স্বর্গের বারান্দায়

স্বর্গের বারান্দায়

আমি প্রায়ই স্বর্গের স্বপ্ন দেখি। আমি এমনিতেই স্বপ্ন দেখি একটু বেশি, বলা যায় স্বপ্ন দেখা আমার রোগ বিশেষ। আমার পেট ও মাথা দুই-ই গরম, কোনো রাত্রেই ভালোভাবে ঘুম হয় না, তাই সিনেমার মতো অজস্র স্বপ্ন আমার চোখের সামনে ভেসে যায় এবং অধিকাংশ স্বপ্নই তার পরের সকালবেলাতেও আমার মনে থাকে। সেই সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে দিলে ফ্রয়েড কিংবা ইয়ুং সাহেবরাও হিমসিম খেয়ে যেতেন।

অন্যান্য লক্ষ লক্ষ স্বপ্নের মধ্যে স্বর্গের স্বপ্নটাই ঘুরে ফিরে আসে। এই স্বপ্নটাতে আমি অত্যধিক উল্লসিত হয়েও উঠি না কিংবা ভয়ও পাই না। স্বর্গ আমার চেনা হয়ে গেছে। এই স্বর্গের সঙ্গে কিন্তু পুরাণে-ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত স্বর্গের দৃশ্যের কোনো যোগ নাই। আমার স্বপ্নে দেখা স্বর্গে কখনো দেবদেবীদের দেখিনি, অপ্সরা-উর্বশীদেরও দেখিনি—একবার মাত্র কয়েক পলকের জন্য রম্ভা নামের নর্তকীকে দেখেছিলাম—যমরাজ বা চিত্রগুপ্তকেও দেখিনি।

আমার দেখা স্বর্গ অনেকটা সুন্দরভাবে সাজানো কোনো ডাকবাংলোর মতন। পাহাড়ি জায়গায় ডাকবাংলোর মতন বেশ খানিকটা উঁচু ভিতের ওপর একটা ধবধবে সাদা রঙের বাড়ি, অনেকগুলি কাচের দরজা ও জানালা। সামনে বেশ বড়ো একটি পরিচ্ছন্ন বাগান, বাড়িটার পিছনে অরণ্য। তবে স্বর্গে মাত্র ওই একটাই মোটে বাড়ি তো হতে পারে না, তাই আমার মনে হয়, ওই অরণ্যের মধ্যে আরও অনেক বাড়ি আছে—সেগুলো আমি দেখিনি। সামনের ওই বাড়িটা স্বর্গের বিশ্রাম-গৃহ, তাই ডাকবাংলোর মতন চেহারা। বহুদূরের পথ পেরিয়েই তো মানুষ স্বর্গে পৌঁছবার পর ওই বাড়িতে প্রথমে একটু বিশ্রাম নেয়।

ওই দৃশ্যটাই যে স্বর্গের দৃশ্য, তা আমি চিনলাম কী করে?

কোথাও তো কোনো সাইন-বোর্ড লেখা নেই! তবু আমি ঠিকই চিনেছিলাম। আমি জীবনে বহু ডাকবাংলোতে থেকেছি কিন্তু ওই বাড়িটা দেখামাত্রই বুঝতে পেরেছিলাম, এটা সব কিছুর থেকে আলাদা। তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয়, যদি ওখানে আশ্রয় পাওয়া যেত তাহলে জীবনে আর কিছু চাই না।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, সামনের বাগানটুকু। অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। অথচ একটাও চেনা ফুল নয়। সবুজ, কালো কিংবা বেগুনি রঙের ফুল কি পৃথিবীতে তেমন দেখা যায় , স্বর্গের বাগানে বেগুনি রঙের প্রাধান্য। রামধনুর প্রথম রং বেগুনি বলেই বোধ হয় এরকম। পৃথিবীতে এক ধরনের লাল শাক আছে, ইট চাপা ঘাসের রং হয় হলদে, এ ছাড়া সব গাছই সবুজ। ওই বাগানের সব গাছই বেগুনি এবং সেই গাছগুলোর ভেতর থেকে আলো বেরোয় ঠিক যেন ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অথচ তৈরি নয়, সজীব।

প্রথমবার এই দৃশ্যটাই দেখে ঠিক চিনতে পারিনি অবশ্য গাছগুলো দেখেই বিস্মৃত হয়েছিলাম আমি যেন বেড়াতে বেড়াতে সেই বাগানের কাছে গেছি, ফুলগাছগুলো দেখে অবাক। ভাবছি এগিয়ে গিয়ে ফুল ছিঁড়ে নেব কিন্তু পরের বাগানের ফুল কাউকে না জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত নয়। খানিক পরে এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম। তিনি নীচু হয়ে ফুলের গন্ধ শুঁকছেন। মেমসাহেবরা সাঁতার কাটার সময় যেটুকু পোশাক পরে, মহিলার শরীরে সেইটুকু পোশাক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহিলার উরু দুটি। কলাগাছের মতন সুডৌল এবং এত মসৃণ ও ঝকঝকে যে মনে হয় ভেতর থেকে আলো বেরুচ্ছে, কলাগাছেরই মতন সবুজ ও হলদে মেশা আলোর আভা। পরে জেনেছিলাম, ওই মহিলারই নাম রম্ভা। লোকে কথায় কথায় রম্ভোরু বলে না?

আমি বাগানের বাইরে থেকে ভদ্রমহিলাকে বললাম, ফুলগুলো আশ্চর্য সুন্দর তো! এই জায়গাটার নাম কী?

মহিলা উত্তর দিলেন, আপনি জানেন না? লোকে এই জায়গাটাকে স্বর্গ বলে।

শুনে একটুও চমকে উঠলাম না। বরং আমার মনে হল, তা তো হবেই। স্বর্গ না হলে এ রকম হয়!

আমি ওঁকে অনুরোধ করলাম, শুনুন, আপনি আমাকে ফুলগাছের একটা চারা দেবেন? মায়ের জন্য নিয়ে যাব। আমার মায়ের ফুল গাছের খুব শখ।

মহিলা খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ভিতরে আসুন না। ওই যে আপনার ডানদিকেই গেট আছে। একটু ঠেলা দিলেই খুলে যাবে।

বুক সমান উঁচু কাচের তৈরি গেট। বাগানের ধারেও মেহেদি গাছের বেড়া, কাঁটা তার বা দেয়াল-টেয়াল নেই। একটু জোর করলে গেটটা ভেঙে ফেলা যায়, কিংবা লাফিয়ে ওপারে যাওয়া যায়। আমি সে-রকম কিছু করলাম না। আস্তে গেটে ঠেলা দিলাম। খুলল না। আমার খুব দুঃখ হল। ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ আমার বুকের মধ্যে সেই দুঃখবোধ চাপ বেঁধে ছিল। আমার জন্য স্বর্গের দরজা খুলল না, আমি কি পাপী? খানিকটা বাদে মনে পড়ল, আমি তো এখনও মরিইনি। আমার তো স্বর্গে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তখন মনটা হালকা হয়ে গেল।

এরপর মাঝে মাঝেই আমি স্বর্গের স্বপ্ন দেখছি। যেদিন আমি কোনো জায়গা থেকে বড়ো রকমের মানসিক আঘাত পাই, সেই রাত্রেই স্বর্গের স্বপ্ন আমার চোখে আসে। কখনো আর ঢোকার চেষ্টা করিনি ভিতরে। দাঁড়িয়ে থেকেছি বাগানের পাশে। দেখতাম মাঝে মাঝেই অনেক নারী পুরুষ বাইরে থেকে এসে দাঁড়াচ্ছে ওই গেটের সামনে। কেউ কেউ হাত দিয়ে ঠেললেই আপনি খুলে যাচ্ছে গেট। তখন তারা বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে উঠছে সেই সাদা বাড়িটার বারান্দায়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চেহারাগুলো ভারি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো মানুষ গেট ঠেললেও খুলছে না। তখন তাদের চোখে জল আসে। সেই জলের ফোঁটা মাটিতে পড়ার আগেই তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি এ পর্যন্ত আমার পরিচিত কোনো মানুষকে স্বর্গের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখিনি। একবার শুধু…

তার আগে দুটি মৃত্যুর কথা বলা দরকার আমার যখন আঠাশ বছর বয়স সেই সময় আমি পশ্চিম দিনাজপুর থেকে একটি প্রেমপত্র পাই। বন্দনা সরকার নামে একটি মেয়ে আমার লেখা-টেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছে। আমাকে তার ভীষণ ভালো লাগে ইত্যাদি। চিঠির শেষে সে আমার উদ্দেশে দু-লাইন কবিতাও লিখেছে। যেহেতু সেই চিঠিতে তিনটি বানান ভুল ছিল, তাই সে চিঠির উত্তর আমি দিইনি।

মাস দু-এক পরে সেই মেয়েটিই আমাকে চিঠি লিখল ডায়মন্ডহারবার থেকে। এবং আর তিন মাস পরে আবার মেদিনীপুর থেকে। ব্যাপারটা একটু রহস্যময় লাগতে শুরু করেছিল। কিন্তু রহস্যভেদের কোনো উদ্যোগ করিনি, কারণ মেয়েটির চিঠিতে বানান ভুলের সংখ্যা কমেনি। তারপর মেয়েটি নিজেই একদিন আমার বাড়িতে এসে হাজির হল।

বন্দনা বলেছিল ওর বয়েস তখন পঁচিশ, কারণ ও জানত আমার বয়েস তখন আঠাশ। আসলে বন্দনা তখন তিরিশ ছুঁয়েছে এবং দেখলেই বোঝা যায়। বন্দনা স্কুল মাস্টারি করে এবং এক জায়গায় তার মন টেকে না বলে ঘনঘন চাকরি বদলায়। আমি তাকে বলেছিলাম, স্কুল শিক্ষয়িত্রীর পক্ষে এ রকম বানান ভুল করা উচিত নয়—তার উত্তরে সে জানিয়েছিল যে, সে অঙ্কের টিচার, বাংলা বানান তার ভালো না জানলেও চলে। তা হয়তো ঠিক, কিন্তু বানান ভালো না জেনে যে প্রেমপত্র লেখা চলে না, এটা কে তাকে বোঝাবে!

আমার সেই বয়সে কত বন্ধু-বান্ধব, কত হই-হুল্লোড় আড্ডা। সারা শহর তোলপাড় করে ছোটাছুটি, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। কখনো অসম্ভব নেশা করে গুন্ডাদের সঙ্গে জুয়া খেলতে যাই, কখনও শ্মশানে গিয়ে কোরাস গান করি। মেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করা ছিল তখন আমার প্রিয় বিলাসিতা। বিশেষত, একটি মফস্বলের মেয়েকে নিয়ে ব্যাপৃত থাকার কোনো সময়ই আমার ছিল না।

বন্দনার চিঠির বানান ভুল অনায়াসে ক্ষমা করা যেত, যদি তার শরীরে রূপ থাকত। অবশ্য কোনো রূপসি মেয়ে আমাকে প্রেমপত্র পাঠাবেই বা কেন? বন্দনাকে ঠিক কুৎসিতও বলা যায় না—লম্বাটে ধরনের চেহারা, গায়ের রং মাজা মাজা, নাক চোখও ঠিকঠাক। তবু তার চেহারায় এমন একটা কিছু ছিল, যে জন্য তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। বন্দনার প্রধান দোষ ছিল চোখ পিটপিট করা। কোনো মেয়ের এই রোগ আমি আগে দেখি নি, বন্দনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর অনবরত চোখ পিটপিট করছে, দেখলেই কী রকম অস্বস্তি লাগে। শুকনো ভদ্রতা দেখিয়ে বন্দনাকে আমি বিদায় করলাম। তবু বন্দনা নিয়মিত চিঠি লেখে। আমি উত্তর দিচ্ছি না অথচ একজন আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখে যাচ্ছে এও তো এক দারুণ যন্ত্রণা। বন্দনার পর পর আটখানা চিঠি পাবার পর আমি সংক্ষিপ্ত ভদ্রতায় একবার উত্তর দিলাম। তাতে বন্দনা এত বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠল যে দু-দিন পরেই স্কুল কামাই করে দেখা করতে এল আমার সঙ্গে, আমাদের বাড়ির বসবার ঘরে সে বসে রইল দু-ঘন্টা, আমি ব্যস্ততার ইঙ্গিত করাতেও উঠল না। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা আমার হাতের আঙুল নিয়ে সে খেলা করতে চায়। তখন তার চোখ পিটপিট করাও বেড়ে যায় খুব।

এই অবস্থায় আমার করণীয় কী ছিল? আমার দোষ এই, আমি আমার কর্তব্য ঠিক করতে পারি না চট করে। বিশেষত, এই রকম অদ্ভুত সমস্যায় পড়লে। বন্দনা আমার প্রেমে পড়তে চায়। বস্তুত, আমার প্রেমে পড়ার জন্য সে বদ্ধপরিকর। আমি আমার কোনো লেখায় লিখেছিলুম, এ পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমাকে ভালোবাসেনি। সেটা পড়েই বন্দনা ধরে নিয়েছিল, আমি খুব দুঃখী মানুষ এবং সে এসেছিল আমার উদ্ধারকর্তা হিসাবে। সে দেখিয়ে দিতে চায়, মেয়েরাও ভালোবাসতে জানে।

ভদ্রতাসম্মতভাবে বন্দনাকে প্রত্যাখ্যান করার যতগুলি উপায় আছে সবগুলিই আমি ব্যবহার করেছি। বন্দনা কিছুতেই বুঝবে না। ওর ধারণা, এসব আমার অভিমানের কথা। কী যে মুশকিলে পড়া গেল।

মোট কথা, বন্দনা তারপর থেকে অতিষ্ঠ করে তুলল আমার জীবন। স্কুলের ছুটি হলেই সে ঘন ঘন কলকাতায় চলে আসে এবং ছায়ার মতো আমায় অনুসরণ করে। ছোটোখাটো অপমান সে গায়েই মাখে না। বন্ধুরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করেছে।

একদিন বন্দনা চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটিয়ে আমার কাছে এসে বলল, তার বাবা মা তার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করেছে।

আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, এ তো চমৎকার কথা। পাত্রটি কী করে?

বন্দনা বলল, পাত্র একটি কলেজে পড়ায়। কিন্তু মরে গেলেও সে তাকে বিয়ে করবে না। আমি কি বন্দনাকে সাহায্য করব না?

আমি কিঞ্চিৎ কঠোর ভাষাতেই জানালাম যে আমার কাছ থেকে কোনো কিছু যেন সে প্রত্যাশা না করে।

বন্দনার আসল ইচ্ছাটি আস্তে আস্তে জানা গেল। ছেলেবেলা থেকেই তার প্রতিজ্ঞা সে কখনো বাপ-মায়ের পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করবে না। সে কারুকে ভালোবাসবে, তারপর তার সঙ্গে যদি বিয়ে হয়—কিংবা তাকে যদি কেউ ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়…। দীর্ঘ তিরিশ বছরের মধ্যে বন্দনার প্রেমে কেউ পড়েনি। এইজন্যই লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বন্দনার চেয়ে ঢের খারাপ চেহারার মেয়ের প্রেমেও অনেক লোক পড়ে—কিন্তু বন্দনার কোনো প্রেমিক জোটেনি। এতদিন পর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত। তখন বন্দনা আমাকেই তার প্রেমিক হিসেবে বেছে নিয়েছে—তার কারণ আমার সেই লেখা, যার মধ্যে লিখেছিলাম, আমি কখনও ভালোবাসা পাইনি। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে! আমি তিন চারটি মেয়ের নাম বলেছি আমার প্রেমিকা হিসেবে—দুজনের সঙ্গে বন্দনার আলাপও করে দিয়েছি, তাও বন্দনা নিবৃত্ত হয় না।

বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বন্দনার বিয়ের কথা যত পাকা হতে লাগল বন্দনা ততই মরিয়া হয়ে উঠল। একদিন আমার কাছে এসে একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিল। বন্দনা বেশ কয়েক বছর মাস্টারি করে সাতশো টাকা জমিয়েছে, সেই টাকা নিয়ে সে আমার সঙ্গে ছুটিতে বাইরে কোনো হোটেলে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটিয়ে আসতে চায়! বিয়ে না হয় না-ই হল, তবু তো সাতটা দিন তার জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সেই প্রস্তাব শুনে আমি নিষ্ঠুরের মতো বলেছিলাম, সাতশো টাকার বদলে তুমি যদি সত্তর হাজার টাকা আনতে তাহলে না হয় চিন্তা করে দেখা যেত। তুমি বরং অন্য কোনো ছেলেকে খুঁজে নাও। অন্য অনেকে রাজি হতে পারে। যদি চাও তো আমিই অন্য ছেলে জোগাড় করে দিচ্ছি।

বন্দনা সেদিন কেঁদে ফেলেছিল। আমারও অসহ্য লেগেছিল তখন।

দিন দশেক বাদে পি. জি. হাসপাতাল থেকে একটা চিঠি পেলাম। পেন্সিলে লেখা খামটাও খুব ময়লা। বন্দনার চিঠি। লিখেছে যে হঠাৎ তার পেটে খুব ব্যথা হওয়ায় ও হাসপাতালে ভরতি হয়েছে। আমি যেন অবশ্যই ওর সঙ্গে দেখা করি। চিঠি লেখার সরঞ্জাম অতি কষ্টে জোগাড় করতে হয়েছে।

হাসপাতালের ত্রিসীমানায় আমি পারতপক্ষে যাই না। বন্দনার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার তো কথাই ওঠে না। পেটে ব্যথা হয়েছে তো আমি দেখতে গিয়ে কী করব!

দু-দিন বাদে বন্দনার আর একটা চিঠি এল। সেই চিঠিখানা আমার কাছে এখনো আছে। তাতে লিখেছে, আমি বুঝতে পারছি আমি আর দু-তিন দিনের বেশি বাঁচব না। তুমিই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমি একটু ভালোবাসার জন্য কাঙাল ছিলাম। তুমি এত কৃপণ, যে আমাকে একটু ভালোবাসতে পারলে না! একবার আসবে? তুমি যদি এসে একবার আমাকে একটা চুমু দাও, শান্তিতে মরতে পারব তাহলে। কোনো ক্ষোভ থাকবে না।

এ চিঠিখানাও আমার অসহ্য ন্যাকামি বলে মনে হয়েছিল। দু-তিন দিন বাদে যে মারা যাবে, তার চিঠি লেখার ক্ষমতা থাকে না। পেটে ব্যথা হলে কেউ মরে না। তা ছাড়া হাসপাতালে গিয়ে চুমু দেব—এ কি ইয়ার্কি নাকি? বাচ্চা মেয়ে হলেও কথা ছিল, অত বড়ো ধিঙ্গি মেয়েকে হাসপাতালে চুমু! ভেবেছিলাম, সময় পেলে হাসপাতালে গিয়ে বন্দনাকে আর একবার ধমকে দিয়ে আসব। সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিন দিনের দিন বন্দনা মারা গেল।

আসলে তার লিউকোমিয়া ছিল, সে জানত না। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথার জন্য অপারেশন করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।

বন্দনার মৃত্যুর খবর শুনে আমি বেশ রেগে গিয়েছিলাম। এ রকম দুম করে মরে যাবার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া তার মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করা কেন? পি. জি. হাসপাতালের শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেছে। আমার পক্ষে কি জোর করে ভালোবাসা সম্ভব? আমি ওর সঙ্গে বেলেল্লা করিনি, সেটা কি আমার অপরাধ?

অতৃপ্ত ভালোবাসা নিয়ে বন্দনা মরে গেল তিরিশ বছর বয়সে?

বন্দনাকে হাসপাতালে দেখতে যাইনি কিন্তু নির্মলকে দেখতে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই বুঝেছিলাম নির্মল বাঁচবে না। আমরা গিয়েছিলাম ওকে সান্ত্বনা দিতে, ওর কপালে হাত রেখে বলেছি, ভয় নেই দুদিনেই সেরে উঠবি।

নির্মল ছিল ওর বাবা মায়ের এক ছেলে। আসলে ওরা ছিল পাঁচ ভাই বোন। কিন্তু আশ্চর্য নিয়তির খেলায় ওর অন্য সব ভাই-বোনই অল্প বয়সে মারা যায়। সেইজন্যই নির্মলের মা ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখতেন, কয়েক ঘন্টা না দেখলে উতলা হয়ে উঠতেন। আমরা সন্ধেবেলায় যখন তুমুল আড্ডা দিচ্ছি, তখন নির্মলকে নিরস মুখে বাড়ি ফিরে যেতে হত। কেউ ঠাট্টা করলে নির্মল বলত, জানিস না তো আমার মাকে, একটু দেরি হলেই মা আবার ফিট হয়ে যাবেন। আমি ভাই মাকে কষ্ট দিতে পারি না। শেষ পর্যন্ত নির্মলের মা-ই তার মৃত্যুর কারণ হন।

নির্মলরা থাকত দমদমে—ওদের বাড়ির পাশেই ইস্কুল ও কলেজ। বাড়ির পাশে কলেজ না থাকলে নির্মলের পড়াশুনা করাই হত না। তা-ও তো দু-তিন পিরিয়ড পর পর নির্মলকে একবার বাড়ি এসে দেখা দিয়ে যেতে হত। নির্মল যখন দিল্লি কিংবা বেনারসে বেড়াতে গেছে, ওর মাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়েছে। মাকে কষ্ট দেবার কোনো উপায়ই ছিল না নির্মলের—ওর মা তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যেতেন—তখন ডাক্তার ডাকা, ছুটোছুটি।

এইরকম ভাবে মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় থাকতে থাকতে নির্মলের স্বভাবটাও একটু অদ্ভুতরকমের হয়ে গিয়েছিল। বাইরের লোকের সঙ্গে মিশতে পারত না, কথা বলতে পারত না। বেশির ভাগ সময়েই বাড়িতে কাটাত, আমরা আড্ডা দিতে ওদের বাড়িতেই যেতাম, ওর মা অবশ্য যত্ন করতেন খুব।

বাবা মারা যাবার পর নির্র্মল আরও একা হয়ে পড়ে। বাড়িতে শুধু মা আর ছেলে, বাড়িখানা ওদের নিজস্ব। আত্মীয়স্বজনেরা পরামর্শ দিলেন নির্মলের বিয়ে দেবার জন্য। নির্মল জীবনে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে মেশেনি। নির্মলের মা চতুর্দিকে পাত্রী দেখে বেড়াতে লাগলেন। কিছুতেই আর পছন্দ হয় না—উনি ডানা-কাটা পরি খুঁজছেন। আমরা গেলে নির্মল একগাদা মেয়ের ছবি তাসের মতো মেলে জিজ্ঞেস করত, বল তো, কাকে পছন্দ করা যায়?

নির্মলের বাড়ির পাশের মাঠে প্রতি বছর সরস্বতী পুজো হয়। সকালবেলা নির্মলের পরনে ধুতি আর গেঞ্জি। নির্মল নিজেদের পাঁচিল দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে—পুজো শেষ হয়েছে কি না। অঞ্জলি না দিয়ে নির্মল চা খেতে পারছে না। পাঁচিলের পাশেই একটা তোলা উনুন ধরতে দেওয়া ছিল, নির্মল সেটা দেখতে পায়নি। সেই উনুন থেকে লকলকে শিখা উঠে নির্মলের ধুতিতে লাগল। নির্মল যখন খেয়াল করল, তখন তার ধুতি দাউদাউ করে জ্বলছে।

সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল ধুতিটা কোনোক্রমে খুলে ফেলা কিংবা মাটিতে গড়াগড়ি দিলেও আগুন নিভে যেত। এ সব তো সবাই জানে। নির্মলও কি জানত না। তবু ওর মাথার গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল আগুন দেখে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে মা মা চিৎকার করে ছুটে গেল নির্মল। মা তখন দোতলায়। সেই ছুটে যাওয়ায় আগুন জ্বলতে লাগল আরও বেশি। দোতলার বাথরুম থেকে সেই আর্ত চিৎকার শুনে বেরিয়েই মা দেখলেন তার জ্বলন্ত সন্তানকে। একটা কম্বল এনে চেপে ধরার বদলে মা তাড়াতাড়ি এক বালতি জল এনে ঢেলে দিলেন নির্মলের গায়ে! তারপর আরও এক বালতি। নির্মলের যদিও বা বাঁচার আশা ছিল কিন্তু ওই জল ঢালার ফলে সেই সম্ভাবনাও ঘুচে গেল।

তিনদিনের মধ্যে নির্মলের জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তাররা বিমর্ষভাবে ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, বাঁচার আশা নেই! যদি বা কোনোক্রমে বাঁচে, পা দুটো আর ব্যবহার করতে পারবে না—সে আর পুরুষ থাকবে না।

তিনদিন পর নির্মলের জ্ঞান ফিরল। তখন আমরা গেলাম ওকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে। নির্মল মানুষ চিনতে পারছে, কথাও বলছে। লোকজনের ভিড় করা একেবারে নিষেধ। নির্মল তার ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত আমার হাতে রেখে জিজ্ঞেস করল, সুনীল, আমি সত্যিই বাঁচব তো? বল, সত্যি করে বল, বাঁচব?

নির্মলের দু-চোখে জল। আমি অম্লান বদনে বললাম, কী বলছিস পাগলের মতন! এক সপ্তাহের মধ্যেই তোকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে।

নারে, আমি বাঁচব না। আমি জানি! দু-চোখে অনর্গল জল, নির্মল আস্তে আস্তে বলল, অতগুলো ছবি, যদি যে-কোনো একজনকে আগেই পছন্দ করে ফেলতাম আমি এ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে ছুঁয়ে দেখিনি। মেয়ের ভালোবাসা পাওয়া যে কী জিনিস জানি না, আমার ভাগ্যে নেই…

কয়েক ঘন্টা বাদেই নির্মল মারা যায়। ওর শবদেহ দাহ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল। পরপর দু-রাত্তির আমারও ঘুম হয়নি। বাড়ি ফিরে স্নান করে চা খেয়েই শুয়ে পড়লাম, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।

সেদিন আবার দেখলাম স্বর্গের দৃশ্য। বাগানটা আজ ফাঁকা, বাড়িটাতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না—আলোর মতন জ্বলন্ত ফুলগাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। চারপাশে একটা অস্পষ্ট নীল আলোর আভা।

বাগানের বাইরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্মল! অর্ধদগ্ধ বিকৃত শরীর। দগদগে ঘা-গুলো দেখা যাচ্ছে। দরজার ওপর হাত রেখে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ঠ্যালা দিতে সাহস পাচ্ছে না—যদি ঢুকতে না পায়। ঝলসানো মুখে বিষণ্ণতা ফুটে উঠেছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তো দাঁড়িয়েই রইলো।

হঠাৎ তার হাতের ওপর আর একখানি হাত এসে পড়ল। নারীর হাত। দূর থেকে আমি দেখলাম, বন্দনা এসে দাঁড়িয়েছে গেটের সামনে। নির্মল চমকে তাকাল বন্দনার দিকে। এই প্রথম তার শরীরে মা ছাড়া অন্য নারীর স্পর্শ। চমকে উঠেছে নির্মল। বন্দনা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নির্মলের দিকে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বন্দনা আর চোখ পিটপিট করছে না।

বন্দনা চাপ দিতেই গেট খুলে গেল। নির্মলের দিকে ফিরে ডাকল আসুন!

আমি জানতাম, নির্মলের জন্য দরজা বন্ধ থাকবে না। ওরা দুজনেই ভালোবাসার অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে।

বাগানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই নির্মলের শরীরের পরিবর্তন দেখা দিল, আবার সে সজীব স্বাস্থ্যবান শরীর ফিরে পেয়েছে। বন্দনার মুখে এসেছে আশ্চর্য কমনীয়তা। পরস্পর হাত ধরাধরি করে ওরা বাগান পেরিয়ে উঠল সেই সাদা বাড়িটার সিঁড়িতে।

অল্পক্ষণের জন্য ওরা আমার চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এল সেই সাদা বাড়ির বারান্দায়। হাস্য-উজ্জ্বল মুখ দুজনেরই। কী যেন একটা রসিকতায় ওরা হঠাৎ একসঙ্গে হেসে উঠল। তারপর বালক-বালিকার মতন আনন্দে লঘু পায়ে ছোটাছুটি করতে লাগল বারান্দায়। একটু পরেই সুখী পায়রার মতন ওরা পরস্পরের মুখ চুম্বন করল। যেন একজনের ঠোঁট থেকে আর একজন সত্যিকারের মিষ্টি কিছু পান করছে।

আমার বুকখানা আনন্দে ভরে গেল। মনে হল এমন সুন্দর কোনো দৃশ্য আমি সারা জীবনে কখনও দেখিনি। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, নির্মল! বন্দনা! ওরা দুজনেই শুনতে পেয়েছে ঠিক। উজ্জ্বল রেলিং ধরে শিশুর মতন ঝুঁকে হাত নাড়তে লাগল আমার দিকে। আমার প্রতি খানিকটা দয়া কিংবা অবজ্ঞার ভাব ফুটে উঠেছে ওদের মুখে। যেন ওরা বলতে চাইছে, তুমি আসতে পারবে না, তুমি কোনোদিন এখানে আসতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *