স্বর্গারোহণ পালা

স্বর্গারোহণ পালা

খুব কম করেও পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা।

কলকাতার এক নামকরা যাত্রা কোম্পানি মেদিনীপুরের এক গ্রামে চলেছে তাদের দল নিয়ে যাত্রা করতে। তখনকার যাত্রাওয়ালারা আজকের মতো এমন লাক্সারি বাসে যাতায়াত করত না। চার-পাঁচটি গোরুর গাড়ি বোঝাই করে অভিনেতা ও দলের অন্যান্য লোকদের নিয়ে যাযাবরের মতো এক দেশ থেকে আর এক দেশে রওনা হত।

এই দলটিও চলেছে। গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে, নদী নালা ডিঙিয়ে, বনজঙ্গল অতিক্রম করে চলেছে। দলের অধিকারী রাখহরি ভাণ্ডারী মহাশয় অত্যন্ত সদাশয় লোক। কোনও পার্টির কাছ থেকে দলের গাওনার জন্য বায়নানামা করার পর কথার খেলাপ করেন না। এবং নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা আগেই তিনি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যান। কিন্তু এবারের যাত্রায় মনে মনে তিনি একটু প্রমাদ গণলেন। গন্তব্যস্থল এখনও সাত ক্রোশ দূর। অথচ আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। ঘন মেঘমালায় আকাশ ভরে আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গোরুর গাড়ি যদি রেলগাড়ির মতো ছোটে তা হলেও তিনি দুর্যোগ এড়িয়ে পৌঁছতে পারবেন না। একেবারে নামে নামে অবস্থা। তবু তিনি চালকদের গাড়ির গতি দ্রুত করতে বলে শঙ্কিত চোখে আকাশের দিকে তাকাতে লাগলেন।

দলের লোকেরাও চিন্তিত হয়ে পড়ল খুব। সত্যিই তো, এইভাবে যাওয়া যায় কী তারা বলল, “অধিকারী মশাই, এবার বোধ হয় আমাদের দলের মান আর রইল না।” অধিকারী বললেন, “সে বললে তো হবে না ভায়া। যত দুর্যোগই হোক, যেতে আমাদের হবেই।”

“তা তো হবেই। কিন্তু যাবেন কী করে? এ যা অবস্থা দেখছি, এখানেই না আটকা পড়তে হয়!” “জয় গুরু জয় গুরু। দেখা যাক কী আছে কপালে! একে আষাঢ় মাস, তায় আকাশের এই অবস্থা।”

“ওরা কি এই বর্ষাকাল ছাড়া যাত্রা করাবার সময় পেল না?”

“সে বললে কি হয়? গ্রামগঞ্জের ব্যাপার। চাঁদা তুলে টাকাপয়সা জোগাড় করবে তবে তো? বোশেখ মাসে হরিসভা দিয়েছিল, তখনই যাত্রা হওয়ার কথা। কিন্তু টাকাপয়সার জন্যই পিছিয়ে গেল। তাই এই অসময়ে হচ্ছে। ওদের বড় আশা, আমাদের দলের যাত্রাগান শুনবে। তাই দোনোমনো করেও বায়নাটা নিয়েই নিলাম।” ।

“কিন্তু আকাশ যেরকম করছে তাতে…।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এ যেন প্রলয়ের পূর্বাভাস।”

বলতে বলতেই ঝড় উঠল। সে কী দারুণ ঝড়। গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। গাছ ওপড়াল। গোরুর গাড়ির ছতরি উড়ল। ধুলোয় কুটোয় ভরে গেল চারদিক। ঝড় আর জলের দাপট মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দেখা দিল । সামাল সামাল রব উঠল চারদিকে।

এদিকে যে গ্রামে যাত্রা হওয়ার কথা, তারাও তখন হায় হায় করছে। শুধু কি এই গ্রামের লোক? ভিন গাঁ থেকেও দলে দলে লোক সকাল দুপুর থেকে চাটাই মাদুর থলে বিছিয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে কলকাতার পেশাদারি দলের যাত্রা শোনবার জন্য। রাত দশটার মধ্যে যাত্রাপার্টির আসবার এবং বারোটায় যাত্রা আরম্ভ করবার কথা। তার জায়গায় এ কী হল?

যাই হোক দুপুরের পর থেকে আরম্ভ হয়ে একটানা সেই দুর্যোগ রাত ন’টা নাগাদ কেটে গেল। চারদিকে কাদায় কাদা। নিচু জায়গাগুলো জলে ডুবে গেছে। কোথাও বা পথের ওপর দিয়ে জলস্রোত বইছে। শামিয়ানা ছিঁড়ে কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে একপাশে। সবাই বিষণ্ন মনে বসে বসে ভাবছে—তাই তো, যাত্রা হোক বা না হোক সেটা বড় কথা নয়। এই অজ গ্রামে আসতে গিয়ে অতবড় দলের লোকজনগুলোর কী অবস্থা হল? তারা যে কোথায় কতদূরে কীভাবে আছে তাই-বা কে জানে? সবাই মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগল, দেখো ঠাকুর যেন দলটির কোনও ক্ষতি না হয়। যাত্রা আজ না হয় কাল হবে। কিন্তু মানুষগুলো যেন প্রাণে বাঁচে।

গ্রামবাসীরা এইরকম সব চিন্তা করছে এমন সময় দেখা গেল পর পর পাঁচটি গোরুর গাড়ি কাদায় মাখামাখি অবস্থায় এসে থামল বারোয়ারিতলায়।

সকলে হইহই করে হ্যাজাক লণ্ঠন নিয়ে ছুটল সেখানে।

অধিকারী মশাই ভুঁড়ি দুলিয়ে নেমে এলেন গোরুর গাড়ি থেকে।

গ্রামবাসীরা অবাক! বলল, “এই দুর্যোগে আপনারা এলেন কী করে?”

“কেন! না আসবার কী আছে? আমার নাম রাখহরি ভাণ্ডারী। কথার খেলাপ আমি করি না। দুর্যোগে কষ্ট পেয়েছি ঠিকই, তবে ওসব আমাদের গা সওয়া। এখন আপনারা অনুমতি দিলেই যাত্রা আরম্ভ হবে।”

এর আবার অনুমতি! চোখের পলকে বারোয়ারিতলা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। হ্যাজাক লণ্ঠনের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল চারদিক। যাত্রার কনসার্টের ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠল গ্রামখানি। কী আনন্দ! কী আনন্দ। সেই আনন্দময় পরিবেশে যাত্রা শুরু হল। অগণিত দর্শক মুগ্ধ চোখে যাত্রা দেখতে লাগল। কেউ দুঃখে কাঁদল, কেউ-বা আনন্দে হাততালি দিল।

ক্রমে রাত শেষ হয়ে এল।

যাত্রা শেষ হয়ে এল।

কিন্তু এ কী! এও কি সম্ভব!

শেষ দৃশ্যে নরবলি আছে। এরা যে সত্যি সত্যিই একটা লোককে হাড়িকাঠে মাথা গলিয়ে নরবলি দিল। তারপর ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এলেন। এঁদের আশীর্বাদে সেই কাটা মুণ্ডু আবার জোড়াও লেগে গেল। বিস্মিত অভিভূত দর্শকরা ভেবেও পেল না এসব কী হচ্ছে। এরকম সাংঘাতিক পালা এর আগে আর কখনও দেখেনি তারা। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। ব্রহ্মা বর দান করে আসরের মাঝখান থেকে হাউইয়ের মতন উড়ে স্বর্গে চলে গেলেন । ব্রহ্মার পর বিষ্ণু আর মহেশ্বর। মাটি ছেড়ে তাঁদেরও দেহটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে আকাশে মিলিয়ে গেল। শুধু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নন। অন্যান্য কুশীলবরাও ওইরকম একই ভাবে স্বর্গারোহণ করলেন।

দর্শকদের তো তখন মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। যাঃ বাবা। এসব আবার কী কাণ্ড!

এইসব ঘটতে ঘটতে ভোরের আলো ফুটে উঠল। আর ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কনসার্ট পার্টির লোকগুলোও কীরকম যেন আবছা হয়ে যেতে লাগল। আর কনসার্টের সুরও মনে হল ক্রমশই যেন দূরে, বহুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এইভাবেই এক সময় সুরও মিলিয়ে গেল, লোকগুলোও অদৃশ্য হয়ে গেল।

পরদিন সকালবেলায় দেখা ‘গেল পাঁচটি গোরুর গাড়ি বোঝাই হয়ে একটি যাত্রার দল আসছে। গোরুর গাড়িগুলো বারোয়ারিতলায় এসে থামতেই অধিকারী মশাই হাতজোড় করে এসে বললেন, “হে সজ্জন গ্রামবাসীগণ, আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। জীবনে এই প্রথম আমি কথার খেলাপ করলাম। ফান্\পথিমধ্যে ভয়ংকর দুর্যোগে পড়ে আমরা বহু চেষ্টা করেও আসতে পারিনি। তবে আসতে যেমন পারিনি তেমনই ওই একই টাকার অঙ্কে পর পর দু’রাত আমরা আপনাদের গ্রামে যাত্রাগান করব। আশা করি আপনারা সবাই খুব খুশি হবেন?”

গ্রামবাসীরা কী যে বলবে আর কী করবে তা ভেবে পেল না। বলল, “সে কী মশাই! আপনারা তো কাল ঠিক সময়েই এসেছিলেন। সারারাত ধরে অভিনয় করলেন। তারপর শেষরাতে ভেলকি লাগিয়ে চলেও গেলেন। আবার এখন এসেছেন হেঁয়ালি করতে? বলি ব্যাপার কী?”

অধিকারী বললেন, “দেখুন মশাই, বাজে কথা বলবেন না। আমি হলুম সিংহরাশির জাতক। লোকের সঙ্গে হেঁয়ালি করার মতো মেজাজ আমার নেই। কাল রাতে দুর্যোগে আমরা আটকা পড়েছিলাম। এই সবে আসছি। সময়ে উপস্থিত হতে পারিনি বলে আপনারা আমাকে বিদ্রুপ করছেন? এই নিন আপনাদের বায়নার টাকা।” বলে গেঁজে থেকে টাকার থলিটা বের করে অধিকারী মশাই ছুড়ে দিলেন সকলের সামনে।

সকলে হাঁ হাঁ করে উঠল, “থামুন, থামুন মশাই! আপনি হলেন স্বনামধন্য লোক। আমাদের গ্রামে আপনার মতো লোকের পায়ের ধুলো পড়েছে বলে আমরা গর্বিত। আমরা কখনও আপনার মতো লোককে বিদ্রূপ করতে পারি? আপনি বিশ্বাস করুন, অত দুর্যোগেও কাল রাত্রে গ্রামে যাত্রা হয়ে গেছে। এবং আপনার দলই করেছে।”

“তা কী করে সম্ভব!”

“বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখুন। আপনার অভিনেতারা কে কীসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তা আমাদের গ্রামের যে-কোনও লোককে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।” অধিকারী ভূকুঞ্চিত করে বললেন, “বেশ, বলুন তো দেখি?”

গ্রামবাসীরা বলল, “ওই তো উনি ব্রহ্মার পার্ট করেছিলেন। উনি হয়েছিলেন বিষ্ণু। উনি মহেশ্বর। আর ওই যে উনি, ওঁকেই তো বলি দেওয়া হয়েছিল। উনি হয়েছিলেন অমুক— উনি তমুক।”

অধিকারী বললেন, “আশ্চর্য! আমাদের এই পালা হচ্ছে এ মরশুমের নতুন পালা। এ তো আপনাদের জানবার কথা নয়। অথচ আপনারা যে যা বলছেন, সবই ঠিক—উনি আমাদের দলে ব্রহ্মা সাজেন, উনি বিষ্ণু, উনি মহেশ্বর। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কাল রাতে আমরা আসতে পারিনি। আমরা দারুণ ঝড়জলে এখান থেকে সাত ক্রোশ দূরে হরিদাসপুর গ্রামে আটকে পড়েছিলাম। আপনারা ইচ্ছে করলে ওখানকার ভুবন মালাকারের বাড়িতে একজন লোককে পাঠিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারেন।”

গ্রামের লোকেরা পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল, “হরিদাসপুর গ্রাম! ভুবন মালাকার!”

অধিকারী বললেন, “হ্যাঁ। হরিদাসপুর গ্রাম। ভুবন মালাকার। কাল ওই দুর্যোগের রাতে ওই গ্রামের লোকেরা ভুবন মালাকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাদের না তুললে সারারাত কী দুর্গতি যে হত আমাদের, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। অমন অতিথিবৎসল গ্রাম আমি দেখিনি। অতগুলো লোককে পেটভরে খাইয়ে দাইয়ে রাত শেষ হওয়ার আগেই আমাদের সড়কে পৌঁছে দিয়ে আপনাদের গ্রামে আসার সহজ পথটি দেখিয়ে না দিলে আজও বিকেলের আগে এখানে আমরা আসতে পারতাম না।”

অধিকারীর মুখে সব শুনে গ্রামের লোকেরা তো থ। বলল, “আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে কলেরার মহামারীতে ওই গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। হরিদাসপুরে এখন গ্রামের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু বন আর জঙ্গল।”

“আর ভুবন মালাকার?”

“ওই মহামারীর কবল থেকে তিনিও রক্ষা পাননি।”

‘সে কী! কাল রাতে আমরা তা হলে ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম!”

“শুধু কি আপনারা? আমরাও যে কাল সারারাত জেগে কাদের যাত্রা দেখেছি তা এবার ভালই বুঝতে পারছি। উঃ কী সাংঘাতিক সেই যাত্রা। যাক, ভাগ্য ভাল যে, প্রাণে বেঁচে গেছেন। এখন বিশ্রাম করুন। তারপর রাত্রিবেলা মনের আনন্দে আপনাদের যাত্রা দেখব।” অধিকারী বললেন, “না, রাত্রে নয়। যাত্রা আজ দুপুরেই হবে। তারপর রাত্রিটা বিশ্রাম নিয়ে কাল সকালেই পালাব আমরা এখান থেকে। আর এ তল্লাটে নয়!”

অধিকারীর কথামতো তাই হল। দিনদুপুরেই খোলা আকাশের নীচে যাত্রা দেখল সকলে।

এই অলৌকিক যাত্রাপালার কথা প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শোনার পরও এখনকার লোকেরা হেসে উড়িয়ে দেয়। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। বলে, এটা একটা আষাঢ়ে গল্প ছাড়া কিছুই নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *