স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু

স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু

“This is the way the world ends
Not with a bang, but a whimper.”

একদিন, জুন মাসের এক বিকেলে মাখনলালের মন ভালো ছিল না।

সেদিন অফিসে অনেকক্ষণ ধরে একটানা একটা জরুরি কাজ করতে হয়েছে। যখন অবশেষে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে সে ঘড়ি দেখল তখন ছ’টা বেজে সতেরো মিনিট। তার মেরুদণ্ড ব্যথা করছিল, মাথার ভিতরে কোথায় একটা রগ বিদ্যুতের মতো চমকে–চমকে উঠছে। পাখার হাওয়ায় কোথায় একটা কাগজ উড়ছে–মাখনলাল দেখতে পেল না-কিন্তু সেই শব্দে তার শিরা-উপশিরা শিউরে উঠেছিল। তার চারদিকে জনশূন্য নিঃশব্দ ঘরটা প্রকাণ্ড হয়ে আছে। মনে হল তাকে অন্যমনস্ক রেখে সারা বিকেল ধরে তার জ্বর এসেছে।

করিডোরে বেরিয়ে এসে সে দারোয়ান রামজীবনের পায়ের শব্দ পায়। নাগরা জুতো অন্ধকারে হাতুড়ির মতো ঠুকতে–ঠুকতে সে অনেকক্ষণ ধরে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছিল। চাবির গোছার শব্দ, কাশির শব্দ, দেহাতি গানের কলি পরস্পর মিশে যায়। সে এই বুড়ো অফিস বাড়িটার সিল করবার গালার অদ্ভুত গন্ধ, পুরোনো গঁদ, কাঠ আর বার্নিশের গন্ধ পায়। অল্প অন্ধকার, দীর্ঘ করিডোরটা পায়ে-পায়ে পেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ মনে হয় বয়স ঢের বেড়ে গেছে। আর মনে হয় বাইরে কোথায় তাকে বাদ দিয়ে একটা উৎসব চলতে-চলতে শেষ হয়ে এল। সিঁড়ি ভেঙে সে বাইরের আলো আর শব্দের মাঝখানে নেমে আসতে-আসতে স্পষ্ট টের পেল রামজীবনের গানের কলি হঠাৎ লক্ষ্যহীন অন্ধের মতো টাল খেতে-খেতে পুরোনো অফিস বাড়িটার কড়ি বরগা আর দেওয়ালের পলেস্তারার ভিতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেল।

বাইরে হাওয়ায় দোকানের উজ্জ্বল আলো আর লোকজনের ভিড়ের ভিতরে নেমে এসে হঠাৎ ঘুম এবং স্বপ্ন ভেঙে গেলে যেমন হয়, তার তেমনি সবকিছু খুব অচেনা লাগছিল। মনে পড়ল সে অনেকক্ষণ সিগারেট খায়নি, জল খায়নি, কোনও খাবার খায়নি। অন্যদিন এই সময়ে তার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা। মনে হয় ললিতা তার অপেক্ষায় আছে কিন্তু আজ এক্ষুনি তার বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না। মনে পড়ে কতকাল সে কলকাতার রাস্তায়, ময়দানে, এসপ্ল্যানডে ঘুরে বেড়ায়নি, দোকানের শো-কেসে সাজানো জিনিস, আলো, লোকজন দেখতে-দেখতে দু-পয়সার বাদাম শেষ করে খামোকা কোনও রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়েনি। এইসব–খানিকক্ষণ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভেবে নিল সে। তারপর আস্তে-আস্তে ট্রাম রাস্তা পেরোল মাখনলাল।

জুন মাসে পরপর কয়েকদিন অনাবৃষ্টি গেছে। জ্বরগ্রস্ত ফুটপাথ থেকে, দেওয়ালের গা থেকে ভাপ উঠে আসছে। ধুলোয় ঘুলিয়ে উঠছে এসপ্ল্যানেডের আলো, গা ঘেঁষে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মন্থর ট্রাম চলে যায়। নীচু বুকচাপা দোকানঘর থেকে চামড়ার কটুগন্ধ। বুক গুলিয়ে ওঠে। বৃষ্টি হবে কি? মাখনলাল চোখ তুলে আকাশ দেখল। মেঘ না তারা না,–কিছুই দেখা যায় না।

আলো অন্ধকার, অবয়ব চোরাগুলি, মুণ্ডের সারি চোখের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। শো-কেসে সাজানো রেডিও, গলফ স্টিক, হাওয়াই শার্ট। স্যুটপরা ‘ডামি’ আলোর নীচে চকিতে হেসে উঠল। একটা সিনেমা হল। লবিতে নিঃসঙ্গ সাদা একটা ওজন নেওয়ার যন্ত্র। মাখনলাল পেরিয়ে যাচ্ছিল। যেতে-যেতে কী ভেবে দাঁড়িয়ে ফিরে এল। এখন বিকেলের শো চলছে। লবিটা নির্জন। মাখনলাল ওজন নেওয়ার যন্ত্রটার দিকে এগিয়ে গেল।

ওজন নেওয়ার যন্ত্রের ভিতর পয়সাটা ফেলে দেওয়ার পর..যখন ঠিঠিন করে একটা জটিল গলিঘুজির পথ দিয়ে সেটা নেমে যাচ্ছিল তখন মাখনলাল যন্ত্রটাকে লক্ষ করল। পয়সাটা কোথায় ধাক্কা মারল কে জানে–হঠাৎ ভিতরে কোথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শিউরে লাফিয়ে উঠল যন্ত্রটার হৃৎপিণ্ড। কোথায় একটা স্প্রিং শিরার মতো টিকটিক করে কাঁপতে থাকে। লিভারের ওঠানামার সঙ্গে-সঙ্গে সে যন্ত্রটার জেগে ওঠা টের পেল। মনে হয় এতক্ষণ স্তব্ধ থাকবার পর যন্ত্রটার শিরা ধমনীর ভিতর দিয়ে রক্তস্রোত প্রবলভাবে বয়ে যাচ্ছে।

টিক করে টিকিট পড়ল ছোট্ট খোপের মধ্যে।

কয়েক পলক মাখনলাল সাদা মসৃণ সুন্দর যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠান্ডা ঘুমন্তের মতো। মনে হয়, একটুক্ষণের জন্য জেগে ওঠে, তারপর জাগরণ ক্লান্তিকর দেখে যন্ত্রটা আস্তে আস্তে আবার তার শীতল চিন্তাহীন ঘুম এবং স্বপ্নের ভিতরে চলে গেছে।

মাখনলাল ওজনের টিকিট তুলে একটা মেয়ের ছবি দেখতে পেল। ছবির নীচে তার ভাগ্য দেওয়া আছে। ওজন ছাপানো টিকিট হাতে মাখনলাল সিনেমা হলের লবি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল।

টিকিটের ওজন ছাপানো দিকটায় ভালো খবর প্রায়ই থাকে। সে দেখল, এবার পাঁচ পাউন্ড কম! লম্বার অনুপাতে তার ওজন বরাবরই চার-পাঁচ পাউন্ড কম ছিল। তাহলে সবসুদ্ধ মাখনলাল হিসেব করে দেখল, তার যতটা ওজন হওয়া উচিত–তার চেয়ে এখন তার ওজন আট-নয় পাউন্ড কম!

তার মন আস্তে-আস্তে বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছিল। ওজন নিয়ে সে কখনও বড় একটা ভাবেনি। কিন্তু হাঁটতে-হাঁটতে একসময়ে টের পেল চারদিকে ভ্রাম্যমাণ লোকজনদের যাতায়াত, স্টেট বাসের শব্দ–এইসব আলোকিত দৃশ্যের ভিতরে থেকেও সে আজ কেবলই নিজের ওজনের কথা ভাবছে!

এইভাবে কিছুক্ষণ হাঁটল মাখনলাল। তারপর রাস্তার ওপাশে একটা খুব ঝলমলে সিগারেটের দোকান দেখতে পেয়ে ট্রামরাস্তা পেরোল।

ব্যস্ত দোকানির দিকে পয়সা বাড়িয়ে ‘এক প্যাকেট চারমিনার’ বলে সে দোকানের অসম্ভব সরু লম্বা আয়নায় হঠাৎ নিজের মুখ এবং কোমর পর্যন্ত দেখতে পেয়ে চমকে উঠল। নিজের লাবণ্যহীন দুর্বল মুখের দৈনন্দিন বিষণ্ণতা আর অবসাদ সে দেখে নিল। সে জানে তার শরীরও ছোটখাটো–কোনওখানেই তা শক্ত কিংবা পুরুষালি নয়। অনেকদিন ধরে সে রক্তহীনতা রোগে ভুগছে কি? কিংবা বহুদিন ধরে অন্যমনস্কতার সুযোগে তার কোনও গোপন অসুখ তৈরি হয়ে গেছে! সে বুঝল না।

সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে দোকানি তাকে লক্ষ করছে টের পেয়ে মাখনলাল চোখ সরিয়ে নিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে সে ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়। ওজন নেওয়ার টিকিটটা তখনও হাতে ধরা ছিল। সেটা  ছুঁড়ে দেওয়ার আগে মাখনলাল তার ভাগ্যটা পড়ল, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘শিগগিরই আপনি খুব বিপদে পড়বেন, তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হবে না।’ বিপদ! মাখনলাল ভ্রূ কোঁচকাল। আবছা রহস্যময় একটা কার্যকারণসূত্রকে সে টের পাচ্ছিল। সে জানে কোনও যুক্তির সূত্রে লেখাটা তার হাতে আসেনি-এর কোনও মানে নেই। তবু কোথায় সূক্ষ্মভাবে সে সচেতন হয়ে উঠেছিল। সিগারেটের তীব্র ধোঁয়া তার স্নায়ুপুঞ্জে, গলার স্বরনালীতে, বুকে দয়াহীন ছড়িয়ে পড়ছিল। সে টিকিটটা দুমড়ে  ছুঁড়ে ফেলে দিল।

তারপর রাস্তায় দোকানের উজ্জ্বল আলো, কাটা-কাটা নাক–মুখ-চোখ গলির মুখে চোরা অন্ধকার দেখতে-দেখতে খানিকক্ষণ বোধহীনের মতো হাঁটল মাখনলাল। সে এসপ্ল্যানেডের বড় রাস্তা, চেনা পথ ছেড়ে আধো অন্ধকার অচেনা রাস্তায় ধাঁধার ভিতরে উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরছিল। কখনও মন খারাপ হয়ে যেতে থাকলে সে দেখেছে কিছুই করার থাকে না। সে নিজের ভীষণ অন্যমনস্কতা টের পেল। টের পেল তার ভয়ংকর খিদে পেয়েছে, তেষ্টায় বুক জ্বলছে। অচেনা গলির মুখে ছিমছাম একটা রেস্টুরেন্ট দেখতে পেয়ে তার দরজায় উঠে দাঁড়াল মাখনলাল। কাঁচের পাল্লা ঠেলে ভিতরে একটা পা বাড়াল।

ভিতরে কোথাও রেডিও বা গ্রামোফোন কোনও অদ্ভুত ড্রামের বাজনা দমকে–দমকে বাজছে। পলকের জন্য তার মনে হল শব্দটা নেড়ি কুকুরের মতো গায়ে গা ঘষটাতে–ঘষটাতে আর্ত চিৎকার করে তাকে এই ঘরে ঢুকতে বারণ করছে। ভিতরে ধু-ধু আলো জ্বলছে–সেই আলো কাঁচ বসানো টেবিল ছাইদানি, পিরিচ, চেয়ার টেবিলের চকচকে বার্নিশের ওপর থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আলপিনের মতো তার চোখে বেঁধে। মনে হয় এর লম্বাটে হলঘরের মতো ঘরটার সবকিছুই আলো বিকিরণ করছে। ভিতরে খুব বেশি ভিড় নেই। যারা আছে তাদের প্রায় সকলকেই বিদেশি কিংবা জাহাজের লোক বলে মনে হয়। বাঁ-দিকে দেওয়ালের কাছে কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে তার কালো মুখে বেশি পাউডার কিংবা রং মাখা বলে মুখটা ছাইরঙা–রক্তশূন্য। রুক্ষ চুল, উঁচু চোয়াল আর মভ রঙের শাড়িতে তাকে সাজানো ডামি বলে মনে হয়। শিবহুল কালো একটা হাত কাউন্টারের ওপর প্রাণহীন–কেউ এসে তুলে নেবে বলে অপেক্ষা করছে।

দু-একজন ফিরে তাকিয়ে মাখনলালকে দেখে। যারা বসে আছে তারা সবাই খুব লম্বা চওড়া আর জোয়ান বলে তার বোধ হল। সে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা কতগুলো মজবুত কবজি দেখছিল। দমকে–দমকে ছড়িয়ে যাওয়া গান, তালে–তালে মৃদু মাথা নাড়া–সবকিছুরই অতিরিক্ত এখানে। তাকে কেউ গ্রাহ্য করল না। যেন সে তার তুচ্ছ শরীর, রক্তশূন্য মেয়েলি মুখ, দুর্বল হৃৎপিণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এখানকার ভীষণ পুরুষালি একটা আবহাওয়াকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এইসব আলো গান, মেয়ে, তার জন্যে নয়। মনে হল–সে ভুল জায়গায় এসেছে, ভাবল–ফিরে যাই।

কাউন্টারে বসা প্রকাণ্ড একটা লোক হাতছানি দিয়ে সে মাখনলালকে একটা খালি টেবিল দেখিয়ে দেয়। অকারণে খুনখারাপি রঙের ঠোঁট ফাঁক করে মেয়েটা হাসে। চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল মাখনলাল। বমি হওয়ার আগের মুহূর্তের দমকা ঘূর্ণি শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসছে টের পেয়ে মাখনলাল হাত নেড়ে লোকটাকে জানাতে চাইলবসবে না। লোকটা একটা মোটা আঙুল মুখে পুরে মাড়ি পরিষ্কার করতে-করতে তার দিকে নিস্পৃহ তাকিয়ে দেখে।

মাখনলাল নিজে কী করছে বুঝতে পারছিল না। বেরিয়ে আসবার জন্য সে অন্ধের মতো কাঁচের পাল্লাটার দিকে হাত বাড়াল। সেই মুহূর্তেই সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো এক বেয়ারা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সে বোঝে–তার জন্যেই। ফিরে তাকাতেই হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে তার মনে হল ভিতর থেকে কেউ আগুনের মতো একজোড়া চোখ তার দিকে  ছুঁড়ে দিয়েই নামিয়ে দিল। পয়সার মতো কী একটা বস্তু তার শরীরের জটিল ফুসফুস মেরুদণ্ডের পথ বেয়ে ঠিঠিন করে হঠাৎ গড়িয়ে গেল। উন্মাদ ড্রামের শব্দ সেই মুহূর্তেই খুব উঁচু গ্রাম থেকে হঠাৎ চূর্ণীকৃত ভগ্নাংশে লয় পেয়ে যাচ্ছিল। পলকের জন্য মাখনলাল নিজের জেগে ওঠা টের পাচ্ছিল। কার চোখ কে দেখতে পেয়েছে বুঝল না।

বিনীতভাবে পাগড়ির ছায়ায় ঢেকে বুড়ো বেয়ারাটা মাখনলালকে কিছু বলছিল। মাখনলাল শুনল না কিংবা শুনেও কিছু বুঝল না। সে জানত না-যেন তার অজান্তেই কোনও ঘটনা এখানে ঘটে আছে। যেন এরা এতক্ষণ দোকান সাজিয়ে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে দ্রুতচোখে শেষবারের মতো রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখে নিচ্ছিল। মনে হল, এখানে কোথাও কোনও জরুরি জিনিস সে ফেলে যাচ্ছে। ভিতরের আলো, সহস্র তল থেকে প্রতিধ্বনিত বাজনার শব্দ, তালে তালে মৃদু মাথা নাড়ার ভিতরে কোথায় যেন যুদ্ধ যাত্রার প্রাক্কালে সৈনিকদের মতো বেপরোয়া ভাব ছিল। মেয়েটার স্থির অবয়ব কাউন্টারে হেলানো, প্রকাণ্ড লোকটা হঠাৎ ঘাড় হেলিয়ে সিলিং দেখছে, বুড়ো বেয়ারাটা দাদুর মতো স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। কিন্তু এদের ভিতর তার চোখ সে দেখতে পেয়েছে বুঝল না। চোরা মারের মতো তাকে আঘাত করেই চোখটা বিবরে সরে গেছে। যেন কেউ আংটি পরা হাত আলোর সামনে এনেই সরিয়ে নিল বিচ্ছুরিত আলো। পলকের জন্য তার চোখে বিধেছিল।

কেন তার এমন মনে হল! কাঁচের পাল্লাটা ঠেলে, সিঁড়ি ভেঙে ফুটপাথে নেমে যেতে-যেতে সূক্ষ্ম একটা অস্বস্তিকে টের পায় মাখনলাল। যেন হঠাৎ জেগে উঠে সে ঠিক কোথায় এসেছে চারপাশে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল। শ্বাস নিতে তার সামান্য কষ্ট হচ্ছিল–খুব উত্তেজনার পর যেমন হয়। সে স্থিরভাবে কোনও কিছুর দিকে তাকাতে পারছিল না, বুঝতে পারল না কোথায় এসেছে। যেন তার হাত পা কোনও কিছুই তার বশে নেই। কেন সে এখানে এসেছিল! চকিতে তার মনে পড়ে যায়, অন্যদিন এতক্ষণে সে তার শহরতলির ছোট্ট বাসায় ফিরে গেছে। তার দেরি দেখে নিশ্চিত ললিতা এখন ছয় বছরের বুকুকে পাশে নিয়ে মেঝের ওপর গড়াচ্ছে। সে ফিরলে উঠে দরজা খুলে দিতে ললিতার ঘুমন্ত মুখ বেয়ে পড়া চুল, লিত আঁচল দেখা যাবে।

খানিকক্ষণ–যেন ঘুমের ভিতরে হেঁটে গেল মাখনলাল। কিছুক্ষণ আগেকার গুমোট ভাবটা আর নেই। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। অবাস্তব এসপ্ল্যানেড দুলে–দুলে সরে যায়। ভেঙেপড়া দুর্গের অবশিষ্ট একটিমাত্র স্তম্ভের মনুমেন্ট। কারা তার সঙ্গে হাঁটছে, উলটোমুখো হাঁটছে, সামনে পিছনে এলোপাথাড়ি তাকে পেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের অবয়ব, মুখ এবং শো-কেসে, আয়নায় প্রতিবিম্বিত তাদের গোলাকার, কখনও লম্বাটে অ্যাবস্ট্রাক্ট চলন্ত ভগ্ন অবশেষ। কেন এমন হয় সে ভাবছিল। কার চোখ সে দেখেছিল! কার চোখ! খুব নিষ্ঠুর কেউ কি! অমন নিষ্ঠুর চোখের লোক পৃথিবী থেকে যত কমে যায় তত ভালো। কেমন নিঃসঙ্গ লাগছিল মাখনলালের। বুকে লুকোনো কোনও মাইক্রোফোন থেকে কে যেন কেবলই কথা বলছে। তার ঠোঁট নড়ছিল। সে কিছুই শুনতে পেল না। বুঝল না। হাজার কোণ থেকে, স্মৃতি থেকে, স্বপ্ন থেকে তির্যক, ভাঙা যৌগিক দৃশ্য ও শব্দ তার ওপর ঝরে পড়ছিল।

নাকি–বৃষ্টি! সুরেন ব্যানার্জি রোড পার হতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের উত্তোলিত হাতে বাধা পেয়ে সে জুন মাসের প্রথম বৃষ্টিপাত দেখল। হাজারটা থার্মোমিটার ফুটপাথে আছড়ে পড়ে ভাঙছে।

সংবিৎ পেয়ে দৌড়ে শিয়ালদার বাসে উঠতে গিয়ে সে দেখল ডবল–ডেকারে বেজায় ভিড়। বাস–স্টপেজের শেড-এর নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়াল মাখনলাল। শেড-এর তলায় ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ভিড়ে দাঁড়িয়ে সকলের গায়ের গরম অসুস্থ ভাপ, নিশ্বাস, সিগারেট ধোঁয়ার শ্বাস নিতে নিতে সে দূরগামী হরিণের লঘু পদশব্দের মতো বৃষ্টির শব্দ শুনছিল। মনে হয় চারপাশের সবকিছু হঠাৎ কোথায় যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সিঁড়িতে, ফুটপাথে, রাস্তায়, ডবল–ডেকারে–সবকিছুর ওপর চরাচর জুড়ে প্রবল হরিণের মতো লাফিয়ে ছুটছে বৃষ্টি। রাস্তার চৌ–মাথা, পুলিশ, লম্বা অফিস–বাড়ি, উজ্জ্বল দেখান–সব কেমন আড়ালের মতো স্থির থেকে ভিজে যাচ্ছে।

বৃষ্টির প্রথম দমকটা কেটে গেলে মাখনলাল ঘড়ি ঢেকে কবজিতে রুমাল বেঁধে রাস্তায় নামল। কিছুটা হেঁটে গেলে আবার বৃষ্টির জোর বাড়তে থাকে। জলের ফোঁটার প্রবল আঘাতে তার মুখের চামড়া ফেটে যাছিল। মাথাটা ভিজে যাচ্ছে–চুল বেয়ে জল ভেজা ঘাড়ের কাছ দিয়ে অজস্র আঁকাবাঁকা কেঁচোর মতো পিঠ বেয়ে নামছিল। হাঁটার তালে কিংবা বাতাসে হঠাৎ জামাটা পিঠের চামড়ার ওপর থেকে সরে যাচ্ছিল বলে তার বোধ হচ্ছিল কেউ তার চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে।

রাস্তাটা ধু-ধু করা বাষ্পকার জলকণায় আদি অন্তহীন। একটা স্কুটার তীব্রভাবে জল কেটে লঞ্চের মতো চলে যায়। সামনে পা ফাঁক করে বলিষ্ঠ একটি ছেলে লোহার হাতে হ্যান্ডেল ধরে আছে। পিছনের সিট-এ জড়োসড়ো রুমালে ঢাকা মুখ মেয়েটি ছেলেটির পিঠে এলিয়ে আছে। সামনে পিছনে ছায়ার মতো কয়েকজন কোলকুঁজো হয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। স্কুটারটা বৃষ্টির ভিতরে দূরে চলে যেতে-যেতে হঠাৎ বাঁক নিল, লাফিয়ে উঠে টাল খেয়ে তীরের মতন মিলিয়ে গেল। উলটে পড়ল না-আশ্চর্য! মাখনলাল দেখল।

চারিদিকে এখন এই বৃষ্টি ছাড়া কিছু নেই। রাস্তার দুধারে যে প্রকাণ্ড উঁচু বাড়িগুলোর তলায় দাঁড়ালে নিজেকে ভীষণ হীন বলে মনে হয়, সে বাড়িগুলো এখন  ঝাঁপসা-পটে-আঁকা-নিসর্গের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া ঝুপসি-ঝুপসি গাছের মতো দাঁড়িয়ে জড়সড়ো হয়ে ভিজছে। নিঃসঙ্গ একা মাখনলাল বৃষ্টির ভিতরে হেঁটে যেতে-যেতে টের পেল চারধারে এই বৃষ্টি এক প্রবল ঘেরাটোপের মতো ঘিরে আসছে– ঝাঁপসা ধোঁয়াটে পুরোনো ছবির মতো ঘরবাড়ি দোকান, দু-একটা মানুষ এরা সব অ-সত্য।

কোথায় যেন এই বৃষ্টির সঙ্গে সে একাকার হয়ে যাচ্ছিল চেনা রাস্তা, তবু তার মনে হল কোনওদিন কখনও সে এই রাস্তায় আসেনি। এই বৃষ্টি যেন তার চেনা পরিচয়কে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। যেন সে এক অদ্ভুত পরদার আড়ালে আছে, পরদা সরালেই দেখতে পাবে–বিদেশ। স্রোতের মতো জল ফুটপাথ থেকে তার জুতোয় চলকে উঠে বয়ে যাচ্ছে। সে খেয়াল করল না।

এমন বৃষ্টির মতো স্বাস্থ্যকর আর কী আছে! মনে পড়ে কতদিন সে বৃষ্টিতে ভেজেনি, রোদে আপদমস্তক পোড়েনি। মনে হয় প্রেমহীন প্রকৃতিহীন কতগুলো দিন সে স্বপ্নের ভিতরে কাটিয়ে দিয়েছে। কখনও ফিরেও দেখেনি দিনগুলি। কোনও স্মৃতি থাক তাও চায়নি। মনে হয় বহু দৃশ্য, শব্দ, চলার ভঙ্গি, অনেক নিস্তব্ধতা, মৃত্যুশোক এইভাবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ঝরে গেছে।

দূরের চিৎকার, অস্পষ্ট মন্থর ট্রামের শব্দ, পাখির ডানার শব্দ, পাতা ঝরে পড়বার শব্দ তার উদ্দেশ্যে কেউ নিক্ষেপ করছিল। এমন স্বজনহীন, বান্ধবহীন সন্ধেবেলা সে আর দেখেনি। কেন সে বৃষ্টিতে এল। কেন? মনে হয় এমনতরো সাধ তার কিছু-কিছু রয়ে গেছে। মনে পড়ে কোনও শীতের দুপুরে কার্জন পার্কে গাছের ছায়ায় সারাদিন শুয়ে থাকবার সাধ তার কখনও মেটেনি। মানুষের কাছে নয় কিন্তু অন্য কোথায় যেন সে ফিরে যেতে চেয়েছিল। পুব বাংলায়–তাদের পুরোনো বাড়ির জানলার ধারে এতদিনে শেফালি ফুলগুলি ম্লান হয়ে এল। পানা পুকুরের কালো পাড়ে শ্যাওলা–কচুপাতায় বাতাস লাগবার শব্দ–কামরাঙা গাছ থেকে একটি মাত্র ঘুঘুর ডাকে কত গভীর দুপুর হঠাৎ দেউলিয়া হয়ে গেল।

কার চোখ সে দেখেছিল! সে কি খুব অচেনা কেউ? নিজেকে এমনতরো উদ্বাস্তু তার আগে। কখনও মনে হয়নি। ছেলেবেলায় ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার শব্দ সে যেমন সবসময়ে খেয়াল করে শুনত না কিন্তু ঘর নির্জন হয়ে এলে কিংবা মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তার দম শেষ করে দেওয়ার অদ্ভুত একরোখা শব্দ শুনে চমকে উঠে ভেবেছে ‘আরে–ঘড়িটা! তাই না!’ তেমনি হঠাৎ নির্জন নিঃশব্দ হয়ে গিয়ে সে তার যন্ত্রণাকে টের পেল। বিষণ্ণতার ভিতর দিয়ে শিয়ালদা স্টেশনে এসে আটটা পঁয়তাল্লিশের ট্রেন ধরল মাখনলাল।

বৃষ্টি পড়ছে না। বাইরে জুন মাসের আকাশ ঘোলা হয়ে আছে। মেঘ না, তারা না-কিছুই দেখা যায় না। ট্রেনের জানলার হাওয়ায় মাথা রেখে চোখ চেয়ে ছিল মাখনলাল। ভেজা মাথা বুক ঠান্ডা বাতাসে চিড় খেয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের চাকা দ্রুত লাইন বদল করছিল। জং–ধরা লোহালক্কড়ের শব্দ, কাপলিং-এর শব্দ, স্প্রিং আর ঢিলেঢালা নাটবন্দুর শব্দ, অবিরাম তার শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসতে থাকে। উলটো মুখো ট্রেনের ভৌতিক জানলায় কার হাত সাপের মতন নড়ে যায়। কার চশমার কাছে বাইরের অন্ধকার নিসর্গের বিকৃত দোমড়ানো প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।

একটু রাতে তার শহরতলির ছোট্ট বাসায় ফিরল সে। দরজা খুলে দিতে-দিতে ললিতা অস্পষ্ট –যেন স্বপ্নের ভিতর থেকে কথা বলছিল। চকিতে মাখনলাল তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ওপাশের দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দূর সূর্যাস্তের দিকে বহমান তিনটে নৌকোর ছবি দেখতে পায়। মেঝের ওপর বুকু ঘুমোচ্ছে। অচেনা মিশ্র এক জনতার ভিতর থেকে এসে ঘরের দরজায় পা দিয়ে সে নিজেকে আলাদা অনুভব করছিল।

হাতমুখ ধুয়ে ঢাকা ভাত খেয়ে নিতে–নিতে আস্তে-আস্তে সে স্বাভাবিক বোধ করছিল। ললিতা খেতে বসলে দু-একটা কথা বলছিল মাখনলাল। তারপর কী বলছিল–ভুলে গেল।

খাটের ওপর আলাদা বিছানায় শুয়ে মাখনলাল দেখছিল ছোট্ট বিছানায় বুকুর পাশে শুয়ে পড়বার আগে ললিতা টর্চ জ্বেলে মশারির ভিতরে মশা খুঁজছে। মনে পড়ে কবে কোন ভিড়ের ট্রামে কিংবা বাস–এ কার হাতের চামড়ায় সবুজ উল্কিতে আঁকা একটা ন্যাংটো পরির ছবি দেখেছিল। পিঠে কাকের পাখার মতো দুটো পাখা লাগানো। বয়সে হাতটার চামড়া কুঁচকে এসেছিল–পরিটার শরীর হয়েছিল বেঢপ–এবড়ো–খেবড়ো–নাক–মুখ-চোখ কিছুই বোঝা যায় না। মনে হয়েছিল–হাতের ওপর পরিটার বয়স অনেক হয়ে গেল–তবু হাত ছেড়ে উড়ে যাওয়ার সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!

ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে মাখনলাল চোখ বুঝবার আগে ললিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল , ‘বুঝলে, ছুটি পেলে খুব দূরে কোথাও বেড়াতে যাব।’

অনেক রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল মাখনলালের। কিছুক্ষণ সে কোথায় কীভাবে আছে না বুঝে চেয়ে রইল। মাথার ভিতরে একটা স্কুটারের শব্দ ঘুরে-ঘুরে যায়। সে টের পেল তার হাত পা, মাথা–সব অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছড়ানো–চিৎ হয়ে শোয়া, দুটো হাত বুকের ওপর। কারা যেন। চোরাগলিতে পরিত্যক্ত নির্জনে একটা ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে রেখে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে গলিজোড়া সেই হাঁ–করা ম্যানহোলের দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ মাধ্যাকর্ষণের কোনও এক মুখ দিয়ে শূন্যতা এবং সময়হীনতার মধ্যে গড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু খুব বেঁচে গেছে মাখনলাল। ঠিক সময়ে ঘুম না ভাঙলে সেই গর্তে–অন্ধকারে–পূতিগন্ধে নগণ্য ইঁদুরের মতো মৃত্যু হত।

অস্থিরতা টের পেয়ে মাখনলাল উঠে বসল। লিত অচেনা গলায় ডাকল–’ললিতা!’ কেউ উত্তর দিল না। কারও জেগে থাকবার শব্দ তার শুনতে ইচ্ছে করছিল। বাইরে বৃষ্টিপাত থেমে গেছে। কিন্তু কোথায় যেন বৃষ্টির সঞ্চিত জল চুঁইয়ে কোনও শূন্য টিনের কৌটোর ওপর পড়ছিল। প্রতিটি ফোঁটার সেই ভারযুক্ত শব্দকে কে যেন তার উদ্দেশ্যে শব্দভেদী বাণের মতো নিক্ষেপ। করছিল।

অনেকক্ষণ ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানে এক অদ্ভুত নিশ্চেষ্টতার ভিতরে সে বসে রইল। বুকের বাঁ-পাশে একটা অস্পষ্ট ব্যথা ডাকটিকিটের মতো লেগে আছে। মনে হল স্বপ্নগুলো এখনও তার মাথা থেকে সম্পূর্ণ ভিতরে–ঢাকনা খুলে রাখা ম্যানহোলে টেনে নিয়ে যাবে। এক ঝলক নীল বিদ্যুতের আলোয় ঘরটা অস্পষ্টভাবে তার চোখের সামনে লাফিয়ে উঠেই মিলিয়ে গেল। যদি আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে? সঞ্চিত জলের সেই প্রতিটি ফোঁটার জ্যা–মুক্ত শব্দশূন্য টিনের ক্যান নির্জনতা তাকে অন্ধকারে স্বপ্নের ভিতরে ঠেলে দিচ্ছিল। সে টের পেল তার সারা শরীরের শাঁসওয়ালা ব্রণের মতো শিউরানো রোমকূপ খাড়া হয়ে আছে।

চৌকির পাশেই রাখা টুলের ওপর থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে অনেকটা জল খেল মাখনলাল। তারপর সিগারেট ধরাল। বৃষ্টির পর গুমোট গরমে ঘরটা কেঁপে আছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুক এখনও ভার। অস্পষ্টভাবে তার মনে হচ্ছিল, কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই ললিতাকে ডাকা উচিত। কিন্তু অতটা সময় পেল না মাখনলাল। ঘুম তটভুমি অতিক্রম করে তার জাগরণের ভিতরে আছড়ে পড়েছিল। কে যেন তাকে ধীরে টেনে নিচ্ছিল ঘুমে স্বপ্নের ভিতরে! স্কুটারের শব্দটা প্রচণ্ড বেগে তার মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে। চকিতে মাখনলালের মনে হয় কে যেন বরাবর তার আগে আগে হেঁটে এসেছে। ওজন যন্ত্রের ভিতর ঠিক টিকিটটা তার জন্যে সাজিয়ে রেখেছিল কে? অচেনা রেস্টুরেন্টে এক মুহূর্তের জন্য মুখোশ খুলে তার ভিতরের আগুন মাখনলালকে দেখতে দিয়েছিল কে? উত্তল কচের তির্যক বিম্বের মতো চকিতে বিদ্যুতের আলোয় ঘরটা আবার লাফিয়ে উঠলে মাখনলাল দেখতে পায়–সে। সাদা দেওয়ালের মতো বুক–সাদা দেওয়ালটাই। ঈশ্বরের বুকের মতো সাদা দেওয়ালটায় চকিতে আবার বিদ্যুৎ বিস্ফোরিত হলে সে-মাখনলাল–সেখানে নিখুঁত সুন্দর একটা বুলেটের ছ্যাঁদা দেখতে পায়। মুহূর্তেই যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে সাদা দেওয়াল অন্ধকার দিয়ে ক্ষতস্থান কামড়ে ধরল।

সিগারেটটা কোথায় ফেলল মাখনলাল! কোথায়…? সে প্রাণপণে উঠে বসবার জন্য চেষ্টা করতে করতে ললিতাকে ডাকতে চাইল। চেষ্টা করে দেখল মাখনলাল–ওঠা যায় না। পিয়ানোর রিড টিপে কে যেন মুহুর্মুহু বিদ্যুতের আলো ফেলছে। সে হাত বাড়িয়ে খুঁজছিল–সিগারেটটা। এই ঘরেই কোথায় কোন অন্ধকার কোণে সেটা পড়ে আছে…জ্বলছেও, তার পোড়ো গন্ধ আগুনের তাপ সে অনুভব করল। সে নিশ্চিত বুঝল–কোথাও জড়ো করে রাখা কাপড়–চোপড়ে, কাঠের টেবিলের পায়ার সঙ্গে লেগে, কিংবা বিছানায় কারও অসতর্ক চুলের ভিতরে সিগারেটটা নির্দয় জ্বলছে।

‘কেন এভাবে! কেন!’ মাখনলাল প্রশ্ন করে। মনে হয় বহুকাল ধরে একটা অন্ধকার ঘরের ভিতরে কোথায় একটা সিগারেট জ্বলছে–সে খুঁজছে। খুঁজছে। সিগারেটটা আছে কোথাও-তার জ্বলা সে টের পাচ্ছিল। প্রাণপণে উঠবার, কাউকে ডাকবার জন্য সঙ্গে ছটফট করছিল।

রাতের প্রথম কুকুরটা ডেকে উঠতেই আস্তে-আস্তে হাল ছেড়ে দিল মাখনলাল। বুঝতে পারল –সে মারা যাচ্ছে। ইঁদুর আরশোলার মতো তুচ্ছভাবে। কাল ক্ষতস্থান থেকে দু-ফোঁটা রক্ত দু চোখে গড়িয়ে পড়লে ওজন যন্ত্রটা ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত বাড়িয়ে তার হাতে একটা টিকিট তুলে দেয়। মাখনলাল কিছুই দেখতে পায় না। নিশ্চিত শেষ স্বপ্নের ঢেউটা এসে পড়লে সে চকিতে শুনতে পায় ললিতা তাকে ডাকছে।

কিন্তু তখন তটভূমি ছেড়ে দিয়ে ঢেউয়ে দুলে–দুলে যাওয়ার মতো মাঝ সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছিল মাখনলাল।

1 Comment
Collapse Comments

অসাধারণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *