1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ১৫

পনেরো

রানার দু’কাঁধে দ্বিতীয়বার জোরালো চাপ দিয়ে ওর পাশেই থামল দানব। কাউন্টারে রাখল সাদা দাগে ভরা কর্কশ দুটো মুঠো। যুবক আগেও বহুবার হাতাহাতি লড়াই জিতে নাম ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে, বুঝল রানা। ভাঙা নাকটা বলে দিচ্ছে কখনও কখনও প্রতিপক্ষের মারও খেয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সে শতভাগ আস্থাবান। ভাবছে, তেড়িবেড়ি করলে পিটিয়ে চুরচুর করে দিতে পারবে রানার প্রতিটা হাড়গোড়। কঠোর চোখে আবারও ওকে দেখল সে। পরক্ষণে ভুরু কুঁচকে তাকাল বারমেইড লিলির দিকে। ‘শোনো, মেয়ে, যার-তার সঙ্গে যা-খুশি ফালতু, চুতিয়া আলাপ জুড়বে না!’

রানা ঠিক করল আপাতত চুপ করে থাকবে।

যুবকের কথায় রেগে গেছে লিলি। পাল্টা উত্তপ্ত স্বরে বলল, ‘তুমি নিজেই বরং নিজের ফালতু প্যাচাল বাদ দাও, মিচ ম্যাকডোনাল্ড! আমি কার সঙ্গে কী বলব আর কী বলব না, সেটা কি তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে? তুমি কিন্তু নিজে যেচে পড়ে খামোকা ঝামেলা পাকাচ্ছ!’

সব বলা শেষ হয়নি মিচ ম্যাকডোনাল্ডের। লিলির দিকে সাগরকলার মত পুরু তর্জনী তাক করল সে। কড়া গলায় বলল, ‘ওই রবার্ট উইলসন হারামজাদা যে আসলে চুতিয়া লোক, তুমি ভাল করেই জানো। আর সেজন্যেই তো পা পিছলে পানিতে পড়ে মরে ভূত হয়েছে! আর তার সঙ্গী, মানে ওই পিটার হ্যানন শুয়োরের বাচ্চা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়!’

‘তুমি নিজে যে কী ধরনের পচা গু সেটা কি সবাই জানে না?’ পাল্টা দাঁত খিঁচাল লিলি।

মেয়েটার কথায় যেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভা ফুটতে শুরু করেছে দানবের বুকে। এবার কী ঘটবে, চট্ করে বুঝে নিল রানা।

ষাঁড়ের মত বিকট এক চিৎকার ছাড়ল ম্যাকডোনাল্ড: ‘কুত্তীর বাচ্চি! খবরদার! আমার ব্যাপারে মুখ সামলে কথা বলবি!’ কথা শেষ করেই ডানহাতে লিলির বুক লক্ষ্য করে প্রচণ্ড এক ঘুষি চালাল সে।

পিছিয়ে গিয়ে মোক্ষম ঘুষিটা এড়াতে চাইল মেয়েটা। তবে ইতোমধ্যেই টুল থেকে নেমে পড়েছে মাসুদ রানা। এবং পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়েই খপ্ করে ধরে ফেলেছে ম্যাকডোনাল্ডের হাতের বুড়ো আঙুল। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড এক মোচড় দিয়ে কবজির উল্টোদিকে নিয়ে গেছে ওটাকে। অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক একটা জুডো লক। তীব্র ব্যথায় চমকে গেছে দানব। মুখ চিরে বেরোল চাপা আর্তনাদ। ছোটাতে চেষ্টা করলে মট্ করে ভাঙবে বুড়ো আঙুল। সরে গিয়ে ব্যথা কমাতে চাইল সে। তবে কবজির ওপর চাপ আরও বাড়াল রানা। সহজ কৌশল হলেও যার ওপর প্রয়োগ করা হয়, তার মনে হয় স্রেফ খুন হয়ে গেছে সে। দানবটাকে আটকে রাখতে রানা ব্যবহার করেছে মাত্র দুটো আঙুল। গাধাটার মগজ বলে কিছু থাকলে সেটায় এখন ধরে গেছে দাউ-দাউ আগুন!

‘মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে হয় না, নরম সুরে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল রানা। ‘ওটা ভদ্রলোকের কাজ নয়। তোমার মা এই কথাটা শেখায়নি, ম্যাকডোনাল্ড?’

আঙুলের ব্যথায় পাবের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে দানব। শূন্যে তুলে রাখা হাতটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। বিচি কেটে নেয়ার সময় খাঁচার ভেতর যেভাবে গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ ছাড়ে বলদ, তার গলা চিরে বেরোচ্ছে তেমনি গ্যা- গ্যা আওয়াজ। গোল টেবিলের চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল তার দুই বন্ধু। বন্ধুর সাহায্যে ছুটে আসবে এখুনি। চোখের কোণে তাদেরকে দেখছে রানা। দুই ষণ্ডার একজন টেবিলের পাশে বাড়ি মেরে ঝনঝন করে ভাঙল হাতের পাইণ্ট গ্লাসের এক অংশ। এবড়োখেবড়ো কাঁচের ছোরাটা রানার দিকে তাক করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘ওর হাত ছাড়, বাদামি কুত্তার বাচ্চা!’

‘লিলির সঙ্গে আলাপ করছিলাম,’ বলল রানা মৃদুকণ্ঠে, ‘তোমাদের বন্ধুকে নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব, ভাই। তবে মেয়েটার সঙ্গে খুব বাজে ভাষায় কথা বলেছে বলে আগে মাফ চাইতে হবে ওকে। তারপর চুপচাপ চলে যাবে এই পাব ছেড়ে।’

‘গ্লাসটা টেবিলে রাখো, ববি ম্যাককার্টার!’ চিৎকার করে উঠল লিলি। সত্যিই সাহস আছে মেয়ের। ওর কথা না শুনে বন্ধুকে উদ্ধার করতে এগোল তারা দু’জন। ঠিক করেছে বারের কাছে পৌঁছে দু’পাশ থেকে হামলা করবে রানার ওপর। রণকৌশলে ভুল নেই। দু’দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুষির পর ঘুষি মেরে রানাকে মেঝেতে ফেলবে। আর একবার পড়ে গেলে উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে না রানা। তার ওপর একজনের হাতে এখন ধারাল কাঁচের ছোরা। ওই যুবকের ভাবসাব দেখে রানা বুঝে নিল, ওটা ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না সে।

স্কটল্যাণ্ডে পা দিয়ে প্রথমদিনেই ঝামেলায় জড়াবে, ভাবতে পারেনি রানা। তবে বিষয়টাকে এখন আর হালকাভাবে দেখার উপায় নেই।

‘কিছু ভাঙচুর হলে আমি সত্যিই দুঃখিত হব,’ নিচু গলায় লিলিকে বলল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখল মেয়েটা। ‘কোথায় আবার কী ভাঙবে?’

রেলগাড়ির মত ধেয়ে এল দুই যুবক। ডানে ম্যাককার্টার, ‘হাতে কাঁচের ছোরা। বামদিক থেকে হামলা করবে তার সঙ্গী। পাকিয়ে ফেলেছে দু’হাতের মুঠো। পাগলা কুত্তার মত ঠোঁট সরে বেরিয়ে এসেছে ওর দাঁত ও মাড়ি। একইসময়ে ম্যাকডোনাল্ডের আটকে রাখা হাতে মোচড় মেরে তাকে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে ঠেলল বামের যুবকের দিকে। গতি আর কিছুটা বাড়াবার জন্যে একটা লাথিও লাগিয়ে দিল ওর বিশাল পাছায়। আড়াই শ’ পাউণ্ডের দেহটা নিয়ে দক্ষ রাগবি প্লেয়ারের মত সরাসরি দোস্তের ওপর চড়াও হলো ম্যাকডোনাল্ড। তার ওজন বন্ধুর চেয়ে ঢের বেশি। ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে বৃত্তাকার টেবিলের ওপর চিত হয়ে পড়ল তার দোস্ত। দু’জনের ওজনে ধসে গেল টেবিল। চারদিকে ছিটকে উঠল বিয়ার, উইস্কি। মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভাঙল কাঁচের গ্লাস। এতক্ষণ সঙ্গীদের কাণ্ড দেখছিল দলের অন্যরা। লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে সরে গেল তারা। লড়াইয়ে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখা গেল না কারও ভিতর

ওদিকে ম্যাককার্টারের দিকে পুরো মন দিয়েছে রানা। একসেকেণ্ড পর পাশ থেকে এসে পাইন্ট গ্লাসের এবড়েখেবড়ো ছোরা চিরে দেবে ওর পেটের মাংসপেশি।

কী করবে ভাবতে গিয়ে হাতে আধসেকেণ্ড মত সময় পেয়েছে রানা। অতি প্র্যাকটিসের ফলে ওর ওই আধসেকেণ্ড সময় সাধারণ মানুষের দশ মিনিটের সমান। এরই ভেতর ঝালিয়ে নিয়েছে কীভাবে যুবককে গিলিয়ে দেবে ভাঙা গ্লাস। অবশ্য বুঝতে পারছে, সেটা উচিত হবে না। এখানে যেমন বন্ধুত্ব করতে আসেনি ও, তেমনি বাধ্য না হলে কাউকে খুন করারও ইচ্ছে নেই। তা ছাড়া, গ্রেফতার হলে ক্ষতি হবে জরুরি কাজের।

ম্যাককার্টার কাছে আসতেই বিদ্যুদ্বেগে তার সামনে থেকে সরে গেল রানা। বাড়িয়ে রেখেছে বাম পা। বেমক্কা ল্যাং খেয়ে ভাঙা গ্লাস সামনে বাড়িয়ে ধরে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল যুবক। মেঝেতে পড়ে কয়েক ডিগবাজি খেয়ে ঠন-ঠনাৎ আওয়াজে দূরে চলে গেল গ্লাসটা। ববি ম্যাককার্টার ময়দাভরা বস্তার মত ধুপ করে পড়েছে বলে মেঝে থেকে ছিটকে উঠল ধুলো। ভারী পতনে কেঁপে গেছে পাবের মেঝে। ছাতের বিম থেকে ঝরঝর করে ঝরল কিছুটা ধুলোবালি।

এদিকে আবারও লড়তে তৈরি হয়েছে মিচ ম্যাকডোনাল্ড। দাঁতে দাঁত পিষে চাপা গর্জন ছেড়ে রানার দিকে ছুটে এল সে। দক্ষ কোনও লড়াকু লোকের বিরুদ্ধে একই কৌশল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করে না রানা। তবে এতদিন স্রেফ গায়ের জোরে জিতে গেছে লোকটা। তাকে উপযুক্ত যোদ্ধা বলে মনে হলো না ওর। তাই কাউন্টারে পিঠ ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। খ্যাপা গণ্ডারের মত তেড়ে এল ম্যাকডোনাল্ড। পাকিয়ে ফেলেছে দু’মুঠো। ভাবছে, ঘুষির পর ঘুষি মেরে ভর্তা করে দেবে ওর অর্ধেক সাইযের প্রতিপক্ষকে। কিন্তু সে কাছে আসতেই প্রজাপতির মত নাচতে নাচতে সরে গেল রানা। অবশ্য এতটা দূরে গেল না যে খপ করে ধরতে পারবে না দানবের ঘাড়। প্রথম সুযোগেই ওর মোটা গর্দানে সড়াৎ করে একটা রদ্দা মেরে দিল রানা, পরমুহূর্তে ওর বাহারি চুল ধরে হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে এনে কাউন্টারের ওপর ঠুকে দিল গায়ের জোরে। শত বছরের পোক্ত, পুরু ওক কাঠের কাউন্টারে ভয়ঙ্কর গুঁতো দিল দানবের মুখ। কাঠে এতই জোরে লেগেছে, রাইফেল থেকে গুলি বেরোবার মত জোরালো টাশ্ শব্দ হলো। বারের পেছনে রাখা বোতলগুলো নাচের ভঙ্গিতে নড়ে উঠল। পিয়ানো বাজছে যেন টুং-টাং শব্দে। টম অ্যাণ্ড জেরির মার খাওয়া বিড়ালটার মতই কাউন্টারে মুখ ঘষটে পিছলে মেঝেতে উপুড় হয়ে নামল ম্যাকডোনাল্ড, নিশ্চিন্তে বেহুঁশ। একদিকে হেলে গেছে রক্তে ভরা লাল, ফোলা নাকটা, ঠিক যেন ফাটা পাকা টমেটো।

‘এসব জিনিস ভাঙতে পারে, সেই কথাই বলেছিলাম, ‘ দুঃখিত স্বরে লিলিকে জানাল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *