ষোলো
কাউন্টারে প্রায় উঠে এসে সামনের মেঝে দেখল ললিপপ লিলি। সৈকতে আটকা পড়া মৃত তিমির মত উপুড় হয়ে পড়ে আছে মিচ ম্যাকডোনাল্ড। মেয়েটা আঁৎকে উঠে বলল, ‘হায়, যিশু! গাধাটা কি সত্যিই মরে গেল?’
‘না,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘তবে গ্রামে ফার্মেসি না থাকলে জ্ঞান ফিরলে বিপদে পড়বে। ওর চাই মুঠো-মুঠো পেইন কিলার। তা ছাড়া, মুখটাও তো মেরামত করতে হবে ফেইশাল সার্জারি করে।’
বহুক্ষণের জন্যে অচেতন হয়েছে মিচ ম্যাকডোনাল্ড। বেকায়দাভাবে মেঝেতে আছাড় খেয়ে মাথা গুলিয়ে গেছে তার বন্ধু ববি ম্যাককার্টারের। শুয়ে শুয়ে চাপা স্বরে গুঙিয়ে চলেছে। তাদের দলের তৃতীয়জন চাপা পড়ে আছে টেবিলের নিচে। ওই তিনজনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে একটা ঘুষিও ব্যবহার করেনি রানা। লড়াই না করেই মুখ চুন করে পাব ছেড়ে বেরিয়ে গেল ম্যাকডোনাল্ড, ম্যাককার্টার এবং অন্য যুবকের বন্ধুরা। এরপরেও যারা রয়ে গেল, পতিত তিন যুবক আর রানার ধারেকাছে এল না তারা।
অবশ্য একজন ব্যতিক্রম। ওই মেয়েকে আগেও দেখেছে রানা। দীর্ঘ কালো চুলের সুন্দরী। হাতব্যাগটা তুলে টেবিল ছেড়ে কাউন্টারের সামনে এসে থামল সে। বয়স বড়জোর পঁচিশ। পরনে আঁটোসাঁটো জিন্সের প্যান্ট ও শার্ট। দুই চোখের মণি কালো। তাকে একটু দূরের টেবিল থেকে নার্ভাস চোখে দেখছে পেরেকের মত খাড়া চুলের এক যুবক। রানার সামনে এসে থামল মেয়েটা, আত্মবিশ্বাসী। ওর চুলে রানা পেল অদ্ভুত এক সুবাস। ওটা কোনও পারফিউম নয়। ওর মনে পড়ল ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া এক বান্ধবীর কথা। তার চুলে ছিল এমনই মনকাড়া ঘ্রাণ। দারুণ ভাব ছিল ওদের। মিতার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। একদিন স্কুলে গিয়ে রানা জানল, বদলি হয়ে যাওয়ায় ওরা চলে গেছে অন্য শহরে। অতীত নিয়ে ভাবতে গিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেল রানা। ফর্সা বাঙালি সুন্দরী বলে অনায়াসেই চালিয়ে দেয়া যাবে একে।
হাতব্যাগ থেকে ওয়ারেন্ট কার্ড নিয়ে মেয়েটা বলল, ‘আমি পুলিশ অফিসার। ভুলেও জায়গা থেকে নড়বে না।’
কার্ড অনুযায়ী ওর নাম জেসিকা থমসন।
‘শুভ সন্ধ্যা, কনস্টেবল,’ আলাপের সুরে বলল রানা। ‘আমার ড্রিঙ্ক শেষ হয়নি, তাই আপাতত কোথাও যাচ্ছি না।’
‘ঝামেলা করেছে ওরাই,’ প্রতিবাদ করল লিলি। আঙুল তুলে দেখাল মেঝেতে পড়ে থাকা ম্যাকডোনাল্ডকে।
‘সবই দেখেছি,’ নিথর দেহটা দেখল জেসিকা থমসন। ঘুরে চোখ বোলাল ধরাশায়ী অন্য দু’জনের ওপর।
ওদের কিছুই হয়নি,’ বলল রানা। ‘একটু বেশি বিয়ার গিলে ফেলেছে। নইলে বিপদে পড়ত না।
ওর চোখে তাকাল জেসিকা থমসন। কড়া সুরে জানতে চাইল, ‘তুমি আসলে কে?’
নিজের নাম বলার পর জ্যাকেট থেকে ওয়ালেট নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাল রানা। কার্ডটা নিল কনস্টেবল জেসিকা। ওটা কয়েক মুহূর্ত দেখার পর ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিল রানার চেহারা। ‘তুমি কি আমাকে গ্রেফতার করবে, অফিসার?’ জানতে চাইল রানা।
‘ভাবছি। কাজটা করলে মন্দ হয় না।’
‘কী অপরাধে?’ জানতে চাইল রানা, ‘দুটো আঙুল ব্যবহার করেছি বলে?’
· কয়েক মুহূর্ত ভাবল জেসিকা। কী যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে রানার হাতে ফেরত দিল ড্রাইভিং লাইসেন্স। ‘তোমাকে গ্রেফতারের কোনও কারণ পাচ্ছি না, মিস্টার রানা। রক্ষা করেছ লিলিকে। নিজেকেও। সেজন্যে তেমন শক্তিও প্রয়োগ করোনি। সত্যি বলতে প্রায় কিছুই করতে হয়নি তোমাকে।’
‘কিছুই করতে হয়নি, কারণ ওরা অত খারাপ ছেলে নয়, ম্যাকডোনাল্ডদের হয়ে সাফাই গাইল রানা। ‘তবে নিজেদেরকে ওরা খারাপ ভাবে।’
‘পিটিয়ে ওরা যাদের হাড়গোড় ভেঙেছে, তাদেরকে এই কথা বললে মানবে না তারা। এবার বোধহয় ভুলই করে ফেলেছে। একজনের হাতে আবার ভাঙা কাঁচের গ্লাসও ছিল। তিনজনের বিরুদ্ধে একজন। লড়াইটা ন্যায্য ছিল না।’
রানার বিরুদ্ধে লড়তে হলে ম্যাকডোনাল্ড, ম্যাককার্টার এবং তাদের বন্ধুর দরকার ছিল একটা করে ছোরা। হামলা করতে হতো একসঙ্গে। সেক্ষেত্রে ন্যায্য লড়াইয়ের সুযোগ হয়তো পেত তারা। যদিও এ বিষয়ে কিছু বলল না রানা। অন্ধকারে থাকুক কনস্টেবল থমসন।
‘তোমার কপাল ভাল যে গ্রেফতার করছি না,’ বলল মেয়েটা।
‘সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ, অফিসার,’ বিনয়ের অবতার হয়ে বলল রানা।
‘তবে সতর্ক করে দিচ্ছি, আবারও কোনও গোলমালে জড়িয়ে গেলে তখন কিন্তু সত্যিই গ্রেফতার করব।’
‘বলো, কেন আমি ঝামেলায় জড়াব? সাধারণ এক পর্যটক, ঘুরে বেড়াচ্ছি চোখের তৃষ্ণা মেটাতে।’
কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল জেসিকা থমসন। বুঝে গেছে, এর মত বিপজ্জনক কাউকে আগে কখনও দেখেনি সে। জানাও নেই এর সঙ্গে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাই বলল, ‘এই দুর্ঘটনার পর হয়তো তোমার ভেতর কাজ করছে মানসিক শক। তুমি সুস্থ বোধ করছ? নাকি বসবে কোনও চেয়ার বা টুলে? কারও সঙ্গে কথা বলবে?’
‘আমাকে দেখে তোমার মনে হচ্ছে যখন-তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ব?’ সুন্দরীর বিরস কথা শুনে হতাশ হয়েছে রানা।
‘না, ঠিক তা মনে হচ্ছে না। তবে তুমি যেন বড়বেশি শান্ত, মিস্টার রানা।’ ঘাড় ফিরিয়ে তিন ভূপাতিত দেহ দেখল জেসিকা। এইমাত্র নড়েছে ববি ম্যাককার্টার। উঠে বসতে গিয়ে বিশ্রীভাবে গুঙিয়ে উঠল। ‘ববি বনবাদাড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেই ওকে গ্রেফতার করতে হবে,’ বলে যুবকের দিকে চলল জেসিকা। ‘তুমি এখান থেকে নড়বে না, মিস্টার রানা।’
‘তোমার কি সাহায্য লাগবে?’ জানতে চাইল রানা।
হাঁটার গতি না কমিয়ে মাথা নাড়ল জেসিকা। বসে বসে ড্রিঙ্ক শেষ করো। আমার কাজ ফুরালে কিছু বিষয়ে জানতে চাইব।’
‘আগেই বলেছি, ড্রিঙ্ক শেষ হয়নি আমার,’ বলল রানা। বসে পড়ল টুলে। হাতে নিয়েছে উইস্কির গ্লাস। এদিকে ববি ম্যাককার্টারের সামনে পৌঁছে গেছে জেসিকা থমসন। মহিলা পুলিশ অফিসাররা নিজের চেয়ে শক্তিধর কারও বিরুদ্ধে সাহসিকতা দেখালে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না রানা। এই মুহূর্তে তা-ই করছে জেসিকা। আইনের ধারা বলে নেয়ার পর ম্যাককার্টারকে জানাল, তাকে গ্রেফতার করছে সে। হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে হাতকড়া নিয়ে আটকে দিল যুবকের দুই কবজিতে। কখনোই দায়িত্ব এড়িয়ে যায় না ভাল পুলিশ অফিসার। রানার ধারণা হলো, জেসিকার হাতব্যাগে আছে এক্সটেণ্ডেবল ব্যাটন আর মরিচের স্প্রে। ম্যাককার্টারকে গ্রেফতার করার পর এল মিচ ম্যাকডোনাল্ডের পালা। তবে এখনও চেতনা ফেরেনি তার। ফোন বের করে কয়েক জায়গায় কল দিল জেসিকা। এত নিচু গলায় কথা বলেছে, কিছুই শুনতে পেল না রানা। আন্দাজ করল, পুলিশ ব্যাকআপ চেয়েছে মেয়েটা। এ ছাড়া, হাসপাতালে কল করেছে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে। দীর্ঘশ্বাস চাপল রানা। শহর থেকে এত দূরের গ্রামে পুলিশ এবং অ্যাম্বুলেন্স আসতে হয়তো বহুক্ষণ লাগবে।
একটু পর খুলে গেল পাবের দরজা। একরাশ তুষার কণা সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকল মধ্যবয়সী এক দম্পতি। ভাঙা টেবিল, গ্লাস, বোতল দেখার পর তাদের চোখ পড়ল মেঝেতে শুয়ে থাকা তিন যুবকের ওপর। অবাক হয়ে মাথা নাড়ল তারা। ওই তিন যুবক মারামারিতে জড়িয়ে গেছে, তা জানাল কনস্টেবল জেসিকা। এখন সে অপেক্ষা করছে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কলিগদের পৌঁছে যাওয়ার জন্যে। রানার কথা তুলল না সে। এদিকে মেঝে পরিষ্কারে নেমেছে বারমেইড লিলি। মাঝে মাঝে মুখ তুলে রানাকে দেখে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
জেসিকা যে টেবিলে বসেছিল, সেখানে আছে ধূসর চুলের এক যুবক। কফি শেষ করে নীরবে পাব ছেড়ে চলে গেল সে। আগে একবার হাত নেড়েছে জেসিকার উদ্দেশে।
আরও আধঘণ্টা পর পাবের মালিকদের সঙ্গে কথা বলল কনস্টেবল, এমনসময় বাইরে দেখা গেল নীল আলো। কয়েক মুহূর্ত পর পাবে ঢুকল ইউনিফর্ম পরা তিন পুলিশ অফিসার। ঘাড়ে-কাঁধে খুশকির মত তুষারের সাদা কণা। প্রায় একইসময়ে পৌঁছে গেল অ্যাম্বুলেন্স। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকল দু’জন প্যারামেডিক, হাতে হালকা স্ট্রেচার।
এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে মিচ ম্যকাডোনাল্ডের। তার দুই বন্ধুও সচেতন। হাতে হ্যাণ্ডকাফ আটকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের। হাউমাউ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তারা। কোনও দোষ নেই তাদের! ‘ওই বাদামি শুয়োরের বাচ্চাটাকে গ্রেফতার করেন! ওই শালাই তো আমাদেরকে মেরে ফেলতে চেয়েছে!’
পুলিশ ম্যাকডোনাল্ডকে গ্রেফতারের আগে ভালমত তাকে পরীক্ষা করল দুই প্যারামেডিক, তারপর হাতকড়া পরিয়ে দেয়ার পর তুলে নিল নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে। ম্যাকডোনাল্ডের দুই বন্ধুকে তোলা হলো আলাদা দুই পুলিশের গাড়িতে। অন্য তিন পুলিশের সঙ্গে বাইরে গেল জেসিকা। জানালা দিয়ে রানা দেখল, পুলিশের একটা গাড়ির সামনের সিটে বসে কী যেন পড়ছে মেয়েটা। কয়েক মিনিট পর গাড়ি থেকে নেমে এল। রানা বুঝে গেল, ন্যাশনাল ক্রাইম ডেটাবেস ঘেঁটে ওর ব্যাপারে তথ্য খুঁজছিল সে। তবে তাতে লাভ হয়নি। ব্রিটেনে ওর অপরাধের কোনও রেকর্ড নেই। এমআইসিক্স-এ যেসব তথ্য আছে, তা জানতে হলে লাগবে হাই-লেভেল অফিশিয়াল ক্লিয়ারেন্স। যেটা রূপসীর নেই।
তুষারভরা পথে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্ম পরা পুলিশদের সঙ্গে কী যেন আলাপ করল জেসিকা, তারপর গাড়িতে চেপে ছাতের নীল বাতি জ্বেলে রওনা হলো তিন অফিসার। আবারও পাবে এসে ঢুকল মেয়েটা। চুল ও পোশাক থেকে ঝেড়ে ফেলল তুষারের কণা। ফিরল কাউন্টারে রানার কাছে। এতক্ষণ পাবের ক্ষতির খতিয়ান নিয়ে ব্যস্ত ছিল মালিক পক্ষ। এবার স্টাফ ওনলি লেখা এক দরজা খুলে ওদিকে উধাও হলো তারা। নিজেও কোথায় যেন গেছে ললিপপ লিলি। পাব এখন খোলা না বন্ধ, বুঝবার উপায় নেই। বাইরে আগের চেয়েও জোরে তুষার পড়ছে। সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ এখন বাড়ি ছেড়ে পাবে এসে মদ্যপান করবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানার পাশের টুলে বসল জেসিকা। ‘ব্যস, আপাতত কাজ শেষ। এখন আবারও ছুটি।’
‘তোমাকে অফার করতাম, কিন্তু ড্রিঙ্ক দেবার মত কেউ নেই,’ বলল রানা।
‘বলার জন্যে ধন্যবাদ। তবে আমি ড্রিঙ্ক করি না।’
‘তুমি না বলেছিলে আরও কিছু প্রশ্ন আছে?’
‘ওটা বলার দায়িত্ব ছিল, তাই বলেছি। তুমি চাইলে চলে যেতে পারো।’
জানালার ওদিকে তাকাল রানা।
আরও বেড়েছে তুষারপাত।
উইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে জেসিকাকে বলল রানা, ‘আপাতত বেরোতে পারব না। কাজেই ইচ্ছে করলে যে- কোনও বিষয়ে জানতে চাইতে পারো।’