স্বপ্নমালা
সব মানুষই স্বপ্ন বোনে।
আমিও তাই বুনি।
স্বপ্নপাখি বড়ো নিষ্ঠুর। ঠোঁট-নখরে খুনোখুনি। রক্তে-রাঙা ভাঙা স্বপন।
পালক ওড়ে ছত্রাকারে।
তবুও যে স্বপ্নবিভোর স্বপ্ন তাকে বুকেই রাখে।
স্বপ্ন ওড়ে।
নীল নদীটির নিবিড় পারে, ঘুম-পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে, অলস পায়ে, যখন হাঁটে মাঘী মাঠের ন্যাবাধরা শূন্যতাতে, ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে স্বপ্নগুলোডানা ঝাপটে, অস্ফুটে কী কইতে কইতে নড়ে-চড়ে।
স্বপ্ন ওড়ে।
স্বপ্নে দেখি, নীড়ের পাখি আসছে নীড়ে।
অনেক পাহাড় মাঠ পেরিয়ে আসছে নীড়ে।
ভালোবাসা ঠোঁটে করে আসছে ফিরে।
পাখি আমার, নীড়ের পাখি, যার চোখেতে মাখামাখি আমার সকাল-বিকেল ও রাত।
বরাত গেছে অন্য দেশে।
এমনি বরাত।
পাখি আমার, কার যেন যে আড়কাঠিতে পড়ল বাঁধা, এমনি ধাঁধা।
গুঁপো-খাটাস হুলোবেড়াল চাটনি বাটে, মেগনি খাটে, আমার পাখির গ্রীবার গন্ধ দারুণ লাগে।
স্বপ্ন আমার, তাদের তাড়ায় দৌড়ে ভাগে।
স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়, আমার স্বপ্ন, স্বপ্ন সবার।
পাখির মতোই।
একলা পাখি, ভুল করে সে ভিড়ল ভিড়ে।
তবুও আমি স্বপ্ন দেখি, রূপের রাজা, গুণের গুনিন মুঠির মাঝে মুক্তো-মণিন সব পাখিদের মুগ্ধ করা মন্ত্র নিয়ে আসব ফিরে এই ধরাতে, আসব ফিরে, বারে বারে। আসব, আসব, আসব ফিরেই অবহেলার হেলাফেলার শোধ নেব ঠিক হিসেব করে।
কোনো পাখিই বশ মানেনি আমার দাঁড়ে।
একটিও নয়।
গায়নিকো গান মিষ্টি গলায় শিউলিভোরে, গায়নিকো গান সাঁঝবেলাতেও হাসনুহানার। সকাল ও সাঁঝ হারিয়ে গেছে নিরুপায়ে, পাখির গায়ে ওম-এর গন্ধ এবং চোখের চেকনাই-এর পসরা নিয়ে, বসরা গোলাপ, পাখি আমার নীড়ের পাখি। চোখ দিয়ে সে মারত চাবুক আমায় একা, কলজে নিয়ে বাটত সে যে গাবুক-গুবুক, পানা-পড়া দিনগুলোকে চমকে দিয়ে লাফিয়ে যেত ত্রস্ত পায়ে মেঘ-দুপুরের ডাহুক যেন।
আমার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন দিয়ে মালা গাঁথি।
স্বপ্নমালা।
স্বপ্নগুলি খুব ভীতু হয়। এবং নরম। খরগোশ আর পাখির সঙ্গে দারুণই মিল আমার এই স্বপ্নমালার স্বপ্নগুলির।
তোমায় নিয়ে বেড়িয়ে বেড়াই বনে বনে। মনে মনে, স্বপ্ন-বনে।
কাল রাতেতে স্বপ্ন বেয়ে গিয়েছিলাম কানহার মাঠে। শিশির-ভেজা লাল ঘাসেতে দেখে এলাম আমরা দুজন, চুপিসাড়ে পা-পা করে হাঁটছে হরিণ, যেমন করে শিশু হাঁটে। রোদের সঙ্গে ছায়ার বিয়ে, আলোর সঙ্গে বিবাদ করে কালো। হাতের সনে হাত মিলিয়ে শব্দ আর গন্ধরা সব যুগলবন্দি খেলে। থাবার চড়ে রোদের ঝালর ঝাপটে ছিঁড়ে লাফিয়ে পড়ে চিতা, শিহর তুলে হরিণ ওড়ে হিরে-মানিক ভোরে।
চমকে ওঠে চতুর চিকুর-তোলা চিল। আলো-ছায়ায় সাপের খেলা অগণ্য কিলবিল।
ছিপছিপে সেই মেয়ে, স্বপ্নেতে সে স্বপ্নে ছিল, স্বপ্নে হবে নীল। ছিপছিপে সে, শ্যামলা গড়ন পেঁয়াজখসি শাড়ি, স্বপনপুরে বাড়ি, আমার সঙ্গে আড়ি।
পায়েতে তার চুমু দিতেই কামেতে জর্জর, চুমোয় হল পায়া ভারী, পায়েতে পায়জোর। দেমাকভরে দাঁড়িয়ে থাকে স্বপ্নে দেখা নারী, পেঁয়াজখসি শাড়ির আঁচল, ঠোঁটের কাছের তিল। স্বপ্নমালায় গেঁথে গেল হরিণ, চিতা, চিল।
স্বপ্নে আমি অনেক কিছুই ভেবেছিলাম।
ভেবেছিলাম এটা করব, সেটা করব, বাড়ি করব, পাহাড়চুড়োয় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে।
পায়ের কাছে নদী বইবে নারীর মতো, বাধ্যতা আর নাব্যতাতে; ভেবেছিলাম বনস্থলীর চমকে ওঠা বেনেবউটি ফুল ফোটাবে হলুদ-কালো, অনেক অনেক… ভেবেছিলাম, তাদের আমি ভালোবাসব সেই তাদেরও, যারা আমায় খুবই খারাপ বাসে; কিন্তু হেসে মিলেমেশে, কাছেও বসে এসে।
ভেবেছিলাম, লিখব আমি গানের মতো, গান গাইব, যেমন করে লিখি, আঁকব ছবি খুন করে রং রঙের রক্ত ছেনে, ভেবেছিলাম যশের রাজার মস্ত হাতি শুঁড় ঘুরিয়ে তুলে নিয়ে আমায় বুঝি বসিয়ে নেবেই ঠিক কোনোদিন লাল-মখমল রোদ-ঝলমল হাওদাটিতে।
ভেবেছিলাম, গুণপনার হাতেই বুঝি হাত রাখে যশ, বুঝি-বা যোগ্যজনে আজ না হলেও দাম ঠিকই পায় কাল, যশ বুঝি বা যোগ্যতারই বশ।
স্বপ্নে যখন পোলাও রাঁধি, ঘি ঢেলে দিই খুউব।
বিকেল হল, বিকেল হল, স্বপ্ন মরে আছে পড়ে, পায়ের কাছে শীতবিকেলের ঝড়ের ফুলের মতো, নরম কিন্তু স্থির, মৃতর চেয়েও মৃত। বিকেল হল, বিকেল হল, হয়নি কিছু, পায়নি কিছুই স্বপন-ঘোরে মুগ্ধ মানুষ একলা-হাঁটা; মূর্খ মানুষ।
অনেক পায়ের ধুলোয় ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে উচ্চগ্রামের স্বর ফুলিয়ে, হাত উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে যূথবদ্ধ পথিকরা সব উল্লাসেতে মাতে। একলা হাঁটে স্বপ্ন-পাগল শাপলা বিলের আলে আলে একলা-ওড়া টি-টি পাখির সাথে।
সন্ধে হলে জোনাকি জ্বলে বাঁশপাহাড়ে, হুক্কা-হুয়ায় শেয়াল দোলে। নকশি-কাঁথার মাঠ পেরিয়ে নগ্ন নির্জন নীল—কুয়াশায় উথালচুলের উড়াল গন্ধ কনকচাঁপার রাতে,
আগল-খোলা বোকা-পাগল গান গেয়ে যায় স্বপ্নমালা হাতে।
যশের বাড়ি দূরে, পথ গিয়েছে ধুলোপায়ে; অনেক ঘুরে ঘুরে।
স্বপ্ন ওড়ে। ওড়ে ওড়ে, চারদিকেতে স্বপ্ন ওড়ে।
নীল নদীটির নিবিড় পাড়ে, ঘুম-পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে, অলস পায়ে যখন হাঁটে মাঘী মাঠের নাব্যধরা শূন্যতাতে ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে স্বপ্নগুলো ঝাপটে পাখা অস্ফুটে কী কইতে কইতে নড়ে-চড়ে।
স্বপ্ন ওড়ে।
স্বপ্ন ওড়ে, বারে বারে।