বারো
দু’দিন পর।
রানা এজেন্সি, লণ্ডনের পিকাডেলি।
ভোরে দোতলার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ঘুম ভাঙতেই হাত- মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে গেল রানা। জগিং সুট পরে নিয়ে ঝাড়া দেড় শ বৈঠক ও দেড় শ’ বুকডন দিল, তারপর ফ্ল্যাটের দরজায় তালা মেরে নেমে এল নিচের রাস্তায়। ঢ্যাঙা ল্যাম্পপোস্টে উজ্জ্বল বাতি জ্বললেও ওটার চারপাশে বিরাজ করছে ধূসর কুয়াশার মেঘ। দৌড় শুরু করে পঁয়ত্রিশ মিনিটে সাত মাইল ছুটে আবারও রানা এজেন্সির সামনে ফিরে এল। ততক্ষণে ফর্সা হয়ে এসেছে আকাশ। স্নান সেরে নেয়ার সময় রানা টের পেল, খিদেয় জ্বলছে ওর পেটটা। আর সেজন্যেই মনে পড়ল যশোরের সেই স্নেহময়ী বৃদ্ধার কথা। ওর বুক চিরে বেরোল দীর্ঘশ্বাস। লণ্ডনে কোথায় পাবে রাঙার মা-র রেঁধে দেয়া রাজকীয় বাঙালি খাবার!
শাওয়ার সেরে ভদ্রস্থ হয়ে ডাইনিংরুমে ফ্রি থেকে ছয় স্লাইস পাউরুটি নিল রানা। ওকে বড়ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করে রানা এজেন্সির রিসেপশনিস্ট মিতু রায়। গতকাল অফিস ছুটি হওয়ার পর, প্রায় জোর করেই রেঁধে দিয়ে গেছে ছয়টা স্ক্র্যাম্বু এগ, রোস্টেড হাফ চিকেন, এক প্লেট বিফ চিলি ও শসা-টমেটো-লেটুস পাতা আর গাজরের সালাদ। ফ্রি থেকে রানা আরও বের করল আস্ত একটা কাগজি লেবু চিপে দেয়া এক গ্লাস নোনা শরবত। ওজন যেন না বাড়ে, তাই ক’দিন হলো বাদ দিয়েছে লোভনীয় ক্রাফ্ট্ পনির। টোস্টারে পাউরুটিগুলো মচমচে করে টোস্ট তৈরি করে তার ওপর পুরু করে মাখাল আন-সল্টেড লারপ্যাক বাটার।
আজ শনিবার। কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই ওর।
চুপচাপ আজকের বরাদ্দ নাস্তা সেরে নিতে নিতে রানা ভাবল: বিসিআই হেডকোয়ার্টার বা রানা এজেন্সির অফিসে বসতে কখনোই ভাল লাগে না ওর। সবসময় মন চায় দারুণ কোনও অ্যাসাইনমেণ্টে জড়াতে। অথচ দু’সপ্তাহ হলো ফোন করেননি বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। আসলে দেয়ার মত কাজ নেই তাঁর হাতে। নইলে ডেকে নিতেন।
খাওয়ার পর বুদ্ধের ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল রানা বিছানার ওপর। তারপর নেমে পড়ল কিচেনের সিঙ্কে প্লেট ধুয়ে নেয়ার যুদ্ধে। কাজটা শেষ হলে বিরক্ত চেহারায় গিয়ে বসল ড্রয়িংরুমের সোফায়। সামনের দেয়ালে আটচল্লিশ ইঞ্চি টিভিটা চালু করল। স্ক্রিনে বিবিসি নিউয। লণ্ডনের তুষারে ছাওয়া হাইওয়েতে হাইস্পিডে ভয়ানক দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে ছয়টা গাড়ি। মোটমাট মৃত্যু ঘটেছে বারোজনের। আহত তিনজন এখন হাসপাতালে ভর্তি। রানার মনে পড়ল বাংলাদেশের কথা। সেখানে অস্বাভাবিক হিড়িক চলছে অদক্ষ ড্রাইভারদেরকে লাইসেন্স দেয়ার। ফলে যা ঘটার তাই ঘটছে: মারাত্মক সব দুর্ঘটনা। করুণ মৃত্যুর খবরে তিক্ত হয়ে ওঠে মন। অথচ, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ সতর্ক হলে কাঁচা ড্রাইভাররা যেমন লাইসেন্স পেত না, তেমনি কখনোই ঘটত না এসব বেশিরভাগ দুর্ঘটনা।
রিমোট কন্ট্রোল টিপে অন্য চ্যানেলে গেল রানা। ওর মেজাজ আরও খাট্টা হলো গণ্ডারের মত দুই কুস্তিগিরের নকল লড়াই দেখে।
পরের চ্যানেল কলকাতার। নাটকে রাজস্থানী মুটকি এক শাশুড়ি আর শুঁটকি এক বাঙালি বউমার ঘন প্যাচাল তিন মিনিট শুনে রানা মনস্থির করে ফেলল, এবার ঠিকই বিক্রি করে দেবে টিভিটা।
এবার কী করা যায় ভাবতে শুরু করেছে, এমনসময় হঠাৎ করেই পাশের সাইড টেবিলে ক্রিং-ক্রিং শব্দে বেজে উঠল ল্যাণ্ডফোন।
জুলজুল করে ওটার দিকে তাকাল রানা।
তবে কি শেষমেশ ডাক এল দেশ থেকে?
ফোন করেছেন ওর চিফ?
নিশ্চয়ই কোনও অ্যাসাইনমেন্ট?
বোধহয় তাই!
বকবক করা টিভি অফ করে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল রানা। ‘হ্যালো?’
‘সালাম কই!’ ওদিক থেকে এল বাজপড়া ধমক। ‘আগে বড় দুলাভাইকে সালাম দিতে হয়, বেয়াদব-বেল্লিক ছোকরা কোথাকার!’
প্রাণপ্রিয় বন্ধু সোহেল। চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ‘চোপ! এবার এমন এক গিরিঙ্গি করে দেব, আগামীকালকেই বাড়ি থেকে নীলার সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দেবে!’
খুক্-খুক্ করে কাশল সোহেল। ‘তবে তোর বোনের কী হবে, বল, শালা?’
‘প্রাণে বাঁচতে চাইলে সরাসরি কাজের কথায় আয়, ভিলেনীয় কর্কশ হাসি হাসল রানা। ‘বুড়ো কি তবে আমাকে ডেকেছেন?’
‘আরে, নাহ্! পুরো দুনিয়াই তো করোনাভাইরাসের ডাণ্ডা খেয়ে ঠাণ্ডা মেরে গেছে। কোনও কাজ নেই অফিসে। প্রতিদিন আড্ডা দিচ্ছি সলীল, জাহেদ, সোহানা… সবাই মিলে।’
‘বুড়ো তা হলে অফিসে বসে মাছি মারছেন?’ কৌতূহলী হয়ে উঠল রানা।
‘তো আর কী, প্রতিদিন ফুঁকছেন বিশটা করে কিউবান চুরুট। উপচে পড়ছে অ্যাশট্রে। মাঝে মাঝেই পুরনো ফাইল আনিয়ে ডেকে নিচ্ছেন আমাকে। আর তারপরই শুরু হচ্ছে ধমক। আমরা কীসব মারাত্মক ভুল করে রেখেছি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।’
‘তুই নিজে সিগারেট ছেড়েছিস?’ জানতে চাইল রানা।
‘করোনার ভয়ে জানেপ্রাণে চেষ্টা করছি ছেড়ে দিতে! এবার দেখবি পেরে উঠেছি! শালার এক শলা বেনসনের দামের কথা ভাবলেই ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়! ওরে, বাপরে!’
‘তো হঠাৎ যে তুই ফোন দিলি?’
‘যাহ্, শালা! বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছি!’
‘কী ভুলেছিস?’
‘দেশে ফেরার সময় এক কার্টন বেনসন এনে দিলে বলতে পারি।’
‘শালা-ঘুষখোর!’
‘তোর বিশ্রী ধমক খেয়ে আবারও সব ভুলে গেলাম!’
‘বিড়িখোর! নিশ্চয়ই আমাকে ফিরতে বলেছেন বুড়ো?’
‘এক কার্টন বেনসন পেলে হয়তো সব মনে পড়বে!’
ষড়যন্ত্রের সুরে বলল রানা, ‘দ্যাখ, এখন বিরক্ত করবি না, সোহেল। আমি সোনালি চুলের অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে খুব বেশি ব্যস্ত।’
‘তা তোর পাশে এখন কে রে?’
‘তোকে বলব কেন? তুই তো সব বলে দিবি তোর বোনকে। দেখ, সোহেল, কথা আরও বাড়ালে স্মার্টফোন দিয়ে’ তোর শুঁটকি পাছায় লাগিয়ে দেব ভার্চুয়াল এক লাথি! পরে দেশে ফিরলে পাবি আসলটা!’
‘তা-ও তো কিছু পাব,’ বিড়বিড় করল সোহেল। ‘বলবি না যখন, তো শোন: পাষণ্ড কোথাকার! বুড়ো বলেছে আপাতত দেশে আসার দরকার নেই। পরে যোগাযোগ করবেন। তোর ছুটি আরও বিশ দিন বাড়িয়ে দিয়েছেন।‘
তোর মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক।’
‘মুখে তো ওসব পড়ে মরার পর খাটিয়ায় রেস্ট নেয়ার সময়। তা-ও নেতা-টেতা হলে। ঠিক আছে, চুপ করে বসে থাক্ লণ্ডনেই। তোর ডাক পড়লে তখন জানিয়ে দেব।’
খুট্ শব্দে কেটে গেল ফোনের লাইন। মাউথ পিসের দিকে তাকাল রানা। ও নিজে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে বলে দমে গেছে সোহেল, নইলে কাঁঠালের আঠার মত লেগে থাকত ব্যাটা।
এবার? –ভাবল রানা।
আবারও টিভির চ্যানেল?
নাহ্!
ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিল রানা। আর তখনই টিট- টিট শব্দে বাজল ওর মোবাইল ফোনের রিং-টোন।
পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ঠেকাল রানা। ‘হ্যালো?’
‘আমি, মিরাণ্ডা, রানা,’ ওদিক থেকে এল ক্লান্ত স্বর।
‘হ্যাঁ, বলুন?’ সোজা হয়ে সোফায় বসল রানা। মন বলছে, কোনও দুঃসংবাদ আছে। নইলে নিজেই ফোন করত বেন হ্যানন। নিয়মিত যোগাযোগ আছে ওদের। দিন দশেক আগেও কথা হয়েছে তার সঙ্গে। কেন যেন ওদিক থেকে কিছুই বলছে না মিরাণ্ডা।
কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা, ‘কী হয়েছে, মিরাণ্ডা?’
‘বেন… ওর বোধহয় খারাপ কিছু হয়েছে,’ ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদতে লাগল মহিলা।
রানার মনে পড়ল স্যাণ্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমির অতীত-স্মৃতি। ওখানেই প্রথমবার কমাণ্ডো ট্রেইনিং নিয়েছিল। ইন্সট্রাক্টর ছিল সার্জেন্ট বেন হ্যানন। কিছু দিনেই সে বুঝে গিয়েছিল, বাঙালি ছেলেটা অন্যরকম। নিজে থেকে সাহায্য করে অন্যদেরকে। খুব চৌকশ। অন্তরটা আবার সোনার মত খাঁটি। নিজের ছেলের মত রানাকে ভালবেসে ফেলেছিল বেন হ্যানন। ফলে সারাজীবনে সামরিক যত জ্ঞান অর্জন করেছে, উজাড় করে দিয়েছিল ওর জন্যে।
প্রশিক্ষণ শেষে যখন দুনিয়ার কয়েকটা দেশ থেকে আসা আড়াই শ’ ক্যাডেট ও এসএএস ফোর্সের ক্যাডেটদের মধ্যে প্রথম হলো রানা, সেই জমকালো পুরস্কার অনুষ্ঠানে খুশিতে কেঁদে ফেলেছিল মানুষটা। রানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘তোমাকে দেয়ার মত আর কিছুই নেই আমার, রানা!’
কয়েক বছর পর মস্ত বিপদে পড়ল মানুষটা। চাকরি গেল অন্যায় অভিযোগে। তার দায়িত্বে থাকা মালখানা থেকে চুরি হয়েছে কয়েক শ’ আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ।
একেবারে ভেঙে গিয়েছিল তার মন।
বিচার শেষে জেল ছিল অবধারিত।
কিন্তু দু’সপ্তাহ পর ডাক পড়ল জেনারেলের অফিসে। জানানো হলো, ধরা পড়েছে আসল চোর। নামকরা এক লর্ডের ছেলে ক্যাপ্টেন জন বেরেসন চুরি করেছে সরকারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্যারিসে চোরাচালানী এক দলের কাছে অস্ত্র বিক্রির সময় তাকে হাতেনাতে ধরেছে স্যাণ্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমিরই প্রাক্তন বাঙালি ক্যাডেট মাসুদ রানা চৌধুরী।
হ্যানন সেদিন বুঝেছিল, বাঙালি ছেলেটা ওকে কোন্ চোখে দেখে। নইলে সাহায্য করত না আগ বাড়িয়ে।
ক’দিন পর চাকরিতে হ্যানন যোগ দেয়ায় ফোনে রানা বলেছিল, ‘খুব ভাল লাগছে সাচ্চা কারও সম্মানের ক্ষতি হয়নি বলে।
জীবনে দ্বিতীয়বার রানার জন্যে কেঁদে ফেলেছিল হ্যানন। বারকয়েক ফুঁপিয়ে উঠে বলেছিল, ‘রানা, তোমার যদি কোনও বিপদ হয়, আর আমি তা জানতে পারি, তোমার জন্যে মরতেও আপত্তি করব না!’
বাস্তবে ফিরল রানা। নরম সুরে জানতে চাইল, ‘আসলে কী হয়েছে, মিরাণ্ডা?’
‘হারিয়ে গেছে… ওকে আর খুঁজে পাচ্ছি না, রানা!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘একদম প্রথম থেকে সব খুলে বলুন, মিরাণ্ডা। কিছুই যেন বাদ না পড়ে।’
কাঁপা গলায় বলতে লাগল বেন হ্যাননের স্ত্রী।
ভাতিজা পিটার বিপদে আছে শুনে সাহায্য করতে স্কটল্যাণ্ডে গিয়েছিল বেন হ্যানন। আগের কথাও জানাল মিরাণ্ডা। কয়েক দিন আগে আরডাইক লকের পানিতে ডুবে মারা গেছে পিটারের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার রবার্ট উইলসন। পিটারের ধারণা হয়েছিল, খুন হয়েছে বেচারা।
ঝড়ের বেগে ইতালিয়ান ভাষায় বলছে মিরাণ্ডা। তাকে বাধা দিল রানা। ‘পিটার কেন ধরে নিল যে খুন হয়েছে তার পার্টনার?’
‘কারণ ওকে ফোন করেছিল এক লোক। সে নাকি নিজের চোখে দেখেছে রবার্টকে খুন হতে।’ প্রায় ফিসফিস করে বলছে মিরাণ্ডা, ‘তাই পিটারকে সাহায্য করতে হাইল্যাণ্ডে গেল বেন। ভেবেছিল খুঁজে বের করবে স্যামন-পোচার লোকটাকে।’
‘যে-লোক ফোন করেছিল, সে স্যামন-পোচার?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু ওখানে গিয়ে বেন জানল, গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে পিটার। রবার্টকে যারা খুন করেছে, তারাই খুব মেরেছে ওকে।’
‘স্থানীয় পুলিশ নিশ্চয়ই এসব জানে?’ জানতে চাইল রানা।
‘হ্যাঁ। তাদের সঙ্গে কথা বলেছে বেন। তবে ওর মনে হয়েছে, ওই দুই কেস নিয়ে কোনও রকম তদন্তই করছে না তারা। তখন বেন ভাবল, নিজেই তদন্ত করবে। তুমি তো জানো, কেমন একগুঁয়ে মানুষ ও। আমাকে বলেছিল, পুলিশকে একপয়সা দিয়েও বিশ্বাস করে না। কথা বলছিল পিটারের বাড়ি থেকে। তখন ওকে বললাম, পিটার ই-মেইল করেছিল ইতালিতে আমাদের খামারে। ওটাই আমার সঙ্গে বেনের শেষ কথা। তারপর থেকে আর ফোন করেনি। ও তো মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। জানি না এখন কোথায় কেমন আছে।’
‘তা হলে ই-মেইল করেছিল পিটার?’
‘হ্যাঁ।’ আরেকবার ফুঁপিয়ে উঠল মিরাণ্ডা। ‘চিঠির সঙ্গে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওই সোনার কয়েন নাকি পেয়েছিল রবার্ট। এর বেশি আর কিছুই জানতে পারিনি।’
সোনার কয়েনের কথায় ভুরু কুঁচকে গেল রানার। আগেও ওই জিনিসের জন্যে খুন হয়েছে বহু মানুষ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল ও, ‘আপনি ছবিটা পাঠাতে পারবেন?’ নিজের ই-মেইল অ্যাড্রেস দিল রানা।
নতুন টেকনোলজির বিষয়ে বেন হ্যাননের চেয়ে অনেক আধুনিক তার স্ত্রী মিরাণ্ডা। ‘এখনই ছবিটা পাঠাচ্ছি।’
একটু পর টিং করে শব্দ পেল রানা। ইনবক্সে এসেছে ই- মেইল। স্মার্টফোনের স্পিকার অন করে ই-মেইল খুলে ছবিটা দেখল। কাছ থেকে তোলা ফোটো। ওই কয়েন যে সোনার, তাতে সন্দেহ নেই। গায়ে খোদাই করে লেখা: ১৭৪৬।
বোঝাই যাচ্ছে, জিনিসটা মূল্যবান, তবে দাম কত, জানা নেই রানার।
‘এটার সঙ্গে বেন, পিটার বা রবার্টের ঠিক কী সম্পর্ক, মিরাণ্ডা?’
‘জানি না তো,’ অসহায় সুরে বলল মহিলা। ‘বেন কিছুই বলেনি। আমার মনে হয়েছিল, ও জানত ওটার জন্যেই খুন হয়েছে রবার্ট। আর পরে মার খেয়েছে পিটার।’
‘বেন এরপর কী করবেন সেটা বলেছিলেন? বা পিটারের বাড়ি থেকে কোথায় যাবেন সেটা জানিয়েছিলেন?’
‘না। শুধু বলল বাড়ি ফিরবে কয়েক দিন পর। আমি যেন চিন্তা না করি। কিন্তু ভয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি, রানা। বেন বলেছিল, প্রতিদিন দু’বার করে ফোন দেবে। ভেবেছিলাম, তখন নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবে কোথায় যাচ্ছে বা কী করছে। কিন্তু এরপর পেরিয়ে গেল পুরো দুটো দিন, যোগাযোগ করল না। আমি খুব ভয়ে আছি, রানা। মনে হচ্ছে চিন্তা করতে করতে মরেই যাব। আর কোনও উপায় না দেখে শেষে ফোন করেছি তোমাকে।’
রানা ভাল করেই জানে, দুনিয়ার সেরা কয়েকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার ভেতর বেন হ্যানন একজন। বয়স হলেও প্রাচীন ওক কাঠের মতই শক্ত। যুদ্ধের সময় শত্রু হিসেবে নয়, নিজ দলে তাকে চাইবে ও। নিজের সম্পর্কে স্ত্রীকে কিছুই বলেনি বেন, নইলে এত ভাবত না বেচারি।
‘মিরাণ্ডা, মনে হয় কোনও বিপদ হয়নি ওঁর,’ বলল রানা, ‘নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে জরুরি কোনও কাজে ব্যস্ত। সঠিক সময়ে ফোন দেবেন। অথবা, দু’এক দিনের ভেতরই ফিরবেন ইতালিতে। এত দুশ্চিন্তা না করাই বোধহয় ভাল।’
‘খুব ভয় লাগছে, রানা,’ বলল মিরাণ্ডা। ‘আমি ছাড়া আর কেউ এটা জানে না। আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিল যেন কাউকে না বলি। ওর হার্টের কণ্ডিশন খুবই খারাপ।’
কথাটা শুনে চমকে গেল রানা। বলল, ‘বেন তো এ ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেননি!’
মিরাণ্ডা দুর্বল স্বরে বলল, ‘কাউকেই বলেনি। অনেক জোরাজুরি করে পেসমেকার লাগাতে রাজি করানো গেছিল।’ ফোঁপাতে লাগল মহিলা।
কী বলবে ভাবছে রানা, এমনসময় আবারও মুখ খুলল মিরাণ্ডা, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম বড় কোনও রোগ হয়েছে ওর। মাঝে মাঝে ফ্যাকাসে হয়ে যেত মুখ। কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই বসে পড়ত মাটিতে। জিজ্ঞেস করলে বলত, কিছুই হয়নি। তবে ছয়মাস আগে স্বীকার করল, খুব ব্যথা হচ্ছে ওর বুকে। তখন জোর করে ধরে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে।’
‘বুঝতে পেরেছি,’ বলল রানা।
‘কিছু টেস্ট করার পর ডাক্তার জানাল, যে-কোনও সময়ে হার্ট অ্যাটাক হবে। অপারেশন খুব জরুরি। কিন্তু কোনও কথাই শুনল না বেন। খুব রেগে গিয়েছিলাম ওর ওপর। জেদ করেও লাভ হলো না। অপারেশন করাবে না। কিন্তু দু’মাস আগে রাজি হলো বুকে পেসমেকার বসাতে।’
এই খবরটা একেবারেই নতুন। ‘গত দু’মাসে অন্তত তিনবার কথা বলেছি,’ বলল রানা। ‘আমার মনে হয়েছিল বেন একটু বেশি ক্লান্ত। তবে একবারও বলেননি অপারেশন করে পেসমেকার বুকে বসাতে হয়েছে।
‘কাউকে বলবে না স্থির করেছিল। তবে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। প্রতিদিন খেতে হয় কড়া সব ওষুধ। ওর কিছুই হয়নি সেটা বোঝাবার জন্যে দ্বিগুণ পরিশ্রম করত। কিন্তু শরীর এখন আর চলে না। একটুতেই হঠাৎ শুরু হয় বুকে ব্যথা। ডাক্তার বলেছেন, পেসমেকার ঠিকঠাক না-ও চলতে পারে। অপারেশনের পরেও রয়ে যেতে পারে অসুস্থতা আর দুর্বলতা। তাই বেন যখন বলল স্কটল্যাণ্ডে যাবে, ওকে অনেক অনুরোধ করেছি যেন ওখানে না যায়। যদি খারাপ কিছু হয় ওর? কিন্তু শুনল না কিছুই। আর তারপর পেরিয়ে গেল পুরো দুটো দিন, একবারও ফোন করল না।’
‘হয়তো জরুরি কাজ,’ বলল রানা। মুখে এ-কথা বললেও কু ডাকছে ওর মন।
‘আমি এরই ভেতর ফোর্ট উইলিয়ামের হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি। ওখানে ভর্তি হয়নি বেন। এখনও ওই হাসপাতালে অচেতন হয়ে পড়ে আছে পিটার। আমার বারবার মনে হচ্ছে, খুব খারাপ কিছু হয়েছে বেনের। পিটারের গ্রাম ওই শহর থেকে বহু দূরে। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা। হয়তো হার্ট অ্যাটাক করে কোথাও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে বেন। কেউ নেই যে সাহায্য করবে। কেউ জানেই তো না ও কোথায় আছে। হয়তো…’ থেমে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল মিরাণ্ডা।
চুপ করে আছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘বেন কোথায় গেছেন সেটা আমাকে জানান, মিরাণ্ডা।’
ইতালিয়ান উচ্চারণে স্কটল্যাণ্ডের গ্রামটার নাম জানাল মহিলা। নোটপ্যাডে টুকে নিল রানা। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, মিরাণ্ডা, যত দ্রুত সম্ভব ওখানে যাচ্ছি। আপনি ফোনের কাছেই থাকবেন। বেনের কাছ থেকে কল এলে দেরি না করে আমাকে জানাবেন। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে, রানা।’
‘জরুরি কিছু তথ্য চাই,’ বলল রানা। ‘যেমন: বেন কি এয়ারপোর্টে নেমে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন?’ বুড়ো যোদ্ধা কোন্ ধরনের গাড়ি বেছে নেবে, ভাল করেই জানে রানা। ওটার রেজিস্ট্রেশন নম্বর পরে কাজে লাগতে পারে। হয়তো রেন্টাল কোম্পানি থেকে কায়দা করে তথ্য বের করতে হবে।
‘ট্রেনে চেপে গেছে বেন,’ বলল মিরাণ্ডা।
পাহাড়ি এলাকার লোকাল রেলস্টেশনে নেমে কয়েক মাইলের ভেতর গাড়ি ভাড়া দেয়ার কোম্পানি পাবে না বেন। ‘তা হলে ট্রেন থেকে নামার পর কী করার কথা ওঁর?’
‘জানি না। সরি।’
‘ওদিকে চেনেন এমন কারও কথা বলেছিলেন বেন? যেমন গ্রামের কেউ? হয়তো ওই লোক পিটারের বন্ধু? বা কোথায় উঠবেন ভেবেছিলেন বেন? হোটেল বা কোনও গেস্টহাউস?’
‘আমাকে কিছুই বলেনি।’
জরুরি তথ্য নেই রানার হাতে। তবে ওখানে পৌঁছে খোঁজ নিলে কিছু না কিছু জানা যাবে।
‘জানি না কীভাবে তোমাকে ধন্যবাদ দেব, রানা,’ বলল মিরাণ্ডা। ‘আর কেউ নেই যার কাছ থেকে সাহায্য পাব। নিজে একা স্কটল্যাণ্ডে যেতে পারব না। চিনিই তো না ওদিকের কাউকে।’
‘আপনি একদম ভাববেন না,’ বলল রানা, ‘চিনে নেব কিনলোকার্ড গ্রাম। ওদিকের মানুষের সঙ্গেও কথা বলব। আশা করি সময় লাগবে না বেনকে পেয়ে যেতে।’
‘তাই যেন হয়,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিরাণ্ডা।
বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল রানা। এবার তৈরি হয়ে নিতে হবে। আগেও বিপদে পড়ে অনেকে সাহায্য চেয়েছে ওর কাছে। রানার মনে পড়ে না কাউকে কখনও ফিরিয়ে দিয়েছে। আর বেন বা তার স্ত্রী তো ওর খুবই প্রিয় দু’জন মানুষ। এদের জন্যে যে-কোনও বিপদে ঝাঁপ দিতে দ্বিধা করবে না রানা।
এখন প্রথম কাজ অফিস থেকে অনুমতি নেয়া। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ল্যাণ্ডফোনে বিসিআই চিফকে কল দিল রানা। ধমকের ভয়ে ধুকপুক করছে ওর হৃৎপিণ্ড।
‘হ্যাঁ, কী, কিছু বলবে?’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠ এল ঢাকা থেকে।
‘স্যর, আমার তো আপাতত কোনও কাজ নেই।’ আর কিছু না বলে ঢোক গিলল রানা।
‘তো?’ জানতে চাইলেন রাহাত খান। ‘আরও বেশি দিনের ছুটি চাই?’
‘জী-না, স্যর, ঠিক তা নয়। আমার এক পরিচিত মানুষ বিপদে পড়েছেন। তাই স্কটল্যাণ্ডে যেতে চাইছি।’
‘বেশ, যেতেই পারো। তবে প্রয়োজনে যেন তোমাকে মোবাইল ফোনে পাই।’
‘জী, স্যর।’
খুট করে কেটে গেল লাইন। বড় করে শ্বাস ফেলে স্মার্টফোন তুলে নিয়ে গুগল ম্যাপে গন্তব্য দেখল রানা।
হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে উঠলে ইনভার্নেস শহরের দূরত্ব চার শ’ চুয়াল্লিশ দশমিক চার মাইল বা সাত শত পনেরো দশমিক এক নয় কিলোমিটার। সবমিলিয়ে সময় লাগবে বড়জোর দু’ঘণ্টা। এয়ারপোর্টের এনকোয়্যারি ডেস্কে ফোন করে জানল, ইনভার্নেস শহরের দিকে আপাতত কোনও বিমান যাচ্ছে না। অবশ্য দুপুর বারোটায় ওই শহর লক্ষ্য করে রওনা হবে কেএলএম-এর একটি বিমান।
রানার ফ্ল্যাটে মাঝারি একটা ব্যাগ সবসময় তৈরি থাকে। ভেতরে দরকারি জিনিসপত্র। রওনা হওয়ার সময় মালপত্র গুছিয়ে নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করতে হয় না ওকে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে বসে থাকতে হবে দুই ঘণ্টা। আবারও টিভি ছেড়ে চ্যানেলগুলো ঘুরে দেখতে লাগল রানা। তারপর সকাল এগারোটায় বাইরের পোশাক পরে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিচতলায় নেমে এল। অডি গাড়িটা স্টার্ট করে চলল হিথ্রো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। বিড়বিড় করে বলল, ‘হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল ওস্তাদ?’