স্বর্ণমৃগ ১

স্বর্ণমৃগ / মাসুদ রানা ভলিউম-১ (অসংক্ষেপিত সংস্করণ) / কাজী আনোয়ার হোসেন / সেবা প্রকাশনী / প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৭

০১.

পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির পর দুটো মাস এক স্বপ্নের ঘোরে কেটেছিল মাসুদ রানার। এক মাস ছুটি নিয়ে কক্সবাজারের এক কটেজে কাটিয়েছিল ভারতীয় স্পাই মিত্রা সেনের সাথে। সামনে অথৈ সমুদ্র। শো শো একটানা শব্দে লুটিয়ে পড়ছে ঢেউ তীরে এসে। মিত্রার বুকে উদ্দাম প্রেম। একান্ত করে পেয়েছিল ওরা। দুজন দুজনকে। কখনও জোয়ার-ভাটা দেখেছে বসে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে-কখনও হাত ধরাধরি করে নেমে গেছে সাগরের জলে। ছেলেমানুষের মত ঝিনুক, শঙ্খ কুড়িয়েছে ছুটোছুটি করে। পূর্ণিমার রাতে দাঁড়িয়েছে গিয়ে সাগর তীরে। হু-হুঁ হাওয়া। আঁচল উড়ে গেছে মিত্রার। খোলা চুল উড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরেছে রানার গলা। কানে কানে মিত্রা বলেছে: রানা, তুমি আমার। কান পেতে শুনেছে রানা এই মধুসম্ভাষণ। ভেবেছে, আমি সুখী!

রাতে নিবিড় হয়ে কাছে এসেছে মিত্রা। আপন করেছে রানাকে। রানার শক্তিশালী বাহুর বন্ধনে আবেশে বিভোর শরীর এলিয়ে দিয়েছে, সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করেছে দয়িতের প্রেম। বলেছে, রানা এমনি করে চিরকাল ভালবাসবে আমায়? কথা দাও, রানা। যদি কোনদিন তোমার প্রেম হারাই, সেদিন যেন…

কথাটা শেষ করতে দেয়নি রানা। চুম্বনে হারিয়ে গেছে মিত্রার শঙ্কা।

জীবন এত মধুর তা কি রানা জানত আগে!

কিন্তু তারপর? ভেঙে গেল খেলাঘর।

হঠাৎ করে যদি ভাঙত, দুঃখ পেত রানা। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল একটু একটু করে, প্রায় একমাস ধরে। ফাঁকটা প্রথমেই ধরা পড়েছিল রানার চোখে। মৃদু হাসি হেসেছিল ও। ও জাত এমনি একটা ব্যাপার, ঘটাই স্বাভাবিক। বিশ্লেষকের মন নিয়ে ও দেখল মিত্রার পরিবর্তন। বুঝল অমৃত আর গরল মিশেই জীবন। দেবতা আর অসুর মিলেই মানুষ। ভিতর ভিতর প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল ও আগেই। আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যাপারে মিত্রার এড়িয়ে যাওয়ায় আরও স্থির নিশ্চিত হলো। সাবধান হয়ে গেল ও সব দিক থেকে।

কিন্তু সত্যি সত্যিই একদিন হতবাক হয়ে গেল ও যখন মিত্রার বালিশের নীচে পেল এক ডজন কন্ট্রাসেপটিভ পিল।

‘এগুলো কী, মিত্রা?’

‘বুঝতেই তো পারছ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বটিকা। ইহা সেবনে…’

‘ঠাট্টা রাখো, মিত্রা। এসব তোমার কাছে কেন? আলীপুর চিড়িয়াখানায় তুমি আমাকে যা বলেছিলে সে-সব কি তা হলে মিথ্যা? আমি তোমার সাথে পরিষ্কার ভাবে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।

‘এখন নয়। বলব। আজ রাতে সব বলব তোমাকে। মিত্রা চলে গিয়েছিল বাথরুমে।

রানা বুঝল আজই তার জীবনের একটা স্মরণীয় রাত্রি আসবে। আজ তার বন্ধন মুক্তির দিন। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ায় অবাক হয়ে আত্মবিশ্লেষণে মন দিল ও। তার দিক থেকে কোনও ত্রুটি ছিল কি না খতিয়ে দেখার চেষ্টা করল সতোর সঙ্গে। আধঘণ্টা পর চা খেয়ে চলে গেল অফিসে।

রাতে অপরূপ সাজে সেজে কাছে এল মিত্রা। সামনের ছোট লনে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বসেছিল রানা আরাম করে। সিগারেটের মাথায় আগুনটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না অমাবস্যার অন্ধকারে। আকাশ ছেয়ে ছিল তারার ঝালর। রানা চেয়ে দেখছিল কালপুরুষের কোমরবন্ধ। চুলের মধ্যে প্রবেশ করল মিত্রার নরম আঙুল।

‘রানা।

বলো।

কথাটা বলতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু…’

‘তবু বলতেই হচ্ছে। তাই না?

‘হ্যাঁ। আমি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই, রানা।

‘সব দিক ভেবে দেখেছ?’

‘অনেক ভেবেই স্থির করেছি আমি।

‘আর আমার সন্তান?

‘ওহ, ওটা কিছু নয়। আমার ভুল হয়েছিল। ওটা আসলে সাধারণ মেনসট্রেশনের গোলমাল। আমি মনে করেছিলাম বুঝি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েছি। কক্সবাজারেই টের পেলাম প্রথম। সেই ছয় দিন অসুস্থতার ভান করে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম তোমাকে। তখন থেকেই নিয়মিত ওই পিল খাচ্ছি।’

‘এবং তখন থেকেই নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করছ কিছু লোকের সঙ্গে।

চমকে উঠল মিত্রা কথাটা শুনে।

‘তুমি জানতে?

হেসে উঠল রানা।

‘তোমার প্লেনের টিকেটের নাম্বার পর্যন্ত বলে দিতে পারি। গত পনেরো দিন ধরে তুমি কোথায় কী করেছ, প্রতিটি পদক্ষেপ আমার মুখস্থ। কিন্তু সেসব কথা থাক। এইসব অভিনয়ের পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা জানতে চাই আমি।’

‘প্রথমে একটা কথার জবাব দাও। তোমরা কি বাধা দেবে আমাকে?

‘না। নির্বিঘ্নে যেতে পারবে।’

‘অবশ্য বাধা দিয়েও কোনও লাভ হত না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতাম, তবু সাপে-নেউলে বন্ধুত্বের অভিনয় করতে পারতাম না কিছুতে। যাক। ব্যাপারটা খোলাখুলিই বলি তোমাকে। রাজশাহীতে আমাদের মধ্যে যা ঘটেছিল, তা ঘটেছিল নিতান্ত ঝোঁকের বসে। আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্যে কৃতজ্ঞতায় আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে, এক দুর্বল মুহূর্তে। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে তোমাকে, সেই সাথে নিজেকেও ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছি আমি। তোমাকে বলেছিলাম, সে-ই আমার জীবনে প্রথম স্থলন। আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল আমি সন্তানের মা হতে চলেছি। কিছু কিছু লক্ষণও আশ্চর্যভাবে মিলে গিয়ে আমার ধারণাটাকে বদ্ধমূল করেছিল। এই ভুলটা যদি না হত তা হলে আজ এত বড় পাপের বোঝা বইতে হত না আমাকে। মনে করো না তোমার জন্যে আমি সাহায্য করেছিলাম তোমাকে টিটাগড় ধ্বংস করতে। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে করেছিলাম সেটা। এই এক চিন্তা মাথার মধ্যে শিকড় গেড়ে বসায় আমি আমার সমাজ-দেশ-জাতি-ধর্মের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম। কিন্তু যখন জানলাম আমার ভুল হয়েছিল, যখন জানলাম একটা মিথ্যে ধারণা নিয়ে…’

‘তখন আগের সেই ঘৃণাটা ফিরে এল, এই তো? তুমি আমার কথা ভাবলে না একটিবারও?

‘সব কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না, রানা। মেয়েমানুষের মনের কথা তুমি বুঝবে না। এ আমার পূর্ব জন্মের পাপ। নইলে এমন বিষময় হবে কেন, আমার জীবন? তোমাকে ছেড়ে যেতেও জ্বলে পুড়ে মরছি, মনে হচ্ছে নীচ, স্বার্থপরের মত শুধু নিজের দিকটা দেখছি, তোমার ভালবাসায় যে বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না সেটাও বুঝতে পারছি; আবার থাকলেও প্রতি পলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি আত্মধিক্কারে। এ এক আশ্চর্য নির্যাতন।

কলকাতায় ফিরে গেলেই তোমার সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে?

যা হবার হবে। মনস্থির করে ফেলেছি-যেতে আমাকে হবেই।

শিউলীর ভারী জমাট সুগন্ধ আর মিত্রার দেহ থেকে মিষ্টি সেন্টের সুবাস এসে মুহূর্তটিকে জীবন্ত করে রাখল রানার মনে চিরকালের জন্য। কালপুরুষের। কোমরে ঝোলানো তলোয়ারটা আর দেখা যাচ্ছে না। খুঁজে পেল না সেটা রানা।

চলে গেল মিত্রা সেন।

.

এত কথা রাহাত খানকে বলবে কী করে? অথচ প্রশ্নটা করেই স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন রানার মুখের দিকে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খান। ধনুকের টান দেয়া ছিলার মত রাহাত খানের লম্বা ঋজু। দেহ। ক্ষুরধার দুই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পুরু বেলজিয়ান কাঁচে ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ-উঁচু রিভলভিং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন তিনি।

‘মাস খানেক আগে চলে গেছে কলকাতায়। সংক্ষেপে জবাব দিল রানা।

সে খবর আমার জানা আছে। কিন্তু ওর পরিণতির খবর পেয়েছ?

না তো!’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল রানা রাহাত খানের মুখের দিকে। ধরা পড়েছে?

‘হ্যাঁ। এবং খোলাখুলি সবকিছু স্বীকার করেছে সে কোর্টে দাঁড়িয়ে।

‘অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড?

এ-কথার জবাব দিলেন না রাহাত খান। হাভানার প্যাকেট থেকে একখানা সেলোফেন পেপার মোড়া চুরুট বের করলেন। সযত্নে কাগজ ছাড়িয়ে দাঁতে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করলেন তাতে। পাতলা সাদা একফালি ধোয়া চোখে যাওয়ায় চোখ দুটো পেঁচিয়ে উপর দিকে ঘুরিয়ে আঙুলের ফাঁকে নিলেন চুরুটটা।

আর একটা খেতাব ঝুলছে তোমার জন্যে, রানা। তিনটে হলো মোট।

‘এবার কী ব্যাপারে, স্যর?’ খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘দ্বোয়ারকা।

মুচকি হাসল রানা। দ্বারোকা নৌঘাটি ধ্বংসে তার যে ভূমিকা ছিল তা কোনওদিন পৌঁছবে না জনসাধারণের কানে। যতদিন না অবসর গ্রহণ করছে বা পটল তুলছে, ততদিন এইসব অতি সম্মানীয় খেতাবের কথাও জানতে পারবে না কেউ। প্রেসিডেন্ট গোপনে ওর বুকে এঁটে দেবেন মেডাল, পিঠ চাপড়ে দেবেন। মৃদু হাসি হেসে, দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন। তারপর সব চাপা পড়ে যাবে কনফিডেনশিয়াল ফাইলের তলায়।

রাহাত খানের ইচ্ছে নয় রানাকে পপুলার হিরো তৈরি করে ওর মাথার উপর বিপদ ঘনিয়ে আনা। রানার ভালমন্দ সবকিছুর ব্যাপারে সদা-সতর্ক দৃষ্টি আছে। তাঁর। এমন কী সিগারেটের ব্র্যাণ্ড, গাড়ির রঙ, হাতের ঘড়ি, পেন ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপারও ওঁর নজর এড়ায় না-মাঝে মাঝেই বদলাবার আদেশ আসে উপর থেকে।

‘আর, দুই নম্বর কথা হলো, তোমার জন্যে একটা কঠিন কাজ তৈরি হচ্ছে। খুব সম্ভব হপ্তাখানেকের মধ্যেই তোমাকে করাচি যেতে হবে।

করাচি?

হ্যাঁ। গোল্ড স্মাগলিং।

‘স্মাগলিং? কিন্তু এসব ব্যাপারে আমরা কেন? সি আই ডি-র কাজ না?’

‘সোনা আসছে মিল-ঈস্ট থেকে। পুরো চ্যানেল ক্লোজ করতে হবে। কাজেই ব্যাপারটা কয়েক হাত ঘুরে আমাদের হাতে এসেছে। স্ম্যাশ করতে হবে এমন একজন লোকের নেটওয়ার্ক যে কর্তৃপক্ষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। একাজটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ঢাকা থেকে আমাদের একজনকে পাঠাতে হচ্ছে।

‘লোকটাকে যদি চেনাই যায়, তা হলে…’

‘কেউ চেনে না তাকে। অদ্ভুত ধূর্ত এক কৌশলী এবং ক্ষমতাশালী লোক আছে এর পেছনে, যাকে কোনমতেই মুখোশ খুলে টেনে আনা যাচ্ছে না। অন্ধকার থেকে আলোয়। এই ফাইলটা পড়লে সবটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পারবে।’

একটা মোটা ফাইলের মধ্যে লাল ট্যাগ আঁটা। তাতে ইংরেজিতে লেখা ‘টপ সিক্রেট’। ফাইলটা ধড়াস করে ফেললেন রাহাত খান, রানার সামনে টেবিলের উপর। প্রচুর ঘাটাঘাটির ফলে কাভারটা নরম হয়ে এসেছে। কিনারা ছিঁড়ে গেছে। দু’এক জায়গায়।

‘এটা মন দিয়ে পড়ো গিয়ে। পরে ডাকব আবার আমি। আজ অনেক কাজ। কখন সময় পাব ঠিক বলতে পারছি না। যদি অফিস আওয়ার পার হয়ে যায় সিনক্রাফোনটা সাথে রেখো।

‘আচ্ছা, স্যর।’

‘এখন আর কোনও কথা নেই। এসো তুমি।

আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে নিজের কামরায় যাচ্ছিল রানা ফাইলটা তুলে নিয়ে। খোলা দরজা দিয়ে রানাকে দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে ডাকল চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখ।

‘আরে এসো, এসো! অত ব্যস্ত হবার কী আছে? রানার হাতের ফালইটা দেখে বলল, আমি জানতাম, তোমাকেই গছাবে এটা।

‘বুড়োকে ভারী সিরিয়াস মনে হচ্ছে? একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল রানা।

‘ভয়ানক। গত দশ দিন ধরে এ ছাড়া অন্য চিন্তা নেই মাথায়। অন্তত এক শ’ জন লোককে ডেকেছে নানান ডিপার্টমেন্ট থেকে। গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর কী করেছে আল্লা-মালুম। শেষে আজ আমাকে হুকুম করেছে তোমাকে তলব করবার জন্যে।

‘সাধারণ একটা গোল্ড স্মাগলার…’

‘সাধারণ নয়! বাধা দিল কর্নেল শেখ। সাধারণ ব্যাপার নিয়ে আমরা ডিল করি না। আমি যদূর জানি, এবার যদি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসতে পারো, জানবে মস্ত ফাড়া কাটল।

কর্নেল শেখের বাড়িয়ে ধরা ‘থ্রি কাসলসের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল রানা। কারও অর্ডার ছাড়াই যখন দু কাপ কফি এসে হাজির হলো, তখন রানা বুঝল খামোকা গল্প করবার জন্যে তাকে ডাকেনি কর্নেল, ব্যাপারটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মুখে কিছুই বলল না ও। কফিতে চুমুক দিয়ে চেয়ে থাকল শেখের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে।

‘সাধারণ হলে আর তোমাকে ঢাকা থেকে করাচি দৌড়াতে হত না। লোকটা এতই ক্ষমতাশালী যে আমাদের করাচির ব্রাঞ্চকে পর পর তিনজন অপারেটর হারাতে হয়েছে।’

‘খুন?’

তবে আর বলছি কি? দুই-এক কদম অগ্রসর হলেই খতম করে দিচ্ছে বিনা। দ্বিধায়। তোমাকে পাঠাবার পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে এই যে, তোমাকে চেনে না ওরা। বিচ লাগজারি হোটেলে ধনীর দুলাল সেজে উঠতে হবে। তোমাকে। তাড়াহুড়ো করে কিছুই করা চলবে না। এমনকী বরাবরের মত একবারও রিপোর্ট করতে হবে না তোমাকে করাচি অফিসে। যেন কোনও ভাবেই টের না পায়, ওরা যে এই কাজে গিয়েছ তুমি।’

‘এত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কেন? একটা লোক…’

‘চিনতে পারলে তো একটা লোক!’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল কর্নেল শেখ, ‘এখন সে একটা অদৃশ্য শক্তি। যে-কেউ যে মতলব নিয়েই লাগুক না কেন পিছনে, অদ্ভুত কোনও উপায়ে টের পেয়ে যাচ্ছে সে, আর বিনা দ্বিধায় নিষ্কণ্টক করে ফেলছে নিজের চলার পথ। এখানে বসে তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না। ওখানে গেলেই টের পাবে কতখানি শক্তিধর সে। রঙ্গমঞ্চে ওর ছায়াও দেখতে পাবে না–অথচ সে-ই হিরো।

‘ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ কেন খামোকা? তোমাকেও দেখছি বুড়োর রোগে ধরেছে–কোনও কাজে পাঠানোর আগে চোদ্দবার বলবে, সাবধান! আমাকে কি কচি খোকা পেয়েছ যে জুজুর ভয় দেখাচ্ছ?’

‘বুঝতে পারছ না। অন্যান্যদের তুমি চিনবে না, রানা। কিন্তু একজনের নাম। বললেই তুমি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। তোমার সাথে দ্বোয়ারকা মিশনে ছিল সিন্ধি ছেলে…’

‘আলতাফ ব্রোহী!

‘হ্যাঁ। কেউ ছুরি দিয়ে ওর সারা শরীর কেচেছে মোরোব্বার মত। তিন দিন পর ফুলে ভেসে উঠেছে লাশ কেমাড়িতে। সাগরের ঢেউ এনে ফেলে গেছে। মৃতদেহ তীরে। বীভৎস সে দৃশ্য। ছবি দেখতে পারো।

একটা ছবি বের করে দিল কর্নেল শেখ ড্রয়ার থেকে। সত্যিই বীভৎস। চিনতে পারল রানা অনায়াসে ওর গলার তাবিজ দেখে মনে পড়ল বিদ্যুৎগতি

সেই সিন্ধি যুবকটির কথা। ছ’ফুট লম্বা, পেটা শরীর। একসাথে পাশাপাশি বুক। ফুলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ওরা বিপদের মুখোমুখি। রানা বুঝেছিল, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে তার সমকক্ষ যদি কেউ থেকে থাকে, সে এই আলতাফ। সেই বুদ্ধিমান করিঙ্কৰ্মা ছেলেটির এই দশা যে লোক করতে পারে সে নিশ্চয়ই অবহেলার পাত্র নয়। কঠিন হয়ে উঠল রানার মুখ, একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। ফুটে উঠল সে-মুখে স্পষ্ট। ধীরে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল ছবিটা।

‘আমি যাব করাচি।’

মৃদু হাসি কর্নেল শেখের ঠোঁটে। সিগারেটটা ফেলে দিল অ্যাশট্রেতে।

‘এবার বুঝতে পারছ গুরুত্বটা? মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘শুধু এ নয়, আরও দুজন ছেলেকে হারিয়েছি আমরা। একজনকে খুন করা হয়েছে দিন-দুপুরে ম্যাকলিওড রোডের উপর। ছাতের ওপর থেকে কেউ মস্ত একটা পাথর ফেলে থেঁতলে মেরেছে ওকে ফুটপাথের ওপর। আর তৃতীয় জন…’

‘আচ্ছা, সেই অদৃশ্য লোকটি সম্পর্কে কোনও তথ্যই জানা যায়নি যাতে তাকে খুঁজে বের করার কাজে কিছুমাত্র সাহায্য হতে পারে?

‘উঁহু। কিছু না। ভিট আয়ল্যাণ্ডের বাসিন্দা সাধারণ কোনও স্মাগলার সে নয়, এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়। অল্পদিন হলো নেমেছে সে এই লাইনে, এরই মধ্যে সবার মাথার ওপর উঠে গেছে। ছোটখাটো গোল্ড স্মাগলার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে এর চেলা হয়ে গেছে। হিউজ স্কেলে কারবার চলেছে এখন।’

‘আমাকে এগোতে হবে কোন সূত্র ধরে? ওদের দলে ঢোকার চেষ্টা করব?

‘ওসব করে কোনও লাভ নেই। আপাতত কিছুদিন তুমি বিচ লাগজারি হোটেলে থাকবে নিষ্ক্রীয় ভাবে। আমরা যখন বুঝব যে তার চোখে পড়োনি তুমি, তখন এখান থেকে লাইন-অভ-অ্যাকশন জানিয়ে প্রসিড করতে বলা হবে। আর যদি দেখা যায় টের পেয়ে গেছে ওরা, তা হলে অ্যাবাউট টার্ন, কুইক মার্চ করবে। তখন অন্য পথে এগোব আমরা।’

কফি শেষ করে উঠে দাঁড়াল রানা।

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু, শেখ।

‘অলওয়েজ মেনশন।

বেরিয়ে গেল রানা ঘর থেকে।

মোটা ফাইলটা বগলে চেপে ছ’তলায় নিজের কামরায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল রানা। সোহেল। রানার চেয়ারে আরাম করে বসে জুতো সুদ্ধ দুই পা তুলে দিয়েছে ও টেবিলের উপর। ডান পা-টা প্রবল বেগে নাচাচ্ছিল; রানাকে দেখে নাচ বন্ধ করে সেটা দিয়ে একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল। গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে রাহাত খানের অনুকরণে বলল, ‘বোসো। তোমার জন্যে একটা অ্যাসাইনমেন্ট…

হঠাৎ এতদিন পর সোহেলকে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে ছুটে গিয়ে ওর কান ধরল রানা। মুখে বলল, ‘এক লাত্ মেরে স্টেডিয়ামের মাঠে নামিয়ে দেব, শালা। ওপর-অলার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি? দাঁড়াও, তোমার চাকরি খেয়ে দিচ্ছি আমি। * সোহেলও কাঁক করে চিমটে ধরেছিল রানার পেটের চামড়া। বলল, কান ছাড়, শালা উল্লুকে পাঠা। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।’

‘তুই আগে পেট ছাড়!

‘তুই আগে ধরেছিস। তুই আগে ছাড়বি। ছাড়লি?

‘আগে পেট ছাড়।

‘কান ছাড়।

আরও কতক্ষণ চলত বলা যায় না। হঠাৎ দরজার সামনে রানার স্টোনো নাসরীন, রেহানাকে ইউএনও-র মত অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু’জনই লজ্জা পেয়ে গেল। বিনা বাক্যব্যয়ে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে বসে পড়ল। যেন তাসখন্দ বৈঠকে। রেহানার উপর হুকুম হলো দু’কাপ কফি সাপ্লাইয়ের।

‘তুই হঠাৎ কোত্থেকে, দোস্ত। ডাক-বাংলোর বেয়ারার কাজ ছেড়ে দিয়ে শুনলাম ক’দিন রেলে-ইস্টিমারে দাঁতের মাজন আর খুজলি-পাঁচড়ার মলম বিক্রি করছিলি। ছেড়ে দিলি নাকি সে বিজনেস?

নিঃশব্দে হাসল সোহেল।

‘স্পেশাল মেসেজ দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে আমাকে হেডকোয়ার্টারে, তা জানিস? তোরা তো শালা এক একটা অকম্মার ধাড়ি, তাই আমাকে ছাড়া চলল না। এখন থেকে আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে তোদের, বুঝলি?

‘এটা দেখেছিস? হাতের মোটা ফাইলটা টেবিলের উপর রাখল রানা।

‘সাঙ্ঘাতিক একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। তুই তো সে তুলনায় নস্যি। তোকে বড়জোর ডেকে এনে একটা দোকানের সেলসম্যান বানিয়ে দিতে পারে। আর আমাকে পাঠাচ্ছে…

করাচি।

‘তুই জানলি কী করে?

‘ওই তো মজা! যে ফাইল অত গর্ব করে দেখাচ্ছিস, জেনে রাখিস, শ্যালক প্রবর, ওতে তোর আগে আমার সই পড়েছে। এবং তোর আগে আমাকেই পাঠানো হচ্ছে সেখানে। বললাম না, আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করা ছাড়া তোদের আর গত্যন্তর নেই।’

কী আছে ফাইলে?’

‘ওই ফাইল পড়ে বিশেষ কিছু লাভ হবে না। ওতে যা আছে তা তিন লাইনে মুখেই বলে দিতে পারি আমি। তবু হুকুম যখন হয়েছে, পড়তেই হবে তোকে। কিন্তু দোস্ত, ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। তোর ওই অপারেশন গুড উইলের চেয়েও। জেনে খুশি হবি, এই ‘স্বর্ণমৃগ’ অ্যাসাইনমেন্টটাও তোরই। আমাকে পাঠানো হচ্ছে তোর বস হিসেবে তাকে সাহায্য করবার জন্যে। আর খোদা চাহে তো যদি পটল তুলিস, সেজন্যে আমি থাকছি স্ট্যাণ্ড বাই।

‘তুই রওনা হচ্ছিস কবে?

‘কাল সকাল সাড়ে দশটার ফ্লাইটে।

‘রাত্রিটা চল আমার ওখানে থাকবি আজ, গল্প করা যাবে।

‘উঁহু। সেটা সম্ভব না। অফিসের বাইরে কারও সঙ্গে দেখা করা নিষেধ।

তবে মরগে যা, শালা।

‘তার আগে কফিটা খেয়ে নিলে হয় না?

ধূমায়িত কফির কাপ নামিয়ে রাখল রেহানা টেবিলের উপর।

রেহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সেদিকে ইঙ্গিত করে সোহেল বলল, ‘সুখে আছ সখা আপন তালে। কেমন? এ-ক্লাস, না বি?

‘জাহেদকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ওই শালা লেগেছে পিছনে। আমি ফুলের মত নিষ্পাপ।

কসম?

কসম।

কফি খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। বেশির ভাগই পুরনো দিনের কথা। দুর্ঘটনায় একটা হাত খোয়া যাওয়ায় হেড অফিস থেকে সরিয়ে ব্রাঞ্চ ইনচার্জ করে দেয়া হয়েছে সোহেলকে। তাই সুযোগ পেলেই সে পুরনো দিনের গল্পে ফিরে গিয়ে স্মৃতি রোমন্থন-সুখ অনুভব করতে চায়। এককালের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে সে-সব গল্প করে রানাও আনন্দ পায়। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে। রানার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল সোহেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুই কাজ কর, আমি জাহেদকে খানিকটা ডিসটার্ব করে আসছি।’

ফাইলের মধ্যে ডুবে গেল রানা সোহেল বেরিয়ে যেতেই।

.

রাত্রি ঠিক পোনে আটটার সময় বেজে উঠল সিনক্রাফোন রানার পকেটে। রানা ছিল তখন গাড়িতে। এলিফ্যান্ট রোডের জামান ড্রাগ হাউজের সামনে থামাল ও লরেলগ্রীন মেটালিক কালারের নতুন টয়োটা করোনা সিডান। চেনা ডাক্তার। টেলিফোন তুলে নিল রানা কানে।

সিনক্রাফোন হচ্ছে ম্যাচ বাক্সের মত দেখতে প্লাস্টিকের ছোট একটা রেডিয়ো রিসিভার। এজেন্টদের বিশেষ কাজে দিনে রাতে যে কোনও সময় ডাকতে হতে পারে। সেজন্য নতুন এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন রাহাত খান অল্পদিন হলো। হেড অফিসের দশ মাইলের মধ্যে থাকলে এর সাহয্যে যে কোনও এজেন্টকে ডাকা যায়। পিতৃ পিপ্ করে শব্দ হয় এতে। এই শব্দ শোনা মাত্র যাকে ডাকা হচ্ছে তার কাজ হলো যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন। নিকটস্থ টেলিফোনে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা।

৮০০৮৩ ঘোরাতেই প্রথমে মিস্ নেলী, তারপর গোলাম সারওয়ার হয়ে রাহাত খানের কাছে পৌঁছল রানার উৎসুক কণ্ঠস্বর।

‘আমি বাসায় আছি। আজ রাতে আমার সাথে খাবে তুমি। আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে এসো। সোহেলকেও ডেকেছি।’

‘ কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা নামিয়ে রেখে দিলেন রাহাত খান। রানা ভেবেছিল আজ আর ডাক পড়বে না। তাই অফিসের পর দু’একটা কাজ সেরে ক্লাবে স্কোয়াশ খেলতে যাচ্ছিল। এলিফ্যান্ট রোড থেকে সোজা বাড়ি ফিরে এল ও।

রাঙার মা-কে বলে দিল রাতে বাড়িতে খাবে না, ফিরতে দেরি হতে পারে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকল রাঙার মা। মিত্রার কথা ভুলতে পারে না ও। কী সুন্দর পুতুলের মত বৌ আসছিল ঘরে, কী হলো তাদের মদ্দি আল্লাই কতি পারে, থাকল না। ভেবেছিল তার হাতে সংসার তুলে দিয়ে দেশে ফিরে যাবে, কিন্তু তা আর হলো কই? এখন যদি রাতে বাড়িতে না খায়, দেরি করে ফিরতে চায়, তা হলে রানাকে দোষ দেয়া যায় না।

.

ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ঠিক লেকের পারে চমৎকার একখানা একতলা বাড়ি। সাদা উর্দি পরা বেয়ারা রানাকে নিয়ে বসাল ড্রইং-রুমে।

‘আমি এক্ষুণি সাহেবকে খবর দিচ্ছি। আপনি এক মিনিট বসুন, স্যর।

প্রকাণ্ড একটা কালো হাউণ্ড ঢুকল ঘরে। রাহাত খানের শখের কুকুর। পিছন পিছন চেন হাতে ঢুকলেন মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান। চেনা লোক, তাও একবার কটমট করে চাইল কুকুরটা রানার দিকে ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে। আপাদমস্তক সবুজ দৃষ্টি বুলাল সে। কোনও আগন্তুককেই পছন্দ করে না হাউণ্ডটাকার মনে কী আছে বলা যায় কিছু? মানুষ তো! কাজেই ওর চোখে স্পষ্ট শাসন-কোনও রকম চালাকির চেষ্টা কোরো না, বাছা, বিপদে পড়বে।

‘বোসো, রানা। সোহেল আসেনি? এখুনি এসে পড়বে। ডিনারও রেডি। খেতে খেতেই কাজের কথা সেরে নেয়া যাবে।

‘আপনার দেহরক্ষীটাকে সামলান, স্যর। কেমন কটমট করে চাইছে আমার দিকে! মনে হচ্ছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।’

একটু হেসে মাথায় দুটো থাবড়া দিয়ে আদর করলেন রাহাত খান ভয়াল কুকুরটাকে। তারপর বললেন, যাও, অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়েছে, তোমারও ডিনার রেডি। খাও গিয়ে।’ শিকলটা বেয়ারার হাতে দিয়ে রানাকে বললেন, ‘একটু ব্যায়াম করাচ্ছিলাম ওকে। যুদ্ধের পর থেকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে। বেচারার প্রতি অবিচার হয়ে যাচ্ছে। একেবারেই সঙ্গ পায় না আমার।

হাফপ্যান্ট আর টাওয়েলের গেঞ্জি পরনে, পায়ে স্নিকার। এই বেশে আর ড্রইংরুমে বসলেন না রাহাত খান। রানাকে বসিয়ে কাপড় ছাড়তে গেলেন। টেবিলের উপর থেকে ডেভিড ওয়াইজ আর টমাস বি. রসের লেখা ‘দ্য ইনভিজিবুল গভর্নমেন্ট’ তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকল রানা। পেপার-ব্যাক এডিশন। বইটার প্রতি পৃষ্ঠায় ‘সিআইএ’ শব্দটা পাওয়া গেল গড়ে দশটা করে। কয়েক পৃষ্ঠা পড়া হতেই দু’দিকের দুই দরজা দিয়ে একসঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল। সোহেল এবং রাহাত খান।

‘এই যে, সোহেলও এসে গেছ। চল একেবারে খাবার টেবিলে গিয়েই বসি।’

সুপ শেষ হতেই বাটিগুলো তুলে নিয়ে গেল বেয়ারা। মুখ খুললেন রাহাত খান।

‘স্মাগলিং যে এত সিরিয়াস একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভাবিনি কোনওদিন। ব্যাপারটা চিরকাল হয়ে এসেছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। আমাদের আসল সমস্যা এখন স্মাগলিং নয়-এর পিছনের প্রতিভাবান ব্যক্তিটিকে ধ্বংস করা। তোমরা দুজনেই তো ফাইলটা পড়েছ। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?

‘দেখলাম, শুধু গত বছরেই আনুমানিক দু-শ’ কোটি টাকার সোনা এসে পৌচেছে এখানে। এটা যখন অনুমান করা সম্ভব হয়েছে, কীভাবে কোন পথে এই চোরাচালান আসছে সেটা আন্দাজ করা যায়নি? রানা জিজ্ঞেস করল।

‘তা ছাড়া সিআইডি এটাকে সিরিয়াসলি টেক-আপ করছে না কেন? সোহেল যোগ করল। কাউকে খুঁজে বের করবার কাজে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ।

একটা মুরগির রানে কামড় বসিয়েছিলেন রাহাত খান। ওটাকে বাগে আনবার আগেই রানাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে উদ্যত দেখে হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করলেন। এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।

‘না। অভিনব কোনও পদ্ধতিতে সোনা চালান হচ্ছে, এটুকু টের পাওয়া গেলেও পদ্ধতিটা জানা যায়নি। পথ হচ্ছে: জল স্থল বা আকাশ; অথবা তিনটেই। আর এর মূল উৎস হচ্ছে মিডলঈস্ট। সিআইডি-র জুরিসডিকশনের বাইরে। আমরা যখন এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হলাম তখন সবটা দায়িত্ব আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ওরা হাত গুটিয়ে নিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেচেছে। আমাদের মত ওরাও কয়েকজন যোগ্য লোক হারিয়েছে। কাজেই বিপক্ষকে আণ্ডার এস্টিমেট করবার ধৃষ্টতা আমাদের থাকা উচিত নয়। তুমি ঠিকই ধরেছ, রানা। যদি ওদের সোনা পাচার করবার পদ্ধতি আমাদের জানা। থাকত তা হলে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে আজ হোক কাল হোক মূল উৎসে পৌঁছানো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সোনা একটা অদ্ভুত জিনিস। এর কোনও.. নির্দিষ্ট আকার নেই। গলিয়ে ফেললেই এর গায়ের সব চিহ্ন মুছে ফেলা যায়, অথচ দাম কমে না এক পয়সাও। তারপর যে কোনও ছাঁচে ফেলে যে কোনও আকার দেয়া যায় সেটাকে। কাজেই ধরা খুব মুশকিল।

এতক্ষণ কথা বলায় যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছিল তা পূরণ করে নিলেন রাহাত খান কিছুক্ষণ চুপচাপ একমনে আহার করে। ওঁর বক্তব্য শেষ হয়নি তাই এই সুযোগে নতুন কোনও প্রশ্ন করল না কেউ।

‘এমনকী, ইচ্ছে করলে এক রকম খয়েরি রঙের পাউডারেও পরিণত করা যায় সোনাকে। হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণের মধ্যে ফেললেই গলে তরল হয়ে যায় সোনা। তারপর সালফার ডাইঅক্সাইড বা অকজালিক অ্যাসিড দিলে খয়েরি পাউডার হয়ে যাবে সেটা। ইচ্ছে করলেই হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড উত্তাপ দিয়ে আবার সেটাকে সোনার টুকরো বানিয়ে নেয়া যায়। ক্লোরিন গ্যাসটা একটু খেয়াল রাখতে হয়, তা ছাড়া পন্থাটা খুবই সহজ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কঠিন বা তরল, এমন কী পাউডার হয়েও আসতে পারে এ জিনিস জল, স্থল কিংবা আকাশ পথে। আমরা এখানে এই সবগুলোর দিকেই তীক্ষ্ণ নজর রাখছি, কোনও রহস্য উদঘাটন করতে পারলে তোমাদের জানানো হবে।

‘আমাদের দুজনকে আলাদা ভাবে পাঠাচ্ছেন কেন?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘তোমাদের যে কোনও একজন বিপদে পড়লে অপরজন তড়িৎবেগে সাহায্য করতে পারবে, এই ভরসায়। দুজন সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণীর লোক সেজে যাচ্ছ। দুজনকে একসাথে সন্দেহ করতে পারবে না ওরা। যদি করে, তা হলে তোমাদের কপাল খারাপ বলতে হবে।’

খাওয়া হয়ে গেলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসল তিনজন। বিস্তারিত আলোচনা হলো কেসটা নিয়ে। সোহেল যাচ্ছে হিংলাজ দর্শনপ্রার্থী বাঙালি সাধু হয়ে, আর রানা যাবে করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু মালের হোল সেল মার্কেট তৈরি করতে। যখন নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হবে তখন কীভাবে কোন্ পথে এগোবে তা নিয়েও বিশদ আলাপ হলো।

সিগারেটের পিপাসা লেগেছে রানার অসম্ভব রকমের। বুকের ভিতরটা খালি হয়ে এসেছে ধোয়ার অভাবে। ওর অবস্থা অনুমান করে বেশিক্ষণ আর আটকে রাখলেন না ওকে রাহাত খান।

চারদিন পর সন্ধ্যার ফ্লাইটে রওনা হলো রানা করাচির উদ্দেশে।

.

০২.

থারটি সিক্স-টোয়েনটি টু-থারটি সিক্স। বয়স ছাব্বিশ।

লাস্যময়ী মহিলা। নাম জিনাত সুলতানা। লম্বা একহারা দেহে আঁটসাট করে পেঁচিয়ে পরা পাতলা নাইলন শাড়িটা পরা না পরা প্রায় সমান কথা। কাঁচের মত এই স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি অনেক কিছুই দেখতে পাবে, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে বুকের মধ্যে কামনার আগুন-এই বাসনাই কি মেয়েটিকে এমন উগ্র সজ্জায় উদ্বুদ্ধ করেছে?

অতুলনীয় রূপের বন্যায় সে কি ভাসিয়ে ডুবিয়ে একাকার করে দিতে চায় মুগ্ধ রূপগ্রাহীকে?

বোধহয় না। রানা ভাবছিল, তাই যদি হবে তা হলে কোনও পুরুষকে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না কেন মেয়েটা? সারা অঙ্গে যেন আগুন জ্বালিয়ে নিয়েছে। কেউ স্পর্শ করলেই হাত পুড়ে যাবে। তাকেও হাতটা পুড়িয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। জীবনে এই প্রথম এমন প্রত্যাখ্যান পেল মাসুদ রানা। কিন্তু এই আগুন যদি কেবল আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত তা হলে এত আকর্ষণ বোধ করত না রানা। এত চিন্তাও করত না মেয়েটির জন্যে। কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছে ও, এই আগুনেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। নিজেকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করছে সে প্রতি পলে। বোধহয় জীবনের সবটা তার দেখা হয়ে গেছে। লোভীর মত সব রস পান করে ফেলেছে সে অল্প সময়ের মধ্যেই।

সাগরের নোনা হাওয়া থেকে সামনের মাজা-ঘষা চেহারাটা আড়াল করবার জন্য রাস্তার দিকে মুখ করে আর সাগরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড সাততলা বিচ লাগজারি হোটেল। আধুনিকতম সব রকমের ব্যবস্থাই আছে। হোটেলের সামনে রাস্তার উপর দামি গাড়িগুলো তেরছা করে সার বেঁধে দাঁড়ানো। অল্প দূরেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে সব সময় অন্তত চারটে ট্যাক্সি দাঁড়ানো থাকে। লোহার গেট দিয়ে ঢুকেই সরু রাস্তার দু’পাশে নানান রকম ফুলের চমৎকার বাগান আর সবুজ ঘাস। কয়েক কদম এগোলেই লাউঞ্জে উঠবার সিঁড়ি। বাম পাশে রিসেপশন কাউন্টার। লাউঞ্জের এখানে ওখানে সোফা সেট। ডান ধারে লিফট। পাশেই সিঁড়ি। প্রকাণ্ড লাউঞ্জ ছাড়িয়ে ঢুকতে হয় বেগুনী পর্দায় ঢাকা কারুকার্য খচিত বার-এ। বারের মধ্যে দুই পাশে দুই টবে লাগানো ‘মানিপ্ল্যান্ট’ লতিয়ে উঠেছে দেয়ালে। গোটা কতক অর্কিড ছাত থেকে সরু পিতলের চেইন দিয়ে ঝোলানো নক্সা আঁকা মাটির পাত্রে রাখা। নীলচে ফ্লোরেসেন্ট টিউবের আলো আসছে সিলিং-এর চারটে গোল গর্ত থেকে। দুই পাশে দেয়ালে চুঘতাইয়ের মস্ত দুটো অয়েল পেইন্টিং। মোগলাই দরবারের সুরা পানের দৃশ্য। বারে ঢুকে সোজা তাকালেই দেখা যায় সাগরের নীলিমা। প্রকাণ্ড সব পুরু বেলজিয়ান কাঁচ বসানো আছে ওদিকটায় দেয়ালের বদলে। ইচ্ছে করলেই কালো স্ক্রিন দিয়ে ঢেকে দেয়া যায় রোদ্রের প্রখরতা।

এই বারের পিছন দিকে সাগরের দিকে মুখ করে চুপচাপ একা বসে আছে রানা। আরেকটা ডাবল-স্কচ এনে রাখল বেয়ারা ওর টেবিলে।

কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা গেল আজও নির্দিষ্ট টেবিলে মুখোমুখি বসে জুয়া খেলছে মেয়েটি সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে। আরও ঘণ্টাখানেক খেলবে। সন্ধ্যে হয়ে গেলেই উঠে পড়বে ওরা। লোকটি কোনও দিকে না চেয়ে সোজা। চলে যাবে, হোটেলের দোতলায় ওর নিজের কামরায়। মেয়েটি এসে ঢুকবে বারে। গ্লাসের পর গ্লাস মদ খাবে। পরিপূর্ণ মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে চলে যাবে পাঁচতলায় নিজের কামরায় দুই হাতে দুটো বোতল নিয়ে।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিলমিল করছে আরব সাগর। হোটেলের পিছনে একটা সরু পিচ ঢালা রাস্তা সোজা চলে গেছে সমুদ্র তীরে। সেই রাস্তার ডান পাশে হোটেল থেকে গজ বিশেক দুরে সেইলরস ক্লাব। একতলা। পারটেক্সের ছাদ আর কাঁচের দেয়াল। সাগর থেকে আসা উদ্দাম হাওয়া রোধ করবার জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করে লোহার ফ্রেমে আঁটা কাঁচের দেয়াল দেয়া হয়েছে। চারপাশে। ফলে সাগর দেখা যায় পরিষ্কার, কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় কফির কাপ বা টেবিলে বাটা তাস উল্টে যাবার ভয় নেই। নানান রকম জুয়োর ব্যবস্থা আছে। ক্লাবটায়। সন্ধ্যে হলেই কালো স্ক্রিন টেনে বাইরের জগৎ থেকে আলাদা করে দেয়া হয় ভিতরের জুয়াড়িদের। তারপর সেখানে চলে সবচাইতে উঁচু স্টেকে টাকা-ওয়ালাদের ভাগ্যের উত্থান-পতন। সেইসাথে আরও কত কী! একজন ‘সেইলর’ও পাত্তা পায় না সেইলরস্ ক্লাবে।

দিনের বেলায় স্ক্রিন সরিয়ে ফেলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিতরের সবুজ ঘাসের গালিচা আর ফুলের কেয়ারিতে সূর্যের আলো ও উত্তাপ লাগানো। তা ছাড়া দিনের বেলা তেমন লোকজনও হয় না। মেয়েমানুষ তো প্রায় থাকেই না যে তাদের চক্ষু লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি দিতে হবে। এই নিরিবিলি ক্লাবের এক কোণের টেবিলে মুখোমুখি বসে ফ্ল্যাশ খেলছে জিনাত সুলতানা সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সঙ্গে। গত পাঁচদিন ধরে রোজই খেলছে।

দ্বিতীয়, গ্লাস উইস্কি সামনে নিয়ে চেয়ে রইল রানা ওদের দিকে। মনে হচ্ছে। একটা প্রকাণ্ড অ্যাকুয়েরিয়ামের মধ্যে বসে আছে ওরা। হরেক রকমের মাছ। আছে এতে। লালচে চুলের ওই প্রৌঢ় জুয়াড়িকে রানার মনে হচ্ছে যেন-গোল্ড ফিশ। মেয়েটি অ্যাঞ্জেল ফিশ। আর ও নিজে? একটু হেসে ভাবল, ঝগড়াটে আর হিংসুক সিয়ামিজ ফাইটার।

গত রাতে এতগুলো লোকের মধ্যে হঠাৎ যখন মেয়েটি মাত্রাতিরিক্ত সেবনের ফলে হিক্কা তুলে বমি করতে আরম্ভ করেছিল, ভদ্রলোকেরা ছিটকে সরে গিয়েছিল জামা কাপড় বাঁচাতে, তখন ছুটে গিয়ে ধরেছিল মাসুদ রানা। বেসিনে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে মুখ ধুইয়ে দিয়েছিল, চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে নিজের। রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছিল ওর মুখ। তারপর? একটু সামলে নিয়েই ঠাস করে। চড় বসিয়ে দিয়েছিল মেয়েটি ওর গালে। চিৎকার করে বলেছিল, ‘নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, বদমাশ কাহিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গিয়েছিল সোজা। নিজের ঘরে। ঘর ভর্তি মহিলারা আন্তরিক দুঃখিত এবং পুরুষরা আনন্দিত হয়েছিল এই ঘটনায়। অপমানিত রানাকেও বার’ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। মাথা নিচু করে।

কিন্তু আজ রানার দিকে চেয়ে মুচকে হাসল কেন মেয়েটি? কী অপূর্ব সেই হাসি!

কে এই মেয়েটি? রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে কেবল নামটা জানা গেছে। আর সবকিছুই রহস্যময়। পাঁচ দিন আগে হঠাৎ এসে উঠেছে এই হোটেলে। রানা স্থির করল মেয়েটির সম্পর্কে সব তথ্য বের করতেই হবে–আগামী কালই। অদ্ভুত এক অমোঘ আকর্ষণে টানছে মেয়েটি ওকে।

রানা ভাবছে, সোনার চোরাচালান ধরতে পারছে না কাস্টমস, কিন্তু কেউ যদি এই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের দেশে যায়, তা হলে ঠিক ধরে ফেলবে। এই মেয়েটি খাঁটি সোনা। অনেক কষ্টি পাথরে যাচাই করা। কারও চোখ এড়ানো সম্ভব নয়, ঠিক আটকে ফেলবে কাস্টমস্। কথাটা মনে উদয় হতে একটু হাসল রানা।

এক চুমুকে গ্লাসের দেড় ইঞ্চি অবশিষ্টটুকু গলাধঃকরণ করে রানা ভাবল, সাগর তীরে হাঁটবে কিছুক্ষণ। আরও খানিকটা নেমে এসেছে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে। আর অল্পক্ষণ পরেই মেঘেরা পরবে রঙীন সাজ। তারপর বসন্তের রাত্রি নামবে করাচি বন্দরে। মহানগরীর অলিতে গলিতে নেমে আসবে রাতের পাপ পঙ্কিল বিভীষিকা। গলিমুখে রূপজীবিনীর ভিড়, হোটেলে/বারে জুয়া-মদ মেয়েমানুষের ছড়াছড়ি। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে মানুষের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে পশু। বাঈজীর কণ্ঠে বসন্তবাহারের সুর মাতাল করে তুলবে সঙ্গীত কক্ষের মদ্যপ শ্রোতাদেরকে।

উঠে পড়তে যাচ্ছিল রানা, এমন সময় চোখে পড়ল ঠিক দশ হাত দূরে জিনাত সুলতানা! অনাবৃত ক্ষীণ কটি। সারা দেহে হিল্লোল তুলে এগিয়ে আসছে। ওর টেবিলের দিকে। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকল রানা ওর দিকে। গত রাত্রির দুর্ব্যবহারের জন্যে দুঃখিত হয়ে ক্ষমা চাইবে নাকি মেয়েটা? সন্ধ্যের আগেই আজ উঠে এল যে খেলা ছেড়ে? রানার চোখে চোখ পড়তেই বিচিত্র এক টুকরো হাসি খেলে গেল মেয়েটির ঠোঁটের কোণে।

‘বসতে পারি?’ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।

‘বসুন।

ঠিক রানার পাশের চেয়ারে বসে পড়ল জিনাত। একটা উগ্র সেন্টের গন্ধ এল নাকে। মেয়েটিকে দেখলেই প্রখর রোদ আর সোডা ওয়াটারের ঝাঁঝের কথা মনে পড়ে যায়। কড়া সেন্টের গন্ধ বেমানান লাগে না একে মাখলে। ট প্রথমেই রেভলন নেইল পলিশ লাগানো নখ দিয়ে টেবিলের উপর রাখা রানার আনকোরা থ্রি-কাসলস প্যাকেটের ওপরকার সেলোফেন পেপার ছিঁড়ে ফেলল জিনাত। একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাতেই লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল রানা সেটা।

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

একগাল ধোঁয়া ছাড়ল জিনাত। চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানল। একটার পর একটা রিঙ তৈরি করতে থাকল ধোয়া দিয়ে। কয়েক টানেই অর্ধেকের কাছাকাছি চলে এল আগুনটা।

‘আমার পেছনে লেগেছ কেন তুমি? গত তিনদিন ধরে লক্ষ করছি। কী চাও তুমি আমার কাছে?

কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল রানা। হাওয়া তা হলে এই দিকেই বইছে। টেবিলের উপর দুই কনুই রেখে হাতের তালুর উপর চিবুক রেখেছে। জিনাত। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে রানার চোখের উপর। রানার দৃষ্টিটা নেমে গিয়েছিল খানিকটা নীচে নিজের অজান্তেই। ক্ষুদ্র চোলিতে অর্ধাবৃত বুকের উপর লতিয়ে পড়ে আছে একটা সোনার লকেট। বড় সাইজের একটা হীরে বসানো আছে তাতে। হঠাৎ চোখ তুলেই বুঝল রানা গভীর মনোযোগের সাথে তাকে লক্ষ করছে জিনাত সুলতানা। লজ্জিত হলো ও একটু।

কী? উত্তর দিচ্ছ না যে? কেন আমার পিছনে লেগেছ তুমি?

এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি সুন্দর, তাই।’

জীবনে কতবার যে কথাটা বলেছে রানা। ভাবল এবারও বুঝি কাজে লাগবে। এ স্তুতি। কিন্তু না, ভুরু জোড়া কুঁচকে গিয়েই আবার সোজা হয়ে গেল। জিনাতের। একটুও হাসল না সে। কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ লাগল রানার কাছে।

ভালবাস আমাকে?

হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল জিনাত। অবাক হয়ে গেল রানা। পাগল নাকি?–এ কেমন ধারা প্রশ্ন? চেনা নেই, শোনা নেই, কিছু না; হঠাৎ ‘ভালবাস?

‘সে সুযোগ তো দাওনি,’ বলল ও স্বাভাবিক কণ্ঠে।

‘পছন্দ করো?

‘নিশ্চয়ই। তোমাকে কে না পছন্দ করবে, বলো?

হঠাৎ অ্যাশট্রের মধ্যে সিগারেটটা ঠেসে মুচড়ে নিভিয়ে দিল জিনাত। মনে। হলো কোনও একটা ভয়ঙ্কর আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হলো এইভাবে। চিবুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আবার সোজা রানার চোখের উপর চোখ রাখল সে। অদ্ভুত এক মাদকতা সে চোখে।

‘ঠিক। সবাই পছন্দ করে। তার কারণও আমার অজানা নেই। বিদ্রুপের বাঁকা হাসি ফুটে উঠল ওর অধরে। তারপর বলল, ‘সবাই পছন্দ করে, পেতে চায়। খুব সহজেই পাওয়া যায় আমাকে। চাও তুমি?

ধক্‌ করে উঠল রানার বুকের ভিতরটা। হঠাৎ কী হলো মেয়েটির? এসব কী বলছে ও?

‘এ কেমন ধারা প্রশ্ন, জিনাত? ঠাট্টা করছ?

তুমি কি আমার ভগ্নিপতি, যে ঠাট্টা করব? অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল জিনাত। যদি ইচ্ছে হয় তা হলে আজ রাতে আসতে পারো আমার ঘরে। কিন্তু বিনিময়ে টাকা দিতে হবে। এক্ষুনি।’

মনে মনে আশ্চর্য না হয়ে পারল না রানা। তা হলে এই ব্যাপার? টাকার বিনিময়ে দেহ? কিন্তু মেয়েটিকে তো ঠিক ও-রকম মনে হয় না। কোনও

অসুবিধায় পড়ে এই কাজ করতে যাচ্ছে না তো?

টাকার তো তোমার অভাব আছে বলে মনে হয় না, বলল রানা। কিন্তু সে কথা থাক। কত টাকা চাই?

দশ হাজার। আমাকে যা-ই মনে করো না কেন? টাকা আমার দরকার। এখন আমি সর্বস্বান্ত।

কী করবে টাকা দিয়ে?

‘সেটা তোমাকে বলতে আমি বাধ্য নই। তবু বলছি। ফ্ল্যাশ খেলব।’

‘এই পাঁচ দিন খুব ফ্ল্যাশ খেলছ বুঝি?

হ্যাঁ।

কত টাকা হারলে?’

‘দেড় লাখ।

‘দেড় লাখ টাকা! অথচ এখনও নেশা কাটেনি তোমার?

‘এত কথা শুনতে চাই না। টাকা দেবে কি না বলে দাও পরিষ্কার।

‘ওই জোচ্চোরের সাথে ফ্ল্যাশ খেলে হারবার জন্যে তোমাকে এক পয়সাও দিতে পারব না আমি। কেন তুমি এভাবে নিজেকে…’

‘উপদেশ খয়রাত করবার কোনও প্রয়োজন নেই, মি. মাসুদ রানা। ভাল মন্দ বুঝবার বয়েস আমার হয়েছে। মনে কোরো না তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছি আমি। তুমি ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই, ভুলেও এ ধারণা কোরো না। এটা তোমার প্রতি একটা বিশেষ অনুগ্রহ ছিল বলেই জেনো। ওয়ালী আহমেদ প্রস্তাব দিয়েছে শুধু একটি দিন অনুগ্রহ করলেই আমার সব টাকা ও ফিরিয়ে দেবে। আমি রাজি হইনি। ওর কাছ থেকে যদি না-ও নিই, এখানকার যে কোনও লোকের কাছে এই প্রস্তাব দিলেই টাকা নিয়ে কুকুরের মত ছুটবে আমার পিছন পিছন। কাজেই উপদেশ খয়রাত করতে এসো না। তোমাকেই প্রথম সুযোগ দেব মনে করেছিলাম। যাক, তুমি যখন রাজি নও তখন, সো লঙ।’

উঠে পড়েছিল জিনাত। রানা ধরে ফেলল ওর হাত। বসে পড়ল সে আবার।

‘তোমাকে যত দেখছি ততই তোমার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছি আমি, জিনাত। আমিই দিচ্ছি টাকাটা। বিনিময়ে কিছু দিতে হবে না। তোমাকে আমি …’

‘মহত্ত্ব দেখানো হচ্ছে, না?’ খেপে উঠল জিনাত। তোমার কৃপা চাই না আমি। আমার কথায় রাজি থাকলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওই টেবিলে পৌঁছে দেবে টাকাটা। উঠে দাঁড়াল সে। ঘড়িটা দেখল একবার। মনে রেখো, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।

চলে গেল জিনাত সেইলরস ক্লাবের দিকে। রানা চেয়ে দেখল নিবিষ্ট চিত্তে খবরের কাগজ পড়ছে ওয়ালী আহমেদ। গত রাতে ডলফিন ক্লাবে বাকারাত। খেলে চল্লিশ হাজার টাকা উপার্জন করেছিল রানা। তার থেকে দশ হাজার খরচ করা ওর জন্য কিছুই না। স্থির করল ও টাকাটা দেবে। কিন্তু কোনও কিছুর লোভে নয়। মেয়েটির নিশ্চয়ই মাথায় গোলমাল আছে। সেই সুযোগে তার দেহ ভোগ করবার কথা চিন্তাও করতে পারে না রানা। তীব্র কোনও বেদনা লুকিয়ে আছে মেয়েটির মনের মধ্যে, অহরহ ছিন্নভিন্ন করছে তাকে। অদ্ভুত একটা মমত্ববোধ জাগল রানার ওর প্রতি। টাকাটা দিলেই যে তার ঘরে যেতে হবে। এমন তো কোনও কথা নেই। টাকা না দিলে মেয়েটি যাচ্ছে-তাই করে বসতে পারে, সেজন্যে দেবে।

লিফটে করে সোজা পাঁচতলায় উঠে ঘর থেকে টাকাগুলো নিল রানা। ঘরের। সঙ্গে লাগানো। ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। জোরালো হাওয়া আসছে সাগর থেকে। ঢেউ ভেঙে পড়ছে এসে বালুকা বেলায়। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। একটা ফাণ্টার বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জিনাত ক্লাবের দরজার সামনে। রানার উপর চোখ পড়ল ওর। রানা হাত নাড়ল। ক্লাবের ভিতর চলে গেল জিনাত। একতলার লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় রানা লক্ষ্য করল সেই তিনজন লোক ঠিকই বসে আছে কোণের টেবিলে। রানার দিকে নির্বিকার মুখে। তাকাল একজন। পাশের লোকটিকে কিছু বলল। সে-ও চাইল রানার দিকে। মতলব কী ব্যাটাদের? এরা নজর রাখছে কেন তার ওপর? ধরা পড়ে গেল নাকি ও? সাবধান হতে হবে। গত তিন দিন থেকে এখানে আড্ডা গেড়েছে। লোকগুলো। বেরিয়ে গেল রানা লাউঞ্জ থেকে চিন্তিত মুখে।

কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা, তবু খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলল না ওয়ালী আহমেদ। পরিচয় করিয়ে দেবে বলে জিনাত ডাকল, এই যে, শুনছেন?’ কোনও সাড়া নেই। গলা নিচু করে জিনাত রানাকে বলল, কানে কম শোনে। তারপর জোরে আবার ডাক দিল, ‘কই সাহেব, শুনছেন?

‘অ্যাঁ!’ বলে চমকে উঠল ওয়ালী আহমেদ। কাগজটা চোখ থেকে নামিয়ে রানাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

‘ইনি মিস্টার ওয়ালী আহমেদ, আর ইনি মিস্টার মাসুদ রানা,’ বলল জিনাত।

‘গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু, মিস্টার মাসুক নানা। উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাণ্ড শেক করল ওয়ালী আহমেদ। নরম তুলতুলে হাতটা। যেন কাদা দিয়ে তৈরি, কিম্বা অর্ধেক বাতাস ভরা বেলুনের গ্লাভস। গা-টা ঘিন ঘিন করে উঠল রানার। লম্বা চওড়া মেদবহুল দেহ লোকটার। চুলগুলো লালচে। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। ঠোঁটের ওপর পাতলা লালচে গোঁফ। সারাটা মুখে বুটি বুটি বসন্তের দাগ। অস্বাভাবিক সবজেটে চোখ। একটু খেয়াল করতেই রানা বুঝল চশমার বদলে কন্ট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে নিয়েছে চোখে। স্থির দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে থাকল ওয়ালী আহমেদ কয়েক মুহূর্ত। তারপর অমায়িক হাসি হেসে বলল, ‘বসুন, মিস্টার নানা।’

হাসির সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল দাঁতগুলো। ঠিক যেন তরমুজের বিচি। এতক্ষণে রানার চোখে পড়ল টেবিলের একপাশে রাখা একটা রুপোর কৌটা। ভর্তি পান। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর একটা করে পান মুখে দিচ্ছে সে। ফলে। দাঁতগুলো আর দর্শনযোগ্য নেই।

‘আমার নাম মাসুদ রানা। মাশুক নানা নয়, একটা চেয়ারে বসে বলল রানা।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। মাসুদ নানা। মাসুদ নানা। মুখস্থ করবার মত করে বলল ওয়ালী আহমেদ। তারপর বুক পকেট থেকে হিয়ারিং এইডটা বের করে। কানে লাগাল। মৃদু হেসে বলল, আপনিও খেলবেন নাকি, মিস্টার নানা?

‘জী, না।’

টাকা ভর্তি এনভেলপটা জিনাতের হাতে দিল রানা ওয়ালী আহমেদকে আড়াল করে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না ওয়ালী আহমেদ। জিনাতকে জিজ্ঞেস করল, তা হলে? খেলা কি আজকের মত শেষ?

‘শেষ হবে কেন, ডিল করুন না। টাকা জোগাড় হয়ে গেছে।

রানার দিকে আরেকবার চাইল ওয়ালী আহমেদ চট করে। তারপর একটা পান মুখে ফেলে নতুন এক প্যাকেট তাস সর্ট করতে আরম্ভব করল। রানাকে জিজ্ঞেস করল, আছেন কোথায়, মি. নানা?

‘এই হোটেলেই। আঙুল দিয়ে দেখাল রানা হোটেলের দিকে।

না মানে, কী করছেন?

ব্যবসা।

কীসের ব্যবসা? কার্ড ডিল করে জিজ্ঞেস করল আবার ওয়ালী আহমেদ।

‘আমাদের ঈস্ট পাকিস্তানের কয়েকটা প্রোডাক্টের জন্যে করাচিতে হোলসেল মার্কেট তৈরির চেষ্টায় এসেছি আমি।’

‘কেমন রেসপন্স পাচ্ছেন?’ এক শ’ টাকার নোট খেলল ওয়ালী আহমেদ।

মন্দ না।’

দুই এক দান খেলেই শো করতে বলল জিনাত। জ্যাক টপেই দান জিতে নিয়ে গেল ওয়ালী আহমেদ।

‘তা ক’দিন থাকবেন?’ আর সপ্তাহ খানেক।’

রানার ইচ্ছে, আরও কয়েক দান খেলা দেখবে। রহস্যটা ভেদ করতেই হবে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে চুরি করছে ওয়ালী আহমেদ কোনও উপায়ে। কিন্তু ভাবছে, এতবড় ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট-যে একটা ব্যাঙ্কের ম্যানিজিং ডিরেক্টর, যে একটা মোটর অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট, তিনটে কটন মিল, একটা জুট মিল এবং গোটাকয়েক নামজাদা হোটেলের মালিক, এবং আরও বহু কোম্পানির ডিরেক্টর, সেই ওয়ালী আহমেদ একটা সাধারণ সোসাইটি গার্লের কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা জোচ্চুরি করে ছিনিয়ে নিতে যাবে কেন? অথচ চুরি যে করছে তাতে কোনও ভুল নেই। নইলে দুই হাতের ফ্ল্যাশ খেলায় পাঁচ দিনে দেড়লক্ষ টাকা জেতা এক কথায় অসম্ভব। যত উঁচু স্টেকই হোক না কেন।

আবার পঞ্চাশ টাকা বোর্ড ফি রাখল দুজন। তিনটে-তিনটে ছ’টা কার্ড বেঁটে দিল জিনাত ওয়ালী আহমেদের কাটা হয়ে গেলে পর। এবারও হারল জিনাত। রানা লক্ষ্য করল কার্ড বাটার মধ্যে কোনও রকম চাতুরীর আভাস নেই। আঙুলে আংটি কিংবা সার্জিক্যাল টেপ নেই যে চিহ্ন দিয়ে রাখবে তাসে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খেলা ওয়ালী আহমেদের। অথচ ছমিনিটের মধ্যেই দুই হাজার টাকা হেরে গেল জিনাত। জিনাতের হাতে ভাল কার্ড পড়লেই কীভাবে যেন টের পেয়ে যাচ্ছে ওয়ালী আহমেদ। ফেলে দিচ্ছে হাতের তাস। শুধু বোর্ড ফি-টা। পাচ্ছে জিনাত। কিন্তু নিজের হাতে যদি বেশি ভাল কার্ড থাকে তা হলে অনেকদূর পর্যন্ত এগোচ্ছে খেলা-জিনাত শো’ না দিলে খেলেই চলেছে। কোনও রকম ব্লাফেই বিচলিত করতে পারছে না জিনাত ওকে। রানা স্থির নিশ্চিত হলো, চুরি করছে ওয়ালী আহমেদ। কিন্তু কী উপায়ে?

একবার জিনাত পেল ফ্ল্যাশ। ফেলে দিল ওয়ালী আহমেদ ওর হাতের কার্ড ‘অফ’ বলে। চট করে কার্ডগুলো তুলে রানা দেখল কিং-এর পেয়ার ছিল ওর হাতে। কিন্তু এক দানও না খেলে নামিয়ে রেখেছে হাতের কার্ড ওয়ালী আহমেদ।

‘অদ্ভুত আপনার আন্দাজ তো!’ টিটকারি মারল রানা।

‘জী, হাঁ। আমি মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কার হাতে কী আছে। এই চোখে কিছুই এড়ায় না।’ বলে একটা পাই পয়সা দিয়ে দুটো টোকা দিল দুই চৌখে। ঠুন ঠুন করে শব্দ হলো।

‘মিস জিনাত কি বরাবরই হারছেন আপনার কাছে?

বরাবর। ওঁকে নিষেধ করেছি। তবু উনি খেলবেন।’

‘আমি দেখেছি জায়গা বদলালে অনেক সময় ভাগ্য ফিরে যায়। আপনারা জায়গা বদলে নিলেই পারেন,’ বলল রানা।

‘সেটা সম্ভব নয়, গম্ভীর মুখে বলল ওয়ালী আহমেদ। সেটা আমি প্রথম দিনই মিস সুলতানাকে বলে নিয়েছি। ওদিকে বসলে সাগর চোখে পড়ে। অ্যাগোরাফোবিয়া রোগ আছে আমার। চোখের সামনে খোলা বিস্তৃতি সহ্য করতে পারি না। তাই হোটেলের দিকে মুখ করে বসি সব সময়। উল্টো দিকে বসলে খেলতে পারব না আমি।’

ক্লসট্রোফোবিয়ার নাম শুনেছি, কিন্তু অ্যাগোরাফোবিয়া তো শুনিনি কোনওদিন?

হ্যাঁ। বেশ অসাধারণ রোগ।

মুখে পান ফেলল ওয়ালী আহমেদ। রানার অনেকখানি বোঝা হয়ে গেছে।

আপনিও বোধহয় এই হোটেলেই আছেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

হ্যাঁ।

‘ওই যে খোলা দেখা যাচ্ছে, এটা আপনার সুইট না? দোতলাতেই আছেন বোধহয়?

‘জী, হাঁ।’ স্থির দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে বলল ওয়ালী আহমেদ।

‘অনেকগুলো দরজাই খোলা দেখা যাচ্ছে। ওগুলোর মধ্যে একটা আমার। আগামী তিন বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছি ওটা আমি।’

উঠে জিনাতের পিছনে দাঁড়াল রানা কিছুক্ষণ। দেখা গেল জিততে আরম্ভ করেছে জিনাত। মৃদু হেসে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল রানা ক্লাব থেকে। হোটেলের দিকে যেতে যেতে পাশ ফিরে একবার দেখল রানা ওদের। ইতিমধ্যে। সাত হাজার টাকা হেরে গেছে জিনাত। ওয়ালী আহমেদ, হোটেলের দিকে মুখ করে বসতে চায়, নাকি জিনাতকে হোটেলের দিকে পিঠ দিয়ে বসাতে চায়? কারণটা কী?

ওয়ালী আহমেদের সুইট-এর দিকে চাইল রানা। কিছু নেই। বিকেলের পড়ন্ত রোদ ব্যালকনিতে। খোলা দরজা দিয়ে ঘরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে।

ফিরে গেল রানা ‘বারে। আবার চোখ পড়ল তার সেই তিনজন লোকের ওপর। কী চায় এরা? জোর করে দূর করে দিল মন থেকে এদের চিন্তা। একটা বড় পেগ আর সোডা অর্ডার দিয়ে আগের সেই চেয়ারটায় গিয়ে বসল ও আবার। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জুয়াড়িদের। বুঝতে পেরেছে রানা ওয়ালী আহমেদের অবিচ্ছিন্ন জয়ের রহস্যটা। কিন্তু ওকে ধরিয়ে দেয়ার আগ্রহ বোধ করল না ও মোটেই। কী হবে একজন ক্ষমতাশালী লোককে অকারণে ঘটিয়ে? ওয়ালী আহমেদ চুরি করলে ওর কী? শত্রু বাড়িয়ে লাভ আছে?

কিন্তু অদ্ভুত বুদ্ধিমান তো এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বড়লোকটি! আশ্চর্য!

.

০৩.

রাত সাড়ে বারোটা। ইজি চেয়ারে শুয়ে পাতা ওল্টাচ্ছে রানা জন ব্লেকের ‘দ্য গোল্ড স্মাগলিং’ বইয়ের। স্বর্ণ-ইতিহাস থেকে আরম্ভ হয়েছে বইটা। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ মাটি খুঁড়ে চলেছে সোনার লোভে। কোথায় ঈজিপ্টের সোনা, মন্টেজুমা আর ইনকাসের খনি। মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্ণখনি নিঃশেষ করল মাইডাস আর ক্রোয়েসাস। ইউরোপে রাইন, পোর উপত্যকা, মালাগা, গ্রানাডার। সমতলভূমি চষে ফেলা হলো। সোনা চাই, সোনা চাই, খেপে উঠল পৃথিবীর মানুষ। নিঃশেষ করল বালকান আর সাইপ্রাসের সোনা। ওদিকে রোমানরা সোনা তুলল ওয়েলস, ডেভন আর কর্নওয়াল থেকে। তারপর এল মেক্সিকো, পেরু। তারপর গোল্ড কোস্ট। উনবিংশ শতাব্দীতে লেনা এবং ইউরালে খনি আবিষ্কার করল রাশানরা। সে-ও শেষ। এখন সোনা উঠছে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটে।

কেবল ১৫০০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আঠারো হাজার টন সোনা, তোলা হয়েছে ভূগর্ভ থেকে। ১৯০০ থেকে আজ পর্যন্ত (১৯৬৩ খ্রি: সংস্করণ) তোলা হয়েছে একচল্লিশ হাজার টন। আগামী পঞ্চাশ বছরেই শেষ হয়ে যাবে গোটা পৃথিবীর স্বর্ণ-সঞ্চয়।

বিরক্ত হয়ে রেখে দিল রানা বইটা। বইখানা গছিয়ে দিয়েছেন ঢাকায় রাহাত খান। বলেছেন চমৎকার বই, খুব মজার। বুড়ো যে কীসে মজা পায় আর কীসে পায় না বোঝা মুশকিল। বিশ পাতা পড়ে রানা বুঝল, এর মধ্যে দাঁত ফোঁটানোর ক্ষমতা ওর নেই। এ আখের রস, তালের নয়। মজা পেতে হলে দাঁতের জোর চাই।

ইংরেজদের ওই দোষ। যা করবে একেবারে গোড়া বেঁধে নিয়ে করবে। আরে বাবা, লিখতে বসেছিস গোল্ড স্মাগলিং। গ্রিল সিরিজের মত লিখে যাবি। চমকপ্রদ সব ঘটনা। তা অত লেকচার মারছিস কেন? এই থিসিস সাবমিট করে। দিলেই তো পিএইচডি মিলে যেত। তা না করে কেন মিছে আমাদের মত সাধারণ পাঠককে নাকানি চুবানি খাওয়ানো, বাবা? অত যদি বিদ্যের ভুড়ভুড়ি ওঠে পেটের মধ্যে তো কলেজে ঢুকে পড়ো না, চাঁদ। প্রচুর শ্রোতা পাবে।

মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে বইটা। টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আবার সজোরে রাখল রানা ওটাকে টেবিলের উপর। গায়ের ঝাল একটু কমল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল ও’। শো শো একটানা সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। স্লিপিং গাউনটা পত পত উড়ছে পতাকার মত। নীচে সেইলরস ক্লাবের কাঁচের ওপাশে কালো পর্দা টানা। এক-আধ চিলতে উজ্জ্বল আলো এসে পড়ছে বাইরে। কালো আলখেল্লা গায়ে জাদুকরের মত লাগছে ঘরটাকে। ভিতরে তার অসীম রহস্য। আর তীক্ষ্ণবুদ্ধির চমক।

এই আলখেল্লার জন্যেই ওয়ালী আহমেদ সন্ধ্যার পর খেলতে পারে না। খেলার কথায় রানার মনে পড়ল জিনাত সুলতানার কথা। অদ্ভুত মেয়ে। এত রূপই ওর কাল হয়েছে। বারবার প্রবঞ্চনা পেয়েছে সে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান পুরুষের কাছ থেকে। মমতা হয় রানার।

এখনও কি অপেক্ষা করে আছে ও রানার জন্যে? বোধহয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কথা দিয়েও যায়নি রানা আজ ওর ঘরে। টাকার বিনিময়ে নারীদেহ ভোগ করবার কথা ভাবতেও পারে না ও। অসম্ভব। যদি রানাকে কেউ পশু মনে করে তার জন্য অপেক্ষা করে, তা হলে রানার কী করবার আছে?

শীত শীত করছে। দোসরা মার্চ। বাংলায় ফাল্গুন মাস। কিন্তু শীতের আমেজ যায়নি। একটু বেশি রাতে তো রীতিমত শীত। ঘরের ভেতর চলে এল। রানা। ওদিকের দরজাটা বন্ধ করে দিল। দুটো কামরা নিয়ে ওর সুইট। ড্রইং রুমের মধ্য দিয়ে বেরোতে হয় বাইরে। দরজা বন্ধ আছে কি না আরেকবার পরীক্ষা করে তিন ওয়াটের সবুজ বাতিটা জ্বেলে দিয়ে বাকি সব বাতি নিভিয়ে দিল রানা। দামি কম্বলের তলায় ঢুকে পাশ ফিরতে যাবে এমন সময় কান খাড়া হয়ে গেল ওর, দরজায় মৃদু টোকা। আবার শব্দটা হতেই বুঝল কানের ভুল নয়।

মদু সাবধানী টোকা। কে হতে পারে? সোহেল? না শত্রুপক্ষ? নিঃশব্দ পায়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল। অপর পারে। ঠুন করে একটা হাল্কা আওয়াজ হতেই মৃদু হেসে বাতি জ্বালল রানা। চুড়ির আওয়াজ। দরজা খুলতেই ঘরে প্রবেশ করল জিনাত সুলতানা। আলুথালু বেশ। খোলা এলো চুল। বোঝা গেল এই মাত্র বিছানা থেকে উঠে এসেছে।

‘কী ব্যাপার, জিনাত?

কোনও উত্তর না দিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল জিনাত। তারপর ঘুরে দাঁড়াল রানার মুখোমুখি। রানার ওপর একবার আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে। নিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল সে। যেন নিজের বাড়ি। রানাও এল পিছন পিছন। স্লান সবুজ আলো জ্বলছে, সুইচ টিপে উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দিল সে।

কথা দিয়েও এলে না কেন?’ জিনাতের কণ্ঠে তিরস্কার। মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ও রানার।

‘আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

‘টাকা দিয়েছ, সুযোগ নেবে না কেন? মানুষে এমনিতেই ভোগ করতে চায়!

‘দেখো, জিনাত, মানুষের কথা ছেড়ে দাও। আমি কোনওদিন পুরোপুরি মানুষ হতে পারিনি। টাকার বিনিময়ে তোমার দেহের অধিকার আমি চাই না। সত্যিই চাই না।’

বৃক্ততা আরম্ভ করে দিয়েছ দেখছি। তা হলে টাকা দিলে কেন?

‘ওটা দিয়েছি অন্য কারণে।

‘দয়া? না পবিত্র প্রেম?’ জিনাতের কণ্ঠে বিদ্রূপ।

না। দয়া নয়, প্রেমও নয়-মমতা। তোমার মত আমিও অনেক আঘাত পেয়েছি, জিনাত। আমি জানি তোমার বেদনার জ্বালা। তোমার দেহের লোভেই যদি টাকা দিতাম তা হলে এত টাকা দিতে যাব কেন বলো। এর বিশ ভাগের এক ভাগ দিয়েই তো ইচ্ছে করলে আমি সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারতাম অন্যত্র। ভুল বুঝো না আমাকে, প্লিজ। আমি তোমাকে কৃপা বা দয়া করিনি।’

‘তোমার মমতার কোনও প্রয়োজন নেই আমার, রানা। কারও মমতা, আর আমাকে ফেরাতে পারবে না। একটা কথার সোজা উত্তর দেবে?

‘নিশ্চয়ই।

তুমি অপমান করতে চাও আমাকে?’ বিছানার উপর বসল জিনাত।

না। ঢের অপমান পেয়েছ তুমি মানুষের কাছে। আর না।

‘তবে চলে এসো। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। টাকার কথা ভুলে যাও। টাকা না পেলেও আমি আসতাম। তোমার স্পর্শের স্মৃতি আমার জীবনের শেষ স্মৃতি হোক।’

তার মানে?

মানে বুঝবার কোনও প্রয়োজন নেই তোমার। উঠে দাঁড়িয়ে দুই পা এগিয়ে এল জিনাত। দু’চোখ ধিক্ ধিক্ জ্বলছে তার।

‘দেখ, জিনাত। যে মিলনে প্রেম নেই…’

‘প্রেম আছে!’ বাধা দিল জিনাত দৃপ্ত কণ্ঠে। এক্ষুণি তোমার মনের মধ্যেও জ্বলে উঠবে প্রেমের আগুন। তুমি পুরুষ, আমি নারী। দুজনে চাইব দুজনকে একান্ত করে। এরই নাম প্রেম।

কিন্তু…

‘কোনও কিন্তু নয়। কোনও কথাই শুনব না আমি।

রানার আপত্তি দেখে আবার বলল জিনাত, তোমার টাকাটা আমি ধার হিসেবে গ্রহণ করলাম। টাকার বিনিময়ে সুযোগ গ্রহণ করতে হবে না তোমাকে।

আমি যদি না-ও থাকি ও টাকা ফেরত পাবে তুমি।’

রানা ভাবল, না-ও থাকি মানে? কোথাও চলে যাচ্ছে নাকি মেয়েটা? নাকি আত্মহত্যা করতে চায়? ফেরত দেবেই বা কে?

অপলক চোখে চেয়ে রইল রানা এই অদ্ভুত মেয়েটির দিকে। কী হয়েছে ওর? কীসের প্রচণ্ড ধাক্কায় চুরমার হয়ে গেছে মেয়েটির হৃদয়? সহ্যের শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে সে, যেন এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। কিন্তু কেন?

মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখল রানা মেয়েটির অতুলনীয় সৌন্দর্য। যৌবন ধন্য হয়েছে ওই দেহকে আশ্রয় করে। উদ্যত ফণা শঙ্খিনীর মত টেনে আনল রানাকে জিনাত অমোঘ এক আকর্ষণে। ঠিক চুম্বকের মত। এগিয়ে গেল রানা। একটা হাত রাখল জিনাতের কাঁধে।

‘জিনাত! তুমি…’

‘কোনও কথা নয়।

একটা আঙুল রাখল ও রানার ঠোঁটের উপর। এক হাতে উজ্জ্বল বাতিরসুইচটা নিভিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকের উপর। সবুজ স্বপ্নিল আলোটা জ্বলছে ঘরের ভিতর। রেশমের মত সসৃণ এলোচুল থেকে বিদেশি ক্রিমের সূক্ষ্ম একটা মিষ্টি সুবাস এসে আবেশে আচ্ছন্ন করল রানাকে। হাত ধরে টেনে নিয়ে এল ওকে জিনাত বিছানার পাশে। একটা একটা করে দুজনের দেহ থেকে খসে মেঝেতে পড়তে থাকল ওদের পরনের কাপড়। সব শেষে ঝুপ করে গোল হয়ে মেঝেতে পড়ল পেটিকোটটা।…

চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে জিনাত রানার প্রেম। মুখে মৃদু হাসি, ম্লান সবুজ আলোয় অপরূপ লাগছে ওর হাসি। ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল জিনাতের মুখটা। নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠল দেহ, কপালের একটা শিরা দপদপ করে লাফাল কয়েকবার।

হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। এলিয়ে পড়ল দেহটা বিছানায়,। ওর-স্বেদ সিক্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে গেল রানা-সরিয়ে দিল ও হাতটা।

‘জিনাত! লক্ষ্মী মেয়ে, শোনো। তুমি দেবে না আমাকে কোনও রকম সাহায্যের সুযোগ? জীবনে হয়তো অনেক দুঃখ পেয়েছ তুমি। তেমনি আমিও পেয়েছি, সবাই পায়। কিন্তু জীবনটা অনেক বড়–সামনে হয়তো…

‘চুপ। এসব কথা শুনতে চাই না আমি। তুমি ঘুমোও তো!’

আবার রানার মুখে হাত চাপা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল জিনাত! পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল। রানারও প্রায় চোখ লেগে এসেছিল, হঠাৎ সচেতন হয়ে চোখ না খুলেই অনুভব করল ওর কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে নেমে গেল জিনাত বিছানা থেকে। জামা কাপড় পরে নিয়ে চলে গেল সে নিজের ঘরে।

ঘুম আসছে না কিছুতেই। ঘুরে ফিরে কেবল জিনাতের কথা ভাবছে রানা। কে এই মেয়েটি? ভেঙে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পৌঁছে গেছে বেচারী। ওকে ফেরানো যায় না? রানার কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি নয় ও। কিন্তু… কিছুই কি করবার নেই রানার? বালিশে জিনাতের চুলের সুবাস, চাদরে গায়ের ক্রিমের গন্ধ। বিছানায় ওর অনুপম দেহের উত্তাপ। কেন জানি নিজেকে বড় অযোগ্য মনে হলো ওর।

শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবছে রানা। তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে টেরই পায়নি ও। ভোর হয়ে এসেছে। সাড়ে চারটে বাজে। মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে এবার ঘুমাবার চেষ্টা করল ও। কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে। শুলো। সমস্ত শরীর ঢিল করে দিয়ে ডাকল ঘুমের সুষুপ্তিকে।

এমনি সময় বাইরে করিডোরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল রানা। কেউ হেঁটে চলে গেল ওর ঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে। এত ভোরে কে যায়? জিনাত না তো! দরজাটা নিঃশব্দে খুলে একটু ফাঁক করে দেখল রানা। সত্যি, জিনাত। করিডোরের, মোড় ঘুরে সিঁড়ির দিকে চলে গেল সে। চুলগুলো তেমনি আলুথালু। হাঁটার ভঙ্গিটা ক্লান্ত, অবসন্ন। যেন স্বপ্নের ঘোরে হাঁটছে শ্লথ পায়ে।

কাক-পক্ষীও ওঠেনি এখন। এই ভোর রাতে কোথায় চলেছে জিনাত? হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর কথা মনে আসতেই চমকে উঠল রানা। ছুটে গিয়ে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে স্যাণ্ডেল পায়ে বেরিয়ে এল ও ঘর থেকে।

রানা যখন রাস্তায় নামল জিনাত তখন চলে গেছে অর্ধেক পথ। সেইলরস ক্লাবের পাশ দিয়ে সোজা সাগরের দিকে চলেছে সে। রাস্তা ছেড়ে বালিতে নামল। জিনাত। আশপাশে যদ্র দেখা যায় একটা জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। পূর্ব দিকের আকাশটায় একটু ফরসা হয়ে আসার আভাস। আবছা কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যায় না। দ্রুত হাটছে রানা। ওর চোখ দুটো স্থির ভাবে নিবদ্ধ সামনের মূর্তিটার উপর। মাথার মধ্যে দ্রুত চিন্তা। তাই একবারও ভাবল না ও পিছন ফিরে চাইবার কথা। চাইলে দেখতে পেত ঠিক বিশ গজ পিছন পিছন আসছে তিনজন। ষণ্ডামার্কা লোক। সেই তিনজন।

নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতে চলেছে জিনাত। রানা ভাবছে, কী বলা যায়? এ কী করছ, জিনাত? বললে সোজা উত্তর আসবে, তোমার মাথাব্যথা কীসের? তোমার নোংরা নাকটা না গলালে চলে না? যদি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘আরে, তুমি এখানে? তুমিও খুব ভোরে স্নান কর বুঝি!’ কিংবা ‘হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। ভালই হলো, দেখা হয়ে গেল। চলো না আজ, কোথাও আউটিং এ যাই! তা হলে অতিরিক্ত নাটকীয় হয়ে যায়। তা ছাড়া ও যে পরিষ্কার মিথ্যে কথা বলছে, বুঝবে জিনাত। গায়ে পড়ে উপকারের চেষ্টা দেখে বিতৃষ্ণায় ভরে যাবে ওর মন।

তার চেয়ে সত্যি কথাটাই বলবে। তোমার পায়ের শব্দ শুনে পিছু নিয়েছি আমি, জিনাত। কিছুতেই মরতে দেব না আমি তোমাকে। আমার জন্যে বাঁচতে হবে তোমাকে। চলো আমার সঙ্গে। যদি না আসে তা হলে কি জোর করে ধরে নিয়ে আসবে? কিন্তু তাতে বিপদের আশঙ্কা আছে। চিৎকার আর ধস্তাধস্তি করলে লোকজন জমা হয়ে পিটিয়ে লাশ করবে ওকে। কেলেঙ্কারী কারবার হয়ে যাবে। দেখা যাক, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।

সাগরের একেবারে কাছে চলে গেছে জিনাত। দৌড়াতে আরম্ভ করল রানা। ওর পায়ের তালে তালে পিছনের তিনজনও দৌড়াচ্ছে এখন। হাঁটু পানিতে নেমে গেছে জিনাত।

‘জিনাত!’ রানা ডাকল।

চমকে ফিরে চাইল জিনাত। দুই গাল বেয়ে পানি পড়ছে ওর অঝোর ধারায়। আবছা কণ্ঠে বলল, ‘কে! কী চাও তুমি?

হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা, উঠে এসো জিনাত। এভাবে মরতে পারবে তুমি। কিছুতেই মরতে দেব না আমি তোমাকে।

কী যেন বিড় বিড় করে বলল জিনাত, রানা বুঝতে পারল না। রানার কাঁধের ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টিটা চলে গেছে পিছনে। কী দেখছে পিছনে ভেবে যেই রানা পিছন ফিরতে যাবে ওমনি কথা বলে উঠল একজন উর্দুতে। আদেশের সুর সে কণ্ঠে।

‘খবরদার! মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও। এক ইঞ্চিও নড়বে না!’

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। যমদূতের মত দাঁড়িয়ে আছে সেই তিনজন পাঠান। স্থির, নিশ্চল। খালি হাতে থাকলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারত রানা। কিন্তু দেখল তিনজনের হাতেই তিনটে চকচকে রিভলভার, ওর দিকে ধরা। ধীরে হাত তুলল রানা মাথার উপর।

ব্যাপার কী? কারা এরা? সাধারণ চোর হ্যাঁচোড় তো নিশ্চয়ই নয়। আজ তিনদিন ধরে লক্ষ্য রাখছে এরা ওর ওপর। ওর পরিচয় কি প্রকাশ পেয়ে গেল। শত্রুপক্ষের কাছে? আজ এই ভোর রাতে যখন ধাওয়া করে এসেছে পেছন পেছন তখন নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে ওদের। নারী দেহের লোভে যে এসেছে তা মনে হয় না। এটা তার উপযুক্ত সময় নয়। তা হলে? কী চায় এরা? ওকে ধরিয়ে দেবার জন্য মেয়েটিকে ওর জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি তো?

এখানেই ওকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে ওদের নেই বোঝা গেল। আওয়াজ শুনে হোটেল থেকে লোকজন বেরিয়ে আসবে, সেজন্যেই হয়তো। দুজন। রিভলভার ধরে থাকল, আর তৃতীয়জন তার রিভলভারটা পকেটে পুরে দ্রুত পরীক্ষা করল রানার সাথে কোনও অস্ত্র আছে কি না। কিছু নেই। রানা বুঝল। এই সুযোগ। অন্তত কিছুক্ষণ দেরিও যদি করানো যায় তা হলে ভাগ্য প্রসন্ন। থাকলে কোনও না কোনও সাহায্য এসে যেতে পারে। গুলি ওরা নেহাত নিরুপায় না হলে ছুঁড়বে না। খপ করে লোকটার ডান হাতটা কব্জির কাছে ধরেই বাম হাতে কনুইটা ঠেলে ওপর দিকে ওঠাল রানা। এটা যুযুৎসুর খুব সহজ একটা প্যাঁচ। বেকায়দা অবস্থায় পিঠের দিকে চলে এল হাত-শরীরের উপর দিক ঝুঁকে পড়ল সামনে। মাঝারি রকমের একটা চাপ দিতেই মুখ দিয়ে আল্লার নাম বেরিয়ে পড়ল লোকটার। আরেকটু জোরে চাপ দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে কাঁধের হাড়। এমন সময় দেখা গেল একটা জিপ এগিয়ে আসছে বালুর উপর দিয়ে।

রানা ভাবল, এইবার ব্যাটাদের দেখে নেবে। সোজা শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে বাছাধনেরা। জিপের আরোহী যে-ই হোক না কেন, নিশ্চয়ই ওর এই বিপদে সাহায্য করবে। কিন্তু মেয়েটা সম্পর্কে কী গল্প বানিয়ে বলবে ও? এই ভোর। রাতে সাগর পারে কেন আসে একজন ভদ্রমহিলা? তার ওপর এমন আলুথালু বেশ।

ওদের দেখতে পেয়েছে জিপের ড্রাইভার। সোজা এগিয়ে আসছে এদিকে। জয়ের উল্লাসে রানা বলল, এখনও সময় আছে, বাপ। তোমরা দুজন কেটে পড়তে পার ইচ্ছে করলে–কিন্তু এই শালাকে ছাড়ছি না।’

কোনও রকম ভাবান্তর হলো না রিভলভারধারীদের চেহারায়। একজন শুধু কাছে এসে চট করে তৃতীয়জনের রিভলভারটা তুলে নিল ওর পকেট থেকে। তারপর আবার কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নির্বিকার চিত্তে। জিপটা কাছে এসে থামতেই লাফিয়ে নামল আরও দুজন। চুপসে গেল রানার সব উৎসাহ। চেহারা দেখেই বোঝা গেল একই দলের লোক।

এবার পরিষ্কার ইংরেজিতে একজন বলল, বাধা দিলে বেহুদা জখম হবে, মিস্টার। হাতটা ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে এসে বসো।’

রিভলভার দিয়ে ইঙ্গিত করতেই জিনাত গিয়ে উঠে পড়ল জিপের পিছনে। রানা বুঝল বাধা দিয়ে এখন লাভ নেই। ও-ও ভালমানুষের মত গিয়ে বসল জিনাতের পাশে। রানার কাবু করে ফেলা তৃতীয়জন ড্রাইভারের পাশে বসল ডান কাধটা ডলতে ডলতে। বাকি চারজনও উঠে বসল গাড়ির পেছনে ঠাসাঠাসি করে। জিনাতকে অভয় দেয়ার জন্যে ওর উরুতে একটু চাপ দিল রানা এক হাতে। আর একটু কাছে ঘেঁষে এল, জিনাত প্রত্যুত্তরে।

একটা ব্যাপার রানা লক্ষ্য করল যে জিনাতের প্রতি এতটুকু অশ্লীল ইঙ্গিত করল না একটি লোকও। এমনকী ওর দিকে চোখ তুলেও চাইছে না কেউ। সাধারণত স্ত্রীলোককে হাতের মুঠোয় পেলে পুরুষ দুবৃত্ত যে ব্যবহার করে থাকে তার কিছুমাত্র প্রকাশ পেল না ওদের ব্যবহারে। দ্বিতীয়বার ভাবল রানা, জিনাত কি টোপ হিসেবে কাজ করল? ওরা একজনকে বন্দি করল, না দুজনকেই? ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে কেউ? না, কি কোনও প্রেমিক বা স্বামীর ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ? এর শেষ কী? নির্যাতন? খুন?

টাওয়ার ছাড়িয়ে ম্যাকলিওড রোডে পড়ল জিপ। নিউ স্টেট ব্যাঙ্ক বিল্ডিং পার হয়ে ঢুকল উডস্ট্রিটে, তারপর বার্নস রোড। নাজিমাবাদের দিকে চলেছে ওরা।

চমৎকার একটা দোতলা বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় এসে থামল জিপ। আরও চারজন পাঠান বেরিয়ে এল। একটিও বাক্য বিনিময় হলো না। চারদিক থেকে ঘিরে রানা এবং জিনাতকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ির ভিতর। লোকগুলোর। চলাফেরা হাবভাব ঠিক চাবি দেয়া যন্ত্রের মত।

কিছুদূর গিয়েই বাঁয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। রানাও জিনাতের পিছু পিছু উঠতে যাচ্ছিল ওপরে। বাধা দিল একজন।

তুম ইস্তারাফ।

ডানধারের দরজা দিয়ে ভারী একটা পর্দা তুলে ঢোকানো হলো রানাকে। চমৎকার সুসজ্জিত একটা ওয়েটিং রুম। অতিথিদের অপেক্ষা করবার জন্য। ঘরের চারকোণে পা-লম্বা টেবিলের উপর চারটে ফ্লাওয়ার ভাসে তাজা ফুলের তোড়া। ওপাশে আরেকটা ঘর। বোধহয় ড্রইং-রুম। সেই দরজাতেও দামি পর্দা। ঝোলানো।

রানাকে সম্পূর্ণ আওতার মধ্যে পেয়ে ওদের সতর্কতায় একটু ঢিল পড়েছিল। তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল রানা। পিছনে না চেয়েই ডান কনুইটা রেল ইঞ্জিনের পিস্টনের মত সজোরে চালিয়ে দিল ও পিঠের সাথে ঘেঁষে থাকা লোকটার পেটের উপর সোলার প্লেক্সাসে।

‘ঘোত করে একটা শব্দ বেরোল ওর মুখ দিয়ে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে টান দিয়ে রিভলভারটা বের করে নিল রানা ওর ওয়েস্টব্যাণ্ড থেকে। কেউ কিছু বুঝবার আগেই একলাফে হাত চারেক পিছিয়ে এল সে।

‘হ্যাণ্ডস আপ! দুই হাত ঘাড়ের পিছনে তুলে দাঁড়াও সবাই।

বুড়ো আঙুল দিয়ে হ্যাঁমারটা তুলল রানা রিভলভারের। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে একজন। বাকি তিনজন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানা। এমন সময় ঠিক কানের কাছে একটা মোলায়েম পুরুষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘সাবাস, মাসুদ রানা! কিন্তু পেছন দিকটাও একটু খেয়াল রাখতে হয়। কেবল সামনের দিকে নজর রাখলে কি চলে? চারদিক সামাল দিতে পারলেই না বলব সত্যিকারের হুঁশিয়ার।’

অত্যন্ত গুরু গম্ভীর, কিন্তু ভদ্র মার্জিত কণ্ঠস্বর। রানা বুঝল হেরে গেছে সে। ভাবল, ঘুরে দাঁড়িয়েই গুলি করবে, যা থাকে কপালে। ঠিক যেন ওঁর চিন্তাটা বুঝতে পেরেই আবার কথা বলে উঠল পিছনের লোকটি। উর্দুর মধ্যে ফ্রন্টিয়ারের টান।

‘আমাকে মেরে কোনও লাভ নেই, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি আপনার শত্রু নই। তা ছাড়া ঘুরে দেখুন, আমি নিরস্ত্র। আপনি আমার মেহমান। কেউ কিছু বলবে না আপনাকে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে রানা দেখল ডান হাতে পর্দাটা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রৌঢ় পাঠান। পরিষ্কার করে গোপ-দাড়ি কামানো। মুখে স্মিত হাসি। প্রশস্ত কপালে বুদ্ধির ছটা। কানের কাছে চুলগুলোতে পাক ধরেছে। লম্বায় রানার চেয়ে ইঞ্চি চারেক ছোট হবে। কিন্তু প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল অসুরের শক্তি আছে ওই পেশিবহুল দেহে। আর বুকের মধ্যে আছে দুর্জয় সাহস। রানা ঘুরতেই পিছন থেকে এগিয়ে আসছিল দুইজন। হাত উঠিয়ে থামতে ইশারা করল ওদের দলপতি। পশতু ভাষায় কিছু বলল। মাটি থেকে টান দিয়ে তুলল ওরা আহত সঙ্গীকে। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘আসুন। ভেতরে আসুন, মিস্টার মাসুদ রানা। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার। কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে। আপনার হাতে রিভলভার আছে। ইচ্ছে করলেই আমাকে খতম করে দিতে পারেন আপনি। কাজেই নিজেকে বন্দি মনে করবেন না। আমিই বরং আপনার বন্দি।

হাসল ভদ্রলোক। অদ্ভুত আকর্ষণীয় হাসি। রানার মনে হলো কোথায় যেন দেখেছে আগে এই হাসি। কিন্তু স্মৃতির পাতা হাতড়ে এই মুখটা কিছুতেই মনে পড়ল না ওর। হাসিটার অদ্ভুত একটা সংক্রামক গুণ আছে। রানাও না হেসে পারল না। বহুদিন পর এমন সজীব, প্রাণবন্ত, ক্ষমতাবান একজন মানুষের মুখোমুখি হলো ও। লোকটার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ আছে, মুখের মধ্যে একটা বাল্ব ধরলে দপ করে জ্বলে উঠবে। নিজের অজান্তেই প্রসন্ন হয়ে উঠল রানার মনটা।

লোকটার পিছনে দরজার গায়ে ক্যালেণ্ডার ঝুলছিল একটা। মার্চ আর এপ্রিল মাস পাশাপাশি। হঠাৎ ‘এপ্রিল ফুল’ বলেই গুলি ছুঁড়ল রানা। পয়লা এপ্রিলের ছোট্ট চারকোণা ঘরের মধ্যে গিয়ে লাগল গুলিটা দলপতির কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল পাঠান ক্যালেণ্ডারটা।

‘সাবাস! বাঙ্গাল কা শের হো তুম, মাসুদ রানা। অব্যর্থ লক্ষ্য দেখে তারিফ করল সে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম খান মোহাম্মদ জান। শুনেছেন কখনও?

না। হঁটের মত শক্ত হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল রানা। নামটা চেনা চেনা লাগলেও মনে করতে পারল না ও কোথায় শুনেছে।

তাই নাকি? আশ্চর্য! কিন্তু আপনার নাম-ধাম পরিচয় সব আমার নখদর্পণে। আপনি পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এই ডিপার্টমেন্টে আসার আগে আপনি আর্মিতে মেজর ছিলেন। করাচি এসেছেন স্বর্ণমুগ শিকার করতে। কি? ঠিক বলিনি?

উজ্জ্বল হয়ে উঠল মোহাম্মদ জানের মুখ। মুখে সক্রামক হাসি।

রানা নিজের বিস্ময় গোপন করে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আপনি কোথাকার জ্যোতিষ্ক, জানতে পারি?

‘আমি মালাকান্দের ট্রাইবাল চিফ।

.

০৪.

এবার আর বিস্ময় গোপন করতে পারল না রানা। সম্ভ্রমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার লক্ষ্য করল প্রাণবন্ত মুখটা।

এই সেই দুর্দান্ত খান মোহাম্মদ জান। বৃটিশের রাজত্বকালে যে কিনা। ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। যার নাম বললেই পশ্চিম পাকিস্তানের ছেলে-বুড়ো সবাই চেনে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে যার নাম ভীতির সঙ্গে স্মরণ করা হয়। এই সেই খান মোহাম্মদ জান!

এই লোক তাকে বন্দি করে এনেছে কেন? এর নামে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে আলাদাভাবে একটা ফাইল রাখা আছে। সবাই জানে আফগানিস্তান, ইরান আর সোভিয়েট রিপাবলিকের দুবৃত্তদের সাথে এর মস্ত চোরাচালানী কারবার আছে। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে লোকটা এই উপায়ে। বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে জমা আছে এর অগাধ সম্পদের বেশ-অনেকখানি অংশ। অথচ কেউ কখনও আইনের প্যাঁচে ধরতে পারেনি একে বেকায়দা অবস্থায়। তার এলাকায় সে সম্রাট। পাকিস্তান সরকারও তাকে সব সময়ে ঘাটাতে সাহস। পায় না।

এই কি তা হলে সোনা চোরাচালানকারীদের অদৃশ্য সর্দার? একেই খুঁজে বের করবার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে ঢাকা থেকে?

কই, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, মি. মাসুদ রানা? বসুন।

একটা সোফায় বসে পড়ল রানা। গুলির শব্দে ছুটে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন। মোহাম্মদ জান হাতে তালি দিতেই ঘরের ভিতর ঢুকে সালাম করল একজন; পশতু ভাষায় কিছুক্ষণ অনর্গল কথা বলল মোহাম্মদ জান। লোকটার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই রানাকে বলল, আপনার জন্যে পাশের বাথরুমে সব কিছু তৈরি আছে, মিস্টার রানা। টুথব্রাশ, সাবান, টাওয়েল, সবই নতুন। আপনাকে বলেছি, আমি আপনার শত্রু নই। আপনি নিশ্চিন্ত মনে মুখ-হাত ধুয়ে আসুন। ততক্ষণে নাস্তা এসে যাবে। প্লিজ!’

‘জিনাতকে কোথায় রেখেছেন?

মৃদু হাসল মোহাম্মদ জান। বলল, ‘চিন্তা করবেন না। ওকেও যত্নে রাখা হয়েছে।’

বাথরুম থেকে বেরিয়ে রানা দেখল একটা টেবিল লাগানো হয়েছে ঘরের মধ্যে। তার দুপাশে দুটো চেয়ার। মস্ত একটা থালায় পাউরুটি টোস্টের পাহাড়। একটা বাটিতে মাখন। সাদা দুটো প্লেটে পাশাপাশি শুয়ে আছে প্রকাণ্ড সাইজের দুটো করে ধূমায়িত ওমলেট-চারটে ডিম দিয়ে তৈরি প্রতিটা। পাতলা করে কাটা টিনের পনির আছে একটা তস্তরির উপর। একটা দামি ফ্রট সেটে উঁচু করে। আঙুর, নাশপতি, আপেল আর মাল্টা-কিছু কাজুবাদাম আর আখরোট। সব মিলে টেবিলটা প্রায় ভরে যাবার যোগাড়। দশজন একসাথে চেষ্টা করলেও শেষ করতে পারবে না সব। মুখোমুখি বসল দুজন দুটো চেয়ারে।

মেজর মাসুদ রানা। আপনার সাথে যা আলোচনা করব তা গোপন রাখবেন বলে কথা দিতে হবে। একেবারে টপ সিক্রেট। রাজি?’

‘তেমন কোনও কথা আমি দেব না। রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কোনও কথা আমাকে বললে সেটা আমার পক্ষে গোপন রাখা সম্ভব হবে না।’

‘সেটা আমি ভাল করেই জানি, মিস্টার মাসুদ রানা। হাসল মোহাম্মদ জান। আপনার সম্পর্কে সব রকম রিপোর্ট নিয়েছি আমি। আপনার মত নীতিবান দেশপ্রেমিকের কাছে তেমন কোনও কথা আমি বলতেই বা যাব কোন সাহসে? আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলাপ করতে চাই। এই ধরুন, আমার একমাত্র কন্যা, জিনাত সম্পর্কে।

এইবার সত্যিই চমকে উঠল রানা। জিনাতের বাবা এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ট্রাইবাল চিফ? এতক্ষণে রানা বুঝল কেন হঠাৎ ফ্রন্টিয়ারের ক্ষমতাশালী এক সর্দার তার সাথে আলাপ করতে চায়। হাসিটাও চিনতে পারল রানা এখন-অবিকল জিনাতের হাসি। রীতিমত নাটক জমে উঠেছে মনে হচ্ছে!

‘তা হলে রাজি, মৃদু হেসে বলল রানা।

‘অনেক ধন্যবাদ। আপনার সম্পর্কে সরকারি রিপোর্টে বলে আপনি দায়িত্বশীল বিশ্বস্ততমদের একজন। রিপোর্ট না পড়েও আপনার মুখ দেখেই সে কথা অনায়াসে বলে দিতে পারতাম আমি। সত্যিকার মানুষ বলতে আমি যা বুঝি, আপনি তাই। সব কথা খুলেই বলব আমি আপনাকে। তার আগে আসুন। নাস্তার পালাটা শেষ করে নেয়া যাক।

নাস্তার পর কফি এল। একটা চেস্টারফিল্ড প্যাকেট থেকে নিজে একটা নিয়ে রানার দিকে বাড়িয়ে ধরল মোহাম্মদ জান। রানা একটা নিল। দুটোতেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে আরম্ভ করল মোহাম্মদ জান:

‘আজ বারো বছর আমি বিপত্নীক। আর বিয়ে থা করিনি। মর্দানের সেরা সুন্দরীকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে এসে বিয়ে করেছিলাম আমি। এবং ভালবেসেছিলাম।

‘মায়ের অভাবে আমার একমাত্র সন্তান এই জিনাত বখে যেতে পারে সেই ভয়ে ওকে লাহোরের শ্রেষ্ঠ বোর্ডিং স্কুলের হোস্টেলে রেখেছিলাম। ছুটি ছাটায় বাড়ি আসত। ওদের শিক্ষা-দীক্ষায় আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। সিনিয়ার কেজি পর্যন্ত ভালই ছিল কিন্তু কলেজে উঠে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বংশ-মর্যাদাবিহীন বড়লোকদের আলট্রা-মডার্ন সব ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশা আরম্ভ করল। জিনাত। খারাপ সংসর্গের এমনই গুণ, এক মাসের মধ্যেই লাজুক পাহাড়ি মেয়েটা বদলে গেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত। চক্রবৃদ্ধি হারে খারাপ লোক এসে ভিড় করল ওর আশপাশে। একেবারেই বখে গেল মেয়েটা। ফিল্ম লাইনে। ঘোরাফেরা আরম্ভ করল। অনেক রাতে ফেরে হোস্টেলে। মাঝে মাঝে দু’একদিন ফেরেও না। হোস্টেলের সুপারের চিঠি আসতে আরম্ভ করল আমার। কাছে। প্রথমে আমি বিশ্বাসই করিনি ওদের নালিশ। নিজ সন্তানের ওপর সব পিতারই এমন অন্ধ বিশ্বাস থাকে।

‘কিন্তু ফোর্থ ইয়ারে উঠে কলেজের এক ছোকরা প্রফেসরের সাথে বাথরুমে ধরা পড়ায় রাসটিকেট করা হলো ওকে।

‘বিশ্বাস করুন, মি. রানা, এই একটি মাত্র মেয়ের দুঃখ হবে বলে বয়স থাকতেও আর বিয়ে করিনি আমি। ওকে চোখের মণি করে রেখে ওর মায়ের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করতাম। যা চাইত, তাই পেত সে। এদিকে আমাকে সেই সময়টা দৌড়াদৌড়ির ওপর থাকতে হত। কয়েকটা কেসে গোলমাল হয়ে যাওয়ায় ধরা পড়বার উপক্রম হয়েছিল। ওর দিকে নজর দেবার সময় পেতাম না। নিজেকে শেষ করে ফেলল ও। সব ব্যাপারে দেখে-শুনে এবার আমি কঠিন হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। আরও অবাধ্য হয়ে উঠল ও। হাত খরচের টাকা কমিয়ে দিলাম। তার ফলে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার

জন্যই বোধহয় ও প্রেমিকদের কাছে টাকা নিতে আরম্ভ করল, যেখানে সেখানে। ধার করতে আরম্ভ করল।’

সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে চুপচাপ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল মোহাম্মদ জান। বোধহয় গুছিয়ে নিল কথাগুলো মনের মধ্যে।

কিন্তু যত যা-ই করুক, ওর মনের একটা দিক নিরন্তর চাবুক মারত ওকে। হাজার হোক, ভাল বংশের মেয়ে। বিবেক দংশন আরম্ভ হলো ওর মধ্যে। নিজেকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করল ও। ঠিক সেই সময়েই বোধহয় আত্মহত্যার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ওর মধ্যে। নিজেকে শুধরাবার চেষ্টা করল জিনাত। জীবনে শান্তি পাওয়ার আশাতেই বোধহয় বিয়ে করে বসল হঠাৎ আমাকে না। জানিয়ে এক ফিল্মস্টারকে। ফিল্ম-লাইন পছন্দ না করলেও আমি খুশি হয়েছিলাম ওর এই পরিবর্তন দেখে। এক কোটি টাকার উপঢৌকন পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বছর দুয়েক হলো ওর সমস্ত টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি চুরি করে পালিয়ে গেছে সেই হিরো বোম্বেতে নাম করবার আশায়। জিনাতের কোলে। তখন তিন মাসের একটা শিশু।

চুপচাপ মন দিয়ে শুনছে রানা রহস্যময়ী মেয়েটার পূর্ব ইতিহাস। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসল ও।

‘অনেক টাকা পয়সা খরচ করে এবং ভয় দেখিয়ে আমি তালাক আদায় করি সেই হিরোর কাছ থেকে। মারীতে একটা বাড়ি কিনে দিলাম জিনাতকে। মনে হলো যেন শান্তি পেল মেয়েটা। বেশ ছিল বাচ্চাকে নিয়ে বিভোর হয়ে। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। আজ আট মাস হলো হঠাৎ একসাথে ডাবল নিউমোনিয়া আর ব্যাসিলারি ডিসেনট্রি হয়ে মারা গেছে বাচ্চাটা।

‘আপনাকে কী বলব, মিস্টার রানা। আমার একমাত্র আদুরে জিদ্দি মেয়েটার কপালে খোদা ভাল যেটুকু লিখেছিল, সে-সময় বোধহয় কলমে তার কালি ছিল না।

‘এই চরম আঘাত পেয়ে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে খেপে গেল মেয়েটা। কিছুতেই আর আপোষ করবে না। ধ্বংস করে ফেলবে নিজেকে। আবার ফিরে গেল ও তার আগের জীবনে। আজ এখানে কাল ওখানে পাগলের মত ও জীবনটা চেখে নিতে চাইল শেষ বিদায়ের আগে। আমি অনেক চেষ্টা করলাম ওর সাথে দেখা করবার, কথা বলবার। কিন্তু হলো না! বারবার এড়িয়ে চলে। গেল ও। কিছুতেই সন্ধি করবে না ও নিষ্ঠুর জীবনের সাথে। আমিও পাগলের মত খুঁজে বেড়াতে থাকলাম ওকে। লোক লাগালাম চারদিকে। কিন্তু আমি পেশোয়ার পৌঁছতে ও চলে যায় পিণ্ডি, পিণ্ডি পৌঁছলে খবর পাই চলে গেছে। লাহোর। কিছুতেই ধরতে পারি না ওকে। কিছুদিন একেবারে গায়েব হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ খবর এল ও করাচির বিচ লাগজারি হোটেলে একটা রুম রিজার্ভ করেছে। ছুটে এলাম করাচি। পাহাড়ি দেশের মানুষ আমরা, সাগরকে সব সময়। ভয় পাই। যখন শুনলাম ও সাগর পারের হোটেলে উঠেছে তখন থেকে আধমরা হয়ে আছি আমি, মিস্টার রানা। জানলাম, দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসছে। যে কোনও মুহূর্তে আমার হাত ফসকে চলে যাবে ও নাগালের বাইরে, চিরতরে।

একটানা এতক্ষণ কথা বলায় দুই কষায় ফেনা জমেছে মোহাম্মদ জানের। রুমাল দিয়ে মুছে নিল সেটা। আরেকটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ টানল সিগারেটটা।

‘আপনাকে আজ আমার এতদিনকার বুকে চেপে রাখা গোপন কথা বলতে পেরে মনটা যে কতখানি হাল্কা হয়ে গেল, মিস্টার রানা, বোঝাতে পারব না! যাক, যা বলছিলাম, কড়া নজর রাখলাম আমি ওর ওপর।

হোটেলের সেই তিনজন লোকের কথা মনে পড়ল রানার।

‘ওর প্রতিটা পদক্ষেপ আমার লোক লক্ষ করেছে। এবং প্রতি দশ মিনিট পর পর টেলিফোনে জানিয়েছে আমাকে। আপনাকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি এখনও। জিনাতকে টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করবার জন্যে আমি আপনার কাছে। আন্তরিক কৃতজ্ঞ।’

‘সাহায্য তো নয়, বরং ক্ষতিই হয়েছে। সব টাকা হেরেছে,’ বলল রানা।

‘কিছু বলা যায় না, মেজর। কিছুই বলা যায় না। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তা এক ওপরওয়ালাই জানেন। আমরা তার কী বুঝি? যাক, যা বলছিলাম। এই বাড়িতে বসেই ওর গতিবিধি আমার নখদর্পণে ছিল। সব খবরই জানি আমি। বমি করে ঘর ভাসানো, আপনার সাহায্য করতে এগিয়ে আসা থেকে নিয়ে রাত পোনে একটায় আপনার ঘরে জিনাতের প্রবেশ এবং দেড়টায় প্রস্থান-কিছুই আমার অজানা নেই।’

অস্বস্তি বোধ করল রানা। একটু নড়ে চড়ে উঠল। হাত উঠিয়ে যেন অভয় দিল ওকে সর্দার।

‘এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই, মেজর রানা। ব্যাটা-ছেলের এতে লজ্জার কিছুই নেই। আর আমার মেয়েও কচি খুকি নয়। তা ছাড়া কে জানে, হয়তো…যাক, সে কথায় পরে আসছি। এমনও হতে পারে গত রাতের ঘটনাটাই ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। হয়তো এটা একটা চিকিৎসার কাজই করল ওর জন্যে।

এইবার খানিকটা আঁচ করতে পারল রানা কেন ওকে ধরে আনা হয়েছে। এর আসল রহস্যটা কোথায়। কেন জানি একবার শিউরে উঠল ওর সর্বশরীর। যেন কেউ হেঁটে চলে গেল ওর কবরের ওপর দিয়ে।

‘গত দুই দিনেই আমি আপনার সম্পর্কে সব তথ্য জোগাড় করে ফেললাম।’

কীভাবে?’ চট করে জিজ্ঞেস করল রানা।

হাসল খান মোহাম্মদ জান ওর সেই সংক্রামক হাসি।

‘সেটা যদিও আমার বলা উচিত না, তবু বলব আপনাকে। কারণ আমি যদি খবর বের করতে পেরে থাকি, অন্যেও পারবে। এটা আপনার নিরাপত্তার ওপর স্পষ্ট হুমকি। কিন্তু এসব কথা পরে হবে। আগে আমার গল্প শেষ করে নিই।

আবার দু’কাপ কফি এল। লোকটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকল খান মোহাম্মদ জান।

‘আপনার সম্পর্কে যা রিপোর্ট পেলাম এবং টেলিফোনে যা খবর পেলাম তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উঠলাম আমি। রাত দুটো পর্যন্ত চিন্তার পর ওদের জানালাম, আপনার সাথে দেখা করতে চাই আমি। আপনার অনেক সময় নষ্ট হলো, সেজন্যে এই জোড় হাত করে মাফ চাইছি আমি। আপনি হয়তো মনে করেছিলেন বিপদে পড়েছেন, সেজন্যেও ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এ ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না, মিস্টার রানা।

‘আর কোনও উপায়ে কি আমার দেখা পাওয়া সম্ভব ছিল না? একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলল রানা।

উঠে এসে রানার বাহুর ওপর হাত রাখল মোহাম্মদ জান।

‘সেজন্যে তো মাফই চাইছি, মেজর। একটা আকুল পিতৃ-হৃদয়ের উদ্বেগের সাথে পরিচয় হতে আপনার দেরি আছে অনেক। আরও পঁচিশটা বছর যাক, তখন বুঝবেন। তা ছাড়া একটু পরেই বুঝবেন ব্যাপারটা কত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডেকে আনতে বললে যে ওরা একেবারে বেধে নিয়ে আসবে তা অবশ্য আমার জানা ছিল না। কিন্তু এর প্রয়োজনও ছিল। এই চিঠিটা পড়লে আর আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। এই নিন, পড়ে দেখুন। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিল মোহাম্মদ জান। যেই জিনাত রওনা হয়েছে সাগরের দিকে ওমনি আমার লোক ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে এখানে। এই চিঠিটা ছিল ওর টেবিলের ওপর। আপনিও তো কিছু সন্দেহ করেছিলেন, তাই না? এখন দেখুন।

ছোট্ট চিঠিটা উর্দুতে লেখা। ‘রানা পড়ল:

আব্বাজী,

এ ছাড়া আমার আর কিছুই করবার ছিল না। শুধু একটু খারাপ লাগছে। একজনের জন্যেও আমাকে ভাল করতে চেয়েছিল। লোকটা বাঙালি। নাম মাসুদ রানা। ওকে খুঁজে বের করে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিয়ো। আমি ধার নিয়েছিলাম। আর তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। বিদায়।

জিনা

চিঠি থেকে চোখ তুলে চাইল রানা। উদগ্রীব একজোড়া চোখ চেয়ে আছে। ওর মুখের দিকে। ফেরত দিল রানা চিঠিটা। ভাজ করে পকেটে রাখল সেটা মোহাম্মদ জান। তারপর হঠাৎ রানার ডান হাতটা তুলে নিল নিজের দুই হাতে।

‘মাসুদ রানা। আপনি সমস্ত কাহিনি শুনলেন। প্রমাণও দেখলেন। খোদা জানে, এর মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে কথা নেই। একটু দয়া করবেন আমার ওপর? মেয়েটাকে রক্ষা করতে একটু সাহায্য করবেন আমাকে? বলুন?

করুণ মিনতি সর্দারের চোখে-মুখে। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে টেবিলের উপর রাখল রানা। কপালে ঘাম দেখা দিল ওর। টেবিলের উপর রাখা হাতের দিকে চেয়ে রয়েছে ও-চোখ তুলল না। মনে মনে ভাবছে, এ কি ফ্যাকড়ায় পড়ল ও।

সে তো ডাক্তার নয়। সে কী সাহায্য করবে? যেন হাতের সাথে কথা বলছে। এমনি ভাবে বলল, আমার মনে হয় না আমি তেমন কোনও সাহায্য করতে পারব। আপনার কী মনে হয়?

উত্তেজনায় জান মোহাম্মদের কপালের দুটো শিরা ফুলে উঠেছে। গলার স্বরে একটা জরুরি ভাব আর সেইসাথে কাতর অনুনয় ফুটে উঠল। কাঁপা কাঁপা। গলায় বলল, ‘আমি চাই তুমি আমার মেয়ের সাথে প্রেম করো, ওকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে তিন কোটি টাকা দেব যৌতুক হিসাবে।’

ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠল রানা।

বাজে বকছেন আপনি, সর্দার। মেয়েটি ভুগছে মানসিক ব্যাধিতে, ভাল ডাক্তার দেখান। কাউকে বিয়ে করব না আমি-আর কারও টাকারও আমার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট রোজগার করি আমি।

একটু থেমে শান্ত গলায় আবার বলল, ‘জিনাতকে আমি পছন্দ করি। ওকে কোনও রকম সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু ও অসুখ থেকে সেরে উঠলেই কেবল ওর সাথে আমার প্রেম বা বিয়ের কথা উঠতে পারে। তার আগে নয়। আমি একজন দুরন্ত প্রকৃতির লোক-শত্রু আর বিপদ নিয়ে আমার কারবার, আপনি জানেন। কারও সেবা-শুশ্রূষা করবার ধৈর্য আমার নেই। ওর। চিকিৎসা দরকার, সর্দার। আপনি যেভাবে ওকে সাহায্য করতে চাইছেন তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বুঝতে পারছেন না আমার কথাটা?

চুপচাপ শুনল কথাগুলো মোহাম্মদ জান রানার চোখের উপর চোখ রেখে। তারপর নরম গলায় বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। আপনার সাথে আমি তর্ক করব না। আপনি যেমন বললেন, ঠিক তাই করব আমি। কিন্তু দয়া করে শুধু একটা অনুগ্রহ করবেন?

কী?’

‘আজ সারাটা দিন ওর সাথে কাটিয়ে ওকে শুধু এটুকু বুঝিয়ে দেবেন, ওকে পছন্দ করেন আপনি, ওর প্রয়োজন আছে বেঁচে থাকবার, আবার দেখা হবে আপনাদের। যদি আপনি ওকে একটু আশা, একটু ভরসা দিতে পারেন, তা হলে বাকিটা আমি পারব বোঝাতে। আমার জন্যে এটুকু করবেন না আপনি, মেজর রানা?’

ব্যস? এইটুকুতেই খুশি? রানার বুকের উপর থেকে যেন পাথর সরে গেল একটা। তা হলে জোর করে ওর কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে চাইছে না এই ক্ষমতাশালী ট্রাইবাল চিফ?

‘নিশ্চয়ই!’ বলল রানা। এটুকু তো নিশ্চয়ই করব আমি। কিন্তু আমি মাত্র তিনদিন আছি করাচিতে। এরপর আপনাকে গ্রহণ করতে হবে ওর ভার।

মোহাম্মদ জানের মুখে হাসি ফুটল আবার।

‘এতক্ষণ পর! উঃ! এতক্ষণ পর একটু আশার আলো দেখালে, বাবা। তিনদিন যথেষ্ট। তারপর নিশ্চয়ই আমি ওর ভার নেব। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল মোহাম্মদ জান। তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার কোনও ভাষা নেই আমার, মেজর রানা। তুমি বাঁচালে আমাকে কিন্তু তোমার জন্যে কিছু করবার সুযোগ দেবে না আমাকে? আমার অনেক বুদ্ধি, অনেক টাকা আর অ-নে-ক ক্ষমতা আছে। সবই এখন তোমার। এমনকী কিছুই নেই আমি তোমার জন্যে করতে পারি না।’

হঠাৎ রানার মনে পড়ল তার কাজের কথা।

‘একজন লোককে খুঁজছি আমি। লোকটা

বুঝেছি। স্বর্ণমুগ। আজই রাত দশটায় হোটেলে থেকো-তোমাকে নিয়ে। যাব এক জায়গায়। সেখানে ওর খবর মিলতে পারে। তা ছাড়া আমি এক্ষুণি। চারদিকে লোক লাগিয়ে দিচ্ছি। এ কাজটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।’ উঠে দাঁড়াল মোহাম্মদ জান। রানাও উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ’ দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রানার দুই গালে চুমো খেল মোহাম্মদ জান। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘরে এসে ঢুকল জিনাত সুলতানা। জিনাতকে দেখেই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি রানাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল সর্দার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *