স্বপ্নের মতো

স্বপ্নের মতো

তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল
দূর সমুদ্রের ধারে বিদেশিনী,
কিছু দিন, কিছু অবসর কেটে গেল
স্বপ্নের ঘোরে, মনে যদি নাও থাকে
তোমার, লিখে রেখে যাই নিজের খেয়ালে
আমি রাজা নই, সামান্য নাগরিক
প্রেম ছাড়া আমাদের কোনো ইতিহাস নেই।

এত সংগীত কোথা থেকে আসছে! এই অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতে। আমার সেই গানের কলিটা মনে পড়ছে, নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়। অ্যান আর আমি গুটি-গুটি হাঁটছি। পাথর বাঁধানো বিশাল চত্বর। এদেশে মনে হয় পাথরের ছড়াছড়ি; যেমন আর্মেনিয়ায়।

অ্যান বললে, ‘বুঝতে পারছ, এ জায়গাটা কী? এটা হল মার্কেট প্লেস।’

চারপাশে সুন্দর সুন্দর দোকান। সব দোকানই এখন বন্ধ। কাঁচঘেরা দোকানের ভেতর নরম আলো জ্বলছে। সেই নরম আলোর মায়ায় সাজানো ভালো ভালো জিনিস। বিভিন্ন ভঙ্গির রহস্যময়ী ম্যানিকুইন। এত জীবন্ত যে, মনে হচ্ছে, এক্ষুনি নড়ে উঠবে। অ্যান আমেরিকার মেয়ে। তার কাছে এসব কিছুই নয়। আমার চোখে স্বপ্ন। ভালো জিনিস, মানুষের তৈরি মায়া দেখতে কার না ভালো লাগে। কল্পনা, রুচি, সৌন্দর্যবোধ সব মিলেমিশে একটা কল্পনার জগত তৈরি হয়েছে।

অ্যানও আমার মতো অবাক হয়ে দেখছে। হয় ভদ্রতাবোধে, না হয় আমার ধারণাই ঠিক, মেয়েটা পাগলি। সাজতে-গুজতে ভালোবাসে না। ন্যাকান্যাকা কথা বলে না। বড়োলোকি চাল নেই। ঘৃণা নেই। অহঙ্কার নেই। এইরকম একটা জায়গায় এসেছি সেই আনন্দে যেমন মাতোয়ারা, তার চেয়েও বেশি আনন্দে হয়ে উঠেছে অ্যানের সঙ্গ। সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো মেয়ে।

এক একটা দোকানের সামনে আমরা হাঁ করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছি। রং-বেরঙের ছেলেদের পোশাক। আকাপুলকো শার্ট। ক্যানক্যান ফ্রক। মেয়েদের জুতো। সুন্দর সুন্দর গহনা। মেকসিকোর হস্তশিল্পীদের তৈরি কাঁচের জিনিস, কাঠের পুতুল। অয়েল পেন্টিং। একটা দোকান আবার দোতলায়। রাস্তা থেকেই সাদা পাথরের অবারিত সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। আমি আর অ্যান ছাড়া কেউ কোথাও নেই। আমরা দু-জনে যেন স্বপ্নে শপিং করছি। অ্যান বললে, ‘ক-দিন তো খুব ভারতীয় দর্শন কপচাচ্ছিলে। এইবার আমি তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। স্বপ্নে মানুষ অনেক কেনাকাটা করতে পারে। টাকার লেনদেন হল—’

‘টাকা নয়। বলো পেসো। যে দেশের স্বপ্ন, সেই দেশের কারেন্সি।’

‘বেশ তাই হল। গোছা গোছা পেসো হাতবদল হল। মনে করো, তুমি আমাকে ওই ফ্রকটা পরালে। আমি তোমাকে পরালুম আকাশি রঙের ওই আকাপুলকো শার্টটা। এইবার ভোর হোল। ঘুম ভাঙল। সব ভোঁ ভোঁ। এইবার লজিকে এস। স্বপ্নের কোনো জিনিস যেমন জাগরণে থাকে না, শুধু অভিজ্ঞতাটাই থাকে, সেইরকম এই জীবনের কোনো জিনিসও পরজীবনে নিয়ে যাওয়া যায় না। তার মানে জীবনও এক দীর্ঘ স্বপ্ন। কোনো সন্দেহ নেই। এই মুহূর্তে প্রমাণিত। এখন রাত বারোটা। স্থান, ইসতাফা।’

‘ঠিক বলেছ। এ হল স্বপ্নের স্বপ্ন।’

অ্যান আমার কাঁধে হাত রেখেছে। দু-জনে পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দোকানে উঠছি। সামনে বারান্দা। কাঁচঘেরা বিশাল ঘর, মৃদু আলোয়, চোখ ভোলানো আয়োজন স্তব্ধ হয়ে আছে। ঘরের মাঝখানে একটি যুবকের মূর্তি; বিশাল সমব্রেরো টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, দোকানের মালিক, যাওয়ার আগে মন্ত্র পড়ে এক জীবন্ত প্রহরীকে স্থাণু করে রেখে চলে গেছেন। কাল সকালে এসে আবার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন।

বারান্দায় দু-তিনটে সোফা পাতা রয়েছে। আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। দু-জনে পাশাপাশি আরাম করে বসলুম। এখন তো আমাদের ছুটি। দু-জনেরই ছুটি। ছুটির মেজাজে ঘড়ির কোনো স্থান নেই। সময় গড়াচ্ছে গড়াক। গড়িয়ে যাবে কোথায়। এখনও তো সে-বয়স হয়নি যে, একটা দিন চলে যাওয়া মানে ভাবতে বসা, কবরের দিকে আরও একদিন এগিয়ে গেলুম। অ্যান ভেসে আসা ডিসকো সংগীতের তালে তাল মিলিয়ে কী একটা ইংরেজি গান গাইছে। মেয়ের অনেক গুণ। গানের গলাটি বেশ ভালো। অনেকটা পল ম্যাকার্টিনির মতো।

হঠাৎ আমার মনে হল, এইভাবে বসে আছি, পুলিশ এসে চোর বলে ধরবে না তো!

‘অ্যান, এইভাবে বসে থাকাটা বেআইনি নয় তো। পুলিশ এসে চোর বলে ধরবে না তো?’

‘এখানে চোরের উপদ্রব আছে বলে তোমার মনে হচ্ছে? কোথাও কোনো পাহারা আছে? এটাকে তুমি স্বর্গ ভেবে নিয়ে দেবদূতের মতো বসে থাকো।’

‘অ্যান, আমার যে খিদে পাচ্ছে।’

‘তোমার আর কী কী পাচ্ছে, একসঙ্গে বলে ফেলো তো, আমার লক্ষ্মীসোনা।’

‘ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে।’

‘আর কী পেয়েছে? ঘুম পেয়েছে?’

‘না ঘুম পাবার কোনো লক্ষণ নেই।’

‘খিদে আমারও পেয়েছে। কোথায় খাওয়া যায় বলো তো?’

‘কেন হোটেলে।’

‘হোটেলে খাবে। শেষে খরচ সামলাতে পারবে? চলো আমরা গানবাজনা লক্ষ্য করে এগোই। রাতের মাইফেল বেশ জমে উঠেছে। মনে হয় ওখানে খাবার পাওয়া যাবে।’

আমরা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। সামনে সেই পাথর বাঁধানো প্রান্তর। যেখানে ইতিমধ্যে আরও দু-একটি পরী উড়ে এসেছে। পরীর পুংলিঙ্গ কী? আমার জানা নেই। তারাও এসেছে। আমরা নীচে নেমে এলুম। বেশ কিছুটা অন্ধকারে হেঁটে আমরা একটা বাগান মতো জায়গায় এসে গেলুম। সামনেই একটা গুদামের মতো ঘর একটু উঁচুতে। বাঁ-পাশের খোলা জায়গায় ডজনখানেক ঝকঝকে মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর সমুদ্রের মতন বাজনা বাজছে। মাঝে মাঝে বাইরে আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের মতো। ডানপাশে লম্বা একটা দোকান। সেই আগের মতোই ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছে। সেই আলোয় থরে থরে সাজানো মায়া। দোকানের লম্বা ধাপ সাদা পাথরে বাঁধানো। কোথাও এতটুকু আবর্জনা নেই। ধুলো নেই। বেলুড়মঠের মতোই পরিষ্কার, পরিছন্ন, তকতকে।

হলঘরের পাশটিতে চারটে চাকা লাগানো সাদা রঙের বৃহৎ একটি বাক্স। তার গায়ে স্প্যানিশ ভাষায় বড়ো বড়ো কী একটা লেখা রয়েছে। বাক্সটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ। রূপ যেন ফেটে পড়ছে। আড়চোখে অ্যানের দিকে তাকালুম। বোঝার চেষ্টা করলুম, এমন চেহারার ছেলেটিকে দেখে তার কোনও ভাবান্তর হচ্ছে কিনা। মেয়েদের যা হয়ে থাকে। অ্যানের কিছুই হয়নি। সে আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, মেকসিকোর ছেলেমেয়েরা বড়ো সুশ্রী।

বাক্সটা একটা স্ন্যাকস কাউন্টার। নেচে-কুঁদে ক্লান্ত হয়ে, ছেলে-মেয়েরা বেরিয়ে এসে, বাক্সর সামনে ভিড় করছে, তরুণটি গরম গরম খাবার আর কোকাকোলা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। ছেলেটির সামনে, অল্প দূরে এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়েই আছে; কিছু খাচ্ছে না। পরনে অতি দুঃসাহসী পোশাক। সংক্ষিপ্ততম স্কার্ট। অতি নীচু গলার ব্লাউজ। নর্তকীর মতো সুঠাম শরীর। কুচকুচে কালো, চকচকে চুলে নিপুণ খোঁপা। ফর্সা মুখটি যেন পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে। চোখের যা স্বভাব! বারেবারেই মেয়েটির দিকে চলে যাচ্ছে। অকারণেই মন ভাবতে শুরু করেছে, মেয়েটি কে! কেন এখানে দাঁড়িয়ে! কলগার্ল নয়তো! মনকে এক ধমক লাগালুম, মন, তুমি কেন পবিত্রতা হারাচ্ছ। মেয়েটি তোমার বিষয় নয়। তোমার বিষয় সমুদ্র, ইতিহাস, লুপ্ত সভ্যতা, ধ্বংসাবশেষ।

অ্যান আমার কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘একটু চঞ্চল হয়েছ, তাই না!’

‘হয়েছিলুম। সামলে গেছি।’

‘ভেরি গুড। উইনার টেকস ইট অল।’

অ্যান সেই বিখ্যাত গানের কলিটি একবার গেয়ে উঠেই থেমে গেল। বললে, ‘খাওয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।’

‘বাকসোর ভেতর থেকে কী বেরোচ্ছে, অ্যান?’

‘হট ডগস হ্যামবার্গার।’

‘মাংস! অচেনা মাংস আমি খাব না, অ্যান।’

‘অত বাছবিচার করলে উপোস করে মরতে হবে। তুমি মাংস বাদ দিয়ে খোলসটা খাও।’

দুটো সুন্দর কাগজের প্লেটে তরুণটি অপূর্ব দক্ষতায় আমাদের খাবার পরিবেশন করল। আমরা দুটো বড়ো বোতল কোকাকোলা নিয়ে ডানপাশের দোকানের পাথরের ধাপে পাশাপাশি হেলান দিয়ে বসলুম। তরুণটির সামনে আপাতত আর কোনো খদ্দের নেই। পরিষ্কার তোয়ালেতে হাত মুছে সে তরুণীটির দিকে এগিয়ে গেল, তারপর হাত দিয়ে বেষ্টন করে সে কী নিবিড় চুম্বন!

আনসেনসারড ছবি দেখার মতো একটা অপরাধবোধে আমি চোখ সরিয়ে নিলুম। অ্যান বললে, ‘বুঝতে পারছ, ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক কী?’

‘আমি আর দেখছি না।’

‘ও, তুমি তো ভারতীয়। তোমাদের কাছে এসব অপরিচিত দৃশ্য। মেয়েটি হল ছেলেটির প্রেমিকা।’

ডিসকো সেন্টার থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। তার পোশাক আরও বিপজ্জনক। পোশাকের প্রতি কেন যে এদের এত অবহেলা! ভগবান সুন্দর শরীর দিয়েছেন বলে! মেয়েটিকে সামান্য সময় অপেক্ষা করতে হল; কারণ ছেলেটির আদর করা তখনও শেষ হয়নি।

আমাদের রাতের ডিনার বেশ জমে উঠেছে। দু-খন্ড রুটির মাঝখান থেকে মালমশলা বের করে করে অ্যানের পাতে তুলে দিয়েছি। কোকাকোলার চুমুকের সঙ্গে মেকসিক্যান ব্রেড অমৃতের মতো লাগছে। অ্যান জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি তো বাইরের আবরণটাই খেলে, আত্মা তো আমার পাতে। পেট কি ভরল? নাকি আরও গোটা দুই নেবো?’

‘আমার পেটের একটা কোণাও ভরেনি।’

অ্যান কোলার বোতলটা রেখে উঠে গেল। বিক্রেতার প্রেমিকাটির চেয়ে অ্যান লম্বা। দু-জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুণে অ্যানকে কত ভদ্র ও সংযত মনে হচ্ছে! প্রেমিকাটি শুধুই সুন্দরী। তার আলাদা কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। শুধুই আদর খাওয়ার জন্যে পৃথিবীর এই সমুদ্রপ্রান্তে জন্মেছে, কী এসেছে।

আমাদের বিল হল বারো হাজার পেসো। হাজার হাজার সংখ্যা শুনে ঘাবড়ে যেতে হয়। আসলে পেসোর একসচেঞ্জ ভ্যালু ডলারের হিসেবে খুবই কম। তাই এই অবস্থা। বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থায় পেসোর মর্যাদা খুবই কম। মুদ্রা-দুনিয়ার দুটি স্তম্ভ, ডলার আর পাউন্ড। বাকি সব চুনোপুঁটি।

অ্যান উঠে পড়ল, ‘চলো এবার দুনিয়া দেখি।’

‘তুমি তো বললে সমুদ্র দেখবে।’

‘রাত আরও একটু গভীর হোক।’

‘আর কত গভীর হবে গো। দুটো প্রায় বাজল।’

‘দুনিয়ার এই অর্ধে দুটো মানে সন্ধ্যে।’

অ্যান আবার আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে লাগল। চলেছে ওই জগঝম্প সংগীত-ঘরের দিকে।

‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’

‘ডিসকো।’

‘তোমার মাথা খারাপ! ওখানে কেউ যায়! পাগলের পাগলামি। তুমি কোনোদিন নেচেছ? নাচতে জান?’

‘নাচ জানার তো কোনো দরকার নেই। ওখানে কে আর নাচছে, সবাই তো শরীর দোলাচ্ছে। আমরাও দোলাব।’

‘অ্যান, তোমার আমার রুচিতে ও জিনিস সহ্য হবে?’

‘অভিজ্ঞতা তো হবে। ভয় পাচ্ছ কেন। ভয়ের কী আছে! হোয়াইল ইন রোম, বি এ রোমান। আরে আমি তো আছি তোমার পাশে।’

গোটা দশেক ধাপ ভেঙে আমরা সেই উঁচু হলঘরে প্রবেশ করলুম। লাল, নীল, হলুদ, সাদা রঙের আলোর চমকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ডানপাশে একটি কাউন্টার মতো, সেখানে বিস্ময়কর রকমের এক সুন্দরী বসে আছেন। তাঁর কাছে প্রবেশ দক্ষিণা দেবার ব্যবস্থা। তাঁর দু-কানে দুটি ইয়ার-রিং-এ বিদ্যুৎচমক। দুটি ঠোঁট করমচার মতো লাল। দু-জনের জন্যে চল্লিশ হাজার পেসো জমা করে অ্যান আমার হাত ধরে নেমে পড়ল ফ্লোরে। সেখানে তিন ডজন সুন্দর আর সুন্দরীর পাগলামি চলেছে। তাদের চেহারা, বেশবাস, অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল, পৃথিবীতে দেহ ছাড়া আর কিছু নেই। মোমের শরীর নৃত্য আর আলোর তালে তালে যেন গলে পড়ছে। প্রথমেই যে দুর্ঘটনা ঘটল, তা হল এক সুন্দরীর ভারী নিতম্বের ধাক্কায় আমি উলটে পড়ে গেলুম! পড়ে হয়তো যেতুম না, পালিশ করা মেঝেতে পা হড়কে গেল।

অ্যান আমাকে হাত ধরে ওঠাতে ওঠাতে বললে, ‘পড়েছ, বেশ করেছ, এখন মান-সম্মান বাঁচাতে নেচে ওঠ।’

নেচে নেচে ওঠা যায়! তবু চেষ্টা। আমার জ্ঞানবুদ্ধি মতো শরীরটাকে এদিক-ওদিক দোলাতে দোলাতে উঠে পড়লুম। হঠাৎ মনে হল, আমি কলকাতার ছেলে, কলকাতার রাস্তায় ঠাকুর বিসর্জনে কত ট্যুইস্ট-নৃত্য আমি নেচেছি। আমি নাচতে পারব না! মনে হওয়ামাত্রই আত্মবিশ্বাস এসে গেল। শুরু করে দিলাম ভূতের নৃত্য। অ্যান আমার পাশে সরে এসে বললে, ‘একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তালের দিকে নজর রাখ। ওয়ান, টু, ওয়ান, টু। কোমরের খেলা দেখাও। ওয়ান লেফট, টু রাইট।’

তাল আর ছন্দটা ধরে ফেললুম। আমাদের চারপাশে বুক আর নিতম্ব নাচছে। মাঝে মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে যাচ্ছি। অ্যান তখন টেনে বের করে নিচ্ছে। সমস্ত শরীরই ঘামে পিচ্ছিল। রক্তস্রোতে আগুন ছুটেছে। পেটে আড়াই বোতল কোকাকোলা গুপুক গুপুক করে গুপীযন্ত্রবাজাচ্ছে।

রাত প্রায় আড়াইটে তিনটের সময় আমরা ঘর্মাক্ত কলেবরে হোটেলে ফিরে এলুম। ভেবেছিলুম অ্যান বলবে, ‘চলো দু-দন্ড বিছানায় গড়িয়ে আসি।’ কোথায় কী। সেরকম কোনো প্রস্তাবই এল না মেয়ের মুখ থেকে। আর বলব কী, হোটেল যেন গমগম করছে। সারা হোটেলে একজনও বৃদ্ধ কী প্রৌঢ় নেই। লিফট নামছে, লিফট উঠছে। নতুন নতুন মুখ। সবাই ছুটছে হোটেলের পেছন দিকে।

অ্যান বলল, ‘কী হল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?’

‘অনেক রাত হল।’

‘রাত হল তো কী হল! তোমারই বা কী, আমারই বা কী! এইবার আমরা সমুদ্র দর্শন করব। মহাসিন্ধুর শেষ রাতের বার্তা শুনব।

আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলুম। বাঁ-পাশে দেয়ালে গাঁথা বিশাল অ্যাকোয়ারিয়ামে ভয় পাইয়ে দেবার মতো নানারকম মাছ খেলছে। এক-একটা মাছের চোখ দেখলে ভয় করে। মাছের চেয়ে মাছের চোখ বড়ো। ড্যাবাড্যাবা রাগী চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি মাছের চেহারা দেখে থেমে পড়েছিলুম। অ্যান হাত ধরে আলগা টান মেরে বললে, ‘চলে এসো। তোমাকে আমি হিংস্র পিরহানা মাছ দেখাব। সেই মাছের ঝাঁক একঘণ্টার মধ্যে আস্ত একটা ঘোড়া খাবলে খেয়ে ফেলতে পারে।’

নারকেল কুঞ্জের পাশ দিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে আমরা সুইমিং পুলে এসে পড়লুম। চারটে বিশাল সুইমিং পুল পাশাপাশি। ফালি পথ চলে গেছে মাঝখান দিয়ে। মাঝামাঝি জায়গায় পথ নেই। কেটে এপাশে-ওপাশে জল চলাচলের ব্যবস্থা। জলের ওপর একটা চারচৌকো পইঠা। লাফিয়ে পইঠার ওপর পড়তে হবে। সেখান থেকে লাফ মেরে পথে। মাঝারি মাপের একটা লাফ মারলেই হয়ে যায়, তবু ভয় ভয় করছে। অ্যান হরিণীর মতো লাফ মেরে ওপাশে চলে গিয়ে, দু’হাত বাড়িয়ে বললে, চলে এসো।’

জায়গাটা এত সুন্দর, ঝিরঝির নারকেলের পাতায় বাতাসের খেলা। চতুর্দিকে আলো। পরিচ্ছন্ন চার পাশ। ধবধবে রঙ করা সুইমিং পুলে একদল হোটেলকর্মী জল ভরছেন। পরিধানে হালকা নীল রঙের ইউনিফর্ম। কোথা থেকে জল আসছে জানি না। দুটো পুল ভরে গেছে। জল কানায় কানায় টলটল করছে। তৃতীয় আর চতুর্থটি চিনচিন করে ভরে উঠছে স্বচ্ছ পরিষ্কার জলে। যে-দুটো পুল ভরে গেছে, তার এপাশ-ওপাশ থেকে কর্মীরা ঝকঝকে লম্বা নলের মতো কী একটা যন্ত্র একবার করে ডোবাচ্ছে, আর তুলে নিচ্ছে, আবার ডোবাচ্ছে। যে-মাথাটা ডোবাচ্ছে তার মুখে একটা ঝাঁঝরি লাগানো। কী কেরামতি হচ্ছে কে জানে!

আমার লাফটা জাম্বুবানের সমুদ্র উল্লঙ্ঘনের মতো বিশাল হয়ে গেল। সোজা অ্যানের ঘাড়ে। দু-জনেই টলে জলে পড়ে যাবার মতো হয়েছিলুম। অ্যান আমাকে জড়িয়ে ধরে শরীরের ভারসাম্য ঠিক করার অবকাশে বললে, ‘তোমার কি সবই অদ্ভুত! তুমি কি ভাবলে লাফিয়ে প্যাসিফিক ক্রস করছ! দু-হাত ডিঙোতে দু-শো হাতের এক পেল্লায় লাফ।’

‘অ্যান, জলে ওরা কী যন্ত্র ডোবাচ্ছে?’

‘ওইটা! জল ডিসইনফেক্ট করছে, কত যত্ন নিচ্ছে দেখছ!’

আরও কিছুক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। জায়গাটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এপাশে-ওপাশে হাজার ঝকঝকে ডেক চেয়ার নিখুঁত করে সাজানো। পুল যেখানে শেষ, তার পাশে একটা চাঁদোয়ার তলায় কফি-বার। পাশ দিয়ে যেতে যেতে অ্যান বললে, ‘বুঝতে পেরেছি, তোমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘তোমার করছে না?’

অ্যান হেসে ফেলল। বিদেশি মেয়েরা ছেলেবেলায় চকোলেট খেয়ে খেয়ে দাঁত নষ্ট করে ফেলে। অ্যানের দাঁত খুব সুন্দর। বোধহয় নিম দাঁতন করে। সুইমিং পুলের দিকে মুখ করে আমরা দু-জনে দুটো চেযারে বসলুম। হাত-পা ছড়িয়ে। কাউন্টারের কফি-বালিকা কাগজের গেলাসে কফি এনে দিলে। অ্যান বললে, ‘তোমার গা থেকে তিন-চার রকমের সেন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে কেন? একসঙ্গে কত রকম মেখেছো?’

‘কোনও সেন্টই মাখিনি তো!’

‘তাহলে?’

‘আমার মনে হয়, ওই ডিসকো থেকে নেচে আসার ফল। যে যতবার জড়িয়ে ধরেছে, তার গায়ের সুগন্ধ শরীরে ঝুলে আছে!’

‘তোমার কেমন লাগল?’

‘সবটাই দেহের ব্যাপার। মনের কিছু নেই।’

‘ভন্ডামি করছ না তো!’

‘মাইরি বলছি।’

‘মাইরিটা কী?’

‘ওটা আমাদের ভাষার একটা সোয়্যারিং।’

কফির গেলাস দুটো যথাস্থানে ফেলে দিয়ে আমরা উঠে পড়লুম। ডানপাশে কিছু দূর এগিয়ে তিন ধাপ সিঁড়ি। নামব কী, শেষ ধাপে জল। জলে ভরা ছোট্ট একটা চৌবাচ্চা যেন। অবাক হয়ে অ্যানের মুখের দিকে তাকালুম। চৌবাচ্চার ওপাশেই বেলাভূমি, ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে। অনেক দূরে অন্ধকার আকাশের পটে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙছে!

জিজ্ঞেস করলুম, ‘অ্যান, পা দেওয়ার জায়গায় এই কায়দাটা কী?’

‘জুতো খুলে, হাতে নাও। এ হল জল-পাপোশ। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। সমুদ্র থেকে যখন আসবে, পায়ে বালি লেগে থাকবেই। ভেতরে আসার সময় এই জলে পা ডুবিয়ে আসতেই হবে। এই ছোট্ট জলাধারটির জন্যে ভেতরটা কত পরিষ্কার রয়েছে দেখেছ!’

জুতো বগলে আমরা সি-বিচে নেমে এলুম। চারপাশ থেকে বড়ো বড়ো ফ্লাড লাইট ফেলে বেলাভূমি আলোকিত করে রাখা হয়েছে। বাঁ-দিকে ভীষণ অন্ধকার। হোটেলের সীমানা ওইদিকে মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। ওই দিকেই পড়ে আছে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত সেই বহুতল ভূতুড়ে বাড়িটি। অন্ধকারে যতটা দেখা যায় তাতে মনে হচ্ছে, বেলাভূমি ওইদিকে আর সমতল নেই। ভূকম্পনে ঢেউ খেলে গেছে। তাকাতেই ভয় ভয় করছে। ঢেউ যখন বিকট গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন সাবানের মতো সাদা ফেনা আকাশের দিকে বহুদূর পর্যন্ত ঠিকরে উঠছে। আলোকিত দক্ষিণ দিকে যত দূর দৃষ্টি যায়, দুগ্ধশুভ্র সৈকতভূমি, ধনুকের মতো পড়ে আছে। ওদিকে পরপর অনেক হোটেল। ওদিকেই আছে টেনিস কোর্ট, গলফ কোর্স। অ্যান বললে, ‘এসো, দুটো মোচা টেনে নিয়ে খানিক শুয়ে থাকি। বড়ো মিঠে বাতাস। মোচাই বটে। পরপর ফাইবার গ্লাসের বড়ো বড়ো ডিঙি পড়ে আছে পাশাপাশি। একটাকে ধরে টানতে গেলুম। বেজায় ভারী। আমার অসহায় অবস্থা দেখে অ্যান এগিয়ে এল। আমি বললুম, ‘কী ভারী গো!’

অ্যান বললে, ‘হ্যামবার্গারের আত্মা বাদ দিয়ে শরীরটুকু খেলে, ভারী তো লাগবেই খোকা। সরো, সরে এসো।’

‘আমি এদিকটা ধরি।’

‘কোনো দরকার নেই। এক টানে আমি নামিয়ে আনছি।’

দুটো মোচা পাশাপাশি টেনে এনে, অ্যান বললে, ‘নাও চিৎপটাং হও।’

চিৎ হয়ে শোওয়ার পক্ষে জিনিসটা বেশ ভালোই। মাথাটা উঁচুতে রইল। বাকি শরীরটা গড়িয়ে নেমে গেল নীচের দিকে। শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখছি। বেলাভূমির বিস্তার দেখছি। মাথার ওপর মেকসিকোর আকাশ দেখছি। আবার বাঁ পাশে ঘাড় ঘোরালে অ্যানকে দেখছি। সুন্দর সুডৌল মুখ। সুগঠিত চিবুক। আর্য নাসিকা। টানা চোখ। চোখ দুটোয় বেশ বুদ্ধিদীপ্ত বাহার আছে। নরম কাপড়ের ফ্রক পরে আছে। লম্বা দুটো পা একটু আগের নৃত্যের ক্লান্তিতে এখন টান টান স্থির। জুতো নেই পায়ে। ধবধবে পাতা দুটো ফ্লাড লাইটের বিচ্ছুরিত আলোয় কেমন যেন অলৌকিক দেখাচ্ছে। অ্যানের চোখ দুটো খোলা। প্রায় ধ্যানস্থ। কথা বলার সাহস হল না।

আমাদের বাঁ-দিকে হাত দশেক দূরে বসে আছে দুটি ছেলে, দুটি মেয়ে। শীত নেই তবু তারা আগুন জ্বেলেছে। একটি ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্প্যানিশ গিটার বাজাচ্ছে। মেয়েদুটি খুব হাসছে। আর একটি ছেলে আগুনে কী একটা ঝলসাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখার পর অ্যানকে প্রশ্ন না করে থাকা গেল না।

‘অ্যান, তোমার ওপাশে আগুন জ্বেলে ওরা কী করছে!’

‘জীবন উপভোগ করছে। ওকে বলে বিচ-ফায়ার।’

‘কী ঝলসাচ্ছে, খরগোস?’

অ্যান ঘুরে তাকাল, ‘ভুট্টা ঝলসাচ্ছে। কর্ন।’

‘ভুট্টা? এখানেও ভুট্টা!’

‘এটা তো ভুট্টারই দেশ। গল্প শুনবে? ভুট্টার গল্প।’

আমি উঠে বসলুম। বিদেশে সমুদ্রের ধারে শেষরাতের গল্পের মতো জিনিস আছে? মোচার খোলে ঠিক মতো বসা যায় না। আমি নেমে শায়িত অ্যানের পাশে, ভুসভুসে বালিতে বসলুম, ধেবড়ে। আমার আধ হাত দূরে অ্যানের মুখ। সুগঠিত কপালের ওপর চুল উড়ে উড়ে পড়েছে। হালকা নি:শ্বাসে নরম জামার তলায় নরম বুকের ওঠাপড়া। পরিষ্কার সামুদ্রিক বাতাস, দামি হুইস্কির মতো নাকে ঢুকছে। স্পেশাল সাইজের গোটা চারেক তারা আকাশে থমকে আছে। ডানপাশে আরও চড়া আলোয়, একেবারে জলের কিনারায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠ হয়ে। তাদের পায়ের ওপর ঢেউ ভেঙে পড়ছে।

এত বড়ো ঢেউ বর্ষার পুরীর সমুদ্রেও দেখিনি। ঢেউ ভাঙার কায়দাটাও বড়ো অদ্ভুত। দূর থেকে আসছে আসছে, হঠাৎ একটা কাছাকাছি জায়গায় এসে, কামান গর্জনের মতো শব্দ করে লাফিয়ে উঠছে। বিশাল লাফ। প্রায় তিন চার তলা বাড়ির মতো। বাতাসে সামান্য দোল খেয়ে আছড়ে পড়ছে তটে। তখন এক সাংঘাতিক শব্দ। সমুদ্রের হিসেবে কোনো ভুল নেই। ঢেউ যেন ওলিম্পিকের এক একটি হার্ডল চ্যাম্পিয়ান। কোথায় হঠাৎ থেমে পড়ে নিখুঁত একটি লাফ মারতে হবে, নির্ভুলভাবে জানে। ঢেউ নয় তো, মায়ের কোলে ছুটে আসা দামাল দস্যি ছেলে। জানে, যে-ভাবেই আছড়ে পড়ুক না কেন, মায়ের কোল পাবেই।

অ্যান বললে, ‘তোমার পকেটে রুমাল আছে?’

‘আছে। পরিষ্কার। দেবো তোমাকে?’

দিতে হবে না, রুমালটা পুরো খুলে আমার মুখটা ভাল করে মুছিয়ে দাও, ভীষণ চটচট করছে। মেয়েদের সেবা করতে শেখো। তোমাদের শাস্ত্রেই বলে না, মেয়েরা হল দেবী।’

রুমালটা খুলে চিত হয়ে শুয়ে-থাকা অ্যানের মুখে চাপা দিলুম, তারপর বিউটি পারলারে কোলনে ভেজানো নরম তোয়ালে দিয়ে যেভাবে মোছায়, সেইভাবে মুছিয়ে দিলুম। রুমালের তলা থেকে অ্যান বললে, ঠিক হচ্ছে। বেশ হচ্ছে। একে বলে আয়েস করা। বুঝলে কিছু?’

রুমালটা তুলে নিয়ে গালে একটা আঙুল রাখলুম। না, আর চটচট করছে না। নাচতে গিয়ে আমরা ঘেমেছিলুম। তাইতে জড়িয়ে গেছে সমুদ্রের বাতাসের লবণ। আমাদের বাঁ-পাশে ছেলেটি মশগুল হয়ে গিটার বাজাচ্ছে। যে ছেলেটি বসেছিল, সে তার সঙ্গী দুটি মেয়ের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবতী যে, তাকে জড়িয়ে ধরে বালিতে শুয়ে আছে।

আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। বাঁ-পাশের বিচ-ফায়ার নিবে এসেছে। বাতাসে নেবা আগুনের ফুলকি বেলাভূমির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ছেলেটি গিটার রেখে সটান শুয়ে পড়েছে। মেয়েটি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। সমুদ্রের সমান অক্লান্ত গর্জন তটভূমির মানুষকে ধমকাচ্ছে।

অ্যান উঠে দাঁড়াল। মাথার ওপর দু-হাত টানটান করে শরীরকে ডাইনে-বাঁয়ে মোচড়ালো। মাথার চুলে ঝাঁকি দিল। বাতাসে তার রেশমি চুল উড়ছে। অ্যান বললে, ‘চলো, সমুদ্রে নামার সময় হয়েছে।’

‘সমুদ্রে? ওই ভয়ঙ্কর সমুদ্রে!’

অ্যান আমার হাত চেপে ধরল, ‘হ্যাঁ গো, ওই সমুদ্রে। চলো নাকানিচোবানি খেয়ে আসি।’

আমাকে টানতে টানতে অ্যান সমুদ্রের দিকে নিয়ে চলল। যেন বলির পাঁঠা হাড়িকাঠে চলছে।

সমুদ্র নয় তো, যেন বিশাল এক মুষ্টিযোদ্ধা। বেজায় এক একটা ঘুঁষির মতো ঢেউ এসে তটের মুখে পড়ছে। সাদা ফেনা গরম দুধের মতো ফুটতে ফুটতে আমাদের দু-জনের পায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো কিছু নয়। ঢেউ যখন উঠছে, তখন ঘাড় পেছন দিকে হেলে যাচ্ছে। টুপি খুলে পড়ে যাওয়া বিশাল অট্টালিকার কথা শুনেছি। টুপি খুলে পড়ে যাওয়া বিশাল ঢেউয়ের কথা শুনিনি; চোখে দেখছি। এমন বলশালী ক্রোধী জলবিস্তার আগে দেখিনি। সমুদ্রের তলভাগ উঁচু হলে এমন হতে পারে। আমার সে গবেষণায় প্রয়োজন নেই।

অ্যান বললে, ‘চলো নেমে পড়ি। জামাটা খুলে প্যান্টটা গুটিয়ে নাও।’

‘তুমি আমাকে মাপ করে দাও। এ যা ঢেউ, এক ঘুঁষিতে আমার দাঁত কপাটি খুলে ফেলে দেবে।’

‘তোমার লজ্জা করছে না! ওই দেখ গোটা-পাঁচেক বালক-বালিকা ঢেউয়ের মাথায় হিপির মতো নাচছে। আর তুমি ভয়ে মরছ!’

‘বাচ্চাদের হাড়গোড় নরম ভাই। ওদের আছড়ে ফেললেও কিছু হবে না। জান, আমাদের পাড়ার বোকাদা পুরী গিয়েছিল। ফিরে এল পুঁটলি বাঁধা তার হাড়গোড়। মালকোঁচা মেরে সমুদ্রে নেমেছিল। কোনো নুলিয়া টুলিয়া নেয়নি। প্রখন ঢেউ তুলে নিয়ে মারলে আছাড়। দ্বিতীয় ঢেউ টেনে নিয়ে গেল, তৃতীয় ঢেউ আবার তুলে আছাড়। শরীরের সব খিল খুলে গেল। গিয়েছিল বীরপুঙ্গব, ফিরে এল ঝুলঝুলে নাচের পুতুল হয়ে। তুমি ভাই আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

‘তোমার বোকাদা বোকা ছিল। সমুদ্রে স্নান আর স্কিপিং এক ব্যাপার। ঢেউয়ের সঙ্গে ওঠা, ঢেউয়ের সঙ্গে নামা। সিনক্রোনাইজেশান। নাও চলো। আরে ম্যান, আমি তোমার পাশে আছি। তোমার হাত ধরে থাকব। তোমাকে আমি মরতে দেব না।’

আমরা যখন কথা বলছি দু-জনে, তারই মধ্যে আমাদের পাশ দিয়ে কত যে বীর অকুতোভয়ে সমুদ্রে গিয়ে নামল! দেখেও আমার লজ্জা নেই। অ্যান বললে, ‘তুমি যদি স্বেচ্ছায় না নামো, আমি তোমাকে তুলে জলে ফেলে দেব। পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীকে ভয় পাচ্ছি। জীবনের এত বড়ো অভিজ্ঞতা না নিয়েই চলে যাব! হাজার হাজার ডলার খরচ করে এখানে লোকে আসছে ডাঙায় উটের মতো বসে থাকার জন্যে?’

হাসিমুখে ফাঁসি বরণ করার মনোভাব নিয়ে জামা-জুতো ফেলে জলে নামলুম। অ্যান সাবধানে আমার হাত ধরে আছে। তার কাছে অ্যাটলাণ্টিক, প্যাসিফিক কিছুই না। ওরা ওইভাবেই মানুষ। আমরা এইভাবেই অমানুষ। আমার আর ভাবা হল না। প্রলয়পয়োধি জলে। কামানের গর্জন। সারা পৃথিবীর জলরাশি গড়াম করে ভেঙে পড়ল ঘাড়ে। শুধু অনুভব করলুম নরম একটা হাত প্রদীপের সলতের মতো আমাকে উশকে দিল। জলের ঊর্ধ্বচাপে টুইয়ে উঠে গেলুম ওপরে, তারপর ঘপাত করে নেমে এলুম নীচে। চিনচিনে বালিতে পা ঠেকল আবার। বালি সরে সরে যাচ্ছে। সে এক বিচিত্র অনুভূতি। প্রথম ধাক্কাতেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল। সজ্ঞানে স্বর্গারোহণের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলুম। প্রস্তুতির আর সময় কোথায়, ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে। অ্যান বললে, ‘শরীটাকে অমন শক্ত করে রেখ না। আলগা করে জলে ছেড়ে রাখো। নিজেকে ভাব মাছ ধরার ফাতনা, ফিসিং ফ্লোট।’ কথা শেষ হবার সঙ্গেসঙ্গেই এক-ঝটকায় হুইশ করে আমরা ওপরে উঠে পড়লুম, যেন নাগরদোলায় চেপেছি।

সেই বিশাল অন্ধকার জলরাশির দিকে মুখ ফিরিয়ে আছি। অন্ধকার আকাশে গিয়ে ঠেকেছে টলটলে সমুদ্র। মনে হচ্ছে এই জলস্রোত যেন আকাশ থেকেই বেরিয়ে আসছে। ঢেউ যখন উঠছে তখন আকাশও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে শতসহস্র নাগের মত দুলছে কালো জল। তার গায়ে নাগের পোশাকের মতো চিকচিক করছে ফসফরাসের প্রলেপ। ওই মুহূর্তেই যা ভয়। জলের বিশাল পাঁচিল কখন কীভাবে ভেঙে পড়বে সেই আশঙ্কায় নিজের অনুভূতি ছোট্ট একটা নিরেট সুপুরির মতো হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় মনে সব সময় মৃত্যুর চিন্তা, বিদেশি মনে জীবনের দোলা। অ্যান ভাবছে এই তো জীবন, আমি ভাবছি এই তো মরণ। মাথার ওপর কালো আকাশ। ধকধক করে জ্বলছে শেষরাতের গোটাকতক তারা। কালো জল অনবরত উঠছে আর পড়ছে। এত অশান্ত যে, তার নাম কে রাখল প্রশান্ত!

ক্রমশ ভয় কেটে গেল। বেশ মজাই লাগছে। আমরা যেন ঢেঁকি। এই উঠছি, এই পড়ছি। অনবরতই কড়াক শব্দে ঢেউ উঠে গড়াম শব্দে ভেঙে পড়ছে। সমুদ্র-স্নানকে স্নান না বলে কুস্তি বলাই ভালো। একটা মিনিট সুস্থির থাকতে দেয় না। অ্যানের হাতে আমার হাত ধরা। ঢেউয়ের ওপর আমরা যখন ভেসে উঠছি, তখন অ্যানের সোনালি চুল ভেসে ভেসে আমার মুখ আর কাঁধে জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠিক এইরকম শেষ রাত আর কোনোদিন জীবনে আসবে না। এইরকম একটা অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির জন্য বারে বারে, জন্মাতে ইচ্ছে করে। মনে গুনগুনিয়ে উঠল একটা লাইন—জন্ম জন্ম সাধ যে আমার, মায়ের কোলে আসি আবার। পরের লাইনে আর যাওয়া গেল না, গ্লাক করে নোনা জল ঢুকে গেল মুখে।

সামনের দিগন্ত হঠাৎ চড়াক করে ফেটে গেল। দিনের ঠোঁটে আলোর হাসি। সুন্দরী ঊষার ঝিলিক মারা হাসি। সেই আলো মুক্তোর মতো সমুদ্রের আকাশছোঁয়া অংশে ঝরে পড়ল। অ্যান বললে, রাত শেষ, আমাদের চান শেষ। চলো যাই, চলে যাই। তটে উঠে আসাও এক কায়দা। শরীরকে ভাসিয়ে তুলে দিতে হবে ডাঙায়। সে দায়িত্ব পালন করবে ঢেউ।

আমরা উঠে এসে তীরে দাঁড়িয়েছি। জল সত্যিই গরম ছিল। এতটুকু শীত করছে না। বরং ভীষণ চাঙ্গা লাগছে। ভোরের বাতাসে গায়ের জল শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ একটা ভৌতিক কান্ড ঘটে গেল। আমাদের মাথার উপর দিয়ে পরপর কয়েকজন জীবন্ত মানবমানবী পরীর মতো উড়তে উড়তে সমুদ্রে ঝপাং করে গিয়ে পড়ল। বেশ ভয় গেয়ে গেলুম। হেলিকপ্টার নয়, জলজ্যান্ত মানুষ। ডানা ছাড়া, সশরীরে কিভাবে উড়ে গেল! আমাদের হোটেলের দিকে তাকালুম। সঙ্গেসঙ্গে, বহুতল বাড়ির উঁচু ছাদ থেকে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠল আরও কিছু মানুষ। মানুষের ঝাঁক আমাদের মাথার উপর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে নামল।

ছেলেমানুষের মতো, আমাকে অবাক হতে দেখে, অ্যান বললে, ‘অবাক হবার কী আছে। এর নাম বিজ্ঞান। পিঠে জেট ইঞ্জিন বেঁধে পুরো মানুষটাকেই ওরা আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে। চলো আমরাও যাই।’

‘তোমার কথায় আমি জলে নেমেছি। তোমার কথায় আমি আকাশে উড়তে পারব না ভাই। মাঝ আকাশেই আমি হার্টফেল করব।’

ভয় নেই, আকাশে থ্রিলার ফিল্মের ভিলেনের মতো ওড়ার ইচ্ছে আমারও নেই।’

হোটেলের ছাদে রোজ ভোরে একটা জমায়েত হয়। মানুষ ওড়াবার স্টেশন। কয়েক হাজার পেসো পেশ করলেই পিঠে একটা সিলিন্ডার মতো জিনিস বেঁধে স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দেবে। হাউইয়ের মতো সোজা আকাশে। তারপর গতিমুখ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কীভাবে অবতরণ হবে, কীভাবে গতি বাড়ানো কমানো যাবে, তা আমি জানি না। কারোকে জিজ্ঞেসও করিনি। কারণ এঁরা এত উৎসাহী ও সহযোগী যে, সেই বাঙালি প্রবাদ, হাতে পাঁজি, মঙ্গলবার কেন হবে ‘সেনর’। ধর ব্যাটাকে। বাঁশ পিঠে যন্তর। দে দম।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা নীচে নেমে এলুম। বেশ চড়া রোদ। ঝকঝকে গাছের পাতা বাতাসে কাঁপছে। তকতকে পথঘাট। ঝাঁক ঝাঁক বেদিং বিউটি, টুপিস কস্টুম পরে সমুদ্রের দিকে ছুটছে। আমাদের গতি সেই মার্কেট স্কোয়ারের দিকে। অ্যান সামান্য একটু সেজেছে। চোখে গগলস। এই সামান্য প্রয়াসেই তাকে মনে হচ্ছে হলিউডের অ্যাকট্রেস। অ্যান বললে, ‘তোমার সানগ্লাস নেই?’

‘ধুৎ আমার আবার সানগ্লাস! আমি ডাল, ভাত, পোস্ত-খেকো এক বঙ্গসন্তান। আমাদের দেশের বৈশাখের রোদের চেহারা জানো? আমার চোখে এই রোদ তো চাঁদের আলো।’

‘বেশি পাকা পাকা কথা বোলো না তো। আমিও কি ফোর্ডের মেয়ে! সমুদ্রে এলে চোখটা ঢেকে রাখাই ভালো। চোখের কোল দুটো কম কালো হয়।’

অ্যান তার কাঁধব্যাগে থেকে একটা সানগ্লাস বের করে আমার হাতে দিল, ‘নাও লাগিয়ে নাও।’ তার এই মমতায় আমার চোখে ছায়া নামল। চারপাশের দৃশ্যে একটা স্নিগ্ধতা ঘনিয়ে এল।

অ্যান বললে, ‘এবার বলো কেমন লাগছে?’

‘ভীষণ ভালো।’

‘তবে!’

অ্যান হনহন করে হাঁটছে। রাতের সেই পরী-নামা-অঞ্চল এখন অন্যভাবে জেগে উঠেছে। অনেক দোকানপাট খুলে গেছে। অনেক খুলছে। কিছু এখনও খোলেনি। রাতের সেই ডিসকো সেন্টার দিনে ঘুমিয়ে পড়েছে। দোকানে দোকানে সুন্দরী বিক্রেতা। এই জায়গাটা যেন মেয়েরাই চালাচ্ছে। রাতে আমরা যে-জায়গাটায় বসেছিলুম, সেখানে একটি পাথরের আসনে সুন্দর একটি দৃশ্য, এক যুবকের কোলে এক সুন্দরী যুবতী তার সুঠাম পা দুটি সটান তুলে দিয়েছে, আর যুবকটি দু-হাতে পদসেবা করছে। আমি অ্যানকে বললুম, ‘আহা রে, দেখছ অমন একটা মেয়েকে কীরকম বাতে ধরেছে!’ অ্যান উত্তরে, ঠাঁই করে আমার মাথায় একটা গাঁট্টা মারল।

খাওয়া তো পরের কথা রেস্তরাঁ দেখেই তাক লেগে গেল। মানুষের কল্পনা আর রুচিবোধেই পৃথিবীতে সুন্দরের জন্ম। আটকাঠ বন্ধ, কাঁচের দরজা ঠাসা আধো অন্ধকার একটা আদিখ্যেতা নয়। চারপাশ খোলা মনোরম উন্মুক্ত একটা পরিবেশ। মাথার ওপর সুদৃশ্য, কারুকার্যমন্ডিত একটা আচ্ছাদনী। চারপাশ দিয়ে চলে গেছে বাঁধানো একটা পথ। রেস্তরাঁর মেঝেটা পথের থেকে তিন ধাপ নীচুতে। চারপাশ কোমর সমান দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই ঘেরা জায়গায় সুন্দর সুন্দর টেবিল। প্রতিটি টেবিলের এদিকে একটা বড়ো সোফা, ওদিকে একটা বড়ো সোফা। দেওয়াল আর ওপরের আচ্ছাদনীর মাঝের ফাঁকা জায়গায় রৌদ্রোজ্জ্বল সামুদ্রিক প্রকৃতি চারপাশে ছবির মতো আটকানো। ঢুকেই ডানপাশে লম্বা একটা কাউন্টার। কাউন্টারে চারজন অতি সুন্দরী তরুণী, যেন গোয়ার আঁকা ছবির পট থেকে জীবন্ত হয়ে নেমে এসেছে। ঘেরওয়ালা স্কার্ট পরেছে। ফুলফুল নীচুগলার ব্লাউজ। ব্লাউজের হাত কাটা। কবিতার মতো দুটি বাহু লতিয়ে এসেছে। ভারতীয় মহিলাদের মতো কালো কুচকুচে চুলের এলো খোঁপা ঘাড়ের কাছে দুলছে। হাসি হাসি মুখ। কাউণ্টারের শেষ মাথায় আধুনিক কিচেন। ঠিক উলটোদিকে, মাঝামাঝি জায়গায় ছোট্ট একটা মন্দিরের মতো। সেখানে একটা গ্যাসের উনুন জ্বলছে। কন্দর্পের মতো দুটি যুবক সেখানে পাঁউরুটি তৈরি করছে। সারা জায়গাটা রুটি তৈরির অপূর্ব গন্ধে ভরে গেছে।

অ্যান আর আমি একেবারে শেষ মাথায়, ধারের দিকের একটা সোফায় পাশাপাশি বসলুম। অ্যান বললে, ‘স্প্যানিশ রেস্তরাঁর সবটাই টাটকা। আসন আর পরিবেশ থেকে শুরু করে রুটি পর্যন্ত। মানুষগুলো দেখেছে! কী অদ্ভুত ফ্রেশ!

রেস্তরাঁ প্রায় ভর্তি। সকলেই ছুটির দিনের বাহারি পোশাকে। কারুর কারুর মাথায় মেকসিক্যান টুপি। কোনো কোনো মহিলা নানা অলঙ্কারে সেজেছেন। দু-কানে লম্বা দুল। মাথা নাড়ার তালে তালে দুলছে আর ঝিলিক মারছে। পৃথিবীটা সত্যিই বড়োলোকের। এই ছবিতে হীন পোশাকের দরিদ্রের কোনো স্থান নেই। আমার যে সাজপোশাক, ‘গেট আউট’ বললে বেরিয়েই যেতে হবে। আমার নিজের দেশে যাঁরা জামাকাপড় তৈরি করেন, তাঁদের কেতা আছে, হাঁকডাক আছে খুব, মজুরির ঠেলায় অন্ধকার; কিন্তু তাঁরা প্যান্ট বানাতে বানান দো-চোঙা আর বুশশার্টের বদলে ফতুয়া। ফিটিং-এর কথা বললেই, জজসায়েবের মতো গম্ভীর মুখে বলবেন, আপনার শরীরে ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট।

আমাদের ঠিক বাঁ-পাশের টেবিলে এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী আর তাদের দুটি শিশু। ফুটফুটে দু-টি মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে কথা বলাতেই ব্যস্ত। স্ত্রীটি লাগদাঁই সুন্দরী। যে কোনও স্বামীর মাথা বিগড়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। স্বামী উলটো দিকে বসে ক্যামেরা তাক করছেন। কী করে ভালো ছবি হবে জানি না। পেছনে এক ফালি উজ্জ্বল আকাশ। গাছ, বাড়ির অংশ। ছোটো মেয়ে দু-টি সরে সরে আমাদের কাছে চলে এল। দুটি জীবন্ত পুতুল। অ্যানের চেয়ে আমার দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। অ্যানের সঙ্গে তাদের মায়ের বিশেষ তফাত নেই; কিন্তু গোটা রেস্তরাঁয় আমি মাত্র এক পিস। আমার গায়ের রং, আমার শরীর। টিপিক্যাল পশ্চিমবঙ্গীয় কুলপুরোহিত। শালগ্রাম শিলাটি ফেলে দোনলা আর বিলিতি ফতুয়া পরে মেকসিকান পাবে বসে আছি বিদেশিনীর পাশে।

সেই ফেয়ারি টেলস’-এ যেমন রঙিন ছবি দেখি, সেই রকম একটি মেয়ে প্রায় উড়তে উড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, কি খাব! পাউরুটি তো খাবই! এমন টাটকা রুটি কোথায় পাব! মেকসিকোর ডেয়ারি খুব উন্নত, মাখন অবশ্যই। তারপর! তারপরেই থমকাতে হল। এরপর সবই তো মাংস। অ্যান বললে, ‘আমেরিকান হলেও, সাতসকালে হাঁউ হাঁউ করে রাক্ষসীর মতো মাংস চিবোতে পারব না, তার চেয়ে প্যাসট্রিই ভালো, আর কফি।

মেয়েটি বলল, ‘এল পাহন, লা মাহন-তে কি-ইহা!’

অ্যান বললে, ‘সি।’

মেয়েটি বললে, ‘কা-ফে-সো-লো? পাস টে লেস?’

‘সি।’

মেয়েটি ভেসে ভেসে চলে গেল কাউন্টারের দিকে। বাচ্চা মেয়ে দু-টির একটি বসেছে আমার কোলের কাছে, আর একটি অ্যানের কোল ঘেঁষে। সব দেশের শিশুরাই একটু স্নেহ পেলে পরকেও আপন করে নিতে পারে। তাদের নানা প্রশ্ন: ইণ্ডিয়া দেশটা কেমন। বাঘ কোথায় কোথায় আছে। ভাল্লুক আছে কিনা! একটা হাতির কত দাম পড়বে? অ্যানকেও নানা প্রশ্ন। মাথা নেড়ে আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন করার সে কী ধরন! ওদের খাবার এসে গেছে। ভদ্রমহিলা মেয়ে দু-টিকে নিলেন। আমাদেরও খাবার এসে গেল। বেত দিয়ে বোনা সুন্দর বাস্কেটে গরম পাউরুটি। ওপর দিকে সোনালি বাদামি রং। বিশাল এক তাল মাখন। জেলি, বিস্কুট। সব সুন্দর পরিচ্ছন্ন করে সাজানো। আমার সবেচেয়ে ভালো লাগল বেতের বাস্কেটটা! কেবলই ভাবছি কি করে ওটাকে নিয়ে যাওয়া যায়।

‘অ্যান, এই রুটির বাস্কেটটা কেনা যায়?’

‘কিনতে হবে কেন, ওটা তুমি এমনিই নিয়ে যেতে পার। কিন্তু করবেটা কী?’

‘বেশ কেমন সাজিয়ে রেখে দেবো।’

‘ঠিক আছে যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।’

‘এইরকম একজন মেকসিক্যান মেয়ে আমাদের দেশে নিয়ে গেলে বেশ হয়। হাসি হাসি মুখ। পরীদের মতো দেখতে।’

‘স্প্যানিশ ব্লাড। রাগলে তোমাকে তুলোধনা করে দেবে সেনর। তোমার খাওয়াটা একটু বাড়াও, তা না হলে রোগা হয়ে যাবে, আর তোমার মা বলবেন, মেয়েটা আমার ছেলেটাকে রোগা করে দিয়েছে। অযত্নে! রুটিতে আর একটু বেশি করে মাখন মাখাও না। অমন কৃপণের মতো স্বভাব হচ্ছে কেন তোমার!’ ‘আমার মা নেই অ্যান, তিনি বহু বহু দিন আগেই আমার উৎপাতে চলে গেছেন। আর কৃপণ বলছ? ভারতে মাখন খাওয়ার শেষ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন এক অবতার, মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ। একালে ভারতে রুটির মাখন দর্শন করিয়েই খাওয়ার বিধি। সাহসীরা একটু স্পর্শ করায় মাত্র।’

‘কেন, দাম বেশি?’

‘মাখন আর সোনা প্রায় এক দাম। সব সময় পাওয়াও যায় না। ভেজালের উৎপাত আছে। তার ওপর হৃদরোগের ভয় আছে।’

আমার মা নেই শুনে অ্যানের বেশ খানিকটা ভাবান্তর হল। মা এমনই এক অস্তিত্ব, যা সবদেশের সন্তানের মনে একটা ভাবাবেগ তৈরি করে। রুটির একটা বড়ো টুকরোয় আচ্ছা করে মাখন মাখিয়ে আমার হাতে দিয়ে অ্যান বললে, ‘তোমার ওজন কমসে কম দশ কেজি বাড়িয়ে তোমাকে আমি দেশে ফেরাব, নো জোক। তোমাকে কেবল আমি বেকড পোট্যাটো, বিনস আর বাটার খাওয়াব আর খাওয়াব রেজিনস আর নাটস।’

ছায়াঘেরা রেস্তরাঁর বাইরে সোনালি রোদের নেশা জমছে। রোদ যে এইরকম ফলের রসের মতো মধুর হতে পারে, সে ধারণা আমার ছিল না। এখানে যাঁরা সমবেত হয়েছেন তাঁরা সকলেই জীবন-তপস্বী। বেঁচে থাকার আনন্দে বুঁদ হয়ে আছেন। যে যা করছেন, সবই পূর্ণপ্রাণে। যার ফলে গোটা এলাকায় ভিন্ন ধরনের একটা প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।

আমরা বেরিয়ে এলুম। রাতের স্বপ্ন দিনে একেবারে স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। আরব্যরজনীর একটা খন্ড কে যেন এখানে ফেলে রেখে চলে গেছে। পরিষ্কার পাথর বাঁধানো চত্বরে একের পর এক দোকান। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকলেই স্বপ্নের এলাকা। মেকসিকোর একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে। হয়তো সব দেশেরই আছে। মেকসিকোয় অত্যন্ত স্পষ্ট। আমেরিকা লোকসংস্কৃতির ওপর স্টিম রোলার চালাতে পারেনি। সর্বত্রই তা যেন ফুটে বেরোচ্ছে। যেকোনো দোকানে ঢুকলেই সবার আগে চোখে পড়বে, মেকসিক্যান জামার ছাঁট আলাদা। ট্রাউজারের কাট আদালা। মেয়েদের পোশাকের ধরন আলদা। অলঙ্কারের নকশা আলাদা। সমস্ত কিছুর মধ্যে মেকসিক্যান সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট।

ঝলমলে রোদের আলোতেই দোকান আলোকিত। শীতল ছায়াঘন শান্তির খেলাঘর। ক্রেতাদের চিৎকার চেঁচামেচি নেই। কোথাও এতটুকু বাড়তি শব্দ নেই। কোনো রেকর্ড বা ক্যাসেট প্লেয়ার অকারণে তপ্ত গান কানে ঢেলে দিচ্ছে না। বাজার, অথচ অসীম শান্তি। সমুদ্রের বাতাসের মতো সবাই পায়ে পায়ে ঘুরছে। দরজা ঠেলে ঢোকার সময় ক্লিং করে বেজে উঠেছে মেকসিক্যান ঘণ্টা। দোকানের ভেতরে কে জীবন্ত মেয়ে, কে ম্যানিকুইন সহসা বোঝার উপায় নেই।

সেলস গার্লস কেমন হওয়া উচিত, এইসব দেশেই শেখা গেল। তিনি তাঁর রূপ দেখাতেই ব্যস্ত নন। ব্যস্ত নন নিজেদের মধ্যে কথায়। আসলে মেকসিক্যান মধ্যবিত্ত মেয়েরা বাঙালি মেয়েদের মতোই মিষ্টি, সহযোগী স্বভাবের। একটু দুঃখী দুঃখী ভাব। কপালের ওপর উড়ু উড়ু চুল। মুখে একটা আন্তরিক হাসি। সাদামাটা পোশাক। গাঢ় রঙের স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ। চুলে বাঁধা রিবন। পায়ে মেকসিক্যান জুতো। এই জুতোর সঙ্গে খড়মের খুব একটা তফাত নেই। চলার সময় এই সুশ্রী সাধারণ মেয়েদের বড়ো আপনজন মনে হচ্ছিল। মেয়েদের কাছ থেকে এত আন্তরিক ব্যবহার আমাদের দেশে পাওয়া কি সম্ভব? কে জানে!

এই সব দোকানে গেঞ্জির কাপড়ে তৈরি বহু ধরনের পোশাক পাওয়া যায়। জামা প্যান্ট, গেঞ্জি প্রভৃতির দাম অবিশ্বাস্য রকমের কম। গেঞ্জির বুকে বড়ো বড়ো হরফে লেখা, ইসতাফা, কানকুন, আকাপুলকো। সবই জনপ্রিয় সমুদ্রনিবাসের নাম।

এ-দোকান, সে-দোকান করতে করতে আমরা এক সুইডস দম্পতির দোকানে ঢুকলুম। এ দোকানে শুধুই হস্তশিল্প সাজানো। দোকানের নামটি ভারি সুন্দর, ফ্লোরেন্স। বিশাল কাঁচের দরজা থেকে শুরু করে, ভেতরের প্রতিটি জিনিস যেন ঝকঝক করছে। লম্বা একটা গাউন পরে দীর্ঘকায়া এক মহিলা বসে আছেন। বব করা চুল। চল্লিশের ওপর বয়স তো হবেই। দেখেই মনে হল, মা বলে ডাকি। মহিলার স্বামী প্রৌঢ় হলেও বেশ সুন্দর স্বাস্থ্য। অতি অমায়িক। আমাদের বললেন, ‘কাম অ্যাণ্ড সি’। দেখেই মনে হয়েছিল এঁরা মেকসিক্যান নন, ইউরোপীয়। পরে জানা গেল, সেই সুন্দর সুইজারল্যাণ্ড থেকে দু-জন এখানে এসে দোকান খুলেছেন। ছবির মতো একটি দোকান। তেল রঙে আঁকা বড়োবড়ো পেন্টিং বিক্রি হচ্ছে। মেকসিকোর নিসর্গ দৃশ্য। পাকা হাতের কাজ। তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। ছবি আমাকে ভীষণ টানে। অ্যানও বেশ চিত্ররসিক। আমরা একটা ছবির সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়েছি। সুইশ ভদ্রমহিলা আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। চোখা বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। আমি হঠাৎ প্রশ্ন করে ফেললুম, ‘মাদার, এ ছবি কার আঁকা?’ ভদ্রমহিলা কেমন যেন হয়ে গেলেন। ভাবান্তর দেখে একটু ঘাবড়ে গেলুম। কিছু মনে করলেন না তো! মিনিট কয়েক স্তব্ধ থেকে মহিলা দু-হাত দিয়ে পরম আদরে আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে, রুদ্ধ গলায় বললেন—‘মাই সান।’ দু চোখের কোণে জল টলটল করছে। ‘মা’-ডাকে চোখে যে-জল নামে, সে-জল হল অন্তরের মুক্তো।

আমি অবাক হয়ে সেই দীর্ঘকায় সুইস মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলুম। তাঁর নরম মুঠোয় আমার হাত দুটি ধরা। চোখের কোণে জল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, মা আমি কী কোনো অন্যায় করে ফেলেছি?’

‘নো মাই সান। তুমি কোনো অন্যায় করোনি। তুমি আমার বেদনার স্থানে হাত দিয়ে ফেলেছ। আমার একটি ছেলে ছিল। একটিমাত্র ছেলে। আমার সেই ছেলে আল্পস একসপিডিশানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ‘বহু বহুদিন পরে আবার আমাকে কেউ ‘মা’ বলে ডাকল। তুমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে।’

কাচঘেরা দোকানে আলোছায়ার মমতায় এক বিদেশিনীর হৃদয়ে পৃথিবীর সনাতন মাকে আবিষ্কার, আমার কাছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চেয়ে বড়ো হয়ে রইল। অ্যান পেছন দিক থেকে ভদ্রমহিলার দীর্ঘ শরীর জড়িয়ে ধরল, যেমন আমাদের দেশে জীবনের অতি কোমল মুহূর্তে মাকে মেয়ে জড়িয়ে ধরে। ভদ্রমহিলা অ্যানের সুন্দর মাথাটা, তাঁর সিল্ক ঢাকা নরম বুকে চেপে ধরলেন। নরম উষ্ণতায় অ্যানের সে সুখ, সেই সুখ আমি আমার অনুভূতিতে ধরতে পারছি।

এসেছিলুম ক্রেতা হয়ে, কী নিছক দর্শক হয়ে, হয়ে গেলুম গভীর কোনো সম্পর্কের আপন জন। দেশে দেশে মোর ঘর আছে, কথাটা কত সত্য! ভদ্রমহিলা আমাদের হাতে একটা কার্ড তুলে দিলেন—কার্ডটা ভারি সুন্দর। এক টুকরো বাহারি প্লাইউড যেন। দোকানের নাম, ফ্লোরেন্স। মহিলার নাম ফ্লোরেন্স স্যান্ডেল। আর্ত ইয়া আর্তেসানিয়া অর্থাৎ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস। ঠিকানা অ্যাপারটাডো পোস্টাল-নাইনটিন। জিহুয়াতানেজো, ফোর জিরো এইট এইট জিরো। গুয়েররেরো। ইসতাফা-সেন্ট্রো কোমারসিয়াল লা পুয়েরটা। টেল (৭৪৩) ৪২৪৬২। কার্ডটা স্মরণ করিয়ে দিল, আমরা পৃথিবীতেই আছি। স্বর্গে নেই। হিংসা, দ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহের পৃথিবীতে হঠাৎ পড়েছে স্বর্গের ছায়া।

সেই সুইস মহিলা, আমার মা, পাশের টেবিল থেকে তুলে নিলেন, ঝকঝকে সোনালি রঙের একটা স্প্যানিশ মেডালিয়ান। আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘সান, দিস ইজ ফর ইউ।’ বেশ একটু অবাক হয়ে গেলুম। এক পয়সারও জিনিস কেনা হল না। উপহার! একটি চাবির রিং। অভিভূতের মতো গ্রহণ করলুম। মহিলা অ্যানের হাতেও অনুরূপ একটি চাবির রিং তুলে দিলেন। অ্যান ভারতীয় কায়দায় সেটিকে কপালে ঠেকাল। তারপর হাসিমুখে বললে, এইবার আমরা কিছু কিনি। এত সব লোভনীয় জিনিস চারপাশে!

মহিলা বললেন, ‘মেকসিকোর হস্তশিল্পের সেরা জিনিস আমার দোকানে। পছন্দ করো, আমি তোমাদের কেনা দামেই দেবো। টুরিস্টদের যে দামে দিই, সে দামে নয়।’

‘আপনার যে লোকসান হয়ে যাবে!’

‘লোকসান কেন হবে! লাভ হবে না। সারা বছর আমার দোকানে অনেকে আসে। লাভ আমি তাদের কাছে করব। তোমাদের সঙ্গে আমি ব্যবসা করতে পারব না।’

ভদ্রমহিলার স্বামী একটু গম্ভীর প্রকৃতির। তিনি দূরে ক্যালকুলেটিং মেশিনের সামনে বসে আপন মনে পাইপ খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধা হল। স্ত্রীর প্রতি এমন ভালোবাসা ইউরোপীয়দের মধ্যে সহসা চোখে পড়ে কি! ওঁরা তো পর্যায়ক্রমে ম্যারেজ, ডিভোর্স, ডিভোর্স, ম্যারেজেই অভ্যস্ত। সন্তানের মৃত্যু অবশ্যই একটা বড়ো রকমের আঘাত, তবু সুখী দাম্পত্য জীবন বলে, মুখে স্বর্গীয় একটা তৃপ্তি, একটা সুখের ভাব লেগে আছে। তাকালেই মনে হচ্ছে এক সাধককে যেন দেখছি। পরিধানে একটি ব্যাগি ট্রাউজার, সাধারণ একটা টি-শার্ট। আজকাল এই ঝোলর-ঝালর পোশাক বিদেশে খুব চালু হয়েছে।

আমরা দু-জনে প্রশস্ত সেই দোকানের ওপাশের কোণে চলে গেলুম। যাবার মতোই জায়গা। অসাধারণ সব কাঠের কাজ সাজানো রয়েছে। কাঠের টুকরো বা খন্ডের ওপর, শিল্পী খোদাই করেছেন, নানা কাহিনির সুপরিচিত চরিত্র। প্রথমেই যে মূর্তিটির ভীষণ আকর্ষণ অনুভব করলুম, সেটি হল ডন কুইজোটের। গাধার ওপর বসে আছেন আমাদের সেই প্রিয় যোদ্ধা। গাধাটা বোঝার ভারে ঘাড় কাত করে আছে। পিঠের দু-পাশে দুটো ভারী বোঝা। গাধাটাকে এমনভাবে করা হয়েছে, যেন হাঁটছে। তার টুকুসটুকুস চলনটি বোঝা যায়। ডন কুইজোটের মাথায় কোণা-মোড়া স্প্যানিশ টুপি। বগলে চেপে-ধরা দীর্ঘ একটা বর্শা। অদ্ভুত সুন্দর একটি কাঠ-খোদাইয়ের নমুনা। হলুদ-বাদামি রঙের ভার্নিস লাগানো।

আমি তো দেখেই কেনার জন্যে লাফিয়ে উঠলুম। এ বস্তু তো আমি আর কোথাও পাব না। স্মৃতি হিসেবে সারাজীবন কাছে রাখার মতো। গাধা যেন সত্যিই হাঁটছে। কে সেই শিল্পী, যার এমন হাতের কাজ!

অ্যান বললে, ‘ধীরে বৎস ধীরে! খুবই ভালো কাজ; তবে তুমি এটাকে কোনো ক্রমেই দেশ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে না। কোনো খোঁচা জিনিস তোমার চলবে না। যেই ব্যাগে ভরবে, চাপ লেগে এই বর্শাটা ভেঙে যাবে। ভেঙে যাবে সুন্দর টুপিটা। তুমি বরং এই বুল ফাইটারটা নাও। এটাও একটা সুন্দর কাজ।’

সত্যিই সুন্দর কাজ। স্প্যানিশ বুলফাইটার। মাথায় কাউবয় হ্যাট। সামনে লাল কাপড়টি দু-হাতে দুলিয়ে ধরেছে। রাগী ষাঁড়টি তেড়ে আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্ত। যোদ্ধার মুখে তীক্ষ্ণ, নিষ্ঠুর এক অভিব্যক্তি। কাঠের সেই মূর্তিটি কিনে ফেললুম। ইচ্ছে ছিল মেকসিক্যান নর্তকীদের গ্রূপটাও কিনব। সাহসে কুলোল না। সব সময় ভেবেচিন্তে খরচ করতে হচ্ছে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ফুরিয়ে গেলে, হয় ভিক্ষে, না হয় অ্যানের সাহায্য। শুকনো মুখে সরে এলুম। এবার যেখানে এসে দাঁড়ালুম, সেখানে শুধু ছবি। সুন্দর সুন্দর অয়েল পেন্টিং। কে সেই শিল্পী?

অ্যান বললে, ‘দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে আসি।’ অ্যানকে আর যেতে হল না। এগিয়ে এলেন ফ্লোরেন্স স্যান্ডেল। বললেন, ‘বড়ো ভালো শিল্পী। ভদ্রলোক মেকসিক্যান, নাম এডইউন মোজেস। তোমরা যদি চাও, পরিচয় করিয়ে দিতে পারি! তেমন প্রচার নেই। প্রচার চানও না। আমি যতটা পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি। তোমার কোনো ছবিটা পছন্দ আমাকে বলো; আমি তোমাকে প্রেজেন্ট করব।’

‘না মাদার। একটা ছবি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, আমি পুরো দাম দিয়ে কিনব। কিনব, শিল্পী আর শিল্পকে ভালোবেসে।’

অ্যান আমাকে সমর্থন করল, ‘ঠিক, ঠিক বলেছ।’

ফ্লোরেন্স বললেন, ‘তুমি বুঝি ছবি ভালোবাস! তাই তোমার স্বভাব এত কোমল।’

এডউইন মোজেসের আঁকা ইসতাফার গ্রামের একটা ছবি কিনলুম। তেলরঙে আঁকা বেশ বড়ো ছবি। এ-দেশ হলে কিনতে পারতুম না। দশ বারো হাজার টাকা দাম পড়ে যেত। দাম পড়ল তিরিশ হাজার। টাকা নয় পেসো।

‘অ্যান, তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে! আমাদের দেশে তোমার মতো মেয়েরা হাতে একটা কিছু পরে। বেশ দেখায়। তোমাকে একটা উপহার দেবো। খুব ইচ্ছে করছে।’

‘বেহিসেবী কাজ করো না। আমি যখন ভারতে গিয়ে তোমার অতিথি হব, তখন আমাকে তুমি একটা সিল্কের শাড়ি কিনে দিও।’

‘তাহলে তুমি একটা কিছু কেনো।’

‘দাঁড়াও, আমি একটা গাউন কিনি। ফ্লোরেন্সকে গাউনে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না! মেয়েদের পোশাক মেয়েদের মতোই হওয়া উচিত। আমরা কি যে ছাই পরে ঘুরে বেড়াই!’

ফ্লোরেন্স থেকে আমরা যখন বেরিয়ে এলুম, তখন মন্দ বেলা হয়নি। ঝাঁঝালো মধুর মতো দিন। মেকসিকোর এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। সারা বছরই রোদ। গায়ে সানট্যান লোশান মেখে বিশ্বসুন্দরীরা সাদা বেলাভূমিতে ওলট-পালট খান। চোখে সানগ্লাস। হাতে ড্রিংকসের বোতল।

অ্যান বললে, ‘তুমি কিছু খেতে চাও?’

‘তুমি কী কিছু খেতে চাও!’

‘না।’

‘তাহলে পরে হবে। পেট ভার।’

সমুদ্রের ধারে তখন জমজমাট ব্যাপার। মেমসাহেবদের চড়ুইভাতি। সমুদ্রের ঢেউয়ে থিকথিক করছে কলো কালো মাথা। কালো নয়, বাদামি, সোনালি মাথা। এমনভাবে সব শুয়ে আছে, তাকাতে লজ্জা করে। এরা নিজেরা লজ্জাটাকে কীভাবে জয় করল কে জানে! লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, তিনটেকে জয় করতে পারলে মানুষ সাধক হয়ে যায়।

অ্যান বললে, ‘এইভাবে আমি যদি দেহে একটু রোদ লাগাই তোমার আপত্তি হবে?’

আমি একটু থমকে গেলুম। অ্যানকে আমি এমন বাজারি অবস্থায় দেখতে চাই না। বললুম, ‘তুমি একজন পন্ডিত মানুষ। তোমার কি উচিত হবে! তুমি মদ খাও না, সিগারেট খাও না। আলাদা ধরনের একটি মেয়ে। আমাদের দেশের মেয়েরা এমন করে না অ্যান। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি বলার সাহস নেই; কারণ তুমি ফু: করে উড়িয়ে দেবে। আমি ডন জুয়ান নই।’

‘তুমি একটা বোকা। কিছুই জান না। কিছুই বোঝো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। দৈহিক নয়। ভালোবাসায় দেহ নেই। আমি তোমার মনটাকে ভালোবাসি। যে মন শিশুর মতো সব কিছু জানতে চায়। তোমার মানিব্যাগটা কোথায়?’

কোন কথা থেকে কোন প্রশ্নে!

‘কেন, আমার ব্যাগ, আমার কাঁধ-ব্যাগে।’

‘ওই আনন্দেই থাকো। তোমাকে ভালোবাসার আর একটা কারণ হল, তুমি অসহায়। ব্যাগটা বেমালুম দোকানে ফেলে চলে আসছিলে। ভাগ্যিস আমি নজর রেখেছিলুম, না রাখলে কি হত!’

‘মাই গড। অ্যান, আমার আর কিছু বলার নেই। তুমি হলে সেন্ট অ্যান। আমি তোমাকে…।’

‘ব্যাস! আর বোলো না। তোমার ব্যাগ, আমার ব্যাগে রইল। তোমার মতো বেহিসেবি, সরল ছেলে আমাদের মুলুকে বিরল। আমাদের দেশের ছেলেরা বড়ো বিষয়ী। বড়ো পাকা।’

হঠাৎ আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল অন্য দিকে। এরা আবার কারা! পিঠে অক্সিজেন সিলিণ্ডার। মুখে মুখোশ। চোখে গগলস। পায়ে মাছের পাখনার মতো দুটো কি। সারা শরীর রবারের মতো পোশাকে মোড়া।

‘অ্যান ওই দেখো। কী বলো তো?’

‘স্কুবা ডাইভার। ডুবুরি। ওরা এখন সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যাবে। তুমি যাবে?’

‘গিয়ে কি হবে?’

‘সমুদ্রের তলায় জীবন দেখবে। কতরকমের মাছ। সামুদ্রিক গাছপালা, ঝিনুক। শামুক। সাপ! সিন্ধুঘোটক, সি-আর্চিন। তিনের চার ভাগ জল। জলে যা আছে, যত রকম আছে, স্থলে তা নেই। রাজী থাক তো বলো। ব্যবস্থা করে আসি।’

‘মাফ করো রানি।’

‘সমুদ্রের তলার জীবন তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?’

‘না। আমার পড়তে ইচ্ছে করে। ছবি দেখতে ইচ্ছে করে। অন্যের চোখেই আমার দেখা হোক।’

‘বাঁ-দিকে, যে জায়গাটায় বিশেষ কেউ যাচ্ছে না, যে দিকে ভূমিকম্পে ফুটিফাটা বিশাল-হোটেল বাড়িটা স্মৃতি চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে, আমরা সেই দিকে এগিয়ে গেলুম। সমুদ্র ওদিকে আরও উত্তাল, আরও ভয়াবহ। ঢেউয়ের লম্ফঝম্ফ অনেক বেশি। এদিকে রোদে ফেলে রাখা নগ্ন শরীর নেই বলে, সমুদ্রই পুরো দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পরিত্যক্ত হোটেল-বাড়ির সমুদ্রের দিকের সমস্ত আধুনিক আয়োজন যেমন ছিল, ঠিক সেইরকমই আছে। নির্জন জনশূন্য তটভাগ হাজার মানুষের জলক্রীড়ার স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে। একদা হেথায় বিরামবিহীন মহাওঙ্কার ধ্বনি উঠত। মানুষ ত্যাগ করলেও, সমুদ্র স্থানটিকে ত্যাগ করে সরে যায়নি। অবিরত ঢেউয়ে ঢেউয়ে অস্থির করে তুলছে। হোটেলে একটা টেনিস লন ছিল। জোড়া জোড়া সুইমিং পুল শুকনো খটখটে হয়ে পড়ে আছে। কফি ও বার কাউণ্টারের ছাদটা উল্ট পড়ে আছে একপাশে। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অতীতকে দেখলুম। ছিল এখন আর নেই। এই সত্যটাই তো কবিতা।

অ্যান আবার চলতে শুরু করল। আমাদের ডান পাশে অনবরত ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। মাঝে মাঝে ছেঁড়া ফ্যানা গায়ে এসে জড়িয়ে যাচ্ছে। জলকণায় আমার চশমার কাঁচ থেকে থেকে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এখানে রোদের রং হলুদ নয় সাদা। অ্যানের ওপর-বাহু সমুদ্রে ভাসমান লবণে চট চট করছে। কোথায় যে চলেছি আমরা!

আরও অনেকটা হাঁটার পর আমরা একটা ধ্বংসাবশেষের কাছে চলে এলুম। কি ছিল, কে জানে? প্রাচীন দুর্গ, বাতিঘর! সমুদ্র একটু একটু করে গ্রাস করে নিয়েছে। ঢেউ সোজা এসে আছড়ে পড়েছে ধ্বংসস্তূপে। খাঁজে খন্দে ফেনার বুড়বুড়ি উঠে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন সোডার বোতল খুলছে অদৃশ্য কোনও হাত। আগ্নেয় শিলায় গাঁথা হয়েছিল একদা। কালো তার রং। জায়গায় জায়গায় লালের ছোপ।

একটা ধার দিয়ে অ্যান টকটক করে ওপরে উঠতে লাগল। এই আশঙ্কাই করেছিলুম। এরপর আমাকেও উঠিয়ে ছাড়বে। হলও তাই। বেশ কিছুটা উঠে আমার দিকে ফিরে তাকাল। একটা পা নিচের খাঁজে, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললে, ‘উঠে এসো, উঠে এসো, অসাধারণ দৃশ্য। জীবনে দেখনি তুমি।’

আমার ডান হাত নরম মুঠোয় ধরে অ্যান আমাকে এক টান মেরে ওপরে তুলে নিল। দু-জনেই থমকে গেলুম। যেটাকে আমরা স্প্যানিস আমলের প্রাচীন কোনো ধ্বংসাবশেষ ভেবেছিলুম, সেটা যে আসলে কী, তা নিয়ে দু-জনেরই সন্দেহ দেখা দিল। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কোথাও কোনো পরিচয়লিপি লাগিয়ে রাখেনি। বিশাল একটা গহ্বরের কিনারায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি ভয়ে ভয়ে। গহ্বরের ভেতরটা অন্ধকার। কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ গবেষণার পর অ্যান বললে, ‘এটা মনে হয় আগ্নেয়গিরি।’

‘কি যে বল না তুমি! আগ্নেয়গিরি মানে বিশাল একটা ব্যাপার। চার হাজার, পাঁচ হাজার ফুট উঁচু ভয়াবহ একটা জিনি। এটা মনে হয় একটা পাতকুয়ো।’

‘সমুদ্রের ধারে পাতকুয়ো! এটা একটা শিশু আগ্নেয়গিরি।’

‘যাই হোক, আমার ভীষণ ভয় করছে। চলো আমরা নেমে যাই।’

‘আবার ভয়! আগ্নেয়গিরি হলেও মৃত। এসো, আমরা এখানে কিছুক্ষণ বসি। এখান থেকে সমুদ্রটাকে বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে।’

পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। বসতেই হল। সমুদ্রের দিকে মুখ করে। সমুদ্র কেন ক্ষণিকের তরেও শান্ত হতে পারে না! কি বিশ্রী স্বভাব। কোনো সমুদ্র-বিশেষজ্ঞ থাকলে প্রশ্নটা করতুম। অ্যান বললে, ‘চকোলেট খাবে?’

‘কোথায় পেলে?’

‘প্লেনে। আমারটা জমিয়ে রেখেছিলুম।’

চকোলেট খেতে খেতে অ্যান বললে, ‘মেকসিকোকে এক সময় বলা হত, নিউ স্পেন। কত বড়ো জান! ফ্রান্স আর স্পেনের চেয়ে চারগুণ বড়ো। ইউ কে-র আটগুণ। সোভিয়েট রাশিয়ার একের বারো ভাগ। একটা ত্রিভুজের মতো পড়ে আছে। ত্রিভুজের ভূমিটা হল আমেরিকার সঙ্গে উত্তরের সীমানা। দক্ষিণে, একটু পশ্চিম ঘেঁষে ইয়ুকাটান পেনিনসুলায় ঢুকে আছে ত্রিভুজের মাথা। আর দক্ষিণে তেহুয়ানতেপেক থেকে শুরু হয়েছে মধ্য অমেরিকার যোজক, যুক্ত করছে বিশাল দুটি মহাদেশ।’

আগ্নেয়গিরি কিনা জানি না, তবে খড়খড়ে গহ্বরের পাড়ে বসে, সুস্বাদু চকোলেট খেতে খেতে ভূগোল শিখতে বেশ ভালোই লাগছে। এইসব যোগবিয়োগ কোথায়, কত দূরে হয়ে আছে, তা জানি না। উত্তরে আছে গিলা আর কলোরাডো নদীর সঙ্গম। সবচেয়ে বড়ো নদীটির নাম সানতিয়াগো। সুউচ্চ গিরিকন্দরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে আমার অচেনা সেই বিশাল নদী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই নদী মেসো আমেরিকার এক প্রাকৃতিক অবরোধ। নদীর একদিকে মেকসিকো আর মিচোয়াকানের কৃষিজীবী মানুষের বসবাস অপর দিকে বন্য শিকারীদের অবস্থান।

বেশি উঁচুতে উঠিনি, অল্প একটু উঠেই মেকসিকোকে এত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কেন? একেই কি বলে স্থানমাহাত্ম্য! আমেরিকার মূল ভূখন্ডটিই যেন বেড়াতে বেড়াতে মেকসিকোয় এসে ঢুকেছে! আমার যদি অর্থ ও শারীরিক ক্ষমতায় কুলোতো, তাহলে একটা তেজী ঘোড়া কিনতুম, একটা বড়ো টুপি, আর একটা কাউবয় পোশাক; একটা নয় দুটো ঘোড়া। আমি কালো, সেই কারণে আমার জন্যে একটা সাদা ঘোড়া আর অ্যান ফরসা, সেই কারণে তার জন্যে তেল চুকচুকে, কুচকুচে কালো রঙের একটা ঘোড়া। তারপরে দু-জনে মিলে উত্তর থেকে শুরু করতুম। ইঞ্চি ইঞ্চি করে দেখে নিতুম ভূগোলের পরম বিস্ময়, এই বিচিত্র ভূখন্ডটিকে। তিনটি তিন ধরনের ভূ-প্রকৃতি উত্তর থেকে নেমে এসেছে দক্ষিণে। গালফ অফ মেকসিকোর সমতটভূমি, রকি মাউণ্টেন, আর দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকার সুউচ্চ মালভূমি। আমাদের যাত্রা শুরু হবে একটু ওপর দিকে থেকেই। পারলে বেরিং সমুদ্রের তীর থেকেই আমরা ঘোড়া ছোটাব, যে পথ ধরে এসেছিল এশিয়ার মঙ্গোলীয়রা। আমরা পাহাড় ধরেই আসব। এত বিশাল পর্বতশ্রেণী আর আমরা কোথায় পাব! একদিকে পাহাড় একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত তটরেখাকে ভগবান একেবারে প্রাণ ঢেলে সাজিয়েছেন।

‘মাউণ্ট ম্যাককিনলে, বুঝলে অ্যান, প্রায় ছ’হাজার ফুট। সেইখান থেকে, আমি সাদা ঘোড়ায়, তুমি কালো ঘোড়ায়—আমাদের যাত্রা শুরু।’

‘মাউন্ট ম্যাককিনলে? সে তো বহু দূরে গো! আলাস্কায়। তুমি ও-নাম জানলে কি করে?’

‘তুমি আমাকে কী ভাব অ্যান? আমরা টেকসাস থেকে দুটো ঘোড়া কিনব, তারপর রকি মাউন্টেন রেঞ্জ ধরে নেমে আসব। মাউন্ট লোগান, মাউন্ট রোবসন হয়ে সেলকার্ক মাউণ্টেন। ভ্যাঙ্কুভারে সাত দিন বিশ্রাম। তারপর বিটার রুট মাউন্টেন রেঞ্জ দিয়ে গড়িয়ে নেমে আসল সল্টলেকে। সল্টলেক সিটিতে বিশ্রাম। তারপর আসব সেই জায়গাটায়, নাম শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়, ডেথ ভ্যালি।’

‘তার মানে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এলে। বা: বেশ সহজে আসছে তো!’

‘কল্পনার এই তো মজা! কল্পনা-অশ্বের চেয়ে বেগবান আর কী আছে অ্যান! কোথায় লাগে তোমার জেটপ্লেন। ডেথ ভ্যালিটা কী গো!’

‘ওর একটু ওপাশে, তার মানে দক্ষিণমুখো দাঁড়ালে, বাঁদিকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। মোজাভে ডেসার্টের উত্তরে ডেথ ভ্যালি। সমুদ্র থেকে ৮৪ মিটার নীচু একটি লবণ উপত্যকা। শুধু নুন পড়ে আছে। কিছুই জন্মায় না। গেলেই, তোমার মৃত্যুর ভাব আসবে। প্রাণী নেই, গাছপালা নেই। লবণের শুভ্রতা মৃতের চাদরের মতো ভূমিতে লুটিয়ে আছে। মৃত্যুর উদ্ভাসিত হাসি।’

অ্যানের বর্ণনায় আমার চোখের সামনে সাগর যেন শুকিয়ে গেল। শুধু লবণের বিস্তার। অ্যান বললে, ‘তা, তুমি ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অত ওপর থেকে কেন শুরু করলে?’

আধঘণ্টার মধ্যে আমরা আবার নীচে। সরাসরি মেকসিকোয় পতন। অ্যান একটা সেই প্রলয়ঙ্কর শব্দকারী, রথসদৃশ গাড়ি ভাড়া করল। আমরা গ্রামে যাব। সেখানে গিয়ে কোনও গ্রাম্য ভোজনালয়ে, মেকসিকোর সবচেয়ে নামি খাবার, টরটিলা খাব।

যে গাড়ি দেখে সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলুম, শেষে সেই রথেরই আরোহী হতে হল। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি দেখে অ্যান বললে, ‘ভয় নেই। এ-যন্ত্র স্কুটারের মতোই। আমি আস্তে চালাব।’

দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিল। থরথর কাঁপুনি। মেকসিক্যান ভূমিকম্পের মতো।

‘অ্যান, কেন বলো তো এত শব্দ হয়!’

গাড়ি ছুটছে। অ্যানের চুল উড়ছে। কপালে লিপস্টিকের সেই টিপ। দুর্দান্ত দেখাচ্ছে।

গাড়ি চালাতে চালাতে অ্যান বললে, ‘মেকসিক্যানদের সঙ্গে ভালো করে মেলামেশা করলে, চরিত্রের দুটো দিক দেখতে পাবে, দুটো বৈপরীত্য। কখনো ভীষণ রাগী, কখনো ভীষণ বিনয়ী, কখনো অতি সহযোগী, কখনো ভীষণ উদ্ধত, কঠোর, কখনো ভীষণ লাজুক, কখনও আবার নাছোড়বান্দা। এই স্বভাবকেই স্প্যানিশ ভাষায় বলে ম্যাচো। ইংরেজরা বলবে, মেল, ম্যাস্কুলাইন। পুরুষালি। এতেও সবটা প্রকাশ পেল না। মানুষের স্বভাব নয়, এইটাই হল কালচার। বিখ্যাত মেকসিকান লেখক অকটাভিয়ো পাজ এই চরিত্রের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন—‘আগ্রাসী, স্পর্শকাতরতা, অবশ্যতা প্রভৃতি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যাকে বলা হয় ম্যাচো, তা একটিমাত্র কথায় সুস্পষ্ট, পাওয়ার। শক্তি। ফোর্স। অ-শৃঙ্খলিত শক্তি। ডিসিপ্লিন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা, লাগামছাড়া ইচ্ছাশক্তি, যে-ইচ্ছে কোনো একটা নির্বাচিত পথ ধরে ছোটে না। ম্যাচো বা পাওয়ারের প্রকাশ ঘটে মানুষকে আহত করে, অপমান করে, ছোটো করে, মানুষকে মেরে। আমাদের চারপাশের জগৎকে আমরা নিরাপদ মনে করি না। কেন করি না, তা আমাদের ইতিহাস, আমাদের তৈরি সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। আমাদের পরিবেশ রুক্ষ, বিরূপ, বাতাসে ভাসমান অজানা একটা ভয় লুক্কায়িত। প্রকাশ জানা নেই। সেই কারণেই আমরা আমাদের মধ্যে গুটিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের প্রতীক হল ক্যাকটাস। সমস্ত জল ভেতরে সঞ্চিত। পাতা নেই, শুধু কাঁটা। সেইটাই হল বাঁচার কৌশল।’ মেকসিকোর মানচিত্রের দিকে তাকাও, দেখবে, এলোমেলো কিছু ভূ-খন্ড যেমন তেমনভাবে লেগে আছে। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। আর সৃষ্টির আদিকালে তাই ঘটেছে। সেই দেশের বাহন একটু বিকট শব্দ করতেই পারে। উলটেও যেতে পারে!

অ্যান, আমি ভয় পাব বলে, খুব সাবধানেই গাড়ি চালাচ্ছে। অচেনা, অজানা পথ সামনে ছুটেছে শিশুর মতো। হোটেল আর সমুদ্র এলাকা থেকে সরে আসার ফলে, প্রকৃত মেকসিকোকে যেন দেখতে পাচ্ছি। মাটির রং আমাদের দেশের মতো নয়। ঘাসের চেহারাও কেমন যেন অচেনা। গাছপালাও অপরিচিত। সমতল তো বলাই চলে না। জমির রং, কালচে কালচে। এই প্রথম, ট্যুরিস্ট ছাড়া মেকসিকোর এই অঞ্চলের প্রকৃত বাসিন্দাদের দর্শন পেলুম। ধনীর আন্তর্জাতিক ঘরবাড়ি নয়। যে অঞ্চলেই বসবাস করুন, পৃথিবীর সমস্ত ধনীর একই রকম ঘরবাড়ি, প্রাচুর্য, জীবনযাত্রার ঢং। এঁরা হলেন সাধারণ মেকসিক্যান। কারুর জীবিকা হয়তো হাতের কাজ, কারুর জীবিকা চাষবাস, মাঝ ধরা। দরজার সামনে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে আছেন মেয়েরা। সকলেই বেশ স্বাস্থ্যবান। মেকসিক্যান পরিবার নেহাত ছোটো নয়। স্ত্রী পুত্র কন্যা পিতা মাতা নিয়ে, সংখ্যায় বিরাট। সকলকেই দেখতে বেশ ভালো। মধ্যবয়সী পুরুষ আর মহিলারা একটু মোটার দিকেই। এঁদের খাদ্যে ফ্যাটের ভাগ বেশি।

‘অ্যান, টরটিলা জিনিসটা কি? কচ্ছপ?’

অ্যান হা হা করে হাসল। তার উড়ন্ত লম্বা চুলের মতো হাসিটাও বাতাসে উড়তে লাগল।

‘খেলেই বুঝতে পারবে, টরটিলা জিনিসটা কি।’

প্রশ্ন ছিল, করা গেল না। ফাঁকা মাঠের দমকা বাতাসে অ্যানের সমস্ত চুল আমার মুখে জড়িয়ে গেল। কয়েক গাছা আটকে গেল চশমায়। একেই বলে চুলে-চশমায় গাঁটছড়া।

আমরা বিকট শব্দ করতে করতে, সকলকে সচকিত করে, গ্রামীণ নিস্তব্ধতা খানখান করে, বিগতদিনের কনকুইসতাদোরের মতো একটি মৎস্যজীবীদের গ্রামে এসে, প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লুম। অ্যান যে ওইরকম আচমকা গাড়ি থামাবে, তা বুঝিনি। কোনো কিছু ধরে বসিনি। পড়েই যেতুম ঠিকরে, পাথুরে রাস্তার ওপর। অ্যান তৎপর বাঁ হাত দিয়ে আমার কোমরটা জড়িয়ে ধরে, পতন থেকে রক্ষা করল।

অ্যানের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, আধুনিক ক্লিওপেট্রা রথ থেকে নামছে। পশ্চিমবাংলার গ্রাম তো নয়; তাই সবুজ অনেক কম! কালচে মাটির, কালচে গ্রাম। জনসংখ্যা খুবই কম। মন-কেমন-করানো ধূসর উদার প্রান্তর, আকাশ ধরতে ছুটেছে। তবু অমেরিকার গ্রাম তো! তার একটা আলাদা ছিরি। পথের ধারে ছাইগাদা, আঁস্তাকুড় নেই। ঘিয়ে ভাজা নেড়ি কুকুর নেই। অলস মানুষের জটলা নেই। ছবির মতো একটা দুটো বাড়ি, কালো আকাশের নীচেই খইয়ের মতো ফুটে আছে। পর্দা-ঘেরা জানালায় জানালায় আলোর ইশারা। কোথাও বাজছে স্প্যানিশ গিটার। মাঝে মাঝে ভারী গলায় কেউ কেউ দুর্বোধ্য ভাষায় গান গেয়ে উঠছে। বড়ো মিষ্টি সুরেলা কন্ঠ। এদের সকলেরই গলায় পেপারওয়েটের ওজন! আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে গ্রামটাকে বোঝার চেষ্টা করছি। বুকে একটু শান্তির পরশ গ্রহণ করছি। বিশাল একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, সঙ্গে কোনো বোটানিস্ট নেই, তবে মনে হয় এই গাছকেই বলে রেডউড ট্রি।

বাতাসে গাছের ঝোলা ঝোলা পাতায় ঝুরু ঝুরু আওয়াজ। দূর আকাশে ছবির মতো আটকে আছে পর্বতশ্রেণি। গ্রামটা যেন বিশাল একটা কড়ার মধ্য থেকে জেগে উঠেছে। চারপাশের ভূমি বেশ উঁচু। আমাদের সামনের পথ নীচু হয়ে আবার ওপরে উঠে গেছে। আমার কন্ঠে আসছিল জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর সেই গান—‘ঘরে ঘরে আলো দেখে লাগে ভালো।’

গাছের ডালে ঝুলছিল সার সার ছাতা। একটা ছাতা খুলছে আর হুস করে উড়ে যাচ্ছে রাতের আকাশে, তারার সন্ধানে। একসঙ্গে এত বাদুড়, আগে দেখিনি। প্যারাট্রুপারদের মতো খুসখাস খুলে পড়ছে, আর বৃত্ত রচনা করে, অন্ধকারের জীব অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে হাসলুম, মনের কী বিমুগ্ধ অবস্থা! বিদেশে এসেছি বলে, বাদুড়ও এমন দর্শনীয়! হঠাৎ একটু ভয়ের ভাব এল, ওগুলো ভ্যাম্পায়ার নয় তো! অ্যানকে জিজ্ঞেস করলুম। অ্যান বললে, ‘অত সৌভাগ্য তোমার এই আমেরিকায় হবে না। যেতে হবে আরও দক্ষিণে, আমাজনের গভীর ভ্যাপসা অরণ্যে। প্রকৃত ভয়ের জায়গা তো ওইটাই। ওখানেই পাবে বিশাল পাইথন। পাবে পিরহানা। আস্ত একটা ঘোড়াকে, এক ঘণ্টায় কঙ্কাল করে ছেড়ে দেবে।

গাছতলায় আমাদের সেই প্রলয়ঙ্করী চতুশ্চক্রযানটিকে ফেলে রেখে, ধীরে ধীরে ঢালু পথ ধরে নীচে নামতে লাগলুম। কোথা থেকে হু-হু করে শীতল বাতাস আসছে, জানি না। শরীর একেবারে জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এ রাত যেন শেষ না হয়। ঘাঘরা পরা মেয়েরা হেঁটে চলেছে। কারুর কারুর মাথায় সুন্দর রিমওয়ালা টুপি। এক বৃদ্ধ পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলে ‘টুরিস্ত?’ অ্যান বললে, ‘সে।’

একাকী বয়েসের ভারে ন্যুব্জ সেই মানুষটি টুকটুক করে আমাদের সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। তার পরনে ঢোলা প্যান্ট। চেক হাওয়াই শার্ট। যখন হাঁটছে, ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। তার মানে, পকেটে একগাদা পেসো আছে। পেসোর মুদ্রা যেমন ভারী, তেমনি মোটা। ধাতুর শ্রাদ্ধ! মুদ্রা দেখলেই বোঝা যায়, এদেশে ধাতুর ঐশ্বর্যের শেষ নেই। দেশের ঠিক কোন অঞ্চলটায় আছে ওই সব খনি! একটা তৈলকূপ যদি দেখতে পেতুম! অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস। কাছাকাছিই আছে কোথাও!

অ্যান সেই বৃদ্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কোথাও ভালো একটা খাওয়ার জায়গা আছে কিনা, যেখানে দিশি খাবার পরিবেশিত হয়। বৃদ্ধের মুখটি ভারি সুন্দর। চামড়ার কুঞ্চনে দীর্ঘ জীবনের ইতিহাস। কপালে কে যেন হাল চাকিয়ে গেছে। অসংখ্য গভীর, অগভীর রেখা। খাড়া নাক। নীল চোখ। বৃদ্ধের কাঁধে ঝুলছে, অপূর্ব কারুকাজ করা একটা ব্যাগ। বৃদ্ধ অ্যানের মুখের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো।’

পথ আবার উঁচু দিকে উঠছে। দু-পাশে তরু-শূন্য বন্ধ্যা প্রান্তর। সেই গিটার আর গানের শব্দ ক্রমশই পিছনে চলে যাচ্ছে। আমাদের গতি বাতাসের বিপরীতে। দূরে দূরে টিপটিপ আলো জ্বলে উঠছে। একটা গাছের তলায় দুটো ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। এই গাছটাও আগের গাছের মতো বিশাল। মনে হয় বাওবাব গাছ। যেসব গাছের নাম পড়েছি, চোখে দেখিনি, সেই সব নাম লাগিয়ে, বেশ পুলকিত হচ্ছি।

পথের পাশের একটি বাড়ি থেকে প্রায় সাদা পোশাক-পরা একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। তার দু-হাতে তোয়ালে জড়ানো একটি শিশু। প্রায় আমাদের পাশে পাশেই মেয়েটি হাঁটছে। শিশুটি ঘুমে অচৈতন্য। বৃদ্ধ মেয়েটিকে কী একটা প্রশ্ন করলেন। মেয়েটি উত্তরে দু-তিনবার ‘মেডিকোস’ শব্দটি উচ্চারণ করল। সেই থেকেই অনুমান করলুম শিশুটিকে নিয়ে, তরুণী মা চলেছে ডাক্তারখানায়। এখানে গ্রামেও ডাক্তার আছেন। হয়তো ভালো হাসপাতালও আছে।

এমন সময় দূরে একপাল কুকুর ডেকে উঠল। আমি আচমকা আমার উল্লাস প্রকাশ করে ফেললুম, ‘এই কুকুর!’

অ্যান বললে, ‘কুকুরেও তোমার ভয়!’

‘ভয় নয়, আনন্দ! এখানেও তা হলে কুকুর ছাড়া আছে? এদেশে তো কুকুরের খুব আদর।’

‘ঠিক ছাড়া-কুকুর নয়। মনে হয় ওখানে কোনো ফার্ম আছে। কুকুরগুলো সেই খামারেই পাহারা দিচ্ছে।’

আমি মনে মনে আশ্বস্ত হলুম, যাক মেকসিকোর কুকুরও, অমাদের দেশের কুকুরের মতোই ডাকে। এইবার একবার দর্শন পেলে, চেহারাটা মিলিয়ে নিতুম। বিশ্বজুড়ে মানুষের হরেক ভাষা। অন্তরঙ্গ মেলামেশায় ভাষা এক বিরাট বাধা। বৃদ্ধটিকে কত কী জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। এই গ্রামের কথা। গ্রামবাসীর কথা। গিটার বাজিয়ে যারা গান গাইছে, তাদের কথা। বড়ো বড়ো গাছের কথা। ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির কথা, জাগুয়ারের কথা, বৃদ্ধের দীর্ঘ জীবনের কথা। তাঁর চলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, বৃদ্ধ নাবিক ছিলেন। নাবিকরাই এইভাবে দুলে-দুলে চলে, একেই বলে, সেলারস গেট। বৃদ্ধের হাতে, পিঠে, সারা গায়ে নিশ্চয়ই উল্কি আঁকা আছে। মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, শিশুটির কী হয়েছে? ভাষার জন্যে আমার সব প্রশ্নই, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কিন্তু কুকুরদের কী মজা! বিশ্বজুড়ে সব কুকুরেরই এক ভাষা—ঘেউ এউ, এউ। আমি না এসে, এখানে যদি আমাদের পাড়ার লালু আসত, তার কোনো অসুবিধেই হত না, সংযোগে। গগন ফাটিয়ে ঘেউকার ছাড়ত। আলাপ-আলোচনাটা ঝগড়ার লাইনে গেলেও একটা লেনদেন, একটা বোঝাপড়া হত। আমাদের বিভিন্ন ভাষাই আমাদের এই ব্যবধানের কারণ।

‘আমি একটা কুকুর দেখব।’

অ্যান বললে, ‘আবার একটা নতুন বায়না শুরু হল!’

কি করে অ্যানকে বোঝাই, কেন আমার কৌতূহল। বিদেশের কুকুর আর স্বদেশের নেড়ি কুকুরের অর্থনৈতিক বৈষম্যটা জানতে চাওয়া কি দোষের! মানুষ দেখছি, ঘরবাড়ি দেখছি, ভূ-প্রকৃতি দেখছি। হলদে ঠোঁটওয়ালা শক্তসমর্থ পাখিও দেখছি, গাছের ডালে। যার ঠোঁটের এক ঠোক্করে মাথার ঘিলু ছলকে যাবে। এদেশে, ওই ভয়ঙ্কর পাখির নাম টোকান। চিমটের মতো বাঁকা বিশাল ঠোঁট। রঙের বাহারও খুব।

আমরা বৃদ্ধকে অনুসরণ করতে করতে চলে এলুম সমুদ্রের ধারে। সমুদ্রকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। হু-হু করছে আকাশ। হিলহিলে বাতাস। সিরসিরে বালি। সমুদ্রের ধারে বেশ জমাট একটি জনপদের জটলা। হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। দু-দিকে দু-সার দোকান, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বালি ঢাকা পথ। নরম নরম আলো জ্বলছে। খোলা একটি জায়গায় বসেছে নাচের আসর। গোল হয়ে বসে আছে দর্শকের দল। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নাচছে। ব্যাঞ্জোর মতো কিছু বাজাচ্ছে আর-একটি ছেলে। তুমুল নাচ। মেয়েটি যখনি লাট্টুর মতো ঘুরছে, তার ঘাঘরা ছাতার মতো ফুলে উঠছে আর দর্শকরা সব উল্লাসে ফেটে পড়ছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেইখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, সমুদ্রের ধার বরাবর বাঁধা রয়েছে এক সার বড়ো-ছোটো নৌকো। বৃদ্ধ সেই নাচের আসরে বসে পড়ার আগে দেখিয়ে দিলেন, কোন দিকে আছে খাবারের দোকান।

আমরা সেই মত্ত আসর ছেড়ে, ফল, মাছ আর সবজির বাজারের ভেতর দিয়ে চলে এলুম রেস্তরাঁয়। জলজ উদ্ভিদ, মাছ আর ফলের গন্ধ মিশে, একটা প্রাচীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেন হাজার বছর পেছনে চলে গেছি। মৃদু মোলায়েম আলো। পানামা হ্যাট পরা খাড়া নাক আর লালমুখো বলিষ্ঠ মানুষ। স্বাস্থ্যবান মহিলা। খোলামেলা ব্যবহার। নাচের জিঙ্গল বেল। আকাশের তলায়, দেশে দেশে কত কী যে ঘটে!

কাঠের মেঝেওয়ালা, স্বল্পালোকিত রেস্তরাঁয় গিয়ে ঢুকলুম। ব্যস্ত-সমস্ত মহিলারা খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশনে ব্যস্ত। রেস্তরাঁর একটা পাশে যেন সিনেমা হচ্ছে। পাতলা সাদা কাপড়ের পার্টিশন টানা। তার ওপর প্রতিফলিত মুখের প্রোফাইল। হাতের ছায়া। আঙুলে ধরা তাস। পরদার ওপাশে তাসখেলা চলেছে। কোনো কোনো ঠোঁটে গেলাস উঠছে। নেমে আসছে। আমরা এপাশ থেকে ছায়া-নাটক দেখছি।

টেবিল চেয়ার টেনে বসতে বসতে অ্যান বললে, ‘গ্যাম্বলিং চলেছে। খেলবে নাকি?’

আমিও বসতে বসতে বললুম, ‘না বাবা। আমার সে সাহস নেই। ও হল টাফ মানুষের খেলা।’ মধ্যবয়সী এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী খেতে চাই।

অ্যান চোখ-কান বুজিয়ে বলে দিলে, টরটিলা। মহিলা এক গাল হেসে চলে গেলেন। অ্যান আমার বিপরীত দিকে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে। আমি বললুম, ‘কী হল? অমন চুপচাপ কেন?’

‘হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। মা এখন কী করছে।’

‘কী করছেন বলে মনে হয়?’

‘মনে হয় রান্না করছেন।’

‘তুমি এই টরটিলার সন্ধান পেলে কী করে?’

অপূর্ব সুগন্ধে প্রাণ ভরে যাচ্ছে। টরটিলা তৈরি হচ্ছে! তারই সুবাস। অ্যান তার সাইড-ব্যাগ থেকে একটা বুরুশ বারে করে, সোনালি চুলে বার কতক চালিয়ে নিল। ফুসফুসে চুল কি অত সহজে বাগে রাখা যায়। অন্ধকার প্রান্তরের ওপর দিয়ে উড়ে আসছে রহস্যময় মায়া সভ্যতার খেয়ালি বাতাস। নিমেষে চুল এলোমেলো। শেষে বিরক্ত হয়ে বুরুশ রেখে দিল। এখানে আসার পর থেকে একটা ভাব আমি কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। এই দেশের আকাশে, বাতাসে, ভূমিতে, সমুদ্রে, পাহাড়ে, অরণ্যে, বহুকালের একটা অভিশাপ যেন ফিকে কুয়াশার মতো ঝুলছে। মাঝে মাঝে একটা ভয়ের ভাবে গা কেমন করে উঠছে। যখনই ভাবছি, ত্রয়োদশ শতকে আমি যদি অ্যাজটেক রাজধানী টেনোকটিলানে জন্মে থাকতুম, তাহলে সেই জন্মে আমার কী অবস্থাই না হয়েছিল! মনে হয়, আমি একজন অ্যাজটেকই ছিলুম। নিজেকে কেমন যেন জাতিস্মর বলে মনে হচ্ছে। অ্যানকে এ-কথা বললে, মুখ বাঁকিয়ে আমাকে ঠাট্টা করবে। বাঙালির কল্পনাবিলাস এদেশের মানুষ কী চোখে নেবে কে জানে!

‘তোমার টরটিলা তৈরি হতে যে সময় লাগে, তাতে একটা সভ্যতার পতনও হয়ে যেতে পারে। তুমি তো এই সময়ের মধ্যে, প্রায় দু-শো বছরের ইতিহাস টেনে নিয়ে এলে।

জেনে রাখ, টরটিলা হল, ফাউন্ডেশান অফ দি মেকসিক্যান ডায়েট। বাড়ি তৈরি করতে গেলে যেমন ভিত স্থাপন করতে হয়, সেইরকম মেকসিকোর খানাপিনার ভিত গড়ে ওঠে টরটিলার ওপর। শুনেছি, তোমরা বাঙালিরা তো খুব ভোজনবিলাসী।’

‘ঠিকই শুনেছ।’

‘তাহলে ফর্মুলাটা তোমাকে বলে দিই, বাড়ি ফিরে তৈরি করার চেষ্টা করো। শুকনো ভুট্টার দানা প্রথমে জলে সেদ্ধ করবে। সেই জলে ফেলে দেবে, হয় একটু কাঠকয়লা আর না হয় সামান্য খাবার চুন। এতে ভুট্টার খোসা তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাবে। হাত দিয়ে ঘষলেই খোসা বেরিয়ে আসবে। এরপর খোসাহীন সেই সেদ্ধ ভুট্টার দানা শিলে ফেলে বাটবে। প্রয়োজন হলে মাঝে মাঝে একটু করে জল দেবে। এরপর ওই মন্ডটাকে খুব ভালো করে ঠেসে মাখবে। মেখে লেচি কেটে গোল গোল করে বেলবে! বেলে একটা হট প্লেটে ভালো করে সেঁকবে।’

‘হয়েছে, হয়েছে। তুমি আমাকে নতুন কী শেখালে! এই যে, আমি তোমার সামনে বসে আছি বিদগ্ধজনের মতো, দেশে গেলে, আমার হাল কী হবে শোনো। রোববার সকালে একগোছা র‌্যাশন কার্ড, গোটা কতক ঢাউস ব্যাগ আর গোটা দুই খালি টিন নিয়ে একটা দোকানের সামনে লাইন দেবো। ধরো, আমি দাঁড়িয়েছি পনেরো জনের পেছনে। মাথার ওপর খাঁ খাঁ রোদ।’

‘কীসের দোকান?’

‘র‌্যাশান শপ।’

‘তোমাদের ওখানে এখনও কী যুদ্ধ চলছে!’

‘আমরা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবস্থাটাকেই বহাল রেখেছি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর অসুবিধা হবে না। ও তোমরা বুঝবে না ভাই। ওই র‌্যাশান শপ থেকে আমি ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় চাল, গম, চিনি আর পাম অয়েল নেবো। আমাদের দেশের যারা বড়োলোক, তারা র‌্যাশানের চাল গম ছোঁয় না। পচা গুমো গন্ধ। এইবার গমটাকে আমি ফেলে দেবো গমকলে। কাঠিকুটি, মাটির ঢ্যালা, ইঁদুর, আরশোলার নাদি সব পিষে একপ্রকার প্রোটিন-মিকস ওই আটা, রোজ আমাদের পাকশালে, তোমার টরটিলার কায়দায় গোল গোল রুটিতে পরিণত হয়। সেই রুটি আর কুমড়ো কা ঘ্যাঁট।’

‘হোয়াট ইজ দ্যাট?’

‘এ ভেরি ভেরি স্পেশাল ইন্ডিয়ান ডেলিকেসি। পরপর সাতদিন খেলে বৈরাগ্য, শেষে সন্ন্যাসী। নাও তোমার ফর্মুলা বাতাও।’

‘ওই হট প্লেটকে মেকসিক্যানরা বলে, কোমাল্লি।’

‘আরে বলো না! আমরা বলি চাটু।’

‘আগুনের ওপর সেই কোমাল্লি চাপিয়ে লেচিগুলোকে হাতের চাপড়ে বড়ো করে সেঁকে নেওয়া হত। এই হল টরটিলার ফাউণ্ডেশান। এর ওপর করা হত যত কারিকুরি। নাও, আমাদের জিনিস এসে গেছে।’

অপূর্ব সুবাস। আমার নাকের ধার ঘেঁষে টেবিলে গিয়ে নামল। যেন ফ্লাইং সসারের অবতরণ। শঙ্কর মাছের মতো আকৃতি। বাদামি রঙ। তার ওপর ছড়ানো ঝুরোঝুরো টোম্যাটো, চিজ, আর লাল লঙ্কা। ভুট্টাকে দু’বার পাক করা হয়েছে। একবার সেদ্ধ করা হয়েছে, তারপর লেচি করে সেঁকা হয়েছে। ফলে তার একটা সুগন্ধ আছে। তার সঙ্গে মিশছে চিজ আর লঙ্কার গন্ধ। মাছ নয়, বিজাতীয় মাংস নয়, কী সুন্দর শুদ্ধ, সাত্ত্বিক একটা খাবার!

অ্যান বললে, ‘বুঝলে, বিজ্ঞানই বলো, জ্ঞানই বলো, অ-পরাবিজ্ঞানই বলো, সবই সেই ওপরওয়ালার কাছ থেকে নেমে এসেছে। অবতীর্ণ জ্ঞান। সেই সময় তো মানুষ কেমিস্ট্রি, কেমিকেল রিঅ্যাকশন বলতে গেলে কিছুই জানত না; অথচ কী সুন্দর একটা রাসায়নিক খেলা হয়েছে টরটিলায়। চুনের জলে ভেজাবার ফলে ভুট্টার যে বি-ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে আছে, সেই নিয়াসিন আর চুনের জলের ক্যালসিয়াম হাইড্রকসাইডের সুন্দর একটি বিক্রিয়া হয়েছে। এই বিক্রিয়ার ফলে নিয়াসিন সহজপাচ্য হয়েছে; শরীর খুব সহজেই বি-ভিটামিন নিতে পারবে। এমনিতে সিনথেটিক ভিটামিন শরীর নিতে চায় না। নব্বই ভাগই বেরিয়ে যায়। এই ন্যাচারাল ভিটামিনের পুরোটাই শরীর টেনে নেয় সহজে। দেখো, প্রাচীন পৃথিবীর বীররা কেমন কায়দা করে প্রোটিন, ভিটামিন আর ক্যালোরির ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। আগে প্র্যাকটিক্যাল, তারপর থিয়োরি আর ব্যাখ্যা।’

লঙ্কার পরিমাণ দেখে ভয় পাচ্ছিলুম। হয়তো ব্রহ্মতালু ছেঁদা হয়েই যাবে। ঝাল হয়েছে, তবে এমন নয় যে, মাঠ-ময়দান ভেঙে, ন্যাজ তুলে দৌড় লাগাতে হবে। আমেরিকার লঙ্কার সঙ্গে ভারতের লঙ্কা ‘পাইপার নাইগ্রাম-এর’ অনেক পার্থক্য। দুটোর জাত আলাদা। আমেরিকার লঙ্কা সি-ভিটামিনে ভরপুর। এখানকার লাল লঙ্কা বা ক্যাপসিকামের দুটো জাত—একটা হচ্ছে বড়, মিষ্টি, যাকে বলে সুইট বেল। অন্যটা হল ছোটো, চিলি। বড়ো লঙ্কা, সুইট বেল—কাঁচা আর সুবজ অবস্থায় সবজির মতো ব্যবহৃত হয়। আর একটা বিশেষ জাতের লঙ্কা আছে, পেকে লাল হলে, শুকিয়ে গুঁড়ো করে, ঝাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর নাম প্যাপরাইকা। সপ্তদশ শতকের গোড়ায় আমেরিকায় চল্লিশ জাতের লঙ্কা ছিল। মেকসিকোয় বর্তমানে বিরানব্বই জাতের লঙ্কা ফলে। অবাক কান্ড। এই জায়গার নামই দেওয়া উচিত ছিল শ্রীলঙ্কা। ভূগোলের ভুলে সেই নামটা গিয়ে পড়েছে আর এক দেশের ঘাড়ে।

টোম্যাটো এই দেশের আর একটি প্রিয় সবজি। এই দেশ কেন, টোম্যাটো সারা দুনিয়ার প্রিয়। টোম্যাটো প্রথমে এই দেশেই ফলেছিল, মেজের বা ভুট্টাখেতের আগাছা হিসেবে। যেমন আমাদের দেশের তেলাকুচো। আপনিই হয় অজস্র। স্প্যানিয়ার্ডরা যখন এল, তখন চাষ শুরু হয়ে গেছে। জাতেরও উন্নতি হয়েছে। আমেরিকা থেকে ইউরোপে যে টোম্যাটো গেল, তার রঙ হলদে। সেই কারণে টোম্যাটোর আদি নাম গোল্ডেন অ্যাপল। ভিটামিন এ আর সি-তে ভরপুর।

মধ্যবয়সী এক মেকসিক্যান মহিলা আমাদের সামনে এসে বসলেন। বুকে অ্যাপ্রন আঁটা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। টানটান করে চুল বাঁধা। সবসময় যেন হেসেই আছেন। সামনে বসার উদ্দেশ্য হল, আমাদের আহারের তদারকি করা। মহিলার কথা অ্যানই ভালো বুঝছে। খুব সামান্য ইংরেজি। বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে স্প্যানিশে। মাঝে মাঝে দু-জনেই হইহই করে হেসে উঠছে। কী রসিকতা হচ্ছে, কে জানে! মেকসিক্যানরা ভীষণ আমুদে। আমরা যেখানে বসেছি, সেইখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, জানলার বাইরে সমব্রেরো টুপি মাথায় একটি লোক, ভীষণ মাতাল হয়ে, গোল হয়ে ঘুরছে। বেশ লাগছিল দেখতে।

অ্যান আমাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘তুমি এদেশের আরক একটু খাবে নাকি?’

‘কী জিনিস সেটা?’

‘টেকুইলা।’

‘এদেশে এক ধরনের গুল্মের চাষ হয়, তার নাম হল অ্যাগেভ টেকুইলেরো। ইয়া মোটা মোটা শিকড় হয় তার। সেই শিকড় চোলাই করে তৈরি হয় টেকুইলা। এই টেকুইলা হল জাতির পানীয়, এক চুমুকে তোমার রক্তে আগুন ধরে যাবে। মেকসিকোর কঠিন, জলশূন্য মৃত্তিকায় পান্থপাদপের মতো এই রসাল গুল্ম খুব ভালোই জন্মায়। চওড়া চওড়া পাতায়, জল ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা। খাবে তো বলো।’

আমি আঙুল তুলে বাইরের মাতালটিকে দেখিয়ে বললুম, ‘ওই অবস্থা হলে কে সামলাবে!’

আমাদের সামনে বসে থাকা হাসিখুশি মহিলাটি বললেন, ‘ও আমার স্বামী। ও টেকুইলা নয়, রাম খেয়েছে। ওই রকম ঘুরতে ঘুরতে এক সময় পড়ে যাবে, তখন আমি তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেব।’

‘সেই কাজটা তো এখুনি করলেই হয়।’

‘এখন গেলে মারবে।’

আমাদের আর টেকুইলা পান করা হল না। বেরিয়ে এলুম স্বল্পালোকিত স্নেহনড়ী রেস্তরাঁ থেকে। অ্যান বললে, ‘এখুনি ফিরবে, না আর একটু ঘুরবে?’

আমি বললুম, ‘জীবনে তো এই একবারই আসা, নতুন কাপড়ের মতো নতুন মাটিরও অদ্ভুত এক আকর্ষণ, সহজে ছাড়া যায় না। চলো, আনাচে কানাচে একটু ঘুরে যাই।’

মধ্যরাতে ইসতাফার এই মার্কেটপ্লেস একেবারে নির্জন। খাবার দোকান ছাড়া অন্যান্য সমস্ত দোকান বন্ধ। বন্ধ হলেও, অন্ধকার নয়। কাঁচের ঘরে থরে থরে সাজানো পণ্যসম্ভার। নরম আলোয় উদ্ভাসিত। প্রাণহীন আয়োজনে দপদপ করছে প্রাণময়তা। ভেতরে ভেতরে কীসের যেন একটা ষড়যন্ত্র চলছে! রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির মতো। রাতের এই সব দোকানের স্বপ্নময়তা আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করছে। চলে যাবার পর, এই দোকানগুলোর কথা আমার ভীষণ মনে পড়বে! স্প্যানিশরা স্বভাবে নিষ্ঠুর ছিল। কত মেরেছে! কত ক্রীতদাসের রক্ত শোষণ করেছে। সভ্যতা লোপাট করে দিয়েছে। দিলেও, ভেতরে একটা সৌন্দর্যবোধ আছে। মায়া তৈরি করার ক্ষমতা আছে। এরা সাদা আর নীল রঙের খুব ভক্ত।

আমরা দোকানের সারির ভেতর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। জনপ্রাণী নেই কোথাও। না থাকলেও, মনে হচ্ছে আছে। কোথাও যেন সব লুকিয়ে আছে। হঠাৎ বেরিয়ে আসবে হইহই করে। স্প্যানিয়ার্ড বললেই, মনে হয় জলদস্যু। বুলফাইট। তলোয়ার। যত সব আকস্মিক, অদ্ভুত ঘটনার জন্যে স্প্যানিয়ার্ডদের দায়ী করতে ইচ্ছে করে। আর সঙ্গেসঙ্গে সেই অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে গেল। আমি আর অ্যান, দু-জনেই থমকে গেলুম।

বর্ম, শিরস্ত্রাণ পরিহিত এক সৈনিক, ফাঁকা মাঠে, রাতের আকাশের তলায়, আপন মনে, একা একা দাঁড়িয়ে আছে! কী হল? লড়াই শেষ হবার পর বাড়ি ফিরে যেতে ভুলে গেছে নাকি? আর সে লড়াইও তো থেমে গেছে বহু বছর আগে। আমরা থেমে পড়েছিলুম, ভয়ে নয়, সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে। কী অসাধারণ আমন্ত্রণ জানাবার কায়দা! একখন্ড পাথর বাঁধানো প্রাঙ্গণ। সেই প্রাঙ্গণে ঝকঝকে বর্ম আর শিরস্ত্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে চরিত্রটা নেই। তার পেছনে একটি মাঝারি আকারের রেস্তরাঁ। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডের মাথার ওপর একটি আলো জ্বলছে। মূর্তিটি পেছনের সেই আলোয় উদ্ভাসিত। জ্যোতির্ময়। রেস্তরাঁর যিনি মালিক, তাঁর অসাধারণ রুচির প্রশংসা করতেই হয়। একটা সময়কে তিনি স্থির করে ফেলে রেখেছেন, নিখুঁত একটি অঙ্গনে। দু-শো বছরের অতীত ঘেঁষে আমরা সেই ভোজনালয়ে প্রবেশ করলুম। আলোয় আলোকময়। একটা সুবিধে, এ দেশের মানুষ রাতকে গ্রাহ্য করে না। ওরে! রাত হয়েছে, বাড়ি আয়। ওরে! রাত হয়েছে, আলো নিবিয়ে মশারি ফেলে শুয়ে পড়। এইরকম কোনো তাগিদ আসে না। এ দেশে আবার মশাও নেই, মাছিও নেই।

এই রেস্তরাঁটা বিলিতি ঢঙের। টেবিল-চেয়ার, টেবিল-চেয়ার, এই ছন্দে সাজানো। তিন-চারজন সুদর্শন তরুণ পরিচালনায়। চার-পাঁচজন সুঠাম চেহারার ভদ্রলোক দুটো টেবিল জোড়া লাগিয়ে খানাপিনা আর গালগল্পে মশগুল। কতক্ষণ চালাবেন কে জানে! অনর্গল স্প্যানিস ভাষা, মাঝে মাঝে সাংঘাতিক হাসির দমকা ফোয়ারা। একেই বলে প্রাণ! চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাণময়তা। প্রাণ সমুদ্রে, প্রাণ মানুষে, প্রাণ ভূ-প্রকৃতিতে। যারা রাত জাগতে পারে, তারা জীবনকে অনেক বেশি জানতে পারে। পৃথিবীর যত রহস্য, সবই, সবই তো উন্মোচিত হয় রাতে।

একটি তরুণ এগিয়ে এসে আমাদের সুন্দর একটি টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল। প্রতিটি টেবিল ধবধবে সাদা টেবিল কভারে ঢাকা। মায়া ছাঁচে তৈরি ছাইদান। গাঢ় লেবু রঙের কাঁচে তৈরি। সাদা টেবিলক্লথের ওপর সুন্দর একটি শোভা।

তরুণটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কী খাবেন?’

অ্যান বললে, ‘আপনাদের রেস্তরাঁ কতক্ষণ খোলা থাকবে?’

ছেলেটি হেসে বললে, ‘সারারাত। সারাদিন। আমাদের এই ফুডজয়েন্ট বন্ধ হয় না কখনো।’

‘তাহলে আমাদের ঠাণ্ডা কিছু দিন, আর প্রকৃত কিছু মেকসিক্যান খাবার।’

‘তাহলে আপনারা বড়ো দুটো কোক খান আর তারপর মেকসিক্যান রাইস।’

ছেলেটি আমাদের সামনে দু-বোতল ঠান্ডা কোকাকোলা রেখে গেল। আমরা সিপসিপ করে খেতে লাগলুম। ঘড়িতে তখন রাত একটা। এই ধরনের রোমাঞ্চ মানুষের জীবনে বারে বারে আসে না। গতানুগতিক জীবনে মানুষ এই সময়ে নিদ্রামগ্ন থাকে। লোক-পাঁচটি হইহই করে খেয়েই চলেছে। আমাদের দিকে তাকাচ্ছেও না। আমরা কিন্তু তাকিয়ে আছি।

সেই তরুণটি একটা ট্রলি নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সে ইতিমধ্যে একটা সাদা অ্যাপ্রন পরে নিয়েছে। দু-হাতে সাদা দুটো গ্লাভস। মুখে একটা সাদা মাস্ক। মনে হচ্ছে একজন সার্জেন এগিয়ে আসছে। ট্রলি নিয়ে সে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল তার জাদুর খেলা। সে তৈরি খাবার আনেনি, এনেছে রান্নার সরঞ্জাম আর কাঁচামাল। আমরা তার কান্ড-কারখানা দেখতে লাগলুম অবাক হয়ে। ট্রলির ওপরে ছোট্ট একটা গ্যাস ওভেন। তার ওপর একটা সসপ্যান। ছেলেটি প্রায় দু-ডজন সবুজ সবুজ চিংড়ি মাছ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ছড়ানো একটা মার্বেল পাথরের স্ন্যাবের ওপর পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল। তার পাশে মাংসের টুকরো। লম্বা লম্বা লঙ্কা। নানারকমের আনাজপাতি। দু-তিনটে বড়ো বড়ো শিশিতে কীসব রয়েছে। ছোটো ছোটো কৌটো। বার্নার জ্বলল। শুরু হয়ে গেল রান্না। ছেলেটির হাত ছবির মতো কাজ করছে। অসাধারণ দক্ষতা! যেকোনো মহিলার ঈর্ষা জাগাবার মতো রন্ধনশৈলী। দেরাদুন বাসমতীর মতো সরু সরু চাল। সেই চালের ভাত, সেই ভাতে মিশে গেল চিংড়ি, মাংসের টুকরো, সবজি, লাল লঙ্কা। প্রথমে কোনো গন্ধ ছিল না। রান্নার একটা পর্যায়ে এসে, ভুরভুর গন্ধ আমাদের জিভে জল এনে দিল। লবস্টার আর রেড পিপারের সঙ্গে মিশেছে মেকসিক্যান মশলা। সবার ওপরে কাজ করে চলেছে, এক স্প্যানিয়ার্ডের গ্লাভস পরা দুটো হাত। সবার শেষে ছেলেটি অদ্ভুত একটা খেলা দেখাল। সব কিছুর ওপর ঢেলে দিল আধ বোতল মদ। পুরো খাদ্যবস্তুর ওপর দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। ছেলেটি সসপ্যানটা গ্যাসের উনুনের ওপর থেকে তুলে নিয়ে ধুনুচি নৃত্যের কায়দায় নেড়েচেড়ে একটি পাত্রে ঢেলে দিল। তারপর সুদৃশ্য দুটো বড় প্লেটে, পরিবেশিত হল আমাদের সামনে—মেকসিক্যান রাইস। ফ্রায়েডরাইস, চাইনিজ নয়, নয় পোলাও অথবা বিরিয়ানি। সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের এক প্রিপারেশন। গরম আগুন। কুলকুল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, ভুরভুরে গন্ধ। ছেলেটি সব গোছগাছ করে তার ট্রলিটি নিয়ে চলে গেল।

প্রথমে আমার খেতে ভয় করছিল। চিংড়ির সঙ্গে মাংস, সব শেষে আগুনের নৃত্য। বাঙালির পেটে সহ্য হবে তো? অ্যান এক চামচ মুখে দিয়ে বললে, ‘খেয়ে দেখো। বেশ বড়িয়া হয়েছে।’ সাহস করে এক চামচ মুখে দিলুম, সঙ্গেসঙ্গে মনে হল ব্রহ্মতালু ছেঁদা হয়ে যাবে। অসম্ভব ঝাল। আমার অবস্থা দেখে অ্যান বলল, ‘কোক খাও, কোক।’ আর কোক, জিভে যেন অ্যাটম বোমা পড়েছে। পাগল ভালো করার জন্যে ধরে দু-চার চামচ খাইয়ে দেওয়া যায়। অ্যান বেশ কিছুটা খেয়ে ফেলে কাঁদতে শুরু করল। দুঃখের কান্না নয়, ভেতরে লঙ্কাকান্ড হচ্ছে। একটা হনুমান যেন লেজে আগুন লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এইরকম খাবার পরপর তিনদিন তিনরাত খেলে মানুষ বিপ্লবী হয়ে যাবে। সিংহাসন থেকে রাজাকে টেনে নামিয়ে এনে পেটাতে শুরু করবে। অলিম্পিক দৌড়বীরকে খাওয়ালে স্বর্ণপদক পেয়ে যাবে। তাঁকে শুধু করতে হবে কী, জিভ বের করে ছুটতে হবে। সমানে টসটস করে লালা ঝরছে আর তিনি ছুটছেন, এক-শো মিটার, দু-শো মিটার, আর মনে মনে বলছেন, ‘মর গিয়া, মর গিয়া রে বাপ!’

অ্যানকে প্রশ্ন করলুম, ‘এত সুস্বাদু, কিন্তু এমন প্রচন্ড ঝাল দেবার কারণটা কী?’

‘একেই বলে জীবনবোধ। বাঁচার আনন্দ। তুমি খাবে। তোমার শরীরে আগুন ছুটবে। তুমি ঘামবে। উদ্দাম নৃত্য করবে। গলা ছেড়ে গান গাইবে। সমুদ্রে ঝাঁপাবে। প্রেম করবে। এই খাদ্যের নাম হল এনার্জি প্যাক। চার্জড উইথ ইলেকট্রিসিটি। ম্যাগনেটিক। খাওয়ার পর মানুষের মানুষকে আকর্ষণ করতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হচ্ছে, তোমার গলা জড়িয়ে ধরে, বাইরের বাতাসে বসে কিছুক্ষণ হুসহাস করি। তোমার সেরকম কোনও ইচ্ছে করছে কি?’

‘করছে। সেই সঙ্গে ড্রাম পিটিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’

‘আমার কী ইচ্ছে করছে জান, ইফেল টাওয়ারের মাথায় উঠে, নীচের দিকে জিভ ঝুলিয়ে বসে থাকি। সব ঝাল টসটস করে ঝরে যাক।’

আমি একের চার-ভাগ খেয়ে চোখ ছানাবড়া করে বসে আছি। অ্যান খেয়েছে আধ ভাগ। দুজনেই বেশ সমস্যায় পড়ে গেছি। রাত দেড়টার সময় পেটের ভেতর অগ্নিকান্ড ঘটানো কি ঠিক হবে! এইসব যখন ভাবছি, তখন সেই তরুণটি এগিয়ে এল। অ্যাপ্রন আর গ্লাভস খুলে ফেলেছে। হাসিমুখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, জিনিসটা কেমন হয়েছে?’

আমরা দু-জনে সমস্বরে বললাম, ‘অসাধারণ, অসাধারণ।’

তরুণটি আমাদের থেকে কিছু দূরে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। বেশ বিপদে পড়ে গেলুম। আর উপায় নেই, আমাদের এখন সবটাই খেতে হবে। অসাধারণ বলার পর তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। অ্যান আমার দিকে তাকাচ্ছে আমি অ্যানের দিকে, আর একটু একটু মুখে পুরছি। এক সময় ঝাল সয়ে গেল; তখন প্রকৃত স্বাদটা ফুটে উঠল। তখন মনে হল রান্নাটা শিখে নিই। দেশে ফিরে একটু কম ঝাল দিয়ে রেঁধে পরিবেশন করলে সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে। তারপর মনে হল, কোথায় পাব এমন লকলকে টাটকা চিংড়ি। কোথায় পাব দপ করে জ্বলে ওঠা বিলিতি মদ।

তরুণটির হাতে একটা ছোট্ট বাক্স। সুদৃশ্য। নাড়াচাড়া করছে আর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আতিথেয়তার এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না অন্য কোনও দেশে। বাক্সটা কী, তা জানার জন্যে মনটা বড়ো উতলা হচ্ছিল। শেষে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললুম, ‘ওটা কী ভাই?’

তরুণটি বললে, ‘দেশলাই।’

ভারি বুঝদার ছেলে। দেশলাই শুনে আমার ছোখে মনে হয় লোভ ঝলসে উঠেছিল; কারণ নানা ধরনের দেশলাই সংগ্রহ করা আমার অনেক দিনের হবি। সে দেশলাইটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, ‘আপনি নেবেন?’

মাছ যেভাবে লোভনীয় টোপ গেলে, আমি সেইভাবে খপ করে তার হাত থেকে দেশলাইটা নিয়ে নিলুম। জিনিসটা খুবই সামান্য, আমার কাছে অসামান্য। পাগল করে দেবার মতো রূপ। যে জিনিস জ্বলেপুড়ে যাবে। তার পেছনেও নির্মাতারা কত যত্ন ঢেলেছেন! আমাদের দেশের সব জিনিসই আধা-খেচড়া। কোনোরকমে কাজ-চলা গোছের একটা কিছু বাজারে ছেড়ে দিলেই হল। এ বাক্সটা পাতলা। হলুদ রঙের। এপিঠে একটা গোল ছবি, ওপিঠে একটা আয়ত ছবি। গোল ছবিটার পেছনে নীল আকাশ। ছবিটা ভেনাসের। তার মাথার ওপর অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা, ১৮৮৫-১৯৮৫। বুঝতে পারা গেল না, এই এক-শো বছর ভেনাসের বয়স, নাকি দেশলাই প্রস্তুতকারক সংস্থা, লুসেস মার্কাসের বয়স। ঠিকানা ১নং স্রিয়া দ্য ইন্দাস্ত্রিয়া। কোমার্সিয়ো পরের পিঠের আয়তাকারের ছবিটি হল একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য। শিল্পী জোর্জে সাজারেস কাম্পোস ১৯৩৭ সালে এঁকেছিলেন অনবদ্য একটি রঙিন ছবি। মেক্সিকোর ভূপ্রকৃতি। দেশলাইটির নাম ‘ক্লাসিকোস দ্য লুজো’। ভেতরে ১৭০টি সুদৃশ্য কাঠি। মোম মাখানো কাগজে তৈরি। সমান মাপের বারুদ লাগানো। সাদা কাঠির মাথায় টুকটুকে গোলাপী বারুদ। অমন শোভন কাঠি জ্বালাতেও মায়া হবে। আবার মাথার দিকের ফ্ল্যাপে লেখা ‘কোম্পানিয়া সরিলেরা, লা সেন্ত্রাল এস এ’। কোনটা যে কোম্পানির নাম, বোঝা কঠিন।

অ্যান বললে, ‘ভাল লেগেছে, পকেটে পুরে ফেলো, একটা দেশলাই নিয়ে অত গবেষণা ভাল লাগে না।’

দাম মিটিয়ে তরুণটির সঙ্গে করমর্দন করে আমরা বেরিয়ে এলুম। দেশলাইয়ের দাম কিছুতেই নিল না। অন্ধকারে নির্জন মার্কেট প্লেসে আমরা ভূতের মতো অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালুম, অলিতে গলিতে ফ্লোরেন্সের, দোকানের সামনে দাঁড়ালুম। আলো জ্বলছে। নিখুঁত করে সাজানো লোভনীয় সব জিনিসপত্র। মিস্টার স্যাভার্সের টেবিলে টাইপরাইটার যেন ঘুমন্ত শিশু। ফ্লোরেন্সের ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্লোরেন্সের বদলে কাঠের একটি মূর্তি। বল্লমধারী এক স্প্যানিশ সৈনিক।

দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা বললুম, ‘মা, বিদায়। কাল সকালে আমরা চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না কোনোদিন। মা, বিদায়।’ বলার পর মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমরা তেমন বড়লোক নই, স্মাগলার নই, ড্রাগ ট্র্যাফিকার নই, রাষ্ট্রনায়ক নই, দূর কোনো অজানা দেশে হালভাঙা নাবিকের মতো হঠাৎ এসে পড়ি ভাগ্যের বাতাসে। ওই একবার জীবনে একটি বার স্মৃতি সঞ্চয় করে ফিরে যাই। এরপর জীবনের দিন যখন শেষ হয়ে আসে, তখন মৃত্যুর নির্জন শয্যায় শুয়ে দেখি, কবে কোন দূর অতীতে বসেছিলুম কোন সমুদ্রের ধারে। তখন আমার পাশে কারা ছিলেন। মনে পড়বে আকাশের গায়ে আটকে থাকা সেই আগ্নেয়গিরির কথা, দিনের বিভিন্ন সময়েই যার রং পালটাত! সেই বহুতল হোটেল, দোকান, রাজপথ, নদী, ঝরনা, প্রান্তর। এমনও হতে পারে, মৃত্যুর পরেই আমার আত্মা একবার ঘুরে যাবে এইসব প্রিয় জায়গায়। কেউ দেখতে পাবে না। কারণ তখন আমার কোনো দেহ থাকবে না। একটি অনাথ শিশুকে একবার দেখেছিলুম। রাজপথের একটি পাশে প্রায়ান্ধকারে দেয়ালে পিঠ রেখে দু-হাতে হাঁটু দুটি জড়িয়ে চুপ করে বসেছিল। দু-চোখ ভরা বিস্ময়। সে কারোর নয়। পৃথিবী তার কথা ভাবে না, অথচ সকলেই তার। তার মন, তার বিস্ময় সকলকে ঘিরে। গাড়ি ছুটছে, বড় বড় বাড়িতে জ্বলে উঠেছে আলো! কত লোক, কত শব্দ, কত রঙ। সিনেমার হোর্ডিং। কেউ তাকে দেখছে না, সে দেখছে সকলকে। আমার আত্মাও ওই অনাথ শিশুটির মতো জায়গায় জায়গায় কিছু সময় বসে থেকে চিরবিদায় নেবে। সব মনেই একটা বেদনা থাকে, বিষণ্ণতা থাকে। একদিন না একদিন চলে যাবার বার্তাটা রক্ত বহন করে বলেই এমনটি হয়।

আমরা ঘুরতে ঘুরতে কখন চলে এসেছি বাজারের বাইরে। সেখানে এক সার একতলা বাড়ি, পাশাপাশি। এখানেও দেখি রাত নামেনি। জানালায় আলো। দুলছে পরদা! দরজার ধাপে তিনটি মেয়ে বসে আছে। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে, মাথায় মাথা ঠেকিয়ে। পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে। তিনজন স্প্যানিশ কুমারী। তিন সখী। অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। পেছনে ঘরের অংশ। আমাদের দেশের মতোই খাট, বিছানার চাদর, চেয়ার, শিশুর দোলনা। মেয়ে তিনটির পায়ের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে মহা আরামে শুয়ে আছে সাদা ধবধবে একটি কুকুর।

হঠাৎ আমার কী হল জানি না, সেই মেয়ে তিনটির পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিশুদ্ধ বাংলায় জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী, ঘুমোতে যাবে না!’

মেয়ে তিনটি কী বুঝল জানি না, হাত তুলে, চোখ বুঁজিয়ে কেমন যেন একটা ঘুমোতে যাবার ভঙ্গি করল, স্প্যানিশ ভাষায় কী একটা বলে হেসে উঠল খিলখিল করে। ততক্ষণে আমরা এগিয়ে গেছি।

অ্যান বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করলে তুমি?’

‘আগে বলো, ওরা কী বললে?’

‘বললে, একটু পরে। তুমি কী বলেছিলে যে, ওরা একটু পরে বলল?’

‘বলেছিলাম, তোমরা ঘুমোবে না?’

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ভাষা ছাড়াই ভাব মানুষকে স্পর্শ করতে পারে! প্রশ্ন যদি আন্তরিক হয়, তাহলে আত্মার মতো, তা আর ভাষার শরীরের অধীন থাকে না। ভাষাহীন ভাষা আন্তর্জাতিক হয়ে দাঁড়ায়।

হোটেলের দেনা-পাওনা চুকিয়ে, সামান্য কিছু খেয়ে আমরা আমাদের সমুদ্রনিবাস ইসতাফাকে চির বিদায় জানিয়ে, চললুম এয়ারপোর্টের দিকে। ঠিক হয়েছে, এখান থেকে আমরা যাব মেরিডা। ‘হোয়াইট সিটি মেরিডা।’

মেরিডা। প্লেন থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে একেবারে মোহিত। সত্যিই হোয়াইট সিটি। প্লেন যত নীচে নামছে, শ্বেত শুভ্র একটি ছবি ক্রমশই ওপর দিকে উঠে আসছে। সাদা চূড়া, গম্বুজ, ডোম, সব সাদা। পরিষ্কার রাজপথ, পরিচ্ছন্ন গৃহ, সবুজ বাগান। শত শত বছরের একটা ইতিহাসের মাথার ওপর চক্কর মারছে আমাদের পুষ্পক রথ।

বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক; তবে খুব একটা বড়ো নয়। সারা বছর টুরিস্টরাই আসে। বিমানবন্দর দিয়ে মাল চলাচল করে না। আরও একুশ-টি এয়ার ফিল্ড এই য়ুকাতান পেনিনসুলায় রয়েছে। মেরিডা য়ুকাতান প্রদেশেরই সুন্দর শহর। প্রাচীন শহর। য়ুকাতানে রয়েছে একটি গভীর জলের বন্দর। আর রয়েছে দশটি অগভীর বন্দর। অন্তর্দেশীয় মাল চলাচল ও যোগাযোগের জন্যে জলপথই ব্যবহৃত হয়। উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে প’ড়ে আছে গালফ অফ মেকসিকো উপসাগর। পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্বে আর একটি প্রদেশ কুইনতানারু। দক্ষিণ পশ্চিমে কামপেচে। য়ুকাতানের সবচেয়ে বড়ো শহর হল মেরিডা। মেকসিকো উপসাগর থেকে ক্যারিবিয়ান পর্যন্ত প্রশস্ত এই অঞ্চলটিকে বলা হয় ল্যান্ড অফ-গডস। এখানে ভগবানের বসবাস। এই পবিত্র ভূমিতেই ছিল মায়াদের বড়ো বড়ো শহর। সেই সব শহরে পূজিত হতেন বৃষ্টির দেবতা। মন্দিরে মন্দিরে, বিশাল বিশাল উপাসনা কেন্দ্রে দেওয়া হত নরবলি। মায়াদের মানমন্দিরে চলত জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা। অতিজাগতিক রহস্যের সমাধানে কেটে যেত মায়া পুরোহিতদের রাত।

মায়ারা এই য়ুকাতানকে বলতেন, কানট্রি অফ দি টার্কি অ্যান্ড দি ডিয়ার। বড়ো জাতের মুরগি আর হরিণের দেশ। ল্যান্ড অফ মিল্ক অ্যান্ড হানি। দুধ আর মধুর ধারা বইত। ভালো চাষবাস হত, প্রচুর শক্তিশালী জন্তু জানোয়ার ছিল, ছিল বহুবর্গের পাখি। এখন কী আছে দেখা যাক। ইতিমধ্যে পাঁচ-ছ-শো বছর গড়িয়ে চলে গেছে কালপ্রবাহে।

য়ুকাতান নামটির উৎপত্তি ভুল বোঝাবুঝি থেকে। প্রথম যে স্প্যানিশ কনক্যুইস্তাদর য়ুকাতানের তটভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তিনি কৌতূহলী হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করলেন, জায়গাটির নাম কী! মায়ারা স্প্যানিশ ভাষার কী বুঝবে! তাঁরা তাঁদের ভাষায় বললেন, সি-উ-থান। তার অর্থ আমরা কেউ কারোর ভাষা বুঝছি না। বিদেশি ভাবলেন, ওইটাই বুঝি অঞ্চলটির নাম। সি-উ-থান থেকে য়ুকাতান। নতুন বিশ্বের ভৌগোলিক অভিধানে, চিরতরে ওই উত্তরটির অধিষ্ঠান হল নাম হিসেবে। সি-উ-থান। আমরা কেউ কারোকে বুঝি না। য়ুকাতান।

পাঁচ-শো বছর পেছোবার আগে এয়ারপোর্টের ফর্ম্যালিটি সামলাই। ভিসা, পাসপোর্ট, ব্যাগের নাড়ি-ভুঁড়ি পরীক্ষা। ভারি শান্ত বিমানবন্দর। ঝকঝকে তকতকে। খুব অল্পেই আমরা ছাড়া পেয়ে গেলুম। বিমানবন্দরের বাইরে পরিষ্কার চওড়া রাজপথ। কোথায় কোনদিকে চলে গেছে, বোঝা না গেলেও অবিলম্বে পাওয়া যাবে। আমরা একটা ট্যাকসিতে চেপে বসেছি। কলকাতার ঝলঝলে, খলখলে গাড়ি নয়। নতুন আমেরিকান গাড়ি। স্টার্ট নেবার সময় পেছনে যে আসনে আমরা বসে আছি, তার তলায় খুস করে একটা শব্দ। সারাক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। ইঞ্জিন চলছে কী চলছে না, বোঝার উপায় নেই। মসৃণ পথ, মসৃণ গাড়ি, ছাঁকা বাতাস, প্রতি মুহূর্তে পরমায়ু বেড়ে চলেছে। গাড়ির চালকের পোশাক শ্বেত-শুভ্র। কাঁধের ওপর জামার আরও দুটি কলার। সেই কলারে সূক্ষ্ম সোনালি বর্ডার। শোভা এমন খুলেছে, চোখ ফেরানো যায় না।

চোখ ফেরাতেই হল। দু-পাশে পথের দৃশ্য অতুলনীয়। অনেক শহর দেখেছি এমন শহর একমাত্র স্বপ্নেই হয়তো দেখা যায়। অ্যান বললে, ‘দু নয়ন ভরে দেখে নাও খোকা। স্পেনে না গিয়েও স্পেন। এ তোমার নরখাদক মেগাপোলিস নয়। এই একবারই এলে। জীবনে আর দ্বিতীয়বার আসা হবে না। মায়া শহরের ওপর এই মেরিডা। পৃথিবীর একপাশে পড়ে আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন ভালো নয়।’

কান দুটো অ্যানের দিকে, চোখ দুটো পথের দিকে। সিমেন্ট বাঁধানো রাজপথ এত পরিষ্কার যে, যেকোনো জায়গায় তাকিয়া মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়া যায়। প্রশস্ত ফুটপাত ততোধিক সুন্দর। প্রাসাদের পর প্রাসাদ। মাঝে মাঝে বাগান-ঘেরা ভিলা। সাদা, সোনালি আর ফিকে নীল ছাড়া কোনো রং নেই। মায়া স্থাপত্যের দিকে নজর রেখে শহরটি সযত্নে তৈরি পাঁচ শো বছর আগে। মায়া স্থপতিরা গ্রিলের ব্যবহার জানতেন না। নিউ ওয়ারলডে গ্রিল এনেছিলেন স্প্যানিশরা। মেরিডাতে গ্রিল দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঢালাই গ্রিল কত ভাবে, কত ডিজাইনে করা যায়। ফেনসিং-এ একরকম, জানালায় একরকম, বারান্দায় আর একরকম। নিখুঁত সাদা রং।

মানুষের কল্পনা থাকলে সিটি প্ল্যানিং-এ কতরকম মজা করা যায়। পথ, যেন মাঝে মাঝেই পথ হারিয়ে এক-একটা গোল চত্বরে ঢুকে পড়েছে। সে বেশ মজা। ট্রাফিক আইল্যাণ্ড নয়, গোটাটাই একটা আইল্যাণ্ড। চারপাশে গাছ। ধারে ধারে বসার জায়গা। মাঝখানে ফোয়ারা। হিস হিস করে মিহি চিনির মতো জল ছুঁড়ছে। গাড়ি বাঁদিকের বৃত্ত ধরে আবার সরল পথে গিয়ে উঠছে। এমনটি আমি আর কোথাও দেখিনি। সেই কথায় আছে, টিকিটের দাম উঠে গেল। মেরিডা দেখে আমার জীবন সার্থক।

অ্যান বললে, ‘এখনও তো কিছুই দেখনি। শুধু একটা রাজপথের দু’ধারের দৃশ্য!’

গাড়ি এসে দাঁড়াল হোটেল হলিডে-ইন-এর সামনে। হোটেলের সম্মুখভাগে একটি স্কোয়্যার। হোটেলের সব কটা জানলা সেই দিকে তাকিয়ে আছে। হোটেলটা মাথায় বড়ো নয়। পাশে বড়ো। প্রতিটি ঘরের লাগোয়া একটি করে ছোট্ট ঝুল-বারান্দা। হোটেলটা হাঁসের পালকের-মতো সাদা। জানলায় জানলায় সাদা পরদা। স্প্যানিশ রুচি যে এত ভালো, আমার জানা ছিল না।

হলিডে-ইন আগের হোটেলগুলোর মতো রাক্ষুসে নয়। ভারি সুন্দর, মেয়েলি একটা শ্রী আছে। কর্মীরাও সব মহিলা। নীচের তলায় রিসেপসান আর রেস্তরাঁ ছাড়া সবই দোকান। সুন্দর সুন্দর দোকান। আকাশ মেঘলা, আমরা আসার আগে এক পশলা হয়ে গেছে। এদেশে মেঘের চেহারাও নরম। ছেঁড়া পালকের মতো সারা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। যে দেশে এত লড়াই এত বিপ্লব, সভ্যতার উত্থানপতন, সে দেশে এত নরম স্বপ্ন জমা হল কী করে!

রিসেপশানের মহিলাদের সব সাদা পোশাক। তার ওপর কে ছুঁড়ে মেরেছে এক মুঠো নীল ফুল। চেহারা দেখে মনে হল, পিয়োর স্প্যানিশ ব্লাড। স্প্যানিশ মেয়েরা খুব সুন্দরী। সৌন্দর্যের প্রচার আর অহঙ্কার নেই বলে যেন আরও সুন্দর। আমরা ঘর পেলুম দোতলায়।

শহরটাকে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই। ঘরে মালপত্র রাখতে রাখতে যেই বেলেছি, ‘চান করে নিলে কেমন হয়!’ অ্যান চটে গেল, ‘তোমার কেবল চান আর চান। আগের জন্মে কি সিন্ধুঘোটক ছিলে?’

আমি বললুম, ‘থাক থাক, চান আর করব না।’

‘চান করতে হবে না, দয়া করে দাড়িটা কামিয়ে এসো। মুখটা যেন কদমফুলের মতো দেখাচ্ছে।’

‘ভাগ্যিস হনুমান বলোনি!’

‘সে তোমার মা বলবেন।’

‘আপাতত আমি অরফ্যান। মা, বাবা দু-জনেই গত।’

অ্যান আমার পিঠে হাত রেখে বললে, ‘আই অ্যাম সরি। তোমাদের দেশে তো পরিবার অটুট থাকে, আর জয়েন্ট ফ্যামিলি। আমাদের দেশে সবই সিঙ্গল ফ্যামিলি, তাও আবার তিন চার বার ভাঙাভাঙি হয়। ডিভোর্সের পর ডিভোর্স। মা থাকে তো বাবা যায়, বাবা থাকে তো মা যায়। আর ছেলে-মেয়েরা ভেসে বেড়ায়।’

‘অ্যান, মনের দিক থেকে তুমি সেণ্ট পারসেণ্ট ভারতীয়।’

‘হতে পারে। ভারত সম্পর্কে আমার ভীষণ কৌতূহল। ভারতীয়রা ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসা নিতে জানে। আমাদের সমাজে দেহটা এত প্রবল, পাগল করে মারে। তোমাদের ধর্মটাও খুব সুন্দর। তুমি ভোরবেলা একমনে ওটা কী ঘোরাও?’

‘রুদ্রাক্ষের মালা। জপ করি। আমি দীক্ষিত।’

‘রুদ্রাক্ষ কী?’

‘এক রকমের ফল। সেই শুকনো ফল গেঁথে তৈরি জপের মালা। হাতে নেওয়ামাত্রই তোমার চোখে ভেসে উঠবে তুষারশুভ্র হিমালয়। পর্বতগুহা। সাধু সন্ন্যাসী। মনে জাগবে ত্যাগ, বৈরাগ্য। আসবে একটা শান্তির ভাব। মালার অনেক পাওয়ার। নিমেষে তোমার সেলফ বদলে যাবে। তারপর জপ করতে করতে স্থায়ীভাবে তোমার সব কিছু পালটে যাবে। সুরক্ষিত চিত্ত সুখ প্রদান করে। আমাদের এই স্থূল শরীরের মধ্যে সূক্ষ্ম শরীর। ওই সূক্ষ্ম শরীরের নাম মন। আর তোমার জপ ও ধ্যান ওই চঞ্চল মনকে স্থির করে। লক্ষ করে দেখো, মন আর মাছি প্রায় এক জিনিস। স্থির হয়ে কোথাও একভাবে বসতে পারে না। অনবরত ভ্যান ভ্যান করছে। মনের গভীরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবে, এক বা একাধিক অসৎ চিন্তা, একটা আর একটার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। সব ক’টাই সমান শক্তিশালী। অথচ মনকে স্থির করতে না পারলে শান্তি নেই।’

‘পিস অ্যান্ড ব্লিস।’

‘ইয়েস পিস অ্যান্ড ব্লিস। মন স্থির করতে হলে চিন্তার ওপর সতর্ক নজর রাখতে হবে। তুমি বাণ দেখেছ? অ্যারো?’

‘দেখেছি।’

‘বৌদ্ধধর্মে ওই বাণের উপমা দিয়ে সুন্দর একটি পথনির্দেশ আছে। বাণ যে তৈরি করে, সে সোজা করেই করে। বাঁকা করে করে না। সেইরকম বুদ্ধিমান ব্যক্তি, চঞ্চল চিত্তকে সরল করেন। নিজের বশে আনার চেষ্টা করেন। জপ আর ধ্যান সেই কাজ সহজ করে।’

‘ধ্যান হল মেডিটেশান। জপ কাকে বলে?’

‘জপ হল, অনবরত, ননস্টপ একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে চলা। হাজার বার, লক্ষ বার।’

‘কী মন্ত্র?’

‘দীক্ষিত হলে, দীক্ষার সময় গুরু কানে কানে মন্ত্রটি বলে দেন।’

‘ধরো, আমি যদি জপ করতে চাই?’

‘তুমি এক মনে ওঙ্কার জপ করে যাও। অউম, ওম।’

‘আর ধ্যান?’

‘ওই ওঙ্কারের ধ্যান করো। চোখ বুজিয়ে দুই ভুরুর মাঝখানে অক্ষরটিকে দেখো আর অবিরত জপ করে যাও।’ অ্যান হাত-পা ছড়িয়ে আরাম কেদারায় বসে রইল। সামনে খোলা জানালা। বাইরে ফিকে নীল আকাশ। সুন্দর একটি শহরের ছবি। অতীতের প্রতি মানুষের একটা শ্রদ্ধা থাকেই। মায়া সভ্যতা সম্পর্কে একটা কৌতূহল একটা সমীহের ভাব শুধু আমার নয়, যাঁরা ইতিহাস চর্চা করেন, তাঁদের সকলেরই আছে। যখনই জানালার বাইরে তাকাচ্ছি, ঘর, বাড়ি, গৃহচূড়া দেখছি, গাছ দেখছি, চার্চ দেখছি, তখনই মনে হচ্ছে, এ কোনো সাধারণ শহর নয়। এর তলায় আছে মায়াসভ্যতা। ছ-শো বছর আগে এই জানালায় দাঁড়ালে দেখতে পেতুম, পথ ধরে চলেছে কোনো ধর্মীয় মিছিল। উজ্জ্বল পোশাকে চলেছেন মায়া পুরোহিত। মায়া মানবের মুখ ও শরীরে, গঠনে এমন একটা কিছু আছে, যা দেখলে মনে একটা রহস্যের ভাব হয়। কাপালিক দেখলে যেমন হয়, যেমন হয় তিব্বতীয় কোনও লামাকে দেখলে। এক সঙ্গে অনেক ছবি ফুটে ওঠে—গভীর রাত, গুহা, সাঁসাঁ বাতাস, হোমকুন্ড, আগুন আগুনের ফুলকি। বিচিত্র ভাষায় গম্ভীর গলায় মন্ত্রোচ্চারণ। বিচিত্র কোনো মূর্তি। নরবলি। মেকসিকো সিটি ছাড়া অন্য যে কোনো অঞ্চলে গেলেই মনে হয়, সমস্ত কিছু আচ্ছন্ন করে বিছানো রয়েছে, রহস্যের একটি অঞ্চল। হালকা কুয়াশার মতো বাতাসে কাঁপছে একটা ‘স্পেল’। একটু আগে অ্যান বলছিল, কনকুইস্তাদররা য়ুকাতান প্রদেশের মেরিডায় এসে অবাক হয়ে গিয়েছিল। অজ্ঞাত কোনো কারণে সাজানো শহর ছেড়ে সবাই পলাতক। কেউ কোথাও নেই। মার্কেটপ্লেস, কমিউনিটি-সেন্টার, সিটি-সেন্টার, পিরামিড, ভজনালয়, ভোজনালয়, প্রাসাদ, গৃহ সব পড়ে আছে। খাঁ খাঁ করছে। চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে অরণ্য। বহু ইমারত চাপা পড়ে গেছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের মতো ঋজু, সরল পথের ফাটলে ফাটলে ঢেকে উঠেছে আগাছা। হঠাৎ বন্দুকের শব্দ হলে গাছের সব পাখি যেমন বাসা ছেড়ে উড়ে পালায়, সেইরকম হঠাৎ বড়ো রকমের এমন একটা কিছু ঘটেছিল। যার ফলে সব কিছু ফেলে রেখে অধিবাসীরা পালিয়েছিল শহর ছেড়ে। সেই কারণটা কী! মায়া সভ্যতার পতনের সঠিক কারণটি এখনও জোর গলায় বলা যায় না বলেই সময়ের ওই পর্বটুকু শুধু ইতিহাস নয়, চাপা এক রহস্য। স্প্যানিয়ার্ডরা এসেই বুঝেছিল, পৃথিবীর এই দূর ভাঁজে দীর্ঘ সময় ধরে অসাধারণ একটা কিছু ঘটে গেছে। স্প্যানিয়ার্ডরা কতদূর বিস্মিত হয়েছিল, আমি কল্পনায় অনুমান করতে পারি।

ইসতাফায় শেভিংসেট ফেলে এসেছি। বাঁচা গেছে, দাড়ি আর কামাতে হবে না। অ্যান বললে, ‘তোমার লজ্জা করে না! এটা গোঁফ-দাড়ির দেশ নয়। দেখছো না, প্রতিটি মানুষ ক্লিন শেভড। চলো, শেভিংসেট কিনে আনি।’ আমরা নেমে এলুম নীচে। রেস্তোরাঁতে দু-চারজন পান ভোজনে বসেছেন। আমরা কোনও দিকে না তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম।

হোটেলটি ঢ্যাঙা নয়; কিন্তু মোটা। পরিসরে বেশ বড়ো। মায়া আর্কিটেকচারের ধরনটা হল, আমাদের মহাভারতের মতো। মায়ারা কোর্ট ইয়ার্ড বা অঙ্গন খুব পছন্দ করতেন। তার চারধার দিয়ে তুলে দিতেন ঘর। আমাদের হলিডে ইন-এর নির্মাণ ছন্দটি প্রায় সেইরকম। সামনে পাথর বসানো ইয়ার্ড। পেছনে একটা বিশাল বাগান। নীচের সমস্ত দোকানের পেছন দিকে এই বাগানের সুবজ স্পর্শ।

আমরা একটা ওষুধের দোকানে ঢুকলুম। ছোট্ট দোকান; কিন্তু ভারি পরিপাটি। এখানে ওষুধের দোকানে স্টেশনারি বিক্রি হয়। শেভিংসেট পাওয়া খুব কঠিন; কারণ, এদেশে ইলেকট্রিক রেজার। দোকানের মেয়েটি আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করছে স্প্যানিশ আর ভাঙা ইংরেজিতে, ইলেকট্রিক রেজারের মতো জিনিস হয় না, ইট ইজ জাস্ট লাইক এ মর্নিং ওয়াক। সকালে গালের ওপর দিয়ে একবার বেড়িয়ে চলে যাবে, অ্যান্ড বিয়ার্ড ইজ গন। জাস্ট লাইক ভোরের কুয়াশা।

মেরিডা তার চারপাশে দুয়ার খুলে দিয়েছে। যে দরজা দিয়েই বেরোনো যাক, পাওয়া যাবে য়ুকাটানের সযত্নরক্ষিত পুরাতত্ত্ব ভূমি। এই দেশের জমিতে মাটির ভাগ কম। কোথাও কোথাও শুধুই স্তরের পর স্তর পাথর, গ্র্যাভেল স্টোন পিউমিস, চুনাপাথর। জলধারণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বৃষ্টিপাতেরও তেমন কোনো নিয়ম নেই। ফলে চাষবাস হয় না বললেই চলে। ব্যতিক্রম হল মেরিডা। সবুজ হয়ে আছে চারপাশ।

আমরা চলে এসেছি পাসিয়ো মোন্তেজোতে। শিরা ওঠা, দামি পাথর বাঁধানো ঝকঝকে ফুটপাত। এইরকম পায়ে চলার পথ আর প্রাসাদশ্রেণি খুব কম শহরেই দেখা যায়। আকাশেই যদি ঈশ্বর থাকেন। তাহলে মুখ তুলে বলি, তুমি আমাকে এই অনুপম শহর থেকে আর বের করে নিও না, তুমি বাকি জীবন এইখানেই ফেলে রাখো আমাকে।

অ্যান বললে, ‘এসো, কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা যাক; তারপর আবার শুরু করা যাবে পরিক্রমা।’ পাসিয়ো মোন্তেজোর দুপাশেই ছাড়া ছাড়া বসার বেঞ্চ। ঢালাই লোহায় তৈরি। কারুকার্য মন্ডিত। নিখুঁত সাদা রং। পাশাপাশি চারজন বসা যায়। রাস্তার দুপাশেই বড়ো বড়ো গাছ। দৈত্যের মতো নয়। সুশ্রী ঝিরঝিরে। আকাশের গায়ে হালকা পাতার তুলি টানছে, বাতাসের দোলায়। একটু শীত শীত ভাব। দিনের বেলায়ও তেমন গরম নয়। পথের তে-মাথার বাঁ-দিকে আমরা বসে আছি পাসিয়ো মোন্তেজোর একপাশে। আমাদের ডানপাশ থেকে আর একটি পথ এসে মিশেছে। জানি না, কী নাম সেই পথের।

আমাদের পেছনে, আমাদের সামনে এক সার অতি সুন্দর বাড়ি। স্প্যানিশ কায়দায় তৈরি। সাদা গ্রিলের বেড়া দিয়ে ঘেরা। গ্রিল গেট। ধাপ ধাপ পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ঝকঝকে সাদা প্রবেশ দরজার দিকে। মাথার ওপর ঝুলে আছে দোতলার বারান্দা। লম্বা লম্বা সুদৃশ্য থাম। জানলার মাথায় মাথায় কারুকার্য করা শেড। কোনো বাড়িই সাধারণ এক আবাসস্থল নয়, সুরম্য এক স্বপ্ন। প্রবেশপথ উদ্ভাসিত হয়ে আছে সাদা আলোয়।

জনসংখ্যা খুবই কম। হয়তো শহরের অন্য প্রান্তে আছে। এই পাসিয়ো মোন্তেজোতে পথচারী নেই বললেই চলে। কোনো বাড়িতেই কোনো শব্দ নেই। জানলায় জানালায় আলো জ্বলছে। পাতলা, সাদা পরদা ভেদ করে সেই আলো চাঁদের আলো হয়ে বাইরে ছুটে আসছে। দেখতে না পেলেও দেখতে পাচ্ছি ভেতরের দৃশ্য। সুন্দরী স্প্যানিশ মহিলারা এ-ঘর, ও-ঘর করছে। পিয়ানোয় সুর তুলছে। হঠাৎ আমাদের সামনের রাজপথে স্বপ্নের জগৎ থেকে যেন বেরিয়ে এল স্বাস্থ্যবান সাদা ঘোড়ায় টানা সাদা একটা ফিটন। বড়ো বড়ো চাকা। চারপাশ ও মাথা খোলা। আরোহী দুই সুন্দরী। হাঁসের পালকের মতো সাদা পোশাক। ঝিমঝিম শব্দ তুলে চলে গেল সংগীতের মতো।

ঝিমঝিম রাত। ঝিমঝিম সেই স্বপ্নের পক্ষীরাজ। সাদা একটা গাড়ি টেনে নিয়ে চলে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে। হঠাৎ রাতের বাতাসে ছড়িয়ে গেল কনসার্টের সুর। আমাদের পেছনের প্রাসাদোপম কোনো বাড়ি হল সেই সুরের উৎস। স্বপ্নের শহরেই তো বাস করবে স্বপ্নের মানুষেরা। চিৎকার চেঁচামেচি নেই। যানজট নেই। মানুষ, দোদুল্যমান বাস, মিনিবাস কন্ডাকটারের আদিম, অমানবিক চিৎকার নেই। ঘূর্ণায়মান বিক্ষোভ মিছিলের, ‘চলছে, চলবে’ নেই। শহর যেন ধ্যানে বসেছে দীপালোক জ্বেলে। প্রার্থনা সংগীতের সুর আসছে বাতাসে।

অ্যান কতকালের আপনজনের মতো আমার কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললে, ‘কি, নেশা ধরে গেছে তো! আমার ধরেছে। জোরে কথা পর্যন্ত বলতে ইচ্ছে করছে না, পাছে রাতের আঁচলে নখের ঘসা লেগে যায়। এ যেন সিল্কের মতো রাত। বিশ্বাস করো জীবনে অনেক বড়ো, ছোটো শহর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, এই শহর ছেড়ে যাবার সময় চোখে জল এসে যাবে।’

‘আমি বসে বসে কী ভাবছিলুম জান, আমি আর ফিরব না। এইখানেই যা হয় একটা কিছু জুটিয়ে নেবো, বেল-বয় কী কাউ-বয়, টি-বয় কী হোটেল-বয়। চেষ্টা করলে হবে না, অ্যান?’

‘হবে, তবে পারবে না। যে যে-জীবনে অভ্যস্ত, বুঝলে না! সেই জীবন সেই ধরনের একটা মানসিকতা তৈরি করে দেয়। পৃথিবীতে যত শহর আছে, তার মধ্যে মেরিডার রাত হল সবচেয়ে কমনীয়, সব চেয়ে শান্ত।’

‘ভারতবর্ষের যোগীরা এই শহরের সন্ধান পেলে ছুটে আসতেন। সারা রাত যোগাসনে বসে ধ্যান করে কাটিয়ে দিতেন। আমার অনুভূতি কী বলছে জান, এই শহরে একসময় অনেক সাধনভজন হয়ে গেছে। এ তোমার হল গিয়ে সিদ্ধপীঠ।’

‘সিদ্ধপীঠ কাকে বলে?’

‘যেখানে যেকোনো একজন সাধক দিনের পর দিন সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন।’

‘সিদ্ধিলাভ কাকে বলে?’

‘সাধনার উদ্দেশ্য হল ঈশ্বরদর্শন। সেই ঈশ্বরদর্শন হলেই সিদ্ধিলাভ।’

‘তোমরা ঈশ্বর ঈশ্বর বলো, আমরা বলি গড। সত্যিই কিছু আছে?’

‘তিনি তর্কাতীত। তিনি আছেন মানুষের বিশ্বাসে। তিনি আছেন ভেতরে, আমাদের অন্তরে। একাসনে বসে, দিনের পর দিন একাগ্র চেষ্টায় ছড়ানো মনকে শামুকের মতো ভেতরে গুটিয়ে আনতে পারলেই তাঁকে পাওয়া যায়।’

‘পেলে কী হয়!’

‘আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ। শান্তি, শান্তি, শান্তি। জ্যোতি, জ্যোতি, জ্যোতি। তুমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শুনেছো?’

‘অফকোর্স। আমি ক্রিস্টোফার ইশারউডের বই পড়েছি।’

আনন্দে অ্যানকে জড়িয়ে ধরলুম। ছেলে কী মেয়ে, আমার জানার দরকার নেই।

অ্যান দক্ষিণেশ্বরের নাম শুনেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় রামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটিতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের বক্তৃতা শুনেছে। খন্ডনভব বন্ধন জগ প্রার্থনা সংগীত অর্গ্যান আর পাখোয়াজ সহযোগে। ছুপা রুস্তম এখন আমাকে পরীক্ষা করছে, ঈশ্বরদর্শন হলে কী হয়! ‘বুঝলে অ্যান, ঠাকুর রামকৃষ্ণ কী বলে গেছেন, ঈশ্বরদর্শন হলে চৈতন্য লাভ হয়। চৈতন্য লাভ করলে সমাধি হয়, মাঝে মাঝে দেহ ভুল হয়ে যায়, কামিনী-কাঞ্চনের ওপর আসক্তি থাকে না, ঈশ্বরীয় কথা ছাড়া কিছু ভালো লাগে না, বিষয়ের কথা শুনলে কষ্ট হয়।’

‘আমরা ঈশ্বর থেকে বহুদূরে, তবু বলব, এই যে আমাদের আলোচনা, আমাদের এই মুহূর্তের অনুভূতি, একটি কথাই প্রমাণ করে, তাঁর তরঙ্গ আমাদের স্পর্শ করেছে।’

‘ঠাকুর কী বলতেন জান, চুম্বক শুধু লোহাকে টানে না, লোহাও চুম্বককে টানে। আমরাও তাঁকে টেনেছি। একেই বলে স্থান মাহাত্ম্য। তুমি তো মায়া গবেষক। তুমি জান, এইখানে ছিল মায়া-শহর টি-হো। ওঁদের শহর মানেই সাধনক্ষেত্র। হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূমিতে তন্ত্রমতে শক্তির আরাধনা হয়েছে। সাধনার সেই তরঙ্গ আজও এখানে জমাট হয়ে আছে। তুমি তো জান, একখন্ড লোহার ওপর দিয়ে রেলগাড়ির লোহার চাকা চলে গেলে লোহা চুম্বক হয়ে যায়।’

‘তুমি কি জান, আমরা যে শহরে বসে আছি, এইখান থেকেই শুরু হয় মায়া ধ্বংসাবশেষ দেখার অভিযান। এই শহরই হল অতীতের চৌকাঠ। ভাবলেই আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। তোমার হচ্ছে না?’

‘আমার হচ্ছে না মানে! আমার মনে হচ্ছে, আমি সেই অতীতের বাতাসেই শ্বাস নিচ্ছি। সেই দূর অতীতের ছায়াদৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাবছে। আমি কখনো মায়া-ইন্ডিয়ান হয়ে যাচ্ছি, কখনো স্প্যানিশ কনকুইস্তাদর।’

কোথায় যে এত সুন্দর কনসার্ট হচ্ছে! আমাদের সামনে পেছনে দু-সার গাছ। দূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা বাতাসে ফিস ফিস করছে। যেন অতীতের গল্প বলছে মা তার শিশুকে। দাসী মেয়েটিকে মায়া পুরোহিত নিয়ে চলেছেন বলি দেবার জন্যে। বছরের পর বছর বৃষ্টি নেই। চুনা পাথরের জমিতে জলধারণ ক্ষমতা নেই। অজন্মা। শহর ছেড়ে শহরবাসীরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছে।

পৃথিবীর কোনো ঘটনাই হারায় না। বাস্তব জগৎ থেকে উঠে যায় ভাবের জগতে। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলে সবই ফিরে আসে একে একে।

অ্যান হঠাৎ কনসার্টের সুরে কন্ঠ মিলিয়ে ‘ওম, ওম’ বলতে শুরু করল। আমার মনে হল, এইখানে এই পরিবেশে যদি খন্ডনভব সংগীতটি বেলুড়মঠের সুরে গাওয়া যেত, তাহলে অসাধারণ হত। এইবার পর পর দুটি ঘোড়ার গাড়ি চলে গেল। নির্জন পথে ঘোড়ার খুরের শব্দ, দূর থেকে মিলিয়ে গেল দূরে। আমাদের সামনের বাড়ির আলোকিত ব্যালকনিতে দুটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। পরনে যেন পরীর পোশাক। দুগ্ধধবল। কানের পেন্টাণ্ডে মনে হয় বহুমূল্য পাথর বসানো। মাঝে মাঝে ঝিলিক মেরে উঠছে।

অ্যান বললে, ‘এই শহরের সবাই কেমন সুখী!’

‘কোথা থেকে এরা এত সুখ পেল, অ্যান? এত সৌন্দর্য!’

‘স্পেনের ছেলেমেয়েরা সুন্দরই হয়। তারপর বিত্ত। তারপর কালচার। দেখছ না, কোথাও কোনও উচ্চকন্ঠ নেই। দৌড়ঝাঁপ নেই। স্প্যানিশ মেয়েরা খুব ভদ্র হয়। খুব হোমলি। পতিপরায়ণা। ভালো মা হয়। গুছিয়ে সংসার করতে পারে। ভালো রাঁধতে পারে, নাচতে পারে, গাইতে পারে। লেখাপড়ায় ভালো। কথায় কথায় স্বামী পালটায় না। বড়ো সংসার পছন্দ করে। মেয়েরা ভালো হলে সংসার সুখের হয়, ছেলে-মেয়েরা মানুষ হয়। স্পেন অনেক দিনের সভ্যতা। বীর বিজেতা। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। যুদ্ধবিগ্রহ করে বড়ো হয়েছে। সেই অহঙ্কার এখনও কাজ করছে। তবে মেকসিকো সিটিতে গেলে তুমি এই স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবটা পাবে না। সেখানে অনেক সমস্যা, দারিদ্র্য, জীবিকাহীনতা, পাপচক্র, মাফিয়াচক্র, দেহব্যবসা, সবই পাবে। তবে, পেলেও তোমার খারাপ লাগবে না। ভূগোল আর ইতিহাস, দুয়ে মিলে একটা ভাবপরিমন্ডল তৈরি করে রেখেছে।’

আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমরা উঠে পড়লুম। মসৃণ রাত ঘুমের আঁচল বিছোবার চেষ্টা করছিল। বলা যায় না, আমরা হয়তো পথের পাশেই অকাতরে ঘুমিয়ে পড়তুম এক সময়।

অ্যান শরীরটাকে টানটান করে আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে বললে, ‘চলো তো, কোথায় ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, দেখি। আজ সারা রাত আমরা ভূতের মতো শহর প্রদক্ষিণ করব। বড়ো রাস্তা ছেড়ে অলিতে গলিতে ঢুকে পড়ব। বসে থাকব প্রাচীন কোনোও পার্কে, ঐতিহাসিক কোনও মূর্তির পাদদেশে।’

আবার শুরু হল আমাদের হন্টন। এমন উৎসাহী, কল্পনাপ্রবণ ভ্রমণসঙ্গী পেলে বেড়ানোর আনন্দ শতগুণ বেড়ে যায়। আমরা যে পথ ধরে চলেছি, তার নাম এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা মোন্তেজোর নামে, প্যাসিও মোন্তেজো। দুপাশেই প্রাসাদশ্রেণি। হঠাৎ একসময় আমাদের সামনে যেন ভেলকি খেলে গেল। নির্জনতা থেকে জনারণ্যে। আলো, রং, টুপি, পোশাক, সামান্য কলরব, ব্যস্ততা, শব্দ, গন্ধ।

অ্যান বললে, ‘এ আমরা কোথায় এলুম?’

‘মনে হয় মার্কেট প্লেস।’

সত্যিই তাই, জোকালো স্কোয়ার পেরিয়ে আমরা মেরিডার বাজারে চলে এসেছি। দিনের কেনাবেচা শেষ। হাট প্রায় ভেঙে এসেছে। এইখানেই আমরা প্রথম দেখলুম, খাঁটি মায়া ইন্ডিয়ান। কিছুই না, তবু মন যেন ভরে গেল। বাবা, এঁরাই তাঁরা, যাঁরা মায়া-সভ্যতার মতো একটা অসাধারণ ব্যাপার সাতসমুদ্রের পারে, পৃথিবীর এ প্রান্তে আপন মনে, নীরবে নিভৃতে গড়ে তুলেছিলেন! চাকার ব্যবহার এঁদের কাছে অসম্ভব ছিল না, তবু করেননি। হয় তো কোনো সংস্কার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এঁদের মৃৎশিল্পীরা চাকা ব্যবহার না করেও হাতের জাদুতে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম রচনা করে গেছেন। চাকার সাহায্য ছাড়াই দূরদূরান্ত থেকে পাথরের চাঁই এনে প্রাসাদ, পিরামিড গড়েছেন।

আমি কেন, মায়া-ইণ্ডিয়ানদের যিনিই দেখবেন তিনিই থমকে দাঁড়াবেন। বহু বহু বছরের অতীত ইতিহাসের পাতা থেকে যেন উঠে এসেছেন জীবন্ত হয়ে। মায়া ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষে যে মুখ উৎকীর্ণ দেখেছি, অবিকল সেই মুখচ্ছবি। কপাল থেকে নাক গড়িয়ে এসেছে কোন খাঁজ না রেখে। যার ফলে মুখের চেহারা দাঁড়িয়েছে খাঁড়ার মতো। দু-টি মঙ্গোলিয়ান চোখ সেই মুখে আটকানো। মাথার মধ্যভাগ চ্যাপ্টা। এই থ্যাবড়া সমতল ভাবটা তাঁরা ইচ্ছে করে তৈরি করতেন শৈশব অবস্থা থেকেই। কৃত্রিম উপায়ে। করার কারণ, মাথায় করে মাল বহনের সুবিধা হবে। অ্যানথ্রোপলজির সংজ্ঞায় একে বলে ব্র্যাকাইসেফালিক ক্রেনিয়াম। চোখের দৃষ্টিতে অল্প একটু তেরছা ভাব। সকলেই ট্যারা নয়। যাঁরা ট্যারা, তাঁরা সম্মানিত। ঈশ্বর-প্রতিম। কারণ স্বর্গের দেবতা ইতযামনার চোখও ট্যারা। মায়াদের গড় উচ্চতা এক মিটার পঞ্চান্ন সেন্টিমিটার। মেয়েদের চুল বেশ লম্বা এবং মোটা। একটি মাত্র চওড়া বিনুনি করে পিঠে ঝোলানো। ছেলেদের মাথায় গোঁজা থাকে একটি করে গোল আয়না। মেয়েদের মাথায় আয়না থাকে না। আয়না হল প্রতীক। স্ত্রী পরিত্যক্ত স্বামীকে মহিলারা যদি অপমান করতে চান, তাহলে সেই অপমানের ভাষা হল—‘ওর বউ নিজের চুলে আয়না গুঁজেছে।’

পুরুষরা সাধারণত কটিবস্ত্র পরিধান করেন! ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত! কাঁধে ফেলা থাকে কম্বলের মতোই একটা জিনিস। মায়া ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘পঞ্চো’। খুব শীত করলে ওইটাই খুলে গায়ে দেন। রাতে কম্বলের মতো বিছিয়ে নিদ্রা। ঠিক ভারতীয় সন্ন্যাসীর মতোই পোশাক আশাক ও জীবনযাত্রার ধরন। কেউ যদি বলেন, মায়ারা ছিলেন ভারতীয় সন্ন্যাসী, তাহলে প্রতিবাদ করব না।

মেয়েদের পোশাকও খুব সহজ সরল, তবে অ-ভারতীয়। তলায় স্কার্ট, ওপরে শার্টের মতো একটি জিনিস। হাঁটা-চলা কথা বলায় ধীর স্থির শান্ত। আমরা দু-জনে একপাশে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছি। যেন বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ চলে এসেছি হাজার বছর পেছনে। অতীত ইতিহাসের পাতায়। সময় যেখানে আটকে গেছে। বিংশ শতাব্দী প্রবাহিত হয়ে গেছে চারপাশ দিয়ে। সমুদ্রে জোয়ারের জল বেরিয়ে যাবার পরেও যেমন আটকে থাকে খাঁড়িতে। এই জায়গাটা হল সময়-সমুদ্রের খাঁড়ি। অতীতের জলাশয়।

অ্যান বললে, ‘তাকিয়ে দেখো, এনসেন্ট, মিস্টিরিয়াস ফেসেস। এই হল ঠিক ঠিক ইণ্ডিয়ান বাজার। তোমাকে এইটাই আমার দেখাবার ইচ্ছা ছিল। মায়া সভ্যতার কালে যা হত, যেভাবে হত, আজও তাই হচ্ছে।’

একপাশে বহু বর্ণের জামাকাপড়ের পাহাড়। বসে আছেন ইণ্ডিয়ান বিক্রেতা। তাঁর সেই প্রাচীন পোশাকে। দু কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুলে আছে ভাঁজ করা পঞ্চো। কালো কুচকুচে চুল। চুলে গোঁজা গোল চ্যাপ্টা আয়না। সেই আয়না মাঝেমধ্যে ঝিলিক মেরে উঠছে। বহুবর্ণের পোশাক বিক্রেতার পাশেই টুপির পাহাড়। ঘাসের টুপি, খড়ের টুপি। টুপিরও কী বাহার! ওপাশে নানারকম ফল ও ফুল, মশলা। মশলার কড়া গন্ধের সঙ্গে মিলেছে ফল ও ফুলের মিষ্টি গন্ধ। রাত এমন মোহময়ী হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। বিক্রেতা পুরুষ ও মহিলারা মায়াপান ভাষায় কী বলছেন নিজেদের মধ্যে জানি না।

আমরা দু-জনে মিশে গেলুম সেই বাজারের ভিড়ে। ফল, ফুল, মশলা, আর রঙিন পোশাকের জগতে। ইন্ডিয়ান পুরুষ আর মহিলাদের অঙ্গ থেকে যেন ধূপ ধুনোর মিশ্রিত গন্ধ বেরোচ্ছে।

আমি দেখলুম, বাজার আর বেসরকারি বাস, এই দুটোকে আমরা যত শব্দময় করে তুলতে পেরেছি, পৃথিবীর আর কেউ তেমন পারেনি। এই ফুল, ফুল আর পোশাকের বাজারটা আমাদের দেশের হলে কী অবস্থা হত! চিৎকার, চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলি, জল, কাদা, আবর্জনা। মায়া ইণ্ডিয়ানরা কথা কম বলেন। বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা দাঁড়িয়েই আছেন। যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা বসে। কেউ হয়তো একটা পোশাক বাতাসে দোলাচ্ছেন। কেউ ‘আসুন আসুন’ ভঙ্গিতে তাঁর জিনিসপত্রের উপর হাত নাড়চ্ছেন। যেন বলতে চাইছেন, আইয়ে, বইঠিয়ে।’

আমাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে বাহারী পোশাকের প্রান্ত। মায়া নারীদের মুখে চাপা আলো পড়ে মনে হচ্ছে মানবী নয়, অতি প্রাচীন কোনও দেবী। মুখ চকচক করছে ঘামতেলে। কুচকুচে কালো চুল। সামনে সিঁথি। টান করে আঁচড়ানো। পেছনে ঝুলছে একটিমাত্র বিনুনি। বিনুনির প্রান্তভাগে নানা বর্ণের ফিতে বাঁধা। গাঢ় রঙের স্কার্ট, সাদা ব্লাউজ। পায়ে চামড়ার ফিতে বাঁধা চটি। আমার মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দূর অতীতের স্বপ্নে আছি।

আমরা একটু আলো-আঁধারি জায়গায় ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছি। আর একটু পরেই এই বর্ণাঢ্য সমারোহ গুটিয়ে আসবে। মায়া ভারতীয়রা ফিরে যাবেন তাঁদের আস্তানায়। ফল আর ফুলের গন্ধে অন্ধকার যেন টুকরো টুকরো হয়ে মৌমাছির মতো উড়ছে। ফলের মধ্যে রয়েছে লেবু, বড়ো বড়ো পেঁপে, বেরি, কলা, পাকা অলিভ, বহু রকমের লঙ্কা, থোকা থোকা আঙুর, জামরুল, পিচ, অ্যাপ্রিকট, চেরি। মাথার ওপর থেকে আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে ফ্লোরেন্সের কোনো বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা স্টিল লাইফ। বাটখারা, দাঁড়িপাল্লার কোনও ব্যাপার নেই। আধুনিক ওজন-যন্ত্র। ডোরাকাটা সুন্দর প্লাস্টিকের ব্যাগ। যত রাত বাড়তে লাগল, ক্রেতার সংখ্যা কমে এল। গম্ভীর দর্শন, ঋজু চেহারার মায়া ইণ্ডিয়ানরা একে একে দোকানপাট গুছোতে লাগলেন। ঘোড়ার পায়ের শব্দ। সাদা সাদা গাড়ি, সুন্দরী আরোহীদের নিয়ে চলেছে। শহর এইবার ঘুমিয়ে পড়বে আজ রাতের মতো।

আমাদের কেনার কিছু নেই। ভাঙা হাটে মন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। সারাদিনের আসর গুটিয়ে এলে মনের মধ্যে কেমন একটা ‘যাই যাই’ সুর বেজে ওঠে। আমরা চলে আসছি, হঠাৎ এক ইণ্ডিয়ান রমণী এগিয়ে এসে আমাদের দু-হাত ভরে দিলেন ফুলে। তার ভাষা যতটুকু বোঝা গেল, তার অর্থ দাঁড়াল, দিনের বেচাকেনার পর এ অবশিষ্ট ফুল তো শুকিয়েই যাবে। তুমি বিদেশি, তোমাকে আমার এই উপহার। এক আঁজলা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরের রাজপথে। এমনও হয়! এমন ঘটনাও ঘটে যুদ্ধবাজদের এই বিশ্বে। যেখানে বিভেদের পাঁচিল তুলে দেশনায়করা ক্ষমতা আর গদির চাষ করেছেন।

ফুলওয়ালী ইণ্ডিয়ান তরুণী আমাকে কী একটা জিজ্ঞেস করলেন।

অ্যান দোভাষীর কাজ করলে। তরুণী জিজ্ঞেস করলে, আমি কোন দেশের? আমিও কি ইণ্ডিয়ান?

মেয়েটি ভারতের নাম শোনেনি। জানে না মানচিত্রের কোথায় আছে ইণ্ডিয়ান নামক দেশটি, যে দেশের অধিবাসীকেও ইণ্ডিয়ান বলে। অ্যান নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল। মেয়েটি বুঝল কি বুঝল না, বোঝা গেল না। শেষে অ্যান জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন যাবে কোথায়?’

মেয়েটি বললে, ‘বাড়ি যাব। তার আগে রাতের খাওয়া সেরে নেবো এখানকার কোনও রেস্তরাঁয়।’

অ্যান জিজ্ঞেস করলে, ‘এখানে কোনো ইণ্ডিয়ান রেস্তরাঁ আছে? যেখানে প্রকৃত ইণ্ডিয়ান খাবার পাওয়া যায়।’

মেয়েটি বললে, ‘আমার সঙ্গে চলো না?’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কী যেন বললে, এক বর্ণও বুঝতে পারলুম না। বোকার মতো হেসে সামাল দিতে চাইলুম। মেয়েটির হাসি আরও স্পষ্ট হল।

অ্যান বললে, ‘বুঝতে পারলে কিছু?’

‘না। কিছুই বুঝিনি।’

‘বললে, ইণ্ডিয়া কোথায় জানি না, তবে আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমাদেরই একজন।’

আমরা রাজপথ ছেড়ে গলিপথে ঢুকলুম। গলি, সেও কত সুন্দর। পাথরের দেশ। সবই পাথর বাঁধানো। কার্নিভালের তাঁবুর মতো একটা দোকানে এসে আমাদের চলা শেষ হল। উনুনে গনগনে আগুন। ভারতের কথা মনে করিয়ে দিলে। আমাদের দেশের পাঞ্জাবি কি হিন্দুস্থানী খানাঘরে এই দৃশ্যই চোখে পড়ে। সেখানে তন্দুরি রুটি হয়। কাবাব চিড়বিড় করে চ্যাটালো কড়ায়। এখানে কী হচ্ছে দেখি।

সাংঘাতিক একটা কিছু তৈরি হচ্ছে। এত খুশবু পৃথিবীর কোনও খাদ্য তৈরির সময় ছড়ায় কিনা আমার জানা নেই। পৃথিবীর কটা খাদ্যই বা খেয়েছি। অ্যান জিজ্ঞেস করলে, ‘কী তৈরি হচ্ছে মম?’

‘মম’ সম্বোধনে বর্ষীয়ান ইণ্ডিয়ান রমণী ভীষণ খুশি হলেন। ‘মা’ নামের এত সম্মোহন। এক গাল হেসে বললেন, ‘মোল পোবলানো’। বস্তুটি কী? তিনি ব্যাখ্যা করলেন। আছে কাঁচা লঙ্কা, রসুন, কলা, পেঁয়াজ, লবঙ্গ, ধনে, জিরে, চিনি ছাড়া চকোলেট। এই সব মিলে তৈরি হচ্ছে সস। সেই সসে পড়বে ঝলসানো টার্কি। পদটির তখন নাম হবে, ‘টার্কি-মোল পোবলানো।’ এইটি হল মেকসিকোর ‘ন্যাশন্যাল ডিশ’।

মহিলা বললেন, ‘টেস্ট করে দেখো। যত খাবে ততই মনে হবে, আরও বাঁচি।’

অ্যান বললে, ঠিক আছে, আমরা বসছি।’

ইণ্ডিয়ান যাঁরা বসেছিলেন, অপেক্ষায় অথবা আহারে, তাঁরা সরে সরে খাতির করে আমাদের বসতে দিলেন। আমি বসে ভয়ে ভয়ে অ্যানকে বললুম, ‘ওই জিনিস খাবে অ্যান? কলার সঙ্গে রসুন, তার সঙ্গে পেঁয়াজ, পেঁয়াজের সঙ্গে চকোলেট, তার সঙ্গে মুরগি। এ তো গুরুচন্ডালি ব্যাপার। পেটে ঢুকে যদি মেকসিক্যান বিপ্লব শুরু করে দেয়!’

অ্যান বললে, ‘কাপুরুষের মতো কথা বলো না। বীরপুরুষ হও।’

দ্যাখো অ্যান, খেয়ে মরলে কেউ বীরপুরুষ বলবে না। যুদ্ধ করে মরলে বলতেও পারে।’

‘তুমি দয়া করে ভয় পেয়ো না। জানবে, আমি তোমার সঙ্গে আছি।’

মনে মনে বললুম, ‘হোতা হ্যায় ওহি, মঞ্জুরে যো খোদা।’

রেস্তরাঁ এত পরিষ্কার রাখা যায় কী করে। নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম। ইণ্ডিয়ান পুরুষদের পরিধানে জাতীয় পোশাক। লম্বা চুল। কপালে হেডব্যাণ্ড। অনেকেই পান করেছেন। স্বদেশি আরক। সাধারণ মানুষের পানীয় ছিল এক সময়, ‘পালকে’। বেশ ভীতিপ্রদ আরক। ম্যাগুয়ে ক্যাকটাসের বালব থেঁতো করে রস বের করা হত। সেই রসকে জ্বাল দিয়ে জারিয়ে তৈরি করা হত ‘পালকে’। শুনলেই ভয় করে। মনসাগাছের মদ। মনসা গাছ তো শুনেছি বিষাক্তই হয়। ‘পালকে’-র চেয়ে প্রিয় এখন ‘তেকুইলা’।

‘তেকুইলা’ একটি ইণ্ডিয়ান গ্রাম। সেই গ্রামে তৈরি হয় এই বিখ্যাত মদ। সেই বিখ্যাত ‘মেসক্যালিন’, যা পান করে অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন বিখ্যাত লেখক অলডাস হাক্সলি। আর তাঁর সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই জীবনের শেষ গ্রন্থ—দি ডোরস অফ পারসেপসান’, ‘হেভন অ্যাণ্ড হেল!’ এই সূত্রে হাকসলির একটু স্মৃতিচারণ করে নিই। বাঙালি মনীষার খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি, আর জীবনের শেষভাগটা তিনি মায়া সভ্যতার দুয়ারপ্রান্তেই কাটিয়ে গেছেন। ১৯২০ থেকে ’৩০ তিনি ছিলেন ইতালিতে। ’৩০ সালে চলে এলেন তুলোঁর কাছে সানারি বলে একটা জায়গায়। এইখানেই বসে লিখলেন ব্রেভ নিউ ওয়ার্লড। হাক্সলি সারাটা জীবন দৃষ্টিক্ষীণতায় অস্বস্তি বোধ করে গেছেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ইওরোপ ছেড়ে চলে এলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। কে যেন বলেছিলেন, ক্যালিফোর্নিয়ায় চোখ ভালো থাকে। এইখানেই বসবাসের সময় আধিভৌতিক জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সাধারণ মানুষ যে দুর্জ্ঞেয় জগতের খবর নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করে না। এইখানেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সেই অভিজ্ঞতারই ফসল দুটি রচনা—ডোরস অফ পারসেপসান আর হেভন অ্যান্ড হেল। ১৯৫৫ সালে মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী মারিয়া। বেহালা বাদিকা লরা আরচারার সঙ্গে আবার বিয়ে হল। তিনি ছিলেন আবার প্র্যাকটিসিং সাইকোথেরাপিস্ট। ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় হাক্সলির মৃত্যু হয়।

নানা জাতের নানা ধরনের মনসা গাছই হল ক্যাকটাস। মধ্য আমেরিকা ও মেকসিকোর জলহীন, প্রায় মরুভূমি-সদৃশ অঞ্চলে শোষক কাঁটাযুক্ত এই কঠিন উদ্ভিদের ছড়াছড়ি। আমরা জন্মাই, খাই দাই, বগল বাজাই, এক সময় টেঁসে যাই। জানতে পারি না, জানার চেষ্টাও করি না বিপুলা এই পৃথিবীর বিচিত্র রহস্য—ঈশ্বরের নিজের হাতের দীর্ঘ সাধনার চিড়িয়াখানা ও বোট্যনিক্যাল গার্ডেনটিকে। কী কান্ড যে করে বসে আছেন তিনি!

কোনো কোনো মানুষ তাঁরই ইচ্ছায় ভাত-ডাল, জরু-গোরুর এই জীবন ছেড়ে রহস্যের কোণা ধরে টান মারতে ছোটেন। অজানা সমুদ্রে পোত ভাসান! পাহাড়-চূড়ায় উঠে যান। গভীর অরণ্যে মৃত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে ক্ষণ-জীবনের মায়া ছেড়ে প্রবেশ করেন। ফারাওদের ভৌতিক আবেশ উপেক্ষা করে, নেমে যান পিরামিডের কন্দরে। তলিয়ে যান সমুদ্রের অতলে। স্পর্শ করে আসেন হাজার বছর আগের কোনো রক্ত-জাহাজের ডুবো কঙ্কাল। আমরা আরাম কেদায়ার বসে আমাদের অবসর সময়ে সেই কাহিনি পড়ি। বলি, অ্যাডভেঞ্চার পড়ছি।

১৮৮৬ সালে এক জার্মান ঔষধ বিজ্ঞানী লুডভিগ লেউইন প্রথম ক্যাকটাস সম্পর্কে তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণালব্ধ জ্ঞান গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেন। পরবর্তীকালে এই প্রজাতির ল্যাটিন নামের সঙ্গে তাঁর নামও যুক্ত হল—অ্যানহালোনিয়াম লেউইনি। বিজ্ঞানে এই গবেষণা সম্পূর্ণ নতুন। আদি মানবের ধর্মে, মেকসিকোর ইণ্ডিয়ানদের কাছে, দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার আদিবাসীদের কাছে এই মনসা বহুদিনের বন্ধু। যেমন আমরা বলি, মা মনসা আমাদের লোকসংস্কৃতিতে দেবী। মেকসিকোর মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন যে স্প্যানিশ কনক্যুইস্তাদররা, তাঁদের একজন ঠিক একই কথা বলেছিলেন। তাঁরা সদলে এক জায়গায় বসে মায়া ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে ভাগ করে গাছের শিকড় খাচ্ছিলেন। ইণ্ডিয়াদের ভাষায়, ‘পেয়তল’। ‘পেয়তল’ হল এক জাতির মনসা। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে তাঁরা অনুভূতির এক ভিন্নতর জগতে নিজেদের হারিয়ে ফেললেন। ঘোর কেটে যাবার পর তাঁরা বললেন, এ তো খাদ্য নয়। বন্ধু। না, বন্ধু, নয়, এ হল দেবতা। আমাদের বিশ্বাসেরই প্রতিচ্ছায়া মা মনসা। সাপের বদলে, সাপ তাড়ানোর গাছ মনসা।

এই ‘পেয়তল’ নির্যাসের কার্যকরী মৌল উপাদানের নাম ‘মেসকালিন’। জ্যায়েনস্ক, হ্যাভেলক এলিস, উইর মিচেল প্রমুখ বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানীরা এই মেসকালিন নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। তবে প্রত্যেকেই একটা জায়গা অবধি গিয়েই থেমে পড়েছেন ; কারণ তাঁদের পশ্চিমী বুদ্ধিতে আর অগ্রসর হবার সাহস পাননি; কারণ তাহলেই প্রাচ্য দুনিয়া ও মায়াদের পৌত্তলিকতাকে মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় বেদের সৎ চিৎ আনন্দকে। ফেলে দিতে হয় দেববদ্ধ আমি -কে। চলে যেতে হয় ‘অনামি’-র জ্যোতিজর্গতে। যেখানে, সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ। স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গলম। ঋগ্বেদের দর্শন প্রত্যক্ষ করা যায়, সেই মহা, মহা, মহাপুরুষ, যাঁর সহস্র মস্তক, সহস্র নয়ন, সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বতোভাবে পরিবেষ্টন করে আছেন। সেই আলিঙ্গনে ধরা পৃথিবী অথবা ব্রহ্মান্ডের পরিমাণ মাত্র দশ আঙুল। বস্তুজগৎ হল তাঁর জ্যোতির উদ্ভাস।

সেই তাঁবু-রেস্তরাঁয় সকলেই প্রায় ‘তেকুইলা’ পান করেছেন। ‘মেসকালিন’-এর তরল লঘু সংস্করণ। ঋষির মতো সেই সব মানব-মানবীরা ক্রমশই চেতন থেকে অতি চেতন জগতের দিকে এগিয়ে চলেছেন। চোখ-মুখ দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে। স্থির দৃষ্টি উজ্জ্বলতর হচ্ছে। দেহের সমস্ত চঞ্চলতা ক্রমেই শান্ত হয়ে আসছে। এখন মনে হচ্ছে, আমরা কোনো খানাপিনার জায়গায় আসিনি, এসে পড়েছি কোনো ধ্যান মন্দিরে। অবাক হয়ে গেলুম দেখে, কোণে ধূপ জ্বলছে। চন্দন, কস্তুরির গন্ধ। সঙ্গে অন্য কোনো রজনও জ্বলছে। সব মিশে তৈরি হয়েছে অপূর্ব এক সুগন্ধ। সেই সুগন্ধে মিলেছে ‘মোল পোবলানোর’ সুবাস। আমাদের বিপরীত দিকে বসেছে সেই ফুলওয়ালী ইণ্ডিয়ান রমণী। তার উপহার দেওয়া একরাশ সাদা ফুল অ্যানের কোলে জড়ো হয়ে আছে। যত রাত বাড়ছে, সেই ফুলও ততই গন্ধে পাগল হয়ে উঠছে।

সকলেই অল্প অল্প কথা বলছেন। মায়া ভাষা ভীষণ সুরেলা। অনেকটা সংগীতের মতো। সাধারণ কথা, মনে হচ্ছে গান গাইছেন সকলে। কিছুই বুঝছি না; তবু সম্মোহিত। একাক্ষরী ভাষা। বিশাল বিশাল বাক্য তৈরির প্রয়োজন হচ্ছে না। এ ভাষার ব্যাকরণ মনে হয় খুবই সহজ হবে। একটা শব্দ বারে বারেই আসছে ‘পোল’। ‘পোল’ মানে কী?

ফুলওয়ালী, যাকে আমি রাত আর একটু গড়াতেই ‘ফুলদি বলে সম্বোধন করেছিলুম, তিনি বললেন, ‘পোল’ মানে মাথা, হেড। ফুলদি মায়া তো জানেনই, স্প্যানিশ শিখেছেন। ট্যুরিস্টদের সংস্পর্শে এসে ইংরেজির কাজ চলা জ্ঞানও হয়েছে। তিনি ভালো ছাত্র পেয়ে আমাকে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মায়া ভাষায় যা বলে, শিখিয়ে দিলেন। মাথা হল পোল, মুখ উইচ, চোখ ইচ, নাক নি, মুখগহ্বর চি, জিভ ইহাক, দাঁত কোহ, ঘাড় কাহল, চুল সোতস, বুক সেম, পেট নাহক, পিঠ পুচ, হাত কা, হাঁটু পিশ, পা ওক, পেটের ভেতর কচ।

অ্যান আমার হাতে হাত রেখে ফিসফিস করে বললে, ‘এক পাত্র তেকুইলা খাবে নাকি! এ সুযোগ তো আর সহসা আসবে না।’

সব কথাই ফিসফিস করে বলতে হচ্ছে। এ হল সংগীতের দেশ। কম কথার দেশ। স্বপ্নাবেশের দেশ।

আমি বললুম, ‘যদি কিছু হয়?’

‘কিছুই হবে না। ভাগ্য ভালো হলে, আধ্যাত্মিক একটা অনুভূতি হবে। সৎ চিৎ আনন্দ। সচ্চিদানন্দ হয়ে যাব।’

সেই মুহূর্তে অ্যানকে এত ভালো লাগল। এ তো নিউক্লিয়র এজ বা জেট এজের মেয়ে নয়। বিশ্বাসে চালচলনে সম্পূর্ণ ভারতীয়। অ্যানকে কোনোদিন যদি আমার মাতাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারতুম আমাদের সারদামঠে, তাহলে বেশ হত।

আমি বললুম, ‘বেশ, তাহলে বলো। দেখা যাক কী হয়!’

ফুলদি বললে, ‘দাঁড়াও, আমি বলে দিচ্ছি।’

মহিলা সাপের মতো ‘হিস’ করে একটা শব্দ করলেন। একজন সঙ্গেসঙ্গে এগিয়ে এলেন আমাদের কাছে। তাঁর বুকের কাছে দুলছে গোল একটা আয়না। মাঝে মাঝে একটা নির্দিষ্ট কোণে এলে বিদ্যুতের মতো আলোর চমক হচ্ছে। ফুলদি তিনটে আঙুল তুলে ইশারা করলেন।

তিন চার চুমুক ‘তেকুইলা’ খাবার পর পানীয়টি বেশ স্বাদে ধরে গেল। মদ সম্পর্কে আমার এবং অ্যানের দুজনেরই অভিজ্ঞতা শূন্য। শুনেছি হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, রাম ইত্যাদি মোটেই সুস্বাদু নয়। মানুষ নেশার কারণে খায়। তেকুইলা কিন্তু স্বাদে অসহনীয় নয়। আধ গেলাস পান করার পর পায়ের দিক থেকে শরীরটা ক্রমশ হালকা হতে শুরু করল। আগে একটা পা তুলে এপাশ থেকে ওপাশ নিয়ে যেতে, বা তুলে একই জায়গায় নামাতে যতটা শক্তির প্রয়োজন হচ্ছিল, এখন আর তা হচ্ছে না। গোটা শরীর একেবারে পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে। সব কিছু ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সমস্ত কিছুর ভেতর থেকে যেন তার নিজস্ব আলো বেরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, আমরা আর ঘটনার বাইরে নেই, ঘটনায় ডুবে গেছি, জলে ডুবে যাবার মতো। নিজেকে আর কোনও কিছু থেকে আলাদা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে আমিই সব। আমিই অ্যান। আমিই ফুলমাসি বা ফুলদিদি। আমিই ওয়াটার। যাঁরা এখানে টেবিলে বসে আছেন, তাঁরাও আমি। গেলাস আমি, প্লেট আমি। আমিই পানীয়। আমিই খাদ্যবস্তু, সব আমি। ম্যাড়মেড়ে ম্রিয়মাণ। আমি নই, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্মান আমি। আরও কয়েক ঢোঁক পান করার পর মনে হল, বস্তুজগৎ হল আলো। সেই আলো আর আলো, আর আলোক-সমুদ্রে ছায়াসম ভাসে বিশ্ব। বস্তুপুঞ্জ। একসময় মনে হতে লাগল, এক থেকে আর এক, আর-এক থেকে আর-এক হয়ে যাচ্ছে। একই বহু, বহুই এক হয়ে যাচ্ছে। আমার আর কিছুই করার নেই। বসে আছি নিশ্চেষ্ট এক সাক্ষী পুরুষেও মতো। আনন্দময় এক মহাপুরুষের মতো। সৎ চিৎ আনন্দ শোনাই ছিল, অভিজ্ঞতাটা হল ‘তেকুইলা’ পানের পর।

অ্যান আমার কাঁধে হাত রেখেছে। আমি অ্যানের কাঁধে। এখন এই লেখার সময় ‘আমি’ ‘তুমি’ ভেদ আসছে, তখন কিন্তু কে আমি কে তুমি এই ভেদ একেবারেই ঘুচে গিয়েছিল। ‘ফিউসান’, সব কিছুর সঙ্গে সব কিছু যুক্ত হয়ে যাওয়া। দেহের আমি-র তিনের চার ভাগ ঘুচে গেলেও একের চার ভাগ অবশিষ্ট পড়েছিল তলানির মতো দেহভান্ডে। সেই এক চতুর্থাংশ আমার বোধে সাহায্য করেছিল। আমার সংস্কার অনুযায়ী দেব দেবী ও অবতার পুরুষদের আবির্ভাব হতে লাগল। এক বস্তু থেকে আর এক বস্তুর প্রকৃত দূরত্ব কত আর বলা যাবে না। হঠাৎ মনে হল, বাইরের পথটা আমাদের টেবিলের উপর দিয়ে চলে গেছে। টেবিলের ওপরের গেলাসটা কতটা হাত বাড়ালে পাব, সেই আন্দাজটা আর নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে দেশ-কাল-পাত্রের বোধটাও চলে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সামনে পরিবেশিত হল সেই বিখ্যাত ‘ন্যাশনাল ফুড’ মোল পোবলানো। আর তো বলতে পারবে না, ওই খাদ্য প্রকৃত কেমন স্বাদু। কেন না খাদ্য-খাদক সম্পর্ক সম্পূর্ণ লুপ্ত। ব্রহ্মানুভূতিতে মানুষের আনন্দ আর একাত্মতা বোধ ছাড়া আর কিছু থাকে না। তবু যা মনে হল, বলি, যেন স্বর্গের উদ্যানে বসে অভিজ্ঞতার উৎকৃষ্টতম খাদ্যটি গ্রহণ করছি। হঠাৎ মনে হল আমরা উলটে গেছি। আমাদের মাথা মেঝের দিকে। আমরা শূন্য থেকে সেই অবস্থায় নীচের দিকে হাত বাড়িয়ে খাদ্য গ্রহণ করছি। ভোজ্যবস্তু মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম না মেনে অক্লেশে উদরে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, ঘরটা সবুজ জলপূর্ণ এক জলাধার, আর আমরা কেউ মানুষ নই, অসংখ্য লাল নীল মাছ। নিজেদের ইচ্ছেমতো অক্লেশে এদিকে-ওদিকে খেলে বেড়াচ্ছি।

আর কিছুক্ষণ পরে দেহবোধ একেবারেই চলে গেল। মনে হল কোটি কোটি আলোকরেণু অভ্রের কুচির মতো ঘরের আকাশে প্রচন্ড গতিতে ছোটাছুটি করছে এদিকে-ওদিকে। নিউক্লিয়ার ফিজিকসের সত্য উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হল তেকুইলার কল্যাণে। শরীর ভেঙে গেছে। পরিণত হয়েছে অসংখ্য চার্জড পার্টিকলে। কণাগুলো মরছে আবার সঙ্গেসঙ্গে উৎপন্ন হচ্ছে নতুন কণা। বায়ুমন্ডল থরথর করে কাঁপছে। এমন একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি, যে শব্দ আগে কখনো শুনিনি। মৃদু কিন্তু অশ্রুত।

স্বাভাবিক অবস্থায় যখন আবার ফিরে পেলুম নিজেদের, তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে। আমরা দু-জনে পরস্পরের ওপর হেলান দিয়ে বসে আছি। আমাদের সামনে টেবিল পরিষ্কার তকতকে। নীল দুটি ছোট্ট পোরসিলিনের পাত্রে ধবধবে সাদা গুঁড়ো মতো একটি পদার্থ। চিকচিক করছে ভোরের আলোয়। পাশে একটি করে তাজা লাল গোলাপ। আমাদের সোজা হতে দেখে ইণ্ডিয়ান ওয়েটার এগিয়ে এলেন। এগিয়ে এসে অদ্ভুত একটি কথা বললেন, ‘গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে পাত্রের চিনিটা খেয়ে ফেলো। তোমাদের শরীরের পক্ষে ভালো হবে।’

তেকুইলার প্রভাব কেটে গেছে। এসে গেছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, মৃত্যুভয়। আমরা ব্রহ্মানুভূতি থেকে ফিরে এসেছি জগদানুভূতিতে। আমরা অবিশ্বাস নিয়ে সেই প্রাচীন, পাথরে কোঁদা মুখটির দিকে তাকালুম। সামনে সিঁথি। পাতা পেড়ে আঁচড়ানো লম্বা চুল। কপালে রঙিন হেড-ব্যান্ড। ডান পাশে গোল মতো পাতলা একটি আয়না গোঁজা। কোমরে জড়ানো একফালি কাপড়। মেটে হলুদ রঙের ওপর পাঁচ হাজার বছর আগের নকশা আঁকা লাল কালোতে। চওড়া বুক। আজানুলম্বিত বাহু।

আমাদের তাকাতে দেখে মায়া মন্দির গাত্রের সজীব সেই পুরোহিত বললেন, ‘আমার আদেশে অবাক হচ্ছ তো, কিন্তু ভুলে যেও না, তোমরা আছ মায়া ভূমিতে। এদেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তোমাদের দেশের অভিজ্ঞতার মিল পাবে না। যা বলি, শোনো। এদেশে আমরা ফায়ার, আর্থ আর এয়ার খাই। অবাক তো! পরে জানতে পারবে। অভিজ্ঞতা হবে। এখন যা বলছি খেয়ে নাও।’

আমরা দু-জন ছাড়া দোকানে আর কেউ নেই।

প্রশ্ন করলুম, ‘আর সকলে গেলেন কোথায়?’

‘বাড়ি।’

‘আমরা এখানে পড়ে আছি কেন?’

‘প্রথম অভিজ্ঞতা বলে।’

পাত্রে শুধু চিনি ছিল না। কোনও একটা গাছের রজন বা গঁদ জাতীয় নির্যাস মেশানো ছিল তার সঙ্গে গোলাপ। বাসি মুখের স্বাদ আর গন্ধ দুটোই পালটে গেল। মনে হল, আমাদের অন্ধকার জৈব মুখগহ্বরেই যেন ভোরের আলো ফুটছে। শরীরের সমস্ত জড়তা কেটে যাচ্ছে। ক্রমশই আমরা সুশীতল হয়ে উঠছি।

আমরা পথে নেমে এলুম। একটা রাত কোথা দিয়ে কেটে গেল। হলফ করে বলতে পারি, এমন রাত জীবনে আর দ্বিতীয় বার আসবে না। অ্যানের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, সে যেন গোলাপের মতোই সদ্য ফুটে উঠেছে। নিজের মুখ তো আর আয়না ছাড়া দেখা যায় না। গোটা শহরটাকে এরই মধ্যে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলা হয়েছে। এঁদের অসীম ক্ষমতা। আমরা প্লাজা দেল জোকালো ধরে বেড়াতে এগিয়ে চলেছি। এই প্রথম পাখির ডাক শুনতে পেলুম। দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ভারিক্কি ডাক শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের দোয়েল কী বুলবুল নয়। ম্যাকাও হতে পারে। কাকাতুয়া হতে পারে। একটা ঈগল পাক মারছে আকাশে, অকারণে অবশ্যই নয়। ব্রেকফাস্টের সন্ধান করছে। ঈগল এই প্রথম দেখলুম। চিলের বড়দা। কী ম্যাজেস্টিক ওড়ার ভঙ্গি! এদেশের ইনসিগনিয়া সেই কারণেই মনে হয় ঈগল।

বিশাল এক প্রাসাদের সামনে এসে আমাদের চলা থেমে গেল। প্রাসাদই থামিয়ে দিল। যেন ফিসফিস করে বলছে দাঁড়াও পথিকবর। বিশাল প্রবেশদ্বারের বাঁ পাশে আর একটি ক্ষুদ্র দুয়ার। তার মাথার উপর বিশাল কালো অক্ষরে লেখা ইংরেজি সি। ‘আমি আর পাঁচ-শো বছরের প্রাচীন।’ পাঁচ-শো বছর এই সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন ওই শহরের স্থাপক ডন ফ্রানসিসকো দা মোন্তেজো।

উলটো দিকের ফুটপাতে একটা পার্কের সামনে সেই প্রাচীন প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আমরা থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছি। কীভাবে তৈরি হয়েছিল বিজেতার এই আবাসস্থল, কী কায়দায় সংরক্ষিত যে, এখনও নতুনের মতোই হয়ে আছে। জরা পারেনি তার লোল হাতের ছোঁয়া লাগাতে। মেকসিকোর পাথরে কেটে তৈরি। মায়া ভারতীয় দাসদের ঘাম ঝরিয়ে তৈরি। অ্যান বললে, এই বাড়ির সামনেটাকে আর্কিটেকচারের ভাষায় বলে প্ল্যাটেরেকস স্টাইল।

মূল প্রবেশ দরজার মাথার ওপর ছোট হালকা একটা ঝুলবারান্দা। বারান্দার চারপাশ আর মাথার ওপর দিয়ে একটা অসাধারণ ও জটিল কারুকার্য উঠে গেছে ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। ছাদের সামনে ত্রিভুজাকৃতির ওই কারুকার্যের মধ্যে বারান্দার দু-পাশে খাড়া দাঁড়িয়ে পাথরে কোঁদা এক বিশাল স্প্যানিশ সৈনিক। কোমর থেকে ঝুলছে চওড়া তরোয়াল। পায়ের কাছে দু-পাশে দুই ছোট মূর্তি। প্রাসাদের এই অংশের কারুকার্য দেখার মতো। পাথরের ঢেউ খেলানো কার্নিশ। সরু লম্বা খাঁজ-কাটা থামের ওপর চৌকো খিলান। নীচের দিকে অলংকরণের মধ্যে দু-পাশে দুই বৃত্ত। সেই বৃত্তের মধ্যে উৎকীর্ণ নিখুঁত দুটি মুখ। হয়তো কোনও দুই হিস্পানি মহাপুরুষেরই হবে।

আমাদের মাথার ওপর ঝুঁকে আছে ঝাঁকড়া কয়েকটা গাছ। অচেনা অজানা জায়গায় চেনা গাছকেও অচেনা মনে হয়। মেরিডার পরিষ্কার ঝরঝরে বাতাসে গাছ দুলেদুলে উঠছে। সর্বত্র ভাসছে মৃদু একটা গন্ধ। ফুলেরই গন্ধ। অনেকটা দামি ওডিকলনের মতো। মেরিডা হল সুগন্ধ, সু-বাতাস আর সুন্দরী তরুণীদের দেশ।

এখানে ঘোড়ার গাড়িকে বলে ‘কালাশ’। এক্ষুনি একটা কালাশ চলে গেল ধীরগমনে আমাদের সামনে দিয়ে। লম্বা সাদা গাউন পরে আসনে বসে আছেন এক তরুণী। মাথায় লেসের কাজ করা রিম দেওয়া টুপি। পাথরের স্ল্যাব বাঁধানো পরিষ্কার রাজপথে ঘোড়ার পায়ের শব্দ যেন সঙ্গীত। কালাশের পাশে মটোর গাড়ির কোনো আভিজাত্যই নেই। দু-একটা সাদা মটোর গাড়ি পরিমিত চওড়া রাজপথ ধরে দূর থেকে দূর চলে যাচ্ছে। মাথা উঁচু ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা বাড়ির শহর এটা নয়। বেশির ভাগ বাড়িরই মাথা উঁচু নয়, পাশে বড়ো। ভার্টিক্যাল নয়, হরাইজেন্টাল। সবই প্রাসাদ। ফিউডাল লর্ডদের সিটি। প্রচুর অর্থ, প্রচুর শ্রম আর রাজকীয় মেজাজে তৈরি। এই শহরে আধুনিক কালের যে কোনও মানুষেরই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হবে।

প্রাচীন শহর যত প্রাচীনই থাকার চেষ্টা করুক, আধুনিক ব্যবসার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেনি। মোন্তেজোর প্রাসাদের দেওয়ালে উঁচিয়ে আছে কোকোকোলার বিখ্যাত বিজ্ঞাপন। সেই পরিচিত অক্ষরের পাঁচ। সোনা-রোদে শহরটিকে সজল স্নিগ্ধ জৈন সন্ন্যাসীর মতো দেখাচ্ছে। প্রাসাদটির পরেই পথের চৌমোহনা। হঠাৎ ডান পাশের পথ থেকে বেরিয়ে এল কমলালেবু রঙের একটি স্টেশন ওয়াগন। কোকাকোলার গাড়ি। চৌমাথার ওপাশের বাড়ির গায়ে আর একটি বিজ্ঞাপন ‘লিবান্ড’। আমেরিকান কোম্পানি ছেড়ে কথা কইবে!

মোন্তেজের এই প্রাসাদ হল শহরের এক নম্বর বাড়ি। হঠাৎ সারা শহরের ওপর আছড়ে পড়ল গম্ভীর ঘণ্টার শব্দ। জনজীবন থমকে গেল ক্ষণিকের জন্য। শহরের সর্ববৃহৎ চার্চ মেরিডা ক্যাথিড্রালের ঘণ্টা। সবচেয়ে বড়ো প্রার্থনার স্থান। আমরা এগিয়ে গেলুম সেইদিকে। স্প্যানিশ আরকিটেকচারের শ্রেষ্ঠ নির্দশন। ক্যাথিড্রাল ও ফোর্টের অদ্ভুত সমন্বয়। স্পেনের সান ক্রিস্টোবালের মডেল। সেকালের নিয়মে ধর্ম ও বর্মকে এক করে ফেলা হত। তরোয়ালের পেছন পেছন ছুটে আসত বাইবেল। ক্যাথলিক ধর্ম।

ভারতে আমরা যে ধরনের ছিমছাম চার্চ দেখি, এ চার্চ সেরকম নয়। এ হল গির্জাদুর্গ। দুর্গগির্জাও বলা চলে। আসলে ফোর্ট। ফোর্টের দু-পাশে জুড়ে দেওয়া হয়েছে গির্জার চূড়া। একেবারে সলিড কনস্ট্রাকশন।

মেরিডা ক্যাথিড্রাল পাথরের ইট গেঁথে তৈরি! সাতটা তোপ মারলেও দেওয়াল দুটো করা যাবে না। চারপাশ ভীষণ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। বাড়িটার আলাদা একটা অথরিটি আছে। সামনে দাঁড়ালেই কেমন যেন একটা ভয় ভয় করে। পাথরের গায়ের শ্যাওলা ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছে প্রাচীনত্ব বোঝাবার জন্য। গির্জাটি পরিত্যক্ত নয়। শহরের এইটাই প্রধানতম গির্জা ও প্রার্থনাকেন্দ্র। সামনে অতি প্রশস্ত এক ফুটপাত। নিটোল নিরেট পাথর বাঁধানো। গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের যখন তুলনা করছি, তখন মনে হচ্ছে আমরা দুটো ইঁদুর। এত ক্ষুদ্র আমরা। প্রধান প্রবেশ পথ এত বিশাল যে, সহজেই আরোহী সমেত পাশাপাশি দুটি হাতি ঢুকে যেতে পারে। পাশে অপেক্ষাকৃত আর একটি ক্ষুদ্র দরজা। দু-টি দরজাই দুর্ভেদ্য। যেমন দুর্গের দরজা হয়। আমরা ভয়ে ভয়ে ক্ষুদ্র দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালুম। বিশাল বিশাল এক-একটি প্রান্তর। ওই পাথুরে প্রাঙ্গনে সেকালে প্রার্থনাও হত, আবার সৈন্যবাহিনীও কুচকাওয়াজ করত। ওপর থেকে নেমে এসেছে সূর্যের আলো। ঝাঁকঝাঁক পায়রার মতো।

মেরিডার ঘোড়ার পায়ের শব্দ যেন কবিতার মতো। ‘কালাশ’টা ক্রমশ দূর থেকে দূরে চলে গেল। অ্যান বললে, ‘আমাদের আর ঘোড়ার গাড়ি চাপা হল না, কাল থেকে এত চেষ্টা করলুম।’

‘আজ হবে।’

‘আর কখন হবে।’

‘এখনই হবে।’

‘তোমার হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছে না?’

‘আমার তো ফ্রেশ লাগছে। তোমার কীরকম লাগছে?’

‘আমারও ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, এইমাত্র ভোরের ফুলের মতো ফুটেছি।’

সত্যিই আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তাজা গোলাপের মতো। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেসিয়ো মোন্তেজো ধরে হাঁটতে লাগলুম। কোথায় একটা কালাশ পাওয়া যায়। অ্যানকে পাশে বসিয়ে দুলকি চালে সারা শহরটা একবার ঘুরে আসব। এই শহরের ঈশ্বর বোধহয় শুনতে পেলেন আমাদের প্রার্থনা, রাস্তার বাঁ-পাশে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো যাত্রী নেই। স্বাস্থ্যবান সাদা ঘোড়াটি চামরের মতো লেজটি দোলাচ্ছে। চালক স্প্যানিশ তরুণটি একটু দূরে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আপন মনে সিগারেট টানছে। গাছের উঁচু ডালে একঝাঁক চন্দনা পাখি সভা করছে। জায়গাটা এত সুন্দর, মনে হচ্ছে সব ছেড়ে ছবি আঁকতে বসে যাই। অ্যান এগিয়ে গেল। যুবকটির সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় কীসব কথা হল, তারপর ইশারায় আমাকে বললে, উঠে বোসো।

আমার দু-জনে উঠে বসামাত্রই গাড়ি গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলল। সেই কোন ছেলেবেলায় কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি চেপেলিম। সে গাড়ি আর এ গাড়িতে অনেক তফাত, সেই পথ আর এই পথ এক নয়। এত সমতল রাস্তা আপাতত কলকাতায় নেই। বাতাস এত পরিষ্কার, মনে হচ্ছে, আমার দু’টো ফুসফুস অবাক হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো শহরে এমন ফুলের গন্ধ আছে কিনা জানি না, আমার নাক নর্দমা আর আবর্জনার গন্ধেই অভ্যস্ত, এই রাস্তার দু’পাশে সারি সারি প্রাসাদোপম বাড়ি। প্রতিটি বাড়িরই পাঁচশো বছরের পুরনো ইতিহাস আছে। যেকোনো বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয়, ভাল শ্রোতা পেলে কত কথাই যেন বলার আছে। হঠাৎ গাড়িটি একটি বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফলকে লেখা রয়েছে ‘প্যালেসিয়ো ক্যান্টন’। গাড়ির চালক অ্যানকে কিছু বলল, অ্যান আমাকে বললে, ‘এই বাড়িটা একসময় প্রাক্তন গভর্নরের বাসস্থান ছিল। তার মানে ‘গভর্নর হাউস’। এখন এখানে লাইব্রেরি ও আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম হয়েছে। দুটোই এখন বন্ধ, খুলবে সেই সকাল দশটার পর।’ আমরা বাইরে থেকে বাড়িটির সৌন্দর্য দেখে এগিয়ে চললুম সামনের দিকে। এই দেশটিকে, ঠিক এই দেশটিকে নয়, আর একটু এগিয়ে ইনকাদের দেশকে অর্থাৎ পেরুকে বলা হয়, ‘সোয়েট অফ দি সান, টিয়ারস অফ দি মুন।’ সূর্যের ঘাম হল সোনা, চাঁদের কান্না হল রুপো। শ-দুয়েক স্প্যানিশ কনক্যুইস্তাদর অত বড়ো একটা ইনকা সভ্যতাকে শুধু ঘোড়া আর কয়েকটা কামানের জেরে তছনছ করে দিয়েছে। বন্দী করেছিল ঈশ্বরের সমান তাদের রাজাকে, রাজা মুক্তিপণ হিসাবে দিয়েছিলেন ঘরভর্তি সোনা, তাতে অবশ্য তাঁর প্রাণরক্ষা হয়নি। বিশ্বাসঘাতকেরা বিচারের তামাশা করে ইনকার ঐশ্বরিক রাডাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলেন। এত সোনা, এত রূপো পৃথিবীর কোথাও ছিল না। গাড়িতে যেতে যেতে পাঁচশো বছর আগের এই রোমহর্ষক কাহিনিটি মনে আসছিল, কারণ সোনাঝরা রোদ, কোনো উত্তাপ নেই, শুধু বর্ণ। সারা শহরটাকে মায়াদের উপাস্য দেবতা সূর্য সেন সোনার পাত দিয়ে মুড়ে দিয়েছেন, ফোয়ারা দিয়ে জল উঠছে যেন রূপোর তবক, কেবলই মনে হচ্ছিল, এই শহরে যদি একটা ঝাড়ুদারের কাজও পাই, তা হলে সারাজীবন থেকে যাই।

হঠাৎ আমাদের সামনে এগিয়ে এল অসাধারণ এক স্মৃতিস্তম্ভ। আমরা সমস্বরে বললুম, ‘দাঁড়াও।’ ঘোড়ার চলন শান্ত হল। চালক বললেন, ‘এটা হল মনুমেন্ট, মায়া ডিজাইনে তৈরি। এর মধ্যে ধরা আছে মেক্সিকোর গত পঁছিশ বছরের ইতিহাস, নির্মাতা কলম্বিয়ার বিখ্যাত এক ভাস্কর রোমুলো রোজো।’ এই মনুমেন্টে এসেই প্যাসিয়ো মন্তেজো শেষ হল, আমাদের গাড়ি ঘুরে গেল ডানদিকে। মেরিডা শহরটি যেন এক মরুদ্যান। মেরিডার চারপাশে রুক্ষপ্রায় তরুহীন বিশাল এক অঞ্চল নিজের ঢেউ নিজের বুকে ধারণ করে স্তব্ধ হয়ে আছে। আকাশ থেকে দেখলে বেশ অবাক হতে হয়, প্রকৃতির এ কী খেলা! কেন এমন হল! ভূগোলে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় ধু-ধু প্রান্তর। কোথাও নীচু, প্রায় গহ্বরের মতো। কোথাও এত উঁচু, যেন পাহাড়। চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। হাজার বছরের সাধনায় উৎকৃষ্টতম যে সভ্যতাটি মানুষ রচনা করেছিল, লোভী একদল মানুষ এসে কোনোরকম দ্বিধা না করে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। অটুট সেই সভ্যতাটিকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের আর হবে না। আমরা আসি ধ্বংসস্তূপ দেখতে। ইতিহাস আমাদের হাত ধরে বর্তমান থেকে নিয়ে যায় অতীতে, সেটাই হল আমাদের রোমাঞ্চ।

অপূর্ব এক বাগানের সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ির চালক বললেন, ‘আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আমাকে ছেড়ে দিয়ে আপনারা এই বাগানটিকে ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখুন। এই শহরে যে তিনটি শ্রেষ্ঠ উদ্যান আছে, এটি তার অন্যতম, এই পার্কটির নাম পার্ক- দেল সেন্টিনারিয়ো। আর দুটি পার্কের নাম পার্ক-দ্য-লাস-আমেরিকান আর পার্ক-জুয়ারেজ।’ চালক গাড়ি নিয়ে ফিরে গেলেন। আমরা সেই পার্কে প্রবেশ করলুম। উদ্যান রচনায় মেরিডার নগরপালের প্রশংসা না করে পারা গেল না। কলকাতায় অনেক পার্ক আছে, নামেই পার্ক। এই পার্কটি না দেখলে আমার ধারণাই হত না, মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ে কত খেলাই না খেলতে পারে। পার্কটির মধ্যস্থলে একটি বিশাল ফোয়ারা, ফোয়ারা মানে জল ছিটানো নয়। প্রতিভাবান শিল্পীরা সেই ফোয়ারাটিকে নানাভাবে অলঙ্কৃত করেছেন মায়া ডিজাইনে। নীল জল তিন পাশের পাথরের দেয়াল বেয়ে ধাপে ধাপে উঠছে আবার নেমে আসছে। আমরা ফোয়ারাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। কোথাও এতটুকু শ্যাওলা নেই, পাথরের দেওয়ালের গায়ে খোদাই করা হয়েছে নানা ডিজাইন। জলের হিসহিস শব্দ। মাথার ওপর থেকে রোদ এসে পড়েছে, সেই রোদ খেয়াল খুশিমতো তৈরি করছে রামধনু। ভিজে একটা ঠাণ্ডা ভাব আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, আর তখন মনে হল, স্নান করতে পারলে ভালো হয়। চারদিকে বেঁটে গাছ, বাহারি ঝোপ, চলার পথ, ঘাসে ঢাকা ফাঁকা জমি যেন সবুজ গালচে। বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য পাখির কলকাকলি। পার্কটির বিভিন্ন জায়গায় সুন্দর মূর্তি ও ভাস্কর্য। দেখলেই মনে হয়, পরিচর্যার সামান্যতম অবহেলা নেই। মূর্তিগুলি মায়া সভ্যতার নিদর্শন থেকে ধার করা। দেখে আমার এটাই মনে হচ্ছিল, একেই বলে বিবেকের দংশন। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত একদল স্প্যানিশ জলদস্যু নির্বোধের মতো যাদের ধ্বংস করেছিল, এখন তাদেরই শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলিকে পুনরায় নির্মাণের আপ্রাণ চেষ্টা। বর্তমান যেন এক অস্ফুট শিল্পবিলাপ—আমরা এ কী করলাম!

পার্কটিতে ইতিমধ্যেই ভ্রমণার্থী ও টুরিস্টদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। ক্যামেরা হাতে বিদেশি টুরিস্টরা ছবির পর ছবি তুলে চলেছেন। এক ফোটোগ্রাফার প্রকৃতি পেয়েছেন, কিন্তু সামনে দাঁড় করাবার মানুষ পাননি।

অগত্যা আমাদের অনুরোধ করলেন, ‘আপনারা একটু সামনে দাঁড়ান, আপনাদের সামনে রেখে আমি পেছনের দৃশ্যটি ধরতে চাই। আশা করি আপনাদের আপত্তি হবে না।’ আমাদের পেছনে এমন একটি কুঞ্জ, যা দেখে মনে হল, চাঁদের আলোয় এই কুঞ্জে আমাদের শ্রীকৃষ্ণ আসেন বাঁশি বাজাতে। আমরা সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক আমাদের দিকে ক্যামেরা ডাক করতে লাগলেন, হঠাৎ বললেন, ‘একটু হাসুন।’ একটু হাসির প্রতি ক্যামেরাম্যানদের কী দুর্বলতা। ছবি তোলার অপর নাম হয়তো ‘প্লিজ লাফ’। ক্যামেরা গম্ভীর, বিষণ্ণ, উদাস অথবা দুঃখ -দুঃখ মুখ পছন্দ করে না। ফোটোগ্রাফার কোন দেশের মানুষ বুঝতে পারলুম না, তবে তাঁর খোলামেলা আচরণে মনে হল আমেরিকান। স্প্যানিশ ছেলে-মেয়েরা খুব প্রেমিক হয়। ইসতাফাতেই তার প্রমাণ পেয়েছি। এখানে আরও বেশি পেলুম। সবুজ শ্যামল গাছপালায় ভরা এই উদ্যানে অনেক নিভৃতি আছে, সেখানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের একাধিক জুটি নজরে পড়ল। পৃথিবী ভুলে, জীবন ও জীবিকা ভুলে পাশাপাশি হাতে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে, কেমন একটা সুখ সুখ স্বর্গীয় ভাব নিয়ে, যা একমাত্র প্রেমই মানুষকে দিতে পারে। এমন একটা জায়গায় হিংসার কথা, যুদ্ধের কথা, জীবন-যন্ত্রণার কথা মনেই আসে না। স্বর্গোদ্যানের কথা শুনেইছি। আমার মনে হল, সেই উদ্যান এর চেয়ে ভালো হতে পারে না। আর একটি জিনিস চোখে পড়ল, যা অবাক করে দেবার মতো। এক-একটি ঝোপের আড়ালে এক-একজন মানুষ ধ্যানস্থ, চোখ বুজে ভারতীয় ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে আছেন নিথর হয়ে। অ্যানকে প্রশ্ন করলুম, ‘ধ্যান এখানেও এসে গেছে?’

অ্যান বললে, ‘ধ্যান আর জপ পৃথিবীর এ প্রান্তে ইদানিং খুব জনপ্রিয়। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বিজয় অভিযান শুরু হয়েছে আমাদের এই বস্তুতান্ত্রিক দেশে। ভোগবাদ এদেশের মানুষকে জর্জরিত করে তুলেছে। ভারতের মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চাইছে, আমরা চাইছি প্রাচুর্য থেকে মুক্তি। ভোগ আমাদের চরিত্র নষ্ট করে দিচ্ছে, আমরা এখন ভোগ থেকে ত্যাগে আসতে চাইছি। আমাদের এ-দেশে রামকৃষ্ণ ও হরেকৃষ্ণ মুভমেণ্ট এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। ভারতীয় যোগ এখন প্রায় ঘরে ঘরে, তবে আমরা দেহটাকে এখনও তোমাদের মতো একেবারে বাদ দিতে পারিনি। আমাদের আত্ম-অনুসন্ধান ও দেহসুখের অনুসন্ধান দুটোই পাশাপাশি চলেছে। তারই উদাহরণ তোমার চোখের সামনে। এ-কুঞ্জে প্রেম, ও-কুঞ্জে ধ্যান, তোমাদের শ্রীকৃষ্ণের কথা মনে করো।’

‘শ্রীরামকৃষ্ণের কথা তো শুনেছ, তিনিও বলতেন রসেবশে রাখিস না।’

‘তোমাদের এই মায়ের কনসেপশানাট ভারি সুন্দর। আমার ভীষণ মা হতে ইচ্ছে করে। ছেলের মা নয়, গুণের মা।’

আমরা বিশাল একটা বার্চ গাছের তলায় ঘাসের ওপর বসলুম, বসার সঙ্গেসঙ্গে উদ্যানটা একটা অন্য চেহারা নিল। সমতল ঘাসের মলমল, সামনে প্রসারিত ফুলগাছের ঝোপ, পাতাবাহার গাছের ঝোপ, পায়ে-চলা পথ সমস্ত কিছু উঠে এল চোখের সামনে। বাতাস আর সোনা-ঝরা রোদ দুয়ে মিলে অদ্ভুত এক শীতোষ্ণ অনুভূতি। বহু দূরে আকাশের গায়ে একটা চার্চের চূড়ায় স্পষ্ট একটি ক্রশ। কাল সারারাত আমরা বসেই কাটিয়েছি। ঘুম ঘুম পাচ্ছে, অ্যান ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই চলে গেল ঘুমের রাজত্বে। আমার মনোবল ভেঙে গেল। প্রথমে আধশোয়া, তারপরে আর মনে নেই। তীব্র আলোয় যখন উঠে বসলুম, তখন সূর্য মধ্যগগনে। উদ্যানটি চলে গেছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের দখলে। সকালের মানুষরা আর নেই আমরা দু-জন ছাড়া। অ্যান উঠে বসল, উদ্যানের বাইরের রাস্তায় খুব বাদ্য বাজনা চলেছে, আমরা বাইরে এলুম। সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে যুবক-যুবতীরা নাচতে নাচতে চলেছে। এক একজনের মাথায় এক এক রকমের টুপি। মেয়েদের পরিধানে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা গাউন। প্রান্তভাগে লেসের ঝালর। কাঁধ ও বুকের কাছে ফ্রিল লাগানো। তারা যখন নাচছে ঘুরে ঘুরে, পোশাকের প্রান্তভাগ, মধ্যভাগ ফুলে ফুলে উঠছে। মনে হচ্ছে উটপাখি নাচছে, স্প্যানিশ সংগীতের সুর ভারি মিষ্টি। সকলেরই পোশাকের রঙে সাদা তো আছেই, তার সঙ্গে আছে গাঢ় কমলালেবু ও নীল রং। মাঝে মাঝে মানানসই লাল। একটা জীবন্ত ছবি দেখছি। আনন্দের স্রোত বইছে। অ্যানকে জিগ্যেস করলুম, ‘ব্যাপারটা কী?’

‘কার্নিভ্যাল চলেছে। এই শহরে রোজই এই ধরনের উৎসব হয়।’

‘এই শহরে অভাব অভিযোগ দুঃখ-দুর্দশা নেই?’

‘আছে, জীবন দুঃখ ছাড়া হয় না, দুঃখ ভারী জিনিস, জীবনপাত্রের তলায় পড়ে আছে। এ দেশের দর্শন হল পুরোটা বাঁচো, অন্তরালে গিয়ে নিভৃতে মরো, দুঃখ-দুর্দশাটাকে প্রদর্শনী করে তুলো না।’

ছেলে-মেয়ে যারা নাচছে, দেখে মনে হচ্ছে, লাল টুকটুকে টম্যাটো আর পাকা বেদানা। এমন স্বাস্থ্য, এমন শরীর, এমন প্রাণ-প্রাচুর্য এরা কোথা থেকে পেল? আমরা একটা মোটর গাড়ি ধরে ফিরে চললুম হোটেলের দিকে। হোটেল থেকে আমরা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা অনুপস্থিত। যেতে যেতে দেখলুম, দুপুরে মেরিডা অন্য সুরে অন্য রঙে জেগে উঠেছে। অ্যান বললে, ‘বেশ একটা ভালো ঘুম হয়ে গেল। সবুজ ঘুম। জীবনের আয়ু কম-সে-কম দশ বছর বেড়ে গেল। হোটেলে আমরা এখন স্নান করব, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ব। এইবার তোমাকে একটা নতুন খাদ্য খাওয়াব, তার নাম হল পিবিল-চিকেন।’

হোটেলের রিসেপশানে একটি মেয়ে হাসিমুখে আমাদের চাবি এগিয়ে দিল, আর এগিয়ে দিল ছাপানো একটি কার্ড। তাতে লেখা আছে সেদিনের খাদ্যতালিকা। আমরা ঘরে ঢুকে অবাক! ঝকঝক তকতক করছে চারপাশ, সমস্ত পরদা আর বিছানার চাদর পাল্টে গেছে। টেবিলের ওপর ড্রয়ারের মাথায় স্প্যানিশ বেতের বাস্কেটে লাল আর সাদা গোলাপ, অ্যাপ্রিকট কমলালেবু, কলা ও পিচ ফল। সারা ঘরে অন্য কোনো সুগন্ধ নয়, ফল আর ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

মেরিডার আশেপাশের অঞ্চলে খুবই জলের অভাব। তার কারণ, এই অঞ্চলের মাটির জলধারণ ক্ষমতা একেবারে নেই বললেই চলে। মেকসিকোর ভূ-প্রকৃতি ভূগোলের এক বিস্ময়। বড়ো বড়ো কয়েকটি আগ্নেয়গিরি এক সময় বছরের পর বছর ধরে অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়ে এখানকার জমি তৈরি করেছে। আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরভাগ থেকে বেরিয়ে এসেছে গলিত ধাতু, বেরিয়ে এসেছে গলা বালি। শীতল হবার পর সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র এক ভূ-প্রকৃতি। বৃষ্টির জল মাটিতে পড়েই চলে যায় তলায়, সেখানে কোনো গহ্বর বা চার দেওয়াল আশ্রিত চৌবাচ্চার মতো কোনো জায়গা পেলে জল সেইখানে জমে থাকে। এই ভূগর্ভস্থ জল কোথাও ঊর্ধ্বচাপে ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসে। একে বলে গিজার। কোথাও এই জলধারা পড়ে আছে খোলা আকাশের তলায়। এক সময় পানীয়জলের এই ছিল উৎস। নি:সন্দেহে খুবই পরিষ্কার জল, কারণ মাটির বিভিন্ন স্তরে ফিল্টার হতে হতে নেমে যাচ্ছে সঞ্চিত স্তরে, নামার সময় সঙ্গে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ। এই জলকে আমরা স্বাস্থ্যকর মিনারেল ওয়াটারও বলতে পারি। মেরিডায় কিন্তু তেমন জলের অভাব দেখলুম না। আমরা হোটেলের বাথরুমে বাথটাবে প্রায় শুশুকের মতো উলটেপালটে চান করলুম। মুখে জল নিয়ে মনে হল সোডা-ওয়াটার, মিষ্টি নয় কিছু তেজী। মেরিডার বাইরে যে অঞ্চল জুড়ে মায়াসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, সেই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ রুক্ষ। বিশেষ গাছপালা নেই। মাটির ওপর জেগে আছে শিলাখন্ড, ধূসর ধোঁয়াটে একটা ভাব। যেন একটা অভিশাপ এখনও ঝুলে আছে। ধূসর পথ তরুহীন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে দূরে। পথ কখনো উঠেছে, কখনো নিচু হয়েছে। ছাই রঙের জমিতে কাঁটাগাছের ঝোপ। এই সব আমাকে দেখতে হয়েছিল পরের দিন।

আজ আমি পাঁচ-শো বছরের প্রাচীন এক শহরে ছোটোখাটো নিভৃত একটি হোটেলে মনের আনন্দে স্নানের পর দিবানিদ্রা দেব কিনা ভাবছি! দু-একটা হাই ইতিমধ্যেই উঠে গেছে, অ্যান বললে, ‘তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে একটা ঘুম দেবার তালে আছে, কিন্তু সে সুযোগ তোমাকে আমি দেবো না। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যখন খুশি আমি চলে আসতে পারলেও ভারত থেকে তোমার আর দ্বিতীয়বার আসা সম্ভব না-হওয়াই স্বাভাবিক। আমার কর্তব্য, কম সময়ে যতটা পারা যায় দেখিয়ে দেওয়া। অতএব বৎস, শয্যাত্যাগ করো, বস্ত্র পরিধান করো, নেমে চলো রাস্তায়। আজ গোটা মেরিডাটা যেমন করেই হোক দেখে নিতে হবে। কাল সকালে আমাদের গন্তব্যস্থল ‘উকসমল।’

আমাদের শাস্ত্রে বলে, নারী হলেন শক্তি। অ্যানই তার প্রমাণ। এমন প্রাণবন্ত মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। এমন দূরদৃষ্টি, এমন বিচক্ষণতা সহসা চোখে পড়ে না। অ্যানের উৎসাহে আলস্য কেটে গেল। নেমে এলাম পথে।

সামনের রাস্তায় বেরোবার আগে আমরা নীচের দোকানগুলো একবার উঁকি মেরে নিলুম। এখানকার দোকান মানে স্বপ্নপুরী। মাঝে মাঝে নিজেকে ধমক লাগিয়েছি, ভ্রমণ মানেই খাওয়া আর কেনাকাটা নয়। তবু এই দোকানগুলির আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মনে হয়েছে এগুলিও দ্রষ্টব্য। কারণ এরা আমার কল্পনাকে জাগাতে সাহায্য করেছে, আমার মনের ওপর অদ্ভুত এক প্রতিক্রিয়া এনেছে। এদেশের দোকানে পুরুষের স্থান নেই, সবাই মহিলা। আর এই মহিলারা ‘মা’ ডাক শোনার জন্য কাঙাল। এদের ‘মা’ বলে ডাকলে এরা সন্তানের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। সেই অভিজ্ঞতাই আমার হল। একটি দোকানে ঢুকে অ্যান বললে, ‘বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে এসো তোমাকে কয়েকটা জিনিস কিনে দিই। লণ্ডন, নিউইয়র্ক এই সব জায়গায় জিনিস অনেকেই কিনতে পারেন, কিন্তু মায়া শহরের জিনিস সহজে কেনা যায় না। অনেকদিন পরে তোমার দেশে গিয়ে এক-একটি জিনিস দেখবে আর তখন তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে এই সুন্দর সাদা শহরটি, যার রাস্তা শ্লেট পাথরে তৈরি, যার ফুটপাতে বসানো শ্বেত পাথর, যার আকাশের গায়ে দুর্গের মতো গির্জার চূড়া, যে শহরের স্থাপত্যে মায়া ও হিসপানি ভাস্কর্যের মিলন, যে শহরের প্রতিটি বাড়ির মাথায় একাধিক গম্বুজ, যে শহরে প্রতিটি দেয়ালগাত্রে উৎকীর্ণ অসাধারণ এক কারুকার্য। সেই শহরের স্মৃতি চিরজীবন তোমার সঙ্গে থাক, এইটাই আমি চাই।’

দোকানের মহিলাটি মধ্যবয়সী, পাকা পেয়ারার মতো চেহারা। যৌবনে যে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, তা বোঝা যায়। লাল-পাড় সিল্কের শাড়ি আর কপালে একটি সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিলে মনে হবে, আমার মা। কিন্তু আমি মাদার বলে সম্বোধন করে হাতটি কাউন্টারে রাখতেই তীব্র একটা জ্বালা অনুভব করলাম। আমি লক্ষ করিনি যে, ওখানে একটি অ্যাশট্রের ওপর জ্বলন্ত একটি সিগারেট ছিল। মহিলা সঙ্গেসঙ্গে আমার হাতটা নিয়ে খুব লজ্জিতভাবে ফুঁ দিতে থাকলেন। অ্যানকে বললেন, ‘তুমি একটু থাক, আমি হোটেল থেকে একটু বরফ নিয়ে আসি।’

অ্যান বললে, ‘আপনি থাকুন, আমি যাচ্ছি।’

মহিলা বললেন, ‘তুমি গেলে দেরি হবে, আমি হোটেলের নাড়ি-নক্ষত্র জানি।’

মহিলা দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, আর ঠিক সেই সময়ে ছোট্ট ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন। নেমে এসে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, কাউন্টারের সেই জায়গায় এসে কিছু খুঁজতে লাগলেন।

অ্যান বললে, ‘আপনি নিশ্চয়ই আপনার সিগারেটটা খুঁজছেন?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন।’

অ্যান বললে, ‘আপনি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছেন, জ্বলন্ত সিগারেট ওইভাবে কেউ রেখে যায়! আমার বন্ধুর হাত পুড়ে গেছে।’

এদেশ হলে ভদ্রলোক বলতেন, বেশ করেছি। বিদেশে এখনও মানুষ সহবত জানে। ভদ্রলোক অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘আমি অসভ্যের মতো কাজ করছি। ওপরে গারমেন্ট সেকশান, ওখানে সিগারেট চলবে না, তাই এখানে রেখে গেছিলাম, এখনই নেমে আসব বলে, আমার ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ কথা শেষ করে ভদ্রলোক আমার হাতটা দেখলেন, আর এক প্রস্থ দুঃখপ্রকাশ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে কিনা। এমন সময় দোকানের ভদ্রমহিলা একটি সুদৃশ্য পাত্রে কয়েক টুকরো বরফ নিয়ে প্রবেশ করলেন, এক টুকরো বরফ আমার পোড়া জায়গাটার চেপে ধরে রইলেন অনেকক্ষণ। ভদ্রলোক চলে যাননি, তিনি পাশে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো বারে বারেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘একটু ভালো বোধ করছেন তো?’

আমি বললুম, ‘আপনি চিন্তিত হবেন না, আমার এমন কিছু লাগেনি।’

এই ছোট্ট ঘটনাটি আমার অনেকদিন মনে থাকবে। তার কারণ, আমার হাত না পুড়লে বিদেশি ওই মহিলা ও পুরুষটির আন্তরিকতা ও স্নেহের গভীরতা আমার অজানা থেকে যেত। বিদেশে গিয়ে প্রকৃতি দেখব, ঐতিহাসিক নির্দশন দেখব, খুবই ঠিক কথা, কিন্তু মানুষকে ঘনিষ্ঠভাবে না দেখলে একটা দেশের সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। ভদ্রলোক এক সময় চলে গেলেন, মহিলাটি তাঁর ফ্লাক্স থেকে দু কাপ কফি ঢেলে আমাদের খাওয়ালেন। কফি শেষ করে আমরা জিনিসপত্র দেখতে শুরু করলুম। অ্যান আমাকে জেড পাথরের একজোড়া কুকুর ও একটি হাতি কিনে দিলে। হাতিটা দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গেলুম। আমি পন্ডিত মানুষ নই, গবেষণা করার অধিকারও আমার নেই, তবু মনে হল, হাতি তো এদেশের প্রাণী নয়, তাহলে শিল্পী এত নিখুঁত হাতি বানালেন কী করে! খোঁজ নিয়ে জানলুম, এ সবই হল মায়া ইণ্ডিয়ানদের তৈরি কারুশিল্প। তখনই রহস্যটা আমার কাছে আমার মতো করে পরিষ্কার হল। মায়ারা এক মতে ছিলেন ভারতীয়, ভারত থেকে গিয়ে দূর মেকসিকোয় উত্তুঙ্গ সভ্যতা স্থাপন করেছিলেন। সেই সভ্যতার রূপরেখা দেখে আততায়ী হিসপানিরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। উন্নত পশ্চিমী সভ্যতার গর্ব ম্লান হয়ে গিয়েছিল। মায়ারা ভারতীয় ছিলেন, বলেই হাতির কল্পনা তাদের স্মৃতিতে এখনও রয়ে গেছে, অ্যান আমাকে প্রায় জোর করেই একজোড়া চটি কিনে দিল।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘চটি কেউ কেনে?’

অ্যান বললে, ‘পরে বুঝবে। এই চটির বিশেষত্ব হল, পুরোটাই কাঠের তৈরি, ওপরে প্লাস্টিকের কোটিং। এইটা এই অঞ্চলের বিশেষ একটি আর্ট। এই জুতো পরলে তোমার পায়ের আর্চ ঠিক থাকবে। কোনো ত্রুটি থাকলে সেরে যাবে। পায়ে কখনো বাত হবে না, পায়ের কাফ উন্নত হবে। এই জুতো পায়ে হাঁটার সময় ঘোড়ার খুরের মতো খটখট শব্দ হবে। সেই শব্দের ছন্দে তোমার নিজের এলোমেলো ভাবে একটা ছন্দ আসবে।’

আমি বললুম, ‘এই জুতো তো দেখছি মেডিকেটেড! বাত ভালো করে, দাঁতের গোড়া শক্ত করে, চোখের জ্যোতি বাড়ায়, মনে কবিতার ছন্দ আনে!’

অ্যান বললে, ‘একজোড়া নিয়ে রাখো, সারাজীবন চলে যাবে।’

মহিলা বললেন, ‘কয়েকটা জামা কিনে নিয়ে যাও। খুবই কম দাম, আমি তোমাকে আরও কম দামে দেব। যেমন ভালো কাপড়, তেমনিই ভালো তৈরি।’ মহিলা আমার হাতে একটি জামা দিয়ে বললেন, ‘প’রে দেখো।’

আমি জামাটা পরে এলুম।

অ্যান বললে, ‘খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’

এদেশের তৈরি জামা আমার না হবারই কথা, কারণ এরা যেমন স্বাস্থ্যে হাতি, আমি তেমনিই চামচিকে। দুটো না তিনটে জামা আমাকে কিনতেই হল, কারণ আমাদের দেশে ওই জামার অনেক দাম, আর এত সুন্দর তৈরি হবে না। আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে এলুম। হোটেল রিসেপশানে জিনিসপত্র রেখে চলে এলুম বাইরে। যে ভদ্রলোকের সিগারেটে আমার হাত পুড়েছিল, তিনি তখনও দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার হাত ঠিক হয়ে গেছে? ডাক্তারখানায় যাবার দরকার হবে কি?’

আমি বললুম, ‘না, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার হাত মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাদের কোথাও লিফট দিতে পারি?’

অ্যান বললে, ‘আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের প্লাজা-দেল-জোকালোতে নামিয়ে দিন। প্লাজা-দেল-জোকালো দিবা দ্বিপ্রহরে জমজমাট হয়ে উঠেছে। আকাশে চড়া রোদ কিন্তু চারপাশে এত গাছ আর তলায় তলায় এত ছায়া, জায়গাটাকে মনে হচ্ছে কোনো বড়লাটের গ্রীষ্মবাস। এ শহরেও কোর্ট-কাছারি অফিস আছে, কর্মী আছে, কিন্তু বাইরে থেকে এত ট্যুরিস্ট এসেছেন যে, তাঁরাই জায়গাটাকে জমজমাট করে রেখেছেন। ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, তিনি যাবেন উকসমল। উকসমলে তাঁর একটি দোকান আছে, ট্যুরিস্ট-শপ। আর ভদ্রলোকের একটি সমব্রেরো হ্যাট তৈরির বড়ো কারখানা আছে। ভদ্রলোক আমাদের সুদৃশ্য চাবির রিং উপহার দিয়ে গেছেন। আমরা সেই ইণ্ডিয়ান বাজারের দিকে এগিয়ে গেলাম, যেখানে কাল রাতে তেকুইলা খেয়ে আমাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা খুঁজে খুঁজে সেই ফুলদিদিকে বের করলুম। আজকে তাঁর ফুলের সম্ভার গন্ধে আর রঙে জমজমাট। হলুদ, গোলাপি, লাল, সাদা, বেগুনি, যত রকমের রং হতে পারে, সব রঙের ফুলের সমারোহ। ফুলদিদি আমাদের বললেন, ‘কেমন আছ?’

আমরা দু-জনেই বললুম, ‘আপনি কেমন আছেন?’

‘আমি ভালো আছি।’

অ্যান বললে, ‘আপনি আমাদের একটা ইণ্ডিয়ান গ্রামের সন্ধান দিতে পারেন?’

ফুলদিদি বললেন, ‘আমার গ্রামই তো আছে।’

‘আমাদের সেই গ্রামে নিয়ে যাবেন?’

‘আমার সব ফুল বিক্রি হয়ে গেলে তবেই তো আমি যেতে পারব। তবে আমার মেয়ের সঙ্গে তোমরা যেতে পার।’

‘আপনার মেয়ে কোথায়?’

‘সে কিছু খেতে গেছে।’

অ্যান বললে, আমরাও তাহলে কিছু খেয়ে আসি। আপনি কিছু খেয়েছেন?’

ফুলদিদি বললেন, ‘আমার মেয়ে এলে আমি খেতে যাব।’

অ্যান বললে, ‘আমরা তাহলে এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরে বেড়াই, আপনার মেয়ে ফিরে এলে তিনজনে একসঙ্গে খেতে যাব।’ মহিলা হেসে বললেন, ‘তোমরা ভারি অদ্ভুত ছেলে-মেয়ে।’

আমরা আধঘণ্টা মতো সময় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালুম। দিনের বেলায় এই বাজারের চেহারা অন্যরকম। পৃথিবীর সমস্ত রং, সমস্ত গন্ধ, সমস্ত রূপ এই বাজারের ওপর কেউ যেন অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছেন। টুপি, জমা-কাপড়, ব্যাগ, পঞ্চো, জপের মালা, অলঙ্কার, জুতো, বিভিন্ন মশলা, ফল, ফুল, কারুসামগ্রী, পুতুল, বেতের কাজ, পাথরের জিনিস এমনকী প্রাচীন মুদ্রা পর্যন্ত এই বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

আমরা তিনজনে একটি ইণ্ডিয়ান রেস্তরাঁয় এসে ঢুকলুম। এদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় সিকিম কী ভুটানে আছি, চেহারায় অদ্ভুত মিল। আমরা টেবিলে বসলাম।

ফুলদিদি বললেন, ‘কাল রাতে তোমরা আমাকে খাইয়েছ, আজ আমি তোমাদের খাওয়াব।’

অ্যান বললেন, ‘তা হয় না। আমরা কালই চলে যাব, আগে আপনার মনে একটু জায়গা করে নিতে চাই। কী খাব বলুন।’

মহিলা বললেন, ‘আজ তোমরা আর একটা উপাদেয় ইণ্ডিয়ান খাবার খাও, যার নাম পিবল চিকেন।’

আমাদের ‘পিবল চিকেন’ এসে গেল। মায়া জগতে সস একটি প্রিয় খাদ্য। সসের ওপরেই সমস্ত কিছু সাজানো হয়। পিবল চিকেনেও সসের ওপর কায়দা করে কাটা মুরগির টুকরো। সুন্দর গন্ধ, ভীষণ সুস্বাদু, আর যে পাত্রে পরিবেশন করা হয়েছে, সেই পাত্রটির দিকে তাকালে মনে হয়, পৃথিবীতে এত সুন্দর শিল্পকর্মও আছে! আমরা খুব দ্রুত আহারপর্ব শেষ করে ফুলদিদির মেয়ের সঙ্গে তাদের গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়লুম। ঠিক হল, আমরা হেঁটেই যাব। গরম নেই বললেই চলে। গালফ স্রোতের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস, ঘাম হয় না এই জায়গায়, ফলে পরিশ্রমে কোনো ক্লান্তি আসে না। ধূলো নেই ধোঁয়া নেই, কোনও পলিউশান নেই। আমাদের পথ-প্রদর্শিকা নেচে নেচে এগিয়ে চলেছে, আমরা চলেছি পেছনে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই, ভাষার সমস্যা। মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে সে হাসছে, আমরাও হাসছি। এ ছাড়া ভাববিনিময়ের আর কোনো পথ নেই। এ হাঁটার ফলে ভূ-প্রকৃতিকে আরও ভালোভাবে জানা গেল। অনেকে মনে করেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেই মায়া সভ্যতার জন্ম। একশো থেকে তিনশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যেকোনো সময় এল সালভাদর এর-মধ্যভাগে অবস্থিত বিশাল আগ্নেয়গিরি ল্লোপাঙ্গো বিস্ফোরিত হয়েছিল। সেই আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ফলে আগ্নেয় ছাই পুরো এল সালভাদর অঞ্চলটিকে গ্রাস করেছিল। সমস্ত গাছপালা এবং পশুপক্ষী সেই ছাই ছাপা পড়ে সঙ্গেসঙ্গে মারা গিয়েছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা যেন একালের হিরোসিমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল। প্রচন্ড উত্তাপ, ভূ-কম্পন, বাতাসের অভাব, পানীয় জলের অভাব সমস্ত মিলিয়ে এমন এক দুর্যোগ, ইতিহাসে যার নজির প্রায় বিরল। ঐতিহাসিকদের অনুমান, তিরিশ হাজারের মতো জীবিত মানুষ এই অঞ্চল ছেড়ে আস্তানা গেড়েছিল মায়া নিম্নভূমিতে। এই তিরিশ হাজার মানুষই পৃথিবীর সর্বোত্তম সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল।

আমরা চলতে চলতে সেই ভূ-খন্ডই দেখছিলুম, যার জনক হল আগ্নেয়গিরি। ধূসর ভূমি, চুনাপাথর, কোথাও বন্ধ্যা কোথাও আবার সামান্য গাছপালা ঘাস। কখনো আমরা উঁচুতে উঠছি, কখনো নেমে যাচ্ছি নিচে। তখন মনে হচ্ছে, আমরা খাদে পড়ে আছি। আকাশ উঠে যাচ্ছে অনেকটা উঁচুতে। এই হাঁটাটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। প্রতি পদক্ষেপে বিস্ময়, প্রতি পদক্ষেপে ঈশ্বরের কথা মনে পড়ছে। তাঁর অসীম শক্তির কথা, সারা পৃথিবীটাকে কী বিস্ময়কর বৈচিত্রে ভরে রেখেছেন। চলতে চলতে মনে হচ্ছিল, এই মায়া নামটি কোথা থেকে এল। যাঁরা এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁরা কি বৈদান্তিক ছিলেন। মায়া নামটি কি তাঁরা বেদান্তের পাতা থেকে তুলে এনেছিলেন! জাঁ-ফ্রেডারিখ ম্যাক্সিমিলিয়ান, যিনি নিজেকে বলতেন কোঁৎ-দ্য-ওয়ালডেক, তাঁর একটি তত্ত্ব আছে। আঠারোশো বত্রিশ সালে তিনি প্যালেঙ্ক দেখতে এসেছিলেন, এই অঞ্চলেই আছে মায়া সভ্যতার সর্বাধিক ধ্বংসাবশেষ। এই ধ্বংসাবশেষ দেখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, প্রাচীন কালের সর্বোত্তম বিশ্ব-সভ্যতার নির্দশন এই মায়া ধ্বংসস্তূপ, অর্ধশতাব্দী পরে এক সুশিক্ষিত অবতার পুরুষ অগাস্টাস-লা-প্লোজিঁয়োঁ আবার ভিন্ন মত পোষণ করতেন। ভদ্রলোককে মহর্ষির মতো দেখতে ছিল। একমুখ দাড়ি, সম্মানিত, বলগাহীন কল্পনার অধিকারী, উগ্র তার্কিক। তিনি বলে গেছেন স্বর্গোদ্যান বা গার্ডেন অফ ইডেন, যার উল্লেখ আমরা বাইবেলে পাই, তা হল এই মায়াভূমি। মায়া স্থাপত্যে আমরা যে আঁকাবাঁকা রেখা পাই, তার থেকেই প্রমাণিত হয় মায়ারা বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মতে য়ুকাটান থেকেই পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার উদ্ভব। সাম্প্রতিক কালের মতো হল, মায়ারা এসেছিলেন বহির্বিশ্ব থেকে মহাকাশ যানে আরোহণ করে। আমি এই মতের সমর্থক, কারণ আমি যতটুকু দেখেছি এখনও পর্যন্ত, তাতে আমার মনে হয়েছে মানবাকৃতি থেকে থেকে শুরু করে পিরামিড, পাথরের মূর্তি, তৈজসপত্র, মোটিফ, গ্রিফস, ভাস্কর্য, ছবি, নকশা, কাপড়-জামা, বর্ণবিন্যাস সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা অতিজাগতিক স্পর্শ, বিশাল এক কর্মতৎপরতা বিচিত্র আচার-আচরণ একটা সময় সীমা পার করে হঠাৎ ভোজবাজির মতো উবে চলে গেছে। এই মতবাদের যাঁরা সমর্থক, তাঁরা যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মধ্যে প্রধান হল: সেই অতীতে অন্য কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না বিশাল বিশাল প্রস্তরখন্ডকে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে এমন অক্লেশে বহন করার, তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না মায়াদের মতো জটিল একটি সমাজ তৈরি করার, তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এমন একটি ধর্ম ও শিল্প গড়ে তোলার। আমরা একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ দেখতে পেলুম দূরে আকাশের গায়ে ছবির মতো আঁকা রয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ‘ইণ্ডিয়ান ভিলেজটি। আমরা ঢাল বেয়ে তরতর করে নেমে গেলুম সেই গ্রামের দিকে। নিজের গ্রামটি যত এগিয়ে আসছে, আমাদের পথ-প্রদর্শিকা মেয়েটির গতিও তত বাড়ছে। অবশেষে আমরা সেই গ্রামে গিয়ে হাজির হলুম। মায়ারা খুবই অতিথিবৎসল। গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন মানুষটি আমাদের অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন। প্রতিটি বাড়ির ভিত পাথরে তৈরি। এক ধরনের বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি দেয়াল। ছাদের আচ্ছাদন হল খড়, প্রতিটি বাড়ির ভেতরে দু-টি করে ঘর, একটি শোবার ঘর ও একটি রান্নাঘর। প্রতিটি গৃহের প্রবেশপথ আছে, কিন্তু দরজা নেই। কারণ এখানে চোর নেই, চুরি নেই, অন্যের সম্পদের উপর কারও কোনো লাভ নেই। ফলে অর্গলের কথা এরা চিন্তাই করতে পারে না। বন্ধ দুয়ার শব্দটি এদের অভিধানে নেই। প্রবেশপথের মাথার ওপর একটি দড়ি ঝুলছে, সেই দড়িতে বাঁধা একগুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘণ্টা। একটু দুলিয়ে দিলেই সেই ঘণ্টা একসঙ্গে বেজে ওঠে নানা সুরেই, এরই নাম মায়া কলিং বেল।

এই গ্রামে একটা মাঝারি উচ্চতার পিরামিড রয়েছে, সেই পাঁচ হাজার বছর আগের ধ্বংসাবশেষ। প্রবীণ মানুষটি ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় বললেন, ‘তোমরা ওর মাথায় উঠে চারপাশটা একবার দেখো, এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়।’

আমার তো সবেতেই ভয়। মনে হল যদি সাপে কামড়ায়, কী একটা জাগুয়ার বেরিয়ে আসে! বাংলাদেশের ছেলে সাপের ভয়টা আগে পাই।

অ্যান বললে, ‘তোমার দ্বিধার কারণটা কী?’

‘অনেকদিনের পুরোনো ধ্বংসাবশেষ, ভেতরে কী আছে কে জানে?’

‘তোমাকে তো ভেতরে যেতে হচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছ না সিঁড়িটা বাইরে?’

তখন আমার চোখ পড়ল সিঁড়িটার দিকে। মায়া জীবন, মায়া সভ্যতার পুরো রহস্যটা এখনও জানা হয়নি। এঁরা বিশাল বিশাল সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। শুধুমাত্র তার চূড়াটিকে ব্যবহার করার জন্য। কোনো সময়ই সিঁড়ি ভেতরে রাখার প্রথা ছিল না। মনে হয়, তার একমাত্র কারণ— মায়ারা বর্তমানের স্বার্থপর সভ্য মানুষের মতো কথা ভাবতে শেখেনি। তাঁরা যা কিছু করত, জনজীবনের দিকে তাকিয়ে, কমিউনিটির দিকে তাকিয়ে। এই যে আমরা যে-গ্রামে এসেছি, মায়া সভ্যতা অবলুপ্ত হলেও মায়া জীবনধারা এখানে পুরোপুরি বর্তমান। অনুসন্ধান করে জানলুম, এদের প্রধান খাদ্য এখনও ভুট্টা, প্রধান জীবিকা চাষবাস। সকাল বেলায় মাঠে যাবার কয়েক তাল ভুট্টার মন্ড সঙ্গে করে নিয়ে যায় খাদ্য হিসেবে। এদের জীবন চলে ‘কমিউনিটি’ প্রথায়। গ্রামের মধ্যভাগে রয়েছে স্নানাগার। মাঠ থেকে ফিরে এসে বিকেলে সকলে ওই স্নানাগারে চলে যায়। সেখানে সবাই মিলে স্নান করে চলে যায় ‘কমিউনিটি ডাইনিং হলে’। সেই ভোজনাগারে সবাই পাশাপাশি বসে দিনের প্রধান খাদ্যটি গ্রহণ করে। ‘কমিউনিটি কিচেন’ থেকে বেরিয়ে আসে গরম ‘মেজ ওমলেট’। বেশ বড়ো আকারের। একসঙ্গে পাশাপাশি কুড়ি-পঁচিশটি ওমলেট থাক করে রাখা হয়। যে যত পার খাও। সঙ্গে থাকে লঙ্কা, যাকে এরা বলে আজি বা চিলি। এদের খাদ্য তালিকায় থাকে রাঙা-আলু, ম্যানিওক, অ্যাভোক্যাডোপিয়ার। আর এখানে খুব কোকোর চাষ হয়। খাদ্য তালিকায় পানীয় হিসাবে থাকে চকোলেট। এখানে এক ধরনের চুইংগাম পাওয়া যায় গাছ থেকে। সে গাছের নাম চিকল ট্রি। সেই গাছের আঠা খুলে নিয়ে মুখে ফেলে চিবোলেই চুইংগ্রাম। মায়া ছেলে-মেয়েরা অনবরতই সেই গাম চিবোচ্ছে।

সিঁড়ির বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণ ধাপ বেয়ে আমরা সেই প্রস্তর পিরামিডের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালুম। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নেমে এসেছে।

বারে বারে একটা প্রশ্নই আমার কাছে ঘুরে ঘুরে আসছে, এঁরা কে, এই মায়ারা! ভারতীয়দের চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত একটা সাদৃশ্য আছে। গাত্রবর্ণে। চুলের রঙে। চোখের রঙে। তাকাবার ভঙ্গিতে। হাসিতে। দাঁতের গঠনে। সকলের নয়, অনেকের নাকের গঠন আমাদের সঙ্গে মেলে না। না আর্য, না অনার্য। ‘হক নোজ’। অর্থাৎ ঈগল চঞ্চুর মতো বাঁকা। সেই মুখে এই ধরনের নাক দেখছি, সেই মুখের আকর্ষণ যেন অনেক বেশি। চোখে দার্শনিকের মতো সুদূর দৃষ্টি। মুখে বুদ্ধিদীপ্ত গাম্ভীর্য। দেখলেই মনে হয় ‘ডিপেণ্ডেবল ক্যারেকটার’। ভালো লাগে। কাছে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, এমন মানুষের পাশ বসলে জীবনের গভীর কথা শুনতে পাব। যে কথা ভেসে আসে মহাসিন্ধুর ওপার হতে।

সেই ইণ্ডিয়ান চিফের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই আমার ভীষণ একটা শ্রদ্ধার ভাব আসছিল। মনে হচ্ছিল, এমন এক ব্যক্তিত্বকেই বলা যায় ‘ফাদার ফিগার’। আমার দিকে যতবার তাকাচ্ছেন, সেই দৃষ্টিতে ঝরছে স্নেহ। আমি প্রশ্ন করলুম, ‘আমাদের মতো আপনাদের সমাজে কেন পাপ নেই! চুরি নেই। ডাকাতি নেই। নারীঘটিত অপরাধ নেই। স্বার্থ নেই। স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নোংরামি নেই। কেন নেই! আপনারাও তো মানুষ।’

অ্যান আমার প্রশ্নটিকে স্প্যানিশে তর্জমা করে দিল। ইণ্ডিয়ান চিফ বুঝতে পারলেন। নীরবে মাথা নীচু করে হাসলেন কিছুক্ষণ। তাঁর এই ভঙ্গিটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, আমার ধ্রপদ-শিক্ষক প্রয়াত সন্তোষ রায় মহাশয়কে। অবিকল একই রকম দেখতে। একইরকম ভাবভঙ্গি। তিনিও এইরকম মুখে স্মিত হাসি নিয়ে মাথা নীচু করে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর গান ধরতেন। তখন এই পৃথিবীতেই খুলে যেত আর এক পৃথিবীর দরজা।

ইণ্ডিয়ান চিফ অনেকক্ষণ ওইভাবে বসে থাকার পর বললেন, ‘আমরা মানুষ নই।’

আমি ভাবলুম অহঙ্কার। পরের কথায় সে ধারণা ভাঙলো। বললেন, ‘স্প্যানিশ বিজেতারা এক শতাব্দী ধরে নিজেদের মধ্যে শুধু তর্ক-বিতর্কই করেছিল, আমরা মানুষ নয়, জন্তু! কারণ আমাদের জন্তু প্রমাণ করতে না পারলে শ্বেত দুনিয়ার গান-পাউডার-সিভিলাইজেশানের অহঙ্কার থাকে না।’

‘এর কারণ তাঁদের হীনমন্যতা।’

‘সে ব্যাখ্যা আপনারা করবেন। আমরা পরাজিত। আমরা বিজিত। আমরা লস্ট এম্পায়ারের ধ্বংসাবশেষ। আমাদের নীরব থাকাই ভালো। তবে আমরা যে-মন্ত্রের পূজারী, সে-মন্ত্র হল, ‘আমা সুয়া, আমা ল্লুল্লা, আমা শেকল্লা’। চুরি কোরো না, মিথ্যে বোলো না, আলস্য ত্যাগ করো। আমরা এই নীতি আজও অনুসরণ করছি। আমাদের ঘর অর্গলমুক্ত। আমরা যা করি, সকলে মিলে করি। আমাদের জীবনে কোনও গোপনীয়তা নেই।’

‘আপানাদের দেখে মনে হচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর মহাকাশ-সভ্যতা থেকে অনেকটা সরে আছেন। ঠিক যেন মিশতে পারছেন না, মিলতে পারছেন না। স্বেচ্ছা-নির্বাসন বলা চলে।’

‘কোনো সন্দেহ নেই। এক বলে সংস্কৃতির পার্থক্য, বিশ্বাসের পার্থক্য, ধর্মের পার্থক্য। আমরা বড়ো বেশি স্পিরিচ্যুয়াল। আমাদের দেবতা কোনো অলীক বিশ্বাস নয়, প্রত্যক্ষ শক্তি। সূর্য, চন্দ্র আর ধরণী। সান কর্ন অ্যান্ড সিভিলাইজেশান। যে প্রকৃতিকে আমরা পূজা করে এসেছি, বিংশ শতাব্দীর উচ্চ সভ্যতা সেই প্রকৃতিকে সুপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে চলেছে। আমাদের দেবতা হলেন সূর্য, বৃষ্টি, বাতাস বারি। আর আমাদের দেবী হলেন শস্য। ভুট্টা। এই সৃষ্টি সম্পর্কে আমাদের এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। আমরা মনে করি, এই ভুট্টাই হল সৃষ্টির উৎস। খাদ্য ছাড়া প্রাণ বাঁচে না। কুইচে মায়াদের ধর্মপুস্তক ‘গোপোল ভু’-তে আছে, ঈশ্বর কীভাবে প্রথম পিতা ও প্রথম মাতা সৃষ্টি করলেন! হলুদ ও শ্বেত ভুট্টা দিয়ে তৈরি হল তাদের হাড়-মাংস, আর হাত-পা! তোমাদের স্থপতিরা যন্ত্রের সাহায্যে শহর গড়ছে, বিশাল বাড়ি তৈরি করছে। আমাদের কোনো গৃহপালিত পশু ছিল না, আমাদের সেই জগতে লোহা ছিল না, আমরা চাকা ব্যবহার করিনি, ফলে আমাদের গাড়ি ছিল না। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা যে-শহর তৈরি করেছিলেন, যে-মন্দির, প্রাসাদ, পিরামিড তৈরি করেছিলেন, তার ধারে-কাছে পৌঁছোবার ক্ষমতা বর্তমান সভ্যতার আছে কিনা সন্দেহ। এমন একটা যুগে বসে আমরা এমন কিছু করেছিলুম, যার গর্ব বংশানুক্রমে আমাদের মধ্যে একটা একাকিত্ব সৃষ্টি করেছে। আজকের যন্ত্র-নির্ভর মানুষ যা নিয়ে গর্ব করে, তা হল যন্ত্রের দান। আমরা যার গর্ব করি, তা মানুষের দান।’

বৃদ্ধ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। আমরা সেই ক্ষুদ্র পিরামিডের মাথা থেকে নেমে এলুম। অচেনা মায়া আকাশে আবার সেই ঘোর লেগেছে। অনেক যুদ্ধ, অনেক হত্যা, লুন্ঠন, অত্যাচার দেখলে বৃদ্ধের চোখ বোধ করি এইরকমই ঝাপসা হয়ে আসত। কবে ঘটে গেছে সেই সব নারকীয় ঘটনা, মাথার ওপর আকাশ কিন্তু বিষণ্ণ রয়ে গেছে চিরতরে। গাছপালা সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব সামান্য। সেই জ্ঞান নিয়ে যে বৃক্ষকে এতদিন ভেবেছি রেড উড, আসলে সেই গাছ হল সিবা ট্রি। সিবা বৃক্ষ। মায়া নাম। মায়া গ্রাম-প্রধানই আমার ঘুম ভাঙালেন। এই বৃক্ষ তাঁদের সেই অবলুপ্ত প্রাচীন সভ্যতারই প্রতীক। যেখানে একসময় সবই ছিল, অথচ এখন কিছুই নেই। অতীত সভ্যতার অতন্দ্র প্রহরীর মতো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এই শিবা বৃক্ষ। এই নাম তাঁরা কোথায় পেলেন! আমাদের শিব থেকেই কি শিবা? মায়াদের কাছে এই গাছ অতি পবিত্র। এই গাছ তাঁদের বিশ্বাসে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্র। জীবন-বৃক্ষ। সেন্টার অফ দি কসমস। বিশাল লম্বা এই গাছের গুঁড়ির আকৃতি বোতলের মতো। যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে একই মাপের পত্রগুচ্ছ, পাখার মতো। আকাশের প্রেক্ষাপটে গাঢ় কালো এক-একটি ছন্দের মতো। চিফ আমাকে চিনিয়ে দিলেন অন্যান্য গাছ। সেডার, মেহগিনি, স্যাপোভিলাস, রেইন ট্রি।

আমি আর অ্যান বিশাল একটি মেহগিনি গাছের তলায় গিয়ে বসলুম। আমাদের ফুলদি’র কিশোরী কন্যাটি মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হেসে চলে গেল। সরল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে। মেয়েটির বাবা আছে, বোন আছে, ভাই আছে, ঠাকুরদা আছে, ঠাকুমা আছে। মায়া পরিবার আর আমাদের বাঙালি পরিবারে অসীম মিল। আমরা যৌথ পরিবার ভেঙে ফেলেছি আর এরা যৌথ সমাজ গড়ে বসে আছেন। একটা গ্রাম নিয়ে একটা পরিবার। এত ভালো লাগছিল এদের জীবন ও জীবন-ব্যবস্থা! এদের জীবনদর্শন। চারপাশ দেবালয়ের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সেডার গাছের সুন্দর একটা গন্ধ আছে। ভাসছে বাতাসে ধূপের মতো।

যত দিন যায়, সময় ততই সরে যায় দূর থেকে দূরে। কিন্তু স্মৃতি! স্মৃতি হল সময়ের শ্যাওলা। মনের দেয়ালে সবুজ শৈবাল। পৃথিবীতে সবই থাকে, মানুষের চেয়ে বেশি দিনই থাকে। পথ, প্রান্তর, ধ্বংসাবশেষ, মানুষের শিল্পকর্ম। থাকে না সম্পর্ক। দু-জনে হয়তো দেখা হল। কিছুকাল মেলামেশা গড়ে ওঠা। একটা সম্পর্ক। তারপর দু-জনে ছিটকে চলে গেল দুটিকে। আর হয়তো দেখাই হল না কোনোদিন। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো চিঠি। কিন্তু উচ্ছাস, আবেগ। ক্রমে তাও ক্ষীণ। অবশেষে স্মৃতি।

মানুষের মনেও একটা গাছ থাকে। থাকে সবুজ প্রান্তরের ছায়া। সেই ছায়ায় বসে থাকে সম্পর্ক। দূরত্ব সেখানে ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারে না। সময় সেখানে নিশ্চল। ভালোবাসা আর ভালোলাগার বেদিতে মুহূর্ত যে চিরকালের মূর্তি হয়ে বসে থাকে!

সেডার গাছের ছায়া আজও সেই প্রান্তরে লুটিয়ে আছে। বাতাসে পাতার গন্ধ। দূর আকাশে পিরামিডের ছবি। সেই ছায়ায় বসে আছে অনাগত কাল। যুগল প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা নি:সঙ্গ ঐতিহাসিক। ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো এক নিবাসে এক নারী তার গবেষণাকর্মে ব্যস্ত। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। পুরাতত্ত্ব তার বিষয়। ব্যস্ত জীবনের আবর্তে সে হয়তো ভুলেই গেছে—

একদিন কোনোদিন বিদেশী পথিক এক
ধরেছিল হাত
সেকথা তোমার আজ নাই মনে থাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *