আঠারো
জেসিকা একতলা বাড়িটার কলিংবেল টেপার তিন মিনিট পর খুলে গেল দরজা। দেখা দিলেন বয়স্কা এক মহিলা। শুধু কিনলোকার্ড গ্রাম কেন, উনি হয়তো দুনিয়ার সবচেয়ে বয়সী মানুষ। গ্যালাপাগোস কচ্ছপের গলার চেয়েও কয়েক ভাঁজ বেশি কুঁচকে আছে মুখ-গলা ও হাতের চামড়া। কানে প্রায় কিছুই শুনতে না পেলেও এটা জানেন, বিশ্বসেরা হোটেলের রুমের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত তাঁর কটেজের ভাড়া। গ্রামের ধারে পাথরের বাড়িটাতে একা থাকেন। পাশের কটেজও পাথরের। বুঝিয়ে লাভ হবে না টের পেয়ে মানিব্যাগ হালকা করে এক সপ্তাহের জন্যে কটেজ ভাড়া নিল রানা। ভাবল, যাক, খুশি হয়েছেন বৃদ্ধা। কঙ্কাল-সদৃশ শুকনো হাতে টাকা গুনে নিয়ে আধহাত লম্বা, কাঁচা লোহার চাবিটা গছিয়ে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন মিসেস ক্লার্ক। জেসিকাকে নিয়ে রানা প্রবেশ করল কটেজে। প্রায় আসবাবপত্রহীন বেডরুম, প্রাচীন টয়লেট ও লিভিংরুম নিয়ে ছোট্ট কটেজ। বার্নারের পাশে কাঠ নেই। অবশ্য জেসিকার কথায় বাইরের ছাউনিতে রানা পেল শুকনো কাঠ ও ধারাল একটা কুঠার।
ওয়েলকাম টু কিনলোকার্ড,’ মৃদু হাসল জেসিকা। ফুটপাথের ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় মিষ্টি লাগছে ওর মুখ, ঠিক যেন লাজুক নববধূ। নিজেকে বড়বেশি নিঃসঙ্গ লাগল রানার। কেন যেন হুতাশ উঠল ওর বুকের গভীরে। খুক্-খুক্ করে কাশল। নরম গলায় জেসিকা জানতে চাইল, ‘এবার কি পৌঁছে দেব তোমাকে গাড়ির কাছে?’
কখন যেন নিঃশব্দে থেমে গেছে তুষারপাত। ঘন কালো আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। হীরার মত ঝিকমিক করছে লক্ষকোটি নক্ষত্র। রানার হঠাৎ করেই মন চাইল, যদি চিরকাল জেসিকার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত অদ্ভুত এই তারার রাজ্যে! বড় করে দম নিতেই বহুদিন পর তাজা হাওয়ায় ভরে গেল ওর বুক। তখনই আবারও নাকে এল জেসিকার চুলের চেনা সেই সুবাস। নিচু স্বরে বলল রানা, ‘ধন্যবাদ। তবে এখন একটু হাঁটতে চাই।’
‘বেশ, তবে পরে দেখা হবে, রানা। আবারও কোনও গোলমালে জড়িয়ে যেয়ো না যেন।’
‘তুমি এমনভাবে বলছ, যেন আমি কলহপ্রিয় একটা বাজে লোক।’
‘আমি অত নিশ্চিত নই যে তুমি আসলে ভদ্রলোক।’
হতাশা ভরে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘সবাই ভদ্রলোক বলে আমাকে, সেটা তুমি জেনে গেলে কী করে?’
‘ওচ, আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করবে না!’
‘স্কটিশ মেয়েরা খুব সুন্দর করে ‘ওচ’ কথাটা বলে।’
রানাকে চোখ পাকিয়ে দেখল জেসিকা। ‘আমি কিন্তু তোমাকে এখনও গ্রেফতার করতে পারি, সেটা জানো?’
‘তা হলে তো তোমার সঙ্গে আর কথা না বলাই ভাল।’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ ল্যাণ্ড রোভারে গিয়ে উঠল জেসিকা। ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল। পেছন থেকে চেয়ে রইল রানা। কেন যেন খুব ভাল লেগেছে ওর মেয়েটাকে।
পথের বাঁকে হারিয়ে গেল ল্যাণ্ড রোভারের লাল টেইল লাইট। জানালার পর্দা টেনে দিয়েছেন মিসেস ক্লার্ক। ছোট একটা ফাঁক দিয়ে আসছে টেলিভিশনের আলো, সঙ্গে কথাবার্তার ভারী আওয়াজ। কটেজের দরজায় তালা মেরে প্যান্টের পকেটে চাবিটা পুরে ধীরপায়ে রানা চলল পিটারের বাড়ির দিকে। তাপমাত্রা নেমেছে শূন্যের নিচে। ঝিরঝিরে হাওয়া ভীষণ কনকনে। পিচ্ছিল, শক্ত বরফ হয়ে যাচ্ছে তুষারগুলো। বাজে মাত্র সন্ধ্যা সাতটা। অথচ এরই ভেতর শুয়ে পড়েছে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। বাড়িগুলোর দোতলার জানালায় জ্বলছে কম ওয়াটের আলো। হাওয়ায় ভাসছে কাঠ- পোড়া মিষ্টি সুবাস।
রানা ছাড়া আর কেউ নেই গ্রাম্যপথে। হিম-ঠাণ্ডা রাতে নিঃশব্দে হেঁটে চলল ও। একটু পর পেছনে পড়ল পাথরের চার্চ ও পাশের কবরস্তান। মাত্র ক’দিন আগে কবরে শুইয়ে দেয়া হয়েছে রবার্ট উইলসনকে। জায়গাটা বড়জোর পঞ্চাশ গজ দূরে। গ্রামের একমাত্র দোকান এখনও খোলা। জানালা- দরজা দিয়ে এসে হলদে আলো পড়েছে পথের ধারে।
স্কটল্যাণ্ডে পা রাখার পর কিছুই খায়নি রানা। হঠাৎ করেই জ্বলতে লাগল ওর পেট। রাস্তাটা আড়াআড়িভাবে পেরিয়ে কিনলোকার্ড স্টোর্সে ঢুকল রানা। কাউন্টারের ওদিকে বসেছেন সাদা গোঁফওয়ালা এক লোক। বয়স মিসেস ক্লার্কের অর্ধেক। রানাকে দেখে বললেন, ‘গুড ইভনিং।’
এই দোকান জেনারেল স্টোর। মুদির মালপত্র থেকে শুরু করে খামারের কোদাল, শাবল সবই বিক্রি করা হয়। একটা বাস্কেট সংগ্রহ করে শেলফ থেকে ওটার ভেতর মালপত্র রাখতে লাগল রানা। মাংসের কয়েকটা স্টুর ক্যান, এক কেজি চালের প্যাকেট, এককৌটা ইন্সট্যান্ট কফি, দুটো স্থানীয় এইল-এর বোতল আর এক বোতল মল্ট উইস্কি নিল। .. রাতের গভীরে হাড়কাঁপা শীতে হয়তো কড়া পানীয় চাঙ্গা করে রাখবে ওকে।
বিল মিটিয়ে দেয়ার পর স্মার্টফোন খুলে প্রৌঢ় দোকানিকে বেন হ্যাননের ছবি দেখাল রানা। ‘ইনি আমার বন্ধু।
এই গ্রামে বেড়াতে এসেছেন। আপনি কি তাঁকে এদিকে কোথাও দেখেছেন?’
কৌতূহলী চোখে ওকে দেখলেন দোকানি। তারপর চোখ বোলালেন ছবিটার ওপর। বেশ কিছুক্ষণ পর মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আই, দেখেছি বলেই তো মনে হচ্ছে। কয়েক দিন আগের কথা। আমার মনে আছে, কারণ ওই লোক ড্রাইভ করছিল পিটার হ্যাননের ক্যাম্পার ভ্যান।’
আমরা সবাই সবাইকে চিনি, জেসিকার কথাগুলো মনে পড়ল রানার। ‘আমার এই বন্ধু পিটারের আপন চাচা,’ বলল ও। ‘তাঁকে খুঁজছি। এখান থেকে কোথায় গেছেন সেটা কি আপনাকে বলেছেন?’
মাথা নাড়লেন দোকানি। ‘না। মালপত্র কিনে চলে গেছে। কথা তেমন বলে না।’
‘কী জিনিস নিয়েছেন?’
ভাবতে চাইলেন দোকানি। ‘দাঁড়াও, মনে করে দেখি। বোধহয় ক্যাম্পিং করতে চেয়েছিল। এত শীতে কেন এসব করবে কেউ, মাথায় ঢোকে না। টিনের খাবার নিয়েছিল। বোতলের পানি, কফি। আরও কিছু।’ কড়াভরা আঙুল হার্ডওয়্যার সেকশনের দিকে তাক করলেন তিনি। ‘মানুষটা বোধহয় বুঝেছে তুষার পড়বে। তাই কিনে নিয়েছে একটা কোদাল।’
কোদালের দিকে চেয়ে শিরশির করল রানার মেরুদণ্ড। ওগুলো ভাল মানের হার্ডওয়্যার। হাতল শক্ত কাঠের। স্টিলের ব্লেড কালো, বড়সড়ো।
তুষার সরাতে ওই জিনিস ব্যবহার করবে না বেন। যে বা যারা তার ভাতিজাকে আহত করে কোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদেরকে নিজ হাতে শায়েস্তা করবে। এবং খুনের পর কবর দিতেই কিনেছে কোদাল।
‘অনেক কিছু জানলাম, সেজন্যে ধন্যবাদ,’ বলল রানা।
‘ইউ আর ওয়েলকাম। আশা করি খুঁজে পাবে তোমার বন্ধুকে।’
‘তাই যেন হয়।’
বড় ক্যানভাস ব্যাগে মালপত্র ভরে দোকান থেকে বেরোল রানা। প্রতি পদক্ষেপে ব্যাগের ভেতর টুং-টাং শব্দ তুলছে স্টুয়ের ক্যান আর এইল-এর বোতল। একটু পর টয়োটা গাড়িটার সামনে পৌছে গেল ও। পিটারের বাড়ির ভেতরটা কবরের মত অন্ধকার। গাড়িতে উঠে মিসেস ক্লার্কের কটেজের সামনে এসে থামল রানা। এখনও টিভি দেখছেন মহিলা।
কটেজের তালা খুলে ক্যানভাস ব্যাগ নিয়ে কিচেনে ঢুকল রানা। কাবার্ড তল্লাসী করতে গিয়ে পেল দুটো সসপ্যান। ধুয়ে নিয়ে ভাত রাঁধার জন্যে একটার ভেতর ঢালল পানি, অন্যটার ভেতর ক্যানের স্টু। আগুন জ্বেলে দুই সসপ্যান চাপিয়ে দিল চুলোয়। স্টুর সঙ্গে আছে অদ্ভুত কোনও সস। শুঁকলে মনে হবে হাজার বছরের পুরনো ময়লা জুতোর সুখতলি। তবে ওটা খেতে দ্বিধা নেই রানার। এর চেয়েও বাজে খাবার জীবনে বহুবার খেয়েছে।
আধঘণ্টা পর কিচেনের সবুজ ফরমাইকা টেবিলে বসে ভাত ও স্টু খেতে লাগল রানা। মাঝে মাঝে চুমুক দিল হ্যামার-হেড এইল-এর বোতলে। খাবার শেষে একবার তাকাল লিভিংরুমের দিকে। জায়গাটা ডিপ-ফ্রিযের চেয়েও ঠাণ্ডা। বাইরের ছাউনি থেকে জ্বালানি কাঠ এনে গুঁজে দিল উড বার্নারে। পুরনো খবরের কাগজ মুড়িয়ে লাইটার দিয়ে জ্বেলে নিল আগুন। বার্নারে প্রথমে ভালভাবে ধরল না কাঠ কিন্তু কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া ছড়িয়ে ঠিকভাবেই জ্বলতে লাগল। আগুনের তাপে টিকটিক শব্দে স্ফীত হচ্ছে স্টোভের কাস্ট- আয়ার্ন বক্স। আগুনের ধারে আর্মচেয়ারে বসল রানা। ভাবছে, এবার কী করবে।
যে-কোনও জায়গায় থাকতে পারে বেন। বেঁচে আছে না মারা গেছে, জানা নেই। ক্যাম্পার ভ্যানের নম্বর প্লেট যতই জানা থাকুক, একহাজার স্কয়্যার মাইল টিলা ও জঙ্গল ছুঁড়ে বেনকে খুঁজে নেয়ার দক্ষতা কারও নেই। অবশ্য, চাইলেই তার মত করে ভাবতে পারবে রানা। সেক্ষেত্রে এক পা এক পা করে এগোতে হবে। তাতে হয়তো পৌঁছুবে মানুষটার কাছে। এদিকে একইসঙ্গে খুঁজবে সেই পোচারকে। তার দিকেই মনোযোগ দেবে বেন। মিথ্যা না বলে থাকলে লোকটা নিজের চোখে দেখেছে রবার্টকে খুন হতে। সে জানে, কারা আহত করে কোমায় ঠেলে দিয়েছে পিটারকে। হয়তো পোচারকে খুঁজতে গিয়ে মস্তবড় কোনও বিপদে আছে বেন। ওই পোচার লোকটাকে পেলে হয়তো তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রানা পৌঁছুতে পারবে অপরাধীদের আস্তানায়।
চুপচাপ বসে থাকল রানা।
কিনলোকার্ড আধুনিক গ্রাম না হলেও জোরালো সিগনাল পাচ্ছে ওর মোবাইল ফোন। গুগল ব্রাউযারে গিয়ে কি-ওঅর্ড হিসেবে রানা লিখল স্যামন পোচিং স্কটল্যাণ্ড। কিছুক্ষণ ব্ৰাউয করে জেনে গেল, মিঠা-পানির স্যামন শিকার নিয়ে চলছে বড় ধরনের কালোবাজারি। স্কটল্যাণ্ডে রয়েছে হাজারো লক এবং নদী। শুধু লক নেসই সাত মিলিয়ন কিউবিক মিটারের চেয়ে বড়। ইংল্যাণ্ড আর ওয়েলসের সমস্ত পানির চেয়েও বেশি। ফলে যতই পোচারদেরকে ধরতে মরিয়া হয়ে উঠুক ফিশারির গোয়েন্দারা, শত শত চোরা শিকারিকে ঠেকাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তারা। লণ্ডন ও এডিনবার্গের বড় সব রেস্টুরেন্ট কোনও প্রশ্ন না করেই কিনে নিচ্ছে চোরাই স্যামন। ওই মাছ চুরি এতই লোভনীয় ব্যবসা, অনেক সময় ধরা পড়ছে ফিশারির নিজেদের লোকই। তার ওপর আছে নানান ছোট-বড় দল। চুরি ধরা পড়বে বুঝলেই ছোরা দিয়ে পেট ফাঁসিয়ে দেয় তারা। অবশ্য রহস্যময় পোচার বোধহয় তাদের দলের নয়। সে স্থানীয় কেউ। স্যামন ধরে পেটপূজা করছে। অথবা মাছ বিক্রি করছে টাকার বিনিময়ে। অক্টোবরে শেষ হয়েছে আনুষ্ঠানিক স্যামন সিযন। আবারও নতুন করে মাছ ধরা শুরু হবে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে। তত দিনে বড় হবে নতুন প্রজন্মের স্যামন মাছগুলো। অবশ্য সেজন্যে অপেক্ষা করতে রাজি নয় অনেকে। হেমন্ত এবং শীতে শিকার করছে নদী ও লকে। ওই একই কারণে ডিসেম্বরে আরডাইক লকে মাছ ধরছিল রহস্যময় পোচার। গুগল ম্যাপ দেখে রানা বুঝল, পশ্চিম থেকে পুবে বিস্তৃত লক আরডাইক; দৈর্ঘ্যে পুরো বারো মাইল। বিশাল জলার ভেতর একজন লোককে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ। তা ছাড়া, আকাশ থেকে চোখ রাখার উপায় নেই রানার।
আবারও স্থানীয় সংবাদ খুঁজতে লাগল ও। লকের পুবে ভাসছিল রবার্টের লাশ। জায়গাটা ডেভেলাপারদের গফ্ কোর্স এবং ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরির সাইট থেকে বেশি দূরে নয়। পোচারকে ওদিকে খুঁজবে কি না ভাবতে গিয়ে আনমনে মাথা নাড়ল রানা। রবার্টকে খুন হতে দেখে ভয় পেয়েছে লোকটা। হয়তো বাড়ি ছেড়ে বেরোবে না আগামী কিছু দিন। অথবা, যাবে অন্য কোনও লক বা নদীতে। এবার ওর মনে হলো, লোকটাকে খুঁজতে যাওয়া উচিত লকের অন্যদিকে। রবার্ট খুন হয়েছে ভোরে বা সকালে। তাই এরপর থেকে হয়তো পোচার বেরোবে রাতের আঁধারে। খুব সতর্ক থাকবে। মনে কাজ করবে ভীষণ আতঙ্ক। ভাল করেই জানে, রাতে লকে চোখ রাখে ফিশারির লোক। তা ছাড়া, তাকে হয়তো খুঁজছে খুনির দল। কোণঠাসা হলে নিজেকে বাঁচাতে বিষাক্ত সাপের মত ছোবল দেবে পোচার। তবে ওটা নিয়ে ভাবছে না রানা। আগেও বহুবার স্যামন-পোচারের চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক মানুষের মোকাবিলা করেছে। এবং এখনও বেঁচে আছে সে বহাল তবিয়তে।
স্টোভের গনগনে আগুনে আরামদায়ক হয়ে উঠেছে কটেজ। তবে আজ আর ঘুমাবে না বলে ঠিক করল রানা।
গভীর রাতে বেরোবে ও মানুষ শিকারে।