স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন

স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন

গাড়ি থেকে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল৷ এত চমৎকার একটা বাসস্থান আমি কল্পনাও করিনি৷ যখন থেকে গাড়ি এই সবুজের ঢেউখেলানো পাহাড়ে চড়ছে তখন থেকেই মনে একটা খুসি ছড়িয়ে পড়ছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে বাড়িতে এসে গাড়ি থামলো সেটার মতো অপূর্ব আর কোনো বাংলো এতটা পথে আমার চোখে পড়ে নি৷ দক্ষিণে থাকে থাকে নেমে গেছে নানা রকমের ফুল আর বাহারী পাতার গাছে সাজানো বাগান৷ পশ্চিমে বড় বড় গাছের মধ্য দিয়ে প্রবেশ-পথ এসে গাড়ি বারান্দায় শেষ৷ এইসব চা-বাগান অঞ্চলে যেমন হয়, কাঠের তৈরি খাস বিলিতি সায়েবী বাংলো৷

দুটি তলায় বিশাল বিশাল দুটি চওড়া বারান্দা বাংলোর তিনদিক ঘিরে আরো পিছন দিকে খানিক দূরত্বে গ্যারাজ ও তার মাথায় সার্ভেন্টস কোয়ার্টার৷ সামনের বাগান ধাপে ধাপে নেমে হঠাৎ এক জায়গায় শেষ হয়েছে৷ সেখানে খাড়াই পাহাড় নেমে গেছে, উপত্যকার দিকে৷

‘কী ডক্টর দেবসেন, বাংলো পছন্দ?’

‘অপূর্ব!’

দূরে পুতুলের ঘরবাড়ির মতো অসমীয়া গ্রাম, খেলনার রেলগাড়ি চলে গেল ভূগোলের মডেলের মতো টোকো গাছের ফাঁক দিয়ে৷ আমি নড়তে পারছি না৷

‘চলুন, ওপরে চলুন, আপনার কামরাটা দেখে নেবেন৷’

ওপর থেকে আরো আরো সুন্দর৷ ঘরে ঢুকতেই ইচ্ছে করছে না৷ একটা মস্ত গাছ ফুলে ফুলে গোলাপী৷

‘আপনার যা দরকার চেয়ে নেবেন৷ এই বেয়ারা, এই বাবুর্চি, আর গাড়ি ড্রাইভার সবই আপনার সার্ভিসে রইল৷ এই হচ্ছে এয়ার কন্ডিশনের সুইচ৷ এই কলিং বেল৷ আর ফোন—’

মি. আখতার হোসেন এদিক-ওদিক তাকালেন—‘ফোন নেই এই ঘরে?’

‘এখন নাই৷’ বেয়ারা অম্লানবদনে জানালো, ‘কলিং বেলেরও লাইন নাই৷’

‘কেন?’

বেয়ারা এ-কথার জবাব দেওয়ার দরকার মনে করল না৷

‘ওপরে কোনো ফোনই নেই?’

‘মাস্টার বেডরুমে আছে৷’

‘কলিং বেল আছে ওখানে?’ বেয়ারা মাথা নাড়ে৷ নঞর্থক৷ ওখানেও বেল নেই৷

‘তাহলে মেমসাহেব তোমাদের ডাকবেন কেমন করে?’

‘জানালা হতে হাঁক দিবেন, বড়ুয়া! বাবুর্চি হোক, মালী হোক, আমি হই—যে কেউ ঠিক চলে আসব৷’

কফি এসে গেল৷ বারান্দায় চেয়ার টেবিলে বসে আরামে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাইরে তাকাই—আঃ, এমন বাংলোতে তিনদিন থাকতে পারব, ফ্রি!

‘ওপাশে নাগা হিলস, বুঝলেন? অরুণাচল প্রদেশ, আর এপাশে বার্মা বর্ডার৷ এই গাছটার নাম হলং৷ কী বড় গাছ, দেখেছেন? বেস্ট টিম্বার দেয়৷’

‘এত চমৎকার বাড়িটাকে ম্যানেজার-ট্যানেজারের বাংলো না করে গেস্ট-হাউস করলেন কেন? বেশির ভাগ সময়েই তো ব্যবহার হয় না?’

বেয়ারার দিকে তাকালেন মি. হোসেন—‘কী বড়ুয়া? লোকজনটন আসে কেমন?’

বেয়ারাকে দেখলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ আমলের লোক৷ হাবভাবই আলাদা৷ যেমন গম্ভীর, তেমন রাশভারি৷ ধপধপে সাদা উর্দি, মোজাবিহীন শু জুতো চকচক করছে৷ মাথায় পাগড়ি৷ বড়ুয়া বলে—‘এইটা তো ভি আই পি বাংলো, এইখানে সারা বৎসরে আর কয়টা লোকই বা আসে! ওই সাতাশ নম্বর বাংলো বেশ ভরা থাকে৷ ঘরে ঘরে লোক৷ ঐটাই মেন গেস্ট-হাউস তো!’

‘আর এত সুন্দর বাংলোটা—’

‘ভি আই পি আর কয়জন আসেন বলুন? সেই যে পেট্রো-কেমিকেলের মিনিস্টার একবেলার জন্য এসেছিলেন, তারপর তো এই মেমসাহেব এলেন, এর মধ্যে কেউই আসেন নাই৷’

‘তোমরা তাহলে কর কি?’ হোসেনের চোখ কপালে উঠেছে৷

প্রশ্নটা বড়ুয়ার পছন্দ হল না৷ তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে বললে,—‘এই ঝাড়াপোছা করি, পেতল পালিশ করি৷ বাগ-বাগিচা সামলাই৷ আর কি!’

‘সরকারি চাকরি, কাজ কর-না-কর যাবে না! মজায় আছ বেশ!’

হোসেন সাহেবের এ কথায় কোনো উত্তর দেয় না বড়ুয়া৷ ‘আর কিছু লাগবে? ঘরে ফ্লাক্সে ঠাণ্ডাপানি দিয়েছি, মেশিন আছে৷ ডিনার কি এইখানে হবে?’

‘আরে না না, এখানে একা একা খাবেন কি? ওঁর ডিনার আছে ক্লাবে—

হোসেন তরুণ অফিসার৷ উৎসাহে টগবগ করছেন৷ রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে তাঁর ভূমিকাই বোধহয় প্রধান৷ আমাকে খুব যত্নআত্তি করছেন এঁরা—সত্যি সত্যি যাকে বলে ভি আই পি ট্রিটমেন্ট, তাই পাচ্ছি৷ হোসেন বললেন, ‘এখন যদি একটু বেড়িয়ে আসতে চান, গাড়ি আছে, যেতে পারেন যেদিকে খুশি৷ আমরা তো আপনাকে নিতে আসব ছ’টার সময়৷’

‘এখানটাই এত সুন্দর যে আর কোথাও যেতে ইচ্ছেই করছে না৷ সত্যি, ঠিক যেন স্বপ্নের মতো৷’ বড়ুয়ার মুখে একটুখানি হাসি ফুটলো৷ এ-কথাটি তার মনের মতো হয়েছে বোধহয়৷ কফি হাতে বসে বসে কোম্পানির গল্প করতে লাগলেন মি. হোসেন৷ তিনি খুব পুরনো নন এখানে, বড়ুয়া বহুদিনের৷ তাঁর বাংলো খানিক দূরে৷ আরেকটা সবুজ টিলার মাথায়৷

‘কিছু চাইলে হাঁক দেবেন’—বলে বড়ুয়া নেমে যায়৷

হোসেন বললেন : ‘এটা অদ্ভুত যে কোনো কলিং বেল নেই!’ বলতে বলতেই দেয়ালে চোখ যায়৷ পাখা আলোর সুইচবোর্ডে কলিং বেল!

‘আরে, এই তো!’ হোসেন উঠে গিয়ে বেল টিপলেন৷ কোনোই শব্দ শুনতে পেলুম না, আমি অন্তত৷ ‘ডিসকনেকটেড, মনে হয়৷’ নিজেই মন্তব্য করেন তিনি৷

বাইরে চমৎকার বর্ষার মেঘমেদুর আকাশ৷ পাহাড়ি সবুজের ওপর তার ছায়া যে কী মোহময়, পশ্চিমবঙ্গে বসে কোনোদিন তা জানা যাবে না৷ চোখের মুগ্ধতা আর কাটেই না৷

‘সেরা বাংলোটাই রেখেছে আর কি ভি আই পিদের জন্য৷ আগে তো সরকারি কোম্পানি ছিল না? প্রাইভেট কোম্পানিতে বাইরে থেকে যারা আসে-টাসে তাদের যত্ন করাটা খুব জরুরি তো? বিজনেস ট্যাকটিকস!’ হোসেনের কথায় আমার মনে হল, আমার ঠিক এটা প্রাপ্য নয়৷ তা হোক৷ মাঝখান থেকে আমার মতন অব্যবসায়ীও এমন মজায় থেকে গেলুম৷ ভালোই হয়েছে, সেরা বাড়িটিকে অতিথিশালা করেছে এরা৷ পুজোর লেখার মূল্যবান সময়টা খরচা করেও এসেছি যে, সেটা সার্থক৷ নিজের খরচে জীবনেও এ-রকম একটা বাংলো ভাড়া করে থাকতে পারতুম না আমি! বেঁচে থাকুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ হোসেন চলে যাবার পরেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি৷ উপত্যকার ওপারে পাহাড়ের পরে পাহাড়ের আবছা হয়ে যাওয়া ঢেউয়ের পরে ঢেউ, চোখ যেন টেনে ধরে রেখেছে৷ বাগানের দিকে তাকাই৷ একটি জাপানী স্টাইলের ছোট্ট বাগান চোখে পড়ল এবার, খানিক নিচে, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে৷ একটা ছোট্ট ল্যাম্পপোস্ট, ছোট্ট একটা আঁকাবাঁকা নীল টালি বাঁধানো নকল নদী, তার ওপরে খুদে খুদে লাল টুকটুকে সেতু৷ ওমা গো, কী সুন্দর! আমি কিছুই চিনি শুনি না৷ হঠাৎ মনে হল টেলিফোন বাজছে৷ যে-ঘরে ফোনের শব্দ হচ্ছে সেই ঘরের দিকে ধেয়ে যাই৷ ঘরে ঢুকতেই ফোন থেমে গেল৷ এ-ঘরটায় আমার ঘরের চেয়েও বড় বিশাল এক বিছানা পাতা৷ এক কোণে আবার এর নিজস্ব ব্রেকফাস্ট-রুম রয়েছে কাচের জানলা ঘেরা৷ এগিয়ে যাই৷ এক্সপ্লোর করতে হবে তো? এত সুন্দর বাংলোতে আর কেউ নেই, একলা আমি! আই অ্যাম দ্য মনার্ক অব অল আই সার্ভে! আঃ! বাথরুম ভেবে যে দোরটা ঠেলি, সেটা ড্রেসিং রুম৷ তার ওপাশে বাথরুম৷ ড্রেসিং রুমে ঢুকতেই সুন্দর একটা হাল্কা সুগন্ধ নাকে এল৷

আরেকটা দোর ঠেলতেই অন্য একটা বেডরুমে ঢুকে পড়ি৷ এটাই মাঝখানের ঘর৷ ভারি সুন্দর৷ এখানেও দ্বৈতশয্যা৷ এখানে কোনো সিংগল বেডওয়ালা ঘরই নেই দেখছি৷ এর সঙ্গে কেবল বাথরুম৷ পাশের যে দরজাটা আধখোলা, তার ফাঁক দিয়ে আমার ঘরটাই দেখা যাচ্ছে, সব দরজায় ভারি ভারি পর্দা, কিন্তু লক করার ব্যবস্থা নেই৷ তিনটে ঘরের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করা যায়৷ আমার খুব আহ্লাদ হল৷ যখন যে ঘরে খুশি ঘুরে-ফিরে থাকা যাবে৷ সব ঘরেই দিব্যি আলো জ্বলে, পাখা চলে, এয়ার কন্ডিশনিং আছে৷ খানিক সুইচ টেপাটেপি করে আবার বারান্দায় যাই৷ সার্ভেন্টস কোয়ার্টার আর বাংলোর মাঝে একফালি উপল-বিছানো জমি৷ খুব বেশি দূর নয়, ডাকলেই ওরা শুনতে পাবে৷ যেমন অতল নিঃশব্দ এই বাংলো, বাগানে শুকনো পাতা উড়লে বারান্দায় তার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ সর্বক্ষণ একটা ঝিম-ধরানো ঝিঁঝির ডাকে ঘেরা এই বাংলো৷ ঘরে এসে খাটে চিৎপটাং হতেই আবার ফোন৷ এবার আমি উঠি না৷ তিনখানা কামরা ইন্সপেকশনের ফলে এখন ভি আই পি পরিশ্রান্ত৷ বিশ্রাম নিচ্ছেন৷ দরজা নক করে বড়ুয়া বললে : ‘মেমসাহেব টেলিফোন এসেছে নিচে৷’

বড়ুয়া ফোনটা নিচেই ধরেছে৷ আমি ওর সঙ্গে নিচে যাই৷ খাবার ঘরে ফোন৷ হোসেন বলছেন ছ’টার একটু আগেই তৈরি থাকতে৷

বারান্দার প্রেমে পড়ে গিয়ে ঘরটাকে ভালো করে দেখা হয়নি৷ এবার খুঁটিয়ে দেখি৷ দেয়ালে বিলিতি গ্রামের শান্ত রঙিন দুটি দৃশ্য ফ্রেমে বাঁধাই অয়েলপেন্টিং৷ কোণে নাম সই করা আছে—টেড৷ বাঁ-ধারে বিশাল একটা শাদা আলমারি, তাতে তালা ঝুলছে৷ অন্য ধারে ছোট একটি আধুনিক স্টাইলের পালিশ-করা ওয়াড্রোব এ ঘরের সঙ্গে ঠিক মানাচ্ছে না৷ ওটাই আমার ব্যবহার্য৷ এদিকে ড্রেসিং টেবিল৷ বিশাল প্রমাণসাইজের বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাটা ওপর-নিচে বেশ দোলানো যায়৷ বাঃ! বাথরুমে ঢুকি৷ গা ধুয়ে তৈরি হয়ে নিতে হবে৷ ঝকঝকে বাথটব৷ তাতে জল ভরতে শুরু করে দিই৷ ইঃ, কি জোরেই জলের শব্দ হচ্ছে! দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আওয়াজ একটু কমাই৷ তালাবন্ধ আলমারিতে কী আছে? তালা কেন? সেই ‘কঙ্কাল’ সিনেমার মতো হঠাৎ খুলে যাবে না তো মাঝরাত্তিরে—আর, এক কোণে ঘাড় গুঁজে বসে থাকা মলয়ার মৃতদেহ দেখা যাবে! ওরে বাবা রে!

অন্য ঘরগুলোতে ঢুকে পরীক্ষা করে আসব নাকি? সব ঘরেই কি তালাবন্ধ আলমারি থাকে? যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ হ্যাঁ, আট-কোনা ঘরেও রয়েছে৷ আর উত্তর দক্ষিণ পূর্বদিকে খোলা মাস্টার বেডরুমে? নেই৷ কোনো আলমারিই নেই৷ ড্রেসিং রুমে? হ্যাঁ, এখানে আছে৷ এই তো তালা নেই৷ টানতেই খুলে গেল৷ ভেতরে সেই সুন্দর গন্ধ৷ কিছু কাচা তোয়ালে ভাঁজ করা আছে৷ ভূতটূত নেই৷ যাক, নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান করতে ঢুকে পড়ি৷

দারুণ ক্লাব৷ দারুণ ডিনার৷ সবই দারুণ৷ নামেই সরকারি—এখনো বেশ দাপট আছে, প্রাইভেট কোম্পানির দিনগুলো সম্পূর্ণ মুছে যায় নি৷ ফিরে এলুম, রাত তখন খুব বেশি হয়নি৷ এসব পার্টি থেকে বারোটার মধ্যেই ফিরতে পারাটা স্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এখানে যে কাজ শুরু হয় ভোর ছ’টায়, শেষ হয়ে যায় দুপুর তিনটেয়৷ রাত্রে বেশিক্ষণ তাই পার্টি চলে না৷ গাড়ি থেকে নেমে দেখি বড়ুয়া বসে ঝিমুচ্ছে৷ উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম করে বললো : ‘বিছানা তৈরি৷ স্নান করবেন? জল তৈরি৷ কিছু লাগবে?’

‘এক পট কফি দিয়ে যেও ঘরে৷’ এবারে তো কালকের বক্তৃতাটা তৈরি করতে হবে, যে জন্যে এতদূর আসা!

আমি রাতপাখি—আমার কাজকর্ম সব রাত্রে৷ দিনের বেলায় মাথায় কিছু ঢোকে না৷ রাত্রিজাগরণে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই৷

‘কফি? এক প—ট? ঠাণ্ডা বিয়ারও আছে কিন্তু মেশিনে, মেমসাব!’

নাঃ, সত্যি সত্যি মেমসাবকে ভি আই পি ট্রীটমেন্টই দিচ্ছে বটে বড়ুয়া! এর আগে হয়তো সারা রাত কফি-খেকো কোন ভি আই পি ওঠেন নি এখানে এসে৷

‘না, না, বিয়ার আমি খাই না বড়ুয়া, কফিই দাও৷ থ্যাঙ্ক ইউ৷’

‘ঘুমটা হত৷ কফিতে কি ঘুম হবে?’

‘আমি তো ঘুমুতে চাই না৷ আমার কাজকর্ম আছে কিনা? কফিটা খেলে সুবিধে হবে রাত জাগতে৷’

‘যা বলেন৷’ বড়ুয়া চলে গেল৷ আমি আবার বারান্দায় যাই৷ বাতাসে বনের গন্ধ, বনের শব্দ৷ কত রকম আশ্চর্য শব্দই যে শোনা যাচ্ছে—আমার খুব ভালো লাগতে থাকে৷ দূর—কে এখন রবীন্দ্রনাথ ও আন্তর্জাতিকতা নিয়ে ভাবতে চায়? আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি৷ বাইরে ঘন অন্ধকার৷ এ বারান্দার প্রত্যেকটা আলো জ্বলছে৷ নিচেরও৷ এত আলোয় কি রাত্রির রূপ দেখা সম্ভব? সুইচ বোর্ডের দিকে হাত বাড়াই৷ একটা একটা করে আলো নেবাতে থাকি৷

‘মেমসাব, ও কি করছেন? লাইটগুলো সব জ্বালা থাকবে৷’

‘কেন? সারারাত্তিরই জ্বলবে?’

বড়ুয়া নিচে থেকে চেঁচিয়ে বলে৷ ‘তাই এখানকার নিয়ম৷ সিকিউরিটির নিয়ম৷’

অ৷—সত্যিই তো৷ জঙ্গলের মাঝখানে বাংলো৷ চারপাশে কিছুই নেই৷ ঐ রাস্তাটি দিয়েই শুধু সভ্য জগতের সঙ্গে যোগ৷ বাঘ-ভাল্লুকের কৌতূহল হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ বাগানটা ঘোর অন্ধকার৷

বড়ুয়া কফির ট্রে নিয়ে আসে৷ বলে, ‘আমরা এবার শুতে যাচ্ছি, মেমসাব৷ কিছু কি লাগবে?’

‘কিছু না৷’

‘দরকার হলে ডাকবেন জানলা খুলে৷ কোয়ার্টার পাশেই৷’

‘ডাকব৷ গুড নাইট বড়ুয়া৷’

‘ও, ক’টায় চা দেব?’

‘ছটায় দিয়ো৷’

‘ব্রেকফাস্ট?’

‘সাতটায়৷’

‘গুড নাইট, মেমসাব৷’

বড়ুয়া চলে গেল, নিচে দরজায় চাবি দেবার শব্দ হল৷ তারপর চারিদিকের স্তব্ধতা যেন চিৎকার করে উঠল৷ এত বড় বাড়িটায় আর কোনো দ্বিতীয় প্রাণী নেই৷ একটা কুকুর পর্যন্ত না৷

ঘরে লেখার টেবিল, চেয়ার নেই৷ বিছানায় গুছিয়ে বসি কাগজপত্তর নিয়ে৷ এয়ার কন্ডিশনারের গুঞ্জন ছাড়া কোনো শব্দ নেই ভিতরে৷ বাইরের বনের আওয়াজ এ-ঘরে আসে না৷ লেখায় মন দিই৷ লেখা এগুতে থাকে কফির গুঁতোয়৷ হঠাৎ একবার মনে হল—যাই, বাইরে গিয়ে অরণ্য পর্বতের নৈশ শোভা পরিদর্শন করে আসি গে৷ আদেখলের ন্যায় কর্ম হচ্ছে জেনেও গুটি গুটি যাই৷ এমন সুযোগ ক’বার আসে জীবনে?

বারান্দায় যেতে যেতে বাগানের দিকে একঝলক তাকিয়েই মনে হল জাপানি বাগানের ছোট্ট ল্যাম্পপোস্টগুলোয় সব আলো জ্বলছে—ভারি সুন্দর তো! ভালো করে দেখব বলে রেলিঙে ভর দিয়ে যেই তাকিয়েছি, দেখি সব নিভে গেছে৷ কই জ্বলছে না তো? অথচ স্পষ্ট দেখলুম খুদে আলো জ্বলছে (S) গড়নের নদীর ধারে ধারে—নাকি চোখের ভুল৷ রাত খুব কি বেশি হয়েছে? সেই ভোর চারটেয় গাড়ি আসবে, দমদমে গিয়ে প্লেন ধরতে হবে সাড়ে পাঁচটায়, সেই তাড়ায় রাত্রে শুতেই যাই নি কাল—যদিও রাত্রিজাগরণে আমার কষ্ট নেই, তবু একেবারেই না শুলে স্নায়ুর একটু ক্লান্তি তো…আরে, আরে, ঐ—ঐ তো আবার জ্বলে উঠেছে আলোগুলো! টালির নদীতে নীল জলের আভা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে— মুহূর্তের অন্যমনস্কতা ঘুচে যেতেই দেখি ফের আকাশ, বাগান অন্ধকার৷ নীল জল মুছে গেছে৷ বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে৷

জলের ওপরে কী সুন্দরই দেখাচ্ছিল আলোটা এক্ষুনি! ইচ্ছে করতে লাগলো বাগানে বেরুতে, কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে৷ ভিজতে সাহস হল না৷ ব্যাপারটা সশরীরে পরীক্ষার প্রচণ্ড ইচ্ছে সত্ত্বেও নিজেকে সামলে রাখলুম : ছাতা যখন নেই তখন এখান থেকেই দ্যাখা৷ তাছাড়া জীবজন্তুও আসতে পারে বাগানে রাত্তির বেলায়৷ দূরের উপত্যকাতে মাঝে মাঝে মিটিমিটি আলোর সারি জ্বলছে, বাস-রাস্তা আছে ওখানে৷ সেটাই দেখেছি হয়তো৷ চোখের ভুল৷—কবির-কল্পনা৷ সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সামনে এত বড় একটা আলো! বেশ জন্তুজানোয়ারের ভয় আছে এখানে, তাই কোনো অফিসার এ বাংলো নেয় নি৷ রোজ রোজ কে আর জঙ্গলে থাকতে চায়?

এমন সময়ে হঠাৎ কোথায় একটা মেশিন চলতে শুরু হল ঘর্ঘর শব্দে৷ আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাই৷ এয়ার কন্ডিশনারটা বিগড়োলো নাকি? নাঃ, ঘরের শব্দ তো যেমনকে তেমনই৷ কান পেতে বুঝতে পারি শব্দটা অন্যত্র—আরেকটি এয়ার কন্ডিশনারের চালু হবার৷ তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে যাই৷ কী রে বাবা, কোথাও লুজ কানেকশন ছিল নিশ্চয়! না তো, এটা তো বন্ধ৷ তবে কি মাস্টার বেডরুমে? পর্দা সরিয়ে দরজা খুলে দেখি আলো জ্বলছে৷ অর্থাৎ বিকেলে আমি আলো নেবাতে ভুলে গেছি৷ কিন্তু এয়ার কন্ডিশনার চলছে না৷ আলোটা নেবাতে ঘরে ঢুকতেই মনে হল একবার ফোনটা বেজে উঠল৷ এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরি৷ মাউথপিসের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঝিমধরানো সুগন্ধ৷ কলকাতাতেও এমনি একটা সার্ভিস আছে, হপ্তায় হপ্তায় এসে ফোনে আতর মাখিয়ে যায়৷

‘হ্যালো?’ ওদিকে শব্দ নেই৷ ‘হ্যালো?’ ‘হ্যালো?’ কই, কেউ তো কিছু বলছে না? ফোনটা বাজলো বলেই মনে হল৷ নাকি বাজে নি? কোনো জবাব নেই৷ বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করে নামিয়ে রাখি৷ নিশচয়ই কোনো মাতালের কাণ্ড৷ আলো নিবিয়ে দিয়ে ফিরে আসি৷ আমার ঘরের আলোটা পরদার ফাঁক দিয়ে আটকোনা ঘরের মেঝেয় এসে পড়েছে, পথ দেখতে অসুবিধা নেই৷ আলোটাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে, মেঝের ওপরে যেন একটা আলোর তৈরি ক্রুশচিহ্ন৷ ফিরে যেতে যেতে মনে হল টেলিফোনের সুগন্ধটা সারা ঘরেই ছড়িয়ে পড়ছে৷ ফোনটা কি বেজেছিলো? না বাজেই নি?

যেই লিখতে বসা, অমনি মনে হল ঝনঝন শব্দে জঙ্গলের বিচিত্র গুঞ্জন আর রাত্রির স্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আবার টেলিফোন বেজে উঠল৷ তাড়াতাড়ি দৌড়োই ও-ঘরে৷ পর্দা তুলে, আলো জ্বেলে দেখি—কই, ঘর তো নিঃশব্দ! এ-ঘরে ফোন বাজছিলো বলে তো মনেই হচ্ছে না৷ কিন্তু ঘরটা খুব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে মনে হল, এয়ার কন্ডিশনারটা কি চলছে? আগেও একবার দেখে গেছি অবশ্য৷ পাহাড়ি বৃষ্টিতে এমনি বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা পড়ে গেছে আর কি৷ তবুও ‘সাবধানের মার নেই’ পন্থায় এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্রটার দিকে ভালো করে আরেকবার নজর করে দেখি৷ নাঃ, অফ করাই তো আছে৷ অথচ ঘর্ঘর শব্দও হচ্ছে কোথাও একটা৷ সম্ভবত এখানে অন্য কোনো রকম যন্ত্র আছে, যেটা রাত্রে অটোমেটিক্যালি চালু হয়৷ বাগানের পাম্প, কি বিজলির, ডাইনামো এজাতীয় কিছু হতে পারে৷ ছাদের ওপরে ইঁদুরের ছুটোছুটি ক্রমশই বাড়ছে৷ খুটখাট খুটুর খুটুর থেকে ঠাশ-ঠকাশের দিকে৷ কাঠের বাড়ির এই দোষ৷ ছাদভর্তি ইঁদুরের রাজত্ব৷ টেলিফোনটা সত্যি জ্বালালে! লিখতে দেবে না৷ বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখে জল দেবো ভাবি, কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে৷ বাথরুমের দরজা খুলতেই সেই মিষ্টি গন্ধটা নাকে আসে৷ ভগবান জানেন, কোন এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করে এরা৷ ঘরে ঘরে স্প্রে করে গেছে কখন এসে! ভালো করে প্রত্যেকটা ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে এসেছি এবারে, যাতে ফোনটা বাজলেও শুনতে না পাই৷ বেশ পুরু পুরু বার্মাটিকের দরজা৷ এবারে লেখাটার একটা হিল্লে করতেই হবে৷ এমন সুযোগ আর কবে পাব? উচিত ছিলো সব পুজোর লেখা-টেখা এইখানে বসেই লিখব৷ এত নির্জনতা তো কলকাতায় তপস্যা করেও পাওয়া যাবে না! কিন্তু যেই খানিকটা এগিয়েছি অমনি মাথার মধ্যে ঝনঝন করে টেলিফোনের বাদ্যি শুরু হয়ে যায়৷ এবারে আমি মন ঠিক করেই যাই, রিসিভারটা নামিয়ে রেখে আসব৷ গেলে তো একবারও দেখছি না ফোন বাজছে৷ অথচ লিখতে বসলেই কানের মধ্যে ক্রিং ক্রিং৷ এইরকম টিলার ওপর নির্জন বাংলো বাড়িতে মধ্য রাত্রে ফোনটা বেজে ওঠাই তো উচিত—ছেলেবেলা থেকে যত ভূতের গল্প পড়েছি তাতে তাই-ই হয়—অথবা দোতলার জানলার কাচে মৃদু ঠকঠক—ওরে বাবা! কাঠে ঠকঠকটা এখনো অন্তত হয় নি—শুরু হয়ে যাবে না তো এবারে? কখন কাজ রেখে উঠে পড়ি—বন্ধ দোর ঠেলতে ঠেলতে আলো জ্বালতে জ্বালতে বড় ঘরে যাই—ঢুকতে গিয়েই মনে হয়, ওদিকে থেকে কেউ এগিয়ে আসছে৷ কোনো রকমে আলোটা জ্বেলে ফেলি, অস্থির কাঁপা হাতে৷ উল্টোদিকের মস্ত দেয়াল-আয়নায় দেখতে পাই, আমিই আমাকে সন্ত্রস্ত অভ্যর্থনা জানাচ্ছি৷ ঘর নিঃশব্দ৷ এই সুগন্ধেই মাথাটা ঝিম-ঝিম করছে কি? টেবিলে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ঘরে ফিরে আসি৷ শব্দ জব্দ৷ ফোন আর বাজবে না৷ সশব্দে নিঃশব্দে, কোনো প্রকারেই না৷ ঘরে ফিরতে ফিরতে টের পাই, এই এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধটায় কেমন যেন গা গুলোতে শুরু করেছে আমার৷ বাঙালি ঘ্রাণে এত সব সায়েবি কায়দা কি হজম হবার? গন্ধ বন্ধ করি কি উপায়ে?

রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক সত্তাটিকে না চিনলে তাঁর চিরকাতর বাঙালি হৃদয়কেও আমরা চিনতে ভুল করব৷ তাঁর বুকের মধ্যে—ওঃ—ওই যে এবারে বুঝি নীচেয় ফোন বাজতে শুরু করেছে! দরজা খুলে রেগেমেগে নামতে থাকি৷ দু’পা নেমেই দেখতে পাই, খাবার ঘরের দরজায় দুটি তালা ঝুলছে৷ আবার উঠে আসি৷ ও ফোন সারারাতই বাজবে৷ বাজুক৷ বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই৷ জাপানি উদ্যানের মৃদু আলোগুলো দপদপ করে জ্বলছে নিবছে৷ দেওয়ালীর টুনি-বালবের মতো ব্যবস্থা আর কি! আলোগুলো জ্বলে-নিবে জ্বলে-নিবে কাউকে যেন কিছু সংকেত দিচ্ছে৷ আমার পা-দুটোকে সজোরে বাগানের দিকে টানছে ওরা৷ এই পাহাড়ি বৃষ্টিতে তা বলে কিছুতেই বেরুচ্ছি না আমি, যতই ডাকো না তুমি আমাকে৷ ভিজে শেষে হাঁপানি হয়ে যাক আর কি! শক্ত পায়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়ি৷ আলোটালো সব নিবিয়ে দিই৷ লিখতে মন নেই৷

ইঁদুররা ছাদের ওপরে যত লাফায় এবারে, আমার তত আনন্দ হয়৷ ঐ তো বাবা, জ্যান্ত প্রাণী সব কত রয়েছে৷ আমি মোটেই এখানে একা নই৷ কেন জানি না, একা একা এত বড় বাড়ি বাগান উপভোগ করার উৎকট এবং গরিবি আহ্লাদটা হঠাৎ উবে গিয়ে কেমন একটা গা-ছমছম ভয়-ভয় ব্যাপারে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বাথরুমের সুগন্ধটা বড্ড যেন বেড়েছে৷ এ ঘরটাকেও ছেয়ে ফেলেছে৷ অদৃশ্য এয়ারকন্ডিশনারটি নির্ঘাৎ নীচেই চলছে কোনো তালাবন্ধ ঘরে৷ ফোনটা কি বাজছে? নীচে না পাশের ঘরেই? ফোনটা কোথায় বাজছে, বেজেই যাচ্ছে—নাছোড় ঘণ্টার শব্দ আমার তন্দ্রালস অর্ধচেতনার মধ্যে সাবানের ফেনার মতন বেড়ে বেড়ে চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে—মাঝে মাঝে তারই মধ্যে কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করছি, জানলার সার্সিতে খট-খট! তালাবন্ধ বড় আলমারিটা হঠাৎ খুলে যাবে না তো ঠাশ করে? আর এক কোণে সেই ‘কঙ্কাল’ সিনেমার মতন—? আজ কফিটা না খেলেই হত, কালকের নিদ্রাহীন স্নায়ুর ওপরে৷ এতদূর প্লেনে এসেছি, ট্রেনে এলে তো তিনদিন লাগত—তারও স্ট্রেন আছে—ওই, ওই তো খট-খট—না, ওটা ছাদে, ওটা সিলিঙের ফাঁকে ইঁদুরের নৈশভোজ—কিন্তু মাথার মধ্যে ফোনের শব্দটা যে থামছে না—বাড়তে বাড়তে দমকলের ঘণ্টির মতো ভয়ংকর, আরো বাড়তে বাড়তে মার্কিন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের মতো প্রচণ্ড মরীয়া শোনাতে থাকে—আমি দাঁতে দাঁত চেপে কম্বলের নীচে ঢুকে পড়ি, কান-মাথা-মুখ কম্বল-মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আপ্রাণ দমবন্ধ চেষ্টায় ইষ্টনাম জপ করতে থাকি৷ এটাই আমার প্রাত্যহিক নিদ্রাকর্ষণের প্রকৃষ্টতম পন্থা—(জীবনে শেষ পর্যন্ত দুশো আটবারও ইষ্টনাম গুনতে পেরেছি কিনা সন্দেহ!) মাথার মধ্যে এই শব্দ আমি আর শুনতে পারছি না, হে ভগবান, আমার শ্রবণে তুমি শান্তি দাও!

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল পাখিদের ডাকাডাকিতে৷ জঙ্গলে যে কতরকমের পাখিই থাকে, আর কতই মনমোহিনী তাদের কলকাকলি! তারই সঙ্গে এখনো ঝিঁঝি ডাকছে বনের ভেতরে—এই তো দিন হয়ে-এল-বলে! মাথাটা ভার ভার লাগছে৷ বারান্দায় বেরিয়েই মাথা হাল্কা হয়ে গেল৷ বৃষ্টি থেমে গেছে৷ কী সুন্দর সেজেগুজেই না সূর্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শৈলশ্রেণী৷

বারান্দা থেকে একদিকের বাকি দুটো ঘরেই বাইরের দরজায় বড় বড় তালা মারা—একমাত্র হৃদয়-হৃদয়েই যাওয়া-আসা করা যায়—যেটা আমি প্রায় গুরুকৃত্যের মতো নিষ্ঠার সঙ্গে সারারাত ধরে করেছি! কী মনে হল আবার, আমার ঘর দিয়ে মাঝের আটকোণা ঘর পার হয়ে বড় ঘরে যাই—ওই তো রিসিভারটা পাশে নামানো রয়েছে৷ ঘরে ঢোকার সময়ে দেওয়াল-আয়নায় আবার নিজেকে দেখতে পাই৷ খাটটা সত্যি মস্ত বড়—মাথার কাছে একটা টানা তাক৷ কী যেন নেই মনে হতে থাকে—ঠিক বুঝতে পারি না৷ খাটের মাথার কাছে ওই তাকে কী থাকার কথা ছিলো—এখনি হঠাৎ খেয়াল হয়, বাইবেল! হ্যাঁ, খাটের মাথার ধারে একটা বাইবেল থাকত নিশ্চয়—ওটা কি কালও ছিলো? গন্ধটা এবারে হঠাৎ চিনতে পারি৷ না আতরের নয়, বিলিতি ইনসেন্সের গন্ধ৷ গির্জেতে সে ধূপ জ্বলে সেই ধূপের৷ ঘরটায় গির্জের গন্ধ৷ কফিনের বাক্সে যে ধূপ জ্বলে, সেরকম৷ মনে কেমন একটা ভার নিয়ে পিছু হেঁটে বেরিয়ে আসি৷ ফোনের রিসিভারটাকে ক্রেডলে তুলে রাখা আর হয় না৷

বড়ুয়া চা নিয়ে আসে ট্রে সাজিয়ে৷—‘গুড মর্নিং মেমসাব৷ আপনার চা৷’

‘গুড মর্নিং বড়ুয়া৷ কাল রাত্রে বার বার একটা ফোন আসছিল!’

বড়ুয়া চুপ করে থাকে৷ ওর এই অভ্যেসটা আমার খুব খারাপ লাগছে৷

‘তোমাদের কোয়ার্টার থেকে শোনা যায় না রিং? রাত্তিরে?’

‘না, মেমসাব৷’

‘ফোনটা খুলে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই?’

‘উপরেরটা খোলা যায়, নীচেরটা যায় না৷’

‘আজ রাত্রে বরং রিসিভারটা নামিয়ে রেখে যেয়ো, নীচে-ওপরে দু’জায়গাতেই৷’

‘ঠিক আছে৷ ব্রেকফাস্ট সাতটায় দেব তো?’

‘হ্যাঁ৷ আচ্ছা বড়ুয়া, ওই জাপানি বাগিচার আলোয় কি টুনি-বালব লাগানো নাকি? আপনা-আপনিই জ্বলে-নেবে?’

‘বলতে পারি না মেমসাব, ওসব ব্যাপার মালী জানে৷’

‘আচ্ছা কাল রাত্তিরবেলায় নীচের তলায় কিসের একটা মেশিন চালু হল বলো তো?’

বড়ুয়া চলে যেতে যেতে ফিরে দাঁড়ায়৷ ভুরু কুঁচকে বলে—‘কই, কোনো মেশিন তো চালানো হয়নি রাত্রে?’

‘হয়নি? কিসের আওয়াজ হচ্ছিল তবে? কোনো এয়ারকন্ডিশনারে লুজ কনেকশন হয়ে নেই তো?’

‘না, মেমসাব৷’

‘কিম্বা আর কিছু? পাম্প সেট-টেট? ডায়নামো?’

‘না, মেমসাব৷’ বড়ুয়া মাথা নেড়েই চলে৷

কিন্তু আমি যে স্পষ্ট শুনলুম, সারারাত—খুব স্পষ্ট শুনলুম—

‘যাই হোক, জাপানি বাগিচার বাতিগুলো রাত্রে কিন্তু ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল!’

‘জ্বলছিল নাকি বাতিগুলো? ঠিক দেখেছেন?’ এবার বড়ুয়ার নির্বিকার মুখে স্পষ্টই চমক লাগে৷

‘কেন, তুমি জ্বেলে দাওনি?’

‘না, মেমসাব৷ ওসব মালী জানে৷’

পাগড়ি বাঁধা মালী বাগানে উবু হয়ে বসে খুরপি হাতে কাজ করছে৷ চায়ের কাপ হাতে বাগানে নেমে যাই৷

‘জাপানি বাগিচাটা ভারি সুন্দর করেছো!’

‘হম নহী বনায়া মেমসাব, ও অংগ্রেজসাহাব আপনা হাথসে বনওয়ায়া থা৷ উধরমে মৎ যানা মেমসাব—মিট্টি গিলা হ্যায় বারিশসে—’

‘জাপানি বাগিচার বাতি কি তুমি জ্বালিয়ে গিয়েছিলে কাল?’

বুড়ো মালী ঘোলাটে চোখ তুলে তাকিয়ে ফোকলা মুখে মিষ্টি করে হাসে৷ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে—‘বাত্তি হ্যায় নেহী মেমসাব, উয়ো ছোটা ছোটা বালব ইধর মিলতা হী নহী, জ্বলাউঙ্গা কৈসে?’

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বরফের বাতাস নেমে গেল৷ ইচ্ছে করল চিৎকার করে উঠি, কিন্তু সারা রাত্তিরই তো বাতি জ্বলেছে ওখানে! জ্বলেছে, নিবেছে, জ্বলেছে! কিন্তু মুখে কিছুই বলি না৷

আমি বুঝতে পারছি, এখন যদি বড়ুয়াকে জিগ্যেস করি, ‘বড়ুয়া, তুমি ঘরে ঘরে কোন এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করেছিলে বলো তো, গন্ধটা বড্ড কড়া ছিল৷’—বড়ুয়া নিশ্চয় বলবে—‘স্যরি মেমসাব, কিন্তু আমি তো কোনো স্প্রে লাগাইনি?’ যথাসাধ্য ঘ্রাণশক্তিকে তীক্ষ্ন করে আরেকবার গন্ধটা খুঁজতে চেষ্টা করি বাতাসে৷ পাওয়া যাচ্ছে না৷ জাপানি বাগানটি আজ সকালের আলোয় কেমন যেন ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছে৷ রাত্রে যে এ-ই মোহিনী মায়ায় পরীর দেশ হয়ে আমাকে ডাকছিলো, তা কে বলবে!

‘সুপ্রভাত! সুপ্রভাত! কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’ ব্রেকফাস্টে হোসেনের সঙ্গে চলে এলেন স্বয়ং ম্যানেজার মিস্টার চ্যাটার্জি এবং ফিনান্স অফিসার শ্রীনিবাসন৷

‘আরে আসুন, আসুন৷ না না, খুবই কমফর্টেবল—’

‘রাত্রে ঘুমটুম হয়েছিলো তো?’

‘খুব ভালো, খুব ভালো,—থ্যাংকিউ’—

‘বাংলোটা পছন্দ হয়েছে তো আপনার? মি. হোসেন অবিশ্যি বলেছিলেন, আপনি এখানে স্যাটিসফায়েড—আমি তবুও এসেছিলাম অন্য একটু সাজেসান নিয়ে—আমার স্ত্রীর খুব শখ আপনাকে একটু আমাদের বাংলো—এই বাংলোর ধারে-কাছে লাগে না, তবু সেটাও একটা অন্যরকম—টিলার ওপরে একটা ঝরনা আছে, একটা ছোট লেক মতনও আছে সামনে—চলুন না, যাবেন নাকি? আমার স্ত্রীর একান্ত অনুরোধ’—

‘অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু কেন মিছিমিছি ঝামেলা বাড়াবেন, বেশ তো আছি?—আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, এটাকে ম্যানেজারের বাংলো না করে গেস্ট হাউস করা হল কেন? এত সুন্দর বাগানটা!’

‘মানে—’ একটু গলাখাঁকারি দিয়ে নিয়ে বৃদ্ধ শ্রীনিবাসনই উত্তর দেন, ‘এটাই আগে ম্যানেজারের বাংলো ছিল, একটা রাদার আনফরচুনেট ব্যাপারের পর থেকে আর ম্যানেজারেরা কেউ এখানে থাকেন না৷’

‘তার মানে?’

‘টেড ম্যাথায়াস নামে এক অল্পবয়সী ইংরেজ ম্যানেজার এ-বাড়িতে মারা গিয়েছিল৷ তারই তৈরি এই টেরাসড গারডেন, তার নিজের হাতে করে গড়া ওই মডেল জাপানি বাগিচা, তার বাগদত্তা বউয়ের জন্যে উপহার৷ ছুটি নিয়েছিল, বিয়ে করতে দেশে যাবে বলে৷ এক রাত্তিরে ট্রাংক কলে হঠাৎ খবর এল—বউ অন্যের সঙ্গে ফ্রান্সে পালিয়ে গেছে৷ ম্যাথায়াস সাহেব খবরটা পেয়ে নিজের রগে গুলি চালায়৷ সেই থেকে অপয়া বাড়ি বলে কেউ এখানে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বসবাস করতে চায় না আর কি! আর যত আজেবাজে গল্প-গুজবও লোকে রটিয়েছে এই ফাঁকে, সেসব অবিশ্যি কিছু না৷’

চ্যাটার্জি বলেন—‘কিছু নয় ঠিকই, তবু শুনে-টুনে ভয়ও তো পায় দেখি লোকে৷ বয়-বাবুর্চিরাও ঐ অজুহাতে এখানে রাত্রিবাসটা করতে চায় না৷ সেবার এক ভদ্রলোক তো ভয়ঙ্কর ভয়টয় পেয়ে কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিলেন৷ কীসব শব্দটব্দ শুনেছেন, আলো-ফালো দেখেছেন, তাঁর সারারাত ঘুম হয়নি৷ হাইপার টেনসনের রুগী, সকালবেলায় সোজা ডাক্তারকে ডাকতে হল৷ সে এক কাণ্ড! সেই থেকে আমরা আর এটা তেমন ইউজ করি না৷’

যতসব ফার্টাইল ইমাজিনেশনের লোক—’ মহোৎসাহে বললেন হোসেনসাহেব, ‘এই তো ডক্টর দেবসেন দিব্যি ঘুমোলেন, কিছুই ডিসটারবড হননি৷ ওসব গল্পসল্প কাউকে বলাই উচিত নয় আগে থেকে৷’

‘কী, আমাদের কথাটা ভাবছেন একটু?’ চ্যাটার্জি বললেন—‘গিন্নির আবেদনটা মঞ্জুর হবে তো? আজ রাত্রে?’

আশা করি ওরা খেয়াল করেননি কখন আমার হাতের কাঁটা-চামচ স্থির হয়ে গেছে, অভুক্ত ডিম বেকনের প্লেটে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *