৪৫
উত্তপ্ত বিকেল। জানালার ধারঘেঁষা আমলকি গাছের ডালে ডালে পিছলে বেড়াচ্ছে তেজি রোদ। পাঁচটার সময় রুদ্রর জিইসি মোড়ে এক বন্ধুর বাসায় যাবার কথা ছিল। জানালার বাইরের ঝলসানো বিকেল দেখে এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এর চেয়ে নিজের বাসায় এসির বাতাসে বসে থাকাই উত্তম। একটু আগে কাজের মেয়েটা ট্রেতে করে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এসেছে। সাথে ফ্রন্ট কেকের মতো দেখতে নারকেল দেয়া তালের পিঠা। রুদ্রর প্রিয় খাবার। চায়ে ডুবিয়ে তালের পিঠা… আহা! অমৃত!
অমৃতও মাঝে মাঝে বিষের চেয়ে ভয়ংকর লাগে। এই যেমন এখন লাগছে। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে রুদ্র হাতে ধরা পিঠার টুকরার দিকে চেয়ে আছে। এত বিশ্রী স্বাদ কেন জিনিসটার? মনে হচ্ছে পিঠা না, ইট চিবিয়ে খাচ্ছে। বিয়ের শপিং করতে গেছে… আচ্ছা… বেশ ভালো কথা… এতে রুদ্রর সমস্যা কী? কেন সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে অসহ্য রাগে? যেন একটা বিষাক্ত পোকা মাথার ভেতর কুটকুট করে কামড় দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। রোমকূপ জ্বলছে। অবাধ্য মনকে কিছুতেই বশে আনা যাচ্ছে না। অসহায় লাগছে!
রুদ্র চায়ের ট্রে ঠেলে রাখল দূরে। বিছানার ওপর থেকে হাতে তুলে নিল অ্যান্ড্রয়েড ফোন। অস্থির অবিন্যস্ত আঙুল চেপে অযথাই ডায়াল লিস্ট চেক করল। ইন্সটাগ্রাম খুলে স্ক্রল করল উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। হাত থেকে নামিয়ে রাখল ফোন। কিছুক্ষণ পায়চারি করল ঘরের মধ্যে। ট্রেডমিলে দৌড়ালো। আবার ফিরে এসে সেলফোনটা তুলে নিল হাতে। চঞ্চল চোখজোড়া নিবদ্ধ করল ফোনের স্ক্রিনে। রেখে দিল। ডান কব্জিতে বেঁধে রাখা রাবার ব্যান্ড খুলে নিয়ে বাবরি চুলে ঝুঁটি বাঁধল। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল সমস্ত চিন্তা। কী মনে করে যেন চারপাশে সাবধানে দৃষ্টি ফেলতে লাগল। যেন কেউ একজন লুকিয়ে আছে ঘরের ভেতর। ওর তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে লুকোনো চোরটাকে কী করে হাতেনাতে ধরা যায় সেই ফন্দি আঁটছে মনে মনে। জানালার পর্দা টানা। প্রখর রোদের খরতাপ লালচে পর্দার ভেতর দিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে। পর্দার মতো রোদের রংও এখন লাল। দেয়াল ঘড়িটা টিকটিক করে সময়ের হিসেব কষে যাচ্ছে। ঘড়ির পাশে একটি পারিবারিক ফটো টাঙানো। পেট মোটা এক মস্ত টিকটিকি ছবির প্রান্ত ঘেঁষে দেয়াল বেয়ে হাঁটছে। বুকশেলফে থরে থরে সাজানো আছে বই। শেলফের পাশে আলনা। তাতে এলোমেলো কয়েকটা কাপড়। রাস্তায় একটা ফেরিওয়ালা হাঁক ছেড়ে ডাকছে। চড়ুই কিচিরমিচির করছে জানালার কার্নিশে। হঠাৎ হঠাৎ ছুটে আসছে গাড়ির হর্ন। রুদ্র বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ রাখল সিলিং-এ। পর্দার ছায়া মেশানো লালচে রঙের রহস্যময় রোদ খেলছে ছাদে। সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে বিশ্ৰী শব্দ তুলে। সেই রহস্যময় অনুভূতিটা অনবরত ছোবল কেটে যাচ্ছে বুকে। মনে হচ্ছে কেউ একজন দেখছে ওকে। গভীর একাগ্র দৃষ্টিতে! উঠে পড়ল। কিছু করার না পেয়ে কয়েকবার বুকডন দিল মেঝেতে উপুড় হয়ে। পড়ার টেবিল সংলগ্ন চেয়ারে অযথা একটা লাথি মারল প্রবল জোর খাটিয়ে। উল্টে গেল চেয়ার। নিজেই আবার সেই চেয়ার সোজা করে দাঁড় করালো। তারপর তৃতীয়বারের মতো ফোনটা হাতে তুলে নিল। ডায়াল করল আকাশের নম্বরে। টের পেল বুকটা অসম্ভব টলছে। শ্বাস পড়ছে বড় বড়। গলা তৃষ্ণায় চৌচির!
‘হ্যালো রুদ্র, কী অবস্থা?’
‘এইত… তুই কই?’ নিজের কাছেই বেখাপ্পা শোনায় নিজের গলা। অচেনা একটা ভয় এসে ধাক্কা খায় মনে। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে?
‘আমি তো দোস্ত শপিং করতে আসছি।’ আকাশের গলা বেশ ফুরফুরে।
‘কীসের শপিং?’ প্রশ্নটা ধমকের মতো শোনায়।
‘বিয়ের।’
‘ও…!’ এরপর রুদ্র কী বলবে খুঁজে পায় না। শরীর জ্বলতে থাকে। ভয়ের ধাক্কাটা সূক্ষ্মভাবে পেঁচিয়ে থাকে চেতনায়। মাথাটা এলোমেলো লাগে।
‘আচ্ছা… তোর জিনিসটা পাওয়া গেছে। এই নে কথা বল।’
ফোনটা হস্তান্তর হয়। টের পায় রুদ্র।
‘হ্যালো রুদ্র ভাইয়া!’
রুদ্র পাথরের মতো কঠিন স্বরে বলে, ‘ভাইয়া ডাকতে নিষেধ করছিলাম।’
তারা থতোমতো খেয়ে চুপ করে যায়। রুদ্রই কথা বলে, ‘কী বলতে চেয়েছিলে?’
‘ইয়ে…ভাইয়া…’ মনের ভুলে আবারও ভাইয়া ডেকে ফেলে জিব কাটে তারা। শুধরে নিয়ে বলে, ‘সরি… মানে আপনার রিস্ট ব্যান্ডটা খুঁজে পেয়েছি।’
‘গুড নিউজ!’ রুদ্রর কণ্ঠস্বর এখনো থমথমে
‘ওটা কি আমার কাছেই রাখব?
‘রাখতে ইচ্ছা না হলে ফেলে দিতে পার ডাস্টবিনে।’
তারা ভড়কে যায়। মিনমিন করে বলে, ‘না মানে… আমার কাছেই
রাখব নাকি আকাশ ভাইয়াকে দেব?’
‘যেখানে ইচ্ছা রাখো। নো বিগ ডিল। আমি ফেরত পেলেই হলো।’
তারা লজ্জিতবোধ করল। সত্যিই তুচ্ছ একটা বিষয়কে সে অযথা টেনে লম্বা করছে। ছি!… রুদ্র হয়ত বুঝে গেছে ওর হ্যাংলামো। একারণেই খটোমটো স্বরে কথা বলছে। তারার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ফিকে হয়ে এল শাড়ির দোকানের সব রং… সব আভা। অনেকক্ষণ এ-দোকান সে-দোকান ঘুরেও পছন্দসই শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। বড্ড বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এবার একটা বেছে নিতেই হবে। চোখের সামনে দোকানী দুই কাঁধে দুই শাড়ি মেলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে মডেলের মতো। রুদ্র ফোনের লাইন কাটছে না। কিছু বলছেও না। আকাশ তখন ঝুমকির সাথে গিয়েছে পাশের দোকানে। মনীষা অধৈর্য গলায় বলল, ‘কোনটা ভালো লাগছে তারা? লাল নাকি মেরুন?’
তারা অসহায়ভাবে স্বগোতোক্তি করল, ‘লাল নাকি মেরুন?
রুদ্র তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর দিল, ‘কোনোটাই না!’
‘তাহলে?’ তারার সত্যিই খুব অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছে শাড়ি পছন্দ করার মতো কঠিন কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই জগতে।
‘সাদা নাই?’
‘সিরিয়াসলি রুদ্র ভাইয়া? বিয়ের দিন মানুষ সাদা পরে?
‘জি… তারা ভাইয়া, বিয়ের দিন মানুষ সাদাও পরে। আমি আমার বউকে বিয়ের দিন সাদা শাড়ি পরাব।’
তারা ফিক করে হেসে দিল, ‘সাদা তো বিধবাদের রং।’
‘লাল রংটা আমার একেবারেই পছন্দ না। তুমি পিংক পরতে পারো… কিংবা… হোয়াট অ্যাবাউট রু?’
‘ব্লু…।’ শব্দটা মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে করতে তারা শাড়ির রাজ্যে আরেকবার তীক্ষ্ণ চোখ বুলিয়ে নিল। দৈবক্রমে একটা ব্লু-কাতানে চোখ আটকেও গেল। তারা বেশ উদ্যমী গলায় দোকানীকে বলল, ‘ভাই ঐ শাড়িটা একটু দেখান প্লিজ!’
দোকানী আদেশ পালন করল। মনীষার চোখ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ছে। সে বুঝতে পারছে না তারার বিয়ের শাড়ি নির্বাচনে রুদ্রর কী ভূমিকা থাকতে পারে? দোকানী নীল কাতানটা খুলে দেখাচ্ছে। তারা বলছে, ‘একটা নীল কাতান পাওয়া গেছে। কাতান কি আপনার পছন্দ?’
রুদ্র শাড়ির নাম-ধাম অত জানে না। কাতান শাড়ি দেখতে কেমন মনে পড়ল না। নির্বিকার গলায় বলল, ‘ভিডিও কল দিচ্ছি। হোল্ড অন।’
তারার বুক ধড়ফড় করছে। মাথাটা পাগল পাগল। কী করছে সে নিজেও জানে না! শুধু জানে এই মুহূর্তে তার ভীষণ ভালো লাগছে! রুদ্র ভিডিও কল করছে। তারা বুঝতে পারছে না ফোনটা ঠিক কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ধরলে চেহারাটা একটু সুন্দর দেখাবে। ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজেকে দেখতে কার্টুনের মতো লাগে। সবুজ অ্যানসার বাটনে আঙুল ছোঁয়াতেই রুদ্রর মুখটা ভেসে উঠল ফোনের পর্দায়। প্রথম কয়েক সেকেন্ড ওরা কেউ কোনো কথা বলল না। তারার চোখ থেকে দ্বিধার ভাবটা কেটে গেছে। সে অকপটে চেয়ে আছে রুদ্রর দিকে।
‘তোমার গাবদা চশমার ফ্রেমটা কোথায় তারা?’
তারা লাজুক গলায় বলল, ‘চেঞ্জ করেছি।’
‘ভালোই তো!’ কথা বলতে বলতে হাসে রুদ্র। বিড়াল চোখজোড়া টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ে তারার রিমলেস চশমার পেছনের সাধারণ চোখ, সরু নাক, ছিপছিপে চোয়ালে। রুদ্র বুকের মধ্যে একটা আশ্চর্য দাপাদাপি টের পায়। জীবনের প্রথমবারের মতো! শাড়ি দেখার কথা কারো মনে থাকে না। ওরা একে অপরকে দেখতে থাকে।
‘কী ব্যাপার? এখনো তোমাদের কথা শেষ হয় নাই?’ আকাশের হুঙ্কার তারার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। ত্রস্ত হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিল আকাশকে। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে শাড়ি দেখার ভান করতে লাগল। আকাশ তেরছা গলায় বন্ধুকে বলল, ‘কী মামা? কী চাই? ভিডিও কল দিছ ক্যান?’
রুদ্র একটু অপ্রতিভ হলো, ‘দিলাম আরকি!
আকাশ সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে বন্ধুর দিকে। রুদ্র ফোনের লাইন কেটে দেয়। আকাশ তারার মুখের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তারা ভীষণ চুপসে যায়। ভয়ে দুরদুর করে কাঁপে বুক।
নীল শাড়িটা দাম বেশি বলে কেনা হলো না। লাল টুকটুকে একটা কাতান শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরল ওরা। ঝুমকি আর মনীষার শাড়ি খুব পছন্দ হয়েছে। মনীষা তারার গাল টিপে দিয়ে বলেছে, ‘যা মানাবে তোমাকে শাড়িটাতে! এমনিতেই দিন দিন সুন্দর হচ্ছ। বিয়ের ফুল ফুটেছে একদম!’
কিন্তু তারা কিছুতেই খুশি হতে পারছে না। হবে কী করে? লাল যে রুদ্রর অপছন্দের রং!
সেই রাতে আকাশের নম্বরে রুদ্রর ফোন এল আবার।
‘দোস্ত কী ভাবলি?’
আকাশ অত্যাশ্চর্য কণ্ঠে বলল, ‘কীসের কথা বলতেছিস?’
‘ওকে জিজ্ঞেস করছিলি?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝতেছি না।’
‘তুই কি তারাকে আস্ক করছিলি সে এই বিয়েটা সে করতে চায় কি না?’
মাথায় তড়াক করে রাগ চড়ে যায় আকাশের, ‘তাতে তোর কী? তুই বিয়া করবি ওরে?’
রুদ্রর বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগে। হঠাৎ খুব লজ্জা হয় ওর।
‘ধুর… এইটা কেমন কথা!’
‘তাহলে ওর বিয়ে নিয়ে তোর সমস্যা কী? ওর কোনো প্রব্লেম থাকলে তো নিজেই বলত, তাই না?’
রুদ্র একটু সময় চুপ করে থাকে। তারপর ক্ষীণ গলায় বলে, ‘তাও ঠিক!’
‘রাখি এখন। অনেক কাজ আছে। তোর মতো আজাইরা জিনিস নিয়ে ভাবার টাইম নাই।’
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সত্যিই আজকাল বড্ড বেশি ‘আজাইরা’ ভাবনা ভাবছে সে। হাতে আপাতত কোনো কাজ নেই বলে এরকম হচ্ছে বোধহয়। হয়ত খুব শীঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কেটে যাবে অস্থিরতার প্রহর। দেশ ছেড়ে উড়াল দিলেই পেছনের সব পিছুটান ফিকে হয়ে আসবে। একলা হলেই চশমা পরা দুটি চোখ তার দিকে আর একাগ্র চোখে চেয়ে থাকবে না। ধীরেধীরে ঐ চোখদুটি হারিয়ে যাবে বস্তুনিষ্ঠ, বিষয়মুখী জীবনের নানা উত্থান-পতন আর ঘাত-প্রতিঘাতে।
৪৬
পরের কটা দিন ঝড়ের বেগে কেটে গেল। এক বিকেলে বিভা জরুরি ভিত্তিতে ডাক পাঠালো বন্ধুদের। উত্তেজনায় তার কণ্ঠ কাঁপছে। কথা গুছিয়ে বলতে পারছে না। বিভার ডাক পেয়ে বন্ধুরা সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বিভার চুল আলুথালু। চোখে পাগলামোর রেশ। ঠোঁটজোড়া শুকনো। বন্ধুদেরকে নিজের ঘরে ডেকে এনে দরজাটা খুব ভালোভাবে বন্ধ করল সে। সবাই ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। উদ্বেগ ফেটে পড়ছে মুখে। এত সাসপেন্স সহ্য হচ্ছে না কারো। বিভা রুদ্রকে ফোন করল। আইপ্যাডটা পড়ার টেবিলের ওপর এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রাখল যে মনে হচ্ছিল যেন রুদ্র সশরীরে উপস্থিত আছে ওদের মাঝে।
বন্ধুরা বিছানায় আর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। বিভা ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, ‘একটা ঘটনা ঘটে গেছে।’
‘কী হইছে?’ ভয় পেয়ে গেলো সবাই। দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে এল মুখ।
‘কথাটা কাউরে বলি নাই এখনো। অভিজিৎকেও না। তোদেরকেই ফার্স্ট বলতেছি।’
‘আরে কী হইছে কস না ক্যান?’
ধমকে ওঠে সামি। বিভা দম আটকে বলল, ‘আই অ্যাম প্ৰেগনেন্ট! ‘
ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল ঝুপ করে। কারো চোখের পলক পড়ছে না। সেকেন্ড কেটে যাচ্ছে… টিক টিক টিক…! প্রথম চিৎকারটা ছুটে এল হৃদির মুখ থেকে। এরপর সবাই উচ্চকণ্ঠে এমন উল্লাস করতে লাগল, যে মুহূর্তের মধ্যে সেই হুল্লোড়জনিত শব্দ ছড়িয়ে পড়ল গোটা পাড়ায়। অনেক লাফঝাঁপের পর একটু শান্ত হলো ওরা। একটা অদ্ভুত গা শিউরে ওঠা অনুভূতিতে বুঁদ হয়ে রইল সকলে। সময় বয়ে চলেছে অমোঘ নিয়মে। এবার এসে গেল পরবর্তী প্রজন্মের আগমনী বার্তা। ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। কদিন পর হয়ত ওদের সবার কোলজুড়ে সন্তান আসবে। সেই সন্তানকে পুতুলের মতো নিজ হাতে সাজাবে, লালন- পালন করবে। নিজেদের বাবা মায়েরা জীবনভর যে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন সেই একই দায়িত্ব অবধারিতভাবে ওদের ওপরেও বর্তাবে। সময় এভাবেই চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যাবে। দায়িত্ব-কর্তব্য আর গল্পগুলো একই থাকবে। শুধু বদলে যাবে চরিত্রদের নাম!
এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে অমৃতা সামির পাশে এসে বসে। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘কেমন আছিস দোস্ত?’ সামি অবহেলায় তাকায় ওর দিকে। দায়সারা উত্তর দেয়, ‘ভালো।’ পরমুহূর্তেই বসা থেকে উঠে পড়ে। শ্বাসনালীতে বাতাস আটকে যায় অমৃতার। দম নিতে কষ্ট হয়। সামি কি তাহলে আর কখনো তার সাথে আগের মতো সহজ হবে না? বন্ধুত্বটা কি ঘুচে গেছে চিরদিনের মতো?
ফোনটা সেই সময় বেজে ওঠে ঝনঝন করে। সামির বুক পকেটে। অচেনা নম্বরটার দিকে একটু সময় ভ্রুকুটি করে চেয়ে থাকে সামি। তারপর অনিচ্ছা নিয়ে কল রিসিভ করে।
‘হ্যালো!’
ওপাশ থেকে কে কী বলল কে জানে! সামির মুখখানা হঠাৎ খুব বিবর্ণ হয়ে উঠল। চোখে ফুটে উঠল প্রকট দিশাহারা ভাব। হৃদি দৌড়ে এলো, ‘কে ফোন করছে? সব ঠিক আছে তো?’
সামি হৃদির দিকে ফিরেও তাকালো না। ফোন কানে ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কোন হাসপাতাল?’
এক মুহূর্ত চুপ থেকে ওপাশের কথা মন দিয়ে শুনল সামি। তারপর ফোনের লাইন কেটে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে হৃদিকে বলল, ‘চল!’
‘কোথায় যাব? কী হইছে বলবি তো!’ চেঁচিয়ে ওঠে হৃদি। সামি ঝড়ের গতিতে বিভার বেডরুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। বন্ধুরা ছুটে আসে পেছন পেছন। সামির মুখ রক্তশূন্য। ঠোঁট শুষ্ক। অস্থির চোখের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। তাড়াহুড়োতে জুতোর ফিতেটাও ঠিক মতো বাঁধল না। জুতোর ভেতর কোনো রকমে পা ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। লিফটের বাটন প্রেস করে কোনো দিকে না তাকিয়েই আর্তস্বরে বলল, ‘বাবা হাসপাতালে। গুলি লেগেছে বুকে।’ একটা প্রবল ঝাঁকুনি কাঁপিয়ে দিয়ে গেল সবাইকে। হৃদি কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অমৃতা স্তব্ধ… নিশ্চল এবং অশ্মীভূত। মুখে রক্তের কোনো অস্তিত্ব নেই। কাগজের মতো সাদা দেখাচ্ছে ওকে। যেন এই মাত্র পাঁজর থেকে হৃৎপিণ্ডটা কেউ খুবলে নিয়েছে।
গাড়িতে ড্রাইভার উপস্থিত আছে। তড়িঘড়ি করে ওরা উঠে বসল। গাড়িতে সবার জায়গা হলো না। বিভা রয়ে গেল বাসায়। তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন দিনে এমন ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ আসবে তা কে জানত! রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। গাড়ি একটু এগোয়, আবার ব্রেক কষে থেমে পড়ে। সামি অস্থির হয়ে নানা জনের কাছে ফোন করছে। ঘটনাস্থল কোথায় ছিল? দুর্বৃত্তকারীদের কেউ দেখেছে কি না? এসব প্রশ্নের টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন উত্তর পাওয়া গেলেও পুরো চিত্রটা এখনো স্পষ্ট নয়। গাড়ির ভেতর শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে। হৃদি কেঁদে যাচ্ছে নীরবে। অমৃতা স্থিরচিত্র। আকাশ একটু সাবধানে সামিকে প্রশ্ন করল, ‘কে শ্যুট করল আংকেলকে? কিছু জানতে পারলি দোস্ত?’
সামি ড্রাইভারের পাশের সিটে মূর্তির মতো বসে আছে। আকাশের প্রশ্নটা শুনেও যেন শুনল না। বক্ষচেরা যন্ত্রণায় তার সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। কেউ যেন মুগুর পিটছে হৃৎপিণ্ডের জমিনে। গত রাতেও বাবা ডেকেছিল। খুব নাকি জরুরি কথা আছে। না বললেই নয়। সামি রোজকার মতো সেই আমন্ত্রণ পায়ে ঠেলে দিয়েছিল। মাথা ব্যথার অজুহাতে দেখা করেনি। খানিক বাদে হৃদি এসে বলল, ‘বাবা বলছেন দিনকাল নাকি খুব খারাপ। আমাদের সঙ্গে সব সময় বডিগার্ড রাখতে হবে।’
সামি মাছি তাড়াবার মতো উড়িয়ে দিল কথাটা, ‘উনার দিনকাল সারা জীবনই খারাপ থাকে। দুইদিন পর পর বডিগার্ডের ভূত চাপে মাথায়। বাদ দে তো এসব।’
‘আচ্ছা তুই একবার দেখা করে আয় বাবার সাথে। তোর সাথে অনেক দিন নাকি কথা হয় না। এই নিয়ে খুব দুঃখ করছিলেন।’
সামি উত্তর না দিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়। ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখন অপরাধবোধ ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে ভেতরটাকে মনস্তাপের তীক্ষ্ণ ফলা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে তুলছে বুক। একটা দলা পাকানো কান্না আটকে আছে গলায়। কেন বাবার ডাকে সাড়া দিল না? এতদিন ধরে এতবার ডাক পাঠালো। কেন একটাবারও কথা বলল না? এখন কী হবে? বাবার যদি কিছু হয়? যদি আর কোনোদিন বাবার সাথে কথা বলার সুযোগ না আসে?
হাসপাতালের লবিতে ভিড়। অফিসের কর্মচারী, পার্টির লোক, পুলিশ, সাংবাদিক সকলেই উপস্থিত আছে। রোমেলা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। সামিকে দেখামাত্র ছুটে এলেন তিনি। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে বিকেলে অফিস বিল্ডিং-এর নিচে গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন রাশেদ। পাশে দুজন গার্ড দণ্ডায়মান ছিল। সিগন্যালের কারণে রাস্তায় অনেকটা সময় ধরে যানবাহন থেমে আছে। একটা সময় সিগন্যাল ছাড়ল। হর্ন বাজিয়ে দলে দলে এগোতে লাগল গাড়ির বহর। রাস্তা একটু ফাঁকা হয়ে আসতেই একটা সাদা মাইক্রোবাস অফিস বিল্ডিং-এর নাক বরাবর চলে গেলো। চলন্ত মাইক্রোর জানালা দিয়ে ছুটে এল গুলি। প্রকট গুলির শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। গুলিবিদ্ধ রাশেদ বুকে একটা হাত রেখে কয়েক সেকন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে উপচে পড়তে লাগল রক্ত। টলতে লাগল পা। মাটিতে পুরোপুরি লুটিয়ে পড়ার আগে গার্ড দুজন তাকে ধরে ফেলল দুপাশ থেকে। উপস্থিত জনগণ ছুটন্ত মাইক্রোর পেছনে তাড়া করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। কেউ গাড়ির নম্বরও সঠিকভাবে বলতে পারছে না। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করা হচ্ছে।
রোমেলা সামিকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছিলেন। সামি মায়ের বাহুডোর থেকে নিজেকে কোনো রকমে ছাড়িয়ে নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। ওকে দেখে কোম্প্যানির চিফ মার্কেটিং অফিসার সবুজ সাহেব ছুটে এলেন। বললেন গুলি অপসারণের জন্য হক সাহেবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওটির বাইরে কোনো সার্জন কিংবা ডাক্তারকে পাওয়া গেল না। একজন নার্স জানালেন, ‘চেস্ট ড্রেইন টিউব দেয়া হয়েছে। ব্লাড ট্রান্সফিউশন হচ্ছে। বুলেট বুকের কোথায় লেগেছে এসব ডিটেইলস এখন বলতে পারছি না।’
সামি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছিল না। শরীরে কোনো বল নেই। মাথাটা গড়ের মাঠের মতো ফাঁকা। ভেতর থেকে একটা তীব্র হাহাকার ঊর্ধ্বগামী হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্ষণে ক্ষণে। কী করে মোকাবেলা করবে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি? কারা মারল তার বাবাকে? খুব বড় কোনো বিপদে পড়েছিল কি বাবা? এমন বিপজ্জনক দিনে বাবার সঙ্গ না দিয়ে, পাশে না দাঁড়িয়ে সামি নিষ্ঠুরের মতো বারবার দূরে ঠেলে দিয়েছে। আকাশ ওর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখল, ‘দোস্ত, মনে সাহস রাখ। ইন-শা- আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সামির চোখ থেকে একটা জলের ধারা নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছিল। কাঁপা কাঁপা আর্ত গলায় সে স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগল, ‘বাবা আমার সাথে কতদিন ধরে কথা বলতে চাচ্ছিল… কেন বললাম না!… কেন বললাম না!’
পুলিশের লোক এবং সাংবাদিক নানারকম প্রশ্ন করছে। সামি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। তার চোখ রক্তাভ। ফর্সা গাল ভিজে আছে অশ্রুর লোনা জলে। আকাশ পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছেন ওর এখন কথা বলার মতো অবস্থা নেই। প্লিজ এসব জিজ্ঞাসাবাদ আপনারা পরে করেন। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক।
অফিসার আকাশের পরিচয় জেনে নিয়ে বললেন, ‘হক সাহেব থানায় জিডি করেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে ফোনে তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না দেখে খুব অবাক হলাম।’
সামির যেন এতক্ষণে বোধদয় হলো। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কারা হুমকি দিয়েছে?’
‘এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই আমরা।’
সামির গলা চড়ে যায় সপ্তমে, ‘আপনাদের কাছে জিডি করা হয়েছে। এর পরেও আপনারা কোনো প্রিকশন নেননি কেন?’
‘যে ফোন নম্বর ব্যবহার করে হুমকি দেয়া হচ্ছিল সেই নম্বর ট্র্যাক করা হয়েছে। তদন্ত চলছে এখনো। আপনাদের বাড়িতে অতিরিক্ত প্রহরী নিযুক্ত করা হয়েছিল। সমস্যা হলো প্রতিপক্ষ দলের সাথে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি জড়িত আছে। হক সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করে ফেললেই সবচেয়ে বেটার হতো।’
সামি দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমার বাবাকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। আর আপনি বলছেন ব্যক্তিগতভাবে আপোস করতে? বাবার যদি কিছু হয়…’
‘আপোস আগেভাগে করে ফেললে তো আর এই দিন দেখতে হতো না! এখন ঝামেলা বেঁধে গেছে। আপনার বাবা অনেকের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। উনার ভক্তরা হাত পা গুটিয়ে বসে নেই। দাঙ্গা, হাঙ্গামা আগামী বেশকিছুদিন ধরে লেগেই থাকবে।’
‘আমাদের তাহলে এখন কী করা উচিত ওসি সাহেব?’ সামি বলল ব্যঙ্গাত্মক গলায়।
‘আপনাদের পরিবারের সকলের এখন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।’
‘আমরা নাহয় সাবধানে থাকলাম কিন্তু আপনাদের কাজটা কী? বসে বসে মাছি মারা?’ সামির অফেনসিভ প্রশ্নে অফিসারের মুখে মেঘ ঘনিয়ে এলো। থমথমে গলায় বলল, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব অব্যাহত রাখব। কিন্তু এসব হাইপ্রোফাইল কেসে উপরমহলের আদেশ আমাদের মেনে নিতে হয়।’
জটলাটা ধীরেধীরে বড় হচ্ছিল। দলের নেতা কর্মীরা অনেকেই এসেছেন। রোমেলা অসুস্থবোধ করছেন। তিনি লো-প্রেশারের রোগী। কিঞ্চিৎ অনিয়ম হলেই মাথা ঘুরায়, হাত পা কাঁপে। হৃদির আব্বা আম্মাও খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। মায়ের শারীরিক অবনতি দেখে সামি হৃদিকে ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুই বরং মাকে নিয়ে বাসায় যা। এখানে বসে থেকে লাভ নাই। আমি আপডেট দিব।’
রোমেলা হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। হাসপাতাল তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ছাড়ে। অগত্যা ছেলের আদেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পালন করতে হলো।
এত কোলাহলের মাঝে কেউ লক্ষ্য করেনি একটি মেয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজার পাশে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে সাদা কালো ঢোলা চেকশার্ট। মাথায় ছোট ছোট চুল। কপালে একটি ক্ষতচিহ্ন। মেয়েটির দু’চোখে গহন শূন্যতা। ঠোঁটজোড়া খটখটে শুষ্ক। দাঁড়িয়ে থাকার নিশ্চল রিক্তহস্ত ভঙ্গিটি দেখে মনে হয় যেন বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকুও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মাঝে হাসপাতালের কয়েকজন আয়া একাধিকবার তাকে বলেছে জায়গাটা থেকে সরে যেতে। অনতিদূরেই বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। সেখানে না বসে মেয়েটি কেন অপারেশন থিয়েটারের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই বিষয়টি তাদের বোধগম্য হয়নি। আকাশ নানা ব্যস্ততায় এতক্ষণ অমৃতাকে লক্ষ্য করেনি। এবার চোখ পড়তেই ছুটে এলো।
অমৃতার কাঁধে একটা হাত রেখে নিচু গলায় বলল, ‘এখানে দাঁড়ায় আছিস ক্যান? চল গিয়ে বসবি।’
অমৃতা তাকাল না আকাশের দিকে। শূন্যে চোখ রেখেই মাথাটা অপ্রকৃতস্থের মতো নাড়তে নাড়তে বলল, ‘না… এখানেই থাকি।’
আকাশ টের পেলো সামি এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। লক্ষ্য করছে ওদেরকে। সে গলার স্বর আরো দুই তিন স্তর খাদে নামিয়ে বলল, ‘দোস্ত, কাছেই বসার জায়গা আছে। ওখানে চল। এখানে দাঁড়ায় থাকাটা কেমন লাগে?’
অমৃতা একরোখা ভঙ্গিতে বলল, ‘এখানে দাঁড়ায় থাকলে উনাকে বের করার সময় একটু দেখতে পাব। নইলে ওরা আমাকে দেখতে দিবে না!’ কথা বলতে বলতে গলা কেঁপে গেল অমৃতার। ঠোঁট চেপে কান্নাটা রুখল সে।
‘কী সমস্যা?’ ধমকের সুরে প্রশ্ন করে সামি। আকাশ অপ্রস্তুতবোধ করল। অমৃতাকে আড়চোখে আরেকবার দেখে নিয়ে সরে এল জায়গাটা থেকে। সামিকে বলল, ‘কোনো সমস্যা নাই। চল গিয়ে বসি।’
‘অমৃতা ঐখানে কী করে?’
আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওর ধারণা ওখানে দাঁড়ায় থাকলে অপারেশন শেষে আংকেলকে বের করার সময় একবার দেখতে পাবে। পরে নাকি কেউ ওরে দেখতে দিবে না।’
সামি কথাটা শুনে কেন যেন খুব বিস্মিত হলো। অবোধ চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। কিছু বলল না। মাথা হেঁট করে শ্লথ পায়ে লবির দিকে এগিয়ে এলো। হৃদির আব্বা আম্মা অনেকটা সময় ধরে বসে আছেন। অপারেশন কখন শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। সামি এক সময় শ্বশুর শাশুড়িকে বিনয়ের সাথে বলল, ‘আপনারা বাসায় ফিরে যান। বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে দোয়া করেন। সেটাই বেশি জরুরি।’ হৃদির আব্বা জানালেন পাড়ার মসজিদে এশার নামাজের পর দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আগামীকাল কোরান খতম হবে। সামি আর আকাশকে ক্যান্টিনে গিয়ে ডিনার করার প্রস্তাব দিলেন। ওরা রাজি হলো না। হৃদির আব্বা আম্মার প্রস্থানের পর একজন আয়া এসে বলল, ‘ওটির পাশে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে। উনি কি আপনাদের লোক? ওখানেই থাকবে? নাকি সরে যেতে বলব?’
এই হাসপাতাল হক সাহেবের কথায় ওঠে বসে। তার আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের জন্য এখানকার প্রচলিত নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তাই এতক্ষণের হৈ-হট্টগোল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মুখ বুজে সহ্য করেছে। সামি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, ‘থাকুক। তাকে কিছু বলা লাগবে না। অপারেশন আর কতক্ষণ চলবে?’
‘এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না স্যার।’
‘ওটি থেকে কোনো ডাক্তার বা নার্স বেরিয়ে এলে আমাকে জানাবেন প্লিজ।’
‘জি স্যার। নিশ্চয়ই জানাব।’
টানা চার ঘণ্টা অপারেশন চলল। সার্জন জানালেন, বুকের ডান পাশে বুলেট লেগেছিল। লাংস, হার্ট ভেসেলস ইনজুরড হয়নি। অপারেশন সাকসেসফুল। রোগীকে চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা অবজার্ভেশনে রাখা হবে। বন্ধুদের বাড়ি ফিরে যেতে বলল সামি। রাতে কারও ডিনার হয়নি। এভাবে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে থাকলে সকলেই অসুখে পড়বে। আকাশের খুব সকালে ক্লাস আছে। হাসপাতালে রাত কাটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বেরোবার সময় অমৃতাকে বলল, ‘চল বাসায় যাই, অপারেশন তো হয়ে গেছে। এখন চিন্তার কিছু নাই।’
‘পরে যাব। আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে যাক উনাকে। তারপর যাব।’ সোজাসাপ্টা উত্তর অমৃতার।
‘রাত হয়ে যাচ্ছে তো!’
‘হোক।’
‘তোর আব্বা আমারে ফোন দিছে এর মধ্যে দুইবার। কী বলব আংকেলকে?’
‘বলিস আমি বিভার বাসায় গেছি।’
‘বললেই বিশ্বাস করবে? আংকেল তো নিউজ দেখছে টিভিতে। সবকিছুই জানে।’
‘জানুক… তোরে যা বলছি তাই কর। বেশি পকপক করিস না।’
আকাশ আর কথা বাড়ালো না। বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। বাড়ি ফিরে দেখল মনীষা বসে আছে ড্রয়িংরুমে। আকাশকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়ালো। এক গাল হেসে বলল, ‘এই যে মশাই। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
‘কী ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ সব ঠিক। একটা সুখবর দেবার ছিল।’
তারা এতক্ষণ মনীষার পাশে বসে ছিল। এখন পাশের ঘরে চলে গেল। আকাশ বসল মনীষার মুখোমুখি সোফায়। উৎসুক গলায় বলল, ‘কী সুখবর?’
মনীষা হালকা গোলাপি রঙের একটা সুতির শাড়ি পরেছে। চোখে কাজল। মোমের মতো পেলব ত্বকে একটু ঘামের ঝিকিমিকি। কী স্নিগ্ধ সুন্দর!
‘চাকরি হয়েছে। বান্দরবানে পোস্টিং।’
আকাশ নিভল, ‘তাই?’
‘হ্যাঁ… আগামী মাস থেকে শুরু। খুব বাঁচা বেঁচে গেছি ভাই। কী যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল!’
আকাশ একটু হাসার চেষ্টা করল, ‘যাক ভালোই হলো। চাকরিটা কীসের?’
‘একটা বিদেশি এনজিও।’
‘বেশ ভালো।’
‘খুব করে চাইছিলাম রাইয়ানের বাবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে। সে যেন কোনোভাবেই আমার খোঁজ না পায়।’
‘পাবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
একটু থেমে মনীষা বলল, ‘তোমাদেরকে খুব মিস করব।’
আকাশ কিছু বলল না। মুখে মিটমিটে হাসিটি নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে মনীষা প্রশ্ন করল, ‘তোমার কিছু বলার নেই আকাশ?’
মনীষার সাগরের মতো গভীর দুটি চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে আকাশ ভরাট গলায় বলল, ‘আপনার চোখ!’
‘কী হয়েছে আমার চোখে?’
‘কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই… নইলে এত সুন্দর কেন?’
‘ফাজলামো না করলে ভালো লাগে না, তাই না?’
‘ফাজলামো নয়। সত্যি বলছি। আপনার চোখদুটো অদ্ভুত সুন্দর মনীষা!’
কী ছিল ওই কথায় জানে না মনীষা, শোনামাত্র ওর বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। অন্যদিকে চোখের পলক ফেলে বলল, ‘এটা একটা কথা হলো?’
আকাশ হাসে… হাসে চোখ… মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘নাহ… এটা কোনো কথা না। বাট আপনাকে দেখলে বারবার আমার এই কথাটা বলতে ইচ্ছে করে… আই ক্যান্ট হেল্প! সরি!’
একটু থেমে আকাশ আবার বলল, ‘কবে যাচ্ছেন?’
‘নেক্সট মাসে। পাঁচ তারিখ দুপুরে বাসের টিকেট করেছি। এক তারিখ থেকেই জয়েন করার কথা ছিল। কিন্তু থাকার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। যে বাসাটা ভাড়া করেছি ওটা চার তারিখে ভ্যাকেন্ট হবে।’
‘আপনি একাই যাচ্ছেন?’
মনীষা কপালে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ একটু বিব্রতভাবে বলে, ‘না মানে… এত জিনিসপত্র নিয়ে একা যাওয়াটা একটু প্রব্লেম না? তাই ভাবলাম কেউ সাথে যাচ্ছে কি না…!’
মনীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘কে যাবে? আমার কেউ আছে নাকি?’
আকাশ চুপ করে থাকে। মনীষা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রেস্ট নাও। আমি বরং আসি।’
আকাশ হেসে বলল, ‘আসুন!’
বেরোবার মুখে থামল একবার মনীষা। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আগামী মাসের শেষের দিকে রাইয়ান আসবে ঢাকায়। তুমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে বান্দরবান?’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই!’ মার্জিত ভঙ্গিতে বলল আকাশ।
মনীষা হাসল, ‘তুমি খুব ভালো একটা ছেলে। দোয়া করি তোমার মনের সকল আশা যেন পূর্ণ হয়!’
কথাটা বলতে বলতে মনীষা দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর একলা ঘরে ক্লান্ত অবসন্ন ভগ্নহৃদয় আকাশ অসীম শূন্যতা মাথায় নিয়ে চুপ করে বসে রইল। এই শূন্যতার উৎস সম্পর্কে সে অজ্ঞাত। অজানা অচেনা অদ্ভুত এই শূন্যতা চারপাশ থেকে ঘন কালো বিভীষণ মেঘের মতো ঘিরে ধরেছে তাকে। ঝুমকি কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ মাথার ওপর হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকাল।
‘কী হয়েছে তোমার বাবা?’
আকাশ অবশ চোখে ঝুমকির দিকে চেয়ে রইল। ঝুমকি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সারাদিন কিছু খাওনি? মুখটা একদম শুকনা দেখাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।’
কথাটা বলে ঝুমকি সরে যাবার জন্য উদ্যত হয়েছিল। আকাশ ওর একটা হাত টেনে ধরে বলল, ‘এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি এখানে আসেন… বসেন…!
ঝুমকি একটু চমকে গেল মনে মনে। আকাশ এর আগে কখনো এমন আকুল হয়ে তার সঙ্গ চেয়েছে কি না মনে পড়ল না। মনটা খুব সিক্ত হয়ে উঠল। সে নিঃশব্দে আকাশের পাশে এসে বসল। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি ঠিক আছ? কিছু নিয়ে মন খারাপ?’
আকাশ ফ্যাকাশে হেসে বলল, ‘মন খারাপ কি না জানি না… তবে আমার খুব একা একা লাগছে।’
ঝুমকি আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘একা একা লাগছে কেন?’
‘আমার বন্ধুরা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে… একা একা লাগবে না?’ কথাটা বলে আকাশ খুব অদ্ভুত একটা কাজ করল। এমন কাজ সে জীবনে কখনো করেনি! চট করে একটা কুশন ঝুমকির কোলের ওপর ফেলে, সেই কুশনে মাথা রেখে সোফার ওপর চিৎ হয়ে পা টানটান করে শুয়ে পড়ল। ঝুমকি অবাক চোখে দেখল ঘটনাটা। তার মাতৃহৃদয় কুলকুল করে ভরে গেল বাৎসল্যের আবেগে। একটা হাত নামিয়ে আনল আকাশের মাথায়। বিলি কাটতে লাগল। আকাশ চোখ বুজল আরামে। ঘুমিয়েও পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই! ভারী নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। আকাশের বাবা টিভি দেখার জন্য ড্রয়িংরুমে এসেছিলেন। আসামাত্র দৃশ্যটাতে চোখ আটকে গেলো তার। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখলেন তিনি ছেলের ঘুমন্ত মুখ, স্ত্রীর অশ্রুসজল চোখ। জায়গাটা থেকে সহজে নড়লেন না। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন স্থবির হয়ে। তারপর কী মনে করে যেন ঝুমকির পাশের সোফায় এসে বসলেন। বসে রইলেন চুপ করে। খানিক বাদে আকাশ একটু নড়ে উঠল। চোখ খুলে দেখল দুজন মানুষ তাকে ঘিরে নির্বাক বসে আছে। তারা কথা বলছে না, নড়ছে না… কারণ, কথা বললে, নড়লে… তার ঘুম ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে। দৃশ্যটা দেখে কেন যেন সংকোচবোধ করল আকাশ। আবার ভালোও লাগল খুব! এত ভালো অনেক দিন লাগেনি তার। মনে হলো সে যেখানেই হারাক না কেন, যত বড় ভুলই করুক না কেন, পৃথিবীর সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও… এই দুজন মানুষ আমৃত্যু তার জন্য ঠিক এভাবেই অপেক্ষা করে যাবে!
৪৭
হৃদি তার শাশুড়িকে নিয়ে আরেকবার এল রাত এগারোটার দিকে। রোমেলা কিছুক্ষণ আইসিউর বাইরে চুপচাপ বসে রইলেন। চুপ করে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর তো কিছু করার নেই! সামি খুব বেশি সময় মা এবং স্ত্রীকে হাসপাতালে রাখতে চাইল না। পাঠিয়ে দিল বাসায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের আনাগোনাও কমে এলো। লাউঞ্জে শুধু অমৃতা বসে রইল একা। সামি দূর থেকে দেখল ওকে। হাসপাতালের বাইরে এসে সিগারেট ধরালো। অনেকক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি। অস্বাভাবিক দুর্বলতায় কাঁপছে শরীর। মাথায় টুকরো মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে নানা দুশ্চিন্তা। বডিগার্ড নিয়ে ঘুরলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? বাবার পাশে তো গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল। এত লোকের ভিড়ে আততায়ী অমন নিখুঁত টার্গেট করল কী করে? আল্লাহর অশেষ রহমত বুলেট সরাসরি হার্ট কিংবা লাংসে লাগেনি। তা না হলে… সামি আর ভাবতে পারে না। অনির্বচনীয় শঙ্কায় তার মস্তিষ্কের নার্ভগুলো কেমন অবশ হয়ে আসে। খুন করাই যদি মোটিভ হয়ে থাকে তাহলে শত্রুপক্ষর এখানেই থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। পুনরায় আক্রমণ হতে পারে যেকোনো সময়।
লাউঞ্চ পার হয়ে আইসিইউর দিকে যাবার সময় অমৃতাকে আরেকবার আড়চোখে দেখল। মাথা হেলিয়ে দিয়েছে চেয়ারের পিঠে। চোখ বন্ধ। সামি আইসিউর সামনে এসে বসল। দুশ্চিন্তার কাঁটা বুক থেকে সরছে না। অস্থির লাগছে। উঠে পড়ল আবার। লাউঞ্জে অমৃতা বসে আছে তখনো। সামি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে। ধড়ফড় করে উঠে বসল অমৃতা।
‘কী অবস্থা?’
মাথা নাড়ল সামি, ‘নো আপডেট।’
ভীষণ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে অমৃতাকে। চোখদুটো টকটকে লাল। সামি বলল,
‘ক্যান্টিনে চল। কিছু খাই।’
অমৃতা আপত্তি করল না। উঠে দাঁড়ালো বাধ্য মেয়ের মতো। হাসপাতালের ক্যান্টিন রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। ওরা এগারোটা পঞ্চাশে গিয়ে পৌঁছল। অর্ডার করল দুটা স্যান্ডুইচ আর দু কাপ চা। ক্যান্টিন প্রায় খালি। দুজন কর্মচারী ছাড়া তেমন কেউ নেই। ওরা দুজন একটা গোল টেবিলে মুখোমুখি বসল। দেখল একজন আরেকজনকে। ভাবলেশহীন চোখে। কয়েক ঘণ্টা আগে বিভার বাসায় সামি অমৃতাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। চোখে চোখে তাকাচ্ছিল না পর্যন্ত। এখন ওসবের কিছুই বোধহয় মনে নেই ওদের। মৃত্যুর অমোঘ উপস্থিতি পার্থিব টানাপোড়েন ফিকে করে দেয়। মানুষকে এক লহমায় বুঝিয়ে দেয় শুধু সুস্থভাবে শ্বাস নিতে পারাটা জীবনের রণক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। বাদবাকি সবকিছু অকিঞ্চিৎকর। স্যান্ডুইচ আসতে সময় লাগল না। নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করল ওরা। অমৃতা এক সময় বলল, ‘গুলি কে করল? কিছু জানিস?’
‘পলিটিক্যাল ইস্যু।’
‘মামলার কী অবস্থা কে জানে। কাল সকালে একবার আমার সিনিয়ারকে ফোন করব।’
‘কিছু জানতে পারলে ইনফর্ম করিস আমাকে।’
‘হুম…’ অস্ফুটে শব্দটা উচ্চারণ করে অমৃতা। স্যান্ডুইচে কামড় বসায়। চিন্তিত গলায় বলে,
‘তোর বাবাকে বলিস আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে সরে যেতে। আমি জানতাম এরকম কিছু হবে।’
সামি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কীভাবে জানতি?’
‘উনি সবাইকে তোষামোদ করে চলতে পারেন না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। এসব কারণে শত্রু সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা।’
সামি সূক্ষ্ম চোখে অমৃতাকে দেখল একবার। তার মনে হলো সন্তান হিসেবে বাবা সম্পর্কে সে যতটা জানে, অমৃতা তার চেয়ে অনেক বেশি জানে। বিষয়টা বুঝতে পেরে এই মুহূর্তে রাগ কিংবা বিতৃষ্ণা কিছুই হলো না তার। বরং একটা নির্বোধ ভোঁতা অনুভূতিতে টইটুম্বুর হয়ে রইল ভেতরটা। অমৃতা বলল,
‘কনফ্লিক্ট কার সাথে ছিল? হুট করে নিশ্চয়ই কিছু হয়নি। তোকে কি কিছু বলেছিলেন এ ব্যাপারে?’
সামি স্যান্ডুইচ চিবোচ্ছিল। প্রশ্নটা শোনামাত্র একটু থমকে গেলো সে। খাওয়া বন্ধ করে নিষ্প্রাণ চোখে অমৃতার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মৃত গলায় বলল, ‘বাবার সাথে আমার অনেকদিন কথা হয় না।’
বিদ্যুৎ চমক দিয়ে গেল অমৃতার শরীরে। বিস্মিত গলায় বলল, ‘মানে কী? কতদিন কথা হয় না?’
‘অনেকদিন।’ নিস্তরঙ্গভাবে উত্তর দেয় সামি। চায়ে চুমুক দেয়। হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখে।
অমৃতা হাতে ধরা স্যান্ডুইচ রেখে দিল প্লেটে। তার গলা দিয়ে এখন আর কিছু নামবে না। মনটা আগের চাইতে আরো অনেক বেশি খারাপ হয়ে গেল। সামির সাথে কথা না বলে থাকাটা ঐ মানুষটার জন্য কতটা কষ্টের তা অন্য কেউ না জানলেও অমৃতা জানে। ওদের পিতা-পুত্রের মধ্যকার দূরত্বের জন্য দায়ী সে নিজে। এই ভয়াবহ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। নিজেকে নিজে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না সে। হঠাৎ সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বলল, ‘আমি তো তোদের লাইফ থেকে সরেই গেছিলাম। এর পরেও উনার সাথে কথা বলিস নাই ক্যান?’
সামি নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলল না। অমৃতার গলার স্বর উচ্চগ্রামে উঠে যাচ্ছিল,
‘ভুল তো মানুষই করে। ভুলের কি কোনো ক্ষমা হয় না? ভুল শোধরাবার চান্স তো দিতে হয়!’
অমৃতার কথার ধরন এখন অসংলগ্ন। চোখে অস্থির পাগলাটে দৃষ্টি। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তাছাড়া আমি তোকে বলছিলাম উনার কোনো দোষ নাই। দোষ আমার। এটাও বলছি আমাদের মধ্যে কখনই কিছু ছিল না। এখনো নাই। এরপরেও কেন সবকিছু স্বাভাবিক হবে না? হ্যাঁ? এতদিন পরেও?’
ক্যান্টিনের ওয়েটার হাঁ করে দেখছিল ওদেরকে। সামি অমৃতার কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। খাবারের দাম মেটাবার জন্য এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে। ওর মুখটা মৃত মানুষের মতো সাদা। চোখের দৃষ্টি শীতল। যেন মানুষ নয়, প্রেত!
খাবারের দাম মিটিয়ে সামি আইসিউর সামনে এসে বসে। অমৃতা হাসপাতালের বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরায়। মধ্যরাতের গা ছমছমে নীরব রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুসফুসে টেনে নেয় নিকোটিনের ধোঁয়া। তারপর উঠে আসে ওপরে। সামির পাশে এসে বসে। বসেই থাকে চুপচাপ। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। ঘুম ঘুম ভাব হয় একটু। রাত দুটার দিকে রুদ্র এসে পৌঁছোয়। অমৃতা ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। যে কান্নাটা দলা পাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আটকে ছিল বুকে, সেটাই রাতের নিঃশব্দ তৃতীয় প্রহরে হঠাৎ অর্গল খুলে বেরিয়ে আসে স্রোতের মতো। রুদ্র ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে। কান্নার জলে শার্ট ভিজে যায়। সামি নিথর হয়ে বসে থাকে। রুদ্র অমৃতাকে ছেড়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রাখে। সান্ত্বনার গলায় বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে দোস্ত। চিন্তা করিস না!’
ভোর পাঁচটায় রাশেদকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হলো। অমৃতা আর রুদ্র হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এল ছয়টায়। বেরোনোর আগে সামি একবার ওদেরকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তোরা কেউ দেখা করবি বাবার সাথে?’ প্রশ্নটা করেছে সে রুদ্রর দিকে চেয়ে। কিন্তু রুদ্র জানে এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। সে অমৃতার দিকে তাকাল। একটু অপ্রস্তুত হলো অমৃতা। মুখে হালকা বিভ্রম খেলে গেল ক্ষণিকের জন্য। পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে।
‘নাহ…!’ কাঁধ নাচিয়ে ড্যাম কেয়ার ভঙ্গিতে শব্দটা উচ্চারণ করল। বন্ধুদেরকেও আজকাল মিথ্যে বলতে হয়। প্রাণের চেয়ে অধিকতর প্রিয় বন্ধুরাও বুঝল না, মুখে যতই না করুক, ভেতরে ভেতরে মানুষটাকে এক নজর দেখতে পাবার অদম্য তৃষ্ণায় ছটফট করছিল সে।
৪৮
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে যাচ্ছে একের পর এক তারিখ। রাশেদ তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। অমৃতা বাদে বাকি সব বন্ধুরা এই দুর্দিনে সামিকে সঙ্গ দিয়েছে। রাশেদকে বাড়ি নিয়ে যাবার সময়ও বন্ধুরা সাথে ছিল। রোমেলা মুখ ভার করলেন। মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে চেয়ে মুখ ফুটে কোনো আপত্তি জানাতে পারলেন না। সামি মায়ের অসন্তোষ টের পেয়ে অপরাধী গলায় বলল, ‘মা, বন্ধুরা সাথে থাকলে আমার ভালো লাগে। মনে সাহস পাই। তুমি কিছু মনে করছ নাতো?’
রোমেলা থমথমে মুখে বললেন, ‘আমার কিছু মনে করা-না-করায় কী এসে যায়? তুমি তো পৃথিবী উল্টে গেলেও এসব বন্ধুদের ছাড়তে পারবে না দেখছি!’
সামি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর অনুনয় করে বলে, ‘রুদ্র চলে যাচ্ছে কদিন পরে। এই ক’টাদিন আমরা একটু আগের মতো মিলেমিশে থাকি মা? এরপর থেকে আমার বন্ধুরা তোমাকে আর কখনো বিরক্ত করবে না।’
বাড়ি ফিরে আসার পরেও চলাফেরা এবং খাদ্যাভ্যাসে বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে রাশেদকে। বাড়িতে একজন বাঁধা পুরুষ-নার্স রাখা হয়েছে। নিজ হাতে পতিসেবা করার মতো অনুরক্ত স্ত্রী রোমেলা কখনই ছিলেন না। স্ত্রীর কাছ থেকে রাশেদের তেমন কোনো প্রত্যাশাও নেই। শুধু ভেবেছিলেন অসুস্থতার উছিলায় নিজের শয়ন কক্ষের হারানো অধিকার ফেরত পাবেন। বহুদিন ধরে স্টাডিরুমে রাত্রি যাপন করে আসছেন। এবার নিজের ঘরে ফিরে যাবার একটি যথোপযুক্ত যৌক্তিক সুযোগ সৃষ্টি হলো। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। নার্স ছেলেটিকে সর্বক্ষণ রোগীর আশেপাশে থাকতে হয়। চলাফেরায় কষ্ট হলেও রাশেদ সব সময় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেন না। হয়ত ল্যাপটপ খুলে কাজ করেন, নইলে বই পড়েন, মাঝে মাঝে ফাইলপত্র নিয়ে বসেন। ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করেন। রোমেলা ফরমায়েশ খেটে অভ্যস্ত নন। রোগীর হাঁটাচলা, খাওয়া দাওয়া, মেডিসিন নেয়া, জামা-কাপড় পরা, বাথরুমে যাওয়ার মতো প্রতিটি প্রয়োজনীয় কাজেই নার্স-ছেলেটির ঘনঘন ডাক পড়ছে। বেডরুমে বাইরের লোকের আনাগোনা ব্যাপারটা রোমেলার পছন্দ নয়। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যতদিন নার্সের ডিউটি থাকবে ততদিন যেন রাশেদ স্টাডিরুমেই থাকেন। কিন্তু এতেই তো আর দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। প্রতিবেলা রোগীর জন্য কী রান্না হবে সেই মেনু রোমেলাকেই ঠিক করতে হচ্ছে। নার্স সময়মতো খাবার সার্ভ করল কি না, সঠিক মেডিসিন দেয়া হলো কি না এসব তদারকির দায়িত্বও রোমেলার। তাই কয়েকটা দিন বাধ্য হয়েই তাকে সামাজিক গেট-টুগেদারগুলো থেকে দূরে থাকতে হলো। ক্লাবের মিটিং থেকে বিরত থাকলেন। এমনকি বাড়িতে অতিথি সমাগমও সীমিত হয়ে এলো।
অফিস যাবার আগে সামি রোজ একবার স্টাডিরুমে উঁকি দেয়। পিতা পুত্রের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হয়। বেশির ভাগ আলাপ ব্যবসা সংক্রান্ত। রাতের খাবারটা পরিবারের সবার একত্রে বসে খাওয়া হয়। এর পেছনে হৃদির অবদানই সবচেয়ে বেশি। সে কিছুতেই শ্বশুর শাশুড়িকে ফেলে ডিনার করে না। প্রায়ই এটা সেটা রান্না করে। নিজের হাতে টেবিল সাজায়। ঘরোয়া হৃদিকে সামির আগের চাইতে আরো বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। বাড়িটা সুখের মৃদু উত্তাপে ছেয়ে থাকে সারাক্ষণ। মনে হয় ধীরে ধীরে সবকিছু আগে মতো হয়ে যাচ্ছে। ক্ষত শুকোচ্ছে। স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে। বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। মায়ের সাথে হৃদির সম্পর্কটা আগের চাইতে অনেক ভালো। ঘরে একদম হাত পা ছেড়ে বসে না থেকে রোমেলা এই ফাঁকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে নিচ্ছেন। বাড়ির সাজসজ্জা পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন আসবাব আসছে। পুরনো জিনিসপত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের প্ল্যান মাফিক নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে সবকিছু।
৪৯
বাবা হবার সুসংবাদ পাবার দুদিন বাদেই অভিজিৎ বাংলাদেশে এসে হাজির হয়েছিল। বিভাদের গোটা পরিবারে তখন থৈ-থৈ করে সুখের হাওয়া বইছে। রুদ্র ওদের ড্রয়িং রুমে ফ্লোরিং করে চারটা রাত কাটালো। পঞ্চম দিন সকালে নাশতার টেবিলে সে ঘোষণা দিল, ‘আমি চিটাগাং যাচ্ছি। বারোটার সময় বাস।’
বিভা অবাক, ‘আসলি তো মাত্র সেদিন। আজকেই চলে যাবি?’
রুদ্র গম্ভীরভাবে বলল, ‘হুম… হাতে বেশি সময় নাই তো। গোছগাছ করতে হবে।’
‘চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকেই তোমার ডিপার্চার?’ অভিজিতের প্রশ্ন।
রুদ্র মাথা নাড়ে, ‘না ঢাকা থেকে। ফ্লাইট তিন তারিখে। চিটাগাং গিয়ে, সবকিছু গোছগাছ করে, আব্বা আম্মার কাছ থেকে একবারে বিদায় নিয়ে এক তারিখ দুপুরে ঢাকা আসব। সেদিন সন্ধ্যায় অমৃতার ফ্লাইট।’ বিভা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘এটা কেমন কথা রুদ্র? তাহলে আমরা তো তোকে আর পাচ্ছিই না। এক তারিখে কেন, আর কয়েকটা দিন আগে আয় না।
‘নারে… বাসায় থাকা লাগবে। আম্মার এমনিতেই মন খারাপ অনেক।’ বিভা খুব হতাশ হয়ে গেলো, ‘আচ্ছা বুঝলাম… কিন্তু আজকেই যাইস না।’
‘থেকে কী হবে?’ বিষণ্ণ শোনায় রুদ্রর গলা।
‘ও আচ্ছা… এখন থেকেই আমাদেরকে আর ভালো লাগতেছে না, তাই তো? বিদেশে গিয়ে বিদেশি ফ্রেন্ড বানাবা। উইকেন্ডে মদ খাবা… পার্টি করবা… ছোট জামা-কাপড় পরা মেয়ে নিয়ে ছবি তুলবা… বিচে গিয়ে বিকিনি পরা বেটি দেখবা হাঁ করে… এত সুখের মধ্যে আমাদেরকে আর মনে পড়বে কেন?’
রুদ্র নাক মুখ কুঁচকে অভিজিৎকে বলল, ‘আপনার বউরে সামলান তো দাদা। এর মাথাটা পুরাপুরি গেছে।’
আকাশের ফোন এল সেই সময়, রুদ্রর মোবাইলে।
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো দোস্ত, আজকের প্ল্যান কী?’ আকাশের প্রশ্ন। ‘চিটাগাং যাচ্ছি।’
‘ধুর ব্যাটা… কীসের চিটাগাং। আইলি তো মাত্র সেইদিন।’
রুদ্র চুপ। আকাশ বলল, ‘শোন আজকে দুপুরে আমাদের বাসায় তোর দাওয়াত। উনি রান্না করতেছে তোর জন্য। তুই চলে যাচ্ছিস, আবার কবে আসিস ঠিক নাই। এইজন্যে তোরে খাওয়াবে।’
‘উনি’ টা কে দোস্ত?’ এই প্রশ্নের উত্তর জানা আছে রুদ্রর। আকাশ এখনো ঝুমকিকে কোনো সম্বোধন করে না। ‘উনি’
‘এইযে’ এসব দায়সারা সম্বোধন দিয়েই জীবন কাটিয়ে নিচ্ছে। জেনে শুনেও কেন যেন আকাশকে একটু খোঁচা দিতে রুদ্রর ভালো লাগল আজ। আকাশ অপ্রতিভ হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ঘুরিয়ে নিল কথার মোড়, ‘বারোটার দিকে চলে আসিস। সবাই আসবে। আমার বাসায় অবশ্য এতজন জায়গা হবে কি না সন্দেহ। অভিজিৎ বাবু কই? ফোনটা দে, উনারে দাওয়াত দেই।’
রুদ্র অভিজিতের দিকে সেলফোনটা এগিয়ে দিল একটু অন্যমনস্কভাবে। ঝুমকির নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার মতো বুকের পাটা তার হবে না কোনোদিন। সেই কলেজ জীবনে ঝুমকির হাতের রান্নার সাথে পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে বহুবার হোস্টেলের বাজে খাবার খেতে না পেরে ঝুমকির শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ক্যাম্পাসে গণ্ডগোল চলছে, রাজনীতির ধারে কাছে নেই এমন ছেলেদেরকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। রুদ্র ধরপাকড় থেকে গা বাঁচাতে হুট করে গিয়ে হাজির হলো আকাশের বাসায়। ঝুমকি কোমর বেঁধে নেমে গেল রান্নায়। খুব বেশি কিছু নয়, হয়ত একটা ডিম ভাজি, গরম ভাত আর ডাল। হোস্টেল লাইফে এতটুকুই অমৃত বলে মনে হতো। সামির বাসায় না বলে কয়ে বিনা নোটিশে গেলেও রাজকীয় আপ্যায়ন পাওয়া যেত। কাজের লোকরা যা খেতে মন চায় তাইই বানিয়ে দিত অতি স্বল্প সময়ে। কিন্তু ঝুমকির হাতের যত্নটা ছিল অন্যরকম। রুদ্র ঐ খাবারে মা-মা গন্ধ পেত। অথচ আজ ঐ বাসায় যাবার কথা ভাবতেই কেন যেন অস্বস্তিতে কাঁটা দিয়ে উঠছে মন। সৃষ্টিছাড়া এক ভয় ভয় অনুভূতি কাটাকুটি খেলছে বুকে। ভয় পাচ্ছে কেন? ভয় কীসের? তার জীবনটায় তো কোনো সংকট নেই, অপ্রাপ্তি নেই, অভাব অনটন নেই। সে ভালো আছে। খুব ভালো! তবুও ভয়ের ছোবল থেকে নিস্তার নেই কেন? যে মানুষের সাথে চুপিচপি মনের ঘরে রোজ দেখা হয়, সশরীরে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় কী?
বিভা রুদ্রর তমসাচ্ছন্ন অন্যমনা মুখটা পরখ করে। আক্ষেপ নিয়ে বলে, ‘তুই কেমন বদলে যাচ্ছিস রুদ্র। কী হইছে তোর?’
রুদ্র ঘোর ভাঙা চোখে তাকায়। ফ্যাকাশে হাসে। ম্লান সুরে বলে, ‘আমি ঠিক আছি। কুডন’ট বি বেটার।’