স্বর্ণমুকুট
শনি, রবিবারই তার পক্ষে প্রশস্ত সময়।
শনিবারেই প্রিয়তোষ অফিস থেকে সোজা শীতলকুচিতে চলে যায়। বাসে ঘণ্টাখানেক, তারপর কিছুটা কাঁচা রাস্তায় তাকে হাঁটতে হয়। গ্রাম জায়গা, ঠিক গ্রাম জায়গা বললেও ভুল হবে, ঘরবাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। কাশের জঙ্গল কিংবা মাঠ পার হয়ে খাল, খালের পাড়ে পাড়ে কিছুটা পথ, তারপর ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে কাঠাপাঁচেক জমি তার। জমিটা এক লণ্ঠনওলার। সে জমিটা বেশিদাম পাওয়ায় ছেড়ে দিচ্ছে। তার কুঁড়েঘরটি আছে। প্রিয়তোষের জায়গাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ার পর এই কুঁড়েঘরটায় সে শনি, রবিবার গিয়ে থাকে।
এবারে সে বেশ মুশকিলেই পড়ে গেছে। পানু প্রায়ই বলবে, বিশেষ করে শনিবার সকালে, বাবা, তুমি আজ যাচ্ছ।
যেতেই হবে। জঙ্গল সাফ করে ইট বালি পড়ার কথা। কতটা কী হল না গেলে বুঝব কী করে।
তুমি যে বলছিলে আমায় নিয়ে যাবে। ডাহুক পাখি দেখাবে।
প্রিয়তোষের এই স্বভাব। সোমবার অফিস করে বাড়ি ফিরলেই, নমিতা, পানু, এবং মা নানা প্রশ্ন করবেন। তারাও দু-একবার গেছে। নমিতা জমিটা কেনার আগে একবার গিয়েছিলেন, তাঁর খুব পছন্দ হয়নি। বরং কিছুটা ক্ষুব্ধই বলা চলে। শহরের কোনো সুবিধেই নেই, পানুর স্কুল, অসুখবিসুখে ডাক্তার এইসব অসুবিধের কথা উঠেছে। তবে এটাও ঠিক প্রিয়তোষের ক্ষমতাই বা কতটুকু, তার সামান্য চাকরি, এবং কিছু টিউশনি ছাড়া অর্থ উপার্জনের বড়ো আর কোনো উপায় নেই। সামান্য সঞ্চিত টাকায় বাস-রাস্তা থেকে এত কাছে জমি পাওয়াই কঠিন। জায়গাটার উন্নতি কবে হবে তাও ঠিক বলা যায় না। তবু কেন যে প্রিয়তোষের এত পছন্দ! আসলে গাছপালা এবং কিছু গরিব মানুষজন, যেমন লণ্ঠনওলার কথাই ধরা যাক, সে নিজের বাড়িতে বসেই ঝালাই করে, কুপিলক্ষ তৈরি করে এবং ঝুড়িতে বয়ে নিয়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কোনো ছকবাঁধা জীবন নয় তার। প্রিয়তোষের মনে হয়েছিল লোকটি একেবারে স্বাধীন। ঝোপজঙ্গলের ডাহুক পাখি, তা ছাড়া কাশের জঙ্গল পার হয়ে ঘাস এবং মাঠ সহ কিছু সাদা বকের ওড়াউড়িও তার পছন্দ। খুবই নিরিবিলি জায়গা। কোনো ব্যস্ততা নেই। কেমন এক নৈঃশব্দ্য রাতে বিরাজ করে। খাল পাড় হয়ে একটা শালের জঙ্গল আছে, সেখানে শেয়ালেরা রাতে হু ক্কাহুয়া করে ডাকে।
আসলে প্রিয়তোষেরা তিন পুরুষ ধরে ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। তাঁর বাবা শ্যামবাজারের এঁদোগলিতে সেই যে দেশ ভাগের পর এসে উঠেছিলেন আর নড়ার নাম করেননি। রাস্তায় ছিটকাপড়ের ব্যবসা, যার নাম হকারি, এই করে দিনযাপন। যাই হোক, প্রিয়তোষও এই বাসায় শৈশব থেকে বড়ো হয়েছে। ঘুপচিমতো ঘরে এত অন্ধকার যে, দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে রাখতে হয়। চারতলা বাড়ির একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরে তার শৈশব যৌবন কেটেছে, কোনোরকমে পাশটাশ দিয়ে সরকারি অফিসের আবহমানকালের কেরানিগিরিতে ঢুকে যাওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না তার। তার ছেলে পানুও জন্মেছে হাসপাতালে, বড়ো হচ্ছে এ বাড়িতে। টাউন স্কুলে পড়ছে। কাজেই যুক্তির কোনও স্বাদ সে জায়গাটায় গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলতেই পারে।
বাড়ি কবে হবে সে অবশ্য জানে না। আর হলেও, এমন একটা জনশূন্য মাঠের মধ্যে থাকা খুব সহজ কথা নয়। তবে স্বপ্ন, পাঁচ কাঠা জমির সবটাই তার। পানু সবসময়ই চঞ্চল স্বভাবের। ভূতের গল্প গোয়েন্দা গল্পের মতো কোনো ঘ্রাণ সে সেখানে না গিয়েও যেন পায়। বাবা কেন যে কিছুতেই নিয়ে যেতে চান না, সে তাও বুঝতে পারে না।
কবে যাবে, বায়না ধরলে, বাবার এক কথা, অতটা রাস্তা হেঁটে যেতে পারবি না। মাঠের মধ্যে একটা কুঁড়েঘরে থাকতে তোর একা ভয় করবে। আমার তো কত কাজ!
কেন, তোমার লণ্ঠনওলা!
আরে সে কখনো ফেরে, কখনো ফেরে না। তার কোনো ঠিক আছে? তাকে আমি থাকতে বলেছি বলে থাকে। সংসারে সে একা মানুষ, বেশিকিছু তার লাগেও না। বয়সেরও গাছ পাথর নেই। খোকাবাবুর জন্য সে একটা জাদুর লণ্ঠন বানিয়ে দেবে, ওটা হয়ে গেলেই সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
কোথায় যাবে বাবা?
কোথায় যাবে, তা অবশ্য কিছু বলেনি।
তারপরই কী ভেবে প্রিয়তোষ বলেছিলেন, ওর অবশ্য নদীর পাড়ে বাড়ি করার খুব ইচ্ছে। এই যেমন বলে, একটা গাছ, তার নীচে কুঁড়েঘর, সামনে নদী, নদীর জলে স্বর্ণমুকুটের প্রতিবিম্ব।
স্বর্ণমুকুট। তার মানে!
ওর এইরকমেরই কথা। হয়তো বলতে চেয়েছে, নদীর জল কলকল ছলছল। কলকল ছলছলই ওর কাছে স্বর্ণকুট হয়ে গেছে। জলে তার স্বর্ণমুকুট ভেসে যাচ্ছে সে দেখতে পায়।
লোকটা খুব তাজ্জব কথা বলে। তোমার বন্ধু না বাবা?
তা ওইরকমের। নামটাও ভারি মজার। তালেব সরকার। সে অবশ্য বলেছে, কর্তাঠাকুর আমাকে তালেব বলেই ডাকবেন।
তোমাকে কর্তাঠাকুর বলে কেন?
আমার গলায় পৈতে আছে না! পৈতে থাকলে কর্তাঠাকুর ছাড়া সে কিছু ভাবতে পারে না। আমি গেলে তার কাজ বাড়ে। সে আমাকে কিছুই করতে দেয় না। জল তুলে আনা, কাঠকুটো জোগাড় করা, উনুন গোবরে লেপে একেবারে নিরামিষাশী বামুনের আহারের সুবন্দোবস্ত। মাচানে শিম, লাউ, খেতে বেগুন, গাছের কাঁচালঙ্কা তার জমিতেই হয়। কাঠাখানেক জমিতেই প্রচুর ফলন।
তালেব গাছ লাগায় বাবা?
লাগায়। তবে ওই শিম, লাউ, বেগুনের চারা। সেখানে গেলে দেখতে পাবে গাছ লাগালে বড়ো হয় কী করে।
পানুর অবশ্য একটা ফুলের টব আছে। টবে সে গাছ লাগায়। তবে বাঁচে না। রোদ না পেলে গাছ বাঁচবে কেন! সে একটা ভুইচাঁপা লাগিয়েছিল, গাছটা বাঁচেনি। সে রথের মেলা থেকে দোপাটি ফুলের চারা এনেছিল, বাঁচেনি। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে গাছ বাঁচতে চায় না। মেলা রোদ সে রাস্তায় গেলে দেখতে পায়, অথচ বাড়িটায় তাদের রোদই ঢোকে না। বাবা খোলামেলা জায়গায় জমি কিনেছে, রোদ অহরহ এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, আর রাজ্যের পাখপাখালি, অর্থাৎ প্রাণীজগতের সাড়া পাওয়া যায়, এমন একটা জায়গায় সে না গিয়ে থাকে কী করে!
বাবা সব বলেন না। সেখানে গেলে সে যেন ঠিক একটা ছোট্ট টিলা আবিষ্কার করে ফেলবে। এবং জন্তু-জানোয়ারেরাও ঘুরে বেড়াতে পারে, সে কাঠবেড়ালি, খেঁকশেয়াল গেলেই দেখতে পাবে, সোনালি হয়ে সে ঘুরে বেড়াতে পারবে—কী মজা! সে তো কার্টুন ছবির যম। সুপারম্যান, স্পাইডার ওম্যান, টিনটিনরা বোধ হয়। সেইসব ঝোপজঙ্গলেই লুকিয়ে থাকে। টিভিতে সে যা দেখে, সবই সেখানে ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে আছে এমন মনে হয় তার। বাবা যায়, মাও ঘুরে এসেছে, ঠাম্মা যায়নি, সেও যায়নি। তার খুবই রাগ হয়। রাগ হলে নানা ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। সে না খেয়ে রাস্তায় দৌড়ে চলে যায়। ফুটপাথ ধরে দৌড়য়।
বাবা পড়ে যান মহাফাঁপরে। সে রাস্তাতেই হাত-পা ছুঁড়তে থাকে, বাজারের সামনে ফুল বিক্রি করে কদম ঠাকুর, সেই বলবে, নিয়ে গেলেই পারেন। ছেলেমানুষ, অলিগলিতে কাঁহাতক ঘুরে বেড়াতে পাবে!
পানু একদিন বলেই ফেলল, বাবা সেখানে ভালুক আছে?
না নেই। ‘বাঘ, হরিণ, টিয়া?
টিয়া আছে। বাঘ, হরিণ নেই।
আছে। তুমি দেখতে পাও না। তালেবকাকা সব জানে। তালেবকাকার কুকুর আছে?
তা আছে। নেড়ি কুকুর। কুকুরটা তালেবের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
কথা শোনে?
কথা শুনবে না কেন?
দু’পা তুলে নাচতে পারে?
তুই থামবি পানু?
কবে নিয়ে যাবে, আমাকে কবে জাদুর লণ্ঠন দেবে তালেবকাকা। আমি খাব না বলে দিলাম। আমার রাগ হয় না! দেখবে একদিন আমি নিজেই বের হয়ে যাব। জায়গাটা খুঁজে দেখা দরকার। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক জায়গায় চলে যাব!
এই রে! বের হয়ে যেতেই পারে পানু। স্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ে। মা তাকে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। এক দুপুরে গিয়ে যদি দেখে পানু স্কুলে নেই, না বলে না কয়ে স্কুল থেকে পালিয়েছে, তা হলেই সমূহ সর্বনাশ।
বাধ্য হয়ে প্রিয়তোষ না বলে পারলেন না, তুমি যাবে। নমিতাকেও বললেন, ওকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাব। জায়গাটা নিয়ে পানু নানা আজগুবি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। কার্টুনের সব চরিত্র সেখানে পালিয়ে আছে কখন কী করে বসবে তার চেয়ে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভাল। শনি, রবিবার থাকব। প্যান্ট-শার্ট আলাদা দিয়ে দেবে। পানুর উদ্ভট চিন্তাভাবনা আমার একদম পছন্দ না।
তুমি ছেলেটাকে নিয়ে শেষে জঙ্গলে রাত কাটাবে! আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।
তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু ছেলেটা সেখানে একা চলে গেলে তোমার ভালো লাগবে!
নমিতা অগত্যা নিমরাজি না হয়ে পারল না।
পানু যাবে শুনেই ঘরের মধ্যে ছুটে বেড়াতে থাকল। রাস্তায় ছুটে গেল। ফুল বেচে খায় লোকটাকে বলল, বাবা আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে।
এক সকালে প্রিয়তোষ, পানুকে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়েই অফিসে যেতে হল। শীতলকুচিতে যান বলে অফিসের কাজ আগেই হালকা করে রাখেন। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের না হলে দিন থাকতে জায়গাটায় পৌঁছনো অসম্ভব।
তাঁকে লাউহাটির বাস ধরতে হবে। অফিস ছুটি হলে বাসে জায়গা পাওয়াই মুশকিল। ঘণ্টাখানেক আগে এসেও জায়গা পেল না। দুটো বাস ছেড়ে দিতে হল। পরের বাসে সামনের দিকে জায়গা পেয়ে গেলেন! সঙ্গে একটা ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটল। মাঝে-মাঝেই পানু চুক চুক করে জল খাচ্ছে। কোনো উত্তেজনায় পড়ে গেলে এটা তার হয়।
বাসটা এয়ারপোর্ট থেকে জানদিকে ঘুরে গেল। পানু এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। চারপাশে যা দেখছে—পাকা বাড়ি, হাইরাইজ বিল্ডিং, এবং প্রশস্ত রাস্তা সবই তার চেনা। এসব দেখে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল সৃষ্টি হয়নি। এমনকী এয়ারপোর্টের উড়োজাহাজও তার কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। ক্রমে বাড়িঘর কমে আসতে থাকলে, বড়ো বড়ো গাছ এবং দুটো-একটা বাংলো টাইপের বাড়ি দেখে কিঞ্চিৎ সে উৎফুল্ল হল। বাস কিংবা অটোরও উৎপাত নেই। দুটো ভ্যানে কিছু লোকজন যাচ্ছিল সে বলল, বাবা দ্যাখো দ্যাখো, ওদিকে তাকাও না!
প্রিয়তোষ দেখলেন, দু-পাশে নয়ানজুলি, দুটো ভ্যান, তারপরই যতদূর চোখ যায় মাছের ভেড়ি—জল আর জল। এবং কিছু ধানের জমি। আসলে সামনেই তাদের নামতে হবে। তারপর হাঁটা। এবং কিছুটা ধানের জমি। কিছুটা রিকশায় গিয়ে নামতে পারে। তবে ঘুরপথ হয়ে যাবে। পানু একবার নুয়ে ব্যাগ খুলে কী দেখল!
কী খুঁজছিস?
সে টেনে বের করল।
প্রিয়তোষ দেখলেন পানু তার এয়ারগান লুকিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
পানুর বড়োমামা জন্মদিনে এয়ারগানটা দিয়ে গেছেন কবে যেন। এমন একটা স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে পানু এয়ারগান দিয়ে কী করবে! টিকটিকি, বড়োজোর দুটো একটা ইঁদুরকে তাড়া করতে পারে। রাস্তার কুকুরকে অবশ্য একবার তাড়া করতে গিয়ে পানুর খুবই ভোগান্তি হয়েছিল। কুকুরের কামড়ে যে জলাতঙ্কের বিষ থাকে সেবারে সুচ ফোঁটাতে ভালোই টের পেয়েছিল পানু। তারপর বোধহয় সে তার এয়ারগানটার কথা ভুলেই গিয়েছিল—সে জঙ্গলে যাচ্ছে, এয়ারগানটা খুবই জরুরি এখনও মনে হতে পারে তার।
পানু তার বাবার সঙ্গে হাঁটছিল। রাস্তার ডানপাশের ভেড়ি ফেলে তারা মাঠের দিকে নেমে গেল। মানুষের কিছু ঘরবাড়িও পার হয়ে গেল তারা। বেড়ার ঘর, নিকোনো উঠোন এবং মানুষজনের সাড়াও পাওয়া গেল। দুটো গোরুর গাড়ি আসছে বাঁশ বোঝাই হয়ে। প্রিয়তোষ একপাশে ছেলের হাত ধরে সরে দাঁড়াল। বাঁশের গাড়ি দেখে পানুর আবার জলতেষ্টা পেল। সে জল খেয়ে ছুটল বাবার পিছু পিছু।
তারপরেই ধানের মাঠ। এবং আল ধরে হাঁটা। কোনো আর রাস্তাই নেই। সে দখল, ধানগাছের গোড়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দুটো হলুদ রঙের পাখি উড়ে গেল। কিউ কিউ করে ডাকছে। আশ্চর্য এক জগৎ ক্রমে যেন উদ্ভাসিত হচ্ছে। দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। এর পরে বোধ হয় নির্জন খাঁ খাঁ প্রান্তর। খুবই রোমাঞ্চ বোধ করছে পানু। বাবা সঙ্গে থাকায় তার বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই। সেই স্বর্ণমুকুটের লোকটাকেও সে এবার ঠিক দেখে ফেলবে। হাতে জাদুর লণ্ঠন নিয়ে হাজির।
তারপর তারা কাশের জঙ্গলেও ঢুকে গেল। যেদিকে তাকায় পানু, কিছুই আর দেখতে পায় না। কাশের জঙ্গলে তার মাথা ঢেকে গেছে। কিছুটা যেন পাতাল প্রবেশের মতো মনে হচ্ছিল পানর। যদি এ-সময়ে স্বর্ণকুটের লোকটা জঙ্গলের ভেতর থেকে সহসা হাত ধরে টানে, তবে সে নির্ঘাত চিৎকার করে উঠবে। তার যে ভয় ভয় করছিল। এতটা রাস্তা হেঁটে সে খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে। ঘামে জবজবে হয়ে গেছে শার্ট-প্যান্ট। ফেব্রুয়ারির মনোরম ঠান্ডা হাওয়াতেও পানু দম পাচ্ছে না। কেবল থেকে থেকে বলছে, বাবা আর কতদূর!
দ্যাখ পানু, এটুকু হেঁটে আর কতদূর বললে কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো মজা পাবি না। এই যে হেঁটে যাচ্ছিস, দু-পাশে মাঠ এবং সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়কার পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছিস, এ বড়োই বিরল দৃশ্য। তুই ছেলেমানুষ, এসব বুঝতে শেখ।
এমন কথায় পানুর খুবই অভিমান হল। আবার ভাবল, বাবা তাকে বোধ হয় গুরুত্ব দিতে চান না। সে তা একবারও বলেনি, বাবা, আমি একটু বসব। এসো গাছটার নীচে বসে একটু জিরিয়ে নিই। বললেই যে সে বাবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। বাবা ঠিক বলবেন, জানিস পানু, এজন্যই তোকে নিয়ে আসি না। সে তো শুধু বলেছে, আর কতদূর?
সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কাশের ঝোপ ফাঁকা হয়ে গেছে। সামনে সেই মাঠ এবং খালপাড়ের দৃশ্য। একটা লোকও দেখা যাচ্ছে, পায়ের কাছে একটা কুকুর লেজ নাড়ছে। যদিও এত দূর থেকে সব স্পষ্ট নয়, কারণ সূর্যাস্ত হচ্ছে, লাল রঙিন এক জগৎ। এবং তার ভেতর একটা মানুষ আর কুকুর কী যে সুমহান কাব্যগাঁথা। সে তার স্যারের ভাষায় দৃশ্যটাকে উপভোগ করার চেষ্টায় চোখ মেলে তাকাতেই মনে হল লোকটা পরে আছে একটা ঢোলা কালো হাফপ্যান্ট, গায়ে ফতুয়া, মাথায় যেন সত্যি স্বর্ণমুকুট। লোকটা এগিয়ে আসছে, কুকুরটা এদিক ওদিক ছুটছে। লাফাচ্ছে। লেজ নাড়ছে।
প্রিয়তোষ বললেন, ওই আসছে তালেব। আজ বোধহয় ফেরি করতে বের হয়নি। তুই যে আসবি তালেব জানে।
কিন্তু পানু কী বলবে! এমন নিঃসঙ্গ প্রান্তরে একজন মানুষ রাজার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে সে কী করতে পারে! মাথায় যে ওটা কী! কখনও মনে হয় নীল কাপড়ের ফেটি, তারপরই সূর্যাস্তের রঙে কেন যে চিকমিক করে উঠতে উঠতে হিরে-জহরত মণিমাণিক্যে ভরা মনে হয়। মনে হয় স্বর্ণমুকুট। এমন একজন মানুষ নদীর পাড়ে বাড়ি করবে ভেবে জমি-জায়গা বিক্রি করে চলে যেতেই পারে। তার যে চাই স্বর্ণমুকুট।
সে নদীর জলে স্বর্ণমুকুট ভেসে যেতে দেখে মাঝে-মাঝে। আর হাতে ওটা কী! কাছে যেতে যেতে সে বুঝল, ওটা লণ্ঠন। জাদুর লণ্ঠন কি না জানে না, কারণ তখন সাঁঝবেলা, আকাশে দুটো-একটা নক্ষত্র ভাসমান, আর হাতে জাদুলণ্ঠনে সে দেখল একটা নক্ষত্র তালেব চুরি করে কাচের ভেতর ভরে রেখেছে। নক্ষত্রটা মিটমিট করে জ্বলছে এবং আলো দিচ্ছে।
সে কেমন মুগ্ধ বিস্ময়ে তালেবের কাছে আসতেই অবাক চোখে দেখল-হাতের লণ্ঠন দুলছে। আলো দিচ্ছে। অন্ধকার চরাচরে লণ্ঠনের এই আলো পানুকে পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে সত্যি যেন হাজির করে দিয়েছে।
তালেব, তুমি আজ ফেরি করতে বের হওনি দেখছি।
বের হয়েছিলাম। রাস্তার মনে পড়ে গেল, খোকাবাবু আসবেন। আমার আর যেতে ইচ্ছে করল না।
পানুর দিকে তাকিয়ে বোধ হয় মনে হল মুখখানা ভাল দেখতে পাচ্ছে না, লণ্ঠন তুলে কাছে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কী গ খোকাবাবু, চোখে যে আপনার স্বপ্ন ঝোলে-মাকে ছেড়ে এলেন। থাকতে কষ্ট হবে না?
পানু বলল, তুমি টায়ারের স্যান্ডেল পরে আছ কেন? মাথায় নীল কাপড়ের ফেটি কেন?
হা হা করে হাসল তালেব। পানু বুঝতে পারল না দূরে সূর্যাস্তের সময় লণ্ঠনওলার নীল রঙের পাগড়ি কেন তার চোখে স্বর্ণমুকুট হয়ে দেখা দিল। এ এক আশ্চর্য অবলোকন, অথবা কোনো ঘোর থেকে সে দেখে ফেলেছে, লণ্ঠনওলার মাথায় স্বর্ণমুকুট।
সে বলল, তুমি স্বর্ণমুকুট পরেছিলে?
পরেছিলাম।
এখন দেখছি নীল কাপড়ের ফেট্টি তোমার মাথায়!
সে আবার আগের মতোই হা হা করে হাসতে হাসতে মাথা থেকে নীল পাগড়ির কাপড়টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে মাথা নুইয়ে দেখল।
এ মা, তোমার এক্কে!যারে টাক মাথা।
‘হাত দিন মাথায়’ বলে লণ্ঠনওলা পানুর হাত তুলে মাথায় ঘষে দিতে দিতে বলল, মানুষের যে চাই স্বর্ণমুকুট। কর্তাঠাকুরকে আমার জমি বিক্রি করে দিলাম, সেই লোভে, নদীর পাড়ে বাড়ি, আর নদীর জলে স্বপ্ন দেখা, আপনি বড় হতে হতে টের পাবেন।
এতসব ভারি কথা পানু বোঝে না। সে বলল, একটা নক্ষত্র যে তুমি চুরি করেছ আমি জানি।
আপনি জানবেন না হয়!
তুমি সত্যি তবে চুরি করেছ?
তা করেছি।
লণ্ঠনের কাচের ভেতর ওটা রেখে দিলে কেন?
তা না হলে আলো যে জ্বলে না।
পানু ভেবে পেল না, লণ্ঠনওলা, মানুষ না অপদেবতা।
সে বলল, তুমি কি ভূত!
এবারে প্রিয়তোষ ধমক না দিয়ে পারল না।
পানু, এমন বলতে হয় না।
তারপর তালেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে তোমরা যে এখানেই জমে গেলে। আরও যে হাঁটতে হয়।
তালেব বলল, চলেন। খোকাবাবুকে আমি কাঁধে নিচ্ছি। কতটা রাস্তা, খোকাবাবু পারবে কেন।
পানু এক লাফে সরে দাঁড়াল। বলল, না, না, আমি হেঁটেই যেতে পারব। কাঁধে নিয়ে তালেব যদি হেঁটে চলে যায়, তাকে নিয়ে ফেরি করতে বের হয়ে যায়—সে হয়তো আর কোনোদিনই তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে না।
তালেব আগে লণ্ঠন দুলিয়ে হাঁটছে।
কুকুরটা আরও আগে দুলকি চালে ছুটছে।
পানু খুবই কাহিল, সে হাঁটতে পারছে না। পায়ে খুব লাগছে, সে বলতেও পারছে না, তার কষ্ট হচ্ছে, বললেই বাবা বলবেন, এজন্যই তোমাকে নিয়ে আসতে চাই না। সে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। অন্ধকারে কেউ টের পাচ্ছে না।
তার তালেবকে এখন নানা প্রশ্ন।
এখানে একটা টিলা আছে?
তা আছে।
ভালুক আছে?
তাও আছে।
টিনটিন। টিনটিন। তালেব আর কিছু বলতে পারল না। টিনটিন বলে কোনো জন্তু জানোয়ার আছে সে জানেই না। তালেবের মুখে রা নেই।
কী হল, কথা বলছ না তালেব?
এই, কী হচ্ছে অসভ্যতা! তোমাকে বলেছি না, তালেবকাকা ডাকবে। প্রিয়তোষ পানুকে ধমক দিলেন।
সে তালেবকাকা ডাকবে কী করে! তালেব অপদেবতা না ভূত, কিছুই বুঝতে পারছে না, তাকে সে তার খুড়োমশাই ভাবে কী করে। সেও কেমন চুপ মেরে গেল। সে বলতে পারল না, জঙ্গলে বাঘ নেকড়ে পুষে রেখেছে তালেব আমি জানি।
এখন সবাই চুপচাপ! তালেব টিনটিন নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছে। তার পৃথিবীতে ঝোপজঙ্গল জোনাকি, জনমনিষ্যিহীন এক প্রান্তর, প্রান্তর ঠেলে দিগন্তে সব প্রায় মাঠ। মানুষের বসতি, সে ফেরি করতে করতে দু-দিনের রাস্তা হেঁটে চলে যায়, ফেরার পথে গঞ্জ থেকে চাল ডাল তেল নুন কেরোসিন কিনে তার জঙ্গলের ঘরে ফিরে আসে, কোথাও সে টিনটিন কিনতে পাওয়া যায় কি না জানে না। কিংবা টিনটিন জঙ্গলে থাকলে তার চোখে একবার অন্তত পড়ত না, হয় না। সে খোকাবাবুর কথায় এমন জব্দ যে, আর তার রা সরল না।
প্রিয়তোষ জঙ্গলে আঙুল তুলে বলল, আমরা এসে গেছি।
আসলে তালেব খোকাবাবুর সব কথাতেই সায় দিয়ে যাচ্ছিল। থাকুক না থাকুক, খোকাবাবু খুশি হলেই সে খুশি। কিন্তু টিনটিন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। টিনটিন বাস না উড়োজাহাজ, টিনটিন বিষয়টি বড়ই গোলমালে ফেলে দিয়েছে তাকে। যে নক্ষত্র চুরি করতে সাহস পায়, মাথায় যার স্বর্ণমুকুট থাকে, সে বলেই বা কী করে, এত খবর রাখি খোকাবাবু, তোমার টিনটিন বিষয়টি আদৌ বুদ্ধিগ্রাহ্য হচ্ছে না আমার! এখন কথা বললেই সে খোকাবাবুর কাছে একেবারে বুন্ধু বনে যাবে। সে শুধু বলল, সকাল হলে আমরা খুঁজে দেখব টিনটিন কোথায় আছে।
এতে পানু বড়োই আহ্লাদ বোধ করল।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একফালি রাস্তা। পাশাপাশি দু-জনে হাঁটা যায় না। ঝোপজঙ্গলের লতাপাতা গায়ে লাগছে পানুর। সে বাবার প্রায় গা ঘেঁষে হাঁটবার চেষ্টা করছে। এত অন্ধকার চারপাশে যে, লোডশেডিং না হলে এমন অভিজ্ঞতা হওয়াও কঠিন। পানু দেখল, সামনে উঠোন, কুঁড়েঘরের বারান্দাও দেখতে পেল। একপাশে বাঁশের মাচান, মাচানে ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর ঝালাইয়ের যন্ত্রপাতি, কাটা টিনের পাত দলাপাকানো। কাঠের তিন-চার রকমের হাতুড়ি। সে বারান্দায় উঠে যাওয়ার সময় সহসা কী এক আর্তনাদে চমকে গেল।
প্রিয়তোষ বললেন, ডাহুক পাখিরা ডাকছে।
কেমন এক কলরব, পাশে একটা জলা আছে, জলাজঙ্গলে ডাহুক পাখিরা ডাকে, এবং পানু আসায় ওরা যে আহ্লাদে আটখানা, প্রিয়তোষ তাও জানিয়ে দিলেন। ডাহুকেরা একসঙ্গে ডেকে উঠলে আর্তনাদের মতো শোনায়, তাও বুঝিয়ে বললেন প্রিয়তোষ। পানু কিছুটা নিজের মধ্যে ফিরে আসায় ঝিঝি পোকা ও কীটপতঙ্গের আওয়াজ শুনতে পেল।
আর তখনই একটা কুপি ধরিয়ে তালেব বাইরে রেখে দিল। দুটো পাথর, পাশে এক বালতি জল, পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রিয়তোষ হাতমুখ ধুলেন, পানুকে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বললেন। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। পানুকে জামা-প্যান্ট সোয়েটার বের করে দিয়ে বললেন, ধুলো ময়লায় সব নোংরা হয়ে গেছে, সব পালটে নাও।
তালেব এখন আর একটা কথাও বলছে না। তার যে মেলা কাজ। কাঠকুটো ধরিয়ে চা আর চিড়েভাজা কাঠের সরাতে সাজিয়ে দিল। প্রিয়তোষ গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বলল, শ্যামলাল আর এসেছিল?
তালেব বলল, জি, শ্যামলাল মিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে তো আপনার বাড়ি যাবে বলেছে। ইট বালি নৌকোয় খালে-খালে নিয়ে আসবে বলল, কত ইট ফেলবে, তা তো বলে যাননি।
শোনো তালেব, এই একটা থাকার ঘর, কিচেন আর একটা বাথরুম—এই হলেই চলবে। তবে সব একসঙ্গে করার ক্ষমতা আমার নেই। শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও বলতে পারব না। একটা স্বপ্ন বুঝলে, নিজের ঘরবাড়ি, তবে বাড়িটা শেষ পর্যন্ত যে ভণ্ডুলমামার বাড়ি হয়ে যাবে না, তাও বলতে পারব না। একদিকে তুলব, আর একদিকে পড়ে যাবে। হাতে এত টাকা কোথায়! মাঠ ভেঙে সরকারি টিউকল থেকে জল আনারও অনেক হ্যাপা। তুমি না থাকলে কে করবে সব! এ-জীবনে আর তোমার নদীর পাড়ে বাড়ি নাই বা হল।
পানুর এসব বিষয়ী কথাবার্তা একদন পছন্দ না। সে ঘরের ভেতর মাটির মেঝেতে মাদুরে বসে চিড়েভাজা আর রসগোল্লা খাচ্ছে। টিফিন ক্যারিয়ারে মা আসার সময় ভরে দিয়েছেন।
ঘরে সেই জাদুর লণ্ঠনটা জ্বলছে। বাবা জলচৌকিতে বসে আছেন তার। দারান্দায় উনুনে মুগের ডাল ভাজা হচ্ছে। মুগের ডাল, বেগুনভাজা, আর গরম ভাত—পানুর যে খুব খিধে পেয়েছিল, তার খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
তালেব কাজও করছে, কথাও বলছে, বাবা এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন, যেন কতকালের এই সখ্য।
তালেব বলল, এবারে জল ঢেলে দিন। প্রিয়তোষ উঠে কড়াইয়ে জল ঢেলে দিতেই ছ্যাঁক করে উঠল। প্রিয়তোষ ডাল, বেগুনভাজা নামিয়ে রাখলে তালেব বলল, বড়ো ধন্দে পড়ে গেলাম কর্তাঠাকুর।
তোমার আবার কিসের ধন্দ।
ওই যে খোকাবাবু বলল, তিনতিন না টিনটিন-ওটা খায় না ওড়ে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
প্রিয়তোষ হেসে ফেললেন, আরও ওসব হচ্ছে ছবিতে গোয়েন্দা সিরিজ। মাথায় টাক যখন আছে দাড়ি থাকলে জাহাজের কাপ্তান হয়ে যেতে পারতে। টিনটিন খোকাবাবুর মতো একটা বাচ্চা ছেলে। তোমার মতো বয়সের একজন বন্ধু আছে তার। টিনটিনের কাছে কোনো অপরাধীরই ক্ষমা নেই। টিনটিন চোর ধরে বেড়ায়। পানু ছবির গল্প পড়তে পড়তে ভাবে সে নিজেই টিনটিন।
টাকমাথা, উসকোখুসকো একগাল দাড়ি নিয়ে তালেব কিছুক্ষণ বসে ছিল। টিনটিন চোর ধরে বেড়ায়, কথাটাতে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে যে চুরিচামারি করত, তাও ধরে ফেলতে পারে। এই জঙ্গলের মাটির নীচে সে সব পুঁতে রেখেছে। জেল-হাজতও সে খেটেছে। জেল থেকে সে পালিয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। সামনের একটা জলায় ডুব দিয়ে আসার সময় এসব মনে হচ্ছিল তার। স্বর্ণমুকুটের কথাও জেনে গেছে মনে হয়। তারপর মনে হল তার, সে নিজের ঘোরেই এসব ভাবছে। কথাটা যাচাই করে দেখলে হয়!
তালেব বলল, কর্তাঠাকুর, স্বর্ণমুকুটের কথা কী যেন একখানা বললেন?
প্রিয়তোষ একেবারে হাঁ।
আমি বললাম, না তুমি বললে!
আমি আবার কবে বললাম?
তুমি একদিন বললে না, নদীর পাড়ে চলে যাবে। নদীর জল কলকল ছলছল, নদীতে স্বর্ণমুকুট ভাসে।
আমি একথা বলিনি।
না বললে পানু বলল কেন, দেখছ তালেব সোনার মুকুট পরে যাচ্ছে।
কখন বলল?
যখন কুকুরটাকে নিয়ে কলপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলে।
আরও বিমর্ষ হয়ে গেল তালেব।
তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, আমি চলে যাব নদীর পাড়ে বাড়ি করে। এখানে কিছুতেই থাকব না। বলে যদি থাকি, সেভাবে কথাটা বলিনি, জলে কখনও কি স্বর্ণমুকুট ভাসে!
প্রিয়তোষ বললেন, ভাসে না প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়।
সে যাই হোক, কথাটা যদি বলেই থাকি, তবে আপনার বাড়িঘরের কথা ভেবেই বলেছি। সবারই চাই স্বর্ণমুকুট। এই ঘরবাড়ি সংসার মানুষের যে সেই স্বর্ণমুকুট লাভের আশায়। জমি কিনলেন, খোকাবাবু বড়ো হতে হতে শহরের ধস এদিকটাতেও নেমে আসবে। পাঁচ কাঠা জমি সোজা কথা! কী অমূল্য দাম হবে তখন। সেই ভেবেই কথাটা বলা।
ঠিক আছে, তোমার কাছে স্বর্ণমুকুট নেই। এখন পানুর একপাশে বসে যাও। তোমাদের খেতে দিয়ে আমি খেতে বসে যাব। সকাল হলে পানুকে নিয়ে একবার জঙ্গলটা ঘুরে আসবে। ছেলেমানুষ যত্তসব আজগুবি চিন্তার ডিপো। সব ঘুরিয়ে দেখালে জঙ্গল নিয়ে আর কোনো রহস্য থাকবে না। বাড়িতে তোমার বউদিকে যা জ্বালায়!
তারপর প্রিয়তোষও খেতে বসে গেল। খাওয়া হলে বাড়তি ডাল-ভাত কুকুরটাকে দিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল। তালেব বাসনকোসন ধুয়ে সব এঁটো সাফসোফ করে বারান্দার সামনে কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ল ঠিক, তবে তার ঘুম এল না। খোকাবাবু ঠিক টের পেয়ে গেছে, সে ভালোমানুষ না। তার চুরি চামারির স্বভাব ছিল, না হলে নক্ষত্র চুরি করার কথা উঠত না। তারপর কেন যে ভাবল সে যা খুঁজে পাচ্ছে না, খোকাবাবু তা ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। টিনটিনের বন্ধু। নিখোঁজ জিনিসের উদ্ধারে খোকাবাবু তাকে সাহায্য করতে পারে। সে তো আর লোভে পড়ে নেই, তার মনেও থাকে না। এই কাশের জঙ্গলে সে তার চুরি করা ধনসম্পত্তি সব মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিল। খোকাবাবু আসায় আবার তার সব মনে পড়ে গেছে। সেখানে দিঘাপতিয়ার রাজার মুকুটটিও যে আছে, শতবার বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
সকালে উঠে চিড়ে মুড়ি দিয়ে পানুর আহারপর্ব ভালোই হল বলা চলে। বাবা খালপাড়ে যাবে, নৌকোয় যদি শ্যামলাল থাকে, এবং তারা যাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। পানু তার এয়ারগানটা নিতে ভুলল না। কিছু ঘুঘু পাখি উড়ে যাচ্ছিল, কিছু শালিখ পাখি, খালপাড়ে উঠে পানু দেখল, তালেবকাকা কাশবনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
সে ডাকল, তালেবকাকা কী দেখছ?
তালেব কেমন উদাসীন গলায় বলল, একখানা কথা আছে আমার।
কী কথা!
আপনি টিনটিন, সব রহস্যভেদের ওস্তাদ। ওই যে কাশের জঙ্গল দেখছেন, তার ভেতর মেলা ধনসম্পত্তি লুকনো আছে। লোকটা খুবই আহাম্মক, পুলিশের তাড়া খেয়ে এদিকটায় এসে থমকে গেল। সে ভাবল, এমন নির্জন জায়গায়, তার ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রাখলে কেউ টের পাবে না। যেই না ভাবা, সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু। তখন উরটি মাঠ। বৈশাখ মাস, লু বইছে, গোপনে মাথাসমান মাটি খুঁড়ে সে তার ধনসম্পত্তি সব লুকিয়ে ফেলল। ত্রাসে পড়ে গেলে মানুষের যে মাথাও ঠিক থাকে না খোকাবাবু।
পানু হাঁ করে সব শুনছে।
তারপর।
তারপর লোকটা ক-বছর বিবাগী হয়ে থাকল। ওই যে নাম, ঠিক হয়ত পুলিশ টের পেয়ে গেছে, সে এদিকটায় এলেই তাকে ধরে ফেলবে, এইসব ভেবেই লোকটা চার বছর তিন মাস কুড়ি দিন বাদে যখন এল, দেখল শুধু কাশের জঙ্গল। যতদূর চোখ যায় শুধু কাশফুল। কোথায় তার লুকানো ধনসম্পত্তি টেরই পেল না। কাশের জঙ্গলে জায়গাটা ভারি মনোরম হয়ে আছে।
তারপর?
তারপর লোকটা শ্রীপদ বাগুইয়ের কাছ থেকে জমি কিনে বসবাস শুরু করে দিল। দিনে লণ্ঠন ফিরি করতে বের হয়, রাতে কোদাল কাঁধে জঙ্গল কোপায়। ওই কোপানোই সার। এভাবে মাস যায়, বছর যায়, শেষে তার কেন যে একদিন মনে হল, জঙ্গলেরও সৌন্দর্য আছে। সে কোদাল কুপিয়ে তাও বিনষ্ট করে দিচ্ছে। ওপরওলার কাছে সে কী জবাব দেবে! সেই থেকে এই মাঠ, শীতলকুচির মাঠ ঠান্ডা মেরে আছে। তার আর রূপ বদলায় না। সেই থেকে সে শুধু ভাবে, নদীর পাড়ে বাড়ি করে সে চলে যাবে। বলে লণ্ঠনওলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সব শুনে পানুর কেন যে মনে হল, লণ্ঠনওলা বড়ই দীর্ঘকায় মানুষ। তাকে সে আর ছুঁতে পারবে না—ক্রমে উঁচু লম্বা হতে হতে আকাশের দিকে তার মাথা উঠে যাচ্ছে। পানু শুধু তার বাবার মতোই বলল, তুমি আমাদের ফেলে চলে যেও না। নদীর পাড়ে বাড়ি আর তোমার নাই বা হল। নদীর জলে স্বর্ণমুকুটের প্রতিবিম্ব দেখার জন্য চলে গেলে আমরা যে খুব একা হয়ে যাব কাকা।