স্বপ্নের বৃষ্টিমহল – ১

হাসপাতালে পৌঁছুতে বন্ধুদের পাক্কা আধা ঘণ্টা সময় লেগে গেলো। ওরা কেউ কোনো কথা বলছিল না। প্রলয়ঙ্করী ঝড় আসার পূর্বে প্রকৃতিতে যেমন একটা থমকানো ভ্যাপসা আবহাওয়া বিরাজ করে, ঠিক সেরকম একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে ওদের চোখেমুখে। এমনকি ছিঁচকাঁদুনে হৃদির চোখ থেকেও এখন অবধি এক ফোঁটা জল গড়ায়নি। তবে হাত-পা কাঁপছিল অবিরত। রুদ্র ওর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। একটু পর পর সান্ত্বনার গলায় বলছে, ‘এতো ভয় পাইস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ মুখে বলছে ঠিকই কিন্তু তার ভেতরেও এখন ভয় বাসা বেঁধেছে। ওরা রাশেদের পাজেরো গাড়ি অনুসরণ করেই এতটা পথ এসেছে। কিন্তু হাসপাতালের লবিতে পৌঁছে পরিচিত মুখ দেখতে পেলো না। দিশেহারার মতো ঘুরে বেড়ালো এদিক-সেদিক। আকাশ রিসিপশনে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে স্খলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘এক্স কিউজ মি, এই মাত্র একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে। মেয়েটা কোথায় বলতে পারবেন?’

মধ্যবয়স্ক মহিলা অতি বিরক্ত গলায় বলল, ‘কোন মেয়ে? কার কথা বলছেন?’

আকাশ কী বলবে জানে না। তার অন্তরাত্মা এক লোমহর্ষক কম্পনে শিহরিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। বাস্তববোধ-বুদ্ধি এখন শূন্যের কোঠায়। চিৎকার করে বলল, ‘আরে মাথায় ছোট ছোট চুল-ওয়ালা একটা মেয়ে। আমার ফ্রেন্ড!’ রুদ্র পেছন থেকে একটা জোর গাট্টা মারল ওর মাথায়, ‘শালা! এমনে কইলে হবে নাকি?’ এটুকু বলে একটুও বিরতি না নিয়ে সে রিসেপশনিস্টকে বলল, ‘অমৃতা নামে কোনও পেশেন্ট আছে?’

স্বপ্নের বৃষ্টিমহল

ভদ্রমহিলা বিরক্তিমিশ্রিত চোখে সম্মুখে রাখা কম্পিউটার মনিটরে তাকালো, ‘এই নামে কোনো এন্ট্রি নেই। ইমার্জেন্সিতে দেখুন।’

ইমার্জেন্সির সামনে বেজায় ভিড়। বন্ধুরা ভিড় ঠেলে একটু সামনে এগোতেই ভেতর থেকে একটা স্ট্রেচার বেরিয়ে আসতে দেখল। স্ট্রেচারে যাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তার পরনের কাপড় ওদের কাছে বড্ড পরিচিত কিন্তু রক্তাক্ত মুখখানা দেখে চেনার উপায় নেই। হৃদি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। খানিক দূরে রাশেদ দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখের দৃষ্টিতে ভয়াবহ শূন্যতা। চামড়া ফ্যাকাশে। সাদা শার্টের বুক রক্তে রঞ্জিত। বুনো মোষের মতো সেদিকে তেড়ে গেলো আকাশ।

‘কী হইছে অমৃতার?’

রাশেদ দিশাহারা বিবর্ণ দুটি চোখ মেলে তাকালেন সামনে। পায়ের নিচে তিনি ভূমিকম্প টের পাচ্ছিলেন। মুখ দিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করারও শক্তি নেই। আকাশ ঠিক সেই মুহূর্তে জীবনের সবচাইতে দুঃসাহসিক এবং অত্যুৎকট কাজটি করে ফেলল। রাশেদের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে হিংস্র ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জন করে উঠে বলল, ‘কী করছেন আপনি?’

রাশেদের মুখখানা এতক্ষণ ফ্যাকাশে ছিল, এবার অপমানে কালো হয়ে উঠল। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বন্ধুর দ্বারা শ্বশুরের এই মর্মান্তিক অপমান সইতে পারল না হৃদি। তার কান্নার তোড় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল। যেন এইমাত্র অতি নিকটাত্মীয়র বিয়োগ ঘটেছে। রাশেদ হাসপাতালে ঢোকা মাত্র তাকে ঘিরে একটা ছোটখাটো ভিড় তৈরি হয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক অঙ্গনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির আগমনের খবর পেয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছুটে এসেছেন।

পরিচালক ছুটে এসেছেন। রাশেদ এই হাসপাতালের একজন আজীবন দাতা সদস্য। অল্পবয়সী সাধারণ যুবক গণ্যমান্য ব্যক্তির কলার চেপে ধরেছে, এই ঘটনা লোকজনকে বিস্মিত করে তুলছে। রুদ্র এগিয়ে এসে আকাশের হাত টেনে ধরল, ‘ছাড় ব্যাটা! এসবের মানে কী?’ আকাশ এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল রুদ্রকে।

বুক পকেটে রাখা সেলফোন বেজে উঠতেই রাশেদ নিজেকে আড়াল করার পথ পেয়ে গেলেন যেন। চট করে রিসিভ করলেন কল। ভিড় থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন আবার। হৃদির দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন, ‘বউমা!’

শঙ্কিত হৃদি এগিয়ে এল কয়েক পা, ‘জি বাবা?’

হৃদি কাছে আসতেই রাশেদ গলার স্বর নামিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে বললেন, ‘গাধাটা উত্তরা থানার কাস্টডিতে আছে। সে নিজেই নাকি থানায় গিয়ে দোষ স্বীকার করেছে। ওসি সাহেব ফোন করেছিলেন।

হৃদি হতভম্ব গলায় বলল, ‘থানায় মানে থানায় কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা!’

‘আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। তুমি গাড়ি নিয়ে প্রথমে থানায় যাও তারপর সামিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যাও। আমি এখানে আছি।’

‘কিন্তু ও থানায় কেন গেছে? কী অপরাধ তার?’

রাশেদ কয়েক সেকেন্ড হৃদির ভীত-সন্ত্রস্ত মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ওর মাথার ওপর সান্ত্বনার হাত রেখে বললেন, ‘তার কোনো অপরাধ নেই। অপরাধ আমার। এই বিষয়টিই তাকে বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব দিলাম তোমাকে। দায়িত্বটা পালন করতে পারবে মা?’

অমৃতার বাবা-মা এবং ছোট বোন দিপা প্রবেশ করল সেই সময় হাসপাতালের ভেতরে। অমৃতার মা বিলাপ করে কাঁদছেন। আকাশ আর রুদ্র এগিয়ে গেছে তার কাছে। প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছে। রাশেদ এই পরিবারটিকে দেখামাত্র বুকের মধ্যে আতঙ্ক অনুভব করলেন। মন চাইছিল মাটির সাথে মিশে যেতে, অদৃশ্য হয়ে যেতে। নিজেকে তিনি সাহসী বলেই জানতেন এতকাল। বছর তিনেক আগে সুন্দরবনের জঙ্গলে ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শ্বাপদ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েও এতটা শঙ্কিত হননি যতটা এখন হচ্ছেন। হৃদি হঠাৎ দৌড়ে এসে একটু চাপা গলায় বলল, ‘বাবা, আমার মনে হয় আপনিও চলুন আমার সাথে। আমি একা সামিকে হ্যান্ডেল করতে পারব না। তাছাড়া এখানে অমৃতার প্যারেন্টস উপস্থিত হয়েছে। ঝামেলা হতে পারে।’

রাশেদ একটু বিচলিতভাবে তাকালেন হৃদির দিকে। মনে হলো মেয়েটা ঠিকই বলছে। এই মুহূর্তে এখান থেকে কেটে পড়াই সমীচীন। তিনি কোনো কথা না বলে আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মতো হৃদির সাথে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। জীবনে কখনো এতটা দুর্বিনীত কলঙ্কজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। আকাশ তখনো দূর থেকে ক্রূর চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়ে হাড়গোড় চিবিয়ে খেতে চাইছে। চলতে চলতে হঠাৎ পা দুটো থমকে গেলো। কোথায় যাচ্ছেন? এই হাসপাতালের কেবিনে অমৃতা আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। লড়াই করছে মর্মান্তিক যন্ত্রণার সাথে। আর তিনি কাপুরুষের মতো লেজ তুলে পালাচ্ছেন। কিন্তু পালাবেন কোথায়? পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন এই দায় থেকে মুক্তি পাবার কোনো অবকাশ কি আর আছে? অমৃতার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তিনি কি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন?

‘বউমা, তুমি যাও। আমি এখানেই আছি। পারলে তোমার শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে যাও। সে হয়ত ছেলেকে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।’

হৃদি কিছু বলার আগেই রুদ্র উড়ে এসে জুড়ে বসল দৃশ্যপটে, ‘কী হইছে?’

হৃদি বলল, ‘সামি নাকি কাস্টডিতে আছে। থানার ওসি ফোন দিছিল বাবাকে।’

‘বলিস কী? কিন্তু কেন?’

আকাশও এগিয়ে এসেছে তখন। শুনতে পেয়েছে দুই বন্ধুর কথোপকথন। উৎসুক গলায় বলছে, ‘থানায় কেন? কী করছে সে?’

প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারল না কেউ। তিনজনে ত্রাসিত এবং উদ্বেলিত চোখে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। রুদ্র বলল, ‘চল আমিও যাই তোর সাথে। আকাশ তুই থাক এখানে। আপডেট দিস।’

সেই সময় একজন নার্স দৌড়ে এল ওদের দলটার দিকে, ‘এক্সকিউজমি! আপনাদের পেশেন্টের ব্লাড লাগবে। ইমার্জেন্সি। রোগীর ব্লাড গ্রুপ এ-নেগেটিভ। খুব রেয়ার। আপনাদের কারো সাথে কি ম্যাচ করে? দ্রুত ব্যবস্থা করুন।’

হৃদি তাৎক্ষণিকভাবে বলল, ‘সামির ‘ও’ নেগেটিভ। ওরে ফোন কর তাড়াতাড়ি।’

রুদ্রর হাত অসম্ভব কাঁপছিল। কাঁপা হাতে সামির নম্বরে ডায়াল করল সে। একটি যান্ত্রিক কণ্ঠ কথা বলে উঠল, আপনি যে নম্বরে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফোন পকেটে পুরে নিয়ে রুদ্র তড়িঘড়ি করে বলল, ‘ঐ শালার ফোনে যায় না। চল তাড়াতাড়ি। সামনা সামনি কথা বলি।’

অমৃতার বাবা এগিয়ে এসেছেন ত্রস্ত পায়ে, উদ্বিগ্ন স্বরে বলছেন, ‘কী হয়েছে আমার মেয়ের?’

ভদ্রলোকের চোখে চোখে তাকাতে পারলেন না রাশেদ। দৃষ্টি অন্যত্র ন্যস্ত করে বললেন, ‘একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।’

রাশেদ কথাটা ছুড়ে দিয়েই পা বাড়িয়ে প্রস্থানোদ্যত হলেন। পেছন থেকে ভেসে এল অমৃতার বাবার শীতল কণ্ঠস্বর, ‘আমার মেয়ের কিছু হলে আমি আপনাকে ছেড়ে দেবো না!’

রাশেদ কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলেন।

থানায় পৌঁছে দেখা গেলো ওসি সাহেব টেবিলের ওপর পা তুলে বসে আছেন বহাল তবিয়তে। হাতে খবরের কাগজ। রুদ্র ব্যস্ত গলায় বলল, ‘সামি কোথায়?’ খবরের কাগজটা নাক বরাবর নামিয়ে ভ্রু-কুঁচকে তাকালেন ওসি, ‘কী বললেন?’

‘সামি… সামিউল হক এমপি রাশেদুল হকের ছেলে। সে কোথায়?’

ওসি এবার নড়েচড়ে বসল, ‘এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন আপনাদের?’

‘হ্যাঁ আমরা ওর বন্ধু।

ওসি টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট কলিং বেলের সুইচ প্রেস করে বললেন, ‘ফ্যামিলি থেকে কেউ আসেনি?’

হৃদি বলল, ‘আমি মিসেস সামিউল হক।’

ওসি সাহেব পা নামালেন টেবিলের ওপর থেকে। যেন হৃদির সম্মানেই করলেন কাজটা। মুখে গদগদ হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম আমরা কিন্তু উনাকে কাস্টডিতে রাখতে চাইনি। স্যারের সাথে কথা বলার আগে এরকম কিছু করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু উনার অবস্থা… মানে আপনার হাসবেন্ডের অবস্থা খুবই শোচনীয়। খুব সম্ভবত তিনি যাকে আঘাত করেছেন সেই ভিক্টিম গুরুতর আহত হয়েছে।’

হৃদি চমকে উঠল, ‘কী বলছেন আপনি? ও কাউকে আঘাত-টাঘাত করেনি।’

‘তিনি নিজেই দোষ স্বীকার করেছেন। খবরটা জানাজানি হওয়ার আগে আপনার শ্বশুরের উচিত ব্যবস্থা নেয়া। মিডিয়া আজকাল খুবই তৎপর। একবার জনগণের কানে কথা চলে গেলে এমপি সাহেবের ক্ষমতা দিয়েও শেষ রক্ষা হবে না।’

হৃদি এসব কথা শুনে খুবই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। রুদ্রর একটা হাত খামচে ধরে সে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘দোস্ত উনি এসব কী বলতেছে? এখন কী হবে?’

রুদ্র বেশ বিনীতভাবে অফিসারকে বলল, ‘স্যার আপনি একটু ওর সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দিন। ও যা বলেছে তা সত্য নয়। কী কারণে সে নিজেকে দোষী ভাবছে জানি না। আপনারা কি ওর কনফেশন রেকর্ড করেছেন?’

‘ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যেহেতু কনফেস করা হয়নি তাই এই স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমপি সাহেবের সম্মানার্থে এখনো মামলা আমলে নেয়া হয়নি। ভিক্টিমের অবস্থার ওপরে অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে। পুলিশ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। ভিক্টিম জবানবন্দিতে কী বলে দেখা যাক। যদি ভিক্টিমের মৃত্যু হয় তাহলে অবশ্য পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে।

একজন পুলিশ সামনে এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়িয়েছে। অফিসার বললেন, ‘উনারা সামিউল হকের সাথে দেখা করবেন। নিয়ে যাও।

খুব বেশি দূর যেতে হলো না। একটা করিডোর পেরোতেই খাঁচা দৃশ্যমান হয়ে উঠল। লোহার গরাদের ওপারে আধো আলো অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামি। আরো দুজন যুবক জেলের মধ্যে পায়চারি করছে। কথা বলছে নিচু স্বরে। এদের চেহারায় তেমন দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। মনে হচ্ছে জেল কাস্টডিতে বন্দি থাকা ডাল ভাত খাবার মতো দৈনন্দিন ঘটনা। সামি নিষ্প্রভ, তমসাবৃত দৃষ্টি মেলে রুদ্র আর হৃদিকে দেখল। মুখে কোনো ভাবান্তর হলো না। হৃদি কান্নার প্রকোপে কথা বলতে পারছিল না। লোহার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

‘দোস্ত ঘটনা কী? একটু খুলে বলবি প্লিজ?’ অস্থিরভাবে প্রশ্নটা করল রুদ্র। সামি ওর দিকে পলক তুলে চাইল। কী নিস্পৃহ শীতল ওর চোখের দৃষ্টি! রুদ্রর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এ যেন তার আবাল্য চেনাজানা সেই সপ্রতিভ, আমোদপ্রিয়, রসিক বন্ধুটি নয়। এই মানুষ সম্পূর্ণ অচেনা কেউ।

‘কথা কস না ক্যান শালা!’ লোহার গ্রিলটা পাঁচ আঙুলে খামচে ধরে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল রুদ্র।

‘অমৃতা কি মরে গেছে?’

সামির হিমস্পর্শী কনকনে ঠান্ডা প্রশ্নটা দুই বন্ধুর বুকে নাড়া দিয়ে গেলো। বেড়ে গেলো হৃদির কান্নার দমক। রুদ্র সদ্য সর্বস্বান্ত মানুষের মতো অসহায় গলায় বলল, ‘মরবে কেন? ওর ব্লাড লাগবে। তুই চল আমাদের সাথে।’

সামি উদভ্রান্ত চোখে তাকালো, ‘ওর ব্লাড গ্রুপ কী?’

হৃদি কথা বলল এতক্ষণে, ‘এ নেগেটিভ। তুই ব্লাড দিতে পারবি ওকে। তাড়াতাড়ি চল।’

সামিকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো। সেই সময় হৃদির সেলফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রাশেদ বললেন, ‘বউমা রক্ত পাওয়া গেছে। এ নিয়ে তোমাদের আর চিন্তার কিছু নেই। তুমি সামিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। বাকিটা আমি দেখছি। চিন্তা করো না।’

‘বাবা অমৃতা কেমন আছে?’

রাশেদ কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘ব্রেইন ইনজুরি হয়নি।’

‘ওর কি জ্ঞান ফিরেছে?’

‘জ্ঞান ফিরেছিল কিছুক্ষণের জন্য। নাক, কান দিয়ে ব্লাড গেছে। খিঁচুনি ছিল। বমি হয়েছে। ব্লাড দেয়ার পর কন্ডিশন ইম্প্রুভ করবে আশা করি।’

হৃদি ফোন রেখে হাঁপধরা গলায় বলল, ‘ব্লাড ম্যানেজ হয়েছে।’

রুদ্র একটা শ্বাস ফেলল ফোঁস করে, ‘যাক… আলহামদুলিল্লাহ।’

‘সামি, তুই বাসায় চল।’ তাড়া দিয়ে বলে উঠল হৃদি। সামি প্ৰবল ভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘না… আমি এখানেই থাকব।’

‘মানে কী?’ হৃদি অবাক।

সামি অস্পষ্ট এবং অনুচ্চ স্বরে পাগলের প্রলাপ বকার মতো বিড়বিড় করে বলল, ‘অমৃতা পুরোপুরি সুস্থ হবার আগ পর্যন্ত আমি এখানেই থাকব।’

কথা শুনে রুদ্র আর হৃদি একে অপরের দিকে তাকালো। রুদ্র শ্রাগ করে বলল, ‘কী কয় এই পাগল? এর কি মাথা পুরাই খারাপ হয়ে গেছে?

হৃদি গ্রিলের ভেতর হাত বাড়িয়ে দিয়ে সামির হাত ধরল, ‘যা হইছে সেখানে তোর কোনো দোষ নেই। তুই যা করছিস রাগের মাথায় করছিস।’

সামি এক ঝটকায় হৃদির হাতটা ছাড়িয়ে নিল। পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। এখন ওর সারা শরীর কাঁপছে। ক্রোধের আস্ফালনে ফেটে পড়ছে মুখের চামড়া। চোখ জ্বলছে হিংস্র জন্তুর মতো।

‘তোরা সব একেকটা ট্রেইটর। শালা বেঈমানের দল কোথাকার!’

‘কী আবোলতাবোল বলতেছিস দোস্ত!’ কাতর স্বরে বলল রুদ্র। সামি এখন ওদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে গেছে। খাঁচাবন্দি সিংহের মতো গর্জন করে বলছে, ‘সব জানতি তোরা। কিন্তু কিচ্ছু বলিস নাই আমাকে! তোরা ফ্রেন্ড? তোদেরকে আমার ফ্রেন্ড ভাবতে ঘেন্না হয়!’ এটুকু বলে সে হৃদির কান্না ভেজা ভীত মুখের ওপর জ্বলন্ত দুটি চোখ স্থাপন করল, ‘আর তুই? তুই না আমার বউ? এত বড় একটা ঘটনা হাইড করলি কীভাবে আমার কাছ থেকে?’

রুদ্র কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্লানির পাষাণ ভারে ভেঙে যাচ্ছে বুকের পাঁজর। বন্ধুর চোখে চোখ রাখার মতো সাহস নেই। হৃদিও বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। শক্ত, শীতল লোহার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে নিভৃতে চোখের জল ফেলে যাচ্ছিল।

ইনটেনসিভ কেয়ারের চারটা ঘণ্টা যেন চার যুগের চেয়েও দীর্ঘ প্রতিপন্ন হয়ে উঠল। লবিতে স্বজন এবং বন্ধুরা অপেক্ষা করছিল। রাশেদ এক মুহূর্তের জন্যও হাসপাতাল ছেড়ে কোথাও যাননি। অমৃতার বাবা-মা তার উপস্থিতি সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারছেন না। তাদের কট্টর চোখের চাউনিই সেই অসন্তুষ্টির প্রমাণ বহন করছিল। রাশেদ এই উদ্ধত বৈরি আচরণ সম্পূর্ণ ভাবে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছিলেন। এর মাঝেই অমৃতাকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করেছেন তিনি। ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা এই দেশেও সম্ভব। তবে রোগীকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপত্তি করবে না। সমস্যা হলো অমৃতার লিগ্যাল গার্ডিয়ান তার বাবা-মা। রাশেদ নন। অতএব অমৃতার চিকিৎসা সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত বাবা মাকেই নিতে হবে। রাশেদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। অমৃতার পরিবার তার সাথে ভদ্রোচিতভাবে একটি বাক্য বিনিময় করতেও নারাজ। তিনি মনে মনে দিশাহারা-বোধ করছিলেন। যেকোনো বিপদ নিজ উদ্যোগে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা তার বহুদিনের মজ্জাগত অভ্যাস। বিপদ সামনে নিয়ে তিনি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। নেতাসুলভ দাম্ভিকতা তার স্বভাবের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বিদ্যমান। যেকোনো সমস্যা ক্ষমতার বলে নিমেষে সমাধান করতে চান। জীবনের সঞ্চার বড়ই বিচিত্র। এর পরতে পরতে হরেক রহস্য, হরেক রং, হরেক দুর্বোধ্য তামাশা ওঁত পেতে থাকে। জীবন আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। কেবলই অর্থের জোর খাটিয়ে, প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয় না। এই বাস্তবতা আজ মর্মান্তিক রূপে উন্মোচিত হয়েছে। তিনি একবার অমৃতার বাবার সাথে সিঙ্গাপুর যাবার বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন। ভদ্রলোক প্রথমেই লৌহতুল্য কণ্ঠে সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘দেখুন আমার মেয়ের বিষয়ে আপনি আর কোনো ধরনের মতামত ব্যক্ত না করলেই খুশি হব। এই দখলদারী আমার পছন্দ হচ্ছে না।’

এমন সোজাসাপ্টা মন্তব্যের পর আর কথা বাড়ানো যায় না। তিনি ব্যর্থ চিত্তে ফিরে এলেন নিজ স্থানে। অনতিদূরে রুদ্র আর আকাশ শীর্ণ মুখে বসে আছে। হৃদি আপাতত সামির সাথেই আছে। থানা থেকে ফেরেনি সে। বিভা খুব কান্নাকাটি করছে। কথায় আছে বিপদ কখনো একা আসে না। দলবল সাথে নিয়েই আসে। আজ দুপুরে অভিজিতের মা হার্ট অ্যাটাক করেছেন। এর মাঝেই কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে ওরা। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিভার পক্ষে অমৃতার এই বিপন্ন দিনে ঢাকায় আসা সম্ভব হচ্ছে না। বান্ধবীর জন্য এক আকাশ ভালোবাসা বুকে টলমল করলেও বাড়ির বউ হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটাই অধিকতর জরুরি কাজ হিসেবে স্বীকৃত এই সমাজে। তাছাড়া অভিজিতের বিষাদ জড়ানো মুখের দিকে চেয়ে, অসুস্থ শাশুড়িকে ফেলে ঢাকা যাবার কথা বলতেও তার বিবেকে বাধছে। অভিজিৎও নিজ থেকে কিছু বলছে না। ও তো জানে বন্ধুরা বিভার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। আজকে অমৃতা মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছে। বাকি বন্ধুদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিভা এই বিপদের দিনে একটাবার বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। ওদের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখতে পারছে না। এই দুঃসহ কষ্টের ভার বুকে নিয়ে সে কলকাতার পথে যাত্রা শুরু করেছে। অভিজিৎ এই কষ্টের কোনো আঁচই টের পাচ্ছে না। সে মায়ের অসুস্থতার শোকে কাতর। অমৃতার অস্তিত্বই যেন বিলীন হয়ে গেছে তার চেতনা থেকে। দিনের-পর-দিন পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকা চিরচেনা মানুষগুলোও মাঝে মাঝে কতই না অচেনা হয়ে যায়! বিভা সারাক্ষণ মানুষটার বুকের সাথে লেগে থাকে, দুজনের নিঃশ্বাসেও এতটুকু ফাঁক থাকে না, অথচ আজ… জীবনের এই চরম টানাপোড়েনের মুহূর্তে দুটি মন বিপরীতমুখী দুই রথে চড়ে বসে আছে। বিভার যে শাশুড়ির জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে না তা নয়। সে মনে-প্রাণে চাইছে ভগবান যেন উনাকে সুস্থ করে দেন। শাশুড়িকে সে মন থেকে শ্রদ্ধা করে, ভালোও বাসে! কিন্তু অমৃতা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় অচেতন পদার্থের মতো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে এই ঘটনা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। হাশিখুশি, সপ্রতিভ, চটপটে এক যুবতী মেয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এমন নিষ্প্রতিভ নিস্তেজ হয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করা যায়? বিস্তারিত ঘটনা এখনো তার অজানা। বন্ধুরা সবটা খুলে বলতে চাইছে না। কিছু একটা লুকাচ্ছে। অসহনীয় দুর্ভাবনায় পিষ্ট হচ্ছে বিভার মন। একটাবার ঢাকায় বন্ধুদের কাছে ছুটে যেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সাংসারিক দায়িত্ব থেকে আজ আর তার নিষ্কৃতি নেই। অগ্নিসাক্ষী রেখে যেদিন অভিজিতকে গ্রহণ করেছিল সেদিনই পূর্বের জীবনের সাথে বাঁধা সুতোর বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছিল। বাপের বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর পর শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে আর ফিরে তাকাবার অবকাশ নেই।

রুদ্র আর আকাশ অস্থির চিত্তে হাসপাতালের লবিতে ঘোরাফেরা করছে। মনীষা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। সঙ্গে তারাও আছে। বিষণ্ণ দুই যুবককে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা তাদের জানা নেই। টানা অনেকগুলো ঘণ্টা ধরে উপোস ওরা। ক্ষুধা তৃষ্ণার তাড়না নেই ভেতরে। চোখে খাঁ-খাঁ করছে শূন্যতা। মুখ ফ্যাকাশে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানা গেলো পেশেন্টের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আইসিইউ থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছে কেবিনে। পুলিশের দুজন লোক হাসপাতালেই অপেক্ষা করছিল। খবর পাওয়ামাত্র তারা কেবিনে ছুটে গেলো। অমৃতার বাবা-মা কিছুতেই এই অবস্থায় মেয়েকে পুলিশের জেরার মুখে ঠেলে দিতে রাজি নন। উনারা তীব্র আপত্তি জানালেন। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। তাদের নিষেধ অমান্য করেই পুলিশের সদস্যরা কেবিনে প্রবেশ করল।

যমে-মানুষে টানাটানির শীতল কয়েকটা ঘণ্টা পার হবার পর অমৃতা চোখ খুলে তাকাতে পেরেছিল ক্ষণিকের জন্য। অনেক কষ্টে! মাথায় শত শত সূচ বিঁধে চলেছে ক্রমাগত। মাঝে মাঝেই জোয়ারের মতো ফিরে আসছে স্মৃতিরা। কত গুরুত্বহীন ঘটনা যে ভেসে উঠছে চোখের সামনে! আবার হারিয়েও যাচ্ছে নিমেষে। অন্ধকারের করাল আঘাত গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত চেতনা!

‘মিস অমৃতা, আপনার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’

অমৃতা চোখ তুলে তাকালো। তার সর্বাঙ্গে এখনো মৃত্যুর ঠান্ডা স্পর্শ। বুকের ওপর ভারী পাথরের মতো কিছু একটা চেপে বসে আছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট! লক্ষ্যহীন ঝাপসা চোখে সম্পূর্ণ অপরিচিত দুটি মানুষকে আবিষ্কার করল সে কেবিনে জ্বলতে থাকা টিউব লাইটের নিচে। এরা কারা? বাবা-মা কোথায়? দীপা কোথায়? কোথায় তার বন্ধুরা? সে কি অন্য জগতে চলে এসেছে? মৃত্যু কি ঘটে গেছে এর মাঝেই? সামনে দাঁড়ানো দুই মূর্তি গোর-সাওয়ালকারী ফেরেশতা নয় তো? শীতল একটা ভয়ের স্রোত বেয়ে গেলো ওর মেরুদণ্ড দিয়ে। ঠোঁট নাড়াতে গিয়ে চোয়াল দুটি টনটন করে উঠল তীব্র ব্যথায়। ক্ষীণ স্বরে কোনো রকমে বলতে পারল, ‘আপনারা কারা?’

একজন বলল, ‘আমরা পুলিশের লোক। আপনার সাথে ঠিক কী ঘটেছিল সে বিষয়ে যতটা সম্ভব খুলে বলুন।’

অমৃতা ফ্যাকাশেভাবে বলল, ‘আমি কোথায়?

‘আপনি হাসপাতালে আছেন এই মুহূর্তে। ভালো আছেন। বাইরে আপনার পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছে। একটু পরেই তাদের দেখতে পাবেন।’

অমৃতা চোখ বন্ধ করল। ধুলো পড়া ঝাপসা মস্তিষ্কে হাতড়ে হাতড়ে স্মৃতি উদ্ধারের চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে তার সবটাই মনে পড়ল। বুকের মাঝে ফিরে এল জাগতিক মন। ফিরে এল যুক্তিবোধ। কেউ একজন ঝপ করে চোখের সামনে মেলে ধরল পার্থিব জীবনের হিসেব-নিকেশ সম্বলিত এক অসম্পূর্ণ খতিয়ান। মনে হলো এই কলঙ্কিত জীবনে ফিরে আসার চাইতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই ঢের ভালো ছিল!

এমন সময় একজন মধ্যবয়সী নার্স প্রবেশ করল ঘরে।

‘দেখুন রোগীর অবস্থা এখনো স্টেবল নয়। আপনারা দ্রুত কাজ শেষ করুন। রোগীর এই মুহূর্তে কথা বলা নিষেধ।’

পুলিশের একজন বলল, ‘মিস অমৃতা, আপনার মাথায় আজ সকাল বেলায় কে আঘাত করেছিল? আঘাতক ব্যক্তির নামটা বলুন।’

অমৃতা অস্ফুটে বলল, ‘কেউ না!’

‘স্পষ্ট করে বলুন প্লিজ।’

‘আমাকে কেউ আঘাত করেনি। এটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল।’

‘কী রকম অ্যাক্সিডেন্ট?’

‘আমি… আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছি।’

‘প্রত্যক্ষদর্শীরা কিন্তু অন্য রকম কথা বলেছে। আপনার বন্ধুটিও স্বীকার করে নিয়েছে অপরাধ।’

‘আমার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আপনারা এই কেস এখানেই ক্লোজ করে দিন প্লিজ।’

পরিবারের সদস্যদের পালা শেষ হবার পর আকাশ আর রুদ্র কেবিনে প্রবেশ করার অনুমতি পেল। অমৃতার চোখের দৃষ্টি তখনো স্বাভাবিক নয়। পরনে হাসপাতালের রোগীর পোশাক। মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতের রগে লাগানো আছে স্যালাইনের চ্যানেল। মুখ পাণ্ডুবর্ণ। শ্বাস ক্ষীণ। শুষ্ক চামড়ার নিচের নীল শিরা প্রকটভাবে ভাসমান। এই অবস্থায়ও দুই বন্ধুকে দেখে হালকা হাসার চেষ্টা করল সে। আকাশ আর রুদ্র দরজার সামনেই কয়েকটা সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। অমৃতাকে এভাবে দেখতে হবে ভাবেনি কখনো ওরা। অমৃতা বন্ধুদের মধ্যে সবচাইতে সাহসী, সবচাইতে নির্ভীক, সবচাইতে উজ্জ্বল! সেই সদা-প্রসন্ন, সহাস্য, দীপ্তিময় মেয়েটির এমন মর্মান্তিক দশা সহ্য করা যেকোনো মানুষের পক্ষে কষ্টকর। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নাটা এবার আর রুখতে পারল না আকাশ। অমৃতার শীর্ণ মুখখানা দেখামাত্র তার বুক মুচড়ে উঠল। ঢোক গিলে কান্না দমানোর চেষ্টা করে অস্ফুট স্বরে রুদ্রকে বলল, ‘তুই থাক। আমি আসতেছি একটু পরে।’ কান্না লুকোনোর উদ্দেশ্যেই যে ওর এই প্রস্থান তা বাকি দুই বন্ধুর বুঝে নিতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আকাশ ঘর থেকে। রুদ্র এগিয়ে এল। বসল বেডের পাশের চেয়ারে। অমৃতার রোগা, বিশীর্ণ, সাদা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন কেমন আছিস?’

অমৃতার চোখের কোল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কান বরাবর। কাঁপা ঠোঁট দুটোকে অনেক কষ্টে নিজের আয়ত্বে এনে দুর্বল গলায় বলল, ‘এখন ভালো আছি দোস্ত!’

রুদ্রর কটা চোখের মণিতে জলের ঝাপটা এসে লাগছে। ভেতরটা কাঁপছে প্রবলভাবে। অনেকটা সময় সে কথা বলতে পারল না। অমৃতার হাতে হাত রেখে চুপ করে বসে রইল।

‘তোরা কেমন আছিস?’ প্রশ্ন করল অমৃতা।

রুদ্র এবার একটু হাসার চেষ্টা করল, ‘যেমন রেখেছিস…!’

অমৃতা রুদ্রর হাতের ওপর নিজের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি সরি দোস্ত! আমার জন্য তোদের অনেক ঝামেলা হয়ে গেল। তোরা সবাই নিষেধ করছিলি আমি শুনি নাই…..।’

‘এখন এসব কথা থাক।’ রুদ্র থামিয়ে দিল ওকে। একটু বিরতি নিয়ে বলল, ‘সব ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না। সুস্থ হয়ে ওঠ। সব আগের মতো হয়ে যাবে।’

‘হৃদি কোথায়?’

‘সামির সাথে আছে।‘

‘বিভা?’

‘বিভার শাশুড়ি একটু অসুস্থ। তাই আসতে পারে নাই ঢাকায়। তোর সাথে কথা বলায় দিবনে একটু পর।’

‘আকাশটা আবার কোথায় গেল?’

‘আছে আশেপাশেই। তুই টেনশন নিস না।’

অমৃতা চোখ বুজল। আর একজন মানুষের কথা তার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। সেই মানুষটা কোথায় আছে, কেমন আছে সেই খবর পাবার জন্য তৃষিত মনটা ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করছিল। কিন্তু রুদ্রর সামনে এই মুহূর্তে তার নাম উচ্চারণ করার সাহস হলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো সাহসের অভাবে মনে উদয় হওয়া প্রশ্ন ঠোঁটের দ্বারপ্রান্তে টেনে আনতে পারল না অমৃতা। কী দিন এল! বন্ধুদের কাছ থেকেও মনের ভাব লুকোতে হয় এখন!

আকাশ কেবিন সংলগ্ন করিডোরটা পার হতেই রাশেদের মুখোমুখি পড়ল। তীব্র হয়ে উঠল চোখের চাউনি। চোয়াল শক্ত। রাশেদ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। অমৃতার কেবিনের নার্স এগিয়ে আসছিল। আকাশের উগ্র চোখের চাউনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাশেদ হেঁটে এলেন কয়েক পা। নার্সকে প্রশ্ন করলেন, ‘পেশেন্ট কেমন আছে এখন?’

নার্স পরিষ্কার গলায় বলল, ‘ক্রাইসিস কেটে গেছে। কপালে বেশ কয়েকটা সেলাই পড়েছে। রেস্টে থাকতে হবে। কথা কম বলতে হবে। স্যালাইন চলছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে সেরে উঠবেন।’

রাশেদ কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে ধন্যবাদ জানালেন নার্সকে। এই মুহূর্তে অমৃতার পরিবারের কোনো সদস্য উপস্থিত নেই হাসপাতালে। বন্ধুরা আছে। একটাবার অমৃতার সাথে দেখা করা যায় কি? কোনো কথা বলবেন না, খুব বেশিক্ষণ দাঁড়াবেনও না। শুধু দূর থেকে একবার দেখবেন! অবিন্যস্ত টলমল পা আর কম্পমান বক্ষ নিয়ে কেবিনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন তিনি। মনে জোর নেই। আত্মবিশ্বাস ক্ষীণ। সারাদিনের অভুক্ত শরীরে দুর্বলতা বাসা বেঁধেছে। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে একটা শক্ত কণ্ঠস্বর তীব্র গতিতে ছুটে এসে কর্ণকুহরে টোকা দিল।

‘কী চাই?’

রাশেদ ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশের রুদ্রমূর্তি আবিষ্কার করলেন। অপমানে টনটন করে উঠল ভেতরটা। আত্মসম্মানে ঘা পড়ল। হাঁটুর বয়সী একটি ছেলে আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে জেরা করছে। এত সাহস কোথায় পায় এরা? ঝলসে ওঠা মেজাজটাকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে তিনি চট করে জায়গাটা থেকে সরে পড়লেন। হনহন করে হেঁটে পেরিয়ে গেলেন করিডোর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *