স্বর্গের বিচার

স্বর্গের বিচার

আমি স্বর্গে গিয়াছিলাম।

বন্ধুগণ শুনিয়া হয়তো অবিশ্বাসের অট্টহাস্য করিতেছেন; ভাবিতেছেন তাঁহাদের ছাড়িয়া অন্যত্র যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু যাঁহারা আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু নন, তাঁহাদের একথা বিশ্বাস করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না। আমি যে ধার্মিক এবং সত্যনিষ্ঠ লোক, একথা সাধারণ্যে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে।

প্রথমটা ভাবিয়াছিলাম, আমার নানাবিধ পুণ্যকার্যের সংবাদ পাইয়া বুঝি দেবরাজ স্থায়ীভাবে আমার স্বর্গে বসবাসের ব্যবস্থা করিয়াছেন; কিন্তু দেখিলাম, তাহা নয়, সাক্ষী দিবার জন্য ডাক পড়িয়াছে। বিচারসভায় হাজিরা দিতে হইবে।

মেঘলোক ভেদ করিয়া বৈদ্যুতিক পূষ্পকরথ স্বর্গের এলাকায় পৌঁছিলে অমরাবতীর বিস্তৃত দৃশ্যটা এক নজরে দেখিয়া লইলাম। এদিকে মন্দাকিনীর ঘাটে বস্ত্রাদি খুলিয়া রাখিয়া কয়েকটি অপ্সরা জলকেলি করিতেছে, কয়েকজন রসিক দেবতা তাহাদের সঙ্গে যোগ দিয়াছেন। ওদিকে চন্দ্রদেব নন্দন-কাননে পারিজাত-বৃক্ষের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া গত রাত্রির খোঁয়াড়ি ভাঙিতেছেন, পাশে সুধা-ভৃঙ্গার পড়িয়া আছে। দুই জন তক্‌মাপরা দেবদূত তাঁহাকে স্থানান্তরিত করিবার জন্য ধস্তাধস্তি করিতেছে, কিন্তু তিনি নড়িতেছেন না, কেশহীন সুচিক্কণ মাথাটি নাড়িতে নাড়িতে কেবলই ফিক্‌ফিক্‌ হাসিতেছেন।

এই সব মনোরম দৃশ্য অতিক্রম করিয়া পূষ্পকরথ বিচারগৃহের সিংহদ্বারে উপনীত হইল। একটি স্বর্গীয় বটবৃক্ষতলে বহু আসামী-ফরিয়াদী-সাক্ষী-পেয়াদা জমা হইয়াছে। একটি ষণ্ডা গোছের যমদূত আমাকে খপ করিয়া ধরিয়া বিচারমণ্ডপে হাজির করিল এবং মুহূর্ত মধ্যে হলফ পড়াইয়া কাঠগড়ায় তুলিয়া দিয়া আবার অন্তর্হিত হইল।

দেখিলাম, সম্মুখেই উচ্চ আসনে দণ্ডধারী যমরাজ বসিয়া আছেন; তাহার নিম্নে পেশকার চিত্রগুপ্ত এক রাশ নথিপত্র লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।

তারপর অদূরে অপর একটি কাঠগড়ায় আসামীর উপর নজর পড়িল। আরে, এ যে হতভাগা ক্যাবলা! তিন দিন আগে তাহার ফাঁসি হইয়া গিয়াছে।

ক্যাবলাকে আমি বাল্যাবধি চিনি, তাহার জীবন-বৃত্তান্ত কিছুই আমার অজানা নাই। সে যে কত বড় নরাধম, তাহা বোধ হয় যমরাজ স্থির করিতে পারিতেছেন না, তাই আমাকে তলব হইয়াছে। ক্যাবলা রৌরব নরকে যাইবার যোগ্য, অথবা কেবলমাত্র কুম্ভীপাক পর্যন্ত গিয়াই নিষ্কৃতি পাইতে পারে, ইহাই সম্ভবত বিচার্য বিষয়।

যমরাজ প্রচণ্ড স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি ক্যাবলাকে চেন?’

করজোড়ে কহিলাম, ‘চিনি, ধর্মাবতার।’

হংসপুচ্ছ তুলিয়া লইয়া যমরাজ বলিলেন, ‘ভাল, তার জীবন-কাহিনী বর্ণনা করো।’

বলিলাম, ‘কি আর বর্ণনা করব, হুজুর, ছোঁড়া ছেলেবেলা থেকেই অধঃপাতে গিয়েছিল। তেরো বছর বয়সে তাড়ি খেতে শেখে…’

‘তারপর?’—ধর্মরাজ জবানবন্দী লিখিয়া লইতে লাগিলেন।

‘ইস্কুলে ক্যাবলার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তুম, হুজুর। ক্যাবলার মতো পাজি বজ্জাত ছেলে ইস্কুলে আর একটিও ছিল না। লেখাপড়া একদম করত না, স্রেফ শয়তানি করে বেড়াত। গাঁয়ের জমিদারবাবুর ওপর তার ভীষণ আক্রোশ ছিল। তাঁর পোষা হাঁসের ডিম চুরি করে এনে পুকুর পাড়ে সেদ্ধ করে খেত; তাঁর পুকুর থেকে মাছ চুরি করে ভিন গাঁয়ে বিক্রি করে আসত। আমরা মানা করলে বলত, ‘জমিদার তো চোর, তার ওপর বাটপাড়ি করলে দোষ নেই।’ একদিন জমিদারের তালগাছ থেকে ভাঁড় নামিয়ে একাই ভাঁড় সাবাড় করে দিলে। তারপর টলতে টলতে ইস্কুলে এসে হাজির হল। ক্লাসে পণ্ডিত মশাই তখন একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন, ক্যাবলা ঘরে ঢুকেই তাঁর মাথায় বমি করে দিলে।’

দেখিলাম, যমরাজের ভয়ংকর গোঁফজোড়া হঠাৎ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে, ভ্রু-যুগল কপালের উপর নাগ-নৃত্য শুরু করিয়া দিয়াছে। যমরাজ ক্যাবলার উপর কুপিত হইয়াছেন, অথবা হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছেন, ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। তিনি মুখখানাকে বিকট রকম কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ‘তারপর? সংক্ষেপে বলো।’

‘সংক্ষেপেই বলছি, ধর্মাবতার। ক্যাবলাকে ইস্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। আমরা গাঁয়ের ভাল ছেলেরা তার সঙ্গে কথা কওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিলুম; সে দুলে-ক্যাওরার ছেলেদের সঙ্গে দিনরাত বদ্‌মায়েসি করে বেড়াতে লাগল।

‘যতই তার বয়েস বাড়তে লাগল, ততই সে বিগড়ে যেতে লাগল। তার চরিত্র একদম খারাপ হয়ে গেল, হুজুর। দুলে-পাড়ার একটি বিধবা স্ত্রীলোককে জমিদারবাবু অনুগ্রহ করতেন, ক্যাবলার নজর পড়ল তার ওপর। জমিদারবাবুর ওপর ক্যাবলার বরাবরই রাগ, সে একদিন দুলে মেয়েটাকে নিয়ে লোপাট হয়ে গেল।’

‘ছ’মাস পরে ক্যাবলা ফিরে এল। শোনা গেল, মেয়েটা নাকি ক্রিশ্চান হয়ে গেছে। ক্যাবলা যেন ভারী সৎকাজ করেছে, এমনই ভাবে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে লাগল।’

এইবার ক্যাবলা হঠাৎ কথা কহিল, বলিল, ‘হুজুর, ক্ষেন্তিকে আমি নিজের বোনের মতো ভালবাসতুম। জমিদার শালা তাকে…’

‘চোপ রও!’—ধর্মরাজ কটমট করিয়া তাকাইলেন, তারপর আমাকে বলিলেন, ‘বলে যাও!’

আমি বলিতে লাগিলাম, ‘ক্যাবলার এক খুড়ো ছিলেন, তিনি তাকে ঘরবাসী করবার জন্যে তার বিয়ে দিলেন। বউটির বয়স বছর এগারো, কিন্তু পেটে প্রকাণ্ড পিলে, হুজুর। এই পিলে-সুদ্ধু মেয়েটাকে নিয়ে ক্যাবলা একেবারে মেতে উঠল। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু এই সময়টাতে ক্যাবলা নাকি তাড়ি গাঁজাও ছেড়ে দিয়েছিল।

বছরখানেক এইভাবে কাটাবার পর ক্যাবলা একদিন বউকে খুড়োর কাছে রেখে বিদেশে গেল। শুনলুম, টাকা রোজগার করতে কলকাতায় গেছে।

‘তারপর তিন বছর আর তার দেখা নেই। কলকাতায় সে কি করছিল, তা, আপনারাই ভাল জানেন, ধর্মাবতার। শুনতুম সে ক্ষেন্তির বাড়িতে থেকে থিয়েটার করত। বাড়িতে একটি পয়সা পাঠাত না; ন’মাসে ছ’মাসে একটা চিঠি দিত—এই পর্যন্ত।

‘ক্যাবলার পৈতৃক দু-এক বিঘে জমি ছিল, তাও খাজনার দায়ে নিলেম হয়ে গেল। ঘরের সম্পত্তি পরের হাতে যাবে, তাই খুড়োমশাই সেটা কিনে নিলেন। কিন্তু ক্যাবলার বউকে খাওয়ায় কে? খুড়ো হাজার হোক্‌ জ্ঞাতি, ভাইপো-বউকে তো চিরকাল পুষতে পারেন না? যতদিন ক্যাবলার জমি ছিল, ততদিন তাকে খোরপোষ দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন?

‘আমরা গাঁয়ের পাঁচজন হয়তো ক্যাবলার বউকে দু-মুঠো খেতে দিতে পারতুম। কিন্তু পরের সোমত্ত বউকে খেতে দিয়ে কে নিন্দে কুড়ুবে, হুজুর? সকলকেই তো স্ত্রী-পরিবার নিয়ে ঘর করতে হয়!

‘ক্যবলার বউ-এর যখন ভীষণ দুরবস্থা, তখন জমিদারবাবু কৃপা করলেন। শিবতুল্য লোক যদি কেউ থাকে তো সে আমাদের জমিদারবাবু। এক কথায় ক্যাবলার বউ-এর সমস্ত ভার তিনি নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন। বেশী কি বলব, হুজুর, তিনি তাকে গয়না পর্যন্ত গড়িয়ে দিলেন। দিনের বেলা পাছে কেউ কিছু মনে করে, তাই রাত্তিরে লুকিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেন। খুড়োমশাই অবশ্য সবই জানতেন, কিন্তু তিনি ধর্মভীরু লোক—কাউকে একটি কথা বলেননি।

‘এইভাবে চলতে লাগল। পাড়াগাঁয়ে কোনও কথাই চাপা থাকে না, কিন্তু তাই বলে পরের হাঁড়িতে কাঠি দিতেও কেউ ভালবাসে না। বিশেষত, জমিদারবাবু মানী লোক; তাই সব দিক বিবেচনা করে আমরা চুপচাপ রইলুম।

‘তারপর হঠাৎ একদিন গভীর রাত্রে ক্যাবলা ফিরে এল। কোথা থেকে খবর পেয়েছিল জানি না; গাঁয়েরই কোনও লোক বোধ হয় বেনামী চিঠি দিয়ে তাকে জানিয়েছিল।’

ধর্মরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে জানিয়েছিল?’

‘তা তো মনে পড়ছে না, হুজুর।’

‘চিত্রগুপ্ত, খাতা দেখ।’

খাতা দেখিয়া চিত্রগুপ্ত বলিল, ‘ইনিই বেনামী চিঠি দিয়েছিলেন। এই যে হস্তাক্ষর-বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট রয়েছে।’

আমি বলিলাম, ‘তা—বোধ হয়—হ্যাঁ, আমিই দিয়েছিলুম, হুজুর, ভালর জন্যেই…’

‘হুঁ। তারপর বলো।’

‘তারপর বলতে আমারই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, ধর্মাবতার। ক্যাবলা ঘরে ঢুকে একবার আপাদমস্তক তার বৌয়ের পানে তাকালে, তারপর জমিদারের দেওয়া সোনার চন্দ্রহার তার কোমর থেকে ছিঁড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বউকে একটি কথাও বললে না।

‘ঘুটঘুটে রাত্তির, হুজুর। ক্যাবলা সটান জমিদারবাবুর পাঁচিল ডিঙিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকল। তারপর যা হল তা সবাই জানে। সকালবেলা দেখা গেল, জমিদারবাবু গলায় চন্দ্রহার জড়িয়ে পড়ে আছেন। পৈশাচিক কাণ্ড, ধর্মাবতার। ক্যাবলা তাঁরই চন্দ্রহার তাঁর গলায় জড়িয়ে তাঁকে খুন করেছে।’

কিছুক্ষণ বিচারসভা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। অবশেষে ধর্মরাজ একবার সজোরে গলা খাঁকারি দিলেন।

‘তোমার আর কিছু বলার আছে?’

‘আর কি বলব হুজুর? আদালতে ক্যাবলার বিচার হল। আমরা সবাই সাক্ষী দিলুম। ক্যাবলা কিন্তু একনাগাড়ে মিথ্যে কথা বলে চলল। বললে, তার স্ত্রী একেবারে সতীসাধ্বী, জমিদার তার জমি নিলেম করিয়ে নিয়েছিল বলেই সে তাকে খুন করেছে। আমরা যতই বলি বউয়ের পেটে ছেলে এল কোত্থেকে, সে ততই বলে ছেলে নয় পিলে। এতবড় পাষণ্ড ক্যাবলাটা, ফাঁসি-কাঠে ঝুলে পড়ল, তবু সত্যি কথা মানলে না।

‘হুজুর, ক্যাবলার যদি ধর্মজ্ঞান থাকত তাহলে সে স্ত্রীকে ত্যাগ করে আবার বিয়ে করত, এমন-তো কতই হচ্ছে। নরহত্যা করবার কি দরকার ছিল? কিন্তু আগেই বলেছি, জমিদারবাবুর ওপর তার ছেলেবেলা থেকে রাগ ছিল…’

ধর্মরাজ হঠাৎ গর্জন ছাড়িলেন, ‘আসামী খালাস!’

আমি হতভম্ব হইয়া গেলাম।

‘প্রভু! ধর্মাবতার! একি বলছেন? ক্যাবলা যদি মুক্তি পায়, সমাজ টিকবে কি করে?’

ধর্মরাজ তাঁহার জ্বলন্ত চক্ষু আমার দিকে ফিরাইলেন। বাঘের মতো চাপা গর্জনে বলিলেন, ‘আর তুমি—তুমি—’

ধর্মরাজের চক্ষু হইতে অসহ্য আলোর রক্তশিখা বাহির হইয়া আমার চক্ষুকে বিদ্ধ করিতে লাগিল; মনে হইল, আগুনের দুইটা শূল আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিতেছে।

ঘুম ভাঙিয়া গেল। দেখিলাম, সকালবেলার এক ঝলক রাঙা রৌদ্র জানালা দিয়া প্রবেশ করিয়া আমার চোখে পড়িয়াছে।

৫ বৈশাখ ১৩৪৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *