চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

স্বপ্ন

স্বপ্ন

আমার ঘুম আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। মাথার দিকের জানালায় অন্ধকার আকাশ। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতা দরজার পাল্লার মতো ঝুলে পড়ে। তারপর আর কিছু মনে থাকে না। স্বপ্ন, দু:স্বপ্নের রাজ্যে তলিয়ে যাই। আজ কিন্তু ঘুম এল না। বরং একটা মজার গল্প মনে এল।

এক শহর। সেই শহরে একটা বাড়িতে একা-একা বৃদ্ধা থাকতেন। পয়সা-কড়ির অভাব ছিল না। স্বামী বেশ ভালোই রেখে গিয়েছিলেন। সেই শহরেই বেশ নামি এক চোর ছিল। যেমন সব শহরেই থাকে। তার বহুদিনের ইচ্ছে, বুড়িকে একটু হালকা করতে হবে। তা সে এক রাতে বুড়ির জানালায় এসে হাজির। গরাদ ধরে খাড়া। ভাঙবে আর ঢুকবে। একটা খাট। খাটে শুয়ে আছেন বৃদ্ধা। আধো ঘুম, আধো জাগরণ। চোর শুনছে, বুড়ি বিড়বিড় করছে—’আবার সেই ডিবডিব। এই ডিবডিবই আমাকে শেষ করবে। ওরে ডিবডিব।’ চোর মাথায় কাছের জানালায় দাঁড়িয়ে শুনছে। ভাবছে, বুড়ি নিশ্চয় অসুস্থ। বুড়ি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—উ:, ডিবডিব। আর পারি না, তুই আমাকে মারবি।’ চোর শুনছে। এ কোন মারত্মক অসুখ। ডিবডিব। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোরের মনে হল, রোগটা খুব ছেঁয়াচে। আর এই এতক্ষণ মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে সেই ছোঁয়াচ তারও লেগেছে। সেও ডিবডিব রোগে আক্রান্ত। তার হাত-পা কাঁপতে লাগল, বুক ধড়ফড় করছে, মাথা ঝিমঝিম। চোরের আর চুরি করা হল না। কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে গেল। সোজা বিছানায়। স্ত্রী বললে, ‘কী হল? শুধু হাতে ফিরে এলে?’ চোর বললে, ‘আর শুধু হাত। আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার দুরারোগ্য অসুখ। সেই অসুখের নাম কেউ কখনো শোনেনি। রোগটার নাম ডিবডিব।’

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকা হল। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘আমার দ্বারা হবে না। আপনারা এই শহরের সেরা ফকির সাহেবকে ডাকুন। আমার শাস্ত্রে ডিবডিব বলে কোনও অসুখ নেই। স্ত্রী বললে, ডিবডিব কী কোনও মারাত্মক জন্ত।’ ডাক্তার বললেন, ‘তাই বা কেমন করে বলি। আমার জানা নেই।’ তখন ফফির সাহেব এলেন। ফফির সাহেবকে বিছানার পাশে দেখে চোর ভাবলে শেষ সময় তাহলে এসে গেছে। কোনও রকমে শক্তি সঞ্চয় করে বললে, ‘এই রাস্তার শেষ মাথায় একটা একতলা বাড়ি আছে, সেই বাড়িতে এক বুড়ি আছে। তার এই রোগ হয়েছে। সেইখান থেকেই এই রোগ আমাকে ধরেছে। প্রভু যদি পারেন তো আমাকে সুস্থ করে তুলুন।’

ফকির বললেন, ‘বাছা দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার শেষ সময়! প্রার্থনা করো। অতীতের পাপ কাজের জন্যে অনুশোচনা করো।’

ফকির বেরিয়ে এলেন, সোজা চলে গেলেন সেই বুড়ির বাড়িতে। রাস্তার ধারের ঘর সেই জানলা। ফকির দাঁড়িয়েছেন জানলায়। বুড়ি শুয়ে আছে বিছানায়। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে শরীর। দোমড়াচ্ছে মোচড়াচ্ছে। ধরাধরা গলায় বুড়ি বলছে—’শয়তান ডিবডিব, তুই-ই আমাকে মারবি। ওরে একটু শান্তি দে, একটু একটু করে আর আমার রক্ত চুষে নিসনি।’

জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ফকির। বুড়ি কখনও আর্তনাদ করছে, কখনও চুপ করছে অল্পক্ষণের জন্যে। কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর ফকির নিজেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শেষে ফকির ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। সেই কাঁপুনিতে জানলার গরাদ কেঁপে উঠল। আর সেই শব্দে বুড়ি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে নেমে জানলার কাছে এসে ফকিরের হাত দুটো ভেতর থেকে চেপে ধরলেন—’এ কী অসভ্যতা। আপনার মতো একজন গুণী, পণ্ডিত মানুষ ভদ্রলোকের বাড়ির জানলায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝরাতে।’

ফকির বললেন, ‘মা, তুমি এমন ভালোমানুষ; কিন্তু তোমার কী দুর্ভাগ্য! এমন এক ভয়ঙ্কর অসুখ কী করে পাকালে? তখন থেকে শুনছি, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ আর ডিবডিব বলে চিৎকার করছ। আমার ভয় হচ্ছে, অসুখটা আমাকেও ধরল। আমার বুকটাও কেমন করছে। দেখছ না। আমার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে।’

বুড়ি বললে, ‘হা রে, আমার মূর্খ। আপনাকে আমি মনে করতুম শহরের সব চেয়ে জ্ঞানী।—গুণী মানুষ। এত বই, এত লেখাপড়ার এই হাল। কে একজন ডিবডিব বলছে, সেই শুনে আপনি মরোমরো। হায় আমার পণ্ডিত রে!। ওই কোণের দিকে তাকান, তাহলেই বুঝতে পারবেন ভয়ঙ্কর ডিবডিব জিনিসটা কী!’

ঘুরে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা। ঘরের কোণের দিকে একটা কল। পাইপে ছোট্ট একটা ফুটো, সেই ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। সেই জলপড়ার শব্দই হল ডিবডিব। ফকিরের সমস্ত অস্বস্তি নিমেষে কেটে গেল। তিনি ছুটলেন চোরের বাড়ির দিকে। এইবার ফকির তাকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন।

চোর বললে, ‘আপনি আমার চোখের সামনে থেকে সরে যান। আমার প্রয়োজনে, আপনি আমাকে গোটাকতক উপদেশ দিয়ে সরে পড়েছিলেন। আপনার ওই বিরসবদন দর্শনে আমার ভবিষ্যৎ খুব একটা উজ্জ্বল হবে না।’

ফকির বললেন, ‘মূর্খ, আমার মতো একটা লোক তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, এ কথাটা কেমন করে ভাবলে। আমি গিয়েছিলুম, কী করে তুমি ভালো হবে, কী করে তোমাকে ভালো করা যায়, তারই অনুসন্ধানে। এখন আমি যা বলি তাই শোনো, আমি যা করি তাই দ্যাখো।’

ভালো হয়ে যাবে শুনে, চোর কিছুটা শান্ত হল। ফকির তখন এক গেলাস জল নিল। জলে মন্ত্র পড়ে, চোরকে বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা করো, আর কোনওদিন চুরি করবে না।’ চোর ভালো হওয়ার আশায় বললে, ‘আর কোনওদিন চুরি করব না।’ তখন সেই ফকির চোরের গায়ে জল ছিটাতে লাগলেন, আর মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। শেষে খুব ধমকের সুরে বললেন, ‘পালা ডিবডিব পালা, যেখান থেকে এসেছিলিস সেইখানে পালা।’

চোর ভালো হয়ে উঠে বসল। তার ডিবডিব ভালো হয়ে গেল।

গল্পটা আমার এই কারণে মনে এল—কেমন অজানা একটা ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সেই ভয়টা কীসের ভয়? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একটা ভিস্তি। ভেতরে আমার আয়ু জলের মতো টলটল করছে। অনবরতই ঝরে যাচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা। সেই ফোঁটা আমি দেখতে পাচ্ছি না, কেবল একটা অশ্রুত শব্দ প্রণবের মতো—ডিবডিব। সেটা আমার হৃদয়ের ধ্বনি—অবিরাম ঢিপঢিপ। যত চলছে ততই ঘড়ির মতো স্প্রিং খুলে যাচ্ছে, এক সময় দম ফুরিয়ে অচল হয়ে যাবে। সেই ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে, না কি ফুরোবার আগে রেস্ত ফুরোবার ভয়। পথে বসে যাওয়ার ভয়। মৃত্যুকে আর মানুষ তেমন ভয় পায় না। জীবনের মোহ শতকরা আশিভাগ মানুষেরই আর নেই। বরং বেঁচে থাকার ভয়টাই বেশি। প্রতিযোগিতা এত বেড়েছে। ছোট্ট এক রেসের মাঠ, গিজগিজ করছে দৌড়ের ঘোড়া। পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

এক ধনী পিতা তাঁর চার ছেলেকে দশ হাজার করে টাকা দিয়েছেন—’যাও, তোমরা ব্যাবসা-বাণিজ্য করে খাও’। বেশ কিছু কাল পরে পিতার খেয়াল হল, আচ্ছা, দেখা যাক ছেলেরা কে কেমন ব্যাবসা করছে, কতটা উন্নতি করেছে। একে একে ডাকলেন চারজনকে। বড় ছেলে বললে, ‘আপনি যা মূলধন দিয়েছিলেন, তার ওপরে আমি বেশ বাড়িয়েছি।’ মেজো ছেলে বললে, ‘খুব বেশি না হলেও মূলধনের ওপর কিছু বাড়িয়েছি।’ সেজো ছেলে বললে, ‘আমি বেশি কিছু করতে পারিনি, তবে মূলধনটা নষ্ট করিনি।’ ছোট ছেলে আসেনি। কেন আসেনি। ডাকো তাকে। সে লজ্জায় লুকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে তাকে ডেকে আনা হল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাছে মাথা নীচু করে।

বাবা বললেন, ‘কী বাবা? তুমি কী রকম উন্নতি করেছ ব্যাবসায়?’

ছেলে বললে, ‘আমাকে দেখে আপনি বুঝতে পারছেন না? আমার পেটে ভাত পড়েনি কতকাল, মাথায় তেল পড়েনি, কতকাল, শতচ্ছিন্ন কাপড় ময়লা। আপনি যা দিয়েছিলেন, সব হারিয়ে ফেলেছি, সব হারিয়ে ফেলেছি।’

ছোট ছেলের ওপর পিতা-মাতার স্নেহ একটু বেশিই হয়। ছেলের অবস্থা দেখে বাবার করুণা হল। একে আরও টাকা দিয়েও লাভ নেই কোনও। আবার হয় তো হারিয়ে ফেলবে। তখন বড় তিন ছেলে দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, তোমাদের ছোট ভাই, সব হারিয়ে ফেলেছে। দেখেই তো বুঝতে পারছ, পেটে ভাত নেই, মাথায় তেল নেই। একে আরও টাকা দেওয়া মানে, সে-টাকাটাও নষ্ট হওয়া। আমার গলায় একটা মণি আছে, রোজ এক পোয়া করে সোনা দেয়। এই মণিটা আমি ওকে দিচ্ছি, তাহলে ও-তো রোজই সোনা পাবে এক পো করে, তাহলে ওর আর কোনও অভাব থাকবে না।’ এই বলে তিনি মণিটা ছোট ছেলের গলায় পরিয়ে দিলেন।

তখন আর তিন ছেলে ভাবলে, ‘আমরা যদি গরিব হয়ে বাবার সামনে এই ভাবে দাঁড়াতে পারতুম, তাহলে আমরাও এমন অলৌকিক কণ্ঠমণি পেতুম।’

আমিও কে সেইরকম আমার পরমপিতার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। সব আমার হারিয়ে গেছে, যা দিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষা-দীক্ষা-সাধনা-কর্মতৎপরতা। কিন্তু এখনও যায়নি নীচ অহঙ্কার। এখনও, আমি, আমি—আমরা আমার করছি। বলতে পারছি না, সব গেছে আমার। এই অহঙ্কারটুকুর জন্যে জ্ঞান আসছে না। সমর্পণ আসছে না। ঠাকুরের সেই গল্পটা আবার মনে পড়ছে—বাছুর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। কশায়ে কাটে, চামড়ার জুতো হয়। আবার ঢোল-ঢাকের চামড়া হয়। সে ঢাক কত জনে পেটে, কষ্টের আর শেষ নেই। শেষে নাড়ি থেকে তাঁত হয়, সেই তাঁতে যখন ধুনুরির যন্ত্র তৈরি হয় আর ধুনুরীর তাঁতে তুঁর্হু তুঁর্হু (তুমি তুমি) বলতে থাকে, তখন নিস্তার হয়। তখন আর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) বলছে না; বলছে তুঁহুঁ তুঁহুঁ (তুমি তুমি)। ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আমি অকর্তা; তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র; তুমিই সব।

এইসব ভাবতে ভাবতে অপার একটা শান্তি এল মনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *