চোদ্দ
ডাবল আর্ম পাবে ঢুকে আঠারো শতকের আবহ দেখতে পেল রানা। বৈদ্যুতিক বাতি ও জুকবক্স ছাড়া পাথুরে দালানের কোথাও কোনও আধুনিকতার ছিটেফোঁটা নেই। ওর মনে হলো, টাইম মেশিনে চেপে সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে গেছে কয়েক শ’ বছর। পাবটা বিশাল এক গুহার মত। চারদিকে ছিটিয়ে আছে কাঠের ভারী ভারী টেবিল ও চেয়ার। বারকাউন্টারটা একপাশে। কাস্টমারদের কারও মুখে নেই হাইল্যাণ্ডের আতিথেয়তার ছাপ। পরিবেশ বিষণ্ন। সবার চোখে রানার প্রতি নীরব প্রশ্ন। ঘরে পাথরের ফায়ারপ্লেসে পুটপুট করে পুড়ছে চ্যালা কাঠ, এ ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই।
ফায়ারপ্লেস ঘিরে ছোট-বড় কটা গোল টেবিলে বসেছে বেশিরভাগ কাস্টমার। তাদের বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশের ভেতর। হাতে সোনালি বিয়ারভরা পাইন্ট গ্লাস। রানার অনুপ্রবেশে থেমে গেছে আলাপ। খালি কিছু চেয়ারের পিঠে ঝুলছে ফ্লিস দেয়া উষ্ণ, ভারী জ্যাকেট। কাউন্টারের ডানের এক টেবিলে বসেছে কালো চুলের এক মেয়ে আর আদা-রঙা চুলের এক যুবক। তাদের হাতের মগ থেকে এঁকেবেঁকে উঠছে বাষ্প। সামান্য দূরে দুই সঙ্গীকে নিয়ে জানালার ধারের আরেক টেবিলে বসেছে পেরেকের মত খোঁচা-খোঁচা চুলের এক যুবক। টেবিল থেকে রানার দিকে তাকাল কালো চুলের মেয়েটা। বাইরে তুষারপাতের দিকে চেয়ে নিজেদের ভেতর আবারও আলাপ জুড়ল তিন যুবক।
কাউন্টারের ওদিকে বিয়ার পাম্পের কাছে টুলে বসে আছে লালচে চুলের এক তরুণী বারমেইড। কোলে মহিলা বিষয়ক ম্যাগাযিন। সামনের টুলে শেয়ালের মত উঁচু চোয়ালের এক যুবক নানান মিষ্টি কথায় পটাতে চাইছে মেয়েটাকে। তবে কিছুই বুঝতে পারছে না এমন ভাব করছে তরুণী।
কাউন্টারের দিকে রানা এগোতেই ম্যাগামিন থেকে চোখ তুলে ওকে দেখল সে। মুখে ফুটল লাজুক হাসি। বড় টেবিল থেকে রানাকে কড়া চোখে দেখছে ক’জন। অবশ্য অস্বস্তিকর কয়েক মুহূর্ত পর আবারও নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলতে লাগল তারা। রানা বুঝে গেল, কেমন আচরণ পাবে এদের কাছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে কাউন্টারে গিয়ে কাঠের টুলে বসে পড়ল। এখানে বন্ধুত্ব করতে আসেনি ও।
হাত থেকে ম্যাগাযিন নামিয়ে রেখেছে বারমেইড। কাছ থেকে দেখে রানা বুঝল, সে তরুণী নয়। মহিলার বয়স হবে কমপক্ষে আটাশ থেকে বত্রিশ। মুখে কড়া মেকআপ। রুপার কণার মত চিকচিকে চুমকি চোখের পাপড়িতে। লাজুক হাসিটা মুখে ধরে রেখে জানতে চাইল রানাকে কী পানীয় দেবে।
কাউন্টারের পেছনে কয়েক সারিতে সিঙ্গল মল্ট উইস্কির বোতল। ওদিকে চোখ স্থির হলো রানার। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘তোমার নিজের পছন্দমত একটা কিছু দাও। ডাবল আউন্স।’
হাসিমুখে কাজে নামল বারমেইড। একমিনিট পেরোবার আগেই রানার সামনে রাখল উইস্কির গ্লাস। এতক্ষণ মেয়েটাকে পটাতে চেয়েছে যে যুবক, বিষনজরে রানাকে দেখল সে। বিল মিটিয়ে দিল রানা। তোয়াক্কা করছে না কারও মুডের। চট্ করে বুঝে গেছে, ওর জন্যেই শেয়ালের প্রতি আকর্ষণ ছুটে গেছে বারমেইডের। একটু পর মহাবিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে টুল ছেড়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে গেল যুবক।
কাউন্টারে দুই কনুই রেখে সামনে ঝুঁকল বারমেইড। কৌশলী পদক্ষেপ। রানা দেখতে পেল তার বুকের গভীর গিরিখাদ ও দু’পাশের শ্বেতশুভ্র দুই পাহাড়ী ঢাল। ভদ্রলোকের মত চোখ সরিয়ে যুবতীর চোখে তাকাল রানা। অস্বস্তিকর খসখসে স্বরে মেয়েটা বলল, ‘আপনি এদিকের নন।’ কণ্ঠে রয়েছে চাপা আমন্ত্রণ।
তথ্য সংগ্রহের সুযোগটা হাতছাড়া করল না রানা। নিচু গলায় বলল, ‘না, এদিকের নই। এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রিঙ্কের জন্যে থেমেছি।’ ওর কথা শুনে হতাশ হয়েছে বারমেইড। এবার আরেকটু যোগ করল রানা, ‘তবে তার আগে দেখা করব ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে।’
‘ও, তাই? আমি তো কিনলোকার্ড গ্রামের সবাইকে চিনি।’ চোখ টিপল বারমেইড। ‘সে কি আপনার বান্ধবী?’
‘না, বিষয়টা ঠিক তেমন নয়,’ বলল রানা।
গোল টেবিল থেকে কাউন্টারের সামনে এসে থামল এক যুবক। পাইণ্ট গ্লাস বারমেইডের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, ‘আবারও একই জিনিস, ললিপপ লিলি।’ যুবক ভালুকের মত ভারী গড়নের। বয়স রানার সমানই হবে। দৈর্ঘ্যে অন্তত ছয় ফুট চার ইঞ্চি। মাথায় কালো, উঁচু, কোঁকড়া, বাহারি চুল খাড়া হয়ে থাকার আরও লম্বা লাগে। বারকয়েক ভেঙেছে নাকের হাড়। তার ঘাড় ও কাঁধের শক্তিশালী পেশি দেখে রানা বুঝল, এই লোক নিয়মিত ভারোত্তোলন করে। গুটিয়ে কনুইয়ের কাছে তুলেছে শার্টের হাতা। আগুনের মত লাল উল্কি দেয়া বাহুর পেশি বাড়ন্ত ওক চারার মতই পুরু। চুপচাপ স্কচ উইস্কিতে চুমুক দিল রানা। দানবীয় যুবকের জন্যে গ্লাসে বিয়ার ভরল ললিপপ লিলি। কাউন্টারে পয়সা রেখে রানাকে একবার বিরক্ত চোখে দেখে নিয়ে গোল টেবিলে ফিরে গেল দানব। বসার সময় করুণ ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ ছাড়ল বয়স্ক চেয়ারটা।
আবারও রানার দিকে ফিরল লিলি। কাউন্টারে দুই কনুই রেখে ঝুঁকে এল শ্বেত পর্বতের শোভা দেখাতে। চোখে আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘তো কোথা থেকে এসেছেন আপনি?’
গ্রাম্য এলাকার মেয়ে, কমই দেখেছে বাইরের মানুষ। বিয়ের বয়স হয়েছে। অথচ গ্রামে নেই উপযুক্ত পাত্র। ‘আমি আপাতত লণ্ডনে আছি,’ বলল রানা।
‘কিন্তু আপনি তো ইংরেজ নন, তাই না?’
‘ঠিকই ধরেছ। আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে।’
‘ব্যাংলাডিশ?’
‘এশিয়ার ছোট্ট একটা দেশ। ইণ্ডিয়ার একপাশে।’
‘এখানে কত দিন থাকবেন?’ উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল লিলি।
‘বন্ধুকে খুঁজে পেলেই চলে যাব। মনে হয় তাতে বেশি সময় লাগবে না। ধরো আছি এক কি দুই দিন।’
‘খুব দুঃখজনক,’ বলল লিলি, ‘আমাদের দেশটা খুব সুন্দর। সময় হলে ঘুরে দেখতে পারতেন। আমি নিজেই আপনাকে অনেক কিছু দেখাতে পারতাম।’
গোপন ইঙ্গিতটা পেয়েও চুপ থাকল রানা।
‘তো আপনার বন্ধু কি এই গ্রামেরই কেউ?’
‘না। সে এসেছে একটা জরুরি কাজে। নাম বেন হ্যানন। এই গ্রামের পিটার হ্যাননের চাচা সে। তুমি হয়তো চেনো পিটারকে?’
লালচে চুল ঝাঁকিয়ে মাথা দোলাল লিলি। ‘হ্যাঁ, ওকে চিনি। শুনেছি বেচারা এখন আছে হাসপাতালে। ওর কোনও খবর জানেন? সেরে উঠছে নিশ্চয়ই?’
‘ঠিক জানি না,’ বলল রানা, ‘আমার বন্ধু এদিকেই এসেছে শুনে ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। তবে এখন মনে হচ্ছে ভুলই করেছি। লিলি, গত কয়েক দিনের ভেতর আমার বন্ধু কি তোমাদের পাবে ড্রিঙ্ক করতে এসেছে? বয়স্ক লোক। আমার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো। টেনে রাখা গিটারের তারের মত টানটান শরীর। চুল-দাড়ি ধূসর রঙের। কথা বলে গ্লাসগোর টানে।
দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়ল লিলি। ‘মনে তো হয় না তাকে দেখেছি। ওই চেহারার অনেক বয়স্ক লোকই তো আসে আমাদের পাবে। সবার কথা মনেও রাখতে পারি না। তবে নতুন কাউকে এর ভেতর দেখিনি।’
ওর ছবিও আছে আমার কাছে, তুমি কি ওটা দেখে বলে দেবে এদিকে কখনও দেখেছ কি না,’ বলল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল বারমেইড। ‘দেখতে তো অসুবিধে নেই! তবে জানি, এখানে আসেনি সে।
কপাল খুলবে না ভাবলেও স্মার্টফোন বের করে ইমেজ ফোল্ডারে গেল রানা। বেনের ছবি কয়েক বছর আগের। ইতালিতে তোলা। তেমন বদলে যায়নি প্রাচীন যোদ্ধা। তাকে কোথাও দেখে থাকলে চিনবে লিলি। স্মার্টফোন কাত করে তাকে ছবি দেখাতে চাইল রানা। একগোছা চুল আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে আরও সামনে ঝুঁকল মেয়েটা। তবে ইমেজ স্টোর করা হয়েছে সদ্য তোলা ছবির তারিখ অনুযায়ী। স্ক্রল করে নিচের ছবির দিকে যেতে হবে রানাকে। ওর গালে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে লিলির তপ্ত শ্বাস।
প্রথম ইমেজ দেখেই আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটা। ছবিটা সোনার মোহরের। ওই ছবি ইতালিতে মিরাণ্ডার ই-মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছিল পিটার। একটু থমকে গিয়ে বলল লিলি, ‘আমি তো এটা চিনি। আপনি কোথায় পেলেন হারিয়ে যাওয়া কয়েনের ছবি?’
বিস্ময় নিয়ে তাকে দেখল রানা। ‘একটু খুলে বলবে?’
‘এই জিনিস তো প্রতিদিন দেখা যায় না,’ লাল নেইল পালিশমাখা দীর্ঘ তর্জনীর নখ দিয়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে টোকা দিল লিলি। ‘এই ছবি আসলটার মতই মনে হচ্ছে।’
‘আগে এই জিনিস দেখেছ?’ জানতে চাইল রানা।
বিদ্যুৎস্পর্শে যেন ঝট করে সামান্য পিছিয়ে গেল মেয়েটা। নিচু গলায় বলল, ‘কয়েক দিন আগের কথা। আপনার এই একই টুলে বসেছিল সে।’
‘কার কথা বলছ?’
জবাব দেয়ার আগে দ্বিধায় পড়ল মেয়েটা, তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আর কে, রবার্ট উইলসন।
‘উইলসন? মানে পানিতে ডুবে মারা গেছে যে যুবক?’
চোখে বিষাদ নিয়ে মাথা দোলাল লিলি। ‘আপনি তা হলে ওই দুর্ঘটনার কথা শুনেছেন? স্কটল্যাণ্ডের গ্রামে এসব খবর তো আন্তর্জাতিক নিউযের মতই আলোড়ন তৈরি করে। খুব দুঃখজনক মৃত্যু। রবার্ট উইলসনকে ভাল করে না চিনলেও খুব খারাপ লেগেছে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে।’ কয়েক মুহূর্ত – ভাবল মেয়েটা, এরপর আরও নিচু গলায় বলল, ‘অনেকে বলছে আত্মহত্যা করেছে। আমি অবশ্য তা বিশ্বাস করি না। যে রাতে ড্রিঙ্ক করতে এল, খুশিতে ঝলমল করছিল ওর চোখ-মুখ। ওই মানুষ আত্মহত্যা করবে, সেটা ভাবাই যায় না।’
‘অর্থাৎ, কয়েক রাত আগে এখানে এসেছিল উইলসন?’ বলল রানা। ‘তার কাছে ছিল ছবির এই কয়েনের মত সোনার মুদ্রা? এটাই কি বোঝাতে চাইছ?’
মাথা দোলাল লিলি। ‘মারা যাওয়ার দু’চার দিন আগের কথা। আর তারপর তো মরেই গেল। আরও একটু আগের কথাও হতে পারে। ঠিক মনে নেই।’
‘তো তুমি নিজের চোখে দেখেছ এরকম একটা কয়েন?’
‘নিজেই দেখিয়েছে আমাকে রবার্ট,’ গম্ভীর দৃষ্টিতে রানাকে দেখল লিলি
এই মেয়ে মিথ্যা বলছে না, বুঝল রানা। এবার জানতে চাইল ও, ‘ওটা তোমাকে দেখাল কেন?’
‘আসলে খুশিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। বারবার বলছিল, বড়লোক হয়ে গেছে। কোটি কোটি পাউণ্ডের গুপ্তধন পেয়ে গেছে। এবার নাকি এই জঘন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে ইতালি বা ফ্রান্সে। সৈকতের ধারে বাড়ি কিনবে। আর কখনও ফিরবে না। আরও বলেছিল, চাইলে আমিও যেতে পারি। তবে বিশ্বাস করিনি ওর কথা। আনমনে কী যেন ভেবে নিয়ে বাস্তবে ফিরল লিলি, ‘এরপর তো মরেই গেল সে।’
‘উইলসন কি মাত্র একটা কয়েন দেখিয়েছে?’
মাথা দোলাল লিলি। ‘হ্যাঁ, মাত্র একটাই। তবে বলেছিল, কোথায় যেন লুকানো আছে বস্তা বস্তা সোনার কয়েন। ওর কথা শুনে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ‘রবার্ট উইলসন, তুমি কি তা হলে সত্যিই সোনার গুদামের খোঁজ পেয়ে গেলে?’
‘জবাবে রবার্ট কী বলেছিল?’
‘হাসতে হাসতে বলল, মরে গেলেও কাউকে বলবে না। অথচ, নিজেই পাবের ভেতর মাতাল হয়ে সবার সামনে বোকার মত বকবক করছিল।’
বেনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া সোনার মোহরের ছবি জরুরি সূত্র, তবে এখন তার চেয়েও জরুরি তথ্য পাচ্ছে রানা। বুঝতে পারছে, ওই সোনার জন্যেই খুন হয়েছে রবার্ট। ক্রমেই আরও জটিল হয়ে উঠছে রহস্যটা। মাত্র একটা কয়েনের জন্যে জানা গেছে এদিকেই কোথাও আছে গুপ্তধন। লিলির কথা ঠিক হলে, শুধুমাত্র রবার্ট জানত ওগুলো কোথায় পাওয়া যাবে। এসব সম্পর্কে কিছুই জানত না পিটার। তবে বন্ধুর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই পেয়ে গেছে একটা বা দুটো সোনার মোহর।
রানার মনে জন্ম নিয়েছে একগাদা প্রশ্ন। তবে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। কাঁধে চেপে বসেছে ভারী দুটো হাত। ভীতিকর গমগমে কণ্ঠে বলল কেউ, ‘উইলসনের ব্যাপারে কীসের এত জিজ্ঞাসাবাদ তোমার, স্ট্রেঞ্জার? আসলে কে তুমি?’
ঘাড় ফেরাল রানা। পেছনে এসে থেমেছে বাহুতে আগুনের উল্কি আঁকা সেই বিশাল দানব। তাকে খুব অসন্তুষ্ট বলেই মনে হলো ওর।