স্বপ্নলোকের চাবি
সীতা
সে অনেকদিন আগেকার কথা। শম্পা নদীর ধারে আনন্দনগর বলে একটা রাজ্য ছিল। সে একটা ভারি সুন্দর দেশ। আনন্দনগরের দক্ষিণে দিগন্তবিস্তৃত ধান খেত, পশ্চিমে শম্পা নদী আর উত্তর ও পূর্বদিক ঘিরে ঘন জঙ্গলে ঢাকা শ্রাবণী পর্বতমালা। সেখানে তখন প্রতাপ সিংহ রাজত্ব করতেন। তিনি খুব ভালো রাজা ছিলেন, তাঁকে সবাই ভক্তি করত, ভালোবাসত।
সেই রাজ্যে সীতা বলে একটি মেয়ে থাকত। তার বাবা-মা দিনমজুর, তাঁরা শহরে কাজ করতেন আর ছুটি পেলে বাড়িতে আসতেন। সীতা থাকত তার বুড়ি পিসিমার সঙ্গে জঙ্গলের ভেতরে শম্পার ধারে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে। সকাল বেলা সে তার পিসির কাছে পড়াশুনো করত, আর বাকি দিনটা পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। সেখানকার যত পশুপাখি তার বন্ধু ছিল। সে নির্ভয়ে তাদের সঙ্গে খেলে বেড়াত।
সেদিন বিকেল বেলা দিনের পড়ন্ত আলোয় সীতা নদীর ধারে একটা পাথরের ওপরে বসে মালা গাঁথছিল আর গোটা ছয়েক টুনটুনি পাখি এধার-ওধার থেকে ফুল তুলে এনে ওর কোলের ওপর ফেলছিল। হঠাৎ ঝোপঝাড় ভেঙে একটা বাঘ হুড়মুড় করে দৌড়ে এসে ওর পায়ের কাছে বসে পড়ল। তারপর, হাঁপাতে হাঁপাতে হাউমাউ করে করুণভাবে কী যেন বলল ওকে।
সীতা নীচু হয়ে বাঘের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, কোনো ভয় নেই তোমার, আমি থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। তুমি এখানে চুপ করে বসে থাকো তো। বলে মুখ তুলে দেখল একটা গাছের নীচে তির-ধনুক হাতে একজন সদ্য গোঁফ গজানো ভারি সুদর্শন ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্বাক বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
সীতার চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটি বলল— করছ কী তুমি? ওটা একটা বাঘ!
সীতা বলল— আমি জানি এটা একটা বাঘ। তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ?
ছেলেটি কিছু বলবার আগেই বাঘটা গুরগুর করে কী যেন বলল। শুনে সীতা চোখ পাকিয়ে বলল— তুমি একে মারতে যাচ্ছিলে, না? কেন?
ছেলেটি আরও আশ্চর্য হয়ে বলল— কেন আবার কী? বাঘ মারব না?
—কেন মারবে? আমি তো সে কথাই জানতে চাইছি। ও তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি।
—না, তা করেনি। তবে, করতে তো পারে। সেইজন্যে বাঘ মারতে হয়, বুঝলে? তা ছাড়া, বাঘ মারতে না পারলে মৃগয়ায় খ্যাতি হবে কী করে?
—সে তো অনেক মানুষও তোমার ক্ষতি করতে পারে। যাও-না, তাদের মারো-না গিয়ে। স্রেফ নাম করার জন্য একটা জীবন্ত প্রাণীকে মেরে ফেলতে হবে? তার কথা, তার বাবা-মার কথা একবারও ভাববার দরকার নেই?
মাথা চুলকে ছেলেটি বলল— তা তো জানি না। তবে এমনই তো হয়।
—এ কখনো হতে পারে না। তুমি যাও-তো, বাড়ি যাও। এখানে এরকম খুনোখুনি করলে আমি কিন্তু মহারাজা প্রতাপ সিংহকে বলে দেব।
ছেলেটি যেন খুব ভয় পেয়েছে এমনিভাবে বলল— সর্বনাশ! তুমি মহারাজা প্রতাপ সিংহকে চেন না কি?
—না, চিনি না। তবে শুনেছি তিনি খুব ভালো লোক আর অন্যায়-অবিচারকে কক্ষনো প্রশ্রয় দেন না। কাজেই ভালো চাও তো এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরে যাও।
ছেলেটি করুণ মুখে বলল— যাব-তো, কিন্তু আমি যে বাঘটাকে তাড়া করতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। তুমি আমাকে এই জঙ্গল থেকে বেরুবার রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে?
মাথা নেড়ে সীতা বলল— আমি এখন যেতে পারব না। এই লবাই তোমাকে নিয়ে যাবে। বলে বাঘটাকে দেখিয়ে দিল।
—এর নাম লবাই? তোমার পোষা বুঝি?
—পোষা আবার কী? ও আমার বন্ধু।
—পোষা নয়, সর্বনাশ! বুনো বাঘ, মাঝপথে ও যদি আমাকে খেয়ে ফেলে?
—খামোখা ও তোমাকে খেতে যাবে কেন? ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো যাও, কিচ্ছু হবে না। যদি ওর কোনোরকম ক্ষতি করতে চেষ্টা করো, তাহলে কিন্তু কী হবে তা আমি জানি না।
—ওরে বাবা! আর কি কেউ নেই যে আমাকে রাস্তা দেখাতে পারে?
বাঘটা গরগর করে শব্দ করল। সীতা বলল— ঠিক আছে। তুমি যাও, ডেকে নিয়ে এস। বলামাত্র বাঘটা উঠে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল।
ছেলেটি কপালের ঘাম মুছে ধপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল। বলল— তোমার বন্ধু কাকে ডাকতে গেল?
সীতা মালা গাঁথতে গাঁথতে হাসতে হাসতে বলল— তোমাকে যে পথ দেখাবে অথচ খেয়ে ফেলবে না, তাকে। লবাই বুঝতে পেরেছে যে তুমি ওকে ভয় পাচ্ছ।
—বলো কী? তুমি বাঘের ভাষা বুঝতে পারো? কী করে?
—বাঃ, জন্ম থেকে এদের মধ্যে আছি আর এদের কথা বুঝতে পারব না? শুধু বাঘ কেন, আমি সব পশুপাখিরই ভাষা বুঝতে পারি। যদি না বুঝতুম তাহলে এরা কী আর আমার সঙ্গে খেলতে বা সুখ-দুঃখের ভাগ নিতে রাজি হত?
বলতে না-বলতেই ধুপধাপ করতে করতে গাছের ডালাপালা সরিয়ে একটা বিশাল দাঁতাল হাতি এসে সীতার পাশে দাঁড়াল। সীতা বলল— দমদম, এ পথ হারিয়ে ফেলেছে। যাও তো, ওকে বনের বাইরে রেখে এস।
দমদম চোখের নিমেষে বিস্ময়বিমূঢ় ছেলেটিকে শুঁড়ে জড়িয়ে তুলে নিল পিঠের ওপরে, তার তির-ধনুক পড়ে রইল মাটিতে। তারপর শম্পার ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ছেলেটির সন্ত্রস্ত হতচকিত মুখভঙ্গি দেখে সীতা হাসতে হাসতে পড়েই যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল— আমার নাম সীতা। তোমার নাম কী?
করুণ কণ্ঠে উত্তর এল, আমার নাম বিক্রম। তারপরেই দমদম গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল।
একটা দাঁড়কাক গাছের ডালে বসে ব্যাপারটা দেখছিল। সে এবার ঝুপ করে নেমে এসে সীতার সামনে ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সীতা তাকে কিছুক্ষণ লক্ষ করে বলল— কী রে মসুরি, কিছু বলবি?
মসুরি খানিক ইতস্তত করে বলল— হ্যাঁ, বলার তো ছিল। কিন্তু সেটা উচিত হবে কি না ভাবছি।
—বেশ। ভাবা শেষ হলে তখন বলিস।
—মানে, কী জানিস? মানুষদের ব্যাপারে আমরা তো কখনো নাক গলাই না, সেটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। তাই ভাবছিলুম কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে কি না। আচ্ছা, এই যে ছেলেটি এখানে এসেছিল তাকে তুই চিনিস?
—না তো। কী করে চিনব? নাম তো বলে গেল বিক্রম।
—হ্যাঁ, মহারাজা প্রতাপ সিংহের ছেলে, আনন্দনগরের যুবরাজ।
—তা হতে পারে। একদম ক্যাবলা।
মোটেই না। দেখতে ছেলেমানুষ হলে কী হবে, ভীষণ বীর। ওর বীরত্বের কথা সবার মুখে মুখে ফেরে। ভয়ডর নেই। ইচ্ছে করে তোর সামনে ক্যাবলামি করছিল। বুঝিস না, প্রচণ্ড দুঃসাহসী না-হলে কেউ পায়ে হেঁটে বাঘের পেছনে তাড়া করে? ওর তোকে খুব ভালো লেগেছে। ওর কিন্তু ভীষণ বিপদ।
—বিপদ? কীসের বিপদ?
—আমরা শহরের কাকেদের কাছে খবর পেয়েছি যে ওর মামা, যাকে প্রতাপ সিংহ আশ্রয় দিয়েছিলেন, মহারাজাকে মেরে আর বিক্রম সিংহকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজে রাজা হয়ে বসবার ষড়যন্ত্র করছে। এর জন্যে সে গুপ্তঘাতক নিয়োগ করবারও ব্যবস্থা প্রায় ঠিক করে ফেলেছে। এরকম নীচতা আর অন্নদাতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কেবল মানুষের মধ্যেই দেখা যায় রে, আর কোথাও নয়।
সীতা চোখ পাকিয়ে বলল— চুপ কর। সব মানুষই এরকম নয়, বুঝলি? কিন্তু, এ তো ভালো কথা নয়। এসব তো বন্ধ করা দরকার। তবে, এত দূর থেকে আমরা করবই-বা কী? এবার বোধ হয় আমার ভাবার পালা। কিংবা আমাদের দু-জনের।
—আমি অত ভাবতে-টাবতে পারিনে। এক কাজ করি। সড়সড়িকে ডেকে আনি? সে-ই এই সমস্ত বনের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান।
সীতা বলল— হ্যাঁ, সেই ভালো। যা, ডেকে আন। কাছেই কোথাও আছে। তাড়াতাড়ি যাবি। সন্ধে হয়ে আসছে, মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে বলে মসুরি ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। ফিরে এল একটু বাদেই। তার পেছনে পেছনে এল একটা বুড়ো শকুন। বিরাট ডানা গুটিয়ে সে যখন আকাশ থেকে নেমে সীতার পাশে বসল, তাকে দেখাল ঠিক একটা টাকমাথা কালো চাদরমুড়ি দেওয়া বৃদ্ধের মতো।
সড়সড়ি থেমে থেমে বলল— মসুরি আমাকে সবকথা বলেছে। প্রতাপ সিংহকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে তোমাকে এই ষড়যন্ত্রের কথা তাঁকে জানাতে হবে। কিন্তু ষড়যন্ত্র হচ্ছে, শুধু এইটুকু জানালেই তো চলবে না। রাজা তাঁর শালাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, বিশ্বাস করেন। তাঁকে অকাট্য প্রমাণ দিতে হবে। নইলে তিনি তোমার কথায় কিছুমাত্র বিচলিত হবেন না।
মসুরি বলল— অকাট্য প্রমাণ পাব কী করে?
—শহরের সব কাক আর প্যাঁচাদের বলে দে, যেন তারা রাজশ্যালক বিরুপাক্ষের ওপর দিনরাত নজর রাখে। সে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, কী কথা বলছে, সব খবর আমার চাই। রোজকার রোজ খবর আনবি। তারপরে কী করতে হবে, আমি বলে দেব।
.
কিছুদিন পরেকার কথা। সকাল বেলা মহারাজা প্রতাপ সিংহ বসেছেন রাজসভায়। পাশে যুবরাজ বিক্রম। চারদিকে পাত্র-মিত্র, সেপাই-সান্ত্রী আর প্রজাদের ভিড়। রাজকার্য চলছে। মহামন্ত্রী কী যেন বলছিলেন, হঠাৎ একটা পায়রা সভাঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে ফটফট করে উড়ে এসে রাজার সিংহাসনের হাতলের ওপর বসল। তার মুখে একটা তালপাতা। সেটা রাজার কোলের ওপর ফেলে দিয়েই সে উড়ে গিয়ে ঘুলঘুলির ওপরে বসল, কিন্তু বেরিয়ে গেল না।
রাজামশাই বিরক্ত হয়ে পাতাটা ফেলে দিতে গিয়ে দেখেন তার ওপরে ভুসোকালি দিয়ে কী যেন লেখা রয়েছে। সেটা পড়তে পড়তে তাঁর মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তিনি পাতাটা বিক্রমের হাতে দিয়ে বললেন— পড়ে দ্যাখো। পরে এ নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
বলে মুখ তুলে পায়রাটার দিকে তাকাতেই সে ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে উড়ে চলে গেল, যেন পাতাটা রাজা পড়লেন কিনা সেটুকু দেখবার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
মহামন্ত্রী ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। বললেন— কী ওটা?
প্রতাপ সিংহ বললেন— ও কিছু নয়। কোত্থেকে কী তুলে এনেছে পায়রাটা। আপনি যা বলছিলেন, বলুন।
.
সেদিন রাজসভা শেষ হলে প্রতাপ সিংহ ছেলেকে নিয়ে মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকলেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া সেখানে আর কারুর ঢোকবার অধিকার নেই। বললেন— চিঠিটা পড়লে? আগামীকাল আমাকে প্রাতর্ভ্রমণ করতে বারণ করা হয়েছে কারণ উদ্যানে নাকি চারজন গুপ্তঘাতক থাকবে আমাকে হত্যা করবার জন্য। তারা আবার নাকি বিরুপাক্ষের দলে। এ কখনো সম্ভব? সে আমার সবচেয়ে অনুগত বিশ্বাসভাজন লোক। আমি একসময় তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলুম। সে কখনো আমার পেছনে গুপ্তঘাতক লাগাতে পারে?
বিক্রম বলল— পারে। গুরুগৃহে থাকার সময় শুক্রনীতিসার আর অর্থশাস্ত্রে যেটুকু রাষ্ট্রনীতি পড়েছি তাতে তো মনে হয় সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকের পক্ষেই বিশ্বাসঘাতকতা করা কেবল সম্ভব নয়, স্বাভাবিক।
—শাস্ত্রে যাই লেখা থাক না কেন, মানুষের সততায় বিশ্বাস হারানো কোনো কাজের কথা নয়। আসলে, আমার মনে হয় কোনো শত্রু রাজ্য আমাদের পরিবারের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছে। হাতের লেখাটা অপরিণত। বোধ হয় কোনো বাচ্চাকে দিয়ে চিঠিটা লেখানো হয়েছে। লক্ষ করে দেখো, বিরূপাক্ষ যখন তীর্থযাত্রায় গেছেন, ঠিক তখনই এই চিঠি এসে উপস্থিত। যাহোক, আমি কাল রোজকার মতো প্রাতর্ভ্রমণে যাব। চারজন গুপ্তঘাতক যদি থাকেও, তাদের ব্যবস্থা আমি করতে পারব।
—তা যান, তবে সশস্ত্র হয়ে যাবেন।
—কক্ষনো না। এরকম একটা উড়ো চিঠির অবাস্তব বক্তব্য পড়ে আমি ভয়ের চোটে তলোয়ার বগলে প্রাতর্ভ্রমণে যাব, এ তো হতে পারে না।
.
পরের দিন রাজসভায় হুলুস্থুল। সবাই প্রতাপ সিংহের কুশল জিজ্ঞাসা করার জন্য ব্যস্ত। রাজা বললেন— আপনারা চিন্তা করবেন না। আজ খুব ভোরে যখন আমি বাগানে হাঁটতে গিয়েছিলুম তখন জনাচারেক উন্মাদ ব্যক্তি আমাকে আক্রমণ করেছিল। সৌভাগ্যবশত, যুবরাজ হঠাৎ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর সামনে তারা দাঁড়াতে পারেনি, আহত অবস্থায় অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। কোটাল তাদের খুঁজতে গেছেন। তারা মুখ ঢেকে রেখেছিল তাই তাদের চেনা যায়নি। তবে অবিলম্বে ধরা পড়বে বলে মনে করি। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমরা দু-জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।
সেদিনের মতো রাজকার্য চুলোয় গেল। মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শুধু এই আলোচনাই চলল। বিকেল বেলা বিক্রম আবার একটা তালপাতায় লেখা চিঠি এনে রাজাকে দিল। বলল— পড়ে দেখুন।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন— কোথায় পেলে?
—আমার শোবার ঘরে, বিছানার ওপর। মনে হচ্ছে আবার কোনো পায়রাই এনে ফেলেছে।
রাজা বিরক্তভাবে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন। যখন শেষ করলেন তখন তাঁর মুখে স্তম্ভিত বিস্ময়। বললেন— একী আশ্চর্য ব্যাপার! শ্রাবণী পাহাড়ের জঙ্গলে নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দিরের ভগ্নাবশেষের কাছে গেলে ওই চারজন গুপ্তঘাতকের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। এর মানে কী? এখুনি কোটালকে সংবাদ দাও। সে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ওখানে যাক আর তাদের ধরে নিয়ে আসুক। অবশ্য যদি তারা সত্যি-সত্যিই ওখানে থাকে। আমি তো এর মধ্যে কেমন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছি।
—মহারাজ, ষড়যন্ত্র আছে তো বটেই। তবে, আমার কেমন একটা অন্যরকম সন্দেহ হচ্ছে। কোটালকে পাঠাবেন না, তিনি কস্মিনকালেও শ্রাবণী পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে মহাদেব মন্দিরের ভগ্নাবশেষ খুঁজে পাবেন না। তবে, আমি জানি সেটা কোথায়।
—আমিও মোটামুটি জানি ওই জায়গাটা কোথায়। ছেলেবেলায় শিকারে বেরিয়ে একবার ওখানে গিয়ে পড়েছিলুম। আজ অবশ্য খুঁজে পাব কি না সন্দেহ আছে।
—তবে চলুন, আমরা দু-জনে যাই। কাল সক্কালবেলা অশ্বারোহণে বেরোলে, দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাব। মহামন্ত্রীমশাই না-হয় একদিন রাজসভার কাজ একাই সামলাবেন।
—সে ঠিক আছে। কিন্তু ওখানে আমাদের শত্রুরা অপেক্ষায় থাকতে পারে।
—তা পারে। তবে আমার সন্দেহ যদি ঠিক হয়, সেরকম কিছু হবে না। তবুও, আপনার যখন অন্যরকম মনে হচ্ছে তখন আমরা কোটাল আর তার সান্ত্রীদের নিয়ে যাব। তারা জঙ্গলের বাইরে অপেক্ষা করবে। আমরা দু-জন গভীর বনে ঢুকব। শম্পার ধারে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে চুপিসাড়ে মন্দিরের কাছে যাব। শত্রুরা যদি থাকে, আমাদের আচমকা আক্রমণ করতে পারবে না। উলটে, আমরাই তাদের চমকে দিতে পারব। যদি বিপদ গুরুতর হয়, তখন না-হয় কোটালকে খবর দেওয়া যাবে।
—উত্তম প্রস্তাব। তাই হবে। বেশ একটা উত্তেজনাপূর্ণ অভিযান হবে বটে। আর, যদি লোকগুলোকে ধরতে পারি, তাহলে ষড়যন্ত্রের নায়কটি যে কে, তা ওদের পেট থেকে টেনে বের করতে অসুবিধে হবে না।
.
নীলকণ্ঠ মহাদেবের মন্দিরটা আগে থেকে জানা না থাকলে খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন। ঘন জঙ্গলের ভেতরে একটা ছোট্ট খোলা জায়গা। সেখানে অতি প্রাচীন মন্দিরটার ধ্বংসাবশেষ নিঃসঙ্গভাবে যেন তার শেষ দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। মূল মন্দিরটাই শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার নাটমন্দির আর চারপাশের বারান্দা ভেঙে পড়ে গেছে। মন্দিরের দরজা-টরজা কিচ্ছু নেই, ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।
প্রতাপ সিংহ আর বিক্রম নিঃশব্দে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারদিক দেখে প্রতাপ ফিসফিস করে বললেন— খুব সাবধান বিক্রম, একটু আগেই এখানে একপাল হাতি এসেছিল। আমার মনে হচ্ছে যে তারা এখনও কাছাকাছিই আছে।
কথাগুলো খুবই নীচু গলায় বললেন বটে কিন্তু ওই নির্জন জায়গায় তা যথেষ্ট নীচু হল না। তাঁর কথা শেষ হওয়ামাত্র অন্ধকার মন্দিরের ভেতর থেকে কাতর আর্তনাদ বেরিয়ে এল, বাইরে কে রয়েছেন? আমাদের বাঁচান। একপাল পাগলা হাতি আমাদের এখানে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে আর মারবার জন্য বাইরে ঘোরাঘুরি করছে। তাদের সঙ্গে আবার দুটো বাঘও রয়েছে। কেন যে জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে এসেছিলুম!
বিক্রম চেঁচিয়ে বলল— তোমরা কারা? বাইরে এসো।
বলামাত্র চারটে লোক ঠেলাঠেলি করতে করতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাজা আর বিক্রমকে দেখে ‘ওরে বাবারে’ বলে আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। বিক্রম বলল— অ্যাই, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? বললুম না বাইরে আসতে? ভেতরে ঢুকে পার পাবে ভেবেছ? রাজাকে হত্যা করার চেষ্টা কত বড়ো অপরাধ তা জানো? তার শাস্তি এড়ানো এত সহজ নয়, বুঝেছ?
লোকগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে বোকামতন দেখতে, সে বলল— বাঃ, আমরা যে রাজাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছি তা আপনি কী করে জানলেন? আমাদের তো মুখ ঢাকা ছিল।
—কী করে যে জানলুম তা আর তোমাদের বুঝে কাজ নেই। এখন চলো, তোমাদের শূলে চড়াবার সব ব্যবস্থাই প্রস্তুত।
বলতেই চারজন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রতাপ সিংহের পায়ে এসে পড়ল। সমস্বরে বলল— আমাদের ক্ষমা করুন, রাজামশাই। আমরা আপনার পাশের রাজ্যের সামান্য সৈনিক। ভীষণ গরিব, দু-বেলা খেতে পাইনে। আপনাকে হত্যা করতে পারলে আমাদের রাজা প্রধর্ষ আর বিরূপাক্ষ বলে একজন লোক আমাদের এত অর্থ দেবে বলেছেন যে, আমরা লোভ সামলাতে পারিনি। আর কখনো এমন কাজ করব না, রাজামশাই।
রাজার মুখ আষাঢ়ের মেঘের মতো হয়ে উঠল। বললেন— তোমরা এই বিরুপাক্ষকে দেখেছ? তাকে চিনিয়ে নিতে পারবে?
—পারব, রাজামশাই। আপনি যা বলবেন, তাই করব। দয়া করে আমাদের শূলে চড়াবেন না।
—সেটা যথাসময়ে বিবেচনা করা যাবে। কিন্তু বিক্রম, এই চারজনকে রাজধানীতে নিয়ে যাই কী করে বলো তো? আমাদের সঙ্গে তো মোটে দুটো ঘোড়া।
—বিক্রম বলল, এই বনের হাতিরা ওদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।
বলতে বলতে সীতা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে মহারাজকে ভক্তিভরে প্রণাম করল। তারপরেই জিভ কেটে বলল, ওই যাঃ, ভুলে গিয়েছিলুম। মহারাজের জয় হোক।
প্রতাপ সিংহ স্তম্ভিত হয়ে ঘটনাটা দেখছিলেন। জয়োচ্চারণ শুনে অট্টহাসি হেসে বললেন— জয় তো হলই। কিন্তু, তুমি কে মা? এই ঘন বনের ভেতরে এমন নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ? কার মেয়ে তুমি? না, না, আমি বুঝেছি। এমন রূপ তোমার। তুমি নিশ্চয়ই বনদেবী।
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সীতা বলল— না, না, আমার নাম বনদেবী নয়, আমি সীতা। এই বনেই আমার বাড়ি। আর আমার তো এখানে কোনো ভয় নেই। এখানে সবাই আমার বন্ধু। আর তুমি তো এখন আমার সঙ্গে আছ, রাজামশাই। তোমারও কোনো ভয় নেই।
হাতজোড় করে প্রতাপ সহাস্যে বললেন— তোমার এই অভয়বাণীতে বড়োই নিশ্চিন্ত হলুম, মা। কিন্তু আমাদের যে খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবে না?
—হ্যাঁ, এক্ষুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বলে মুখ তুলে সীতা বলল— যা তো মসুরি, লাখুটিকে খাবার আনতে বল। সাতজনের জন্য। ওই চারটে পাজিরও ক্ষিদে পেয়েছে। কাল থেকে খায়নি তো কিছু।
মসুরি অমনি সাঁ করে উড়ে চলে গেল। রাজা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— মসুরি, লাখুটি, এরা সব কারা?
—ওই দাঁড়কাকটা, ওর নাম মসুরি। আর লাখুটি হচ্ছে এই বনের সব হনুমানদের দলপতি।
—হনুমান? সত্যিকারের হনুমান?
—তা নয়তো কী? মিথ্যে হনুমান আবার হয় নাকি?
—না, তা হয় না। মানে, আমি ভাবছিলুম তুমি হয়তো এই বনের শবর বা কিরাতদের কথা বলছ।
—এ মা, রাজামশাই, তুমি কিচ্ছু জানো না। শবর বা কিরাতরা তো বনের ধারে থাকে। এমন ঘন বনের ভেতরে তারা আসে না তো। আচ্ছা, তোমরা দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? বসো না ওই পাথর দুটোর ওপরে। না, না, দাঁড়াও, আগে ও দুটো পরিষ্কার করে দিই। যা ধুলো পড়েছে! দমদম, পাথর দুটো পরিষ্কার করে দেবে?
মন্দিরের পেছন থেকে বিশালকায় দমদম বেরিয়ে এসে শুঁড় দিয়ে ফুঁ দিয়ে পাথর দুটোর ওপরের সব ধুলোবালি উড়িয়ে দিল। রাজামশাইকে আর দ্বিতীয় বার অনুরোধ করতে হল না। ব্যাপার-স্যাপার দেখে বিস্ময়ে কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে বসে পড়লেন। বিড়বিড় করে বললেন— এ সব আমি কী দেখছি?
ওঁর পাশে বসে বিক্রম বলল— আমি যেটুকু জানি, আপনাকে বলছি। বলে রাজার কানে কানে ওর আগের দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলল। রাজামশাই শোনেন আর বলেন, কী আশ্চর্য, কী অদ্ভুত!
এই কথার মধ্যে একপাল পাকানো পাকানো লম্বা ল্যাজওলা হনুমান হুপ হুপ করে গাছের ওপর থেকে লাফিয়ে নামল। তাদের কারুর হাতে বড়ো বড়ো পদ্মপাতায় কলা, আম, কাঁঠালের কোয়া ইত্যাদি, কেউ এনেছে ওইরকম পদ্মপাতায় জল।
রাজা আর এখন আশ্চর্য হচ্ছেন না। বেশ স্বচ্ছন্দে হনুমানদের হাত থেকে একটা পদ্মপাতা নিয়ে বেশ পরিতৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করলেন।
খেতে খেতে বিক্রম বলল— সীতা, আমাদের খাওয়া শেষ হলে দমদম যেন বন্দিদের জঙ্গলের বাইরে রেখে আসে। ওখানে কোটাল অপেক্ষা করছেন। তোমরা পায়রা দূতকে দিয়ে তাঁকে অগ্রিম খবরটা পাঠিয়ে দিও। যে চিঠিটা লিখবে তাতে একটা সংকেতবার্তা দেবে যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে সেটা মহারাজের আদেশ। সেই সংকেতবার্তাটা আমি তোমাকে দিয়ে দেব।
রাজা বললেন— সীতা এ কাজ করতে পারবে?
—পারবে, মহারাজ। আপনার রাজকর্মচারীদের থেকে অনেক ভালো পারবে। দেখলেন না ও কীভাবে আপনার প্রাণ বাঁচাল আর গুপ্তঘাতকদের ধরিয়ে দিল?
দমদম আর তার দলবল বন্দিদের নিয়ে চলে যাবার পর সীতা বলল— তুমি কি ওদের সত্যি সত্যি শূলে চড়াবে, রাজামশাই? মেরে ফেলবে?
রাজা সহাস্যে বললেন— তুমি কী পাগল নাকি? জানো না, আমাদের রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড নেই। কোনো শূলই নেই তো চড়াব কোথায়? বিক্রম ওদের মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছিল। তবে ওদের শাস্তি হবে। ওসব কথা ছাড়। এখন বলো তো তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? তুমি তো দিব্যি লেখাপড়া জানো। কার কাছে পড়ো?
সীতা তার সবকথা বলল। তারপরে জিজ্ঞাসা করল— জানো তো রাজামশাই, পিসিমা আমাকে অঙ্কও শেখায়? পঁচিশকে পঁচিশ দিয়ে গুণ করলে কত হয়, বলো তো?
—কত হয়?
—জানো না? ছ-শো পঁচিশ। কী অদ্ভুত, তাই না?
—সত্যিই অদ্ভুত। আচ্ছা সীতা, তুমি আমাকে তোমার বাড়ি দেখাবে না?
—হ্যাঁ, দেখাব। এসো আমার সঙ্গে।
হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে রাজাকে তার নানা রকমের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল সীতা। রাজা মুগ্ধ বিস্ময়ে সেইসব কাহিনি শুনলেন। একবারও বাধা দিলেন না।
শম্পা নদীর কাছে এসে সীতা বলল— ওই দ্যাখো, আমাদের পাতার কুঁড়েঘর। কী সুন্দর, তাই না? রাজামশাই, তোমার বাড়িটা এর চেয়েও বড়ো? আরও সুন্দর?
মহারাজের চোখে জল এল। বললেন— হ্যাঁ রে মা। আমার বাড়িটা তোর ওই বাড়ির চেয়ে বড়ো, কিন্তু ভীষণ বিচ্ছিরি। সেখানে কোনো সৌন্দর্য নেই। সেখানে সবসময় অন্ধকার, তার কোণায় কোণায় ভয় আর অবিশ্বাস জমাট হয়ে আছে। সেখানে কেউ হাসে না, সবাই ভুরু কুঁচকে গোমড়ামুখে ঘুরে বেড়ায় আর যত রাজ্যের নোংরা ঘাঁটে। তোদের বাড়ির একটা টুকরো যদি তুলে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমার ঘরেও আলো জ্বলে উঠবে, সবাই হাসবে, মনের আনন্দে গান গাইবে।
—সেই ভালো। থেকো-না অমন বাড়িতে। আমার বাবা তো ঘর বানায়। বাবাকে বলব তোমাকে আমাদের মতো একটা ঘর তৈরি করে দেবে। তাহলে আর তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।
—ঠিক বলবি তো? আমিও বলব। আমি হলুম গিয়ে রাজামশাই, আমার কথা তোর বাবা ঠেলতে পারবেন না।
হঠাৎ বিস্ফারিত চোখে সীতা বলল— আরে! দাওয়ার ওপরে বাবার লাঠিটা। তাহলে বাবা-মা নিশ্চয়ই এসেছে। তুমি এখানে বসো, আমি ভেতর থেকে ওদের ডেকে নিয়ে আসছি।
দাওয়ায় বসে বিক্রম আর রাজা শুনতে পেলেন সীতা তার মার কাছে বকুনি খাচ্ছে, কোথায় থাকিস বল তো সারাদিন? ডেকে ডেকে পাই না।
সীতা বলল— শোনো-না মা, কী হয়েছে? বাবা তুমিও শোনো। তারপরে ঝড়ের বেগে সে কী সব বলে গেল। একটু পরেই ওর বাবা আর মা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলেন আর ‘মহারাজের জয় হোক’ বলে দু-জনে রাজাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।
সীতার বাবা বললেন— মহারাজ, আমার এই পর্ণকুটিরে এসেছেন। আমি কী করে আপনার আপ্যায়ন করব?
রাজা বললেন— তোমার এই মেয়ে আমাদের যা আপ্যায়ন করেছে তা কোনো চক্রবর্তী সম্রাটের পক্ষেও সম্ভব হত না। শুধু কী আপ্যায়ন? সে দু-দু-বার আমার প্রাণরক্ষা করেছে। এক বার আততায়ীর হাত থেকে আর এক বার প্রবল ক্ষুধার থেকে।
জোড়হাত করে সীতার বাবা বললেন— নিজের মেয়ে বলছি না মহারাজ, সীতা কিন্তু সত্যিই অসাধারণ।
—তা আমি বুঝতে পেরেছি। ভেতরে চলো, তোমার কাছে আমার একটি ভিক্ষে চাইবার আছে।
.
সীতার বাবা-মা আর রাজা প্রতাপ সিংহ ঘরের ভেতরে চলে গেলে, সীতা বিক্রমের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল— মহারাজ আমার বাবার কাছে কী ভিক্ষা চাইছে, বলো তো? আমাদের তো দেবার মতো কিছুই নেই।
বিক্রম মৃদু হেসে বলল— উনি নিশ্চয়ই তোমার বাবার কাছে অত্যন্ত মহার্ঘ কিছু দেখেছেন। তাই চাইছেন।
—অত্যন্ত মহার্ঘ কিছু? বাবার কাছে? সেটা আবার কী?
উত্তরটা ভেবে বের করবার আগেই ঘরের ভেতর থেকে রাজার গলা শোনা গেল— হ্যাঁরে সীতা, একটা কথা বল তো। আমার বাড়িতে একটা ল্যাজকাটা হনুমান আছে। সেটা বেজায় দুষ্টু। কারুর কথা শোনে না, কেবল লাফিয়ে বেড়ায়। তুই তার ভার নিয়ে তাকে সামলাতে পারবি?
সীতা বলল— কেন পারব না? হনুমান যত দুষ্টুই হোক, আমার কাছে তার কোনোরকম জারিজুরি চলবে না।
বলামাত্র ঘরের ভেতরে রাজা অট্টহাসি হেসে উঠলেন আর তার পরেই একটা শঙ্খের গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে গেল সমস্ত বনভূমিতে।
নগার ডাকাতি
অনেক অনেকদিন আগে লতাবাগান গ্রামে পণ্ডিত হরনাথ তর্কতীর্থ টোল চালাতেন। আশেপাশের দশটা গ্রামের লোক তাঁর নাম জানত। সে যে শুধু তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তাই নয়, প্রচণ্ড সত্যবাদী বলেও তাঁর খ্যাতি ছিল। সবাই জানত, হরনাথ তর্কতীর্থ মরে যাবেন তবুও মিথ্যে কথা বলবেন না। ঘোর বিপদের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি কখনো অসত্য কথা বলেননি। এইসব কারণে পণ্ডিতমশায়ের বয়েস খুব বেশি না হলেও সবাই তাঁকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত। সে দেশের রাজা তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনিও তাঁকে গভীর সম্মান করতেন। তাঁর টোল চালাবার জন্য সিধে পাঠাতেন।
তর্কতীর্থের কুঁড়েঘরটা ছিল লতাবাগানের একটেরে। সেখানেই টোল। বাড়িতে থাকতেন পণ্ডিতমশাই আর তাঁর স্ত্রী সরস্বতী। দু-চারজন গরিব ছাত্রও তাঁর বাড়িতে থাকত। তর্কতীর্থ তাদের নিজের ছেলের মতো দেখতেন। তাঁর বাড়ির পরেই ফাঁকা জমি আর তার পরে জঙ্গল। দরিদ্র ব্রাহ্মণ চোর-ডাকাতের ভয় করতেন না। ভয় ছিল বন্য জন্তুর। সেজন্য, তাঁর বাড়ি আর উঠোন ঘিরে কাঁটাঝোপের বেড়া দেওয়া ছিল আর সন্ধের পর বেড়ার ঝাঁপ বন্ধ করে সেটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হত।
সেদিন ছিল অমাবস্যা। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে ঘরের দাওয়ায় বসে তর্কতীর্থ প্রদীপের আলোয় একটা পুঁথি পড়ছিলেন। সকলে তখন শুয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে একটা নিশাচর পাখির কর্কশ ডাক ছাড়া চারদিক নিস্তব্ধ। পড়তে পড়তে হঠাৎ তাঁর কানে এল বেড়ার ওপাশে কিছু ভারী পায়ের শব্দ। জন্তুজানোয়ার নয়, মানুষ। এত রাতে কারা এল দেখবার জন্য পণ্ডিতমশাই আসন ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন, শুনলেন বেড়ার দরজা খুলে কেউ তাঁর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে তাঁর দিকে আসছে।
পণ্ডিতমশাই আবার আসনে বসে পড়লেন আর অন্ধকারের মধ্যে কে আসছে সেটা দেখবার চেষ্টা করতে লাগলেন। যে লোকটা তাঁর দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল, প্রদীপের আলোয় তাকে দেখে পণ্ডিতমশায়ের তো চক্ষুস্থির!
মাঝবয়সি লোকটা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ আর প্রকাণ্ড ষণ্ডা জোয়ান। তার হাতে একটা লম্বা লোহার সড়কি, সারা গায়ে তেল মাখা, পরনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ধুতি, খালি গা, কুতকুতে চোখ, মুখে একজোড়া বিরাট গোঁফ আর মাথার বাবরি চুলের ওপরে লাল কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা।
লোকটা মোটা গলায় বলল— পেন্নাম হই, পণ্ডিতমশাই। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
পণ্ডিতমশাই নির্বিকার মুখে বললেন— তুমি একজন ডাকাত, সেটা বুঝতে পারছি। তার বেশি পরিচয় আমার জানা নেই।
ডাকাত বুক ফুলিয়ে বলল— আমার নাম নগেন গায়েন। এই তল্লাটে সবাই আমাকে নগা ডাকাত বলে জানে।
—তা হতে পারে। তবে, তুমি তো দেখছি ডাকাতি করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়েছ। সেক্ষেত্রে, আমার বাড়িতে তোমার আবির্ভাবের কারণটা তো ঠিক বুঝতে পারলুম না, বাপু। তোমার কি ধারণা হয়েছে যে আমার বাড়িতে সোনাদানা বস্তাবন্দি করে রাখা রয়েছে?
—আজ্ঞে না, পণ্ডিতমশাই। আপনার বাড়িতে যা আছে তা পঞ্চাশ বার লুট করলেও আমার যে পড়তায় পোষাবে না, তা আমি ভালো করেই জানি। আমি এসেছি অন্য কারণে। আপনার কাছে আমার একটা খবরের দরকার আছে।
—কী খবর চাও?
—দেখুন, পণ্ডিতমশাই, আপনি তো আমাদের রাজামশায়ের গুরু এবং কুলপুরোহিত। এবার বলুন তো, রাজবাড়ির কোষাগারে ঢোকার গুপ্তপথের সন্ধান জানেন নাকি একমাত্র রাজামশাই আর আপনি। রানিমা বা তাঁর ছেলেপুলেরাও জানেন না, এ কথাটা কি ঠিক?
ভয়ানক গম্ভীর মুখে পণ্ডিতমশাই বললেন— হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তুমি জানলে কী করে?
—খুব সহজে। রাজামশায়ের খাজাঞ্চি উদ্ধব রায়কে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাঁশ দিয়ে ডললুম আর সে গড়গড় করে বলে দিলে।
—কী সর্বনাশ! তোমার কাছে দেখছি কোনো কুকর্মই অসাধ্য নয়।
—ঠিক কথা। তাহলে, এবার ওই গুপ্তপথে ঢোকার উপায়টা আমাকে বলে দিন। ওটা আমার জানা খুব দরকার।
—তোমার যদি দরকার থাকে তো তুমি নিজে খুঁজে নাওগে যাও। আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? আমি তোমাকে বলব না। আর, সেই জন্য তুমি যদি আমাকে মেরে ফেলতে চাও তো মেরে ফেলতে পারো। তুমি বোধ হয় জানো না যে আমার মৃত্যুভয় বলে কিছু নেই।
একগাদা এবড়ো-খেবড়ো হলদে দাঁত বের করে হাসল নগা। বলল— আপনাকে মারতে যাব কোন দুঃখে? আপনার মতো একটা শুঁটকো পণ্ডিতকে মেরে খালি হাতে বাড়ি ফেরার জন্য তো আর এতটা পথ আসিনি। কোষাগারে ঢোকার পথটা না-জেনে ফিরি কী করে, বলুন? তবে, নেহাতই যদি না বলেন, তাহলে অবশ্য যাওয়ার আগে আপনার গিন্নি আর ছাত্রগুলোকে মেরে এই টোল আর বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে রেখে যাব। নগা ডাকাতের হুংকার শুনলে এ গাঁয়ের একটি লোকও আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। একা আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখবেন।
—বটে? আচ্ছা, ধরো আমি তোমাকে বললুম। কিন্তু আমি তো তোমাকে ভুলপথে পাঠাতে পারি। তুমি বুঝবে কী করে?
মাথা নেড়ে নগা বলল— তা আপনি করবেন না। আমরা জানি যে, কোনো অবস্থাতেই আপনি মিথ্যেকথা বলতে পারেন না।
নগার কথা শুনে পণ্ডিতমশাই কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেন— বেশ, গুপ্তপথের সন্ধান আমি তোমাকে দেব। কিন্তু, একটা শর্ত আছে।
—কী শর্ত?
—শর্তটা হল যে আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে বাধ্য করবে না। যদি করো, তাহলে রাজামশাই ঠিকই জানতে পারবেন। তখন বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমাকে শূলে চড়াবেন আর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবেন। তোমাকে কিছু যদি না-বলি, তাহলে তুমিও তাই করবে। কাজেই শর্ত না মানলে তোমাকে কিছু না বলাই শ্রেয় হবে।
নগা তাড়াতাড়ি বলল— না, না, পণ্ডিতমশাই, আপনার শর্ত আমি মেনে নিচ্ছি। আপনি যদি সাধারণ মানুষ হতেন তাহলে আপনাকে গলায় গামছা দিয়ে টেনে নিয়ে যেতুম। কিন্তু, আমরা জানি যে আপনার ওপরে অত্যাচার করে কোনো লাভ হবে না। আপনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
—আমি তোমাকে গোপন পথের কথা বলে দেবার পর তুমি আমার ওপরে জোর করবে না তো?
নগা ডাকাত হাতজোড় করে বলল— এটা কী কথা বললেন, পণ্ডিতমশাই? আমি ডাকাত হতে পারি কিন্তু দশগাঁয়ের লোক জানে যে আজ পর্যন্ত নগার কথার নড়চড় হয়নি, কোনোদিন হবেও না।
পণ্ডিতমশাই বললেন— বেশ কথা। বলে, ফিসফিস করে নগাকে গুপ্তপথের হদিশ বলে দিলেন।
নগা সবকথা মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল— শুধু এতে তো হবে না পণ্ডিতমশাই। দরজা খোলার মন্তরটাও তো বলতে হবে। ওখানে শুনেছি জগদ্দল দরজা। সেটা ভাঙতে গেলে তো তার শব্দে রাজবাড়ি সুদ্ধু লোক আর যত রাজ্যের পাইক-পেয়াদা সেখানে এসে উপস্থিত হবে। অথচ, মন্তর বললে দরজা নাকি হুড়ুৎ করে খুলে যায়।
পণ্ডিতমশাই বললেন— অঃ, সে-কথাটাও জেনে গেছ? তবে শোনো। যখন দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, তখন প্রথমে জোরে জোরে বলবে, ওঁ হ্রং ভ্রীং ঘুট, তাহলে দরজা খুলে যাবে। তারপরে বলবে, ওঁ ঝিড়িং গিড়িং ফট। তাহলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হবে। ভুল করে মন্ত্রগুলো উলটোপালটা করে ফেল না যেন। তাহলে কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাবে।
নগা মাথা নেড়ে বলল— ভুল হবে না, পণ্ডিতমশাই। বলে বিড়বিড় করে মন্ত্র দুটো মুখস্থ করে ফেলল। তারপর, পণ্ডিতমশাইকে একটা নমস্কার করে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল।
নগা বেরিয়ে যেতেই ঘরের ভেতর থেকে সরস্বতী বেরিয়ে এলেন। বললেন— এটা কী করলে? আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমাদের উপকারী রাজামশায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে? আমাদের না-হয় বাঁচালে, কিন্তু তোমার ছাত্রদের মধ্যে হয়তো কেউ নগা আর তোমার কথাবার্তা শুনেছে। তারা তো বাইরে গিয়ে রটাবে যে তুমি কৃতঘ্ন, বিশ্বাসঘাতক। সেটা সইতে পারবে?
পণ্ডিতমশাই মাথা নেড়ে বললেন— বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখো। কেবল, একটা জায়গায় খটকা রয়ে গেল। আজ থেকে বহুবছর আগে আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ তন্ত্রাচার্য ঈশ্বর জগন্নাথ আগমবাগীশ কতগুলো মন্ত্র দিয়ে ওই দরজা বেঁধে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় যে মন্ত্রটা নগাকে শেখালুম সেটা তো কখনো ব্যবহার হয়নি, এখন এত বছর বাদে সেটা কাজ করবে কি না সে বিষয়ে একটু সন্দেহ হচ্ছে। যদি কাজ না করে তাহলে বিপদ।
—এতদিন মন্ত্রটা যদি ব্যবহার নাই হয়ে থাকে, তাহলে দরজাটা খোলা হয় কী করে? চাবি দিয়ে বুঝি? বুঝতে পেরেছি। নগা যাতে চাবির জন্য রাজামশায়ের অন্দরমহলে গিয়ে উপস্থিত না-হয়, তাই তুমি ওকে মন্ত্রটা দিলে, তাই না?
হরনাথ তর্কতীর্থ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না-দিয়ে চিন্তিত মুখে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাওয়ায় বসে রইলেন।
.
ঝোপঝাড় ভেঙে নগা আর তার দলবল রাজবাড়ির পেছনে বাগানের পাঁচিলের কাছে পৌঁছল। সেটা টপকে ভেতরে ঢুকে তারা চলে গেল একটা প্রকাণ্ড বটগাছের সামনে। তার একগুচ্ছ ঝুরি আর কাঁটাঝোপ সরিয়ে দেখা গেল গাছের মূলকাণ্ডের গায়ে একটা দরজা। কেউ বলে না-দিলে সেটা চেনা একেবারে অসম্ভব। শাবলের চাড় দিয়ে দরজা খোলা হল। তার পেছনে একটা সুড়ঙ্গ পথ। সেটা নেমে গেছে মাটির নীচে। মশাল জ্বালিয়ে নগা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ভেতরে ঢুকল।
সুড়ঙ্গটা যেখানে শেষ হয়েছে সেটা একটা বড়ো ঘর আর তার একপাশে বিরাট শালকাঠের মজবুত দরজা। সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নগা বলল— ওঁ হ্রং ভ্রীং ঘুট। বলামাত্র দরজাটা কড়কড় করে খুলতে শুরু করল। তখন নগা বলল— ওঁ ঝিড়িং গিড়িং ফট। বলতে বলতে দরজাটা পুরো খুলে গেল।
দরজার পেছনে একটা বড়োসড়ো ঘর, নিরেট পাথরের দেওয়াল। সেখানে মশাল রাখার খাঁজ কাটা আছে। ঘরের মেঝেয় সাত-আটটা লোহার সিন্দুক। নগা বলল— কেউ আগে সিন্দুক খুলবি না। আগে মশালগুলো খাঁজের মধ্যে রাখ। দু-জন সড়কি নিয়ে দরজায় পাহারা দে। বাকি সবাই সড়কি আর লাঠি তৈরি করে রাখ যাতে ওই গর্ত দিয়ে কেউ নেমে এলে আমাদের কোণঠাসা ইঁদুরের মতো অবস্থা না-হয়। সিন্দুকগুলো খুলব আমি।
সেইমতো ব্যবস্থা হল। প্রথম সিন্দুকটা খুলে নগা একেবারে স্তম্ভিত। সেটা সোনা আর রুপোর টাকায় ভরতি। দ্বিতীয়টাও সেইরকম। তৃতীয়টায় গয়নাগাঁটি। তার পরেরটায় সোনা-রুপোর তৈজসপত্র। কোনোটাতে হিরে-মণি-মুক্তো। নগা আর তার লোকেরা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল।
নগা কোনোরকমে বলল— হারু, হাঁ করে কী দেখছিস? থলেগুলো বের কর। সেগুলো ভরতে হবে না?
বলতে বলতে নগা যেই টাকা ভরতি সিন্দুকটায় হাত ঢুকিয়েছে অমনি একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়ে সে মেঝের ওপর হাত-পা তুলে ছিটকে পড়ল। চট করে সামলে নিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— অ্যাই, অ্যাই, কে মারল রে? কার এতবড়ো সাহস?
দলের সবাই সমস্বরে বলল— আমরা কেউ মারিনি, সর্দার।
—মারিসনি তো আমার গালে এমন জোরে লাগল কী করে, শুনি?
একজন বলল— বোধ হয় তাড়াহুড়োয় সিন্দুকের ডালাটায় লেগে গেছে।
—হুম, তাই হবে। বলে নগা যেই আবার সিন্দুকে হাত দিয়েছে, কে যেন পেছন থেকে ওর ঘাড়ে এমন রদ্দা মারল যে তার মুখ টাকার স্তূপের ভেতরে সিধিয়ে গেল।
সবাই আবার সমস্বরে বলল— অত হাঁক-পাক কোরো না, সর্দার। সময় আছে। আস্তে আস্তে করো।
বিকৃত মুখে ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে নগা বলল— নাঃ, আমার দ্বারা হচ্ছে না। তোরা সক্কলে থলে নে, আর ভরতে শুরু কর।
তখন ঘরের মধ্যে একেবারে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। কেউ শূন্যে উঠে দড়াম করে মেঝের ওপরে আছড়ে পড়তে লাগল, কেউ ‘ওরে বাবারে, মরে গেলুম রে’ বলে লাফাতে লাফাতে ঘরের চারদিকে দৌড়তে লাগল, কেউ এক বার এ দেওয়ালে আর এক বার ও দেওয়ালে মাথা ঠুকতে লাগল, কেউ-বা মেঝের ওপর পড়ে গাঁক গাঁক করতে করতে হাত-পা ছুড়তে লাগল। আর সক্কলে মিলে ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাতে শুরু করে দিল। নগা বলতে গিয়েছিল যে অমন চ্যাঁচালে রাজবাড়ি সুদ্ধু লোক জেগে যাবে। কিন্তু সে কথা বলবার আগেই আবার ঘাড়ে প্রচণ্ড রদ্দা খেয়ে সেও মাটিতে পড়ে হাউমাউ করে চিৎকার জুড়ে দিল। যে দু-জন দরজার কাছে পাহারা দিচ্ছিল, তারা পালাতে গিয়ে আর পালাতে পারল না। ছিটকে ঘরের ভেতরে এসে পড়ল। সে একেবারে হুলুস্থুল ব্যাপার।
.
বাগানের দিক থেকে প্রবল চ্যাঁচামেচি শুনে রাজবাড়ি সুদ্ধু সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। রাজামশাই হাই তুলতে তুলতে খোলা তরোয়াল হাতে কোটাল আর তাঁর পাইক-বরকন্দাজদের নিয়ে বটগাছটার কাছে চলে এলেন। ততক্ষণে আওয়াজ বন্ধ হয়েছে। দেখা গেল অদ্ভুত দৃশ্য। গাছের তলায় একপাশে কতগুলো মুস্কো লোক হাত-পা ছড়িয়ে, কেউ চিৎপাত হয়ে, কেউ-বা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে।
রাজামশাই তো স্তম্ভিত। বললেন— দেখো তো, এরা কারা।
মশালের আলোয় লোকগুলোকে দেখে বরকন্দাজরা বলল— এরা তো ডাকাত, রাজামশাই! বেজায় মার খেয়ে সব ক-টা অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। আর, মুখের যা অবস্থা হয়েছে তাতে এদের মা-মাসিরাও মাসখানেকের আগে এদের চিনতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে। আহারে, নাক-চোখ-মুখ সব একাকার হয়ে গিয়েছে। এরা এখানে এলই-বা কী করে আর এদের এমন মারই বা দিলে কে?
রাজামশাই চোখ মুছতে মুছতে বললেন, সে কথা পরে ভেবো। আগে এদের ভালো করে পিছমোড়া করে বাঁধো, তারপরে মুখে জল ঢেলে জ্ঞান ফেরাও।
সে রকমই করা হল। ডাকাতদের যারই জ্ঞান ফেরে সেই ‘ভূত ভূত’ বলে চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পালাতে যায়। কিন্তু পালাবে কোথায়? হাত-পা তো বাঁধা।
রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন— তোমাদের সর্দার কে?
ডাকাতরা বলল— আজ্ঞে, ওই যে উনি যাঁর জ্ঞান ফেরানোর জন্যে মুখে কলসি কলসি জল ঢালা হচ্ছে।
—কী নাম তোমাদের সর্দারের?
—আজ্ঞে, ছিরি নগেন্দরনাথ গায়েন।
এইবার রাজামশায়ের ঘুম ছুটে গেল। বললেন— কী সর্বনাশ! তোমরা নগা ডাকাতের দল নাকি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, রাজামশাই। লোকে আমাদের তাই বলে বটে।
ইতিমধ্যে ছিরি নগেন্দ্রনাথ গায়েনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। বরকন্দাজরা তাকে টানতে টানতে রাজামশায়ের কাছে নিয়ে এল। তার ছিরি দেখে রাজামশায়ের কষ্টই হল। নাকটা বেঁকে গেছে, চোখ দুটো আর দেখাই যাচ্ছে না, কপাল আর ঠোঁট ফুলে ঢোল, হাত-পাগুলো কেমনধারা যেন ত্যাড়াব্যাঁকা হয়ে গেছে।
রাজামশাই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— অ্যাই, তুমি নগা ডাকাত?
নগা কাঁদতে কাঁদতে বলল— হ্যাঁ, রাজামশাই।
—তোমার মুণ্ডুটা অমন বেঁকিয়ে রেখেছ কেন? ওটা কি জন্মাবধিই ওরকম নাকি?
—না, রাজামশাই। ঘাড়ে এমন রদ্দা খেয়েছি যে মুণ্ডু সোজা করতে পারছি না। ভূতের রদ্দা, সে কী সোজা ব্যাপার?
রাজামশাই কোটালকে ডেকে বললেন— এরা কেবল ভূত ভূত করছে। মনে হচ্ছে মার খেয়ে বা অন্য কোনো কারণে ওদের সকলের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এদের এখন কারাগারে নিয়ে যাও। সকাল হলে রাজসভায় নিয়ে এসো। সেখানে ওদের সবকথা শুনব আর তারপরে বিচার হবে।
কোটাল বললেন— রাজামশাই, এই নগা আর তার দলের অত্যাচারে আশেপাশের সব ক-টা রাজ্যের লোক ত্রাহি ত্রাহি করছে। ওর ভয়ে আমরা সারারাত ঘুমোতে পারি না। ধনী-দরিদ্র কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। কত লোক যে ওদের জন্যে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার সীমা নেই। অনেক চেষ্টা করেও এতদিন কেউ ওদের আটকাতে পারেনি। এখন যখন ওদের বাগে পেয়েছি, আমরা সবাই আশ মিটিয়ে হাতের সুখ করে নিতে চাই। আপনি দয়া করে বাধা দেবেন না। তারপরে আমরা রাজসভায় নিয়ে যাব।
রাজামশাই বললেন— ওদের তো নড়াচড়া করবারও ক্ষমতা নেই। তার ওপরে আরও মারলে মরে যাবে যে।
—কিচ্ছু মরবে না। আপনি দেখুন না, ওরা নড়াচড়া করতে পারে কিনা।
তখন বরকন্দাজরা সবাই মিলে ডাকাতদের গায়ে আচ্ছা করে জলবিছুটি ঘষে দিল আর অমনি তারা, ‘ওরে বাবারে, গেলুম রে, মলুম রে’, বলে বেঁকেচুরে নাচতে শুরু করে দিল।
তারপরে যা হল সে আর বলে কাজ নেই।
ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে নগা রাজামশায়ের পায়ে পড়ে বলল— আপনি তো আমাদের শূলেই দেবেন। তার আগে আমার একটি অনুরোধ রাখবেন, রাজামশাই?
—কী অনুরোধ? রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন।
—মশানে যাবার আগে একটি বার আমি হরনাথ পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি আমাকে সেই অনুমতিটা দিন, রাজামশাই।
অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে রাজামশাই বললেন— সেকী? তুমি পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাও? ঠিক আছে, তাই হবে। তবে মশানে যাবার আগে কেন? এখুনি চলো। রাত তো প্রায় শেষ হয়ে এল। আমরা ওঁর বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে উনি উঠে পড়বেন।
.
পুবদিকে রাঙা আলোর আঁচল উড়িয়ে ঊষা আসছেন। পাখিরা ঘুম ভেঙে কলরব করে তাঁর আগমনী গাইছে। পণ্ডিতমশাই দাওয়ায় বসে মুগ্ধ চোখে সেই দৃশ্য দেখছিলেন। উদবেগে সারারাত ঘুমোতে পারেননি। ভোর বেলার ঠান্ডা বাতাস তাঁর তপ্ত মুখে যেন তাঁর স্বর্গতা মায়ের সস্নেহ হাতের স্পর্শ মাখিয়ে দিচ্ছিল।
সেইসময় ছোট্ট একটি রাখাল ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে বলল— পণ্ডিতমশাই, পণ্ডিতমশাই, আমাদের রাজামশাই লোকলস্কর নিয়ে এইদিকে আসছেন। তাঁর বরকন্দাজরা কতগুলো হুমদো মতন লোককে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। ইসস, লোকগুলোর কী অবস্থা! বরকন্দাজরা তাদের মেরে একেবারে কাঁঠাল পাকিয়ে দিয়েছে।
বলতে না-বলতেই রাজার দলবল পণ্ডিতমশায়ের বাড়ির সামনে এসে পড়ল। রাজামশাই পালকি থেকে নেমে জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলেন। পণ্ডিতমশাই ততক্ষণে দাওয়া থেকে নেমে এসেছেন। রাজামশাই তাঁকে প্রণাম করে বললেন— গুরুদেব, কাল নগা ডাকাতের দল আমাদের বাগানে ঢুকেছিল। বোধ হয়, তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজকোষ লুঠ করা। সে তো তারা পারেইনি, উলটে কোনো রহস্যময় কারণে প্রচণ্ড মার খেয়ে গাছের তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। আমার গোড়াতেই সন্দেহ হয়েছিল যে রাজকোষ রক্ষা পাওয়ার পেছনে আপনার কোনোরকম ক্ষমতা কাজ করেছে। পরে যখন নগা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইল তখন স্থির নিশ্চয় হলুম যে আমার সন্দেহে কোনো ভুল ছিল না। আমি ওকে নিয়ে এসেছি। আপনি ওর কথা শুনুন, আমি পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।
হরনাথ বললেন— সে-কী? তুমি রাজা, তোমার কাছে তো কোনো কথা গোপন থাকতে পারে না। তুমি এখানেই থাকবে। নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে যা কিছু আলোচনা তা তোমার সামনেই হবে।
রাজামশায়ের আদেশে নগাকে পণ্ডিতমশায়ের সামনে আনা হল। সে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে নমস্কার করে বলল— পণ্ডিতমশাই, শূলে যাবার আগে আপনাকে শেষ দেখা দেখতে এলুম। আপনার অনেক গুণের কথা আমি শুনেছি, কিন্তু আপনি যে আমাদের ভূতের মারও খাওয়াবেন আবার পেয়াদার মারও খাওয়াবেন, এতটা বুঝতে পারিনি। কোনো রাজা-মহারাজারও এ কাজ করার সাধ্যি ছিল না।
হরনাথ রাজামশাইকে জিজ্ঞাসা করলেন— ওদের কি শূলেই দেবে?
রাজামশাই বললেন— নাঃ, যা ঘটেছে তারপরে ওদের শূলে দেবার কোনো প্রয়োজন দেখি না। তবে, আমি ওদের জন্য আরও বড়ো শাস্তি ভেবে রেখেছি।
—সে আবার কী?
—এই নগার বংশগত পেশা হল খোল বাজিয়ে কীর্তন গাওয়া। ও যখন গানের দল গড়ে গাওনা শুরু করল, দেখা গেল যে যে-ই তাদের কীর্তন শোনে সে-ই ভীষণ ক্ষেপে যায় আর ওদের খোল-টোল ভেঙে দিয়ে মারতে তাড়া করে। বার কয়েক বেধড়ক প্রহার খেয়ে ও দলবলসুদ্ধু গান ছেড়ে ডাকাতি করতে শুরু করে দিল। সেইজন্যে আমি স্থির করেছি যে ওকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেবো আর ওর কাজ হবে রোজ সকালে কারাগারের সমস্ত বন্দিদের কীর্তন শোনানো।
তাই শুনে নগা আবার হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিল। সে কাঁদে আর বলে, ওরে বাবারে, এর চেয়ে যে শূলে যাওয়া ছিল ভালো। এত বড়ো শাস্তি আমাকে দেবেন না রাজামশাই। রোজ সকালে? ওরে বাবারে!
.
নগাকে নিয়ে কোটাল আর বরকন্দাজরা চলে যাবার পর, রাজামশাই হরনাথকে বললেন— গুরুদেব, আপনার শক্তিতেই আজ আমাদের রাজকোষ রক্ষা পেয়েছে। সেটা কীভাবে হল, তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
পণ্ডিতমশাই বললেন— আমার শক্তিতে কিছুই হয়নি। তুমি তো জানো যে আমার পূর্বপুরুষ ঈশ্বর জগন্নাথ আগমবাগীশ এই রাজ্যের কোষাগারের দ্বার মন্ত্র দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেটা খোলার মন্ত্রটা তুমি জানো। আরও কয়েকটা মন্ত্র কিন্তু আছে। বংশপরম্পরায় সেই মন্ত্রগুলো এখন আমার আয়ত্তে। তাদের মধ্যে একটা আছে যেটা দরজার সামনে উচ্চারণ করলে পাতালবাসী অপদেবতারা জেগে উঠবে আর কেউ যদি রাজকোষের অর্থ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে বা করতে যায় তাহলে তারা বাধা দেবে আর ঘাড়ে ধরে সেই অর্থ যথাস্থানে রেখে দিতে বাধ্য করবে।
—কী সেই মন্ত্র, গুরুদেব? আমি কি সেটা জানতে পারি না?
পণ্ডিত হরনাথ তর্কতীর্থ গম্ভীর গলায় বললেন— না, রাজা। এই মন্ত্রের যাতে কোনোরকম অপব্যবহার না-হয়, সেই জন্য অন্য কাউকে সেটা না জানানোর আদেশ আছে আমার ওপর।
রাজামশাই মাথা চুলকে বললেন— বেশ কথা, গুরুদেব। আমার জানার দরকার নেই, কিন্তু নগা তো জেনে ফেলেছে। অবশ্য, তাতে আর কিছু যায় আসে না। সে যা মার খেয়েছে, তারপরে মন্ত্র তো দূরস্থান, সে যে তার পিতৃনামও বিস্মৃত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শালকোঁড়া বনে গণ্ডগোল
সে অনেকদিন আগেকার কথা। মহেন্দ্রনগর রাজ্যে অনন্তপুর গ্রামের কেষ্ট নস্করের গোরুটা হঠাৎ একদিন রাত্রে গোয়াল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ভোর বেলা মাঠে-ঘাটে ঘুরে কেষ্ট যখন গোরুটাকে পেলেন না, তখন তাঁর গ্রামের লোকেদের গিয়ে বললেন— আমার গোরুটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে সে শালকোঁড়া বনের দিকে চলে গেছে। আমি সেদিকেই যাব ভাবছি। তোমরা আমার সঙ্গে আসবে?
সবাই কেষ্ট নস্করকে খুব ভালোবাসত। তারা সমস্বরে বলল,— নিশ্চয়ই। একা-একা তোমার ওই বনের মধ্যে যাওয়া হতেই পারে না।
কেষ্ট নস্করের সঙ্গে তখন গ্রামসুদ্ধু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে শালকোঁড়া বনের দিকে চলল। বনটা বড়ো, তবে গভীর জঙ্গল কিছু নয়। বড়ো বড়ো গাছ আছে বটে, তবে ঝোপঝাড়ই বেশি। নস্কর আর তাঁর লোকজন হই-হই করতে করতে আর লাঠি দিয়ে ঝোপগুলো খোঁচাতে খোঁচাতে বনের ভেতরদিকে এগোতে শুরু করল। ব্যাপার দেখে গ্রামের ছোটোরাও লাফাতে লাফাতে এসে তাদের বাবা-কাকাদের সঙ্গে জুটে গেল। বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল।
এই সময়ে অনন্তপুরের পাশের গ্রাম শীতলদিঘির কিছু হাটুরে লোক শালকোঁড়া বনের পাশ দিয়ে হাটে যাচ্ছিল। গোলমাল শুনে তাদের খুব কৌতূহল হল। তারা অনন্তপুরের বাসিন্দা গোবিন্দকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল— তোমরা কী খুঁজছ গো?
গোবিন্দ আবার শীতলদিঘির লোকেদের একদম পছন্দ করত না। সে বললে— তোমাদের সে কথা বলতে যাব কেন হে? যাও, যাও, নিজের কাজে যাও।
তাই শুনে হাটুরেদের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। তারা কাকুতি-মিনতি করে বলল— আহা, বলোই-না! আমাদের অমন পরপর ভাবছ কেন? আচ্ছা, ঠিক আছে, এই একটা পেয়ারা খাও। ডাঁসা আর খুব মিষ্টি। এইবার বলো।
গোবিন্দ পেয়ারা খেতে খেতে বলল— এই একটা বড়ো সাদা মতন জিনিস। ভীষণ দামি। ব্যস, আর কিছু বলতে পারব না। বলে, সে এক দৌড়ে বনের ভেতরে চলে গেল।
হাটুরেরা পড়ল মহা সমস্যায়। বড়ো সাদা মতন জিনিস, ভীষণ দামি। সেটা কী হতে পারে?
একজন বললে— বুঝেছি। ভীষণ দামি বড়ো সাদা জিনিস মানে কোনো দামি পাথর। হিরেও হতে পারে। তবে কি বনের ভেতরে গুপ্তধনটন লুকোনো আছে আর সবাই মিলে সেটাই খুঁজতে এসেছে? নিশ্চয়ই তাই। তাহলে আমরাই বা বাদ যাই কেন? বনের ভেতরে লুকোনো গুপ্তধন তো যে পাবে তার। চলো, আমরাও আমাদের গাঁয়ের লোকেদের ডেকে আনি।
এই কথা বলামাত্র সবাই মিলে দৌড়ল তাদের গ্রামের দিকে। একটু বাদেই দেখা গেল শীতলদিঘির লোকজন শাবল, কোদাল, খন্তা ইত্যাদি নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে। শালকোঁড়া বনে ঢুকেই তাদের কেউ মাটি কোপাতে শুরু করে দিল, কেউ ঝোপগুলো খোঁচাতে লাগল, আবার কেউ-বা মোটা মোটা গাছগুলো ফাঁপা কি না সেটা বোঝবার জন্য তাদের গায়ে বাঁশ দিয়ে ঢকাং-ঢকাং করে পেটাতে লাগল।
এদিকে হয়েছে কী, শীতলদিঘির দু-জন, পঞ্চানন আর দুলাল, মহেন্দ্রনগরের সৈন্যদলে কাজ করত। সকাল বেলা তারা এল না দেখে সেনাপতি একজন সেপাইকে তাদের বাড়িতে পাঠালেন তাদের খোঁজ করবার জন্য। সে শীতলদিঘিতে এসে দেখে গ্রামের মধ্যিখানে মহিলারা একজোট হয়ে খুব উত্তেজিতভাবে কী যেন আলোচনা করছে। তাদের ভেতর থেকে দুলালের স্ত্রীকে খুঁজে বের করে সে জিজ্ঞাসা করল— দুলাল আজ কাজে যায়নি কেন?
দুলালের স্ত্রী পেট-আলগা মানুষ। সে তড়বড় করে বলল— কেন যাবে? তুমি শোনোনি বুঝি যে শালকোঁড়া বনে গুপ্তধন পাওয়া গেছে? সে ওখানে গেছে সেইসব আনবার জন্য।
—গুপ্তধন পাওয়া গেছে না কি? বলো কী? কীরকম গুপ্তধন?
—আমি তো শুনলুম সেসব বেজায় দামি দামি হিরে-মানিক। এই ধরো, হাঁসের ডিমের মতো মুক্তো, আধলা ইটের মতো চুনি, হাতের তেলোর মতো পান্না, কদবেলের মতো হিরে, আরও কত কী। তাদের একটা পেলেও কাউকে আর সাতপুরুষ করে খেতে হবে না। আমি তো ওঁকে বলেছি যে আমাকে একটা হিরে বসানো বিছেহার গড়িয়ে দিতেই হবে, হ্যাঁ। আমার বলে কত দিনের শখ!
পুরো কথাটা আর শোনা হল না। খানিকটা শুনেই সেপাই বাবাজি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল রাজবাড়ির দিকে।
.
দেখতে-না-দেখতে কথাটা মহেন্দ্রনগরের রাজা প্রচণ্ড সিংহের কানে উঠল। উনি তৎক্ষণাৎ সেনাপতি আর মন্ত্রীমশাইকে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা দু-জনে তখন রাজবাড়ির রান্নাঘরে রাঁধুনিঠাকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে গোপনে ইলিশমাছের ডিমভাজা খাচ্ছিলেন। রাজামশায়ের ডাক পেয়ে প্রবলবেগে মুখ মুছতে মুছতে দৌড়ুলেন অন্তঃপুরের দিকে।
প্রচণ্ড সিংহ অলিন্দে চিন্তিতভাবে পায়চারি করছিলেন। দু-জনে কাছে আসতে নাক কুঁচকে বললেন— আমার রাজ্যে যখন ভয়ংকর সব ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে, তখন আপনারা ইলিশমাছ খাচ্ছেন। লজ্জা করে না আপনাদের?
সেনাপতি বললেন— আজ্ঞে, ইলিশমাছ নয় মহারাজ, আমরা ইলিশমাছের ডিমভাজা খাচ্ছিলুম। ওই, মানে খুব খিদে পেয়েছিল কিনা!
মন্ত্রীমশাই সেনাপতিকে চিমটি কেটে বললেন— তুমি থামো। কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, মহারাজ?
রাজামশাই বললেন— কোথায় থাকেন সবাই? আপনারা কি জানেন, যে শালকোঁড়ার বনে গুপ্তধন বেরিয়েছে?
মন্ত্রীমশাই আর সেনাপতি সমস্বরে বললেন— কই, না তো!
—কোত্থেকে আর জানাবেন! ইলিশমাছের গন্ধ পেলে কী আর আপনাদের কোনো জ্ঞানগম্যি থাকে? যাকগে, সেসব বেরিয়েছে আর অনন্তপুর এবং শীতলদিঘির লোকেরা সেই গুপ্তধন সংগ্রহ করতে বনের ভেতর ঢুকেছে। এ সব কী হচ্ছে? শুনলুম, ওখানে না কি অত্যন্ত মহার্ঘ্য মণিমাণিক্যাদি পাওয়া গেছে; যার এক-একটারই মূল্য লক্ষ স্বর্ণমুদ্রারও বেশি। সেইসব রত্ন ওই গেঁয়ো লোকগুলো ভোগ করবে আর আমি এখানে বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষব?
মন্ত্রীমশাই বললেন— না, না, তা কখনোই হতে দেওয়া যায় না। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না মহারাজ। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
—বটে। তা কী ব্যবস্থা নেবেন?
মন্ত্রীমশাই মাথা চুলকে বললেন— তাই তো। কী ব্যবস্থা নেব? শালকোঁড়া বন তো আমাদের রাজ্যের বাইরে।
রাজামশাই কপাল চাপড়ে বললেন— এই না-হলে আমার মন্ত্রী। শালকোঁড়া বনে যেমন আমার অধিকার নেই তেমনি আর কারুরই তো নেই। এমনকী ওপাশের উপবর্তন রাজ্যেরও নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের ওখানে অভিযান চালাতে কোনো অসুবিধে আছে?
মন্ত্রীমশাই মাথা নেড়ে বললেন— আজ্ঞে না, তা নেই। তবে কি না…
—তবের কথা পরে হবে। আপনি এই মুহূর্তে সৈন্যদল প্রস্তুত করুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শালকোঁড়া বন ঘিরে ফেলতে হবে যাতে কেউ বেরুতে না-পারে।
সেনাপতি মিনমিন করে বললেন— আজ্ঞে ইয়ে হয়েছে, সৈন্যরা সবে দুপুরের ভাতটা খেতে বসেছে। তার ওপরে আজ বড়ি দিয়ে পালংশাকের তরকারি হয়েছিল। এক্ষুনি না-বেরিয়ে বিকেলের দিকে গেলে হত না?
প্রচণ্ড সিংহ প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে বললেন— আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। যা বলছি তাই করুন।
সেই হুংকার শুনে মন্ত্রীমশাই আর সেনাপতি পড়ি কী মরি ছুট লাগালেন।
.
উপবর্তন রাজ্যের রাজা দুর্দান্ত সিংহও ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গেছেন। তিনিও তাঁর মন্ত্রী আর সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন— মহেন্দ্রনগর থেকে আমাদের গুপ্তচর কী খবর পাঠিয়েছে, তা তো আপনারা জানেন। এক্ষুনি সৈন্য সাজান। যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের শালকোঁড়া বনে যেতে হবে। মহেন্দ্রনগরের ওই হতচ্ছাড়া পচা সিঙ্গি শালকোঁড়া বনের ধনভাণ্ডার হাতিয়ে নেওয়ার আগেই আমাদের ওখানে গিয়ে পড়তে হবে।
মন্ত্রীমশাই জিজ্ঞাসা করলেন— আচ্ছা মহারাজ, শালকোঁড়া বনে এত ধনরত্ন এল কোত্থেকে?
রাজামশাই গ্রাম্ভারি চালে বললেন— দেখুন, ওই ধনরত্নের যা বর্ণনা শুনলুম তাতে মনে হয় যে ওসব কোনো সাধারণ লোকের বা ছোটোখাটো রাজাগজার সম্পত্তি নয়। কোনো রাজচক্রবর্তী সম্রাটের কাছেই ওই ধনভাণ্ডার থাকতে পারে।
—কোনো রাজচক্রবর্তী সম্রাটের ধনভাণ্ডার শালকোঁড়া বনে আসতে যাবে কোন দুঃখে, মহারাজ?
—আসতেই পারে। আমার যতদূর জানা আছে, এ ধরনের সম্পদ ছিল পাটলিপুত্রের সম্রাট ধননন্দের কাছে। তাঁর ঐশ্বর্যের কোনো সীমা ছিল না। তাঁর ধনভাণ্ডারে এত স্বর্ণমুদ্রা ছিল যা একজন লোক সারাজীবনেও গুনে উঠতে পারত না। যখন চন্দ্রগুপ্তের কাছে ধননন্দ যুদ্ধে হেরে যান, তখন পালিয়ে যাওয়ার পথে তিনি আর তাঁর পরিজনরা এই অখ্যাত বনে তাঁর ধনরত্নের কিছু অংশ ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এই আশায় লুকিয়ে রেখে থাকতেই পারেন।
—অদ্ভুত, মহারাজ, আশ্চর্য আপনার জ্ঞান আর ধীশক্তি!
দুর্দান্ত সিংহ বললেন— হেঁ হেঁ, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আর তাহলে দেরি করবেন না। আপনারা সৈন্যশিবিরে চলে যান।
.
দুই রাজ্যের সৈন্যদল প্রায় একইসময়ে শালকোঁড়া বনে এসে পৌঁছল। রাজারা আর সেনাপতিরা ঘোড়ার পিঠে, বাকি সৈন্যরা দুপুরের খাওয়াটা না-হওয়ার জন্য ব্যাজার মুখে থপাস-থপাস করতে করতে পেছনে পেছনে এল।
দুর্দান্ত সিংহ বললেন— এ কী, রাজা প্রচণ্ড, তুমি এখানে কী মনে করে?
প্রচণ্ড সিংহ বললেন— আমার রাজ্যের কিছু লোক এই বনে ঢুকেছে। আমি তাদের নিয়ে যেতে এসেছি। কিন্তু, তুমি এখানে এই ভরদুপুরে কোন রাজকার্যে এসেছ?
দুর্দান্ত সিংহ আর ভদ্রতা করতে পারলেন না। বললেন— দ্যাখ পচা, মিথ্যে কথা বলা তোর ছোটোবেলাকার স্বভাব। তুই এসেছিস সম্রাট ধননন্দের সম্পদ হস্তগত করতে। ওই সম্পদ আমার, তুই এর এক কণাও পাওয়ার অধিকারী নোস।
—বটে! ওই যে সম্রাট বললি, তার সম্পত্তি তোর আর তাতে আমার কোনো অধিকার নেই, কেন সেটা জানতে পারি কি?
—অবশ্যই। তার কারণ, সম্রাট ধননন্দ আর অজাতশত্রু আমার পূর্বপুরুষ, সেইজন্য।
—দ্যাখ দেঁতো, তুই আর হাসাসনি। তোর ঊর্দ্ধতন চোদ্দোপুরুষে কেউ অমন বিদঘুটে নামওয়ালা সম্রাট ছিলেন, সেকথা শুনলে আমার বেড়ালটাও মুচ্ছো যাবে। এখন ডেঁপোমি না-করে যা বলছি শোন। শালকোঁড়া বনে যা আছে তা আমার। কারণ, আমার রাজ্যের লোকেরা এখানে প্রথম এসেছে। ব্যস, এর ওপরে আর কোনো কথাই হতে পারে না।
—পচা, এটা ভালো হচ্ছে না বলছি। তুই এখান থেকে যাবি, না তোকে মেরে তাড়াতে হবে।
—দেঁতো, তোর আস্পর্দ্ধা কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, মার না-খেলে তোর বুদ্ধি খোলে না। দেখছি সেই ব্যবস্থাই নিতে হবে।
—ঠিক আছে, তাহলে যুদ্ধই হোক। তাতে যদি রক্তগঙ্গা বয়ে যায়, তাই যাবে।
—ঠিক আছে, যুদ্ধই হোক।
.
কাছেই একটা বটগাছের ছায়ায় এক সন্ন্যাসীঠাকুর নাক ডাকিয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন। গোলমাল শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। হাই তুলতে তুলতে এসে দুই যুযুধান সৈন্যদলের মাঝখানে দাঁড়ালেন। বললেন— কী ব্যাপার? একটা দাঙ্গাহাঙ্গামার গন্ধ পাচ্ছি যেন?
দুই রাজা সমস্বরে বললেন— আপনি সরে যান, ঠাকুরমশাই। আজ ওই হতচ্ছাড়া মিথ্যেবাদীটার মুণ্ডু যদি না-কেটেছি তো কী বলেছি!
সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন— মুণ্ডু কাটা হবে অখন। আগে শুনি এই যুদ্ধবিগ্রহের কারণটা কী?
দুই রাজার মুখে কারণ শুনে সন্ন্যাসীঠাকুর হাসতে শুরু করলেন। বললেন— কে বলেছে তোমাদের যে শালকোঁড়া বনে সম্রাট ধননন্দের সম্পদ লুকোনো আছে?
দুর্দান্ত সিংহ বললেন— মহেন্দ্রনগর থেকে আমার গুপ্তচর খবর পাঠিয়েছে।
শুনে প্রচণ্ড সিংহ রেগে কাঁই। চিৎকার করে বললেন— কী, আমার রাজ্যে তুই গুপ্তচর লাগিয়েছিস? কে সেই হতভাগা? আজ তারই একদিন কী আমারই একদিন!
সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন— সে পরে দেখা যাবে। আগে বলো দেখি, রাজা প্রচণ্ড সিংহ, তোমাকে এহেন সংবাদটি দিলে কে?
প্রচণ্ড সিংহ ব্যাজার মুখে বললেন— খবরটা এনেছে আমাদের এক সৈন্য। শীতলদিঘি গ্রামের এক মহিলার কাছে সে জানতে পারে যে সেই গ্রামের লোকেরা এই বনে এসেছে এক বিশাল গুপ্তধনের খোঁজে। তারা আবার সংবাদটি পায় অনন্তপুর গ্রামের লোকেদের কাছে।
শুনে সন্ন্যাসীঠাকুর হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়লেন। বললেন— এইরকম একটি উড়ো কথার ভিত্তিতে তোমরা দুই রাজা একেবারে সসৈন্যে যুদ্ধ শুরু করতে চলেছ? বাবা, তোমাদের খুরে-খুরে দণ্ডবৎ।
ঠিক এইসময় দেখা গেল অনন্তপুর গ্রামের লোকেরা হইহই করে একটি সাদা গোরু তাড়াতে তাড়াতে আর পেয়েছি পেয়েছি বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বন থেকে বেরিয়ে আসছে। তারা দুই সৈন্যদলকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে থেমে গেল।
তাদের পেছনে পেছনে শীতলদিঘির লোকেরাও বেরিয়ে এল। তারা জিজ্ঞাসা করল— গুপ্তধন পেয়ে গেছ? কই, দেখি।
শুনে অনন্তপুরের লোকেরা অবাক। বলল— গুপ্তধন? কীসের গুপ্তধন? আমরা তো কেষ্টদার গোরু খুঁজতে গিয়েছিলুম।
—সে কী? তোমাদের গোবিন্দচন্দর যে বললে তোমরা ওখানে বড়ো বড়ো হিরে খুঁজতে গিয়েছিল?
গোবিন্দ হাত-পা ছুঁড়ে বলল— কক্ষনো আমি সেকথা বলিনি। আমি শুধু বলেছি যে আমরা একটা বড়ো সাদা মতন ভীষণ দামি জিনিস খুঁজতে যাচ্ছি। তা, কেষ্টজ্যাঠার গোরুটা কি তাই নয়?
এই কথোপকথন শুনে সন্ন্যাসীঠাকুর হাসতে হাসতে শুয়েই পড়লেন। উবুড় হয়ে পড়ে মাটি থাবড়ান আর বললেন— হো-হো, হা-হা, সম্রাট ধননন্দ থেকে একেবারে গোরু! হায়-হায়, হো-হো, হা-হা!
দেখতে-দেখতে তাঁর সাদা দাড়ি ধুলোয় ধূসর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ বাদে হাসি সামলে দাড়ি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সন্ন্যাসীঠাকুর। দুই অধোবদন রাজাকে সম্বোধন করে বললেন— হে রাজন্যগণ, তোমরা এবার বাড়ি যাও। গিয়েই আচ্ছা করে মাথায় হুঁকোর জল ঢেলো আর রোজ ব্রাহ্মীশাক সেদ্ধ করে খেও। এতে আর কিছু না-হোক, তোমাদের ঘটে বুদ্ধি একটু বাড়বে।
প্রচণ্ড সিংহ কোনোরকমে লজ্জিত মুখ তুলে বললেন— বুঝলি দেঁতো, একটু ভুল হয়ে গেছিল। তা সে তো মানুষমাত্রেরই হতে পারে। আমি বলি কী, এখন এক কাজ করা যাক। এতটাই যখন এসেছিস, তখন আর একটু কষ্ট করে আমার বাড়িতে চল। তোর সৈন্যরাও চলুক। সবাই মিলে দুপুরের খাওয়াটা ওখানেই সারা যাবে। তোর রানিবউদিও সেদিন বলছিল যে অনেকদিন দাঁতু ঠাকুরপোকে দেখি না।
দুর্দান্ত সিংহ বললেন— তুই যখন বলছিস তখন তো যেতেই হয়। তোর কথা কি আর কোনোদিন ঠেলতে পেরেছি আমি?
দু-পক্ষের সৈন্যদল এই কথা শুনে সহর্ষে দুই রাজার নামে জয়ধ্বনি দিল।
মৃত্যুঞ্জয় আর জয়ন্ত
কালিন্দী রাজ্যের মহারাজ সুজন সিংহের বরকন্দাজদের প্রধান ছিল মৃত্যুঞ্জয় নায়েক। তার ধ্যানজ্ঞান সব-ই ছিল মহারাজের সেবা করা। আর কোনো দিকেই তার কোনো খেয়াল ছিল না। শহরের একপ্রান্তে তার বাড়ি ছিল। তার স্ত্রী তাদের ছেলে জয়ন্তর জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন, তাই ছেলের দেখাশোনার ভার দূরসম্পর্কের এক বৃদ্ধা বিধবা মাসির ওপর ছেড়ে দিয়ে সে দিনরাত রাজবাড়িতে পড়ে থাকত।
জয়ন্ত তার দশ বছরের জীবনে বাবাকে প্রায় দেখেইনি। তাদের পাড়ায় তার সমবয়সি কোনো বন্ধু ছিল না, তাই সে একা একাই বড়ো হয়ে উঠেছিল। ঘরের কাজ আর পড়াশুনো সেরে জয়ন্ত সারাদিন আপন মনে মাঠে-ঘাটে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, ফুলপাতা তুলে এনে ঘর সাজাত, বৃষ্টিতে ভিজত, রোদে পুড়ত আর পাখিদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইত। আকাশ, বাতাস, গাছপালা আর নদীর জল তার গান শুনত।
আর শুনতেন তার ঠাকুমা। যখন সন্ধে গড়িয়ে রাত আসত, তখন আলো আঁধারি দাওয়ায় বসে তিনি তাঁর নাতির গান শুনতে শুনতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আত্মনিমগ্ন হয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে জয়ন্ত যখন তার বাবার কথা মা-র কথা জিজ্ঞাসা করত, তিনি গোপনে চোখের জল মুছে তার প্রশ্নের উত্তর দিতেন।
কখনো সখনো মৃত্যুঞ্জয় যখন বাড়ি আসত, তখন সে তার মাসিকে বলত— দেখো মাসি, জয়ন্ত যেন জঙ্গলের দিকে না-যায়।
তিনি বলতেন— আমি কি আর তোর ছেলের পেছনে দৌড়ে পারি? তোর ছেলের ভার আর কাউকে দে, বাবা। এই বয়সে আমি আর পারছি না।
মৃত্যুঞ্জয় বলত— হবে, হবে, যথাসময়ে সব হবে; বলে রাজবাড়িতে ফিরে যেত। কিন্তু সেইসময় হবার কোনো লক্ষণই দেখা যেত না।
কালিন্দীর সীমানার মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা মস্তোবড়ো পাহাড়ি জঙ্গল ছিল। সবাই বলত উত্তরের জঙ্গল। একবার একটা ভয়ংকর রাক্ষস সেখানে কোত্থেকে এসে আশ্রয় নিল। জঙ্গলের ধারেকাছে যারা থাকে, তারা মাঝে মাঝে রক্তজলকরা ভীষণ গর্জন শুনতে পায়। তার ফলে, ভয়ের চোটে তারা সূর্যাস্তের আগেই যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে শুরু করে দিল। যারা কাঠ কেটে জীবনধারণ করত, তাদের কাজকর্ম শিকেয় উঠল। একবার কয়েক জন ডাকাবুকো কাঠুরিয়া রাক্ষসটাকে মারতে জঙ্গলের ভেতরে চলে গিয়েছিল। তাদের প্রায় কেউই আর ফিরে আসেনি।
কথাটা রাজামশাইয়ের কানে গেল। তিনি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে যদি কেউ নরখাদক রাক্ষসটাকে মারতে পারে তাহলে সে এক-শো স্বর্ণমুদ্রা পাবে। তাতে অবশ্য লাভ কিছুই হল না।
এই সময়ে রাজামশাইয়ের ছোটোছেলের ভীষণ অসুখ করল। রাজকবিরাজ অনেক ওষুধপত্র দিলেন বটে কিন্তু রাজপুত্রের অসুখ সারা তো দূরস্থান, বরং বেড়েই যেতে লাগল। শেষপর্যন্ত তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। বললেন— আর আমার কিছু করবার নেই। মনে হচ্ছে, রাজপুত্রের আয়ু আর সাতদিনের বেশি নেই।
রাজবাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। মহারানি মৃত্যুঞ্জয়কে ডেকে বললেন— তুমি একবার আমার বাপের বাড়ি পুষ্পিতনগরে যেতে পারবে? সেখানে মহর্ষিকে রাজপুত্রের অসুখের কথা সবিস্তারে বলবে, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এই ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধারের কোনো পথ বলে দিতে পারবেন। তবে, সময় তো আর বেশি নেই আর মহর্ষি যা বিধান দেবেন তার ব্যবস্থা করতে যে কতদিন লাগবে তা তো জানি না। তাই তোমাকে দু-দিনের মধ্যে ফিরে আসতেই হবে। অনেকটা পথ, কাজেই কোথাও দেরি করলে চলবে না। আমি তোমাকে চিনি, মৃত্যুঞ্জয়। আমি জানি, একমাত্র তুমিই একাজ করতে পারবে।
মৃত্যুঞ্জয় বলল— নিশ্চয়ই পারব, মহারানি। আপনি শুধু মহারাজকে বলুন তাঁর নিজের ঘোড়া মাতরিশ্বাকে আমায় দিতে। আমি ঠিক দু-দিনের মধ্যে আপনাকে সংবাদ এনে দেব।
মহারাজ এই প্রস্তাবে সানন্দে সম্মত হলেন। সেইদিনই মৃত্যুঞ্জয়কে পিঠে নিয়ে মাতরিশ্বা প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলে গেল পুষ্পিতনগরের দিকে।
দু-দিন শেষ হবার আগেই ফিরে এল মৃত্যুঞ্জয়। তার সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত, মাতরিশ্বার মুখ দিয়ে যেন ফেনা উঠছে। রাজামশাই তাকে বিশ্রাম নিতে বললেন; কিন্তু কথা না-শুনে সে ছুটতে ছুটতে চলে গেল মহারানির কাছে।
মৃত্যুঞ্জয় বলল যে মহর্ষির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। তিনি বলেছেন রাজপুত্রের অসুখের একটাই ওষুধ আছে। উত্তরের জঙ্গলের গভীরে একটি অতি প্রাচীন মহাকালের মন্দির আছে। কে যে সেটা বানিয়েছিল তা কেউ জানে না। বহু বছর ধরে সেটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। সেই মন্দিরে যাওয়ার পথটিও অত্যন্ত দুর্গম। তাই, কেউ সেখানে যায় না। একপাশে একটা অত্যন্ত দুর্লভ আকাশপদ্মের গাছ আছে। রোজ সকালে তার একটি ফুল মহাকালের পায়ের কাছে পড়ে। সেই ফুল এনে রাজপুত্রের মাথায় ঠেকালে তার অসুখ সেরে যাবে।
মহারাজ তাঁর রাজ্যের সমস্ত শিকারিদের ডেকে পাঠালেন। দেখা গেল তারা কেউ সেই মন্দিরের হদিশ জানে না, বা জানলেও না-জানার ভান করছে। তখন ডাকা হল কাঠুরিয়াদের। তাদের মধ্যে কেবল একজনই একটা পাহাড়ের ওপর থেকে মন্দিরটা দেখছে। তার নাম কানাই। কিন্তু সে যা বলল তা শুনে রাজামশাই অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।
কানাই বলল সে মন্দিরে যাবার পথটা যে কেবল দুর্গম তাই নয়, সেটা গেছে একটা অন্ধকার গুহার ভেতর দিয়ে। সেই গুহার ভেতরেই রাক্ষসটা থাকে। সেটা অতিকায়, অত্যন্ত হিংস্র, প্রচণ্ড শক্তিশালী আর অসম্ভব ধূর্ত। কাঠুরিয়াদের যে দলটি রাক্ষসটাকে মারতে গিয়েছিল, কানাই ছিল সেই দলে। তাকে তারা সবাই মিলে আক্রমণ করেছিল। তাদের সম্মিলিত কুঠারের আঘাতে তার তো কিছুই হল না, বরং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে সমস্ত দলটাকে মেরে ফেলল। একমাত্র কানাই পালিয়ে আসতে পেরেছিল। মহারাজ তাঁর সমস্ত সৈন্যদলও যদি পাঠান, তাহলেও কিন্তু রাক্ষসটা তাদের একজনকেও গুহা পার হতে দেবে না। আর, ওই পথ ছাড়া মন্দিরের কাছে পৌঁছনোর আর কোনো রাস্তাও নেই। পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়া হয়তো যায়, কিন্তু তাতে অনেক দিন লেগে যাবে।
রাজামশাই অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। অনেকে অনেক প্রস্তাব দিলেন কিন্তু তার একটাও তাঁর পছন্দ হল না। শেষপর্যন্ত মৃত্যুঞ্জয় বলল— মহারাজ, আপনি আর একবার মাতরিশ্বাকে আমায় দিন। আমি আবার মহর্ষির কাছে যাই। তিনি নিশ্চয়ই রাক্ষসটাকে মারার কোনো উপায় বলে দিতে পারবেন। আর তো মোটে পাঁচদিন আছে। আমি ঘুরে এসে তিনি যা করতে বলবেন, তা নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও করবার ব্যবস্থা করে ফেলব।
মহারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন— ঠিক আছে, তাই করো।
দু-দিন পরে মৃত্যুঞ্জয় ফিরে এল। তার বিষণ্ণ মুখ দেখে রাজামশাই উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— খবর কী মৃত্যুঞ্জয়?
মৃত্যুঞ্জয় বলল— খবর ভালো নয়, মহারাজ। মহর্ষি বলেছেন যে রাক্ষসটাকে মারার একটাই উপায় আছে; কিন্তু সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
—কী সেই উপায়?
—মহর্ষি বলেছেন যে ওই ধরনের রাক্ষসদের একটাই দুর্বলতা। তারা গান শুনলে জেগে থাকতে পারে না, ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু, সে গানে কোনোরকম ভুলভাল থাকলে চলবে না। যদি সুর ভুল হয় বা ছন্দপতন ঘটে, তাহলে সে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।
—বলো কী! এ তো ভয়ানক দুঃসংবাদ। আমার সভা গায়করা সবাই তো ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যায়, ল্যাগব্যাগ করে হাঁটে আর বেড়াল দেখলে ভয় পায়। তারা কখনো রাক্ষসের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারবে? যাকেই এরকম গান গাইবার কথা বলব, সে তো ভয়েই মরে যাবে।
—আমি তা জানি মহারাজ। কিন্তু, ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমি কাল ভোর না-হতেই উত্তরের জঙ্গলে যাব। রাক্ষসটাকে এড়িয়ে মন্দিরে পৌঁছোনোর একটা-না-একটা পথ বের করবই। যদি দেখি যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাহলে রাক্ষসটাকে সরাসরি আক্রমণ করব। সে হয়তো তার প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে আমার ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পেরে উঠবে না। আমি একাই যাব যাতে নিঃশব্দে কাজ সারতে পারি।
—সে কিন্তু ভীষণ ধূর্ত। তুমি কি বুঝতে পারছ যে তুমি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছ?
—ধূর্ততায় আমিও কিন্তু কম যাই না, মহারাজ। একটা জংলি রাক্ষসের কাছে বুদ্ধির লড়াই-এ আমি হেরে যাব না। আর, আপনি তো জানেন, আমার মৃত্যু ভয় বলে কিছু নেই।
রাজামশাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন। মৃত্যুঞ্জয় বলল— তাহলে অনুমতি করুন, এখন আমি বাড়ি যাই। আমার মাসি আর ছেলেটাকে একবার দেখে যাই, আমার তিনকুলে শুধু ওই দু-জনই আছে। হয়তো তাদের আর দেখতে পাব না। একটা অনুরোধ, আমি যদি ফিরে না-আসি, তারা যেন একেবারে অর্ধাহারে না থাকে।
রাজামশাই ম্লান হেসে বললেন— তুমি না বললেও তাদের সমস্ত ভারই আমি নিতুম, মৃত্যুঞ্জয়।
অসময়ে মৃত্যুঞ্জয়কে বাড়ি আসতে দেখে তার মাসি খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সবকথা শুনে তিনি নীরবে অশ্রুবিসর্জন করতে লাগলেন। ঠিক তখনই জয়ন্ত এসে বাড়িতে ঢুকল। ঠাকুমাকে কাঁদতে দেখে আর বাবাকে বাড়িতে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। চোখ পাকিয়ে বাবাকে বলল— তুমি ঠাকুমাকে বকেছ?
মৃত্যুঞ্জয় জয়ন্তকে কোলে নিয়ে বলল— না বাবা। আমি কাল ভোর বেলা একটা কাজে যাচ্ছি, হয়তো ফিরতে দেরি হবে। তাই তোর ঠাকুমা কাঁদছেন।
জয়ন্ত বলল— আমি সব শুনেছি, বাবা। তুমি রাক্ষস মারতে যাচ্ছ। কালিন্দীর সব্বাই এই কথা আলোচনা করছে। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল— তুই যাবি কী করে? বাচ্চারা কি রাক্ষস মারতে পারে? তোকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আমার কি সুবিধে হবে, বল? রাক্ষসটা যখন আসবে তখন তোকে বাঁচাব না-সেটার সঙ্গে লড়াই করব?
—ওই রাক্ষসটাকে তুমিও মারতে পারবে না, বাবা। কিন্তু, আমি গেলে তুমি ঠিক একটা আকাশপদ্ম নিয়ে আসতে পারবে।
—বটে? কী করে সেটা সম্ভব হবে?
—প্রথমত খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে ওখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আমি রাক্ষসের গুহাটা চিনি। অনেক বার গিয়েছি ওখানে। আগে ওখানে দুটো ভালুক তাদের দুটো বাচ্চা নিয়ে থাকত। তারা আমার বন্ধু ছিল। রাক্ষসটা এসে তাদের সবাইকে মেরে ফেলে গুহাটা দখল করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত আমি রাক্ষসটার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইব। সেই গান শুনে রাক্ষসটা ঘুমিয়ে পড়বে আর তুমি চট করে গিয়ে ফুলটা নিয়ে আসবে।
—তুই গান গাইতে পারিস?
—পারি, বাবা। ভালোই পারি। তুমি ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখো।
একথা বলামাত্র ঠাকুমা হাহাকার করে উঠলেন। বললেন— না-না, ও একদম গান গাইতে পারে না। হায় ভগবান, এ রাজ্যে কী একজনও গাইয়ে নেই? এই দুধের শিশুটাকেই ওখানে যেতে হবে?
জয়ন্ত বলল— আমি দুধের শিশু নই, ঠাকুমা। আমি বড়ো হয়ে গেছি। তুমি কি বুঝতে পারছ না যে ওই রাক্ষসটাকে মারবার জন্য বাবাকে সবরকমভাবে সাহায্য করা আমার কর্তব্য? সে যে আমার বন্ধুদের অকারণে মেরে ফেলেছে। আমি তার প্রতিশোধ যদি সুযোগ পেয়েও না-নিয়ে ভয়ের চোটে ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে থাকি, তবে আমি আরও বড়ো হয়ে বাবার মতো সৈনিক হবার যোগ্য হব কী করে? আমি বাবার সঙ্গে যাবই আর ফুল নিয়ে ফিরেও আসব। তুমি কান্নাকাটি কোরো না।
জয়ন্তর কথা শুনে মৃত্যুঞ্জয়ের চোখে জল এল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল— ওই ভয়ংকর রাক্ষসটাকে আসতে দেখলে তুই তো ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যাবি।
—কক্ষনো না। আমার বন্ধুদের কথা যখন ভাবব, তখন কোনো ভয় থাকবে না। তা ছাড়া আমি দূর থেকে রাক্ষসটাকে দেখেছি। আমার ভয় করেনি।
অনেক তর্কবিতর্ক হল, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় কিছুতেই ছেলেকে টলাতে পারল না। জীবনে এই প্রথম তাকে হার স্বীকার করতে হল।
.
ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই মৃত্যুঞ্জয় জয়ন্তকে নিয়ে উত্তরের জঙ্গলের দিকে রওনা হল। সঙ্গে নিল অস্ত্রশস্ত্র, পাহাড়ে চড়ার জন্য দড়ি ইত্যাদি। ওরা যখন রাক্ষসের গুহার সামনে এসে পৌঁছল, তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। কাছাকাছি আসতেই, রাক্ষসটা হামাগুড়ি দিয়ে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তাকে দেখে জয়ন্ত দাঁড়িয়ে পড়ে স্থির হয়ে গান গাইতে শুরু করে দিল। এ গান সে শিখেছে পাখিদের কাছে, গাছের পাতার মর্মরশব্দে, ঝরনার ঝরঝর আওয়াজে। স্তম্ভিত মৃত্যুঞ্জয় রোমাঞ্চিত হয়ে সেই গান শুনতে লাগল।
রাক্ষসটা হুংকার করে তার অতিকায় শরীর নিয়ে হুড়মুড় করে ছুটে আসছিল; কিন্তু জয়ন্তর গান শুনে তার গতি ক্রমশ কমে আসতে লাগল। রাগে বিকৃত তার কদাকার মুখটা আস্তে আস্তে কেমন যেন শান্ত হয়ে এল। তার চোখদুটো ঢুলঢুল হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত জয়ন্তর প্রায় পায়ের কাছে এসে মাটিতে শুয়ে পড়ে হাসিহাসি মুখে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে শুরু করে দিল।
জয়ন্ত গান থামাল না, হাতের ইশারায় মৃত্যুঞ্জয়কে ফুল আনতে যেতে বলল। মৃত্যুঞ্জয় একদৌড়ে গুহার ভেতরে ঢুকে গেল আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আকাশপদ্মের অপূর্ব একটা ফুল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ফুলটা ছেলের হাতে দিয়ে পাহাড়ে চড়ার দড়ি দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় রাক্ষসটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল, যাতে গান থামার পরে তার উঠে দাঁড়াতে একটু সময় লাগে আর এই সময়ের মধ্যেই তারা যাতে যত দূরে সম্ভব পালিয়ে যেতে পারে। রাক্ষসটা কিন্তু একটুও বাধা দিল না। জয়ন্তর গান চলতে থাকল আর সে ঘুমিয়েই রইল।
.
এদিকে মৃত্যুঞ্জয়কে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে রাজামশাই আর রানিমা সারারাত ঘুমোতে পারেননি। মনের কষ্টে আর বিবেকের দংশনে দু-জনে ছটফট করেছেন। কাজেই, ভোর হওয়ামাত্র রাজামশাই সসৈন্যে মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে সবাই মিলে উত্তরের জঙ্গলে যাবেন, কিন্তু এসে যা শুনলেন তাতে তো রাজামশাই স্তম্ভিত। তার মাসিকে বললেন— আপনি ভাববেন না। আমরা যাচ্ছি, আপনার বোনপো আর নাতিকে উদ্ধার করে আনবই। তারপরে, একটা ওইটুকু বাচ্চা ছেলেকে অমন বিপদের মুখে নিয়ে যাবার জন্য মৃত্যুঞ্জয়কে খুব শাস্তি দেব।
মাসি বললেন— না, না, মৃত্যুঞ্জয় ওকে নিয়ে যেতে চায়নি। অনেক বাধা দিয়েছিল। কিন্তু আমার নাতি কোনো কথাই শোনেনি।
—সে দেখা যাবে। বলে, রাজামশাই ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর পেছনে পেছনে গেল তাঁর সৈন্যদল।
রাক্ষসের গুহাটার কাছাকাছি আসতেই, রাজামশাই একটা অপূর্ব গান শুনতে পেলেন। তিনি ইশারায় সৈন্যদের কোনোরকম শব্দ করতে বারণ করে ঘোড়া থেকে নেমে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, ফুল হাতে নিয়ে জয়ন্ত নির্ভীক গলায় গান গাইছে আর মৃত্যুঞ্জয় দড়ি দিয়ে রাক্ষসটাকে বেঁধে ফেলছে।
বাঁধা যখন হয়ে গেল, রাজামশাই নিঃশব্দে সৈন্যদের নিয়ে এগিয়ে এলেন। ইশারায় জয়ন্তকে গান চালিয়ে যেতে বললেন আর ওইভাবেই সৈন্যদের বললেন, রাক্ষসটাকে কাছেই একটা খাদের কাছে টেনে নিয়ে যেতে। খাদটা অত্যন্ত গভীর, অনেক নীচে বয়ে যাওয়া বিশাল নীলাম্বরী নদীটিকে সূর্যের আলোয় একটা চকচকে সরু রুপোলি সুতো বলে মনে হচ্ছিল।
রাজামশাইয়ের আদেশে সৈন্যরা সবাই মিলে রাক্ষসটাকে ছুড়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিল।
.
বাবার কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরছিল জয়ন্ত। বলছিল— জানো তো বাবা, রাজামশাই বললেন যে আমি বড়ো হলে তিনি আমাকে তাঁর দেহরক্ষী সৈন্যদলে ভরতি করে নেবেন। আমার কিন্তু এখনই বড়ো হয়ে গেছি বলে মনে হচ্ছে। এখান থেকে আমি কত দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। তুমি যখন রাজবাড়িতে চলে যাবে, আর আমি কষ্ট পাব না। আমি কেবল নিজেকে তোমার মতো বীর সৈনিক হবার জন্য তৈরি করব।
মৃত্যুঞ্জয় জয়ন্তর পা দুটো শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল— না বাবা, আর আমি তোমাকে কষ্ট দেব না। এখন থেকে আমি রোজ বাড়ি চলে আসব আর রাত্রি বেলা তোমার গান শুনব।
স্বর্ণরেণুর স্বয়ংবর
রাজকন্যা স্বর্ণরেণু সকাল বেলা চিন্তিত আর বিষণ্ণ মুখে রাজবাড়ির বাগানে পায়চারি করছিল আর মাঝে মাঝে এক একটা ফুলগাছ থেকে ফুল তুলে তার পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলছিল। তার মুখ দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছিল যে সে কোনো কারণে মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছে।
এইসময় সেনাপতি প্রদ্যুম্ন বাগানের পাশ দিয়ে রাজবাড়িতে যাচ্ছিলেন। প্রদ্যুম্নের বয়েস বেশি নয় কিন্তু বীরত্ব, সাহস আর তীক্ষ্ন বুদ্ধির জন্যে তাঁর খুব সুনাম। তাঁর বাবা দুর্মদ সিংহও ছিলেন মহাবীর আর এ রাজ্যের সেনাপতি। তিনি রাজামশায়ের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। সেইজন্য দুর্মদ সিংহ অবসর নিলে, রাজামশাই প্রদ্যুম্নকেই সেনাপতি পদে বরণ করে নিয়েছেন।
স্বর্ণরেণুকে দেখে প্রদ্যুম্ন দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন— কী রে রেণু, এই সাতসকালে এমন হাঁড়িপানা মুখ করে আছিস কেন রে? রানিমা বকেছেন, না কাল একগাদা কুল খেয়েছিস, তাই পেট কামড়াচ্ছে? নইলে, চারদিকে এত ফুল ফুটেছে, পাখি-টাখি ডাকছে, এখন তো তোর চিত্ত প্রফুল্ল হবার কথা।
রাজকন্যা চোখ পাকিয়ে বললেন— তুমি থামো-তো প্রদ্যুম্নদা। পাখি কেন, হাতি ডাকলেও আমার চিত্ত আর কোনোদিন প্রফুল্ল হবে না, বুঝলে?
—বটে? তবে তো ব্যাপার খুব গুরুতর বলে মনে হচ্ছে। কী হয়েছে বলবি?
স্বর্ণরেণু কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে— দেখো না, প্রদ্যুম্ন দাদা, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।
প্রদ্যুম্ন পুলকিত হয়ে বললেন— সে তো খুব ভালো কথা রে। তোর নিশ্চয়ই কোনো রাজার সঙ্গে বিয়ে হবে। ব্যস, অমনি তুই রাজকন্যে থেকে একলাফে রাজরানি হয়ে যাবি। তখন আর সারাদিন আমাদের রানিমার কথামতো চলতে হবে না, এই ঠান্ডায় সকাল-সন্ধে চন্দন মেখে পদ্ম ফুলের পাপড়ি ভেজানো জলে চান করতে হবে না, যত খুশি কুল আর লঙ্কার আচার খেতে পারবি। আর তোর বিয়েতে আমরাও কবজি ডুবিয়ে খাব। আর চারদিন নেমন্তন্ন তো হবেই বল, তাই না? অনেক দিন রাজবাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়া হয়নি।
—তুমি চুপ করবে? তোমার খালি খাওয়ার চিন্তা। তুমি জানো, কার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চলছে? চূড়ামণি রাজ্যের রাজা গজগোবিন্দ সিংহের সঙ্গে। মা কাল থেকে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।
এইবার প্রদ্যুম্নের হাসি শুকিয়ে গেল। বললেন— গজগোবিন্দ? বলিস কী রে? সে ব্যাটার তো তিনটে রানি বর্তমান; আরও একটা চাই? লোকটার ধামার মতো পেট, মুখ ভরতি জঙ্গুলে দাড়িগোঁফ, বয়েসের কোনো গাছপাথর নেই, তার সঙ্গে তোর বিয়ে? কী হয়েছে আমাদের রাজামশায়ের?
—কী হয়েছে? বলিদান দিচ্ছেন মেয়েকে, বলিদান! তাঁর কাছে প্রজাদের মঙ্গল মেয়ের মঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি বড়ো।
—খুলে বল।
—গজগোবিন্দ বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বলেছে বিয়ে না-দিলে সসৈন্যে এসে আমাদের রাজ্য ছারখার করে দেবে।
শুনে প্রদ্যুম্ন অট্টহাসি হেসে উঠলেন। বললেন— গজার সৈন্যেরা আমাদের রাজ্য ছারখার করে দেবে? সেদিন তো সূর্য সন্ধে বেলা পশ্চিম দিকে উঠবে। অন্য কেউ না-হোক, ওরা আমাদের আক্রমণ করলে হেরে ভূত হয়ে তো যাবেই, ওদের একজনও চূড়ামণিতে হেঁটে ফিরে যাবে না, হামাগুড়ি দিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত দেখবি গজাব্যাটা রাজামশায়ের শোবার ঘর ঝাঁট দিচ্ছে।
—তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?
—নিশ্চিত হব না? ওদের সেনাপতি কে জানিস? আমাদের উত্তর দিকে একটা রাজ্য আছে, তার নাম কাঞ্চনপুরী। তার রাজার ছোটো ভাইয়ের ছেলে, নাম অচলাদ্রি। একেবারে সার্থকনামা। পাহাড়ের মতোই অচল, ওকে নড়ায় কার সাধ্যি। ওর দিদিই তো গজার মেজোরানি। যেমন রাজা তার তেমনি সেনাপতি। ওকে তোর মনে নেই?
—না তো। কে অচলাদ্রি?
—তোর অবশ্যি মনে না থাকারই কথা। তুই যে বছর থেকে তপোবন গুরুগৃহে যেতে শুরু করলি, আমি আর অচল তো সেই বছরেই কৌশাম্বীতে চলে গেলুম যুদ্ধবিদ্যা শিখতে। অচল ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গবেট, হাঁদাস্য হাঁদা। চার বছরেও কোদণ্ড আর কার্মুকের পার্থক্যই শিখে উঠতে পারল না। একটা পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। ওকে দেখলেই আমাদের গুরুমশায়ের শিখা খাড়া হয়ে যেত, চোখ লাল করে চিৎকার করতে শুরু করতেন। শেষপর্যন্ত আর পারলেন না, ওকে বিদ্যাশ্রম থেকে বেরই করে দিলেন। তখন দিদিকে ধরে গজার সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি হয়ে গেল। ও একটা অস্ত্রই চালাতে পারে, সেটা হল বাঁটুল বা গুলতি।
স্বর্ণরেণু চিন্তিত হয়ে বলল— কিন্তু বাবা বোধ হয় এসব কথা জানেন না। তুমি একবার ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখো-না, প্রদ্যুম্ন দাদা। উনি তোমার কথা খুব মানেন। পারলে তুমিই পারবে। তোমার মনে নেই, ছেলেবেলায় তুমি আমার নাগালের বাইরে থাকা আম বা পেয়ারা পেড়ে দিতে? সেই রকম।
প্রদ্যুম্ন বললেন— রাজামশায়ের সঙ্গে আমি এখনই গিয়ে কথা বলছি। তুই এখানেই থাক, আমি এসে তোকে কথাবার্তা কী হল তা জানাচ্ছি।
.
বেশ কিছুক্ষণ বাদে প্রদ্যুম্ন রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। উদবিগ্ন স্বর্ণরেণু এগিয়ে এসে বলল— কী কথা হল, প্রদ্যুম্ন দাদা? তোমাকে এমন গম্ভীর আর চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
প্রদ্যুম্ন বললেন— দ্যাখ, ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলুম তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর। ঘটনাটা হল, গজা রাজামশায়ের কাছে তুই যেমন বলেছিলি সেরকমই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তুই তো জানিস, আমাদের রাজামশাই যেমন মহাবীর আবার তেমনি দয়ালু আর শান্তিপ্রিয় মানুষ। উনি যুদ্ধ একেবারেই পছন্দ করেন না বরং ঘৃণা করেন। তাই উনি ভাবলেন তুই স্বয়ংবরা হতে চাস বললে গজা পেছিয়ে যাবে আর কোনো গণ্ডগোল হবে না। কারণ, ও অন্তত এটুকু বোঝে যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের রাজকন্যা ওর গলায় স্বেচ্ছায় মালা দেবে না। কিন্তু, সেই প্রস্তাবটা শোনার পরে এখন ও একটা নতুন চাল চেলে বসেছে। ও বলে পাঠিয়েছে যে ওর কাছে না কি একটা ধনু আছে যেটা ও ছাড়া আর কেউ তুলতে পারে না। ওই ধনুটা না কি রাবণ রাজার ধনু। রাম-রাবণের যুদ্ধের পর সেটা বিভীষণের হাতে যায়। বিভীষণ সেটা নিয়ে হিমালয়ে চলে যান তপস্যা করতে। গজা যখন হিমালয়ে গিয়েছিল তীর্থ করতে তখন সেখানে ওর সঙ্গে বিভীষণের দেখা হয়। তা, বিভীষণ না কি গজাকে দেখে এতই পছন্দ করে ফেলেন যে তাকে ধনুটা উপহার দিয়ে দেন।
—বাবা এই আষাঢ়ে গল্পটা বিশ্বাস করলেন? এতদিন ধরে বিভীষণ টিকে থাকতে পারেন কখনো?
—শাস্ত্রমতে কিন্তু থাকবারই কথা। রামচন্দ্রের বরে বিভীষণ তো অমর। কাজেই তাঁর সঙ্গে দেখা তো হতেই পারে। আর তাঁর তো গজাকে পছন্দ হবেই। ওকে দেখে তাঁর নিশ্চয়ই দাদার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, অমন রাক্ষুসে চেহারা তো মানুষের মধ্যে সচরাচর নজরে পড়ে না। তাই ভালোবেসে দাদার ধনুটা ওকেই দিয়ে দিয়েছেন।
—তোমার রসিকতা রাখো তো। এই ধনুর সঙ্গে স্বয়ংবরের কী সম্পর্ক?
—গজা বলেছে যে স্বয়ংবর হোক, কিন্তু তাতে একটা শর্ত থাকতে হবে। ওই ধনু নিয়ে গজা এখানে আসবে। স্বয়ংবর সভায় যে ওই ধনু তুলতে পারবে, তোকে তার গলায় মালা দিতে হবে। অনেকটা সীতার স্বয়ংবরের মতন আর কী! বোঝাই যাচ্ছে, ওটা গজা ছাড়া আর কেউ তুলতে পারবে না। তাহলে স্বয়ংবর সভায় তোকে ওর গলায় মালা দিতেই হবে আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও প্রমাণ হবে যে ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী লোক হল রাজা গজগোবিন্দ।
—তুমি বাবাকে ওই রাজাটির সৈন্যদল আর তার সেনাপতির কথা বলোনি?
প্রদ্যুম্ন হাত নেড়ে বললেন— বলিনি আবার? কিন্তু রাজামশাই কিছুতেই যুদ্ধ করতে রাজি নন। বললেন, যুদ্ধে হার-জিত যারই হোক না-কেন, কিছু সৈন্যের তো মৃত্যু হবেই। আমার ব্যক্তিগত সমস্যায় তারা কেন প্রাণ দেবে? তাদের পরিবার পরিজনকে আমি কী সান্ত্বনা দেব? তারা যে আমার প্রজা, আমার সন্তান। আমার মেয়ের সুখের জন্যে আমি এতজনের সুখ আর আনন্দ সারা জীবনের মতো কেড়ে নিতে পারি? ভারতবর্ষের কত রাজারই তো একাধিক স্ত্রী। তাঁরা সবাই যদি সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন তো আমার মেয়ে পারবে না কেন? কী জানিস রেণু, তোর বাবার কথা শুনতে শুনতে আমার তাঁর ওপরে রাগ আর শ্রদ্ধা দুটোই হচ্ছিল। আমি সৈনিক, যুদ্ধই আমার পেশা। তাই, যুদ্ধ যে কী একটা অর্থহীন জঘন্য ব্যাপার তা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। তাই, ওঁর কথা শুনতে শুনতে আমার মন শ্রদ্ধায় ভরে যাচ্ছিল। তবু রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে, এ যুগে তোর বাবার মতো একজন নির্লোভ আদর্শবান মানুষ জন্মান কেন? ওঁর কথায় আমাদের নিজেদের খুব খারাপ ধরনের অমানুষ বলে মনে হচ্ছিল।
—তাহলে কী হবে, প্রদ্যুম্ন দাদা?
—কী আবার হবে? স্বয়ংবর হবে।
স্বর্ণরেণু চেঁচিয়ে উঠল— স্বয়ংবর হবে? তার মানে আমাকে ওই রাক্ষসটাকে বিয়ে করতে হবে?
প্রদ্যুম্ন আবার হাত নেড়ে বললেন— আহা, স্বয়ংবর হবে মানেই যে তোকে গজাকে বিয়ে করতে হবে তা তো নয়।
—কী বলতে চাইছ তুমি?
—শোন, এই ধনু-তোলা ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা চালাকি আছে, সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। গজা আর যাই হোক রামচন্দ্র নয়। যে ধনু কেউ তুলতে পারে না, সেটা ও তুলবে, একথা আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করব না। ওর বিশাল ভুঁড়ি দেখলে কেউ তা করবেও না। আমি স্বয়ংবর সভায় ওর সেই মিথ্যাচারটা ধরে ফেলতে পারব বলে মনে করি। গজা এমন বুদ্ধিমান নয় যে, ওর কূটকৌশল আমি ধরতে পারব না। তাহলে ওর বিবাহ করার আশা তো যাবেই, নাকটা মাটিতে ঘষে যাবে সমস্ত রাজাদের সামনে।
—ব্যাপারটা তো ইন্দ্রজালও হতে পারে, কিংবা মন্ত্রশক্তি? সেক্ষেত্রে তুমি কিছু করতে পারবে কী?
—চুপ কর। আজকের যুগে ওসব ইন্দ্রজাল বা মন্ত্রশক্তিতে কেউ আবার বিশ্বাস করে না কি? ওসব মানুষের তৈরি ধাঁধা, লোক ঠকানোর জন্যে। এ ব্যাপারে আমি চার্বাক ঋষিদের কথাই মেনে চলি। তুই চুপচাপ থাক-তো। দেখ না, যদি রহস্যটা ধরতে নাও পারি, এমন একটা গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দেব যে সব ভেস্তে যাবে। তারপরে কী হয়, সেটা তখন দেখা যাবে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিলেই হবে।
—এরকম গণ্ডগোল বাবা পছন্দ করবেন কি? উনি কিন্তু অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হবেন।
—মনে হয় না। ওঁর মুখ দেখলে সন্দেহ থাকে না যে উনিও মনে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। এরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলে উনি যতটা অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত ততটা হয়তো হবেন না। তুই যাই বলিস না কেন, নিজের নীতিবোধের কাছে আসলে উনি নিজেকেই বলি দিচ্ছেন। সেটা তুই বুঝতে পারছিস না। সত্যি, আশ্চর্য মানুষ এই আমাদের রাজামশাই।
—আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে, প্রদ্যুম্ন দাদা।
—আবার বলে ভয় করছে। বলেছি না যে ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দে। তোকে আম আর পেয়ারা পেড়ে দিয়েছি আর এই কাজটা করতে পারব না?
.
স্বয়ংবরের দিন এসে গেল। রাজধানী পতাকা আর ফুলের স্তবকে সাজানো হয়েছে। পথগুলি জল দিয়ে ধোয়া হয়েছে, তার ওপরে ফুল ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাশ্রমগুলিতে অনধ্যয়ন বা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছেলে মেয়েরা বাসন্তী আর লাল রঙের কাপড় পড়ে, মাথায় নানা রকমের ফুলের অলংকার পরে হো হো করছে। স্বয়ংবর সভার জন্যে রাজবাড়ির পাশেই সুদৃশ্য বিশাল মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। সেখানে ভোর না-হতেই উৎসবের সংগীত বেজে উঠেছে। রাজপথের দু-ধারে শিরস্ত্রাণ পরে সৈন্যদল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভ্যাগত রাজাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে। তাঁদের দেখবার জন্যে রাজপথের দু-ধারে সমস্ত বাড়ির ছাদে ভিড় করে উত্তেজিত পুর নারীরা কলরব করছেন।
একটু পরেই ডঙ্কা আর শিঙ্গা বেজে উঠল। রাজাদের ফুল আর পতাকায় সাজানো রথগুলি একের পর এক রাজপথে এসে ঢুকল। প্রত্যেক রাজার রথ ঘিরে পায়ে পা মিলিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত শূলধারী দেহরক্ষীদল সগর্বে এগিয়ে এল। তাদের আগে আগে খোলা তলোয়ার হাতে প্রধান দেহরক্ষী চিৎকার করে তার রাজার নাম আর গুণাবলি ঘোষণা করতে করতে চলল। যেমন— সুপর্ণ রাজ্যের মহারাজ মহাবীর জয়লক্ষ্মীর বরপুত্র মহাধনুর্ধর মহারথ পরমকান্তিমান শ্রীমান ক্ষেমধর্মা আসছে-এ-এন। রথগুলি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে বাড়িগুলির ছাদে ছাদে কোন রাজার ভাগ্যে বরমাল্য জুটতে পারে, তাই নিয়ে পুর নারীদের প্রবল আলোচনা চলতে লাগল।
সবশেষে এল চূড়ামণি রাজ্যের রাজা গজগোবিন্দের রথ। রথের ভেতরে সুখাসনে বসে তিনি খুব অহংকৃত মুখে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলেন বটে, কিন্তু তাঁকে দেখে নাগরিকদের আলোচনাটা কেমন যেন থিতিয়ে গেল।
গজগোবিন্দের রথের পেছনে পেছনে এল একটা গোরুর গাড়ি। তার ওপরে রাখা মস্ত একটি জটিল কারুকার্য করা কাঠের পেটিকা। সেটার মধ্যেই না কি রাবণ রাজার ধনুটা থাকে। এসেছে চূড়ামণি থেকে রাজা গজগোবিন্দের সঙ্গে। ওটা কখনো কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না, তবে এখন স্বয়ংবর উপলক্ষ্যে সবাইকে দেখাবার জন্যে সেটা পেটিকাটার ওপরে রাখা আছে।
পেটিকাটি লম্বায় প্রায় পাঁচহাত, চওড়ায় আর উচ্চতায় দু-হাত। তার ওপরে পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা আছে একটি ধনু। সেটি লম্বায় চারহাত, মাঝখানে যেটা মুষ্টি বা ধরবার জায়গা সেটা কালো শিঙের, বাকিটা সাদা কাঠের। ধনুটা কিন্তু খুবই সাধারণ, দেখলে নতুন বলেই মনে হয়, পুরাকালের বলে একেবারেই মনে হয় না। সবাই কৌতূহল নিয়ে সেটা দেখল বটে কিন্তু কেউ কোনো মন্তব্য করল না। গজগোবিন্দকে দেখে সকলেই যেন বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছে বলে মনে হল। এবার একে একে দর্শকদের সবাই যে যার কাজে চলে গেল।
.
মণ্ডপের ভেতরে রাজারা অর্ধচন্দ্রের আকারে সাজানো আরামপ্রদ আসনগুলিতে বসেছেন। তাঁদের পাশে নিমন্ত্রিত অতিথিদের বসবার জায়গা। মণ্ডপের ওপরে প্রকাণ্ড কারুকার্য করা চন্দ্রাতপ, নীচে কাশ্মীরের মোটা রাজাস্তরণ। তাঁদের সামনে অসংখ্য পুষ্পস্তবকে সাজানো বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। সেখানে কিছুটা দূরে পেটিকার ওপরে ধনুটা রাখা আছে। সেটা পাহারা দেবার জন্যে তার একপাশে সেনাপতি প্রদ্যুম্ন আর অন্যপাশে স্বর্ণরেণুর মামা রাজা অনঙ্গদেব খোলা তলোয়ার হাতে স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রদ্যুম্নের মুখ অভিব্যক্তিহীন কিন্তু তাঁর তীব্র আর চঞ্চল দৃষ্টি দেখলে বোঝা যায় যে তাঁর মনের ভেতরে কোনো একটা চিন্তা প্রবলভাবে কাজ করে চলেছে।
এদিকে সৈন্যরা সমস্ত মণ্ডপটি ঘিরে রেখেছে যাতে অনিমন্ত্রিত কেউ ঢুকে পড়তে না পারে। তাদের পেছনে কৌতূহলী জনতা উঁকিঝুঁকি মারছে আর উত্তেজিত আলোচনা করছে। রাজারাও নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। ফলে উৎসব সংগীত ছাপিয়ে মণ্ডপের ভেতরে বেশ একটা গুন গুন করে গুঞ্জন চলছিল।
হঠাৎ দামামা বেজে উঠল। একজন ঘোষক মণ্ডপে ঢুকে উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করলেন— আমাদের মহারাজা তাঁর কন্যা রাজকুমারী স্বর্ণরেণু সমভিব্যাহারে আসছেন।
সঙ্গেসঙ্গে গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেল। সবাই উৎসুক চোখে রাজপুরীর দিক থেকে মণ্ডপে ঢোকার প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাজামশায়ের পাশে পাশে রাজকন্যা স্বর্ণরেণু সভায় ঢুকলেন। তাঁদের পেছনে পেছনে এল রাজকন্যার সখীরা আর রাজামশায়ের দেহরক্ষীরা। সালঙ্কারা স্বর্ণরেণুর পরনে লাল চিনাংশুক, হাতে সাদাফুলের মোটা স্বয়ংবরের মালা। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। সবাই নির্বাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলেন।
রাজামশাই নিস্তব্ধ সভার মাঝখানে এসে তিনবার উচ্চকণ্ঠে বললেন— এই আমার একমাত্র মেয়ে স্বর্ণরেণু। আজ তার স্বয়ংবর অনুষ্ঠিত হবে। এই যে ধনুটি এখানে রাখা আছে, এটি এই সভায় উপস্থিত যিনি পেটিকার ওপর থেকে প্রথম তুলে ধরতে পারবেন, স্বর্ণরেণু তাঁর গলায় মালা দেবেন।
এই ঘোষণা করে রাজামশাই মেয়েকে নিয়ে পেটিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রদ্যুম্ন সামনে দিকে তাকিয়ে খুব নীচু গলায় বললেন— ভয় পাসনি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথাটা স্বর্ণরেণু আর রাজামশাই, দু-জনেরই কানে গেল। কিন্তু দু-জনেই চুপ করে রইলেন। রাজামশাইয়ের মুখটা গম্ভীর বিষণ্ণ হয়ে রইল।
এইবার একজন একজন করে রাজারা আসন থেকে উঠে হাসতে হাসতে পেটিকার দিকে আসতে লাগলেন। সঙ্গেসঙ্গে ঘোষক ঘোষণা করতে লাগল— এইবার চিত্রগঙ্গা রাজ্যের মহারাজ কীর্তিধর আসছেন। এইবার রজতগিরি রাজ্যের রাজকুমার অগ্নিদেব আসছেন। ইত্যাদি।
হাসতে হাসতে আসছেন তো বটে, তবে একটু পরেই মাথা নীচু করে ফিরেও যাচ্ছেন। রোগা-মোটা-বেঁটে লম্বা সব রাজারাই দু-হাতে ধনুটা ধরে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে অনেক টানাটানি করেও একচুল নড়াতে পারলেন না।
সবশেষে এলেন গজগোবিন্দ। বিরাট ভুঁড়ি দুলিয়ে থপ থপ করতে করতে ধনুটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ দু-হাত ঘষে চারবার তালি দিলেন। তারপর, কোনোরকমে সামনে ঝুঁকে এক হাতে ধরে ধনুটা তুলে ধরলেন। সেটা মাথার ওপরে তুলে বিজয়গর্বে সকলের দিকে তাকালেন। তারপর খুব সন্তর্পণে ধনুটা যথাস্থানে রেখে বিজয়গর্বে দু-বার হাততালি দিয়ে দাঁড়িগোঁফের ভেতর দিয়ে দন্তবিকাশ করতে করতে স্বর্ণরেণুর দিকে এগিয়ে গেলেন। সমস্ত সভা স্তব্ধ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
ঠিক তখুনি প্রদ্যুম্নর হুংকার শোনা গেল— একটু দাঁড়ান, রাজা গজগোবিন্দ। আপনার এই ধনু তোলবার ব্যাপারটা একটা কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি এক্ষুণি সেটা প্রমাণ করে দিচ্ছি আর প্রমাণ করে দিচ্ছি যে আপনি এই স্বয়ংবর সভায় সমবেত সকলকে অন্যায়ভাবে প্রতারণা করেছেন।
গজগোবিন্দ দাঁড়িয়ে গিয়ে নাক কুঁচকে বললেন— এই কথা বলবার তুমি কে হে? তুমি তো একজন সামান্য সৈনিক। তুমি তো রাজা নও। এই প্রশ্ন তুলতে পারেন একমাত্র রাজারা। তোমার তো তোলবার অধিকার নেই।
—কে বলেছে আপনাকে যে অধিকার নেই? আমাদের রাজামশাই তো একবারও বলেননি যে এই স্বয়ংবর অনুষ্ঠান শুধু রাজাদের। তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে এখানে উপস্থিত যে-কেউ এতে অংশ নিতে পারে। আমার মতে একজন সামান্য সৈনিকও পারে। কাজেই এই স্বয়ংবরে কেউ দুর্নীতির আশ্রয় নিলে, সেই অন্যায় কাজ প্রকাশ করে দেবার অধিকার এখানে সকলেরই আছে।
বলামাত্র সভার বাইরে সমবেত প্রজারা আর গজগোবিন্দের শত্রুপক্ষের রাজারা সমস্বরে বলে উঠলেন— ঠিক ঠিক, একদম ঠিক কথা।
রাজারা বললেন— তুমি এগিয়ে যাও তো। আমরা জানতে চাই রাজা গজগোবিন্দ আমাদের বোকা বানিয়েছেন কিনা।
গজগোবিন্দ পূর্ববৎ নাক কুঁচকে বললেন— ঠিক আছে। দ্যাখো, আমি কোনো অন্যায় করেছি কি না। তবে, যদি কিছু প্রমাণ করতে না পারো, তাহলে আমি তোমাদের রাজামশাইকে বলে তোমার মুণ্ডু কাটার ব্যবস্থা করব। এই কথাটা মনে রেখো।
প্রদ্যুম্ন সহাস্যে বললেন— মনে রাখব, রাজা গজগোবিন্দ।
প্রদ্যুম্ন দৃঢ়পদে ধনুটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তীব্র দৃষ্টতে ধনুটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পর পর চারটে তালি দিলেন। তৎক্ষণাৎ গজগোবিন্দ চিৎকার করে উঠলেন— অ্যাই, অ্যাই, হাততালি দিচ্ছ কেন? হাততালি দেবে না, বলে দিচ্ছি।
প্রদ্যুম্ন গজগোবিন্দের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। জোরে জোরে বললেন— ধনুটা একটু নড়েছে।
বলে একহাতে ধনুটা ধরে টেনে মাথার ওপরে তুলে ধরলেন। রাজাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— এটা অত্যন্ত হালকা। একটা বাচ্চা ছেলেও এটা তুলতে পারে। আমার কখনোই সন্দেহ ছিল না যে গজগোবিন্দ আর যেই হন, মহাবীর নন। তিনি একটা প্রতারক। গজগোবিন্দের রামচন্দ্র হবার বাসনা হয়েছিল, যদিও তিনি তাঁর পায়ের নখেরও যোগ্য নন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে ইঁদুরের গোঁফ গজালে সে সিংহ হয় না।
একজন রাজা চিৎকার করে বললেন— গজগোবিন্দ ইন্দ্রজাল বা তান্ত্রিক মন্ত্র অবলম্বন করে আমাদের প্রতারণা করেছেন।
প্রদ্যুম্ন বললেন— না, ইন্দ্রজালে আমি বিশ্বাস করি না, তন্ত্রমন্ত্রে তো নয়-ই। এটা সোজাসুজি প্রতারণা। কীভাবে উনি এটা করলেন সেটাও এখুনি বের করে দিচ্ছি।
বলে প্রদ্যুম্ন খুব ভালো করে ধনুটা পরীক্ষা করলেন। তাঁর মুখে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তারপরে পেটিকাটা খুঁটিয়ে দেখলেন। এবার রাজাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— দেখুন, এই ধনুর মাঝখানে মুঠো করে ধরবার জায়গা দু-পাশে দুটো ছোট্ট ছোট্ট লোহার পাত লাগানো আছে। দেখলে মনে হবে যে ধনুর্ধরের হাতের মুঠো যাতে পিছলে না যায় তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এই পাত দুটোর ডগায় একটা করে ছোটো ছিদ্র করা আছে। এবার দেখুন, এই পেটিকার ওপরে কারুকার্যের ভেতরে দুটো ছোটো ছিদ্র করা আছে যার ভেতর দিয়ে এই পাত দুটো গলে পেটিকার ভেতরে ঢুকে যাবে যদি সাবধানে ধনুটা এর ওপরে রাখা যায়। এখন যদি পেটিকার ভেতর থেকে এই দুটো ছিদ্রের ভেতরে একটা লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ওপর থেকে সহস্রবার টানলেও ধনুটা ওঠানো যাবে না।
রাজারা প্রশ্ন করলেন— তাহলে কি পেটিকার ভেতরে কোনো যন্ত্র রাখা আছে?
প্রদ্যুম্ন বললেন— দেখছি।
বলে পেটিকার ওপরের ভারী ডালাটা টেনে সরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, ভেতরে একটা বেঁটে লোক লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছে। প্রদ্যুম্ন তাকে চুল ধরে টেনে তুলে বের করে আনলেন। এক চড় মেরে বললেন— কে তুই? ওখানে কী করছিলি?
লোকটা হাউমাউ করে বলল— আমি ছিদাম। আমি তো শলাকা পরাচ্ছিলুম।
—বটে? কে তোকে শলাকা পরাতে বলেছিল?
—আমাদের মহারাজ গজগোবিন্দ। আমাকে বললেন যে চারবার হাততালি শুনলে আমি যেন শলাকাটা ছ্যাঁদার ভেতর থেকে বের করে নি আর দু-বার হাততালি শুনলে আবার সেখানে ঢুকিয়ে দি।
তখন সভার ভেতরে-বাইরে ভীষণ গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। গজগোবিন্দের পক্ষের রাজারা চিৎকার করে বললেন যে যুদ্ধে আর বিবাহে প্রতারণা করলে দোষ হয় না। বিপক্ষের রাজারা ততোধিক গলা ফাটিয়ে বললেন, বাজে কথা। যেকোনো অবস্থাতেই প্রতারণা অপরাধ এবং প্রতারককে শাস্তি পেতেই হবে।
এদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজারা এক এক পক্ষকে সমর্থন করে চিৎকার করতে লাগল। তারা এমন হুড়োহুড়ি লাগাল যে তাদের মণ্ডপের বাইরে রাখতে সৈন্যরা গলদঘর্ম হয়ে উঠল। গোলমালে কান পাতা দায় হয়ে উঠল।
তা, ক্ষত্রিয়রা তো বেশিক্ষণ তর্কাতর্কি করতে পারেন না। একটু পরেই সড়াক সড়াক করে কোষ থেকে তরোয়াল বেরিয়ে এল আর চোখের পলকে দু-পক্ষে প্রবল অসিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সবাই মণ্ডপের ফাঁকা জায়গাটায় নেমে এলেন। খানিক বাদে কে যে কার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন বোঝা দুষ্কর হয়ে উঠল।
ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কিতে অভ্যাগতদের বসবার আসনগুলো উলটেপালটে একাকার হল। রাজামশায়ের দেহরক্ষীরা তাঁকে ঘিরে ফেলে একপাশে নিয়ে গেল। রাজকুমারীর সখিরা এদিক-ওদিক ছিটকে গেল। স্বর্ণরেণু মালা হাতে কোথায় যাবে ঠিক করতে না-পেরে সন্ত্রস্তমুখে তাড়াতাড়ি প্রদ্যুম্নের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
প্রদ্যুম্ন তখন একসঙ্গে তিনজন রাজার সঙ্গে অসিযুদ্ধ করছিলেন। হঠাৎ, অন্য দুই যুযুধান রাজার ধাক্কায় স্বর্ণরেণুর হাত থেকে মালাটা ছিটকে গিয়ে প্রদ্যুম্নের গলায় পড়ে গেল।
প্রদ্যুম্ন চমকে উঠে বললেন— ওই যা, এটা আবার কী? ওরে বাবা, এটা যে স্বয়ংবরের মালা দেখছি। ওরে রেণু, কোথায় গেলি?
স্বর্ণরেণু বলল— এই তো, তোমার পাশেই আছি।
—এই মালাটা তাড়াতাড়ি খুলে নে তো।
—তুমি খুলে নাও না।
—যুদ্ধ করছি যে, একহাতে খুলতে গেলে ছিঁড়ে যেতে পারে। শিগগির কর।
—আমি খুলতে টুলতে পারব না।
—দূর বোকা! খুলবি না, মানে কী? এটা কী যে সে মালা নাকি? এটা হল স্বয়ংবরের মালা। এ মালা কি আমার গলায় মানায়?
—কেন মানাবে না? দিব্যি মানিয়েছে। অমন মোটা ফুলের মালা গলায় দিয়ে তোমার আগে কেউ বোধহয় অসিযুদ্ধ করেনি।
—এ তো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল দেখছি।
ঠিক এইসময় দেখা গেল রাজা গজগোবিন্দের সেনাপতি অচলাদ্রি তরোয়াল হাতে ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে কোথায় যেন যাচ্ছে।
প্রদ্যুম্ন গর্জন করে বললেন— এ্যাই অচা, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
অচলাদ্রি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল— না, মানে ওই ইয়ে, তোদের রাজামশাইকে বন্দি করতে যাচ্ছি। মানে, জামাইবাবু বললেন কিনা।
—সাবধান, আর এক পা এগোলে তোকে ওপর থেকে দেড় বিঘৎ ছেঁটে দেব, বলছি। তোকে তখন আর কেউ চিনতে পারবে না। যা! যেখান থেকে এসেছিস সেইখানে ফিরে যা।
বলতেই অচলাদ্রি বেশ কিছুটা যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ‘অ জামাইবাবু, অ জামাইবাবু’ বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে একদিকে চলে গেল।
তখন প্রদ্যুম্ন তার প্রতিপক্ষ তিনজন রাজাকে খুব বিনীতভাবে বললেন— আপনারা একটু দাঁড়াবেন? আমি এই রাজকুমারীর সঙ্গে একটু কথা বলেনি।
তিনজন রাজাই খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন— এ সব খুব খারাপ। চমৎকার যুদ্ধটা হচ্ছিল, তার মধ্যে যত সব ঝামেলা! ঠিক আছে, কথা শেষ করে নিন, আমরা দাঁড়াচ্ছি। তারপরে আবার শুরু করা যাবে।
প্রদ্যুম্ন রাজাদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্বর্ণরেণুর দিকে ফিরে বলল— শোন রেণু, ছেলেমানুষী করিসনি। এই মালা কি আমার জন্যে? তুই এ মালা পরাবি কোনো রাজপুত্রকে কিংবা কোনো দিগ্বজয়ী রাজার গলায়। আমাকে পরালে সেটা ঠিক হবে না তো।
স্বর্ণরেণু বলল— কেন হবে না? তুমি রাজা বা রাজপুত্তুরের চেয়ে কম কীসে? রাজা বা রাজপুত্রদের কি মাথায় দুটো শিং আছে না পেছনে একটা ল্যাজ আছে?
অপেক্ষমান রাজাদের একজন বললেন— রাজকন্যা তো ঠিক কথাই বলেছেন। আপনি দেখতে শুনতে ভালো, খ্যাতনামা বীর, অনায়াসে তিনজনের সঙ্গে অসিযুদ্ধ করে যাচ্ছেন, আপনার তীক্ষ্ন বুদ্ধির কথা এতদিন শুনেই এসেছি, আজ স্বচক্ষে দেখেছি। আপনি রাজা বা রাজপুত্তুরদের চেয়ে কোন অংশে কম?
প্রদ্যুম্ন চোখ পাকিয়ে বললেন— আপনি চুপ করুন তো মশায়। মেলা জ্ঞান দেবেন না। দেখছেন এদিকে মা মনসা, আর আপনি তার ওপরে ধুনোর গন্ধ দিয়ে যাচ্ছেন। শুনুন, সেনাপতি হই আর যাই হই, আসলে আমি একজন বেতনভোগী সৈনিক। রাজামশাই যে বেতন দেন, তাতে আমি, আমার ছোটো ভাই, বাবা আর মা এই চারজনের সংসার সুখে-স্বাচ্ছন্দেই চলে যায়। আমি যদি এখন রাজকন্যে বিয়ে করি তাহলে আমরা সবাই কী আতান্তরে পড়ব, সেটা বুঝতে পারছেন? ঘটি-বাটি বিক্রি করে সকলকে যে পথে দাঁড়াতে হবে।
পেছন থেকে একটা গম্ভীর গলা শোনা গেল— সেটা পরেকার কথা। আপাতত রেণু এই স্বয়ংবর সভায় সর্বসমক্ষে তোমার গলায় মালাটা যখন দিয়েই ফেলেছে, তখন তোমার ওকে বিয়ে করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বলে রাজামশাই উচ্চকণ্ঠে বললেন— সবাই শান্ত হন, অস্ত্র সংবরণ করুন। এই সভায় আমার একমাত্র মেয়ে রাজকন্যা স্বর্ণরেণু আমার পরম বন্ধু দুর্মদ সিংহের জ্যেষ্ঠপুত্র সেনাপতি প্রদ্যুম্ন সিংহের গলায় বরমাল্য দান করেছে। আমি তাদের আশীর্বাদ করছি এবং তাদের বিবাহে আপনাদের সবাইকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করছি। আপনারাও ওদের আশীর্বাদ করুন। আর ঘোষণা করছি যে এই বিবাহে যৌতুকস্বরূপ আমি আমার অর্ধেক রাজত্ব আমার জামাতা বাবাজীবনকে দান করছি।
সবাই সহর্ষে অনুমোদন জানালেন।
.
রানিমা কেঁদে কেঁদে শয্যা নিয়েছিলেন। স্বর্ণরেণুর সখীদের মুখে সব শুনে উঠে বসলেন। বললেন— আমার খুব ইচ্ছে ছিল যে রেণুর ঠিক প্রদ্যুম্নের মতো বুদ্ধিমান আর সাহসী একটি বর হোক। ভগবান যে আমার সেই ইচ্ছে পূর্ণ করবেন তা আমি ভাবতেও পারিনি। ওকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। বড়ো ভালো ছেলে। সৎ আর তেজস্বী। আমাদের রেণুকে ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই বোধ হয় ভগবান ওকে পাঠিয়েছেন।
শুনে সখীরা হেসে গড়িয়ে পড়ল।
রানিমা আশ্চর্য হয়ে বললেন— হাসছিস কেন রে তোরা? এতে হাসির কী আছে?
সখীরা বলল— হাসব না? রাজামশাই হঠাৎ অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যের ঘোষণা করতেই মহাবীর প্রদ্যুম্ন দাদার হাত থেকে তরোয়ালটা ধুপ করে খসে পড়ল যে।
রানিমা সস্নেহে বললেন— তাতে হাসবার কী আছে? রেণুর মতো অমন একটা ডানপিটে দুষ্টু মেয়েকে বিয়ে করতে হবে শুনলে অনেক রথী-মহারথীরও বুকের রক্ত শুকিয়ে যাবে। আমাদের প্রদ্যুম্ন তো তাদের তুলনায় একেবারে ছেলেমানুষ।