স্বর্গাদপি গরীয়সী (১ম খণ্ড)

স্বর্গাদপি গরীয়সী ১ (প্ৰথম খণ্ড) – বিভূতি মুখোপাধ্যায়

উৎসর্গ
সৃষ্টির পরিকল্পনায় যাঁরা ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’
তাঁদেরই উদ্দেশে

ভূমিকা

“স্বর্গাদপি গরীয়সী” জীবন নয়, যদিও একথা অস্বীকার করা চলে না যে ইহাতে জীবনীর উপকরণ প্রচুর পরিমাণেই বর্তমান।

নারী-জীবনের পূর্ণ সার্থকতা মাতৃত্বে,—এই মূল কথাটিই বলা আমার উদ্দেশ্য। এই মাতৃত্বের বিকাশ যাঁহার জীবনে সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করিবার সুযোগ আমার হইয়াছিল তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া আমি সেই উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়াসী হইয়াছি। এই উপন্যাসের মধ্যে আমার এই ব্যক্তিগত অংশটুকু গৌণ বলিয়া ধরিয়া লওয়াই বোধ হয় ভালো। বিধাতার অনুকম্পায় আমি যে আদর্শ পাইয়াছিলাম উচ্চাঙ্গের—এ-সৌভাগ্যও ব্যক্তিগত, এবং উপন্যাসের পক্ষে আকস্মিক।

বিশেষ ভাবে এই যাঁহাকে আমি অবলম্বন করিয়াছি, তাঁহার জীবনের সেই অংশগুলিই বাছিয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছি যাহা নারীর জীবনের এই চিরন্তন বৃত্তি অর্থাৎ মাতৃত্বের পরিপোষক। এর অতিরিক্ত যে সব অংশ, তাহাদের লইয়াছি উপন্যাসের দাবী মিটাইতে। গোটা মানুষটি দাঁড় করাইয়া তুলিতে না পারিলে তাহার কোন একটি বৃত্তির আধার সৃষ্টি হয় না; তেমনি গোটা মানুষটিকে দাঁড় করাইতে হইলে যাহারা তাহাকে ঘিরিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাহার জীবনকে প্রভাবিত করিয়াছিল তাহাদের আনিয়া ফেলিতে হয়।…এই করিয়াই যাহা এক কথাতেই বলা চলিত, তাহা বহু কথায় শাখায়িত হইয়া ওঠে,—যাহা মাত্র দুইটি শব্দের মন্ত্র, তাহা শব্দবহুল উপন্যাসে রূপ ধরিবার প্রয়াস করে।

আর একটা কথা বলা দরকার এইখানে। শুধু সত্য লইয়া উপন্যাসের চলে না। এই জন্য ইংরেজীতে উপন্যাসের একটি নামই fiction, বাংলায় এর প্রতিশব্দ গালগল্প। বিধাতা জীবনকে উপন্যাস করিয়া গড়েন না, বিশেষ করিয়া সামান্য একটি বাঙালী মেয়ের জীবনে ঘটনা-সংঘাত এত কম যে সত্য ধরিয়া বসিয়া থাকিলে উপন্যাসের কথা ভুলিতে হয়। সেই জন্য আমায়ও বহুল পরিমাণে কল্পনার আশ্রয় লইতে হইয়াছে। অত কথা কি, যাত্রাই শুরু করিতে হইয়াছে কল্পলোকের মধ্য দিয়া, এবং বইয়ের অনেকগুলি প্রধান চরিত্রও কাল্পনিক। এই পর্যন্তই বলিয়া রাখি, নাম করিয়া উপন্যাসের ইন্টারেস্ট (যদি কিছু থাকেই) নষ্ট করিয়া আত্মঘাতী হইব না।

আমার মূল উদ্দেশ্য ধরিয়া আরও একটা কথা বলিয়া রাখা প্রয়োজন। ঐ যে বলা হইল— “নারী-জীবনের পূর্ণ সার্থকতা মাতৃত্বে” ওটা প্রকাশ পায় ভাব এবং অভাব—দুয়ের মধ্যেই।—নারী- জীবনের এটা যে কতবড় সত্য, যে মা হইতে পারিল সে তো ফুটাইয়া তুলিলই নিজের জীবনে, যে পারিল না হইতে, সে-ও কম করিয়া ফুটায় না। সন্তানকে যে পাইয়া অর্ধপথেই হারাইল, সে তো কম নয়ই, এমন কি যে পাইতে চাহিল না সে-ও মায়ের মনের একটি অপরূপত্বকেই রূপ দিয়া বসে।…তাই গিরিবালার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে কাত্যায়নী;—আরও পরবর্তী জীবনে মৈথিল বধু দুলারমন, ঝি খজনী…বিধাতা তাঁর এই শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকে আকার দিতে নারী-মনের আরও যে কত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার সন্ধান কে-ই বা রাখিতে পারে?

ব.ভ.ম.

.

স্বর্গাদপি গরীয়সী

প্রকাশকালের নিরিখে “স্বর্গাদপি গরীয়সী” প্রথম খণ্ড বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় উপন্যাস। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এগারোটি গল্পগ্রন্থ এবং একটি উপন্যাস— “নীলাঙ্গুরীয়”।

প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ‘নীলাঙ্গুরীয়’ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ বিষয়ে অবহিত থেকেও এবং ‘নীলাঙ্গুরীয়’ সম্পর্কে বিশদ মমতা থাকা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণের ধারণায় ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী ই তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। এ-কথা জানিয়েছিলেন তিনি ‘ধ্বনি’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে এক সাক্ষাৎকারে। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, “কালিদাসদা’ (কালিদাস রায়) একদিন বলেন তোমার ‘স্বর্গাদপি’তে এপিকের পুরো মেজাজ পাচ্ছি। এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে হয়।” (দ্রঃ ধ্বনি; নব পর্যায়/৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৫/পৃষ্ঠা ৪৯৮) আন্তরিক প্রত্যয় নিয়ে এবং এই কথা স্মরণে রেখেই সম্ভবত, বর্তমান লেখককেও এক ঘরোয়া কথোপকথনের কালে জানিয়েছিলেন যে, ‘একটু Dis- criminating পাঠক’ ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’-কেই উত্তর মূল্য দেবে বলে তাঁর বিশ্বাস। এমন পাঠকের সন্ধান আমরা পাইও। গজেন্দ্রকুমার মিত্র সসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন, “নীলাঙ্গুরীয় প্রথম যখন পড়ি তখন খুব যে একটা ভালো লেগেছিল তা নয়—কিন্তু স্বর্গাদপি গরীয়সী পড়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলুম। অদ্ভুত, আশ্চর্য বই”!” (দ্রঃ কথাসাহিত্য/জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৩/পৃষ্ঠা ৭০৫।)

কোন্ বৈভবে ঋজু হয়ে ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ সম্পর্কে এমন একটা অভিমানকে প্রশ্রয় দিতে পেরেছেন লেখক—কৌতূহলটা পাঠকের মনে স্বতঃই বাঁক নেয় জিজ্ঞাসার চিহ্নে। অচিরে নির্দেশ পাই “নারীজীবনের পূর্ণ সার্থকতা মাতৃত্বে—এই মূল কথাটিই বলা আমার উদ্দেশ্য। এই মাতৃত্বের বিকাশ যাঁহার জীবনে সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করিবার সুযোগ আমার হইয়াছিল তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া আমি সেই উদ্দেশ্যসাধনে প্রয়াসী হইয়াছি।…বিধাতার অনুকম্পায় আমি যে আদর্শ পাইয়াছিলাম তাহা উচ্চাঙ্গের—এ সৌভাগ্যও ব্যক্তিগত এবং উপন্যাসের পক্ষে আকস্মিক।” (দ্রঃ উপন্যাসের ভূমিকা।) এবং “এই একটি মায়ের চরিত্রকে অবলম্বন করেই আমি universal moth- erhood-এর দিকে যাবার চেষ্টা করেছি।” (দ্রঃ কথাসাহিত্য/জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৩/পৃষ্ঠা চ।)

বিভূতিভূষণের মনে এই মাতৃত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জল্পনার একটা পূর্ব ইতিহাসও ভাবা যেতে পারে ‘নীলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসে অনিলের উক্তির সূত্রে— “সব মেয়েরই উমার অংশে জন্ম, উদাসীনের জন্যই তাদের তপস্যা।” (দ্রঃ বি.মু.রচনাবলী/প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ২০৪।) এবং অনিল চরিত্র ব্যাখ্যা করে ২০.৪.৭২ তারিখে এক চিঠিতে তিনি বর্তমান লেখককে লিখেছিলেন, “অনিল সম্বন্ধে তুমি যা বলেছ, আমারই মনের প্রজেকশন। আমারই জীবনদর্শন অন্যের মুখ দিয়ে বলানো।”

স্বর্গাদপি গরীয়সী (১ম খণ্ড)-র কাহিনী প্রকৃতপক্ষে বিভূতিভূষণের পূর্বপুরুষের পাণ্ডুলে আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনী। মূল আদর্শের পরিপোষক হিসেবেই, আদর্শের অগ্রমান্য বিভাব-এর বিশ্বাসযোগ্য আবেষ্টনী হিসেবেই পূর্বপুরুষের ইতিহাসকে উপন্যাসে সমাদর করেছেন উপন্যাসিক অন্যথায় মুখোপাধ্যায় বংশের পারিবারিক গৌরবগাথা রচনার কোনো সঙ্কল্প আলোচ্য উপন্যাসে লেখকের ছিল না। ‘উপন্যাসের পক্ষে আকস্মিক’ এই সব উপাদান তিনি গ্রহণ করেছেন মাত্র “উপন্যাসের দাবী মিটাইতে…”। (দ্রঃ উপন্যাসের ভূমিকা।) তথাপি এই অঘটনের বাস্তবিকতার ভিত্তিমূলক কিছু তথ্য উৎসাহী পাঠকের কাছে দাখিল করা যায়।

বিভূতিভূষণের পিতামহ ৺মধুসূদন, পিতা ৺বিপিনবিহারী। এঁদের আদিনিবাস চাতরা-শ্রীরামপুর, আর তাঁর মাতামহ ৺রসিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বেলে- প্রতাপপুর (হাওড়া)-এর অধিবাসী। বিভূতিভূষণের মায়ের নাম ৺গিরিবালা দেবী। পিতামহ মধুসূদনই বিহর-এর দ্বারভাঙ্গা জেলার পাণ্ডুল-এ প্রথম পদার্পণ করেন জীবিকার তাগিদে। (দ্রঃ সাম্প্রত/কার্তিক১৩৭৯/ পৃষ্ঠা ১।) স্থান-কাল-পাত্রের এইসব পরিচয় বিনা আয়াসেই খুঁজে পাওয়া যাবে উপন্যাসে। আরও পাওয়া যাবে কিছু কিছু পারিবারিক ঘটনার বিবরণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে এদের যাবতীয় সম্ভ্রম ঐ আদর্শ পরিপোষণের, উপযুক্ত আবেষ্টনী রচনার খাতিরেই। আদর্শ নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র মূল্য লেখক নিজেই এদের জন্য নির্দেশ করেননি।

‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ (১ম খণ্ড) প্রথম প্রকাশ করেন জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্স, ১১৯ ধর্মতলা স্ট্রীট, কলিকতা। প্রকাশকাল, শ্রীশ্রীরাধাষ্টমী ১৩৫১। “সৃষ্টির পরিকল্পনায় যাঁরা স্বর্গাদপি গরীয়সী” গ্রন্থটি তাঁদেরই উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। গ্রন্থটির ৮ম (?) সংস্করণ—প্রথম মিত্র-ঘোষ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৬৯-এ এবং মিত্র-ঘোষ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৭৭-এ। বর্তমান রচনাবলীর অন্তর্ভুক্ত হবার আগে এটাই সর্বশেষ সংস্করণ ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ (১ম খণ্ড)-র।

উপন্যাসটির একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখেছেন অনিল বিশ্বাস, তাঁর বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য (উপন্যাস) গ্রন্থে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *