স্বর্গের জানালায় – প্রবীরগোপাল রায়

স্বর্গের জানালায় – প্রবীরগোপাল রায়

চন্দন রায়ের কথা

উপরে যে—নামটা দেখছেন, সেটি আমার ছদ্মনাম। আসল নাম প্রকাশে বাধা আছে। পরিচয় সংক্ষেপে সারি। বর্তমানে আমি ভারতবর্ষের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন একটি রাষ্ট্রে আমাদের দূতাবাসে নিযুক্ত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা—দপ্তর থেকে আমার নিযুক্তি। কাহিনি যখন শুরু হচ্ছে, তখন আমি দিল্লিতে। যে—দেশে আমার নিয়োগ আসন্ন, সেখানকার ভাষা রপ্ত করতে ব্যস্ত।

সেদিন প্রভাতী দৈনিকে চোখ বোলাতে গিয়েই এককোণে একটি খবর চোখে পড়ল। কলকাতার তরুণ চিত্র—পরিচালক জয়ন্ত সেন একটি এক্সক্লুসিভ হোটেলে মত্ত কলহে লিপ্ত হয়ে ছুরিকাহত হয় এবং তাতেই তার মৃত্যু ঘটে।

বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে এই প্রথম বড়রকম শোক পেলুম। পশ্চিমের একটি স্কুলে এবং তারপর কলেজে মোট আট বছর ও আমার সহপাঠী ছিল। আমাদের বন্ধুত্ব পরিচিত হলে প্রবাদের সামিল ছিল। বি. এসসি. পাশ করার পর আমাদের জীবনধারা ভিন্নমুখী হল ও গেল কলকাতায়—প্রথমে সোসাইটি ফটোগ্রাফার হয়ে এবং তারপর চিত্র—পরিচালনার কাজে। কিন্তু চিঠিপত্রের আদানপ্রদান এবং বছরে বার দুই—তিন সাক্ষাৎ বন্ধ হয়নি। আমরা দুজনেই আত্মীয়স্বজনের ঘনিষ্ঠ আবহাওয়ার বাইরে মানুষ। অভাবটি আমরা অনেকখানি মিটিয়েছিলুম পরস্পরকে পেয়ে। ইদানীং অবশ্য আমি বড় কাজপাগল হয়ে উঠেছিলুম (আমার কাজে কিছু অ্যাডভেঞ্চার আছে।) এবং ওর জীবনে নারীর মোহিনী প্রভাব বিস্তারিত হচ্ছিল।

সংবাদপত্র পড়ে মন শোকে অভিভূত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে ছিল ক্ষোভ। ভারতবর্ষের প্রধান তিনটি ফিল্ম—সেন্টারে অপদার্থ, অশিষ্ট বা লম্পট চিত্র—পরিচালকদের তো অভাব নেই, অথচ জয়ন্তকেই রেকর্ড করতে হল এভাবে মৃত্যুবরণ করার। এ—পরিণাম অবশ্যই ওর প্রাপ্য নয়। তারপরেই মনে হল, আমায় কলকাতায় যেতে হবে। গিয়ে যে কার কি কাজে আসব, তা ভাবিনি। খুবই সম্ভব যে, আমার পৌঁছোতে পৌঁছোতে বন্ধুর শেষকৃত্য সমাপ্ত হয়ে যাবে।

ফোনে খবর পাওয়া গেল যে বেলা দশটাতেই প্লেন পাচ্ছি এবং আসন—সংরক্ষণ সম্ভব। এরপর ছুটলুম আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে ছুটি আদায় করতে হবে।

সেদিনই বিকেলে জয়ন্তের শবানুগমনে অংশগ্রহণ করা আমার ভাগ্যে ঘটেছিল। পোস্ট—মর্টেমের হাঙ্গামা মিটে গেলে তবে পুলিশ মৃতদেহ হস্তান্তর করেছিল। খবর পেয়ে আত্মীয়দের মধ্যে জয়ন্তের বাবা এবং ওর চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড় এক দিদি এসেছিলেন। এঁরা আমায় চেনেন। চিত্রজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু লোক ভিড় করেছিল। এদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। অবশ্য, জয়ন্তের প্রধান সহকারী সুশান্ত ভৌমিক আমায় খুব খাতির করে। শুনলুম, সে আসানসোল—বার্নপুরে গেছে বহির্দৃশ্য—গ্রহণের স্থান নির্বাচন করতে। কোনো কারণে লোকমুখে বা সংবাদপত্রে খবরটি পেতে তার দেরি হচ্ছে।

ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশই, বলা বাহুল্য, জয়ন্তকে ভালোবাসত। তাদের কেউ কেউ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তারা নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে যে—সব আলাপ করছিল, তার কিছু কিছু আমি চেষ্টা করে শুনলুম। শুনতে ভালো লাগছিল। কারণ, ক্রোধালু ও মত্ত (সুরায় এবং নটীর প্রতি প্রেমে) জয়ন্ত তার উচিত শাস্তিই পেয়েছে, এমন ইঙ্গিত কারো কথায়ই ছিল না। সৌজন্য বাধা ছিল বলে নয়। কারণ বেশ রূঢ় ভঙ্গি ও ভাষাতেই তারা সংশ্লিষ্ট নটীটির প্রতি তাদের ক্রোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করছিল।

এইখানে হত্যাকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিই। অভিনেত্রী মধুরা দেবীর সঙ্গে জয়ন্ত হোটেলটিতে গিয়েছিল। সেখানে অধুনা নিষ্কর্মা নট বিপ্রদাস বসুর সঙ্গে তার প্রথমে বচসা ও পরে মারামারি হয়। বিপ্রদাস আহত হলেও একটি ছুরিকার সাহায্যে জয়ন্তর কণ্ঠচ্ছেদন করে। সে—আঘাতে বাঁচা অসম্ভব। পুলিশ হত্যাপরাধে বিপ্রদাসকে গ্রেপ্তার করেছে।

বিপ্রদাসের অপরাধের গুরুত্ব সম্বন্ধে দেখলুম দুটি ভিন্ন মত আছে। একদলের বক্তব্য, ওর বিরুদ্ধে দুটি খুনের অভিযোগ আনা উচিত। অবিনাশ সরকারকে অবশ্য ও নিজ হাতে খুন করেনি, কিন্তু ঘাতকদের লেলিয়ে দিয়েছিল। মধুরা যদি তখন ওকে ধরিয়ে দিত, তাহলে জয়ন্তকে প্রাণ হারাতে হত না।

দ্বিতীয় দলের বক্তব্য, অবিনাশ—হত্যার ষড়যন্ত্র বিপ্রদাসের রচনা নয়। জয়ন্তর হত্যায় সে প্ররোচিত ও প্রেরিত হয়েছিল। এই মত যাদের, তারা নিশ্চিত যে বিপ্রদাস যদি বেকসুর খালাস না—ও পায়, দশ বছরের জেল ওর সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে। যে হতভাগ্য শূন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিভার পচিয়ে (তার ধার—করা পয়সার মদে) মরাই শ্রেয়তর ভেবেছিল, তার কাছে এই বিলম্বিত আত্মহত্যার চেয়ে মুঠো মুঠো টাকার লোভে মানুষ খুন করে কয়েক বছর জেলে বেড়িয়ে আসা অবাঞ্ছিত নাও মনে হতে পারে।

মোট কথা, সব শুনে আমার মনে হল যে জয়ন্ত (এবং অবিনাশ)—এর হত্যাকাণ্ডে সকল খুঁটিনাটির সন্তাোষজনক ব্যাখ্যা এখন পাওয়া যায়নি।

এ—চিন্তা আমার কাছে অসহ্য। যে মানুষটা একটা নয়, দু—দুটো হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো—না—কোনভাবে দায়ী, সে কিনা শেষ পর্যন্ত আইনকে কলা দেখাবে? হতে দেব না। বিশেষত যখন নিহত দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন সুহৃদবর।

পরের দিন ভোরে দিল্লির দিকে উড়লুম। এখন শুধু দিন গোনা—কবে আদালত বিপ্রদাস সম্বন্ধে রায় দেয়। ইতিমধ্যে কলকাতায় উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি দুটি খুন সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে—সব আনালুম। তথ্যের জঞ্জাল বিন্যস্ত করতে দেখা গেল মধ্যখানে জ্বলজ্বল করছে মধুরার উপস্থিতি।

জয়ন্তর আমাকে লেখা সাম্প্রতিক দু—একটি চিঠিতে মধুরার প্রসঙ্গ ছিল। স্পষ্টতই ও প্রেমে পড়েছিল। মধুরার স্বামী এখনো বেঁচে এবং ওদের একটি ছেলেও আছে। মধুরা খ্যাতির শীর্ষে যবে থেকে উঠেছে, একাধিকবার স্বামী—স্ত্রীর বিবাহ—বিচ্ছেদের সম্ভাবনা কুৎসাপ্রিয় পত্রিকাগুলির পাতায় ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ যে পুরুষটিকে ঘিরে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল, তার নাম জয়ন্ত সেন।

টালিগঞ্জের উদীয়মান চিত্র—পরিচালকদের মধ্যে জয়ন্তর সম্ভাবনা সর্বস্বীকৃত হয়েছিল। গত দু—বছরে ওর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা দুই। দ্বিতীয় ছবিটির কাহিনি ছিল হলিউড—ছবি ‘বাটারফিল্ড—৮’ থেকে ধার করা। নায়িকার ভূমিকায় মধুরা তার অভিনয়—প্রতিভার আবার নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেছিল। জয়ন্তর অসমাপ্ত ছবিটির নাম ‘স্বর্গের জানালায়’। গল্প নেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ ছবি ‘রুম অ্যাট দি টপ’ থেকে। নায়িকার ভূমিকায় সেই মধুরাই।

জয়ন্ত নিজের প্রেমে বিপদের সম্ভাবনা সম্বন্ধে অনবহিত ছিল না। আমায় লেখা ওর শেষ চিঠির অংশবিশেষ—

‘আমার খালি মনে হয় যে কে বা কারা যেন আমায় আর মধুরাকে অনুসরণ করছে। শুধু মনে হওয়া নয়, ছোট করে চুল ছাঁটা এবং চোখে কালো চশমা আঁটা সেই লোকটাকে আমি অন্তত দু’দিন দেখেছি মোটর—বাইকে আমাদের গাড়ির পিছনে আসছে। তুই এসব পড়ে হাসিস নি। অবিনাশ সরকারের কথা তো তোকে লিখেছি। তার হত্যাকারীদের পুলিশ আজও ধরতে পারেনি। আমি কাপুরুষ নই। কিন্তু প্রেমের জন্য প্রাণের তোয়াক্কা করি না—এমন কথা বলতে পারব না।’

অবিনাশ সরকার।

মধ্যবয়স্ক, চোখে চশমা, স্বল্পবাক ভদ্রলোক ছিলেন। অনেক বছর ধরে মোটামুটি ভালো এবং ব্যবসায়—সফল ছবি তিনি তৈরি করেছিলেন। বছর পাঁচেক আগে ব্যয়বহুল ছবি তুলেছিলেন ‘কপালকুণ্ডলা’। প্রযোজকের টাকা উঠল না। কিন্তু ভারত সরকার ছবিটিকে একটি বিদেশি ফিল্ম—ফেস্টিভ্যালে পাঠাল। সেখানে ছবিটির নায়িকার চরিত্রাভিনেত্রী মধুরা পুরস্কার এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সুনাম কুড়োল। পরবর্তী তিন বছরে মধুরার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মোট সংখ্যা চার। তার মধ্যে একটি বোম্বাইয়ের হিন্দি ছবিকে বাদ দিলে দুটি ছবির পরিচালক অবিনাশ সরকার ও একটির জয়ন্ত সেন। অথচ তার আগের চার বছরে মধুরা ছ’জন পরিচালকের অধীনে সাতটি বাংলা ছবি তুলেছিল। মোট কথা, ইদানীং ওর পাবলিক ইমেজ বদলে দিতে এবং ওর প্রতিভা—বিকাশে স্বর্গগত পরিচালকদ্বয় কৃতিত্ব ভাগ করে নিয়েছিল।

অবিনাশ মারা গিয়েছেন প্রায় বছরখানেক হল। মধুরার সঙ্গে তাঁর তদানীন্তন ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে অল্প লোকই জানত। ডায়মন্ডহারবার রোডের উপর মধুরার একটি সুরম্য বাগানবাড়ি আছে। কলকাতা থেকে প্রায় মাইল পনেরো দূরে। সেদিন সন্ধ্যায় মধুরার গাড়িতে দুজনে গেছিল সেই বাড়িতে। বাগানের অন্যতম আকর্ষণ মার্বেল পাথরে তৈরি একটি বিশ্রামস্থল। মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু মাটির একটি ভিত্তির উপর এটি নির্মিত। কিন্তু বাগানের পিছন দিকে বলে রাস্তা থেকে গাছপালার আড়ালে শুধু গোলাকৃতি শুভ্র উপরিভাগটি চোখে পড়ে।

বাগানের দারোয়ান সাক্ষ্য দিয়েছে যে সে—সময় মাঝে মাঝেই দুজনে সন্ধ্যাটা ওই কুঞ্জে কাটাচ্ছিল। সন্ধ্যা মানে রাত আটটা—সাড়ে আটটার বেশি নয়। সেদিন যখন রাত দশটা বাজতে চলল তবু দুজনে ফিরে গেল না, তখন ওর আশঙ্কা হয় যে কোথাও হয়তো একটা গণ্ডগোল হয়েছে। খোঁজ করতে সামান্য এগিয়েই ও মধুরার আর্তস্বর শুনতে পায়।

মধুরার সাক্ষ্য শোনা যাক। ওরা নিশ্চিন্তে সন্ধ্যা কাটাচ্ছিল। পরবর্তী ছবির চিত্রনাট্য নিয়ে নাকি আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় কালো চশমা আঁটা তিনজন দুর্বৃত্তের আবির্ভাব। দুজনেরই মুখ চেপে ধরা হয়েছিল। কিন্তু মধুরা বেশি ছটফট করছিল বলে প্রথমে একজন ওর ডান হাতটি মুচড়ে দেয়। ওদের আসল রাগ ছিল অবিনাশের উপর। একটি রুলের দ্বারা তাঁকে প্রহার আরম্ভ হয়। এই দেখে মধুরা দ্বিতীয়বার ছটফট করাতে ওর মুখে রুমাল বেঁধে লাথি মেরে ওকে গড়িয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর ও জ্ঞান হারায়। যত না আঘাতে, তার চেয়ে বেশি অপমান ও ভয়ে। জ্ঞান ফিরে আসার পর ও যখন আর্তস্বর গলা থেকে বার করছিল, তখন সেই স্বর দারোয়ান শুনেছিল।

গুন্ডাগুলো যাবার আগে অবিনাশকে শেষ করে গিয়েছিল। মধুরার মাথায় বাঁধার সিল্কের বড় নীল রুমালটি দিয়ে গলায় ফাঁস পরিয়ে।

কাগজে খবরটি ওঠার পর সকলেই বুঝেছিল গুন্ডার দলটি কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে আক্রমণ করেনি। তাদের ভাড়া করা হয়েছিল। কে ভাড়া করেছিল সে—বিষয়েও যারা খবরাখবর রাখে তাদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

মধুরাও পুলিশকে জানিয়েছিল যে গুন্ডাগুলো অবিনাশকে মারধোর শুরু করার সময়ে তাদের ইতর ভাষা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে অবিনাশকে তার বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার দুর্মতির জন্যই শিক্ষা পেতে হচ্ছে।

গুন্ডাদের নিয়োগকারী হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করার মতো কোনো প্রমাণ পুলিশ কিছুতেই জোগাড় করে উঠতে পারেনি।

পুলিশের হাঙ্গামা মিটতেই মধুরা প্রায় চার—পাঁচ মাসের জন্য অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। ওর ছেলে ইংলন্ডের একটি স্কুলে পড়ছে। কেউ কেউ বলত যে মধুরা ওই ক’ মাস ইংলন্ডে ছেলের কাছাকাছি ছিল। আরেক দলের মতে সে আমেরিকায় গিয়ে বিউটি—ট্রিটমেন্ট করাচ্ছিল। সে যাই হোক।

এই কয়েক মাস আগে সে কলকাতায় আবার উদিতা হয়েছিল। স্বামী চিরঞ্জীব মৈত্রকে নিউ আলিপুরের বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে উঠে গেল টালিগঞ্জে নতুন বাড়ি কিনে। জয়ন্তর চিত্রনাট্য পছন্দ হওয়ায় নামমাত্র দক্ষিণায় (মাত্র পঁচাশি হাজার) সে তাতে কাজ করে। দু—মাসে ছবি শেষ। ছবি যখন মুক্তি পেল, চোখ—ঝলসানো রূপ ও অভিনয়—প্রতিভায় আবার কাগজে কাগজে তার জয়জয়কার। এলিজাবেথ টেলরের সঙ্গে অনুকূল তুলনা।

বিপ্রদাস বসু।

বছর পাঁচেক আগে ওর আর মাধুরার জুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। পাঁচ—ছটা ছবিতে ওদের সম্মিলিত অবতরণ ঘটেছিল। মধুরারও ওকে পছন্দ ছিল, কারণ ললিত ও কায়দাদুরস্ত বিপ্রদাসের পাশে ওর ডায়নামিক অভিনয় খুলত।

কিন্তু জনসাধারণকে আর কতদিন বোকা বানানো যায়! ‘কপালকুণ্ডলা’ বিখ্যাত জুটির শেষ ছবি। নবকুমার ভাবলেশহীন মুখে শূন্য সৈকতে ঘুরছে, ঘুষি পাকিয়ে মতিবিবির সামনে চিৎকার করছে ‘যবনীজার হতে পারব না’ এবং শেষাংশে কাপালিকের দেওয়া কারণবারি পান করে মাতলামো ও তারপর কপালকুণ্ডলার সামনে নীলডাউন হয়ে কাঁদো—কাঁদো স্বরে প্রেম নিবেদন—এসব জিনিস অসহ্য!

মধুরার সঙ্গে জুটি ভেঙে যাবার পর অন্য নায়িকার বিপরীতে ও যে দুটি ছবি করল, দুটোই টিকিট—ঘরে মার খেল। সত্য বলতে কি বিপ্রদাসের নট—জীবন শেষ হয়ে গেছে। এ—পতনের জন্য জয়ন্তকে দায়ী করা চলে না। কিন্তু পুলিশ বলতে চায়, মধুরাকে কেন্দ্র করে তার ভূতপূর্ব ও পরবর্তী প্রণয়ীর মধ্যে বিদ্বেষের পরিণাম এই খুন।

বলা বাহুল্য, হত্যা পূর্ব—কল্পিত নয়। বিপ্রদাস এমনিতে কাপুরুষ, যদিও সুরার প্রভাবে তার মুখে রৌদ্ররসের বাণী ফোটে। হত্যার রাত্রে নিহত ব্যক্তি এবং হত্যাকারী—দুজনেরই পেটে সুরা পড়েছিল।

হত্যার স্থল পার্ক স্ট্রিটের ‘জ্যোতি’। কাল প্রায় মধ্যরাত্রি। হোটেলটির দুটি অংশ। একটি অংশে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার রয়েছে। দ্বিতীয় অংশ এক্সক্লুসিভ প্রায় একটি ক্লাব।

ঘটনার রাত্রে ওখানকার প্রোগ্রামে একটি শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীর গান ছিল। উজ্জ্বল আলোক—বৃত্তে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে সে মোলায়েম স্বরে গাইছিল। অতিথিরা বসেছিল ছড়িয়ে—ছিটিয়ে। মৃদু ও মায়াময় আলোকে মদের গ্লাস সামনে নিয়ে সঙ্গিনীর সঙ্গে গদগদ বচনে কথা কইছিল। মধুরা ও জয়ন্ত বসেছিল এক প্রান্তে। আসন গ্রহণের একটু পরেই জয়ন্ত উঠে গিয়েছিল অদূরে একটি কাউন্টারে। সেখানে থরে থরে নানা পানীয় সাজানো। দেবার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে নেই। নিজে পছন্দমতো ঢেলে নিতে হবে।

দুটো গ্লাস ভর্তি করে পানীয় নিয়ে জয়ন্ত যখন ফিরল, তখন ওর চেয়ারটি অধিকার করে বিপ্রদাস বসে। মধুরার দিকে ঝুঁকে এবং ওর কাঁধে হাত রেখে সে কথা বলছিল। কোনো মাড়োয়ারি প্রযোজক নাকি বিপ্রদাসকে সুযোগ দিতে রাজি। শুধু একটি শর্তে— মধুরাকে নায়িকার ভূমিকায় নামতে রাজি করাতে হবে। তাই বিপ্রদাস মধুরাকে ধরে পড়েছে।

মধুরা এককথায় প্রস্তাব নাকচ করে দিল। তারপর বোঝাল যে বিপ্রদাসের এত গরজ থাকলে সে একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে বাড়িতে আসুক। বিপ্রদাস কিন্তু ওঠবার কোনো লক্ষণ দেখাল না।

জয়ন্ত ওর হাতের গ্লাস দুটো টেবিলে ঠক করে নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়েই ছিল। তৃতীয় চেয়ার ছিল না। ও আসতেই মধুরা বিপ্রদাসকে বলেছিল, ‘জয়ন্ত সেন, চেনো বোধ হয়।’

দুজনের আলাপ ছিল না। কিন্তু বিপ্রদাস ওর উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিল।

জয়ন্ত অবশেষে বলল, ‘মধুরা, এ—ভদ্রলোক কি তোমার অনুমতি নিয়ে এখানে বসেছেন?’

মধুরা শঙ্কিত, বিপন্ন দৃষ্টিতে দুজনের দিকেই তাকাল।

জয়ন্ত আদেশের সুরে বলল, ‘I say, please, get up.’

বিপ্রদাস বলল, ‘মধুরা, এ—লোকটাকে বলে দাও, ইনি যখন খোকা ছিলেন তখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক।’

উচ্চারণ ও মুখভঙ্গিতে ‘সম্পর্ক’ শব্দটির ওপর গভীরতর অর্থ আরোপিত হল। মুহূর্তে প্রলয় ঘটে গেল।

জয়ন্ত বিপ্রদাসের কলার চেপে ধরে ওকে দাঁড় করাল। সঙ্গে সঙ্গে ওর পেটের ওপর পড়ল এক ভারী মুঠির ঘুঁষি। সামলে নিয়ে জয়ন্ত বিপ্রদাসের ডান হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘আসুন।’

মদের কাউন্টারটির একটু কোনাকুনি রয়েছে টয়লেট। একটি সঙ্কীর্ণ প্যাসেজ টয়লেটটির দরজার পাশ দিয়ে পিছন দিকে এগিয়েছে, যার শেষপ্রান্তে হোটেল—হল থেকে বেরুবার একটি বিকল্প রাস্তা। জয়ন্ত বিপ্রদাসকে সেই সঙ্কীর্ণ প্যাসেজের প্রায়ান্ধকার অংশে টেনে নিয়ে গেল।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মধুরা বসেছিল। এদিকে যে এমন ব্যাপার ঘটছে উপস্থিত অন্য অতিথিদের মধ্যে কারো সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। শুধু একজন ছাড়া। হঠাৎ মধুরা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। সম্ভবত যুদ্ধরত দুজন মানুষের কাছে দৌড়ে যেত। কিন্তু হাই হিল জুতো পায়ে লাফানোটা কায়দামতন হয়নি, সশব্দে পড়ল।

সেখান থেকেই চিৎকার করল, ‘সেন, ফিরে এসো।’

এই চিৎকারে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। কয়েকজন ওর কাছে দৌড়ে এল। ইতিমধ্যে অন্ধকার কোণ থেকে বিপ্রদাসের কাতরানি শোনা গেছে। কয়েকজন কাউন্টারের পাশ দিয়ে ঘুরে সেদিকে গেল ব্যাপার কি দেখতে। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। অকস্মাৎ জাগল এক তীক্ষ্ন আর্তচিৎকার। মৃত্যু—যন্ত্রণায়ই মানুষ এমন চিৎকার করে। চিৎকার বেরিয়েছে জয়ন্তেরই গলা থেকে।

গিয়ে দেখা গেল দুজনেই লুটোচ্ছে। বিপ্রদাসের নাক—মুখ থেকে রক্ত বেরিয়েছে, প্রহারে প্রহারে সে প্রায় অচেতন। জয়ন্তের গলা তীক্ষ্ন অস্ত্রে ফাঁক করে দেওয়া হয়েছে। গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। মধুরা এসে নিজের আঁচলে জায়গাটা চেপে ধরেছিল। আঁচল রক্তে ভিজে গেল। তারপর কয়েক মুহূর্ত ছটফট করে জয়ন্তের দেহটা স্থির হয়ে গেল। মধুরার সে কী ডুকরে কান্না!

যে তীক্ষ্ন অস্ত্রে হত্যা করা হয়েছিল, সেটি সেখানেই পড়েছিল। ক্ষুদ্রাকৃতি এবং মূল্যবান একটি ছুরিকা। বিদেশি জিনিস। বিপ্রদাস খুনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে যে, ও—ছুরি সে পূর্বে কখনো দেখেনি।

মধুরার স্বামী চিরঞ্জীব মৈত্র।

পুলিশ এবং জনসাধারণের একটা বড় অংশ ভেবেছিল অবিনাশ—হত্যাকাণ্ডে এঁরই হাত আছে। এখনও অনেকের বিশ্বাস যে, অন্তরালে থেকে ইনিই বিপ্রদাসকে জয়ন্তের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেছিলেন। কিন্তু প্রমাণাভাব।

এখন ভদ্রলোকের মাথাজোড়া টাক, সারা শরীরে চর্বি। কানা বলে সর্বদা কালো চশমা পরেন। কিন্তু একসময়ে সুপুরুষ ছিলেন এবং মধুরার সঙ্গে ওঁর বিয়ে প্রেমজ। মধুরা সাধারণ পরিবারের মেয়ে। আসামে করিমগঞ্জ কলেজে পড়ছিল এবং সঙ্গীত ও অভিনয়ে পটীয়সী ছিল।

বিয়ের সময়ে চিরঞ্জীব কলকাতা, দেরাদুন ও পুরীতে তিনটি ভালো হোটেলের মালিক ছিলেন। নতুন বৌকে নিয়ে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, অল্পদিন পরে দেখা গেল দেরাদুন ও পুরীর হোটেলের ব্যবসাতে অবস্থা শোচনীয়। চিরঞ্জীব হতোদ্যম হলেন না। কিন্তু পরিষ্কার ছিল যে হোটেল দুটিকে হাতছাড়া না করার একমাত্র বিকল্প প্রচুর টাকা ধার করে দেনা মেটানো।

মধুরা বলল, ‘টাকা ধার করো। শোধ দেবার উপায় পরে ভাবলেও চলবে।’

এই উপায় কী হতে পারে সে—বিষয়েও প্রস্তাব এল ওরই তরফ থেকে। বলল, ‘সিনেমায় নামব।’

আজ থেকে দশ বছর আগে কৃষ্ণলীলা—বিষয়ক একটি ছবিতে রাধার ভূমিকায় ওর প্রথম চিত্রাবতরণ। ছবিটি তুচ্ছ, মধুরার অভিনয়ও উচ্চাঙ্গের হয়নি। কিন্তু ওর ঢলঢল মুখখানি দর্শকদের হৃদয় কাড়ল। সেই প্রথম ছবি থেকে ওর যে—জয়যাত্রা শুরু হল, আজও তার শেষ নেই।

চিবঞ্জীব ভাবেননি যে তাঁর স্ত্রী এত যশ, এত অর্থ পাবে। শান্ত মেয়েটির এত মেজাজ ও খেয়াল দেখে তিনি অবাক। গত কয়েক বছর ধরে মধুরার ওপর তাঁর বিন্দুমাত্র শাসন নেই। সত্য কথা প্রথম প্রথম তিনিই মধুরার হয়ে কন্ট্রোক্টে সই করতেন এবং করতেন চিত্রনাট্য না পড়েই। তাতে কি এসে যায়। অনভিজ্ঞা হেডি ল্যামারকে পরিচালকের নির্দেশে সম্পূর্ণ নিরাবরণ দেহে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। মধুরাকে পরিচালকের নির্দেশে এক ঘনঘন চোখের জল ফেলার ব্যাপারে ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে কিছু বাড়াবাড়ি করতে হয়েছে? হিন্দি ছবিতে নামার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল সম্পূর্ণ তার একার দায়িত্বে।

মোটকথা, বর্তমানে দুজনের দুজনের সম্বন্ধে অভিযোগ আছে। দুজনেই হয়তো অসুখী এবং সুখের অন্বেষণে দুজনেই আদিরসাত্মক ক্রিয়াকলাপ ছাড়াও শোনা যায়, কখনো কখনো যা করে তা বীভৎসরসাত্মক। স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে কার পদস্খলন আগে ঘটেছে এবং কার ক্ষেত্রেই বা সে—পদস্খলন ভীষণতর তা বাইরের লোক জানে না।

একবার বিষম ঝগড়ার পর চিরঞ্জীব মোটরে মধুরাকে তুলে নিয়ে ঘণ্টায় আশি মাইল গতিতে গাড়ি চালিয়েছিলেন। ওঁরা তখন মহারাষ্ট্রে ছিলেন। মতলব ছিল গাড়িসুদ্ধ পাহাড়ের ওপর থেকে আড়াই হাজার ফিট নীচে লাফাবেন। কিন্তু পাহাড়ের কিনারায় পৌঁছোবার আগেই গাড়ি উল্টোল। মধুরা সামান্য চোট পেল এবং চিরঞ্জীব বাম চোখটি হারালেন।

জয়ন্তের মৃত্যুর পর খবর বেরুল যে, স্বামী—স্ত্রীর বিবাহ—বিচ্ছেদ সম্পর্কে দুই পক্ষের উকিলেরা ইতিমধ্যেই একটি বোঝাপড়া শেষ করেছিলেন।

আইনের বিচারে বিপ্রদাস শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস পেল। এই বিপর্যয় যে ঘটবে প্রথম থেকেই তার আভাস মিলছিল।

পুলিশ অধিকতর তদন্ত—সাপেক্ষে মামলা স্থগিত রাখার জন্য বারংবার প্রার্থনা করেছিল। সম্ভবত, অবিনাশ সরকারের হত্যাকাণ্ডে ওর দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছিল। সে—চেষ্টা ব্যর্থ হল।

হত্যা পূর্বপরিকল্পিত ছিল—এ—বক্তব্যের ধোপে টেঁকা অসম্ভব ছিল। জয়ন্তই প্রথমে বিপ্রদাসের গায়ে হাত দেয় এবং ঘুষি খাবার পর সেই বিপ্রদাসকে মারামারির জন্য টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

দুজনের মধ্যে জয়ন্তই ছিল অধিকতর বলশালী ও ক্ষিপ্র। ওর প্রহারে প্রহারে বিপ্রদাস যখন প্রায় অচেতন, তখনই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। জয়ন্তও বেশ মার খেয়েছিল এবং স্থানটি ছিল প্রায়ান্ধকার। তথাপি প্রায় অচেতন বিপ্রদাস কী করে ওকে হঠাৎ কায়দা করে গলায় ছুরি বসিয়েছিল, তার ব্যাখ্যাতে পুলিশপক্ষকে যথেষ্ট কল্পনাশক্তির পরিচয় দিতে হয়েছিল। তারা বলেছিল, মার খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পর বিপ্রদাস অচেতনতার ভান করে, তখন জয়ন্ত ওকে দেখতে ঝুঁকেছিল এবং সেই সুযোগে বিপ্রদাস অবশিষ্ট শক্তি সংগ্রহ করে ওর গলায় ছুরি বসিয়েছিল।

হত্যার অস্ত্রটিও পুলিশের পক্ষে যথেষ্ট শিরঃপীড়ার কারণ ঘটিয়েছিল। তাতে বিপ্রদাস, বা অন্য কারো যে হাতের ছাপ ছিল সে—কথাও পুলিশ প্রমাণ করতে পারেনি।

আদালতে ফতুর বিপ্রদাসকে সমর্থন করল দুজন উকিল—অনিমেষ পালিত ও নন্দিতা গুপ্তা। প্রথমজনের অভিজ্ঞতা অল্প, স্বভাবে ধৈর্য নেই। কিন্তু ওরিজিন্যাল ব্রেন। তরুণ আই. এ. এস. অফিসার ছিল। হঠাৎ কাগজে বেরিয়েছিল যে, ওর নামে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। ঘুষ নিয়েছে বলে নালিশ। তদন্তে কিছুই প্রমাণ হল না, কিন্তু অনিমেষ সরকারি চাকরি ছেড়ে কাঁধে উকিলের শামলা ফেলে কোর্টে যাতায়াত আরম্ভ করল।

ওরই কৃতিত্বে বিপ্রদাসের বিচার আরও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। যে—জায়গায় জয়ন্ত ও বিপ্রদাস হিংস্র মারামারিতে মেতেছিল, সেই কোণে চাপ চাপ অন্ধকার দিয়ে গড়া একটি মনুষ্যমূর্তির অস্তিত্ব ও প্রমাণ করল। যাদুকর যেমন শূন্যে টুপির মধ্যে হাত পুরে কবুতর বার করে, সেই ঢঙের ব্যাপার আর কি। ওর প্রমাণিত তথ্য ও ওর করা জেরার কিছু অংশ উদ্ধৃত করি। যে আত্মবিশ্বাস ও শোম্যানশিপ—এর সঙ্গে ও সব জিনিসটা হাজির করেছিল, তা কল্পনা করে নিতে হবে।

জয়ন্তের হাতে প্রহৃত হবার পর বিপ্রদাসের ইন্দ্রিয়গুলি খুব সজাগ ছিল না, এবং সেকথা সে নিজেও মানল। তথাপি, অনিমেষের এই সাজেশন যে জয়ন্ত এক তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা নিহত হয়েছিল তাকে সে সম্ভব বলে স্বীকার করেছে। সে অন্ধকারে তৃতীয় একজনের ক্ষণিক আবির্ভাব যেন মনে করতে পারে এবং মৃত্যু—চিৎকারের আগেই যে ভয়ার্ত ও বিস্মিত কণ্ঠে ‘কে, কে’ বলে উঠেছিল, সে—কথা তার স্পষ্ট মনে আছে।

অনিমেষ সাক্ষ্য দিতে জ্যোতির একজন পরিচারক কৃপাল সিংকে ডেকেছিল। মারামারি হয়েছিল যে জায়গায়, তার অদূরবর্তী খিড়কিপথে বেরুবার দরজাটা সর্বদাই বন্ধ থাকে। ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগে এবং হোটেলের অন্য সব দরজায় যখন রাত্রের জন্য তালা দেওয়া হয়, তখন ওতেও তালা লাগে। কৃপাল জানাল যে হত্যাকাণ্ডের পর যখন হল অতিথিশূন্য হল এবং চাবির গোছা নিয়ে দরজায় দরজায় তালা দিচ্ছে, তখন উক্ত খিড়কির দরজাটিকে সে ছিটকিনি খোলা অবস্থায় দেখেছিল।

অনিমেষের জেরা : ‘দরজাটি কার পক্ষে খোলা সম্ভব ছিল?’

‘বলা মুশকিল। ওটা এমারজেন্সি একজিট, ও—পথে যেই বেরিয়ে থাকুক, তার পালাবার বিশেষ তাড়া ছিল এবং সকলের অলক্ষে পালানো সে ম্যানেজ করেছিল।’

‘জয়ন্তবাবুর আর্ত চিৎকারের পর দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলে, তাই না?’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ।’

‘কিন্তু তোমার আগেই কেউ কেউ মৃতদেহের সামনে হাজির হয়েছিল। ঠিক কিনা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, দুজন ভদ্রলোক—তাঁদের আমি মুখ চিনি, আমার আগেই পৌঁছেছিলেন।’

‘তাঁরা কেউ খিড়কিপথে পালাননি?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তুমি পৌঁছোবার পর ও—পথে কেউ বেরোয়নি?’

‘আজ্ঞে না। তাহলে আমি দেখতে পেতুম। তারপর একটু বাদেই তো পুলিশ এসে একে একে নাম—ঠিকানা নিয়ে হলের সব লোককে বার করে দিয়েছিল।’

‘জয়ন্তবাবু চিৎকার করার আগে কারো মনোযোগ ওদিকে যায়নি। ধরা যাক, অন্ধকার প্যাসেজে আগে থেকেই কেউ লুকিয়ে বসেছিল। কিংবা দুজনে যখন মারামারি শুরু করেছিল, তখন কেউ উঁচু টানা কাউন্টারটির পাশ ঘুরে দ্রুত ওদের দিকে গিয়েছিল এবং জয়ন্তবাবুকে হত্যা করে খিড়কির দরজা খুলে পালিয়েছিল। এমন সম্ভব কি না? আমার প্রশ্ন বুঝতে পেরেছে।’

‘আজ্ঞে, পেরেছি।’ কৃপাল একটু ভাবল; শেষে বলল, ‘আজ্ঞে। আপনি যা বললেন তা নিশ্চয়ই সম্ভব।’

‘ব্যস।’

অতঃপর অনিমেষ হলটির নকশা, ফার্নিচার, লাইট—অ্যারেঞ্জমেন্ট ইত্যাদির বর্ণনা দিয়ে আদালতকে বোঝাল যে কৃপাল কেন তার সাজেশনটিকে সম্ভব বলে মনে করল।

পুলিশ কনস্টেবল তুষার ভদ্র। ছোকরাটি আসামি পক্ষের আর এক সাক্ষী।

হত্যাকাণ্ডের রাত্রে সময় তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। পার্ক স্ট্রিটে ও ডিউটি দিচ্ছিল। জ্যোতির খিড়কিদোর যে—গলিতে খুলে যায়, সেই গলিরই মুখে ও তখন দাঁড়িয়ে এক পরিচিত ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা কইছিল। গলি থেকে বেরিয়ে একটি লোক এসে ট্যাক্সিতে উঠেছিল। তার তাড়া ছিল এবং তুষারকে একটু ঠেলে সরিয়েই পিছনের সিটে আশ্রয় নিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিয়েছিল, ‘স্ট্র্যান্ড রোড চলো।’

ঠেলা খেয়ে তুষার রুষ্ট হয়েছিল। ট্যাক্সির প্রস্থানের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যখন হত্যাকাণ্ড নিয়ে হৈচৈ শুরু হল, তখন লোকটির কথা স্বভাবতই মনে পড়েছিল। কিন্তু বিপ্রদাসকে ঘটনাস্থলেই গ্রেপ্তার করার পর ব্যাপারটা নিয়ে আর পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।

তুষার পূর্বেও দু—একদিন লোকটিকে দেখেছিল। ওই একই গলি থেকে বেরোতে। অনিমেষ পালিত প্রসঙ্গত আদালতকে জানাল যে জ্যোতির বেয়ারারা, তুষার এবং উক্ত ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও রহস্যময় লোকটির প্রকৃত নাম—ঠিকানা উদ্ধার করা যায়নি। হোটেলের রিজার্ভেশন—রেজিস্ট্রারে একটি নাম অর্জুন আগরওয়ালা ও একটি বাজে ঠিকানা অবশ্য সে লিখিয়েছিল।

জ্যোতিতে সে বসত একটি অন্ধকার কোণ বেছে নিয়ে একলা। তুষার তাকে একেবারে মুখোমুখি কোনোদিন দেখেনি এবং ট্যাক্সিচালক তাকে স্ট্র্যান্ড রোডের উপর একটি তিন রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর জ্যোতির চৌকাঠ আর সে কোনোদিন মাড়ায়নি।

লোকটি সামান্য যে দু—একটা কথা বলত তা হিন্দিতে। কণ্ঠস্বর রূঢ়। অবশ্য চোখ নামিয়ে কথা বলা তার অভ্যাস ছিল। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত, পান খেয়ে কথা বলা তার একটা অভ্যাস ছিল। মাঝারি দৈর্ঘ, শ্যামবর্ণ। একটু ঢিলেতালা মাপের ভারী কোটে তাকে বলিষ্ঠই মনে হত। কোঁকড়া কালো চুল, লম্বা জুলফি ও চাপ দাড়ি ছিল।

অনিমেষ এখানেই থামেনি। ডায়াগ্রাম এঁকে, হোটেল—বেয়ারাদের সাক্ষ্য নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল অর্জুন আগরওয়ালার পক্ষে কিছুই অসম্ভব ছিল না বিপ্রদাস—জয়ন্তর মারামারির সময়ে অন্যের অলক্ষে উঠে এসে জয়ন্তকে খুন করা এবং তারপর খিড়কিপথে সরে পড়া। খুনির মোটিভ নিয়ে অবশ্য অনিমেষ কিছু আলোকপাত করতে পারেনি।

দিল্লিতে বসে বসে এই পর্যন্ত সব তথ্য আমি জোগাড় করলুম। অতঃপর কিছু চিন্তা করা গেল। এই সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলুম যে জয়ন্তর এবং হয়তো অবিনাশেরও হত্যাকারীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। রহস্য এমন কিছু ঘোরালো মনে হয়নি আমার কাছে। ‘অপরাধী কে’ সে সমস্যা নয়, অপরাধের প্রমাণ জোগাড়ই মনে হচ্ছিল আসল সমস্যা। অর্জুনই যদি প্রকৃতই অপরাধী হয় তো তার পরিচয় কি? কী তার মোটিভ? মধুরার ব্যক্তিগত জীবনে হয়তো এ সকল প্রশ্নের উত্তর রয়েছে, কিন্তু পুলিশের পক্ষে সোজা পথে মধুরার পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়াই মুশকিল। অন্য দিকে, আমি যদি কাজে নামি, আমার পক্ষে পুলিশের সাহায্য না নিলে চলবে না।

আমার একটা সুবিধা, আমি গোয়েন্দা—দপ্তরেরই লোক। যাই হোক, এক শনিবার বিকেলে আমি কলকাতার দিকে উড়লুম। জয়ন্তর খুনের তদন্ত করেছিলেন রঞ্জিত শিকদার। দিল্লিতে বসেই আমি ব্যবস্থা করেছিলুম যাতে তিনি তাঁর সাধ্যের সীমার মধ্যে আমায় সর্বপ্রকারে সাহায্য করেন।

আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার আগে ওঁকে জয়ন্ত ও আমার বন্ধুত্বের ইতিহাস সব বললুম। রঞ্জিতবাবু শুধু বুদ্ধিমান নন, সহৃদয়ও বটে। উনি সব বুঝলেন। অতঃপর কাজের কথায় আমাদের অত্যন্ত খোলাখুলি আলোচনা হল।

আমার প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল অর্জুনকে নিয়ে। পুলিশ কি সত্যই তাকে জয়ন্তর হত্যাকারী বলে বিশ্বাস করেছে? রঞ্জিতবাবু সম্মতিতে শির হেলালেন।

তার পরিচয়—প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে পুলিশ কতদূর এগিয়েছে? এগোতে পারেনি। সে যেন হাওয়ায় উবে গেছে। তবে এটুকু বুঝতে কারো বাকি নেই যে অর্জুনের বাইরের চেহারা ছদ্মবেশমাত্র। পুলিশ, বলা বাহুল্য, চিরঞ্জীবকে সন্দেহ করেছিল। চোখ কানা হলেও (সে—চোখটিতে তিনি কাচের চোখ ব্যবহার করেন) ওই রকম ছদ্মবেশ ধারণ তাঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। অসম্ভব—যারা অর্জুনকে দেখেছে, তাদের পক্ষে আদালতে হলফ করে বলা যে চিরঞ্জীব ও অর্জুন একই ব্যক্তি।

চিরঞ্জীবের নির্দিষ্ট সময়কার অ্যালিবিও তর্কাতীত নয়। তিনি নাকি বাড়িতেই ছিলেন এবং দরকার হলে সাক্ষী হাজির করবেন। সন্ধ্যার পর তাঁর মহলে তিনি দু—একজন অন্তরঙ্গ নিয়ে একটু ফুর্তি করেন। সাক্ষীরও অভাব হয় না। যাই হোক, মৈত্র মহাশয়ের অ্যালিবিকে যাচাই করতে যাওয়া মানে পণ্ডশ্রম জেনে পুলিশ সে—চেষ্টাই করেনি।

অবিনাশ সরকারকে হত্যার দিন অবশ্য চিরঞ্জীবের অ্যালিবি ছিদ্রহীন। এ তো জানা কথাই যে ওঁকে যারা আক্রমণ করেছিল, তারা ভাড়াটে গুন্ডা। সেই প্রথম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অর্জুন আগরওয়ালার কোনোরকম যোগাযোগের সূত্র পুলিশ আবিষ্কার করতে পারেনি।

‘সে—যোগাযোগের সূত্র আমরা আবিষ্কার করব,’ আমি বললুম, ‘যদি দেখি যে অবিনাশবাবু ও জয়ন্তকে হত্যার পিছনে একই ধরনের মেথড ক্রিয়াশীল।’

‘কিন্তু কী করে তা দেখা সম্ভব!’ রঞ্জিতবাবু নিজের সন্দেহ ব্যক্ত করলেন, ‘অবিনাশবাবুকে খুন করেছিল ভাড়াটে গুন্ডারা। দ্বিতীয়ত সে—খুন পূর্ব—পরিকল্পিত। হোটেলে জয়ন্ত ও বিপ্রদাসের মারামারি কি পূর্ব—পরিকল্পিত ছিল?’

‘না।’

‘যদি বলতেন ‘হ্যাঁ’, তাহলেও না হয় বুঝতুম যে গুন্ডাদের যে লাগিয়েছিল, সেই ব্যক্তিই ধরা যাক অর্জুন আগরওয়ালা, প্রথমে বিপ্রদাসকে সামনে ঠেলে দিয়ে পরে নিজে এসে হত্যাকাণ্ডটি সমাধা করেছিল। তা যখন….’

‘আমি এখন ব্যাখ্যা করতে চাইছি না। ধীরে ধীরে এগোনো ভালো। প্রথমে যে পয়েন্টটি সম্বন্ধে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, তা এই যে গুন্ডারা অবিনাশ সরকারকে হত্যা করেনি।’

‘কী বলছেন আপনি!’

‘হ্যাঁ, এবং সেই গুন্ডাদের মুখ থেকেই সত্য কথা শুনব।’

এবার রঞ্জিতবাবু রাগ করলেন।

‘আপনি নিশ্চয়ই খবর রাখেন যে তাদের ধরবার জন্যে পুলিশ কোনো চেষ্টারই কসুর রাখেনি।’

‘আর একবার চেষ্টা করুন। মোটরবাইকে ঘোরে, ছোট করে চুল ছাঁটা এবং চোখে কালো চশমা আঁটা একটি লোককে আমাদের ধরতে হবে। চিরঞ্জীব মৈত্রের ওপর নজর রাখলেই সম্ভবত তাকে ধরা যাবে।’

বিস্ময়ে রঞ্জিতবাবুর মুখে প্রথমটায় কথা সরল না। শেষে সংক্ষেপে বললেন, ‘বেশ।’

তিনি কথা নয়, কাজ বোঝেন। তাই জানতে চাইলেন না আমি গুন্ডার বর্ণনা পেলুম কোথা থেকে।

ওঁর সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলুম। সোমবার ভোরে দমদম থেকে বিমানে দিল্লি ফিরে গেলুম।

দিন গুনে গুনে দশ দিন কাটল। একাদশতম দিনে রঞ্জিতবাবুর জরুরি তার পেলুম। ‘শীঘ্র আসুন।’ এলুম।

রঞ্জিতবাবুর সঙ্গে দেখা হতে যখন করমর্দনের জন্য ওঁর দিকে হাত বাড়ালুম, উনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘মশায়, সব খুলে বলুন। আপনি কি ম্যাজিক জানেন?’

জয়ন্তর চিঠিতে আমি বর্ণনা পেয়েছিলুম, সেকথা কবুল করলুম।

লোকটির নাম বাদল গুপ্ত। পেশাদার গুন্ডা নয়। মূর্খ ও চরিত্রহীন। শরীরে শক্তি ধরলেও অন্তরে কাপুরুষ। বিশেষত ভয় পাচ্ছিল যে খুনের মামলায় পাছে আসামি হতে হয়। তারপর গুঁতোর চোটে সব কথা স্বীকার করেছে। ওর বাকি দুজন সঙ্গীকেও ওর সাহায্যে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। পৃথক পৃথক গৃহীত তিনজনের স্বীকারোক্তিই খুঁটিনাটিতে পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে।

‘কিন্তু বুঝলেন, মশায়,’ রঞ্জিতবাবু আমায় বলছিলেন, ‘অদ্ভুত আপনার অনুমান। শয়তানগুলো বারবার বলছে যে অবিনাশকে ওরা হত্যা করেনি। ওরা বলে যে চিরঞ্জীব ওদের লাগিয়েছিলেন একদিন সুবিধা মতো অবিনাশকে উত্তম—মধ্যম দেওয়ার জন্যে।’

‘ঠিকই বলে।’

‘ওরা তাহলে সত্যই অবিনাশকে খুন করেনি?’

‘না। ঠিক যেমন বিপ্রদাসও জয়ন্তকে খুন করেনি। খুনি উভয় ক্ষেত্রেই সুযোগ বুঝে পরে আবির্ভূত হয়ে কাজ হাসিল করেছে। এমন ভাবে করেছে যাতে সন্দেহটা সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর পড়ে। জয়ন্তর হত্যার পর অবশ্য তার জারিজুরি কিছু ধরা পড়েছে। পুলিশ তার জন্য অনিমেষ পালিতের কাছে ঋণী হবে।’

‘কী সাংঘাতিক! মারামারির জন্যে লোক লাগিয়ে শেষে নিজে এসে খুন করা। আমি ইতস্তত করছিলুম এইবার চিরঞ্জীব মৈত্রকে গ্রেপ্তার করব কিনা। এখন বুঝছি যে এমন লোককে তো আর এক মুহূর্তও জেলখানার বাইরে ছেড়ে রাখা নিরাপদ নয়।’

‘তা হয়তো নয়। কিন্তু ওঁকে এখনই গ্রেপ্তার করতে দৌড়োবেন না। উনিই যদি সত্যি খুনি হন তো আদালতে ওঁর বিরুদ্ধে কি প্রমাণ করা যাবে? উনি অবিনাশের বেলায় ষড়যন্ত্র করেছিলেন এই মাত্র, বিপ্রদাসের বেলায় সেটুকুও প্রমাণ করা যাবে না।’

রঞ্জিতবাবু বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন; শেষে বললেন, ‘আপনার যুক্তি মিথ্যা নয়। কিন্তু চিরঞ্জীববাবুর সম্বন্ধে আবার যদির কোয়ালিফিকেশন আছে নাকি?’

‘আছে।’

‘বেশ!’ উনি কণ্ঠস্বরে যথাসম্ভব নির্লিপ্তি আনলেন, ‘কিন্তু আমাদের অতঃপর কী করণীয়?’

‘ভাবছি। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। চিরঞ্জীব ও মধুরাকে ডেকে পাঠান। আমি আপনাকে বলব ওঁদের কী সব প্রশ্ন করতে হবে। আমি আড়ালে বসে ওঁদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করব।’

‘ডাকব। কিন্তু ওঁরা আসবেন কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। আর কিছু?’

‘অনিমেষ আর নন্দিতাকে উকিল লাগিয়েছিল কে?’

‘খবরটি গোপন রাখার চেষ্টা হয়েছিল। আমি কোনোরকমে সঠিক খবর পেয়েছি। চিরঞ্জীব মৈত্রই টাকা জুগিয়েছেন।’

চিরঞ্জীব এবং তাঁর গিন্নি দুজনের কেউই সহজে ইন্টারভিউতে আসবার পাত্র নন। ভদ্রলোককে কায়দা করা সম্ভব হল; কারণ ওঁর কুসঙ্গীরা পুলিশের খপ্পরে এবং তারা ওঁকে জড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছে। যাই হোক, সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট হল। উনি এলেন না। খবর এল যে উনি নাকি অসুস্থ। সেই সঙ্গে অনুরোধ যে ইন্সপেক্টর যদি মৈত্র মহাশয়ের বাড়ি পদধূলি দেন তো তাঁর অভ্যর্থনায় ত্রুটি হবে না। এ—প্রস্তাব গ্রহণ করলে আমার অসুবিধা। অতএব রঞ্জিতবাবু কঠোরভাবে তাড়া দিলেন।

দ্বিতীয় যে দিনটি দেওয়া হল সেদিন চিরঞ্জীববাবু এলেন। অবশ্য নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পরে। পায়ে নাগরা, পরনে পাজামা ও সিল্কের পাঞ্জাবি। মাথার চুল এলোমেলো। চেয়ারে বসবার পর হাতের কালো ছড়িটিকে কোলের উপর রেখে নাচাচ্ছিলেন। ওঁর দুই হাতই তাতে ব্যস্ত ছিল। রঞ্জিতবাবু সিগারেট অফার করেছিলেন, কিন্তু উনি জানালেন যে উনি কোনোকালে ধূমপান করেন না।

কথা শুরু করার আগে রঞ্জিতবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ওই কালো চশমায় আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ওটা যদি….’

চিরঞ্জীববাবু মুখ টিপেই একটি শব্দ করলেন, যার মানে তোমাদের শয়তানি আমি বুঝি। যাক, চশমা উনি নামালেন। আমি যেখানে বসেছিলুম, সেখান থেকে ওঁর মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। একটি চোখ কাচের, অপরটি লাল। ওঁর মুখে ভয় লেখা ছিল না, যা ছিল তা নির্বোধ একগুঁয়েমি।

রঞ্জিতবাবু ভূমিকা ফাঁদলেন, ‘আপনি এসেছেন—সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এলে খুশি হতুম। যাক, একবার যখন এসেছেন, পুলিশ আপনার কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।’

চিরঞ্জীববাবু নীরব।

‘পাব না কি?’

‘পাবেন।’

‘সহযোগিতার কথা ভেবেচিন্তেই বলা। কারণ, ডবল মার্ডারের পেছনে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হাত আছে—এটা যেমন সম্ভব, আবার নেইও—সেটাও ঠিক ততখানিই সম্ভব। আমরা এ—কথা মানি, বিশ্বাস করুন।’

‘করলুম।’

‘আপনার কথা এখানে রেকর্ড করা হচ্ছে না। আদালতে এসব কথার কোনো প্রামাণিকতাও নেই। আশা করি, এই শুনে খোলাখুলি কথা বলতে আপনি আর একটু বেশি ভরসা পাবেন।’

‘পেলুম।’

রঞ্জিতবাবু একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

‘বেশ, বলুন। আপনি ভেবে দেখেছেন কি যে অবিনাশ এবং জয়ন্তর হত্যার পেছনে একই লোকের হাত আছে কিনা?’

‘ভেবে দেখিনি।’

‘এখন ভাবুন। আপনি ওইভাবেই শুধু আপনার প্রতিশ্রুত সহযোগিতা আমাদের দিতে পারেন।’

মনে হল যেন চিরঞ্জীববাবুর মুখে হাসির একটু আভাস দেখলুম।

‘আজকাল আমার ভাবনা পদে পদে হোঁচট খায়, টলমল করে। বেশি ভাববার চেষ্টা করলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। ভাগ্যক্রমে, আমার জাগরণের অধিকাংশ মুহূর্ত আমি অপ্রকৃতিস্থ থাকি।’

রঞ্জিতবাবু একটু ভাবলেন কোন দিক থেকে আক্রমণ চালানো যায়।

‘জয়ন্তকে কে খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়?’

‘কে জানে। হয়তো বিপ্রদাসই।’

‘অবিনাশ সরকারকে কিন্তু বিপ্রদাস খুন করেনি।’

‘হয়তো। করলেও তাতে অসম্ভব কিছু নেই।’

‘কেন করবে?’

চিরঞ্জীববাবু মুখ খুললেন। ওঁর মুখের নির্বোধের ভাব আসলে বোধ হয় মুখোশ।

‘অবিনাশ ও জয়ন্তই মধুরাকে কনভেনশনাল সিনেমা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ফলে আরো অনেকের মতো বিপ্রদাসেরও সম্প্রতি অন্ন উঠেছিল। দুজনের ওপরেই ওর রাগ থাকা স্বাভাবিক।’

‘কে বলবে আপনার চিন্তাশক্তি দুর্বল!’ রঞ্জিতবাবুর কণ্ঠস্বরে ব্যঙ্গ গোপন ছিল না। তারপর বললেন, ‘অনেকের ধারণা, কেবল প্রমাণাভাবে পুলিশ বিপ্রদাসকে জোড়া খুনের জন্যে দায়ী করতে পারেনি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, ওই অপদার্থ ও মূর্খটা জোড়া খুনের নায়ক হতে পারে না।’

চিরঞ্জীব মৈত্র অনাসক্ত চোখে ছোট্ট ঘরখানির সামান্য আসবাবসজ্জার উপর চোখ বোলাচ্ছিলেন।

রঞ্জিতবাবু তীক্ষ্নকণ্ঠে বললেন, ‘বিপ্রদাসের ঘাড়ে সব অপরাধের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার আপনার এ আগ্রহের মানে কি?’

‘যা খুশি ভাবুন।’

‘আমাদের মনে হয়, বিপ্রদাসের পিছনে অন্য ব্যক্তি রয়েছেন।’

‘আপনি বলে যখন সম্বোধন করছেন, তখন তাঁর পরিচয়ও জানেন মনে হচ্ছে।’

‘একথা অন্তত জানি যে অনিমেষ পালিত ও নন্দিতা গুপ্তের মোটা ফিসের টাকা কে জুগিয়েছে।’

‘আমিই জুগিয়েছি। কী বলতে চান আপনি?’

রঞ্জিতবাবু একটু থতমত খেলেন।

‘আপনার এ—বদান্যতার এক্সপ্লানেশন আশা করি।’

‘বদান্যতা নয়; অপব্যয় করার অধিকার এবং সামর্থ্য আমার আছে। সে—অধিকার আমি যথেচ্ছ প্রয়োগ করি। এর বেশি কৈফিয়ত দেবার কিছু নেই।’

‘অপব্যয় যত খুশি করুন। কিন্তু যাকে আপনি সম্ভাব্য খুনি বলে ভাবতে পারেন, তার পেছনে টাকা ঢালার নৈতিক সমর্থন আপনি পান কোথা থেকে?’

‘সে—সমর্থনের প্রয়োজন নেই। রঞ্জিতবাবু, প্লিজ, মনে রাখবেন যে আমি নীতিবাগীশ মানুষ নই।’

চিরঞ্জীববাবু ভেবেছিলেন শেষের বাক্যটি হাসতে হাসতে বলবেন, কিন্তু দেখলুম তাঁর সে—হাসি বিকৃত হয়ে গেল।

‘জয়ন্তকে আপনি দেখতে পারতেন না এবং তার শত্রু বিপ্রদাস….’

কথা কেড়ে চিরঞ্জীব বললেন, ‘If you so insist, আমার স্ত্রীর সকল প্রেমিক আমার শত্রু এবং তাদের সকল শত্রু আমার মিত্র। মিত্রদের সাধ্যমতো সাহায্য করাটা আমি—এমনকি আমিও—কর্তব্যের মধ্যে গণ্য করি।’

এ তীব্রতা রঞ্জিতবাবু আশা করেননি।

‘আপনি এমন খোলাখুলি….’

‘অবশ্য, স্ত্রীর সকল ব্যাপারে উদাসীন হতে ক্রমশ অভ্যাস করছি। করতে হচ্ছে। কারণ বাংলা সিনেমা পত্রিকাগুলির কল্যাণে সেকথা কারও অজানা নয়, আজকাল আমরা separated—যে কথা অনেকে জানলেও ভুলে যায়, আমাদের ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল।’

কিছুক্ষণ আর কারো মুখে কোনো কথা নেই।

চিরঞ্জীব শেষে বললেন, ‘বিপ্রদাসকে জয়ন্তর পেছনে আমি লেলিয়ে দিইনি, কিংবা বাদলদের বলিনি অবিনাশকে খুন করতে। আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে?’

‘আছে। জ্যোতির সেই দাড়িওয়ালা লোকটি কি আপনার নিযুক্ত কেউ?’

‘না।’

‘সে যে কে, আপনি অনুমান করতে পারেন?’

‘পারি না।’

‘আপনার স্পাইরা তো সর্বক্ষণ মধুরা দেবীকে অনুসরণ করছে।’

‘করছে নয়, করত। সর্বক্ষণ নয়, যখন কাউকে শিক্ষা দেবার দরকার হত, তখন। স্পাই শব্দটি আপত্তিকর। অবিনাশ মারা যাবার পর আর আমি মধুরার গতিবিধির কোনো খবর রাখি না।’

‘যাক, আপনার স্পাই, বন্ধুদের মুখে আপনি কোনোদিন ওই দাড়িওয়ালা লোকটির কথা শুনেছিলেন, বা এমন কারো কথা, যে ওই মেকআপে মধুরা দেবীকে এখন অনুসরণ করছে?’

‘শুনিনি।’

‘আপনি লোকটিকে সনাক্ত করতে আমাদের কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারেন না?’

‘দেখুন, সে অনেক কেউই হতে পারে।’

মনে হল চিরঞ্জীব মুখ খুলতে আগ্রহী।

‘যেমন? বলুন।’

‘হয়তো রোমান হলিডে ফিল্মের সেই দাড়িওয়ালা ফটোগ্রাফারের মতো যে কেউ বিশ্বখ্যাতা অভিনেত্রীর রগরগে ফটো তোলার ফিকিরে ঘুরছে। কিংবা….’

‘কিংবা?’

‘হাংরি জেনারেশনের কোনো তরুণ কবি যে আমার স্ত্রীর মুখ থেকে শুনে বাংলা, হিন্দি ও ইংরাজি ভাষার যত অশ্লীল শব্দের সংকলন করছে।’

‘ঠাট্টা করবেন না।’ রঞ্জিতবাবু কষ্টে মুখের গাম্ভীর্য রক্ষা করছিলেন।

‘কিংবা মধুরার কোনো ব্যর্থ প্রেমিক।’

‘আবার প্রেমিক!’

‘কেন নয় বলুন? বাংলাদেশে at any given time মধুরার প্রেমে পাগল ডজন ডজন যুবক রয়েছে। মধুরাকে অনুসরণ করে তাদের কেউ হয়তো হোটেলে হাজির হয়েছিল।’

রঞ্জিতবাবু একটু ভাবলেন আর কোনো প্রশ্ন আছে কিনা।

‘মিস্টার মৈত্র, ধন্যবাদ। আর বিশ্বাস করুন, এই সাক্ষাৎকারের ফলে আপনার সম্বন্ধে আমাদের ধারণার উন্নতিই হল। রহস্য যদিও রহস্যই রইল।’

রঞ্জিতবাবু যে বহুবচন ব্যবহার করলেন, তাঁর সে—বুদ্ধির পরিচয়ে আমি চমৎকৃত হলুম। কথাটি সত্য।

চিরঞ্জীব সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। ভারী পায়ে একটু পা টেনে টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি।

কলকাতায় ছবির কাজে ব্যস্ত না থাকলে মধুরাকে ধরা শক্ত। আজ সে বোম্বাইতে, তো কাল ব্যাঙ্গালোরে, আবার পরশুই হয়তো কুলু উপত্যকায়। বিশেষত আমাদের কাছে ধরা দিতে সে চাইছিল না।

হঠাৎ খবর পাওয়া গেল সামনের সপ্তাহে যে—কোনোদিন কিছু বৈষয়িক কর্মে সে কলকাতায় আসছে। আমি দিল্লি থেকে এলুম। ও যেদিন সকালে কলকাতায় পৌঁছোল আমাদের খবর পেতে দুপুর হল। রঞ্জিতবাবু ফোন করলেন।

‘মধুরা দেবী নেই।’ ওপাশ থেকে পুরুষ—কণ্ঠ, সম্ভবত কোনো কর্মচারীর, ভেসে এলো।

‘আমি ইন্সপেক্টর রঞ্জিত শিকদার। পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে বলছি।’

‘বলুন।’

‘আমরা জানি যে, মধুরা দেবী এখন কলকাতায়।’

‘এখন বাড়িতে নেই। কখন ফিরবেন, কোথায় গেছেন জানি না।’

‘যে—মুহূর্তে ফিরবেন তিনি যেন যোগাযোগ করেন।’

‘আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করলে ওঁর পক্ষে কারো সঙ্গে দেখা করা, এমন কি ফোনে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়।’

‘এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলুম। প্রয়োজন জরুরি।’

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তারপর শোনা গেল, I am afraid, মধুরা দেবী যে—কোনো মুহূর্তে কলকাতা ত্যাগ করতে পারেন। হয়তো ইতিমধ্যেই করেছেন।’

‘Listen, Mr. Whoever-you-are, মধুরা দেবীর সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে। তিনি যে—মুহূর্তে বাড়ি ফিরবেন, আমি যেন খবর পাই। আমি না পৌঁছোনো পর্যন্ত ওঁকে আটকানোর দায়িত্ব আপনার। যদি বেশি চালাকি বা মনিবানী—ভক্তি দেখাতে যান ফল ভালো হবে না। বুঝলেন?’

‘হ্যাঁ।’ ওপাশ থেকে সংযত সংক্ষিপ্ত উত্তর ভেসে এল।

ফোন রেখে রঞ্জিতবাবু হাত নেড়ে আমায় জানালেন যে, মধুরার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও সহযোগিতা পাবার আশা সুদূরপরাহত। হঠাৎ আমার মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধি খেলল। কৃষ্ণকিশোর গোস্বামী মশায় বাংলাদেশের একজন অতি মানী জননেতা। মাংসের ওপর ওঁর বড় বিরাগ। তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্তা নটীর সংবর্ধনা—সভায় সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করায় তিনি কিছুই অগৌরব দেখেন না। তাঁর ঔদার্যের মূল্যে তিনি গোটা টালিগঞ্জ—পাড়ার আনুগত্য ক্রয় করেছেন। ছুটলুম তাঁর কাছে।

ভাগ্যক্রমে তাঁকে পাওয়া গেল। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে কি কাজে নেমেছি জানালুম। আমার কথায় রহস্য—রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়ে তিনি আগ্রহী হলেন। জানালেন তাঁর গিন্নি অমিয়—নিমাই—চরিত ফেলে দীনেন্দ্র রায়ের গ্রন্থাবলী গেলেন এবং মেয়ে বছর বছর কলেজে ফেল করলেও একের পর এক অগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস গেলে। সেসব কথা যাকগে, তাঁর নামের মন্ত্রগুণে তিনি ফোনের ওপ্রান্তে মধুরাকে অনায়াসে পেলেন। তিনি অনুরোধ করলেন যে, বিশেষ বাধা না থাকলে ও যেন ইন্সপেক্টর রঞ্জিতবাবুর সঙ্গে দেখা করে। মধুরা ভালোমানুষের মতো জানাল যে, সে দেখা করবে বলে ইতিমধ্যেই কথা দিয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া ইন্সপেক্টারটার মতলব বোঝা যাচ্ছে না। কৃষ্ণকিশোরবাবু ওকে যথাসম্ভব আশ্বস্ত করলেন।

রাত সাড়ে আটটা। মধুরার টালিগঞ্জের বাড়িতে বসবার ঘরে রঞ্জিতবাবু ও আমি অপেক্ষা করছি। ঘরটি যেভাবে সাজানো, তাতে সংস্কৃতিবান বাঙালি অপেক্ষা অর্থবান বাঙালি বেশি খুশি হবে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ঘরের পর্দা ঠেলে মধুরা দেখা দিল।

পর্দার সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে এক নজরে আমাদের দুজনকেই দেখে নিল। তারপর রঞ্জিতবাবুর দিকে এগোল। নিশ্চিত কিন্তু লঘু পায়ে যেন নেচে এলো ও। মেঝেতে কার্পেট পাতা বলে চটিতে শব্দ হচ্ছে না। সিল্কের শাড়ি পরেছে এবং গায়ে কাশ্মীরি কাজ করা পুরো হাতা একটা আঁটা গরম জামা। কুঞ্চিত কাল ঘন চুলের রাশ কোমর ছাড়িয়েছে। ধূপের সৌরভ পাচ্ছি, সে হয়তো ওই চুল থেকেই। দুই ভুরু সযত্নে আঁকা, এছাড়া মুখে অন্য প্রসাধন নেই। চামড়ার রং তামাটে। মধুরা অনন্তযৌবনা, বয়স বোঝার উপায় নেই। দীর্ঘ গ্রীবার ওপর উদ্ধত শির।

আমি একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিলুম। রঞ্জিতবাবু বসেছিলেন। মধুরা আসতে উঠে দাঁড়ালেন। ওঁকে একটু স্টিফ মনে হচ্ছিল। মধুরা সামনে এসে ঝকঝকে দুই দাঁতের পাটি দেখিয়ে হাসল।

‘নমস্কার। রঞ্জিত শিকদার আপনিই? বসুন।’

সে নিজে বসল। রঞ্জিতবাবুও নমস্কার করে বসলেন। মধুরা তার বড় বড় দুই চোখের পূর্ণ দৃষ্টি আমার মুখে স্থাপন করল।

রঞ্জিতবাবু পরিচয় দিলেন, ‘ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর চন্দন রায়।’

আমি নমস্কার করলুম। যত কম সম্ভব মাথা নেড়ে নমস্কারের স্বীকৃতি দেওয়া যায়, মধুরা ততটুকুই নাড়ল। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

‘আমার একজনের সঙ্গেই না দেখা করার কথা।’

আমি সামান্য শব্দ করে হাসলুম। মধুরা আবার আমার দিকে তাকাল। আমার দুই চোখ কৌতুকে নাচছে।

‘আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’

শির নোয়ানোয় কুর্নিশের একটা আভাস এনে আমি এক পা পিছোলুম।

‘Impudent! ঠিক আছে, আপনাকে যেতে হবে না। বসুন।’

হায়, মেক—আপের চশমা, গোঁফ ও থ্যাবড়া নাকে আমায় ধৃষ্ট ছোকরাই মনে হচ্ছিল।

‘আমি কিন্তু বেশি সময় দিতে পারব না।’ মধুরা সতর্ক করল।

‘মিসেস মৈত্র, আমরা না ভেবে পারি না যে, যদিও অবিনাশ এবং জয়ন্ত দুজনের কেউই আপনার অশ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন না….’

বাধা পড়ল।

‘তারা দুজনেই আমার প্রণয়ী ছিল।’

‘প্রণয়ী ছিলেন, তথাপি তাঁদের হত্যারহস্যের সমাধানে পুলিশ আপনার কাছ থেকে বাঞ্ছিত পরিমাণে সহযোগিতা পাচ্ছে না। কেন?’

‘পাচ্ছে না?’ মধুরার মুখ কালো হয়ে উঠল, তারপরই হেসে ফেলল, ‘বিশ্রী প্রশ্ন আপনার। পরবর্তী প্রশ্ন?’

‘আমরা আপনার কাছে আপিল করছি, ভিক্ষা করছি আপনার সহযোগিতা।’

মধুরা ভিতরে ভিতরে একটু চঞ্চল হয়েছে মনে হল। অপেক্ষাকৃত উচ্চৈচঃস্বরে বলল, ‘Next question, please?’

‘জয়ন্ত ও বিপ্রদাস মারামারি করতে সরে গেল। আপনি ওদের বাধা দেননি। ওরা মারামারি করছিল আপনার চোখের আড়ালে। তারপর আপনার সেই তীক্ষ্ন চিৎকার—সেন, ফিরে এসো। আপনি ছুটে ওরা যেখানে মারামারি করছিল সেদিকে যাচ্ছিলেন। এ—অদ্ভুত আচরণের একটিই ব্যাখ্যা হয়।’

মধুরার দুই ঠোঁট কাঁপছিল। স্বতই ওর মুখ থেকে বেরুল, ‘কি?’

‘আপনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, কোণের টেবিলটি ছেড়ে কোঁকড়া চুল ও দাড়িওয়ালা সেই লোকটি একটু ঘুরে আড়ালে অন্ধকারে দুজনের দিকে এগোচ্ছে। এক মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা আপনার মনে….’

‘ব্যস ব্যস। আপনারা যত মনগড়া গল্প বলে আমায় জ্বালাচ্ছেন।’

হাত বাড়িয়ে ও একটি ঘণ্টি বাজাল। সঙ্গে সঙ্গে একটি সপ্রতিভ তরুণী পর্দা সরিয়ে দেখা দিল।

‘আরতি, এঁরা যে—ড্রিঙ্ক ইচ্ছে করেন এনে দে। বলুন আপনারা।’

‘এক কাপ চা হলেই হবে।’ রঞ্জিতবাবু বললেন।

‘হট চকোলেট।’ আমি বললুম।

জয়ন্তই আমায় ওই পানীয়টির ভক্ত বানিয়েছিল। মধুরা একবার চকিতে আমায় দেখল।

রঞ্জিতবাবুকে বলল, ‘আমাদের ইণ্টারভিউ শেষ। হয়তো আপনাদের নিরাশ করলুম।’

‘তা একটু করলেন। কিন্তু আমরা পরস্পরের প্রতি মনে কোনো ক্ষোভ রেখে বিদায় নেব না।’

চায়ে চুমুক দিতে দিতে রঞ্জিতবাবু আবার কথা পাড়লেন, ‘মধুরা দেবী, আমি আপনার ভক্ত দর্শকদের একজন।’

ও হাসল।

‘কেন ভোলাচ্ছেন। আমি আমার ভক্তদের চোখ দেখলেই চিনতে পারি।’

‘কেন, মুখ থেকে না ঝরে তাদের চোখ থেকেই লালা ঝরে নাকি?’

মধুরা এবার সশব্দে হাসল।

হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, ‘বুঝলেন ইন্সপেক্টর, যে—কারণেই হোক আমার আপনাকে এবং আপনার সঙ্গীকে ভালো লেগেছে।’

আমি চোখ বুজে মাথা নাড়লুম। মানে, পরাণটা আমার জুড়িয়ে গেল।

মধুরা বলছিল, ‘লালা পড়ার কথায় আপনি কৌশলে আমায় শুধু জনতার লোভের সামগ্রী বললেন….’

‘আমি মাফ চাইছি।’

‘আপনি না চাইতেই আপনাকে মাফ করেছি। নাহলে এতক্ষণে…..যাকগে। আপনার সঙ্গীটি যে ছদ্মবেশে এসেছেন, সেজন্যও আমি কিছু বললুম না।’

রঞ্জিতবাবু স্পষ্টই বিচলিত হলেন। আমি কিছু পরম নিশ্চিন্তে আমার গোঁফে তা দিচ্ছি।

মধুরা বলল, ‘যে—কথা বলতে আমার ভক্ত হওয়ার বাহানা তুলেছিলেন, সেটা শেষ করুন।’

রঞ্জিতবাবু ততক্ষণে অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়েছেন।

‘আমার বড় ইচ্ছে আপনি জয়ন্তের যে—অসমাপ্ত ছবিটিতে কাজ করছিলেন সেটি শেষ করুন। হয়তো ওটিই আপনার সর্বোত্তম ছবি হবে।’

আমরা খবর পেয়েছিলুম যে, সে ছবিটি শেষ করার প্রস্তাব আপাতত কানে তুলতেই রাজি নয়। এখন আমাদের কথা শুনে ও একটু ভাবল।

‘আমি ছবিটির শুটিং—এ যোগ দিলে আপনাদের তদন্তে কোনো সুবিধা হবে?’

মিথ্যা কথা বলে লাভ নেই।

‘হবে।’

‘আপনাদের প্রস্তাব আমার মনে থাকবে। কোনো কথা দিতে পারছি না।’

বিদায় নেওয়ার আগে মধুরা কটাক্ষে আমায় আর একবার দেখে রঞ্জিতবাবুকে বলল, ‘আপনার সঙ্গীটি অসাধারণ কম কথা বলেন।’

‘ওহো, চন্দন। ওর বাচালতার পরিচয় আপনি কোনোদিন পাবেন।’

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

মধুরার বাড়ি থেকে অদূরে একটি ছোট মোটরগাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড় করানো ছিল। আমাদের জিপ তাকে পাশ কাটাল। গাড়িটির চালকের আসন শূন্য, পিছনের সিটে টুপি—মাফলারে জবড়জং হয়ে একজন অন্ধকারে বসেছিল। জিপের হেড—লাইটে মানুষটিকে মাত্র মুহূর্তের জন্য দেখা গেল। রঞ্জিতবাবুকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘গাড়িটাতে কে বসেছিল চিনতে পারলেন?’

‘না। কে?’

‘ভদ্রলোকের পাশে যে ওঁর কালো ছড়িটি পড়েছিল, তা বোধ হয় আপনি দেখতে পাননি।’

‘চিরঞ্জীব মৈত্র!’

মধুরার কথা

জয়ন্ত মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন সকালে কলকাতায় সুশান্ত ভৌমিক আমার সঙ্গে দেখা করতে এল।

গত তিন মাস ধরেই ও প্রায় মরিয়া হয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে আসছে। চিঠির পর চিঠিতে একই কথা—আমি যেন দয়া করে অসমাপ্ত ছবিটি শেষ করি। জয়ন্ত মারা যাবার আগে ছবিটির ইনডোর শুটিং যা করার মোটামুটি শেষ করেছিল। তারপর বর্ষা নামল। কথা ছিল, পুজোর পর নভেম্বরে কলকাতার বাইরে নতুন কোনো শিল্পাঞ্চলে গিয়ে এক্সটেনসিভ আউটডোর শুটিং হবে।

‘স্বর্গের জানালায়’ শেষ করার আগ্রহ আমারও রয়েছে। জয়ন্তের লেখা চিত্রনাট্যে আমায় ম্যাক্সিমাম সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সে—সুযোগের আমি সদ্ব্যবহার করছিলুম। নায়ক করছে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোনো সুবীর গাঙ্গুলি। সত্যি কথা বলব, ও লরেন্স হার্ভের চেয়ে কিছু খারাপ কাজ দেখাচ্ছিল না। আমরা সবাই বলাবলি করতুম যে, ছবিটি মুক্তি পেলে সুবীরকে নিয়ে নির্ঘাত হৈ—চৈ হবে। জয়ন্ত খুব খাটছিল এবং প্রায়ই বলত যে, ‘স্বর্গের জানালায়’ ওর অদ্যাবধি মুক্তিপ্রাপ্ত সব ক’টি ছবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবে।

আর একটি কথাও আমার মনে আছে। মাস তিন—চার আগে ইন্সপেক্টর রঞ্জিতবাবু কী ভেবে জানি না অনুরোধ করেছিলেন যেন ছবিটি আমি শেষ করি।

ছবিটির সঙ্গে আমি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় একটি ক্যাপাসিটিতে জড়িয়ে পড়েছি। জয়ন্ত পরিবেশক সাধুখাঁর কাছ থেকে মূলধন ধার নিয়ে ছবিটি তুলছিল। ও মারা যাবার অল্পদিন পর থেকেই সাধুখাঁ আমার ওপর চাপ দিতে লাগল ছবিটি শেষ করতে। আশ্চর্য, এই মানুষটার কত অন্যায় আবদারও আমি আগে মিটিয়েছি। বিরক্ত হয়ে আমি ওর সব টাকা মিটিয়ে দিয়েছি। ‘স্বর্গের জানালায়’ এখন আমারই প্রযোজিত ছবি হবে। এর আগে কতবার কতজন, বিশেষত চিরঞ্জীব, আমায় প্রযোজিকা হবার সুবিধা ও লাভ বোঝাতে চেয়েছে। আমি কোনো কথায়ই রাজি হইনি।

পক্ষে অনেক কারণ থাকলেও জয়ন্তের মৃত্যুর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই হয়তো আমি ছবিটি শেষ করতে আসতুম না। কিন্তু আমার মূলধন আটকা রয়েছে, সে নিয়ে আমায় ভাবতে হচ্ছে। ব্যবসায় বুদ্ধি প্রখর হলে ভাবতে হত না। মাসে পনেরো—বিশ হাজার টাকা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি, যখন আমার রোজগার ছিল তখন চিরঞ্জীবকে বিজনেস—ম্যানেজাররূপে পেয়ে নিশ্চিন্ত ছিলুম। যখন আলাদা হয়ে গেলুম সব টাকার হিসেব চাইনি। শুনেছি, মোটা টাকা জমা আছে আমাদের ছেলের নামে। যা টাকা আমার হাতে এল তার একটা অংশ বেরিয়ে গেল টালিগঞ্জে নতুন বাড়ি কিনতে। আজকাল ছবিতে নামি খুব কম। যে—ক’টিতে নেমেছি টাকা পেয়েছি কম। সমালোচক ও দর্শকদের ধন্য—ধন্য পেয়েছি বেশি। চিরঞ্জীবের সঙ্গে বিবাহ—বিচ্ছেদ হয়ে গেলে আমার অ্যাটর্নি ওর কাছে টাকাকড়ির হিসেব বুঝে নেবে এখন। আপাতত দেখা যাচ্ছে, শীঘ্র হাতের ছবিটি শেষ করে রিলিজ করা দরকার।

সুশান্তকে লিখেছিলুম যে, যথাসম্ভব কম খরচে ছবি শেষ করতে হবে। আমার কিছু কংক্রিট সাজেশানস ছিল। পরিচালনায় দ্বিতীয় সহকারী সত্যরঞ্জন বড়ুয়া; চিত্রগ্রহণ—পরিচালক বীরেশ্বর পাল; সম্পাদক প্রশান্ত জানা; বোম্বাই ও বাংলায় বিখ্যাত সঙ্গীত—পরিচালক বিরাম মুখোপাধ্যায়; বহির্দৃশ্যের পার্শ্ব—চরিত্রাভিনেতা বিকাশ চট্টোপাধ্যায়, রতন রায় ও রবি বন্দ্যোপাধ্যায়; কয়েকজন কলাকুশলী ও ব্যবস্থাপককে বাদ দেওয়া হোক। উক্ত অভিনেতাদের বদলে (যে—ক্ষেত্রে চরিত্রগুলিকে ছেঁটে দেওয়া সম্ভব নয়) নতুন মুখ নেওয়া হবে, সঙ্গীত—পরিচালনা করবে তরুণ সরোদিয়া স্বদেশ ঘোষ, বীরেশ্বরের সহকারী হিসেবে ক্যামেরা—অপারেটর ছিল বিজন বসু, হবে নতুন চিত্রগ্রহণ— পরিচালক এবং স্বয়ং সুশান্ত পরিচালনার সঙ্গে সম্পাদনার দায়িত্বটাও নেবে।

সুশান্ত অবিলম্বে জানাল যে, আমার সব ক’টি প্রস্তাবেই সে রাজি। শুধু পরিচালনায় ওর একজন সহকারী দরকার। একজনকে ও প্রাথমিকভাবে মনোনীত করেছে। নাম—অবনী দাশগুপ্ত। কোথায় কবে আমাদের দেখা হচ্ছে, সে—কথা লিখলেই ও ভদ্রলোককে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। চিঠি পড়ে আমি হাসলুম।

সুশান্ত ভৌমিক আজ থেকে পনেরো—ষোলো বছর আগে সিনেমা—লাইনে ঢুকেছিল। বয়স ছিল আঠারো কি বিশ। শেখবার অসীম আগ্রহ ছিল, কয়েক বছরের মধ্যে এ—লাইনে কলাকৌশলের যাবতীয় বিভাগে হাতেকলমে দক্ষতা অর্জন করল। একটি জিনিসই ও আজ পর্যন্ত শেখেনি—কী করে যেনতেন—প্রকারেণ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ফলে প্রায় পনেরো বছর ধরেও সহকারী পরিচালকই রয়ে গেল। সিনেমা—লাইনে আসার পর জয়ন্তের ধৈর্য ছিল না কলা—কৌশলের খুঁটিনাটি রপ্ত করার। সুবিধের জন্য মোটা মাইনেয় সুশান্তকে সে নিজের প্রধান সহকারী করল। সে যে সুশান্তকে মক—ফ্ল্যাটারিতে গুরুজি বলে ডাকত তার মধ্যে সত্যও ছিল।

ভগবান সুশান্তের চেহারাখানাকে কমিক্যাল করেই গড়েছিলেন। ওর নিজের অমনোযোগে সে—ভাবটি আরও জাগায়। লম্বায় হয়তো পাঁচ ফুটেরও কম, বুক—পেটের গড়নের জন্য ওকে পিপের মতো দেখায়। ঘাড়ের ওপর গলা নেই, ফুটবলের মতো গোল মুন্ডু বসানো। বড় বড় চুল কপালের ওপর এসে পড়ে। শার্টে ইস্ত্রি থাকে না এবং প্যান্টটা ঝলমলে। গলার স্বর মেয়েলি।

জয়ন্তের দ্বিতীয় সহকারী ছিলেন সত্যরঞ্জন বড়ুয়া। শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান সৌম্য ভদ্রলোক। বয়সে চল্লিশোত্তীর্ণ। যৌবনে সামান্য লেখকখ্যাতি পেয়েছিলেন। তখন স্কুল—মাস্টারি করতেন। ওঁর মুখে শুনি সে—খ্যাতি উনি পুনরর্জন করবেন। নাটক ও উপন্যাস লেখার কাজে না কি হাত দিয়েছেন। কিন্তু চোখে দেখি শুধু ফিল্মের ওপর ছোট ছোট লেখা এ—পত্রিকায় ও—পত্রিকায় বেরুচ্ছে। জয়ন্ত ওঁকে সহকারী করেছিল আমারই পরামর্শে। পশ্চিমে মানুষ বলে ওর বাংলা—জ্ঞান অল্প। সত্যরঞ্জন ওকে সংলাপ—আবৃত্তি ও চিত্রনাট্য—রচনায় সাহায্য করতেন।

এঁকে বাদ দিয়ে পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে সুশান্তের এমনিতে আপত্তি নেই। কিন্তু বহির্দৃশ্য গ্রহণের সময়ে, বিশেষত আমার মতো ডাকসাইটে নটী যেখানে অংশ নিচ্ছে, মাথা ঠান্ডা রেখে এবং ভিড় সামলিয়ে কাজ করার জন্য কঠোর ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। অনুমান করলুম, সত্যরঞ্জনের বদলি হিসেবে সুশান্ত যাকে নিচ্ছে, তার বাজখাঁই গলা আর গুন্ডাদের মতো চেহারা হবে। অবশ্য, আমার পছন্দ না হলে তার নিযুক্তির প্রশ্ন ওঠে না।

আমি সুশান্তকে লিখে দিলুম যে, ও যেন ওর প্রস্তাবিত সহকারী—সমেত একটি নির্দিষ্ট তারিখে সকালে টালিগঞ্জের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করে।

আমায় ঘরে ঢুকতে দেখে সুশান্ত শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল। ওর একটা বিশ্রী অভ্যাস আছে। যাদের ও সমীহ করে তাদের নমস্কার করার পর ওর হাত দুটো আবার শরীরের পাশে ঝুলন্ত অবস্থায় ফিরে যেতে সময় নেয়। দুটো হাত প্রায় বুকের কাছে রেখে সে আঙুল মটকায় ও হাতে হাত ঘষে।

ঘরে ঢুকেই আমি লক্ষ করেছি অবনী আমাদের দিকে পিছন ফিরে দেয়ালের ধারে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। ওই দেয়ালের ধারে একটা বুককেসের উপর জয়ন্তর একটি উজ্জ্বল পূর্ণ প্রতিকৃতি রয়েছে। ছবিটি কায়দা করে ও নিজেই তুলেছিল। আমি সম্প্রতি ওখানে সাজিয়েছি। অবনী নিশ্চয়ই সেই ছবিটা দেখছে। আমার পদশব্দ কানে না গেলেও সুশান্তর আমায় অভিবাদনও কি আর ওর কানে যায়নি! তথাপি ঘুরে দাঁড়াতে বুঝি দু—এক সেকেন্ড দেরি হল।

সুশান্ত ডাকল, ‘অবনীবাবু!’

অবনী ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে আমার শ্বাসরোধ হল। শ্রীসম্পন্ন পৌরুষের কী মূর্তি! দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গাত্রবর্ণ দেখলে মনে হয় পঞ্চনদের তীরের অধিবাসী।

সুশান্ত বলল, ‘অবনী দাশগুপ্ত, শ্রীমতী মধুরা মৈত্র।’

‘গুড মর্নিং।’

প্যান্টের পকেটে বাঁ হাত পোরা। অবনী একটু ঝুঁকে আমায় অভিবাদন করল। আমি লক্ষ করেছিলুম যে ও যখন আমাদের দিকে ফিরল যেন কি ঘোরে ছিল। আমার দিকে নজর পড়তেই কি ওর চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল? পরে বুঝেছিলুম যে জয়ন্তর স্মৃতি ওকে বিচলিত করে রেখেছিল।

আমি অভিবাদনের উত্তরে বললুম, ‘নমস্কার।’

তখন দেখি ওর মুখে হাসি। এতক্ষণে সম্পূর্ণ আত্মস্থ দেখাচ্ছে ওকে। এ মুখ আমি আগেও কোথায় যেন দেখেছি। সামনে এগিয়ে এসে ও হাতের ইঙ্গিতে আমার আসন দেখিয়ে বলল, ‘বসুন।’

যেন ওর বাড়িতেই ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমি। আমরা দুজনে বসবার পর সুশান্তও বসল। আমি স্মিত মুখে অবনীকেই দেখছি। এদিকে সুশান্ত ওইটুকু সময়ের মধ্যেই উসখুস করছে—ও শুধু কাজ বোঝে।

বলল, ‘শ্রীমতীজি, ছবির শুটিং কবে আরম্ভ করলে আপনার সুবিধে হবে?’

এখানে বলে নিই, আমাকে ‘শ্রীমতীজি’ সম্বোধন চালিয়েছিল জয়ন্তই। ওর আবির্ভাবের আগে ফিল্ম লাইনে অ্যাসিস্টেন্টরা সব আমায় মধুরা দেবী বলেই ডাকত।

বললুম, ‘অন্য আলোচনা করার আগে অবনীবাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্টটা কনফার্ম করলে হয় না?’

আমি অবনীর দিকে ফিরলুম।

‘বলুন, আপনার কি কোয়ালিফিকেশনস?’

‘আমি যাঁকে সাহায্য করবার জন্য নিযুক্ত হবো, তিনি আমার যোগ্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত। আর কি চাই?’

‘ছবির আমিই প্রযোজিকা এবং ডিয়ার লিটল ভৌমিকের কোনো মতামতকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। আপনাকে সাবধান করছি, অ্যাসিস্টেন্টদের ঘুরিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না।’

সুশান্তর মুখে সন্ন্যাসীর নিস্পৃহতা। কিন্তু স্পষ্ট দেখলুম যে অবনীর মুখ কালো হয়ে উঠল। কিন্তু অসম্ভব ওর আত্মসংযম। পরক্ষণেই হাসল।

ও যে ক্রুদ্ধ হয়েছিল সেকথা পরে একদিন স্বীকার করেছিল। তখন ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। একদিন ও আমায় একটা মূল্যবান ছবির বই উপহার দিল। বিরাট সাইজের বইতে রঙিন সব ছবি। পূর্ব ইউরোপের একজন বিখ্যাত চিত্রকর ছবিগুলি এঁকেছেন। রাশিয়ার মহান সম্রাট পিটার (১৬৭২—১৭২৫) স্বদেশকে পশ্চিম ইউরোপীয় আদর্শে সভ্য করার জন্য অসম্ভব খেটেছিলেন। বইটির বিষয় তাই। উপহার—পৃষ্ঠায় অবনী লিখেছিল : ‘সভ্যতা ও সৌজন্যের সূত্রগুলি কি অপরিবর্তনীয় সেকথা আমরা ভুলে যাই। বিশেষত নিম্নপদস্থদের প্রতি ব্যবহারে। পিটার উঁচু তলা থেকেই তাই সংশোধন আরম্ভ করেছিলেন।’ অবনী বুঝিয়ে দিয়েছিল যে সেদিন সুশান্তর প্রতি আমার দুর্বিনয় ওর ভালো লাগেনি।

যাক, যেদিনকার কথা হচ্ছিল। অবনী বলল, ‘আমি যাঁর জায়গায় এসেছি, তিনি তো সংলাপ—আবৃত্তি ও চিত্রনাট্য—রচনায় সাহায্য করতেন। সেই দিকে আমি কি করতে পারব তার একটু আভাস দিই। আশা করি, আপনার মজা লাগবে।’

একটু থেমে ও আরম্ভ করল, ‘ধরুন এক পরিচালক এক মোহময়ী অভিনেত্রীকে নির্দেশ দিচ্ছে পঙক্তি কীভাবে বলতে হবে। অভিনেয় অংশ হল, নায়িকা তার বাপের কারখানায় একটি শূন্য পদের জন্য উমেদারদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পরিচালকের নির্দেশ শুরু হল :

ম্যাডাম, আপনি একটু চোখ নামিয়ে, মানে সেই ভাবেই আপনার মুখ সবচেয়ে ফটোজনিক কিনা, একটু হাসবেন। যেমন হাসি আগের সেটে নায়ককে ‘চায়ে ক’ চামচ চিনি দেবো’ প্রশ্ন করার সময়ে হেসেছিলেন। তারপর এইভাবে বলবেন—বলুন, আপনার কী কোয়ালিফিকেশনস?’

আমি গাম্ভীর্য রক্ষা করছি। ক্যারিকেচার হলেও মনে পড়ল যে ওই ভাবেই দু’ বছর আগে পর্যন্ত পরিচালকেরা আমায় নির্দেশ দিতেন।

‘আচ্ছা, এবার ধরুন সিচুয়েশন অনুরূপ কিন্তু ইন্টারভিউ নিচ্ছে মালিকের ছেলে। অভিনেতার বিদ্যে ক্লাশ এইটে তিনবার ফেল। যদিও পার্ক স্ট্রিটের সাহেবের বাচ্চার কাছে এখন সে সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টা ইংরেজি শেখে। এদিকে তার রসগোল্লার মতো মুখ থেকে আধো—আধো বচনেই নাকি মহিলা দর্শকদের মনে অকাল বসন্ত জাগে। তার সংলাপ বলার কায়দাটা দেখুন—বলুন, আপনার কী কোয়ালিফিকেশনস?’

স্পষ্টতই এটা বিপ্রদাসের প্রসিদ্ধ বাচনভঙ্গিকে ব্যঙ্গ। আমি এবার হেসে ফেলেছি।

‘আপনার প্রসন্নতা দেখে আশা হচ্ছে যে ভাঁড়ামো আপনার হৃদয়দুর্গে প্রবেশের অন্যতম পন্থা হলেও হতে পারে।’

আমি এ—বাক্যের কি অর্থ ভাবছি, অবনী কিন্তু থামল না।

‘আশা করি, এখন আর আমায় বলে ভড়কে দেবেন না যে—বলুন, আপনার কী কোয়ালিফিকেশনস?’

অতঃপর উচ্চহাস্য অসংবরণীয়। যদিও বুঝছি যে ওর ইঙ্গিত এই যে তথাকথিত ভড়কানোর জন্য আমার চেষ্টা ব্যর্থ ও কৃত্রিম। আমার হাসির আওয়াজ শুনে পর্দার ওপাশ থেকে আরতি উঁকি না মেরে পারল না। আমি ওকে ডাকলুম। পানীয় সরবরাহ করার সময় হয়েছে।

সুশান্ত আমার ধরন—ধারণ জানে। আনন্দে তুড়ি মেরে লাফিয়ে উঠেছে। মানে, ছবি তৈরির ইউনিট আবার ক্রিয়াশীল হবে। সারথি সুশান্ত ভৌমিক এবং তার সহকারী অবনী দাশগুপ্ত।

পরের সপ্তাহে চলচ্চিত্র—সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি প্রেস কনফারেন্সে আমি মিলিত হলুম। ‘স্বর্গের জানালায়’ ছবিটির সংগঠকবৃন্দে কিছু রদবদল করে আমরা যে এবার ছবিটি শেষ করব—প্রকাশ্যে সেই ঘোষণার উদ্দেশ্যেই সম্মেলন।

গৌরবের শিখরে দীর্ঘকাল আছি। কিন্তু সাংবাদিক—সম্মেলন ডাকার অভিজ্ঞতা পূর্বে কখনো হয়নি। ‘কপালকুণ্ডলা’র জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলুম এবং আরও দু—একবার পত্রিকায় আমার বিবৃতি পাঠিয়ে দিয়েছি এইমাত্র। ‘কপালকুণ্ডলা’র বেলায় ওটা লিখে দিয়েছিলেন সত্যরঞ্জন।

এ সম্মেলন ডাকার মতলব এসেছিল অবনীরই মাথায়। প্রথম দিন যখন এসেছিল, পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে আলোচনার ফাঁকে প্রস্তাবটি দিয়েছিল। সুশান্তরও সায় ছিল যে নির্মীয়মান ছবিটির প্রচারে এ ধরনের কনফারেন্সের অসাধারণ উপযোগিতা আছে।

যেদিন সন্ধ্যায় সবাই আসবে, সেদিনই সকালে আমি চিরঞ্জীবের নিম্নলিখিত চিঠিটি লোক মারফত পেলুম।

 কলকাতা : শুক্রবার

শুনু,

আজকাল কখন কোথায় থাকো কিছু খবর পাই না। আশা করি সম্পূর্ণ ভালো আছো। লোক—পরম্পরায় কানে এল যে আজ তোমার ওখানে একটা সাংবাদিক সম্মেলন। আমার পরামর্শ যদি শোন, ওটা বাতিল করো।

যারা আসবে তারা হাসিমুখেই আসবে, তোমার দেওয়া খাদ্যপানীয় খুব সহজেই তাদের গলা দিয়ে নামবে, এবং সন্দেহ কি, পত্রিকাগুলিতে এ সম্মেলনের সপ্রশংস উল্লেখই স্থান পাবে। কিন্তু মানুষগুলির মুখোশের আড়ালে কি আছে জানো? তোমার প্রতি ক্রোধ ও ঘৃণা।

কেন, বুঝতেই পারছো। আশ্চর্য কী জানো, সকলেই জানে অবিনাশ বা জয়ন্তকে তুমি খুন করাওনি। সে—গৌরব আমায় দেওয়া হয়। অন্য পক্ষে, দুজনের কেউ বেঁচে থাকতে যে জনসাধারণের শ্রদ্ধা পেত তাও নয়। কিন্তু ওদের মৃত্যুতে কোনো রহস্যময় যুক্তিতে তোমার কিছু দায়িত্ব কল্পনা করে সকলে তোমার প্রতি বিদ্বিষ্ট। হত্যারহস্যের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত আর আমাদের সুখ নেই। অধিক কি লিখি?

চিরঞ্জীব মৈত্র

পুনশ্চ, উকিলেরা আমাদের বিবাহ—বিচ্ছেদের কাগজপত্র তৈরি করেছে। সেগুলোর আর দরকার হবে কি? নীতু আর কয়েক মাসের মধ্যেই ইংলন্ড থেকে ফিরবে। অন্তত ততদিন পর্যন্ত বিচ্ছেদটা স্থগিত থাকতে পারে।

এ—চিঠি পড়ে আমার মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠল। প্রথম যে—চিন্তা মাথায় এল তা এই যে কলকাতা থেকে পালাই। ‘স্বর্গের জানালায়’ আর শেষ করে দরকার নেই। কিন্তু কার সঙ্গে পরামর্শ করি?

মাথাটা একটু ঠান্ডা হতে মলয়কে ডাকলুম। মলয় সিংহ আমার সেক্রেটারি। ছোকরা এই বাড়িতেই থাকে।

ও আসতেই বললুম, ‘আজকের প্রেস—কনফারেন্স বাতিল করতে হবে। নিমন্ত্রিতদের লিস্ট তোমার কাছে আছে?’

জবাব দিতে গিয়ে ভয়ে মলয়ের গলা কেঁপে গেল।

‘ছিল। কাল সন্ধ্যায় সুশান্তবাবু সেটা চেয়ে নিয়ে গেছেন।’

‘ইডিয়ট। লিস্টটার একটা কপি করে দিতে পারতে। এক্ষুনি যাও। ওকে ধরে নিয়ে এসো। এক মিনিট দেরি করবে না।’

মলয় ছুটল। সুশান্তটা হাড়কিপ্টে। বাড়িতে এখনও ফোন নেয়নি। প্রতীক্ষা করে মিনিট কুড়ি কাটালুম। চিরঞ্জীবের চিঠিটার এক—একটা পংক্তি আমার মনে দাগ কেটে বসছে। আমায় বাঁচতে হবে।

আমার ঘরের আলমারিতে নানা আকারের থরে থরে বোতলে মদ রয়েছে। পান করলে অপমানের জ্বালা, দুঃসহ স্মৃতি, অস্থির অসহায়তা সব ভুলিয়ে দেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি সেই আলমারি খুললুম।

আধঘণ্টা পরে। বাইরে পদশব্দ পেলুম। দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। আরতির গলা, ‘সুশান্তবাবু এসেছেন।’

আমি চেঁচিয়ে বললুম, ‘প্রেস—কনফারেন্স বাতিল।’

পদশব্দ মিলিয়ে গেল। পরে শুনেছি যে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুশান্ত নীচে গিয়ে অবনীকে তার হোটেলে ফোন করেছিল। পরিস্থিতি শুনে অবনী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল।

‘বাতিল করা অসম্ভব। মধুরা বেঁকে বসলে ওকে ছাড়াই প্রেস—কনফারেন্স হবে। পানীয়ের বন্দোবস্ত ভালোমতো হয়েছে তো?’

‘ফার্স্ট রেট। কিন্তু ভেবে দেখুন….’

‘ভাববেন আপনি। এবং ছবির পরিচালকের যে—দায়িত্ব নিয়ে ভাবা উচিত, সেইভাবেই ভাববেন। ঠিক কথা, সুবীর গাঙ্গুলি আসছে তো?’

‘আসতে বিশেষভাবে অনুরোধ গেছে। তবে হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আসেনি। মহরতের দিন একটা বাজে ওজোর দেখিয়ে অনুপস্থিত ছিল।’

‘ওর ঠিকানা কি?’

‘সন্ধ্যার পর ওকে কলেজ স্ট্রিটের কফি—হাউসে পাবেন।’

‘ঠিক আছে। সাংবাদিক—সম্মেলন যেন কোনোমতেই বাতিল না হয়।’

আমি সুশান্তকে তাড়াবার অল্প পরেই আবার ও উপরে উঠে এসেছিল। বাইরে থেকে কাতর স্বরে ডেকেছিল, ‘শ্রীমতীজি….’

আমি চুপ।

‘ভেবে দেখুন, নেমন্তন্ন করে আবার ফিরিয়ে নিলে আমাদের প্রেস্টিজ….’

ওর পক্ষে এমন কথার ওপর কথা বলতে আসা অসহ্য বেয়াদবি। বোতল হাতে আমি পালঙ্ক থেকে নামলুম। কাঁধের আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, তাতে একবার হোঁচট খেলুম।

দরজা খুলতে দেখি, প্রমাদ গুনে সুশান্ত সিঁড়ি বেয়ে নীচে সরে পড়ছে। আমি হিন্দিতে একটা গাল দিয়ে ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললুম, এবং হাতের বোতলটা ওর দিকে ছুড়ে মারলুম। সেটা অবশ্য ওর গায়ে লাগল না। আমি আবার দড়াম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে পালঙ্কে এসে বসে নতুন একটা বোতলের ছিপি খুললুম।

ঘরের বাইরে বিকেলের আলো তখন ম্লান হয়ে আসছে। আমি উঠে বসলুম। সব কথা একে একে আমার মনে পড়ল। যত নষ্টের গোড়া চিরঞ্জীবের সেই চিঠিটা আবার পড়তে হবে। চিঠিটার খোঁজে চারিদিকে চাইলুম। কোথাও নেই। নিশ্চয়ই তাহলে সেটাকে দলা পাকিয়ে পালঙ্কের তলায় ছুড়ে ফেলেছি।

হামাগুড়ি দিয়ে পালঙ্কের তলায় ঢুকে চিঠিটাকে উদ্ধার করে আনতে মাথাটা একটু ঠুকে গেল। মনে হল, তাতে মাথাটা আরো পরিষ্কার হল। কিন্তু চিঠিটা পড়তে মাথা আরো ঠান্ডা করা চাই।

বাথরুমে গিয়ে ওডিকলোনে মাথাটা ধুয়ে ফেললুম। ফ্লাস্কে সকাল—সন্ধ্যায় আমার জন্য বিনা দুধে কফি করে রাখা হয়। তাই খানিকটা খেলুম। তারপর আলো জ্বালিয়ে চিঠিটা আবার পড়তে বসলুম।

এবার পড়ে হাসি পেল। চিরঞ্জীবটা এত ভণ্ড না। ও কি জানে না যে, ওর এত সাবধানতা সত্ত্বেও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের কত খুঁটিনাটি ইতরদের নিত্য আলোচনার খোরাক, ও কি দেখেনি একের পর এক কমার্শিয়াল ছবির পরিচালকেরা কীভাবে আমার শরীরকে নিয়ে পর্দায় এক্সিবিশনিজমের খেলায় মেতেছিল। চিরঞ্জীব সব জেনে—শুনেও আমার গৃহস্থবধূ পরিচয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। অথচ, সত্যি কি এসে যায় যদি সম্প্রতি লোকের মুখে আমার নামের সঙ্গে বিবিধ বিশেষণের মেলায় ‘রাক্ষসী’, কি ‘পিশাচী’, কি ‘ডাইনি’ বিশেষণও যুক্ত হয়। হতচ্ছাড়া সুশান্তটা আবার সত্যি সাংবাদিক—সম্মেলন বাতিল না করে দিয়ে থাকে।

আমি উঠে দরজা খুললুম। দরজার বাইরে আরতি যথারীতি বসে। আমি মধুর হাসিতে ওকে অভ্যর্থনা করলুম।

বললুম, ‘কি খবর?’

‘প্রোগ্রাম—মতো প্রেস—কনফারেন্স হচ্ছে।’

‘ঠিক আছে। আমি তৈরি হচ্ছি। তুমি নীচে খবর দাও। আর তারপর আমার জন্যে কিছু খাবার সাজিয়ে আনো।’

সন্ধ্যা সাতটায় সম্মেলন। ঠিক তার পনেরো মিনিট আগে সুবীরকে সঙ্গে নিয়ে অবনী এল। দুজনকে একসঙ্গে দেখে আমি অবাক। আলাপ শুনলে মনে হয় ওদের মধ্যে যেন কতকালের পরিচয়। শুনলুম যে, অবনী আজই ঘণ্টাখানেক আগে গিয়ে কফি—হাউসে সুবীরের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছে।

সুবীর সাদাসিধে, রং ময়লা, ছিপছিপে গড়ন যুবক। মুখে মিষ্টি লাজুক হাসি। ‘স্বর্গের জানালায়’ ওর প্রথম ছবি। আমি বয়সে ও ব্যক্তিত্বে ওর চেয়ে বড়, খ্যাতনাম্নী নটী এবং আমার মনমেজাজের কূল পাওয়া যায় না—আমার প্রতি কামার্ত যুবকের ভূমিকায় অদ্ভুত অভিনয় করছে ও। আমার রসিকতার জবাবে ওর বুদ্ধির পরিচয়ও পেয়েছি। ওকে দেখে খুব ভালো লাগল।

একটু পরে সুশান্ত এল। কোনো হেয়ার—ড্রেসারের সাহায্যে চুলে টেরি বাগিয়েছে। নতুন কেনা জামাকাপড়ে সেজেছেও খুব। সুবীরের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরল।

‘আমায় অভিনন্দন জানাও।’

সুবীর সহাস্যে ওর সঙ্গে করমর্দন করল।

‘পদোন্নতির জন্যে অভিনন্দন তো? জানালুম।’

আমি সুবীরকে বললুম, ‘অমন কেড়ে না নিলে বুঝি অভিনন্দন জানাতে নেই। আমি যে প্রযোজিকা হলুম।’

‘অভিনন্দন। সুশান্তবাবুকে চান্স দিলেন, সেজন্য দ্বিতীয়বার অভিনন্দন।’

আপনা থেকেই আমার দৃষ্টি চলে গেছে অবনীর দিকে। ও একটু তফাতে দাঁড়িয়ে মলয়ের সঙ্গে নিম্নস্বরে কিছু আলাপ করছে।

আমি বললুম, ‘সুবীর, আজ সন্ধ্যায় আমাদের মধ্যে কে প্রধানতম আকর্ষণ হবে জানো?’

সুবীর আমার দৃষ্টিকে অনুসরণ করেছিল। বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। অবনীবাবুকে কোথা থেকে পেলেন?’

‘সুশান্ত ওকে এনেছে।’

‘ভদ্রলোক যথেষ্ট পড়াশোনা করেন। কনটেমপোরারি সিনেমার সব ফ্যাক্টস ও ফিগারস ওঁর নখদর্পণে।’

হঠাৎ দরজায় চোখ পড়াতে আমি চমকে উঠেছি। সত্যরঞ্জন ঢুকলেন। ঢুকে উনি সোজা আমার কাছে এগিয়ে এলেন।

‘খুব অবাক হয়ে গেছ। না? ঠিক অনিমন্ত্রিত আসিনি। ‘মায়া’র দপ্তরে তোমাদের নেমন্তন্ন গেছল। আমি সেই পত্রিকাটির তরফ থেকে আসছি।’

‘আমাদের সৌভাগ্য।’ আর কি বলব ভেবে পেলুম না।

সুবীর একটু পিছিয়ে গেছে। সত্যরঞ্জন আমার আর একটু কাছে এগিয়ে এলেন।

‘এই কয় মাসেই তুমি কি রোগা হয়ে গেছো। সমস্ত বেদনা তোমায় একা বহন করতে হয়েছে। আমি তো জানি একাকিত্বের কি যন্ত্রণা।’

সঙ্গীতের মতো মধুর সত্যরঞ্জনের কণ্ঠস্বর। এক মুহূর্তেই মানুষের গভীর পর্যন্ত নাড়া দেয়।

উনি অবনীকে দেখিয়ে বললেন, ‘দাশগুপ্তকে পেয়ে তোমাদের খুব লাভ হল।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘আপনাদের আলাপ ছিল?’

‘উঁহু, ও নিজে গিয়ে কয়েকদিন আগে আমার সঙ্গে আলাপ করেছে। আমার নিজ হাতে কপি করা চিত্রনাট্য সঙ্গে করে এসেছিল। কয়েকটা বিশেষ জায়গা নিয়ে আলোচনা করল। ভারী শেখার ইচ্ছে।’

কপিখানা এখন সুশান্তের জিম্মায় থাকার কথা। বুঝলুম, অবনী সেটিকে বগলদাবা করে ঘুরছে। ভারী শেখার ইচ্ছে বটে! অবনী সামনে এসে দাঁড়াল।

সত্যরঞ্জনকে নমস্কার করে সংক্ষেপে বলল, ‘আমাদের সৌভাগ্য।’

‘বাঃ, বাঃ! ইতিমধ্যেই যে প্রোডিউসারের সঙ্গে একপ্রাণতা অর্জন করেছ। মধুরা এইমাত্র অবিকল এই ভাষায় আমার স্বাগত করেছে।’

অবনী স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে। আমি একটু বিব্রত।

সত্যরঞ্জন হাসতে হাসতেই বললেন, ‘ছাঁটাইয়ের খাঁড়া গর্দানে পড়েছে। সেটাকে সুড়সুড়ি বলে ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু, তোমাদের সকলের সৌভাগ্যের এই বহরে আমি দিশাহারা।’

আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। দরজা দিয়ে চুরুট মুখে জনৈক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ঢুকলেন। ‘কলিকাল’—এর সহ—সম্পাদক হরিদাস ভাদুড়ী। অন্যান্য কাগজের জনতিনেক প্রতিনিধিও ওঁর পিছনে পিছনে এলেন। সুশান্ত এগিয়ে গেল। সত্যরঞ্জন দেখলুম সরে যাচ্ছেন। আমি ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছি। শুনি অবনী বলছে, ‘শ্রীমতীজি….’

আমি একটু চমকালুম। ওর ইনটোনেশন অদ্ভুতভাবে জয়ন্তকে স্মরণ করায়। উচ্চারণে একই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য।

অবনী নিম্নস্বরে বলছিল, ‘বিব্রত হবেন না। ইকনমির খাতিরে আপনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের advisability তর্কাতীত। বিশেষত মিস্টার বড়ুয়ার বেলায়, ওঁর ছাঁটাই শাপে বর হয়েছে। উনি এখন একটা ছবিতে সহকারী পরিচালক। তাছাড়া কলকাতার ‘মায়া’ এবং বোম্বাইয়ের ‘The Film-Fortnightly’—তে মোটা টাকার বিনিময়ে নিয়মিত লিখছেন।’

আমার জবাব দেওয়ার কিছু নেই। সুশান্ত দুজন অতিথিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে এল। দেয়াল ঘড়িতে তখন ঢং ঢং করে সাতটা বাজছে।

বোম্বাইয়ের দুই—একজন বড় অভিনেতা—প্রযোজক কীভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন সে—গল্প আমার শোনা। বড় হোটেলে সন্ধ্যা ৭টায় সময় দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে অভিনেতার সেক্রেটারি এবং অভিনেতারই কিছু ইয়ার দেখা দিল। সাংবাদিকরা একে একে আসতে আরম্ভ করল সাড়ে সাতটা থেকে। অভিনেতা এলেন রাত ৯টায়। তিনি নাকি উটিতে শুটিং করছিলেন, বোম্বাইতে পা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছেন এখানে। যাই হোক, ইতিমধ্যে প্রচুর পানীয়ে গলা ভিজিয়ে অধিকাংশ সাংবাদিকই বেসামাল। কেউ আর তর্ক করল না। পনেরো মিনিট গল্প—গুজবের পর অভিনেতা বিদায় নিলেন। পার্টি চলতে লাগল মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। ফেরবার আগে সেক্রেটারির দেওয়া স্টিলস এবং টাইপ—করা রিপোর্ট সাংবাদিকেরা পকেটে ভরল।

আমার এখানে তেমন কাণ্ড হতে দেওয়া হল না। প্রথম দিন সম্মেলন—প্রসঙ্গ আলোচনার সময়েই অবনী method শব্দটি (শব্দটি জয়ন্তেরও প্রিয় ছিল) একাধিকবার ব্যবহার করেছিল। আজ দেখলুম, মলয় ছোকরা যথেষ্ট কমপিটেন্ট এবং সুশান্তও অনলস।

মাত্র পনেরো মিনিট দেরিতে সম্মেলন শুরু করা গেল। টেবিলের একধারে কেন্দ্রে আমি। ডান দিকে আমার পাশে ক্রমশ সুশান্ত, অবনী, বিজন বসু এবং মহিলা—সাংবাদিক প্রীতি সেন। বাম দিকে ক্রমশ সুবীর, স্বদেশ ঘোষ এবং ছবির সহ—নায়িকা মিতা সান্যাল। টেবিলে আমার মুখোমুখি সত্যরঞ্জন এবং তাঁর দুই পাশে অন্যান্য সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারেরা। সবাই পুরুষ। শুরু হবার আগে অবনী আমায় বলেছিল যে, আমাকেই প্রথমে বলতে হবে।

‘মলয় একটা সামারি করেছে; আপনি সেটা একবার দেখবেন কি?’

‘কোনো দরকার নেই।’

সঙ্গত ও শোভন হত যদি আমি বলতে উঠে প্রথমে জয়ন্তের কথা বলতুম। কিন্তু তা পারতুম না। ভয় ছিল, যদি অর্ধপথেই ভেঙে পড়ি। বিশেষত যখন এই ভিড়ে কেউ কেউ ভণ্ড।

বললুম, ‘কত বাধা আছে জেনেও ছবিটি শেষ করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হয়েছে। বাংলা ও হিন্দি ছবির সুরকার রূপে প্রসিদ্ধ বিরাম মুখোপাধ্যায়, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যামেরাম্যান বীরেশ্বর পাল, আমাদের আত্মীয়তুল্য সত্যরঞ্জন বড়ুয়া, এঁদের এবং আরও কয়েকজনকে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাদ দিয়েই ছবি শেষ করতে হবে। অতিরিক্ত ও গুরুতর দায়িত্ব যারা কাঁধে তুলে নিল, আশা করা যায়, তারা যোগ্যতায় সকলকে খুশি করবে। ইউনিটে দুজন মানুষ নতুন—স্বদেশ ও অবনী।’ দুজনের পরিচয় আমি দিলুম।

আমার পরে বলল সুশান্ত। ওর দীর্ঘ প্রতিষ্ঠা—সংগ্রামের কথা দুই—চার কথায় বলে উচ্ছ্বসিত কিন্তু আন্তরিক (ভাগ্যিস সকালে বোতলটা ওর গায়ে লাগেনি) ভাষায় আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল। জয়ন্তের কোনো উল্লেখ ওর মুখেও শোনা গেল না।

তারপর স্বদেশ বলল। মামুলি দু—চার কথা।

আমাদের তরফে শেষে দাঁড়াল অবনী। আমি স্পষ্ট অনুভব করলুম, ও নিজের দিকে উপস্থিত সকলের অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। চেয়ে দেখি ওর মুখে কী দৃঢ় ব্যঞ্জনা! ওর সেদিনকার ভাষণের একটি পদও অ্যালকোহলিজমের প্রভাব স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারেনি।

‘টালিগঞ্জের পরিচালক জয়ন্ত সেনের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। আমি তাঁর ছবিগুলি দেখেছি এইমাত্র। আজ সভার শুরুতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে নীরবতা—পালন বা আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের মধ্যে কারো ভাষণে তাঁর উল্লেখ হয়তো শিষ্টাচারসম্মত হত। এই স্পষ্ট ত্রুটির জন্য ক্ষোভের কারণ দেখি না। কারণ, আমাদের স্মৃতিতে সেই উদ্ধত যুবকটির সঙ্গে শিষ্টাচার সর্বত্র অনিবার্যরূপে যুক্ত নয়। আর শিষ্টাচার দেখাবে কারা? এখানে উপস্থিত কারো কারো মনে যখন অন্যজন সম্বন্ধে অভিযোগ আছে যে, দ্বিতীয়জন জয়ন্তের হত্যাকারী যাতে শাস্তি পায় সেজন্য যথাশক্তি করে নি।’

আমি স্তম্ভিত। অবনীর এ কী দুঃসাহস! দেখি, কেউ আর চোখ তুলতে পারছে না।

অবনী বলছিল, ‘কিন্তু আমি এমন সিনিকও নই যে ভাবব, এই ছবিটি শেষ করার সঙ্কল্প যাঁরা ঘোষণা করলেন, তাঁদের বলার মধ্যে যে—ডেডিকেশনের ভাব দেখলুম, তার সবটাই ফাঁকা আওয়াজ। কারণ, আমাদের অন্তরে প্রেম ও প্রেরণা জাগ্রত করার ক্ষমতা ছিল বৈকি জয়ন্তের। চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা যারা পর্দার উপর ছায়ার মায়া সৃজন করে, অভিনয়—শিল্পীরা যারা পরিচালকের ইঙ্গিতে হাসে—কাঁদে—ভালোবাসে, তারা কেউ কেউ নিশ্চয়ই সেই স্বাস্থ্যবান যুবকের হৃদয়ের উত্তাপ অনুভব করেছিল। যে বাংলাদেশে বিশ্বের মানদণ্ডে উত্তীর্ণযোগ্য পরিচালকের সংখ্যা মোটে দেড়খানা কি আড়াইখানা হবে, সেই দেশে জয়ন্তের মধ্যে আমরা একজন ব্রিলিয়ান্ট পরিচালককে পেয়েছিলুম সেই আমাদের মস্ত লাভ।’

সমস্ত ঘরে কী নিস্তব্ধতা! নীরবতা—পালন বুঝি সভার শুরুতে না হয়ে মধ্যে হচ্ছে। আমার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

অবনী নিজের বক্তব্য শেষ করে আনল, ‘সেই সহৃদয় ও ব্রিলিয়ান্ট পরিচালকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির বিচার হবে সম্পূর্ণ ছবিটি মুক্তির পর। কিন্তু তাঁর প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত ঋণ যতটুকু পারি শোধ করব, এই সঙ্কল্প নিয়ে আজ আমরা অসমাপ্ত ছবিটি শেষ করার দায়িত্ব নিলুম। এই বিনয় যদি আমাদের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে থাকে তো তাহলে আমাদের দিক থেকে এবং আপনারা আপনাদের রিপোর্টে যদি তার উল্লেখ করেন তো তাহলে আপনাদের দিক থেকে এই সভায় দুই পক্ষের মিলন সার্থক হয়। ধন্যবাদ।’

চিত্র—সাংবাদিকদের তরফ থেকে উত্তর দিলেন, প্রথমে সর্বজ্যেষ্ঠ ও শ্রদ্ধেয় নৃপেনবাবু। অবনী সভার সুর যেন নিজহাতে বেঁধে দিয়েছে। সেই সুরেই উনি উত্তর দিলেন। জয়ন্তের মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এই কথা বলে শুরু করে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি শেষ করলেন।

শেষে বললেন সত্যরঞ্জন। সহাস্যে বললেন যে, অবনী—কথিত দুই পক্ষের মধ্যে তিনি দুই পক্ষেই আছেন। তবে কিনা ছবির সংগঠক হিসাবে তাঁর আসল কাজ (অর্থাৎ চিত্রনাট্য—রচনা) তিনি শেষ করেছেন জয়ন্ত বেঁচে থাকতেই। স্বদেশ ও অবনী ছাড়া তিনি আর একটি ব্যক্তিত্বকে স্বাগত জানাচ্ছেন। ঠিক নতুন ব্যক্তিত্ব নয়, পরিচিত ব্যক্তিত্বের নতুন ক্ষেত্রে আবির্ভাব হল—প্রযোজিকা মধুরা দেবী।

এই সব বক্তৃতার পর খাদ্য ও পানীয় এল। সেগুলির সদ্ব্যবহারের ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্নোত্তর চলছিল। প্রশ্নবাণ বেশি সহ্য করল অবনীই।

‘আপনাকে দেখলে আর গলা শুনলে গ্রেগরি পেকের কথা মনে পড়ে।’ সেই সন্ধ্যায় প্রীতি সেন অবনীকে বলেছিল।

‘মনে হচ্ছে এটা প্রশংসা। কিন্তু আমি কি অভিনেতা?’

‘অভিনয়ে নামুন না। নায়কের ভূমিকায় আপনাকে বাংলাদেশ লুফে নেবে।’ এটা সুবীরের মন্তব্য।

‘হুঁ। কিন্তু বাঙালিদের অ—ললিত নায়কদের প্রতি যা বিদ্বেষ, আমায় কেউ টালিগঞ্জের গ্রেগরি পেক না বলে বলবে টালিগঞ্জের দারা সিং।’

সবাই হাসল।

‘আপনার এইম কি?’ জনৈক সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা।

‘আপাতত উত্তমরূপে সহ—পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা। পরের কথা ভাবিনি।’

‘জয়ন্তের বন্ধু ছিলেন আপনি?’ প্রশ্নটি সত্যরঞ্জনের।

‘শুধু জয়ন্ত কেন, অবিনাশও আমার বন্ধু ছিলেন। তাতে আপনার কোনো ভয়ের কারণ আছে?’

অবনীর হাসি শুনে সবাই বুঝল ও রসিকতা করছে। কিন্তু অন্য কেউ হাসতে পারল না।

‘সুশান্তকে এবং মধুরা দেবীকে আপনার যোগ্যতা সম্বন্ধে এত সহজে কনভিন্স করলেন কি করে?’ আরেকজনের জিজ্ঞাস্য।

‘এত সহজে? যাক, ওঁদেরই জিজ্ঞাসা করুন। নিজমুখে আর নিজের গুণপনা প্রকাশ করি কি করে।’

কোন উপায়ে অবনী সুশান্তের পাশে নিজের জায়গা করে নিল, সে—নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। সাধারণত সিনেমা—লাইনে প্রতিষ্ঠা পেতে আত্মীয়—স্বজনের খুঁটির জোর চাই, অথবা একদম তলা থেকে শুরু করে কঠিন চড়াই। অভিনেতার পিছনে একস্ট্রাদের এবং পরিচালকের পিছনে সহ—পরিচালকদের ভিড় সর্বদা লেগে থাকে। এবং কৃপা বিলোতে সবাই কৃপণ। সুশান্তের পুরোনো এবং বেকার বন্ধুর অভাব নেই।

অবনীকে পূর্বে কেউ টালিগঞ্জে দেখেনি। আমার সন্দেহ হয় ওর সিনেমা—লাইনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা। ও নিজে স্পষ্ট করে কিছু বলবে না। আসলে ওর সব বিদ্যে পুথিগত। বাকিটা ও নিজের অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সামলায়। সুবীরকে ও মুগ্ধ করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু কাজের মানুষ সুশান্ত কেন বশ?

সাংবাদিক—সম্মেলনের দু’দিন পরে জয়ন্ত যে কয় রিল ছবি তুলে গেছল, তার প্রোজেকশন হল। আমি উপস্থিত ছিলুম। সুশান্ত rushes দেখেছিল, তবু আবার খুঁটিয়ে সবটুকু দেখল। প্রোজেকশনের ফাঁকে ফাঁকে উপস্থিত কলাকুশলীদের সঙ্গে আলোচনা করল। কিন্তু অবনী প্রায় চুপ। সুশান্ত যেন তা দেখেও দেখল না। শুধু তাই নয়, কোনো রহস্যময় কারণে সে অবনীর সঙ্গে সমীহ করে ছাড়া কথা বলতে পারে না।

অবনীর একটা পরিচয় অবশ্য আছে। চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এসসি পাশ করে ও দিল্লিতে একটা রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিল। অবিবাহিত এবং খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ নেই। বরাবর হোস্টেলে মানুষ। জয়ন্তও হোস্টেলে মানুষ হয়েছিল। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকথা কোনোদিন হয়তো বলেছিল, এখন ভুলে গেছি। তবে ডিগ্রিটা বি.এসসি’ই ছিল। ওর বাড়ি ছিল লক্ষ্নৌতে।

সাংবাদিক—সম্মেলনের সন্ধ্যার আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি। প্রচুর ছবি তোলা হয়েছিল। অবনী নানা কায়দায় একটি ছবিতেও ওর মুখ স্পষ্ট করে আনতে দেয়নি।

শুটিং শুরু করা গেল। বস্তি অঞ্চলের কিছু ছবি তোলা হল টালিগঞ্জে রসা রোডে রেল লাইনের ধারে। বাকি ছবি তোলা হবে দুর্গাপুরে গিয়ে। সে—ব্যবস্থা করার ভার নিল স্বয়ং অবনী। ছবির ব্যবস্থাপক বা মলয়কে না পাঠিয়ে ও নিজেই দুর্গাপুরে রেল এবং ওখানকার একজন ইংরেজ কর্মকর্তার কাছ থেকে সবরকম সুবিধা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে আনল।

টালিগঞ্জে ছবি তোলা শুরু করার দু—একদিন পরে হঠাৎ একরাত্রে অবনীর আসল পরিচয় আমার মনে পড়ল। সেই সাংবাদিক—সম্মেলনে জয়ন্তের ওপর ওর ভাষণ শুনেই মনে পড়া উচিত ছিল। সত্যরঞ্জন তো ঠিকই ওকে জয়ন্তর বন্ধু বলে সন্দেহ করেছিলেন। অবনী জয়ন্তর সহপাঠী এবং সবচেয়ে বড় বন্ধু। জয়ন্তর অ্যালবামে ওর অনেক ছবি দেখেছি। জয়ন্ত বলেছিল যে ওর বন্ধু ভারতের বৈদেশিক দপ্তরে চাকরি নিয়ে বিদেশে থাকে। বন্ধুর প্রশংসা ছাড়া নিন্দে কোনোদিন শুনিনি। অবনীর ছদ্মবেশ ধারণের পিছনে মতলবটা কি?

ভোরবেলাই অবনীকে ফোন করে বাড়িতে আনালুম। তাড়াহুড়ো নেই, নিখুঁত সাহেবি পোশাক, মুখে হাসি নিয়ে ও সামনে এসে দাঁড়াল।

‘আপনাকে অবশ্য বদমায়েশ বলে ভাবতে পারছি না। কিন্তু আপনার এই পরিচয় গোপন করার মানে কি?’

অনেকক্ষণ অবনীর মুখে জবাব নেই। হাসিমুখে শুধু আমায় দেখছিল। শেষে বলল, ‘আমায় খুনে—বদমায়েশ বলে মনে হয় না তো? ব্যস, আমার আসল পরিচয় ভুলে যান। I am after a prize.’

আমি মূর্খ; তাই সেদিন ভেবেছিলুম আমিই সেই পুরস্কার।

‘প্রাণের ভয়ে পরিচয় গোপন করেছি। সময় এলে ভিখারির ছদ্মবেশ খসিয়ে রাজপুত্র হওয়া যাবে।’

‘কিন্তু….’

অবনীর ডান হাতের তর্জনী আমার ঠোঁটের ওপর পড়ল : ‘কোনো কথা নয়, কোনো কথা নয়।’

আমি প্রায় আশা করেছিলুম অবনীর বাহু আমায় ঘিরবে। কিন্তু আমায় যেন সম্মোহিত রেখে আর কিছু না বলে সে বেরিয়ে গেল।

টালিগঞ্জে শুটিং যখন হচ্ছিল আমরা অবনীর ব্যক্তিত্ব দেখলুম। যেদিন শুটিং থাকত, সুশান্ত সকালে আমার বাড়িতে বসে চিত্রনাট্যের খাতা খুলে অবনীকে বুঝিয়ে দিত কীভাবে কাজ হবে। Actual shooting—এর সময় সুশান্ত ক্যামেরাম্যান বিজনের পাশেই প্রায় সারাক্ষণ থাকত। ভিড় সামলানো, উচ্চৈচঃস্বরে আদেশ দেওয়া এবং লোকেশন থেকে যে সমস্ত স্ত্রী—পুরুষ—শিশুকে অভিনয়ে অংশ নিতে ডাকা হত, তাদের কাছ থেকে ঠিক কাজটি আদায় করা—এ—সবের দায়িত্ব ছিল অবনীর ওপর। সাদা ফুলশার্টের হাতা গোটানো, বাম হাতে চিত্রনাট্যের খাতা, ও যখন অসীম ধৈর্যের সঙ্গে এক—একজনকে পরিচালক কী চায় বোঝাত, তখন একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হত। সুশান্ত কেন প্রাণপণে খাটছে বুঝি। এই ছবির সাফল্যের ওপর ওর সমস্ত কেরিয়ার নির্ভর করছে। কিন্তু অবনী খাটছে কি সুখে? দীর্ঘ উপক্রমণিকা কিম্বা অন্য উপলক্ষ্যে ব্যস্ততার ভান করে শেষ পর্যন্ত যারা আমাকেই চায়, আমি তাদের চিনতে পারি। অবনী তাদের দলে নয়।

কাজের মধ্যে ওর ক্রুদ্ধ অথবা বিরক্ত রূপও দেখলুম। কিন্তু যখনই সুবীর বা আমি ওকে ডেকেছি—ও আশ্চর্য স্মিতমুখে সাড়া দিয়েছে। জয়ন্ত সেটে অতিথি বা সাংবাদিক—ফটোগ্রাফারদের বিশেষ আমল দিত না। ওদের সামলাতেন সত্যরঞ্জনই। এখন এই কাজের দায়িত্বও অবনীর ওপর। ওর চাপে আমি (এবং এখন আমার ছবিটিতে বৈষয়িক স্বার্থ রয়েছে) যারা শুটিং দেখতে এল বা খবর নেওয়ার অছিলায় বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করল, তাদের প্রতি আমার ব্যবহারকে যথাসম্ভব সহিষ্ণু ও মধুর করলুম। সাংবাদিক—সম্মেলন চমৎকার উতরিয়েছিল। এখন এই সবের পর বিনা পয়সায় কাগজে কাগজে আমার, আমার ছবির এবং কিছু পরিমাণে অবনীর গুণগান শুরু হল। আমার আনন্দ ধরে না।

যেদিন আমরা দুর্গাপুর রওনা হবো তার আগের রাত্রে চিরঞ্জীব এল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আর দিন দশেক সময় আছে। তারপরই আমরা আইনত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। ভাবলুম ও হয়তো একবার আবেদন করে দেখতে চায়। দেখুক।

চিরঞ্জীব নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে আমায় দেখছিল।

বললুম, ‘বলো।’

ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল; বলল, ‘শুনতে পাই, তুমি আজকাল আবার সুখে আছো।’

‘আছি। আর কিছু শুনতে পাও না?’

‘নতুন লাভার জুটিয়েছো—তাকে বিয়ে করছো নাকি?’

‘তুমি এবার জাহান্নমে যেতে পারো।’

আমি উঠে পড়েছিলুম। চিরঞ্জীব আমার হাত চেপে ধরল।

আমি চাপা—স্বরে গর্জন করলুম, ‘ছেড়ে দাও। আমি একবার চিৎকার করলে আরতি, দারোয়ান সব ছুটে আসবে।’

ও আমায় ছেড়ে দিল। শয়তান হাসছিল।

‘শুনু, আমি গুজবে বিশ্বাস করি বলিনি তো। তোমার সঙ্গে আমার সামান্য কথা আছে।’

‘আমি এখন খুব ব্যস্ত।’

‘আমি জিজ্ঞেস করছি, অবনীকে কোথায় পেলে?’

‘সুশান্ত ওকে এনেছে।’

‘আমার সন্দেহ হয়, ও পুলিশের লোক।’

সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ল চন্দন রায়কে। জয়ন্ত তো কোনোদিন বলেনি ওর বন্ধু পুলিশে চাকরি করে। যাই হোক, আমি কেঁপে উঠেছি।

সামলিয়ে বললুম, ‘ভালোই তো। অবিনাশ আর জয়ন্তের খুনিকে ও ধরতে চায় বোধ হয়?’

‘কিন্তু সাবধান! ও নিজেই না খুন হয়ে যায়।’

আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেছি। চিরঞ্জীবের মুখে কুটিল হাসি খেলে গেল।

‘অবশ্য আমি নিজেও হয়তো নিরাপদ নই। শুনু, তুমি জানো, বিষকন্যা কাদের বলে বল তো?’

‘বেরিয়ে যাও। এক্ষুনি!’ আমি ফেটে পড়লুম।

চিরঞ্জীব বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেল। আমি সেই মুহূর্তে লোক পাঠালুম সুশান্তকে ধরে আনতে।

সুশান্ত যখন সামনে এসে দাঁড়াল, আমি তখন ক্রোধে কাঁপছি।

‘সুশান্ত, আমি কোনো বাজে কথা শুনতে চাই না। অবনীকে কোথায় পেলে?’

‘ম্যাডাম, শ্রীমতীজি, বিশ্বাস করুন, উনি নিজেই এসে ধরা দিয়েছেন।’

‘আহা, বনের সোনার হরিণ আর কি!’ আমি ভ্যাংচালুম, তুমি সত্যি কথা বলবে কিনা?’

‘আজ্ঞে দেখছেন তো, ওঁকে দিয়ে আমরা কত কাজ পাচ্ছি। পাবো জেনেই নিয়েছিলুম। ওঁর সম্বন্ধে আপনি যা জানেন, আমি তার বেশি কিচ্ছু জানি না।’

‘ছবি তোলার বিষয়ে ও কিছুই জানে না। তুমি যে তা বোঝোনি, কি করে বিশ্বাস করবো?’

‘অপরাধ যদি না নেন তো বলি, উনি আপনাকেও ঠকিয়েছিলেন। আমি তো কোন ছার।’

আমার রাগ কমে আসছে। সামনে অপরাধী ছাত্রের ভঙ্গিতে সুশান্ত কথা বলছে। কে জানত, ওটা মিটমিটে শয়তান।

ওকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললুম, ‘বোসো।’

আমি নিজেও তারপর বসে আরম্ভ করলুম, ‘কাল তো তাহলে আমি দুর্গাপুর যেতে পারি না।’

‘কী বলছেন! এমন বিপদে ফেলবেন না। সব ঠিক।’

সুশান্ত জোড়হস্ত হল।

‘কিন্তু অবনী মনে হচ্ছে সাঙ্ঘাতিক লোক। তার পরিচয় না জানা পর্যন্ত কি করে বুঝব যে, সে আমাদের কোনো বিপদে ফেলবে না?’

মরিয়া হয়ে ও বলল, ‘অভয় দেন তো একটা কথা বলি।’

‘বলো।’

‘আজ্ঞে, আমারও মনে হয় অবনীবাবু ছদ্মবেশী কেউ। উনি হয়তো কি বলে….ইয়ে…. আপনার….’

‘বলে ফেল।’

‘মানে, আপনার ভক্ত আর কি।’

‘তারপর?’

‘কোনো লাখপতির ছেলে হবেন। আপনার….কি বলব….সঙ্গটঙ্গ পাবার লোভে সহ—পরিচালক সেজেছেন।’

আজ কল্পনাটি অসঙ্গত মনে হল। যদিও একদিন আমিও ওই ধরনের কিছু একটা কল্পনা করেছিলুম। আমি সামনের দিকে ঝুঁকলুম। সুশান্তর হাঁটুতে আমার হাঁটু ঠোক্কর খেল।

ওর কাঁধে চাপড় মেরে বললুম, ‘কিন্তু আমার প্রেমিকের সুবিধা হলে, তোমার লাভটা কোথায়?’

ঘাড়টাড় চুলকিয়ে লাল হয়ে ও স্বীকার করল, ‘আজ্ঞে, অবনীবাবু কথা দিয়েছেন, আমার প্রথম স্বাধীন ছবিতে উনি নায়ক করবেন।’

সব মিথ্যে! সুশান্তকে এখন হান্টারপেটা করি বা আদর খাওয়াই, ও সত্যি কথা বলবে না। আমার চেয়ে অধিকতর প্রভাবশীল ব্যক্তিত্বে ও এখন পরিচালিত।

তিক্তস্বরে বললুম, ‘তুই সেই সার্কাস—ক্লাউনের মতো, যে একগাল হেসে মুখ থেকে বাইশ গজ হলদে ফিতে বার করে। তোমার বেলায় মিথ্যের ফিতে। যাও।’

ও তড়াক করে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলি। কালকের প্রোগ্রাম কিন্তু সব ঠিক রইল। নমস্কার।’

‘দূর হও, রাস্কেল।’

‘স্বর্গের জানালায়’ ছবির শুটিং শেষ। এখন সুশান্ত সম্পাদনা করছে। তারপর সেন্সরবোর্ডকে দেখানো হবে। ‘এ’—সার্টিফিকেট পাবে না বলেই আশা করছি। সাধুখাঁর বদলে জিতু লাহিড়ি ছবিটির পরিবেশনার স্বত্ব আমাদের পক্ষে অত্যন্ত লাভজনক শর্তে নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রায় সব ক’টি সিনেমা—পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায় প্রচ্ছদপটে আমাদের ছবির স্টিলস ছেপেছে। ঠিক আছে, ১৫ই মে ছবিটি মুক্তি পাবে!

আমি ছোটনাগপুরের নেতারহাটে এসে বিশ্রাম করছি। মলয়কে রাঁচিতে রেখেছি। এখানে সঙ্গে আছে শুধু ঝি, আরতি আর পুরোনো ড্রাইভার সীতানাথ। কলকাতার কেউ আমার ঠিকানা জানে না। বাস—আড্ডা থেকে আমার ভাড়া করা বাংলোটা একটু দূরে নিরিবিলিতে। এখানে আমায় কেউ চিনতে পারেনি। এই স্বাচ্ছন্দ্যটি দার্জিলিং কি মুসৌরি গেলে পাব না। সেখানে আমার মোটরগাড়িখানা দেখেই কেউ কেউ আমার পরিচয় আন্দাজ করবে। শুনছি, এখানে মে—মাসের মাঝামাঝি থেকে লোকের ভিড় বাড়বে।

ছবিটি নিয়ে অনবরতই ভাবি। আর কেবল অবনীকে মনে পড়ে। ওকে আমি কিছুতেই বলতে পারিনি যে, ওর পুলিশ—পরিচয় আমি জেনেছি। আসলে, ওকে পুলিশ বলে ভাবাই যায় না। পুলিশ মানেই যেন যারা ঘুষ খায়, ক্ষুধার্তদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করে এবং মধুরা দেবী ও কংগ্রেসনেতাকে সমান বিশ্বস্ততার সঙ্গে জনতার স্পর্শ থেকে বাঁচায়। চোর—ছ্যাঁচোড়দের মধ্যে মধ্যে ধরে বৈকি। কিন্তু কে কবে শুনেছে (এমন কি গল্পের বইতেও) যে, পুলিশের মধ্যে এমন একটি প্রায়—দুর্লভ ব্যক্তিত্ব কোনো হত্যাকারীকে ধরতে দিনের পর দিন অনন্যকর্মা হয়ে অভিনয় করে চলেছে।

শেষ পর্যন্ত আমি এখানের ঠিকানা দিয়ে রেজেস্ট্রি—ডাকে অবনীকে একটা চিঠি দিলুম।

 নেতারহাট

 ১২ই এপ্রিল

অবনী,

চিঠি পেয়ে বোধ হয় খুব অবাক হয়ে যাচ্ছ। আমি একটা খুব ভালো জায়গায় আছি। রাঁচি থেকে দূরত্ব প্রায় শত মাইলের। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দৃশ্য অপূর্ব। সুশান্তকে তার এডিটিং—এ সাহায্য করা নিশ্চয়ই তোমার বিদ্যার বাইরে। কি নিয়ে দিন কাটাচ্ছ? এমপ্লয়মেন্টের অনেক ভালো ভালো অফার তুমি নাকচ করেছিলে আমার সামনেই। কিন্তু আমার অভিনীত বা প্রযোজিত দ্বিতীয় কোনো ছবিতে তোমাকে পাওয়া যাবে কি?

যাই হোক, ছবির রিলিজের দিন কিন্তু তোমার থাকা চাই। ইতিমধ্যে যদি এখানে দু—দিনের জন্য বেড়াতে আসো, তোমাকে, উৎপাত মনে করব না। প্রীতি নিও। ইতি—

 মধুরা বসু

(আর আমি মৈত্র নই, জানো বোধহয়)

দু’দিন বাদে বিকেলে অবনীর টেলিগ্রাম পেলুম, ‘আমি আসছি।’ আন্দাজ করলুম, পরের দিন দুপুর নাগাদ ও এসে পৌঁছোবে। আজ বিকেলে সালোয়ার—কামিজ পরে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে আরতি আর সীতানাথকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে বেড়াতে গেলুম। সূর্যাস্তের পর ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল।

অন্যদিন সন্ধ্যায় দুই—এক পাত্র শ্যাম্পেন গলায় ঢেলে বাংলোর পিছনের দরজায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আকাশের তারা গুনি, কি গুনগুন করে গান গাই। আরতি যথারীতি পাহারা দেয়। কানে ভেসে আসে বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে সীতানাথ সুর করে তুলসীদাসী রামায়ণ পড়ছে। পাপের মধ্যে থাকলেও বুড়োটার ধর্মভাব যায়নি। কোনোদিন আবার আরতির সঙ্গে ক্যারাম খেলি। আজ কিন্তু টেপ—রেকর্ডারে একটা বিলিতি নাচের বাজনা বাজিয়ে আমি তালে তালে নাচছি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল।

‘কে?’

‘আমি অবনী।’

আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললুম। সামনেই দাঁড়িয়ে অবনী হাসছে। আমি ওর হাত ধরে ঘরের মধ্যে টেনে আনলুম।

‘ইস, তুমি উড়ে এলে নাকি?’

‘না। ট্রেনে ধানবাদ, তারপর বাস, তারপর ট্যাক্সি।’

‘আর তর সইছিল না বুঝি?’

অবনী সুর করে বলল, ‘না, না।’

নাচের বাজনা তখনও বেজে চলেছে।

বললুম, ‘আমার যে খুব তোমার হাত ধরে নাচতে ইচ্ছে করছে।’

‘নাচতে আমিও জানি।’

ও গায়ের কোটটা খুলল। আমি গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলুম।

আমার হাত ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অবনী হঠাৎ বলল, ‘মধুরা, তোমার মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে।’

‘মুছিয়ে দাও’।

‘আমার রুমালটা যে ময়লা।’

বলে, বিব্রতভাবে আমার দিকে তাকাতে আমি আমার রুমালটা দেখিয়ে দিলুম। আমার বুকের ওপর এখন ওড়না নেই। কামিজের নেক—লাইন ক্রমশ সরু হয়ে দুঃসাহসিক গভীরে নেমেছে! তারই ফাঁকে রুমালটি গোঁজা। অবনী সেটি বার করে যত্নে মুখ মুছিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর দুই হাতে আমার মুখখানি তুলে ধরে অধর স্পর্শ করল। আমি ঘনতর হতে পারলুম না। হঠাৎ ভয় হল, অবনীর অধর স্পর্শ করতে গেলে যেন চন্দনের গোঁফের ওপর আমার ঠোঁট পড়বে। আমি সুখে ডুবতে চাইছিলুম।

অবনী বলল, ‘এসো, নাচি।’

‘তুমি এত পথ এসে ক্লান্ত।’

‘ক্লান্তিকে কে ডরায়। হট—চকোলেটেরও দরকার নেই। তুমি আমায় চুমু দিলে না তো?’

আমি ওর ইচ্ছা পূর্ণ করলুম। আমরা দুজনে নাচছি।

এক ফাঁকে আমি বললুম, ‘তুমি বেশি বাড়িয়ে বোলো না। আমি জানি যে, বাড়াবাড়ি তোমার স্বভাবে নেই।’

‘তোমার প্রেমে স্বভাব—চরিত্র আমি হেলায় হারাব।’

অবনী হাসতে হাসতে বলেছিল। আমি জবাব দিলুম তিক্তস্বরে।

‘আমি নটী বলে একথা বলছো?’

অবনী আমার হাত ছেড়ে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

‘মধুরা, ক্ষমা করো। আমি কিন্তু অতশত ভেবে বলিনি।’

ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার নিজের ওপর ধিক্কার জাগল। আমি কিনা ওর অভিনয়ে আর সাজানো কথায় আত্মবিস্মৃত। ও হয়তো এখন হিসেব করছে কীভাবে ভুল চালটার সংশোধন হবে। প্রেমিক হলে পায়ে ধরত, নয়তো সব অভিমান আর লজ্জা উড়িয়ে দিত।

বললুম, ‘সরকারি চাকরিতে ক’ টাকা মাইনে পাও?’

কোটটা তুলে নিয়ে অবনী বলল, ‘আমি চললুম।’

‘সেই চাকরি বজায় রাখতে তুমি অপ্রেমে আমায় আলিঙ্গন করো। তুমি মিথ্যুক ছোটলোক। তুমি লম্পট নটেরও অধম। তুমি পুলিশ।’

অবনী বেরিয়ে গেল। দড়াম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি বিছনার ওপর উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লুম।

পরদিন আমার ঘুম ভাঙল বেলা আটটায়। ঘরের বাইরে বেরোতেই আরতি জানাল যে একটি চাপরাশি ইতিমধ্যে আমার খোঁজ করে বার দুয়েক ঘুরে গেছে। আমার নামে একটি চিঠি আছে।

‘কে লিখেছে?’ আমি উৎকণ্ঠাকে স্বাভাবিক স্বরে ঢাকতে চাইলুম।

‘অবনীবাবু।’

‘আমায় ডেকে তুলিসনি কেন? সীতানাথকে এখুনি পাঠা সেই চাপরাশিটাকে ধরে আনতে।’

আরতি আদেশ পালন করতে তৎপর হচ্ছিল।

‘থাক, কাউকে যেতে হবে না।’

সৌভাগ্যক্রমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চাপরাশিটার পুনরাবির্ভাব ঘটল। নিজের ঘরে দরজা ভেজিয়ে যখন খাম ছিঁড়ে চিঠি বার করছি, উত্তেজনায় আমার হাত কাঁপছে।

 পালামৌ ডাকবাংলো

 সাকাল সাতটা

মধুরা—

আমি জয়ন্তর বন্ধু, সেটাই আমার আসল পরিচয়। যেভাবে ওকে খুন করা হয়েছে, তা ও ডিজার্ভ করত না। সেই হত্যা—রহস্যের সমাধানে আমি নেমেছি। বলা বাহুল্য, আমার প্রাইভেট ক্যাপাসিটিতে।

সরকারি চাকরি আমি করি। এই তদন্তে নামতে প্রয়োজনীয় অনুমতি ও ছুটি যখন চেয়েছিলুম, আমার সে—চাকরি যেতে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত আমার জেদই অবশ্য বজায় থেকেছে। সমস্ত পৃথিবী বাধা হয়ে দাঁড়ালেও কিংবা তোমার মতো শত সুন্দরীশ্রেষ্ঠাকে যদি বলি দিতে হয়, তাহলেও আমি জয়ন্তর হত্যাকারীকে ধরবই।

তুমি যদি পুরোনো বাংলা ফিল্মের নায়িকাদের মতো থপথপ করে হাঁটতে এবং উচ্চকণ্ঠে প্রেমালাপ করতে, তাহলেও তদন্তের প্রয়োজনে তোমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতুম। কিন্তু প্রকৃতি যে তোমায় বিশেষ ভাবে আদর ও ভালোবাসার জিনিস করে গড়েছে। আমার রোমাঞ্চিত ত্বক ও ফুটন্ত রক্ত তার সাক্ষী। আমি একথা লিখতে পরম গৌরব অনুভব করছি যে আমি তোমায় ভালোবাসি, ভালোবাসি। তোমার হৃদয়ও নিশ্চয়ই বেসুরো গাইবে না। ভালোবেসে আমরা পরস্পরকে অল্পই দিতে পারি। তুমি যদি ভাবো যে স্মৃতি ছাড়া আমাদের প্রেমের অন্য কোনো ভবিষ্যৎ আছে—তাহলে তুমি ভ্রান্ত। বর্তমানের কয়টি মুহূর্ত যদি তোমার কাছে মূল্যবান মনে হয়, আমরা আবার একসঙ্গে নাচতে নাচতে ভালোবাসতে পারি।

যদি স্বর্গ থাকত, এই কয়টি মুহূর্তের মূল্য হিসেবে তাকে বাহুবলে জয় করে তোমার পায়ে লুটিয়ে দিতুম। কিন্তু হায়, অসম্ভব—অসম্ভব যে মানুষের অমৃতে অধিকার। তাই বিচ্ছেদ ও মৃত্যু অনিবার্য।

তোমার জবাব পাই ভালো। না পেলেও আশা করি আমার ব্রত তোমার ছেলেমানুষিতে নষ্ট হবে না।

 অবনী

চাপরাশিটাকে ডেকে বললুম, ‘নিয়ে চলো তোমাদের বাংলোয়।’

একটা চড়াই ভেঙে শীঘ্র পৌঁছোনো যায়, চাপরাশিটা সেই পথে আমার আগে আগে চলেছে। হঠাৎ দেখি একটু উঁচুতে অবনী দাঁড়িয়ে।

চাপরাশিটাকে বললুম, ‘পরে এসে বখশিস নিয়ে যেও।’

ছেলেটা লাফাতে লাফাতে দৌড়ে অবনীর পাশ কাটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অবনী দ্রুত নামতে লাগল। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ও যখন কাছে এল আমি তখন রুদ্ধশ্বাস। ও হাসছিল, যেন কিছুই হয়নি। শেষে বলল, ‘ফেরার পথে হাঁটতে তোমার কষ্ট হবে না।’

একটু বাদে আরতি ওরা দেখল অবনী আর আমি হাত ধরাধরি করে গেট ঠেলে ঢুকছি। অবনীর বাম হাতে সুটকেস, সকালবেলা এখনো ওর দাড়ি কামানো হয়নি, শার্টের বোতাম খোলা। ওকে এখন একটু লাজুক—লাজুক দেখাচ্ছে। আর আমি পা ফেলছি যেন স্কুলগার্লদের রেসে প্রথম পুরস্কারটি জিতে বাড়িতে ঢুকছি।

পরের দিন বিকেলে আমরা দুজনে কিছু দূরে একটা ঝরনা দেখতে গেছি। দুটি ধারা এসে একসঙ্গে মিশে নীচে লাফিয়ে পড়ছে। সূর্য যখন পাটে বসেছে, তখন সেই জায়গায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। হঠাৎ আমি বললুম, ‘জানো, আমি এককালে কবিতা লিখতুম।’

অবনী সোল্লাসে হাততালি দিয়ে বলল, ‘আমাদের কপাল ভালো। বোম্বাই ঢাক পেটায় ওদের এক প্রধানা অভিনেত্রী উর্দুতে কবিতা লেখে আর অোমাদের যিনি প্রধানতমা….’

আমি বাধা দিলুম : ‘এই ঠাট্টা কোরো না।’

‘ঠাট্টা!’ অবনী কৃত্রিম গাম্ভীর্য আনল : ‘তুমি জানো না, যারা পদ্য লেখে একদা তাদের প্রতি আমি কি রকম ভক্তি ধরতুম। আজো তার ভগ্নাংশ অন্তরে রয়ে গেছে।’

সেই যাকে বলে বিলোল কটাক্ষ, আমি তারই একটি হানলুম অবনীর প্রতি।

বললুম, ‘ভগ্নাংশ—টগ্নাংশের কি লোভ দেখাচ্ছ এখন! এককালে ও—জিনিসের গোটা গোটা পেয়েছি।’

‘হুঁ। করিমগঞ্জ কলেজের সেই ভক্তিভাজনা মেয়েটিকে আমি বেশ কল্পনা করতে পারি।’

‘আমার জীবনী—সংগ্রহ বুঝি গোয়েন্দার রুটিন—ওয়ার্কের অন্তর্গত ছিল?’

‘আঃ, বাধা দিও না।’ অবনীর গাম্ভীর্য এখন আর কৃত্রিম মনে হচ্ছিল না, ‘যে মেয়েটির কথা হচ্ছিল—স্কুল—জীবন থেকেই সে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হত, অভিনয় করত, চলনসই গাইত এবং কী আশ্চর্য, নিজ গুণেই স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করত।’

‘ভালো লাগছে শুনতে। তারপর?’

‘কিন্তু স্থানীয় তরুণ সঙ্ঘের পরিচালক সত্যরঞ্জন বড়ুয়ার হাতে এই মেয়েটির গুণপনা বহুগুণিত হল। কুঁড়ি যেন এতকাল ভোরের আলোর অপেক্ষায় ছিল।’

‘ইস, তোমাকেও তো অ—কবি বলে ঠেকছে না।’

অবনী আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখখানিকে একটু নাড়িয়ে দিল।

‘এই মেয়েটি যখন মধুর সপ্তদশী ছিল, ক্লাশে অধ্যাপক পড়াতে পড়াতে হয়তো দেখলেন দু—একটি ছাত্র নোট নেওয়া ছেড়ে….’

‘আহা, আর দু—একটি অধ্যাপকেও যে মাঝে মাঝে পড়ানোয় ভুল হয়ে যেত—সে কথা বলতে মুখে বাধছে বুঝি?’

অবনী হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।

‘আমি সে—বিবর্ণ ছবি দেখেছি যাতে তবু চেনা যায় ক্ষেমঙ্করবেশী সত্যরঞ্জনের পাশে মালিনীর মেকআপে মধুরা বসু দাঁড়িয়ে।’

আমার এবার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তবু বললুম, ‘আর কি দেখেছ?’

‘তোমার মনে পড়ে, যে বছর তুমি দিল্লিতে যুব উৎসবে গিয়েছিলে এবং সেখানে তোমার জয়—জয়কার?’

চিরঞ্জীব আমায় প্রথম দেখে সেই বছর দিল্লিতে এবং দেখেই হৃদয় খোয়ায়।

বললুম, ‘মনে পড়ে।’

‘ফিরে এসে তুমি সত্যরঞ্জনকে ছিন্নপত্রের এক কপি উপহার দিয়েছিলে। তার উপহার—পৃষ্ঠায় এই উদ্ধৃতি—

 মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক

 আমি তোমাদেরই লোক।

‘আর তলায় তোমার স্বাক্ষর।’

‘কোথা থেকে তুমি জানলে এত সব কথা?’

‘সত্যরঞ্জন স্বয়ং আমায় সে—উপহার দেখিয়েছেন।’

‘ভালো করেননি।’

‘হয়তো। মধুরা, তোমারও উচিত হয়নি রবি ঠাকুরের লাইন ওভাবে ব্যবহার করা।’

‘কেন?’

‘কবির wishful thinking তোমার জীবনের সেই সন্ধিতে তোমার মুখে প্রতিশ্রুতির মতো শুনিয়েছিল। পরিচিতার কত প্রতিশ্রুতিই তো আমরা ভুলি, কিন্তু মহাকবির পংক্তি বলেই ওতে haunting quality রয়েছে। ওর মিথ্যা ওর মিষ্টত্বে চাপা পড়েছে।’

‘কিছু বুঝছি না।’

কিন্তু একটু একটু যেন বুঝতে পারছিলুম আমি।

‘হায়, কে তোমার বোঝার পরোয়া করে। তুমি তো বিয়ের পর করিমগঞ্জ থেকে কলকাতায় উড়লে। তারপর একদিন চিরঞ্জীবের অন্তঃপুর থেকে ছিটকে, আহা, তোমার বিশ্ব—বিজয়। লন্ডনের বাঙালি ডাক্তারের মনিব্যাগে তোমার কপালকুণ্ডলার স্টিল এবং আফ্রিকান শ্রমিকের ঘরে নোংরা দেয়ালে তোমার সেই হিন্দি ছবির স্টিল যাতে গুপ্তযুগের বারাঙ্গনার ভূমিকায় তোমার উত্তমাঙ্গের সবটাই প্রায় অনাবৃত।’

‘কেন বলছো এসব কথা? আমায় অপমান করতে?’

‘তোমার ভাবার সময় ছিল না যে ভারতবর্ষের পূর্বতম রাজ্যে এক দরিদ্র শিক্ষক তোমার সই করা উপহার সযত্নে রক্ষা করছেন। এবং ভাবছেন যে চিরচঞ্চলের মাঝে স্থির হয়ে থাকার মতনই একটা অদ্ভুত প্রহেলিকায় তোমার করিমগঞ্জের পরিচয় লুপ্ত হয়ে যায়নি। হায়, তা কবেই গেছে।’

‘হয়তো। পরিবর্তন আমাদের কারো কারো জীবনে হয়।’

সন্ধ্যার সেই ঘনায়মান অন্ধকারে আমি যেন অবনীর মুখে আমার মৃতুদণ্ড শুনলুম।

‘মধুরা, তুমি বদলাওনি। তুমি যে নষ্ট হয়ে গেছো! অর্থপিশাচ এবং কামুকে, সাধুখাঁরা এবং বিপ্রদাসেরা তোমায় নষ্ট করে দিল।’

আমি দাঁত দিয়ে অধর চেপে ছিলুম। ফুঁপিয়ে কান্না যেন গলা থেকে বেরোতে না পারে।

বাড়ি ফিরে দেখি বারান্দায় মলয় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

‘আমার ঠিকানা পেলে কি করে?’

‘নেতারহাটে পৌঁছে একটু খোঁজ করতে হয়েছে।’

‘কি দরকার?’

মলয় উত্তর দেবার আগে একবার অবনীর দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকাল। ও চলেই যাচ্ছিল, আমি ধরে রাখলুম।

‘কে তোমায় পাঠিয়েছে?’

‘চিরঞ্জীববাবু।’

‘কেন?’

মলয়ের উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে।

‘চিরঞ্জীবের কোনো কথা কানে তোলার আমার সময় নেই।’

অবনী বলল, ‘চিরঞ্জীববাবু সম্ভবত বিচলিত যে তাঁর ভূতপূর্ব স্ত্রী এবং অবনী দাশগুপ্তকে জড়িয়ে নানা রটনায় বাংলাদেশের গসিপ—কলামনিস্টরা তৎপর হয়েছে।’

‘মলয়, সত্যি?’

মলয় চুপ।

‘কাদের কাগজে বেরুচ্ছে? একজনের নাম করো তো?’

‘চতুর্ভুজ গুপ্ত।’

কুত্তির বাচ্চাটা এসে একবার আমার কাছে কেঁদে পড়েছিল। সেবার ওর কাগজে মিথ্যা খবর ছাপিয়েছিল। এবার সত্য খবর বলেই কী এত তেজ! যাক, অবনীর সামনে আমি মুখ খুললুম না।

অবনী হাসতে হাসতে বলল, ‘শয়তান চতুর্ভুজের এক একটা হাত ভোঁতা তরোয়ালে কচকচ করে কাটলে বোধ হয় তোমার গায়ের ঝাল মিটবে। মলয়, আরতি কোথায় গেল দেখ, আমরা আর একপ্রস্থ চা পান করব।’

আমার হাত ধরে অবনী আমায় ভিতরে নিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে মলয় রাঁচি চলে গেল। অবনী আর আমি ওকে বাস—আড্ডার দিকে খানিকটা এগিয়ে দিলুম। বেড়াতে বেড়াতে ফিরে আসছি, একটি সুবেশ হিন্দিভাষী যুবক আমাদের পথ আটকাল। তার হাতে দামি ক্যামেরা।

ইংরেজিতে আমায় বলল, ‘ক্ষমা করবেন। অনুমতি পেলে আপনাদের যুগলের ছবি তুলি!’

যাকে—তাকে কখনোই আমার ছবি তুলতে দিই না। কিন্তু আজ আমি কিছু বলার আগেই যখন অবনী অনুমতি দিল, আমি আর কিছু বললুম না।

দু—তিনটে ছবি উঠল। অবনী অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে সব ছবিতেই আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। আমি একটু অবাকই হলুম।

ছবি তোলা শেষ হতে আমি বললুম, ‘চেনো নাকি আমায়?’

‘বলতে লজ্জা পাচ্ছি, না। আপনার পরিচয় দিতে আপত্তি আছে?’

‘আছে। সে যাক, যদি কমার্শিয়াল উদ্দেশ্যে এ—ছবি কোথাও ছাপাও তো আইনের প্যাঁচে পড়বে।’

ধন্যবাদ দিয়ে হাস্যমুখে ছেলেটি চলে গেল।

বিকেলবেলা বেড়াতে অবনী বলল, ‘মধুরা, আমি একটা মস্ত বড় অন্যায় করেছি।’

‘বলো।’

‘সকালবেলার ছেলেটি আমারই বন্দোবস্তে এসে আমাদের ছবি তুলল। ওগুলো সম্ভবত পরশুই কলকাতার কাগজে বেরোবে।’

আমি একটু ভাবলুম।

‘অবনী, আমি রাগ করছি না। কিন্তু এ—পন্থা না নিলেই কি চলত না?’

‘আমার হাতে সময় কম। চারদিকের সব রটনার পর এই ছবিগুলি খুনিকে উত্তেজিত করে বের করে আনবে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

আমি বললুম, ‘কীসের তাড়ায় তুমি আমার চিঠি পেয়েই কলকাতা থেকে দৌড়ে এসেছিলে এখন বুঝছি। তোমার ষড়যন্ত্রের সেই beginning of the end নয় কি?’

অবনী একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘প্রমাণ হয়ে গেল যে আমি সত্যই মিথ্যুক, ছোটলোক।’

আমি কিছুই বলতে পারছিলুম না। আমার বুক শুধু এই ভেবে টনটন করছিল যে এইবার সব শেষ!

শেষে বললুম, ‘বাড়ি ফিরে চলো।’

তখন আমরা প্রায় বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছেছি। অবনীকে থামিয়ে বললুম, ‘তোমায় একটা কথা বলব।’

‘বলো!’

‘ইতিহাসে হয়তো একজন কুখ্যাতা নটীরূপে আমার নাম লেখা থাকবে। আমার আলতায় টালিগঞ্জের অন্তত দুজন ট্যালেন্টেড পরিচালকের রক্ত লেগেছিল….’

‘ভুলে যাও এসব কথা।’

‘ভুলেই তো থাকি। না হলে আবার তোমার প্রেমে এমন হাবুডুবু খাই!’

‘অনুতাপ হচ্ছে?’

‘না। শোন, যা বলছি। আজ এই সন্ধ্যায় অনুভব করছি যে রাক্ষসীর নিজের শরীরের রক্ত এবার ঝরছে। তোমার সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদের মধ্যে যেন সেই সব—শেষ— হয়ে—যাওয়া যার অন্য নাম মৃত্যু।’

সে—রাত্রে বারে বারে আমার ঘুম ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আর প্রতিবারই অনুভব করছিলুম যে, অবনীর হাত আশ্বাস দিতে আমার পিঠে রয়েছে। ভোরের দিকে একনাগাড়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম। শুনি অবনী ডাকছে, ‘মধুরা, ওঠো।’

ধড়মড় করে উঠে দেখি, ও গলায় টাইয়ের ফাঁস পরাচ্ছে।

‘আমি চললুম। আর আধঘণ্টা আছি।’

এত তাড়া!

বললুম, ‘আমি নিজেই ড্রাইভ করে তোমায় রাঁচিতে পৌঁছে দেব।’

‘বাসেই যাবো।’

ভালো কথা।

‘আমি যদি তোমায় বাসে তুলে দিয়ে আসি, তোমার ক্ষতি আছে?’

‘সে তো আমার সৌভাগ্য।’

আরতিকে ডেকে চা করতে বলে আমি একলা ঘরে সাজতে বসলুম।

আধঘণ্টা হয়ে গেল। অবনী ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল।

‘মধুরা, আমার যাওয়ার সময় হল।’

আমি বেরিয়ে এলুম। একটা লাল দামি বেনারসি পরেছি, চোখে কাজল, কপালে বড় করে টিপ। অবনী তখন কয়েক চুমুকে চায়ের কাপ শেষ করে কেক আর সন্দেশ পকেটে পুরছে।

আমি শুষ্ককণ্ঠে বললুম, ‘তোমার বউ নই যে, মাথার দিব্যি দিয়ে বলব, সব খেতে হবে।’

ও সহাস্যে বলল, ‘লোভ আমারই।’

বললুম, ‘দিন কয়েকের মধ্যেই হয়তো আমি কলকাতায় ফিরব।’

‘ছবি—রিলিজের দিন আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে।’

আমি ঝি, আরতি, সীতানাথ ওদের ডাকলুম।

‘নমস্কার করো। এঁকে জীবনে আর কখনও দেখতে পাবে না।’

দেখলুম, অবনীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে!

শেষে সুটকেসটাকে হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘চলো।’

‘থাক। আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে গিয়ে তুমি হয়তো বাস ফেল করবে।’

‘বেশ।’

এই মানুষ নাকি আমার পায়ে ইন্দ্রের ঐশ্বর্য লুটিয়ে দিতে পারত।

আরতি ওরা সরে গেছে।

বললুম, ‘তুমি এবার এসো।’

অবনী আমায় দেখছিল।

হঠাৎ বলল, ‘তোমায় এমন কে সাজিয়ে দিলে?’

আমি আর দাঁড়াতে পারলুম না। এক দৌড়ে ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম। কানে শুনলুম, অবনীর ভারী পায়ের আওয়াজ বারান্দা থেকে নেমে ক্রমশ মিলিয়ে গেল। সম্ভবত সচেতনভাবেই অবনীর শেষ কথাটি ছিন্নপত্রের একটি অংশের প্রতিধ্বনি। অংশটি আমারও মুখস্থ—

‘তার বর যদি নেই, তবে তাকে এমন সোনার বিবাহবেশে কে সাজিয়ে দিলে।’

সত্যরঞ্জনের কথা

‘স্বর্গের জানালায়’ ছবিটির মুক্তি আসন্ন। কুলীন পত্রিকাগুলিতে পর্যন্ত তার পাতা—জোড়া বিজ্ঞাপন। অন্যদিকে কুৎসাপ্রিয় পত্রিকাগুলিতে মধুরার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে জল্পনা—কল্পনার শেষ নেই। জল্পনা—কল্পনার মধ্যে সত্যের ভিত্তি নেই, তা বলা চলে না।

বাংলা দৈনিক ‘সন্দেশ’ ও চতুর্ভুজের সাপ্তাহিক ‘রূপবাণী’ অবনী ও মধুরার ঘনিষ্ঠ ছবি ছাপল। সেই সঙ্গে এই খাঁটি খবর যে, চিরঞ্জীব মৈত্রের স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হয়ে গেছে এবং মধুরা এখন ইচ্ছামতো দ্বিতীয় পতি বরণ করতে পারে। ওর ছেলের সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা হয়েছে, তা অবশ্য কোনো কাগজেই লেখেনি।

‘রূপবাণী’তে ছবি বেরুবার কয়েক দিন বাদেই মধুরা কলকাতায় ফিরল। প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ সে করল না! কয়েকজন প্রযোজক লাখ—দেড় লাখ টাকার প্রস্তাব নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আপাতত ও কোনো ছবিতে নামার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখতে রাজি নয়। অবনী এখন কলকাতায় এবং কি করছে সে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছিল এমন একাধিক পরিচালক বা প্রযোজক ওকে অভিনেতা বা সহকারী পরিচালকরূপে পেতে আগ্রহী।

অনেকেই অনুমান করছে যে, অবনী আসলে মধুরাকে পাবার লোভেই ওর তারকায়িত ছবির সংগঠকবৃন্দে জায়গা করে নিয়েছিল। ছবি মুক্তি পেলে তারপর দুজনের বিয়েটা হবে। ছাপার অক্ষরে কেউ না লিখলেও দু—একজনের ধারণা বিয়ে ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এবং ছোটনাগপুরে দুজনের মধুচন্দ্রিকাযাপন শেষ।

এসব অনুমানের কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা জানি না। একটি জিনিস নিশ্চিতরূপে জানি—মধুরা অবনীর প্রেমে পড়েছে।

সেই সাংবাদিক—সম্মেলনের দিন থেকে যারা অবনীকে লক্ষ করে আসছে, তাদের মধ্যে আরও দুটি সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা—কল্পনা আছে। এক, অবনী জয়ন্তের কোনো আপনার জন। দুই, ও ছদ্মবেশী গোয়েন্দা।

কিছুই অসম্ভব নয় যে, অবনী একাধারে একজন গোয়েন্দা, জয়ন্তের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল এবং তদন্তের প্রয়োজনে সে সিনেমা—কর্মীর ছদ্মবেশ নিয়েছে। মধুরা তার সত্য পরিচয় জেনে হোক বা না জেনে হোক তার প্রেমে পড়েছে।

অসম্ভব নয়, তবে অবনীকে একই সঙ্গে জয়ন্তের বন্ধু, মধুরার প্রেমিক এবং পুলিশের একজন বলে ভাবা যেন অসঙ্গত। বিশেষত, অবিনাশ ও জয়ন্তের হত্যাকারীর বিরুদ্ধে আদালতে গ্রাহ্য হবে, এমন প্রমাণ সহস্র চেষ্টাতেও যখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তখন এত কাঠখড় পুড়িয়ে লাভ?

১৫ই মে তারিখের দিন সাতেক আগে সুশান্ত নিজে আমায় নেমন্তন্ন করতে এল। শুনলুম, ১৪ই রাত ৯টায় দক্ষিণ কলকাতার ফ্যাশনেবল হল ফাল্গুনীতে একটি বিশেষ শো’তে নিমন্ত্রিতদের সামনে ছবিটির প্রথম প্রদর্শন হবে।

আমি বললুম, ‘আমি যেতুমই। ছবিটির সংগঠকবৃন্দে একদা ছিলুম বলে ও—ছবির ওপর আমার বিশেষ মায়া।’

‘একদা বলছেন কেন। সহকারী—পরিচালক দ্বয়ের মধ্যে আপনার নাম প্রথমে, তারপর মিস্টার দাশগুপ্তের।’

‘সেদিন অবনীর দেখা পাওয়া যাবে তো?’

‘নিশ্চয়ই। ছবি শুরু হবার আগে উনিই দর্শকদের উদ্দেশে দু—চার কথা বলবেন।’

‘প্রযোজিকা নয়, পরিচালক নয়, সহকারী—পরিচালকের ওপর এ—সম্মান।’

‘শ্রীমতীজির বিশেষ ইচ্ছে। মামুলি বক্তৃতা নয়, উনি লেট মিস্টার সেন সম্বন্ধে সামান্য বলবেন। সেই সাংবাদিক—সম্মেলনের দিন আমরা শুনেছি, উনি এ—কাজের কত যোগ্য।’

ফাল্গুনীর লবিতে দাঁড়িয়ে দেখছিলুম, একে একে গণ্যমান্য অতিথিরা আসছেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন ব্রিটিশ কাউন্সিল, ফিল্ম—সোসাইটি, পুনার ফিল্ম—ইনসটিটিউট (ওখানে জয়ন্তের নামে একটি বৃত্তি দেওয়ার বন্দোবস্ত হবে), পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রীসভা এ—সবের প্রতিনিধিরা। আঞ্চলিক ফিল্ম—সেন্সর বোর্ডের জনৈকা মহিলা—সদস্যাও আসছেন। প্রসঙ্গত, ছবিটি সেন্সরের কাঁচি থেকে বাঁচলেও শুধু বয়োপ্রাপ্তদের জন্য অনুমোদিত। দু—চারজন সাহিত্যিক এবং সিনেমা—সাংবাদিক বলে সামান্যও পরিচয় আছে এমন সকলেই। সন্দেশের সম্পাদক ও চতুর্ভুজও বাদ পড়েননি। আর, ফিল্ম—ট্রেড যে তার সকল শাখায় যথাযোগ্যভাবে রিপ্রেজেন্টেড তা না বললেও চলে। শোনা যাচ্ছে, ছবির অপহৃত কাহিনিটিকে কেন্দ্রীয় ফিল্ম—অ্যাওয়ার্ড কমিটি বছরের শ্রেষ্ঠ চিত্র—কাহিনি হিসেবে পুরস্কার দেবেন। মজা মন্দ নয়।

অভ্যর্থনার আয়োজনে নেতৃত্ব করছিল সুশান্ত ও মধুরা। মধুরা অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে সেজেছে। একটু শুষ্ক ও চঞ্চল মনে হচ্ছিল ওকে। আমায় দেখে শুধু একটু হাসল।

সুশান্ত বলল, ‘সত্যদা, আপনি দয়া করে একটু আমাদের পাশে দাঁড়ান।’

ভিড়ের মধ্যে সামান্য চাঞ্চল্য। দেখি, মন্ত্রীমশায় কৃষ্ণকিশোর গোস্বামী আসছেন। খুব প্রফুল্ল এবং একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সঙ্গে সেন্সর—বোর্ডের মহিলা—সদস্যা। ওঁদের যত্ন করে নিয়ে এল অবনী। প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও চওড়া কাঁধ সামান্য ঝুঁকিয়ে ওর সেই বলিষ্ঠ হাঁটার ভঙ্গি। ঝকঝকে হাসিতে মুখ ভরে রয়েছে। মন্ত্রীমশায় এবং তাঁর সঙ্গিনীর সঙ্গে অবিরাম কথা বলছে। তারই ফাঁকে এক—একবার ডাইনে—বাঁয়ে দেখছে। আমার হঠাৎ সন্দেহ হল সেই লবিতে উপস্থিত প্রত্যেকটি ব্যক্তি যেন এবার অবনীর নজরের জালে বন্দি হয়ে গেছে।

অবনীই মন্ত্রীমশায়ের ও তাঁর সঙ্গিনীর সঙ্গে মধুরা, সুশান্ত ও আরো দু—চারজনের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর মধুরা দুজনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে হলের দ্বিতলে চলে গেল।

অবনী আমার সামনে এসে আমায় নমস্কার করে দাঁড়াল।

‘সত্যদা, মন্ত্রীমশায়ের সঙ্গে যখন সকলের আলাপ করাচ্ছিলুম, আপনি কোণের দিকে সরে পড়েছিলেন কেন?’

‘যেতে দাও ভাই। আমরা নিরীহ মানুষ। তোমার খবর কি?’

‘ভালো।’

‘অনেক দিন তো ডুব মেরে ছিলে। আজকের পর আবার ডুব মারবে তো?’

‘ইচ্ছে সেই রকমই। কিন্তু প্রযোজিকা আমার পাওনাগণ্ডা এখনো পুরো মেটাননি।’

ও যেভাবে হাসল তাতে মনে হয়, পাওনাগণ্ডা এমনই ভারী যে মেটাতে গেলে স্বয়ং মধুরাকেই বিকিয়ে যেতে হয়।

সুশান্ত আমাদের দিকে একটু ঘেঁষে এসে অর্থপূর্ণভাবে কাশল। আমি ওর দিকে তাকালুম। অবনী আমার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। পিছন ফিরে আমি চমকিত। চিরঞ্জীব মৈত্র!

অবনী ওঁর সামনে গিয়ে নমস্কার করে বলল, ‘আমাদের সৌভাগ্য!’

চিরঞ্জীব প্রতি—নমস্কার করলেন না। কালো চশমার ভেতর দিয়ে উনি অবনীকে দেখছেন বোঝা গেল। শেষে বললেন, ‘তোমায় দেখতেই এসেছিলুম। তোমার সাফল্য কামনা করি।’

উনি ঘুরে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে অবনীর হাত পড়ল ওঁর কাঁধে।

‘চিরঞ্জীববাবু….’

শান্ত স্বরেই বলছিল অবনী। কিন্তু চিরঞ্জীব যেভাবে নিজের কাঁধের ওপর রাখা ওর হাতের দিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন, তাতে মনে হল এখনই বুঝি একটা কাণ্ড বাধে। সুশান্ত আঙুল মটকাল।

অবনী বলছিল, ‘এই শো’—তে আপনাকে নেমন্তন্ন করতে আমি দু—দুদিন আপনার বাড়ি গেছি। আপনি ঝুটা বাহানায় দেখা করেননি। এখন যখন একবার এসে পড়েছেন আপনাকে ছাড়ব কেন?

চিরঞ্জীব তখন অবনীর মুখোমুখি।

অবনীর কঠোর স্বর শোনা গেল, ‘মিতা, চিরঞ্জীববাবুকে সসম্মানে ওপরে নিয়ে যাও। যান।’

শোয়ের প্রথম ওয়ার্নিং বেল ক্রিং—ক্রিং করে বাজল।

মিতা সান্যাল সামান্য দূরে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকেই কোনোরকমে বলল, ‘আসুন।’

চিরঞ্জীব দেখলুম শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মী ছেলেটির মতোই মিতাকে অনুসরণ করলেন।

সুশান্ত অবনীকে বলল, ‘মিস্টার দাশগুপ্ত, এবার সময় হয়েছে।’

‘হ্যাঁ। আপনি ওপরে যান।’

সুশান্ত চলে গেল। নিমন্ত্রণ পত্রে বিশেষ ভাবে নির্দেশ ছিল যে যথাসময়ে সকলকে আসন গ্রহণ করতে হবে। লবি এখন দ্রুত ফাঁকা হয়ে আসছে। হলের বাইরে পুলিশ যে উদ্বেলিত জনতাকে ঠেকিয়ে রেখেছে, তাদের গলাবাজি ভেসে আসছে। লবিতে এখন আমরা দুজন ছাড়া হলের দু—একজন কর্মচারী এবং যারা এতক্ষণ পানীয় সরবরাহ করছিল, তাদের কাউকে কাউকে দেখা যাচ্ছে।

লবির বাঁ—দিক থেকে একটি লম্বা সঙ্কীর্ণ প্যাসেজ চলে গেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির দর্শকেরা ওই প্যাসেজ—সংলগ্ন দুটি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। বিশেষ প্রদর্শনী বলে দরজা দুটি এখন বন্ধ। প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটি বিশেষ দরজা আছে। সেটি খোলে ঠিক পর্দার প্ল্যাটফর্মের পাশে। বুঝলুম অবনী ওই তৃতীয় দরজাটি দিয়ে ঢুকে প্ল্যাটফর্মে উঠে দর্শকদের সম্ভাষণ করবে।

অবনী আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যদা, আপনি এখনো ওপরে আসনে গেলেন না?’

‘একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি। তবে ভেবো না, তোমার বক্তৃতা আমি ঠিক শুনবই।’

দ্বিতীয় ওয়ার্নিং বেল বাজল ক্রিং—ক্রিং করে।

হলের একজন usherer টর্চ হাতে অবনীর দিকে এগিয়ে এল।

অবনী বলল, ‘আমাকে পথ দেখাতে হবে না। তুমি হলের মধ্যে যাও।’

আমি দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। অবনী যাচ্ছে সেই প্যাসেজের দিকে। আমি যখন প্রথম ল্যান্ডিং—এ এসে দাঁড়িয়েছি, তখন লবি ফাঁকা। ক্লোকরুম—অ্যাটেনড্যান্ট নিজের খোপে এবং লবির দুজন দ্বারীই দরজার বাইরের দিকে। আমি আরো কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙে দ্বিতীয় ল্যান্ডিং—এ পৌঁছোলুম। দেয়ালে মানুষ—প্রমাণ আয়না। তাতে নিজের চেহারাখানা দেখছি। শুনি শেষ ঘণ্টি বাজছে। ক্রিং—ক্রিং। মানে, এখুনি হলের সব আলো নিভে যাবে। পর্দায় জয়ন্তর ছবি প্রতিফলিত হবে। তা মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে একটি ছোট্ট আলো জ্বলবে। অবনী এসে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশে কথা শুরু করবে।

আমি নীচে নেমে এলুম। ক্লোকরুমে একটি প্যাকেট জমা দেওয়া ছিল। টোকেনটি দিয়ে সেটি চাইলুম। কর্মচারীটি অবাক হল, কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করল।

আমি দ্রুতপদে অবনী যে প্যাসেজ ধরে এগিয়ে গেছল সেদিকে চললুম। পিছনে দেখলুম, না, কেউ আমায় অনুসরণ করেনি। একটি অন্ধকার কোণ বেছে নিয়ে আমি দাঁড়ালুম। প্যাকেট থেকে বেরোল একটি রিভলবার।

এক—একটি মুহূর্ত কাটছে যেন এক—একটি যুগ। অন্য বক্তৃতা হলে হাততালি পড়ত, এতে তার অবকাশ নেই। অবশেষে কোণের দরজা খুলে গেল। আমি প্রস্তুত। যে মুহূর্তে বুঝলুম অবনীর সুট—পরা দীর্ঘকান্তি বাইরে বেরিয়েছে, গুলি করলুম। আগ্নেয়াস্ত্রের কী গর্জন! ওর বুক লক্ষ্য করে পর পর তিনবার। শরীরের পতন দেখে বুঝলুম শেষ হয়ে গেছে। চিৎকার করার পর্যন্ত ফুরসত পায়নি। আমি এক মুহূর্ত ভাবলুম পালাবার চেষ্টা করব কিনা। তারপর রিভলবারটাকে কপালের পাশে চেপে ধরেছি। আত্মহত্যাই শ্রেয়। কিন্তু ঘোড়া টেপার আগেই কেউ আমার হাত থেকে এক ঝটকায় রিভলবারটা কেড়ে নিল। জোর আলো জ্বলে উঠেছে। আমি ইন্সপেক্টর রঞ্জিতবাবুর হাতে বন্দি। হলে প্রচণ্ড গণ্ডগোল হচ্ছে।

আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে রঞ্জিতবাবু আমায় লবিতে টেনে নিয়ে গেলেন। হলের লোকেদের বেরুতে দেওয়া হয়নি। গুলির আওয়াজের কোনোরকম একটা ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের শান্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে কনস্টেবলরা জড়ো হয়েছে! কেউ কেউ নিশ্চয়ই মন্ত্রীমশায়ের রক্ষী হিসেবে এসেছিল। ষড়যন্ত্রের জাল পেতেছিল অবনী আর রঞ্জিতবাবু। যাক, অবনীকে আমি নিজ হাতে মারতে পেরেছি।

রঞ্জিতবাবু হুকুম দিলেন, ‘পায়ে বেড়ি পরাও। লোকটা সাংঘাতিক খুনে বদমায়েশ।’

আমি চুপ। শুধু অনুতাপ হচ্ছে, শেষবার ঘোড়াটা টিপতে এক মুহূর্ত দেরি করে ফেললুম কেন!

হঠাৎ ভূত দেখার মতো আমি চমকে উঠেছি। অবনী অক্ষত দেহে প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে আসছে।

‘একি, আমার তিনটে গুলি খেয়েও তুমি মরোনি!’

‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একটা ডামি আপনার গুলিগুলো খেয়েছে।’

ক্লান্তকণ্ঠে আমি বললুম, ‘শিগগির আমার ফাঁসি হোক। নরক থেকে আবার উঠে আসব তোমায় খুন করতে। তোমাকেই।’

শুনতে পাই, ‘স্বর্গের জানালায়’ পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে সগৌরবে চলছে। যাদের কল্পনা অন্যের ব্যক্তিগত কুৎসায় অদ্ভুত বেগ লাভ করে, তারা সম্প্রতি মধুরার লোক—লোচনের বহির্ভূত জীবন সম্বন্ধে প্রত্যাশার অতিরিক্ত তথ্য পেয়ে উল্লসিত। ছবি ভালো চলার সেও নিশ্চয়ই একটা কারণ। ছবিটির প্রচারের জন্য যে—ব্যয় নির্দিষ্ট, আমি সঙ্গতভাবেই তার কিছু শতাংশ দাবি করতে পারি।

অবশ্য, বলা দরকার যে বিচারে কোনো পক্ষ থেকেই মধুরাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হয়নি। আমি দোষ স্বীকার করে নিয়েছি বলে পুলিশপক্ষ অপরাধের মোটিভ প্রমাণের জন্য বিশেষ বাগবিস্তার করেনি। অবনী নাকি স্বয়ং গিয়ে চতুর্ভুজ গুপ্ত ও সন্দেশ—সম্পাদককে ধমকে এসেছে। এবং অন্য সম্পাদকদের অনুরোধ করেছে যে মধুরা ও আমার সম্পর্ক নিয়ে ছাপার অক্ষরে যেন স্বল্পতম সম্ভব উল্লেখমাত্র থাকে। কিন্তু, লোকের মুখে কে তালা দেবে?

অস্কার ওয়াইল্ড তার ‘ডি প্রোফন্ডিস’ শুরু করেছে এই বলে যে ভবিষ্যতের ইতিবৃত্তে তার স্থান নির্দিষ্ট হবে Gilles de Retz এবং Marquis de Sade—এদের মাঝামাঝি। আমার স্থান সম্ভবত হবে homicidal maniac ও বিকৃত যৌনাচারীদের দলে। আহা, নরকে খোকা গুন্ডা, চেসম্যান এবং নবোকভের নায়ক আমায় সঙ্গ দেবে।

অবিনাশ এবং জয়ন্তকে খুন করার জন্য আমি অনুতপ্ত নই। তারা ভদ্রলোক ছিল না। কিন্তু আসল শত্রুকে চিনতে আমার ভুল হয়েছিল। চিরঞ্জীব মৈত্র। মধুরার জীবনের শ্লেটে মুক্তোর মতো পঙক্তি পরের পর লেখা হচ্ছিল। চিরঞ্জীবের নোংরা হাত অর্থলালসার লালায় ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে সে—শ্লেট মুছে দিয়েছিল। তারপরই অন্ধকার। মত্ত এবং বেয়াদব মানুষের যেন শোভাযাত্রা চলেছে। শ্লেটখানিকে কোলে নিয়ে সবাই যা—খুশি লিখবে, কাটবে, মুছবে। অন্তত দুজন বেয়াদবকে আমি স্বস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি, এই আমার সান্ত্বনা। দুশোজন বেয়াদবকে শাস্তি দিতে আমার হাত কাঁপত না। ক্লাসের চল্লিশটা ছেলেকেই কতদিন একসঙ্গে নীলডাউন করে দিয়েছি।

কিন্তু এই বড় আশ্চর্য যে আমরা শুরু করি এক লজিক দিয়ে, শেষ করি আরেক লজিক দিয়ে। এই বড় পরিতাপ যে দাবার চালের মতো জীবনের চাল ফেরত নিয়ে অপেক্ষাকৃত নিখুঁততর লজিকে আবার এগোনো যায় না। নাকি, জীবনের মধ্যে লজিকের অস্তিত্বই শুধু ভান?

অবিনাশ ও জয়ন্তকে যে মেরেছে, সে—ই আবার অবনীকে মারতে অস্ত্র তোলে কোন লজিকে? এক পাপ অন্য গুরুতর পাপের পথে আমাদের গড়িয়ে দেয়—এই কি সূত্র?

আমার কোনোকালে সন্দেহ হয়নি যে অবনী ভদ্রলোক নয়। ‘রূপবাণী’তে যখন ওর মধুরার ঘনিষ্ঠ ছবি ছাপল, চারদিকে যখন কানাকানি হচ্ছে যে দুজনে নেতারহাটে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছে, তখন আমি ঈর্ষার নরকাগ্নিতে দগ্ধ হচ্ছি। সেই তখনো আমার মনে হচ্ছিল যে সব রটনা কোনো কৌশলীর ফাঁদ। ফাঁদই তো ছিল। আমাকে এক উন্মত্ত ও বুদ্ধিহীন কর্মে প্রেরিত করতে। বালক বয়সে গোয়েন্দা—কাহিনিতে পড়তুম যে খুনি বিপদ বুঝলেই গোয়েন্দাকে খুন করতে অস্ত্র তোলে। সেই লজিক কি আমাকেও পেয়ে বসেছিল?

অবনীর ফাঁদের অঙ্গ ছিল এই ধারণার সৃষ্টি যে ছবির মুক্তির দিন ওকে পাওয়া যাবে, নয়তো আর কোনোকালে নয়। আমি রিভলবারটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম। অবনী চেষ্টা করে এমন সেট সাজাল যে মনে হল ওকে খুন করার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। সাবাশ পরিচালনা!

রঞ্জিতবাবু ওত পেতে বসেছিলেন আমি জানতুম না। আমি জানতুম যে চেষ্টা করলে খুন করে পালানো যায়। কিন্তু আমি সেদিকে বিশেষ চেষ্টাই করলুম না।

আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলুম। ছোটবেলায় যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমি রবি ঠাকুরের কবিতায় পড়েছিলুম—’মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সে—মন্ত্র আমার কাছে অর্থপূর্ণ ছিল।

অবনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার আগেই আমি চমকে জেগে দেখেছিলুম যে আমি শেষ হয়ে গেছি, মৃত্যু ছাড়া আমার অন্য পথ নেই। সংক্রামিত মৃত্যু। আমি জেনেছিলুম, মধুরা নিজের সর্বাঙ্গে সেই মৃত্যুর শীতলতা বহন করে ছোটনাগপুর থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু মনে হয়েছিল, অসম্ভব আমার পক্ষে এই ক্লৈব্য যে অবনী অক্ষত থাকবে। ‘এক কাজ বাকি আছে এ—জীবনে, সেই হোক প্রাণেশ্বর।’

মধুরা ছোটনাগপুর থেকে ফিরেছে খবর পেতেই আমি ওকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলুম। জবাব দিল মলয়।

‘কোনো মেসেজ থাকলে আমায় দিতে পারেন। ওঁর পক্ষে এখন ফোন ধরা সম্ভব নয়।’

‘আমি অবিলম্বে মধুরার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘ওঁকে বলব। উনি সময় নির্দিষ্ট করে দিলে আপনাকে জানাব। নিশ্চিন্ত থাকুন।’

দু—দিন কাটল। বুঝলুম ওদিক থেকে সাড়া পাবো না। গেলুম দেখা করতে। খোঁজ নিয়ে এমন সময়ে যখন মলয় অন্যত্র। দারোয়ান আমায় চেনে। গেট খুলে দিলে। কিন্তু জানালে যে এত রাত্রে তো শ্রীমতীজির সঙ্গে দেখা হবে না! বললুম, আমার আরতির সঙ্গে দেখা করা দরকার।

বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বসলুম। চাকর আমার স্লিপ নিয়ে ওপরে গেল। খবর এল আরতি আসছে।

আরতি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলুম। সিঁড়ির মাঝামাঝি আমি ওর মুখোমুখি হলুম। আমার ভাগ্যক্রমে চাকরটা আমায় অনুসরণ করেনি।

আরতি স্পষ্ট করে বলল, ‘আপনার সঙ্গে উনি দেখা করবেন না।’

‘হঠাৎ ওর অনুগ্রহের এমন অভাব কেন? তুমি জানো, জানো নাকি, ওর শয়নকক্ষের দরজা ও নিজেই একদিন খুলে আমায় ঢুকিয়েছিল।’

‘আপনি বেরিয়ে যান।’

‘বাক্যটি যার মুখে শুনলে কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশবে….’

অনুমান করি, কুৎসিত হাসিতে তখন আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। সেই মুখ আমি আরতির মুখের কাছে নিয়ে গেছি। ওর কানে কানে কিছু বলতুম কি? ঠাস করে ওর হাতের চড় পড়ল আমার গালে। আমি তখন উন্মত্ত। হয়তো সেইখানেই আরতিকে হাত—মুখ বেঁধে রেখে আমি ওপরে উঠে দরজা ভেঙে মধুরার ঘরে ঢুকতুম। কিন্তু সেই মুহূর্তে সিঁড়ির মুখে মধুরা এসে দাঁড়াল।

‘আরতি, ওঁকে আসতে দাও।’

মধুরা ঘরে ফিরে গেল। আমি একটি—একটি করে সিঁড়ি ভাঙছি। এক—একবার মনে হচ্ছে ছুটে পালাই, আবার মনে হচ্ছে ক্রোধে চিৎকার করি।

মধুরা দরজার দিকে মুখ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতক্ষণ বোধ হয় চুল বাঁধছিল। ওর পিঠময় কালো চুলের রাশ। একটা সাদা পাতলা ড্রেসিং গাউন পরে রয়েছে। পিছনে টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্পের আলো ওর আপাদমস্তকে প্রতিফলিত। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ওর শরীরের রেখা। শিল্পী—শ্রেষ্ঠের এই মনোরম ভাস্কর্য কি লোকালয়ের নয়? মানুষের প্রেমের নয়?

আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলুম।

মধুরা বলল, ‘বেহায়া, পশু! বলো আজ কোন ভঙ্গিতে তোমার সেবা করি?’

ওর পায়ে পড়ে আমি বললুম, ‘দয়া করো।’

মধুরা হাসল। শুষ্ক বিদ্রুপপূর্ণ হাসি।

‘দয়া না করলে তো কালকেই তোমায় ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হবে।’

‘কি?’

‘অবিনাশকে তুমিই খুন করেছিলে। আমি তখন বুঝিনি। কিন্তু অর্জুন আগরওয়ালার বেশে তুমিই ছিলে, না? সেকথা আমি পরে ক্রমশ বুঝেছি।’

ওর স্বরে কোনো ক্রোধ ছিল না। যেন সুদূর থেকে বিষণ্ণ স্বর ভেসে আসছিল তার। আমি ওর পায়ে লুটোচ্ছিলুম। ও ইচ্ছা করলে আমার মাথায় লাথি মারত। কিন্তু কিছুই করল না সে।

‘চিরঞ্জীব আমায় বিষকন্যা বলেছিল। আমার কোনো প্রেমিক বাঁচবে না। তুমিও মরবে। শেষ খুনটা আমাকেই করো না।’

শেষ বাক্যটি আমার কানে বড় করুণ শোনাল। বললুম, ‘মধুরা কি হয়েছে তোমার?’

ও চুপ। আমি উঠে দাঁড়ালুম।

হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘অবনী….’

মধুরা তীব্র চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘ভাবছো, এবার অবনীকে খুন করবে? পারবে না, আমি বলছি। কেন জানো?’

আমার দুই হাত ছিল মধুরার কোমরে। টের পেলুম, ভেতরের কোনো আবেগে সে এখন কাঁপছে।

‘কারণ….কারণ সে আমায় ভালোবাসেনি। তিন দিন তিন রাত সে আমার ঘরে ছিল, তবু সে আমার প্রেমিক নয়। তোমার নোংরা হাত তাকে ছুঁতে পারে না।’

ওর চোখের জল দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আজ প্রথম দেখলুম, ওর চোখের কোলে কালি, ওর বয়স হয়েছে। প্রেম এ—নারীর জীবনে শুধু স্মৃতি। এমনকি এর শরীরেও আর উৎসাহ নেই আলিঙ্গনে। দরজা খুলে পালিয়ে এলুম আমি।

আজ আর স্মরণ নেই, তারুণ্যের কোন প্রভাতে আমার জীবনেও নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। পাখি গান গেয়েছিল, রৌদ্রের আশিস মাথায় ঝরেছিল। তখন মনে হয়েছিল যে বিধিদত্ত অধিকারে আমি সরস্বতীর সেবকদলে, সবচেয়ে পিছনের সারিতে হলেও, কোথাও আছিই। আমার শক্তির মধ্যাহ্নে মধুরা আমার জীবনে এসেছিল। একটিও মুহূর্তের দুর্বলতায় আমাদের সম্পর্কের সে—অধ্যায় কলঙ্কিত নয়। হ্যাঁ, জানতুম যে আমরা পুরুষেরা যা সবচেয়ে ভালো দিতে পারি, তা দেবার প্রেরণা জোগাতে রয়েছে ঈশ্বরের দূতীরা। আমাদের পুণ্যফলের অনুপাতে তারা আমাদের জীবনে একটি—দুটি কিংবা ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। চিরঞ্জীব যখন মধুরাকে নিয়ে চলে গেল, অহঙ্কারবশত মনে হয়েছিল আমি নতুন শিষ্যা গড়ব।

তারপর বছরের পর বছর কাটতে লাগল। অন্য কাউকেই গড়া হল না, আর কিছুই সৃষ্টি হল না। শিল্পী হিসাবে কোনো অলিখিত মাস্টারপিসের রচয়িতা হলেও হতে পারতুম এবং সংসারী হিসাবে নিতান্ত ব্যর্থ—এই আমার পরিচয় দাঁড়াল।

এককালে মধুরাকে নাট্যাভিনয়ে তালিম দিয়েছি। ও লজ্জায় লাল হত, যখন দেখিয়েছি কি করে কটাক্ষ হানতে হয় কিংবা সুন্দরী কি করে কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করে। যেন ওর তূণের অস্ত্রে আমি পূর্বেই বিবিদ্ধ এবং বিদগ্ধ। যারা আমার চোখের সামনে বালিকা থেকে ক্রমশ তরুণী হল, তাদের ওই সব তালিম দিতে গেলে তারা শুধু মুখ টিপে হাসে। আমোদ পেয়ে, কিংবা নিতান্তই অনুকম্পায়। আমার স্ত্রীর সঙ্গে তার পাকা মেয়েটির অদ্ভুত মতৈক্য যে ওদের জব্দ করতেই নাকি আমি গরিব স্কুল—মাস্টারের পেশা নিয়েছি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নয়, একেবারে, ধরা যাক, বিশসালা পরিকল্পনা।

এই রকম অন্ধকারের মধ্যে মধুরার মূর্তি আমার মনে পড়ে গেল। ওর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল, তখনই সে কলেজের ছাত্রী। ওকে আমি ক্ষীণা থেকে পূর্ণা দেখিনি, পূর্ণা থেকে পূর্ণতরা দেখেছি। ওকে আমি ওর পারিবারিক প্রতিবেশে দেখিনি, ও যেন অবন্ধনা। করিমগঞ্জে ওর গুণপনা দেখেছে শত শত মানুষ, দিল্লিতে যুব—উৎসবে হাজার হাজার; কলকাতা—বোম্বাইতে তৈরি ওর ছবিগুলির দর্শক লক্ষ লক্ষ, ‘কপালকুণ্ডলা’য় ও বিশ্বের প্রেয়সী।

মধুরা যেন এই সবই এক ঝলকে দেখতে পেয়েছিল। আমাকে উপহৃত ‘ছিন্নপত্রে’ ওর সেই স্বাক্ষরিত অঙ্গীকার—’আমি তোমাদেরই লোক।’ সে কী মিথ্যা! একি মায়া যে আমার গৌরবশশী যখন অস্ত গেছে, আমার মাথায় এখানে—সেখানে রূপালি রেখা তখনও মধুরা অনন্ত যৌবনের দীপ্তিতে জ্বলছে।

আমার যৌবন, কীর্তি, প্রেম, আশা সকল গেছে এবং কোথায় লুকিয়েছে, তার চাবিকাঠি যেন রয়েছে মধুরারই কাছে। ওকে আমার চাই। আসাম থেকে একদিন আমি পাড়ি দিলুম কলকাতার দিকে। সঙ্গের সুটকেসে ‘ছিন্নপত্রে’র কপিখানি।

এসে আমায় অনুতাপ করতে হয়নি। মধুরার সঙ্গে দেখা অবশ্য সহজে হয়নি। ও তখন থাকত নিউ আলিপুরের বাড়িতে—স্বয়ং চিরঞ্জীবের পাহারায়। দারোয়ান আমায় সে—বাড়ির গেটের ভিতরেই প্রবেশ করতে দিলে না। ঠিক করলুম, কোনোরকমে মধুরার নয়ন—পথে পড়তে হবে।

একদিন ভোরবেলা। ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। ও রাত্রের শুটিং করে বাড়ি ফিরছে। আমি দাঁড়িয়েছিলুম ওদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা দোকানের শেডে। মোটরটা হঠাৎ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলুম। ভিজে যাচ্ছি সে—খেয়াল নেই। মধুরা চোখ থেকে কালো চশমাটা নামাল। লাল দুই চোখ।

‘সত্যদা না? আপনি এখানে?’

‘এসে পড়লুম।’

‘সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন নাকি?’

‘সব ছেড়ে চলে এসেছি।’

‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার?’

‘কই, না!’

ও ব্যাগ খুলে একটা একশো টাকার নোট বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘যান, করিমগঞ্জে ফিরে যান।’

‘আমি তোমাকেই চাই।’

মধুরা ড্রাইভারকে হিন্দিতে বলল গাড়িতে স্টার্ট দিতে। গাড়ি চলে গেল। আমি নোটখানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি।

আবার একদিন দেখা একটি স্টুডিয়ো—গেটের সামনে। তখন রাত এগারোটা। মোটর থেকে হাতছানি দিয়ে ও আমায় ডাকল। আমি কাছে গেলুম।

‘একি ভূতের মতো চেহারা করেছ তুমি!’

ওর ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে অবতরণ আমার কানে মধুবর্ষণ করল। আমি চুপ।

‘কি চাও?’

‘তোমাকেই। তুমি আমারই।’

‘ভদ্রলোকেরা আমায় মনোযোগের অযোগ্য রূপে সস্তা ভাবে।’

‘আমি ভদ্রলোক নই।’

‘আমি করিমগঞ্জে যে সত্যরঞ্জন বড়ুয়াকে চিনতুম, তাঁর তুল্য ভদ্রলোক একজনকেও আজ পর্যন্ত দেখিনি।’

আমি চুপ।

‘তুমি মরো!’

হুশ করে ওর গাড়িটা আমার পাশ দিয়ে গেটে গিয়ে ঢুকল।

আমি জানতুম, মধুরা মচকাবেই। অবশেষে ডায়মন্ডহারবার রোডের উপর বাড়িতে ও আমায় নিমন্ত্রণ করল।

ওকে যখন চুমু খাচ্ছি আমার বুকের ওপর গুমগুম করে কিল মেরে বলল, ‘এই, তুমি যে কুম্ভকর্ণের মাসতুতো ভাই!’

‘কেন?’

‘অনেক দিন না খেয়ে শুধু ঘুমিয়ে, শেষে জেগে উঠে আর পাত্রাপাত্র বিচার নেই। নিজের ছাত্রীকেই কামড়াচ্ছ!’

এ—কথার পরে আর মজা জমল না।

‘ছিন্নপত্রে’র কপিখানি একদিন আমি অবনীকে দেখিয়েছিলুম। কারণ বোধ হয়, আমার অধিকারের অভিজ্ঞান ওকে দেখাতে গর্ববোধ করছিলুম।

দেখেশুনে ও গম্ভীর হয়ে গেল। বললে, ‘সত্যদা, মাপ করবেন। আমার মনে হয়, সাহিত্যের পঙক্তির আক্ষরিক অর্থ নেওয়া বিপজ্জনক। প্রতারিত হতে হয়।’

সেদিন আমি তর্ক করিনি। আমি কি জানাতে পারতুম আমার সৌভাগ্যের কথা যে আমি প্রতারিত হইনি।

অবনী ভ্রান্ত। তাই মূর্খ অর্থপুস্তক—প্রণেতাদের মতো তার ধারণা যে সাহিত্যের বুঝি একটি—দুটি সরকারি অর্থ আছে।

যখন শুধু সাহিত্যের ছাত্র ছিলুম, মনে হত, সাহিত্য বুঝি কোনো অলৌকিক আকাশ—প্রদীপ। ধরণীর ঊর্ধ্বে তার করুণসুন্দর কিন্তু অনির্বাণ শিখা সেই অসীমকে আলোকিত করার চেষ্টা করছে—যা সম্পূর্ণ আলোকিত হবার নয়। যুগ থেকে যুগান্তরে রসিকেরা এই আলোর দিকে মুখ তুলে দেখে বিস্ময়ের পার পায় না।

পরে বুঝেছি যে, সাহিত্যের যদি কোনো অর্থ থাকে তো তা প্রেম। লিখতে ভালো লেগেছিল বলে কেউ তা লিখেছিল। তা স্বয়ং আলো নয়, আলোর উৎস। যে—প্রেমিকের ভালো লেগেছে, সে তার থেকে আলো আহরণ করে দীপাবলির রাত্রে প্রাসাদশীর্ষে রংমশাল জ্বালিয়েছে। কিংবা ঝড়ের রাতে কুটিরে প্রদীপ। কিংবা বাসরে প্রেমিকার মুখ দেখেছে।

মধুরার লিখতে ভালো লেগেছিল, তাই সে ‘ছিন্নপত্রে’র উপহার—পৃষ্ঠায় কিছু লিখেছিল। ও তো কারো কাছে অর্থ জানতে চায়নি। আমি পড়ে বুঝেছিলুম যে, ওতে ওর প্রেমের ঘোষণা রয়েছে। আমি কি মাথা ঘামাই পঙক্তি দুটির আক্ষরিক বা আলঙ্করিক অর্থ নিয়ে!

কী আশ্চর্য, গভীর আশ্বাসে মধুরা ধরা দিল। যন্ত্রের আগ্রাসন, মহাযুদ্ধ, অর্থশাস্ত্র শাসন করছে আমাদের প্রিয়জনদের হৃদয়, প্রেম আর ললিতকলা নিয়ে বেনিয়াদের ছিনিমিনি তবু আছে, আছে মধুরার মতো নারীর শরীরের নীড়। তার সরু কোমরের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করে এলে স্বর্গানুসন্ধিৎসু পুরুষ পথ ভুলবে এবং সেই বিস্মৃতিকেই আজন্মের সঞ্চিত সুকৃতিফল বলে গণবে। সংস্কার আমাদের কানে জপছে, রমণীর পক্ষে যে—ধন যে—কোনো মূল্যে সদৈব রক্ষণীয়, মধুরা তাকেই বিনামূল্যে ভিখারির পায়ে বিকিয়ে দিল। হা হা, মজা মন্দ নয়।

মধুরা যদি আমারই, তাহলে সে আর কারো নয়। এ—যুগের অর্জুন প্রেয়সীর প্রেমে ভাগীদার সহ্য করবে না। সে চিরঞ্জীবের নয়, চিরঞ্জীব ওকে পয়সার লোভে হাটে ছেড়েছিল। অবিনাশ ও জয়ন্ত দুজনেরই আসল জোর ছিল, তারা মধুরার ছবির শুধু পরিচালক নয়, যেটা আরও বড় কথা, প্রযোজকও ছিল। মত্ত মধুরা, নর্মাল হিউম্যান ফিমেল হিসেবে সবল পুরুষকে খোঁজে মধুরা, বুদ্ধিমানে ওর প্রেমে পড়লেও নিজে এমন কিছু বুদ্ধিমতী নয় মধুরা—সে নিজেকে ঠকাচ্ছিল, অবিনাশ ও জয়ন্তকে দিয়েছিল ওকে ঠকাতে যে ও ওদের ভালোবেসেছিল। ব্যর্থ সত্যরঞ্জন—এমন কি তার গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত হয়েছিল তার প্রেয়সীর কৃপায়—তার সুচিরসঞ্চিত সকল ক্রোধ ও ঈর্ষা নিয়ে অর্থবান ও সফল অবিনাশ এবং যৌবনোদ্ধত ও সফল জয়ন্তকে খুন করে বসল। আমি খুনি বলে নিজেকে ঘৃণা করি না। কিন্তু একটা বড় ভুল হয়েছিল।

আমি ভেবেছিলুম, মৃত প্রেমিকদের নিয়ে দু—চার দিনের বেশি শোক করবে না মধুরা। কিন্তু ও তো সত্যই সুরসুন্দরী নয়। ‘হেলি উর্বশীর স্তনে স্বর্ণবীণা থেকে থেকে যেন অন্যমনে অকস্মাৎ ঝঙ্কারিত কঠিন পীড়নে নিদারুণ করুণ মুর্চ্ছনা।’ মধুরার বেলা সর্বদাই বিলাপ ‘যেন অন্যমনে অকস্মাৎ’ নাও হতে পারে। ঠিক কথা, অবিনাশকে সে সহজে ভুলল, জয়ন্তকে অবশ্য ভুলতে সময় নিল। ইকনমির অজুহাতে আমায় তাড়াল। কিন্তু জয়ন্তকেও ভুলল ঠিকই। তাহলে সে আবার অবনীর প্রেমে পড়ে কি করে। তার পরই দারুণ উপসংহার।

সে—রাত্রে অবনীর কথা স্মরণ করে যখন সে চোখের জল ফেলছে, বুঝলুম যে, অপ্সরার ছদ্মবেশ খসিয়ে মানবী বেরিয়ে এসেছে। যখন সে আমায় ‘পশু’ সম্বোধন করল, বুঝলুম যে, ওর জীবনে আমার সব খেলা ফুরিয়েছে। সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলুম যে, আমি অবনীকেও খুন করব, তার রক্তাক্ত মৃতদেহ লুটোবে, শেষে আমিও মরব এবং মধুরা—’বসুধালিঙ্গনধূসরস্তনী বিললাপ বিকীর্ণ—মূর্ধজা।’

আমার স্ত্রী প্রতিমা আমার ফাঁসি হওয়ার আগে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সঙ্গে আমার বছর পাঁচেকের ছেলে। বড় মেয়ে আসেনি। খুনি বাপকে ঘৃণা করা প্রশংসনীয় বোধ হয়। কলকাতায় আসার পর প্রথম প্রথম আমি এদের ভুলে ছিলুম। তারপর অবশ্য নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছি। আজ প্রতিমার দিকে তাকিয়ে মনে হল, যে—কোনো স্কুল—মাস্টারের বর্তে যাওয়া উচিত, এমন বউ ভাগ্যে জুটলে। দেখলুম, ওর গায়ে গহনা প্রায় শূন্য, শাড়িটা বড্ড সাদা।

বললুম, ‘আমি তো এখনও মরিনি। এখনই বিধবার বেশ কেন?’

কোনো জবাব নেই। দেখলুম, প্রতিমার চোখের জল সব শুকিয়ে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলুম, ওকে দু—দুটি সন্তান উপহার দেওয়া আমার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার চরম হয়েছে। ওর দ্বিতীয়বার বিবাহে সেটা সমস্যা হতে পারে।

ছেলেকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ পড়া আরম্ভ করেছ?’

ও সম্মতিতে ঘাড় নাড়ল।

প্রতিমা ছেলেকে বলল, ‘খোকা, বাবাকে বলো তো, এখন তোমার ভালো নামটি কি?’

‘শ্রীমান প্রিয়রঞ্জন চৌধুরী।’

প্রতিমা যেন আমাকে দণ্ডদানের জন্য এইটুকু রিহার্সাল দিয়ে এসেছিল। ‘চৌধুরী’ ওর কুমারীজীবনের পদবি। আমি ছেলের দিকে তাকিয়ে কষ্টে হাসলুম।

প্রতিমা বলল, ‘ওকে ইউ. পি.—তে নিয়ে গিয়ে মানুষ করার ব্যবস্থা হচ্ছে।’

‘ভালো কথা।’

আমি শেষ কথা বললুম, ‘তোমার ছেলের যদি কোনোদিন স্বাধীন বুদ্ধি হয়, ওকে আমার সব কথা বোলো।’

‘মা, আমরা আর বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসব না?’

‘আসব। আজ চলো।’

ওরা চলে গেল। বলা বাহুল্য, ওদের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।

খবর পাঠিয়েছিলুম, মধুরা যেন আমার সঙ্গে একবার দেখা করে। ফাঁসির আগের দিন বিকেলে অবনী এল। আমি রুক্ষস্বরে বললুম, ‘তোমায় তো আমি দেখতে চাইনি।’

‘জানি। মধুরাকে দেখতে চেয়েছিলেন।’

হঠাৎ আমার মনে একটা বিশ্রী সন্দেহ হল।

অস্থির হয়ে বললুম, ‘তুমি কি সম্প্রতি অধিকারী হয়েছ মধুরার হয়ে….’

‘ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কি?’

‘এমন কি আরতিকেও সঙ্গে নেয়নি।’

হয়তো কোনো ঝরনার ধারে শিলাতলে মাথা রেখে সে অশ্রু—বিসর্জন করছে। আর তার অশ্রুর মুক্তাবিন্দুগুলিকে বুকে নিয়ে স্রোত কোন নিরুদ্দেশে ভেসে গেল।

‘ওর ছেলে নীতীন্দ্র ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে। চিরঞ্জীববাবু ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মধুরার খোঁজে ভারতবর্ষময় ছুটোছুটি করছেন।’

সেই কাঞ্চনদাস কিংবা এই অধম টিকটিকির খপ্পরে মধুরা যেন আর কোনোদিন না পড়ে।

বললাম, ‘আমার সঙ্গে দেখা করার তোমার কোনো দরকার ছিল?’

‘মনে হল, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করা কর্তব্য। আপনি হয়তো কিছু বলবেন, যাতে আপনাকে আর একটু বুঝতে পারি। হয়তো আমারও কিছু বলার আছে।’

‘তুমি মধুরাকে এমন অসুখী করেছ, ওর উচিত ছিল নখে তোমার মুন্ডু ছিঁড়ে নেওয়া।’

অবনী চলে গেল।

আগামীকাল ভোর চারটেয় আমার ফাঁসি হবে। বিবর অন্বেষী কীটের মতো আমি অন্ধকারে মুখ লুকোব। অন্ধকার, সম্ভবত যার পার নেই, তাকে ভয় নয়। লুপ্তির সম্পূর্ণ চেহারাখানা দেখেছি, ছেলে যখন পৈতৃক পদবির বর্জন শোনাল।

অসাধারণ কীর্তির জন্য আমরা আজীবন শ্রম দিতে পারি। অদ্ভুত সুখে মজে বিশ্ব—বিস্মৃত হতে পারি। কিন্তু শেষ বিভীষিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই বাণী রেখে যেত ইচ্ছা করে—

 মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,

 আমি তোমাদেরই লোক

 আর কিছু নয়,

 এই হোক শেষ পরিচয়।

অর্থাৎ, আমাদের যে—পরিচয়ে আমরা স্বাভাবিক মানুষের কাছাকাছি, আমাদের সেই—পরিচয়ই সত্য হোক।

কিন্তু হায়, একি আয়রনি! মধুরার বেলায় তাকে ঘিরে ব্যবসায়িক স্বার্থে গ্ল্যামারের এমন বৃত্ত রচিত হল, যার আড়ালে তার সাধারণ মানবীরূপ অদৃশ্য। তাই পরিণামে মানবীর বুক—ফাটা হাহাকার তার বিধিলিপি। এবং আমি আমার পাপ ও উন্মত্ততা নিয়ে পৃথিবীতে নিশ্বাস নেওয়ার অযোগ্য প্রমাণিত হলুম।

Freakish and odd—কে নিয়ে পৃথিবী—জুড়ে বেনিয়াদের ফলাও ব্যবসায়। যারা স্বভাবতই হিংস্র, তাদের কুৎসিত আমোদ ও অস্বাস্থ্যকর কৌতূহল মেটানোর উদ্দেশ্যে। যে বাংলা দৈনিকটি ক্রিস্টিন কিলারের সচিত্র জীবনী ছাপিয়েছিল, সেটি হয়তো তার মনোযোগ দ্বারা আমাকেও সম্মানিত করবে। কোনো অধম লেখক হয়তো রহস্য—রোমাঞ্চ পত্রিকার পাতায় আমায় নিয়ে উপন্যাস ফাঁদবে।

তখন কে আর এই খবরটি দেবে যে, শুধু নৈঃশব্দ্য ও তমসার তীরে জীবনের শেষ কয় ঘণ্টায় আমি বারবার জপেছিলুম—আমি তোমাদেরই লোক, আমি তোমাদেরই লোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *