দুক। ওর থেকে কয়েক ফুট পেছনের এক গাছে লাগল একরাশ ছররা।
ওর অস্ত্রের মাযলের ঝলকানি দেখলে বিপক্ষ জেনে যাবে কোথায় আছে ও, তাই পাল্টা গুলি করল না রানা। মাটির ওপরে জেগে ওঠা শেকড় ও সামনের ঝোপে হোঁচট খেয়ে যে-কোনও সময়ে ধড়াস্ করে পড়বে। এদিকে যে-কোনও মুহূর্তে পদশব্দ শুনে তৃতীয় বুলেট পাঠাবে স্নাইপার!
পুরো দুই মিনিট ঝড়ের বেগে ছুটে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। কুয়াশাভরা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে লোকগুলো। পায়ের নিচে তুষার মৃদু আওয়াজ তুলছে বলে গতি আরও কমিয়ে হেঁটে চলল রানা।
একঘণ্টা পর জিপিএস কোঅর্ডিনেট দেখে পৌঁছে গেল টয়োটার কাছে। সরাসরি ওটাতে গিয়ে ওঠা হবে চরম ভুল। ঘন এক ঝোপে থেমে চারপাশে চোখ রাখল রানা। পেছনে ফেলে আসা সেই স্নাইপারের মত আশপাশে থাকতে পারে আরও এক বা একাধিক স্নাইপার। হয়তো গোপনে দেখছে গাড়িটা। চোখ স্কোপে। ট্রিগারে আঙুল। গাড়ির দিকে গেলেই এক গুলিতে উড়িয়ে দেবে ওর মাথা।
মিনিট দশেক ঝোপে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ রাখল রানা। ওর কানে এল না অস্বাভাবিক কোনও আওয়াজ। কেউ আশপাশে নেই সেটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে ছায়ার মত পৌঁছে গেল গাড়ির পাশে। ব্লিপার দিয়ে খুলল ড্রাইভিং দরজা। লাফ দিয়ে উঠল সিটে। দরজা আটকে ইঞ্জিন চালু করে ঘুরিয়ে নিল টয়োটা। তুষারে ভরা পিচ্ছিল পথে বাড়ছে গাড়ির গতি। জ্বেলে নিল হেডলাইট। আধুনিক আরএভির ট্র্যাকশন কন্ট্রোল তৈরি করা হয়েছে তীরবেগে বাঁক নেয়ার জন্যে। গতি না কমিয়ে পথের তীক্ষ্ণ কয়েকটা বাঁক পেরোল রানা। রিয়ারভিউ মিররে দেখল, পেছনে কোনও হেডলাইট নেই। নিশ্চিত হয়ে গেল ওর পিছু নেয়নি কেউ।
কিনলোকার্ড গ্রামের দিকে ফিরে চলেছে রানা। বুঝে গেছে, আজ স্রেফ কপাল জোরে বেঁচে ফিরছে। সেই পোচারকে হত্যার উদ্দেশ্যেই লকের তীরে গেছে স্নাইপার। পোচারের ঠোঁটে আছে কাটাচিহ্ন। যেভাবেই হোক খুনিরা জেনে গেছে, রবার্টকে খুন হতে দেখেছে সে। ফলে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে যেন কোনও সাক্ষী বা প্রমাণ না থাকে। এরা যে কিনলোকার্ড গ্রামের বাসিন্দা তাতে কোনও সন্দেহ নেই রানার মনে। ওর মনে পড়ল, রবার্ট উইলসনের ব্যাপারে লিলির সঙ্গে কথা বলার সময় গায়ে পড়ে ঝামেলা করেছিল মিচ ম্যাকডোনাল্ড। জেসিকার কথা ঠিক নয়। লোকটা বোকা ষাঁড় হলেও, শুধুমাত্র ঘৃণা থেকে’ এত খেপে ওঠেনি। তার আচরণ ছিল অপরাধী মানুষের প্রতিক্রিয়া। কিছু গোপন করতেই আগ্রাসী হয়ে উঠেছে সে। দু’চার ঘা লাগিয়ে ভয় দেখাতে চেয়েছে রানাকে।
রানার ইচ্ছে হলো ফোর্ট উইলিয়ামের পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সেল ভেঙে বের করে আনে ম্যাকডোনাল্ড ও তার বন্ধুদেরকে, তাদের পেট থেকে বের করে সব। তবে জেল ভেঙে ঢোকা অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও বেরোনো কঠিন। কাজেই অনুচিত হবে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। ধৈর্য ধরলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হবে অনেক কিছুই। গ্রামের পাবে যা ঘটে গেছে, সেজন্যে লোকগুলোকে দু’চার দিন ভুগিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন নিজের সুবিধামত তাদেরকে কোথাও ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা করতে পারবে ও।
এটা জানা জরুরি, কে ওই স্নাইপার। ম্যাকডোনাল্ড বা ম্যাককার্টার তাকে ভাল করেই চেনে। গ্রামের মাথাগরম সাধারণ কোনও যুবক নয় সে। টর্চ হাতে লকের তীরে যারা গেছে, প্রত্যেকেই অতিরিক্ত আওয়াজ করেছে। সঙ্গে মারাত্মক অস্ত্র থাকলেও তাদের আচরণ ছিল অপেশাদারি। কিন্তু স্নাইপার ছিল প্রথম শ্রেণীর। নির্দিষ্ট সময় পর পর গুলি এবং সাইলেন্সারের খুক্ আওয়াজ রানাকে বলে দিয়েছে, ওপর দিকের জমি বা গাছে ছিল সে। পরিষ্কার দেখেছে সামনের দিক। ঘুটঘুটে আঁধারে গুলি করেছে ইনফ্রারেড নাইট-ভিশন স্কোপ ব্যবহার করে। ওটা জেন ২+ ইনটেনসিফায়ার টেকনোলজি বা আরও আধুনিক কিছু। দামি ও নিখুঁত। আরেকটু হলেই ঝোপঝাড়ে গেঁথে ফেলেছিল রানাকে। ওই দুরূহ কাজ করতে হলে চাই দারুণ দক্ষতা ও বিশেষ ট্রেইনিং। এটা এখন রানার কাছে পরিষ্কার: লক তীরে যেসব গাধা ছিল, ওই লোক তাদের থেকে ভিন্ন।
ঘিরে ফেলা বাঘকে বিটারদের মাধ্যমে যেভাবে শিকারির দিকে তাড়িয়ে নেয়া হয়, সে-কাজই লোকগুলোকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে স্নাইপার। মনে করেছে রানাই সেই পোচার। তার দুর্ভাগ্য, প্রথম বুলেট গেছে রানার মাথার দেড়-দুই ইঞ্চি দূর দিয়ে। হয়তো গাছের ডালপাতায় লেগে সামান্য সরে গেছে বুলেটের গতিপথ, নইলে বাঁচত না রানা। এখন ক্ষতবিক্ষত মাথা নিয়ে জঙ্গলে পড়ে থাকার কথা ওর। রানা ভাল করেই টের পেয়েছে, কতবড় মার্কসম্যান ওই দক্ষ স্নাইপার।
ওর মনে এল বেন হ্যাননের কথা।
ক্রমেই আরও চিন্তিত হয়ে উঠছে ও।
বেন যোগ্য যোদ্ধা হলেও বয়স হয়েছে তার। তা ছাড়া অসুস্থ। যে-কোনও সময়ে আড়াল থেকে তাকে খুন করবে তুখোড় ওই স্নাইপার। নিজেকে মনে করিয়ে দিল রানা, প্রথম কাজ বেন হ্যাননকে খুঁজে বের করা। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সরিয়ে দেবে এই এলাকা থেকে। তা ছাড়া ওর নিজের চাই দরকারি কিছু যন্ত্রপাতি। আগামীকাল সংগ্রহ করবে সেগুলো।
ভোর হওয়ার আগেই কটেজের কাছে পৌঁছুল রানা, ক্লান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। শিলাবৃষ্টি পড়ছে পাথুরে পেভমেন্টে। জায়গাটা পিচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সাবধানে কটেজে ঢুকল রানা। বহু আগেই নিভে গেছে উড বার্নারের আগুন। ফ্রিয়ের মত ঠাণ্ডা কটেজের ভেতরটা। নতুন করে আগুন জ্বেলে নিল রানা। ভেজা পোশাক খুলে চাপিয়ে দিল উড বার্নারের পাশের চেয়ারে। স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে নিয়ে বসল আর্মচেয়ারে। মনে পড়ল, গাড়িতে রয়ে গেছে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া বন্দুক। পেছনের সিটে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে ওটা। চেয়ার ছেড়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে গাড়ি থেকে বন্দুকটা নিল রানা। ছাউনির ভেতর ঢুকে চলে গেল যন্ত্রপাতি রাখার বাক্সের সামনে। ওটার ভেতর থেকে পেল একটা হ্যাকস’। ওটা পুরনো হলেও যথেষ্ট ধারাল। বেঞ্চের ভাইস-এ বন্দুক আটকে কাজে নামল রানা। কেটে নামাচ্ছে দুই ব্যারেল। কাজ শেষ হলে কেটে অর্ধেক বাদ দিল বন্দুকের বাঁটও। রয়ে গেল শুধু পিস্তল গ্রিপ। ওর হাতে বন্দুকটা হয়ে উঠেছে বারো গেজের হাত-কামানের মত। পাখি বা হরিণ শিকার সম্ভব না হলেও কাছ থেকে গুলি করলে ছিন্নভিন্ন হবে শত্রুপক্ষ। পুরনো বস্তা খুঁজে ওটার ভেতর অস্ত্রটা পুরল রানা। বস্তা হাতে ফিরল কটেজে। ইন্টারনেটে সার্চ করে জেনে নিল ইনভার্নেস শহরের কোন্ দিকে রয়েছে শিকারের ইকুইপমেন্টের দোকান। তখনই স্থির করল, আগামীকাল ঘুরে আসবে ওখান থেকে। শহরে গিয়ে আবারও গ্রামে ফিরতে ওকে ড্রাইভ করতে হবে সবমিলে এক শত চল্লিশ মাইল। তা হোক।
বেডরুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা। তিন মিনিট পেরোবার আগেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
.
মাঝারি এক পথের ধারে খবরের কাগজের স্ট্যাণ্ড আর ছোট এক রেস্তোরার মাঝখানে বসে আছে ইনভার্নেস গান শপ। উল্টোদিকেই শেরিফের কোর্ট। গাড়ি থেকে নেমে দোকানে গিয়ে ঢুকল রানা। ওর নাকে এল পাকা চামড়া, ইস্ত্রি করা শিকারি-পোশাক, মোম দেয়া তুলো, বুট পালিশ আর গান অয়েলের মিশ্রিত ঘ্রাণ।
দোকানটা অনেকটা গুহার মত। মেঝে থেকে শুরু করে ছাত পর্যন্ত দেয়ালে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে নানান মালসামান। দেয়ালের পাশে যেখানে রসদ নেই, ঝুলছে মৃত হরিণের শিংওয়ালা মাথা। দোকানের মালিক মধ্যবয়স্ক এক পেটমোটা লোক। তার নাকে যে চশমাটা রানা দেখল, ওটার কাঁচ হবে ইঞ্চিখানেক পুরু। গভীর মনোযোগে অস্ত্রসংক্রান্ত একটা সাময়িকী পড়ছে লোকটা। নিচু গলায় তাকে শুভ সকাল জানিয়ে নিজের কাজে নেমে পড়ল রানা। ওর চারপাশে শিকারিদের পোশাক, মাছ ধরার সরঞ্জাম, ক্যাম্পিং ইকুইপমেন্ট, হাইকিঙের মালপত্র। একটা তালিকা এনেছে রানা। সেটা দেখে জিনিসপত্র জড়ো করে ক্যাশ কাউন্টারে রাখতে লাগল।
পরের র্যাকে রয়েছে ধনী মহিলা ও ভদ্রলোকদের শুটিং জ্যাকেট। তারই ভেতর রানা পেল ঘিলি সুট। ওটা পরে সতর্ক হরিণেরও খুব কাছে চলে যেতে পারবে যে-কেউ। ওটা জঙ্গলে ব্যবহার করতে চাইবে যে-কোনও মিলিটারি স্নাইপার। পোশাকটাকে নকল শেওলা বললেও ভুল হবে না। হ্যাঙার থেকে নামিয়ে কাউন্টারের পাশে রাখল রানা। আবারও ব্যস্ত হয়ে গেল কেনাকাটায়।
একদিকের দেয়ালের র্যাকে রয়েছে স্কোপওয়ালা নানান কোম্পানির হান্টিং রাইফেল। তবে ওদিকে গেল না রানা। ব্রিটেনে ফায়ারআর্মস কেনার লাইসেন্স ওর নেই। নিঃশব্দে হামলার জন্যে বেছে নিল কালো ফলার ক্ষুরের মত ধারাল কে-বার ছোরা। এরপর নিল ভাল দেখে একটা নাইট-ভিশন গগল্স্। ওটার দাম কয়েক শ’ পাউণ্ড। আগে ব্যবহার করত স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা। কিছু দিন হলো সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঘন জঙ্গলে বা দুর্গম পাহাড়ে শত্রুর ওপর চোখ রাখতে হলে ওই জিনিস খুবই দরকার।
কাউন্টারে সব রেখে ওগুলোর দাম চুকিয়ে দেয়ার জন্যে পকেট থেকে মানিব্যাগ নিল রানা। ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে ওর দিকে চেয়ে হাসল দোকান-মালিক। ‘কখনোই ঘিলি সুট বা নাইট-ভিশন গগল্স্ খুব একটা বিক্রি করতে পারিনি তারপর হঠাৎ করে এই হপ্তাতেই বিক্রি করতে চলেছি দুই সেট। অবাকই লাগছে।’
দোকান-মালিকের দিকে চেয়ে আছে রানা। খুশি হয়ে জানাল মানুষটা, ‘আই, গত ক’দিন আগে বিক্রি করেছি বয়স্ক এক লোকের কাছে নাইট-ভিশন গগল্স্ আর এক পেয়ার ঘিলি সুট। আসলে ভাবাই যায় না!
চট করে পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে বেন হ্যাননের ছবি বের করে দোকান-মালিককে দেখাল রানা। ‘এই ভদ্রলোক নাকি?’
পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে ছবি দেখল ভদ্রলোক। পিছিয়ে বসে মাথা দোলাল। ‘হ্যাঁ, এই একই লোক। তার মানে উনি বোধহয় আপনার বন্ধু?’
‘সিনিয়র বন্ধু,’ বলল রানা, ‘জঙ্গলে হরিণ শিকারে যাওয়ার কথা। তবে আসতে দেরি করেছি। উনি কি বলেছেন কোন দিকের জঙ্গলে চলেছেন?’
‘বলেননি,’ বলল দোকান-মালিক। ‘তবে ভাল লাগছে যে আপনার মত কমবয়সী ছেলেরা আজও বয়স্কদের সঙ্গে শিকারে বের হন।’ চোখ ভিজে গেল তার। ‘লাল হরিণ শিকারে আমিও বেরোতাম আমার বাবার সঙ্গে।’
‘আরও কিছু কিনেছে?’ জানতে চাইল রানা।
‘বয়স হয়েছে, একটু দেখে বলতে হবে,’ বলল মানুষটা। পাশের কমপিউটারে মন দিল। মিনিটখানেক পর বলল, ‘এই যে। কয়েক দিন আগের কথা। সবই মনে আছে। রাতে দোকান বন্ধ করব, এমনসময় এলেন। বাড়তি একটা জিনিস নিয়েছেন। ওটা আপনার লিস্টে নেই। ‘
‘সেটা কী?’ নরম সুরে জানতে চাইল রানা।
‘ওই জিনিস,’ কাউন্টারের পেছন দেয়ালে ঝুলন্ত এক সারি ক্রসবো দেখাল ভদ্রলোক। ওগুলোর বেশিরভাগই প্লাস্টিকের খেলনার মত। তবে তারই ভেতর রয়েছে কয়েকটা সত্যিকারের ক্রসবো। ওগুলোর ক্ষুরধার ফলা অনায়াসে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে পূর্ণবয়স্ক গণ্ডারের বুক।
দোকান-মালিকের চোখ অনুসরণ করে ক্রসবো দেখছে রানা।
‘এক্সক্যালিবার। কানাডায় তৈরি। মার্কেটে এর চেয়ে ভাল আর কিছু নেই। লাইসেন্সও লাগে না। আপনার বন্ধু বেশ কিছু তীরও কিনেছেন। তখন মনে করিয়ে দিলাম, ওই অস্ত্র দিয়ে শিকারের অনুমতি নেই ব্রিটেনে। উনি বললেন, কোনও সমস্যা নেই। টার্গেট প্র্যাকটিস করবেন।
পছন্দমত একটা ক্রসবোর দিকে আঙুল তাক করল রানা। ‘ওটা দেবেন?’
খুশিতে ঝলমল করে উঠল দোকান-মালিকের মুখ। ‘আপনিও ওই জিনিস কিনতে চান?’
‘আগে জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখি কেমন লাগে।’
দেয়ালের হুক থেকে সবচেয়ে দামি ক্রসবোটা নামিয়ে রানার সামনে কাউন্টারে রাখল দোকান-মালিক। অস্ত্রটা হাতে তুলে নিল রানা। হালকা হলেও ওটা খুব ব্যালেন্সড্। অনবোর্ড টেলিস্কোপের মাঝ দিয়ে দোকানের জানালা পথে তাকাল রানা। স্কোপ হাই-টেক, সঙ্গে ইনবিল্ট লেযার রেঞ্জফাইণ্ডার এবং ইলেকট্রনিক রেড-ডট অপটিকাল রেটিকিউল। কম আলোয় ওটা ব্যবহার করা যাবে লক্ষ্যভেদের সময়। দূরের টার্গেটে তীরটাকে মাধ্যাকর্ষণ নিচে নামিয়ে দেবে বলে এলিভেশন ইনক্রিমেন্ট মিল-ডট দেখিয়ে দেবে কোথায় তাক করতে হবে শুটারকে। একবার তীর ছুঁড়ে দেয়ার পর দুই শ’ গজের ভেতর রেহাই নেই টার্গেটের। তার ওপর যদি এই অস্ত্র পড়ে বেন হ্যাননের মত দক্ষ যোদ্ধার হাতে, বাঁচার উপায় নেই কারও।
রানা বুঝল, যুদ্ধের জন্যে তৈরি ওর ওস্তাদ। প্রথমে সংগ্রহ করেছে ক্যাম্পার ভ্যান। এরপর দরকারি সাপ্লাই, ঘিলি ক্যামোফ্লেজ সুট, কমব্যাট নাইফ, নাইট-ভিশন গগল্স্ এবং হাই-পাওয়ারের ক্রসবো। স্কটল্যাণ্ডে লাল হরিণ শিকারে আসেনি সে। ভাল করেই জানে কী ধরনের বিপদ হতে পারে। আর তাই কোনও ঝুঁকিও নিচ্ছে না। কয়েক দিন আগেই শিকারের পিছু নিয়েছে। রানার মনে প্রশ্ন জাগল: সে কি এখন শিকারি না শিকার?