স্বপ্ন
এক অনতিবিখ্যাত ইংরেজ কবি প্রশ্ন করেছিলেন:
যদি স্বপ্ন বিক্রি হত,
যদি বাজারে কিনতে পাওয়া যেত
সুখের স্বপ্ন আর দুঃখের স্বপ্ন
আনন্দের স্বপ্ন আর বেদনার স্বপ্ন
যদি রাস্তায় রাস্তায় ‘স্বপ্ন চাই’ বলে
হেঁকে বেড়াত ফেরিওয়ালা—
তুমি তার কাছ থেকে কীরকম স্বপ্ন কিনতে?
কবির এই জটিল প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ নয়। অন্য এক কবি তাঁর এক বহুবিদিত পঙ্ক্তিতে বলেছিলেন, ‘আমাদের মধুরতম সংগীতগুলি করুণতম দুঃখের কথা বলে।’
স্বপ্নের পক্ষে অবশ্য মধুর হওয়া কঠিন। স্বপ্ন স্বপ্নই, দিনের আলোয় সেটা চুরমার হয়ে মিলিয়ে যায়। সুখস্বপ্নই বলে কিছু নেই, সব সুখস্বপ্নই হারিয়ে যাওয়ার অথবা না পাওয়ার দীর্ঘনিশ্বাসে ভরা।
স্বপ্নের কোনও বিকল্পও নেই। বাংলা কিংবা ইংরেজি, কোনও অভিধানেই স্বপ্ন কিংবা ড্রিম (Dream) শব্দটির কোনও প্রকৃত প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে না, শুধু একটু ইনিয়ে বিনিয়ে মানেটা ব্যাখ্যা করা আছে। রাজশেখরবাবুর চলন্তিকায় স্বপ্ন শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ‘নিদ্রাবস্থায় মনের ক্রিয়া।’ সি ও ডি অর্থাৎ কনসাইজ অক্সফোর্ডে বলা হয়েছে vision।
স্বপ্ন কবিতার কাছাকাছি একটা ব্যাপার। কবিতার মতোই স্পষ্ট অস্পষ্ট বাস্তব অবাস্তব, স্বপ্ন এই পৃথিবীর মধ্যে অন্য এক পৃথিবী। ধরা ছোঁয়ার খুব কাছে, কিন্তু বাইরে।
স্বপ্ন নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের অন্ত নেই। মনোবিজ্ঞানী থেকে বুজরুক জ্যোতিষী সবাই স্বপ্নের কারবারি, স্বপ্নের ব্যাখ্যাদার। পৃথিবীতে এমন কোনও ভাষা বোধহয় নেই, যে ভাষায় স্বপ্নতত্ত্ব নিয়ে গ্রন্থ নেই।
স্বপ্ন নিয়ে তত্ত্বের কথা থাক। কবিতার কথাও আপাতত মুলতুবি। স্বপ্ন নিয়ে একটা রূপকথার কাহিনী। হিমানী নামে একটি মেয়ের কাহিনী।
হিমানী খুব স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।
কত রকমের যে স্বপ্ন দেখে হিমানী, পাহাড়ের স্বপ্ন, সমুদ্রের স্বপ্ন, নদীর স্বপ্ন, নৌকার স্বপ্ন।
কোনও দিন কোনও নৌকায় চড়েনি হিমানী, তবু সে কখনও কখনও নৌকার স্বপ্ন দেখে, অচেনা নদীর কালো জলে ছোট ডিঙি নৌকায় দুলতে দুলতে স্বপ্নের মধ্যে হিমানী ভেসে যায়, তীরে আসে।
শেষ রাত্রের দিকে যখন বাইরের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে, কালো জামদানির ঘোমটা খুলে নীলাম্বরীর ওড়নায় মুখ ঢাকে আকাশ, যখন দূরের তারাগুলোকে শিশিরবিন্দুর মতো দেখায়, উঠোনের সিঁড়ির পাশে অযত্নের তৃণদলের শিষের ওপরে শিশিরবিন্দুগুলোকে দূর আকাশেম তারার মতো দেখায়, তখনই আশ্চর্য সব স্বপ্ন এসে ভিড় করে হিমানীর চোখের পাতার নীচে। সারারাতের ঘন গভীর ঘুমের শেষে তখন হালকা আমেজ মেশা তন্দ্রায় দূরের নীল পাহাড়ের স্বপ্ন দেখে হিমানী, ঊর্মিচপল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে, নদী আর নৌকা তো রয়েছেই। রয়েছে আরও কত কী?
স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে হিমানী।
দিন আর রাতের মধ্যেকার সামান্য একটু আবছায়া, রহস্যময় সময় হিমানী স্বপ্নের ঘোরে থাকে।
স্বপ্নের মধ্যেই থাকে। তার বাইরে যাওয়ার সাহস নেই তার। স্বপ্নের ভিতরে ডিঙি নৌকায় মাঝেমধ্যে একটুখানি ভেসে গেলেও, স্বপ্ন ভাঙার আগেই যথাস্থানে ফিরে আসে হিমানী। তারপর ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে যথারীতি জীবন। আবার পরের দিন প্রদোষের জন্য প্রতীক্ষা। স্বপ্নের জন্য প্রতীক্ষা। সামান্য কিছুক্ষণ স্বপ্নের মধ্যে ভেসে তারপর ফিরে আসা।
কিন্তু একদিন স্বপ্নের ভেতর থেকে হিমানী আর ফিরে আসতে পারল না।
কোথায় যে সে চলে গেল কে জানে?
কয়েকদিন হল স্বপ্নের মধ্যে এক রাজপুত্র দেখা দিচ্ছিল হিমানীকে। কী সুন্দর দেখতে সেই রাজপুত্র। লম্বা, ফরসা, বাঁশির মতো নাক, পটল-চেরা চোখ, মাথায় সোনার মুকুট, তাতে হিরে মুক্তো বসানো, গায়ে জরির পোশাক, রুপোর নাগরা পায়ে।
শেষ রাতের আকাশ যখন কালো জামদানির ঘোমটা খুলে নীলাম্বরী ওড়না পরে, তখন সে আসে। কখনও দূরে নীল পাহাড়ের ঢাল ভেঙে ধুলো আর পাথরকুচি উড়িয়ে সাদা ডানা লাগানো সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে নেমে আসে স্বপ্নের রাজপুত্র। কখনও সে আসে ময়ূরপঙ্খী সোনালি জাহাজে চড়ে সাগরের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে হাজার রঙের নিশান উড়িয়ে।
ছোট নদীর সেই ডিঙি নৌকা, সেটা এখন স্বপ্নের এক পাশে পড়ে থাকে। তাতে আর ওঠা হয় না হিমানীর। সে শুধু অবাক হয়ে দেখে কোনওদিন রাজকুমারের পক্ষীরাজ ঘোড়া, কোনওদিন রাজকুমারের ময়ূরপঙ্খী জাহাজ আর কোনওদিন শুধু রাজকুমারকে।
এক-একদিন রাজকুমার খুব কাছে আসে, একেবারে হিমানীর বিছানায়, বালিশের পাশে চলে আসে। তন্দ্রার মধ্যে হিমানীর ঠোঁটে গালে লাগে ঘোড়ার নাকের গরম নিশ্বাস, ময়ূরপঙ্খী জাহাজের রঙিন পালের শীতল বাতাস।
হিমানীকে রাজকুমার শিয়রে এসে ‘এসো’, ‘এসো’ বলে ডাকে, হিমানীর কেমন ভয় হয়, তার সাহস হয় না রাজকুমারের সঙ্গে যেতে। চোখ শক্ত করে বন্ধ করে, হিমানী বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে দিনের সব আলো জানলা দিয়ে হিমানীর চোখেমুখে, বিছানায় এসে পড়ে। পক্ষীরাজ ঘোড়া আর ময়ূরপঙ্খী জাহাজ নিয়ে রাজকুমার ফিরে যায়।
হিমানী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। হাতমুখ ধোয়। আর একটা দিন শুরু হয়।
কিন্তু একদিন ব্যতিক্রম তো হবেই।
তাই হল।
সেদিন সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া। হিমানীর ঘরের বন্ধ জানলার কাচে সারারাত নিরবচ্ছিন্ন ঝিরঝির ঝিরঝির করে শব্দ। সেদিন আর আকাশের তারা নেই, ঘাসের শিষে শিশিরবিন্দুও নেই। আকাশ পৃথিবী বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে একাকার।
আজও হিমানীর স্বপ্নে রাজকুমার এল। শেষ রাতে বৃষ্টি যখন আরও প্রবল হয়ে উঠেছে, বাতাস যখন আরও বেশি সোঁ সোঁ করে আওয়াজ করছে, রাজকুমার হিমানীকে এসে জড়িয়ে ধরল। তারপর সে কোনও কিছু টের পাওয়ার আগে সাদা ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল তাকে। ছুটে চলল ঘোড়া পাখা মেলে। বৃষ্টিতে রাজকুমারের জামাকাপড়, জরির ঝলমলে পোশাক কিছুই ভিজছে না, এমনকী ঘোড়ার গায়ের লোম পর্যন্ত ভিজছে না।
অঝোর বৃষ্টির মধ্যে হিমানীকে কোলে তুলে উড়ে চলেছে রাজকুমার। হিমানীর গায়েও একফোঁটা বৃষ্টির জলের ছোঁয়া লাগছে না। কেমন ভয় লাগল হিমানীর, সে তার স্বপ্নের রাজকুমারের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছ?’ প্রশ্ন শুনে রাজকুমার অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কী করে বলব? এ তো তোমার স্বপ্ন, তুমিই জান কোথায় যাচ্ছ?’
স্বপ্নের রাজকুমারের কোলে সাদা ঘোড়ার পিঠে বসে এখন হিমানী যেখানে ইচ্ছে যাক, তার রূপকথার পৃথিবীতে সে যতক্ষণ থাকতে পারে থাকুক, ইতিমধ্যে স্বপ্ন নিয়ে অন্তত দুটো গরম গল্প বলি।
দুটোই দাম্পত্য কাহিনী। অনেকদিন আগে দুই জায়গায় দুই সূত্রে লিখেছিলাম গল্প দুটো, এবার একত্র করছি।
স্বভাবতই এবং স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ স্বামী-স্ত্রী একই শয্যায় শয়ন করেন এবং সেই হেতু একই স্বপ্নের তারা অংশীদার।
সে যা হোক একটি গল্প একটু সরল, সেটাই আগে বলি। স্বামী সারারাত ঘুমের মধ্যে ‘জলি’ ‘জলি’ করে কাকে যেন ডেকেছেন, খুঁজেছেন। বলাবাহুল্য জলি সহধর্মিনীর নাম নয়। সুতরাং ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর স্ত্রী স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই যে সারারাত স্বপ্নের মধ্যে ‘জলি-জলি’ করলে, জানতে পারি কি জলিটা কে?’
স্বামী বেচারা থতমত খেয়ে গিয়ে দু’বার ঢোঁক গিলে বললেন, ‘আরে না না, তুমি যা ভাবছ তা নয়, জলি কোনও মেয়েছেলে-টেলের নাম নয়, জলি হল একটা রেসের ঘোড়া, কাল রেস খেলতে গিয়েছিলাম না, ওই জলির ওপরেই বাজি ধরেছিলাম।’
তখনকার মতো স্বামী পার পেয়ে গেলেন। একটু পরে স্বামী বাথরুমে দাড়ি কামাতে গেছেন এমন সময় একটা ফোন এল। স্ত্রী ধরলেন সেই ফোনটা, তারপর ফোনটা নামিয়ে বাথরুমে গিয়ে স্বামীকে বললেন, ‘কাল যে রেসের ঘোড়াটার ওপরে তুমি বাজি ধরেছিলে, ওই যে তোমার জলি নামের ঘোড়াটা, সেই ঘোড়াটা তোমাকে ফোনে ডাকছে।’
এবার জটিল গল্পটিতে যাই। গল্পটি ছোট কিন্তু মারাত্মক।
মধ্যরাতে বউ ঘুম ভেঙে উঠে পাশে শায়িত ও নিদ্রিত স্বামীকে বুকেপিঠে দমাদম ঘুষি মারতে লাগল। স্বামীর প্রহৃত হওয়ার অভ্যাস আছে, কিন্তু এ রকম অতর্কিতে ঘুমের মধ্যে মার খেয়ে সে বেচারা ঘাবড়িয়ে গেল। কেবল চেঁচাতে লাগল, ‘কী হল, আমার কী দোষ, আমি কী করলাম?’
ইতিমধ্যে প্রহারকারিণী ক্লান্ত হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে, স্ত্রীর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামী প্রশ্ন করল, ‘বলো না কী হয়েছে। কাঁদছ কেন? মারলে কেন?’
এই প্রশ্নে ফোঁপানি থামিয়ে স্ত্রী বলল, ‘আমি যদি আর কখনও স্বপ্নে দেখি যে, তুমি অন্য কোনও মেয়েকে আদর করছ, তা হলে আমি সুইসাইড করব, আত্মহত্যা করব।’
এ রকম একটি মারাত্মক কাহিনী দিয়ে রম্য নিবন্ধ শেষ করা উচিত হবে না, বিশেষ করে যে নিবন্ধের নাম ‘স্বপ্ন’।
কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, কবিতা দিয়েই শেষ করি। মূল কবিতাটি নিতান্ত স্বপ্নময়, লেখক উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস। আমার প্রথম অনুবাদ সামান্য কয়েক পঙক্তি নিবেদন করছি:
আমি নিতান্ত দরিদ্র
আমার স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আমার সেই স্বপ্নগুলি
আমি তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিয়েছি,
তুমি একটু সাবধানে যেয়ো,
দেখো আমার স্বপ্নগুলো
তোমার পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ো না।