স্বপ্নের অলিন্দে

স্বপ্নের অলিন্দে

আমার জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৯ সালের পঁচিশে জুলাই, মাঝরাতে। শ্রাবণ মাসের সেদিন ছিল আট তারিখ। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মানলে অবিশ্রান্ত শ্রাবণধারার নিচে বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট-লোকালয়ের তখন ঝাপসা হয়ে থাকার কথা। জানি না পৃথিবীতে আমার জীবনের সেই প্রথম রাতটি কেমন ছিল।

যদ্দুর শুনেছি আমার জন্ম হয়েছিল মিসেস মণ্ডল নামের একজন ধাত্রীর হাতে। পৃথিবীতে তিনিই আমাকে প্রথম দেখেছিলেন। এজন্যে কোনোদিন না-দেখা সেই রহস্যময় মাতৃতুল্যা মহিলার মুখ ফিরে ফিরে কল্পনা করতে সারাজীবন আমি খুবই আকুলতাবোধ করেছি।

হিসাবমতে আমার জন্ম টাঙ্গাইল জেলার করটিয়াতেই হওয়ার কথা ছিল; ওখানে সাদাত কলেজে আমার আব্বা, আযীমউদ্দীন আহমদ, ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু আমার জন্মের কিছুদিন আগে আমার নানি মাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ায় আমার জন্মের জায়গাটা হঠাৎ করেই পাল্টে যায়। এতে আমার অবশ্য একটা লাভ হয়েছিল। এককালের ভারতের রাজধানী এবং সে- সময়ের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাণকেন্দ্র কলকাতা মহানগরীর সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল। সারাজীবন এর জন্যে আমার ভেতর একটা চাপা গর্ববোধ কাজ করেছে।

আমার জন্মের সময়ে বাঙালি সংস্কৃতি তার পরিপূর্ণ শক্তিমত্তা নিয়ে বয়ে চলেছে। কিন্তু সে ছিল এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অস্তমিত হবার ঠিক আগের মুহূর্ত। এর পরের বছর-বিশেকের মধ্যে তার সম্পন্নতা প্রায় পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে আমার দু-বছর বয়স পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এই বাংলাদেশে, আমার কাছাকাছি কোথাও বেঁচে ছিলেন। সৃষ্টিশীলতার উত্তাল-পর্ব অতিক্রম করছিলেন বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রতিভারা। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, অবন ঠাকুর, মোহিতলাল, নজরুল, জীবনানন্দ, মানিক, তারাশঙ্কর, সুধীন দত্ত, জসীমউদ্দীন, বুদ্ধদেব বসু; শিল্পে যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, জয়নুল আবেদীন; রাজনীতিতে সুভাষ বসু, ফজলুল হক; বিজ্ঞানে সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা; পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে সুকুমার সেন, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, নীহাররঞ্জন রায়—এমনি কত জ্যোতিষ্কে-নক্ষত্রেই না ভরা ছিল বাংলার আকাশ! বাঙালি সংস্কৃতির মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের সেই সম্পন্ন বর্ণচ্ছটা, সন্ধ্যার রক্তরাগের মতোই, আকাশকে বর্ণাঢ্য করে রেখেছিল। আমি আমার কৈশোর-যৌবনের দিনগুলোয় সেই ঐশ্বর্যময় সংস্কৃতির শেষ দিনগুলোর বিলীয়মান সৌন্দর্য বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখেছি।

আমি একটা ছোট্ট ছেলেকে চিনি, তার বয়স পাঁচ বছর। আমি দেখে অবাক হই যে সে তার দেড়-দু’বছরের ঘটনাগুলো অবলীলায় বলতে পারে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগে। আমার ধারণা কেবল ও নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি শিশুই হয়ত ওর মতো। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ছিল এদের প্রায় উল্টো। শিশু হিশেবে আমি এদের মতো একেবারেই মেধাবী ছিলাম না, সবকিছুতেই ছিলাম পিছিয়ে পড়া। আমার জীবনে শৈশব এসেছে দেরি করে, কৈশোর এসেছে দেরি করে। যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য সবই এসেছে দেরি করে। এ-কারণেই আমার আশা বার্ধক্যকে আসতে হলে তাকে আমার মৃত্যুর পরেই আসতে হবে।

মাটির পৃথিবীর ওপর নিজেকে প্রথম আমি খুঁজে পাই আমার পাঁচ বছর বয়সে, টাঙ্গাইল জেলার করটিয়ার প্রকৃতি-ছাওয়া মাঠ-ঘাটের ওপর। এর আগের প্রায় কোনো কথাই আমার মনে নেই। করটিয়ার দিনগুলোর কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা অস্ফুট জগতের ছবি, জীবন থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়ার বেদনায় যা বিষণ্ণ। আমি দেখতে পাই একটা শীর্ণ ছোট্ট নদী, তার পাশে করটিয়া কলেজ কম্পাউন্ডের গাছগাছালির ভেতর থেকে মুখ উঁচিয়ে-থাকা আমাদের টিনের চালওয়ালা বেড়ায়-ঘেরা বাসা, বাসার সামনে গাছপালার ওধারে করটিয়া কলেজ ভবনের বিশাল অস্ফুট অস্তিত্ব, বাসার পেছনে বড় বড় গাছের শেষে বিরাট কলার বাগান, তারও কিছুটা পেছনে টিন দিয়ে বানানো কলেজ-হোস্টেল পেরিয়ে মাটির তৈরি টাঙ্গাইল-মির্জাপুর সড়ক (তখন কি ঢাকা-মির্জাপুর সড়ক তৈরি হয়েছে?)। আর সেই রাস্তা ধরে মির্জাপুরের পথে কিছুটা এগোলে দুপাশজুড়ে শুধু অন্তহীন ফসলের ক্ষেত আর জলাভূমি, যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চখা বক সারসেরা নিশ্চিন্তে উড়ে বেড়ায় আর হাঁটাহাঁটি করে, যেখানে এক সুদূর অপরূপ পৃথিবীতে জীবনের সব অবিশ্বাস্য কুহক আর রহস্য। করটিয়ার কথা মনে হলেই একটা উদগ্রীব আনন্দ আমাকে ভর করে। আমি দেখতে পাই এর পথে-ঘাটে, গাছের ডালে ডালে আমার দুরন্ত কৈশোর বন্য পৈশাচিক হিংস্রতায় তীব্রভাবে নিজেকে উপভোগ করে চলেছে। বছর-বিশেক আগে আমি একবার করটিয়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে ছেলেবেলার পরিচিত জায়গাগুলো দিয়ে হেঁটে বেড়াবার সময় প্রায় প্রতিটা গাছের আড়ালে-আবডালে, দেয়ালের পাশে, কলেজের বারান্দায়, মাঠে, জলার ধারে কতবার-যে আমার কৈশোরের সেই ছোট্ট ‘আমি’টির ফিরে ফিরে দেখা পেয়েছি, তার বিস্ময় ও বেদনা বলে বোঝানো কঠিন।

করটিয়া কলেজে আব্বা অধ্যাপক হয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা আচমকাভাবেই। বিখ্যাত চাঁদ মিয়া ছিলেন তখন করটিয়ার জমিদার। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার শিক্ষানুরাগী। স্যার সৈয়দ আহমদের আদলে তিনিও আধুনিক শিক্ষা- দীক্ষার মাধ্যমে মুসলিম জাতির মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। বাংলার আলীগড় বানানোর স্বপ্ন নিয়ে তিনি করটিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল কলেজ নয়, কলেজের সঙ্গে গড়ে তোলেন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা মেলানো এক বিরাট শিক্ষা কমপ্লেক্স। তাঁর জমিদারির একটা বড় অংশ ওয়াক্ফ করে তার আয় তিনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে যান। করটিয়া কলেজ গড়ে তোলার দায়িত্ব তিনি দেন সুসাহিত্যিক ইবরাহীম খাঁর ওপর। তিনি হন এর প্রিন্সিপ্যাল। আব্বা এই সময় ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের (এখন মওলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ) ইংরেজির সাময়িক প্রভাষক। আব্বাকেও তিনি নিয়ে আসেন এই কলেজে। আস্তে আস্তে আসেন আরও অনেক নামকরা অধ্যাপক। ইংরেজি বিভাগে আসেন কাজী আকরাম হোসেন ও মকসুদ হিলালী। বাংলা বিভাগে আসেন জ্ঞানেশ্বর ভট্টাচার্য, দর্শনে আসেন কেতাবউদ্দিন আহমদ ও পরে সাইয়েদ আবদুল হাই (যিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হয়েছিলেন), ইংরেজিতে আসেন সৈয়দ রফিকউদ্দীন আহমদ; এ- ছাড়াও সাইদ-উর রহমান, প্রফুল্ল চন্দ্র চক্রবর্তী—এমনি আরও অনেকে। একটা চমৎকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে এঁদের কেন্দ্র করে। গান, বাজনা, নাটক, সাহিত্য রচনায় মুখর হয়ে থাকে করটিয়ার এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। কলেজে যিনি যে-বিষয়ের অধ্যাপক, তাঁকে সেই বিষয়ের নামেই ডাকা হত তখন। রেওয়াজটা সুরসিক ইবরাহীম খাঁ-ই চালু করেছিলেন। যেমন : ইংলিশ সাহেব, আরবি সাহেব, হিস্ট্রি সাহেব, এরকম। কিন্তু কেন যেন কেতাবউদ্দিন সাহেবকে সবাই ‘কেতাব সাহেব’ বলেই ডাকতেন। হয়ত ফিলসফি সাহেব বা দর্শন সাহেবের মতো ওজনদার শব্দে যখন-তখন তাঁকে ডাকাডাকি করা বাঙালির করুণ স্বাস্থ্যে কুলিয়ে উঠত না।

সদ্য কলেজ শুরু হয়েছে বলে ঐ কলেজের ছাত্রসংখ্যা তখনও খুব কম। চারপাশ থেকে ছাত্ররা সবে এসে ভিড় করছে এক-দুই করে, এদের অনেকেরই লজিং-এর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে নানাজনের বাড়িতে। অধ্যাপকরা চারপাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে লজিং-এর ব্যবস্থা করতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের বোঝাতেন : আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করবে। তারা বড় হবে। মুসলমান সমাজের মধ্যে শিক্ষা নেই। তারা শিক্ষার আলো পাবে। দুনিয়ার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আপনারা বাড়িতে তাদের লজিং না রাখলে তারা এসব পারবে কী করে।

এই করে ধীরে ধীরে কিছু ছাত্র জোগাড় হল কলেজে। তাদের বেতনে কলেজের মাস্টারদের মাসোহারা টেনেটুনে মেটানো হতে লাগল। শুনেছি সপ্তাহ শেষে অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ বসতেন ছাত্র-বেতনের টাকা নিয়ে, শিক্ষকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেবার জন্যে। ভারি মধুর মানুষ ছিলেন ইবরাহীম খাঁ। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘বাতায়ন’-এ এই রসিক ও আমুদে মানুষটি সপ্রাণ হয়ে রয়েছেন। টাকা ভাগাভাগি করতে গিয়ে এক হাস্যমধুর দৃশ্যের অবতারণা হত। ইবরাহীম খাঁ বলতেন : ‘তাইলে আরবি সাবেরে সাতটা টাকাই দেই।’ তাঁর দুষ্টুমিভরা চোখ চশমার ফাঁক দিয়ে আরবি সাহেবের ওপর গিয়ে পড়ত। আরবি সাহেব কাউমাউ করে উঠতেন—’বাড়িতে মেহমান আছাল, আর কিছু না- বাড়াইলে যে হয় না।’ আরবি সাহেবের বরাদ্দ সাত টাকা থেকে বেড়ে যেত দশ টাকায়। ইবরাহীম খাঁর দৃষ্টি এরপর ঘুরে যেত ইংলিশ সাহেবের দিকে— ‘ইংলিশ সাহেবের তো পাঁচ টাকা হইলেই হয়। খালি বিবিসাব আর আপনে।’ সেকালের মজলিশি মানুষ বলতে যা বোঝাত ইবরাহীম খাঁ ছিলেন তা-ই। মজার মজার গল্প আর রঙ্গরসে চারপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। তাঁর মুখে সবসময় দুষ্টুমিভরা মিষ্টি হাসি লেগে থাকত।

এভাবে ছাত্র-বেতন থেকে পাওয়া সামান্য টাকা ভাগাভাগি করে তাঁরা চলতেন তখন। আমার জন্ম করটিয়া কলেজের এই অবস্থা পেরিয়ে যাবার পর। আব্বা করটিয়া কলেজে যান ‘২৯ সালে, আমার জন্ম ‘৩৯ সালে। ততদিনে কলেজের অধ্যাপকদের বেতন কিছুটা নিয়মিত হয়েছে এবং আব্বা ও অন্য শিক্ষকরা মোটামুটি চলতে পারছেন।

খুব বেশি স্মৃতি নেই আমার করটিয়ার, যা আছে তাও অস্ফুট আর ছেঁড়া-ছেঁড়া। অস্ফুট কিন্তু কবিতার মতো অনুভূতিময়। হয়ত সবার শৈশবই কমবেশি এমনি কবিতাময় আর স্নিগ্ধ।

করটিয়ার কথা ভাবলেই আমি দেখতে পাই আমাদের বাসার পাশ দিয়ে চলে গেছে খুব সুন্দর, শান্ত, ছোট্ট একটা নদী। করটিয়া কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে এসেছে নদীটা। নদীও ঠিক নয় আসলে, শীর্ণ খালের মতো একটা ধারা— ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া একটা স্বচ্ছ পানির স্রোতরেখা। শীতকালে তাতে পানি কমে যেত। একটা রুপালি শীর্ণধারা তিরতির করে বয়ে যেত সে-নদীতে। ‘পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি’র সঙ্গে আমাদের শৈশব নিয়েও ওই নদী আমরা পারাপার করতাম। কিন্তু বর্ষায় অন্যরূপ দেখা দিত তার। রবীন্দ্রনাথের ছোট নদীর বর্ষাকালের প্রমত্ত রূপের মতো তীব্র উত্তাল স্রোতে সে-নদী তখন দুকূল ছাপিয়ে হিংস্র হয়ে উঠত।

ওই নদীটা আমার ছেলেবেলার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমি ওই ছোট্ট নদীটাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবতাম। ওই নদী কোথায় কোন্‌দিকে গেছে, কোথা থেকে এসেছে কিছুই আমি জানতাম না। হাটের ওপাশে একটা বড় নদী ছিল, সেখান থেকেই এসেছিল ওটা। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তার ওপরকার ব্রিজটার নিচ দিয়ে (ব্রিজটা তখন কাঠের ছিল) এ নদী জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে, মাদ্রাসা-স্কুল পিছে ফেলে এঁকেবেঁকে দূর গ্রামের গাছপালার ভেতর কোন্খানে যেন হারিয়ে গিয়েছে।

ওই নদীটার দিকে তাকিয়ে আমার নানান কথা মনে হত : আহা, ওই নদীটা গিয়েছে কোথায়? নদীর সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে ঐ নদীর শেষ দেখতে ইচ্ছে করত আমার। ঐ সময় একটা গান মাঝে মাঝে শুনতাম আব্বার মুখে : ‘বংশাই নদীর কূলেরে ভাই মস্ত একখান বাড়ি / (ওরে) কর্তা তারই রামকানাইরে ভারি জমিদারি/ নাগর আয় আয়রে।’ হয়ত কোনো পালাগানের ধুয়া। গানটা শুনলেই আমার মনটা কেন যেন ছলছল করে উঠত। কোনো-এক অচেনা জমিদার রামকানাইয়ের জীবনের দুঃখময় করুণ ভালোবাসার কাহিনীর কথা ভেবে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়তাম। গানটা শুনে আমার কেবলই মনে হত আমাদের এই নদীটাই হয়ত সেই বংশাই নদী। এর ধারেই একটা মস্ত বাড়িতে কর্তা রামকানাই বিরাট জমিদারি সাজিয়ে বসে আছেন। যুবক-জমিদার রামকানাইকে আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। নদীটাকে ঘিরে এক অদ্ভুত রহস্য আমার ভেতর ঘোরাফেরা করত।

এসব ভাবনার সঙ্গে ঐ নদীর কিন্তু কোনো যোগ ছিল না, নদীটা আমার এসব কল্পনা বা অনুভূতির কিছুই জানত না। কেবল নিজের মনে কুলকুল করে বয়ে যেত।

নদীটাকে নিয়ে একটা স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে মনের ভেতরে। ঘটনাটা এক শীত সন্ধ্যার। নদীর ধারা সে-সময় পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়েছে। তখন করটিয়ার মতো এদেশের সুদূর গ্রামগুলোতে গ্রামোফোন, রেডিও কিছুই ছিল না, থাকলেও খুবই কম। ছিল না আজকের মতো সান্ধ্যকালীন গানের অনুষ্ঠান। এক-একটা গানের টুকরো কিংবা গানের লাইন হঠাৎ করেই এখান-ওখান থেকে আমাদের কানে ভেসে আসত, ওটুকুই ছিল আমাদের সংগীত শোনার সাকুল্য সুযোগ। স্বৰ্গ থেকে হঠাৎ ভেসে-আসা গানের সেই দুর্লভ কলিগুলো আমাদের উতলা করে আবার হারিয়ে যেত।

একদিন সন্ধ্যার সময় আমি সেই নদীটির ধার দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ শুনলাম সেই অস্ফুট অন্ধকারের ভেতর দূরে কোন্খান থেকে কে যেন গেয়ে উঠল : ‘দাদা আর যাব না ওই ইশকুলে লিখতে।’ খুব সম্ভব গুনাইবিবি যাত্রার গান। গানটার কথার মধ্যে এমন কিছুই ছিল না, কিন্তু গায়কের কণ্ঠের মধ্যে এমন একটা আশ্চর্য মদিরতা ও বিষণ্ণতা ছিল যে, সন্ধ্যার নিস্তব্ধ অন্ধকারের ভেতর সেই গানটা মুছে যাবার পরও আমার মনে হতে লাগল নদীর জনহীন পাড়দুটোকে সেই গানের স্মৃতি যেন পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে একটা করুণ বেদনা নদীর দুধারের নির্জনতাকে ছাপিয়ে যেন কেঁদে চলল অনেকক্ষণ। আমার বুকের ভেতরটা শোকে মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল। আমার মনের ভেতর সে-গানটা হৃদয়কে কষ্ট দিয়ে আজও তেমনি কাঁদে। ঐ নদীটি নিয়ে এমনি সব অদ্ভুত স্মৃতি আছে আমার ভেতর।

গান নিয়ে আরেকটা স্মৃতি আছে ছেলেবেলার। একবার গিয়েছিলাম আমাদের ঠিক পাশের গ্রামে, করাতিপাড়ায়। ‘করাতি’ শব্দটার মানে আমি তখনও জানতাম না। কিন্তু বড় বড় কাঠ-কাটা দাঁতওয়ালা বিশাল করাতের সঙ্গে ঐ নামটার মিল থাকায় নামটা শুনলেই আমার ভেতরটা কেন যেন ভয়ে শিরশির করে উঠত

কেবল ঐ নামটাকে নয়, ঐ পাড়ার সামনের বিশাল ধূ-ধূ মাঠটার দিকে তাকালেও একটা অজানা ভয়ের অনুভূতিতে আমার বুকটা ধুকধুঁক করত। আমি যেন স্পষ্ট দেখতাম মাথায় পাগড়িবাঁধা দরবেশের মতো একটা লোক কাঁধে বড় একটা ঝুলি নিয়ে ঐ মাঠের ওপারের গ্রাম থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে কেবলি এগিয়ে আসছে। আমি বুঝতে পারতাম না কে সে? কেন আসছে? খালি একটা ভয়ের অনুভূতিতে অসুস্থ হয়ে উঠতাম।

একদিন সেই করাতিপাড়ায় গিয়েছিলাম একটা বিয়েতে। আমার এবারের করাতিপাড়ার স্মৃতি কিন্তু ঐ ভয়ের একেবারে উল্টো। তখন গরমের রাত। দশটা-এগারোটা বেজে গেছে। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ। চারপাশ নিঝঝুম, অসাড়। আঙিনার ওপর এখানে-ওখানে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে আছে। আধো ঘুমের মধ্যে টের পেলাম বাড়ির ভেতর কে যেন একটা গ্রামোফোনে গান বাজানোর চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে তাতে এক-একটা রেকর্ড চাপিয়ে দিচ্ছে আর সেই গানের মিষ্টি শব্দে চারপাশের রাতের হৃদয়টা সোনালি হয়ে উঠছে। একসময় সেই গ্রামোফোন থেকে একটা গান আমার কানে ভেসে এল : ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।’ আমার শোনা ওটাই নজরুলের প্রথম গান। আমি ওই গানের সুরের ভেতর একটা ধূসর-নীল পাহাড়কে বিরাট আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে গভীর তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতে পেলাম যেন—নাকি একজন গভীর পুরুষের বুকে নিমগ্ন মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অস্ফুট নারীকে, কে জানে? চোখের ওপর স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছবিটা। সুদূর ছেলেবেলার এই ছবিটা আজও আমি দেখি।

প্রথমে সন্দেহ জেগেছিল করটিয়ার ঐ অল্প ক’টা দিনের ক’টা স্মৃতিই-বা মনে আছে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর সংখ্যা হয়ত সত্যি-সত্যি অফুরান। এর ক’টাই- বা লেখা যায় বা লেখা উচিত। কিন্তু অন্য কিছু লিখি আর না-লিখি একটা সকালের কথা আমাকে লিখতেই হবে। একটা কবিতায় ভরা সকালের রূপকথা। প্রায় স্বপ্নের মতোই ছিল সকালটা। আমার বয়স তখন হয়ত পাঁচ-সাড়ে পাঁচ। আমি, আমার ছোটভাই, ছোটবোন আর সেইসাথে আরও দু-একটি ছেলে, হয়ত আমার চাইতেও ছোট, কেন যেন করটিয়া কলেজের মাঠ পেরিয়ে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কীভাবে কেন হাঁটতে শুরু করলাম কিছুই মনে নেই, কেবল মনে আছে বেশ ক’জন মিলে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি তো চলেইছি। চারপাশে মটরশুঁটির ক্ষেত। ঠিক বড় মটরশুঁটি নয়, ছোট একধরনের মটরশুঁটি, আমরা ছেই বলতাম সেগুলোকে। ক্ষেতে বসে খোসা ছাড়িয়ে এগুলো খেতে খুব মজা লাগত আমাদের।

সেইসব ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা রহস্যময় জগতের মধ্যে এসে পড়লাম। শীতকাল সবে বিদায় নিয়েছে। শিশির জমে আছে সারা মাঠজুড়ে, সবখানে। দূরে চারপাশে সবুজ গ্রাম। তার গায়ে শিশিরের স্নিগ্ধতা। এপাশে-ওপাশে গন্ধক-হলুদ রঙের ফুলে ভরা শর্ষেক্ষেতের জগৎ। বিলের পাশে বকেরা বসে আছে। মিষ্টি, শান্ত সকাল। এসবের মধ্য দিয়ে, যেন প্রায় একটা রূপকথার দেশের ভেতর দিয়ে, হেঁটে চললাম সবাই।

হাঁটতে হাঁটতে অনেক মাঠ-ঘাট-প্রান্তর পেরিয়ে একটা গ্রাম এল আমাদের সামনে। সে-গ্রামে দেখা গেল একটা অবস্থাসম্পন্ন বাড়ি। সে-সময় রূপকথার গল্পে রাজবাড়ির যে-বর্ণনা শুনতাম, ঠিক সেরকম বিশাল এলাকা নিয়ে সে-বাড়ি; তার সামনের দিকটায় পাকা দালান, পেছনে অনেক দূরে ছোট ছোট বেশকিছু টিনের চাল ছাওয়া ঘর। শুনলাম মুকুন্দ সাহা নামে একজনের বাড়ি সেটা। মুকুন্দ সাহা নামটাও রহস্যময় লাগল। বাড়ি দেখেই বুঝেছিলাম খুবই অবস্থাসম্পন্ন আর বিত্তবান মানুষ এঁরা। হয়ত এদেশের রাজাই হবেন। আমরা যেতেই তাঁরা খুব খাতির করলেন আমাদের। সে-সময় খুব সম্ভবত কোনো পূজা বা ঐ ধরনের কিছু চলছিল ওঁদের বাড়িতে। লুচির সঙ্গে নানানরকম মিষ্টি, পায়েস, নারকেলের নাড়ু, বরফি খেতে দিলেন তাঁরা। রূপকথার মদনকুমার মণিমালারা যেসব দিয়ে নাশতা করে, প্রায় সেসব। বিশাল অবস্থাসম্পন্ন বাড়ি, সেখানকার মুখরোচক খাবার, তার সঙ্গে আশ্চর্য স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন সত্যি- সত্যিই রূপকথার জগতের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি আর সে-জগতের মতোই না-চাইতেই অভাবিত সব জিনিশ পেয়ে যাচ্ছি।

‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডে’ অ্যালিস রূপকথার দেশে চলে গিয়েছিল স্বপ্নের ভেতরে। বোধহয় সব মানুষই শৈশবের কোনো-না-কোনো মুহূর্তে এমনিভাবে ওরকম অ্যালিস হয়ে যায়। চারপাশের বাস্তব পৃথিবীটাকে পুরনো খোলসের মতো ফেলে রেখে একটা অলীক জগতের উজ্জ্বল পথে-ঘাটে অবাস্তবভাবে হেঁটে বেড়াতে থাকে।

খাওয়াদাওয়ার পরে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকদূর হেঁটে পেলাম একটা বড় রাস্তা। বড় মানে পিচঢালা নয়। একটা চওড়া মাটির রাস্তা, একটা নদীর ধার ঘেঁষে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখলাম আধোডোবা একটা লঞ্চ রাস্তার পাশের নদীর অল্প পানিতে ভেঙে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। লঞ্চটাকে এভাবে জরাগ্রস্তের মতো ডুবে থাকতে দেখে আমার মনটা বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে গেল। মনে হতে লাগল একটা কোনো বড়ধরনের জাহাজডুবির দুঃখময় স্মৃতি যেন ওটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেন এখানে একটা বড় ধরনের বেদনাদায়ক কিছু ঘটে গিয়েছিল কোনো এককালে, সেই অব্যাহতিহীন দুঃখটা সেখানকার আকাশে-বাতাসে আজও কেঁদে চলেছে। কত অভাবিত কিছুই-না ভাবতে পারতাম আমরা সে-সময়!

এসব দেখতে-দেখতে বিমর্ষ-মনে হেঁটে চলেছি, হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখি আমাদের পাশেই একটা রহস্যজনক সবজির ক্ষেত। সে-ক্ষেতের মধ্যে বড় বড় লতাজাতীয় সবুজ সতেজ পাতাওয়ালা একধরনের সার-সার ছোট গাছ। গাছের পাতা একটু ফাঁক করলেই দেখা যায় ছোট-বড় কচি কচি খিরাই ধরে আছে। এর আগে আমি কখনও খিরাই দেখিনি। এর ছোট ছোট নরম কাঁটাওয়ালা সবজিগুলোর সবুজ গড়ন দেখে সেগুলোকে রূপকথার ফলের মতোই মনে হতে লাগল। ক্ষেতের আশপাশে কেউ ছিল না, আমরা খুশিমতো খিরাইগুলোকে গাছ থেকে ছিঁড়ে খেয়ে চললাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে গলাও শুকিয়ে এসেছিল। সেই ঠাণ্ডা খিরাইগুলো প্রাণটাকে যেন জুড়িয়ে দিল। স্বপ্নের জিনিশকে এমন অপর্যাপ্তভাবে এর আগে কখনও পাইনি।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় সবাই চলে গিয়েছিলাম আরও অনেকদূরে। একসময় হঠাৎ দেখি পাশেই বেশ বড়সড় একটা নদী। নদীর উল্টোদিকে বিরাট একটা চর। নদীটাকে দেখে কেন যেন আমার মনটা ছলছল করে উঠল। নদীর ওধারের বিস্তীর্ণ চরের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই মনে হতে লাগল, রূপকথার শেয়াল- পণ্ডিতের গল্পের সেই সন্তানহারা আর্তনাদমুখর কুমির ধূর্ত-শেয়ালকে ধরার জন্যে হয়ত ঐ চরের কোনো-এক জায়গাতেই মরার মতো ভান করে আজও শুয়ে আছে। নদীটাকে বাঁয়ে রেখে একটা হাটের ভেতর দিয়ে কিছুটা হাঁটতেই একসময় এসে হাজির হয়েছিলাম আমাদের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সেই নদীটার ধারে। হঠাৎ কী করে এল নদীটা এখানে? আমরা দুধের সাগর ক্ষীরের সাগর ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দেশ সব ঘুরে হঠাৎ আবার বাসার কাছের নদীটার ধারে ফিরে এলাম কী করে! সবকিছুই আমার কাছে ভেল্কিবাজি বলে মনে হতে লাগল। সেই নদীর পাড় ধরে অনেকদূর হেঁটে ফিরে এলাম আমাদের বাসায়।

বছর-বিশেক আগে গিয়েছিলাম করটিয়াতে। তখন হেঁটে দেখার চেষ্টা করেছিলাম ছেলেবেলার সেই আশ্চর্য সকালে কোন্ পথ ধরে কতদূরে আমরা গিয়েছিলাম। খুঁজতে গিয়ে দেখেছিলাম, আমরা সব মিলে আসলে সেদিন হয়ত মাইলখানেকের বেশি হাঁটিনি। কয়েকটা ক্ষেত পার হয়েছিলাম মাত্র। আমাদের পাশের গ্রামেই ছিল মুকুন্দ সাহার বাড়ি। কাজেই কতদূরেই-বা যেতে পারি? আসলে আমরা তখন কেবলই কয়েকটি শিশুমাত্র, দুটো ছোট ছোট করুণ পা আমাদের, কয়েকটা অবোধ অসহায় প্রাণী আমরা। কতদূরেই-বা যাওয়া সম্ভব আমাদের? খুবই সামান্য জায়গা ঘুরে এসে আমরা পৃথিবীর শেষপ্রান্ত হেঁটে আসার বিস্ময় ও মুগ্ধতা অনুভব করেছিলাম। ছেলেবেলায় বিশ্বাস করার, অবাক হবার এই অপরিমেয় শক্তি থাকে মানুষের।

কয়েকটা টুকরো স্মৃতি আছে করটিয়ার, তার মধ্যে একটা আমাদের স্কুলটাকে নিয়ে। স্কুলটা ছিল টাঙ্গাইল-মির্জাপুর রোডের দক্ষিণ দিকে। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা পেরিয়ে, স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে, পুকুরের পাড় ধরে এগিয়ে তবে পৌঁছতে হত স্কুলটাতে। স্কুলের উল্টোদিকে মাদ্রাসা, স্কুলটারই মতো একটা একতলা লম্বা শাদা দালান। স্কুলটাতে ক্লাস ওয়ানে পড়েছিলাম কি না মনে পড়ে না, কিন্তু টু-তে যে পড়তাম স্পষ্ট মনে আছে। মনে পড়ে ক্লাস টুর পাশেই ছিল থ্রির ক্লাস। থ্রির ছেলেরা ছিল মোটামুটি আমারই বয়সী। এক বছরের ব্যবধানে কতটুকুইবা বড় হতে পারে? কিন্তু ওই ক্লাসের সামনে দিয়ে হাঁটতে গেলে এদের সবাইকে আমার বিরাট বিরাট মানুষের মতো মনে হত, যেন নাইন-টেনের বা কলেজের বড় বড় ছাত্র। ক্লাসটার দিকে তাকালেই মনে হত সেই বড় বড় ছেলেরা সবাই একসঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। ক্লাসভরা অত ছাত্রের সেই অতিকায় বিদ্রূপের সামনে দাঁড়িয়ে কী করব বুঝতে পারতাম না। কেন অমন মনে হত? আসলেও কি তারা হাসত? না, তারা হাসত না, কিন্তু আমার অমনটাই মনে হত। ঐ ক্লাসের সামনে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আমার বুক ধড়াস ধড়াস করত, পা আড়ষ্ট হয়ে আসত, ভয়ে আমি পুরো ভেঙে পড়তাম।

কেন ছোট ছোট ওই ছেলেদের অত বিরাট মনে হত ব্যাপারটা নিয়ে আমি বড় হয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে মনে হয়েছে ওরা বড় ছিল বলে যে ওদের অতবড় মনে হত তা না, আসলে নিজেকে আমি মানুষ হিশেবে এত বেশিরকম ছোট আর নগণ্য ভাবতাম যে সেই অপরিসীম হীনমন্যতার জন্যেই ওদের সবাইকে অতবড় মনে হত। নিজের সম্বন্ধে এই হীনমন্যতার অনুভূতি সারাজীবন আমাকে তাড়া করেছে। ওই বয়সেই-যে কেবল নিজের চেয়ে সবাইকে বড় মনে হয়েছে তাই নয়, সারাজীবনই মনে হয়েছে। প্রায় প্রতিটি মানুষকে মনে হয়েছে আমার চেয়ে যোগ্য আর অসাধারণ। ফলে সবদিক থেকে উন্নত ও অতিকায় ওই মানুষগুলো ধীরে ধীরে আমার চোখে হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ংকর আর ভীতিপ্রদ। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের সামনে থেকে পালিয়ে নিজেকে কোথায় লুকাব বুঝে উঠতে পারিনি। একজন-দুজন মানুষ দেখলে ভয় তো লাগতই, একসঙ্গে বেশি মানুষ দেখলে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়তাম। কোনো ঘরে সভা চলছে বা বিশ-পঞ্চাশজন লোক বসে আছে বুঝলে কিছুতেই সে-ঘরের দিকে যাবার সাহস পেতাম না। নিঃশব্দে সেখান থেকে পালিয়ে যেতাম। মনে হত সেখানে গেলেই ঘরভর্তি মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করবে।

এ ভীতির কারণেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাসে দাঁড়িয়ে স্যারদের কখনও প্রশ্ন করতে পারিনি। ক্লাসভর্তি এতগুলো ছাত্র যে একসঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দ্বিগুণসংখ্যক চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাবে, সেই বিশাল ভয়ংকর ও দানবীয় চাউনি সহ্য করা ছিল আমার ক্ষমতার বাইরে। সবচেয়ে বিপদে পড়েছি যখন দেখেছি একদল মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে অথচ আমাকে যেতে হবে তাদের সামনে দিয়েই। হেঁটে যাবার সময়, বিশেষ করে হঠাৎ তারা যদি (কী কারণে জানা নেই, হয়ত কোনো কারণই নেই) খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তবে তো কথাই নেই। আমার মনে হল আমার হাঁটার কোনো অদ্ভুত ভঙ্গি বা চেহারার কোনো হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয়ই তারা হাসছে। ওদের দেখে আগেই আমার বুকে ধুঁক ধুঁকানি শুরু হয়ে গিয়েছিল, ঐ সামান্য উদ্দীপকের সহযোগে আমি পুরো বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম আমার মুখ কান লাল হয়ে উঠেছে, আমার নিয়ন্ত্রণহীন পা-দুটো ঠিক তেমনি এলোমেলোভাবে পড়তে শুরু করেছে যেভাবে পড়লে তাদের আসলেই হেসে ওঠার কথা।

আমার এই করুণ অবস্থা-যে কতটা দুঃসহ ছিল তা একটা গল্প বললে বোঝানো সহজ হবে। তখন আমি এইট কি নাইনে পড়ি। একদিন একটা আধা- নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি সামনে থেকে একদঙ্গল স্কুলের মেয়ে প্রায় গোটা রাস্তা দখল করে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ আমি মেয়েদের প্রতি সৌজন্য দেখানোর জন্য এত বাড়াবাড়িরকমে তৎপর হয়ে পড়লাম যে রাস্তা ছেড়ে প্রায় ড্রেনের কিনারা পর্যন্ত নেমে তাদের যাবার পথ করে দিলাম। আসলে সৌজন্য দেখানোর জন্যে নয়, নার্ভাস হয়েই আমি অমনটা করেছিলাম। আজ বুঝি ওভাবে ড্রেনে না-নেমে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েও সৌজন্যপূর্ণভাবে আমি তাদের যাবার পথ করে দিতে পারতাম, যেভাবে আর সবাই দিচ্ছিল। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে হীনমন্যতার অনুভূতি আমার এমনই তীব্র ছিল যে এতগুলো বড় বড় মেয়ের মাঝখানে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যেতে পারে তা ভেবে উঠতে না-পেরে ড্রেনের কিনারাটাকেই হয়ত বেশি নিরাপদ মনে হয়েছিল। মেয়েগুলোর কাছে সেদিন ব্যাপারটা-যে কতখানি হাস্যকর আর উপভোগ্য লেগেছিল তা ভাবতেও আজ আমার কান লাল হয়ে ওঠে।

আমার প্রথম শৈশবের পরিবেশ ছিল সুস্থ সবল মন নিয়ে বেড়ে ওঠার তা ছিল খুবই অনুকূল। আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার সবচেয়ে বড়বোন—বড়আপা– আমার চেয়ে আট বছরের বড়। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমার মেজোবোনের জন্ম হয়। বাড়ির সবাই তখন ছেলে-সন্তানের জন্যে উন্মুখ। তাই পরপর দুটি মেয়ে হওয়া সবাইকে খুব হতাশ করেছিল। সবচেয়ে বেশি খেপে গিয়েছিলেন বড়আপা নিজে। কেন তাঁর ভাই না হয়ে আবার বোন হল—এই ক্ষোভে তিনি আমার মেজোবোনের দেড়-দু-বছর বয়সের সময় একটা সাইকেলের পাম্পার তাঁর মুখে ঢুকিয়ে পাম্প করতে করতে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।

এমনি অভিনন্দিত মুহূর্তে পরিবারের প্রথম সন্তান হিশেবে আমার ‘আবির্ভাব’। সবার কাছে আমি ছিলাম খুবই আদরের। আমি জন্মেছিলাম সম্পন্ন স্বাস্থ্য নিয়ে, জন্মের পর স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যে আরও দৃষ্টিলোভন হয়েছিলাম। যাদের গ্ল্যাক্সো-বেবি বলা হয় আমি ছিলাম তাই। এতটাই আমি মোটাসোটা ছিলাম যে প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর মেয়ে খালেদা আপা, আমার বড়বোনের ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী—আমাকে কোলে পর্যন্ত নিতে পারতেন না। কথাটা বহুবার তিনি আমাকে বলেছেন। শিশুদের বেশি মোটাসোটা হওয়া-যে তাদের স্বাস্থ্যপ্রদ বিকাশের জন্যে ক্ষতিকর এ-তথ্য হাল আমলের বিজ্ঞানীরা বলতে শুরু করেছেন, কিন্তু সেকালে সবাই জানত এর উল্টোটা। সেকালে গ্ল্যাক্সো-বেবি মানেই ছিল সুন্দর, স্বাস্থ্যবান আদরণীয় শিশু। আমি-যে গ্ল্যাক্সো-বেবি হয়েছিলাম তা অকারণে নয়। বেশি পরিমাণ দুধ খাওয়ার ফলেই আমার ঐ হাল হয়েছিল। গড়পড়তা শিশুরা দিনে ছ’বার দুধ খায়, প্রতিবার এক বোতল করে। আমি দিনে ছ’বার দুধ খেতাম, প্রতিবার তিন বোতল করে। অর্থাৎ মোট আঠারো বোতল প্রতিদিন। আমার দুধ খাওয়ার আরও একটা শর্ত ছিল। যে-বোতলে দুধ খাচ্ছি তা শেষ হবার আগেই পরবর্তী বোতলের নিপল আমার মুখে ঠুসে দিতে হবে। এতে দু-এক সেকেন্ড দেরি হলেও আমি নাকি দৈত্যের মতো কলজে কাঁপানো শব্দে গর্জন করে উঠতাম। মা তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমাকে ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি। সবার তুলনায় বাড়তি আদর-আহ্লাদ তাঁর কাছ থেকে আমি পেতাম। জ্বাল-দেওয়া ঘন দুধের বাদামি পুরু সর তিনি-যে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে দিতেন, তা আমার এখনও মনে আছে। মোটকথা আমার প্রথম শৈশব কেটেছে একটা সুস্থ প্রাণবন্ত পরিবেশে।

১০

এভাবে স্কুলের দিনগুলোতেই আমি বুঝেছিলাম আমার ভেতর নিজের সম্বন্ধে এক তীব্র হীনমন্যতাবোধ জন্ম নিয়েছে, যার ফলে মানুষের পৃথিবী থেকে পালিয়ে নিজস্ব বিবরের ভেতর ককিয়ে ককিয়ে আমি হয়ত একসময় শেষ হয়ে যাব; হয়ত আমার তাই-ই হত। কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার একটা ব্যাপার : মানুষের জন্যে সুগভীর ভালোবাসা। মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকার আকুতি। সবকিছুর ওপর দিয়ে সেই মৃত্যুবেদনাদীর্ণ আর্তি : ‘মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’

সেই ছোট্ট ছেলেবেলা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই আকুতির ধাক্কা নিজের ভেতরে আমি অনুভব করেছি। প্রতিমুহূর্তে টের পাই আমার চারপাশের মানুষদের আমি যে কেবল গভীরভাবে ভালোবাসি তাই নয়, তাদের হৃদয়েও আমি বেঁচে থাকতে চাই এবং এই বেঁচে থাকাকে আমার নিয়তির সর্বোচ্চ সম্মান ও দুর্লভতম ঐশ্বর্য বলেও শ্রদ্ধা করি। স্বর্গ-নরক নিয়ে খুব একটা ভাবি না। এই মানুষদের সুখী করা ও তাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই আমার মানবজন্মের সম্পূর্ণতা ও নির্বাণ। আমি স্বর্গ-নরক নিয়ে খুব একটা ভাবি না। চারপাশের মানুষদের সুখের জন্যে নিজেকে দিতে পারাকেই স্বর্গপ্রাপ্তি বলে মনে করি। আমি মানুষের জন্যে সাধ্যমতো কাজ করে জীবনের পরিসরেই জীবনকে পুরোপুরি জ্বালিয়ে বিদায় নিতে চাই।

কিন্তু জীবনের একেবারে শুরুর সেই অসহায় করুণ দিনগুলোয়, আমার শৈশবে, আমার ভেতর এমন কী ছিল যা নিয়ে সবার সামনে দাঁড়াতে পারি,

তাদের হৃদয়ের মধ্যে বাঁচতে পারি? একসময় মনে হয়েছে কিছু না হোক, একটা জিনিশ তো অন্তত দিতে পারি তাদের। আমার বিনীত আচরণ, আমার সততা, আমার ভালোবাসা। আমার সরল হৃদয়ের অবোধ অর্থহীন ভালোবাসা।

আমার চোখের চেয়ে দেখা আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা আমার আনাগোনা—

এই ভালোবাসা ও সৌজন্য বিলাতে গিয়েই সেই ছোট শৈশবে মানুষের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তাদের কাছে গিয়েই অনুভব করেছি আমার চারপাশের মানুষদের ফুলের মতো ফুটন্ত উন্মুখ অনিন্দ্য মুখগুলোই এই পৃথিবীর জ্যোতির্ময়তম দৃশ্য, আমার সবচেয়ে প্রিয় ধর্মগ্রন্থ। সেই থেকে মানুষের জন্যে এই টান আমার দিনের-পর-দিন বেড়েছে।

১১

করটিয়ার আর যে ক’টা স্মৃতি মনের কোণে এখনও উজ্জ্বলভাবে বেঁচে আছে একদিন রাতে-দেখা একটা স্বপ্ন তার একটা। ততদিনে মার কাছ থেকে ‘ঠাকুমার ঝুলি’ বইয়ের ‘শীত বসন্ত’ গল্পটা শোনা হয়ে গেছে। সেই গল্পে সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুধ-শাদা রঙের গজমোতি হাতি তখন আমার চোখের সামনে গোলাপি স্বপ্নের মতো দাঁড়িয়ে। স্বপ্নে দেখলাম হুবহু সেরকম একটা হাতি এক বিকেলে আমাদের বাসার সামনের মাঠটায় এসে হাজির। বন্ধুদের সঙ্গে খেলা ছেড়ে হাতির দিকে এগিয়ে যেতেই হাতিটা বিনীতভাবে মাটির ওপর বসে আমাকে পিঠে উঠিয়ে আবার চলতে শুরু করে দিল। কার কাছে যেন শুনেছিলাম স্বপ্নে হাতির পিঠে উঠলে মানুষ রাজা হয়। গজমোতি হাতির পিঠে উঠলে তো কথাই নেই। কাজেই হাতির পিঠে বসে রাজত্বের রঙিন সম্ভাবনায় মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আত্মতৃপ্তির সঙ্গে মনে হল : সত্যি সত্যি রাজা হতে যাচ্ছি তাহলে! একবারে সত্যিকারের রাজা।

হঠাৎ দেখি হাতিটা একটা বিশাল প্রাসাদের বারান্দা দিয়ে নিজের মনে হেঁটে চলেছে। প্রাসাদটা নিশ্চুপ, নিঝঝুম। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। দরোজা-জানালা সব বন্ধ। ঠিক যেন একটা ঘুমন্ত পুরী (যেখানে হাতিশালে হাতি ঘুমায়, ঘোড়াশালে ঘোড়া)–রাজা-রানি, পাত্র-মিত্র, পারিষদ, সৈন্যসামন্ত সবাই সেই ঘুমের জাদুতে বন্দি। বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাতিটা একসময় পৌঁছল এসে একটা নদীর ধারে। নদীর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল পাড়ের সঙ্গে বাঁধা একটা লঞ্চ, বিকেলবেলার ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার ওপর দাঁড়িয়ে আব্বা, খুররম খান (সে- সময়কার করটিয়ার জমিদার) আর ইব্রাহীম খাঁ গল্প করছেন।

যে ছেলে ভবিষ্যতে রাজা হতে যাচ্ছে তার জন্যে স্বপ্নটার এ পর্যন্ত রীতিমতো উৎসাহব্যঞ্জক, রূপকথার জগতের মধ্য দিয়ে আচমকা হাতির পিঠের পরিভ্রমণটাও গৌরবজনক। কিন্তু তারপরেই যা ঘটল তা খুবই বিশ্রী ও রসভঙ্গকর। রাজকীয় ভঙ্গিতে হাতির পিঠে বসে আমি লঞ্চটার কাছে যেতেই আব্বা হঠাৎ লঞ্চের ওপর থেকে বলে উঠলেন : এই, দে তো নদী থেকে একগ্লাস পানি তুলে। বলে লঞ্চে দাঁড়িয়েই একটা গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। স্বপ্নের রঙিন স্বর্গলোক থেকে যেন কদর্য ডাস্টবিনে পড়ে গেলাম। এতবড় একজন রাজাকে চাক্ষুষ সামনে দেখেও আব্বা যে তাকে চিনতে পারলেন না, যে কারণে তার জন্যে দুঃখ হল। সবাই নিশ্চয়ই মানবেন একজন ভবিষ্যৎ রাজাকে এ-ধরনের অসম্মানজনক একটা ফরমাশ দিয়ে আব্বা একেবারেই ভালো করেননি। এর প্রতিবাদেই হয়ত, গ্লাস হাতে হাতির পিঠ থেকে নামতে গিয়েই আমার স্বপ্নটা ভেঙে গেল।

তখন আমার অল্পবয়স। করটিয়ার বাইরের খুব বেশি জিনিশ আমার দেখা হয়নি। তাই আমার স্বপ্নও সেই অভিজ্ঞতার জগতের খুব একটা বাইরে যেতে পারেনি। অনেক পরে স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই স্বপ্নের ভেতর আমি যা যা সেদিন দেখেছিলাম সবই ছিল আমার চারপাশের পরিচিত জিনিশ। স্বপ্নের ভেতর যে-হাতিকে দুধরঙের গজমোতি হাতি বলে মনে হয়েছিল বাস্তবে তা আদৌ দুধরঙা ছিল না। আসলে ওটা ছিল করটিয়ার জমিদারবাড়ির হাতি। তার গায়ের রঙ আর দশটা হাতির মতোই ছিল খসখসে কালো। আমাদের কলাবাগানে হাতিটা প্রায়ই এসে কলাগাছ খেত বলে যাবার সময় কৃতজ্ঞতা হিশেবে হাতির মাহুত আমাদের হাতির পিঠে তুলে কিছুটা জায়গা ঘুরিয়ে দিত। ওই হাতিটাকেই আমি স্বপ্নের মধ্যে গজমোতির হাতি হিশেবে দেখে রাজা হবার স্বপ্নে উথলে উঠেছিলাম। স্বপ্নে যে-জনশূন্য খাঁ-খাঁ রাজপ্রাসাদ দেখেছিলাম সেটাও ছিল আমার চেনা। আসলে তা ছিল করটিয়া কলেজের বিশাল ভবন। গরমের ছুটিতে বন্ধ-থাকা কলেজের ঘুমন্ত জনহীন ছবিটাই স্বপ্নের ভেতরে ওভাবে আমি দেখেছিলাম। আর নদীটা ছিল করটিয়ার হাটের পাশের সেই বড় নদী যা থেকে আমাদের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটা বেরিয়ে এসেছিল। আর রাজা হওয়ার সাধ-যে রূপকথার গল্প শুনে শুনে মনের ভেতর বাসা বেঁধেছিল তাতে আর আশ্চর্য কী! স্বপ্নটার কথা ভাবলে আজ মনে হয় জীবন আমাকে আমার ভবিষ্যৎ-দিনের পরিণতিটাই যেন বলে দিয়েছিল ঐ স্বপ্নটার ভেতর দিয়ে—অন্তত এটুকু বুঝিয়েছিল পৃথিবীতে যে শিশুটি রাজা হবার জন্যে হাতির পিঠে চড়ে একদিন রওনা হয়েছিল, নদী থেকে গ্লাসে করে পানি তোলার মতো হাস্যকর কাজ করে তাকে জীবন শেষ করতে হবে।

১২

করটিয়া-পর্বের আর একটা উজ্জ্বল ব্যাপার কলকাতা বেড়ানোর রোমাঞ্চকর স্মৃতি।

কলকাতায় ছিল আমার নানাবাড়ি—সে-কারণেই ঘনঘন সেখানে যাওয়া হত। করটিয়া থেকে কলকাতা রওনা হয়ে প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে যেতে হত পোড়াবাড়ি বা চাড়াবাড়ি ঘাটে। সেখান থেকে দুপাশে বিশাল বিশাল চাকা লাগানো জাহাজে চড়ে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে সিরাজগঞ্জে নেমে সুরমা মেল ধরে তবে কলকাতা। করটিয়া থেকে চাড়াবাড়ি পর্যন্ত ছিল লাল ইট-বিছানো একটানা রঙিন পথ। পথটার রক্তিম সৌন্দর্য আজও আমার চোখে লেগে আছে। রাস্তাটা ধরে এগোতে থাকলে কিছুটা পরপরই উঁচু উঁচু ব্রিজ। ব্রিজগুলো এত উঁচু যে মনে হয় লাল টুকটুকে রাস্তাটা যেন কোনোমতে শরীরটাকে টেনেটুনে সেই অতি উঁচুতে তুলে একসময় হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়েছে। কখনও কখনও যেতাম পোড়াবাড়ি হয়ে। পোড়াবাড়ির চমচমের খ্যাতি তখন দেশজোড়া। ঘিয়ে ভাজা পুরু মালাই ধরানো সেই চমচমের নাম আজও কমবেশি রয়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের ওপর জাহাজটা খুব বেশিক্ষণ থাকত না, কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যে বিশাল ঐ নদীটাকে আমি গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলতাম। তার বিশালতা আমাকে অভিভূত করত। স্রোতের সঙ্গে কাঠের গুঁড়ি, পশুর মৃতদেহ, ফেনা, কচুরিপানার দল, লতাপাতা নিয়ে সে চলছে তো চলছেই। কখনও সন্ধ্যায়, কখনও সকালের দিকে জাহাজটা নদী পেরোত। দু-সময়েই নদীটার জলজ-জগতের অন্তহীনতা, ডেকের উত্তাল বাতাস, জাহাজের মুখর উধাও কলস্বর—সবকিছু মিলে যেন একটা সজীব প্রাণময় ছবি জ্বলজ্বল করতে থাকত চোখের সামনে।

১৩

কলকাতা মহানগরী আমার কাছে তখন ছিল এক জাগ্রত বিস্ময়ের নাম। আমি সেই বিস্ময়ের শেষ পেতাম না। অবাক চোখে এই শহরের প্রতিটি জিনিশকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। মানুষ, গাড়ি, ট্রাম, ঘরদোর, শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্য এলাকা—সবকিছু দুহাতে জড়িয়ে এই পরাক্রান্ত শহরটা দুর্ধর্ষের মতো এগিয়ে চলেছে; কিন্তু কোথাও যেন ছন্দপতন নেই। সবকিছুই বলীয়ান, সবকিছুই নির্ভেজাল, অনিন্দ্য।

কলকাতা শহরের যা আমার তরুণমনকে সবচেয়ে খুশি আর অবাক করে তুলত তা এর নয়নাভিরাম ট্রাম। সেকালে কলকাতার বাইরেও মোটরগাড়ির দেখা পাওয়া যেত কিন্তু ট্রাম ছিল একেবারেই কলকাতার নিজের জিনিশ। ভারতের আরও কিছু শহরে ট্রাম থাকলেও কলকাতার মতো এত সুন্দর ট্রাম আর কোথাও ছিল না।

সুন্দর সুন্দর রঙিন বিজ্ঞাপনে শোভিত রাজহাঁসের মতো রাজকীয় গড়নের এই ট্রামগুলো আমার দুইচোখে গভীর মুগ্ধতা ছড়াত। আমি অবাক বিস্ময়ে ট্রামগুলোর অপরূপ সৌন্দর্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।

এই ট্রামের সৌন্দর্য কীভাবে একবার আমার কচি চোখদুটোকে রূপের মোহে অন্ধ করে আমাকে ধ্বংস করতে বসেছিল সে-গল্পটা এই ফাঁকে শুনিয়ে নিই। সেবার মাত্র কয়েকদিনের জন্যে নানার বাসায় বেড়াতে গেছি। আমার বয়স তখন চার কি সাড়ে চার। কলকাতায় যাবার পরের দিন হঠাৎ দেখা গেল সারা বাসায় কোনোখানে আমি নেই। ছাদে, বারান্দায়, আশেপাশের রাস্তায় কোথাও না। আমাকে না-দেখে মা প্রায় পাগলের মতো হয়ে উঠলেন। চারিদিকে খোঁজ পড়ে গেল। খুঁজতে খুঁজতে মামা বড় রাস্তায় (পার্ক স্ট্রিটে) এসে দেখেন ট্রামলাইনের মাঝখানে দুহাত পেছনে দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি একটা এগিয়ে আসা ট্রামের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। মামা ছুটে এসে এক ঝটকায় আমাকে কোলে তুলে ট্রামলাইন থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ায় সেবারের মতো আমার জীবন বেঁচে যায়। নিজের বোকামির জন্যে ট্রামের নিচে পড়তে বসেছিলাম, এটা গলা চড়িয়ে অন্যকে বলার ব্যাপার নয়, আমিও তাই ঘটনাটা সারাজীবন চেপে গেছি, কিন্তু আসল ঘটনাটা কী ঘটেছিল তা আজও আমার মনে আছে।

ঘটনাটার আগের দিন বিকেলেই করটিয়া থেকে আমরা কলকাতায় পৌঁছেছি। নানার বাসায় যাবার পথে রাস্তার ট্রামগুলোর দৃষ্টিলোভন সৌন্দর্য দেখে আমি প্রায় চন্দ্রাহত হয়ে গেলাম। আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। ট্রামগুলোকে আবার কখন দেখব সেই অস্থিরতায় আকুলিবিকুলি করতে লাগলাম। পার্ক স্ট্রিট ট্রামলাইন বাসার কাছেই, মাত্র দুটো গলি পরে। দুপুরে খাওয়ার পর কাউকে না বলে চলে গেলাম সেই বড় রাস্তায়। সামনেই ট্রামের সেই অনিন্দ্য অপরূপ জগৎ। কী স্বপ্ন আর সৌন্দর্যে ভরা একেকটা ট্রাম! কী রঙিন আর রাজকীয় তাদের আসা-যাওয়া। আমার চোখে নেশা ধরে গেল। দেখে দেখে সেই সৌন্দর্য যেন শেষ হয় না। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে ট্রামদের মন ভরে দেখার পর লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম সামনে থেকে দেখার জন্যে। এর মধ্যেই দেখলাম হাত-পঞ্চাশেক দূরে একটা ট্রাম আমার দিকে এগিয়ে আসছে। নিঃশব্দে, রাজহাঁসের মতো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে সে। তার হিসহিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। কী অপরূপ বৈভব! আমি মুগ্ধ অবাক চোখে তাকিয়ে তার অফুরন্ত বিস্ময় আর রহস্যের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। আমি তো গ্রাম থেকে আসা অবোধ শিশু। আমি কী করে জানব ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওই অপার্থিব সৌন্দর্য আমাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে! অমন মঞ্জরিত সৌন্দর্যের কাছ থেকে কী করেই-বা তা প্রত্যাশা করা যায়! আমি লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে মুগ্ধ অবোধ চোখে ট্রামটাকে দেখছি। এর মধ্যে টুং টুং করে ট্রামের সাবধানী ঘণ্টাও আমার কানে এসেছে। কিন্তু এই হুঁশিয়ারি যে আমার সরে যাবার জন্যে কী করে বুঝব! এর আগে আমি শুধু ট্রেন দেখেছি, তার বাঁশির গগনবিদারি শব্দই শুধু চিনি। সুন্দর ঐ ট্রামগুলোর মিষ্টি ঘণ্টা যে জল্লাদ হয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে কী করে তা জানব! আমি তখনও অপলক। হঠাৎ দেখলাম কে যেন একটা হ্যাঁচকা টানে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ফুটপাথের ওপর আছড়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখলাম মামা। চারপাশের লোকজন আমাকে ঘিরে আতঙ্কিত স্বরে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা নিয়ে এলোমেলো কথা বলছে। বাসায় ফিরলে মা ছুটে এসে আমাকে কোলে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।

এইভাবে শুধু ট্রামের হাতে নয়, অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের হাতে চন্দ্রাহত হয়ে জীবনে অনেকবার আমার প্রাণ যেতে বসেছে। আর সৌভাগ্যবশত প্রতিবারই মামার মতো কেউ-না-কেউ এসে আমাকে অলৌকিকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

১৪

ছেলেবেলার কলকাতা আর যা যা দেখিয়ে আমাকে অবাক করেছিল চিড়িয়াখানা তার একটি। একবার বড়মামার সঙ্গে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানায়। চিড়িয়াখানার বাঘ, সিংহ, হাতি, জিরাফ, গণ্ডার দেখে আমার ছেলেবেলার চোখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না। নানান রঙের পাখিদের বিচিত্র অবয়ব আর সৌন্দর্য এখনও আমার চোখে লেগে আছে। কিন্তু সবচেয়ে বিমর্ষ আমাকে করে তুলেছিল দেয়াল-ঘেরা জলাশয়ের ভেতর আকণ্ঠ-ডুবে-থাকা জলহস্তীটা। এর অবশ্য একটা ছোট্ট কারণ ছিল। ভয়ের ব্যাপারে চিরদিনই আমার একটা মারমুখো ভালোবাসা আছে। সেদিন জলহস্তীর বিশাল মুখটা দেখে যত ভয়-ভয় করছিল দেয়ালের ওপর ততই বেশি বেশি ঝুঁকে পড়ে জলহস্তীটাকে দেখছিলাম। আমার মামা আমাকে সেখান থেকে ফেরানোর জন্যে বললেন : ‘অত ঝুঁকলে পড়ে যাবি। জলহস্তীরা কিন্তু ছোটবাচ্চাদের চিবিয়ে খেতে খুব ভালোবাসে।’ বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘খেয়েছে নাকি?’ মামা বললেন, ‘গত বছর তোর বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ে ঠিক এখান থেকে পড়ে গিয়েছিল। জলহস্তীটা সবার সামনে থেকে মেয়েটাকে মুখে করে পানিতে নেমে গিয়েছিল। কাগজে উঠেছিল গল্পটা।’

মামার কথা শুনে ভয়ে পিছিয়ে এলাম। বহুদিন পর্যন্ত দেয়াল থেকে পড়ে যাওয়া মেয়েটার আতঙ্কগ্রস্ত মুখটা চোখের সামনে অসুস্থের মতো ঘুরে বেড়াত আমার। বহুবছর ধরে কানের পাশে মেয়েটার মৃত্যুমুহূর্তের আর্তনাদের শব্দ শুনতাম। একেকসময় নিজেকে ওই মেয়েটা বলে মনে হত। গল্পটা মনে হলেই বিমর্ষ হয়ে যেতাম।  

কলকাতার আর একটা বড় আকর্ষণ ছিল পার্ক সার্কাস ময়দান। খুব ভোরে ছোট মামার সঙ্গে চলে যেতাম ওখানে। মুকুল ফৌজের শরীরচর্চা দলে আমাদের পিটি আর কুচকাওয়াজ করাতেন শিল্পী কামরুল ইসলাম। তিনি তখন সুদর্শন স্বাস্থ্যবান যুবক। কিল দিয়ে ঝুনো নারকেল ভাঙেন। মাঝে মাঝেই ‘গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে’ গুরুসদয় দত্তের ‘আমরা বাঙালি সবাই বাংলারই সন্তান/বাংলাদেশের মাটি হাওয়ায় তৈরি মোদের প্রাণ’ বা ‘চলো কোদাল চালাই/ ভুলে মনের বালাই’ গানের সঙ্গে হাতে ছোট ছোট লাঠি নিয়ে দুপাশের ছেলেদের লাঠির সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে শরীরচর্চার আনন্দ উপভোগ করতাম। ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় মনটা তরতাজা হয়ে যেত।

আরও যেসব রঙিন খেলনা দিয়ে কলকাতা আমার শৈশবকে প্রলুব্ধ করেছিল তার মধ্যে নানান আকৃতির নানান রঙের অজস্র গাড়ি, বিশাল গড়ের মাঠ, সুদৃশ্য ঠেলাগাড়ি থেকে কেনা দুধশাদা ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিম, রাতের বেলার কুলফি বরফ তার কয়েকটি। পেস্তা-বাদাম দেয়া কুলফি বরফের অলৌকিক স্বাদ আমাদের সন্ধ্যাগুলোকে অভাবিত বিস্ময়ে ভরিয়ে রাখত।

১৫

ছেলেবেলায় আমি ছিলাম খুবই দুরন্ত। দুরন্ত কিন্তু সরল সোজা। ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর প্রবণতা আমার মধ্যে প্রায় ছিলই না। আজও নেই।

.

আমার ছেলেবেলা ভরা ছিল অফুরন্ত খেলাধুলায়, গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানোর দুরন্ত আনন্দে, সাঁতারে আর দূরদূরান্তে হারিয়ে যাবার উপচানো খুশিতে। আমার ছোটভাই মামুনও ছিল অসম্ভব দুরন্ত। কিন্তু ওর দুরন্তপনার মধ্যে প্রায়ই একটা ধ্বংসাত্মক অভিসন্ধি কাজ করত। ও প্রায়ই ওর অশুভ তৎপরতাগুলোর সঙ্গে সুকৌশলে আমাকে জড়িয়ে নিত, কিন্তু বিপদ দেখলেই আমাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে পেছন থেকে সরে পড়ত। ফলে গল্পের বাজিকরের সেই বোকা ছাগলের মতো যাবতীয় শাস্তি আমাকে পিঠ পেতে নিতে হত। মারধোর খেতে হত প্রায়ই। ব্যাপারটা কেমন তা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। একদিন মামুন আমাকে খবর দিল, রান্নাঘরে মিটসেফের ওপরের তাকে এক হাঁড়ি দুধ জাল দিয়ে ঘন করে রাখা হয়েছে। তাতে বেজায় পুরু সর।

আমি বোকা-সরল মানুষ। বললাম, ‘সর পড়েছে তো কী হয়েছে?’

মামুন বলল, “চলেন হাঁড়িটা নামিয়ে আমরা খেয়ে ফেলি।’

দুধটা সবার জন্যে জাল দিয়ে রাখা হয়েছে, তাই শুধু দুজনে কেন আমরা খাব ভাবনাটা প্রথমে আমার মাথাতেই আসেনি।

ওর কথা শুনে ব্যাপারটা মাথায় এল : ‘তাই তো, হাঁড়ি নামিয়ে তো সবটা সর দুজনে খেয়ে নেয়া যায়!’

বললাম, ‘চল্।

মা ঘুমিয়ে ছিলেন শোবার ঘরে। আমরা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

মিটসেফ বেশ বড়। ওপরের তাকটা আমার মাথার চেয়েও ফুটখানেক উঁচুতে। সেই তাকে হাঁড়ি। কাজেই মিটসেফ বেয়ে ওপরে উঠতে না-পারলে হাঁড়ি নামানো সম্ভব নয়। আমি মিটসেফের তাক বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। মামুন পেছন থেকে দুহাতে ঠেলে আমাকে উঠতে সাহায্য করে চলল। কিন্তু আগেই বলেছি আমি ছিলাম বেজায় মোটাসোটা। আমার ভার মিটসেফ সহ্য করতে পারল না, বিরাট শব্দে আমার ওপরে পড়ে গেল। মিটসেফের ভার ঘাড়ে নিয়ে হাঁড়ির দুধের মধ্যে আমি গড়াগড়ি যেতে লাগলাম। বিকট শব্দে মিটসেফ পড়া আর সেইসঙ্গে আমার তীব্র চিৎকার—এই দুয়ে মার ঘুম ভেঙে গেল। তাঁর ধারণা হল আমার বিপজ্জনক কিছু হয়েছে। উনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন রান্নাঘরের দিকে। মামুন প্রথমে চেষ্টা করছিল আমাকে মিটসেফের নিচ থেকে বের করতে। কিন্তু মা রান্নাঘরে ঢুকছেন টের পেতেই ও আস্তে করে দরোজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল আর মা ঘরে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পেছন দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মা ভেবেছিলেন মিটসেফের নিচে পড়ে আমি হয়ত থেঁতলে গেছি। কিন্তু মিটসেফ সরিয়ে যখন দেখলেন যে আমি পুরোপুরি সুস্থ এবং হৃষ্টপুষ্ট তখন দুর্ঘটনায় আমার যতটুকু আহত হবার কথা ছিল তা তিনি নিজের হাতে সম্পূর্ণ করে দিলেন।

১৬

আমাদের দুজনের এসব সংঘবদ্ধ দৌরাত্ম্যে মার জীবন দুর্বিষহ ও যন্ত্রণামুখর হয়ে উঠেছিল। মা (বেগম করিমউন্নিসা) নিজেও ছিলেন অসম্ভব জেদি ও প্রচণ্ড একরোখা স্বভাবের। অল্পবয়সে তাঁর দুরন্তপনা আমাদের চেয়ে কম ছিল না। তাঁর রাগও ছিল সৃষ্টিছাড়া। রেগে গেলে তিনি দাঁত কড়মড় করতে থাকতেন। আমরা পাশের ঘরে থেকে তাঁর সেই কড়মড়ানির শব্দ শুনতে পেতাম। আমাদের মতোই তাঁরও ছেলেবেলার দস্যিপনাও ছিল সমবয়সী সবাইকে ছাড়ানো। গেছো-মেয়ে বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। সারাদিন গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো, সুরেশ্বরে বাবার পৈতৃক বাড়ির সামনে পদ্মার প্রমত্ত স্রোতে ঝাঁপিয়ে জাহাজের হাল ধরে দাপাদাপি করা বা সমবয়সী ছেলেদের নেতৃত্ব দিয়ে নানারকম ধ্বংসযজ্ঞ চালানোয় তাঁর জুড়ি ছিল না।

মার স্বভাব যে কী দুঃসাহসী আর সৃষ্টিছাড়া ছিল তা আরও বোঝা যাবে কী করে আমাকে তিনি সাঁতার শিখিয়েছিলেন তা শুনলে। একটু আগেই বলেছি তিনি খুবই ভালো সাঁতার জানতেন। একা একা পদ্মায় নেমে সাঁতরাতেন। একদিন সকালে মা আমাদের বাসায় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে গল্প করছিলেন, হঠাৎ আমাকে দেখে বললেন : এই সাঁতার শিখবি? আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, শিখব। আমার বয়স তখন পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ। মা আমাকে আর ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বাসার পাশের সেই ছোট্ট নদীটার ধারে গেলেন। তখন সম্ভবত ফাল্গুন-চৈত্র মাস, নদীতে কোমর পানির বেশি নয়। স্বচ্ছ পানির নিচের চিকচিকে বালু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মা আমাকে হাত ধরে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নামালেন, তারপর হঠাৎ, আমি বোঝার আগেই, ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলেন। আচমকা এমন বিপদে পড়ব ভাবতেই পারিনি। হঠাৎ ডুবে গিয়ে আমি পুরো দিশেহারা হয়ে গেলাম। দেখলাম আমি কিছুতেই ভেসে থাকতে পারছি না, আমার শরীর কেবলি ভারী হয়ে নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আমি বাঁচার জন্যে হাত-পা ছুড়ে প্রাণপণে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। একটা অদ্ভুত ভয় আমাকে ঘিরে ধরল। আমার মনে হল আজ আমি হয়ত মরে যাব। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। বাঁচার জন্যে আমি পানি খেতে লাগলাম আর পাগলের মতো ওপরে ওঠার জন্যে যুদ্ধ করে চললাম। আমার শরীর-মাথা তখনও পানির নিচে। পানির ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখি মাটির ওপর দাঁড়িয়ে মা নির্বিকারভাবে আমাকে দেখছেন আর হেসে হেসে সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে গল্প করছেন। মাকে আমার অসম্ভব নিষ্ঠুর মনে হতে লাগল। চিৎকার করে যেন তাঁকে বলতে চাইলাম, মা আমাকে বাঁচান, দেখছেন না পানির নিচে আমি মরে যাচ্ছি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এসে আমাকে পানি থেকে তুলে নিলেন। ততক্ষণে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে আপ্রাণ চেষ্টায় আমি আমার মাথা নিজেই পানির ওপরে তুলে ফেলেছি।

ব্যাপারটা দুই-আড়াই মিনিটের বেশি সময়ের নয়, কিন্তু দেখলাম, এরি মধ্যে অদ্ভুতভাবে আমি সাঁতার শিখে ফেলেছি। মাথা পানির ওপর ভাসিয়ে রাখতে অসুবিধা হচ্ছে না। পানিতে সাঁতরাতে এরপর আমাকে আর কারো সাহায্য নিতে হয়নি।

১৭

আমার এমন দুর্দান্ত মা-ও মধ্যযৌবনে আসার আগেই কঠিন অসুখে পড়ে সম্পূর্ণ নির্জীব হয়ে পড়লেন। তাঁর স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙে গেল। আমার মিটসেফের গল্পের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ-তেত্রিশ বছর। তাঁর নিষ্প্রাণ শীর্ণ চেহারা থেকে তারুণ্যের লালিত্য ততদিনে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে তিনি ছিলেন আমাদের ত্রাসের কারণ। আমাদের দৌরাত্ম্য দুঃসহ হয়ে গেলে এক-এক সময় তিনি হিংস্র হয়ে আমাদের নির্মমভাবে পেটাতেন। তখন মার সেই সৃষ্টিছাড়া ভয়ংকর চেহারা দেখে আমার ভীষণ ভয় করত। মনে আছে একবার কী একটা অপরাধে যেন, হয়ত অপরাধটা বেশ বড়সড়ই, মা আমাকে বাগানের গাছের সঙ্গে বেঁধে দুটো শক্ত কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে আমার শরীর ফালা ফালা করে দিয়েছিলেন। তাঁর এসব হিংস্রতা অকারণ ছিল না। আসলে এটা তাঁর হিংস্রতাও ছিল না। এ ছিল নিজের ব্যর্থতার জন্যে নিজের ওপর নিজের প্রতিশোধ। সেকালে ঘরে ঘরে মেয়েদের সূতিকা নামে একটা রোগ হত। এ ছিল প্রায় দুরারোগ্য। এর কোনো ওষুধ ছিল না। এ রোগ হলে স্থায়ী অজীর্ণরোগে এবং রক্তশূন্যতায় বছরের পর বছর ভুগে তিলে তিলে নিঃশেষিত হয়ে মেয়েরা মারা যেত। আমার মা-ও বহুদিন ধরে এই রোগে ভুগেই শারীরিকভাবে নিঃশেষিত হয়ে এসেছিলেন। আমার মিটসেফের ঘটনার দেড় বছরের মধ্যে এ রোগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি তখন তাঁর প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিছুই করতে পারছেন না, অথচ আমরা পড়াশোনা ফেলে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছি— দেখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তিনি মরে গেলে আমাদের কী হবে এই দুশ্চিন্তা তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ করে তুলত। সামনে অকালমৃত্যু, এদিকে ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে জীবনের ব্যর্থতার যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি—সব মিলে তিনি একেবারে ভেঙে গিয়েছিলেন। তাই আমাদের দুরন্তপনার বাড়াবাড়ি দেখলে পাগলের মতো পিটিয়ে নিজের সেই অক্ষমতার প্রতিকার খুঁজতেন।

একদিনের একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। পাশের বাড়ির আরবির অধ্যাপক সাহেবের বাসার রান্নাঘরে বসে তাঁর স্ত্রীর কাছে মা তাঁর নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলছিলেন। আমি ছিলাম সামনেই। মাকে অসম্ভব নিরুপায় আর বিস্রস্ত মনে হচ্ছিল। আমার আর আমার ছোটভাই মামুনের নষ্ট হবার কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন। একসময় অসুস্থের মতো সামনের শিলপাটা থেকে শিলটা নিয়ে জোরে জোরে কপালে ঠুকে বলতে লাগলেন : ‘খোদা, আমাকে তুই নিয়ে যা, আমি আর সহ্য করতে পারি না।’ স্পষ্ট মনে পড়ে শিলের ঘায়ে মার ফরসা কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল। আরবির অধ্যাপকের স্ত্রী ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা হয়ে মার হাত থেকে শিলটা জোর করে কেড়ে নিয়ে বলতে লাগলেন : ‘কী করছেন আপনি, এ কী করছেন!’ আমাদের বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা, দুরন্তপনা আর অধঃপাতে যাবার দুঃসহ অশান্তি বুকে নিয়ে আমার মা এ-পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

১৮

মার দুর্ভাগ্যভরা ও বেদনাক্লিষ্ট এই দিনগুলোতে আমাদের জীবন কিন্তু ছিল উদ্দাম ফূর্তি আর অবাধ স্বাধীনতায় থৈ থৈ করা। আব্বা আছেন কলেজ আর পড়াশোনা নিয়ে, রুগ্‌ণ মা আমাদের সামলাতে পারেন না, আমাদের পায় কে! সারাদিন টো টো করে ঘুরে, সাঁতার কেটে, গাছের মগডালে ইচ্ছামতো দোল খেয়ে, বিড়ালের লেজের সঙ্গে ইট বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে, ইট দিয়ে ইঁদুরের মুখ থেঁতলে, কুসংসর্গে প্রতিদিন নষ্ট থেকে নষ্টতর হবার অকথ্য সুখে আবিল হতে হতে আমাদের সময় কাটতে লাগল। কী যে সেই অপার স্বাধীনতার পৈশাচিকতা, বোঝানো দায়। প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজনা, অভিযান, রোমাঞ্চ আর হিংস্র উদ্‌যাপনে উচ্ছৃঙ্খল। আমার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ ও আনন্দমধুর সময়ের এটা একটা। কী করে আমরা বুঝব স্বপ্ন আর মত্ততায় ভরা এইসব অনাবিল আর উত্তাল দিনগুলোর ভেতর দিয়ে আসলে আমরা অধঃপাতের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি! আমরা ভাবতেও পারিনি পড়াশোনা না-করে, গৃহশিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে, বখাটে ছেলেদের সঙ্গে টো টো করে আমরা যখন জীবনের সব সম্ভাবনা শেষ করে ফেলছি তখন মা আমাদের নিয়ে উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তার ভেতর কী অসহায় সময় কাটাচ্ছেন!

আগেই বলেছি আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা অসহনীয় হয়ে গেলে মা আমাদের অমানুষিকভাবে মারতেন। হয়ত দুশ্চিন্তা আর অক্ষমতার শীর্ষ থেকে দুরাশার মতো তাঁর মনে হত অমনি নির্মমভাবে পেটালে আমরা ভয় পেয়ে ভালো হয়ে যাব। বুদ্ধি বিবেচনামতো যতটুকু সাধ্য মা আমাদের জন্যে করেছিলেন। মা যে কথায়-কথায় আমাদের পেটাতেন তা নয়, হয়ত সে-শক্তিও তাঁর তখন ছিল না, কিন্তু বড়ধরনের অন্যায় করলে সমস্ত শক্তি একখানে করে শাস্তি দিতেন। শাস্তি দেওয়া শেষ হলে ক্লান্তিতে হাঁপাতেন, কাঁদতেন। একদিনের এমনি একটা নির্মমতার কথা আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। যেসব ঘটনা ঘটলে মা সবচেয়ে খেপে যেতেন তার একটা হল প্রাইভেট টিউটর আসার সময় বাসায় না-থাকা। আমাদের বাসা থেকে বেশদূরেই একটা তেঁতুলগাছে তেঁতুল পেকেছিল, বেলেতেঁতুল, ভারী স্বাদের। আমরা গিয়েছিলাম সেই গাছে তেঁতুল পাড়তে। তেঁতুলের ঝাঁঝালো নেশায় স্যারের আসার কথা মাথা থেকে পুরো মুছে গেল। যখন ফিরে এলাম তখন তিনি চলে গেছেন। মার হাতে কী সব উচ্চস্তরের আদর-আপ্যায়ন জুটবে তা ভেবে শিউরে উঠলাম। গুটিগুটি পায়ে বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম মা হাতে চুলোর কয়লা-ফেলার লোহার একটা লম্বা হাতা নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনায় দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ রেহাই নেই। ভেতরে ঢোকামাত্র তিনি গাঁক করে গিলে ফেলবেন। কী উপায় বাঁচার! হঠাৎ একটা বুদ্ধি ঝলক দিল মাথায়। আমি জানতাম তেঁতুলের ব্যাপারে মা দুর্বল। বললাম : ‘মা, তেঁতুল খাবেন? বেলে- তেঁতুল। খুব মজা।’ মা বললেন : ‘দে।’ কিন্তু দিতে গেলেই তো মার হাতে পড়ে যাব। আর পড়া মানেই। বললাম : ‘দিতে গেলে তো আপনি ধরে ফেলবেন।’ মা নিরুত্তর। ঘুষটা তাহলে দিই কী করে? হঠাৎ মাথায় আর-একটা বুদ্ধি এল। আমাদের বাসার গেটের নিচ দিয়ে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। ভাবলাম মা যদি গেটটা বন্ধ করেন তবে তো গেটের নিচ দিয়ে তেঁতুলটা তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া যায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম কোনোমতে তেঁতুলটা একবার মার হাতে গছানো গেলে আজকের মতো বেঁচে যাব। বললাম : ‘আপনি দরোজাটা বন্ধ করেন, আমি দরোজার নিচ দিয়ে তেঁতুলটা আপনার হাতে দিই।’ মা রাজি হয়ে দরোজাটা বন্ধ করলেন। আমি সরল বিশ্বাসে দরোজার নিচ দিয়ে তেঁতুলসুদ্ধ হাতটা ঢুকিয়ে দিলাম। সরাসরি মার সামনে না-পড়ায় ভেবেছিলাম মার খাওয়া থেকে আজকের মতো বেঁচে গেছি। কিন্তু দরোজার নিচ দিয়ে যে-হাতটা আমি ঢুকিয়ে দিলাম সে হাতটাও যে আসলে আমিই—হাত ঢোকানোর সময় সে খেয়ালই আমার হয়নি। মনেই হয়নি ওটাকে পেটালেও আমাকেই পেটানো হবে। এতটাই ছিলাম আমি বুদ্ধিহীন। মা সুযোগ ছাড়লেন না। হাত ঢোকাতেই খপ করে তা চেপে ধরলেন। তারপর সেই হাতা দিয়ে আমার হাতটাকে পিটিয়ে ভবিষ্যৎ তেঁতুল পাড়ার পক্ষে এমনি বিকল করে দিলেন যে হাতের ব্যথা বিদায় হতে বেশ কয়েকদিন লেগেছিল।

এসব ঘটনার পর মা খুব বেশিদিন বাঁচেননি। ভেঙেপড়া, দুশ্চিন্তাক্লিষ্ট, রুগ্‌ণ শরীরে এই সময়েই আবার তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন। জরাজীর্ণ স্বাস্থ্যের ওপর এই চাপ থেকে তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। রুগ্‌ণ শরীরে সন্তান জন্ম দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর দু’দিন পর আমার নবজাতক ভাইটিও মারা যায়। মৃত্যুর সময়ও অস্ফুটগলায় বিড়বিড় করে তিনি কেবল তাঁর ছেলেমেয়েদের কথা বলছিলেন। তিনি চলে গেলে তাঁর ছেলেমেয়েদের কী হবে সেই দুশ্চিন্তার কথা।

আমাদের তিন ভাই দু-বোনকে রেখে মা বিদায় নেন।

১৯

মাকে কবর দিয়ে ফেরার সময় ‘সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী’ ছাপানো একটা বিশাল গভীর শূন্যতা আর বিষণ্ণতা আমাকে অধিকার করে বসল। মৃত্যুর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। আচমকাভাবেই অনুভব করলাম, যে-মানুষটিকে এখানে রেখে যাচ্ছি সমস্ত চোখের পানির বিনিময়েও তাঁকে এই পৃথিবীতে কোনোদিন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে মায়ের ওপর কত সময় কত অভিমান করেছি, যাকে নিয়ে কত অনুযোগ ছিল মা বলে ডাকার সেই অপছন্দের মানুষটিও আর কোথাও রইল না। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হল।

তখন ডিসেম্বর মাস। শীতের দুপুর পড়ি পড়ি করছে। আমি টের পেলাম আমার অস্তিত্বজুড়ে একটা অব্যক্ত কান্না আমার চোখ-মুখ ছাপিয়ে কেবলি ছলছল করছে। চারপাশের পৃথিবী, আকাশ সবকিছু যেন একটা নিমগ্ন শোকের অস্বচ্ছ কুয়াশায় ঝাপসা (মায়ের মৃত্যুর কথা মনে হলে আমি আজও বিয়োগ-বেদনায় ভরা সেই ঝাপসা বিষণ্ণ দিনটাকে একইরকমভাবে চোখের সামনে দেখতে পাই)। এক-এক করে সবাই গোরস্তান ছেড়ে চলে এল। কিন্তু আমার পা চলতে চাইল না। মাকে রেখে কী করে ফিরে যাব আমি! সবাই চলে যাবার পর কবরের পাশে ঘাসের ওপর দুর্ভাগ্য-বিহ্বল মানুষের মতো মাথায় হাত দিয়ে কয়েকঘণ্টা একা বসে থাকলাম। আমার কেবলই ইচ্ছা করতে লাগল যেভাবে রাতে নিঃশব্দে মার বুকের সঙ্গে একান্ত সংলগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে থাকতাম তেমনি তাঁর কবরের অন্ধকারের ভেতর তাঁকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি।

মার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন সত্যি সত্যি শেষ হয়ে গেল। যে অন্ধ অবোধ মমতা, আবেগ, আদর আর নিরাপত্তা দিয়ে তিনি আমাকে ঘিরে রেখেছিলেন, মুহূর্তে তা মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম এসবের কোনোকিছুই আমার চারপাশে কোথাও নেই। হঠাৎ করেই নিজেকে আশ্রয়হীন শিশুর মতো মনে হল। দেখতে পেলাম যে- মানুষটি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলত, গোসল করিয়ে চুল আঁচড়ে দিত, জামাকাপড় পরিয়ে ভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠাত, সকাল-বিকাল পড়ানোর জন্যে প্রাণান্ত চেষ্টা করত, দৌরাত্ম্য করলে পিটুনি লাগাত, এককথায় জীবনের শিয়রে স্নিগ্ধ নিশ্চয়তার মতো জ্বলে থাকত; সেই মানুষটি আচমকা উধাও হয়ে গেছে। আজ আমাকে বেঁচে থাকার, ভালো থাকার কথা বলার আর কেউ নেই। একটা মানুষ আমার সারাজীবনটাকে কীভাবেই না দুহাত ধরে ছিলেন, তিনি থাকায় তা অনুভবই করতে পারিনি। তাঁর বিদায়ে জীবনটা নিজের চেয়ে হাজার কোটি গুণ ভারী হয়ে নিজের বুকের ওপর চেপে বসল।

জীবন যে এত বিশাল আর গুরুভার কে তা জানত? কী করে আমি বেঁচে থাকব? আমি যে নিজেকে একেবারেই দেখে রাখতে পারি না। কে আমার চুল আঁচড়ে দেবে? কে জামাকাপড় পরিয়ে স্কুলে পাঠাবে? একা একা মানুষ কীভাবে বাঁচতে পারে? আমার চারপাশে কোথাও কারো ভালোবাসার হাত তো আমি দেখছি না! একটা অদ্ভুত ভয় আমার সারা অস্তিত্বকে গ্রাস করতে লাগল। স্বপ্নের মধ্যে প্রায়ই দেখতাম সাততলা সিঁড়ির ওপর থেকে আমি হঠাৎ পা হড়কে ভয়ংকর আর্তনাদ তুলে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন দেখে আমি আঁতকে উঠতাম। আমার ঘুম ভেঙে যেত। জেগে দেখতাম আমার গা ঘেমে উঠেছে, আমার বুকের ভেতরটা থরথর করছে। জীবনের পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এই স্বপ্ন আমি নিয়মিত দেখেছি।

২০

মা মারা যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। একদিন বিকেলে আমরা টাঙ্গাইল-করটিয়া রাস্তার ওপর খেলছি, হঠাৎ দেখলাম একটা ঘোড়ার গাড়ি করটিয়া ব্রিজ পার হয়েই রাস্তার কাদায় আটকে গেল। এভাবে কোনো গাড়ি কাদায় পড়লে আমরা সবসময়ই সেগুলোকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিতাম। সেদিনও তাই করতে গেলাম। ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখি গাড়ির মধ্যে আব্বা আর তাঁর পাশে বসা একজন সাজগোজ করা অপরিচিত মহিলা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনলাম, গাড়ির ভদ্রমহিলাটি আমাদের মা। কিন্তু মার সঙ্গে তাঁর চেহারার মিল না পাওয়ায় আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়লাম। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ছোটচাচা। তিনি ভুলটা ভাঙিয়ে দিলেন। বললেন : মারা যাবার পর ফিরে এসেছেন তো, তাই চেহারা কিছুটা পাল্টে গেছে। আমি খুব সোজা সরল ছিলাম, কথাটা পুরো বিশ্বাস করলাম।

২১

খুব খ্যাতিমান হতে না-পারলেও রক্তের ভেতর আব্বা ছিলেন লেখক। অধ্যাপনা, পড়াশোনা আর লেখালেখির মত্ততার মধ্য দিয়েই তাঁর করটিয়ার দিনগুলো কেটেছিল। এই পনেরো বছর ছিল তাঁর জীবনের সৃষ্টিশীলতার সবচেয়ে ফলবান সময়। মূলত নাট্যকার হলেও আব্বা বেশকিছু গল্প আর কবিতাও লিখেছিলেন। ‘থার্ডমাস্টার’ নামে তাঁর একটা অনুভূতিময় গল্পের কথা আজও মনে পড়ে। এই থার্ডমাস্টার ভদ্রলোকটি ছিলেন আব্বার স্কুলেরই শিক্ষক। তাঁর সত্যিকাহিনী নিয়েই গল্পটি লেখা। নির্মম তীক্ষ্ণ বেতে ছাত্রদের ছিন্নভিন্ন করা ছিল তাদের প্রতি থার্ডমাস্টারের ভালোবাসা প্রকাশের উপায়। তিনি মনে করতেন ঠিকমতো বেতানো গেলেই ছাত্রদের জ্ঞান পরিশুদ্ধ ও জীবন সফল হয়। বেতানো ছিল ছাত্রদের প্রতি তাঁর বিবেক-নিঃসৃত অপত্যস্নেহের অনাবিল প্রস্রবণ। যত ভালো ছাত্রই হোক, তাঁর হিংস্র বেতের হাত থেকে কারো রেহাই ছিল না। ছাত্রেরা সবাই তাঁকে একজন নির্মম নিষ্ঠুর শিক্ষক হিশেবেই জানত। কিন্তু ছাত্রদের জন্যে তাঁর মমতা-যে কতখানি নিখাদ আর আন্তরিক ছিল তা বোঝা গেল ছেচল্লিশ বছর শিক্ষকতার পর যেদিন তাঁকে অবসর দেওয়া হল সেদিন। নিঃসঙ্গতায় তিনি পুরো ভেঙে পড়লেন। স্কুলের সময় হলেই দেখা যেত তিনি স্কুলের পাশের একটা নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে স্কুলের দিকে কান খাড়া করে আছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পেয়ে বলতেন : ‘ছেলেদের কিচিরমিচির না-শুনলে মনটা বড় খাঁ খাঁ করে রে। ওদের ছাড়া আমি-যে একদম থাকতে পারি না।’ ছাত্রদের থেকে বিচ্ছেদের এই শোক তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেননি। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও প্রবল জ্বরের ভেতর তাঁর প্রলাপের অসংলগ্ন কথা থেকে বোঝা যাচ্ছিল তখনও তিনি ছাত্রদের বই থেকে এক-এক করে পড়া ধরে চলেছেন আর কেউ তা না-পারলে প্রলাপের ভেতরেই নির্মমভাবে তাকে বেতিয়ে ফালি-ফালি করছেন। ভারি সুলিখিত ছিল গল্পটা।

কবি হিশেবে আব্বার পরিচয় না-থাকলেও কিছু ভালো কবিতা তিনি লিখেছিলেন। মার মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে লেখা আব্বার একটা কবিতার কয়েকটা লাইন এখনও আমার মনে আছে :

…তবু বারংবার
চাহিস তাহারে ফিরে ওরে আত্মভোলা
বাঁধিবারে নীড়।
সে যে আসিবে না
স্মৃতি রেখে চলে গেছে যে ছিল আপনা।

আগেই বলেছি মূলত নাট্যকার ছিলেন আব্বা। তাঁর রক্তে ছিল নাটকের নেশা। নাটক নিয়ে প্রায় সারাবছরই মাতোয়ারা হয়ে থাকতেন তিনি। প্রতিবছর একটা বা দুটো নাটক লেখা আর কলেজের ছাত্রদের দিয়ে দিনের-পর-দিন রিহার্সাল করিয়ে সেগুলো মঞ্চস্থ করানো ছিল তাঁর সাংবাৎসরিক উদ্দীপনা। হাসির নাটক তিনি লিখেছিলেন কিছু, সামাজিক নাটকও। তাঁর সামাজিক নাটক ‘মা’ পি.ই.এন.-এর নাট্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল।

২২

আমার দাদাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শিল্পপ্রবণতাসম্পন্ন। আমার দাদা এনসানউদ্দীনের মধ্যে শিল্পের তেমন উৎসাহ না-থাকলেও তাঁর নামের মতোই তিনি ছিলেন একজন খাঁটি ‘এনসান’। তাঁর মধ্যে ছিল উঁচুমাপের ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার। গ্রাম-গ্রামান্তের লোকেরা বিচার-সালিশের জন্যে তাঁর কাছে আসত এবং ন্যায়বিচার পেয়ে খুশিমনে বিদায় নিত। সালিশপ্রার্থীদের ভিড়ে তাঁর বাড়ি সারাক্ষণ গমগম করত।

তাঁর তরুণ বয়স থেকেই লোকেরা সালিশের জন্যে তাঁর কাছে আসত। তাঁর অতিপ্রজ পিতা তাঁর এসব গুণপণা দেখে টের পেয়েছিলেন যে সারাজীবন বিচারের জন্যে তাঁর কাছে লোকেরা অবিরাম যাওয়া-আসা করবে। এজন্যে অভ্যাগতদের ‘তামাক খরচের’ জন্যে অন্য ভাইদের তুলনায় তাঁকে আলাদা করে দশ বিঘা বেশি জমি দিয়ে গিয়েছিলেন।

আমার দাদার মধ্যে কতগুলো বোধ ছিল খুব তীক্ষ্ণ। অনেক কিছুই তিনি নিজের অজান্তে বুঝতে পারতেন। আকাশে মেঘের এতটুকু চিহ্ন নেই, হঠাৎ বলে উঠতেন : ‘শিগগির উঠান থেকে ধান উঠিয়ে ফেল। বৃষ্টি আসছে।’ দেখা যেত কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এসে গেছে।

আমার দাদাদের মধ্যে যাঁর মধ্যে শিল্পীর রক্ত সবচেয়ে প্রবল ছিল তাঁর নাম গয়েজউদ্দীন। একসময় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৃহত্তর খুলনা (খুলনা-বাগেরহাট- সাতক্ষীরা) অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কবিয়াল। আব্বার কাছে শুনেছি একবার বাগেরহাট শহরে বরিশাল অঞ্চলের সেরা কবিয়াল ও তাঁর মধ্যে ‘কবির লড়াই’ হয়েছিল। বিশাল থৈ থৈ আসর। লোক উপচে পড়ছে। কে হারে কে জেতে তা দেখার জন্যে সবাই উদগ্রীব। নানান ধারালো প্রশ্নোত্তর হচ্ছে, কিন্তু কে জিতছে কে হারছে সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। দুজনেই যাচ্ছেন সমানে সমানে। চাপান উতোরের এই তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে বরিশালের বিজয় কবিয়াল হঠাৎ করেই অশ্লীল ভাষায় দাদাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। গোটাচারেক বিষমাখা পঙ্ক্তি আউড়ে সব শেষে অশালীন ভঙ্গিতে বললেন :

তোরা হলি আঠারো ভাই
তোর মার পেটে উজুরি নাই।

‘উজুরি নাই’ কথাটা এমন অশ্লীল হাসিতে প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে দিলেন যে বরিশালের লোকেরা প্রচণ্ড জয়ধ্বনিতে পিশাচের মতো নাচতে লাগল। ঘণ্টা পিটিয়ে তারা এভাবে নাচতে শুরু করল যেন জিতে গেছে। খুলনার সমর্থকদের মুখ চুপসানো। তারা টের পাচ্ছে তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। সবার দৃষ্টি দাদার দিকে। কী উত্তর দেন তিনি! ঠিকমতো পারবেন তো! জিতবে তো তারা? নাকি এখানেই ইতি? দাদা মৃদু হেসে বিজয় কবিয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর একই ভঙ্গিতে সুর করে গেয়ে উঠলেন :

আমরা হলাম আঠারো ভাই
আমার মার পেটে উজুরি নাই।

এই তো কথা কবিয়াল? শোনো তবে প্রস্তাব আমার :

বিজয় কবিয়ালের দিকে হাত দিয়ে আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে আহ্বান জানিয়ে গাইলেন :

তুই হলে আমরা উনিশ ভাই
তোর মাকে দে এনে আমার বাপের ঠাঁই।

এমন অশ্লীল ভঙ্গিতে তিনি শেষ কথাটাকে ছুড়ে দিলেন যে খুলনার লোকেরা আনন্দে উত্তেজনায় পুরো বেসামাল হয়ে উঠল। প্রচণ্ড ঢোলের বাড়ির সঙ্গে এমন উন্মাদ নৃত্যে মঞ্চের চারপাশে ঘুরতে লাগল যে বিজয় কবিয়াল বারবার চেষ্টা করেও আর গান বাঁধতে পারলেন না। মুখ চুন করে বরিশালের লোকেরা বিদায় নিল।

আমার ধারণা গয়েজউদ্দীন কবিয়াল হয়েছিলেন খ্যাতির লোভে। কিন্তু যে-গান গেয়ে তিনি হাজার হাজার লোকের হৃদয় গলাতে পেরেছিলেন তা হল কীর্তন দাদার গলার স্বর ছিল খুবই মিষ্টি আর সুরেলা। কীর্তন গাইতেন তিনি জীবন উজাড় করে। গাইতে গাইতে গভীর আবেগানুভূতির ভেতর তাঁকে ভাবে পেয়ে বসত। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে তিনি মূর্ছিত হয়ে যেতেন। তাঁর কীর্তনের গভীর ভক্তিরসে মুগ্ধ হয়ে আমাদের অঞ্চলের বহু হিন্দু তাঁকে ‘বাবা হরিদাস’ বলে ডাকত। এই পিতৃসম্বোধনের সূত্রে আজও আমাদের অঞ্চলের নমশূদ্রদের মধ্যে আমাদের অনেক আত্মীয় আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের যাওয়া-আসা চলে।

২৩

গয়েজউদ্দীন দাদার খ্যাতিমান হবার কাহিনী অদ্ভুত। যে-অঞ্চলে তিনি জন্মেছিলেন সেখান থেকে শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখাও ছিল অসম্ভব। গোটা বাগেরহাট জেলাটাই তখন ছিল অশিক্ষার নির্মম অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বাগেরহাট শহরে তখনও হাইস্কুল হয়নি। কী করে পড়াশোনার সুযোগ পাবেন? কিন্তু তাঁকে ঠেকানো ছিল অসম্ভব। তাঁর বয়স যখন দশ-বারো বছর তখন হঠাৎ একদিন তিনি ভোজবাজির মতো বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। দশ-বারো বছরের মধ্যে তাঁর কোনো হদিশই কেউ করতে পারল না। বছর-বারো পরে হঠাৎ একদিন তিনি দেশে ফিরে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন এক সুদুর্লভ ও পরাক্রান্ত ডিগ্রি, নাম : এন্ট্রান্স ফেল। এতই বড় এই ডিগ্রি যে ওই এলাকার কেউ এর নাম আগে কোনোদিন শোনেনি। ফেল শব্দটার মানে জানে এমন মানুষও তখন ঐ এলাকায় কেউ ছিল না। ডিগ্রির দাপটে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। সবার কাছে তাঁর মানমর্যাদা হয়ে দাঁড়াল গগনচুম্বী।

সেই মহিমার ভিত পাকা করতে অদ্ভুত সব কাণ্ড শুরু হল তাঁর। তিনি একটা কাঠবাদাম গাছের মগডালে চেয়ার বসিয়ে সেখানেই তাঁর আস্তানা গেড়ে বসলেন। সারাদিন সেখানে বসে তিনি এক হাতে বই অন্য হাতে হুঁকা নিয়ে পড়াশোনা করতেন। সবাই স্তব্ধ বিস্ময়ে তাঁর এসব দৈবী কাণ্ডকারখানা তাকিয়ে দেখত আর নিচু স্বরে সেসব নিয়ে কথাবার্তা বলত। তিনি অনুগ্রহ করে তাঁর অগণিত ভাইপোর মধ্যে কাউকে কোনো ফরমাশ দিলে সে তা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করত। আব্বার ওপর দায়িত্ব ছিল ঘণ্টাখানেক পরপর কাঠবাদাম গাছের মগডালে উঠে তাঁর হুঁকাটা নিচে এনে তাতে নতুন তামাক ভরে আবার সেটাকে তাঁর মগডালের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। এটুকু করতে পেরেই গর্বে আব্বার মাটিতে পা পড়ত না।

গয়েজউদ্দীন দাদার মতো আব্বার মধ্যেও ছিল শিল্পের রক্ত। কিন্তু শিল্পের চেয়েও আব্বার মধ্যে বেশি ছিল পড়াশোনার আগ্রহ। কী করে গয়েজউদ্দীন দাদার একটা ঘটনা থেকে আব্বার শিক্ষিত হবার আগ্রহ প্রজ্বলিত হয় সেই গল্প বলেই দাদার প্রসঙ্গ শেষ করব।

একবার আব্বা তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হিশেবে গিয়েছিলেন পাঁচ-সাত মাইল দূরের এক গ্রামে। সে-গ্রাম আব্বাদের গ্রামের চাইতেও অজ। গয়েজউদ্দীন দাদার বয়স তখন সাতাশ-আঠাশ হলেও হাজিবাড়ির প্রতিটি বিয়েতে বংশের পতাকা হিশেবে তাঁকে তখন হাজিরা দিতে হচ্ছে। সেই বিয়েতেও তিনি বরযাত্রী হিশেবে গিয়েছিলেন। বরযাত্রীরা বিয়েবাড়িতে গিয়ে সবে সুস্থির হয়ে বসেছেন, পুলিপিঠা পরিবেশন করে খাতির শুরু হয়েছে এমন সময় এক ফাজিল বুড়া শাদা দাড়ি নাচাতে নাচাতে মজলিশে এসে হাজির। পেছনে তাঁর ছোটখাটো একটা জনতা। এসেই বিজয়ীর ভঙ্গিতে লেজের বাড়িতে আকাশ কাঁপিয়ে তুললেন তিনি : ‘কই? কেডা? কার সঙ্গে লড়তি অবে? কই সে? কোথায়?’

সেকালে আমাদের অঞ্চলের প্রায় সব বিয়েতে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘আই ডোন্ট নো’ গল্পের মাস্টারমশাইদের মতো প্রত্যেক পক্ষ থেকে একজন করে ইংরেজি-জানা লোক কবির লড়াইয়ের ধাঁচে পরস্পরের মুখোমুখি হত। তাদের মধ্যে যে-দলের লোকটি ইংরেজি-জ্ঞানে জয়ী হত সেই দলই জিতল বলে ধরে নেওয়া হত। প্রতিযোগিতার সময় প্রতিটি প্রশ্ন আর তার উত্তর নিয়ে মজলিশে টানটান উত্তেজনা দেখা দিত। যে-দলের ইংরেজিপণ্ডিত প্রতিপক্ষের মোট তিনটি শব্দের অর্থ বলতে অপারগ হতেন তিনি হেরে গেলেন বলে ধরে নেওয়া হত। তখন পরাজিত দলের বিমর্ষ মুখের ওপর দিয়ে জয়ীদলের নারকীয় উল্লাস আস্ফালনে বিয়েবাড়ি উত্তপ্ত হয়ে উঠত।

সেই দাড়ি নাচানো বুড়োটি কনেপক্ষের ইংরেজিপণ্ডিত। তিনিই ঐপক্ষের হয়ে লড়বেন। তিনি জানতে চান বরপক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে লড়াই করার সাহস কার। বরপক্ষের লোকেরা সশ্রদ্ধভাবে আঙুল দিয়ে চৌকির ওপর বিনীতভাবে বসে থাকা ‘এন্ট্রান্স ফেল’কে দেখিয়ে দিল।

তাঁর জড়োসড়ো ভাব আর বয়স দেখে দাড়ি নাচানো বুড়োর উল্লাস বেড়ে গেল : ‘আরে এ দেখি সেদিনের ছেইলে। নাক টিপলি দুধ বেরয়। এর সঙ্গে লড়বো কী! যা হোক এইসেই যখন পড়িছে তখন জিজ্ঞাসাই করি, বলেন দেখি ‘আই গো হোম’ মানে কী?’

এমন একজন দুর্ধর্ষ এন্ট্রান্স ফেলের কাছে এই তুচ্ছ প্রশ্ন যে কতটা হাস্যকর তা সহজেই বোধগম্য। নিজের মর্যাদার খাতিরেই তিনি মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।

তাঁর নীরবতাকে পরাজয় ধরে নিয়ে ফাজিল বুড়ো উল্লাসে পিশাচের মতো নাচতে শুরু করে দিলেন। দলের অন্যদের চিৎকার আর হর্ষধ্বনিতে তাঁর সে বিজয় আরও মজবুত হল। আনন্দধ্বনি শেষ হলে বুড়ো বললেন, ‘পাল্লেন না তো। ঠিক আছে, এবার আরও সোজা দেইখে প্রশ্ন করি। দেখি পারেন কি না? কন দেখি, ‘কাম’ মানে কী?’

আগের প্রশ্নটার উত্তর দিতেই যার মর্যাদায় লেগেছে এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার পক্ষে কী করে সম্ভব? তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে আরও নীরব হয়ে গেলেন। প্রতিপক্ষের সম্মিলিত বিজয়-নিনাদে সারা তল্লাট কেঁপে উঠল I

এরপর সেই ফাজিল বুড়ো শেষবারের মতো হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘কিছুই তো পাত্তিছেন না। পারবেন বইলেও আর মনে হয় না। যা হোক, ফাজিল বুড়ো দাড়ি নাচাতে নাচাতে খেঁকিয়ে উঠলেন : কেডা? কেডা? শেষবারের মতো একটা খুব সোজা প্রশ্ন করি। এ না পাল্লি বোজবো আপনি কিছুই জানেন না। বলেন দেখি, ‘আই’ মানে কী।’

আমাদের এন্ট্রান্স ফেল এর আর কী জবাব দেবেন? তিনি আগের মতোই চুপ করে বসে রইলেন।

তাঁর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেল। প্রতিপক্ষের বিজয়-উল্লাসে সারা মজলিশ গর্জে উঠল।

প্রতিপক্ষের বিজয় যখন সুসম্পূর্ণ তখন বরপক্ষ থেকে এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ

উঠে দাঁড়ালেন। বরপক্ষের বুঝতে বাকি ছিল না কেন তাঁদের এই গর্বিত পতাকা, যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারেন, এসব তুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। তারা ঘাপটি মেরে মজা দেখছিল। প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে সেই বৃদ্ধ ক্ষুব্ধ ধমকে গর্জে উঠলেন : এই যে মেয়ারা! খুব তো নাচানাচি অত্তিছ। জান ইডি (গয়েজউদ্দীন দাদাকে দেখিয়ে) কে?

ফাজিল বুড়ো দাড়ি নাচাতে নাচাতে খেঁকিয়ে উঠলেন : কেডা? কেডা?

উনি গর্জন করে উঠলেন, ইনি একজন ‘এন্ট্রান্স ফেল’! ‘ফেল’ কথাটা উচ্চারণের সময় তিনি এমন বজ্রপাতের মতো শব্দ করে উঠলেন যেন ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ডিগ্রি।

ভয়ংকর তথ্যটায় শত্রুপক্ষ একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ল। মনে হল যেন অ্যাটম বোম পড়েছে। এমন দুর্ধর্ষ একজন ডিগ্রিধারীর সামনে তারা এতক্ষণ যে মূর্খের মতো এভাবে অসভ্যতা করে চলেছে তা ভেবে একেবারে চুপসে গেল। সেকালে ঐ এলাকায় এন্ট্রাস ফেল তো দূরের কথা, টু-থ্রি পড়া লোকও ছিল না। মুহূর্তে তাদের মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সেই দাড়ি-নাচানো বুড়ো সবার পেছন দিয়ে চোরের মতো কোথায় যে পালিয়ে গেলেন তাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না।

গল্পটা শুনেছিলাম আব্বার কাছ থেকে। গল্প শেষ করে আব্বা বলেছিলেন, বজ্রনির্ঘোষিত ‘এন্ট্রান্স ফেল’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ও-পক্ষের লোকগুলোর মুখের জ্যোতি করুণভাবে নিভে যেতে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল : আহা, কোনোদিন যদি এরকম একজন ‘এন্ট্রান্স ফেল’ অন্তত হতে পারতাম!

২৪

সেই অজ পাড়াগাঁ থেকে পড়াশোনা করে উঠে আসতে আব্বাকেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন ঐ গোটা এলাকার প্রথম এম.এ.। আব্বাদের গ্রামের সাত মাইলের মধ্যে কোনো প্রাইমারি স্কুল ছিল না। গ্রামের একজন স্বল্পশিক্ষিত পণ্ডিত মশাইকে প্রতিদিন বেতন হিশেবে এক ছিলিম তামাক দিয়ে আব্বা তাঁর কাছ থেকে সামান্য কিছু বাংলা শিখে অল্পবয়সেই বাগেরহাটে পাড়ি জমান। সেখানে অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে সে বাড়ির চারজন ছাত্রকে নিয়মিত পড়িয়ে অমানুষিক কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে যান। যাদের তিনি পড়াতেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিল তাঁরই ক্লাসের ছাত্র।

আব্বা প্রতি ক্লাসে নিয়মিতভাবে প্রথম হতেন। এন্ট্রান্স এবং এফ.এ.-তে তাঁর ফল হয় অসাধারণ। আব্বা দর্শন, ইংরেজি, গণিত আর বাংলায় ছিলেন খুবই ভালো। ১৯৫৫-৫৭ সালে আব্বা যখন বাগেরহাট কলেজের অধ্যক্ষ, আমরা ছাত্র, তখন ওই বিষয়গুলোর কোনো ক্লাসে কোনো শিক্ষক না এলে আব্বা নিজেই সেই ক্লাসগুলো নিয়ে নিতেন।

আব্বার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক। রাতের পর রাত তিনি মত্ত অবস্থায় অঙ্ক করে কাটাতেন। কখন যে রাতগুলো কেটে যেত তিনি টের পেতেন না।

সব পরীক্ষাতেই অঙ্কে একশ’র মধ্যে একশ’ পেলেও আব্বা এম.এ. করেছিলেন ইংরেজিতে। আব্বার স্বপ্ন ছিল অধ্যাপক হবেন। সেরা অধ্যাপক। কেবল সেরা অধ্যাপক নন, যে-কলেজে তিনি পড়াবেন সে-কলেজের সব ক্লাসের সব ছাত্রের অধ্যাপক। অঙ্কের অধ্যাপক হলে তাঁর সে-স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল না। অঙ্ক সব ক্লাসে পাঠ্য নয়। কিন্তু কলেজের সব ক্লাসের সব ছাত্রকে ইংরেজি পড়তে হয়। তাই তিনি ইংরেজিতে এম.এ. করেন। পরে অবশ্য বাংলাতেও এম. এ. করেছিলেন।

আব্বার মনে সেরা অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। আব্বা যেবার কলেজে ওঠেন সেবারই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাগেরহাট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজেই তিনি ছাত্রদের পড়াতেন, সবসময় তাঁদের নিজের সঙ্গে রাখতেন। তাঁর প্রেরণাতেই আব্বা সিভিল সার্ভিসে যাবার বদলে শিক্ষক হবার সিদ্ধান্ত নেন। সেরা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন আব্বার ব্যর্থ হয়নি।

২৫

ছেলেবেলায় আমি কেমন ছিলাম তা বোঝাতে ছেলেবেলার একটা কবিতা থেকে দুটো লাইন তুলে ধরছি :

ঘোষেদের রবি
সে বড় লোভী।

ছেলেবেলায় আমি ছিলাম এই রবির মতো। কেবল ছেলেবেলায় নয়, বড় হওয়ার পরেও। এই সেদিন পর্যন্তও খাওয়ার সময় লোভের ঘোরে চারপাশের মানুষদের চিনতে পারতাম না। আমার এক বয়সী বন্ধু প্রায়ই বলেন : ‘তুমি খাও লোভী বালকদের মতো।’ কথাটা ভুল নয়। আজ এই বয়সেও সামান্য ‘ভাত’ শব্দটা জিভে পানি ছাড়া আমি উচ্চারণ করতে পারি না।

করটিয়ায় থাকতে একবার সেখানকার ডাক্তার মণিবাবুর বাসায় গিয়েছিলাম এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। তিন-দফায় সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। আমি বসেছিলাম প্রথম দলের সঙ্গে, কিন্তু তৃতীয় দফার লোকেরা উঠে যাবার পরেও আমার খাওয়া চলছে। এর মধ্যে মা বারকয়েক এসে তাগাদা দিয়ে গেছেন ওঠার জন্যে, কিন্তু আমার ভাবান্তর নেই। একসময় পিঠের ওপর মার হাতের ভারী কিলগুলো তালের মতো পড়তে শুরু করল। কিন্তু আমি নির্বিকার। এমন সুস্বাদু খাবার যদি খাওয়াই যায় তো এসব এক-আধটু কিল খেতে অসুবিধা কোথায়! আমার পুরো মনোযোগ তখন খাওয়ার দিকে। পিঠের ওপর মার কিল ধুপধাপ পড়ছে, আর তা খেতে-খেতেই আমি ক্ষুব্ধস্বরে বলে চলেছি : ‘আহ, খাইয়া লই।’

আমি-যে কতখানি লোভী ছিলাম, ছাত্রবয়সের একটা গল্প বলে তা বোঝাই। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। মুন্সিগঞ্জে বেড়াতে যাচ্ছি আমাদের বাসায়। যাবার পথে পকেটের সাকুল্য সঞ্চয় দিয়ে মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে গোটা-পঞ্চাশেক লিচু কিনে নিয়েছি ছোট ভাইবোনদের জন্যে। কিন্তু কিছুটা হাঁটার পরই হঠাৎ টের পেলাম হাঁটা শুরু করার পর থেকেই আমি লিচুগুলো নিঃশব্দে খেয়ে চলেছি। কিছুদূর গিয়ে টের পেলাম যে-হারে আমি খাচ্ছি তাতে বাসা পর্যন্ত পৌঁছানোর পর কোনো লিচুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু খাওয়াও তো বন্ধ করা সম্ভব নয়। তা হলে কী করে অন্তত অল্পকিছু লিচু বাসা পর্যন্ত নিই। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। অনেক ভেবে দেখলাম লিচু বাঁচানোর উপায় একটাই : দৌড় দেওয়া। প্রাণপণে দৌড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে পারলে, খাওয়ার সময় না পাওয়ায়, গোটাকয় লিচু বাঁচতে পারে। দিলাম দৌড়। কিছু লিচু শেষপর্যন্ত বাসায় পৌঁছাল।

একদিনের একটা ঘটনা মনে পড়লে আজও খারাপ লাগে। ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপিকা শায়েস্তা আপা প্যারিস থেকে অলৌকিক স্বাদের কিছু টফি এনেছেন। তাঁর বাসার লোকজনই এর মধ্যে টফির বাক্স প্রায় সাফ করে দিয়েছে; গোটা-দশেক কোনোমতে আনতে পেরেছেন আমাদের জন্যে। তিনি আমাকে তা থেকে গুনে গুনে চারটা টফি দিয়ে বললেন : ‘এর একটা আপনার, একটা গিন্নির, আর দুটো দুই মেয়ের।’ আমি তাঁর কথা সজ্ঞানে ও সুস্থমস্তিষ্কে বুঝে সেগুলো গ্রহণ করলাম। টফিগুলো হাতে নিয়ে প্রথমেই নিজেরটা মুখে ছুড়ে দিলাম। অপার্থিব স্বাদ। মুখের ভেতরটা মাধুর্যে যেন ভরে উঠল। তাড়াতাড়ি রওনা হলাম বাসার দিকে; যত তাড়াতাড়ি পারা যায় যার যা হক তা তার হাতে বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম কলেজের গেট পর্যন্ত যেতে না যেতেই কখন যেন নিজের অজান্তে আর একটা মুখে দিয়ে ফেলেছি। কখন যে দিলাম আমি নিজেও জানি না। মনে হল আমার নিয়তি যেন অলক্ষ্যে টফিটা আমার মুখে তুলে দিয়ে চলে গেছে। ধরে নিলাম গিন্নির অংশটা লোপাট হল। খারাপ লাগল, কিন্তু স্ত্রীদের ওপর স্বামীদের একটা বৈধ দাবি আছে মনে করে সহ্য করলাম। কিন্তু মেয়েদের বেলায় তো এসব ফিকির খাটবে না। তাড়াতাড়ি রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। যে করেই হোক তাড়াতাড়ি ওদেরগুলো পৌঁছাতে হবে। রিকশায় চলতে চলতে হঠাৎ টের পেলাম আমার ডান হাতটা নিঃশব্দে আমার ডান পকেটের দিকে যেন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম। কিন্তু অসহায়ের মতো টের পেলাম আমার সম্মোহিত হাতটা নিজের অজান্তে পকেট থেকে একটা টফি খুবই আলগোছে বের করে নিল। একসময় আরও বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম আমার বাঁ হাতটা ডান হাতের দিকে এগিয়ে এসে দুজনে মিলে ওর মোড়কটা খোলার চেষ্টা করছে। আমার চোখের সামনে একবার বড়মেয়েটার করুণ মুখ ভেসে উঠল। আমার হাতদুটোও সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে থেমে গেল। কিন্তু তারপরে ভালো করে তাকাতেই দেখি আমার হাতদুটো কী করে যেন টফির মোড়কটাকে এরই মধ্যে খুলে ফেলেছে। আমার সামনে মেয়েটার বিমর্ষ মুখ আবার ভেসে উঠল। আমার হাতদুটো আবার কিছুক্ষণের জন্যে থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি গোটা টফিটা আমার মুখের ভেতরে। আত্মধিক্কারে মনটা ভরে গেল। বাবা হয়ে এ কী করলাম আমি! কোনো বাবা কি এমন স্বার্থপর হতে পারে? কিন্তু এখনও আর একটা টফি বাকি। যেমন করেই হোক ওটাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু ওটা আর কার জন্যে নেব? নেওয়া মানেই তো কাড়াকাড়ি, অশান্তি। শুধু একজনের জন্যে কী করে নেওয়া যায়? বাকিদের কী বলব? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দেখি বাকিটাও আমার মুখের ভেতর।

২৬

করটিয়ার আর-একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা এখনও ভুলতে পারিনি। খুব সম্ভব মায়ের আরোগ্যের জন্যে মানত করতে আমরা বাসার সবাই আব্বা ও মার সঙ্গে নৌকায় করে কোনো-এক পীরের দরগায় যাচ্ছিলাম। তখন ভাদ্র মাস। প্রবল বন্যা সেবার। বন্যার পানি নদীর পাড়ের মাঠ ডুবিয়ে আমাদের বাসার গেট পর্যন্ত এসে গেছে। বাসার গেট থেকেই নৌকায় উঠলাম। আমাদের একটা প্রিয় কুকুর ছিল, নাম ভোলা। সারারাত জেগে জেগে বাসা পাহারা দিত। সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকত। আমরা বাসার সবাই কুকুরটাকে খুবই ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করে এত ছোট্ট একটা নৌকায় এত মানুষের সঙ্গে ওকে নেওয়া যায়? অনেক ভাবনাচিন্তার পর ঠিক হল কুকুরটাকে বাসাতেই রেখে যাওয়া হবে। কিন্তু আমাদের নৌকায় ওঠার প্রস্তুতি দেখেই কুকুরটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ওকে অস্থির দেখাতে লাগল। ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে ওর যেন মনে হয়েছে আমরা ওকে ফেলে চিরতরে চলে যাচ্ছি। নৌকায় মালপত্র ওঠানোর সারাটা সময় ও নৌকার পাশে ঘোরাঘুরি করে করুণ চোখে আমাদের দেখতে লাগল। ওর চোখে কাতর প্রার্থনার দৃষ্টি। আমার কেন যেন মনে হতে লাগল কুকুরটা কাঁদছে। ওর চোখদুটো যেন সত্যি সত্যি পানিতে ভেজা। কুকুরটাকে সঙ্গে নেবার জন্যে আমি কেঁদে কেঁদে সবাইকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু কেউ তাতে কান দিল না। নৌকা যখন ছাড়ল একটা অদ্ভুত ব্যাপার করল ও তখন। সোজা পানিতে নেমে পাগলের মতো সাঁতার কেটে নৌকার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসতে লাগল। ওর চোখেমুখে একটা করুণ অসহায় আর অমানুষিক আকুতি দেখতে পেলাম আমি। ওর গলার ভেতর থেকে অস্বাভাবিক মিহি আর বিষণ্ণ একটা কান্নার শব্দ বেরোতে লাগল। আমরা সবাই বলতে লাগলাম : ‘ফিরে যা ভোলা, ফিরে যা।’ আমাদের ভাষা দিয়ে বোঝাতে লাগলাম, তোর কোনো ভয় নেই, আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসছি। কিন্তু ওকে ফেরানো গেল না। অনেক দূর যাবার পর নৌকাটা মাঠের এলাকা পেরিয়ে নদীতে এসে পড়ল। নদীতে পড়েই পাল তুলে দিল। নদীতে তখন তীব্র স্রোত। পানিতে ডোবা মাঠের ওপর দিয়ে আসার সময় কুকুরটা ভাবতে পারেনি যে আর কিছুটা এগোলেই ও আচমকা নদীর মধ্যে পড়ে যাবে। হঠাৎ দেখলাম কুকুরটা নদীতে পড়েই খরস্রোতে পেছনদিকে সরে যাচ্ছে। একবার ডুবছে একবার ভাসছে। প্রচণ্ড স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে কুকুরটা যে কোথায় হারিয়ে গেল, কিছুই বোঝা গেল না।

দরগাহ থেকে ফিরে এসে কুকুরটাকে আমরা অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু কোথাও পাইনি। কুকুরটা কি সেই তীব্র স্রোতের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল? যে অবোধ প্রাণীটা আমাদের এভাবে এতখানি ভালোবেসেছিল, আমাদের উপেক্ষা আর অনাদরে তার এমন করুণ মৃত্যুতে আমি অসম্ভব অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। কুকুরটার কথা মনে হলেই আমার চোখে পানি এসে যেত। করটিয়ার অনেক বড় বড় ঘটনার কথা আমি ভুলে গেছি, জীবনের অনেক বড় মানুষের কথাও। কিন্তু কুকুরটার সেই বিষণ্ণ অশ্রুসিক্ত চোখ, চাপা কান্না, নৌকার নিষ্ঠুর মানুষগুলোর সঙ্গী হবার জন্যে অসহায়ের মতো জীবনপণ করে পানির ভেতর দিয়ে সাঁতরে এগিয়ে আসা আর স্রোতের মধ্যে তার হারিয়ে যাওয়ার অসহ্য দৃশ্যটা আজও আমি ভুলতে পারিনি। করটিয়ার কথা মনে হলে আজও সেই অসহায় কুকুরটার বিষণ্ণ ভেজা চোখদুটোকে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *