স্বপ্ন

স্বপ্ন

কার না ইচ্ছে করে বেশ একটু খেলিয়ে, কালোয়াতি করে বাঁচতে। যেমন ছোটো হলেও, নিজের ছিমছাম মাথা গোঁজার মতো একটা আস্তানা। নাহয় কাঁচাই হল। বাবুই পাখির মতো চড়াইদের বলব—কাঁচা হোক তবু ভাই নিজেরই বাসা। চারপাশে আর তিন ঘর ভাড়াটের মধ্যে স্যাণ্ডউইচ মেরে থাকতে হয় না। রোজ প্রাতঃকালে কমন বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে লেবার পেনের রমণীর মতো ডেলিভারি প্রায় হয়ে গেল বলে ছটফট করতে হয় না। নিজের মালিকানার বাথরুম। সাহস করে যা তা খাওয়া যায়, যখন খুশি ঢোকা যায়। পেঁয়াজি খেতে পারি, কাঁঠাল খেতে পারি, ছোলার ডাল, লুচি। সব সময় দরজা, জানলায় পরদা ঝোলাতে হয় না বেআব্রু হওয়ার ভয়ে। মাঝরাতে পাশের ঘরে বিড়ি ফোঁকা করে কেউ দমকা কাশি কাশবে না। বউ পেটানোর নাকি-কান্না শুনতে হবে না। শাশুড়ি-বউয়ের চুলোচুলির নীরব সাক্ষী হতে হবে না।

নিজের বাড়ি, লাল মেঝে। দক্ষিণ খোলা শোবার ঘর। একটা ইংলিশ স্টাইলের খাট। টান টান বিছানা। কমলা রঙের পরদা। জানলার কাছে টেবিল। একটা মনোরম বসার ঘর। এক চিলতে কার্পেট। কাঁচ লাগানো সেন্টার টেবল। হালকা ধরনের গোটা তিনেক সোফা। একটা বুক কেস। মনের মতো শ-দুয়েক বই। ছোটো একটা শোকেসে কিছু পুতুল। গোটা দুই কফি মাগ। একটার গায়ে লেখা, মর্নিং কিস। আর একটার গায়ে, লেটনাইট অ্যাফেয়ার। সবই অপ্রয়োজনীয় শোভা। পাহারাদারের মতো খাড়া একটা টেবল ল্যাম্প, মাথায় তার তুর্কি টুপি।

ছোটো কিন্তু আধুনিক একটা রান্নাঘর। খোপে খাপে সুন্দর করে সাজানো একমাপের সব কৌটোর গায়ে লেবেল মারা, চা, চিনি, সুজি, পোস্ত, আটা, ময়দা, নুন। একটা ‘অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস’ গ্যাসবার্নার। মহাদেবের মতো সদা অকুন্ঠ গ্যাস সিলিন্ডার। ছাই ছাই রঙের মৃদু গীতগায়ী সদা শীতল, সুগৃহিণীর মতো একটা রেফ্রিজারেটার। অভ্যন্তরভাগে যাবতীয় সুখাদ্য। দরজাটি খোলামাত্রই হিমালয়। তপস্বীর মতো একপাত্র রসগোল্লা।

জমাট সমাধিমগ্ন দধি, ব্রহ্মলীন একডজন কুক্কুঢী আন্ডা। স্নেহশীতল একখন্ড মাখন। শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের আঁকা আপেলের মতো একদল কাশ্মীরী তরুণী আপেল। ত্বক-যৌবনা মুসুম্বি গুটিকয়। সুখ ও সমৃদ্ধির শিশিরমন্ডিত একটি ছবি।

কোথাও একটি মূল্যবান ক্যাসেট রেকর্ডার ও প্লেয়ার আত্মগোপন করে থাকবে, সুমধুর যার কন্ঠস্বর। উচ্চকিত কর্কশ নির্ঘোষে যা শ্রোতাকে পালাই পালাই ডাক ছাড়ায় না। সেই যন্ত্রে কখনো ধ্বনিত হবে সুমধুর জল-তরঙ্গ, চপলচরণ সেতার, স্বর্গীয় কন্ঠসংগীত। জ্ঞানানন্দে মাতোয়ারা হবে পরিবার পরিজন।

সুতৃপ্ত মার্জার যেমন মিউ মিউ করে না, ঘড়ঘড় শব্দ করে, সেইরকম অতিতৃপ্ত, সুপুষ্ট স্ত্রী, মৃদুভাষী। আপন মনে থাকলে যার কন্ঠে মধুমাতাল ভ্রমরের মতো রবীন্দ্রসংগীত গুঞ্জরিত হয়। ঘর থেকে ঘর যে ঘুরে বেড়ায় নর্তকীর ছন্দে। যার চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, দেখছি ফোটা কুসুম। যার ললাটের বৃত্তাকার টিপে ভোরের সূর্যোদয়। যার সুমিষ্ট ‘হ্যাঁগো, শুনচো’ ডাকে রসমালাইয়ের আস্বাদন।

আউন্সে মাপা সন্তান-সন্ততি। পরিমিত মদ্যপানের মতো। একটি পেগ, বড়োজোর দু-টি। তিনটি কদাচিৎ নয়। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। তারা মাধ্যমিকে সাতটা লেটার পাবে। উচ্চমাধ্যমিকেও অনুরূপ রেকর্ডে অম্লান থাকবে। জয়েন্ট এনট্রান্সে সবক-টায় চানস পাবে, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং। হাটে ঘাটে মাঠে বাজারে, ট্রামে বাসে ট্রেনে, জনে-জনে সেই অসীম সাফল্যের কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব। লোকে আমায় হিংসে করবে। ফিসফিস করে বলবে, লোকটা একটা ভাগ্য করে এসেছিল বটে! ট্রামে বাসে লোকে আমাকে সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দেবে, আরে বসুন বসুন। মহিলা হলে বলত, আপনি মা, রত্নগর্ভা। আমি পুরুষ আমাকে বলবে, পিতা স্বর্গঃ। স্বর্গীয় পিতা আপনি। আপনার কি দাঁড়ানো উচিত? অফিসে আমার বস আমাকে সমীহ করতে শুরু করবেন। আর গোরু ছাগলের মতো ব্যবহার করবেন না। ঘরে টেবিলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়া করে রাখবেন না। ঢোকামাত্রই বলবেন, আরে আসুন আসুন, বসুন। ভালো আছেন তো! মিসেস ভালো আছেন। ছেলেকে কোথায় দিলেন? আই আই টি! শিবপুর! মেডিকেল কলেজ! ছেলেকে কি আপনি নিজে পড়াতেন! আই সি; তাই বলুন! নিজে না দেখলে ওইরকম ব্রিলিয়্যান্ট রেজাল্ট হয়। চাকরিই আমাদের কাল! কেরিয়ার করে ছেলেমেয়ের লাইফটা নষ্ট হল। মেয়েকে কোথায় দিলেন! প্রেসিডেন্সি! তা তো হবেই। অত লেটার পেলে প্রেসিডেন্সি ছাড়া যাবে কোথায়! আমার মেয়েটা আর পনেরোটা নম্বর বেশি পেলে একটা ভালো কলেজে চেষ্টা করা যেত। এ যা হল, কোনো কলেজেই অ্যাডমিশান পাবে না। আর কী হবে! সর্বক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকলে পরীক্ষায় গোল্লাই পেতে হয়। আর এক সর্বনাশের আমদানি হয়েছে, স্টার টিভি, কেবল টিভি। ইকোয়াল স্ট্যাটাস না হলে বস চা অফার করেন না। আমাকে চা খাওয়াবেন। দু’চারটে সংসারের কথা বলবেন। বলবেন আপনার একটা প্রোমোশানের কথা ভাবছি। একই পোস্টে অনেকদিন পড়ে আছেন, এটা ঠিক নয়! স্ট্যাগনেশন মিনস ফ্রাসট্রেশান। আমাদের ডিভিশনাল অফিসে আপনাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছি।

এক ছেলে আর এক মেয়েই আমার ভাগ্যের দরজা খুলে দেবে। ছেলে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে; কিন্তু ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হবে না। মেয়ে প্রেম করবে এমন একটা ছেলের সঙ্গে, যার ব্রাইট ফিউচার। ভীষণ উদার। বিনাপণে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজে আমার আপত্তি নেই। আমার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে হাত পড়বে না? জামাই আমেরিকায় বসবাস করবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের খরচে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাবে। বছরে একবার দেশে আসবে। আমার জন্যে ব্লেড আনবে, আফটারশেভ লোশান আনবে, সাবান, সেন্ট আনবে, ইলেকট্রনিক গুডস আনবে, স্যুটপিস আনবে। চকোলেট, লজেন্স আনবে। আমি গন্ধগোকুল হয়ে ঘুরে বেড়াব।

আমার ছেলে ফার্স্টক্লাস পেয়ে বেরিয়ে আসবে। বেরোনোমাত্রই একটা ভীষণ ভালো চাকরি তাকে বোয়াল মাছের মতো কপ করে গিলে ফেলবে। বিরাট অঙ্কের মাইনে। অতবড়ো একটা চাকরি পেয়েও আমার ছেলের মাথা ঘুরে যাবে না! সে আমার নেওটাই থাকবে। আমার পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজই করবে না। স্কুলে পড়ার সময় সে যে-রকম ছিল, তখনও সে সেইরকমই থাকবে। আমরাই ভালো সম্বন্ধ করে তার বিয়ে দেবো। সুন্দরী, শিক্ষিতা, গৃহকর্মে সুনিপুণা। কিন্তু অহঙ্কারী নয়। কিন্তু উদ্ধত, মুখরা নয়, শ্বশুর-শাশুড়িকে শৃগাল জ্ঞান করে না। ‘বাবা’ বলে কাঁধের পাশে এসে শীতল ছায়ার মতো দাঁড়াবে। শিশুর মতো সরল; কিন্তু সাংঘাতিক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। আমার ছেলে তার রোজগারের সমস্ত টাকা আমার হাতে দিয়ে বলবে, এই নাও, সংসারটাকে তুমি কন্ট্রোল করো। তুমি যেভাবেই চালাবে, সেই ভাবেই আমরা চলব। তুমি হলে আমাদের কান্ডারী, আমাদের ভান্ডারী। হেড অফ দি ফ্যামিলি।

এই ভাবে আমার বয়স বেড়ে যাবে। বৃদ্ধ কিন্তু স্থবির নই। অনেক বছর চাকরি করেছি। সংসার বলবে, এইবার তুমি আরাম করো! দোতলার দক্ষিণ খোলা সবচেয়ে ভালো ঘরটা আমার। ঝকঝকে খাট ধবধবে বিছানা। সকালে ব্রেকফাস্ট, সুগুন্ধী চা, পরিমিত ভ্রমণ, সবকটা খবরের কাগজ পাঠ। বারোটার মধ্যে সুষম আহার, সামান্য দিবানিদ্রা। বৈকালিক আড্ডা। সন্ধ্যায় টিভি দর্শন। পরিবার পরিজনের সঙ্গে রসালাপ। অন্তে নীল মশারিতে শয়ন।

জানি এ-সব কিছুই হবে না। অন্তে চিতায় শয়ন।

গ্রামোফোন একটা সুন্দর উদাহরণ। রেকর্ড হল সংসার। আর আমি হলুম স্টাইলাস বা পিন। যে মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে রেকর্ডের ওপর পড়লুম, নানা সুরের গান, সংসার সংগীত। নিজেকে তুলে নিলুম, সব সংগীত স্তব্ধ, অখন্ড নীরবতা। সংসারে ফেলা আর সংসার থেকে তুলে নেওয়া দুটো কৌশলই শিখতে হবে, তা না হলে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে।

সংসারে ঢুকলে কেন বাছা? মানুষ তো সংসারেই আসে। কে আর মরুভূমিতে ক্যাকটাসের মতো গজিয়ে ওঠে। পিতা, মাতা, আত্মীয়পরিজন, ভাই-বোনের মধ্যেই মানুষ জন্মায়। সংস্কারেই সে সংসারে আবদ্ধ হয়। ক-জন আর সন্ন্যাসী হতে পারে। কত রকমের রিপু আমাদের বাঁদর নাচ নাচায়, সে তো যৌবনে বোঝা যায় না। তখন অনুসন্ধানের কাল। ভোগের অনুসন্ধান। একই মুদ্রার এ-পিঠে ভোগ, ও-পিঠে দুর্ভোগ। বিধাতার হাতের টুসকিতে কখন কোন পিঠ পড়বে আমরা জানি না। তবে ভোগের চেয়ে বড়ো দুর্ভোগ কিছু নেই। ভোগ জিনিসটা টিউমারের মতো। যথাসময়ে অপারেশন না করলে বাড়তেই থাকে। শেষকালে থলথলে এক উৎপাত। সুখ নয় অসুখ।

তা হলে কী করা যাবে! প্রশ্নটা নিজেকেই করি। তুমি কতটা বোকা! তোমার নাকের ডগায় সংসার-গাজর দুলছে। যা ধরা যায় না, তা ধরার জন্যে গাধাটা এগোচ্ছে। এগোচ্ছে মহাকালের পথ ধরে। চাই, আমার চাই এই মন্ত্র। সেবা চাই, সঙ্গ চাই তাই জীবনে স্ত্রীর আগমন। বার্ধক্যের সহায় হবে সন্তান। তাই তার যাবতীয় শিক্ষা-দীক্ষার আয়োজন। কন্যা পরের সংসারে বিদায় নেবে; কিন্তু সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী না হলে ভালো পাত্র জুটবে না। শেখাও লেখা-পড়া, নাচ-গান। দেবদাসী প্রথা উঠে গেছে কি! না! কন্যা হবে অপরের জীবনের দাসী, অতএব ঘরে ঘরে তার প্রস্তুতি। মানুষের স্বার্থপরতা থেকে সমাজ এক পাও এগোয়নি। আমি স্বার্থপর। আমি স্বার্থপর হলেও, তুমি নারী, তুমি কেন স্বার্থপর হবে! জান-প্রাণ দিয়ে আমার সেবা করো! আমি সেইটাই চাই। আমার চাওয়ার শেষ নেই। আমার জন্যে তোমাকে তটস্থ থাকতে হবে। অবশ্যই তা হবে না। সম্ভব নয়। যুগ পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে। সকলেই নিজের স্বার্থ বুঝতে শিখেছে। কোনো আর রাখঢাক নেই। কথায়, ব্যবহারে সে-কথা জানিয়েও দেবে।

আশা জিনিসটা তেমন খারাপ নয়; কারণ তা দুধের মতো নিজের ভেতরই উথলে ওঠে ফোঁস করে, আবার সমতা ও বিচার বুদ্ধির ফুঁ মারলেই নেমে যায়। আমাদের সব আশা ভাগ্যের কাছে, অদৃশ্য কোনো মহাশক্তির কাছে, কখনো নিজের কর্মের কাছে। আশা-নিরাশার স্রোত অন্তঃসলিলা। কিন্তু প্রত্যাশা! প্রত্যাশার উৎসভূমি মানুষের পাটোয়ারী বুদ্ধি। ভয়ঙ্কর মনুষ্য-নির্ভর। আমি তোমার জন্যে এই করেছি, তুমি আমাকে তার প্রতিদান দাও। দেওয়া-নেওয়া। স্ত্রী! তোমাকে আমি দুধ-কলা দিয়ে পুষেছি। ছোবল যেমন মেরেছ, এইবার জীবন সায়াহ্নে তোমার স্নেহ-মমতার মণিটি খুলে দাও। সন্তান! তোমাকে আমি মানুষ করেছি, শিক্ষা-দীক্ষায় অলঙ্কৃত করে উচ্চ জীবিকার পথ মুক্ত করে দিয়েছি, সংসারী করেছি, আমার এই বার্ধক্যে তোমার কাছে প্রত্যাশা—তুমি আমাকে সম্মান করবে, বন্ধুর মতো আমার পাশে এসে দাঁড়াবে, আমার অবসর জীবন সুখ আর শান্তিতে ভরে দেবে। আমাদের প্রত্যাশা এইরকমই এক চতুর্মুখ ব্রহ্মা। একটা মুখ পরিবার পরিজনের দিকে, আর একটা কর্মস্থলের দিকে, একটা সমাজের দিকে, আর একটা মহাকালের দিকে। অনুচ্চার এই চাওয়ার নামই প্রত্যাশা। স্থির সরোবরে একটি প্রস্তর নিক্ষেপজাত বৃত্তাকার তরঙ্গের মতো বিস্তৃত আরো বিস্তৃত। বৃত্তের ভেতর বৃত্ত। কোনোটাই আর প্রত্যাশার কূল ছুঁতে পারে না। জীবন সরোবারের তীরে কেউ পুষ্পার্ঘ্য রেখে যায়নি, ভাসায়নি প্রদীপ। সেখানে আছে কৃতকর্মের পঙ্ক, আশা আকাঙ্ক্ষার গেঁড়ি গুগলি শামুক। আশা-নিরাশার সঙ্গে সমঝোতা করা যায়, প্রত্যাশা মানুষকে ছোবল মারে। প্রত্যাশা হল বিষধরকে চেপে ধরার চেষ্টা।

সমস্ত দুঃখের কারণ, প্রত্যাশা। ওরা আমার জন্যে করবে। আমার আপনজন। আমার জন্যে করবে না? প্রত্যাশার আবার বড়ো ছোটো আছে। স্বল্পমেয়াদী প্রত্যাশা, দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যাশা। স্বল্পমেয়াদী প্রত্যাশা হল, মুখের কথা খসতে না খসতেই জল আর চা। পরিপাটি বিছানা, মশারি ফেলা। পরিষ্কার চাদর, বিছানার সুব্যবস্থা, ফুলতোলা বালিশের ঢাকা। শুয়ে শুয়ে পড়ার জন্যে মাথার কাছে আলোর ব্যবস্থা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে স্ত্রী এসে যত্নে চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে খাপে ভরে রাখবে। বইয়ের পাতায় একটা চিহ্ন দিয়ে মুড়ে রাখবে। বুকের উপর থেকে হাত দুটো নামিয়ে দেবে। স্নেহসিক্ত গলায় বলবে, পাশ ফিরে ঠিক করে শোও। আবহাওয়া বুঝে গায়ে একটা পাতলা চাদর টেনে দেবে। রোজই এমন একটা কিছু যত্ন করে রাঁধবে, যা আমার প্রিয়। কোনো কাজ করার আগে আমার পরামর্শ নেবে, অনুমতি নেবে। ‘না’ বললে খুশি মনে মেনে নেবে। মুখ ভার করবে না। আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পেছনে ঘোঁট পাকাবে না। ছিটে গুলির মতো কথার ছড়রা ছুঁড়ে মারবে না। আমার কতৃত্বের স্নিগ্ধ স্নেহচ্ছায়ায় সবাই হাসিমুখে ঘুরবে। একটাই উপমা।

সেই উপমা হল কুম্ভকারের চাকলড়ি। সেটা কী? একটি খোঁটাকে অবলম্বন করে চাকা ঘুরছে। আমি কর্তা, আমার চারপাশে পরিবেশের চাকা ঘুরছে। সবাই সেই সত্যটি উপলব্ধি করে আমাকে আমার প্রাপ্য যথোচিত শ্রদ্ধা আর স্নেহ ফেরত দিচ্ছে। আমার ভালো লাগা আর না-লাগার দিকে তাদের প্রখর নজর। ছোট ছোট সুখে আমার ঝুলি ভরে দিচ্ছে। আমি যেন হাজার শক্তির আলো। আমাকে ঝাড়বে-মুছবে। আমার পরিচর্যা করবে। এই সবই স্বল্পমেয়াদী প্রত্যাশা।

দীর্ঘমেয়াদী হল; পরে বলছি।

স্বল্পমেযাদী প্রত্যাশার তবু একটা বিহিত আছে। হল না, হল না। রাগ হল, অভিমান হল, মুখ ভার করে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিলুম। সময় হল সমুদ্রের ঢেউ। মন হল বেলাভূমি। গর্ত বেশি দিন থাকে না। ভরাট হয়ে যায়। সমস্যা হল দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যাশা নিয়ে।

সেটা কীরকম। আদর্শ, সংস্কার সব জড়িয়ে-মড়িয়ে জটিল এক ব্যাপার। সেই প্রত্যাশা স্ত্রীর কাছে, ছেলের কাছে, মেয়ের কাছে। পিতার কাছে, মাতার কাছে।

পিতা আমাকে পালন করবেন। মা আমাকে অহেতুক স্নেহ করবেন। এই পালন, এই স্নেহে কোনো প্রত্যাশা থাকবে না। এই প্রত্যাশাটা আমাদের সংস্কারে আছে। উৎপাদন করা সহজ নয়। কিন্তু তা তো হয় না। পিতা তাঁর যত চাওয়া সন্তানের মধ্য দিয়ে তৃপ্ত করতে চান। লেখা-পড়া শিখে জ্ঞানী হলে চলবে না। ভালো চাকরি যোগাড় করতে হবে। বেশ একটা সচ্ছল সংসারের স্বপ্নকে বাস্তব করতে হবে। না পারলে তুমি অপদার্থ। মায়ের স্নেহে ভাঁটা পড়বে। সংসার উদাসীন। তুমি আসবে-যাবে, তোমার খোঁজ কেউ রাখবে না। জ্ঞানী সন্তানের চেয়ে, ধনী মূর্খের কদর এই পৃথিবীতে অনেক বেশি। যে-ছেলের রোজগার বেশি, বাবা-মার কাছে তারই কদর।

স্ত্রীর কাছে মানুষের সুদীর্ঘ প্রত্যাশা। একদিনের নয়। সুদীর্ঘ জীবনপথে মানুষ স্ত্রীকে পাশে পেতে চায় বন্ধু হিসেবে, উপদেষ্টা হিসেবে। বার্ধক্যে চায় সেবা। একটু দরদ পেতে চায়। ক-জন পায়! প্রত্যাশা প্রত্যাশাই থেকে যায়। দাম্পত্য জীবন হয়ে দাঁড়ায় মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষা। ঝাঁঝালো মেজাজ। উদাসীনতা। এক করতে আর এক। শীতল ব্যবহার। সদা বিরক্ত। বার্ধক্যে তোমার পাশে কেউ নেই। একমাত্র ঈশ্বরই ভরসা। বৃদ্ধ পড়ে আছে একপাশে, সংসার নেচে বেড়াচ্ছে আর একপাশে।

মানুষের দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যাশা সন্তানের কাছে। উপার্জনশীল সন্তান, শিক্ষিতা সুন্দরী পুত্রবধূ। তাতে হলটা কী! তোমার কী লাভ হল! সংসারটাই তো ভেঙে গেল। পুত্র আর পুত্রবধূ আলাদা জায়গায় সংসার পেতেছে। সেখানে তাদের সুখের কাব্য। পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক ভাসাভাসা। ওই দেখা হয়, কথা হয়, একবার, দুবার আসা-যাওয়া। এই পর্যন্ত।

স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। কী ছিল তোমার স্বপ্ন? বিশাল প্রাচুর্য নয়। ছোটো একটা বাড়ি। একটু খোলা জায়গা। দু-একটা ফুলগাছ। একটু সবুজ ঘাস। দু-একটা পাখি। নিটোল একটি পরিবার। ছেলে, মেয়ে, জামাই, পুত্র, পুত্রবধূ। সব এক সুরে বাঁধা তরফদার সেতারের মতো। ফুটফুটে নাতি-নাতনি। মানুষের সংসার। কোন মানুষ! যে মানুষের হুঁশ আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সংজ্ঞায়, মান যুক্ত হুঁশ: মানুষ। হুঁশয়আলা মানুষের সংসার। হুঁশ হল মানবতার আদর্শ। একা বাঁচা নয়, সকলকে নিয়ে বাঁচার মানসিকতা। কর্তব্য নয়, প্রেম। মানুষ অনেক কিছু শেখে। শেখে না ভালোবাসতে। ভালোবাসার সংসার হারিয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে ঘৃণার সংসার। প্রয়োজনের সংসার। যতক্ষণ তোমাকে আমার প্রয়োজন, ততক্ষণই তোমার সঙ্গে ভাব ভালোবাসা। যেই প্রয়োজন ফুরালো, সম্পর্ক শীতল।

বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী সেবা করবে, পুত্র সহায় হবে। মেয়ে-জামাই সময় পেলেই পাশে এসে বসবে। এই সব দীর্ঘমেয়াদী প্রত্যাশা মন থেকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারলেই সুখ। সমাজ ও শাসনের কাছেও মানুষের অনেক প্রত্যাশা। দানবের সমাজ নয়, মানবের সমাজেই মানুষ বাঁচতে চায়। সুস্থ, সবল মানুষ জীবিকা পাবে। রাস্তাঘাট, পরিবহনের সুব্যবস্থা থাকবে। ছেলে-মেয়েরা সৎ শিক্ষা পাবে। ভালো হাসপাতাল, সুচিকিৎসা, জীবনের শান্তি, সুস্থ পরিবেশ। কোথায় কী! রাক্ষসী সমাজ নিয়ত রক্ত চাইছে। কেউ বলছে না, মানুষ হও। বলছে দানব হও। রাজনীতির কুচকাওয়াজ। দুই পক্ষের তাল-ঠোকা। ভবিষ্যৎ চাই না, চাই গদি। ক্ষমতার আস্ফালন। যারা আসছে, তাদের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। আমরা সরবে খামচা খামচি করে বেঁচে থাকি। পরে পায়ের তলায় জমি থাকবে কী যাবে, সে-বোধের প্রয়োজন নেই।

তাহলে সমাজের কাছেও আমাদের কোনো প্রত্যাশা রইল না। আমাদের অতীত নেই ভবিষ্যৎও নেই, ঘোলাটে বর্তমান। কোনোরকমে বেঁচে থাকো, ফুরসত পেলেই মরে যাও।

স্বামী বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে লিখছেন :

এই তো জীবন শুধু কঠোর পরিশ্রম। আর তা ছাড়া কীই বা আমাদের করবার আছে? কঠোর পরিশ্রম কর। একটা কিছু ঘটবে; একটা পথ খুলে যাবে। আর যদি তা না হয়—হয়তো কখনও হবে না—তা হলে তারপর কী, আমাদের যা কিছু উদ্যম, সবই হচ্ছে সাময়িকভাবে সেই চরম পরিণতি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা। অহো, মহান সর্বদুঃখহর মৃত্যু! তুমি না থাকলে জগতের কী অবস্থাই না হত! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে বর্তমান প্রতীয়মান এই জগৎ সত্য নয়, নিত্যও নয়। এর ভবিষ্যৎই বা আরও ভাল হবে কি করে? সেও তো বর্তমানের ফলস্বরূপ। সুতরাং আরও খারাপ না হলেও ওই ভবিষ্যৎ বর্তমানেরই অনুরূপ হবে। স্বপ্ন অহো! কেবলই স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখে চল। স্বপ্ন স্বপ্নের ইন্দ্রজালই এ জীবনের হেতু। আবার ওর মধ্যেই এ জীবনের প্রতিবিধানও নিহিত রয়েছে। স্বপ্ন, স্বপ্ন, কেবলই স্বপ্ন! স্বপ্ন দিয়েই স্বপ্ন ভাঙো।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কথায় কথায় একটি সুন্দর গল্প বলতেন। মনে গেঁথে গেছে। সংসার জিনিসটা কী! কোথায় আমি আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছি! কোন সুখের আশায়! ঠাকুরের সেই গল্প: একজন চাষার বেশি বয়সে একটি ছেলে হয়েছিল। ছেলেটিকে খুব যত্ন করে। ছেলেটি ক্রমে বড়ো হল। একদিন চাষা খেতে কাজ করছে, এমন সময় একজন এসে খবর দিলে যে, ছেলেটির ভারী অসুখ। ছেলে যায় যায়। বাড়িতে এসে দেখে, ছেলে মারা গেছে। পরিবার খুব কাঁদছে, কিন্তু চাষার চোখে একটুও জল নেই। প্রতিবেশীদের কাছে পরিবার তাই আরও দুঃখ করতে লাগল যে, এমন ছেলেটি গেল, এঁর চোখে একটু জল পর্যন্ত নেই। অনেকক্ষণ পরে চাষা পরিবারকে সম্বোধন করে বললে, কেন কাঁদছি না জান? আমি কাল স্বপ্ন দেখেছিলুম যে, রাজা হয়েছি, আর সাত ছেলের বাপ হয়েছি। স্বপ্নে দেখলুম যে, ছেলেগুলি রূপে গুণে সুন্দর। ক্রমে বড়ো হল, বিদ্যাধর্ম উপার্জন করলে। এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল, এখন ভাবছি যে, তোমার ওই এক ছেলের জন্য কাঁদব, কী আমার সাত ছেলের জন্য কাঁদব।

এই হল জ্ঞান—স্বপ্ন আর বাস্তব দুটোই সমান। একটা ক্ষণস্থায়ী আর একটা দীর্ঘস্থায়ী! এই সত্যটাকে ঠিক মতো ধরতে পারলে মহাসুখ। পারি না। আমার জ্ঞানের অভাব। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একটা পাশবালিশ। ভেতরে তুলো ভরা। বিচি গজগজ করছে। ওই গুলোই আমার কামনা বাসনা। আমার স্বার্থ। জগৎটা কেমন চলবে, আমিই ঠিক করছি আমার মতো করে।

ছেলেকে একদিন ডেকে বললুম—আমার চাকরি তো প্রায় শেষ হয়ে এল, এইবার একটা ভালো কিছু ধরো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। সংসারের নিয়ম জানো তো! এক কত্তা যায়, তো আর এক কত্তা এসে বসে। এইবার তো তোমাকেই হাল ধরতে হবে। আমি তো জিরো ফ্যাকটার হতে চলেছি। পাঁচ ছ’হাজারের কমে তো ডাল-ভাত জুটবে না। আফটার রিটায়ারমেন্ট আমি একটু আধটু গতর দিতে পারি, টাকা তো তেমন দিতে পারব না বাবা। গ্যাসের লাইন, কেরোসিনের লাইন, ইলেকট্রিক বিলের লাইন, কাজের বউটি না এলে ঝাঁটপাট, সদর ধোওয়া, ইত্যাদি শ্রমদান ছাড়া, দান করার মতো তো আর আমার কাছে কিছুই থাকবে না। ষাটে পা দিলে, এই আমার ব্রাইট ফিউচার, সেটা কি ভেবে দেখেছ!

কথাটা সে অন্যভাবে নিল। মাকে গিয়ে বললে, বাবা আমাকে খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছে। কাল থেকে আমাকে আর মাছটাছ দিয়ো না। শুধু ডালভাত। রোজগার করতে পারলে, ভালোমন্দ খাব। খাব নিজের পয়সায়। এই ঘোঁট চলল বেশ কিছু দিন। থমথমে চালতার মতো মুখ। আমার সঙ্গে কথা বন্ধ। একে বলে মেন্টাল টরচার।

সহজ সত্যটা টের পেয়ে গেলুম—ছেলে বড়ো হয়ে গেলে, সে আর ছেলে থাকে না—একজন জেন্টলম্যান, পরিচিত এক প্রতিবেশীমাত্র। রেশমকীটের মতো তার খোলের বাইরে অভিমানের সুতো জড়ানো পরতে পরতে। ভালো কথা বললেও গায়ে ছেঁকা লেগে যাবে। সংসারে একটা দল তৈরি হয়ে যাবে। সংসারের কর্তাটিকে তখন সবাই ভাবতে থাকবে, এ ব্যাটা এক ঘটোৎকচ। কারোকে কিছু বলা যাবে না। বললেই মন্ত্র বদলে যাবে—পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম নয়, তখন পিতা নরক পিতা অসুর, পিতাকে কোতল করো।

আমাদের পাড়ায় সেদিন এক মজার শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। কর্তা মারা গেছেন। তিন ছেলে। তিন জনেই বড়ো বড়ো চাকরি করে। এখন শ্রাদ্ধ তো একটা করতেই হয়। হিন্দু সংস্কার। তিনভাই এক এক করে শ্রাদ্ধে বসলে ঘণ্টা বারো সময় লাগবে। অত সময় তো দেওয়া যাবে না। একটা শর্টকাট কিছু চাই। পুরোহিত মাথা খাটিয়ে একটা কায়দা বের করলেন। শ্রাদ্ধের সমস্ত নিবেদনের ওপর একটা বড়ো গামছা চাপা দেওয়া হল। বড়ো ভাই সেই গামছার কোণ ধরে বসল। বড়ো ভাইয়ের কাছা ধরে বসল মেজো ভাই। মেজো ভাইয়ের কাছা ধরে ছোটো ভাই। কোরাসে মন্ত্র পাঠ। তিন ঘণ্টায় শ্রাদ্ধ শেষ। শর্টকাট ফর্মূলা। এই তো একজন মানুষের জীবনের পাওনা। স্বর্গে তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। রক্ত জল করা পয়সায় তিন ছেলেকে মানুষ করার এই হল ফল। তবু আমাদের সংসারের মায়া যায় না। যাবার নয়। শেষের সময়ে সকলেই বিছানার চাদর খামচে ধরে, যেন অনিচ্ছুক বালকটিকে কেউ জোর করে সকালের স্কুলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বা বলির পাঁঠাকে দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হাড়িকাঠের দিকে।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সুন্দর একটি গল্প বলতেন: আমি ও আমার। এর নামই ঠিক জ্ঞান—হে ঈশ্বর! তুমিই সব করছ, আর তুমিই আমার আপন লোক। আর তোমার এই ঘরবাড়ি, পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু, সমস্ত জগৎ—সব তোমার! আর ‘আমি সব করছি, আমি কর্তা, আমার ঘরবাড়ি, পরিবার, ছেলেপুলে, বন্ধু বিষয়’—এসব অজ্ঞান।

গুরু শিষ্যকে এ কথা বোঝাচ্ছিলেন। ঈশ্বর তোমার আপনার, আর কেউ আপনার নয়। শিষ্য বললে, ‘আজ্ঞে, মা, পরিবার এরা তো খুব যত্ন করেন। না দেখলে অন্ধকার দেখেন, কত ভালোবাসেন।’ গুরু বললেন, ‘ও তোমার মনের ভুল। আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি, কেউ তোমার নয়। এই ওষুধের বড়ি ক-টা তোমার কাছে রেখে দাও। তুমি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে শুয়ে থেকো। লোকে মনে করবে যে তোমার দেহত্যাগ হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার সব বাহ্য জ্ঞান থাকবে। তুমি সব দেখতে শুনতে পাবে—আমি সেই সময় গিয়ে হাজির হব।

শিষ্যটি তাই করলে। বাড়িতে গিয়ে বড়ি কটা খেয়ে ফেললে। খেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে রইলে। মা, পরিবার, বাড়ির সকলে কান্নাকাটি আরম্ভ করলে। এমন সময় গুরু কবিরাজের বেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সমস্ত শুনে বললেন, আচ্ছা, এর ওষুধ আছে—আবার বেঁচে উঠবে। তবে একটা কথা আছে। এই ওষুধটা আগে একজন আপন লোককে খেতে হবে, তারপর ওকে দেওয়া যাবে। যে আপনার লোক ওই বড়িটা খাবে, তার কিন্তু মৃত্যু হবে। তা এখানে ওর মা কি পরিবার এরা তো সব আছেন, একজন না একজন কেউ খাবেন, সন্দেহ নেই। তাহলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে।

শিষ্য সমস্ত শুনছে! কবিরাজ আগে মাকে ডাকলেন। মা কাতর হয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন। কবিরাজ বললেন, ‘মা। আর কাঁদতে হবে না। তুমি এই ওষুধটা খাও, তাহলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে। তবে তোমার এতে মৃত্যু হবে।’ মা ওষুধ হাতে ভাবতে লাগলেন। অনেক ভেবে-চিন্তে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বাবা, আমার আরও কটি ছেলেমেয়ে আছে, আমি গেলে কী হবে, এও ভাবছি। কে তাদের দেখবে, খাওয়াবে, তাদের জন্যে ভাবছি। পরিবারকে ডেকে তখন ওষুধ দেওয়া হল—পরিবারও খুব কাঁদছিলেন, ওষুধ হাতে করে তিনিও ভাবতে লাগলেন। শুনলেন যে, ওষুধ খেলে মরতে হবে। তখন কেঁদে বলতে লাগলেন, ‘ওগো, ওঁর যা হবার তা তো হয়েছে গো, আমার অপোগন্ডগুলোর এখন কী হবে বল? কে ওদের বাঁচবে? আমি কেমন করে ও ওষুধ খাই?’ শিষ্যের তখন ওষুধের নেশা চলে গেছে। সে বুঝলে যে, কেউ কারো নয়। ধড়মড় করে উঠে গুরুর সঙ্গে চলে গেল। গুরু বললেন, তোমার আপনার কেবল একজন। তিনি ঈশ্বর।

মাঝে মাঝে ভাবি তিনি আছেন? কে তিনি? পুরুষ অথবা নারী? সাকার না নিরাকার! সে যাই হোক আমার অনেক দাবি তাঁর কাছে। অভাব অভিযোগের শেষ নেই আমার। অর্থ চাই। ভেবে পাই না কোন দেশের মুদ্রায় চাইব। ডলারে না পাউণ্ডে, না টাকায়! খুব অভাবের সময় দু-একবার চেয়েছি। ঘোড়ার ডিম পেয়েছি। শেষে ধার করতে হয়েছে। তিনি এক অদ্ভুত মানুষ বা দেবতা। যাকে দেবেন, তাকে দিতেই থাকবেন ছপ্পড় ফাঁড়কে। এই তো আমাদের পাড়ার মধুসূদন মাইতি! লেখাপড়ায় ক অক্ষর গোমাংস। ছোটো একটা দোকান ছিল, পৈতৃক। সেইটাই ফুলে ফেঁপে তিন চারটে হল। বড়ো বড়ো কোম্পানির এজেন্সি। সব চেয়ে ভালো পজিশানে তিনখানা বাড়ি, দুটো গাড়ি। সে আরও বড়ো লোক হচ্ছে। হচ্ছে তো হচ্ছেই। পায়ের কড়ার মতো তার ঐশ্বর্য বেড়েই চলছে। আর আমার! ঈশ্বরের কাছে একটা প্রোমোশান চেয়েছিলুম। শ’পাচেক টাকা মাইনে বাড়লে তবু হয় তো একটু সামাল দেওয়া যাবে। খুব শুনলেন তিনি। আমার অনেক জুনিয়ার প্রতাপ রায় আমাকে টপকে অফিসার হয়ে গেল। আলাদা কামরা। ঘণ্টা বাজিয়ে বেয়ারা ডাকে। সে এসে আমাকে বলে সাহেব ডাকছে।

এই তো আমার ঈশ্বরের খেলা। এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না। আমি কি এতটাই অপদার্থ! প্রতাপ গাড়ি পেয়েছে। ছুটির পর আমার নাকের ডগা দিয়ে হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যায়। আমি ট্যাঙোশ ট্যাঙোশ করে ট্রাম স্টপের দিকে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে বিচার করি, কী নেই আমার। মাথা আছে, বোকা নই। খাটতে পারি। তাহলে! তাহলে আমার কেন এইরকম ভ্যালভেলে অবস্থা!

এক মহাপুরুষ আমাকে একটি সুন্দর গল্প বলেছিলেন—ভগবান বসে আছেন স্বর্গের জানলায় পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে। পাশে বসে আছেন নারায়ণী। ভগবান বললেন, বসেই যখন আছি, তখন একটা কাজ করি নারায়ণী। ওই যে দেখছ হলুদ রঙের বাগান বাড়ি—ওই জায়গাটা হল বীরভূম। লোকটা খুব বড়োলোক। ব্যবসা করে, দু-নম্বরী করে অনেক টাকা করেছে। ভগবানে বিশ্বাস করে না। কোনো বোধই নেই। কেবল টাকা, ব্যবসা, সম্পত্তি, ভোগ নিয়েই মেতে আছে। তা, ওই লোকটাকে বেশ মোটা রকমের আরো কিছু পাইয়ে দেওয়া যাক। ও এখনি লটারিতে তেইশ লাখ টাকা পাবে।

নারায়ণী বললেন, একটু দূরেই তো দেখছি একটা পোড়ো বাড়ি। ওটা কার?

ভগবান বললেন, আমার এক পরম ভক্তের।

নারায়ণী বললেন, তোমার ভক্ত। তা, তাকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখেছ কেন? ওকে কিছু দাও।

ভগবান বললেন, তা তোমার যখন ইচ্ছে ওকে কিছু দেওয়া যাক। ওর গোয়ালে দেখেছ, একটি মাত্র গোরু আছে। ওর একমাত্র সম্বল। ওই গোরুর দুধ বেচে যা পায় তাইতেই কোনোক্রমে সংসার চলে। তা ওই গোরুটাকে মেরে দিই।

বলা মাত্রই গোরুটা মারা গেল।

নারায়ণী অবাক হয়ে বললেন, ‘প্রভু! তোমার খেলাটা বোঝা গেল না। যে তোমাকে বিশ্বাস করে না, ভোগী, বিষয়াসক্ত, স্বার্থপর, তাকে তুমি আরও দিলে। আর যে দিবারাত্র তোমার নাম করে, তার শেষসম্বল গোরুটাকে মেরে দিলে?’

ভগবান হাসতে হাসতে বললেন, ‘এইচাই বিচার। এইটাই আমার কেরামতি। যে বিষয়ে মজে আছে তাকে আমি আরো জড়িয়ে দিই। বটপাতার আঠার মতো বিষয় যেন তাকে সেঁটে ধরে। লাখো জনম কেটে যাক। চিত্ত শুদ্ধ হলে তবেই বিশ্বাস আসবে। বিশ্বাস এলেই সে আমার কৃপা পাবে। আর যার গোরুটাকে মেরে দিলুম, তার কী হয়েছিল জান, ওই গোরুটাই হয়ে উঠেছিল তার শেষ সংসারবন্ধন। তার আর আমার মাঝে ওইটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল একমাত্র বাধা, সেই বাধাটা আজ সরিয়ে দিলুম। এখন ও পুরোপুরি আমাতে আত্মসমর্পণ করবে।’

আমার জীবনটাও সেই দিকে চলেছে না কী! বৈষয়িক কোনো কিছুই তেমন খোলতাই হচ্ছে না। সংসারটা এলোমেলো হয়ে আছে, নাট-বল্টুর ছড়াছড়ি। সকলেরই উগ্র মিলিটারি মেজাজ। চুপচাপ থাকলে বলবে, বোবা হয়ে গেলে না কী। কথা বললে বলবে, তুমি আর বেশি জ্ঞান দিয়ো না, তোমার মুরোদ জানা আছে। সেই বলে না, এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছোলেও নির্বংশের ব্যাটা। তাহলে করিটা কী।

আজকাল আর বাসে ট্রামে উঠতে পারি না। সব সময়েই মারদাঙ্গা। তাই গুটি গুটি হাঁটি, আর হাঁটতে হাঁটতে ভাবি। কত রকমের ভাবনা আসে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। দিবাস্বপ্ন। পথ চলার এই আনন্দ—চারপাশ দিয়ে গলগল করে লোক চলেছে, ছুঁচো বাজির মতো বেরিয়ে যাচ্ছে এক একটা স্কুটার কি মোটর বাইক। কষ্টেসৃষ্টে কোঁত পাড়তে পাড়তে যাচ্ছে ঠেলা, রিকশায় ভুঁড়ি উলটে চলেছে সন্ধ্যের মাতাল। জায়গায় জায়গায় ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে শিকারী মেয়েছেলে। আজব শহর কলকাতা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই শহরের গতি আছে, মন নেই। যন্ত্রের মতো ঘুরে চলেছে। মেট্রো সিনেমার ফুটপাথে একটি লোক পেছন দিক থেকে বিপুল এক ধাক্কা মেরে সামনে এগিয়ে গেল, যেন ভীষণ তাড়া। ধাক্কা খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলুম। হঠাৎ মনে হল, জানা দরকার, ভদ্রলোকের কীসের অত তাড়া। ছুটলুম তার পেছনে। গ্র্যান্ডের তলায় ধরে ফেললুম।

—একটা প্রশ্ন ছিল।

—বলুন। ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

—আপনি যাচ্ছেন কোথায়? কীসের এত তাড়া?

—যাচ্ছি কোথায়? ভদ্রলোক একটু চিন্তিত হলেন।

—যে ভাবে আমাকে ধাক্কা মেরে চলে এলেন।

—যাওয়ার বিশেষ কোনো জায়গা নেই। একটা জায়গাই আছে, বাড়ি। তা গেলেও হয় না গেলেও হয়। দুটো ঘর, দশটা লোক। লাগাতার গুঁতোগুঁতি।

—তাহলে?

—তাহলে, এই একটাই ব্যাপার, হনহন করে হাঁটি, কেবলই মনে হয়, আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোথাও একটা যেতে হবে। সেই কোথাওটা ঠিক কোথায়, আমার জানা নেই।

ভদ্রলোক যেন যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা আমারই মতো এক মানুষ। বেশ ভাব হয়ে গেল। পাশেই গ্র্যান্ডের প্রবেশদ্বার। হুস হাস করে বড়ো বড়ো গাড়ি ঢুকছে, বেরোচ্ছে। যেসব মানুষ ভেতরে বসে আছে, এক ঝলক দেখলেই মনে হয়, মানুষ নয়, কতকগুলো ডামি। পেছনের আসনে অনেক সময় মানুষীও বসে থাকে। বড়ো দোকানের কাঁচের জানলার সাজগোজ করা পুতুলের মতো। কতরকমের চুল, মুখ, পোশাক, ঢং। উর্দিপরা দারোয়ান যন্ত্রের কায়দায় হাত নাড়ছে, সেলাম করছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার নয়। টাকার সঙ্গে যন্ত্রের ব্যবহার। দুনিয়ায় মানুষ কমছে, রোবট বাড়ছে। ভদ্রলোককে বললুম, আমার পয়সা থাকলে গ্র্যান্ডে ঢুকে আপনাকে চা খাইয়ে বন্ধুত্বটা পাকা করতুম। আপনার নামটা বলবেন? আমার নাম মানব।

—আমার নাম, আমার যা নেই তাই—বিবেক।

গ্র্যাণ্ডের তলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা লিন্ডসের দিকে এগোচ্ছি। কেনাকাটা আছে। রোজই আমি কিছু না কিছু কিনি। পয়সা দিয়ে নয় চোখ দিয়ে। পৃথিবীটা যত আবোল-তাবোল জিনিসে ভর্তি। অদ্ভুত অদ্ভুত সব জামা ঝুলছে, যেমন রঙ, তেমন ডিজাইন, হরেক রঙের সোয়েটার, চটের ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি শার্ট। হাজার রকমের মেকআপের সামগ্রী, আমের আঁটির মতো সাবান, ঢাউস শ্যাম্পু। এসব না হলেও একজন মানুষের সহজেই জীবন চলে যায়।

বিবেক বললেন, আপনারও ওই অভ্যাস আছে না কী?

—উইন্ডো শপিং!

—হ্যাঁ।

—আমার বেশ মজা লাগে। দুনিয়ার তিনের চার ভাগ জিনিসই অপ্রয়োজনীয়।

—তা অবশ্য ঠিক। ভাত, ডাল, একটা তরকারি, গোটা চারেক সাধারণ জামা, প্যান্ট একজোড়া জুতো, এর বেশি সবই বাজে। অকারণ। আপনার মতো আমিও দোকানের শো-উইণ্ডো দেখে সময় কাটাই। পয়সাওয়ালা বোকারা পাগলের মতো এই সব আবর্জনা কেনে। যার মাথা জোড়া টাক, সেও দেখি শ্যাম্পু কিনছে।

—এর মধ্যে আমি গোটকতক জিনিস কিনে ফেলেছি—একটা জ্যাকেট নরম শীতে পরব বলে—আর চওড়া বেল্ট লাগানো একটা ট্রাউজার।

—নিউ মার্কেটের ভেতর একবার যাবেন না কী! খিদে পাচ্ছে। ভালো ভালো স্টল আছে, কেক প্যাস্ট্রি, প্যাটিস!

—চলুন না, আপত্তি কীসের! আমাদের তো পয়সা লাগছে না।

আমরা মার্কেটের গভীরে ঢুকে পড়লুম ফুলের বাজারের পাশ দিয়ে। যাওয়ার সময় কিছু লাল গোলাপ তুলে নিলুম চোখ দিয়ে। ছাত্রজীবনে আমার এক খ্রিস্টান সহপাঠী ছিল। তাকে আমার খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করত, স্কার্টপরা সেই পরীর মতো মেয়েটি। তার নাম ছিল শিলা। সে কোথায় জানিনা। কার গৃহিণী! আজ হয়তো তার জন্মদিন। মনের ফুল মনে মনেই তাকে পাঠিয়ে দিলুম সুদৃশ্য কার্ড লাগিয়ে—হ্যাপি বার্থ ডে। বিবেক বলল, ফুল পাঠাবার মতো কেউ আছে না কী!

—এক সময় ছিল, এখন আর কেউ নেই।

—কোথায় গেল?

—সে কি এমন Fool যে আমার ফুলের অপেক্ষায় থাকবে! প্রজাপতি হয়ে গেছে। আমরা একটু কেক-টেক দর করলুম। কাঁচের শো-কেসে পাশাপাশি শুয়ে থাকা প্যাটিস দর্শন করলুম। ম্যাগনোলিয়ার আইসক্রিম কত দামী হতে পারে, সেই গবেষণা করলুম। চারপাশে সুন্দরী সুন্দরী মেয়েরা নেশাগ্রস্তের মত দোকানে দোকানে ঘুরছে। কেউ কিনছে নেটের পর্দা, কেউ দামী কাপ ডিশ। পয়সার একটা ধর্মই হল, বেশি হলে কামড়াতে থাকে। মানুষকে স্থির হয়ে বসতে দেয় না।

সব শেষে আমরা আমাদের মতো একটা দোকানে বসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলুম। মধ্যবিত্তের দোকান, জল, কাদা, মাছি, ময়লা, বেশ পবিত্র একটা পরিবেশ, মন্দিরের মতো। এ-দোকানে রুটি আর ভীষণ ঝাল তরকারি পাওয়া যায়। গুণ্ডার মতো চেহারার সিঙ্গাড়া। দোকানটার সামথে পথ জুড়ে জুতোর স্টল। পাহাড়ের মতো ডাঁই করা আধুনিক জুতো। গলির দখল নিয়ে নিয়েছে হকাররা।

চা মানে খানিকটা গরম জল। সেইটাই বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে আমাদের আলাপটা আর একটু গভীর হল। আমরা কে কি করি। কার ঘাড়ে কতটা বোঝা। দেখা গেল, দুজনেই ভারবাহী জীব। দুজনেই এক আতঙ্কে ভুগছি—শেষ পর্যন্ত বোঝা বয়ে যেতে পারব তো! একটা সমীক্ষাও হয়ে গেল—কার কী অসুখ। শরীরে বাঙালি ব্যামো যা যা থাকা দরকার, দু-জনেরই আছে। যেমন, গোটা দুই দাঁত, গরম ঠাণ্ডায় জানিয়ে দেয় আছি গো আছি। হজম যন্ত্র দু-জনেরই খুব দুর্বল। সকালে দু-জনেই খুব দুর্বল বোধ করি। ইঞ্জিন স্টার্ট নিতে দেরি করে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। দু-জনেরই হাঁটুতে বাত আছে অ্যালার্জি। নাকে ধুলো ধোঁয়া গেলেই হাঁচি, হাঁপানি। চোখের সমস্যা। চা খেলেই মুখ টকে যায়, তবু খাই। বারে বারে খাই। দু-জনের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় একই রকম ওই দশ বারো দিন কোনোক্রমে চলে, তারপর তেল ফুরিয়ে যাওয়া মটোর গাড়ির মতো ঠেলতে হয়। দু’জনের স্ত্রীই ভীষণ মেজাজি। সুর নেই ঝঙ্কার আছে। আমরা দু-জনে মুখোমুখি বসে আছি যেন আয়নায় মুখ দেখছি। শেষে একটাই প্রশ্ন। দু-জনে দু-জনের দিকে বলের মতো ছুঁড়ে দিলুম—আমাদের কী হবে? হোয়াট ইজ আওয়ার ফিউচার!

আমার ঘুম আসতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগে। মাথার দিকের জানালায় অন্ধকার আকাশ। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতা দরজার পাল্লার মতো ঝুলে পড়ে। তারপর আর কিছু মনে থাকে না। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের রাজ্যে তলিয়ে যাই। আজ কিন্তু ঘুম এল না। বরং একটা মজার গল্প মনে এল।

এক শহর। সেই শহরে একটা বাড়িতে একা এক বৃদ্ধা থাকতেন। পয়সা কড়ির অভাব ছিল না। স্বামী বেশ ভালোই রেখে গিয়েছিলেন। সেই শহরেই বেশ নামি এক চোর ছিল, যেমন সব শহরেই থাকে। তার বহুদিনের ইচ্ছে, বুড়িকে একটু হালকা করতে হবে। তা সে এক রাতে বুড়ির জানালায় এসে হাজির। গরাদ ধরে খাড়া। ভাঙবে আর ঢুকবে। একটা খাট। খাটে শুয়ে আছেন বৃদ্ধা। আধো ঘুম, আধো জাগরণ। চোর শুনছে, বুড়ি বিড়বিড় করছে—আবার সেই ডিব ডিব। এই ডিব ডিবই আমাকে শেষ করবে। ওরে ডিব ডিব। চোর মাথার কাছে জানালায় দাঁড়িয়ে শুনছে। ভাবছে বুড়ি নিশ্চয়ই অসুস্থ। বুড়ি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—উঃ ডিব ডিব। আর পারি না, তুই আমাকে মারবি। চোর শুনছে। এ কোন মারাত্মক অসুখ। ডিবডিব। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোরের মনে হল, রোগটা খুব ছোঁয়াচে। আর এই এতক্ষণ মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে সেই ছোঁয়াচ তারও লেগেছে। সেও ডিবডিব রোগে আক্রান্ত। তার হাত কাঁপতে লাগল। বুক ধড়ফড় করছে, মাথা ঝিমঝিম। চোরের আর চুরি করা হল না। কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে গেল। সোজা বিছানায়। স্ত্রী বললে, কী হল! শুধু হাতে ফিরে এলে! চোর বললে, আর শুধু হাত! আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার দুরারোগ্য অসুখ। সেই অসুখের নাম কেউ কখনো শোনেনি। রোগটার নাম ডিব ডিব!

সঙ্গেসঙ্গে ডাক্তার ডাকা হল। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। বললেন আমার দ্বারা হবে না। আপনারা এই শহরের সেরা ফকির সাহেবকে ডাকুন। আমার শাস্ত্রে ডিব ডিব বলে কোনো অসুখ নেই। স্ত্রী বললে, ডিব ডিব কী কোনো মারাত্মক জন্তু? ডাক্তার বললেন, তাই বা কেমন করে বলি। আমার জানা নেই। তখন ফকির সাহেব এলেন। ফকির সাহেবকে বিছানার পাশে দেখে চোর ভাবলে শেষ সময় তাহলে এসে গেছে। কোনো রকমে শক্তি সঞ্চয় করে বললে, এই রাস্তার শেষ মাথায় একটা একতলা বাড়ি আছে, সেই বাড়িতে এক বুড়ি আছে। তার এই রোগ হয়েছে। সেইখান থেকেই এই রোগ আমাকে ধরেছে। প্রভু যদি পারেন তো আমাকে সুস্থ করে তুলুন।

ফকির বললেন, ‘বাছা দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার শেষ সময়। প্রার্থনা করো। অতীতের পাপ কাজের জন্যে অনুশোচনা করো।’

ফকির বেরিয়ে এলেন, সোজা চলে গেলেন সেই বুড়ির বাড়িতে। রাস্তার ধারের ঘর সেই জানালা। ফকির দাঁড়িয়েছেন জানালায়। বুড়ি শুয়ে আছে বিছানায়। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে শরীর। দোমড়াচ্ছে, মোচড়াচ্ছে। ধরা ধরা গলায় বুড়ি বলছে—‘শয়তান ডিব ডিব তুইই আমাকে মারবি। ওরে একটু শান্তি দে, একটু একটু করে আর আমার রক্ত চুষে নিসনি।’

জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ফকির। বুড়ি কখনো আর্তনাদ করছে, কখনো চুপ করছে অল্পক্ষণের জন্য। কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর ফকির নিজেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। শেষে ফকির ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। সেই কাঁপুনিতে জানালার গরাদ কেঁপে উঠল। আর সেই শব্দে বুড়ি তড়াক করে বিছানা ছেড়ে নেমে জানালার কাছে এসে ফকিরের হাত দুটো ভেতর থেকে চেপে ধরলেন—এ কী অসভ্যতা! আপনার মতো একজন গুণী, পন্ডিত মানুষ ভদ্রলোকের বাড়ির জানালায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন মাঝরাতে।

ফকির বললেন, ‘মা, তুমি এমন ভালোমানুষ; কিন্তু তোমার কী দুর্ভাগ্য, এমন এক ভয়ঙ্কর অসুখ কী করে পাকালে? তখন থেকে শুনছি, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ আর ডিব ডিব বলে চিৎকার করছ। আমার ভয় হচ্ছে, অসুখটা আমাকেও ধরল। আমার বুকটাও কেমন করছে। দেখছ না, আমার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে।’

বুড়ি বললে, ‘হা রে আমার মূর্খ। আপনাকে আমি মনে করতাম শহরের সবচেয়ে জ্ঞানীগুণী মানুষ। এত বই; এত লেখাপড়ার এই হাল! কে একজন ডিব ডিব বলছে সেই শুনে আপনি মরো মরো। হায় আমার পন্ডিত রে! ওই কোণের দিকে তাকান, তাহলেই বুঝতে পারবেন ভয়ঙ্কর ডিব ডিব জিনিসটা কী!

ঘুরে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা। ঘরের কোণের দিকে একটা কল। পাইপে ছোট্ট একটা ফুটো, সেই ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। সেই জল পড়ার শব্দই হল ডিব ডিব। ফকিরের সমস্ত অস্বস্তি নিমেষে কেটে গেল। তিনি ছুটলেন চোরের বাড়ির দিকে। এইবার ফকির তাকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন।

চোর বললে, ‘আপনি আমার চোখের সামনে থেকে সরে যান। আমার প্রয়োজনে, আপনি আমাকে গোটাকতক উপদেশ দিয়ে সরে পড়েছিলেন। আপনার ওই বিরসবদন দর্শনে আমার ভবিষ্যৎ খুব একটু উজ্জ্বল হবে না।’

ফকির বললেন, ‘মূর্খ, আমার মতো একটা লোক তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে, এ কথাটা কেমন করে ভাবলে! আমি গিয়েছিলুম কী করে তুমি ভালো হবে, কী করে তোমাকে ভালো করা যায়, তারই অনুসন্ধানে। এখন আমি যা বলি তাই শোনো, আমি যা করি তাই দেখো।’

ভালো হয়ে যাবে শুনে, চোর কিছুটা শান্ত হল। ফকির তখন এক গেলাস জলে মন্ত্র পড়ে চোরকে বললেন, ‘প্রতিজ্ঞা করো, আর কোনো দিন চুরি করাব না। চোর ভালো হওয়ার আশায় বললে, আর কোনো দিন চুরি করব না। তখন সেই ফকির চোরের গায়ে জল ছিটোতে লাগলেন আর মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন, শেষে খুব ধমকের সুরে বললেন, পালা ডিব ডিব পালা, যেখান থেকে এসেছিলিস সেইখানে পালা।’

চোর ভালো হয়ে উঠে বসল। তার ডিব ডিব ভালো হয়ে গেল।

গল্পটা আমার এই কারণে মনে এল—কেমন অজানা একটা ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সেই ভয়টা কীসের ভয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা ভিস্তি। ভেতরে আয়ু জলের মতো টলটল করছে। অনবরতই ঝরে যাচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা। সেই ফোঁটা আমি দেখতে পাচ্ছি না, কেবল একটা অশ্রুত শব্দ প্রণবের মতো ডিব ডিব। সেটা আমার হৃদয়ের ধ্বনি—অবিরাম টিপ টিপ। যতই চলেছে ততই ঘড়ির মতো স্প্রিং খুলে যাচ্ছে। একসময় দম ফুরিয়ে অচল হয়ে যাবে। সেই ফুরিয়ে যাবার ভয়ে, নাকি ফুরোবার আগে রেস্ত ফুরোবার ভয়। পথে বসে যাওয়ার ভয়! মৃত্যুকে আর মানুষ তেমন ভয় পায় না। জীবনের মোহ শতকরা আশিভাগ মানুষের আর নেই। বরং বেঁচে থাকার ভয়টাই বেশি। প্রতিযোগিতা এত বেড়েছে! ছোটো একটা রেসের মাঠ, গিজগিজ করছে দৌড়ের ঘোড়া। পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

এক ধনী পিতা চার ছেলেকে দশ হাজার করে টাকা দিয়েছেন—‘যাও, তোমরা ব্যবসা বাণিজ্য করে খাও’। বেশ কিছুকাল পরে পিতার খেয়াল হল, আচ্ছা দেখা যাক, ছেলেরা কে কেমন ব্যবসা করছে, কতটা উন্নতি করছে। একে একে ডাকলেন চারজনকে। বড়ো ছেলে বললে, ‘আপনি যা মূলধন দিয়েছিলেন, তার উপরে আমি বেশ বাড়িয়েছি।’ মেজো ছেলে বললে, ‘খুব বেশি না হলেও মূলধনের উপর কিছু বাড়িয়েছি।’ সেজো ছেলে বললে, ‘আমি বেশি কিছু করতে পারিনি, তবে মূলধনটা নষ্ট করিনি।’ ছোটো ছেলে আসেনি। কেন আসেনি। ডাকো তাকে। সে লজ্জায় লুকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে তাকে ডেকে আনা হল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নীচু করে।

বাবা বললেন, ‘কী বাবা? তুমি কিরকম উন্নতি করেছ ব্যবসায়?’

ছেলে বললে, ‘আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না? আমার পেটে ভাত পড়েনি কতকাল, মাথায় তেল পড়েনি কতকাল, শতচ্ছিন্ন কাপড় ময়লা। আপনি যা দিয়েছিলেন সব হারিয়ে ফেলেছি, সব হারিয়ে ফেলেছি।’

ছোটো ছেলের ওপর পিতা-মাতার স্নেহ একটু বেশিই হয়। ছেলের অবস্থা দেখে বাবার করুণা হল। একে আর টাকা দিয়েও লাভ নেই কোনো। আবার হয়তো হারিয়ে ফেলবে তখন। তখন বড়ো ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখ, তোমাদের ছোটো ভাই, সব হারিয়ে ফেলেছে। দেখেই তো বুঝতে পারছ, পেটে ভাত নেই, মাথায় তেল নেই। একে আরও টাকা দেওয়া মানে, সে টাকাও নষ্ট হওয়া। আমার গলায় একটা মণি আছে, রোজ এক পোয়া করে সোনা দেয়। এই মণিটা আমি ওকে দিচ্ছি, তাহলে ও তো রোজই সোনা পাবে এক পো করে, তাহলে ওর কোনো অভাব থাকবে না।’ এই বলে তিনি মণিটা ছোটো ছেলের গলায় পরিয়ে দিলেন।

তখন আর তিন ছেলে ভাবলে, ‘আমরা যদি গরিব হয়ে বাবার সামনে এই ভাবে দাঁড়াতে পারতুম, তাহলে আমরাও এমন অলৌকিক কন্ঠমণি পেতুম।’

আমিও কী সেইরকম আমার পরমপিতার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি, সব আমার হারিয়ে গেছে যা দিয়েছিলেন তিনি। শিক্ষা-দীক্ষা সাধনা-কর্মতৎপরতা। কিন্তু এখনও যায়নি নীচ অহঙ্কার। এখনো আমি আমি, আমার আমার করছি। বলতে পারছি না, সব গেছে আমার। এই অহঙ্কারটুকুর জন্যে জ্ঞান আসছে না। সমর্পণ আসছে না। ঠাকুরের সেই গল্পটা আমার মনে পড়ছে—বাছুর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) করে তাই তো অত যন্ত্রণা। কষায়ে কাটে, চামড়ার জুতো হয়, আবার ঢোল-ঢাকের চামড়া হয়। সে ঢাক কত পেটে, কষ্টের আর শেষ নেই। শেষে নাড়ি থেকে তাঁত হয় সেই তাঁতে যখন ধুনুরির যন্ত্র তৈরি হয় আর ধুনুরির তাঁতে তুঁহু তুঁহু (তুমি তুমি) তখন নিস্তার হয়। তখন আর হাম্বা হাম্বা (আমি আমি) বলছে না; বলছে তুঁহু তুঁহু (তুমি তুমি) ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আমি অকর্তা; তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র, তুমিই সব।

এইসব ভাবতে ভাবতে অপার একটা শান্তি এল মনে।

শান্তি এল কিন্তু ঘুম এল না। বয়েস বাড়লে মানুষের ঘুম কমে। সেটা অবশ্য একপক্ষে ভালোই। যাবার দিন এগিয়ে আসছে, যতটা পারা যায় পৃথিবীটাকে দেখে নাও। দিনের পৃথিবী, রাতের পৃথিবী। আমার ঘরটায় মাপ খুব জোর দশ বাই বারো। দোতলার ওপর। লাগোয়া একটা বারান্দা আছে রাস্তার দিকে। অন্য ঘরে পরিবার পরিজন। দিবসের সংগ্রামে ক্ষত-বিক্ষত সবাই গভীর ঘুমে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এখন সব কত শান্ত! বেঁচে থাকার একটা প্রবল শব্দ আছে। এলোমেলো শব্দ। আজকাল মানুষ বড়ো চিৎকার করে কথা বলে। মানুষের ভেতরটা যত ‘হল না, হল না, গেল, গেল, সব গেল’ বলে লাফাচ্ছে, বাইরে তত শব্দ হচ্ছে। আধুনিক খাদ্যে মানুষের ঝাঁঝ বাড়ছে। মনে হয় ইউরিয়া সারের এফেক্ট। আজকাল তো সবেতেই ইউরিয়া। মুড়িতে, তরিতরকারিতে, মাছে। সেই কারণেই মনে হয় মানুষের কথার সাইজ বাড়ছে, স্বাদ কমে যাচ্ছে। মিষ্টি কথা শোনাই যায় না।

উঠে পড়লুম বিছানা থেকে। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। শীত শীত বাতাস। বাতাস এখনো তার মমতা হারায়নি, রাত এখনও তার মায়া হারায়নি। ছেলেবেলার তারাগুলো সেই একই ভাবে আকাশে জ্বলে আছে।

একটা নি:সঙ্গ কুকুর আপন মনে রাস্তার ধারে কী খুঁজে চলেছে। একটা পাগল বীরের মতো হেঁটে চলেছে হাত-পা নাড়তে নাড়তে। পৃথিবীটাকে এরা কেমন আপন করে নিতে পেরেছে! আমরা সব দূরে সরে আছি দশ বাই বারোর খাঁচায়। দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনার মশারি খাটিয়ে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম নেই। ভাবছি বড়ো নিরাপদে আছি। এই আপদকে যে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে সেই নিরাপদ। কে কার! কেউ কারো নয়। একজন বলেছিল, সব জনে সুতো দিয়ে বাঁধা। সেটা কি? বললে, ম্যাজিক দেখনি! একটা বাচ্চা মেয়েকে টান টান করে চার ছ’টা তরোয়ালের ফালের ওপর ম্যাজিশিয়ান শুইয়ে দিলে। তোমরা অমনি ভয়ে মরলে। চীনে সুতো চোখে দেখা যায় না। সেই সুতো দিয়ে মেয়েটাকে ওপর থেকে ঝোলানো হয়েছে। স্বার্থ হল চীনে সুতো, চোখে দেখা যায় না। সম্পর্ক হল অদৃশ্য স্বার্থ। চলে গেলে কেউই মনে রাখবে না। আমার বাবা, মা, জ্যাঠাইমা, জ্যাঠামশাই যাঁরা একে একে চলে গেছেন, আমি কি তাঁদের মনে রেখেছি! সবই তো তিন দিনের শোক। আমার নাওয়া-খাওয়া, ঘুম, ফুর্তি কোনটা বন্ধ ছিল ক-দিন! এখন কি একবারও মনে পড়ে তাঁদের!

ওই যে পুব দিকের বাড়িটা! প্রফুল্লবাবুর বাড়ি। মেয়ের বিয়ের জন্যে একলাখ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখেছিলেন। তাঁর কিডনি দুটো হঠাৎ বিকল হয়ে গেল। পরিবার পরিজন বললে, যে যাওয়ার সে তো যাবেই, ব্যাঙ্কের টাকা ভাঙলে মেয়েটার তো বিয়ে হবে না। মেয়ের বিয়ের প্রয়োজন বেশি, না একটা বুড়োর বেঁচে থাকা! চলে গেলেন প্রফুল্লবাবু। বছর না ঘুরতেই বাড়িতে আলোর রোশনাই। মেয়ের বিয়ে। এই তো সংসার, প্রয়োজনের সংসার।

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সেই গল্পটা মনে পড়ল, গুরু শিষ্যের গল্প। শিষ্য হঠযোগ করত, কিন্তু সংসারে বদ্ধ। গুরু সংসার ছাড়ার কথা বললেই শিষ্য বলে, কী করি গুরুদেব! আমার পরিবার যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, আদর যত্ন করে, ওর জন্যেই তো সংসার ছাড়তে পারছি না। গুরুদেব বললেন, ভালোবাসে! কতটা ভালোবাসে, সত্যি সত্যি একবার পরীক্ষা করো তো! শিষ্যকে একটা ফন্দি শিখিয়ে দিলেন। একদিন তার বাড়িতে ভীষণ কান্নাকাটি। পাড়া প্রতিবেশী সব দৌড়ে এল। এসে দেখে সাংঘাতিক ব্যাপার, হঠযোগী ঘরে আসনে এঁকে বেঁকে, আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। সবাই বুঝতে পারলে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। স্ত্রী আছড়ে কাঁদছে, ‘ওগো আমাদের কী হল গো, ওগো তুমি আমাদের কী করে গেলে গো!’ সে একেবারে আছাড়-পাছাড় কান্না। ‘ওগো দিদি গো, এমন হবে তা জানতাম না গো!’ এদিকে আত্মীয় বন্ধুরা খাট এনেছে। ওকে ঘর থেকে বার করার চেষ্টা করছে। শ্মশানে নিয়ে যাবে সৎকারের জন্যে।

এখন একটা গোল হল। এঁকেবেঁকে অমন আড়ষ্ট হয়ে থাকাতে ঘরের দরজা দিয়ে বার করা যাচ্ছে না। তখন একজন প্রতিবেশী দৌড়ে গিয়ে একটা কাটারি নিয়ে এল। কাটারি দিয়ে ঘরের চৌকাঠ কাটতে লাগল। স্ত্রী অস্থির হয়ে কাঁদছিল, সে দুম দুম শব্দ শুনে দৌড়ে এল। এসে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলে, ‘ওগো কী হয়েছে গো?’ প্রতিবেশীরা বললে, ‘এঁকে তো বার করা যাচ্ছে না, তাই চৌকাঠ কাটছি।’ তখন স্ত্রী বললে, ‘ওগো অমন কর্ম করো না গো। আমি যে এখন বিধবা হয়ে গেলুম। আমাকে আর দেখবার লোক কেউ নেই, কটি নাবালক ছেলেকে মানুষ করতে হবে। এ দোয়ার গেলে আর তো হবে না। ওগো ওঁর যা হবার তা তো হয়ে গেছে—বরং ওঁর হাত পা কেটে বার করার চেষ্টা করো।’ হঠযোগীকে গুরু একটা বড়ি দিয়েছিলেন। সেই ওষুধের প্রভাবে শিষ্য এমন তেউড়ে ছিলেন, কিন্তু কানে সব কথাই আসছিল। পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা শুনে তিনি আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ওষুধের প্রভাব কেটে গেল। দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘তবে রে শালী, আমার হাত-পা কাটবে!’ এই বলে তিনি সংসার ত্যাগ করে গুরুর হাত ধরে চলে গেলেন।

এই হল প্রয়োজনের সংসার। যতদিন তোমাকে আমার প্রয়োজন, ততদিন তোমার সঙ্গে আমার ভাব-ভালোবাসা, সোহাগ-আদর। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল তো হয়ে গেল। আগে যা ছিল, আজও তাই আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। যতদিন মানুষের সংসার ততদিন এই নিয়ম। সব মানুষই কিন্তু ভাবে ব্যাপারটা পালটে যাক। আমি মানুষ, তুমি মানুষ, সে মানুষ—সকলেরই এক ভাবনা; কিন্তু আচরণে আমরা প্রত্যেকেই স্বার্থপর। মানুষ কেন কুকুর হতে পারে না।

বারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে এলুম। মাঝরাতে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক নয়। বাতাসে হিম লাগছে। ব্যামোয় ধরলে কে দেখবে! দু-একবার অসুখে পড়ে দেখেছি, খুব একটা সুবিধে হয় না। পরিবারের কেউই সেটা আন্তরিকভাবে নিতে পারে না। খুব ঘটা করে ডাক্তার ডেকে আনে একগাদা ওষুধ। দু-দিন নিয়ম করে খাওয়ায় তারপর আর খেয়াল করে না। তখন সেল্ফ হেল্প। একবার হয়তো জিজ্ঞেস করলে, সকালের ক্যাপসুলটা খেয়েছ? খাও নি! অসুখটা কার! তোমার না আমার! মনে করে ওষুধটাও খেতে পার না। সাত দিনের বেশি শুয়ে থাকলে বলবে, এইবার একটু ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করো। রোগকে যত পাত্তা দেবে রোগ তত পেয়ে বসবে। মন থেকে অসুখটা ঝেড়ে ফেলো। আমাদের বাড়িতে যে বউটি কাজ করে তার অসুখ করলে বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়। সেই মনোভাব আমার বেলাতেই বা অন্যরকম হবে কেন! ওই একই মন নিয়ে তো সংসারের কারবার। আধুনিক সংসার সেবাকে ভয় পায়। বড়লোকরা পয়সা দিয়ে নার্স রাখে। যে অনেক দিন ভুগবে আর ভোগাবে বলে মনে হয় তাকে নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেয়। চতুর্দিকে বৃদ্ধ-নিবাস গজিয়ে উঠছে। সংসারে বৃদ্ধদের আর স্থান হবে না। সেই সংসার চিরতরে হারিয়ে গেল, নাতি-নাতনি, দাদু, দিদা। গোরুর দুধ বন্ধ হলে কসাইখানায় পাঠাত। একালে অকেজো বৃদ্ধকে রোজগেরে ছেলেরা আর তাদের আধুনিকা বউরা ওলড এজ হোমে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তুমি কত শান্তিতে থাকবে বাবা! তোমার মতো আরও কত বন্ধু পাবে। সারাটা দিন শুধু অবসর। বেড়াবে, গল্প করবে, বই পড়বে, টিভি দেখবে। তোমার কী দরকার এই সংসারের গোলমালে! বয়েসে মানুষ কী চায়! শান্তি চায় নির্জনতা চায়। তাই না! আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে তোমাকে দেখে আসব।

বৃদ্ধের তখন হয়তো মনে পড়বে পরমহংসদেবের সেই গল্প:

এক পথিক, এই যেমন আমরা সংসার পথের। এক পথিক পথ চলতে চলতে মস্ত বড়ো এক মাঠে গিয়ে পড়ল। রোদে হাঁটছে বহুক্ষণ। ক্লান্ত, শ্রান্ত, ঘামে সারা শরীর জবজবে। একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্যে সে একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। এই সময় তার মনে খেয়াল হল—এখন যদি বেশ নরম একটা বিছানা পাওয়া যেত, তাহলে আরাম করে ঘুমানো যেত। সে যে গাছটার নীচে বসেছিল সে জানত না যে, সেটা একটা কল্পতরু। যাঁহাতক ভাবা অমনি নরম একটা বিছানা এসে গেল। সে তো মহা অবাক। যাই হোক সে তার ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিল। এবার সে ভাবতে লাগল—একটি অল্প বয়সী সুন্দরী এসে যদি তার পদসেবা করত! কল্পতরু! সঙ্গেসঙ্গে তার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল। এক সুন্দরী যুবতী এসে তার পা টিপতে লাগল। পথিকের আনন্দ আর ধরে না, কেয়া মজা! যা চাইছি তা-ই পাচ্ছি। আচ্ছা, এই যে এতটা পথ হেঁটেছি, খিদে তো বেশ ভালোই পেয়েছে, এখন ভালোমন্দ কিছু খেতে পেলে কেমন হত! সঙ্গেসঙ্গে এসে গেল প্রচুর ভাল ভাল খাবার। কোনটা খায় আর কোনটা না খায়! সে খাওয়া শুরু করল। পেট ভরে খেয়ে-দেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে ভাবছে সারাদিনের সব ঘটনার কথা। এ তো বেশ ভালই হচ্ছে। আচ্ছা, এখন যদি একটা বাঘ এসে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, তাহলে কেমন হয়! সঙ্গেসঙ্গে কেঁদো এক বাঘ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড় মটকে দিলে।

ডিগ্রি ডিপ্লোমা চাই! পাওয়া হল। একটা চাকরি চাই। তাও হল। স্ত্রী চাই। এসে গেল। সংসার চাই। চলে এলে খাট-পালঙ্ক, ড্রেসিং টেবিল, ডিনার টেবিল, ফ্রিজ, টিভি! সভ্যতার যাবতীয় আবর্জনা ঢুকে গেল সংসারে। সে কী সরব বাঁচা! অহঙ্কারের প্রবল আস্ফালন। এসে গেল ছেলে-মেয়ে। শুরু হল দৌড় ঝাঁপ। ছোটো থেকে বড়ো করা। চাইল্ড স্পেশালিস্ট, ফলের রস, ডিমের কুসুম, ইংলিশ মিডিয়াম। স্বপ্ন দেখা। হচ্ছে, ছেলে বড় হচ্ছে, মেয়ে বড়ো হচ্ছে। নিজের বয়েস বাড়ছে। মাথার সামনের দিক ফাঁকা হচ্ছে। চোখের উজ্জ্বলতা কমছে। হজমের বিভ্রাট, হাঁটুতে বাত। চাকরির দিন কমছে, বাজার দর বাড়ছে, দায়িত্ব বাড়ছে, ফ্যাচাং কমছে না, ক্রমশই জটিল হচ্ছে। এইবার হঠাৎ যদি একটা বাঘ আসে। নয়া জমানা সেই বাঘ। দে বুড়োকে সংসারের বাইরে ফেলে! অন্ধকারে হাত বাড়াই, কেউ একজন ধর। কেউ নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে অতিশয় ব্যস্ত।

এই বোকা! তোমার সেই গল্পটা মনে নেই! মোজেস একদিন ভগবানকে বললেন, তোমার তো অনেক বন্ধু, যে কোনো একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাও না। ভগবান বললেন, চলে যাও উত্তরের উপত্যকায়, সেখানে তুমি একজনকে পাবে, যে আমাকে ভালোবাসে, আমার প্রিয়, আমার পথেই সে চলে। মোজেস সেই নির্দেশ অনুসারে চলে, সেই মানুষটির দেখা পেলেন। পরনে ছেঁড়া কাপড়, চারপাশে পোকা মাকড়। ভগবানের প্রিয়পাত্র বসে আছেন। মোজেস বিনীতভাবে বললেন, হে ঈশ্বরের দূত! কোনোভাবে আমি কি আপনার সেবা করতে পারি?

মানুষটিকে বললেন, অবশ্যই পারেন, প্রভু আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, যদি দয়া করে এক গেলাস জল এনে দেন, বড়ো উপকার হয়।

মোজেস জলের সন্ধানে বোরোলেন! ফিরে এসে দেখেন, লোকটি মারা গেছে! মোজেস তখন বেরোলেন একখন্ড সাদা কাপড়ের সন্ধানে। মৃতদেহ তো খোলা রাখা যায় না, চাপা দিতে হবে। কাপড় নিয়ে যখন ফিরে এলেন, দেখলেন একটা মরুভূমির সিংহ সেই মৃতদেহ খেয়ে ফেলেছে। মোজেসের মনে বড়ো লাগল। তিনি চিৎকার করে বললেন, ভগবান! তুমি সর্বশক্তিমান, তুমি সর্বজ্ঞ; কিন্তু তোমার এ কেমন বিচার! তুমি মাটি থেকে মানুষ তৈরি করলে। মৃত্যুর পর কারোকে নিয়ে গেলে স্বর্গে। কেউ পায় অসীম যন্ত্রণা, কেউ সুখী, কেউ চির অসুখী। তোমার পৃথিবীর এই বিচিত্র ধাঁধার আমি কোনো সমাধান যে খুঁজে পাই না প্রভু!

ঈশ্বরের জবাব এল, শোনো মোজেস, তোমার সামনেই একটা ঘটনা ঘটে গেল। লোকটি জল চাইল তোমার কাছে। কেন জান মোজেস! এই লোকটি সব ব্যাপারে এতকাল আমার ওপরেই নির্ভর করে ছিল, হঠাৎ সে ঘুরে গেল তোমার দিকে। তোমার সাহায্যে সে জল পেতে চাইল। অর্থাৎ আমার ওপর তার বিশ্বাস টলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আমি তার হাত ছেড়ে দিলুম মোজেস। দু নৌকোয় পা দিলে চলে না। এই তার পরিণতি। কেমন? বুঝলে তো! পেলে তোমার উত্তর!

মোজেস কেন? আমিও তো উত্তর পেলুম; কিন্তু সেই বিশ্বাস আসে কই! সাহায্যের আশায় মানুষের কাছেই যে ছুটি! তিনি আছেন কি নেই সে তো বুঝি না! গভীর রাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে একটা অনুভূতি আসে। বিশ্বচরাচর নিদ্রিত। এক-আকাশ তারা জ্বল জ্বল করছে, তখন মনে হয় এই ফুটখানেক শরীরের অস্তিত্ব পৃথিবীর তুলনায় কিছুই নয়। এর এত বোলচাল কীসের! কীসের এত হাঁকডাক! বিশ্বাস অবিশ্বাসের এত কচকচি!

একজন লঙ্কা থেকে সমুদ্র পার হবে, তা বিভীষণ বললেন, বেশ তো, তোমার কাপড়ের খুঁটে এই জিনিসটা বেঁধে নিয়ে সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাও। কিন্তু খুলে দেখার চেষ্টা করো না, কি আছে! দেখতে গেলেই ডুবে যাবে। সেই লোকটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল। বিশ্বাসের এমন জোর। খানিকটা যাওয়ার পর হঠাৎ তার মনে সন্দেহ এল। বিভীষণ কী এমন জিনিস বেঁধে দিয়েছে যে জলের ওপর দিয়ে চলে যেতে পারছি! এই বলে কাপড়ের খুঁটটি খুলে দেখে, শুধু ‘রাম’ নাম লেখা একটি পাতা রয়েছে। তখন সে ভাবলে, এঃ এই জিনিস! ভাবাও যা, অমনি ডুবে যাওয়া।

আবার শুয়ে পড়লুম। এইবার যদি একটু ঘুম আসে। অনেকদিন আগে পূর্ণিমা হয়ে গেছে। শেষ রাতে অসুস্থ একটা চাঁদ উঠেছে। ফ্যাকাসে মেয়ের মতো মুখ। সেই দিকে তাকিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম।

বেশ একটু বেলায় ঘুম ভাঙল। পৃথিবী তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। বাইরের জগৎ ক্যাচোর-ম্যাচোর করছে। কোনো নতুনত্ব নেই। সেই এক খবরের কাগজ, দুধের প্যাকেট, বাজারের ব্যাগ, কেরোসিনের লাইন, রেশানে গম নেই, কলে জলের জন্য চিৎকার। মানুষে মানুষে গলাগলি, ফাটাফাটি। গাঁক গাঁক গান ভেসে আসছে লাউড স্পিকারে। হয় বিয়ে, না হয় কোনো নেতার জন্মদিন।

সব দিন যেরকম, আজকের দিনটাও সেইরকম। সেই পুরোনো কাপে চা, একটা বিস্কুট। সেই গোড়ালি ক্ষয়ে যাওয়া চটি, সেই ফাটা মেঝে, শ্যাওলা ধরা বাথরুম, গোল আয়না, কতকালের চেনা মুখ, সাবানের ফ্যানা, ব্লেডের টান। একটা লোক ষাটবছর ধরে এই করে যাচ্ছে। একটু এদিক-ওদিক নেই। সেই এক অফিস, এক রোজগার।

বহুকাল আগে এক সংসারে একটি ছেলে জন্মেছিল। মায়ের মুখে হাসি, পিতার মুখে গর্ব। বংশধর এসেছেন। তারপর সব শিশুরই যা হয়। কোলে পিঠে চেপে বড়ো হতে লাগল। শিশুটি নয়, বড়ো হচ্ছে শিশুটির পিতা, মাতা, আত্মীয়স্বজনের স্বপ্ন। এই হবে, সেই হবে, ওই করবে, সেই করবে, জজ ব্যারিস্টার, হাকিম, ডাক্তার। যাই করুক, দুটো জিনিস চাই, সম্মান আর অর্থ। একটা আশা বড়ো হচ্ছে, বড়ো হচ্ছে একটা চাওয়া। গাছ পুঁতেছে সংসার, ভালোবাসার বেড়া দিয়ে সার আর জল ঢালছে ফলের আশায়। তাঁরা আর কেউ নেই। মহাকাল নিয়ে চলে গেছে। পড়ে আছে দীর্ঘশ্বাস। গাছে তেমন ফল ধরেনি। বাঁজা গাছ। ওই কোনোরকমে সংসার চালায়। যত না চলে তার চেয়ে বেশী শব্দ করে। এ এমন এক গাড়ি, তেল টানে গাদা, যায় কম কিলোমিটার।

একটা মানুষের সব আশা চলে গেলে, সে লোকটা বাঁচে কেমন করে! তার তো মরাটাই বাঁচা। মরতে পারছে না বলে বেঁচে আছে। জীবনের যত ভুলভ্রান্তি বোঝা যায় জীবনের শেষের দিকে এলে। প্রথমে বোঝা যায় না। শৈশবে অজ্ঞান, কৈশোরে চপলমতি, যৌবনের নেশা, বার্ধক্যে হাহাকার। অঙ্কের মতো। কষে আসছি পর পর। শেষে উত্তর মেলে না। দেখ দেখ কোন স্টেপে ভুল করেছিস। অঙ্ক ফিরে কষা যায়, জীবনের অঙ্ক সংশোধন চলে না। যা হয়ে গেল, তা হয়ে গেল।

এই আমি যদি কোনো অলৌকিক কায়দায় আমার শৈশব ফিরে পাই তাহলে আমি আরও মনোযোগী ছাত্র হব। কৈশোর থেকেই আসন, ব্যায়াম, প্রাণায়াম করব যৌবনে সৎসঙ্গ, সদগ্রন্থ। আলস্য ত্যাগ করব, পরিশ্রমী হব, নিজেকে রোজ মাজাঘষা করব আদর্শের ছোবড়া দিয়ে। গুরুজনের কথা শুনব, ভক্তি আর শ্রদ্ধা আনব মনে, আর একটু ধার্মিক হওয়ার চেষ্টা করব। ক্রোধ, অহঙ্কার গোঁ এইসব কমিয়ে ফেলব। মানুষকে ভালোবাসতে শিখব, হিংসা জয় করব উচ্চাশায় লাগাম পরাব। পারলে, সংসার করব না। সংসারের মতো পন্ডশ্রম আর কিছু নেই। চিরদাস হয়ে যাওয়া। রোজগার কত হল, খরচ কত হল, জমল কত টাকা? এর বাইরে সবই তো ফাঁকা। শুধু টাকার ধান্দা। টাকায় টাকায় গড়ায় সংসার।

সেই কৃপণের গল্পটা মনে পড়ছে। অনেক কান্ড করে সে লাখ তিনেক টাকা জমিয়েছিল। একটা বাগানবাড়ি কিনেছিল। সাজানো গোছানো। একটা গাড়ি। অভাব ছিল না কোনো কিছুর। হঠাৎ সে ভাবল, যথেষ্ট হয়েছে, এইবার একটা বছর সে আরাম করবে। তারপর ভাবা যাবে ভবিষ্যৎ কী হবে।

কিন্তু যে-রাতে সে এই সিদ্ধান্তে এলে, সেই রাতেই এসে হাজির হল যমদূত, চলো সরকার তোমার সময় হয়ে গেছে। লোকটি বললে, সে কি! এখন আমি যাব কী! এই তো সবে একটু গুছিয়ে বসছি। এখনো তো আমার আকাঙ্ক্ষা মেটেনি, আমার যে অনেক ভোগ বাকি। দূত নাছোড়বান্দা। ওসব ধান্দা ছাড়ো, এখন ওঠো। লোকটি বললে, বেশ, তুমি আমাকে তিনটে দিন সময় দাও। আমি তোমাকে একলাখ টাকা দিচ্ছি।

যমদূত বললে, ওসব হবে না ভাই, তুমি চলো, তোমার সময় হয়ে গেছে। যমদূত জীবনের দড়ি ধরে মারলে টান।

লোকটি বললে, করো কী! আচ্ছা বেশ, তুমি চলো, তোমার সময় হয়ে গেছে। যমদূত জীবনের দড়ি ধরে মারলে টান।

লোকটি বললে, করো কী! আচ্ছা বেশ, তুমি আমাকে দুটো দিন সময় দাও ভাই, আমি তোমাকে দু-লাখ টাকা দেবো।

যমদূত বললে, তোমার সব টাকা দিলেও নিস্তার নেই, যেতে তোমাকে হবেই।

লোকটি হতাশ হয়ে বললে, বেশ, তুমি আমাকে সেইটুকু সময় দাও, যে-সময়ে আমি দুটো লাইন লিখে যেতে পারি। যতদূত বললে, বেশ, তুমি যা লিখতে চাও লেখো, আমি দাঁড়াচ্ছি। লোকটি তখন নিজের রক্ত দিয়ে লিখলে হে মানব! তোমার নিজের জীবনকে ব্যবহার করো। আমি তিনলাখ টাকাতেও এক ঘণ্টা সময় কিনতে পারলুম না। মৃত্যু গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা সাবধান হও, সময়ের মূল্য বুঝতে শেখো।

সেই মূল্যটাই তো এই মাকাল ফল বোঝেনি। এই বয়সে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, পৃথিবীটা কী বুঝলে হে! উত্তরটা আমার পক্ষে দেওয়া সহজ হবে, আজ্ঞে, এটি একটি তেজী ঘোড়া, টগবগ করে অনবরতই ছুটছে, তোমাকে বসে থাকার কসরত করতে হবে। পথ খুব দুর্গম, খানাখন্দে ভরা, ছিটকে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। এই সওয়ার হয়ে থাকাটাই তোমার কায়দা। সেই কায়দাটা শেখাই হল শিক্ষা।

তোমাকে কী হতে হবে? সবার আগে হতে হবে স্বার্থপর। নিজেরটা বোঝো, অন্যেরটা তোমার বোঝার দরকার নেই। তারপর হতে হবে বিষয়ী। ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার। দয়া মায়া মমতা ওসব কেতাবের কথা। আসল কথা হল, স্রেফ নিজের কোলে ঝোল টানো। জায়গাজমি কেনো, বাড়ি করো, রোজগার বাড়াও। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ভুলে যাও। নিজের ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াও। ভালমন্দ খাইয়ে মোটাসোটা করো।

বড়োলোক হওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হল খরচ না করা। ক্ষমতাশালী লোকের সঙ্গে দোস্তি বাড়াও। তাদের ততদিনই তোষামোদ করো, যতদিন তাদের কাছ থেকে কিছু পাবার আশা আছে। সম্পর্কটা কেমন হবে? না, শালপাতায় সন্দেশ। সন্দেশটা তুলে খেয়ে ফেল, পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দাও। মানুষকে বড়ো বড়ো উপদেশ দাও, নিজে তার উলটোটা কর। এ যুগ হল, ভন্ড আর ভন্ডামির। চতুর্দিকে লন্ডভন্ড অবস্থা। এক নম্বর আর কিছু নেই, দু-নম্বরের খেলা। যে যত বড়ো অভিনেতা, সে তত সফল। মানুষের মৃত্যুতে মানুষের চোখে আর জল আসে না। যদি প্রশ্ন করা হয়, কি রে, বাবার মৃত্যুতে চোখে একটু জল নেই! বললে সে আপনি বুঝবেন না, শোকে পাথর হয়ে গেছে। এই পাথুরে শোক, তরল শোকের চেয়ে মারাত্মক।

ছেলে যাত্রার হিরো। সেই হিরো হল ভিলেন হিরো। আমাদের বাড়ির সাতটা বাড়ি আগে থাকে। মাথায় ঝুমকো চুল। ইয়া চেহারা। বাবা মারা গেছেন। বয়েস হয়েছিল। আমরা সবাই গেছি। মেয়েরা অল্পস্বল্প কাঁদার চেষ্টা করছেন। ছেলে হিরোর মতো দাঁড়িয়ে। তার নিজের ইয়ারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। বিষয়, দুর্গাপুরে বায়না আছে, সেটা তো ক্যানসেল করা যাবে না, পরের দিন পান্ডুয়া। এক ইয়ার বলছে, ক্যানসেল করবে কেন? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, কাজ ধর্ম। আগে কাজ পরে শোক। তোমার তো ভয়ের কিছু নেই। আজকাল ইলেকট্রিকে এক ঘণ্টায় সব শেষ। দেশ কত অ্যাডভানস করেছে।

পাশে আমারই বন্ধু পরেশ দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁ রে! অভিনয়ের কান্নাও তো একটু কাঁদতে পারে, তাহলে ব্যাপারটা একটু মানানসই হত না!

সে বললে, কাঁদলে হাসি নষ্ট হয়ে যাবে।

সে আবার কী?

যাত্রায় সবেতেই হাসতে হয়। আমার বাবা আজ সাতটায় মারা গেছে, হা হা হা। ও তো কাঁদতে গেলেই গলা ভারী করে হেসে উঠবে। তার চেয়ে যেমন আছে তেমন থাক। সেই ছেলে অশৌচ পালন তো করলেই না। শ্রাদ্ধে মাথাও কামাল না। বললে, গন্ধর্ব মতে শ্রাদ্ধ হল। জীবনে শুনিনি। শাস্ত্রে আছে, হিরোদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে না। ক্ষৌরকারকে দক্ষিণা ধরে দিলেই হল। তবে হ্যাঁ, শ্রাদ্ধে প্রচুর লোক খাইয়েছিল। এলাহি ব্যাপার। কীর্তন দিয়েছিল নামকরা কীর্তনীয়ার। সব যাত্রার দলের নায়ক নায়িকা, অধিকারীরা এসেছিলেন। মনে হচ্ছিল টন টন মাংস। সব থলথলে শরীর। চোখের তলায় সব অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত থলি। হরেক সুগন্ধী-মাখা স্বপ্নলোকের জীবসমূহ। বাড়ির সামনে পুলিশ পোস্টিং। একেই বলে ছেলের মতো ছেলে। পাড়ার একেবারে ফিলকেয়ার লাগিয়ে গিয়েছে গো। কে কবে এমন দেখেছে! কোন বাপের কী ছেলে! ওই জন্যেই শাস্ত্রে বলে, বাপের চেয়ে ছেলে বড়ো। গাছের চেয়ে ডিম বড়ো! সে আবার কী! বললে, ওই হল। গাছের ফল, হাঁসের ডিম। আমগাছ, আমগাছ করে কেউ লাফায় না, নৃত্য করে আম আম বলে। হাঁসের কোনো খাতির নেই, খাতির তার ডিমের।

সে আবার কী কথা? গাছেরই তো ফল, হাঁসেরই তো ডিম।

সেই কথাটা কেউ মনে রাখে না ভাই! রাখলে পৃথিবীটা তো সুখের হত। কোনো ছেলেই বাপ মাকে মনে রাখে না। যেই নিজের পায়ে দাঁড়াল শুরু হল তার নিজের ধান্দা। প্রবৃত্তিমার্গে বিচরণ। একটা লোক দেখানো ব্যাপার থাকে, যেন কতই ভক্তিশ্রদ্ধা! সমস্ত জিনিসটা খাড়া হয়ে আছে একটা মিথ্যার ওপর। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস নেই বলেই মিথ্যেটাকে সত্য মনে করা।

স্বামী-স্ত্রীর আধুনিক সম্পর্কও তাই। গানের মতো। একজন গাইছে আর একজন বাজাচ্ছে। তালে তাল মেলাতে পারলে তো জোর আসর, নয়তো সব ভেস্তে গেল। ভালবাসা একাট লাগসই কল্পনামাত্র। ভালোবাসা নেই, আছে স্বার্থ।

একটা শেয়াল একটা বলদের পেছন পেছন ঘোরে। বদল যেখানে, শেয়াল সেখানে। বলদ ঘুমোয় তো শেয়ালও তার পাশে শোয়। আবার যেই উঠে চরতে বেরুলো তো, শেয়ালও চলল পেছন পেছন। সবাই ভাবে, আহা কী ভালোবাসা! একেবারে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কেউ বোঝে না শেয়ালের তালটা কী! সে শুধু শেয়ালই জানে! শেয়াল ভাবছে বলদের অন্ডকোষটা কখনো না কখনো খুলে পড়ে যাবে, আর সে খাবে। সব সম্পর্কের মাঝখানে এইরকম একটা প্রত্যাশা ঝুলে আছে। পাওনার আশা না থাকলে সম্পর্ক শিথিল।

তাহলে সুখ কোথায়! আমি কোথায় পাব তারে। আমার মনের মানুষ যে রে! সেই গল্পটা মনে পড়ছে :

একজন মানুষ মোটামুটি বেশ সুখেই ছিল, তেমন কোনো অভাব টভাব ছিল না। তবু তার মনে হল, আরও সুখ চাই। সে একদিন সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে বললে, মহারাজ আমার সবই আছে, বৈষয়িক যা কিছু তার কোনো অভাব নেই আমার; কিন্তু আমার উদ্বেগ আর অস্থিরতা কিছুতেই যাচ্ছে না। বছরের পর বছর চেষ্টা করছি, কেমন করে একটু সুখে একটু আনন্দে থাকা যায়! পৃথিবীটাকে কেমন করে একটু বাগে আনা যায়! অনুগ্রহ করে বলুন, কীভাবে আমার এই অস্থিরতা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা কাটবে।’

সন্ন্যাসী হাসলেন! হেসে বললেন, শোনো, যে জিনিস অনেক মানুষ চেপে রাখে, অনেক মানুষ আবার সেটাকেই প্রকাশ করে পেলে। আবার অনেকে যা বলে ফেলে, আর একজন তা চেপে রাখে। তবে, তোমার এই সমস্যার একটা সমাধান আমি বলে দিচ্ছি, তবে সে-সমাধান খুব সহজ নয়। তোমাকে একটু খাটতে হবে। তুমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়, পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষটিকে খুঁজে বের করে, যে জামাটা সে পরে আছে, সেইটা চেয়ে নিয়ে, নিজে পরে ফেলো।’

লোকটি তখন বেরিয়ে পড়ল সবচেয়ে সুখী মানুষটির অনুসন্ধানে। একের পর এক দেখা হয়, আর জিজ্ঞেস করে, আপনিই কি সবচেয়ে সুখী? তাঁরা প্রত্যেকেই বলেন, হ্যাঁ, আমি সুখী বটে, তবে আমার চেয়েও সুখী একজন আছে।

এক দেশ থেকে আর এক দেশ, সে দেশ থেকে অন্য আর এক দেশ, বছরের পর বছর, লোকটি ঘুরছে। কোথায় সেই সবচেয়ে সুখী মানুষ! এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে, সে একটা বনের ধারে এল। প্রত্যেকেই বললে, এই বনে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লোকটি থাকে।

হঠাৎ কানে এল হাসির শব্দ। জঙ্গলের ভেতর থেকে আসছে সেই শব্দ। লোকটি গাছপালা ভেদ করে ছুটল, সেই হাসির শব্দ লক্ষ্য করে। গাছগালা ক্রমশ কমে আসছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা পরিষ্কার একখন্ড জমি! একটি লোক বসে আছে।

সে জিজ্ঞেস করল, ‘সবাই বলছে, আপনিই না কি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লোক?’

লোকটি বললেন, ‘অবশ্যই। আমার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে আর কে আছে!’

‘তাহলে শুনুন আমার এই নাম অমুক দেশে আমার বাড়ি। এক সন্ন্যাসী বলেছেন, আপনার জামাটা গায়ে দিতে পারলেই আমি আপনার মতো সুখী হতে পারব। অনুগ্রহ করে, আপনার জামাটা আমাকে দিন, বিনিময়ে যা চাইবেন, আমি তা-ই আপনাকে দেবো।

সবচেয়ে সুখী মানুষটি লোকটির অনুরোধ শুনলেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর হাসতে শুরু করলেন। হাসছেন, হাসছেন, সে হাসি আর থামে না।

লোকটি বিরক্ত হয়ে বললে, ‘আপনি কি পাগল! এইরকম একটা দরকারি কথায় হাসছেন?’

‘হয়তো তাই তবে, তুমি যদি কষ্ট করে আমাকে একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে, তাহলে, তাহলে লক্ষ করতে, আমার গায়ে কোনো জামা নেই।’

‘তাহলে আমার উপায়! আমি এখন কী করব!’

‘আর ভয় নেই, এইবার তোমার ব্যামো সেরে যাবে। যা পাওয়া যায় না তার অনুসন্ধানে আর তোমার সময় ও শক্তি নষ্ট হবে না। জীবনে যা পাওয়া পেতে পারে, সেই চেষ্টাই তুমি করবে! আর এখন সেইটা তোমার পক্ষে পাওয়া অনেক সহজ হবে। যেমন ধরো, তুমি একটা নদী লাফিয়ে পার হতে চাও, এখন সেই নদীর চেয়ে আরও বড়ো নদী পার হওয়ার অভ্যাস থাকলে, ওটা কিছুই নয়। একেবারে জল-ভাত।’

কথা শেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি তাঁর পাগড়িটা খুলে ফেললেন। পাগড়ির একটা অংশে তাঁর মুখ চাপা পড়ে ছিল। মুখ দেখে অনুসন্ধানকারী অবাক, আরে! এই তো সেই সন্ন্যাসী, এঁর উপদেশেই তো সে এতকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

লোকটি তখন বললে, ‘মহারাজ। এই কথাটা তো আপনি আমাকে প্রথম দিনেই বলতে পারতেন, তাহলে আমি এমন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতুম না।’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘তখন বললে তুমি বিশ্বাস করতে না। সুখ জিনিসটা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। সুখের কোনো সীমা নেই বৎস! মানুষ কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। সে চির অসুখী।

এই হল সার কথা। জীবনে কখন কোনটাকে যে সুখ ভেবেছি, তার মাথামুন্ডু নেই। যখন ছাত্র, তখন মনে করেছি, পরীক্ষায় ভালো ফল করার মতো সুখ কিছুতে নেই। হল, মোটামুটি একরকম হল, কিন্তু ফার্স্ট তো হতে পারলুম না! সে আনন্দটা ফার্স্ট বয়েরই রয়ে গেল। যাক, সে আর কী করা যাবে! এই ব্যর্থতা রয়ে গেল দীর্ঘশ্বাস হয়ে। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়স্বজনরা বললেন, ‘বালক! হতাশ হওয়ার কী আছে! মানুষের জীবন বিশাল। তুমি স্কুলে যা পারলে না, কলেজে চেষ্টা করো। অনেকের জীবনে এমন ঘটেছে। যতই এগিয়েছে ততই সফল হয়েছে। জীবনের পথ ধরে এগোও, এগোও।’

সেই সময় তাঁরা অবশ্যই ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সেই গল্পটি আমাকে বলেছিলেন। একজন কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে গিয়েছিল। সামনাসামনি যা কিছু ডালপালা পেয়েছিল তাই মাথায় করে বেরিয়ে আসছিল, এমন সময় এক ব্রক্ষ্মচারীর সঙ্গে দেখা। ব্রহ্মচারী বললেন, ‘ওহে, এগিয়ে পড়।’

পরের দিন জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে তার সেই কথাটি মনে পড়ল, ‘এগিয়ে পড়।’ মনে হওয়ামাত্রই কাঠুরে জঙ্গলের গভীরে কিছুটা ঢুকে গেল। কী আশ্চর্য! সেখানে সব চন্দনের গাছ। কাঠুরের তো মহানন্দ! ব্রহ্মচারী তো আচ্ছা কথা বলেছিলেন! হাতে হাতে ফল। সে মহানন্দে গাড়ি গাড়ি চন্দন কাঠ কেটে এনে বিক্রি করে অনেক পয়সা পেলে।

কিছু দিন বাদে আবার সে জঙ্গলে গেছে! সেই চন্দনের বন। মনে পড়ল ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, এগিয়ে যাও! মনে হওয়ামাত্রই সে আরও এগোলো। একটা নদী। সেই নদীর ধারে রুপোর খনি! আর তাকে পায় কে! খনি থেকে রুপো তুলে এনে বিক্রি করে। অনেক পয়সা।

তবে সে রুপোতে আটকে থাকল না। আরো এগুলো, পেয়ে গেল সোনার খনি। সোনাতেই শেষ হল না, আরও এগোলো। দেখে এক জায়গায় পড়ে আছে রাশিকৃত কুবেরের ঐশ্বর্য, হীরে মানিক জহরত।

সংসার ভাই অন্য ধরনের অরণ্য। যত এগোবে ততই আবর্জনা। আমার মতো যে-সব আধবুড়োর সঙ্গে দেখা হয়, জিজ্ঞেস করি, কী পেলে? পরেশ, আশিস, নবকৃষ্ণ, ঘনশ্যাম! ভাই, বয়েসে যা যা পাওয়ার কথা সবই পেয়েছি, একেবারে কড়ায়-গন্ডায়। হার্টের পাম্প তেমন কাজ করছে না। বুকের যেপথে প্রাণবায়ু চলাচল করে, সেই পথে শ্লেষ্মা আসর বসিয়েছে। সারা রাত সানাই বাজে। এ হল মৃত্যুর সানাই। চোখে ছানি আসছে। চুলে পাক ধরেছে। সামনে টাক। গাঁটে গাঁটে বাত। রাতে দু’কদম বেশি খেলে সকালে ঢেঁকুর। সকলেই মনে করতে শুরু করেছে, এ ব্যাটা আবর্জনা।

কেন এই সব পাননি! কৃতী সন্তান, সোনার চাঁদ জামাই!

তারা হাসে। পালটা প্রশ্ন করে, তুমি পেয়েছ?

আমি পাইনি। যুগ জড়িয়ে গেছে। আদর্শ ঢিলে হয়ে গেছে। বার্ধক্য ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই! যতদিন কর্তা ছিলে, তোমার হাঁকডাক সবাই খুব সহ্য করেছিল, এখন অন্য কর্তারা এসে তোমাকে উলটে ফেলে দিয়েছে।

মনে হয়েছিল, একটা চাকরি পেলে খুব সুখ হবে। তারপর মনে হল, বিয়ে করলে। সবই হল, শেষে মহা কলরব, কোলাহল! আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি! প্রেমের চেয়ে ঝগড়া বেশি। সবাই চিৎকার করছে কর্তব্য করো, কর্তব্য করো। খালি খেটে মরো। সংসারে বিশ্রামের অবসর নেই। আলস্য মানে দারিদ্র! আলস্য মানে অন্ধকার।

ব্যাঙ্কের দুটো কাউন্টার, একটায় জমা পড়ে, আর একটায় টাকা তোলে। আরামটা তোলার ঘুলঘুলি। আসছে, চেক ভাঙাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। আমি যেন জলের পাইপ! ঘোরালেই জল চাই। সাফসুতরো করে সাপ্লাই ঠিক রাখো। নয় তো একটাই খেতাব, অকর্মণ্য, অপদার্থ। সকলকে সুখে রাখ, নিজের সুখের সন্ধান কোরো না। তুমি একটা মোমবাতি। জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয়ে যাও। সবাই তোমার কাছে আলো চায়।

সমস্যাটা কোথায়! নিজেকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। আমার বোধহয় বেড়ালের স্বভাব। প্রথমটায় মেও মেও করি, তারপর যখন দেখি, বরাতে কিছু জুটবে না, তখন একপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ি। আমার পাশ দিয়ে জগৎ বয়ে চলে যায় নগর সংগীর্তনের মতো। সেই কীর্তনের আখর হল, চাকরি চাই, উন্নতি চাই, প্রচুর-প্রচুর টাকা চাই, সুন্দরী স্ত্রী চাই, যৌতুক চাই, ভাল একটা ফ্ল্যাট চাই, ছেলে-মেয়ের জন্যে নামি একটা স্কুলে ভরতির ব্যবস্থা চাই, ফ্রিজ চাই, কালার টিভি চাই, ওয়াশিং মেশিন চাই, ফোন চাই, গাড়ি চাই, ক্ষমতা চাই, নাম চাই। নাচতে নাচতে জগৎ চলেছে। ঐকতান : চাই, চাই, চাই আর চাই।

গৃহিনী আর বেড়াল। মাছ কাটছেন, বেড়াল থাবা বাড়াচ্ছে। এক থাপ্পড়। বেড়াল দূরে সরে গিয়ে মুখ গোঁজ করে বসল। ভাগ্য হল মাছকাটা গৃহিনী। প্রত্যাশা হল বেড়াল। এই সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে গেলে মানুষ নিজের কামনা-বাসনাকে কিছুটা সংযত করতে পারে। কিন্তু ক-জন বোঝে! লোভ এক বড় শত্রু। একটা গল্প মনে পড়েছে :

একটা লোক একদিন রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। সঙ্গে চলেছে একটা ভেড়া। ভেড়ার গলায় একটা দড়ি বাঁধা। দড়ির প্রান্ত লোকটির হাতে। লোকটি আগে আগে, ভেড়াটা পিছু পিছু। লোকটি বিভোর হয়ে হেঁটে চলেছে। একটা তৎপর চোর করলে কি, নি:শব্দে পেছন দিক থেকে এসে, ভেড়ার গলার দড়িটা কেটে, ভেড়াটাকে নিয়ে পালাল। লোকটির হাতের দড়িটা ঝুলে পড়তেই তার টনক নড়ল, পেছনে তাকিয়ে দেখে ভেড়াটা নেই। এদিক দৌড়োয়, ওদিক দৌড়োয়, কোথায় সেই চোর, কোথায় তার ভেড়া।

খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় এসে দেখলে পাতকুয়ো। কুয়োর ধারে একটা লোক। মুখ দেখে মনে হল, লোকটার একটা কিছু হয়েছে। কোনো বিপদ-আপদ। লোকটা আসলে কিন্তু সেই ভেড়া চোর। ভেড়ার মালিক তা জানে না।

মালিক জিজ্ঞেস করলে, ‘কী হয়েছে তোমার? এরকম মুখ করে দাঁড়িয়ে কেন?’

লোকটি বললে, ‘আর বলো কেন ভাই! একটা কেলেঙ্কারি কান্ড করে ফেলেছি।’

‘কী কান্ড ভাই?’

‘কুয়োয় কতটা জল দেখার জন্যে যেই ঝুঁকেছি, বুক-পকেটে ছিল টাকার ব্যাগ, টপাং করে জলে পড়ে গেল।’

‘কত টাকা ছিল?’

‘কড়কড়ে পাঁচ-শো। তা তুমি যদি ভাই কুয়োয় নেমে ব্যাগটা উদ্ধার করতে পার, তাহলে সেই টাকা থেকে তোমাকে এক-শো টাকা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবো।’

ভেড়ার মালিক ভাবলে, তা মন্দ কি। ভেড়াটা তো গেছেই, এখন নগদ এক-শোটা টাকা পেলে কিছুটা পুষিয়ে যাবে। আহা। একেই বলে ভাগ্য। একটা দরজা বন্ধ হলে, সঙ্গেসঙ্গে আরও এক-শোটা দরজা খুলে যেতে পারে। এই যে সুযোগ আমার সামনে এসেছে, এ আমার ওই হারানো ভেড়ার চেয়ে দশগুণ দামি।

যাঁহা ভাবা তাঁহা কাজ। কুয়োর ধারে জামাকাপড় সব খুলে রেখে লোকটি ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর সেই চোর! সে এইবার সমস্ত জামাকাপড় নিয়ে চম্পট দিলে। বুঝেছ ভায়া! এই হল গিয়ে তোমার পৃথিবী। এখানে একদল কেবল হারাতে আসে, হারতে আসে। এই যে সাতাশ নম্বর বাড়িটা! মালিক ছিলেন হরিচরণ বাবু। বেঁটেখাটো স্বাস্থ্যবান মানুষ। মাথাজোড়া টাক। সেকালের সওদাগরি অফিসে চাকরি করতেন। চক মেলানো বাড়ি। দোল দুর্গোৎসব সবই হত। বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। কোথা থেকে এক স্যাঙাত এল। নাম তার পঞ্চানন। সে ধরালো রেস খেলার নেশা। হরিচরণ কোনো শনিবার হারেন, কোনো শনিবার জেতেন। তাঁর জগতটা হয়ে গেল ঘোড়াময়। নাম হল ঘোড়াচরণ। শয়তে স্বপনে জাগরণে ঘোড়া।

অদূরেই ওঁত পেতে বসেছিল অক্ষয়। ব্যবসাদার মানুষ। তিনখানা দোকান তার। মুদিখানা, মিষ্টির দোকান। দিন দিন ব্যবসা তার জমে উঠছে। মিষ্টিখোর বাঙালি, বৈরো বাঙালি তার কাছে মাথা মুড়োচ্ছে। মুদিখানায় সব খাতার বাবু। দশ টাকার জিনিস নেয় তো লেখা হয় পনেরো টাকা। মাসকাবারি খদ্দের সব। অক্ষয় পড়তি মধ্যবিত্তদের মাথা কামাচ্ছে। ক্রমশই ফুলছে ঝাড়ে বংশে। মধ্যবিত্তদের একটাই উত্তরাধিকার : অহঙ্কার আর আলস্য।

হরিচরণ যত না জেতেন তার চেয়ে বেশি হারেন। বন্ধু সেজে এগিয়ে এল অক্ষয়। অক্ষয় হল বাঘ, পঞ্চানন ফেউ। অক্ষয় হাওলাত দিতে শুরু করল। দিতে দিতে টাকার অঙ্কটা বেশ মোটাই হল। হরিচরণের বাড়ি জমি সব চলে গেল। হরিচরণও চলে গেলেন। পরিবার পথে বসল। সাতাশ নম্বরের মালিক এখন অক্ষয়কুমার খাঁড়া। কী তার বোলবোলা! অপদার্থ আমরা। হিংসা ছাড়া আর তো আমাদের কিছু করার নেই। অহঙ্কারের পাত মোড়া ঠুনকো আদর্শই আমাদের সম্বল। কে কবে বলে গিয়েছিলেন, প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং, সেইটার আড়ালে আমাদের যত অক্ষমতা চাপা দিয়ে মনের আনন্দে দিন কাটাচ্ছি অদ্ভুত এক আত্মসন্তোষে।

আমাদের কিছু বড়োলোক আত্মীয়স্বজন আছে। লাল, নীল গাড়ি। কালেভদ্রে দেখাসাক্ষাৎ তো হয়ই। সে যে কী যন্ত্রণা। বড়োলোকরা আজকাল খুব দেখনাই বাড়ি করে। আর্চ, ব্যালকনি, ঝোলা সিঁড়ি, মোজাইক মেঝে, স্বপনপুরীর দরজা। সবই এতটাই ছিমছাম, বসবাসের অযোগ্য। সেই সব বাড়িতে ঘণ্টাখানেক থাকাটাই অস্বস্তির, তার ওপর বড়ো বড়ো চালের কথা। পুরুষদের যদিও বা সহ্য করা যায়, মেয়েরা অসহ্য। চুল কেটে ছোটো। আধুনিক পোশাকের তেমন আব্রু নেই। কৃত্রিম ছবি-আঁকা ভুরু। নাক উঁচু। মেপে মেপে কথা। তাদের ছেলে-মেয়েরা আরও সাঙ্ঘাতিক। ঢোল কোম্পানি জামাপ্যান্ট। পায়ে ভোঁদকা জুতো। এমন সব বিষয়ে কথা বলে, যার সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনো যোগ নেই। ইংরিজি গান শোনে, ইংরিজি নভেল পড়ে। চাইনিজ খাবার খায়। মেয়েদের এক গাদা ছেলে বন্ধু, ছেলেদের মেয়েবন্ধু। থেকে থেকে ফোন আসছে, থেকে থেকে ফোন করছে। খোলটা বাঙালির, ভাবটা আমেরিকার। এদের পাশে নিজেকে ফেললে চুপসে যেতে হয়। মনে হয় কেন জন্মালুম! এই অচল-অধম জীবনের দাম কী!

এই কথাটা আমার পরিবারও বলেন, একটু ঘুরিয়ে, ‘সারাটা জীবন করলে কী!’

আমি যা বলতে চাই, তা আর সাহস করে বলা হয় না—‘তোমরাই বা কী করলে?’ আমি করব, আর তেনারা শুধু ফল ভোগ করবেন। আমি ভেজানো চিঁড়ে, দই কলা কদমা দিয়ে ফলার চটকাব, আর তাঁরা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন। আদমের ছেলে ইব্রাহিমের গল্পটা মনে পড়ছে আমার। সাল আর ইব্রাহিম একসঙ্গে চলেছেন। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। দূরের পথ। সাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ইব্রাহিম তাঁর সেবা করছেন। প্রথমে যা কিছু সঙ্গে ছিল, সব বিক্রি করে রুগির পরিচর্যা করলেন। সাল একটু সুস্থ হয়ে একদিন বললেন, এইবার আমার ভালো ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। ইব্রাহিমের কাছে টাকাপয়সা তখন আর কিছুই নেই। তখন করে কী! শেষ সম্বল গাধাটাকেই বিক্রি করে সাল যে সব খাবার খেতে চাইছেন, কিনে আনলেন।

সাল ধীরে ধীরে আরোগ্য লাভ করছেন, একদিন হঠাৎ বললেন, সেই গাধাটা কোথায়, আমি যে তার পিঠে চেপে একটু বেড়াতে চাই। যেখানে যাব বলে বেরিয়েছি, সেখানেই এবার যাই।

ইব্রাহিম বললেন, আমিই সেই গাধা। আপনি আমার কাঁধে চেপে বসুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি। বাকি পথটা সাল ইব্রাহিমের কাঁধে চেপে চললেন।

সংসারে আমিও ইব্রাহিমের মতো এক গাধা। সব আদমপুত্রেরই এক-এক ভাগ্য। সংসার বইতে বইতেই জীবন শেষ। অথচ কেমন নেচে নেচে সংসারে ঢুকেছিলুম। যৌবন কালটা ভয়ঙ্কর রকমের বিপজ্জনক। দু-চারটে নভেল আর গোটাকতক সিনেমা দেখে ধারণা হল, প্রেম ছাড়া জীবন অন্ধকার। আর সমবয়সী কিছু ইয়ার বন্ধু নাচিয়ে দিলে। পৃথিবীতে নাচিয়ে দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। কেউ একবারও বললে না ভায়া, সংসার হল আমড়া, আঁটি আর চামড়া! সারবস্তু কিছুই নেই ভায়া। প্রলুব্ধ নাই বা হলে।

যতটা রোজগার হলে সংসার মোটামুটি চলতে পারে, তা হওয়ার আগেই টোপর মাথায় পিঁড়েতে চেপে বসলুম। বাংলার বাজারে মেয়ের অভাব নেই, কেউ একবার বিয়ে করব বললেই হল। মেয়ের বাবার গুটিকতক প্রশ্ন, ছেলে নড়তে চড়তে পারে তো?

হ্যাঁ, তা পারে।

হাবা কালা বোবা নয় তো?

না না।

নেশা ভাঙ করে?

মনে হয় না।

আর যদিই বা করে, পুরুষ মানুষ করতেই পারে, সে একটু বেশি রাতে করুক।

রেস খেলে?

সেরকম কিছু শুনিনি।

রোজগার পত্তর?

মোটামুটি। পরে নিশ্চয় বাড়বে।

আহা। দু-বেলা দুটো খেতে পেলেই হল, তারপর তো স্ত্রী-ভাগ্যে ধন, শাস্ত্রে আছে। আর দেখে কে! বেনারসী-মোড়া বউ এসে গেল। সঙ্গে এল কিছু আবর্জনা। খুব পালিশমারা আম না জাম কাঠের একটা খাট। কেরোসিন কাঠের একটা সাজের টেবিল। আয়নাটায় ঢেউ খেলছে। মুখ দেখলে মনে হবে, করোগেটেড টিন কেটে বিধাতা মুখটা তৈরি করেছিলেন। একটা টিনের তোরঙ্গ, তাতে গুচ্ছের খেলো শাড়ি। একগাদা সাজের জিনিস যেমন তেল, পাউডার, স্নো, চিরুনি, ফিতে, কাঁটা। কিছু দু-আড়াই টাকা দামের গল্পের বই। নড়বড়ে একটা আলনা।

সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। যেমন পাত্র, তার তেমন পাওনা। এ তো রাজপুত্তুর নয় যে, অর্ধেক রাজত্ব নিয়ে রাজকন্যে আসবে সোনার পালকি চেপে। ছ-টা মাস একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। সংসার। নতুন মুখ, নতুন স্বভাব, মন, কন্ঠস্বর। নতুন গন্ধ, নতুন বর্ণ, নতুন জীবনধারা। তারপর! সব বিবর্ণ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। লোক, লৌকিকতা। আত্মীয়- স্বজনের উৎপাত। নতুন জীবনের আগমন। ট্যাঁ, ভ্যাঁ, চ্যাঁ। নিত্য অসুখ, নিত্য ডাক্তার। মাথার চুল খাড়া। শেষে ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। বললেই তো হল না। সংসার হল বটের আঠা। যতই ছাড়াতে চাইবে, ততই জড়িয়ে ধরবে। শেষে সেই গল্প। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন:

‘জাল ফেলা হয়েছে পুকুরে। দু-চারটে মাছ এমন সেয়ানা যে কখনো জালে পড়ে না—এরা নিত্য জীবের উপমাস্থল। কিন্তু অনেক মাছই জালে পড়ে। এদের মধ্যে কতকগুলি পালাবার চেষ্টা করে। এরা মুমুক্ষুজীবের উপমাস্থল। কিন্তু সব মাছই পালাতে পারে না। দু-চারটে ধপাঙ ধপাঙ করে জাল থেকে পালিয়ে যায়, তখন জেলেরা বলে, ওই একটা মস্ত মাছ পালিয়ে গেল। কিন্তু যারা জালে পড়েছে, অধিকাংশই পালাতেও পারে না; আর পালাবার চেষ্টাও করে না। বরং জাল মুখে করে, পুকুরের পাঁকের ভিতর গিয়ে চুপ করে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে—মনে করে, আর কোনো ভয় নেই, আমরা বেশ আছি। কিন্তু জানে না যে, জেলে হড় হড় করে টেনে আড়ায় তুলবে। এরাই বদ্ধজীবের উপমাস্থল।’

সেই সংসারের পাঁকে জাল মুখে নিয়ে পড়ে আছি! ভাবছি, এইতেই আমার যতেক সুখ। এই ভয় এই আতঙ্ক। আজ গেলে কাল আমার কী হবে। একটাই হবে, আমার জ্ঞান বাড়বে। গল্পটা এইরকম, একদা এক গ্রামে এক কাঠুরিয়া ছিল। রোজই সে গ্রামের উত্তরদিকে এক জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেত। দিনের শেষে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরে এসে দোরে বিক্রি করত। এই ছিল তার জীবিকা। দশ বারো বছর ধরে সে এইভাবে কষ্টেসৃষ্টে তার সংসার চালাচ্ছে। একদিন তার মনে হল, আর পারা যায় না। দিনের পর দিন এই একই কষ্ট। এর জন্যে দায়ী সেই প্রথম পুরুষ আদম। সমস্ত মানবের যিনি আদি পিতা। মানুষের সমস্ত দুর্ভাগ্যের তিনিই আদি কারণ। কাঠুরিয়া সিদ্ধান্ত করল, আজ জঙ্গলে গিয়ে সমস্ত কাঠকুটো এক জায়গায় জড় করব, তারপর আদমের হাড় কখানা খুঁজে বের করে আগুন ধরিয়ে দেবো।

কাঠুরিয়া জঙ্গলে গিয়ে, কাঠ সংগ্রহ করে স্তূপাকার করছে। এমন সময় ভগবান এক দেবদূতকে পাঠালেন। দেবদূত জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে তুমি কী করছ ভাই। এত কাঠ!’

‘আমি কাঠ জোগাড় করছি, আমাদের আদিপিতা আদমের হাড় কখানা জ্বালিয়ে দেবো, তাঁর জন্যেই মানুষের আজ এই এত কষ্ট।’

দেবদূত বললেন, ‘আচ্ছা ধর, আমি যদি এমন করে দিই, তোমাকে আর কোনো পরিশ্রমই করতে হবে না, তাহলে কেমন হয়!’

‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়, আমি তাকে অজস্র ধন্যবাদ দেবো।’

‘তাহলে আমি তোমাকে এখুনি একটা মনোরম উদ্যানে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে তুমি খাবে-দাবে আর মনের সুখে ঘুরে বেড়াবে। কেবল একটাই শর্ত, তুমি সেখানে যা দেখবে, দেখেই যাবে, কোনো প্রশ্ন করা চলবে না।’

‘বেশ তাই হবে।’

দেবদূত দু’হাতে তালি বাজালেন, কাঠুরিয়া সঙ্গেসঙ্গে চলে গেল স্বর্গোদ্যানে। সেখানে যেমন হয়, ফলে ফুলে ভরা, চিরবসন্ত। তিনটে-চারটে দিন কাঠুরিয়ার বেশ মনের আনন্দেই কাটল। পঞ্চম দিনে দেখে কি, একটা লোক, তার হাতে একটা কুড়ুল। লোকটি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরছে আর মরা ডালগুলো বাদ দিয়ে সবুজ পাতাওয়ালা টাটকা ডালগুলো কেটে ফেলছে। কাঠুরিয়া এই কান্ড দেখে মনে মনে ভাবছে, এ কী কান্ড! আর তো পারা যায় না। যদিও প্রশ্ন করা বারণ, তবুও যে জানতে ইচ্ছে করছে। এই পাগলামির কী মানে! ‘আরে মশাই, এটা কী হচ্ছে! কাটতে হলে, মরা ডালগুলো কাটুন, কচিকাঁচা ডালগুলো কাটছেন কেন?’

লোকটি হেসে বললে, ‘কতদিন আসা হয়েছে এখানে?’

‘এই তিন চার দিন।’

বলামাত্রই কাঠুরিয়া দেখল সে আর স্বর্গোদ্যানে নেই। সেই জঙ্গল, ভাঙা কাঠকুটো ডালপালা, তার সেই কুঠার। কাঠুরিয়া বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল।

দেবদূত এসে বললে, ‘তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলুম, দেখবে কিন্তু প্রশ্ন করবে না।’

‘আমি কথা দিচ্ছি প্রভু, আর এ ভুল করব না, আমাকে ফিরিয়ে দিন।’

দেবদূত আবার তালি বাজাতেই কাঠুরিয়া ফিরে গেল স্বর্গোদ্যানে। তিন চার দিন সুখেই কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন দেখে কী, এক থুত্থুড়ে বুড়ো একটা হরিণীর পেছনে তাড়া করেছে। হরিণী ছুটছে বিদ্যুতের বেগে আর বৃদ্ধ অনেক চেষ্টায় একপা হয়তো এগোতে পারছে।

এ আবার কী! যাকে ধরা যাবে না, তাকে ধরার জন্যে বুড়োটা গলদঘর্ম হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নটা না করে থাকি কী করে! এই পাগলকে তো সমঝানো দরকার। কাঠুরিয়া প্রতিজ্ঞা ভুলে প্রশ্ন করলে, ‘মশাই কেন ছুটছেন, পারবেন ওকে ধরতে?’

বৃদ্ধ বললে, ‘ক’দিন এসেছ এখানে?’

কাঠুরিয়াকে উত্তর আর দিতে হল না, আবার পতন। সেই জঙ্গল, সেই কাঠের তাড়া। কাঠুরিয়া আবার বুক চাপড়াতে লাগল! দেবদূত এসে বললে, ‘কী হল আবার?’

‘আবার সেই ভুল করে ফেলেছি। আমি কথা দিচ্ছি, এ ভুল আর করব না প্রভু।’

‘দেখা যাক, বারবার তিনবার।’

দেবদূত তালি বাজাতেই কাঠুরিয়া আবার স্বর্গে। এইবার সে খুব সাবধান। যাই দেখুক প্রশ্ন আর করবে না। তিন-চার দিন গেল। আবার এক ঘটনা। এক জায়গায় ভারী একটা জাঁতা পড়ে আছে আর চার-পাঁচ জন লোক ধরাধরি করে সেটাকে তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সবাই একদিকটা ধরে তোলার চেষ্টা করছে, ফলে হচ্ছে কী, এদিক থেকে উঠে ওদিকে পড়ে যাচ্ছে ধপাস করে।

কাঠুরিয়া মনে মনে হাসছে, এরা কী কিছুই জানে না, একেবারেই গাধা! এদের কিছু না বলে কেমন করে থাকা যায়! বোকার দল মিছি মিছি খেটে মরছে। ‘আরে ভাই, জাঁতাটাকে যদি তুলতেই চাও, তবে সবাই মিলে চারপাশ থেকে ধরো।’

লোকগুলি বললে, ‘কদিন এসেছ এখানে?’

আর সঙ্গেসঙ্গে কাঠুরিয়া দেখলে সে আর স্বর্গে নেই, ফিরে এসেছে জঙ্গলে, সেই কাঠের গাদার সামনে। আবার কান্নাকাটি।

দেবদূত এসে বললে, ‘শোনো বাপু, আর হবে না। তোমাদের পিতা আদম মাত্র একটি পাপের জন্যে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, আর তোমার পাপের পর পাপ, তারপরেও পাপ। তোমার আর কোনো উপায় নেই। যতদিন না মরছ, এই কাঠ কেটেই তোমাকে খেতে হবে।’

আমিও সেই কাঠুরিয়া, জগৎকারণ বোঝার চেষ্টা করেও বুঝি না। বিধাতাকে না মেনে প্রশ্ন করি, কেন এমন করছেন। ওই যিনি কাঁচা ডাল কাটছিলেন, তিনি তো ঈশ্বর। কত বৃদ্ধ, মৃতপ্রায় মানুষ বেঁচে থাকে, আর ঝরে যায় টাটকা সবুজ প্রাণ। কার যে কখন দিন শেষ হয়, কেউ কি বলতে পারে!

ওই যে বৃদ্ধ, বিদ্যুৎগতি হরিণীর পেছনে ছুটছে, ও তো মানুষের আদি স্বভাব, কামনা বাসনা। যা আয়ত্তের বাইরে তার পেছনে ছোটাটাই মানুষের ধর্ম! আর যারা ওই জাঁতাটা তোলার চেষ্টা করছিল! ওরা মানুষের নিয়তি মানুষের সভ্যতার নিয়তি। উঠবে আবার পড়বে, পড়বে আবার উঠবে। অনন্তকাল এই খেলাই চলবে।

এই খেলারই এক খেলোয়াড় আমি। জীবন মানেই এক দীর্ঘ স্বপ্ন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন :

সকলেই ঈশ্বরাধীন। তাঁরই লীলা। তিনি নানা জিনিস করেছেন। ছোটো, বড়ো, বলবান, দুর্বল, ভালো, মন্দ। ভালো লোক, মন্দ-লোক। এ-সব তাঁর মায়া, খেলা। এই দেখো না, বাগানের সব গাছ কিছু সমান হয় না।

যতক্ষণ ঈশ্বরকে লাভ না হয়, ততক্ষণ মনে হয় আমরা স্বাধীন। এ ভ্রম তিনিই রেখে দেন, তা না হলে পাপের বৃদ্ধি হত। পাপের শাস্তি হত না।

যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁর ভাব কি জান? আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর তুমি ঘরণী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও, তেমনি চলি।

সে কেমন বিশ্বাস! না, এইরকম : এক জায়গায় একটি মঠ ছিল। মঠের সাধুরা রোজ মাধুকরী করতে যায়। একদিন একটি সাধু ভিক্ষা করতে করতে দেখে যে, একটি জমিদার একটি লোককে ভারি মারছে। সাধুটি বড়ো দয়ালু; সে মাঝে পড়ে জমিদারকে মারতে বারণ করলে। জমিদার তখন ভারি রেগে রয়েছে, সে সমস্ত কোপটা সাধুটির গায়ে ঝাড়লে। এমন প্রহার করলে যে, সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল। কেউ গিয়ে মঠে খবর দিলে, তোমাদের একজন সাধুকে জমিদার ভারি মেরেছে। মঠের সাধুরা দৌড়ে এসে দেখে, সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। তখন তারা পাঁচজনে ধরাধরি করে তাকে মঠের ভেতর নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে শোয়ালে। সাধু অজ্ঞান, চারিদিকে মঠের লোক ঘিরে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। কেউ কেউ বাতাস করছে। একজন বললে, মুখে একটু দুধ দিয়ে দেখা যাক। মুখে দুধ দিতে সাধুর চৈতন্য হল। চোখ মেলে দেখতে লাগল। একজন বললে, ‘ওহে দেখি জ্ঞান হয়েছে কিনা? লোক চিনতে পারছে কিনা? তখন সে সাধুকে খুব চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘মহারাজ। তোমাকে কে দুধ খাওয়াচ্ছে?’ সাধু আস্তে আস্তে বলছে, ‘ভাই! যিনি আমাকে মেরেছিলেন, তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।’

সুখ, দুঃখ, বঞ্চনা, গঞ্জনা, সবই সেই এক হাত থেকে আসছে।

While mankind remains mere baggage in the world
It will be swept along, as in a boat, asleep.
What can they see in sleep?
What real merit or punishment can there be?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *