স্বপ্নের নেশা

স্বপ্নের নেশা

একটা সরু গলির শেষ প্রান্তে সেই বাড়িটি। ট্যাক্সিওয়ালা বড় রাস্তায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। এ দেশের ট্যাক্সিওয়ালারা একেবারে ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ির দোর গোড়ায় নামিয়ে দেয়, কিন্তু এই সরু গলিতে গাড়ি ঢুকবে না, ভারী সুটকেসটা আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।

দুপুরবেলা, কোনও জন-মনুষ্য নেই, থাকার কথাও নয়। গলিটার দুপাশে উঁচু দেয়াল, একেবারে নিরেট, মনে হয় কোনও কলকারখানা আছেদু-ধারে। বাড়িটার দরজার সামনে এসে ঠিকানাটা ভালো করে দেখে নিয়ে আমি বেলের বোতামে হাত দিলাম।

একটু পরে দরজা খুলল একজন লোক, বয়েস হবে চল্লিশের কাছাকাছি, মুখে না-কামানো দাড়ি, ময়লা জিনসের প্যান্ট আর একটা গেঞ্জি পরা, হাতে একটা হাতুড়ি। কিছু না বলে সে তাকিয়ে। রইল আমার দিকে।

সুটকেসটা নামিয়ে রেখে বললাম, আমি ইণ্ডিয়া থেকে এসেছি, এটা নিশ্চয়ই একটা গেস্ট হাউস? এখানে আমার একটা ঘর বুক করা আছে আজ থেকে।

লোকটি তবু নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল বলে আমি পকেট থেকে চিঠিটা বার করে দেখালাম।

সে চিঠিটা আমার হাত থেকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দরজা খোলা রেখে। দুমদাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পায়ের শব্দ পেলাম।

এক মিনিট বাদেই সে ফিরে এল হাসি মুখে। হাতুড়িটা রেখে এসেছে, প্যান্টে হাত মুছে সে তুলে নিল আমার সুটকেসটা। মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ভেতরে আসবার জন্য।

এসব দেশে নিজের মালপত্র নিজেকেই বইতে হয়। আর এটা তো হোটেল নয় যে-কোনও বেল বয় থাকবে! আমি লোকটিকে বললাম, না, না, সুটকেসটা আমিই নিচ্ছি! লোকটি সে-কথা শুনল না, দ্রুত এগিয়ে গেল।

এ পর্যন্ত লোকটি একটিও শব্দ উচ্চারণ করেনি। বোবা? সাহেব-বোবা আমি কখনও দেখিনি আগে।

সরু কাঠের সিঁড়ি, কার্পেট নেই, বেশ খানিকটা দৈন্য দশা বলেই আমার মনে হয়। আমি অসন্তুষ্ট হলাম। যেসব বাড়ির দু-একটা ঘর বাইরের লোকদের ভাড়া দেওয়া হয়, তার একটা নির্দিষ্ট মান থাকার কথা। এরকম ভাঙাচোরা সিঁড়ি কেন?

উঠতে হল তিনতলায়। এখানটা অবশ্য বেশ ঝকঝকে তকতকে। সদ্য রং করা ও ওয়াল পেপার বদলানো হয়েছে বোঝা যায়। ঘরে সুন্দর বিছানা পাতা। বাথরুমটি পরিচ্ছন্ন। অভিযোগ করার কিছু নেই।

সেই লোকটি বাথরুমের কল খুলে গরম জল, ঠাণ্ডা জল দেখিয়ে দিল, একবার ফ্লাস টানল, আলোর সুইচ জ্বালাল-নেভাল, সবই নিঃশব্দে।

সামনা-সামনি দুটো ঘর, মাঝখানে বসবার জায়গা। একটা শ্বেত পাথরের টেবিল। তার ওপর একটি চিঠি চাপা দেওয়া। লোকটি সেই চিঠিটা দিল আমাকে।

তাতে ইংরেজিতে আমার উদ্দেশ্যেই লেখা আছে যে, তোমার ঘর প্রস্তুত। তোমার বিছানায় পাশের টেবিলের ড্রয়ারে একটি চাবি আছে। তুমি যখন খুশি যাওয়া আসা করতে পারো, ওই চাবিতে সদর দরজা খোলা যাবে। তোমার আর কিছুর প্রয়োজন থাকলে সন্ধেবেলা আমাকে জানিও।

তলায় একজন মহিলার সই।

আমি বললাম, থ্যাংক ইউ। আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

লোকটি হাসি মুখে আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে চলে গেল।

আমি সুটকেস খুলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। এখন থেকে সাতদিন এই ঘরের মধ্যে আমার সংসার। হোটেলের চেয়েও এই ধরনের গেস্ট হাউস আমার বেশি পছন্দ। খরচ একটু কম পড়ে তো বটেই, তা ছাড়াও একটা বাড়ি-বাড়ি বোধ থাকে। হোটেলগুলো সব দেশেই প্রায় একই রকম আর একঘেয়ে।

ভালো করে স্নান সেরে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।

খিদে নেই, শরীর এখন ঘুম চাইছে। বহুক্ষণ প্লেন জার্নি করে এলে মাথাটা কেমন অবশ হয়ে যায়।

বিছানাটা বেশ নরম। জানলাগুলোতে সাদা সিল্কের পর্দা। ভেবেছিলাম শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ব, কিন্তু তা হল না। ঘুমের প্রয়োজন হলেই যে ঘুম আসবে তার তো কোনও মানে নেই। এক একসময়ে ঘুমের পায়ে ধরে সাধাসাধি করলেও ঘুম আসে না।

খানিকক্ষণ ছটফট করার পর হঠাৎ মনে পড়ল, দুটো টেলিফোন করা খুব দরকার। এ ঘরে টেলিফোন নেই। হোটেলের তুলনায় এই একটা অসুবিধে। অধিকাংশ গেস্ট হাউসেই টেলিফোন ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকে না।

বোবা লোকটি ছাড়া এ বাড়িতে আর কোনও লোক আছে বলে মনে হল না। ওর কাছ থেকে কিছু জানারও উপায় নেই। রাস্তায় বেরুলেই অবশ্য টেলিফোন বুথ পাওয়া যাবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি আমার একেবারে অচেনা নয়, আগে এসেছি।

জামা-প্যান্ট জুতো পরে আবার তৈরি হয়ে নিতে হল। চাবিটা নিয়ে নামবার সময় দেখলাম, সেই লোকটি হাতুড়ি-করাত নিয়ে সিঁড়ি সারাচ্ছে। এক জায়গায় কাঠ-ফাঠ সব খুলে ফেলেছে, আমাকে ডিঙিয়ে যেতে হল, লোকটির সঙ্গে হাসি বিনিময় করলাম।

ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এসে দেখি, তখনও সে একমনে কাজ করে যাচ্ছে। সিঁড়ির অনেকটা অংশ সে নতুন করে ফেলেছে। তাঁর গেঞ্জিটা ভিজে গেছে ঘামে।

সন্ধের সময় গৃহকত্রী আমার খবর নিতে এল। বেশ গাঁট্টা-গোঁট্টা চেহারার জার্মান মহিলা, মুখের ভঙ্গি প্রাশিয়ানদের মতন। মোটামুটি কাজ চালানো ইংরেজি জানে। কাছাকাছি ট্রাম-স্টপ, বাস স্টপ ও হোটেল রেস্তোরাঁর কথা জানিয়ে দিল আমাকে। আমি ভাড়ার টাকা দিয়ে দিলাম অগ্রিম।

সেই বোবা লোকটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত বোবারা কালাও হয়। কিন্তু এই লোকটি যেন সবকথা শুনছে মন দিয়ে। ওর গলায় বেশ বড় একটা লকেট, তাতে কার যেন একটা ছবি। আমাদের দেশে যেমন সাঁইবাবা কিংবা অন্য কোনও গুরুর ছবি অনেকে গলায় ঝোলায়,। সেইরকমই কোনও ব্যাপার মনে হল। লোকটি আপন মনে লকেটটি নাড়াচাড়া করছে এক হাতে।

মহিলাটি বলল, আমার স্বামীর সঙ্গে তোমার তো আগেই আলাপ হয়েছে? আমি সারাদিন বাড়ি থাকি না। কিন্তু ফিলিপ থাকবে। তোমার যখন যা প্রয়োজন হয়, এর কাছে চাইবে।

এই বোবা লোকটি এই মহিলার স্বামী? আমি ওকে ছুতোর মিস্তিরি ভেবেছিলাম। তাড়াতাড়ি ডানহাত বাড়িয়ে ওর সঙ্গে করমর্দন করলাম। ওর হাসিটি বেশ সারল্য মাখা।

গৃহস্বামিনী তার নিজের খুব একটা শক্ত নাম বলে বললেন, আমাকে অবশ্য এ নামে কেউ ডাকে না, আমাকে সবাই নোরা বলে। এবং আগেও আমাদের এখানে দু-একজন ভারতীয় অতিথি থেকে গেছে। তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। আশা করি, তোমারও…

আমি বললাম, না, না, চমৎকার জায়গা। রেল স্টেশনেরও খুব কাছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখান থেকে বুক ফেয়ার যাওয়া-আসারও সুবিধে হবে।

নোরা বলল, আমরাও একদিন বুক মেসে দেখতে যাব। তুমি কি আমাদের জন্য টিকিট এনে দিতে পারবে? আমার স্বামী খুব বই ভালোবাসে, ও নিজেও একজন কবি!

আমি আবার চমকে উঠলাম। সঙ্গীত স্রষ্টা বিথোফেন একসময় কালা হয়ে গিয়েছিলেন, হোমার মিল্টন হয়েছিলেন অন্ধ, কিন্তু মূক ব্যক্তি কখনও কবিতা রচনা করেছে, এমন শুনিনি!

নোরা বলল, ও অবশ্য জার্মান ভাষায় লেখে না। লেখে ম্যাসিডোনিয়ান ভাষায়!

আমি বললাম, মাকেদোনিয়ান?

এবার নোরা একটু চমকে উঠল। কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে বলল, তুমি ওই ভাষার কথা জানো? আমরা জার্মান নই, মাকেদোনিয়ান!

আমি আরও একটু জ্ঞান ফলাবার জন্য বললাম, তার মানে তোমরা ঠিক কোথাকার? মাকেদোনিয়া নামে তো কোনও দেশ নেই। সে দেশটুকরো-টুকরো হয়ে খানিকটা বুলগেরিয়া, খানিকটা যুগোশ্লোভিয়া আর খানিকটা গ্রিসের মধ্যে ঢুকে গেছে। বোধহয় আলবেনিয়ার মধ্যেও কিছুটা গেছে, তাই না? তোমরা কি যুগোশ্লাভিয়া থেকে এসেছ? আমি একবার…

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই এক কাণ্ড ঘটল।

এতক্ষণ যাকে বোবা ভেবেছিলাম, এবার সে কথা বলে উঠল। বেশ রাগত সুরে সে কী যেন জিগ্যেস করল নোরাকে। সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ভাষা!

তারপর নোরা আর ফিলিপ নিজেদের মধ্যে কথা বলে যেতে লাগল ওই ভাষায়। যেন ঝগড়া করছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বোকার মতন।

একটু বাদে নোরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার স্বামী তোমাকে ভেবেছে স্পাই! আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি যে তুমি ইন্ডিয়ান, তোমার এ ব্যাপারে কোনও স্বার্থ নেই, ইণ্ডিয়ানরা এসব সাতে-পাঁচে থাকে না…

যাঃ বাবা আমাকে স্পাই ভেবেছে? তার মানে এখানে কি কোনও গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার চলছে? বোমা-বন্দুক বানায়? এ কোথায় এলাম?

নোরা আমাকে গুটেন নাখট জানিয়ে স্বামীর হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গেল। দুজনে তখনও তর্কাতর্কি করছে।

খুব একটা ভয় না পেলেও আমার খানিকটা দুশ্চিন্তা হল ঠিকই। হঠাৎ স্পাই-এর কথা উঠল কেন? বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে কোনও গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ব না তো? একজন লোক কথা বলতে পারে, তবু বোবা সেজে থাকে, এটাও বেশ সন্দেহজনক!

ফিলিপের মুখখানা দেখলে তাকে সরল, ভালোমানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু হঠাৎ সে রেগে উঠল কেন? আমি এমন কী বলেছি?

কয়েক বছর আগে আমি যুগোশ্লাভিয়াতে ওখরিদ নামে একটা হ্রদের পারের ছোট্ট শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন হয়। সেখানে গিয়েই আমি শুনেছিলাম

যে সে অঞ্চলের ভাষা হচ্ছে ম্যাসিডোনিয়ান এবং সেই ভাষার দাবি-প্রতিষ্ঠার জন্য একটা আন্দোলন চলছে। আমি যে বাংলা কবিতাটি পাঠ করেছিলাম, তার অনুবাদ শোনানো হয়েছিল ম্যাসিডোনিয়ার ভাষায়!

ম্যাসিডোনিয়া! নামটা শুনলেই রোমাঞ্চ হয়।

যিশুর জন্মেরও প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে ওই ছোট্ট একটা দেশের রাজা ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আমাদের দেশের গল্পে-ইতিহাসে আলেকজান্ডারের একটি বিশেষ স্থান আছে, তার কারণ, পারস্য, মিশর, ব্যাবিলন পায়ের তলায় মাড়িয়ে এলেও। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার ভারত জয় করতে পারেননি। তক্ষশিলার বিশ্বাসঘাতক রাজার সাহায্য নিয়ে তিনি ঝিলাম নদীর পারে মহারাজ পুরুকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন বটে, কিন্তু পুরুর পরাক্রম দেখে তিনি তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বও করেছিলেন। ভারতীয় সৈন্যদের শৌর্য দেখে আলেকজান্ডারের বাহিনীও আর এগোতে চায়নি, গঙ্গা পার হননি আলেকজান্ডার।

আমার ধারণা ছিল, এত হাজার বছরের ইতিহাস-ভূগোলের নানান ওলোট-পালোটে ম্যাসিডোনিয়া নামটা মুছে গেছে মানচিত্র থেকে। আলেকজাণ্ডারের অকাল মৃত্যুর পরই তাঁর সাম্রাজ্য টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। ম্যাসিডোনিয়া নামটা তো আর কোথাও পাইনি।

কিন্তু যুগোশ্লাভিয়া গিয়েই জানতে পারলাম, ম্যাসিডোনিয়া নামে দেশটা হারিয়ে গেলেও সে নামটা এখনও লুপ্ত হয়নি। তিন-চারটি দেশে ছড়িয়ে আছে ম্যাসিডোনিয়া, সেই প্রাচীন ভাষা এখনও গ্রিক কিংবা সার্বো-ক্রোয়াশিয়ানের সঙ্গে টক্কর দেয়। ম্যাসিডোনিয়া নামটারও আসল উচ্চারণ মাকেদোনিয়া।

জার্মানিতে বহু জাতের মানুষ থাকে। আমি এসে পড়েছি এক ম্যাসিডোনিয়ান পরিবারে। কিন্তু এরা স্পাই-এর ভয় পায় কেন? এরা এখানে অবৈধভাবে আছে? কিন্তু আমিও তো আন্দাজে এখানে আসিনি। বইমেলা কর্তৃপক্ষের কাছে হোটেল ও গেস্ট হাউসের একটা তালিকা থাকে, সেখান থেকে ঠিকানা দেখে আমি আগে যোগাযোগ করেছি। বইমেলা কর্তৃপক্ষ তো ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে কারুর নাম সুপারিশ করবে না! তারা গেস্ট হাউসগুলোও পরিদর্শন করে যায়। সুতরাং এদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও গণ্ডগোল থাকলে ধরা পড়ে যেত।

এরা যদি বোমা-বন্দুকের কারবারি হয়, তা হলে সামান্য কিছু টাকার জন্য বাইরের অতিথি রাখবেই বা কেন?

সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরেই মনে পড়ল চায়ের কথা।

গেস্ট হাউসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে না, বাইরেই খেতে হয়, কিন্তু সাধারণত ব্রেক ফাস্ট দেয়। কিন্তু হোটেলের মতন ঘরে চা দিয়ে যাবে না নিশ্চয়ই। ঘুম ভাঙার পর চায়ে চুমুক না দিয়ে আমার দিনটাই শুরু করতে পারি না।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মনে হল, লজ্জা করে লাভ নেই, নীচে গিয়ে চাইতে হবে।

তিনতলার অন্য ঘরটিতে কেউ আসেনি। দোতলা-একতলায় ওরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কারুর অস্তিত্ব টের পাইনি।

সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়াতেই দেখলাম, একতলার একটি ঘর থেকে ঘুমচোখে বেরিয়ে এল স্বামীটি। একটা হাফ-প্যান্ট পরা, খালি গা। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েই সে পেছন ফিরে এক দৌড় মারল। ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে।

এই রে, লোকটা বোধহয় আমার ওপর এখনও রেগে আছে।

কিন্তু রাগ করুক আর নাই করুক, আমার তো চা না হলে চলবে না। মহিলাটিকে ডাকি কী করে? নেমে এলাম নীচে।

ফিলিপ আবার বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এখন প্যান্ট-শার্ট পরা, খুব তাড়াতাড়ি ভদ্রস্থ হয়ে এসেছে। খালি-গায়ে ছিল বলে আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছিল।

মাথা নেড়ে বলল, মর্নিং মর্নিং!

ফিলিপ তা হলে ইংরেজিও জানে? কাল আমার সামনে একটি অক্ষরও উচ্চারণ করেনি। এটাই বা কী রহস্য?

ড্রেসিং গাউন পরে এবার বেরিয়ে এল নোরা। সুপ্রভাত বিনিময় করার পর আমি জিগ্যেস করলাম, দয়া করে আগে এক কাপ চা দিতে পারবে কী? ব্রেক ফাস্ট পরে খাব। আগে একটু চা চাই।

মহিলাটি খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ব্রেক ফাস্ট? তোমার সঙ্গে যে রেট ঠিক হয়েছে, তার মধ্যে তো ব্রেক ফাস্ট নেই! ব্রেক ফাস্টের জন্য ডেলি আরও পঁচিশ মার্ক বেশি লাগে। তুমি সে। কথা কিন্তু চিঠিতে জানাওনি!

আমি বললাম, ও! দুঃখিত! দুঃখিত! ঠিক আছে, আমি ব্রেক ফাস্ট বাইরে খেয়ে নেব!

ওপরে উঠতে-উঠতে হিসেব করলুম। পঁচিশ মার্ক? ওতে আমার লানচ হয়ে যাবে। জ্যাম-জেলি বিস্কিট কিনে ঘরে বসে খেলে সস্তা পড়বে অনেক। দরকার নেই আমার ব্রেক ফাস্ট!

মুশকিল হচ্ছে এই যে চা খেতে হলেও এখন জুতো-মোজা পরে বেরুতে হবে বাইরে। বাসি মুখে চা খাওয়া আমার অভ্যেস। বাথরুম-টাথরুম কিছুই সারা যাবে না। সকালবেলা উঠে টাকা পয়সার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল।

কোনওরকমে মুখ চোখ ধুয়ে এসে মোজাটা সবে পায়ে গলিয়েছি, সেই সময় নোরা এসে দাঁড়াল খোলা দরজার কাছে। হাতে একটা ট্রেতে চায়ের পট, আর একটা ক্রোয়াশ।

আমি একটু বিরক্তভাবে বললাম, আমি তো চাইনি। বাইরে খেয়ে নেব।

নোরা বলল, এটা ফ্রি! এটা ফ্রি!

শুনে আমার আরও খারাপ লাগল। কেন আমি ওর দয়ার দাক্ষিণ্য নিতে যাব? এরা যদি এক কাপ চায়ের দাম নিয়েও হিসেব কষে, তা হলে আমিই বা বিনা পয়সায় নেব কেন?

চা তৈরি করে এনেছে, ফেরানো যায় না। বললাম, না, না, তুমি কেন ফ্রি দেবে? ঠিক আছে, আজকের পঁচিশ মার্ক দিয়ে দিচ্ছি কাল থেকে তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

নোরা আবার বলল, তোমায় পয়সা দিতে হবে না। আমার স্বামী তোমার জন্য এটা বানিয়ে দিয়েছে।

নোরার ইংরেজি ভাঙা-ভাঙা। সবকথা গুছিয়ে বলতে পারে না। ভাষাজ্ঞানের অভাবেই ওর মুখে পয়সার কথাটা অমন রূঢ় শুনিয়েছে। না হলে, এককাপ চা চাইলে এদেশে কেউ দাম চায় না। ও বোধহয় ভেবেছিল, শুধু ঘর-ভাড়ার রেট দিয়ে আমি ওর কাছে ব্রেক ফাস্ট দাবি করছি।

ট্রে-টা নামিয়ে রেখে নোরা বলল, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হয়, ব্রেক ফাস্ট বানাবার সময় পাই না। তবে, তুমি যদি চাও, তা হলে আমার স্বামী তোমাকে বানিয়ে দিতে পারে। কাল তুমি ফিলিপের কথা শুনে রাগ করোনি তো?

আমি বললাম, আমি তো ওর ভাষা বুঝতে পারিনি। রাগ করব কী করে? তোমার স্বামী কি আমার কোনও কথা শুনে রাগ করেছে?

নোরা বলল, না, রাগ করেনি। একটু দুঃখ পেয়েছে। তুমি যে বললে, মাকেদোনিয়া নামে কোনও দেশ নেই! সেই কথা শুনে!

একটু হেসে নোরা নিজের বুকের মাঝখানে একটা হাত রেখে বলল, আসলে ওই দেশটা এখনও আছে। এখানে!

আমি বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, তা তো বটেই। আচ্ছা, তোমার স্বামী ইংরেজি জানে, কিন্তু অন্য লোকদের সামনে বলে না কেন?

নোরা বলল, ও খুব কমই ইংরেজি জানে। আমার চেয়েও কম। কিন্তু ও ইংরেজি বা জার্মান কিছুই বলতে চায় না। মাকেদোনিয়ান ভাষায় তো ফিলিপি কবিতা লেখে, বিদেশে থাকতে-থাকতে সেই ভাষা যাতে ও না একটুও ভুলে যায়, তাই সব সময় সেই ভাষাই বলে। সে ভাষাতেই চিন্তা করে।

কিন্তু তোমার স্বামী যখন বাইরে যায়, কিংবা চাকরি বাকরি করতে গেলে তো মাকেদোনিয়ান ভাষা চলবে না।

ও বিশেষ বাইরে যায় না। ও একজন কবি, চাকরি করবে কেন? এ-বাড়িতেই ওর অনেক কাজ।

আমি চাকরি করি, সেটাই যথেষ্ট।

তোমার স্বামীর কবিতার অনুবাদ হয়নি?

নাঃ! কে করবে?

নোরা চলে যাওয়ার পর মনে পড়ল, আমাকে কেন ফিলিপ স্পাই ভেবেছিল, সেটা তো জিগ্যেস করা হল না! স্বামী কবিতা লেখে বলে বউ তাকে চাকরি করতে দেয় না, এ যে দারুণ ব্যাপার! আগে কখনও শুনিনি!

এরপর দু-তিনদিন আমি ব্যস্ত রইলাম, ওদের সঙ্গে দেখাই হল না ভালো করে। যাওয়া-আসার পথে দেখেছি, বিকেলের দিকে এ-বাড়িতে আরও কিছু লোক আসে, প্রায় সবাই-ই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দোতলার একটা ঘরে ঢুকে যায়। তাদের অতি নিরীহ চেহারা। ফিলিপ সিঁড়ি সারায়, ইলেকট্রিকের লাইন ঠিক করে! আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলে একটু হাসে। আমি ঘরেই চায়ের ব্যবস্থা করে নিয়েছি। ব্রেক ফাস্ট, লাঞ্চ বাইরে খাই, রাত্তিরে প্রায়ই নেমন্তন্ন। থাকে। কোনও অসুবিধে নেই।

দিনচারেক পরে এক সকালবেলা নোরা এসে বলল, আজ তুমি আমাদের সঙ্গে ব্রেক ফাস্ট খাও!

আমি বললাম, কেন? আমার ঘরেই অনেক খাবার রয়েছে, আজ আর অন্য কিছু খাবারের দরকার নেই।

নোরা বলল, আজ আমার ছুটি। ফিলিপ প্যান কেক বানাচ্ছে। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে খেতে আস, আমরা খুশি হব।

এরপর আপত্তি করা যায় না। আমি এক প্যাকেট বেকন-বিস্কিট কিনে রেখেছিলাম, সেটা নিয়ে নেমে গেলাম নীচে। রান্নাঘরটি ছোট, তার মধ্যেই ডাইনিং টেবল। এ-দেশের রীতি অনুযায়ী কারুকে রান্না ঘরে আড্ডা দিতে ডাকা মানে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত।

ফিলিপ গায়ে একটা অ্যাপ্রন বেঁধে প্যানে কী যেন ভাজছে। আমার দিকে তাকিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বলল, মর্নিং সিট! এগ?  

শুধু কয়েকটা ইংরেজি শব্দ, কোনও ক্রিয়াপদ নেই! নোরা বলেছিল, ওর স্বামী মাকেদোনিয়ান ভাষায় লেখে বলে, অন্য কোনও ভাষা বলে না। ওই ভাষাতে চিন্তা করে সব সময়। আমাকে দেখে আজ যে দয়া করে দু-চারটি ইংরেজি শব্দ বলছে, তাই-ই যথেষ্ট।

ভারতবর্ষ সম্পর্কে টুকিটাকি প্রশ্ন করতে লাগল নোরা। সাধারণ কৌতূহল। ফিলিপ কোনও প্রশ্ন করছেনা, মন দিয়ে শুনছে। আমরা নানারকম খাবারের সঙ্গে কাপের পর কাপ কফি পেয়ে যাচ্ছি।

একটু পরে একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ওপরের কাবার্ড থেকে একটা বোতল নামাল ফিলিপ। সেটা আমার সামনে ধরে বলল, উজো! লাইফ।

নোরা বলল, এটা উজো। খাঁটি মাকেদোনিয়ান। খেয়ে দেখবে?

উজো আমি চিনি। একরকমের গ্রিক মদ। অনেকটা আমাদের দিশি মদের মতন। সকালবেলা ও জিনিস পান করার কোনও ইচ্ছে নেই আমার।

আমি বললাম, না, এখন থাক। ফিলিপ বরং দু-একটা তার নিজের কবিতা পড়ে শোনাক না।

নোরা বলল, তুমি কি তা বুঝতে পারবে? তুমি আমাদের ভাষা জানো?

আমি বললাম, তা জানি না। বুঝবো না, ধ্বনিটা শুনবো। যুগোশ্লাভিয়ায় গিয়ে আমি তিন-চারদিন ধরে অনেকের মুখে মাকেদোনিয়ান ভাষা শুনেছি, বেশ মিষ্টি ভাষা মনে হয়।

এটা আমি ওদের খুশি করার জন্যই বললাম। ওরাও শিশুর মতন খুশি হয়ে উঠল। নোরা দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা বই, পত্র-পত্রিকা ও বড়-বড় রোল করা পোস্টার নিয়ে এল।

ফিলিপ নোরাকে কী যেন বলল, নোরা আমাকে বুঝিয়ে দিল যে ফিলিপ নিজের কবিতা পড়বে না। লজ্জা-লজ্জা পাচ্ছে। ও আমাদের ভাষায় অন্য কয়েকজন বড়-বড় কবির লেখা শোনাচ্ছে।

শুনতে-শুনতে আমি মাথা দোলাতে লাগলাম। খারাপ লাগছে না। পড়ার ভঙ্গি আর শব্দগুলির সমন্বয়ে কবিতার মর্ম খানিকটা ধরা যায়।

পড়তে-পড়তে ফিলিপের গলা আবেগে কাঁপতে লাগল একসময়। বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। নোরা তাকে থামিয়ে দিয়ে কফি খেতে বলল।

আমি জিগ্যেস করলাম, মাকেদোনিয়ান ভাষা কত লোকে পড়ে? কবিতার বই বিক্রি হয়?

নোরা মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু হয় না। আজকাল মাকেদোনিয়ানরা অনেক দেশে ছড়িয়ে গেছে। নিজেদের ভাষার আর চর্চা করে না। সেইজন্যই আমরা আন্দোলন করছি।

ফিলিপ কাগজের রোলগুলো খুলে ফেলল। তাতে বেশ সুন্দর-সুন্দর ছবি আঁকা, আর দু-এক লাইন কবিতা। চমৎকার সব পোস্টার।

ফিলিপ নিজের ভাষায় কী যেন বলল খনিকটা, নোরা বুঝিয়ে দিল, এইসব পোস্টার করে আমরা পার্টি ফাণ্ডে টাকা তুলি।

আমি জিগ্যেস করলাম, তোমাদের কী পার্টি?

নোরা বলল, মাকদোনিয়ান পার্টি। আমার স্বামী ফিলিপ তার লিডার।

ফিলিপ বাধা দিয়ে বলল, নো। মাদার! মাদার লিডার।

নোরা বলল, হ্যাঁ। ফিলিপ এখানকার লিডার। আর আমাদের সকলের লিডার হল মা। আমি জিগ্যেস করলাম, কার মা? তোমার, ফিলিপের?

ওরা দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর কীভাবে উত্তর দেবে তার ভাষা খুঁজে না পেয়ে ভাঙা-ভাঙা ভাবে বলল, মা, সকলের মা, আমাদের প্রেরণাদাত্রী। তিনি আমাদের শিক্ষা দেন, তাই তিনি মা। সকলের মা।

ব্যাপারটা ঠিক ধরা গেল না। আমি জানতে চাইলাম, তোমাদের পার্টি কী নিয়ে আন্দোলন করছে?

এর উত্তরে ওরা যা জানাল তা শুনে আমি প্রায় স্তম্ভিত।

ফিলিপ আর নোরা দুজনেই জার্মানিতে এসেছে প্রায় তিরিশ বছর আগে, বাবা-মায়ের সঙ্গে। এখন ওরা জার্মান নাগরিক। কিন্তু এখানে বসে স্বাধীন মাকেদোনিয়ার আন্দোলন চালাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ম্যাসিডোনিয়াকে এরা আবার সংযুক্ত করবে এবং সেটা হবে একটা স্বাধীন আলাদা দেশ। এই বাড়িটা সেই আন্দোলনের কেন্দ্র। যে-সব ম্যাসিডোনিয়ান জীবিকার সন্ধানে জার্মানিতে বসতি নিয়েছে, তাদের একত্র করার কাজ চলছে। এ বাড়ির ওপরের দুটি ঘর অতিথিদের ভাড়া দেওয়া হয় এই আন্দোলনেরই টাকা তোলার জন্য। নোরা এবং আরও কয়েকজন চাকরি করে যে টাকা পায়, সবই এই কাজে ঢেলে দেয়। ফিলিপ এখানকার চব্বিশ ঘণ্টার কর্মী।

ফিলিপের গলায় যে লকেটটা ঝুলছে, তার ভেতরের ছবিটা আমি এবার চিনতে পারলাম। কোঁকড়া-কোঁকড়া চুলওয়ালা আলেকজাণ্ডারের প্রোফাইল!

একমাত্র আলেকজাণ্ডারের জন্য ম্যাসিডোনিয়ার নাম সারা পৃথিবী জেনেছিল। তারপর আর কোনও দুর্ধর্ষ বীর সেখানে আসেনি। ইওরোপ-আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল ভূ-ভাগেই ওই ছোট্ট দেশটির আধিপত্য শেষ হয়ে যায় কিছু কালের মধ্যেই। গ্রিকদের পর জেগে ওঠে রোমানরা। রোমান সাম্রাজ্য বিস্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ম্যাসিডোনিয়ার দর্পচূর্ণ হয়ে যায় চিরতরে। রোমানদের পরে এসেছিল বাইজানটাইন ও অটোমান শাসকরা। অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র থেকে মর্মর সাগর পর্যন্ত একটা রাস্তা ছিল প্রাচীন ম্যাসিডোনিয়ায়, সেই রাস্তাটা দখল করার লোভে বিদেশি শক্তি বারবার এখানে হানা দিয়েছে।

বহুকাল ধরে যে-দেশ সামরিক শক্তিহীন ও খণ্ড-বিখণ্ড, সেই দেশকে আবার সম্পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখছে কয়েকজন মানুষ জার্মানিতে বসে!

নোরা জিগ্যেস করল, তুমি আমাদের মন্দির দেখবে?

আমি আবার অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, মন্দির? কোথায়?

নোরা বলল, এই বাড়িতেই। এসো!

আমি একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম, সেটা দেখিয়ে বললাম, এটা নিয়ে কি যাওয়া যাবে? ফিলিপ আমাকে ইঙ্গিতে বোঝাল সিগারেটটা শেষ করে নিতে।

দোতলার একটি দরজা খুলে দেখা গেল প্রথমে একটা ছোট্ট ঘর। সেখানে সবাই জুতো খোলে। দেয়ালে কয়েকটি ছবি।

একটি ছবির দিকে আঙুল তুলে নোরা জিগ্যেস করল, এটা কার ছবি জানো?

আমি চিনতে পারলাম না। নোরা খানিকটা গর্বের সঙ্গে বলল, অ্যারিস্টটল!

আমি কোনও ভক্তি না দেখিয়ে শুকনো গলায় বললাম, ও!

গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস আমার নমস্য, কিন্তু অ্যারিস্টটল আমার প্রিয় নন মোটেই। তিনি বলেছিলেন, যারা গ্রিক নয়, তাদের সকলকেই ক্রীতদাসের মতন গণ্য করা উচিত!

এরপর একটি বিরাট বড় হলঘর।

ঘরটিকে একটা মিউজিয়ামের মতন মনে হয়। সব দেওয়াল জুড়ে অনেক ছবি, এদিকে-ওদিকে বহু মূর্তি, পুরোনো আমলের বাসন-কোসন, একদিকে সাজানো রয়েছে কিছু অদ্ভুত ধরনের পোশাক।

কয়েকজন নারী-পুরুষ এক কোণে বসে কিছু জামা-কাপড় সেলাই করছে, একজন মেঝেতে কাগজ ছড়িয়ে পোস্টার আঁকছে।

দেওয়ালের ছবিগুলোর মধ্যে আলেকজান্ডারেরই তিন চারখানা। ইনিও আমার প্রিয় নন। ইতিহাসের এইসব দিগ্বিজয়ীদের নিয়ে অনেক রোমান্টিক কাহিনি তৈরি হয় বটে, কিন্তু আসলে তো এরা রক্তপিপাসু, নির্দয়, খুনি। ধ্বংসের সওদাগর। কুড়ি বছর বয়সে রাজা হয়ে। আলেকজাণ্ডার এক দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তুলে ছিলেন। দুঃসাহসী ও অকুতোভয় এই ছোকরাটির পরাক্রমের তুলনা ছিল না ঠিকই, আরও কয়েকটি গুণও ছিল, যা না থাকলে নেতৃত্বই দেওয়া যায় না। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী, প্রচণ্ড মাতাল ও নিষ্ঠুর। মদের ঝোঁকে তিনি পার্সিপোলিস নগর পুড়িয়ে দেননি? নেশাগ্রস্ত অবস্থায় খুন করেননি অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে?

রাজা হওয়ার পরই আলেকজান্ডার গিয়েছিলেন ডেলফির মন্দিরে দৈববাণী শুনতে। সেখানে এক পিথিয়ান সন্ন্যাসিনী তাকে বলেছিলেন, বৎস, তুমি অজেয় হবে। তারপর বহু রাজ্য জয় করতে করতে আলেকজান্ডারের ধারণা হয়ে গিয়েছিল, তিনি সত্যিই অজেয়, সমস্ত বিশ্ব তাঁর পদানত হবে। ক্ষমতার মদ গিলতে-গিলতে এক সময় সেই যুবকটির বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে তিনি সাধারণ মানুষ নন, তিনি দেবতা, তিনি জিউসের সন্তান। তেত্রিশ বছর বয়েসে তিনি এক উন্মাদ। তিনি চেয়েছিলেন, জীবন্ত দেবতা হিসেবে সবাই তাঁকে মান্য করুক। স্পার্টানরা চাপা ঠাট্টার সুরে বলেছিল, আলেকজান্ডারের যখন এতই দেবতা হওয়ার ইচ্ছে, তাহলে হোন তিনি এক দেবতা!

অতি অল্প বয়েসে সেই দেবতাটির মৃত্যু হয়েছিল অতিরিক্ত মাতলামিতে।

নোরা আর ফিলিপ আমাকে দেওয়ালের অন্য ছবিগুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। সেগুলো ম্যাসিডোনিয়ার অন্যান্য বীর পুরুষ, কবি ও নাট্যকারদের। কস্মিনকালেও ওঁদের কারুর নাম। শুনিনি।

আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন খচখচ করছিল। যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিসের মধ্যে ছড়িয়ে আছে টুকরো-টুকরো ম্যাসিডোনিয়া, সেগুলোকে ওরা এক করবে কোন পন্থায়? ওই সব দেশ ছাড়বে কেন? এরা কি যুদ্ধ কিংবা সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে ম্যাসিডোনিয়াকে স্বাধীন করতে চায়?

কিন্তু এ-প্রশ্ন করা বোধহয় আমার পক্ষে সঙ্গত নয়। আবার ওরা আমাকে স্পাই ভাববে।

যেখানে নানারকমের পোশাক ঝুলছে, সেখানে এসে নোরা বলল, এগুলো আমাদের জাতীয় পোশাক। অনেক পুরনো ছবি দেখে বানানো হয়েছে।

আরও কয়েকজন সেই পোশাক সেলাই করছে দেখে আমি জিগ্যেস করলাম, এগুলো কি বিক্রির জন্য?

নোরা ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এগুলো বিক্রি করে টাকা তোলা হয়।

পোশাকগুলো নানারকম ঝলমলে রঙের। মেয়েদেরগুলো বেশ সুন্দর। একটা কিনে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। এদেরও কিছুটা সাহায্য করা হয়।

আমি জিগ্যেস করলাম, কত দাম?

নোরা বলল, দুঃখিত, এটা আমরা শুধু মাকেদোনিয়ানদের বিক্রি করি। আমাদের অল্প বয়েসি ছেলেমেয়েরা তো পুরোনো ঐতিহ্য ভুলে গেছে, নিজেদের ভাষা ভুলে গেছে, এখানকার উগ্র পোশাক পরে। আমরা তাদের আবার জাতীয়তাবাদের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তাদের জন্য ভাষা শেখাবারও ব্যবস্থা আছে।

আধুনিক জার্মানির জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে গেছে যেসব ছেলেমেয়ে, তারা আবার দু-হাজার বছরের পুরোনো পোশাক পরবে, এখানকার পক্ষে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা ভাষা শিখবে, যে দেশের অস্তিত্ব নেই, সেই দেশের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হবে? সময়ের চাকাটাকে এরা ঘুরিয়ে দিতে চায়?

আমার মনে হল, এটা নোরা, ফিলিপ আর কয়েকজনের অলীক স্বপ্ন। অলীক হলেও নিশ্চয়ই খুব মধুর। ওরা এই স্বপ্ন নিয়ে মেতে আছে। এও এক দারুণ নেশা।

একদিকের দেয়ালের পর্দা সরিয়ে ওরা আর-একটা দরজা খুলল।

সেখানে একটা ছোট ঘর, কেমন যেন অন্ধকার-অন্ধকার, ধুলোর ধোঁয়া উড়ছে। সামনে কীসের যেন একটা মূর্তি। এক পাশের জানলার কাছে একটা চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধ মহিলা, মুখের একটা পাশ শুধু দেখা যাচ্ছে। আমরা ঘরে ঢুকলেও তিনি মুখ ফেরালেন না।

বুঝলাম, এটাই ওদের মন্দির।

নোরা ফিসফিস করে বলল, উনি আমাদের মা। সকলের মা। উনি পৃথিবীর সবকিছু জানেন। ওঁর নির্দেশেই আমরা চলি।

ফিলিপ তার নিজের ভাষায় বৃদ্ধাকে কী যেন বলল। বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়ে সেই ভাষাতেই উত্তর দিলেন।

নোরা আমাকে বলল, মা তোমাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছেন। আমি বললাম, ওঁকে আমার নমস্কার জানিয়ে দাও!

ফিলিপ এবার সুইচ টিপে একটা আলো জ্বালাল।

আমার বুকটা ধক করে উঠল। সামনের মস্ত বড় মূর্তিটা আলেকজান্ডারের বুকেফেলাস নামে অশ্বের পিঠে চেপে আছেন সেই দৃপ্ত যুবা, হাতে তলোয়ার, মাথার পেছনে একটা জ্যোতির আভা।

অত্যন্ত সুদর্শন হলেও এ যে আর এক হিটলার! আলেকজান্ডারকে আদর্শ করে ম্যাসিডোনিয়ানরা কি আবার বিশ্বজয়ের চিন্তা করছে?

আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে এল, আলেকজান্ডারকে তোমরা সত্যিই দেবতা বানিয়ে ফেলেছ?

বৃদ্ধা এবার মুখ ফিরিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, ইনি সত্যিই তো দেবতা। ওঁর অনুপ্রেরণায় আমরা স্বাধীন মাসেদোনিয়া ফিরে পাব। তার বেশি দেরি নেই।

বৃদ্ধার মুখ শত কুঞ্চিত, মাথার চুল পাউডার পাফের মতন, কিন্তু চক্ষু দুটি উজ্জ্বল। আমার মনে হল, এর বয়েস দু-হাজার চারশো বছর। ইনিই সেই ডেলফির নারী পুরোহিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *