স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ৩৫

৩৫

ডাইনিং-এ লোকটা বসে ছিল। দুঃখী মানুষের মতো একা একা চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার সময় সামি চিরাচরিত দৃশ্যটা একঝলক দেখল। একজন গৃহকর্মী সিঁড়ি সংলগ্ন রেলিং-এর ধুলো মুছে নিচ্ছিল ভেজা ন্যাকরা দিয়ে। সামি প্রশ্ন করল, ‘মা কোথায়?’

‘ম্যাডাম তো বাইরে।’

‘কখন বেরিয়েছে?’

‘তা ঠিক জানি না ভাইয়া।’

সামি নিজের ঘরে এসে গোসল সেরে নিল। ব্যান্ডেজ খোলার পর ক্ষতস্থান লালচে হয়ে আছে। ব্যথা আছে অল্প। তেমন গুরুতর কিছু নয়। কয়েকদিনের ভেতরেই এই দাগ এবং ব্যথা মুছে যাবার কথা। ঘরটা আজকাল বেশ অগোছালো হয়ে থাকে। কাজের লোকরা শুধু মেঝে ঝাড়পৌঁছ করে চলে যায়। আনুষঙ্গিক গোছগাছ করে না। হৃদি থাকলে ঘরের চেহারা অন্যরকম থাকে। প্রয়োজনীয় জিনিস হাতের কাছে পাওয়া যায়। আসবাবপত্রর মুখ চকচক করে। জামা-কাপড় থাকে ইস্ত্রি করা, টান টান, গোছানো। বাথরুমের ফ্লোর ঝকঝকে পরিষ্কার। কাজের লোকরা বেডরুমে ঢুকে ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিক, গোছগাছ করুক, এই ব্যাপারটা হৃদির বরাবরই অপছন্দ। সে নিজ হাতে সংসারের কাজ করতে ভালোবাসে। তাই হৃদির অনুপস্থিতির এই কটা দিন সামি বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল বেডরুমের জিনিসপত্রে যেন কেউ হাত না লাগায়।

দরজায় টোকা পড়ছিল। খুলতেই একজন ভৃত্য বলল, ‘ভাইয়া স্যারে আপনারে ডাকে।’

অজান্তেই সামির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। লোকটার সমস্যা কী? রোজ একবার করে ডাক পাঠায় কেন? ক্রমাগত প্রত্যাখ্যাত হতে কি তার সম্মানে বাধে না? বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে যায় সামির। বিরক্তি চাপা দেয়ার চেষ্টা করে সহজ গলায় বলে, ‘আসছি।’ নিজের মুখ নিঃসৃত শব্দটা শুনতে পেয়ে নিজেই ভীষণ চমকে উঠল সামি। সত্যিই কি সে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে? চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে? ওই মুখের দিকে তাকালে আজ যাকে দেখতে পাবে সে আসলে কে? কী তার আসল পরিচয়? সামির জন্মদাতা পিতা? গর্ভধারিণী মায়ের স্বামী? নাকি বন্ধুর প্রেমিক?

ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি। খেতে ইচ্ছেও করছে না। আকাশের বাসায় ভরপেট চা নাশতা খেয়েছে। বারান্দায় এসে সিগারেট ধরাল। ঘরের ভেতর আলো জ্বলছিল। সামি মাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখল। দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছিল। সিগারেটটা দ্রুত ছুড়ে ফেলল দূরে।

ছেলের ক্ষতবিক্ষত আহত মুখ দেখে কেঁদে ফেললেন রোমেলা। তিনি বাইরের পোশাক ছাড়েননি এখনো। পরনে দামী জামদানী শাড়ি। পারফিউমের সুঘ্রাণ ছেঁকে ধরেছে শরীর। মুখে কড়া প্রসাধনী। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তোমাকে বলেছিলাম ঐ বখাটে ছেলে-মেয়েগুলোর সাথে মেলামেশা না করতে। শুনলে না আমার কথা। এখন দেখলে তো পরিণতি?’

সামি বিস্মিত হলো। বন্ধুদের সাথে চট্টগ্রাম গিয়েছিল এই খবর মায়ের জানার কথা না। মাকে বলেছিল বিপ্লবের গ্রামের বাড়ি যাবে। তারমানে মা হৃদির কাছ থেকে সবটাই শুনেছে। সামি মায়ের কথায় কোন প্রত্যুত্তর করল না। অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইল বিছানার ওপর। রোমেলা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘এখন কেমন আছ? ডাক্তার কী বলেছে?’

‘আমি একদম ঠিক আছি। চিন্তার কিছু নেই মা।’ ম্লান শোনাল সামির কণ্ঠস্বর।

রোমেলা ছেলের পাশে বসে বললেন, ‘চিটাগাং কেন গিয়েছিলে?’

‘রুদ্রর বাসায় গিয়েছিলাম। ও আগামী মাসে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’

‘আমাকে মিথ্যে বলেছিলে কেন?’

সামির মুখটা আরো অনেকখানি ঝুঁকে যায় নিচের দিকে। অপরাধবোধে টনটন করে বুক। চুপ করে থাকে। রোমেলা কাঁপা গলায় বললেন, ‘এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরেও তুমি বাজে ছেলে-মেয়েগুলোর সঙ্গ ছাড়তে পারলে না। আমি ভেবেছিলাম এবার অন্তত তুমি তোমার ভুল বুঝতে পারবে।’

‘ভুল’ বলতে মা ঠিক কী বোঝাতে চায় সামির তা বোধগম্য হয় না। এত বছরের বন্ধুত্ব, মনের টান, বোঝাপড়া… এর সমস্তটাই কি ভুল? আগে বন্ধুদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে ক্রোধে ঝলসে উঠে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। উল্টো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। আজ সেই প্রতিবাদ বা প্রশংসার জায়গাটা বড্ড দুর্বল। কিছু বলার মতো মুখ নেই। যে বন্ধুদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল, শর্তহীনভাবে মনের অনেকটা জুড়ে স্থান দিয়েছিল, সেই বন্ধুরাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করে ছাড়ল। সামির তাই আজ প্রতিবাদ করার মতো কোনো ভাষা নেই, সাহস নেই। এক বুকভর্তি গ্লানির বোঝা নিয়ে সে নতমুখে বসে থাকে। বুকের ভেতর ভাংচুর হয়। বোবা কষ্টে দম আটকে আসে। ঘেন্না হয় নিজের প্রতি। মায়ের সম্মানটুকুও সে বজায় রাখতে পারল না। ছাড়তে পারল না সেইসব প্রতারক বন্ধুদের সঙ্গ, যারা তার সুন্দর সাজানো পরিবারটাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। হঠাৎ অন্যরকম একটা প্রশ্ন এসে ভিড় করল মাথায়। মায়ের চোখের দিকে চেয়ে সামি স্পষ্ট গলায় জানতে চায়, ‘আচ্ছা মা… বাবাকে তুমি এখনো ভালোবাসো?’

রোমেলার চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুখে স্থবিরতা। ঠোঁটে কম্পন। মনে পড়ল সামি এর আগেও প্রশ্নটি করেছিল একবার। তখন বললেন, পাশকাটানো উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। আজ এতদিন পর, আবারও সেই একই প্রশ্ন কেন? তিনি ছেলের মাথার ওপর একটা হাত রেখে কম্পিত কণ্ঠে ‘তোমাকে তো বলেছি আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। সবকিছু ঠিক আছে। ঐ নষ্ট, বেহায়া মেয়েটা কয়েকদিন একটু ফষ্টিনষ্টি করে কয়টা গয়নাগাঁটি, পয়সা কড়ি বাগিয়ে নিতে চেয়েছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু করার সাধ্য ওর নেই।’ সামি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিল। মাকে কে বোঝাবে অমৃতার গয়নাগাটি, টাকা কড়ির প্রতি কোনো কালেই লোভ ছিল না। মাকে কে বোঝাবে যে এখনো… হ্যাঁ, এতকিছুর পরেও অমৃতাকে কেউ নষ্ট মেয়ে বললে সামির কষ্ট হয়।

নিচে লোকটা তার জন্য অপেক্ষা করছে। রোজ অপেক্ষা করে থাকে! সামি অস্থিরভাবে উঠে পড়ে বসা থেকে। বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। রোমেলা পেছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

সামি ম্লান গলায় দায়সারা উত্তর দেয়, ‘একটু হেঁটে আসি মা। ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।’

লিভিং রুমে মানুষটা বসে ছিল। সামি একটু থমকে দাঁড়ায়। চোখে চোখ পড়ে। অভিমানের বাষ্পে ভরে ওঠে সামির বুক। শ্বাসনালীতে আটকে যায় বাতাস। শিরদাঁড়ায় একটা বিশ্রী কাঁপন ওঠে। মানুষটা পুত্রের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ভয় পাবার লোক সে নয়। তবুও আজ তার চোখের তারায় একটু যেন ভয়ের আভাস উঁকিঝুকি দেয়। সামি বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। চট করে সরে পড়ে জায়গাটা থেকে। বেরিয়ে আসে বাড়ি ছেড়ে। বাইরে গুমোট রাত। বাতাসের কোনো অস্তিত্ব নেই। জ্বলন্ত চুল্লির মতো উত্তপ্ত চারপাশ। সামির শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি। চোখ জ্বালা করছে। হাতে পায়ে ম্যাজম্যাজ ভাব। মাথার মধ্যে কিলবিল করছে সহস্র দুশ্চিন্তার পোকা। মনে হচ্ছে ঘুমোতে পারলে বেঁচে যেত। কিন্তু বিছানা টানছে না। পাগল পাগল লাগছে। কোথায় যাবে? কোথায় গেলে দুদণ্ড শান্তি পাবে?

গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে যানজটের শহরে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় রোজকার মতোই হাজার মানুষ। গাড়ি, রিকশা, সিএনজিতে ঠেসে আছে রাজপথ। বাসের গায়ে বাঁদরের মতো ঝুলছে লোকে। অযথা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছে। কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে অন্ধের মতো ছুটে চলেছে। ফুটপাতে হাঁটছে ভিখিরির দল। অনেকটা সময় নিরুদ্দেশ ঘুরে বেড়ালো সামি। মাথা ধরে গেল। শরীরজুড়ে অবসাদ। দশটার দিকে আকাশের বাসার নিচে এসে অস্থির হয়ে ফোন করল ওর নম্বরে, ‘নিচে নাম।

আকাশ একটু ঘাবড়ে গেল, ‘কী হইছে তোর? সব ঠিক আছে তো?’

‘কিছুই ঠিক নাই। তুই নিচে নাম।’

আকাশ তড়িঘড়ি করে পায়ে চপ্পল গলিয়ে নিচে নেমে এলো। গেটের সামনেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামি আদেশ দিল, ‘উঠে পড়।’

আকাশ কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠল। দৌড়ে এসেছে বলে হাঁফ ধরে গেছে ওর। বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে বলল, ‘কাহিনি কী? ‘

সামি কিছু বলল না। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে অন্ধকার গলিটা থেকে বেরিয়ে এল বড় রাস্তায়। আকাশ সামিকে দেখছে। রাস্তার আবছা ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ওর মুখটা পড়ার চেষ্টা করছে। সেই সময় বিভার নম্বর থেকে ফোন এল ওর মোবেইলে। ধরতেই বিভা হড়বড় করে বলল, ‘কী করিস?’

আকাশ আমতা আমতা করল, ‘এইতো। তেমন কিছু না।’

‘কালকে তোর ক্লাস কখন?’

‘বেলা তিনটায়। কেন?’

‘তাহলে তো সকালে উঠার তাড়া নাই। দোস্ত প্রচণ্ড বোর হচ্ছি বাসায় বসে থেকে। চলে আয় না!’

‘আচ্ছা দেখি।’ পাশ কাটানো কথাটা বলে আকাশ ফোন কাটল দ্রুত। সামির দিকে চেয়ে বলল, ‘কী সমস্যা তোর?’

‘বিভা কী বলে?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে সামি।

ওর বাসায় যাইতে বলতেছে।’

সামি এবারেও কিছু বলল না। নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আকাশ ওর পাশে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে বুকের চাপ অনেক খানি কমে গেছে। যেন ডাক্তার এসে এই মাত্র ব্যথা কমার ইনজেকশন পুশ করে গেছে নার্ভে। ধীরেধীরে ব্যথানাশক সেই ওষুধ শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। কমিয়ে আনছে যন্ত্রণা।

বিভার বাসায় দারুণ হুলুস্থুল কাণ্ড। একগাদা অতিথিতে গমগম করছে চারপাশ। দুই বন্ধু এই এত এত মানুষের ভেতরে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে বোকা বনে গেল একদম। বিভা বন্ধুদের আড়ালে ডেকে বলল, ‘দ্যাখ কর্নারের সোফায় যে মেয়েটা বসে আছে, ওর নাম সেতু। মাস্টার্স করছে এন এস ইউতে। মায়ের বান্ধবীর মেয়ে।’

বন্ধুরা যার-পর-নাই বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তো আমরা কী করব?’

বিভা ফিসফিস করল, ‘আকাশের সাথে মানাবে!’

‘মানে কী? তুই আমাকে এইজন্যে ডেকে আনছিস?’ আকাশ অবাক।

বিভা জমানো গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, এইজন্যেই। আজকে হুট করে চলে আসল ওরা। আমি ভাবলাম তোর সাথে পরিচয় করায় দেই। এমন সুযোগ তো সব সময় হয় না। এত লম্বা জার্নি করে চিটাগাং থেকে ঢাকা আসলাম। আমি প্রচণ্ড টায়ার্ড। তবুও ভাবলাম তোর একটা গতি হোক।’

সুন্দরী মেয়েদের সাথে পরিচিত হতে আকাশের কখনই কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সামির মুখের দিকে চেয়ে বিভার প্রস্তাব গ্রহণ করতে সাহস হলো না তার। কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘মাইয়াটার ফোন নাম্বার দিয়ে রাখ। পরে কথা বলব।’

সামি আকাশের কাঁধে হাত রাখল, ‘সমস্যা নাই। তুই কথা বল মেয়েটার সাথে। আমি এখন আসি।’ কথাটা ছুড়ে দিয়েই সামি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে এল বিভার ফ্ল্যাট থেকে। বিভা পেছন পেছন দৌড়ে এলো, ‘মাত্র তো আসলি। একটু বসে গেলেই পারতি।’

সামি মাথা নাড়ল, ‘আজকে না দোস্ত। পরে আসব আবার।’

বিভাদের বাসা থেকে সামি সরাসরি চলে এল শ্বশুরবাড়ি। দরজা খুলল কাজের মেয়ে। এই মেয়ে নতুন এসেছে। সামিকে চেনে না। দরজা খুলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। সামি কোনো কথা না বলে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে গেল ভেতরে। ডাইনিং-এ শাশুড়ির মুখোমুখি পড়ে গেল। সালাম দিয়ে বলল, ‘আম্মা কেমন আছেন? হৃদি কোথায়?’

‘ওর ঘরেই আছে। তুমি খাওনি তো রাতে তাই না? আমি খাবার দিচ্ছি। এসো খাবে।

‘আমার খিদে নেই। আপনি ঝামেলা করবেন না প্লিজ।’

হৃদির বেডরুমের দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ঘরের ভেতরটা টিউবলাইটের সাদা আলোয় ঝলমল করছে। হৃদি ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে আছে। সাদা টপ আর হলুদ ঘের ওয়ালা স্কার্ট তার পরনে। চুলে বড়সড় খোঁপা। সামির আচমকা আগমন তাকে চমকে দিয়েছে। চমকটা ভারী মধুর! যেন ভালোলাগার দমকা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে গেছে এইমাত্র। ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘কীরে? কী চাই?’

সামির মুখে হাসি নেই। অবিন্যস্ত চুল। লালচে চোখ। পরনে কুঁচকানো টিশার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে সে অস্ফুটে বলল, ‘আমার কিছু ভালো লাগতেছে না!’

হৃদির বুকটা কেঁপে উঠল অনির্ণেয় শঙ্কায়। ল্যাপটপ একদিকে সরিয়ে রেখে সামির সামনে এসে দাঁড়ালো সে। কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী হইছে?’

সামি চোখ রাখল হৃদির চোখে। গভীর শূন্যতায় ভরা দিশাহারা দুটি চোখের দৃষ্টি হৃদির অন্তরাত্মায় নাড়া দিয়ে গেল। সে ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? তুই এমন মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না। কষ্ট হয়।

সামি কেমন সম্মোহিত গলায় বলে, ‘আমাদের মধ্যে কি কখনো কোনো তৃতীয় ব্যক্তি আসবে হৃদি? আমরা কি কখনো কমিটমেন্ট ব্রেক করব?’

হৃদি আঁতকে উঠে সামির মুখে আঙুল চেপে ধরে। রুদ্ধস্বরে বলে, ‘তার আগে যেন আমি মরে যাই!’

‘আমার ভীষণ ভয় হয় জানিস? আজকাল আমার কাউকে বিশ্বাস হয় না! নিজেকেও না!’

‘আমাকে বিশ্বাস কর সামি! আমি তোকে ভালোবাসি। ভালোবাসব সব সময়!’

‘যদি এই ভালোবাসা বদলে যায়? যদি আজ থেকে অনেক বছর পর হঠাৎ একদিন তোর মনে হয় আমাকে তুই কোনোদিন ভালোবাসিস নাই?’

হৃদি কেঁদে ফেলে, ‘এসব অশুভ কথা কেন বলতেছিস সামি? খুব খারাপ লাগতেছে শুনতে। প্লিজ এসব কথা আর কোনোদিন বলবি না! আমাদের মধ্যে কখনো অন্য কেউ আসবে না। এসব বাজে কথা ভাববি না।’

‘আমার বাবা মাও কি কখনো ভাবছিল একদিন এমন দিন আসবে? আমিও কি ভাবছিলাম বল?’

ভয়াবহ হতাশ শোনায় সামির কণ্ঠস্বর। ওর মাথাটা বুকে টেনে নেয় হৃদি। কম্পিত চাপা স্বরে বলে, ‘আমাদের মধ্যে কখনো বিচ্ছেদ আসবে না! আমি তোকে বিশ্বাস করি। নিজেকেও বিশ্বাস করি। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের ভালোবাসায় আমার বিশ্বাস আছে। থাকবে আজীবন।’

সামি চুপ করে থাকে। মুখ ডুবিয়ে রাখে হৃদির উষ্ণ, কোমল, সুগন্ধী বুকে। মনের আগুন নিভু নিভু হয়ে আসে। ক্লান্তিতে বুজে আসে চোখ। হঠাৎ মাথা তুলে সে বলে, ‘আজ রাতটা এখানেই থাকি। কী বলিস?’

হৃদি খুশি হয়, ‘হ্যাঁ থাক। মা তো প্রতিদিন কমপ্লেইন করে তুই আমাদের বাসায় থাকতেই চাস না। জামাই এসে থাকবে বলে বাবা আমার ঘরে নতুন এসি লাগিয়ে দিল। বাথরুম রেনোভেট করল। কিন্তু তোর টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় না।’

সামি শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। ফ্যাকাশে গলায় বলল, ‘লাইট অফ কর। ঘুম আসতেছে। আম্মাকে বলিস রাতে কিছু খাব না।’

‘মা নিশ্চয়ই এতক্ষণে টেবিল রেডি করে ফেলেছে। আচ্ছা সমস্যা নেই। তুই ঘুমা। আমি একটু কাজ করতেছিলাম। কাজটা শেষ করে আসছি কেমন?’ ল্যাপটপ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল হৃদি। সামি কেমন অন্যরকম গলায় বলল, ‘কাজ পরে করিস। এখন এইদিকে আয়। আমার কাছে…।’

হৃদি দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো। ল্যাপটপ নামিয়ে রাখল টেবিলে। বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল সামির পাশে। সামি ওকে জড়িয়ে ধরল কোল বালিশের মতো। কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে যাস না কখনো। কেমন?

হৃদির চোখের কোল ভিজে উঠল লোনা জলে। অস্ফুটে বলল, ‘কখনো কোথাও যাব না তোকে ছেড়ে।’

সামির ঠোঁট চিরে নিশ্চিন্ত একটা হাসি ফুটে উঠল। ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। হৃদির কানে আর ঘাড়ে ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝাপটা এসে লাগতে লাগল। নিঃশ্বাসে কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। কানে লাগছে খুব। সামি ডান পা টা ওর গায়ের ওপর তুলে দিয়েছে। লম্বা চওড়া শক্ত- সমর্থ যুবক পুরুষের হাড়েরও আলাদা ওজন আছে। ওই একটা পায়ের ওজন বহন করতেই হৃদির কষ্ট হচ্ছিল খুব। তবুও এক ফোঁটা নড়ল না সে। স্ট্যাচু হয়ে রইল। নড়লেই সামির ঘুম ভেঙে যাবে। বেচারা একটু ঘুমাক আরাম করে।

৩৬

মেয়েটির মাথায় ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল। দারুণ ফর্সা। ডান গালে একটা মস্ত বড় লালচে ব্রণ। সবুজ রঙের গাউন লম্বা ছিপছিপে শরীরে মানিয়েছে বেশ। বিভার বেডরুমে মেয়েটির সাথে আলাপ হলো আকাশের। কথাবার্তার ধরন দেখে বোঝা যায় বড়লোকের আহ্লাদি মেয়ে। আক্কেল নামক জিনিসটা বিভার ঘটে কোনোদিন ছিল না, থাকবেও না কখনো। থাকলে বুঝত এই ধনীর দুলালী আকাশের মতো চালচুলোহীন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের সাথে কখনই প্রেম করবে না। তাছাড়া মেয়েটি কথা বলে নাকি সুরে। প্রতিটা শব্দে একটি চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়ে যায়। এই যেমন এখন বলছে,

‘আঁপনার ভার্সিটিতে আঁমার এক কাজিন পঁড়ে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে।’ আকাশ এমন অদ্ভুত গলার স্বর আগে কখনো শোনেনি। সে একটু থতোমতো খেয়ে গেছে। মিনমিন করে বলল, ‘তাই নাকি?’

‘জি। আমার সেই কাজিন কিন্তু ফেসবুক সেলিব্রিটি। আঁপনি হয়ত চিনবেন।’

‘আমি আসলে ফেসবুকে অতটা একটিভ নই।’

‘বলেন কী? ইন্সটাতে আঁছেন?’

‘জি না। আমি সোশ্যাল মিডিয়া যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি।’

মেয়েটা খুব অবাক হয়, ‘কেঁন?’

আকাশের হঠাৎ মনে পড়ল ছোটবেলায় মা পেত্নির গল্প বলতেন।

পেত্নিরা নাকি সুরে কথা বলে। এই মেয়ে তো মানুষ, কিন্তু কথা বলছে পেত্নির মতো। ঘটনা কী? বিভা কেটে পড়েছে। ঘরের দরজাটা অর্ধেক ভেজানো। ফাঁকা দিয়ে ডাইনিং-এর অল্প-বিস্তর অংশ দেখা যাচ্ছে। সেখানেও বিভাকে দেখা যাচ্ছে না। আকাশ বিরক্তবোধ করল। সেই সাথে একটি ক্ষীণ বিস্ময়ের অনুভূতি তার চেতনায় ঠকঠক কড়া নেড়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। কিছুদিন আগেও একজন সুন্দরী রমণীর সান্নিধ্য ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন বিনোদনগুলোর একটি। সুন্দর মেয়ে দেখতে কার না ভালো লাগে? আকাশেরও লাগত। কোনো সুন্দর মেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই স্বর্গীয় ঘ্রাণ এসে ধাক্কা দিত বুকে। আজ হঠাৎ বিস্মিত আকাশ আবিষ্কার করল তার সেই পুরনো মনটা হারিয়ে গেছে। সামনে উপনীত মেয়েটিকে দেখতে তার খারাপ লাগছে তা নয়, তবে মনের গভীরে কে যেন রেড সিগন্যাল জ্বালিয়ে বলছে, অযথা সময় নষ্ট করো না। বাড়ি ফিরে যাও। কত কাজ! একটা বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে। আজকাল প্রায়ই কথাটা মনে হয়… কত কাজ! অথচ তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আকাশের আছে কি? বাড়ি ফিরে কী করবে? ঘুমানো ছাড়া আজ আর কোনো বিশেষ কাজ নেই তো! তবুও কেন যেন শব্দ দুটো অষ্টপ্রহর কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করতে থাকে… কত কাজ! …কত কাজ!

তারার বিয়ের কথা মনে পড়ে আকাশের। এ মাসের শেষের দিকে তারিখ পড়েছে। মেয়েটির আপনজন বলতে কেউ নেই। নানার বাড়ির লোকগুলো আস্ত একেকটা চামার। বিয়ের খরচার ভার আকাশকেই নিতে হবে। ব্যাংকে কিছু টাকা জমেছিল। লাখ খানেক। সেই টাকাতেই হাত দিতে হবে। অনেকদিনের খাটুনির সঞ্চয়। ডিপিএসটা ভেঙে ফেলতে কষ্ট হবে আকাশের। কিন্তু কিছু করার নেই। নিজের একটা ছোট বোন থাকলে এতটুকু করতে নিশ্চয়ই গায়ে লাগত না। তারাও তো ওর ছোটবোন। বোনের জন্য অল্প-বিস্তর ত্যাগ স্বীকার করাই যায়। এদিকে আজ সকাল থেকে পিতৃদেবের বুকে ব্যথা। মেডিক্যাল চেকআপ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। লোকটা কখনই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। বয়স বাড়ছে, অথচ শরীরের প্রতি কোনো যত্ন নেই। নির্বোধ লোকটা গোটা জীবন পার করে দিচ্ছে অযত্নে, অবহেলায়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতায়। আকাশ ক্রমেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা ওকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?’

আকাশ উঠে পড়ল। বিনীত গলায় বলল, ‘হঠাৎ একটা কাজ মনে পড়ে গেল। আসছি আমি।’

সেতুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল আকাশ। বিভাকে ড্রয়িং, ডাইনিং কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বিভার মা ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলেন অতিথিদের সাথে। আকাশকে এদিক-সেদিক উঁকি দিতে দেখে বললেন, ‘তোমার ফ্রেন্ড আমার ঘরে আছে। জামাইয়ের সাথে কথা বলছে ফোনে। তুমি বসো। ডিনার করে যেও আমাদের সাথে।’

আকাশ হাতঘড়িটা দেখল একবার, ‘না আন্টি। অন্য একদিন। বিভা ব্যস্ত আছে, ওকে আর ডিস্টার্ব না করি। আজ আসি।’

অন্ধকার গলিতে রিকশাটা ঢোকে টুংটাং ঘণ্টা বাজিয়ে। অজান্তেই ছয়তলার ছাদের ওপর চোখ চলে যায়। একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। রোজ অনেক রাত পর্যন্ত মনীষা ছাদের রেলিং-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশ দেখে। গুনগুন করে গায়। আকাশের মনে পড়ল মনীষাও চলে যাবে কদিন বাদে। ওর বদমাশ দুর্বৃত্ত বর এই বাসার ঠিকানা জেনে গেছে। অফিসের ঠিকানাও জেনে গেছে। যেকোনো দিন জামিনে ছাড়া পেয়ে ছুটে আসবে। নেশা করার জন্য টাকা চাইবে। না দিলে মারধর করে অন ঘটাবে। সেই ভয়ে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে মনীষা। ঠিকানাও বদলে ফেলতে চাইছে খুব দ্রুত। চিন্তিত ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে আকাশ। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে একটু থমকে দাঁড়ায়। আর এক সিঁড়ি ওপরে উঠলেই মনীষার চিলেকোঠা। একবার যাবে কি? কিন্তু কেন? কোনো প্রয়োজন তো নেই! কলিংবেলে আঙুল চেপে ধরে আকাশ। দরজা খুলে দেয় তারা। ব্যস্ত গলায় বলে, ‘টেবিলে খাবার রাখা আছে ভাইয়া। গরম করে দেব?’

ভেতরে ঢুকে পায়ের স্যান্ডেলজোড়া খুলে রাখে আকাশ। স্মিত কণ্ঠে বলে, ‘দাও।’

আকাশ লক্ষ্য করল তারার চোখে নতুন চশমার ফ্রেম। আগের মতো বিশাল মোটা নয়, রিমলেস পাতলা কাচের চশমা। এই চশমা যেন মেয়েটির মুখের আদলই পালটে দিয়েছে। চোখদুটো আগের চাইতে প্রকাশ্য এবং সতেজ। শুধু এটুকুই নয়, আকাশের মনে হলো মেয়েটির মুখে সুখের একটা চাপা দীপ্তি এসে জুড়েছে। বিষণ্ন-মলিন ভাবটা নেই। মুখের ত্বকের কালচে ভাবটাও গায়েব। এই পরিবর্তন ভালো লাগল আকাশের। স্বস্তির সুবাতাস বয়ে গেল বুকের ওপর দিয়ে। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করছে না। পাত্র তার পছন্দ হয়েছে। সেই পছন্দের রেশ পড়েছে তার মনে। মনই তো মানুষের মূল সৌন্দর্যের আধার। মন ভালো থাকলে, সুন্দর থাকলে, বাহ্যিক চেহারায়ও সেই রূপের ছাপ পড়ে।

নিজের ঘরে ঢুকতেই রুদ্রকে মনে পড়ল। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে রুদ্র তার রুমমেট ছিল। আজকে ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেলফোন বের করে রুদ্রর নাম্বারে ডায়াল করতে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো, কী লাভ ফোন করে? দুদিন পর তো দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছে। ভাবতে গিয়ে বুকটা কেমন খাঁ-খাঁ করে। বড্ড একা লাগে! রুদ্র ছিল ওর ক্রাইম পার্টনার। আজ রুদ্রটা পাশে ছিল না বলেই বিভার বাসায় সেই মেয়েটির সাথে আড্ডা জমেনি। রুদ্র থাকলে হাজারটা ফাজিল কথা বলে পেটে হাসির খিল ধরিয়ে দিত। তারা দরজায় এসে দাঁড়ায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘খাবার দেয়া হয়েছে ভাইয়া।’

কথাটা বলেই সরে আসে সে। সেলফোনটা বেজে যাচ্ছিল ক্রমাগত। রাব্বির ফোন। ফোনটা সুইচড অফ করে দিল। লোকটার কথা শুনলে মাথা ধরে যায়। ড্রয়িংরুমে এসে একটা গল্পের বই খুলে বসল সে। আজকাল বই পড়তে আগের চাইতেও বেশি ভালো লাগে। জাদুকরের মায়াজাদুতে তার কুৎসিত ভুবনটা নন্দন কাননে রূপান্তরিত হয়েছে। দমচাপা ভ্যাপসা গরমের রাতগুলোতে একা একা জেগে থেকে জাদুকরের কথা ভাবতে তার ভালো লাগে। খাবারদাবারে স্বাদ ফিরে এসেছে। আজকাল তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে সে। এমনকি আয়নার সামনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতেও দারুণ লাগে! খুঁতগুলো চোখে পড়ে না… বরং শরীরটা আগের চাইতে অনেক ভরন্ত বলে মনে হয়। বুকে গোপন শিহরন নিয়ে সে নিজের ভেতর নারীত্বের এক নতুন বিকাশ টের পায়। কে যেন পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে, একটুও কুৎসিত নও তুমি। তোমার মধ্যে আছে শান্তি… আছে আরাম… এমনটাই তো বলেছিল সে! এসব মন কেমন করা স্নিগ্ধ সব অনুভূতির মধ্যে হঠাৎ বিমর্ষতা এসে হানা দেয়। মনে পড়ে… তার সাথে হয়ত আর কোনোদিন দেখা হবে না। সে চলে যাবে আটলান্টিকের ওপারে। তারার বিয়ে হবে রাব্বির সাথে। সংসার হবে। হয়ত একদিন কোলজুড়ে দুনিয়া আলো করে আসবে ফুটফুটে শিশু। সেদিনও জাদুকরকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। একা হলেই জাদুকরের জন্য মন কেমন করবে। জাদুকর তাকে মনে রাখেনি বলে, কখনো একটু ভালোবাসেনি বলে অভিমানের বাষ্পে ভরে থাকবে বুক। কোলের শিশুটিকে একদিন হয়ত সে জাদুকরের গল্প শোনাবে। জানো? এক দেশে ছিল এক মস্ত জাদুকর। মানুষের অন্ধকার মুখে মায়াজাদু দিয়ে হাসির আলো ছড়ানো ছিল সেই জাদুকরের কাজ। চোখের সামনের অক্ষরগুলো নিমেষেই কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করে। অস্থির বাতাস আটকে থাকে শ্বাসনালীতে। বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা ব্রেসলেট একবার আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় তারা। চোখের কার্নিশ টপকে গালে নেমে আসে এক ফোঁটা জল।

৩৭

বেডরুমে ফিরে এসে আকাশকে না পেয়ে মনটা খারাপ হলো বিভার। যাবার সময় একবার বলেও গেল না। তার বন্ধুগুলো কেমন পালটে যাচ্ছে দিনকে দিন। আকাশের নম্বরে ডায়াল করল। একবার রিং পড়তেই ওপাশ থেকে ভেসে এল শব্দটা, ‘হ্যালো!’

‘অ্যাই হারামজাদা! চইলা গেলি ক্যান?’

আকাশ ভাত চিবোতে চিবোতে অস্পষ্টভাবে বলল, ‘তোরে তো খুঁজলাম আসার আগে। পাইলাম নাতো।’

‘সেতুকে কেমন লাগল?’

‘কেমন যেন… অদ্ভুত!’

‘অদ্ভুতের কী আছে?’

‘কথা বলে নাকিসুরে। পেত্নির মতো।’

‘পেত্নির কথা তুই জীবনে কখনো শুনছিস?’

‘আজকে শুনলাম।’

বিভা শ্বাস ফেলল বড় করে, ‘কাউরেই পছন্দ হয় না তোদের। সমস্যা কী আসলে? এরকম করলে সারাজীবন সিঙ্গেল থাকতে হবে। গতি হবে না। রুদ্রটারও একই অবস্থা। ফাইজলামি করতে করতে তোদের লাইফ চলে যাবে। সিরিয়াস রিলেশন হবে না।’

‘সিঙ্গেল থাকতে তো খারাপ লাগতেছে না। বেশ ভালো আছি। সিরিয়াস রিলেশনের দরকার নাই। তুই আমাদের ব্যাচেলার লাইফকে এত হিংসা করতেছিস ক্যান?’

‘মেয়েটা তো বেশ সুন্দর। তোর পছন্দ হইল না ক্যান?’

‘সুন্দর হলেই পছন্দ হতে হবে এমন কোনো কথা আছে? আজিব!’ বিভা গভীর হতাশা নিয়ে বলে, ‘তাহলে কী হবে আকাশ? তোর কি কখনো বিয়ে হবে না?’

আকাশ হেসে ফেলল, ‘আমার এখনো তিরিশ বছর হয় নাই মামা। এমনভাবে বলতেছিস যেন বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিয়ে টিয়ে নিয়ে আমি এখন ভাবতেছি না। বিয়ে করব কি না কখনো সেটারও নিশ্চয়তা নাই।’

‘কিন্তু তোর মা তো খুব দুশ্চিন্তা করতেছে। সেদিন বলল এই বছরই তোকে বিয়ে দিতে চায়। আমরা যেন পাত্রী দেখি।’

আকাশ একটু থমকে গেল। ‘তোর মা’ বলতে বিভা কাকে ইঙ্গিত করেছে আকাশ তা জানে। জানার পরেও অস্বস্তি হলো। বিরক্তির ঢেউ এসে লাগল বুকে। ঝুমকি তার বাবার স্ত্রী। মা নয় তো! একটু ঝাঁজ নিয়ে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কী আছে?’

‘মায়েদের কাজই হলো দুশ্চিন্তা করা।

‘হুম… আচ্ছা শোন… ভাত খাইতেছি। পরে কথা বলব নে।’

‘ফোন রাখার জন্য এত পাগল হইছিস ক্যান?’

‘কইলাম তো ভাত খাইতেছি।’

‘ভাত খাইতে খাইতে কি কথা বলা যায় না? তোরা সব কেমন জানি হয়ে গেছিস। ধুর… আজাইরা। ঠিক আছে রাখি!’

‘রাগ করতেছসি কেন?’

‘তোরা আমাকে আর ভালোবাসিস না।’

‘হুম…’

‘হুম মানে?’ ধমকে ওঠে বিভা।

‘কী সমস্যা? পাগলামি করতেছিস কেন?’ দায়সারাভাবে বলে আকাশ। ‘কোনো সমস্যা নাই। রাখি।’

ফোন কেটে দেয় বিভা। মেজাজ খিঁচড়ে থাকে। অতিথিরা চলে গেছে। পাশের ঘরে বাবা ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। ঘড়িতে রাত এগারোটা। বিভা রোজকার নিয়ম অনুযায়ী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্লিনজার ঘষে মুখের প্রসাধন মুছে নেয়। নাইট-ক্রিম লাগায়। চুলে তেল দেয়। ইদানীং প্রতি রাতে মাথায় তেল দিয়ে ঘুমায়। সকালে স্নানের সময় শ্যাম্পু করে ফেলে। এতে চুলের স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হচ্ছে। ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ হবার আগেই মা এসে পড়ে। এবার সারারাত ধরে মা মেয়েতে ফুসুর ফাসুর কত গল্প যে হবে! একটা বয়সের পর মেয়েদের মায়ের চেয়ে আপন বন্ধু বোধহয় আর হয় না। আজকে মা খুব অদ্ভুত একটা কথা বলল।

‘তোদের জেনারেশনটাকে আমি ঠিক বুঝি না। আচ্ছা সামির সাথে তো তোর এক সময় প্রেম ছিল। এখন ওর সাথে বন্ধু হিসেবে মেলামেশা করতে অস্বস্তি হয় না?’

বিভা চমকে উঠেছিল মনে মনে। গা শিউরে ওঠা প্রশ্নটা কিছুক্ষণের জন্য তার ভাবনার সমস্ত তরঙ্গকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। একটু চুপ করে থেকে সে ধীর গলায় বলল, ‘নাহ… একটা ফোঁটাও অস্বস্তি হয় না। এখন সামির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনেই পড়ে না যে এককালে ও আমার প্রেমিক ছিল। আমাদের বন্ধুত্বে কোনো খাদ নেই মা। কোনো পাপবোধ নেই। আরেকটা বিষয় কী জানো?’

বাতাসে রহস্যের গন্ধ পেয়ে মায়ের গলার স্বর জমে যায়। ভারী উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী?’

বিভা অন্ধকারে মিটমিট করে হাসে। লঘু গলায় বলে, ‘প্রেমিক হিসেবে সামিকে যতটা ভালোবেসেছিলাম, তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম বন্ধু হিসেবে। আমি জানতাম, প্রেম চলে গেলেও, বন্ধুত্ব কখনো যাবে না।’

মা বিভার গায়ের ওপর আলতো করে হাত রেখে প্রশ্ন করে, ‘হ্যাঁরে, অভিজিতের সাথে তোর বনিবনা হয় তো ঠিকমতো?’

‘না হলে কী করবে? কী করার আছে বলো তো?’

‘অলক্ষুণে কথা বলিস না বিভা!’

‘অভিজিৎ ভীষণ ভালো মানুষ। এত ভালো হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। একটু অভিযোগ করার জায়গা না থাকলে দাম্পত্য জীবনটা ঠিক জমে না মা।’

‘তোর এসব পাগলামো আর গেল না। মানুষ একটা ঝামেলাবিহীন জীবনের জন্য মাথা কুটে মরছে। আর তুই সবকিছু পেয়েও অবহেলা করছিস।’

বিভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অবহেলা নয়, তবে মাঝে মাঝে একটু একঘেয়ে লাগে বৈকি। বিভার জীবনটা বড্ড সাজানো-গোছানো, বড্ড পরিপাটি। স্বামীর উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি। খোলা আকাশ, পাহাড়, নদী ঘেরা ছবির মতো সুন্দর গ্রামের সুন্দর কোয়ার্টারে তার বাস। সেখানে গৃহকর্মীর অভাব নেই। বিভা নিজ হাতে কিছু না করলেও দিব্যি দিন কেটে যাবে। তবুও বিভা নিজ হাতে রান্না করে। বাগানের ফুলের পরিচর্যা করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা ফুলবিবিটি সেজে সংসার সংসার খেলা করে। গাঁয়ের লোকে তাকে দেবীর মতো সম্মান করে। শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলো উদার মনের অধিকারী। শ্বশুর শাশুড়ির জন্য একবুক মায়া টলমল করে তার বুকে। কেউ বিভার সাথে বিরূপ আচরণ করে না। সবাই ভালোবাসে। অভিজিতের সন্তুষ্টি তাকে কায়দা করে অর্জন করতে হয় না। অভিজিৎ সর্বদাই স্ত্রীর প্রতি অতি মাত্রায় সন্তুষ্ট। কোনো অভিযোগ নেই। ঈর্ষা নেই। ভারি নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্ন জীবন বিভার। রাত্রিগুলো দুশ্চিন্তাবিহীন। চোখের কোলে কালি জমে না। ঝকঝক করে সারাক্ষণ। রূপ যেন ফেটে পড়ে। অভিজিতের দেয়া হাতখরচের টাকা জমে থাকে। খরচ করার প্রয়োজন হয় না। শপিং করে অভিজিতের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। দেশে আসার পর মায়ের জন্য জামদানি শাড়ি আর বাবার জন্য ফতুয়া কিনল হাত খরচের টাকা থেকে। এতেই বাবা মা খুশি। সবাই অল্পেই খুশি হয়ে যায় বিভার ওপর। এমন তরঙ্গহীন নিরুপদ্রব জীবন মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

মা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এবার একটা বাচ্চা নিয়ে নে। আর দেরি করিস না।’

বিভা হাতে পায়ে লোশন মাখতে মাখতে প্রত্যুত্তর করল, ‘একটা নাচের স্কুল দেব ঠিক করেছি। বিনা পয়সায় মেয়েদের নাচ শেখাবো। আইডিয়াটা কেমন মা?’

সেলফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। আকাশের ফোন। মা বিরক্ত হলো, ‘তোর বন্ধুগুলার আক্কেল বলতে কিছু নেই। এত রাতে ফোন করা কোনো ভদ্রলোকের কাজ?’

বিভা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে ফোন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

‘কী?’

‘রাগ করছিস নাকি?’ আকাশের প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ রাগ করছি।’

‘আর কোনো কাজ নাই করার মতো, তাই না?’

‘না নাই।’

‘তুই চাকরি-বাকরি কিছু করিস না ক্যান?’

‘প্রয়োজন নাই।’

‘প্রয়োজন আছে।’

‘কী প্রয়োজন?’

‘কাজ-কাম থাকলে হুদাই এর ওর ওপর রাগ করে টাইম ওয়েস্ট করবি না। জগতে শান্তি বিরাজ করবে।’

‘লাখি খাবি। আমি বলছিলাম তোরা আমাকে আর ভালোবাসিস না। তুই বললি ‘হুম’। এটার মানে কী?’

‘এটার মানে হচ্ছে ভালোবাসার কথা সবসময় বলতে হয় না। বুঝে নিতে হয়।’

বিভার কণ্ঠে বিষণ্নতার সুর এসে লাগে, ‘তোরা কেমন বোরিং হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।’

‘বয়স বাড়তেছে তো।’

‘তোদের বাড়তেছে। আমার বাড়তেছে না।’

‘কমতেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুই কি বেনজামিন বাটন?’

‘না। আমি বিভাবরী ভট্টাচার্য। আমার বয়স ষোলো ছিল। ষোলো আছে। ষোলোই থাকবে।’

আকাশ হাসে… হাসে বিভাও… রাত বাড়তে থাকে….।

৩৮

রাশেদ পুত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁয়ে ফেলেছে এর মাঝেই। পুত্র এখনো ফেরেনি। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আজকাল দিনরাত শুধু সন্তানের কথাই ভাবছেন তিনি। জীবনের অন্য সবকিছু গৌণ হয়ে গেছে। ফোনটা আজকাল প্রায়ই আসে। অচেনা কণ্ঠ জান নেবার হুমকি দেয়। স্ত্রী পুত্রের ওপর হামলা করার ভয় দেখায়। বিষয়টা নিয়ে সামির সাথে আলাপ করতে হবে। রোমেলাকেও সতর্ক হতে হবে। নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই রাশেদের। অমোঘ মৃত্যু বন্দুকের নল তাক করে আছে। যেকোনো মুহূর্তে নিশানা কার্যকর হবে। বহুদিন বাঁচলেন তো! জীবনের প্রতি আর কোনো লোভ অবশিষ্ট নেই। যা রেখে যাবেন তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের পুরো জীবন কেটে যাবে হেসে খেলে। কিন্তু সামিকে কিছু দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। অবিরাম অধ্যবসায় এবং জীবনভর শ্রমের বিনিময়ে তিনি যা অর্জন করেছেন তা যেন অবহেলায় হারিয়ে না যায় সেই দায়ভার একমাত্র পুত্রের ওপরেই বর্তাবে। সামি কি এই দায়িত্বের গুরুত্ব বোঝে? গভীরতা টের পায়? সেই পরিপক্ক মনোভাব কি ওর মাঝে আদৌ অঙ্কুরিত হয়েছে? কে জানে! মনের একটা অংশ বারবার তাড়া দিয়ে উঠছে। সময় শেষের ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন। তার বয়স এখনো পঞ্চাশ পেরোয়নি। মানুষ তো ষাট সত্তর বছর পর্যন্তও বাঁচে। তিনি কর্মক্ষম ব্যক্তি। শরীরে কোনো রোগ নেই। ঝরঝরে স্বাস্থ্য। মৃত্যু-চিন্তায় পেয়ে বসার কোনো অবকাশ নেই। তবুও মৃত্যুর অমোঘ পরিণতির কথা আজকাল তার ভাবনায় ছোবল মেরে যাচ্ছে। এর কারণ কী? তিনি কি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন? নাকি বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বলেই মৃত্যুকে স্মরণ করতে ভালো লাগছে?

রাশেদ অস্থির চিত্তে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলেন। বেডরুমের দরজাটা আধখোলা। রোমেলা ড্রেসিং টেবিল সংলগ্ন টুলের ওপর বসে আছেন। এই ড্রেসিং টেবিল গতমাসে গুলশানের একটা অভিজাত আসবাব পত্রের শোরুম থেকে কেনা হয়েছে। মূল্য তিন লাখ টাকা। আয়নার ওপর নানা রকম বাতি লাগানো। সেই বাতিতে নাকি সেলফি ভালো আসে। রোমেলার আজকাল সেলফি তোলার বাতিক হয়েছে। তিনি নানা পোশাকে নানা ভঙ্গিতে সেলফি তোলেন দিন রাত। সেইসব ছবি আপলোড করা হয় ইন্সটাগ্রামে। অনেকেই প্রশংসা করে। রোমেলা উপভোগ করেন সেসব প্রশংসা। অহংকারের সুন্দর আস্ফালনে রমরম করে আত্মা। অহংবোধকে তিনি কখনো খারাপ নজরে দেখেননি। তার ধারণা অহংকার মানুষের সৌন্দর্যের একটা অংশ। পৃথিবীতে ভাগ্যবানরাই কেবলমাত্র অহংকারী হতে পারে।

রোমেলার গায়ে একটা আকাশী রঙের শার্টিন সিল্ক স্লিপ ওয়্যার। শাড়ি অথবা কামিজ পরে ঘুমাতে পারেন না তিনি। তাছাড়া ঘুমোতে যাবার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নেয়ার মধ্যে আভিজাত্যের একটা প্রকাশ আছে বলে তার ধারণা। বড়লোকদের সব কিছুতেই একটা আর্ট থাকা উচিত। যা সাধারণ মধ্যবিত্তদের সাথে টেনে দেবে সীমারেখা। কালো চুলের গোছা ছড়িয়ে আছে বুকের একপাশে। ডান হাত দিয়ে চুলের ওপর হেয়ারব্রাশ চালাচ্ছেন তিনি। বাম হাতে সেলফোন। রাশেদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই হালকা একটু চমকে উঠলেন। রাশেদ দেখলেন রোমেলার ঠোঁটে হাসি, চোখে মৃদু আনন্দের আভা। দুশ্চিন্তার ছাপ নেই কোথাও।

‘সামি এখনো ফেরেনি বাসায়। যাবার সময় কিছু বলে গেছে তোমাকে?’

রোমেলা পলক তুলে তাকালেন। তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হলো রাশেদের কথা তার মস্তিষ্ক ছুঁতে পারেনি। এখনো মন পড়ে আছে সেলফোনের পর্দায়। কেমন অন্যমনস্ক ভাব। আমতা আমতা করে বললেন,

‘কী বলছ?’

‘সামি কোথায়?’

‘ফোন করলেই তো পার।’

‘আমার ফোন সে রিসিভ করবে?’

‘রিসিভ করুক না করুক, চেষ্টা তো করতে পার!’

রাশেদ বিছানার পাশে রাখা ইজি চেয়ারে বসলেন হেলান দিয়ে। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তুমি তো জানো আমার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। আমার ছেলে আমার ফোন ইগ্নোর করছে। ইচ্ছাকৃতভাবে রিসিভ করছে না। বিষয়টা মেনে নিতে আমার কষ্ট হবে।’

রোমেলা কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে সামির নম্বরে ডায়াল করলেন। ফোন রিসিভ করল হৃদি।

‘হ্যালো মা!’

রোমেলা একটু থমকানো গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার? সামি কোথায়?’

‘ও তো ঘুমাচ্ছে।’

‘তোমাদের বাসায়?’

‘জি।’

‘আমাকে একটু জানিয়ে দিলেই তো পারতে। একটা টেক্সট করে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়, তাই না?’

কথাটা বলতে বলতে ফোনের লাইন কেটে দিলেন রোমেলা। গজগজ করে বললেন, ‘আমার ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এদিকে আমি কিছুই জানি না!’

‘সামি কি শ্বশুরবাড়িতে?’

‘হ্যাঁ।’

রাশেদ একটু মুচকি হাসলেন, ‘ভালোই তো। বউমা কবে আসবে? তুমি একবার জিজ্ঞাসা করলেই পারতে।’

রোমেলার চোখে তেজ ঝিলিক দেয়, ‘আমি কোন দুঃখে এসব জানতে চাইব? আসলে আসুক, না আসলে না আসুক। আমার ছেলেটার মাথা তো ঘুরিয়েই দিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য!’

একটু সময় চুপ করে থেকে রোমেলা ভারী গলায় বললেন, ‘তুমি তো জানো এই বিয়েটা আমার মতের বিরুদ্ধে হয়েছে। ভেবেছিলাম ছেলে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বিয়ে হয়েছে বছরও গড়ায়নি। এখন ডিভোর্স হয়ে গেলে ছেলেটাকে আমি দুই মাসের মধ্যে আবার বিয়ে দিতাম।’

একটা প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস রাশেদের বুক চিরে বেরিয়ে এলো। রোমেলা বরাবর অগভীর এবং অপরিণামদর্শী। অনুভূতিহীন, স্থূলচর্মের মানুষ। এ কারণেই তার সাথে কখনো মতের মিল হলো না। মনের মিল তো দূরের কথা। জীবনযুদ্ধে চিরকাল তিনি একা লড়ে গেছেন। স্বামীর দুশ্চিন্তা ভাগ করে নেয়ার মতো সদিচ্ছা রোমালার কখনো ছিল না। স্বামীর ক্লান্তিময় খরার দিনে স্ত্রী ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়ায়। বিশ্রাম দেয়। কিন্তু রোমেলার কাছে তিনি কোনোদিন মনের বিশ্রাম খুঁজে পাননি। শাড়ি, গয়না, ক্লাব আর সামাজিক স্ট্যাটাসের বাইরেও যে একটা বিশাল বড় পৃথিবী আছে রোমেলা তা কিছুতেই অনুভব করতে পারেন না। তার মনটা প্রচণ্ড অর্থকেন্দ্রিক। কিন্তু এসবের বাইরে রোমেলার একটা ভীষণ শক্তিশালী গুণ আছে। তিনি বাস্তববাদী। নিজেকে তীক্ষ্ণভাবে ভালোবাসতে পারেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের প্রতি এই ভালোবাসা অটুট রাখতে জানেন। একটা সাময়িক ঝড় তার জীবনে এসেছিল বটে। ভেঙে পড়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে খুব একটা সময় লাগেনি। বাস্তববাদী বিষয়ী রোমেলা খুব ভালো মতোই জানেন তার ন্যায়বান, মার্জিত, সচ্চরিত্র স্বামীর দৈবক্রমে একবার পদস্খলন হয়ে গেলেও তিনি অবিলম্বেই সঠিক পথে ফিরে আসবেন। বিবেকের কাছে এই লোকটা জীবন বিকিয়ে দিয়েছে বহু আগে। প্রয়োজনে তিনি প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু বিবেক নয়।

রোমেলা কখন পাশে এসে বসেছেন খেয়াল করেননি রাশেদ। হঠাৎ কানে এসে ভিড়ল কণ্ঠস্বর।

‘তুমি আগের চাইতে আরো সুন্দর হয়েছ। ঘটনা কী? তোমাকে বয়সে পায় না কেন? মেয়েটার সাথে এখনো লুকিয়ে প্রেম করছ নাকি?’

অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে একটু থমকে গেলেন রাশেদ। কয়েক সেকেন্ডের অস্বস্তির পর স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললেন, ‘আমি সবকিছু ভুলে গেছি। খুব ভালো হয় যদি তুমিও ভুলে যাও।’

রোমেলা আরেকটু গা-ঘেঁষে বসলেন। রাশেদের কাঁধের ওপর চিবুক রেখে অনেকটা ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি সত্যিই ভুলে গেছ?

রাশেদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বুকে একটা অপ্রত্যাশিত চমক লেগে গেছে। একথা সত্য তিনি সবটাই ভুলে গেছেন বা ভুলে যেতে চেয়েছেন। সচেতনভাবে তিনি অমৃতাকে মনে করেন না। কিন্তু কিছু জিনিস আলাদা করে মনে করার প্রয়োজন পড়ে না। অনুক্ষণ মনের সাথে লেগে থাকে, ঠেসে থাকে, বিঁধে থাকে কাঁটার মতো। সেই কাঁটা উগরে ফেলা যায় না। গিলে হজম করাও যায় না। নিত্যদিনের অভ্যাসের মতো গেঁথে যায় বুকের ভেতর। হঠাৎ হঠাৎ শুধু খচখচ করে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। রোমেলার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

তুমি কখনই খুব একটা রোমান্টিক ছিলে না। মেয়েটা কীভাবে তোমাকে ফাঁদে ফেলল বলো তো? চেহারার ছিরিছাঁদ তো কিছুই নেই। ছেলেদের মতো ষণ্ডা মুখ। তুমি স্বীকার না করলেও আমি জানি, মেয়েটার চেয়ে আমি এই বয়সেও অনেক বেশি সুন্দরী।’

রাশেদ ঠোঁট টিপে হাসলেন, ‘তুমি নিঃসন্দেহে সুন্দরী।’

রোমেলা বিদ্রূপের স্বরে বললেন, ‘তবুও তোমার মনে ধরল ছেলেদের মতো দেখতে রুক্ষ এক মেয়েকে। রুচির বাহার দেখে আমার লজ্জা হয়, জানো? ঐ মেয়ে আমার পায়ের নখের সমান যোগ্যতা রাখে না। কী দেখলে ঐ গোঁয়ার মেয়েটার মধ্যে?’

রাশেদ দরজার চোকাঠে একটা হাত রেখে নিরুচ্চারে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ নতমুখে। রোমেলার মাত্র ছুড়ে দেয়া প্রশ্নটা বুকের ভেতর ঢেউ ভাঙছে। কী দেখেছিলেন মেয়েটার মধ্যে তা আজও স্পষ্ট নয়। যে মেয়ে দেশকে ভালোবাসে নিঃশর্তভাবে, যে মেয়ের শাড়ি গয়নার প্রতি কোনো ঝোঁক নেই, সাজগোজে মন নেই, যে মেয়ের মুখে ঝিকমিক করে বুদ্ধির দীপ্তি… মনের গভীরতা হরহামেশা ছাপ ফেলে চোখের আয়নায়, সেই মেয়ে স্পষ্টত অন্য সকলের চেয়ে আলাদা!

‘কাল ব্যাংকক যাচ্ছি। শুনেছ তো?’

ঘোরলাগা চোখে তাকালেন রাশেদ। তথ্যটা আগে শুনেছেন কি না মনে করতে পারলেন না। অস্ফুটে বললেন, ‘সাথে কে যাচ্ছে?’

‘ক্লাবের কয়েকজন ফ্রেন্ডের সাথে যাচ্ছি। তিনদিনের ট্রিপ।’

‘বেশ তো। ঘুরে এসো। ভালো লাগবে।’

রাশেদ ধীরেধীরে সরে এলেন জায়গাটা থেকে। ভেতরকার দুর্বলতাকে তিনি কখনই প্রশ্রয় দিতে চান না। কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠার বর্ম-আবরণে ঢেকে রাখেন নিজেকে। কাজকর্মের নেশায় মনকে ভুলিয়ে রাখেন অবিরাম। কিন্তু এই ফাঁকিবাজি খেলায়ও একসময় ক্লান্তি এসে যায়। অবসাদগ্রস্ত, ক্লিষ্ট মন হন্যে হয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করে। আগে পুত্রের চোখের দিকে তাকালে জান্নাতী সুবাতাসে ভরে যেত মন। এখন তার চোখে চোখ রাখা যায় না। অপরাধবোধে গুড়িয়ে যায় পাঁজরের হাড়। একমাত্র সন্তানের নিরন্তর উপেক্ষা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়!

৩৯

পরদিন রাত নয়টায় রোমেলার ফ্লাইট। সামি জানতে পারল দুপুরে। রোমেলাই ফোন করে জানালেন ছেলেকে। সামি তো অবাক।

‘আগে বলোনি তো মা!’

‘হুট করেই প্ল্যান হলো। তোমাকে তো বাড়িতে পাওয়াই যায় না। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকো দিন-রাত। বলব কী করে?’

সামি অসন্তোষ মুখে নিয়ে চুপ করে থাকে কিয়ৎ ক্ষণ। মা এমনভাবে কথাটা বলল যেন একটা রাত শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে সামি মহা অপরাধ করে ফেলেছে। আজ সকাল থেকেই মন মেজাজ ভালো নেই। বোর্ড মিটিং ছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার মুখোমুখি হতে হয়েছে। মিটিং-এ একগাদা লোকের সামনে তিনি বারংবার সামিকে এটা সেটা প্রশ্ন করছিলেন। বাধ্য হয়ে উত্তর দিতে হয়েছে। চোখে চোখ না রেখেই মত বিনিময় করেছে সামি। অফিসের অধিকাংশ কর্মচারী পিতা পুত্রের মধ্যকার এই শীতল আবহাওয়া টের পাচ্ছে। লোকমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা কথা। অমৃতার অ্যাক্সিডেন্টের দিনটা নিয়ে গুঞ্জনের শেষ নেই। সাংবাদিকরা ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে। কখন কোন গোপন কথাটি জন সম্মুখে ফাঁস হয়ে যায় এই নিয়ে সামি আজকাল দুশ্চিন্তা বোধ করে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে মা’কে বলল, ‘কটায় বের হবে বাসা থেকে?’

‘ভাবছি সন্ধ্যা সাতটায় বেরিয়ে পড়ব।’

সামি ইতস্তত করে বলল, ‘তাহলে বিকেলের দিকে রেডি থেকো মা। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাব।’

‘কোথায় যাবে?’

‘হৃদির বাসায়।’

রোমেলা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ‘কেন?’

‘ওকে নিয়ে আসব বাড়িতে।’

রোমেলা বিস্তর বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আসতে চাইলে আসুক। আমি তো তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলিনি। আমার যেতে হবে কেন?’

মায়ের কথার ধরনটা ভালো লাগল না। সামি আহত গলায় বলল, ‘কেন মা? একটা দিন আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে তোমার খুব কষ্ট হবে? তুমি তো কখনো যাওনি!’

‘কষ্টের কিছু নেই। কিন্তু বিষয়টা খুবই অযৌক্তিক। তাছাড়া আমার গোছগাছ হয়নি এখনো।’

‘এখন বারোটা বাজে। আরো অনেকটা সময় আছে হাতে। ব্যাগ গুছিয়ে নাও এর মাঝে।’

রোমেলা মুখ ব্যাজার করে রইলেন। ভ্রু কুঞ্চিত। নাকের ভাঁজে ঝরে পড়ছে বিরক্তি। কঠিন গলায় বললেন,

‘তোমার বউ কি এখনো ঐ বজ্জাত মেয়েটার সাথে সম্পর্ক রেখেছে? এ বাড়িতে আসতে হলে ঐ ফ্রেন্ড-সার্কেল ছেড়ে আসতে হবে। বিষয়টা ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়েছ তো তাকে?’

সামির বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগল। হৃদযন্ত্রটা যেন কয়েক ধাপ উঁচু সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ল নিচে, ডিগবাজি খেয়ে। কয়েকটা থমকানো সেকেন্ড কেটে যাবার পর সে বিষণ্ণ ম্লান গলায় বলল, ‘হ্যাঁ… তা তো বটেই।’

‘তোমার কি এখনো যোগাযোগ আছে ঐ মেয়ের সাথে?’

সামির বুকে বাতাস আটকে যায়, ‘নাহ…!’

‘বেশ তো। বিকেলে এসে তাহলে আমাকে নিয়ে যেও। রেডি থাকব।’

‘থ্যাংক ইউ মা!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *