৬০
সামি আর হৃদি রোমেলাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর অমৃতার মনে হলো এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কাজ নেই। সিএনজি বা বাসে করে বাড়ি ফিরে গেলেই হয়। টিপটিপ বৃষ্টিটা আবারও ঝরতে শুরু করেছে। যেকোনো সময় ঝেঁপে নামবে। মাথার চুল কিছুটা ভিজে গিয়েছে এর মাঝেই। শীত শীত ভাব হচ্ছে। বেরোবার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে লাইব্রেরি ঘরের দিকে তাকালো সে। দেখল গোল বারান্দাটা অন্ধকারে ঢাকা। একটা লম্বা ছায়ামূর্তি সিমেন্ট বাঁধানো রেলিং-এর সামনে স্থিরচিত্র হয়ে আছে। বারান্দার পাশে মেঘভেজা সন্ধ্যাবেলার সমস্ত বিষণ্ণতা গায়ে মেখে একলা দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছটা। বৃষ্টি-বৃষ্টি মাতাল বাতাসে নড়ছে গাছের ডাল। পোর্চে জ্বলতে থাকা হলুদ আলোর একটা অংশ অমৃতার গায়ে এসে পড়েছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখ সে অন্ধকারে ঠিকঠাক দেখতে না পেলেও সেই মানুষটা তাকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছিল। অমৃতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একবার ভাবল গিয়ে কথা বলে। পরমুহূর্তেই ক্ষণিক আগের অবজ্ঞাসূচক ব্যবহারের কথা মনে পড়ল। অভিমানের বাষ্পে আটকে গেলো শ্বাস। অমৃতাকে তিল পরিমাণ সম্মানও দিল না লোকটা। ছেলের সামনে কেমন খোলস পাল্টে অন্য মানুষ হয়ে গেল। কাপুরুষ আর কাকে বলে!
রাশেদ একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। অমৃতা এখনো গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো পকেটে রাখা। চেয়ে আছে এদিকেই। অন্ধকারে কী দেখছে কে জানে! সামি বেরিয়ে এল বাড়ির ভেতর থেকে। কী যেন কথা বলল দুজনে নিচু স্বরে। রাশেদ দেখলেন সামি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। অমৃতা হেঁটে এসে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলল। রাশেদ সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেলেন। হঠাৎ করেই শরীরের সমস্ত স্পন্দন মৃত মানুষের মতো থেমে এল এক মুহূর্তের জন্য। অমৃতা গাড়িতে উঠে বসল। রাশেদ চেয়ে রইলেন। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়িটা এগিয়ে গেলো ড্রাইভওয়ে ধরে মসৃণ গতিতে। রাশেদ চেয়ে চেয়ে দেখলেন। ঝুম বৃষ্টি নামল। দমকা বাতাসে সিগারেটের আগুন গেলো নিভে। গাড়িটা গেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার পর কণ্টকিত একটা দীর্ঘশ্বাস রাশেদের শ্বাসনালীর রক্তাক্ত দেয়াল বেয়ে ছেঁচড়ে নেমে এলো। বুকে বুলেট এসে লাগার দিনটির মতো আরো একবার তিনি মৃত্যুর লোনা স্বাদ টের পেলেন। বেঁচে থেকেও কত টুকরো টুকরো মৃত্যুর মুখোমুখি যে হতে হয় মানুষকে!
বৃষ্টির ছাঁট বারান্দার মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রবল বর্ষণের উন্মাদ আস্ফালনে কান বধির হয়ে যাবার উপক্রম। একজন বিক্ষিপ্তচিত্ত একলা, অন্ধকার মানুষ ঝুম বৃষ্টি সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। দুর্মোচ্য কষ্টের চূড়ান্ত উৎপীড়ন তার পাঁজর আঁকড়ে ধরেছে বিষাক্ত কীটের মতো। বাতাসে অবিরাম ফোঁসফোঁস শব্দ, যেন অশরীরীর অভিশপ্ত কান্না। বিদ্যুৎ চমকে ঝলসে উঠল আকাশ। ট্রান্সফরমার জ্বলে যাবার প্রকট একটা শব্দ হলো। পাড়ার কিছু মানুষ হইচই করে উঠল অযথা। চারপাশে ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। চারিদিকে এখন শুধুই বৃষ্টির সাদা জাল। শোঁ-শোঁ বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকে যাচ্ছে ফুসফুসে। হঠাৎ পদশব্দ কানে এসে লাগল। মনে হলো কাদাজলে ছপছপ পা ফেলে কেউ এগিয়ে আসছে। রাশেদ থমকানো বক্ষ নিয়ে দেখলেন একটা ছিপছিপে ছায়ামূর্তি বারান্দার সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় আকাশজুড়ে নীল বিদ্যুৎ চমকে উঠল। অতর্কিতে ছায়ামূর্তির মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের সামনে। পরমুহূর্তেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। রাশেদ বুঝতে পারছেন না অমৃতা কি এখানে সত্যিই এসেছে নাকি তার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে? তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করলেন। আগুন একটু জ্বলে উঠেই বাতাসের দাপটে নিভে গেল আবার। ততক্ষণে অবশ্য জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে যুক্ত হয়েছে জেনারেটর মটরের যান্ত্রিক শব্দ। ছায়ামূর্তিটা সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠে এসেছে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ রাশেদের মনে হলো… অমৃতাকে ফিরে আসতেই হতো। সে ফিরে না এলে কোথাও বুঝি একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেত। বাকি জীবনে যে ক্ষতিটা সামাল দিয়ে ওঠা আর সম্ভব হতো না।
‘ভিজে গেছ। ভেতরে এসো।’ কথাটা বলতে বলতে রাশেদ ক্ষিপ্র পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে ঢুকলেন ভেতরে। বাতি জ্বালালেন। অমৃতা কর্দমাক্ত জুতো জোড়া দরজার বাইরে খুলে রেখে খালি পায়ে ভেতরে ঢুকল। ভেজা শরীর থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। পরনের টি-শার্ট মিশে গেছে গায়ের সাথে। টেবিল সংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারের পিঠে একটা তোয়ালে রাখা ছিল। রাশেদ তড়িঘড়ি করে তোয়ালেটা তুলে এনে অমৃতার দিকে এগিয়ে দিলেন। এরপর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে বললেন, ‘সামি কোথায়?’
‘একটু পর ফিরবে বলল। গাড়িতে তেল ভরবে খুব সম্ভবত।’
‘তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে এলে কেন? ওর সাথে এলেই তো পারতে।’
‘মনে হচ্ছিল একটা কথা আপনাকে এখুনি বলতে হবে। দেরি সহ্য হচ্ছিল না।’
রাশেদ রিভলভিং চেয়ারে এসে বসলেন। অমৃতার পুতুল পুতুল চোখের পাপড়িতে বৃষ্টির জলের ফোঁটা জমে আছে এখনো। কাঁপছে তিরতির করে। কপালের ক্ষতটা বড় বেশি প্রকাশ্য! তবুও রূপের কোনো কমতি নেই ঐ মুখে। রাশেদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া অমৃতার কপাল, নাক, ঠোঁট পেরিয়ে কণ্ঠাস্থির শৈল্পিক খাঁজের ছোট্ট তিলটায় গিয়ে আটকে গিয়েছিল। তিনি নিঃশ্বাসে মৃদু কম্পন টের পেলেন। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে হঠাৎ অমৃতার হাত থমকালো ক্ষণিকের জন্য। কেঁপে উঠল বুক। মাত্র কয়েক হাত দূরেই বসে আছে মানুষটা। গালে হাত রেখে গভীর অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। প্রাজ্ঞ দুটি চোখ, কাটা কাটা নাক মুখ, ছিপছিপে ধারালো চোয়াল আর ব্যক্তিত্বের টানটান কাঠিন্য… কী যে সুন্দর! অমৃতার হাতে পায়ে ভালোলাগার ঝিঁঝিঁ ধরে গেল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল সে। ফর্সা গালে পড়ল রক্তের আভাস। আড়ষ্ট হয়ে এল শরীর। ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে দিয়ে সেই চেয়ারটাই টেনে নিয়ে বসল। আস্তে করে চোখের বৃষ্টি জলভরা ঘন পাপড়ি তুলে দেখল সামনে। চেয়ে আছে এখনো…পলকহীন চোখে!
‘এখন এত কী দেখছেন? ছেলের সামনে তো চিনতেই পারলেন না!’ রাশেদ এ প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন না। ঠোঁট টিপে ভাবলেন কিছু একটা। তারপর গম্ভীর সুরে বললেন,
‘সন্তানের মনরক্ষার জন্য কত কিছুই তো করতে হয় অমৃতা!’
‘সামিকে আপনি ভয় পান কেন? কাপুরুষ নাকি?’
রাশেদ তার ধারালো শ্রীময় মুখখানা ভরে চমৎকার হেসে বললেন, ‘এটা ভয় নয়। ভালোবাসা।’
অমৃতা চোখ সরিয়ে নেয় অন্য দিকে। বয়ঃসন্ধির কিশোরীর মতো অভিমান ঢেউ তোলে তার গলায়। রুদ্ধশ্বাসে বলে, ‘আপনি শুধু আপনার ছেলে, আপনার বউ, আপনার দেশের মানুষ… এদেরকেই ভালোবাসেন… আমাকে একটুও বাসেন না!’
রাশেদ একটু থমকে গেলেন। সেই ওষ্ঠ-টেপা, চিন্তিত ভঙ্গিটা ফিরে এল মুখে। গাল থেকে হাত নামিয়ে চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বসলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘তুমি কী বলতে এসেছিলে? জরুরি কিছু?’
‘বলব। আগে বলেন আপনি কেমন আছেন এখন? শরীর কেমন?’
‘আগের চেয়ে ভালো আছি। হাঁটাচলায় সমস্যা হচ্ছে না।’
‘স্বস্তি পেলাম।’
‘লন্ডন কতদিনের জন্য যাচ্ছ?’
‘দুই বছরের কোর্স।
‘মাস্টার্স?’
‘জি।’
‘কোন স্কুল?’
‘ক্যাম্ব্রিজ।’
‘বাহ… খুব ভালো!
একথার পর দুজনেই একটু চুপ করে রইল। রাশেদ পিঠটা আরো একটু হেলিয়ে দিলেন চেয়ারের গায়ে। ডান হাত প্রসারিত করে একটা পেপার ওয়েট নাড়াচাড়া করতে লাগলেন অন্যমনস্কভাবে। অমৃতা বলল,
‘আপনার মনে আছে আমি আপনাকে বলেছিলাম, যে আমি বিশ্বাস করি আমার বন্ধু আমাকে একদিন বুঝবে?’
পলক তুলে তাকালেন রাশেদ। স্থির গলায় বললেন, ‘মনে আছে।’ অমৃতা হাসল, ‘আমার ধারণা সঠিক ছিল। আজ আমি আপনার সামনে বসে আছি। এই ঘটনা সামি জানে। খুব সম্ভবত আপনার স্ত্রীও জানে। আজ আপনার সাথে আমার চুরি করে দেখা করতে হচ্ছে না। আর এই সাহস, এই অনুমতি আমাকে আমার বন্ধুই দিয়েছে।’
রাশেদের মুখে বিমর্ষতার ছায়াপাত ঘটল। চিন্তিত গলায় বললেন, ‘সামির এই ধরনের আচরণের পেছনে ব্যাখ্যাটা কী? সে কি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পেরেছে? তোমাকে ক্ষমা করেছে?’
‘ক্ষমা করেছে কী করেনি সে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। ক্ষমাটা এখানে মুখ্য নয়। মুখ্য হলো সত্যকে গ্রহণ করতে পারার সাহস সঞ্চয় করা। আমার মনে হয় প্রতিটি শিক্ষিত আধুনিক মানুষেরই উচিত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া।’
রাশেদ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। অমৃতা বলল, ‘যাই হোক… আজ একটা কারণে আমার মনটা খুব ভালো। আপনার সাথে শেষ দেখাটা অন্তত চুরি করে করতে হলো না। আমার বন্ধু বাইরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সে জানে আমি তার বাবার সাথে আছি। আমার অন্য বন্ধুরাও আমাকে… এই খারাপ, পাপী, নিকৃষ্ট আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। ভালোবেসেছে। আমার জীবনে অন্য কিছু থাক বা না থাক… আমার জীবনে সত্যিকারের কয়েকজন বন্ধু আছে!’
রাশেদ নিঃশব্দ হাসি হেসে বললেন, ‘জেনে খুশি হলাম।’
অমৃতা কিছু না বলে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে। তাকিয়ে রইলেন রাশেদও। অমৃতা একটা ঘন শ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনার আমাকে মনে থাকবে সব সময়?’
রাশেদ চোখ নামিয়ে নিলেন। আবেগ অনুভূতির প্রকাশ তার অভ্যাসে নেই। তিনি অন্তর্মুখী, বৈষয়িক এবং বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া তার কাছে পাপের সমতুল্য। কিন্তু এই মেয়েটির অপাপবিদ্ধ মুখশ্রী দেখলে, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে। এটা বড় ধরনের দুর্বলতা। তিনি ভেতরকার দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মনে থাকা না-থাকায় কিছু এসে যায় না অমৃতা। এসব নিয়ে আর ভেবো না। তুমি ভীষণ ব্রাইট একটা মেয়ে। আমি বিশ্বাস করি তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। সামনে এগিয়ে যাও। অনেক দূর যেতে হবে তোমাকে।’
অমৃতা করুণ হেসে বলল, ‘ভবিষ্যতে আর কোনোদিন আপনার সাথে আমার দেখা হবে না, কথা হবে না। এটা সুনিশ্চিতভাবে জানার পর আমার কাছে সেই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল লাগার কোনো কারণ নেই।’
রাশেদ উদ্বেগ চাপা দেয়ার চেষ্টা করে কণ্ঠস্বরে স্থিরতা বজায় রেখে বললেন, ‘এভাবে ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি বেঁচে থাকি… হয়ত সামনে আবারও দেখা হবে। তুমি পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসো। ততদিনে তোমার মন পরিবর্তন হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
এবার একটা কান্নার স্রোত যেন বহুদূর থেকে তীব্রবেগে তেড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে গেল অমৃতার বুকে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্নার ঢোঁক গিলে বলল, ‘আপনার সাথে আর কোনোদিন আমার দেখা হবে না। সামিকে কথা দিয়েছি!’
রাশেদের চোখে উৎকণ্ঠা ঝিলিক দিয়ে উঠল। কপালে পড়ল গাঢ় কুঞ্চন।
‘কথা দিয়েছ মানে? ঠিক বুঝলাম না।’
অমৃতা একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ও আমাকে দুটা অপশন দিয়েছিল। এক নম্বর অপশন…’ অস্বস্তিতে কণ্ঠস্বর প্রায় বুজে এল অমৃতার। একবার তাকালো রাশেদের দিকে। সংকোচের অত্যাচারে কেঁপে উঠল ঠোঁট, কাঁপল ফর্সা গালের নীল শিরা। চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে সে বলল, ‘এক নম্বর অপশন ছিল বিয়ে করা, দুই নম্বর অপশন ছিল চিরতরে ছেড়ে যাওয়া…’
রাশেদ বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘বিয়ে করা মানে?’
অমৃতা তাকাল। জল টলমল চোখ নিয়ে বলল, ‘আপনার ছেলে জানতে চেয়েছিল, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই কি না।’
রাশেদ ভীষণ চমকে গেলেন। কুণ্ঠিতভাবে সরিয়ে নিলেন চোখ। কানের ডগায় লালচে রেশ পড়ল। অস্ফুটে বললেন, ‘দিস ইজ অ্যাবসার্ড!
‘কোনটা অ্যাবসার্ড?’
‘এইযে… বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনা।’ লজ্জিতভাবে বললেন রাশেদ। অমৃতার বুকটা মুচড়ে উঠল কষ্ট, অপমান এবং গ্লানিতে। সে চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
‘হ্যাঁ সেটাই… এজন্যেই আমি দ্বিতীয় অপশনটা বেছে নিয়েছি।’
রাশেদ চোখ তুলে তাকালেন না এবারেও। নিচু হয়ে থাকা মুখে খেলছে যন্ত্রণার সুস্পষ্ট চিহ্ন। অমৃতা বলল, ‘আসি তাহলে।’
‘এসো।’
অমৃতার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে। পঞ্জরাস্থি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। সে চট করে ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল দরজার কাছে। সে মুহূর্তে রাশেদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অতর্কিতে। কোনো এক অদৃশ্য প্রকাণ্ড শক্তি যেন ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিল তাকে। অমৃতা দরজার সামনে পৌঁছে গেছে তখন। রাশেদ আচমকা ওর বাহু খামচে ধরে টেনে আনলেন নিজের কাছে। অমৃতা ওই হৃষ্ট-পুষ্ট মেদবর্জিত বলিষ্ঠ বক্ষে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। রাশেদ অমৃতার কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠা পিঠের ওপর একটা হাত রেখে বললেন, ‘কেঁদো না। তোমাকে শক্ত হতে হবে।
অমৃতা কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘এতদিন রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হতো আজ হয়ত আপনার সাথে দেখা হবে। ভুল করে, ভুল পথে, হুট করে হয়ত আপনার মুখোমুখি পড়ে যাব। এই আশাটুকু নিয়েই বেঁচে ছিলাম। এখন কী হবে রাশেদ? কীভাবে থাকব?
রাশেদ অমৃতাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছে। মুখের ভাঁজে ভাঁজে কষ্টের আঁকিবুকি। ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘স্মোক করো না আর কেমন? বদঅভ্যাসটা ছেড়ে দাও।’
অমৃতা ফোলা ফোলা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল ‘আপনি তো ছাড়বেন না। আমাকে কেন ছাড়তে হবে? আমি একজন মেয়ে… শুধুমাত্র এই কারণে?
‘স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বস্তু ত্যাগ করাই উচিত, তাই না? তাছাড়া… তুমি রাস্তাঘাটে একগাদা ছেলেপুলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে স্মোক করছ, এই দৃশ্যটা ভাবতে আমার কখনই ভালো লাগে না।
রাশেদের কুঁচকে যাওয়া পাঞ্জাবির গলা হাত দিয়ে টেনেটুনে ঠিক করতে করতে অমৃতা লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলল ‘আচ্ছা।’
‘মনে থাকবে তো?’
‘থাকবে।’
‘আর হ্যাঁ… আগেও বলেছি। আবারও বলছি। একজন পার্টনার খুঁজে নিও।’
‘পার্টনার কী জন্যে?’
‘একা একা বেঁচে থাকা যায় নাকি?’
‘আমাকে তো একাই বাঁচতে হবে। এটাই আমার নিয়তি।’
‘জিদ করো না অমৃতা। আমি মরে যাবার আগে শুনে যেতে চাই যে তুমি বিয়ে করেছ। সুখে আছ।’
অমৃতা ফ্যাকাশে হাসল,
‘আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি… আমার সবকিছু শুধু একজনেরই জন্য। কিন্তু সেই একজন কখনো আমাকে পেতে চায়নি!’
‘তোমার ধারণা ভুল।
অমৃতা মুখ তুলে চাইল। জলভর্তি চোখ নিয়ে আকুল কণ্ঠে বলল, ‘আপনার কখনো ইচ্ছে করেছে আমার সাথে বাঁচতে?’
রাশেদ অমৃতার দিকে আবিষ্ট চোখে তাকালেন। বড় একটা কম্পিত শ্বাস ফেলতে ফেলতে দেখলেন ওর পুতুল পুতুল ভেজা চোখ… দেখলেন চন্দন রঙের মসৃণ গালে অশ্রুবিন্দুর ঝিকিমিকি… দেখলেন গোলাপি পাতলা ঠোঁটের তিরতিরে কম্পন আর কপালের দগদগে ক্ষত। তারপর ঠোঁট দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলেন ক্ষতটা। ওই স্পর্শে কেমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল অমৃতা। রক্ত চনমন করে উঠল। বিবশ গলায় বলল, ‘আমরা বরং কোথাও চলে যাই…’ রাশেদ ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে একটা গভীর চুমু খেয়ে বললেন,
‘তোমার বন্ধুকে করা প্রমিজ তুমি ব্রেক করতে পারবে অমৃতা?
অমৃতা থমকে গেলো। বিবর্ণ হয়ে উঠল মুখখানা। মনে পড়ল বাইরে সামি অপেক্ষা করছে। বন্ধুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসে টলমল করছে তার বুক! অমৃতা ম্লান চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল রাশেদের দিকে। তারপর একটা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘নাহ… সামি আমাকে বিশ্বাস করেছে। আমি ওর বিশ্বাস ভাঙব না কোনোদিন।’
‘আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, তুমি তোমার বন্ধুর বিশ্বাস কখনো ভঙ্গ করবে না।’
অমৃতা প্রগাঢ় স্বরে বলল ‘কিন্তু রাশেদ… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে… এভাবে বেঁচে থাকতে পারব?’
‘আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার পরেও আরো অনেকদিন তুমি বাঁচবে অমৃতা। তোমাকে বাঁচতে হবে।’
‘আপনাকেও অনেক দিন বাঁচতে হবে।’
‘মৃত্যুর আগে আমি একটা সুখবর শুনে যেতে চাই! ভীষণভাবে চাই!’
‘কী সেটা?’
‘শুনতে চাই তুমি বিয়ে করেছ। সংসার করছ। একবার বলেছিলে তোমার মেয়ে হলে নাম রাখবে রিমঝিম। আমি চাই রিমঝিম পৃথিবীতে আসুক।’
অমৃতা রাশেদের টানটান ধারঅলা চোয়ালে একটা হাত রেখে করুণ গলায় বলল, ‘আপনি দেবেন আমাকে? একটা রিমঝিম?’
রাশেদের মুখে হঠাৎ অতলান্ত স্তব্ধতা নেমে এলো। রুদ্ধশ্বাসে কয়েক নিমেষ চেয়ে রইলেন তিনি অমৃতার সকরুণ ব্যাকুল মুখখানার দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘এটা সম্ভব না!’
অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছাড়ল অমৃতা। ভাঙা গলায় বলল, ‘ঠিকই বলেছেন… এটা সম্ভব না… সম্ভব না কারণ… কারণ সামি আপনার ছেলে… কারণ সামি আমার বন্ধু… সম্ভব না কারণ, আমি আমার বন্ধুত্বকে বেছে নিয়েছি… আপনাকে নয়!’
একটু থামল অমৃতা। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে রাশেদের ঠোঁটে একটা নিবিড় চুমু খেল। ধীর গলায় বলল, ‘আরো অনেক কথা বলার ছিল… সময় নেই… সময় হবেও না কখনও! ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।’ অমৃতা আর দাঁড়াল না। দরজা খুলে দেখল বিশ পঁচিশ গজ দূরে বাড়ির সামনে হলদে আলোর নিচে সামি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। অমৃতার হাত পা নিঃসাড়। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। দম নিতেও কষ্ট! সেই সময় রাশেদ বারান্দার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ডেকে উঠলেন ব্যগ্রভাবে, ‘অমৃতা!’
অমৃতা ঘুরে দাঁড়াল। রাশেদ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে শেষবারের মতো। তারপর ওর চোখে চেয়ে মুখে একটা বিবর্ণ হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘আমারও তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল পুতুল! কখনো বলিনি কারণ, ইমশোনাল কথাবার্তা যথাযথভাবে প্রকাশ করার কৌশলটা আমার জানা নেই। তুমি আমার মনে দাগ কেটেছিলে সেই প্রথম দিন থেকে। উদ্ধত, উশৃঙ্খল একটা মেয়ে যেদিন হুট করে আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ে আমাকে সবার সামনে অপদস্থ করে তুলেছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম এই মেয়েটা অন্য কারো মতো নয়!’
‘আপনার আমাকে মনে থাকবে রাশেদ?’
‘তোমাকে আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে মনে থাকে অমৃতা!… মনে থাকবে সবসময়!’ অমৃতা রাশেদের একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘ভালোবাসি আপনাকে!’
রাশেদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিলেন, ‘ভালোবাসতে চাইনি বিশ্বাস করো… কখনো চাইনি… কিন্তু ভালোবাসা আমাকে বাধ্য করেছে… তোমাকে ভালোবাসতে!’
.
ঘরের ভেতরে জ্বলতে থাকা আলোর রেশ এসে পড়েছিল বারান্দায়। পঁচিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সামি দৃশ্যটা দেখেছিল কি না কে জানে, তবে সে একটু বিচলিতভাবে সরে পড়েছিল অন্যদিকে। মিনিট দুয়েক বাদেই দেখতে পেল ওদেরকে। আবছায়া আলোয় দুজনে পাশাপাশি হেঁটে আসছে। রাশেদ সামিকে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দেবে?’
সামি একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘সাবধানে যেও।’ হালকা গাম্ভীর্যের সুরে বললেন রাশেদ।
সামি এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল অমৃতার জন্য। অমৃতা একবার তাকালো রাশেদের দিকে। রাশেদ ওর মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, ‘ভালো থেকো।’
অমৃতার মনে হচ্ছিল বুকটা কেউ তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে। গাড়িতে উঠে মুখ চেপে ধরে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল সে। সামি পাশে এসে বসল। একটা হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে অপর হাত বাড়িয়ে অমৃতার হাত ধরল। কোমল গলায় বলল… ‘ইটস ওকে দোস্ত… ইউ উইল বি ফাইন! এভ্রিথিং উইল বি ফাইন… টেক অ্যা ডিপ ব্রেথ!
গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল। অমৃতা ব্যাক মিররে চোখ রেখে শতছিন্ন অশ্রুর পর্দা ভেদ করে দেখতে পেল, আবছা আলো-আঁধারিতে অবসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ! ধীরেধীরে মুখটা দৃষ্টির সীমানা থেকে মুছে গেলো! বুক মথিত করা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল অমৃতার শ্বাসনালী থেকে
ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘সামি! তোর বাবাকে দেখিস! কষ্ট দিস না কখনো। তার ওপর রাগ পুষে রাখিস না। আমি তাকে ভালোবাসি। এটা আমার দোষ! তার কোনো দোষ নাই। এই কথাটা মনে রাখিস সবসময়।’ সামি কিছু বলল না। চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। অমৃতাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সামির মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে উঠল। প্রাচীন পৃথিবীর সমস্ত বিরহ, বিভেদ, অপ্রাপ্তি যেন তীব্র শীতের গাঢ় জরাগ্রস্ত কুয়াশার মতো চারদিক থেকে ছেঁকে ধরল ওকে। বুক ভার হয়ে উঠল বাবার জন্য, মায়ের জন্য, অমৃতার জন্য… এমনকি নিজের জন্যও!
৬১
রক্ত দিয়ে শপথ করেছিল ওরা। শপথ করেছিল আজীবন পাশাপাশি থাকবে। বিভা, হৃদি আর অমৃতা। সেই ওয়াদা ভঙ্গ করে বিভা চলে গিয়েছিল ইন্ডিয়া, আজ অমৃতা চলে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। কৈশোর এবং তারুণ্যের রং-গন্ধভরা পুরনো সেই শহরে হৃদি তার উড়ুউড়ু উদাসী বন্ধুপাগল মনটা নিয়ে পড়ে রইল একলা!
বিমান বন্দরে বন্ধুরা এসেছে অমৃতাকে বিদায় দিতে। তখন সন্ধ্যা। ডিপার্চার টার্মিনালের সামনে বুকচাপা ভিড়। ওরা ছয়জন হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যেকের চোখের নিচে গভীর মেঘের ছায়া। কষ্ট দানা বেঁধেছে মুখে। কেউ কোনো কথা বলছিল না। শূন্যতা সর্বস্ব খাঁ-খাঁ করা এক ঘাতক অনুভূতি ওদের চলন বলন শক্তি কেড়ে নিয়েছে। অমৃতাকে যেতে হবে। চেকইন হয়ে গেছে অনেক আগেই। এবার ইমিগ্রেশন আর সিকিউরিটি পার হবার পালা। কথা বলাটা খুব মুশকিলের ব্যাপার এখন। মুখ খুললেই চোরা কান্না ঝাপটা মেরে বেরিয়ে আসবে। তবুও কিছু বলতে হবে। কিছু একটা বলা চাই। অমৃতা বড় একটা শ্বাস টেনে নিল। জলের আভাস ছোঁয়া অস্থির চোখে বন্ধুদের সবার মুখের দিকে তাকাল একবার। কান্নার ঢোক গিলে বলল, ‘শোন তোরা… চলে যাচ্ছি… কিন্তু ছেড়ে যাচ্ছি না। বুকের ভিতরে করে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের স্বপ্নের বৃষ্টিমহল। ওখানে দেখা হবে রোজ!’
কথাটা বলে অমৃতা একটু হাসার চেষ্টা করল। ধূসর মেঘ ভেদ করে উঁকি দেয়া সূর্যের পাতলা আলোর মতো করুণ সেই হাসি। বিভা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। জড়িয়ে ধরল একে একে সব বন্ধুরা। তারপর কারো দিকে আর একবারও না তাকিয়ে অমৃতা তার ছিন্ন-ভিন্ন রিক্ত অন্তর নিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলো গেটের ভেতরে। পাঁচ বন্ধু নিঝুম নির্বাক দৃষ্টিতে অমৃতার ছিপছিপে শরীরটাকে সন্ধ্যার বাদামি আলো থেকে বিমান বন্দরের চোখ ধাঁধানো সাদা আলোর মাঝে মিলিয়ে যেতে দেখল।
আকাশে রূপালি একটা চাঁদ জেগে আছে। বিমানবন্দরের তুমুল কোলাহল এবং হৈচৈয়ের মাঝে ওরা কজন অন্ধকার অন্তরীক্ষের ওই নিঃসঙ্গ চাঁদটার মতোই ছমছম একাকিত্ব গায়ে মেখে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যার বাদামি আলো কুলকুল করে ছেয়ে যায় প্রগাঢ়, ঘনীভূত, বিষণ্ণ এক অন্ধকারে। জোছনায় ভিজে ভিজে ধীরপায়ে ওরা এগোতে থাকে পার্কিং লটের দিকে। বিচ্ছেদের জমাটবাঁধা বেদনায় বুক ভার হয়ে থাকে। পরশু দিন আরো একবার আসতে হবে এখানে। রুদ্রকে বিদায় দিতে 1 যেতে নাহি দেব… হায় তবু যেতে দিতে হয়! প্রকৃতির এই অলঙ্ঘনীয় সত্য দিন শেষে সকলকেই মেনে নিতে হয়। সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায় জীবনের গতিপথ। একই গণ্ডিতে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোকে বেছে নিতে হয় ভিন্ন ভিন্ন সব গন্তব্য। বিচিত্র ভবিষ্যৎ হাতছানি দেয়। ধীরে ধীরে ছেলেবেলার বন্ধুরা হারিয়ে যেতে থাকে আটপৌরে জীবনের নানা টানাপোড়েনের মাঝে। তবুও কিছু বন্ধুপাগল মানুষের বুকের মাঝে আজীবন টিকে থাকে… একটি করে স্বপ্নের বৃষ্টিমহল!
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী
চলিতেছি যতদূর শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
যেতে আমি দিব না তোমায়
যেতে নাহি দিব হায় তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যায়…
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সমাপ্ত
কাঁচ ভাঙার এত কষ্ট হয় কেন! স্বপ্নের বৃষ্টি মহল ভেঙে গেলে সত্যিই বুকের ভিতর কাঁচ ভাঙার বেদনা অনুভব করছি। এত কষ্ট কি নিদারুণ ব্যথা বুকে শয়ে আছি। গত তিনদিন যাবত বৃষ্টিমহল পড়ে শেষ করেছি। এই তিনটে দিন যেন এই পৃথিবীর মানুষ ছিলাম না আমি। চোখের সামনে সব কিছুই জীবন তো তবু মনটা যেন কোথায় একটা আটকে আছে। পরে বুঝলাম মনটা আমার বৃষ্টি মহলে আটকে গেছে। বৃষ্টি মহলের ওই ছয় বন্ধুর মাঝে। তারা কি নিদারুণভাবে আমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে তাদের বন্ধনী কিছুতেই ছাড়তে চায় না। তাই আমিও তাদের ছেড়ে যাওয়ার অবকাশ পাইনি। সবকিছু হয়তো সুখকর হয় না বা শেষের মধ্যেও এক রকমের সুখ থাকে সয়ে যাওয়ার সুখ। হয়তো বৃষ্টি মহলের যাত্রা এখানেই শেষ লেখকের হাত ধরে। তবু বুকের ভেতর প্রতিনিয়ত গড়ে উঠবে আরেক বৃষ্টি মহল। সেই বৃষ্টি হলে ছয়টা প্রকোষ্ঠ। ছয় বন্ধুর জায়গা। সেখানে কোন সমাজে আসে না, কোন বাধা আসে না, কোন সম্পর্ক আসে না। না আসে কোন বিবেক। সেটা শুধুই স্বপ্নের বৃষ্টি মহল তাদের বড় একান্তের। সেখানে স্বপ্ন দেখা দোষের নয়। তাই সেখানে সমাজ পেরিয়ে সব চিন্তা পেরিয়ে অমৃতা আর তার ভালোবাসার মানুষ রাশেদ সুখে থাকুক।