স্বপ্নের একটি দিন

স্বপ্নের একটি দিন

মনোলীনার মাথায় যত সব অদ্ভুত প্রশ্ন আসে। কখন যে সে কোন কথাটা বলবে, তার কোনো ঠিক নেই। প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে তার এক মুহূর্তও লাগে না। সেই জন্যই মেয়েটিকে বড়ো বেশি রহস্যময়ী মনে হয়।

শুভ্র ভর দুপুরবেলা ওর সঙ্গে এসেছে গঙ্গার ধারে। বেশি ভিড় নেই এখন এখানে। চার পাঁচ জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে-সেখানে। আর কিছু অলস চেহারার মাঝবয়েসি লোক, পৃথিবীর সমস্ত পার্ক বা বেড়াবার জায়গায় এই ধরনের কিছু লোককে বসে থাকতে দেখা যায়। তবুও অনেক বেঞ্চ খালি। কিন্তু একটাও পছন্দ নয় মনোলীনার। বেশ সুন্দর, গাছের ছায়ার নীচের ফাঁকা বেঞ্চ দেখেও সে বলছে, উঁহু, এখানে নয়!

শুভ্র হেসে বলল, তোমার যদি বসতে ইচ্ছে না করে, আমরা হেঁটে বেড়াতে পারি। আমার রোদ্দুরের মধ্যে হাঁটতে ভালো লাগে।

মনোলীনা জিজ্ঞেস করল, হাঁটু পর্যন্ত কাদার মধ্যে তুমি হেঁটেছ কখনও?

শুভ্র বলল হ্যাঁ! কেন হাঁটবো না!

শেষবার কবে? এমনি কলকাতা শহরের কাদা নয়। হাঁটু পর্যন্ত কাদা!

শুভ্র একটু মুশকিলে পড়ল। ঠিক বলা শক্ত, শেষবার কবে সে কাদার মধ্যে দিয়ে হেঁটেছে। বারবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। যেন শুভ্র একটা বাচ্চা ছেলে, ইচ্ছে করে কাদার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে, কোন এক অচেনা নদীর ধারে।

শুভ্র সময় নিচ্ছে দেখে, মনোলীনা বলল—থাক, বলবার দরকার নেই।

মনে পড়েছে! একবার সুন্দরবন গিয়েছিলাম…নৌকো থেকে নেমে—দারুণ কাদা…ঝিনুকের টুকরোয় আমার পা কেটে গিয়েছিল।

কতদিন আগে?

আট-ন-বছর হবে। দাঁড়াও, হিসেব করে দেখছি, না, ঠিক এগারো বছর আগে।

তখন আমি ফ্রক পরতাম।

মনোলীনার বয়েস কুড়ি-একুশের বেশি নয়। শুভ্রর বয়েস প্রায় চল্লিশ ছুঁয়েছে, বেশ কিছু পাকা চুল দেখা যায়। ওদের দেখলে কেউ ঠিক প্রেমিক-প্রেমিকা ভাববে না। ওরা তা নয়ও বোধহয়।

শুভ্র জিজ্ঞেস করল কফি খাবে? দোকানটা খোলা আছে দেখছি।

মনোলীনা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল আমি কোথায় জন্মেছি, জানো?

তুমি যদি জিজ্ঞেস করো, আমি কোথায় জন্মেছি, তাহলে আমি বলব রাস্তায়।

তার মানে?

আন্দাজ করো।

ট্রেনের মধ্যে? প্লেনে? গাড়িতে যেতে যেতে?

না, হল না।

তাহলে? এ তো খুব শক্ত ধাঁধা দেখছি?

আমি তোমাকে আমার জন্মস্থান দেখিয়েও দিতে পারি। সেটা সত্যিই একটা রাস্তা।

ব্যাপারটা কী, খুলে বলো!

আমরা তখন দুবরাজপুরে থাকতাম। মানে, আমার মা আর বাবা থাকতেন। আমি তো তখন পৃথিবীতে ছিলামই না। তারপর আমি জন্মালাম। একটা ছোট্ট সুন্দর সাদা একতলা বাড়ি। এখন সে বাড়িটা নেই। সেই বাড়িটা ভেঙে এখন সেখান দিয়ে একটা রাস্তা হয়েছে। বাস যায়, ট্রাক যায়।

মনোলীনা খুব হাসতে লাগল। তারপর হাতের বইগুলো ঘাসের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললে এখানে বসবে?

শুভ্র বলল না। রোদ্দুরের মধ্যে আমি হাঁটতে পারি, কিন্তু বসে থাকতে ভালো লাগবে না।

মনোলীনা বলল তাহলে ওই গাছের নীচে। মোট কথা মাঠে বসব, বেঞ্চিতে না।

গাছটার তলায় গিয়ে মনোলীনা বসলেও না, সোজা শুয়ে পড়ল। জায়গাটা খুব পরিষ্কার নয়, কিছু আখের ছিবড়ে পড়ে আছে। দু-একটা আইসক্রিমের গেলাস। মনোলীনা সেসব গ্রাহ্য করল না।

শুভ্রর একটু অস্বস্তি লাগছে। একটা মেয়ে মাঠের মধ্যে এরকমভাবে শুয়ে থাকলে পথচারীরা ফিরে ফিরে তাকাবেই। তবু শুভ্র ঠিক করল, সে মনোলীনার কোনো ইচ্ছেতেই বাধা দেবে না।

আমি যখন জন্মাই, তুমি তখন কোথায় ছিলে।

শুভ্র একটু হিসেব করে নিয়ে বললে খুব সম্ভব বিলেতে। আমি উনিশ বছর বয়েসে বিলেতে গিয়েছিলাম পড়তে।

অনেকদিন ছিলে?

প্রায় দশ বছর।

আর তুমি যখন জন্মাও, তখন আমি কোথায় ছিলাম?

শুভ্র এবার হাসলে। এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কোনো মেয়ের কাছ থেকে কখনও শোনেনি শুভ্র। সে যখন জন্মায়, তখন মনোলীনা কোথায় ছিল?

শুভ্র বলল ওই যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে না। ‘ইচ্ছা হয়েছিল মনের মাঝারে—’! তোমার নামটাও এদিক থেকে খুব সার্থক!

তুমি কবিতা পড়ো বুঝি?

কেন ইঞ্জিনিয়ারদের বুঝি কবিতা পড়তে নেই? এখন অবশ্য সময় পাই না, কিন্তু এককালে পড়তাম।

বিলেতে যাবার আগে তুমি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়োনি?

না। বিলেত যাবার পরই!

তুমি ইংরেজিতে প্রথম প্রেম করেছো?

তাও না। বিলেতে গিয়ে আমি একটি বাঙালি মেয়েরই প্রেমে পড়েছিলাম।

সেই মেয়েটিই হাসিদি?

উঁহু। হাসির সঙ্গে আমি প্রেম করেছি দেশে ফিরে এসে।

তাহলে সেই মেয়েটি, যাকে তুমি প্রথম ভালোবেসেছিলে। তাকে তুমি বিয়ে করলে না, নাকি সেই তোমাকে বিয়ে করল না?

সে-ই আমাকে বিয়ে করল না। তার বদলে সে টুপ করে মরে গেল।

তাকে তোমার মনে আছে? তার মুখটা মনে আছে?

হ্যাঁ, সব মনে আছে।

কত বয়েস ছিল তার, যখন সে মরে যায়?

প্রায় তোমারই বয়েসি ছিল।

সেই জন্যই আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমার মনে হয়, আমি যদি এখন মরে যাই, তাহলে আমাকে অনেকে অনেকদিন মনে রাখবে। নইলে, আমি সকলের কাছেই একদিন না একদিন পুরোনো হয়ে যাব।

মনোলীনা, তুমি সত্যিই একটা অদ্ভুত মেয়ে!

মনোলীনা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মাটি থেকে পটাং পটাং করে কয়েকটা ঘাস ছিঁড়ল। তারপর সেইগুলো শুভ্রর কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল তোমাকে যে আজ ডেকে আনলাম, সেজন্য তুমি রাগ করেছ?

শুভ্র বলল না, রাগ করব কেন? তবে একটু অবাক হয়েছি ঠিকই।

অবাক হওয়াটাই তো খুব ভালো। আমার মানুষকে অবাক করে দিতে খুব ভালো লাগে।

আমরা তো আজকাল চট করে অবাক হই না।

জীবনে আমরা যতবার অবাক হই, তার চেয়ে অনেক বেশিবার রেগে যাই, তাই না? অথচ, আমরা কেউ রাগতে চাই না। অবাক হতে চাই।

মেয়েটি এত সুন্দরভাবে কথাটা বলল যে, শুভ্র একটা তীব্র খুশি বোধ করল শরীরে। তার ইচ্ছে করল, মেয়েটিকে আদর করতে। কিন্তু এই দুপুরবেলা খোলা মাঠের মধ্যে।…তা ছাড়া মনোলীনার সঙ্গে তার পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের।

তবু সে হাত বাড়িয়ে মাটির ওপর ছড়িয়ে থাকা মনোলীনার একটা হাত চেপে ধরল। মনোলীনা হাত সরিয়ে নিল না, তার কোমল হাতের স্নিগ্ধ উত্তাপ উপহার দিল শুভ্রকে। তারপর বলল তুমিও শুয়ে পড় না এখানে!

শুভ্র ভুরু উঁচু করে বলল, শুয়ে পড়ব!

হ্যাঁ, কেন, তোমার ইচ্ছে করছে না? টাই আর কোট পরে তোমায় মজার দেখাচ্ছে। কোটটা খুলে ফেলে মাথার বালিশ করে নাও!

হঠাৎ মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়ব?

এমনিতেই শুভ্রর চেনাশুনো কেউ তাকে এই দুপুরবেলা মাঠের মধ্যে বসে থাকতে দেখলে আঁতকে উঠবে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারবে না। শুভ্রজ্যোতি সেনগুপ্ত একজন বিরাট ব্যস্ত মানুষ। বিলেত থেকে ফেরার পরে শুভ্র কিছুদিন সরকারি দপ্তরে কাজ করেছিল, তারপর নিজের ফার্ম খোলে। সারা ভারত জুড়ে তাদের কাজ কারবার, এমনকি মালয়েশিয়াতেও কাজ করেছে কিছু। কাজের ব্যাপারে শুভ্র দারুণ সিরিয়াস। তা ছাড়া, সে হালকা স্বভাবের মানুষ নয়। সে নেশা করে না, বা মেয়েদের পেছনে ছোটাছুটি করে না। গোপনে যদি নারীদের উপভোগ করতে চাইতো সে, তা হলেও তার কোনো অসুবিধে ছিল না। প্রায়ই তাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়, টাকা দিয়ে সে মেয়েদের কিনতে পারে। কিন্তু শুভ্রর সে রকম ইচ্ছে হয় না। বিবাহিত জীবনে সে পরিতৃপ্ত।

মনোলীনার সঙ্গে তার আলাপ মাত্র কয়েকদিন আগে। তার ছোটো শ্যালিকার বান্ধবী এই মেয়েটি। একটি নেমন্তন্ন বাড়িতে প্রথম পরিচয় হয়। সেদিন উৎসব ভাঙতে বেশ রাত হয়েছিল। তার ছোটো শ্যালিকা বলেছিল, শুভ্রদা, তুমি একটু আমার বান্ধবীকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেবে? অনেক রাত হয়ে গেছে, ওকে একা একা যেতে হবে…।

হাসির জ্বর হয়েছিল বলে সেদিন সে নেমন্তন্ন বাড়িতে আসেনি। গাড়িতে আরও লোক উঠেছিল, সবাইকে নামাতে নামাতে গিয়েছিল শুভ্র। মনোলীনার বাড়ি সবচেয়ে শেষে। মনোলীনার বাড়ির সামনে এসেও গাড়ির মধ্যে অন্তত আধঘন্টা কথা বলেছিল দুজনে। প্রথম আলাপেই মনোলীনা তাকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছিল। আজকালকার মেয়েরা বোধহয় এ রকমই বলে।

সেদিন মনোলীনা বলেছিল—তুমি সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দিলে, কিন্তু কারুর সঙ্গে একটাও কথা বললে না কেন?

শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল কথা বলিনি? কই, বললাম তো!

সে শুধু ভদ্রতার কথা। সবাই তোমাকে ধন্যবাদ জানাল, তুমি তার উত্তরে ভদ্রতা দেখালে। তুমি অন্য কথা ভাবছিলে? তুমি বুঝি সব সময় কাজের কথা ভাবো?

প্রথম দিনের আলাপেই কেউ এ রকমভাবে কথা বলে না। তা ছাড়া, একটা কলেজেপড়া বাচ্চা মেয়ে…তার তুলনায় শুভ্র রীতিমতো একজন দায়িত্বপূর্ণ ভারিক্কি লোক।

সেদিন গাড়ি থেকে নামবার সময় মনোলীনা বলেছিল—পাইপ খাও, এক এক সময় তোমার চোখ বুজে যায়—আমি লক্ষ করছিলাম। যারা লোকজনের মাঝখানে চোখ বুজে পাইপ টানে, তাদের সেই সময়টায় খুব বোকা বোকা দেখায়।

শুভ্র এ কথা শুনে রাগ করবে না বিরক্ত হবে, ঠিক করতে পারছিল না। মনোলীনা তক্ষুনি আবার বলেছিল—এবার থেকে চেষ্টা করে চোখ খুলে রেখো…তুমি তো আর সত্যি সত্যি বোকা নও!

শুভ্র এরপর তার ছোটো শ্যালিকা জয়িতাকে বলেছিল—তোমার বান্ধবীটি ভারী অদ্ভুত তো! কী রকম যেন কথা বলে…

জয়িতা বলেছিল ওই মনোলীনা তো, কলেজে ওকে অনেকে পাগলি বলে কিন্তু দারুণ ভালো মেয়ে। মনটা একেবারে সোনার মতন।

দু-তিনদিন বাদেই মনোলীনা একদিন ওদের বাড়িতে এসে হাজির। কয়েক মিনিটেই হাসির সঙ্গে তাঁর দারুণ ভাব হয়ে গেল। কোনো রকম আড়ষ্টতা না দেখিয়ে সে ঘুরে ঘুরে দেখল সব কটা ঘর। শুভ্রর ঘরের দেয়ালে একটা ছবি বাঁকা হয়ে ঝুলেছিল, সেটাকে সোজা করে দিল। চা খেল তিন কাপ। তখন টেলিভিশানে সিনেমা শুরু হবার কথা, তাকে বলা হয় সিনেমা দেখে যেতে। কিন্তু সে তক্ষুনি হাতের বইগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল—না, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

সে কেন এসেছিল, কেন হঠাৎ চলে গেল, কিছুই বোঝা যায়নি। সে যাবার পর দেখা গেল, একখানা বই সে ফেলে গেছে।

আজ সে হঠাৎ শুভ্রর অফিসে এসে হাজির। শুভ্র তখন বোর্ড মিটিং-এ ব্যস্ত ছিল। অন্য যে কেউ হলে সে দেখাই করত না। কিন্তু হাজার হোক একটি যুবতী মেয়ে এবং ছোটো শ্যালিকার বান্ধবী, সুতরাং পুরোপুরি অবজ্ঞা করা যায় না। হাতের কাজ খানিকটা সরিয়ে রেখে সে মনোলীনাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী ব্যাপার!

যেন কতকালের চেনা, এইরকমভাবে মনোলীনা বলেছিল, তোমার অফিসটা দেখতে এলাম! একজন মানুষকে শুধু নেমন্তন্ন বাড়িতে দেখলে চেনা যায় না। নিজের বাড়িতে, অফিসে সে নিশ্চয়ই আলাদা আলাদা মানুষ!

শুভ্র বলেছিল, বিভিন্ন পরিবেশে মানুষ তো খানিকটা আলাদা হয়ে যায়ই। এতে আর আশ্চর্য কী আছে?

তুমি আমার সঙ্গে একটু বেরুবে? গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাব।

শুভ্র আকাশ থেকে পড়েছিল। অফিসে হাজার ব্যস্ততার মধ্যে নিশ্বাস ফেলার পর্যন্ত সময় থাকে না। অন্যের অফিস নয় যে, শুভ্র মাঝে মাঝে ফাঁকি মারবার চেষ্টা করবে। এটা তার নিজের অফিস। তা ছাড়া দুপুরবেলা গঙ্গার ধারে বেড়ানো …সে তো কলেজের ছেলেদের ব্যাপার।

শুভ্র বলেছিল, তোমার গঙ্গার ধারে বেড়াতে ইচ্ছে করছে…আমার সঙ্গে…কেন, তোমার নিজের বন্ধু টন্ধু নেই?

মনোলীনা বলেছিল, কেন থাকবে না, অন্য অনেকের সঙ্গেই তো বেড়াতে যাই…আজ তোমার সঙ্গেই যেতে ইচ্ছে করছে, তুমি যাবে না?

শুভ্র বলতে যাচ্ছিল, না, এটা একটা অবাস্তব ব্যাপার। অফিসের জরুরি কাজকর্ম ফেলে সে একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যাবে? মনোলীনা সরল ঝকঝকে দুটি চোখ মেলে তাকিয়েছিল তার দিকে। যেন এই মেয়েটিকে কিছুতেই আঘাত দেওয়া যায় না।

তখন হঠাৎ শুভ্র ভেবেছিল, একদিন নিয়মের ব্যতিক্রম করলেই বা ক্ষতি কী? দেখাই যাক না, এই মেয়েটি তার কাছে কী চায়। অফিসের সমস্ত লোককে বিস্মিত করে শুভ্রজ্যোতি সেনগুপ্ত দুপুর তিনটের সময় বেরিয়ে পড়েছিল একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ের সঙ্গে।

শুভ্র বলল, আমি টাই পরে আছি বলে তোমার খারাপ লাগছে। আচ্ছা, খুলে ফেলছি।

মনোলীনা বলল, তুমি এই মাঠের ওপর শুয়ে পড়তে লজ্জা পাচ্ছ? কিন্তু, শুয়ে থাকলে কতখানি আকাশ দেখা যায়…শুয়ে আকাশ দেখা মানুষের ভাগ্যে খুব কম হয়…

শুভ্র খুলে ফেলল কোটটা। সেটা সাবধানে ভাঁজ করে রেখে সেও শুয়ে পড়ল, হচ্ছে যখন, ছেলেমানুষির চূড়ান্ত হোক। এই অবস্থায় শুয়ে থাকা আইনবিরুদ্ধ কিনা কে জানে! যদি তাদের পুলিশে ধরে।

মনোলীনা পাশ ফিরল শুভ্রর দিকে। শুভ্রর বুকের ওপর সে নিজের এক হাত রেখে বলল, তুমি জান না, তোমার মুখখানা এখন একেবারে অন্য রকম দেখাচ্ছে! তুমি নিজেই দেখলে বোধহয় চিনতে পারবে না।

শুভ্র বলল, আমি এখন সত্যিই একটা অন্য মানুষ!

তুমি ফুল ফোটা দেখেছ?

ফুল ফোটা মানে? কী ফুল?

যে-কোনো ফুল। গাছে প্রথমে একটা কুঁড়ি এল, তারপর আস্তে আস্তে একটু একটু করে সেটা ফুটল, একদিন পুরোপুরি ফুল হল, তারপর আবার ঝরে গেল…

না দেখিনি…ফুল অনেক দেখেছি, ফুলের মালা…ফ্লাওয়ার ভাসে সাজানো ফুল।

ফুলের চেয়েও ফুল ফোটা বেশি ভালো লাগে।

কী করে দেখবো বলো…আমরা শহুরে মানুষ।

অনেক বাড়ির ছাদে ফুলের টব থাকে।

হাসি কয়েকটা টব রেখেছিল ছাদে, তারপর ঠিক মতন যত্ন নিতে পারেনি।

তুমি যত্ন করোনি?

আমি? আমার সময় কোথায়?

একটি অল্পবয়েসি বাচ্চা এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। পয়সা চাইছে। গাছতলার ছায়ায় স্নিগ্ধ বাতাসের মধ্যে শুয়ে থেকে শুভ্র যেন সত্যিই এক নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে। এ সময় ভিখিরির উৎপাত তার ভালো লাগলো না। ভিখিরিদের বিদায় করার সবচেয়ে ভালো উপায় দুটো-চারটে পয়সা দিয়ে বিদায় করা। কিন্তু একজনকে দিলেই আরও আসবে। তা ছাড়া, শুভ্রর কাছে একেবারেই খুচরো পয়সা নেই।

এই যাও।

কিন্তু ছেলেটি যাবে না। বিরক্তি সৃষ্টি করাই তার অস্ত্র। শুভ্র বেশ জোরে বকুনি দিল ছেলেটিকে।

মনোলীনা তার ছোট্ট ব্যাগ খুলে একটা দশ পয়সা বার করে শুভ্রর হাতে দিয়ে বলল এই নাও!

মনোলীনা তো নিজেই ভিক্ষে দিতে পারত ছেলেটিকে। তার বদলে পয়সাটা সে শুভ্রর হাতে দিল কেন? শুভ্র একটু ক্ষুণ্ণ হল। খুচরো পয়সা থাকলেও সে তো পুরো একটা টাকাই দিয়ে দিতে পারত ছেলেটিকে। তার কাছে এক টাকার দাম কিছুই নয়।

মনোলীনা কি ওই দশ পয়সা শুভ্রকেই ভিক্ষে দিল? পয়সাটা সে ছুড়ে দিল ছেলেটির দিকে। বলল এরপর আরও ছেলেরা আসবে।

মনোলীনা বলল আমার কাছে আরও খুচরো পয়সা আছে।

টাটকা হাওয়ায় শুভ্র জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। এমনকি তার পাইপ ধরাবারও ইচ্ছে হল না। এতক্ষণে সে একবারও পাইপ খায়নি।

মনোলীনা, আমার মনে হচ্ছে আমি তোমার সমান বয়েসি হয়ে গেছি।

তুমি বুঝি নিজেকে খুব বড়ো ভাব?

বয়সের দিক থেকে তো বটেই, সেটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তা ছাড়া আমি ভীষণ একটা কাজের জগতে, ব্যস্ত জগতে ঢুকে গিয়েছিলাম… কোনোদিন দুপুরবেলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি…তুমি ভাগ্যিস আমাকে ডেকে আনলে…তা তোমার কাছে আমি কতটা কৃতজ্ঞ।

আমরা অনেকে এরকম প্রায়ই আসি…শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি।

আমাকে তোমাদের দলে নেবে?

উত্তর না দিয়ে মনোলীনা হাসল শুধু। শুভ্রর ইচ্ছে করল, ওই নির্মল হাসিটুকু সে মনোলীনার ওষ্ঠ থেকে চেটে নেয়। এরকম ইচ্ছে তার আগে কখনও হয়নি। আজ সে বাচ্চা বয়সের মতন উত্তেজনা বোধ করছে।

মনোলীনা বলল তুমি এমন কোনো জায়গা জানো, যেখানে কোনো অশান্তি নেই, দুঃখ নেই, হিংসে নেই, লোভ নেই।

শুভ্র বলল সেরকম জায়গা পৃথিবীতে আবার আছে নাকি। আমার তো মনে হয় না।

আছে।

আছে? কোথায়? তুমি সেরকম জায়গা খুঁজে পেয়েছ?

না, এখনও খুঁজে পাইনি। কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে নিশ্চয়ই…যতদিন সে জায়গাটা খুঁজে না পাই, ততদিন মনে মনে সেরকম জায়গা বানিয়ে নিতে পারি…এরকম আকাশের নীচে শুয়ে, চোখ বুজে…তুমি চোখ বুজে দেখো…

শুভ্র সত্যিই চোখ বুজল? অমনি তার মনে পড়ে গেল অফিসে ফেলে রেখে আসা কাজের কথা। সে বিরক্ত হয়ে উঠল নিজের ওপর। সব কিছু ভুলে যেতে চাইল। একটু পরেই মনে হল, সে বুঝি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমের মধ্যে একটা লোভহীন, হিংসাহীন শান্তিময় জায়গা আছে বটে।

শুভ্র উঠে বসল। মনোলীনা তখনও চোখ বুজে আছে। এই মেয়েটি তার কাছে কী চায়?

মনোলীনা, সত্যি করে বলো তো, তুমি আমাকে এখানে ডেকে আনলে কেন?

এমনিই!

এমনিই? কিন্তু …যদি আমার নেশা ধরে যায়? যদি আমি বারবার তোমার সঙ্গে এখানে আসতে চাই?

তা তুমি চাইবে না!

যদি চাই?

আমাকে ডেকো, আমি আসবো!

কিন্তু কেন আসবে? আমি তোমার কে? তোমার নিশ্চয়ই অনেক সমবয়সি বন্ধু-বান্ধব আছে…ইস, পাঁচটা বাজল, আমাকে অফিসে যে একবার ফিরতেই হবে।

চল, ফিরে যাই।

যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে, একবার অন্তত, কিছু বলে আসিনি…আমি না ফেরা পর্যন্ত অনেকে বসে থাকবে।

চলো।

তুমি কোনদিকে যাবে?

আমি অন্যদিকে…একটু এগুলেই বাস পেয়ে যাবো।

আমি ট্যাক্সি নিচ্ছি, তোমায় কোথাও নামিয়ে দেবো?

না।

তুমি আর কখনও নিজে থেকে এসে আমায় ডাকবে?

কী জানি।

আজ তবে কেন এলে? কেন হঠাৎ ডাকলে?

এমনিই ইচ্ছে হল।

মনোলীনা, তুমি এত সুন্দর…তুমি আজ আমাকে কী চমৎকার দুটি ঘন্টা উপহার দিলে…যদি আবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই…কিংবা যদি আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই।

মানুষকে মানুষ ভালোবাসবে, এই তো স্বাভাবিক।

সেরকম ভালোবাসা নয়…আমি যেন তোমাকে বহুকাল ধরে চিনি, তুমি আর আমি খুব কাছের মানুষ।

চোখ বুজে পাশাপাশি শুয়ে থাকলে এই রকম মনে হয়। তারপর চোখ খুলে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকবার পর সেটা ভেঙে যায়।

মনোলীনা চট করে উঠে দাঁড়াল, তারপর শুভ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললে ওঠো, তোমার দেরি হয়ে যাবে।

শুভ্রর পিঠে ধুলো লেগেছিল, মনোলীনা সযত্নে ঝেড়ে দিল পিঠটা। শুভ্র যেন শিশু একটা। তারপর শেষ বিকেলের রঙিন আলোর মতন ঝলমলিয়ে হেসে মনোলীনা বলল, যারা খুব কাছের মানুষ, কিছুক্ষণের জন্য তাদের কাজ ভুলিয়ে দিতে আমার খুব ভালো লাগে।

আবার দেখা হবে?

হ্যাঁ, যখন তোমার ইচ্ছে হবে।

আর দেরি করা যায় না। শুভ্রকে এগিয়ে আসতেই হল রাস্তার দিকে। সহজেই পাওয়া গেল ট্যাক্সি। কিন্তু মনোলীনা কিছুতেই রাজি হল না সেই ট্যাক্সিতে চাপতে। সে হাঁটবে। শুভ্রর ট্যাক্সি ঘুরে গেল উল্টো দিকে। পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। মনোলীনা মাথা নীচু করে হাঁটছে আস্তে আস্তে। যেন সে দিগন্তের মধ্যে মিলিয়ে যাবে।

পাইপ জ্বালবার জন্য কোটের পকেটে হাত দিয়ে অন্য কী যেন টের পেল শুভ্র। এক মুঠো ঘাস। মনোলীনা এক সময়ে তার পকেটে ভরে দিয়েছিল। সেগুলো ফেলে দিতে গিয়েও ফেলল না শুভ্র। অফিসে ফিরে এসে রেখে দিল নিজের ড্রয়ারে।

তারপর আবার আগেকার মতন দিন কাটতে লাগল, সেই একঘেয়ে ব্যস্ততায়। এক সপ্তাহের মাথাতেই তাকে অফিসের কাজে যেতে হল দিল্লি। ফিরে এল দুদিন বাদেই। মনোলীনা আর আসেনি। মনোলীনার কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় শুভ্রর। এক এক সময় বুকটা মুচড়ে ওঠে।

মনোলীনাকে যখন সে জিজ্ঞেস করেছিল, আবার দেখা হবে? তার উত্তরে সে বলেছিল, যখন তোমার ইচ্ছে হবে। শুভ্রর কি ইচ্ছে হয় না। কিন্তু ইচ্ছেটাই সব নয়!

মনোলীনা তার কাছে কিছু চায়নি। শুভ্র খুব ভালোমতন ভেবে দেখেছে, মেয়েটির অন্য কোনো মতলব ছিল না। সে শুভ্রকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমে পড়তে চায়নি। শুভ্রর টাকা পয়সা, প্রতিপত্তি আছে, কিন্তু সে সম্পর্কে কোনো আগ্রহই দেখায়নি মনোলীনা। একটা পয়সা খরচ হয়নি তার জন্য। বরং মনোলীনাই দশটা পয়সা দিয়েছিল শুভ্রর হাতে। যেন সে প্রচুর সম্পত্তির মালিক সেইভাবে বলেছিল, আরও অনেক খুচরো পয়সা আছে।

মনোলীনা আর কিছু চায়নি, শুধু তার ইচ্ছেটুকু চেয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছেটাই সব নয়। ইচ্ছে থাকলেও শুভ্র আর গঙ্গার ধারে মাঠের ওপর দুপুরবেলা শুয়ে থাকার সময় করতে পারে না। মনোলীনাকে খুঁজে বার করার চেষ্টাও সে করেনি। তার ছোটো শ্যালিকা জয়তীর কাছে মনোলীনার খোঁজ নিতে লজ্জা পেয়েছে। এমনকি মনোলীনার বাড়িও সে চেনে। একদিন মাঝ রাতে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু শুভ্র কি হঠাৎ মনোলীনার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলতে পারে, তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে চলো। তা হয় না। সে শুভ্রজ্যোতি সেনগুপ্ত, দারুণ ব্যস্ত মানুষ, এসব ছেলেমানুষি তাকে মানায় না।

মাঝে মাঝে টেবিলের ড্রয়ার খুলে সে সেই ঘাসগুলো দেখে। শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে এসেছে। তবু থাক। শুভ্রর দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সেই গাছের তলায় ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা দুপুরবেলা, তার বুকের ওপর মনোলীনার একটা হাত, সেই দৃশ্যটা যেন স্বপ্ন মনে হয়। কিন্তু স্বপ্ন তো নয়, ঘাসগুলো রয়েছে।

মনোলীনা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি যখন জন্মেছিলে, তখন আমি কোথায় ছিলাম?

শুভ্র বলেছিল, ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলে মনের মাঝারে’।

এখন, শুভ্রর বুকের মধ্যে মনোলীনা একটা ইচ্ছে হয়েই রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *