স্বপ্নবাসবদত্তা – প্রসঙ্গকথা

স্বপ্নবাসবদত্তা – প্রসঙ্গকথা

প্রথম অঙ্ক

ভাসের স্বপ্ন নাটক ছয়টি অঙ্কে সমাপ্ত। প্রেক্ষাগারে দর্শকের আসনে বসে দর্শকের দৃষ্টি দিয়েই নাটকের কাহিনী উপভোগ করা ভালো। নাট্যকার সব কথা আগেই বলেন না, নাটকীয় উৎকণ্ঠা অক্ষুণ্ন রেখে ধীরে ধীরে কাহিনীর গ্রন্থি মোচন করতে থাকেন। সুতরাং অধীর হয়ে লাভ নেই। ভাস যে কত বড় নাট্যকার ছিলেন তা নাটকের কাহিনীবিন্যাসের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

প্রথম অঙ্কের দৃশ্য—রাজগৃহের সমীপবর্তী একটি আশ্রমপথ। পথে কোলাহল, প্রহরীরা লোকজন সরিয়ে দিচ্ছে। মগধরাজ দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতী এসেছেন আশ্রমবাসিনী তাঁর মাকে দেখতে। এক পরিব্রাজকও এসেছেন আশ্রমে। তাঁর সঙ্গে আছেন এক রমণী।

পদ্মাবতী আশ্রমবাসীদের বিভিন্ন দ্রব্য দান করবেন, কার কী প্রার্থনা তা তিনি জানতে চাইলেন। পরিব্রাজক এগিয়ে এলেন, সঙ্গিনী রমণীকে নিয়ে বললেন, তিনিও প্রার্থী। তাঁর প্রার্থনা—তাঁর ভগিনীকে পদ্মাবতীর আশ্রয়ে কিছুকাল রাখতে হবে, কেননা ওর স্বামী এখন প্রবাসে আছেন। পদ্মাবতী সম্মত হলেন। এমন সময় এলেন এক ব্রহ্মচারী, তাঁর মুখে শোনা গেল, লাবাণক থেকে তিনি আসছেন। লাবাণক বৎসরাজের অন্তর্গত একটি গ্রাম। বৎসরাজ উদয়নের স্ত্রী বাসবদত্তাকে নিয়ে লাবাণকে বাস করছিলেন। উদয়ন মৃগয়া উপলক্ষে অন্যত্র ছিলেন। সেই সময়ে এক অগ্নিকাণ্ডে বাসবদত্তার মৃত্যু ঘটেছে, মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণও তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। উদয়ন পত্নীশোকে উন্মাদ।

পরিব্রাজকদের সঙ্গিনীই যে বাসবদত্তা তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কারণ বাসবদত্তার ‘স্বগতোক্তি’গুলো অন্তত দর্শকদের শ্রুতিগোচর হবার কথা। পরিব্রাজক যে উদয়নের মন্ত্রীই যৌগন্ধরায়ণ সে কথাও না হয় বুঝে নেওয়া গেল! কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ব্যাপার কী? উৎকণ্ঠা জাগে—ততঃ কিম্? প্রথম অঙ্কের এই দৃশ্যে পদ্মাবতীর কাছে বাসবদত্তাকে রেখে যৌগন্ধরায়ণ চলে গেলেন।

১. নান্দী

সংস্কৃত নাটকের প্রযোজনায় ‘নান্দী’ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। নাটকে লেখা থাকে—‘নান্দ্যন্তে সূত্রধারঃ’। নান্দীর পরে (নান্দ্যন্তে) মঞ্চে প্রবেশ করলেন সূত্রধার। সূত্রধার মঞ্চে প্রবেশ করে যে স্তুতিশ্লোক উচ্চারণ করবেন (দেবদ্বিজনৃপাদীনাং স্তুতিঃ) তারও নাম নান্দী; তবে সেই নান্দী অবশ্যকর্তব্য—উদ্দেশ্য নাট্যাভিনয়ে সকল প্রকার বিঘ্নের অবসান। বিঘ্নোপশমের জন্য অনুষ্ঠান বিচিত্র। প্রথমে পূরবঙ্গ, তারপর সভাপূজা, তারপর দেবতা ব্রাহ্মণ বা নৃপতির স্তুতিমূলক শ্লোকপাঠ। এইসব অনুষ্ঠান মঞ্চের নেপথ্যেই হয়ে থাকে, কারণ নাটকের পাত্র-পাত্রীগণ। অনুষ্ঠানগুলোর মিলিত নাম ‘নান্দী’। এদের মধ্যে দেবতাদির স্তুতিমূলক যে শ্লোকপাঠ তা অবশ্যই করতে হবে! অন্য অনুষ্ঠান (সভাপূজা, পূর্বরঙ্গ) বাদ দিলেও ক্ষতি নেই।

‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ নাটকের বিখ্যাত ভাষ্যকার রাঘব ভট্ট অলঙ্কার শাস্ত্র থেকে নান্দীর যে সংজ্ঞা উদ্ধৃত করেছেন তা হল—‘আশীনমন্ত্রিয়ারূপঃ শ্লোকঃ কাব্যার্থসূচকঃ’। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আলোচ্য নাটকে নান্দীর অন্তে সূত্রধার মঞ্চে প্রবেশ করে যে শ্লোকটি উচ্চারণ করলেন (উদয়নবেন্দুসবর্ণা ইত্যাদি) তাকে নান্দী বলতে হয়। আশীনমক্রিয়া ছাড়া কাব্যার্থের সূচনাও এতে আছে। প্রধান চারটি চরিত্রের উল্লেখ এখানে শ্লেষের সাহায্যে ব্যক্ত করা হয়েছে—উদয়ন, বাসবদত্তা, পদ্মাবতী ও বসন্তক।

তবু মঞ্চনির্দেশ যখন দেওয়া আছে ‘নান্দ্যন্তে (অর্থাৎ নান্দীর অন্তে) ততঃ প্রবিশতি সূত্রধারঃ’, তখন এখানে সূত্রধার মঞ্চে এসে যে শ্লোকটি উচ্চারণ করলেন তাকে সূক্ষ্মবিচারে ‘নান্দী’ না বলাই ভালো! নান্দী নাটকের নেপথ্যে আগেই হয়ে গেছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী একে বলা যেতে পারে ‘রঙ্গদ্বার’।

২. স্থাপনা

সংস্কৃত নাট্যাভিনয়ের এক প্রধান অংশ এই ‘স্থাপনা’। নান্দীপাঠের পর স্থাপনা অংশটি অভিনীত হবে। অলঙ্কার শাস্ত্রে এর আরও দুটি নাম হচ্ছে—‘আমুখ’ বা ‘প্রস্তাবনা’ (‘আমুখং তত্ত্ব বিজ্ঞেয়ং নাম্না প্রস্তাবনাপি সা’)। এই অংশে সূত্রধার অন্য কোনো নটের সঙ্গে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে নাট্যকারের নাম ও অভিনেয় নাটকের উল্লেখ করেন; কেবল নামোল্লেখ নয়, অভিনেতব্য নাটকের বিষয়বস্তুরও একটু আভাস দেওয়াও এই প্রস্তাবনা বা স্থাপনার লক্ষ্য। এইসব নিয়ম হয়তো তখন অবশ্য পালনীয় ছিল না, কেননা ভাস-রচিত কোনো নাটকের স্থাপনা অংশে নাট্যকারের নাম নেই।

৩. পরিব্রাজকবেষঃ

‘বেষ’ শব্দটির অর্থ অঙ্গব্যাপক অর্থাৎ পরিচ্ছদ। পরিব্রাজকের তুল্য বেষ যাহার। সমার্থবাচক শব্দ ‘বেশ’ (সাজ)। উদয়নের মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ পরিব্রাজক বা সন্ন্যাসীর বেশে মঞ্চে আবির্ভূত।

৪. কাঞ্চকীয়

কঞ্চুকী আর কাঞ্চকীয় দুটি শব্দই সংস্কৃত নাটকে প্রয়োগ করা হয়েছে। সংস্কৃত নাটকের একটি চরিত্রের নাম কঞ্চুকী। রাজান্তঃপুরে এর অবাধ গতি, ইনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সর্বগুণের আধার এবং সকল কার্যে কুশল। নাট্যশাস্ত্রে এঁর পরিচয়—‘অন্তঃপুরচরো বৃদ্ধঃ বিপ্রো গুণগণান্বিতঃ। সর্বকার্যার্থকুশলঃ কঞ্চুকীত্য ভিধীয়তে।’ মঞ্চে প্রথম এসেই ইনি সাধারণত বার্ধক্যের অক্ষমতাহেতু নৈরাশ্যসূচক কথা বলে থাকেন।

৫. দর্শকস্য

অজাতশত্রু পুত্র দর্শক মগধের রাজা, বৎসরাজ উদয়নের সমসাময়িক। ইনি ছিলেন উদয়নের দ্বিতীয়া স্ত্রী পদ্মাবতীর ভ্রাতা।

৬. চেটী

অর্থ দাসী। বাংলায় “চেড়ী’।

৭. প্রবিশতি উপবিষ্টা তাপসী

এখানকার মঞ্চনির্দেশ একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। উপবিষ্ট অবস্থায় যদি তাপসীর প্রবেশ কল্পনা করতে হয় তাহলে এই সিদ্ধান্তও অনিবার্য হয়ে ওঠে যে সে যুগের নাট্যপ্রযোজনায় হয়তো Revolv।ng stage বা ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের অস্তিত্ব ছিল। প্রকৃতপক্ষে ‘উপবিষ্টা তাপসী প্রবিশতি’ কথাটির অর্থ ‘উপবিষ্টা তাপসী দর্শকানাং গতিপথং প্রবিশতি’ যবনিকার (curta।n ) ব্যবহার পূর্বে ছিল। যবনিকা তুললেই দর্শকেরা দেখবেন—তাপসী আসনে উপবিষ্ট আছেন।

৮. আত্মীয়া ইদানীং সংবৃত্তা (অত্তণীআ দাণিং সংবৃত্তা)

রাজা প্রদ্যোত তাঁর পুত্রের সঙ্গে পদ্মাবতীর বিবাহপ্রস্তাব এনেছেন এই সংবাদে বাসবদত্তা খুশি হয়ে উঠেছেন; কেননা, সেই ক্ষেত্রে বাসবদত্তার সহোদর ভ্রাতার সঙ্গে পদ্মাবতীর বিবাহ।

৯. ব্যাপাশ্রয়না

প্ৰাৰ্থনা

১০. বিশ্বাসস্থানম্

পরিকল্পনা এইরকমই ছিল যে যৌগন্ধরায়ণ বাসবদত্তাকে যখন উদয়নের নিকট ফিরিয়ে দেবেন, তখন পদ্মাবতী নিজেই তার চরিত্র বিষয়ে সাক্ষী থাকবেন।

১১. ব্রহ্মচারী

এই চরিত্রটির নাটকীয় গুরুত্ব রয়েছে। এর মুখে লাবাণকের যে কাহিনী শোনা গেল তাতে বাসবদত্তার প্রতি উদয়নের গভীর প্রেম ব্যক্ত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার পরবর্তী মিলনের জন্য এটি প্রয়োজন।

১২. লাবাণক

নাটকে আছে—‘বৎসভূমৌ লাবাণকং নাম গ্রামঃ’। লাবাণক বৎসরাজ্যের অন্তর্গত একটি গ্রামের নাম। এখানে উদয়ন বাসবদত্তার সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন।

১৩. প্রিয়শিষ্যে

রাজা প্রদ্যোত বা মহাসেন-কন্যা বাসবদত্তার সংগীত-শিক্ষকরূপে নিযুক্ত করেছিলেন উদয়নকে। বাসবদত্তা উদয়নের প্রেমাসক্ত হন, তারপর দুজনেই গোপনে রাজ্য ত্যাগ করে চলে আসেন।

১৪. রুমন্বান্

রুমধান্ উদয়নের অমাত্য, যৌগন্ধরায়ণ মন্ত্রী; অমাত্যও একশ্রেণির মন্ত্রী—তবে মন্ত্রীর চেয়ে পদমর্যাদায় ছোট। পদগৌরবে প্রথম সচিব, তারপরে মন্ত্রী, সবশেষে অমাত্য।

দ্বিতীয় অঙ্ক

দৃশ্য—রাজগৃহে রাজপ্রাসাদের অন্তর্গত উদ্যান। একমাস পরবর্তী ঘটনা! পদ্মাবতীর আশ্রিতা বাসবদত্তা রাজগৃহের প্রাসাদে দিন কাটাচ্ছেন।

বাসবদত্তার জীবনে দ্রুত কতকগুলো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এই দৃশ্যে বাসবদত্তা চেটীর মুখে জানতে পারলেন পদ্মাবতী উদয়নের গুণমুগ্ধা। এই দৃশ্যেই ধাত্রীর মুখে শুনলেন পদ্মাবতীর সঙ্গে উদয়নের ‘বিবাহ সম্পর্ক’ স্থির হয়ে গেছে; এমনকি অন্য এক দাসী এসে জানিয়ে গেল সেইদিনই শুভদিন! (অজ্জা এব্ব কিল সোভণং ণক্‌খত্তং—আজই শুভ নক্ষত্র)—

পদ্মাবতীর বিয়ে হতে চলেছে তাঁরই স্বামীর সঙ্গে : বাসবদত্তার ব্যাকুলতা দর্শক নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। দৃশ্যের শেষে তাঁর আর্তনাদ একটিমাত্র কথায় ফুটে উঠেছে—‘অন্ধীকরেদি মে হিঅঅং’! (অন্ধীকরোতি মে হৃদয়ম্)!

প্রশ্ন জাগে এই সময়ে যৌগন্ধরায়ণ কোথায়? কী তার পরিকল্পনা?

দর্শকের ভাববার সময় নেই, কেননা নাটকের ঘটনা অত্যন্ত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে!

১৫. প্রবেশক

রঙ্গমঞ্চে নাটকীয় বিষয়বস্তুর আনুপূর্বিক বিন্যাস সম্ভব হয়ে ওঠে না। যে অংশ দীর্ঘ বা নিষ্প্রয়োজন, শিল্পী সেইসব অংশ মঞ্চে উপস্থিত করেন না; না করলেও সেইসব অংশের আভাস তাঁকে দিয়ে যেতে হয়। সংস্কৃত নাটকে যে পাঁচটি পদ্ধতির সাহায্যে এই আভাস সৃষ্টি করতে হয় তাদের বলা হয়েছে ‘অর্থোপক্ষেপক’; ‘প্রবেশক’ এই পাঁচটির অন্যতম। প্ৰবেশক রচনায় কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে—

ক. ‘প্রবেশক’ থাকবে দুটি অঙ্কের মধ্যে। দুটি অঙ্কের মধ্যে এর অবস্থান। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রথম অঙ্কে ‘প্রবেশক’ রচনা নিষিদ্ধ।

খ. ‘প্রবেশক’-এ সমাজের নিম্নস্তরের পাত্র-পাত্রীরা অংশগ্রহণ করবে। সংলাপের ভাষা হবে প্রাকৃত! আলোচ্য প্রবেশকের চরিত্র—চেটী; বলাবাহুল্য নিম্নস্তরের!

১৬. কন্দুকেন ক্রীড়তি

এক ধরনের বলখেলা প্রাচীন ভারতে মেয়েদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ছিল। বল আকারে ছোট আর খুব হালকা, এই বল উপরে ছুড়ে দিয়ে আবার তা ধরতে চেষ্টা করা বা অন্যের দিকে ছুড়ে দেওয়া, এইরকমই বোধহয় খেলার ধরন ছিল। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে কালিদাস পার্বতীর ‘কন্দুকক্রীড়ার’ বর্ণনা দিয়েছেন; ‘রঘুবংশে’র ষোড়শ সর্গেও এই ক্রীড়ার উল্লেখ দেখা যায়। দণ্ডী-রচিত ‘দশকুমারচরিতে’ও ‘কন্দুকবতীর’ আখ্যান রয়েছে।

১৭. ভবিষ্যন্মহাসেনবধূ

উজ্জয়িনীরাজ প্রদ্যোত বিশাল সেনাবাহিনীর অধিকারী ছিলেন বলে ‘মহাসেন’ নামেও পরিচিত ছিলেন : বাসবদত্তা ইচ্ছে করেই পদ্মাবতীকে ‘মহাসেনবধূ’ বলে সম্বোধন করেছেন, উদ্দেশ্য উদয়ন সম্পর্কে পদ্মাবতীর মনোভাব জেনে নেওয়া। প্রদ্যোত নিজের পুত্রের সঙ্গে পদ্মাবতীর সম্বন্ধ প্রস্তাব করে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু পদ্মাবতীর তাতে সম্মতি ছিল না।

১৮. আগমপ্রধানানি

আগম অর্থ শাস্ত্র! শাস্ত্র যাদের নিকটে প্রধান অর্থাৎ যারা সাংসারিক জীবনে শাস্ত্রের উপরে অধিক মূল্য দিয়ে থাকেন।

১৯. কৌতুকমঙ্গল

কৌতুক অর্থ বিবাহসূত্র—বিবাহের পূর্বে বিবাহসূত্র হাতে বেঁধে নেওয়া নিয়ম; এই উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয় তার নাম ‘কৌতুকমঙ্গল’!

তৃতীয় অঙ্ক

দৃশ্য সেই দ্বিতীয় অঙ্কের মতোই—প্রাসাদের অন্তর্গত উদ্যানে।

আজ বাসবদত্তার বড় দুঃখের দিন। পদ্মাবতী ও উদয়নের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে। উদ্যানের নির্জনতায় বসে বাসবদত্তা নিজের অদৃষ্টের কথাই ভাবছিলেন। এমন সময়ে দাসী এল—নববিবাহিত দম্পতির জন্য মিলন-মালা গেঁথে দিতে হবে বাসবদত্তাকেই! বাসবদত্তা হাসিমুখে গেঁথে দিলেন সেই মালা!

২০. প্রিয়ঙ্গুশিলাপট্টকে

প্রিয়ঙ্গুলতার নিচে একটি শিলাসনে বাসবদত্তা উপবিষ্ট ছিলেন। কবিরা বলেন—নারীর পাদস্পর্শে প্রিয়ঙ্গুলতার কুসুমবিকাশ ঘটে!

২১. কঃ কালঃ!

অর্থটা এই, কতক্ষণ তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি! এইজাতীয় বাগ্‌বিন্যাস ভাসের অত্যন্ত প্রিয়।

২২. কৌতুকমালিকাম্‌

বিবাহের মালা : ‘কথাসরিৎসাগরে’ বর্ণিত ঘটনা অন্যরূপ। সেখানে বাসবদত্তার গাঁথা মালা ‘অমলিন’ দেখে পরে কাহিনীর শেষে উদয়নের মনে সন্দেহ জাগবে। তিনি পদ্মাবতীকে প্রশ্ন করবেন, এ মালা কে গেঁথেছে? নিশ্চয়ই এ মালা বাসবদত্তার গাঁথা। কৌতুকমালা বিয়ের কন্যাকেই গাঁথতে হয়। নাটকে বাসবদত্তাকে গাঁথতে হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় গাঁথেননি। নাটকে তাঁর উক্তি—“ইদমপি ময়া কর্তব্যমাসীৎ—অহো অকরুণাঃ খলু ঈশ্বরাঃ’– “এও করতে হল, বিধাতা কী নিষ্ঠুর।’

২৩. মণিভূম্যাম্‌

মণিময় ভূমিবিশিষ্ট চতুষ্কোণ শৌচাগার! চার কোণে চারটি স্তম্ভ থাকবে—সর্বত্র মণিখচিত।

২৪. গতা এষা

দাসী মালা নিয়ে চলে গেছে। অথবা এই অর্থও হতে পারে—আমার গাঁথা মালা এখন গেছে পদ্মাবতীর হাতে।

২৫. অবিদা

দুঃখসূচক অব্যয়।

স্বপ্ন নাটকের তৃতীয় অঙ্ক বিষাদাচ্ছন্ন—দ্বিতীয় অঙ্কে যে দুঃখের সূচনা হয়েছিল তৃতীয় অঙ্কে তারই অত্যন্ত গভীরতর অভিব্যক্তি। এখানে বাসবদত্তার শুধু দুঃখের গভীরতাই নয়, তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের দিকটিও সুন্দর ফুটে উঠেছে।

চতুর্থ অঙ্ক

দৃশ্য—প্রাসাদের একটি অংশ এবং প্রমোদউদ্যান। এই দৃশ্যে বিদূষকের মঞ্চে প্রথম আবির্ভাব। সংস্কৃত-নাটকের সাধারণ প্রথা এই যে কোনো ফুল বা ঋতুর নামে বিদূষকের নাম রাখতে হয়। স্বপ্ন নাটকের বিদূষকের নাম ‘বসন্তক’, অভিজ্ঞান শকুন্তলের বিদূষক ‘মাধব্য’ (মধু=Spr।ng) শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতেও বিদূষকের নাম ‘বসন্তক’। স্বপ্ন নাটকে বিদূষক চরিত্র ঠিক প্রথানুগত নয়, তুলনায় অনেক সজীব। পদ্মাবতী ও উদয়নের বিবাহোৎসবে একটু অধিক ভোজনের ফলে তার পরিপাকশক্তি বিঘ্নিত।

দৃশ্যটি এই—পদ্মাবতী বাসবদত্তার সঙ্গে এলেন উদ্যানে; ওঁরা উদয়নের কথাই বলছিলেন। এমন সময়ে বিদূষকের সঙ্গে সেখানে এলেন উদয়ন। উদয়নকে দেখে ওঁরা একটা মাধবীকুঞ্জে আত্মগোপন করলেন। ওখান থেকে ওঁরা উদয়ন ও বিদূষকের কথা শুনতে লাগলেন।

অনেক কথাই ওঁরা শুনলেন। বাসবদত্তা শুনলেন—পদ্মাবতীর অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও বাসবদত্তার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেননি। বলতে বলতে উদয়নের চোখে এল জল, বসন্তক গেল জল আনতে। এদিকে পদ্মাবতী গেলেন উদয়নের কাছে, বাসবদত্তা চলে গেলেন স্বস্থানে। ওদিকে জল নিয়ে এল বসন্তক। পদ্মাবতীকে রাজার কাছে দেখে ওঁর এক বিহ্বল অবস্থা। সেই অবস্থায় রাজার চোখের জলের ইতিহাস সে যা বলল তা উপভোগ্য!

উদয়ন এখনও জানেন না, যাকে মৃত ভেবে তিনি শোকাকুল, তিনি তাঁর কাছে কাছেই আছেন। খুবসম্ভব দর্শকগণ উভয়ের মিলনের জন্য উৎকণ্ঠিত—কিন্তু সে মিলন হবে কোন পথে?

২৬. অনপ্সর সংবাসঃ উত্তরকুরুবাসঃ

উত্তরকুরুর ভৌগোলিক অবস্থান হিমালয়ের ওপারে যেখানেই হোক, এই স্থান সুখ ও শান্তিময়। রামায়ণে এই দেশ দেবতাদের ভূমি এবং অনন্তশান্তিধাম বলে বর্ণিত হয়েছে। বিদূষকের বক্তব্য এই—যথারীতি স্নান ও ভোজন করে এমন সুখে তার দিন কাটছে, মনে হচ্ছে সে যেন উত্তরকুরুর অধিবাসী, কেবলমাত্র অপ্সরার অভাব। এইটুকু যা পার্থক্য।

২৭. পরিণমতি

পরি+নম্ হজম হওয়া অর্থে প্রযুক্ত। ভুক্তদ্রব্যের পরিপাক সম্পর্কিত অভিযোগ ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’-এর মাধব্যও বহুবার করেছে।

২৮. অকল্যবর্তম

‘কল্যবর্তম—প্রাতভোজনম্’ ন কল্যবর্তঃ—তদ্রহিতঃ অর্থাৎ বদহজমের ভয়ে সামান্য প্রাতভোজনও নিষিদ্ধ। আহারপরিণামভয়গ্রস্তম্—বিদূষকের বক্তব্য—রোগে অভিভূত এবং প্রাতভোজনবর্জিত হওয়াটা মোটেই সুখের নয়।

২৯. বর্জয়িত্বা ভোজন

ঔদরিক বসন্তকের ভোজন সম্পর্কে এই বৈরাগ্য খুবই সাময়িক বলা বাহুল্য। বৈরাগ্যের কারণ উদরের শোচনীয় অবস্থা!

৩০. অক্ষিপরিবর্তঃ

চেটীর প্রশ্ন ছিল—আপনি ভোজন বারণ করলেন কেন?

বসন্তক একটি উপমা দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে—কোকিলের চোখ যেমন ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়, তেমনি পরিবর্তন চলেছে তার উদরের মধ্যে। অর্থাৎ সেখানে ভয়ানক গোলযোগের ব্যাপার!

বিদূষক এখানে ‘কাক’ বলতে ‘কোকিল’ বলে ফেলেছে। কাকেরই দুটি চোখের জন্য একটি তারা, তাই ঘন ঘন পরিবর্তন করতে হয়। অবশ্য, এ জাতীয় ভাষা বিপর্যয় বিদূষকের পক্ষে স্বাভাবিক এবং উপভোগ্য। উদরের গোলমালে ভাষার গোলমাল!

৩১. প্রবেশক

সংস্কৃত নাটকে দুটি অঙ্কের মধ্যে প্রবেশক রচনার বিধি আছে। আলোচ্য ‘প্রবেশকে’র উদ্দেশ্য শুধু হাস্যরস সৃষ্টি নয়, দর্শকদেরও কয়েকটি সংবাদ দেওয়া। প্রথম সংবাদ—উদয়ন ও পদ্মাবতীর বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে; দ্বিতীয় সংবাদ—উদয়ন ভালোই আছেন। আলোচ্য প্রবেশকের আর একটি উদ্দেশ্য, দর্শকবৃন্দকে উদয়নের আবির্ভাবের জন্য প্রস্তুত রাখা।

৩২. আর্যপুত্রেণ বিরহিতা উৎকণ্ঠিতা

উদয়নের জন্য পদ্মাবতীর প্রেম এখানে অত্যন্ত গভীরভাবে এই সামান্য কথাতেই ব্যক্ত হয়েছে। পদ্মাবতীর উক্তি—কত গভীর সে ভালোবাসা বোঝাবার উপায় নেই, শুধু এইটুকুই বলতে পারি—‘তাঁকে না দেখলে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ি।’

৩৩. আর্যপুত্রপক্ষপাতেন অতিক্রান্তঃ সমুদাচারঃ

স্বামীর প্রতি গভীর প্রেমবশত বাসবদত্তা একটু সীমা লঙ্ঘন করে গেছেন। তিনি ভুলে গেছেন তাঁর এখনও অজ্ঞাতবাস চলছে, তিনি এখনও ছদ্মবেশে আছেন। পদ্মাবতীর সঙ্গে উদয়নের বিবাহ—পদ্মাবতী উদয়নকে দেখেননি! চেটী প্রশ্ন করেছে—যদি তিনি কুরূপ হন? বাসবদত্তা সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলেছেন—না, না, তিনি দেখতে খুবই সুন্দর! বলেই ভাবলেন, বলা ঠিক হয়নি! সঙ্গে সঙ্গে পদ্মাবতীর প্রশ্ন—আপনি কী করে জানলেন? বুদ্ধিমতী বাসবদত্তা ঘুরিয়ে বললেন—উজ্জয়িনীতে সবাই তো ওইরকম বলে থাকে।

৩৪. পঞ্চেষবঃ

প্রেমদেবতার পঞ্চশরের (মদন) পাঁচটি শর—

অরবিন্দ মশোকঞ্চ চূতঞ্চ নবমল্লিকা
নীলোৎপলঞ্চ পঞ্চৈতে পঞ্চবাণস্য সায়কাঃ।

উদয়নের বক্তব্য—আমি যখন অবন্তিরাজতনয়া বাসবদত্তার প্রেমে মত্ত তখনই তো কামদেব আমার প্রতি পঞ্চশর নিক্ষেপ করেছিলেন। আবার এখন পদ্মাবতীর সঙ্গে বিবাহের পরে আমি শরে বিদ্ধ। এই ষষ্ঠ শর কোথা থেকে এল? (তুলনীয়—‘পথিক-যুবতিলক্ষ্যঃ পঞ্চ্যভ্যামধিকঃ শরো ভব’—শকুন্তলা, ষষ্ঠ অঙ্ক)

৩৫. পাদন্যাসনিষণ্ণাঃ কান্তবিযুক্তাঃ

দুইটি বিশেষণই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। উদয়ন বিদূষককে অনুরোধ করছেন—ভ্রমরগণকে ত্রস্ত কোরো না। এরা এখন প্রিয়ার দ্বারা আলিঙ্গিত। পাদক্ষেপে পীড়িত হলে এরা আমার মতোই কান্তাবিযুক্ত হয়ে পড়বে। বাসবদত্তার প্রতি উদয়নের গভীর প্রেম এখানে কারুণ্যের সুরে অভিব্যক্ত :

৩৬. কাশকুসুমরেণুনা

আড়াল থেকে বাসবদত্তা দেখেছেন উদয়নকে। চোখে জল আসা স্বাভাবিক! চেটী বলছে—আপনার চোখে জল! বাসবদত্তা বললেন—না, না, ও কিছু নয়—কাশফুলের রেণু চোখে এসে লাগল, তাই

৩৭. অসন্নিহিতা

বিদূষক উদয়নকে প্রশ্ন করেছে—কে আপনার প্রিয়? তখনকার বাসবদত্তা, না এখনকার পদ্মাবতী? রাজা বলতে অনিচ্ছুক। বিদূষক বলছে—স্বচ্ছন্দে বলুন, একজন তো মরেই গেছেন, আর একজন কাছে নেই।

অদৃষ্টের পরিহাস! দুজনেই তখন আড়ালে বসে সব কথা শুনছেন!

৩৮. সত্যেন শপামি (সচ্চেন সবামি)

বিদূষকের শপথ বাক্য—সত্যের নামে শপথ করছি, কাউকে বলব না! বিদূষক মুখ চরিত্র—রাজা জানতেন, আমরাও জানি এই শপথের কোনো মূল্য নেই। তবু এই শপথ উপভোগ্য, একদিকে উদয়নের মতো গভীর অনুভূতিশীল ব্যক্তি—অন্যদিকে বিদূষকের মতো চপল চরিত্র, উভয়ের সংলাপ এই কারণেই আকর্ষণীয়।

৩৯. অজ্ঞাতবাসোঽপি অত্র বহুগুণঃ

বাসবদত্তার উক্তি! তিনি উদয়নের মুখে শুনেছেন—তাঁর প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠা ও প্রেমের স্বীকারোক্তি। তাই তাঁর মনে হয়েছে—এই অজ্ঞাতবাসের দুঃখ ও ত্যাগের বিনিময়ে তিনি বহুগুণ পুরস্কার ফিরে পেয়েছেন।

৪০. বৈধেয়

শব্দটির অর্থ—অজ্ঞ, মূঢ় বা মূর্খ। যে ‘বিধেয়’ অনুসারে চলে; বিধেয়ে অনভিজ্ঞ।

৪১. মহাব্রাহ্মণ

হীন ব্রাহ্মণ! এখানে অবশ্য কৌতুকের ছলেই উদয়ন এই সম্বোধনটি প্রয়োগ করেছেন একটি সংস্কৃত কারিকা আছে—

শঙ্খে তৈলে তথা মাংসে বৈদ্যে জ্যোতিষিকে দ্বিজে
যাত্রায়াং পথি নিদ্রায়াং মহচ্ছব্দো ন দীয়তে।

কারিকার উল্লিখিত শব্দগুলোর সঙ্গে মহৎ শব্দের সমাস হবে না। আলোচ্য ক্ষেত্রে দ্বিজ শব্দের সঙ্গে সমাস হয়নি, হয়েছে তার সমার্থক ব্রাহ্মণ শব্দের সঙ্গে। সুতরাং ‘মহাব্রাহ্মণ’ হীনার্থক হবে না, এরকম মত কেউ কেউ পোষণ করে থাকেন। অবশ্য উক্ত কারিকাটি পরবর্তীকালের—কালিদাস নিজেও প্রয়োগ করেছেন ‘সন্তানকাকীর্ণং মহাপথম্ (কুমারসম্ভব, সপ্তম সর্গ), ভট্টি প্রয়োগ করেছেন ‘পুণ্যো মহাব্রহ্মসমূহূ জুষ্টঃ (ভট্টিকাব্য, প্রথম সর্গ)—কোনো প্রয়োগই হীনার্থক নয়।

৪২. এতদিদম্। ইদমেতৎ (এদং ইদৎ। ইদং এদং)

বাসবদত্তার স্মৃতিরোমন্থনে উদয়নের মুখ অশ্রুলিপ্ত; বিদূষক পদ্মপত্রে জল বহন করে এনেছেন, হঠাৎ পদ্মাবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। হাতে জল, কী ব্যাখ্যা দেবেন? বিহ্বল বিদূষক কিছুই বলতে না পেরে বলে উঠলেন এই এই, এই, এই—

পদ্মাবতী জেদ করতে থাকেন, বলুন, বলুন; তাতে কৌতুকরসটি আরো জমে ওঠে!

৪৩. অপবাৰ্য্য

অন্য কেউ না শুনতে পায় এইভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আড়ালে কথা বলাকে সংস্কৃত- নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘অপবারিত’। বাংলায় বলি—জনান্তিকে কথা বলা। চতুর্থ অঙ্ক নাটকের অন্য অঙ্কগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম। কিন্তু দর্শকের কৌতূহল, আগ্রহ বা উৎসুক্য কোথাও ক্ষুণ্ণ হয় না। চরিত্রচিত্রণে বা ঘটনাবিন্যাসে নাট্যকার ভাস সর্বত্র তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন! এই অঙ্কেই বিদূষকের প্রথম আবির্ভাব কিন্তু সে তার সরলতা ও রসবোধের সাহায্যে সহজেই দর্শকের মন জয় করে!

পঞ্চম অঙ্ক

পত্নী বিরহিত উদয়নের জাগ্রত অবস্থার ভাববৈচিত্র্য অঙ্কিত হয়েছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অঙ্কে। পঞ্চম অঙ্কের রূপ পৃথক। এখানে নিদ্রিত অবস্থায় উদয়নের স্বপ্নচারণার মধ্যে উদ্ঘাটিত হয়েছে সূক্ষ্মতর মনোবিশ্লেষণ। এ যেন সমুদ্রগৃহের রঙ্গমঞ্চে অভিনীত আর এক ভ্রান্তি বিলাস নাটক (A Comedy of Errors ) —আখ্যান-গঠনের কৌশলে সংস্কৃত সাহিত্যের তুলনাহীন।

৪৪. সমুদ্রগৃহ

প্রাসাদ থেকে একটু দূরে সমুদ্রতীরে নির্মিত গ্রীষ্মাবাস। (Summer House) প্রতিমা নাটকে সমুদ্রগৃহের উল্লেখ আছে (দ্বিতীয় অঙ্ক); কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকেও সমুদ্রগৃহের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।

৪৫. কাকোদর

কাকের ন্যায় উদর যার—কুৎসিতোদর, সৰ্প।

৪৬. অস্তি নগরং ব্ৰহ্মদত্তম্

বিদূষক বিস্মৃতিনিপুণ—তাই নগরের নামে ও রাজার নামে এই ভ্রান্তি।

৪৭. সূচয়তি মামালিঙ্গেতি

সমুদ্রগৃহের এই দৃশ্যটিই শৃঙ্গাররসের উদ্দীপন বিভাব। সুশীতল পরিবেশ; শয্যার অধিকারী ছাড়া গৃহে আর কেউ নেই। নিষ্প্রভ আলো, বাসবদত্তার সমস্ত হৃদয় স্বামীর প্রেমস্মৃতিতে পূর্ণ। এই অবস্থায় বাসবদত্তার হৃদয়ে শৃঙ্গাররসের উদ্বোধন ঘটবে এতে আর বিচিত্র কি? বাসবদত্তা জানতেন না—ঘরে আর কেউ থাকতে পারে। নাটকের নায়ক এবং নায়িকা এই প্রথম মুহূর্তের জন্য মিলিত হলেন, তারপরেই আবার ক্ষণিক বিচ্ছেদ ঘটবে।

৪৮. মহান্ প্রতিজ্ঞাভারঃ

মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণের কাছে বাসবদত্তার এই শপথ, পরিকল্পনা পূর্ণ হওয়ার আগে আত্মপ্রকাশ করা চলবে না।

৪৯. নহি নহি দুঃখিতাস্মি

অদ্ভুত ভাসের প্রকাশভঙ্গী! বাসবদত্তা বলছেন—না, না, আমি রাগ করিনি, আমি দুঃখিত। এই সংক্ষিপ্ত উক্তির মধ্যে বাসবদত্তার গভীর দুঃখ কেমন সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

৫০. বিরচিকাং স্মরসি

কথাসরিৎসাগরের কাহিনীতে আছে—বিরচিকা ছিল এক অন্তঃপুরচারিকা—উদয়ন এক সময়ে তার প্রেমাসক্ত ছিলেন।

৫১. আরুণি

উদয়নের পরম শত্রু—আরুণি বৎসরাজ্যের অধিকাংশই গ্রাস করেছিলেন। অবশ্য কথাসরিৎসাগরে বা গুণাঢ্যের বৃহৎ কথায় আরুণির উল্লেখ নেই; হয়তো ভাসের সময়ে আরুণির কাহিনী প্রচলিত ছিল।

৫২. ত্ৰিপথগা

তিন পথে যার গতি—গঙ্গা। স্বর্গে মন্দাকিনী, মর্ত্যে গঙ্গা—পাতালে ভোগবতী।

আলোচ্য পঞ্চম অঙ্কের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাটকের নামকরণ করা হয়েছে। ভাসের কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি স্বপ্নে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিয়েছেন—কিন্তু বাস্তবতাকে ক্ষুণ্ণ করেননি। নিদ্রিত নায়ক স্বপ্নে কথা বলছেন জাগ্রত নায়িকার সঙ্গে; এই সূক্ষ্ম সংলাপ মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে অপূর্ব!

মনে রাখা প্রয়োজন, যৌগন্ধরায়ণের আরুণি প্রকল্পই নাটকের প্রধান ব্যাপার নয়, নাট্যকারের প্রকৃত লক্ষ্য ছদ্মবেশিনী বাসবদত্তার সঙ্গে উদয়নের মিলন সংগঠন। সমস্ত দৃশ্যটিই করুণরসে সিক্ত। বাসবদত্তার সংক্ষিপ্ত সংলাপ সেই কারুণ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতি রক্ষা করেছে!

দৃশ্যটি শেষে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে! সমুদ্রগৃহে পদ্মাবতী নেই কেন? না থাকার কারণ নাটকে কিছু নেই।

ষষ্ঠ অঙ্ক

এই দৃশ্যের স্থান—কৌশাম্বী, বৎসরাজ্যের রাজধানী

আরুণির সঙ্গে যুদ্ধের আয়োজনের কথা বলা হয়েছে পঞ্চম দৃশ্যের শেষে! সেখানে আমরা জেনেছি, মন্ত্রী রুমন্বান এসেছেন বিশাল বাহিনী নিয়ে। আরুণির বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য উদয়নও প্রস্তুত হয়েছেন।

কিন্তু নাটকে যে সুর বেজে উঠেছে তার সঙ্গে যুদ্ধের সুর মেলে না। পঞ্চম দৃশ্যে সমুদ্রগৃহে যে দৃশ্যের সূচনা, সেখানে ভিন্নতর এক সংগ্রাম শুরু হয়েছে উদয়নের মনে, বাসবদত্তা নিশ্চয়ই জীবিত!

নাট্যকার ভাস সার্থক শিল্পী। তিনি নাটকের করুণ সুরটি কখনও ক্ষুণ্ণ করতে চাননি, তাই যুদ্ধের ফলাফল জানিয়েই তিনি নিশ্চিত। তাঁর লক্ষ্য—নায়ক-নায়িকার মিলন।

বহু দুঃখ ও বিড়ম্বনা ভোগের পর এই মিলন বর্ণিত হয়েছে ষষ্ঠ দৃশ্যে।

৫৩. প্রতিহারী

প্রতিহার শব্দটির অর্থ দ্বাররক্ষক, দৌবারিক—স্ত্রীলিঙ্গে প্রতিহারী।

৫৪. সূর্যামুখপ্রাসাদ

‘সূর্যাঃ আমুখঃ যস্য স সূৰ্য্যামুখঃ,’ অর্থ—‘সূর্য্যাভিমুখঃ’ সূর্যকে সম্মুখবর্তী করে নির্মিত প্রাসাদ। শব্দটির একটি পাঠান্তর—শয্যামুখ। সে ক্ষেত্রে অর্থ হবে—শয্যাকক্ষ বা নিদ্ৰাকক্ষ—যে প্রাসাদের সম্মুখে বর্তমান। অন্য একটি পাঠ—সুযামুনপ্রাসাদ। ‘সুযামুনং যস্মাৎ’ যে প্রাসাদ থেকে যমুনার দৃশ্য সুন্দর দেখা যায়। বুদ্ধস্বামীর ‘বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহে’ আছে—‘সুযামুনপ্রাসাদ’ নামে উদয়নের একটি প্রাসাদ ছিল। এই পাঠটিই সঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য।

৫৫. ঘোষবতী

উদয়নের বীণার নাম। এই বীণা উদয়ন পেয়েছিলেন বাসুকির ভ্রাতা বসুনেমির কাছ থেকে! বসুনেমিকে শবরদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন উদয়ন—বীণা তারই পুরস্কার। ঘোষবতীর সুরে উদয়ন হাতিকেও পোষ মানাতে পারতেন। কথাসরিৎসাগরে আছে, বাসবদত্তা এই বীণা বাজাবার দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

৫৬. মিশ্রবিষ্কম্ভক

প্রবেশক বা বিষ্কম্ভক—দুই-ই একজাতীয় অর্থাৎ দুইয়েরই উদ্দেশ্য যা ঘটে গেছে বা যা ঘটতে যাচ্ছে তারই সংক্ষিপ্ত আভাস দর্শকদের কাছে দিয়ে যাওয়া। তবে প্রবেশক আর বিষ্কম্ভকের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। প্রবেশক থাকবে দুই অঙ্কের মধ্যে, সুতরাং প্রথম অঙ্কের আদিতে ‘প্রবেশক’ থাকতে পারবে না। কিন্তু দুই-ই হবে বৃত্ত বর্তিষ্যমানানা কথাংশানাং নিদর্শকঃ।

পাত্র-পাত্রীর দিক থেকেও পার্থক্য আছে। প্রবেশক—‘নীচপাত্র প্রযোজিতঃ’, বিষ্কম্ভক ‘মধ্যপাত্র প্রযোজিতঃ’। কিন্তু কোনো বিষ্কম্ভকে যদি নিচ এবং মধ্যশ্রেণির পাত্র-পাত্রীর মিশ্রণ ঘটে তাহলে তাকে বলা হবে মিশ্র বিষ্কম্ভক (অথবা সঙ্কীর্ণ বিষ্কম্ভক)। ষষ্ঠ অঙ্কের প্রথমে আছে মিশ্র বিষ্কম্ভক—এই অংশে কঞ্চুকী মধ্যম পাত্র, প্রতিহারী নিচ পাত্র। ‘সঙ্কীর্ণো নীচমধ্যমৈঃ’।

৫৭ রৈভ্য সগোত্র

রৈভ্য—বাসবদত্তার পিতা মহাসেনের এক বৃদ্ধ কঞ্চুকীর নাম। রৈভ্য উদয়নের পরিচিত। সমান গোত্র যাহার—সগোত্র: রৈভ্যের সগোত্র।

৫৮. অঙ্গারবর্তী

মহাসেনের মহিষী—ইহার দুই পুত্র গোপাল ও পালক, এক কন্যা—বাসবদত্তা।

৫৯. বসুন্ধরা

বাসবদত্তার ধাত্রী

৬০. বৈদেহীপুত্রস্য

নাটকে আছে ‘সদৃশমেতৎ বৈদেহীপুত্রস্য’ (উদয়নস্য) কিন্তু কথাসরিৎসাগরে আছে উদয়নের মাতা অযোধ্যার রাজকুমারী ছিলেন। অবশ্য মাতার অন্য নাম বৈদেহী’ হতে পারে।

৬১. ষোড়শান্তঃপুরজ্যেষ্ঠা

মহাসেনের ষোড়শ মহিষীর মধ্যে যিনি প্রধানা। ‘অন্তঃপুর’ শব্দের লক্ষ্যার্থ ‘অন্তঃপুরস্থা স্ত্রী’।

৬২. সর্বগতং কুশলমিতি

খুবই অল্প কথায় উদয়নের হৃদয়ভাবের সুন্দর প্রকাশ। ধাত্রী বলেছেন—‘ভর্ত্রী সর্বগতং কুশলং পৃচ্ছতি’। অর্থাৎ বাসবদত্তার মাতা আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল জানতে চেয়েছেন। উদয়ন উত্তর দিলেন, ‘সর্বগতং কুশলমিতি। অম্ব! ঈদৃশং কুশলম্!’ সর্বাঙ্গীণ কুশলই বটে! এই তো, কুশল—দেখতেই পাচ্ছেন।

বাসবদত্তার স্মৃতিবিজড়িত হৃদয়ের সার্থক অভিব্যক্তি। এই কথাটুকুর মধ্যে উদয়নের করুণ নিশ্বাসের ধ্বনিও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

৬৩. প্রবিশ ত্বমভ্যন্তরম্

আবন্তিকারূপে পরিচিতা রমণী যে বাসবদত্তা—একথা শোনামাত্র উদয়ন উত্তেজিত হয়ে বলে উঠেছেন—কী! ইনি মহাসেনপুত্রী! দেবী, তবে পদ্মাবতীর সঙ্গে অন্তঃপুরে যাও। কিন্তু যৌগন্ধরায়ণ বাধা দিলেন—তিনি তাঁদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে চান!

৬৪. কৌশাম্বী

বৎসরাজ উদয়নের রাজধানী

৬৫. ভরত বাক্যম্

নাটকের শেষে শুভেচ্ছা প্রকাশক শ্লোক। ভরত শব্দের অর্থ নট—এই শ্লোক কোনো এক প্রধান নাটকীয় চরিত্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে। তাছাড়া, ভরত ছিলেন নাট্যশাস্ত্রের আদি প্রবর্তক—সুতরাং নাটকের শেষে তাঁকে স্মরণ করাও এই শ্লোকের উদ্দেশ্য।

‘ভরতবাক্য’ একজন প্রধান চরিত্রের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে অথবা মঞ্চনির্দেশ এভাবেও দেওয়া চলে—নাটকের শেষ দৃশ্য অভিনীত হয়ে গেল—নাটকে অংশগ্রহণকারী নট-নটী সবাই এসে দাঁড়ালেন রঙ্গমঞ্চে, তাঁরা মিলিত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন এই ‘ভরতবাক্য’।

শ্লোকে রাজসিংহের কথা আছে—খুব সম্ভব ‘রাজসিংহ’ কোনো বিশেষ রাজার নাম নয়। কেউ-কেউ অবশ্য বলেন, রাজসিংহ ভাসের সমসাময়িক এক রাজা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভাস-রচিত তেরটি নাটকের মধ্যে ছয়টি নাটকের সমাপ্তি ঘটেছে এই একই ভরতবাক্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *