স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন মাত্র
জঙ্গল থেকে বেরুতেই থ মেরে দাঁড়াতে হল ওদের। বন এত নিবিড়, আর হায়েনা শেয়ালের চলাচলের যে-শুঁড়ি পথ ধরে তারা পায়ে-পায়ে চলে এসেছে এতক্ষণ ভারবাহী খচ্চরটা সমেত, তা এমনি আঁকাবাঁকা, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হোরেস বা হ্যামিল্টন কেউই বুঝতে পারেনি যে, আর কয়েক ফুট দূরেই এত বড়ো একটা ধারণাতীত চমক প্রতীক্ষায় আছে তাঁদের।
মন্দির? তা ছাড়া আর কী হতে পারে ওটা?
কিন্তু মন্দির কি এত বড়ো হয়? বোরোবুদুর তারা দেখেনি, বইয়ে তার বিবরণ যা পড়েছে, তার থেকে তো একে খাটো মনে করা চলছে না কোনো মতেই! একটা মন্দির না-বলে মন্দিরমালাই একে বলা উচিত, অথবা মন্দিরনগরী। চূড়ার পরে চূড়া মাথা তুলেছে আকাশে, নীচের সৌধশ্রেণি ভগ্ন জীর্ণ হলেও এক অখণ্ড বিরাটের স্পষ্ট আভাস তা থেকে প্রথম দৃষ্টিতেই পাওয়া যায়।
জঙ্গলটা হঠাৎ শেষ হয়েছে এখানে। মহামহীরুহদের পল্টন মার্চ করে আসতে আসতে হঠাৎ যেন কোন অদৃশ্য ক্যাপ্টেনের আদেশ শুনতে পেয়েছে ‘হল্ট’, আর দাঁড়িয়ে পড়েছে সরল রেখায়, পুনরাদেশের জন্য কান খাড়া করে।
সেই সরল রেখার পরে অন্তত আধ মাইল চওড়া আধ মাইল লম্বা একটা ফাঁকা মাঠ, তাতে দূরে দূরে বিচ্ছিন্নভাবে এক-একটা বড়ো গাছ না-আছে তা নয়, কিন্তু আসলে মাঠটা বেঁটে খাটো ঝোপঝাড় দিয়েই ভরা। কাঁটাঝোপও যেমন আছে, তেমনই আছে সেখানে ফুলে ফুলে সমাচ্ছন্ন লতাবিতানও। ওরা আশ্বস্ত হল, পথ বলে কিছু না থাকলেও ও-মাঠে চলাচলের জায়গা বেশ প্রশস্তই রয়েছে।
‘বাইবেলের সেই গল্প মনে পড়ছে রে!’ বলল জিমি। জিমি হোরেস। ‘সেই যে কে গাধার খোঁজে বেরিয়ে রাজ্য পেয়ে গিয়েছিল।’
‘আমরা তো কিছুই খুঁজতে বেরুইনি!’ জবাব দিল হ্যারি হ্যামিলটন, ‘স্রেফ দেখতে বেরিয়েছি মেক্সিকোর মহারণ্য। ইতিহাসের দেবতা আমাদের জন্য যদি পুমা জাগুয়ার র্যাটল স্নেকের সঙ্গে বিধ্বস্ত মন্দির বা নগরীও মজুত রেখে থাকেন সেখানে। দেখব সে-সবও। আনন্দ করেই দেখব। দার্শনিকের মতো নির্লিপ্ত রাখ মনটা। বিলুপ্ত আজটেকরা যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় আমাদের চেয়ে বড়ো ছিল, সেটা চট করে স্বীকার করা বসো না।’
‘শয়তানকেও তার প্রাপ্য সম্মানটা দিতে হবে তো!’ বিলুপ্ত আজটেক রাজাদের পক্ষে ওকালতি করবার জন্য রুখে দাঁড়াল জিমি।
‘প্রাপ্য ভর্ৎসনাটাও ওইসঙ্গে। এই বিরাট মন্দিরনগরী না-গড়ে যদি কামান বন্দুক গড়ত অভাগারা, স্পেনের হার্মাদ কোর্টেজ পারত না তাদের ধ্বংস করতে। কিন্তু প্রোগ্রাম কী? বেলা দুপুর? লাঞ্চটা সেরে নেওয়া দরকার। এখানে জঙ্গলের ছায়া এখনও পাচ্ছি। এগিয়ে গেলে আর তা পাব না। তবে হ্যাঁ, ওই বড়ো বড়ো গাছগুলোর কোনো একটা পর্যন্ত এগিয়ে যাই যদি—’
‘যেতেই হবে। ওই যে বড়ো গাছটা আগাগোড়া হলদে ফুলে অঙ্গসজ্জা করে দাঁড়িয়ে আছে, পাঁচ-শো বছর আগেকার সোনায়-মোড়া কোনো আজটেক রাজার মতো, চল ওর আশ্রয়েই গিয়ে দাঁড়ানো যাক। ওখান থেকে, খেতে খেতেই মন্দির পর্যবেক্ষণ করতে পারব, বেশ স্পষ্টভাবেই। এখানে দেখছ তো, বসে পড়লে আর নজর চলছে না এই ঝোপগুলোর জন্য।’
অতএব এগিয়েই চলল দুই বন্ধু। প্রথমেই আশ্চর্য হয়ে দেখল, জঙ্গলের মাটি ছিল কালো, আঠালো, অথচ জঙ্গল থেকে দুই পা এগিয়ে আসতেই মাঠের মাটি একদম সাদা এবং বেলে। এই বেলে মাটির জন্যেই কি জঙ্গলের অগ্রগতি রোধ হয়েছে এমন আকস্মিকভাবে? তা যদি হয়ই, তবু একটা কল্পিত সরল রেখার দু-ধারে দু-রকম মাটি হবে, এই বা প্রকৃতির কীরকম খেয়াল?
কিন্তু গবেষণার উপযুক্ত স্থান বা কাল এটা নয়। এখনকার কর্তব্য হল একটা ছায়ার মধ্যে আশ্রয়গ্রহণ এবং খচ্চরের পিঠ থেকে আহার্য পানীয়গুলি নামিয়ে কিছু কিছু উদরে প্রেরণ। খচ্চরের দড়ি ধরে জিমি হোরেস এগিয়ে পড়ল, খচ্চরের পায়ে পায়ে হ্যারি হ্যামিলটন। ঠিক এইভাবেই এরা অতিক্রম করে এসেছে পাঁচ-শো মাইল পথ, তার শেষের দিকে প্রায় এক-শো মাইলব্যাপী নিশ্ছদ্র অরণ্য, খচ্চরকে মধ্যে রেখে দুই বন্ধুর আগে-পিছে পথ পরিক্রমা। বলা যায় না, নজর না রাখলে এমনও হতে পারে যে, বানর এসে নিঃশব্দে বাহনের পিঠ থেকে একটা থলে তুলে নিয়ে চলে গেল নিকটতম গাছের উচ্চতম ডালে। ঝপ করে যে-শব্দটা হল, তাতে চমকে গিয়ে ওরা যখন উপর পানে চাইল, তখন হয়তো চোখে পড়ল কপিবরের আকর্ণবিশ্রান্ত হাসি। এক হাতে মুখ-খোলা ক্যানভাসের ব্যাগ, অন্য হাতে বৃহৎ একখণ্ড কেক বা ক্রিমরোল।
ওদের অভিজ্ঞতায় ঠিক এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, তা ঠিক। কিন্তু অন্য এক পর্যটকের ভাগ্যে ঘটেছিল সে-বিড়ম্বনা, পরে স্বরচিত কেতাবে তিনি ঘটনাটার রসাশ্রিত বর্ণনা দিয়ে পাঠকের চিত্তবিনোদনে প্রয়াসী হয়েছেন। পড়েছে তা জিমি-হ্যারি। পড়েছে তারা অনেক কিছু। এই যে পাঁচ-শো মাইল পথ তারা পায়ে পায়ে হেঁটে এল, এই যে এক-শো মাইল অরণ্য তারা অতিক্রম করে এল পুমা জাগুয়ার এবং তার চেয়েও মারাত্মক প্রাণী, সাপের মুখ পেরিয়ে। এ-সবেরই সম্পর্কে ভূরি ভূরি তথ্য তাদের জানা ছিল আগে থেকেই।
কিন্তু—
হঠাৎ একইকথা খেয়াল হয়েছে দুই বন্ধুর। হ্যারি ডেকে উঠেছে ‘জিমি!’ জিমি ডেকে উঠেছে ‘হ্যারি!’ যুগপৎ।
‘ল্যান্ড অব দ্য আজটেক’, বা ‘ওয়ান্ডার্স অব এ মাইলেনিয়াম এগো’, ‘এ ট্রেক টু লস্ট স্পেলন্ডার’-এর কোনো বইয়ে কিন্তু ওই মন্দিরের উল্লেখ নেই।
‘আমিও সেকথা ভাবছি। বইগুলো তো আমাদের কণ্ঠস্থ বললেই হয়।’
‘এমন হতে পারে যে, লেখকরা এ-পথে কেউ আসেননি। মহারণ্যের অন্য দিক দিয়ে অবশ্যই আরও অনেক অনেক পথ আছে।’
‘তা তো থাকবেই। তবু, যারা বই লিখেছে, তারা এমন একটা— একটা এমন—’
‘অতীত আজটেক গৌরবের নিদর্শন সম্পর্কে বিলকুল অজ্ঞ রয়ে গেল। এটাকে কেলেঙ্কারি ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। যাহোক, তারা ওই কেলেঙ্কারি করেছে বলেই আমরা দুনিয়াকে নতুন কিছু খবর দিতে পারব। অনেকগুলো ফোটো তুলতে হবে ওই মন্দিরমালার—’
কথায় কথায় তারা এগিয়ে এসেছে অনেক। ফুলে ফুলে আচ্ছন্ন যে গুলমোহরের গাছটা তাক করে হাঁটছিল তারা, অর্ধেক পথই এসে গিয়েছে তার দিকে। হঠাৎ—
খচ্চরটা নেচে উঠল হঠাৎ। তারপর একবার এদিক, একবার ওদিক কাত হয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে, চার পা উপরে তুলে। একটা কালো ফিতে বিদ্যুৎবেগে অদৃশ্য হয়ে গেল ডাইনের ফুলন্ত লতাকুঞ্জে।
সাপ! সাপে কামড়েছে অভাগা খচ্চরটাকে। অতবড়ো জঙ্গলে কিছু হল না জন্তুটার, এখন ফাঁকা মাঠে এসে পড়ে গেল সাপের মুখে। হুঁ, জায়গাটা খারাপ ছিল। যে-লাইন ধরে যাচ্ছিল ওরা, তার বাঁয়ে একটা কাঁটাবন, ডাইনে একটা লতামণ্ডপ। বাঁয়ের ঝোপ ঘেঁষেই চলছিল তারা, যম বেরিয়েছে সেইখান থেকেই। কথাবার্তায় অন্যমনস্ক ছিল দুই বন্ধু, লক্ষ করেনি। অবশ্য এমন বিদ্যুতের বেগে সে এসেছিল, দেখলেও কামড়টা আটকাতে তারা পারত না, পারত হয়তো কামড়াবার পরে পিস্তলের গুলিতে ওর মাথাটা উড়িয়ে দিতে। তাও বলা যায় না ঠিক। তাক করবার মতো চওড়া ফণা ওর নেই, সারা দেহের মতো মাথাটাও ফিতের মতো সরু। গুলি ফসকানো কিছুমাত্র ব্যাপার ছিল না।
যাহোক সে-সব ভাবনা ওরা ভাবছে না এখন। নিতান্তই অবান্তর হবে সে-ভাবনা। যা ওরা ভাবছে, তা হল এই, ঘোর বিপদেই পড়া গেল যাহোক। কম্বল-মশারি, কাপড়-জামা, আটা-চিনি, গোলাবারুদ সব মিলিয়ে জন্তুটা বোঝা বইছিল কম না। ওর অভাবে এখন সে-সব জিমি-হ্যারিদের কাঁধেই চাপবে তা নিশ্চয়ই! ভ্রমণের আনন্দ উবে গেল সে-চিন্তাতেই। মনে হতে লাগল, সাঁ করে ওরা যেন নেমে গিয়েছে কুলির পর্যায়ে।
চিন্তাই যে করছে ওরা কেবল, তা কিন্তু নয়। খচ্চরটাকে ওরই মধ্যে যথাজ্ঞান পরীক্ষাও করেছে ওরা। খুরের ঠিক উপরে দুটো দাঁতের দাগ, সূক্ষ্ম দুটো লাল ফুটকি। ফুটকি দুটো নীল হয়ে আসছে যেন তাদের চোখের সমুখেই। নীল হয়ে আসছে খচ্চরের সারা অঙ্গই। হাত-পা দুই-একবার ছুড়েছিল, মাটিতে পড়ার পরই। এখন আর ছুড়ছে না। অবশ হয়ে আসছে দেহ। মুখে গাঁজা ভাঙছে।
ওষুধপত্র সামান্য কিছু আছে সঙ্গে। হঠাৎ কলেরা হলে মরার আগে ওষুধ খেতে পারবে। কিংবা ম্যালেরিয়া। সর্দিকাশি উদরাময়ে চট করে না-মরতেও পারে। কিন্তু সাপের কামড়? ওর, হ্যাঁ, ওরও নাকি ওষুধ আছে। কী একরকম সেরাম। কিন্তু তা আনা হয়নি। প্রথমত ওটার কথা খেয়ালই হয়নি, দ্বিতীয়ত ওটা সে-শহরে বোধ হয় পাওয়াও যেত না, যেখান থেকে অভিযান শুরু হয়েছিল ওদের।
সেকথা যাক, আনা যখন হয়নি, কী আর করা যাচ্ছে। ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে। খচ্চরের পিঠ থেকে মালপত্র খালাস করো, তারপর একে একে সেগুলিকে পাচার করো ওই হলুদ ফুলের বড়ো গাছটার নীচে। যা করতে হবে, তা করেই ফ্যালাই দরকার। গড়িমসি করে ফল নেই। পেটের নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে ওদিকে। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যায়।
দু-জনে মিলে খচ্চরটাকে উপুড় করল ওরা। দারুণ মেহনতের কাজ। কিন্তু তা না-করলে মালগুলো খোলা যাচ্ছে না, দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে তো ওর পিঠে! উপুড় করার পরেও বাঁধন খোলা গেল না, ছুরি বার করে দড়ি কাটতে হল।
একটা-দুটো করে মাল ওরা গাছের নীচে নিয়ে গাদা করছে। ঝোপঝাড়ের কাছে প্রাণান্তেও যাচ্ছে না, পায়ের দিকে তীক্ষ্ন নজর রেখেছে। একটা সাপ দেখা গিয়েছে, আরও এক-শোটা কোন না-আছে ওই সব ঝোপে! সাবধানের মার নেই, কথায় বলে। এক্ষেত্রে সাবধান হয়েও মারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কিনা, ঠিক কী!
সব মালই বওয়া হয়ে গেল, খচ্চর তখনও মরেনি। থেকে থেকে দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠছে এক একবার। গ্যাঁজলা ঝরছেই মুখ থেকে, তার রং এখন নীল।
শেষ বোঝা দুটো ওর পিঠ থেকে খুলে নিজেদের কাঁধে তুলবার পরে ওরা বিমর্ষমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল জীবটার পাশে। পাঁচ-শো মাইল ওদের সঙ্গে সঙ্গে ও এসেছিল, শুধু পথের ধারের ঘাস আর লতাপাতা খেয়ে খেয়ে। জিমি-হ্যারির কাছে ও নেয়নি কিছু, একতরফা সেবাই করে গিয়েছে দুই মাস ধরে। শেষকালে প্রাণটাও দিয়ে গেল ওদেরই সেবায়।
ধীরে ধীরে ওরা গিয়ে গাছতলায় বসল, খাওয়া-দাওয়াও সেরে নিল আস্তে আস্তে। মুষড়ে পড়লে তো চলবে না! এখন আরও বেশি খাটতে হবে, বেশি বেশি সাহসে বুক বাঁধতে হবে—
এক-একটা বোঝা মাথায় দিয়ে ওরা বিশ্রাম করছে, একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক, রোজই লাঞ্চের পরে ঘণ্টাখানেক তারা বিশ্রাম করে, তা নইলে পারবে কেন? সেই তো সকাল থেকে অন্তত ছয় ঘণ্টা তারা পথই চলছে। পথই চলছে— পথই—
একী! এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেল? মানে কী এর? এ্যাঁ? ঘুমিয়ে পড়েছিল দু-জনেই। এমন সাপের ভয় সত্ত্বেও?
অবশ্যই পড়েছিল ঘুমিয়ে। এক ঘুমে কী তাজ্জব? পাঁ-চ ঘণ্টা— একঘুমে কাবার? লাঞ্চ খেয়েছিল বেলা একটায়, এখন ছ-টা বারো মিনিট। বড়োজোর পাঁচ ঘণ্টা ঘুম দিনের বেলায়। রেকর্ড রেখেছে ওরা ঘুমের। কিন্তু এখন? এখন কী করা যায়? সন্ধ্যার আগে তো একটা যেকোনোরকম আশ্রয়ের ভিতরে ঢুকে পড়া চাই!
ধড়মড় করে উঠে বসেছে দু-জনে। জিমি ঠেলছে হ্যারিকে, হ্যারি ঠেলছে জিমিকে, ‘ওঠ, ওঠ, বেলা যে গেল!’ দু-জনেই উঠে দাঁড়াল। জিমি বলল, ‘মালপত্র থাকুক এমনি পড়ে। আমরা যাব আর আসব। অত অত ভাঙা মন্দির। একটা রাত কাটাবার মতো একটা খুপরি কি আর পাব না ওখানে? তারপর এসে মাল নিয়ে যাব। চল আগে হোটেলে নাম লিখিয়ে আসি—’
দ্রুতপদেই চলল দু-জনে। পিছনে একবার তাকিয়েও দেখল না, খচ্চরটার দেহ নিয়ে শেয়াল শকুনে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে কিনা। মরে যে এতক্ষণ গিয়েছে, তাতে তো আর ভুল নেই নিশ্চয়ই!
বলতে কী, একটা খচ্চর যে তাদের ছিল এবং সেটা যে এই কিছুক্ষণ আগে শোচনীয়ভাবে মারা পড়ল সর্পাঘাতে, এ কথাগুলোই সে-মুহূর্তে জিমি-হ্যারির মনে পড়েনি একটি বারের তরেও। তাদের দৃষ্টি তো বটেই, তাদের ধ্যানজ্ঞান সবই তখন নিবদ্ধ ওই অদূরের ভগ্ন মন্দিরমালার উপরে।
পাশাপাশিই হাঁটছে দু-জনে, দ্রুতবেগেই হাঁটছে। কতক্ষণ লাগে আর? ওই তো একটা সিংহদরজা। মাথাটা ভেঙে পড়েছে, দরজার অর্ধেকটা ছোটো-বড়ো পাথরের চাঙড়ে ভরতি, কিন্তু কোথাও তাদের টপকে, কোথাও পাশ কাটিয়ে গলবার মতো পথও করে নিতে পারা যাবে।
পেরিয়ে এসেছে সিংহদ্বার। সমুখে খোলা চত্বর একটা। অর্থাৎ চত্বরটা খোলাই ছিল একসময়, এখন আগাছায় ঝোপঝাড়ে ঘিরে ধরেছে তাকে। বাইরের ওই প্রান্তরের মতোই অবস্থা এ-চত্বরের, তফাত শুধু এই যে, এখানে বড়ো গাছ আদৌ নেই, যেমন আছে বাইরে।
এদিকে-ওদিকে চাইছে ওরা, কোথায় রাতের মতো একটু আস্তানা পাওয়া যাবে। হঠাৎ তাদের সারা দেহ যেন অবশ হয়ে গেল, পাথরের মতো শক্ত অনড় একেবারে। চত্বরের প্রত্যেকটা ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক-একটা সশস্ত্র সৈনিক। পুরাতত্ত্বের বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে সেকেলে আজটেক যোদ্ধাদের পোশাক-আশাকের সম্বন্ধে ইদানীং ওদের ধারণা হয়েছে একটা। এই যোদ্ধাদের পরনে সেই ধরনের পোশাক। সেই ঊরু পর্যন্ত ঝোলানো আঁটো কামিজ, সেই হাঁটু পর্যন্ত তোলা কাঁচা চামড়ার পট্টি। কোমরবন্ধটার চেহারা খুবই আশ্চর্য, হুবহু সেই কালো সাপটার মতো, যার কামড়ে ওদের খচ্চরটা মারা পড়েছে একটু আগে।
আজটেক যোদ্ধা? আজটেকরা না বিলুপ্ত হয়েছে ধরণী থেকে? অথচ এই যোদ্ধারা, অন্তত পঞ্চাশটা লোক তো এই চত্বরেই আছে তাদের চারপাশে। এদের আত্মীয়-পরিজন-স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও অবশ্যই আছে কোথাও না-কোথাও, তাহলে তো ওদের বিলুপ্তির খবর ডাহা ফাঁকি।
কিন্তু ভাববার সময় ওদের আর হল না। একটা অট্টহাস্য শোনা গেল আজটেকদের কণ্ঠ থেকে। তারপর তাদের একজন কথা কইল। যে ভাষায় কথা কইছে, তা জিমি-হ্যারির অজানা, কিন্তু আশ্চর্য এই ভাষা না-জেনেও ওদের কথার ভাব পরিষ্কার বুঝতে পারছে এরা। আজটেকরা বলছে, ‘আয় আয় বিদেশি। ঠিক সময় এসে গেছিস, বলিদানের সময় ঠিক সূর্যাস্তেরই মুহূর্ত—’
আশ্চর্য! এই তো বেশ খানিকটা দূরেই ওরা ছিল এতক্ষণ। কিন্তু কথা যখন শেষ হল, জিমি-হ্যারি সভয়ে দেখল লোকগুলো একেবারে তাদের গায়ের উপরে এসে পড়েছে। হেঁটে আসুক, উড়ে আসুক, আসার সময় ওদের দেখতে পেল না জিমি-হ্যারি— এ কেমন কথা? ম্যাজিক? সূর্য সত্যিই অস্ত গিয়েছে, কিন্তু অন্ধকার তো হয়নি এখনও, গোধূলির আলোতে সব কিছুই এখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ ওদের আসার ব্যাপারটা মোটেই চোখে পড়ল না এদের? পড়লে অবশ্যই দুই-একটা গুলি চালাতে পারত এরা! হাতে রাইফেল রয়েছে!
আরে, আরে, ঠিক সেই ব্যাপারটাই আবার। কখন তাদের বাঁধল আটেকরা, কখন তাদের টেনে নিয়ে ফেলল হাড়কাঠের সামনে। কখন—
একখানা এক ফুট উঁচু লম্বা পাথর। তার এদিকে শুইয়ে দিয়েছে হ্যারিকে, ওদিকে শুইয়ে দিয়েছে জিমিকে। মাথা দুটো পাথরের উপরে, মুখোমুখি। দুটো মাথার ভিতরে ব্যবধান ছয় ইঞ্চির বেশি নয়। জিমি দেখছে হ্যারির মাথার উপরে খাঁড়া নামছে হ্যারি দেখছে জিমির মাথার উপরে খাঁড়া নামছে।
‘দস্যু কোর্টেজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে দুনিয়ার সব সাদা আদমিকে। এইভাবে তাদের বলিদান হবে ভাগ্যদেবতার বিচারে।’— ঠিক যেন বজ্রনাদের মতো ধ্বনিত হল জিমি-হ্যারির কানে।
বজ্র? বজ্রনাদের শেষ দিকটা যে খচ্চরের ডাক বলে মালুম দিচ্ছে! ধড়মড় করে উঠে বসল হ্যারি-জিমি! কোথায় কী? তাদের গলায়ও বাঁধন নেই, তাদের বধ্যশিলায় ফেলে মাথার উপর খাঁড়াও তোলেনি কেউ।
সূর্যাস্তের অনেক দেরি। ঘড়ি বলছে তিনটে এখনও বাজেনি।
সবচেয়ে আশ্চর্য, খচ্চরটা মরেনি, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেই চেঁচিয়ে মরছে প্রাণপণে। তার আওয়াজকেই বজ্রনাদ বলে ভুল করেছিল জিমি-হ্যারি।
সেই আধমাইল জোড়া মন্দিরনগরীই বা কোথায়? হলদে ফুলের গাছটা ঠিকই আছে বটে, তারই তলায় ওরা আছে এখনও। কিন্তু মন্দির সমুখে নেই। পিছনেও যেমন বিশাল অরণ্য, সমুখেও তেমনি। দুইজনের চোখ একইরকম ভুল দেখল? মন্দিরমালা, সর্পাঘাত, বধ্যশিলা,— সব? ওরা পরস্পরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।