স্বয়ংবরা
বার্লিনের বড় রাস্তা কুরফুর্স্টেনডাম যেখানে উলান্ডস্ট্রাসের সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকে উলান্ডস্ট্রাসে উজিয়ে দু-তিনখানা বাড়ি ছাড়ার পরই ‘Hindusthan Haus’ অর্থাৎ ‘Hindusthan House’ অর্থাৎ ভারতীয় ভবন’। আসলে রেস্তোরাঁ, দা-ঠাকুরের হোটেল বললেই ঠিক হয়। জর্মনি শুয়োরের দেশ, অর্থাৎ জর্মনির প্রধান খাদ্য শূকর মাংস। হিন্দুস্থান হাউসে সে মাংসের প্রবেশ নিষেধ। সেই যে তার প্রধান গুণ তা নয়, তার আসল গুণ, সেখানে ভাত ডাল মাছ তরকারি মিষ্টি খেতে পাওয়া যায়। আর যেদিন ঢাকার ফণি গুপ্ত বা চাটগাঁর আব্দুল্লা মিয়া রসুইয়ের ভার নিতেন সেদিন আমাদের পোয়াবারো, কিন্তু উলাডস্ট্রাসেতে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যেত। জর্মনিতে লাল লঙ্কার রেওয়াজ নেই, (‘পাপ্রিকা’ নামক যে লাল আবীর লঙ্কার পদ পেতে চায় তার স্বাদ আবীরেরই মতো) কাজেই হিন্দুস্থান হৌসে লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে তার চতুর্দিকে সিকি মাইল জুড়ে হাঁচি-কাশি ঘন্টাখানেক ধরে চলত। পাড়াপড়শীরা নাকি দু-চারবার পুলিশে খবর দিয়েছিল, কিন্তু জর্মন পুলিশ তদারক-তদন্ত করতে হলে খবর দিয়ে আসত বলে আমরা সেদিনকার মতো লঙ্কার হাঁড়িটা ‘ডয়েটশে ব্যাঙ্কে’ জমা দিয়ে আসতুম। শুনেছি শেষটায় নাকি প্রতিবেশীদের কেউ কেউ লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে গ্যাস-মাস্ক পরত। জর্মনি বৈজ্ঞানিকদের দেশ।
ঢুকেই রেস্তোরাঁ। গোটা আষ্টেক ছোট ছোট টেবিল। এক একটা টেবিলে চারজন লোক খেতে পারে। একপাশে লম্বা কাউন্টার, তার পিছনে হয় ফণি নয় আব্দুল্লা লটরটর করত, অর্থাৎ অচেনা খদ্দের ঢুকলে তার সামনে ব্যস্ত-সমস্ততার ভান করত। কাউন্টারের পাশ দিয়ে ঢুকে পিছনে রান্নাঘর। রেস্তোরাঁর যে দিকে কাউন্টার তার আড়াআড়ি ঘরের অন্য কোণে কয়েকখানা আরামকেদারা আর চৌকি কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। এ কুণ্ডলীর চক্রবর্তী চাচা, উজির-নাজির গুটি ছয় বাঙালি।
অবাঙালিরা আমাদের আড্ডায় সাধারণত যোগ দিত না। তার জন্য দায়ী চাচা। তিনি কথা বলতেন বাঙলায়, আর অবাঙালি থাকলে জর্মনে। এবং সে এমনি তুখোড় জর্মন যে তার রস উপভোগ করবার মতো ক্ষমতা খুব কম ভারতীয়েরই ছিল। ফলে অবাঙালিরা দুদিনের ভিতরই ছিটকে পড়ত। বাঙালিরা জানত যে তারা খসে পড়লেই চাচা ফের বাঙলায় ফিরে আসবেন। তাই তারা তার কটমটে জর্মন দুদণ্ডের মতো বরদাস্ত করে নিত।।
জব্বলপুরের ঔপনিবেশিক বাঙালি শ্রীধর মুখুয্যে তাই নিয়ে একদিন ফরিয়াদ করে বলেছিল, বাঙালি বড্ড বেশি প্রাদেশিক। আর পাঁচজন ভারতবাসীর সঙ্গে মিলে-মিশে তারা ভারতীয় নেশন গড়ে তুলতে চায় না।
চাচা বলেছিলেন, প্রাদেশিক নয়, বাঙালি বড্ড বেশি নেশনাল। বাংলাদেশ প্রদেশ নয়, বাংলাদেশ দেশ। ভারতবর্ষের আর সব প্রদেশ সত্যকার প্রদেশ। তাদের এক-একজনের আয়তন, লোকসংখ্যা, সংস্কৃতি এত কম যে পাঁচটা প্রদেশের সঙ্গে জড়াজড়ি করে তারা যদি ইন্ডিয়ান নেশন, ইন্ডিয়ান নেশন’ বলে চেল্লাচেল্লি না করে, তবে দুনিয়ার সামনে তারা মুখ দেখাতে পারে না। এই বার্লিন শহরেই দেখ। আমরা জন চল্লিশ ভারতীয় এখানে আছি। তার অর্ধেকের বেশি বাঙালি। মারাঠি, গুজরাতি কটা, এক হাতের এক আঙুল, জোর দু আঙুলে গোনা যায়। ত্রিশটা লোক যদি বিদেশের কোনো জায়গায় বসবাস করে তবে অন্তত তার পাঁচটা একজায়গায় জড়ো হয়ে আড্ডা দেবে না? মারাঠি, গুজরাতিরা আড্ডা দেবার জন্য তোক পাবে কোথায়?
আড্ডার পয়লা নম্বরের আড্ডাবাজ পুলিন সরকার বলল, ‘লোক বেশি হলেও তারা আর যা করে করুক, আড্ডা দিতে পারত না। আড্ডা জমাবার বুনিয়াদ হচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপ, কাছারি-বাড়ি, টঙ্গিঘর, বৈঠকখানা—এককথায় জমিদারী প্রথা।
চাচা জিজ্ঞেস করলেন, তাই বুঝি তুই কলেজ পালিয়ে আড্ডা মারিস? তোদের জমিদারীর সদর-খাজনা কত রে?
সরকার বলল, কাণাকড়িও না। জমিদারি গেছে, আচ্ছাটি বাঁচিয়ে রেখেছি। আমার ঠাকুরদাকে এক সায়েব আদালতে জিজ্ঞেস করেছিল তার ব্যবসা কী? বুড়ো বলেছিল, সেলিং।
মুখুয্যে জিজ্ঞেস করল, তার মানে?
তার মানে, তিনি জমিদারী বিক্রি করে করে জীবনটা কাটিয়েছেন। তাই বাবাকে কোনো সদর-খাজনা দিতে হয়নি।
হিন্দুস্থান হৌসে মদ বিক্রি হত না। কিন্তু বিয়ার বারণ ছিল না। সূর্য রায় বেশির ভাগ সময়ই বিয়ারে গলা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে নাক দিয়ে ধুয়ো ছাড়তেন। চাচার পরেই জ্ঞানগম্যিতে তার প্রাধান্য আড্ডায় ছিল বেশি। চাচার জর্মনজ্ঞান ছিল পাণ্ডিত্যের জ্ঞান, আর রায়ের জ্ঞান ছিল বহুমুখী। বার্লিনের মতো শহরের বুকের উপর বসে তিনি কাগজে জন কলাম লিখে পয়সা কামাতেন। ফোনে কথা শুনে শব্দতাত্ত্বিক হের মেনজেরাট পর্যন্ত ধরতে পারেননি যে জর্মন রায়ের মাতৃভাষা নয়।
চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ‘হক কথা কয়েছ সরকার। সবই বিক্রি, সব বেচে ফেলতে হয়। খাই তো দুফোঁটা বিয়ার, কিন্তু বিক্রি করে দিতে হয়েছে বেবাক লিভারখানা।’
আড্ডার সবচেয়ে চ্যাংড়া ছিল গোলাম মৌলা। রায়ের ‘প্রতেজে’ বা ‘দেশের ছেলে’। সে সবসময় ভয়ে ভয়ে মরত, পাছে রায় বিয়ারে বানচাল হয়ে যান। চুপেচুপে বলল, মামা, বাড়ি চলুন।
রায় চোখ মেললেন। একদম সাদা। বললেন, তুই বুঝি ভয় পেয়েছিস আমি মাতাল হয়ে গিয়েছি! ইম্ বিন্ ইন্ মাইনে নরমালে সুস্টান্ট, ডাস্ হাইস্ট, আইন বিশে ব্লউ। আমি আমার সাধারণ (নর্মাল) অবস্থায় আছি, অর্থাৎ ঈষৎ নীল। তার মানে, মনে একটু রঙ লেগেছে, এবং ঐ রঙ লাগানো অবস্থাই ছিল তার নর্মাল অবস্থা। মদ্যসংক্রান্ত বিষয় রায় কখনো বাংলায় বলতেন না। তার মতে বাংলায় তার কোনো পরিভাষা নেই। পান্তা ভাতে কাঁচা লঙ্কা চটকে এক সানকে গিলে এলুম—যেমন জনে বলা যায় না, তেমনি মদ্যসংক্রান্ত ব্লাউ (নীল), বেজফেন্ (টে-টঘুর), ফ (সম্পূর্ণ), বেঙ্কে (ডুবেমরা) কথার বাংলা করলেও বাংলা হয় না।
চাচা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার অ্যাবনর্মাল অবস্থাটা দেখবার বাসনা আমার মাঝে মাঝে হয়।’
রায় আঁৎকে উঠে বললেন, ষাট, ষাট! আমি মরব, আপনিও মরবেন। গেল সাত বছরে একদিন এক ঘন্টার তরে বিয়ার না খেয়ে আমি অ্যাবনর্মাল অবস্থায় ছিলুম। গিয়েছিলুম ফেরবেল্লিনার প্লাৎসের মসজিদে—ঈদের পরবে।* মদ খেয়ে মসজিদে যাওয়ার সাহস ওমর খাইয়ামেরও ছিল না, আমি তো নস্যি। বলে ওস্তাদরা যে রকম মিয়া (তানসেন) কী তোড়ী গাইবার সময় কানে হাত ছোঁয়ান সেইরকম কানমলা খেয়ে নিলেন। বললেন, ফল? ফেরার পথে মিস জমিতফকে বিয়ের কথা দিয়ে ফেলেছি। অ্যাবনর্মাল–
কিন্তু তারপর রায় কী বলেছিলেন, সে কথা শোনে কে? রায়ের পক্ষে খুন করা অসম্ভব নয়, অবস্থাভেদে গাঁটও হয়তো তিনি কাটতে পারেন, কিন্তু তিনি যে একদিন বিয়ের ফাঁদে পা দেবেন, এত বড় অসম্ভব অবস্থার কল্পনা আমরা কোনো দিন করতে পারিনি। স্বয়ং হিন্ডেনবুর্গ যদি তখন গোঁফ কামিয়ে আমাদের আড্ডায় এসে উপস্থিত হতেন তাহলেও আমরা এতদূর আশ্চর্য হতুম না।
রায় তখন লড়াইয়ে-জেতা বীরের গর্জনে হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, দেখতে চান আমার অ্যাবনর্মাল অবস্থা আরো দু-চারবার? সরকারী লাইব্রেরী পোড়ানো, আইনস্টাইনকে খুন, কিছুই বাদ যাবে না। তবু যদি
চাচা বললেন, বড় ভাবিয়ে তুললে হে রায়সাহেব!
আমরা তখন সবাই কলরব করে রায়কে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কেউ বলছে এমন সুন্দরী সহজে জোটে না, কেউ বলছে, ম্যাথম্যাটিকস যা জানে, কেউ বা বলে, কী মিষ্টি স্বভাব!
সরকার বলল, ওহে গোলাম মৌলা, রাধা কেষ্টর কে হয় জানো?
চাচা বললেন, বড় ভাবিয়ে তুললে হে রায়সাহেব!
দু-দুবার চাচা যে কেন ‘ভাবিত’ হলেন আমরা ঠিক ধরতে পারলুম না। রায় যে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে আশ্চর্য হওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কী আছে?
চাচার সবচেয়ে ন্যাওটা ভক্ত গোঁসাই বলল, আপনি তো বিয়ে করেননি, কখনো এনগেজডও হননি। তাই আপনার ভয়, ভাবনা
চাচা বললেন, আমার ফাঁসি হয়নি সত্যি, কিন্তু তাই বলে আসামী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াইনি, তুই কী করে জানলি?’
ঠেলাঠেলির ভিতর বাসের হ্যান্ডেল ধরতে পেলে মানুষ যে রকম ঝুলে পড়ে, রায় ঠিক তেমনি চাচার জবানবন্দীর হ্যান্ডেল পেয়ে বললেন, ‘উকিলের নাম বলুন চাচা, যে আপনায় বাঁচালে।
রায়ের বিয়ের খবর শুনে আমরা আশ্চর্য হয়েছিলুম, কিন্তু স্তম্ভিত হইনি। কারণ রায় স্ত্রীজাতিকে অতি সন্তর্পণে দূরে ঠেলে রাখতেন। তাই শেষ পর্যন্ত ধরা দিলেন। কিন্তু চাচা এ সব বাবদে স্ত্রী-পুরুষে কোনো তফাৎ রাখতেন না। বার্লিনের মেয়েমহলে তিনি ছিলেন বেসরকারী পাত্রী। বরঞ্চ পাদ্রীদের সম্বন্ধে ফষ্টিনষ্টির কাহিনী মাঝে মাঝে শোনা যায়, কিন্তু চাচার হৃদয় জয় করতে যাবে কে? সে-হৃদয় তিনি বহু পূর্বেই আত্মজনের মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। অততা হিস্যেদারের সম্পত্তি নিলামে উঠলেও তো কেউ কেনে না। আমরা সবাই করুণ নয়নে চাচার দিকে তাকালুম, তিনি যেন কাহিনীটা চেপে না যান।
চাচা বললেন, ‘ওরকম ধারা তাকাচ্ছিস কেন? তোরা কাউকে চিনবিনে। ১৯১৯-এর কথা। আমি তখন সবে বার্লিনে এসেছি। বয়স আঠারো পেয়নি। মাকুন্দ বলে বিনা ব্লেডে গোঁফ কামাতুম—ল্যান্ডলেডি যাতে ঘর গোছাবার সময় ক্ষেউরির জিনিসপত্র না দেখে ভাবে আমি নিতান্ত চ্যাংড়া। তার থেকেই বুঝতে পারছিস আমি কতটা অজ পাড়াগেঁয়ে, আনাড়ি ছিলুম। একগাদা ভারতীয়ও ছিল না যে আমাকে সলা-পরামর্শ দিয়ে ওয়াকিফহাল করে তুলবে। যে দু-চারজন ছিলেন তারা তখন আপন আপন ধান্দায় মশগুল—জর্মনির তখন বড় দুর্দিন।
ভাগ্যিস দু-চারটে গুঁত্তাগাঁত্তা খাওয়ার পরই হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল!
সাইনবোর্ডে ‘গেট্রেক্তে’ (পানীয়) শব্দ দেখে আমি বিয়ারখানায় ঢুকে দুধ চেয়ে বসেছি। কী করে জানবো বল পানীয়গুলো রূঢ়ার্থে বিয়ার-ব্রান্ডি বোঝায়। ওয়েট্রেসগুলো পাজরে হাত দিয়ে দু-ভাজ হয়ে এমনি খিলখিল করে হাসছিল যে শব্দ শুনে হিম্মৎ সিং রাস্তা থেকে তাড়িখানার ভিতরে তাকালেন। আমার চেহারা দেখে তার দয়ার উদয় হয়েছিল তোদের মতো পাষণ্ডগুলোরও হত। গটগট করে ঘরে ঢুকলেন। আমার পাশে বসে ওয়েট্রেসকে বললেন, ‘এক লিটার বিয়ার বিটে (প্লীজ)!
আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ার নহী পিতে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললুম, না।
‘ওয়াইন?
ফের মাথা নাড়ালুম।।
‘কিসি কিসকি শরাব?’
আমি বললুম যে আমি দুধের অর্ডার দিয়েছি।
দাড়ি-গোঁপের ভিতর যেন সামান্য একটু হাসির আভাস দেখতে পেলুম। বললেন, ‘অ সমঝা। তারপর আমাকে বসে থাকতে আদেশ দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন এক গেলাস দুধ হাতে নিয়ে। সমস্ত বিয়ারখানার লোক যে অবাক হয়ে তার কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছে, সেদিকে কণামাত্র হৃক্ষেপ নেই। তারপর, সেই যে কসলেন গেট হয়ে, আর আরম্ভ করলেন জালা জালা বিয়ার-পান। সে পান দেখলে গোলাম মৌলা আর ককখনো রায়ের পানকে ভয় করবে না।
শিখের বাচ্চা, রক্তে তার তিনপুরুষ ধরে আগুন-মার্কা ধেননা, আর মোলায়েমের মধ্যে নির্জলা হুইস্কি। বিয়ার তাঁর কী করতে পারে?
লিটার আষ্টেক খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পয়সা দিয়ে বেরোবার সময়ও কোনো দিকে একবারের তরে তাকালেন না। আমি কিন্তু বুঝলুম, বিয়ারখানার হাসি ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। সবাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে হিম্মৎ সিংয়ের দিকে তাকাচ্ছে, আর ফিসফিস প্রশংসাধ্বনি বেরুচ্ছে।
বাইরে এসে শুধু বললেন, অব ইনলোগোঁকো পতা চ গিয়া কি হিন্দুস্থানী শরাব ভী পি সত্তা।
তারপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে একখানা চেয়ারে বসালেন। নিজে খাটে শুলেন। কান পেতে আমার দুঃখ-বেদনার কাহিনী শুনলেন। তারপর বাড়ির কর্তী ফ্রাউ (মিসেস) রুবেসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মহিলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিধবা। খানদানী ঘরের মেয়ে এবং হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে যে ভাবে কথা কইলেন তার থেকে বুঝলুম যে হিম্মৎ সিং সে বাড়িতে রাজপুত্রের খাতির-যত্ন পাচ্ছেন।
তারপর এক মাসের ভিতর তিনি বার্লিন শহরের কত সব হোমরাচোমরা পরিবারের সঙ্গে আমায় আলাপ করিয়ে দিলেন, এতদিন পর সেসব পরিবারের বেশির ভাগের নামও আমার মনে নেই। কুটনৈতিক সমাজ, খানদানী গোষ্ঠী, অধ্যাপক মণ্ডলী, ফৌজী আজ্ঞা সর্বত্রই হিম্মৎ সিংয়ের অবাধ গতায়াত ছিল। হিম্মৎ সিং এককালে ভারতীয় ফৌজের বড়দরের অফিসার ছিলেন। ১৯১৪-১৮র যুদ্ধে বন্দী হয়ে জর্মনিতে থাকার সময় তিনি জর্মনদের যুদ্ধপরামর্শদাতা ছিলেন। এবং সেই সূত্রে বার্লিনের সকল সমাজের দ্বার তার জন্য খুলে যায়। হিম্মৎ সিং আমাকে কখনো তার জীবনী সবিস্তারে বলেননি, কাজেই জনরা কেন যে ১৯১৭-১৮ সালে তাকে মস্কো যেতে দিয়েছিল, ঠিক জানিনে। সেখান থেকে কেন যে আবার ১৯১৯ সালে বার্লিন ফিরে এলেন, তাও জানিনে। তবে তাকে বহুবার রুশ-পলাতক হোমরাচোমরাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখেছি। সেসব রুশদের কাছ থেকে একথাও শুনেছি যে হিম্মৎ সিং মস্কোতে যে খাতির-যত্ন পেয়েছিলেন তার সঙ্গে তাঁর বার্লিনের প্রতিপত্তিরও তুলনা হয় না। কম্যুনিস্ট বড়কর্তাদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়াতে তিনি নাকি মস্কো ত্যাগ করেন। আশ্চর্য নয়, কারণ হিম্মৎ সিংয়ের মতো জেদী আর একরোখা লোক আমি আমার জীবনে দুটি দেখিনি।
আর আমায় লাই যা দিয়েছিলেন! ভালোমন্দ কিছুমাত্র বিবেচনা না করে আমাকে যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যেতেন, আমি বেজার হয়ে বসে রইলে রাইস্টাক ভাড়া করে নাচের বন্দোবস্ত করবার তালে লেগে যেতেন। আমার সর্দি হলে বার্লিন মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালকে ডেকে পাঠাতেন, শরীর ভালো থাকলে নিজের হাতে কাবাবরুটি বানিয়ে খাওয়াতেন।
তিন মাস ধরে কেউ কখনো সুখ-স্বপ্ন দেখেছে? ফ্রয়েড নাকি বলেন, স্বপ্নের পরমায়ু মাত্র দু-তিন মিনিট। এ তত্ত্বটা জেনেও মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারলুম না, যেদিন হিম্মৎ সিং হঠাৎ কিছু না বলেকয়ে নিরুদ্দেশ হলেন। ফ্রাউ রুবেন্সও কিছুই জানেন না। বললেন, যে স্যুট পরে বেরিয়েছিলেন তাই নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কয়েকদিন পরে মার্সাই থেকে চিঠি, তার জিনিসপত্র ভিখিরি-আতুরকে বিলিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে।
বহু বৎসর পরে জানতে পেরেছিলুম, আনহাটার স্টেশনে তার এক প্রাচীন রাজনৈতিক দুশমনকে হঠাৎ আবিষ্কার করতে পেয়ে তাকে ধরবার জন্য পিছু নিয়ে তিনি একবস্ত্রে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
হিম্মৎ সিংয়ের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি। তার কাছ থেকে কোন দিন কোনো চিঠিও পাইনি।
তারপর আরো তিন মাস কেটে গিয়েছে। বার্লিনে যে সমাজে আমাকে চড়িয়ে দিয়ে হিম্মৎ সিং মই নিয়ে চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে আমি লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে জখমও হলুম।
এমন সময় ফ্রাউ রুবেন্স একদিন টেলিফোন করে অনুরোধ জানালেন আমি যেন তার সঙ্গে ক্যোনিক কাফেতে বেলা পাঁচটায় দেখা করি। বিশেষ প্রয়োজন। হিম্মৎ সিং চলে যাওয়ার পর ফ্রাউ রুবেসের সঙ্গে আমার মাত্র একদিন দেখা হয়েছিল। টেলিফোনে মাঝে মাঝে হিম্মৎ সিংয়ের খবর নিয়েছি—যদিও জানতুম তাতে কোনো ফল হবে না কিন্তু ও-বাড়িতে যাবার মত মনের জোর আমার ছিল না। গোঁসাইয়ের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বার্লিনে শরৎ চাটুয্যের উপন্যাস পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতুম না বটে, কিন্তু বাঙালি তো বটি!
পাঁচটার সময় কাফে ক্যোনিকে গিয়ে দেখি কাফের গভীরতম আর নির্জনতম কোণে ফ্রাউ রুবেন্স বসে, আর তার পাশে—এক ঝলকে যা দেখতে পেলুম—এক বিপজ্জনক সুন্দরী।
ফ্রাউ রুবেন্স পরিচয় দিয়ে নাম বললেন, ফ্রলাইন ভেরা গিব্রিয়ডফ।
লেডি-কিলার অর্থাৎ নটবর পুলিন সরকার জিজ্ঞেস করল, ‘বিপজ্জনক সুন্দরী বলতে কী বোঝাতে চাইলেন আমার ঠিক অনুমান হল না। বার্লিনের আর পাঁচজনের জন্য বিপজ্জনক, না আপনার নিজের ধর্মরক্ষায় বিপজ্জনক?
চাচা বললেন, আমার এবং আর পাঁচজনের জন্য বিপজ্জনক। তোর কথা বলতে পারিনে। তুই তো বার্লিনের সব বিপদ, সব ভয় জয় করতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিল।
শ্রীধর মুখুয্যে আবৃত্তি করল–
মাইন হের্ৎস ইস্ট ভী আইন বীনেনহাউস
ডী মেডেল জি ডী বীনেন—
হৃদয় আমার মধুচক্রের সম
মেয়েগুলো যেন মৌমাছিদের মতো
কত আসে যায় কে রাখে হিসাব বল
ঠেকাতে, তাড়াতে মন মোর নয় রত।
রায় বললেন, কী মুশকিল! এরা যে আবার কবিত্ব আরম্ভ করল।
চাচা বললেন, ফ্রাউ রুবেন্স ফ্রলাইন ভেরার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বিশেষ করে জোর দিয়ে বললেন যে হিম্মৎ সিং যখন মস্কোতে ছিলেন তখন বসবাস করেছিলেন গিব্রিয়ডফদের সঙ্গে। আমি তখন ভেরার দিকে তাকাতে তিনিও ভালো করে তাকালেন।
ছ’মাস ধরে প্রতিদিন যে লোকটির কথা উঠতে-বসতে মনে পড়েছে তিনি এদের বাড়িতে ছিলেন, এই মেয়েটির চোখে তার ছায়া কত শত বার পড়েছে, আমি আমার অজান্তে তার চোখে যেন হিম্মৎ সিংয়ের ছবি দেখতে পাবার আশা করে ভালো করে তাকালুম।
হিম্মৎ সিংয়ের ছবি দেখতে পাইনি, কিন্তু ভেরার চোখ থেকে বুঝতে পারলুম, হিম্মৎ সিং আমার জীবনের কতখানি জায়গা দখল করে বসে আছেন সে-কথা ভেরাও জানেন। তার চোখে আমার জন্য সহানুভূতি টলটল করছিল।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, আপনি হিম্মৎ সিংকে অত্যন্ত ভালোবাসেন।
এর উত্তর দেবার আমি প্রয়োজন বোধ করলুম না।
ফ্রাউ রুবেন তখন বললেন, একটি বিশেষ অনুরোধ করার জন্য আমরা দুজন আজ আপনাকে ডেকেছি। হিম্মৎ সিং আজ বার্লিনে নেই—যেখানেই হোন ভগবান তাকে কুশলে রাখুন—আমি ধরে নিচ্ছি তিনি যেন এখন আমাদের মাঝখানেই বসে আছেন। তাই আপনাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছি, আজ যদি হিম্মৎ সিংয়ের কোনো প্রিয় কাজ করতে আপনাকে অনুরোধ করি আপনি সেটা করবার চেষ্টা করবেন কি?
আমি বললুম, আপনাদের মনে কি সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আছে?
ফ্রাউ রুবেন্স তখন বললেন, ‘আমার মনে নেই! ফ্রলাইন ভেরার জন্য শুধু আপনাকে জিজ্ঞাসা করছিলুম। ভেরা মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন, তারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। ফ্রাউ রুবেন্স বললেন; ‘ভেরা অত্যন্ত বিপদে পড়ে মস্কো থেকে বার্লিন পালিয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক দলাদলিতে ধরা পড়ে তার বাপ-মা, দু’ভাই সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়েছেন। এক ভাই তখন অডেসায় ছিলেন। তিনি কোনোগতিকে প্যারিসে পৌঁচেছেন। ভেরা যদি তার ভায়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন, তবে তার বিপদের শেষ হয়। কিন্তু তার কাছে রাশান পাসপোর্ট তো নেইই, অন্য কোনো পাসপোর্টও তিনি যোগাড় করতে পারেননি। জর্মন পাসপোর্ট পেলেও কোনো বিশেষ লাভ নেই। কারণ জর্মনদের ফ্রান্সে ঢুকতে দিচ্ছে না। তবে সেটা যোগাড় করতে পারলে তিনি অন্তত কিছুদিন বার্লিনে থাকতে পারতেন। এখন অবস্থা এই যে বার্লিন পুলিশ খবর পেলে ভেরাকে জেলে পুরবে। রাশাতেও ফেরৎ পাঠাতে পারে।
আমরা সবাই একসঙ্গে আঁৎকে উঠলুম।
চাচা বললেন, এতদিন পরও ঘটনাটা শুনে তোরা আঁৎকে উঠছিস। আমি শুনেছিলুম ফ্রলাইন ভেরার সামনাসামনি। আমার অবস্থাটা ভেবে দেখ।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, এখন কী করা যায় বলুন?
হিম্মৎ সিংয়ের কথা মনে পড়ল। আমাদের কাছে যে বাধা হিমালয়ের মতো উঁচু হয়ে দেখা দিয়েছে, তিনি তার উপর দিয়ে স্কেটিং করে চলে যেতেন। পাসপোর্ট যোগাড় করার চেয়ে দেশলাই কেনা তার পক্ষে কঠিন ছিল–শিখধর্মের সিগরেট নিষেধ’ তিনি মানতেন।
ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, ‘ভেরার জন্য পাসপোর্ট যোগাড় করা তাঁর পক্ষেও কঠিন, হয়তো অসম্ভব হত। কিন্তু একথাও জানি যে শেষ পর্যন্ত তিনি একটা পথ বের করতেনই করতেন।
এ বিষয়ে আমার মনেও কোনো সন্দেহ ছিল না।
ফ্রাউ রুবেন্স অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করতে আপনার কোনো আপত্তি আছে কি?
ধর্মত বলছি, আমি ভাবলুম ফ্রাউ রুবেন্স রসিকতা করছেন। সব দেশেরই আপন আপন বিদঘুটে রসিকতা থাকে, তাই এক ভাষার রসিকতা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। হয়ত জর্মন রসিকতাটির ঠিক রস ধরতে পারিনি ভেবে ক্যাবলার মতো আমি তখন একটুখানি ‘হে-হে’ করেছিলুম।
ফ্রাউ রুবেন্স আমার কাষ্ঠরসময় ‘হে-হে’তে বিচলিত না হয়ে বললেন, ‘নিতান্ত দলিল-সংক্রান্ত বিয়ে। আপনি যদি ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করেন তবে তিনি সঙ্গেসঙ্গেই ভারতীয় অর্থাৎ ব্রিটিশ নেশনালিটি পেয়ে যাবেন এবং অনায়াসে প্যারিস যেতে পারবেন। মাসতিনেক পর আপনি ভেরার বিরুদ্ধে ডেজারশনের (পতিবর্জনের) মোকদ্দমা এনে ডিভোর্স (তালাক) পেয়ে যাবেন। তারপর একটু কেশে বললেন, ‘আপনাকে স্বামীর কোনো কর্তব্যই সমাধা করতে হবে না। একটুখানি থেমে বললেন, ‘খাওয়ানো পরানো, কিছুই না।’
লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল, না ভয়ে আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, না আশ্চর্য হয়ে আমার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল আজ এতদিন বাদে বলতে পারব না। এমনকি ক্যাবলাকান্তের মতো ‘হে-হে’ করাও তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
রায়ের বিয়ার ফুরিয়ে গিয়েছে বলে কথা বলার ফুর্সৎ পেলেন। বললেন, ‘বিলক্ষণ। আমারও সেই অবস্থা হয়েছে।
চাচা বললেন, ছাই হয়েছে, হাতি হয়েছে। আমার বিপদের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। সব কথা পয়লা শুনে নাও, তারপর যা খুশি বলল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফ্রাউ রুবেন্স যা বললেন তার থেকে বুঝতে পারলুম যে তিনি ভাত ঠাণ্ডা হতে দেন না, তার উপরই গরম ঘি ছাড়েন। বললেন, আমার দৃঢ় প্রত্যয়, হিম্মৎ সিংকে এ পথটা দেখিয়ে দিতে হত না। তিনি দু’মিনিটের ভিতর সব কিছু ফিক্স উন্ড ফের্তিস (পাকাপোক্ত করে দিতেন।
চাচা বললেন, ইয়োরোপে cold-blooded খুন হয়, ভারতবর্ষে কোল্ড-ব্লাডেড বিয়ে হয়। এবং দুটোই ভেবে চিন্তে, প্ল্যানমাফিক, প্রিমেডিটেটেড। কিন্তু এখানে আমাকে অনুরোধ করা হচ্ছিল কোল্ড-ব্লাডেড বিয়ে করতে, কিন্তু না ভেবে-চিন্তে, অর্থাৎ রোমান্টিক কায়দায়। প্রথম দর্শনে প্রেম হয় শুনেছি, কিন্তু প্রথম দর্শনেই বিয়ে, এরকমধারা ব্যাপার আমি ইয়োরোপে দেখিওনি, শুনিওনি। অবশ্য আমার এ সব তাবৎ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু বলির পাঁঠা আমি হতে যাব কেন?
অপরূপ সুন্দরী। দেখে চিত্তচাঞ্চল্য হয়েছিল অস্বীকার করব না, কিন্তু বিয়ে–!
ফ্রাউ রুবেন্স গম্ভীরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
আমি চুপ।
তখন ফ্রাউ রুবেন্স এমন একখানা অস্ত্র ছাড়লেন যাতে আমার আর কোনো পথ খোলা রইল না। বললেন, আপনি কি সত্যি হিম্মৎ সিংকে ভালোবাসতেন?
চাচা বললেন, অন্য যে-কোনো অবস্থায় হলে আমি ফ্রাউ রুবেন্সকে একটা ঠিক উত্তর দেবার চেষ্টা করতুম, কিন্তু তখন কোনো উত্তরই দিতে পারলুম না। তোরা জানিস আনি স্নেহ-প্রেম-দয়ামায়াকে বুদ্ধিবৃত্তি-আত্মজয়ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দাম দিই। কাজেই ফ্রাউ রুবেসের আঘাতটা আমার কতখানি বেজেছিল তার খানিকটে অনুমান তোরা করতে পারবি। কোনো চোখা উত্তর যে দিইনি তার কারণ, ততখানি চোখা জর্মন আমি তখন জানতুম না।
ঘড়েল মাস্টারগুলো জানে যে ছাত্র যখন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, তখন তাকে ভালো করে নির্যাতন করার উপায় হচ্ছে চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করা। ফ্রাউ রুবেন্স সেটা চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি তা হলে হিম্মৎ সিংয়ের ঋণ শোধ করতে চান না?
রায়ের বিয়ার এসে গিয়েছে। চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চাচা, মাপ করুন। আপনার কেস অনেক বেশি মারাত্মক।’
চাচা রায়ের কথায় কান না দিয়ে বললেন, ‘সেই বে-ইজ্জতিরও যখন আমি কোনো উওর দিলুম না তখন ফ্রলাইন গিব্রিয়ডফ হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। কুণ্ডলী-পাকানো গোখরো সাপকে আমি এরমধারা হঠাৎ খাড়া হতে দেখেছি। গিব্রিয়াডফের মুখ লাল, কালো চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে, সে আগুনের আঁচ ব্লন্ড চুলে লেগে চুলও যেন লাল হয়ে গিয়েছে।
ফ্রাউ রুবেন তাকে বললেন, আপনি শান্ত হোন। বারন ফন্ ফাক্লেনডর্ফ যখন আপনাকে বিয়ে করার জন্য পায়ের তলায় বসেন, তখন এর প্রত্যাখ্যানে অপমান বোধ করছেন কেন?
ভেরা বসে পড়লেন।
আমি তখন দিগ্বিদিকশূন্য। অতিকষ্টে বললুম, আমাকে দুদিন সময় দিন। ফ্রাউ রুবেন্স কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ভেরা বাধা দিয়ে বললেন, ‘সেই ভালো। দু’জনাই উঠে দাঁড়ালেন। ফ্রাউ রুবেন্স বললেন, ‘পরশুদিন পাঁচটায় তাহলে এখানে আবার দেখা হবে।
হ্যান্ডশেক না করেই দুজনা বেরিয়ে গেলেন। ফ্রাউ রুবেন্স কঁচা রেল লাইনের উপর বিরাট এঞ্জিনের মতো হেলেদুলে গেলেন, আর ভেরার চেয়ার ছেড়ে ওঠা আর চলে যাওয়ার ধরন দেখে মনে হল, যেন টব ছেড়ে রজনীগন্ধাটি হঠাৎ দুখানা পা বের করে ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সর্বাঙ্গে হিল্লোল, কিন্তু মাথাটি স্থির, নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো। যেন রাজপুত মেয়ে কলসী-মাথায় চলে গেল। ক্যোনিক কাফের
আন্তর্জাতিক খদ্দের-গোষ্ঠী সে-চলন মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখল।
লেডি-কিলার সরকার বলল, মাইরি চাচা, আপনার সৌন্দর্যবোধ আর কবিত্বশক্তি দুইই আছে। অমনতরো বিপাকের মধ্যিখানে আপনি সবকিছু লক্ষ্য করলেন!
চাচা বললেন, কবিত্বশক্তি না ষাঁড়ের গোবর! আমি লক্ষ্য করেছিলুম জ্বরের ঘোরে মানুষ যে রকম শেতলপাটির ফুলের পেটার্ন মুখস্থ করে, সেই রকম।
তারপরে দুদিন আমার কী করে কেটেছিল সে-কথা আর বুঝিয়ে বলতে পারব না! একরকম হাবা হয় দেখেছিস, মুখে যা দেওয়া গেল তাই পড়ে পড়ে চিবোয় আর চিবোয়—বলে দিলেও গিলতে পারে না। আমি ঠিক তেমনি দুদিন ধরে একটি কথার দুটো দিক মনে মনে কত লক্ষবার যে চিবিয়েছিলুম বলতে পারব না। হিম্মৎ সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবার একমাত্র পন্থা যদি ফ্রলাইন ভেরাকে বিয়ে করাই হয় তবে আমি সে কর্তব্য এড়াই কী করে—আর চেনা নেই, পরিচয় নেই, একটা মেয়েকে হুশ করে বিয়ে করিই বা কী প্রকারে? সমস্যাটা চিবুচ্ছি আর চিবুচ্ছি, গিলে ফেলে ভালো-মন্দ যাই হোক, একটা সমাধান যে করব, সে ক্ষমতা যেন সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলুম।
মুরুব্বি নেই, বন্ধু নেই, সলা-পরামর্শ করিই বা কার সঙ্গে? হিম্মৎ সিং যাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা জন্মাবার কথা নয়, নিজের থেকেও কোনো বন্ধু জোটাতে পারিনি কারণ আমার জর্মন তখনো গল্প জমাবার মতো মিশ্রির দানা বাঁধেনি। যাই কোথায়, করি কী?
য়ুনিভার্সিটির কাছে একটা দুধের দোকানে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি—আমার মেয়াদের তখন আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা বাকি—এমন সময় জুতোর শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, সামনে ফ্রলাইন ক্লারা ফন্ ব্রাভেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের ছাত্রী, বার্লিনের মেয়েদের হকি টিমের কাপ্তান। ছ’ফুটের মত লম্বা, হঠাৎ রাস্তায় দেখলে মনে হতো মাইকেলএঞ্জেলোর মার্বেল মূর্তি স্কার্ট-ব্লাউজ পরে বেড়াতে বেরিয়েছে। আমার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল।
জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে আপনার?
মাথা নাড়িয়ে জানালুম কিচ্ছু হয়নি।
ধমক দিয়ে বললেন, আলবৎ হয়েছে! খুলে বলুন।
বয়সে আমার চেয়ে ছয় বছরের বড় হয় কি না হয়, কথার রকম দেখে মনে হয় যেন জ্যাঠাইমা। বললুম, বলছি, কিছুই হয়নি।
ফন্ ব্ৰাখেল আমার পাশে বসলেন। আমার কোটের আস্তিনে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, বলুনই না কী হয়েছে।
তখন চেখফের একটা গল্প মনে পড়ল। এক বুড়ো গাড়োয়ান তার ছেলে মরে যাওয়ার দুঃখের কাহিনী কাউকে বলতে না পেয়ে শেষটায় নিজের ঘোড়াকে বলেছিল। ঘোড়ার সঙ্গে ফন্ ব্রাভেলের অন্তত একটা মিল ছিল। হকিতে তার ছুট যেমন-তেমন ঘোড়ার চেয়ে কম ছিল না। আমি তখন মরিয়া। ভাবলুম, দুগগা বলে ঝুলে পড়ি।
সমস্ত কাহিনী শুনে ফন্ ব্রাভেল পাঁচটি মিনিট ধরে ঠা-ঠা করে হাসলেন। হাসির ফাঁকে ফাঁকে কখনো বলেন, ‘ডু লীবার হের গট (হে মা কালী), কখনো বলেন, ‘ভী ক্যোলি’ (কী মজার ব্যাপার), কখনো বলেন, লাখেন ডি গ্যোটা’ (দেবতারা শুনলে হাসবেন)।
আমি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। ফন্ ব্রাভেল আমার কাঁধে দিলেন এক গুত্তা। ঝপ করে ফের বসে পড়লুম। বললেন, ‘ডু ক্লাইনার ইডিয়োট (হাবাগঙ্গারাম), এখখুনি তোমার ফোন করে বলে দেওয়া উচিত, তোমার দ্বারা ওসব হবে-টবে না।
আমি বললুম, হিম্মৎ সিং থাকলে যা করতেন, আমার তাই করা উচিত।
ফন্ ব্রাভেল বললেন, ঈসপের গল্প পড়নি? ব্যাঙ ফুলে ফুলে হাতি হবার চেষ্টা করেছিল। হিম্মৎ সিংয়ের পক্ষে যা সরল, তোমার পক্ষে তা অসম্ভব। তাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি—হকি খেলায় তিনি আমাদের তালিম দিতেন। তার দাড়ি-গোঁফ নিয়ে তিনি পঁচিশখানা বিয়ে করতে পারতেন, দুটো হারেম পুষতে পারতেন। পারো তুমি?
আমি বললুম, গিব্রিয়ডফ বড় বিপদে পড়েছেন। আমার তো কর্তব্যজ্ঞান আছে!
ফন্ ব্রাভেল বললেন, যে মেয়ে মস্কো থেকে পালিয়ে বার্লিন আসতে পারে, তার পক্ষে বার্লিন থেকে প্যারিস যাওয়া ছেলেখেলা। রুশ সীমান্তের পুলিশের হাতে থাকে মেশিনগান, জর্মন সীমান্তের পুলিশের হাতে রবরের ডাণ্ডা।
আমি যতই যুক্তিতর্ক উত্থাপন করি তিনি ততই হাসেন, আর এমন চোখাচোখা উত্তর দেন যে আমার তাতে রাগ চড়ে যায়। শেষটায় বললুম, আপনি পুরুষ হলে বুঝতে পারতেন, যুক্তিতর্কের উপরেও পুরুষের কর্তব্যজ্ঞান নামক ধর্মবুদ্ধি থাকে।
ফন্ ব্রাভেল গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি যে পুরুষ তাতে আর কী সন্দেহ! সোজা বলে ফেল না কেন সুন্দরী দেখে সেই পুরুষের চিত্তচাঞ্চল্য হয়েছে।
আমি আর ধৈর্যধারণ করতে পারলুম না। বেরবার সময় শুনতে পেলুম ফন্ ব্রাভেল বলছেন ‘বিয়ের কেক-শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়ে না কিন্তু! বিয়ে হবে না।
একেই তো আমার দুর্ভাবনার কূলকিনারা ছিল না, তার উপর ফন্ ব্রাথেলের ব্যঙ্গ। মনটা একেবারে তেতো হয়ে গেল। শরৎ চাটুয্যের নায়করাই শুধু যত্রতত্র ‘দিদি’ পেয়ে যায়, আমার কপালে ঢুঢ়ু।
সোজা বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়লুম। অন্ধকারে শিস দিয়ে মানুষ যেরকম ভূতের ভয় কাটায় আমি তেমনি হিম্মৎ সিংয়ের প্রিয় দোহাটি আবৃত্তি করতে লাগলুম:
‘এহসান নাখুদাকা উঠায় মেরী বলা
কিস্তি খুদা পর ছোড় দু লঙ্গরকো তোড় দুঁ।’
‘মাঝি আমায় সব বিপদ-আপদ থেকে বাঁচাবে এই আমার ভরসা?
নৌকো খুদার নামে ভাসালুম, নোঙর ভেঙে ফেলে দিয়েছি।
পরদিন পাঁচটার সময় কাফে ক্যোনিকে গিয়ে বসলুম। জানা ছিল, ফাসির পূর্বে খুনীকে সাহস দেবার জন্য মদ খাইয়ে দেওয়া হয়। হিম্মৎ সিং আমাকে কখনো মদ খেতে দেননি। ভাবলুম, তার ফঁসিতে যখন চড়ছি তখন খেতে আর আপত্তি কী?
গোলাম মৌলা অবাক হয়ে শুধাল, ‘মদ খেলেন?
চাচা বললেন, ‘কেনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়নি।
সোয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটা, ছ’টা বাজল। ফ্রাউ রুবেন্স, ফ্রলাইন গিব্রিয়ডফ কারো দেখা নেই। এর অর্থ কী? জর্মনরা তো কখনো এরকম লেট হয় না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। যাই হয়ে থাকুক না কেন, আমি পালাই।
বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে ল্যান্ডলেডিকে জিজ্ঞেস করলুম, ফ্রাউ রুবেন্স ফোন করেছিলেন কি? না। আমার উচিৎ তখন ফোন করা। অনুসন্ধান করা, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? কিন্তু চেপে গেলুম। নোঙর যখন ভেঙে ফেলে দিয়েছি তখন আমি হালই বা ধরতে যাব কেন?
সাতদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিলুম। রাত্রে শুতে যাবার সময় একবার ল্যান্ডলেডিকে চিচি করে জিজ্ঞেস করতুম, কোনো ফোন ছিল কি না। ল্যান্ডলেডি নিশ্চয় ভেবেছিল আমি কারো প্রেমে পড়েছি। প্রেমের দ্বিতীয় অঙ্কে নাকি মানুষ এরকম করে থাকে।
কোনো ফোনও না।
করে করে তিন মাস কেটে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কাজকর্মে মন দিলুম।
নটেগাছটি মুড়িয়ে দিয়ে চাচা চেয়ারে হেলান দিলেন।
ভোজের শেষে সন্দেশ-মিষ্টি না দিলে বরযাত্রীদের যে রকম হন্যে হয়ে ওঠার কথা, আমরা ঠিক সেইরকম একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলুম। মুখুয্যে বলল, কিন্তু ওনারা সব এলেন না কেন, তার তো কোনো হদিশ পাওয়া গেল না।
সরকার বলল, আপনার শেষরক্ষা হল বটে, কিন্তু গল্পটির শেষরক্ষা হল না।
রায় কঁদ-কাঁদ হয়ে বললেন, ‘নোঙর-ভাঙা নৌকোতে আমাকে ফেলে আপনি কেটে পড়লেন চাচা? আমার উদ্ধারের উপায় বলুন।
চাচা বললেন, মাসতিনেক পরে দস্তানা কিনতে গিয়েছি তীৎসে’। জর্মনদের হাতের তুলনায় আমাদের হাত ছোট বলে লেডিজ ডিপার্টমেন্টে আমাদের দস্তানা কিনতে হয়। সেখানে ফন্ ব্রাথেলের সঙ্গে দেখা। কানে কানে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হে পুরুষপুঙ্গব, এখানে কেন? নিজের জন্য দস্তানা কিনছ, না বউয়ের জন্য? কিন্তু বউ কোথায়? আমি উম্মাভরে গটগট করে চলে যাচ্ছিলুম, ফন্ ব্রাভেল আমার হাতটি চেপে ধরলেন— ‘বুলি’র সময় হকিস্টিক যেরকম চেপে ধরেন।
সেই কাফে ক্যোনিকেই নিয়ে বসালেন।
বললেন, ‘আমি সেদিন পাঁচটার সময় কাফের উপরের গ্যালারিতে বসে তোমাকে লক্ষ্য করছিলুম।
আমি তো অবাক।
বললেন, ‘ওরা কেউ এল না বলে তোমার সঙ্গে কথা না বলে চলে গেলুম। কিন্তু তারা এল না কেন জান? তবে শোননা। তোমার মতো মুখকে বাঁচাননা আমার কর্তব্য মনে করে আমি তাদের সঙ্গে লড়েছিলুম। হিম্মৎ সিং আমার বন্ধু, আমার পিতারও বন্ধু। তার প্রতি এবং তার প্রতেজে তোমার প্রতি আমারও কর্তব্য আছে।
তোমার কাছ থেকে সব কথা শুনে আমি সোজা চলে যাই ফ্ৰাউ রুবেসের ওখানে। তাকে রাজি করাই আমাকে গিব্রিয়াডফের ওখানে নিয়ে যাবার জন্য। সময় অল্প ছিল বলে, এবং ইচ্ছে করেই, ফোন করে যাইনি। গিয়ে দেখি সেখানে একপাল ষাঁড়ের সঙ্গে সুন্দরী শ্যাম্পেন খাচ্ছেন, হৈহল্লা চলছে। ফ্রাউ রুবেসের চক্ষুস্থির। তিনি গিব্রিয়ডফ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্য ধারণা করেছিলেন–ইংরেজিতে যাকে বলে ডেমজে ই ডিসট্রেস্ (বিপন্না)। সে কথা থাক—আমি দু’জনকে সামনে বসিয়ে পষ্টাপষ্টি বললুম যে তোমাতেআমাতে প্রেম, বিয়ে স্থির—আমি অন্য কোনো মেয়ের নোসেন্স সহ্য করব না।
আমি বললুম, এ কী পাগলামি! আপনি এসব মিথ্যেকথা বলতে গেলেন কেন? ফন্ ব্রাভেল বললেন, চুপ করে শোননা। আমি বাজে বকা পছন্দ করিনে। এছাড়া অন্য উপায় ছিল না। গিব্রিয়ডফ কিন্তু কামড় ছাড়ে না—আমি তখন ভয় দেখিয়ে বললুম যে, আমি পুলিশে খবর দেব তার পাসপোর্ট নেই, আর পাসপোর্ট যোগাড়ের জন্য তোমাকে মেকি বিয়ে করছে। আমি অবশ্য সমস্তক্ষণ ভান করছিলুম যে আমি তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি—তোমার মতো অজমূখের প্রেমে হাবুডুবু, শুনলে মুরগিগুলো পর্যন্ত হেসে উঠবে!—আর তোমাকে বিয়ে করার জন্য এমনি হন্যে হয়ে আছি যে, পুলিশ লেলানো, খুনখারাবী সব কিছুই করতে প্রস্তুত।
গিব্রিয়ডফ হার মানলেন। ফ্রাউ রুবেন্স ততক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। গিব্রিয়ডফ যে তাকে কতদূর বোকা বানিয়েছে বুঝতে পেরে বড় লজ্জা পেলেন বাড়ি ফেরার পথে গিব্রিয়ডফ তাঁর সঙ্গে কী করে বন্ধুত্ব জমিয়েছিল সে ব্যাপার আগাগোড়া খুলে বললেন। তখন আরো অনুসন্ধান করে জানলুম, মস্কোতে এ গিব্রিয়াডফের বাড়িতে হিম্মৎ সিং কখনো বসবাস করেননি—এরা ওঁদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় মাত্র।
চাচা বললেন, ‘ফন্ ব্রাভেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমার তাড়া আছে, হকি ম্যাচে চললুম।’
আমি বললুম, কিন্তু একটা কথার উত্তর দিন। গিব্রিয়ডফ বিয়ের জন্য আমাকেই বাছলেন কেন? বারন ফন্ ফাক্লেনডর্কের মতো বর তো ছিল।
ফন্ ব্রাভেল বললেন, ‘লীবার ইডিয়োট (প্রিয় মূর্খ), গিব্রিয়ডফ তো বর খুঁজছিল না, খুঁজছিল শিখণ্ডী। ফাক্লেনডর্ফ বা অন্য কাউকে বিয়ে করলে সে স্বামী তার হক চাইত না? তা হলে পঁচিশটে ষাঁড়ের সঙ্গে দিবারাত্তির শ্যাম্পেন চলত কী করে? ফাক্লেনডর্ফ প্রাশান মোম, নীটশের উপদেশে বিশ্বাস করে স্ত্রীলোকের কাছে যেতে হলে চাবুকটি নিয়ে যেতে ভুলো না।–হল? বুঝলে হে নরাভ?
চাচা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, জীবনে এরকম বোকা বনিনি, অপমানিত বোধ করিনি। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা গিলে ফেলা ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না।’
গোলাম মৌলা বলল, একটা বাজতে তিন মিনিট। শেষ ট্রেন একটা দশে।
আমরা হন্তদন্ত হয়ে ছুট দিলুম সাভিন্নিপ্লাস্ স্টেশনের দিকে। রায় চেঁচিয়ে বললেন,
চাচা, ফন্ ব্রাথেলের ঠিকানা কী?
চাচাও তখন তার গলাবন্ধ কোটের বোম লাগাতে লাগাতে ছুট দিয়েছেন। বললেন, সে বিয়ারে ছাই। তোমার ফিয়াসে শ্রীমতী জমিতফের সঙ্গে ফন্ ব্রাথেলের গলাগলি। তাই তো বলেছিলুম, বড় ভাবিয়ে তুলেছ!
—————
* ফেরবেলিনার প্লাসের মসজিদে ঈদ-পর্ব উপলক্ষে বার্লিনের আরব, ইরানী, ভারতীয় সব মুসলমান জড়ো হয়। অমুসলমানের মধ্যে প্রধানত যায় বাঙালি হিন্দু।
Thanks for this!
অসাধারণ