স্বর্গ নরক
এই বিশ্বসংসারে যত কিছু বিষয় আছে, কুকুর-বিড়াল, মাতাল, উকিল-ডাক্তার এমনকী ছাতা-তালা কিংবা টর্চলাইট-প্রেসারকুকার ইত্যাদি সমস্ত প্রাণী ও দ্রব্য নিয়ে আমার পক্ষে যা সম্ভব উলটো-পালটা সবই লিখে ফেলেছি এবং তাও কোনও সদুদ্দেশ্য বা সাহিত্যের আদর্শের তাড়নায় নয় নিতান্ত অর্থ ও তাৎক্ষণিক খ্যাতির লোভে।
সুতরাং এবার আমাকে পরমার্থের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এদিকে বয়েসও বাড়ছে, হাসি-ঠাট্টা আর কতদিন করা যায়। এবার স্বর্গের দিকে হাত বাড়াই। বামনদের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর একটা অক্ষম প্রয়াস থাকে। আমার এই চেষ্টাও তাই।
এই আলোচনার গোড়াতেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে স্বর্গ সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার নয়। বাল্যকালে বিদ্যালয়ে পাঠ্যবইতে সকলের সঙ্গে সেই সরল কপিটি আমিও কণ্ঠস্থ করেছিলাম, যেখানে কবি বলেছিলেন অর্থাৎ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেই জবাব দিয়েছিলেন যে সে বহুদূর নয়। মানুষের মধ্যেই স্বর্গ-নরক রয়েছে। স্বর্গ-নরক মানুষ তার নিজের ব্যবহারে রচনা করে।
এসব কাব্যকথা থাক, স্বর্গ-সংক্রান্ত যে-কোনও আলোচনা ধর্মকথার সূত্রেই যাওয়া উচিত।
হিন্দুর স্বর্গে পারিজাত কানন আছে, আছে মন্দাকিনী নদী, আছে অনন্ত যৌবনা উর্বশী-রম্ভা-মেনকা এইসব সুরসুন্দরীরা। সেখানে অমৃতের ফোয়ারা। সুস্বাদু পানীয় ও খাদ্য স্বর্গবাসীদের জন্যে সর্বদাই প্রস্তুত। এবং সংগত কারণেই স্বর্গবাসীরা অজয় এবং অমর।
খ্রিস্টানের স্বর্গ অর্থাৎ যাকে বাইবেলে প্রমিসভ ল্যান্ড বলা হয়েছে, সেখানে মধু ও দুধের বন্যা বয়ে চলেছে। এ বিষয়ে গল্প আছে, এক পাদরি এক বালিকাকে নিষেধ করেছিলেন যাতে সে কুকুর-বিড়াল না ভালবাসে। তিনি মেয়েটিকে বলেন, তোমার বিড়াল বা কুকুর যখন মরে যাবে, তুমি মনে কষ্ট পাবে, তাদের আর কোনওদিন দেখতে পাবে না।
পাকা মেয়েটি একটু ভেবে নিয়ে বলেছিল, কেন, আমি যখন মরে যাব তারপর স্বর্গে যাব, তখন ওদের সঙ্গে আমার স্বর্গে দেখা হবে। পাদরি তখন বললেন, তা সম্ভব নয়, কারণ জীবজন্তু কোনওদিন স্বর্গে যেতে পারবে না। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, বাঃ, তা কেন হবে? স্বর্গে যে দুধ আর মধুর বন্যা বয়ে যায়, সেখানে যদি গোরু আর মৌমাছি না থাকে তা হলে ওই দুধ আর মধু আসে কী করে?
স্বর্গের বা পরলোকের বিষয়ে হজরত মুহম্মদের একটি কাহিনী স্মরণীয়। হজরত একদিন একটি খেজুরের পাতার চাটাইয়ের উপরে ঘুমিয়েছিলেন। তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর তাঁর এক ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন, আপনি যদি অনুমতি করেন আমি তা হলে একটা ভাল বিছানা আপনার জন্যে তৈরি করে দিই। শুনে হজরত মুহম্মদ বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে আমার কীসের প্রয়োজন? একজন অশ্বারোহী যেমন ক্ষণিকের জন্যে গাছতলায় দাঁড়ায় এবং পরক্ষণেই তা পরিত্যাগ করে, পথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেইরকম।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পবিত্র হাদিস শরিফে আছে, পৃথিবী আত্মম্ভরিতার স্থান এবং স্বর্গ সুখের স্থান। পৃথিবী বিশ্ববাসীদের জন্যে কারাগার ও দুর্ভিক্ষ, যখন তারা পৃথিবী পরিত্যাগ করে তখন তারা যেন কারাগার এবং দুর্ভিক্ষ ত্যাগ করে। (রেফিক উল্লাহ সংকলিত এবং সম্পাদিত হাদিস শরিফের বাংলা অনুবাদ দ্রষ্টব্য)।
মহাকবি মিলটন তাঁর ‘প্যারাডাইস লস্ট’ নামক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা শ্রেয়।
রবীন্দ্রনাথেরও স্বর্ণ ব্যাপারটা সম্পর্কে যথেষ্ট অনীহা ছিল বলেই মনে হয়। এক অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা গড়িব না ধরণীতে। আর ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, শোকহীন, হৃদিহীন সুখস্বর্গভূমি, উদাসীন চেয়ে আছে এবং শেষ বিচ্ছেদের ক্ষীণ লেশমাত্র অশ্রুরেখা স্বর্গের নয়নে দেখা যাবে না।
ধর্ম এবং কাব্য নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা মোটেই নয়। এবার আমরা স্বর্গসম্পর্কিত হাস্যকর উপাখ্যানে প্রবেশ করছি।
প্রথমে সেই গ্রাম্য বালকটির কথা বলি, যে তার বাবার সঙ্গে প্রথম একটা বড় শহরে বেড়াতে এসেছিল। সেই শহরে এসে সে জীবনে প্রথম বহুতল অট্টালিকা দেখে এবং লিফটে চড়ে। বাবার সঙ্গে লিফটে চড়ে সে যখন সর্বোচ্চ তলে দ্রুতগতিতে উঠে যাচ্ছিল, অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে সে বাবাকে প্রশ্ন করে, বাবা, ভগবান কি জানে যে আমরা যাচ্ছি?
স্বর্গ বিষয়ে পরের কাহিনীটি এক গোঁড়া ক্যাথলিককে নিয়ে। ক্যাথলিক ভদ্রলোকটি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি করুণ কণ্ঠে পার্শ্বে উপবিষ্টা স্ত্রীকে বললেন, ওগো, তোমাকে একলা ছেড়ে যেতে আমার মন কেমন করছে। এই কথা শুনে সাধ্বী স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কেঁদো না, এত সহজে মন ভেঙে ফেলো না। আমার একটা পরামর্শ শোনো।
পরামর্শের প্রস্তাব শুনে ভদ্রমহিলা কান্না একটু থামালেন। তখন ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে দু’বার গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, আমি মরে যাওয়ার পরে তুমি আবার বিয়ে করো।’ এই প্রস্তাবে ভদ্রমহিলা আঁতকিয়ে উঠলেন, ‘না, না। দুই স্বামীর কথা আমি ভাবতেও পারি না।’
ভদ্রলোক তখন বললেন, ‘আরে আমি তো আর একসঙ্গে দুই স্বামীর কথা বলছি না। আমার মৃত্যুর পরে তুমি বিয়ে করছ। তোমার এখনও এক স্বামী রয়েছে, তখনও এক স্বামী থাকবে।’
ভদ্রমহিলা অনেক চিন্তা করে বললেন, ‘কিন্তু যখন আমরা সবাই মারা যাব, তখন স্বর্গে গিয়ে তো আমার আবার সমস্যা দেখা দেবে। সেখানে আমার দু’জন স্বামী হয়ে যাবে।’
মুমূর্ষু ভদ্রলোক এবার সত্যিই চিন্তায় পড়লেন। এটা ভাববারই কথা, স্বর্গে তাঁর স্ত্রীর তিনি ছাড়া আরও একজন স্বামী থাকবে এটা অকল্পনীয় এবং খুব অনৈতিক হবে। তিনি বেশ মুষড়ে পড়লেন। কিন্তু একটু পরেই তাঁর মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল; তিনি স্ত্রীকে বললেন, ‘ওগো, তুমি আমার মৃত্যুর পরে পাশের গ্রামের জন সাহেবকে বিয়ে কোরো।’ স্ত্রী অবাক হলেন, ‘কেন জন সাহেবকে বিয়ে করলে সুবিধে কী?’ স্বামী বললেন, ‘খুব সুবিধে। জন সাহেব যে ক্যাথলিক নয়। এ তো আর স্বর্গে যাবে না। তুমি পৃথিবীতে জন সাহেবের বউ হবে, তারপর মৃত্যুর পরে স্বর্গে গিয়ে আবার আমারই বউ হবে।’
এই ক্যাথলিক ভদ্রলোকের মতো স্বর্গ সম্পর্কে সকলের ধারণা কিন্তু এত পরিষ্কার নয়।
স্বর্গে যাওয়ার সহজ পন্থা এই বিরল শতকের শেষেও এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। বহুকাল আগে ত্রেতাযুগে লঙ্কেশ্বর দশানন সরাসরি স্বর্গে চলে যাওয়ার জন্যে সিঁড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। দুঃখের বিষয় অকাল মৃত্যুর ফলে তাঁর সেই স্বপ্ন সফল করে যেতে পারেননি। তাঁর সেই মহান পরিকল্পনা পৌরাণিক প্রবাদে রাবণের সিঁড়ি নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। যদি রাজা দশানন সত্যি সত্যি সিঁড়িটা বানিয়ে যেতে পারতেন, এই ধরাধামের পাপীতাপীদের খুব উপকার হত। তাঁদের আর খারাপ কাজ করে মৃত্যুর পরে কষ্ট করে নরকবাস করতে হত না। তাঁরা সোজা সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে চলে যেতেন।
অন্য একটা পুরনো গল্প আছে স্বর্গের সিঁড়ি নিয়ে। পৃথিবীর মানুষেরা একবার ঠিক করল যে সবাই মিলে একসঙ্গে পরিশ্রম করে স্বর্গ পর্যন্ত সিঁড়ি বানাবে যাতে মর্ত্যলোক থেকে সিঁড়ি বেয়ে সকলেই স্বর্গে চলে যেতে পারে।
সেটা ছিল পৃথিবীর আদিম যুগ। তখন ছিল সব মানুষেরই এক ভাষা। মানুষে মানুষে তখনও ভাষার ব্যবধান তৈরি হয়নি। সিঁড়ি গাঁথার কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। আকাশ ছুঁড়ে স্বর্গের দিকে ক্রমাগত এগোচ্ছে সেই সিঁড়ি।
অবশেষে ভগবান কিংবা স্বর্গের দেবতারা প্রমাদ গণলেন। সর্বনাশ, কী সর্বনাশ! এই সিঁড়ি সম্পূর্ণ হলে তো দেবতা আর মানুষে, স্বর্গে-মর্ত্যে কোনও পার্থক্য থাকবে না। যে-কোনও মানুষ সোজাসুজি স্বর্গে উঠে আসবে; কোথায় তখন থাকবে স্বর্গের পবিত্রতা।
অনেক ভেবেচিন্তে মহামান্য ঈশ্বর অবশেষে একটা বুদ্ধি বার করলেন। বলা বাহুল্য, কূট কচালে বুদ্ধির তাঁর কখনওই অভাব হয়নি। তিনি ভাষার সৃষ্টি করলেন। একেক গোষ্ঠী মানুষের মুখে একেক রকম ভাষা।
ফল দাঁড়াল অতি ভয়াবহ। আগে যেমন সবাই সবাইয়ের কথা বুঝতে পারছিল, সবাই নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিঁড়ি তৈরিতে সহযোগিতা করছিল, অতঃপর তার আর সম্ভব হল না।
সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপের লোক হয়তো চাইছে ইট; যেহেতু তার ভাষা পরের ধাপের লোকের বোধগম্য নয়, সে এগিয়ে দিল বালি। আবার এর পরের ধাপের লোক যখন বালি চাইছে, তার নীচের ধাপের লোকেরা তাকে এগিয়ে দিল চুন।
অনতিবিলম্বে দেখা দিল চূড়ান্ত হইচই, গোলমাল, সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা। মানুষের স্বর্গের সিঁড়ির স্বপ্ন সেখানেই ভেস্তে গেল।
সেই আদিম যুগ থেকে শুরু হয়েছে। মানুষের স্বর্গের স্বপ্ন চিরদিনই এইভাবে ভেস্তে গেছে। আত্মকলহ এবং নিজেদের মধ্যে বোঝাবুঝির অভাবে এই মর পৃথিবী থেকে স্বর্গ আজও বহুদূরে।
নন্দনবন ও পারিজাত কানন, রম্ভা ও উর্বশী, অমৃতরসের অধিকার থেকে মানুষ চিরকালের জন্যে বঞ্চিত হয়েছে।
অবশেষে এই স্বর্গ-নরকের সামান্য নিবন্ধটি একটি অবিশ্বাস্য গল্প দিয়ে শেষ করি। বলা বাহুল্য, গল্পটি পুরোপুরি আমার নয়, এর মূল কৃতিত্ব এক বিদেশি লেখকের।
মাত্র তিরিশ সেকেন্ড আগে সুবিমলবাবু ইহলীলা সম্বরণ করেছেন। এরই মধ্যে তিনি পরলোকে এসে গেছেন। এত তাড়াতাড়ি তিনি সাধনোচিত ধামে পৌঁছে যাবেন একথা ইহজীবনে তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
সুবিমলবাবু চোখ খুলে দেখতে পেলেন সামনেই দেয়ালে একটা ঘড়ি ঝুলছে, এখন সময় কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটা। এই তো আধ ঘণ্টা আগে সকাল দশটার সময় তিনি নিজের বাড়ির বাইরের ঘরে আরাম কেদারায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা দমবন্ধ ভাব এবং তীব্র যন্ত্রণা, তিনি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যান। তারপরে ঠিক সাড়ে ঊনত্রিশ মিনিটের মাথায় তিনি অক্কাপ্রাপ্ত হলেন এবং অবিলম্বে আধ মিনিটের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছেছেন।
স্বর্গের দূরত্ব পৃথিবী থেকে মোটেই কম নয়। পৃথিবী, মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি গ্রহ এবং তাদের চাঁদ-টাদ উপগ্রহ সমেত সূর্যের সৌরমণ্ডল। আবার অনেকগুলি সূর্যের অনেকগুলি সৌরমণ্ডল নিয়ে মহাসূর্যের মহাসৌরমণ্ডল। এখানেই শেষ হলে ভাল ছিল। কিন্তু বিশাল তিমি মাছের পরে বিশালতর তিমিঙ্গিল, তারও পরে তিমিঙ্গিলগিল যেমন আছে, তেমনই মহাসূর্যের পরে আছে প্রমহাসূর্য, এইরকমভাবে ক্রমশ প্রপ্রপ্র…মহাসূর্য, এইসব চাকার উপরে চাকা, তার উপর চাকা ইত্যাদি। যেখানে শেষ হয়েছে তারও শেষে কিংবা শুরুতে রয়েছে পরলোক।
এই অনন্ত পথ মাত্র তিরিশ সেকেন্ডে চলে এসে সুবিমলবাবু অতিশয় বিস্মিত হলেন, তার চেয়েও বিস্মিত হলেন একটি আধুনিক রুচিসম্মত, সুসজ্জিত পথে প্রবেশ করে। সুবিমলবাবু মনে মনে ভাবলেন, স্বর্গ জায়গাটা তা হলে এইরকম। সেই যে পারিজাত বন, নন্দনকানন ইত্যাদির কথা তাঁর শোনা ছিল, তার সঙ্গে খুব মিল নেই কিন্তু এই ঘরটা ভাল। ভগবান তাকে ভাল ঘরই দিয়েছেন স্বর্গবাসের জন্যে।
সুবিমলবাবু একবার তাঁর সদ্য অতীত মানবজীবনের দিকে ফিরে তাকালেন। নিজের হাতে খুন করা ছাড়া পৃথিবীতে আর যত রকমের খারাপ কাজ করা সম্ভব জীবদ্দশায় তিনি তার সবই করেছেন। তাঁর ছিল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা অর্থাৎ লোকে যাকে বলে, ইধারকা মাল উধার আর উধারকা মাল ইধার। জাল-জুয়াচুরি, পঞ্চ মকার, জীবনে দু’পয়সা কামানোর জন্যে এবং নিজের তাৎক্ষণিক ইন্দ্রিয় সুখের জন্যে তিনি করেননি বা করতে পারতেন না এমন কোনও কুকর্ম নেই।
সুবিমলবাবু কিন্তু তাঁর পার্থিব জীবনে একবারও ঘুণাক্ষরে কল্পনা করতে পারেননি যে মৃত্যুর পরে তাঁর স্বর্গবাস হবে। চিরদিন তাঁর বিশ্বাস ছিল ওসব স্বর্গ-ফর্গ নেহাত গাঁজাখোর মূর্খের আজগুবি চিন্তা, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ। স্বর্গও নেই, নরকও নেই, যা হবে তা পৃথিবীতে জীবনকালেই হবে। মরে যাওয়ার পরে পুরো ব্যাপারটা একদম শূন্য, যাকে বলে ফক্কা।
কিন্তু এখন মৃত্যুর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে সজ্ঞানে এইরকম একটি সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করে সুবিমলবাবু বুঝতে পারলেন, স্বর্গ-নরক ব্যাপারটা মিথ্যে নয়।
দশটা তিরিশ মিনিটে অর্থাৎ কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটায় তিনি এই ঘরে প্রবেশ করেছেন, সামনের ডিসটেম্পার করা দেয়ালে ইলেকট্রনিক ঘড়িতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন দশটা বত্রিশ। মাত্র দু’মিনিট, এরই মধ্যে তিনি তাঁর লবণহ্রদের নবনির্মিত বাড়ির দোতলার ড্রয়িংরুম থেকে প্রমহাসৌরমণ্ডল অতিক্রম করে এখানে এসে গেছেন এবং শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে একজন জাপানি গেইসা বালিকা নৃত্যরতা অবস্থায় তাঁর পদপ্রান্তে এক প্লেট মাংসের বড়া রেখে গেছে, আর একটি দক্ষিণী দেবদাসী বিলোল অঙ্গ-বিভঙ্গে এক বোতল হুইস্কি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে।
সবদিক থেকে সব ব্যবস্থাই সুবিমলবাবুর মনোমতো। ঘরের দেয়ালে ফিকে নীল রংয়ের ডিসটেম্পার, একটা সুন্দর বিদেশি ক্যালেন্ডার, ভিতরে একটি ছিমছাম মণিপুরী চাদরটাকা নরম বিছানা, বিছানার পাশে টিপয়ে সুদৃশ্য কাচের গেলাসে জল। এপাশে জানলার ধারে একটা হাফ-ডেকচেয়ার, ভাল বেতের জিনিস, আজকাল প্রায় পাওয়াই যায় না।
এখন আরাম করে এই ডেকচেয়ারে বসে গেলাসে একটু হুইস্কি ঢেলে নিয়ে সুবিমলবাবু ভাবতে লাগলেন, একটু সোডা আর বরফ থাকলে ভাল হত। যেমন চিন্তা তেমন কাজ; সুবিমলবাবু ভাববার মুহূর্তের মধ্যে কোথা থাকে একটি মদালসা রক্ষী একটি নিঃশব্দ ট্রলির উপর রুপোর ট্রেতে সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে কয়েক বোতল সোডা আর একটা বরফের তাপনিয়ন্ত্রিত বাটি এনে রেখে গেল।
ডেকচেয়ারে বসে অল্প অল্প চুমুক দিয়ে নিজের ঠোঁট আর গলাটা ভিজিয়ে নিলেন সুবিমলবাবু। মাংসের বড়ায় কামড় দিয়ে বুঝলেন এ জিনিসও অতি উপাদেয়, কোনওরকম ছাঁট বা চর্বি দিয়ে ভেজাল মাংসের বড়া নয় প্রকৃতই ভাল নরম মাংস, এ রকম জিনিস ভাল জায়গায় অর্ডার দিলেও সচরাচর পাওয়া যায় না।
পৃথিবী থেকে এখন পর্যন্ত আসতে সুবিমলবাবুর কোনও পরিশ্রমই হয়নি, হাওয়ায় পাখির পালকের মতো ভেসে তিনি চলে এসেছেন। কিন্তু এত দীর্ঘ দূরত্ব পলকের মধ্যে পাড়ি দিলেও কেমন যেন একটা মানসিক ক্লান্তি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। আর তা ছাড়া মাত্র আধঘণ্টা আগের সেই হার্ট স্ট্রোকের মর্মান্তিক আঘাত এবং যন্ত্রণা সুবিমলবাবু নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করার পরে এখনও যেন অনুভব করতে পারছেন।
কিঞ্চিৎ পানভোজনের পরে সামনের খাটের উপরে পাতা বিছানায় গিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন। আপাতত একটু বিশ্রাম দরকার। কোথা থেকে কোথায় এলেন, এখানে কী করবেন, কতদিন থাকতে হবে, এসব বিষয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা করার দরকার।
ঠান্ডা মাথা কথাটা মনে আসতে এবার সুবিমলবাবুর মনে একটু খটকা লাগল। মৃত্যুর পরেও এখন কি তাঁর মাথা আছে, তাঁর সেই চকচকে, গোলগাল, মসৃণ কুবুদ্ধিভরা টাকওলা মাথাটা। হাত তুলে মাথায় দিয়ে তিনি স্পষ্ট সেটার অস্তিত্ব অনুভব করলেন। কিঞ্চিৎ রোমাঞ্চ হল তাঁর, তা হলে তিনি সশরীরে এখানে এসেছেন। এত দূর পথ এত ভারী শরীরটা নিয়ে সাবলীলভাবে চলে আসা সোজা কথা নয়।
এবার আসল চিন্তা শুরু হল সুবিমলবাবুর। সামান্য কিছুক্ষণ আগে পৃথিবীতে ফেলে আসা তাঁর সংসার, নিজের হাতে তৈরি গাড়ি, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, ব্যবসা, ধনদৌলত, ফস্টিনস্টি কোনও কিছুর জন্যেই তিনি এখন আর কোনও টান অনুভব করছেন না।
সুবিমলবাবু ঠিক করলেন এত দূরে এখানে যখন এসেই পড়েছেন, এখানেই নতুন করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। ধীরে ধীরে এই স্বর্গ জায়গাটাকে ভাল করে বুঝে নিয়ে কবজা করতে হবে। যদি পার্টিশনের পর শুন্য হাতে এবং হাজারো দায়িত্ব কাঁধে নোয়াখালি থেকে কলকাতায় এসে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা, প্রতিষ্ঠা সব আয়ত্ত করতে পারেন তবে এখানেও পারবেন।
কীভাবে কী করবেন নানারকম ভাবতে ভাবতে সুবিমলবাবু গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলেন।
বহুক্ষণ পরে যখন তাঁর ঘুম ভাঙল, সামনের দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন দশটা বেজে চৌত্রিশ। সুবিমলবাবু ধড়মড় করে জেগে উঠলেন। সর্বনাশ! একটানা বারো ঘণ্টা ঘুমোলাম নাকি?
এই প্রশ্নটা মনের মধ্যে জাগতেই এক ব্যক্তি, যাত্রাদলের প্রতিহারীর মতো পোশাক তার, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল এবং সুবিমলবাবুর চিন্তার সূত্র ধরে বলল, না, মোটেই বারো ঘণ্টা নয়, দশটা বত্রিশ থেকে দশটা চৌত্রিশ, আপনি মাত্র দু’মিনিট ঘুমিয়েছেন। তার মধ্যে ঘুমোনোর আগে আপনি চল্লিশ সেকেন্ড ব্যয় করেছেন চিন্তা করার জন্য। অর্থাৎ ঘুমের জন্য মোটমাট আপনার আশি সেকেন্ড সময় গেছে।
সুবিমলবাবুর মুখমণ্ডলে প্রগাঢ় বিস্ময়ের ভাব দেখে প্রতিহারী বলল, আপনার পানীয়ের গেলাসে দেখুন, বরফ একটুও গলেনি। বারো ঘন্টা হলে বরফ গলে জল হয়ে যেত।
অতঃপর প্রতিহারী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বিমূঢ় সুবিমলবাবুকে বলল, এবার আপনার আহারের আয়োজন করছি।
সঙ্গে সঙ্গে গেইসা, দেবদাসী ইত্যাদি দেবভোগ্যা রমণীরা সোনার থালায়, সোনার বাটিতে থরে ধরে হাজার রকম সুখাদ্য এনে উপস্থিত করল, সঙ্গে উত্তম সুরা ও মধুর পানীয়। তারা বিলোল ভঙ্গিতে পরিবেশনে ব্যস্ত হল।
সুবিমলবাবু একটু আগেই কয়েকটা মাংসের বড়া খেয়েছেন। তবু ভাল খাবারের গন্ধে তাঁর আবার ক্ষুধার উদ্রেক হল। তিনি যথাসাধ্য ভোজন করার চেষ্টা করলেন। অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর একটি সুন্দরী বালিকা হাত মোছার ধবধবে তোয়ালে এবং সুগন্ধি উষ্ণজল এনে নিজেই সুবিমলবাবুর হাত-মুখ মুছিয়ে দিল।
ক্রমাগত সুন্দরী রমণীর সাহচর্যে সুবিমলবাবু একটু বিহ্বল বোধ করছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সম্পূর্ণ অচেনা এই জায়গায় সদ্য এসে দুম করে কোনওরকম হঠকারিতা করে ফেলা বিপজ্জনক হতে পারে। কেউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, একটু ধীরেসুস্থে রয়েবসে এগোতে হবে।
এদিকে কিন্তু দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ কপালে উঠল, এতক্ষণে দশটা ছত্রিশ হল। মাত্র ছ’ মিনিট। এরই মধ্যে বিশ্রাম, দীর্ঘ ঘুম, পানাহার সব হয়ে গেল। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য।
সুবিমলবাবুর মনে আরেকবার সন্দেহের ভাব দেখা দিতেই সেই আগের প্রতিহারী এসে উপস্থিত হল এবং বিনা প্রশ্নেই বলল, না, ঘড়িটা খারাপ নয়। মহাজাগতিক বৈদ্যুতিক চুম্বক সবকিছুর সঙ্গে ওকে চালাচ্ছে। এটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে একসঙ্গে বাঁধা আছে। ওটা যদি থেমে যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও থেমে যাবে।
প্রতিহারী আরও বলল, এখানে সময়টা একটু আস্তে কাটে বলে প্রথম প্রথম মনে হয়। আপনি যদি পান, আহার, বিশ্রাম বা ঘুম অথবা অন্য কিছু ইচ্ছা করেন বলুন, তার আয়োজন করছি।
একটা লম্বা হাই তুলে সুবিমলবাবু বললেন, আর কত খাব, ঘুমাব। একটা কিছু করে তো সময় কাটাতে হবে। এত লম্বা সময়।
প্রতিহারী বলল, করার মতো কিছু তো এখানে নেই। বলে সে নিঃশব্দে চলে গেল।
বিরক্ত হয়ে সুবিমলবাবু আরেকটু সুরা পান করলেন, তারপরে আরও একটু। এইভাবে প্রচুর পান করে আবার নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
তারপর ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন দু’ মিনিটও যায়নি। এখন সবে দশটা চল্লিশ। সুবিমলবাবু অস্থির হয়ে উঠলেন, এখানে কতদিন থাকতে হবে, এই দীর্ঘ সময় কী করে কাটবে?
মনে প্রশ্ন জাগা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিহারী এসে উদয় হল, বলল, কী হল, ফুর্তিতে থাকুন। আরাম করুন।
সুবিমলবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, আর কত আরাম করব? এখানে আমাকে কতদিন থাকতে হবে?
প্রতিহারী ধীরকণ্ঠে বলল, চিরদিন। অনন্তকাল।
সুবিমলবাবু বিছানায় উঠে বসে সামনের শূন্য বোতল আর গেলাসটা মেঝেয় ছুড়ে ফেলে দিলেন। সে দুটো তুলোর খেলনার মতো মেঝেতে গিয়ে পড়ল, সামান্য শব্দ হল না, ভাঙল না, চুরল না।
এতে তিনি আরও খেপে গেলেন, প্রতিহারীর দিকে ছুটে গেলেন। প্রতিহারী বাতাসের মতো। হালকা শরীর নিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
পরাজিত সুবিমলবাবু গতিক সুবিধের নয় দেখে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, এর চেয়ে আমার নরকে যাওয়াই ভাল ছিল।
সেই একইরকম মৃদু হাসতে হাসতে প্রতিহারী ঠান্ডা গলায় বলল, এটাই নরক।