স্বনামধন্যদের সমাজ
They are celebrated because they are displayed as celebrities… their very image is dependent upon publicity… –C. Wright Mills
ডাস্টবিনের আবর্জনাস্তূপ থেকে সেদিন বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের একখানি ছেঁড়া পাতা হাওয়ায় উড়ে এসে পায়ে জড়িয়ে গেল। পা ছাড়াতে গিয়ে হঠাৎ একটা দু—কলম হেডিং—এর উপর নজর পড়ল—’বাংলার সংস্কৃতি—সংকট : সভাপতি শ্রীভজহরি মণ্ডলের ভাষণ’। কাগজে ছাপা ছবিতে মণ্ডলমশায়ের রোম্বাসের মতো ভারিক্কি মুখখানা ময়লার ছাপ লেগে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, চেনা যায় না। পথে চলতে চলতে চেষ্টা করেও মনে পড়ল না, এ মুখ কোথাও দেখেছি কি না। অবশ্য আমার পক্ষে না—দেখাই স্বাভাবিক, কারণ সাহিত্যসভা বা সংস্কৃতির আসরে উপস্থিত থাকা আমার কাছে ফ্যাসিস্ট নির্যাতন সহ্য করার চেয়েও মারাত্মক মনে হয়। বস্তুত কোনো বক্তৃতা—সভা আমার ধাতে সয় না। কাজেই সংবাদপত্রের ছবিতে অস্পষ্ট ভজহরি মণ্ডলের মুখ আমার স্মৃতিপটে স্পষ্ট না হয়ে ওঠারই কথা। তা না উঠলেও এইটুকু বুঝলাম যে তিনি কলকাতার ‘সিলেব্রিটি’ বা স্বনামধন্যদের মধ্যে একজন।
বর্তমানকালে স্বনামধন্য তাঁরা যাঁদের নাম দিনের পর দিন ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হয় সংবাদপত্রে, বেতারে এবং জনসংযোগের নানা রকমের আধুনিক প্রচারযন্ত্রে। প্রথমে মহানগরের সংঘ, ক্লাব, পার্টি, মণ্ডলী প্রভৃতি থেকে নামটির মৃদুধ্বনি উঠতে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অবশেষে সেই ধ্বনিতরঙ্গ মহানগরের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের দূর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছোয় প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে। একালের প্রচারযন্ত্রের এমনই মাহাত্ম্য যে, যে—কোনো অপরিচিত অজ্ঞাতকুলশীল তৃতীয় পুরুষ রাতারাতি তার কৃপায় স্বনামধন্য হতে পারেন। সংবাদপত্রে যদি ঘন ঘন সাত দিন তাঁর নাম মুদ্রিত হয়, বেতারের হাওয়াযন্ত্রে সেই নাম ধ্বনিত হয়, সংবাদচিত্রে সেই মুখ প্রদর্শিত হয়, এবং কয়েকটি জনসভায় তাঁর কম্বুকণ্ঠের ভাষণ মাইকযন্ত্রে নিনাদিত হয়, তাহলে রাস্তার রামের পক্ষেও দশরথনন্দন রামচন্দ্রর চেয়ে বেশি গুণবান ও স্বনামধন্য হয়ে ওঠা কঠিন হয় না। তারপর যেখানে তিনি যাবেন সেখানে লাউডস্পিকার যাবে, ক্যামেরা কাঁধে ফোটোগ্রাফাররা তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করবে, অটোগ্রাফ—হান্টাররা ঘিরে ধরবে এবং সমস্ত প্রচারযন্ত্র মিলে এমন একটা ‘ইমেজ’ তাঁর তৈরি করে দেবে, যা দেখে রাস্তার রাম বা ভজহরি মণ্ডল নার্সিসাসের প্রতিবিম্বের চেয়েও অবাক হয়ে যাবেন। আধুনিক স্বনামধন্যতার প্রতিরূপ তৈরির ব্যাপারটা কতকটা হাততালির মতো। হাততালি সর্বদাই একটি—দুটি হাত থেকে আরম্ভ হয়, তারপর বহু হাতের তালিতরঙ্গের বিস্ফোরণ হয় প্রচণ্ড ধ্বনিতে। স্বনামখ্যাতিরও ক্রমবিস্তারের গতি অনুরূপ, হাততালিসদৃশ।
মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে কিছুকাল আগে পর্যন্ত—খুব বেশি হলে তিনশো বছরের বেশি নয়—স্বনামধন্যতার কোনো সমস্যা ছিল না সমাজে। আজকাল খ্যাতি বলতে যা বোঝায় তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না তখন। ক্ষমতা ও প্রভাব—প্রতিপত্তি ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ বলে স্বীকৃত হত এবং সেই গুণ যাঁদের থাকত তাঁদের মর্ত্যলোকের মানুষ বলেই মনে করা হত না, ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করা হত। যেমন প্রাচীন ও মধ্যযুগের শাসকরা, রাজারাজড়ারা। শাসকগোষ্ঠীর বাইরে যাঁরা তাঁদের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করতেন, তাঁদের প্রভাব—প্রতিপত্তি থাকলেও, তা এত সাময়িক ও রাজারাজড়াদের খেয়াল—মর্জিনির্ভর ছিল যে কোনো খ্যাতির বিভ্রম ব্যক্তিসত্তাকে বেষ্টন করে রচিত হওয়া সম্ভবই ছিল না। বর্তমানে যাঁদের ‘এলিট’ বলা হয়, সেই ‘এলিট’ শ্রেণিও সেকালে খ্যাতির প্রাঙ্গণ থেকে অনেক দূরে থেকে নিজেদের সামাজিক কর্তব্য পালন করতেন, সমাজের জনমানসে তাঁদের ব্যক্তিত্বের কোনো প্রতিরূপ নিবদ্ধ করার কোনো প্রচেষ্টাই তাঁদের ছিল না। সমাজের পরিবেশ তখন অন্যরকম ছিল এবং প্রচার ও বিজ্ঞাপনের আধুনিক কলাকৌশল তখন উদ্ভাবিত হয়নি। কাজেই আত্মপ্রচারের কোনো উদ্ভট ইচ্ছা (সেকালের বিচারে উদ্ভটই বলতে হয়) যদি তখন কারও মনে নিভৃতে জেগে থাক, তাহলে নিরুপায় অবস্থায় অঙ্কুরেই তার বিনাশ হয়েছে। স্বনামখ্যাতি সম্বন্ধে অচেতনতার উল্লেখ্য দৃষ্টান্ত হল প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিল্পীরা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিল্পকলা—স্থাপত্য—ভাস্কর্যের যে বিস্ময়কর নিদর্শন দেশে দেশে দেখা যায়, তার স্রষ্টা শিল্পীদের কোনো পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না, মাত্র কয়েকজন রাজসভার শিল্পী বা রাজপ্রসাদজীবী শিল্পী ছাড়া। আর যে বিপুল লোকসাহিত্য, লোকশিল্প ও লোকসংগীতের নিদর্শন জনসমাজে আজও ব্যাপক প্রেরণার উৎসরূপ, তারও স্রষ্টা—রচয়িতাদের নামগোত্র আজও আমাদের জানা নেই। সমাজের যৌথ প্রতিমাই (‘কালেকটিভ ইমেজ’) তখন মানুষের কাছে ব্যক্তিপ্রতিমার চেয়ে অধিকতর বাস্তব সত্য ছিল এবং সমস্ত সত্যকে আচ্ছন্ন করে ছিল শাসকদের ঈশ্বর—প্রতিনিধিত্বের বা অবতারত্বের সত্য, যার মধ্যে সমাজের সমস্ত ব্যক্তির সত্তা নিমজ্জিত। ব্যক্তিপ্রতিমার উৎকট প্রকাশেচ্ছা অথবা স্বনামধন্য বা ‘সিলেব্রিটি’ হওয়ার উদগ্র বাসনা তাই তখন লোকের মনে জাগত না।
ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয়েছে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অভ্যুদয়কালে। যদিও ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক মডেল গড়ে উঠেছে চতুর্দশ—পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে এবং যাকে ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগরণ বলা হয় তার সূচনা হয়েছে তখন, তাহলেও ধনতন্ত্রের ঐতিহাসিক অগ্রগতি অষ্টাদশ শতক থেকেই আরম্ভ হয় এবং তার প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় ঊনবিংশ শতকে। অষ্টাদশ শতকে জনসনের যুগের কফি হাউস—ট্যাভার্নের কলগুঞ্জনের মধ্যে কিছুটা মধ্যযুগীয় যূথচেতনার রেশ ছিল, ছোট ছোট গোষ্ঠী ছাড়িয়ে ব্যক্তির মধ্যে সেই চেতনার বিস্তার তখনও বিশেষ হয়নি। অবশ্য খাতির প্রাঙ্গণে ব্যক্তিবিশেষদের আনাগোনা তখন থেকেই শুরু হয়েছে বলা যায়। তারপর ঊনবিংশ শতকে ধনতন্ত্রের অবাধ অগ্রগতি ও তার সাম্রাজ্যবাদী বেশ ধারণের সময় সামাজিক জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস রীতিমতো তীব্র হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অজ্ঞাতকুশীলরা এই সময় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দুঃসাহসিক অভিযানে বলবুদ্ধি প্রয়োগে কৃতিত্ব দেখিয়ে ইতিহাসে স্মরণীয় কীর্তিমান ও খ্যাতিমান ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। এদিকে আর্থিক জীবনে ফ্রি মার্কেট, অবাধ বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতায় সাফল্যলাভ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ সোপান বলে গণ্য হয়। ব্যক্তিগত জীবনেও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা প্রখর হয়ে ওঠে। কিন্তু ঊনবিংশ শতকেও এই আত্মপ্রতিষ্ঠার মানদণ্ডগুলি অনেকটা সুনির্দিষ্ট ছিল, যেমন বিত্ত ও বিদ্যা। বিংশ শতকে, বিশেষ করে গত পঁচিশ—তিরিশ বছরের মধ্যে, যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের বাহ্যরূপের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এবং প্রচারযন্ত্র ও প্রচারকলার প্রভাব এত বেড়েছে যে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার কোনো মানদণ্ডই নির্দেশ করা এখন প্রায় অসম্ভব। আগেকার বিত্ত ও বিদ্যার মানদণ্ডগুলি যে বর্তমানে অচল হয়ে গেছে তা নয়, এখনও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতির দিক দিয়ে তাদের মূল্য আছে। কিন্তু বর্তমানকালের পাবলিসিটি বা প্রচারমূল্যের কাছে অন্য সবকিছুর মূল্য—ব্যক্তিগত গুণ বা প্রতিভা, এমনকী বহুদিনের শক্তিশালী মানদণ্ড ‘অর্থ’ পর্যন্ত বলা চলে। এখন নামটাই হয় বিখ্যাত, প্রচারযন্ত্রের পুনরাবৃত্তির ফলে, ব্যক্তি কী তা বিচার্য নয়। প্রচারযন্ত্র যখন কোনো কারণে বিকল ও স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সেই নামটাও আবার অসংখ্য নামের বিশাল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়; একদা—স্বনামধন্য ব্যক্তি অগণিত অজ্ঞাতকুলশীলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যান। তখন কোনো মহানগরের বিশাল কোনো জনতার মধ্যে যদি কেউ তাঁকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো পাশের লোকটির কানে কানে বলেন, ‘ওই লোকটি কে জানেন? উনি ভজহরি মণ্ডল, ১৯৪২—৪৩—এ প্রায় প্রত্যহ যাঁর নাম খবরের কাগজে বেরুত।’ এই হল বর্তমানের স্বনামধন্য। অর্থাৎ ‘স্বনামধন্য’ এমন কতকগুলি নাম যা কেবল প্রচারধ্বনির জন্য ধন্য এবং সেই প্রচারধ্বনি নীরব হয়ে গেলে তাঁদের পক্ষে স্বনামধন্যতাও বজায় রাখা কঠিন। স্বনামধ্বনি যাঁর যত বেশি তিনি তত বেশি স্বনামধন্য, শুধু ধ্বনির জন্যই ধন্য।
ইংরেজদের আগমনের পর কলকাতার নাগরিক সমাজে যে নতুন অভিজাত গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা হয়, অর্থাৎ যাঁরা স্বনামধন্য হন, তাঁরা প্রধানত নানা উপায়ে উপার্জিত অর্থের জোরেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগের ১৮৩৯ সালের কাগজপত্রে তাঁদের নাম—পরিবারের একটি তালিকা পাওয়া যায়। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের নাম—পরিবারের সংখ্যা এই :
বাগবাজার ৬ শোভাবাজার ৬
শ্যামবাজার ৪ নিমতলা ২
জোড়াবাগান ১ সিমলা ৩
গরানহাটা ১ জোড়াসাঁকো ৩
পাথুরিয়াঘাটা ১৮ বড়বাজার ১১
মেছুয়াবাজার ১ চোরবাগান ৪
কলুটোলা ৬ পটলডাঙ্গা ১
বহুবাজার ৩ মলঙ্গা ৩
জানবাজার ৪ খিদিরপুর ২
কাশীপুর ৩ ভবানীপুর ২
এই ৮৪টি পরিবারে মোট প্রায় ১০০ জন উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কলকাতা শহরে স্বনামধন্য ছিলেন। আমেরিকার মেট্রোপলিটন ৪০০—র মতো আমরা এই একশোজনকে বাংলার ‘মেট্রোপলিটন ১০০’ বলতে পারি। এঁরা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন অর্থের বা বিত্তের জোরে, মধ্যযুগের কুলকৌলীন্য বেশ কিছুটা নস্যাৎ করে দিয়ে। কী প্রকারে অর্থ উপার্জন করেন? সেই দীর্ঘ রোমাঞ্চকর ইতিহাস আবৃত্তির অবকাশ নেই এখানে। সংক্ষেপে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বলা যায় :
ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুরের অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন এই কলিকাতা নামক মহানগর আধুনিক কাল্পনিক বাবুদিগের পিতা কিম্বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আসিয়া স্বর্ণকার বর্ণকার কর্মকার চর্মকার চটকার মঠকার বেতনোভুক হইয়া কিম্বা রাজের সাজের কাঠের ঘাটের খাটের মঠের ইটের সরদারি চৌকিদারী জুয়াচুরি পোদ্দারি করিয়া… কিঞ্চিৎ অর্থসঙ্গতি করিয়া কোম্পানির কাগজ কিম্বা জমিদারি ক্রয়াধীন বহুতর দিবসাবসানে অধিকতর ধনাঢ্য হইয়াছেন ইহারা অখণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত…
নববাবুবিলাস (১৮২২—২৩)
‘ইংরাজ কোম্পানি বাহাদুরের অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা’ অবলম্বন করে কলকাতা শহরে যাঁরা ‘অধিকতর ধনাঢ্য’ হয়েছিলেন, নাগরিক সমাজে তখন তাঁরাই ছিলেন ‘অখণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত’। তাঁরাই হলেন আমাদের বাংলার স্বনামধন্যদের আদিপুরুষ, আধুনিক যুগের প্রথম ‘সিলেব্রিটি’র দল। তাঁরা যেসব মোসাহেব ও পণ্ডিত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন, তাঁরাই ছিলেন তখন তাঁদের নামমাহাত্ম্যের প্রচারক, সংবাদপত্রের প্রচার তখন বড় একটা ছিল না, খুব সামান্য ছিল, ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তাঁরা ছিলেন ‘ভিজুয়াল পাবলিসিটি’র বস্তু, অন্য কোনো যান্ত্রিক প্রচারের সাহায্যে তাঁরা স্বনামধন্য হননি। ‘দরিদ্রনারায়ণ’—এর সেবায়, পুত্রকন্যার বিবাহে, পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধে, দেবদেউল প্রতিষ্ঠায় লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে তাঁরা স্বনামধন্যতা অর্জন করেছেন। তাঁদের স্বর্ণযুগ উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে অস্তগামী হল, যখন আধুনিক শিক্ষার প্রচলনের ফলে বিত্তের সঙ্গে বিদ্যা ও কৃতিত্ব আত্মপ্রতিষ্ঠার মান হিসাবে মিশে গেল এবং তার সঙ্গে সংবাদপত্রের প্রচারকার্য আরম্ভ হল। স্বনামধন্যতার প্রতিযোগিতা বাড়ল সমাজে, তার প্রচারক্ষেত্র প্রসারিত হল সংবাদপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু তথাপি খ্যাতি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার এই পন্থা—প্রতিযোগিতার একটা সুবিন্যস্ত প্যাটার্ন ছিল এবং একটা যুক্তি বা বুদ্ধি—বিবেচনার গণ্ডির মধ্যে টেনে এনে তার বিচার করাও সম্ভব হত। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের অনেক ক্ষেত্রেই যেমন অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় ঘটেছে, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার পন্থা—প্রতিযোগিতার প্রচলিত প্যাটার্ন গত একপুরুষকালের মধ্যে ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে গেছে। মানুষের শ্রদ্ধা—ভক্তি—ভালোবাসার মনোভঙ্গিরও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। সকলের অগোচরে অতিদ্রুত একটা সামাজিক বিপ্লব হয়ে গেছে টেকনোলজিক্যাল অগ্রগতির জন্য। এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে যে তার পায়ের চিহ্ন পর্যন্ত আমাদের চেতনার তটে পড়েনি, তাই আমরা পরিবর্তনের রূপ দেখে বিহ্বল হয়ে যাই, যুক্তি বা বুদ্ধির কোনো গণ্ডির মধ্যে খুঁজে পাই না। অর্থনৈতিক উৎপাদনক্ষেত্রের ব্যাপক যন্ত্রীকরণের মতো, কম্পিউটার অটোমেশনের মতো, মানুষের সমাজের ও জীবনের সামগ্রিক যন্ত্রীকরণ হয়েছে আজ। মানুষের জীবন হয়েছে অটোমেশনের মডেল, তার হৃদয়, বুদ্ধি, যুক্তি সবই আজ কম্পিউটারের নামান্তর মাত্র। আজকের দিনে তাই যাঁরা এই যান্ত্রিক সমাজের সকল রকমের প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে ‘স্বনামধ্বনি’র সুযোগ পান, তাঁরাই যন্ত্রতুল্য মানুষের যান্ত্রিক বুদ্ধিযুক্তি জয় করে অতি সহজে ‘স্বনামধন্য’ হতে পারেন।
আধুনিক যন্ত্রীকৃত সমাজের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত আমেরিকান সমাজ। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির আশ্চর্য উন্নতির ফলে আমেরিকায় ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য এত বেড়েছে যে মানুষ যেন সেখানে আজ অফুরন্ত অনির্বাণ উপভোগের ওয়ান্ডারল্যান্ডের অধিবাসী। সমাজবিজ্ঞানীরা আজকের আমেরিকানদের কনজিউমারল্যান্ডের বেবি (শিশু) বলেছেন। এই তাজ্জব দেশ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন হওয়া সত্ত্বেও অর্থ ও ভোগেচ্ছার মোহে অন্ধ হয়ে মানুষ আজ সেখানে শোষণ—পীড়ন—দাসত্বের যন্ত্রণা পর্যন্ত কিছুটা ভুলে গেছে। একচেটিয়া ধনতন্ত্রের অথবা আধুনিক কর্পোরেট ব্যুরোক্রাটিক ধনতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে এই পণ্যপ্রাচুর্যের প্রথম ফল হয়েছে প্রতিযোগিতার জন্য বৈচিত্র্য, অনন্ত বৈচিত্র্য বলা চলে—যেমন হাজার রকমের হিটার ফ্রিজিডেয়ার কুকার রেডিয়ো টেলিভিশন অটোমোবিল কসমেটিক ইত্যাদি। বৈচিত্র্যজনিত প্রতিযোগিতায় মুনাফাসহ মাল বিক্রির তাগিদে আজ আমেরিকান সমাজে বিজ্ঞাপন বা প্রচারের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞাপন আজ শুধু বিশেষরূপে জ্ঞাপন নয়, প্রচারকলা (অ্যাড—আর্ট) বিশেষ, এবং সমস্ত শিল্পকলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কলা প্রচারকলা। বড় বড় শক্তিমান শিল্পীরাও আজ হাজার হাজার ডলার বেতনে প্রচারকলার সাধনায় নিযুক্ত। ১৯৬৬ সালে আমেরিকার ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপনের জন্য দু—হাজার কোটি ডলার (১৬ হাজার কোটি টাকা) খরচ করেন। ভারতবর্ষের মতো অর্ধোন্নত দেশের একটা বড় রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনা এই টাকায় সার্থক হতে পারে। কীজন্য এই বিজ্ঞাপন? ক্রেতাদের মন ভুলিয়ে ফুসলিয়ে মাল বিক্রির জন্য এবং চটকদার মোড়ক, প্যাকেজ ও লেবেলের সাহায্যে। মাল যা—ই হোক, তাতে কিছু আসে—যায় না, বিক্রি নির্ভর করে মোড়কের আকর্ষণ, প্যাকেজের ডিজাইন ও লেবেলের চমকের উপর। মাল যদি বাজারের শ্রেষ্ঠ মাল হয়, কিন্তু তার মোড়ক ও প্যাকেজ যদি চিত্তাকর্ষক না হয়, তাহলে তা বিকোবার কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমান যুগের বিজ্ঞাপনের এই ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করলে একালের শ্রেষ্ঠ এপিক উপন্যাস রচনা করা যায় এবং যে উপন্যাস যে—কোনো বিকৃত কামোদ উপন্যাসের চেয়েও আকর্ষণীয় হতে পারে। * আপাতত তাই বিজ্ঞাপন বা প্রচার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমরা ‘স্বনামধন্য’র প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে অবান্তর নয়। ‘পাবলিসিটি’র সঙ্গে আধুনিক ‘সিলেব্রিটি’র সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ যে বিজ্ঞাপন—প্রসঙ্গের এটুকু অবতারণা না করে উপায় নেই। এই বিজ্ঞাপন ও প্রচারসর্বস্ব সমাজের কথা ভাবলে মনে হয় যেন বর্তমান সমাজ একটা বিশাল ‘সেলসরুম’ ছাড়া কিচ্ছু নয়, যেখানে প্রত্যেকেই ‘সেলসম্যান’ :
The salesman’s world has now become everybody’s world, and… everybody has become a salesman…– C Wright Mills
এই সেলসম্যানের সমাজে স্বনামধন্যতা নির্ভর করে সেলসম্যানশিপের কৃতিত্বের উপর। হরির দশরকম গুণ আছে, কিন্তু সে ভালো সেলসম্যান নয়, কাজেই বাজারে সে বেশি দামে বিকোল না, ‘সিলেব্রিটি’ হল না, অথচ এ রকমের গুণ নিয়ে ভজহরি ভালো সেলসম্যান বলে—অর্থাৎ সুযোগ্য আত্মবিক্রেতা বলে—খবরের কাগজে ডবল—কলম হেডিং—এও স্থান পেল এবং স্বনামধন্যও হয়ে গেল। বর্তমান যুগে বিদ্যার ক্ষেত্রে এই মোড়ক—লেবেল—প্যাকেজের মাহাত্ম্য যেরকম প্রকট, এরকম বোধহয় আর কোনো ক্ষেত্রেই নয়। সত্যিকার পণ্ডিত ও বিদ্বান ব্যক্তি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণীয় ডিগ্রির প্যাকেজ—লেবেলে ভূষিত না হন, তাহলে বিদ্বৎসমাজ বা সাধারণ সমাজে তাঁর যোগ্য সমাদার দুষ্প্রাপ্য ব্যাপার। অথচ আজকের সমাজে প্রচুর অর্ধশিক্ষিত লোক কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ম্যানিপুলেটেড’ ডিগ্রির প্যাকেজ—লেবেলের জোরে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে সমাজ—রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভুত্ব করেছেন দেখা যায়। আজকের তরুণ বিদ্রোহ ও ছাত্র বিদ্রোহ প্রধানত বিদ্যার এই সেলসম্যানশিপ ও প্যাকেজ—মাহাত্ম্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত এবং পাঠ্য বিষয় পরীক্ষা শিক্ষক—অধ্যাপক—উপাচার্যের প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রদর্শনের একটা বড় কারণও তা—ই। ফ্রান্সের কোঅন—বাঁদিত থেকে আরম্ভ করে পৃথিবীর সমস্ত দেশের তরুণ ছাত্রনেতাদের উক্তি, বিবৃতি ও রচনা থেকে তা পরিষ্কার—বোঝা যায়। কে না জানে যে বাইরের সমাজের যাবতীয় দুর্নীতি, নৈতিক অবনতি, পরস্পর—পিঠ—চুলকানি, স্বজনপোষকতা প্রভৃতি ব্যাধির উপসর্গ (বয়োজ্যেষ্ঠদের) আজকের বিদ্যায়তনে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যধিক প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারি তদন্ত কমিশন কিছুদিন আগে (১৯৬৭) বিহারের বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টে বলেছেন—
…things are really unspeakably bad in Bihar University, The rot has run deep, very deep… It is no longer a University.
যেমন বিহারে, তেমনি অন্যান্য প্রদেশে, এবং শুধু এ দেশের প্রদেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র। সরকারি তদন্ত কমিশন এমন কথাও বলেছেন, ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে, যে টাকা দিলে যে—কোনো ডিগ্রি পাওয়া যায়, যেরকম ডিগ্রি সেরকম টাকার পরিমাণ। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যায়তন নাম এরকম একটি পচাগলা বিকৃত শব—প্রতিষ্ঠানকে যদি সমাজের ভবিষ্যতের মানুষ, অর্থাৎ তরুণরা, উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন করে, তাহলে তার বাইরের রূপ যতই উচ্ছৃঙ্খল মনে হোক, কেবল অভিসম্পাত বর্ষণ করে তা বন্ধ করা যাবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শোচনীয় অবনতি ও পচন যেমন সত্য, তেমনি তার বিরুদ্ধে ছাত্র বিদ্রোহটাও নির্মম বাস্তব সত্য। কোনো সত্যই কেবল হাহুতাশ, কপাল—চাপড়ানি ও কটুবাক্য দিয়ে অপসারিত করা যাবে না।
আগে বলেছি যে আধুনিক যুগে স্বনামধন্যতার দুটি বড় সোপান হল—বিত্ত ও বিদ্যা। বিত্তের অখণ্ড প্রতিপত্তি যতদিন মার্কেটতুল্য সমাজে থাকবে, ততদিন বিত্তবানেরও প্রতিপত্তি থাকবে, কেউ খণ্ডাতে পারবে না। যদিও বিত্তবানের রূপ আজ অনেক বদলে গেছে, যেমন শিল্প মালিক ও তাঁর ম্যানেজার বা প্রধান কর্মসচিব উভয়েই বিত্তবান—একজন মালিক ও অন্যজন তাঁর অধীন কর্মী—কিন্তু তাহলেও প্রত্যক্ষ প্রতিপত্তি ম্যানেজার বা কর্মসচিবের অনেক বেশি (যদিও মালিকের তুলনায় তাঁদের বিত্ত অনেক কম) এবং স্বনামধন্য বর্তমান সমাজে ম্যানেজার ও কর্মসচিব, তাঁদের মালিকরা নন। বিদ্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি হয়েছে যে—কোনো ভোগ্যপণ্য বা বিক্রয়পণ্যের মতো চটকদার প্যাকেজ—লেবেলসর্বস্ব। কাজেই বিদ্বানদের সিলেব্রিটিও এ যুগে ডিগ্রি নামক প্যাকেজ—ডিজাইন ও লেবেল প্রচারের উপর নির্ভরশীল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সবার উপরে মানুষ নয়, তার গুণ চরিত্র প্রতিভা নিষ্ঠা কিছুই নয়, প্যাকেজ—লেবেল—ট্রেডমার্ক ও প্রচারই বড় সত্য, এবং যাঁর প্যাকেজের ডিজাইন চিত্তাকর্ষক, যার প্রচারের ধ্বনি বেশি, তিনিই বর্তমান সমাজে সবচেয়ে বেশি স্বনামধন্য। সারবস্তু বা পদার্থ কিছুই নয়, লেবেলটাই মহাসত্য, যেমন ভোগ্যপণ্যের বাজারে, তেমনি বিদ্যাপণ্যের বাজারে।
যন্ত্রীকৃত সমাজ, বহুজনতন্ত্র (‘মাস ডেমোক্রাসি’), অর্ধশিক্ষিতের বিপুল বন্যা (শিক্ষামানের শোচনীয় অবনতির জন্য), ভোটতান্ত্রিক রাজনীতির যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং যান্ত্রিক আমোদপ্রমোদ ও অবসর বিনোদন ইত্যাদির ফলে ব্যক্তিমুখী আকর্ষণও যান্ত্রিক উত্তেজনাশ্রিত হয়ে উঠেছে। আমেরিকান সমাজে আজ যাঁরা এক নম্বরের স্বনামধন্য তাঁরা হলেন (রাইট মিল্স)—
Movie Stars
Broadway Actors
Sportsmen
Crooners
Dinner Show Clowns
কলকাতা—দিল্লির সমাজের সঙ্গে কোনো পার্থক্য আছে কি? একেবারেই নেই। কিছুদিন আগে কোনো চিত্রতারকাকে কলকাতার পৌরসভা থেকে অভিনন্দিত করার আয়োজন করা হয়, কিন্তু সভা প্রায় পণ্ড হয়ে যায় দর্শনাকাঙ্ক্ষী মুগ্ধ ভক্তদের উন্মত্ত আচরণে। সংবাদপত্রে ডবল—কলম হেডিং—এ খবর দেওয়া হয়।
FANS GO WILD AT CIVIC RECEPTION
আরও কিছুদিন পরে যখন চিত্রতারকারা রাইটারস’ বিল্ডিংস—এ তাঁদের আরজি পেশ করতে যান তখন সেখানকার কর্মীদের (যাঁরা প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতিসচেতন বলে শোনা যায়) কলরবে ও ছুটোছুটিতে মহাকরণ কেঁপে ওঠে।
FILM STARS’ ENTRY CREATES
CHOAS IN WRITERS’ BUIDINGS
সংবাদপত্রের ডবল—কলম হেডিং। নিউ ইয়র্ক ও কলকাতা—দিল্লির মধ্যে আজ আর স্বনামধন্যতা ও জনপ্রিয়তার কোনো তফাত নেই। চিত্রতারকা যেমন খেলোয়াড়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ আকর্ষণীয় ব্যক্তি, তার প্রমাণ খেলার মাঠ থেকে খেলোয়াড়দের হোটেল পর্যন্ত সবসময় পাওয়া যায়। হোটেলের ক্রুনার ও ক্লাউনরাও তাঁদের জগতে বেশ স্বনামধন্য, কাগজের বিজ্ঞাপনে ও হোটেলের হলঘরে মাইকের প্রচারে তাঁদের ‘সিলেব্রিটি’ তৈরি করা হয়। সাহিত্যক্ষেত্রে সিনেমা—পত্রিকা ও দৈনিক সংবাদপত্র সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং বর্তমান সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। লোকরুচি তাঁরাই তৈরি করেন। কাজেই বর্তমানকালে সম্পাদক, সাংবাদিক ও রিপোর্টারই সাহিত্যজগতের শ্রেষ্ঠ স্বনামধন্য ব্যক্তি। জনসংযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার তাঁদের আয়ত্তে, তাঁরা ইচ্ছা করলে শিবকে বাঁদর এবং বাঁদরকে শিব করতে পারেন, হয়কে নয় এবং নয়কে হয়ও করতে পারেন। এ যুগের খবরের কাগজ সাধারণের কাছে বেদ—বাইবেলের মতো। কাজেই সকল শ্রেণির লোককে—বিশেষ করে যাঁরা স্বনামধন্য হতে চান—সাংবাদিকদের তোষামোদ করতে হয়, যদি একটু আত্মপ্রচারের সুযোগ পাওয়া যায়—এবং তার ফলে সাংবাদিকরা অটোমেডিকালি স্বনামধন্য হয়ে যান। এ ছাড়া, রাজনৈতিক নেতারা স্বনামধন্যদের মধ্যে শীর্যস্থানীয়, তালি ও ধ্বনির জোয়ারে এত সহজে তাঁরা স্বনামধন্যতার তরঙ্গশীর্ষে উঠতে পারেন, যা সমাজের আর কোনো শ্রেণির লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিলে, আধুনিক আমেরিকান সমাজে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বনামধন্যদের শতকরা হার এইরকম দাঁড়ায় (রাইট মিলস)—
ক. সিনেমা, রেডিয়ো, প্রমোদ, স্পোর্টস, সাংবাদিকতা : শতকরা ৩০ জন
খ. বনেদি ধনী, কিন্তু নতুন কৃতিত্বের অধিকারী : শতকরা ১২ জন
গ. প্রতিষ্ঠানের এগজিকিউটিভ, ম্যানেজার, সরকারি
উচ্চপদের কর্মী, অল্পসংখ্যক বিজ্ঞানী, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ : শতকরা ৫৮ জন
আমাদের দেশের সমাজ এখনও আমেরিকার মতো সম্পূর্ণ যন্ত্রীকৃত ও অর্থোন্নত হয়নি, কাজেই স্বনামধন্যদের শ্রেণিগত শতকরা হারের কিছু তারতম্য এখানে হবে, কিন্তু প্যাটার্ন বা বিন্যাস একই রকমের, এবং সেটাই বড় কথা।
‘সিলেব্রিটি’ বা স্বনামধন্যতার দুর্বার গতি আজ রাজনৈতিক নেতা, চিত্রতারকা, খেলোয়াড়, ক্রুনার—ক্লাউন ও ভজহরি মণ্ডলদের দিকে। বিজ্ঞানী শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিক পণ্ডিত এঁরা আজ স্বনামধন্যদের সমাজে উপেক্ষিত প্রলেটারিয়েট শ্রেণিভুক্ত, অর্থাৎ সর্বনিম্নস্তরভুক্ত। একটি দৃশ্য কলকাতা শহরে স্বচক্ষে একদিন দেখেছি যা আজও ভুলতে পারিনি। কলকাতার একটি বড় হোটেলে আমাদের দেশের ও বিদেশের কয়েকজন বিখ্যাত (স্বনামধন্য নন) বিজ্ঞানী এসেছিলেন বোধহয় বিজ্ঞান কংগ্রেস উপলক্ষে। সেই সময় কয়েকজন ক্রিকেট খেলোয়াড় ও একজন চিত্রতারকাও সেই হোটেলে ছিলেন। হোটেলের সামনে বিরাট জনতা, ঠেলাঠেলি—হুড়োহুড়ি, খেলোয়াড়রা ও চিত্রতারকারা বেরুবেন, তাঁদের দর্শনের জন্য। এমন সময় বৈজ্ঞানিকরাও তাঁদের কর্মোপলক্ষে বেরিয়ে আসছিলেন, ঠেলাঠেলির ধাক্কায় তাঁরা ফুটপাতে পড়ে যান, একজন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী রীতিমতো আহত হন। তাঁকে চ্যাংদোলা করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পুলিশ ভ্যান এসে কাঁদুনে গ্যাস ছেড়ে চিত্রতারকা ও খেলোয়াড়দের বহির্গমনের পথ মুক্ত করে দেন। যান্ত্রিক বহুজনসমাজে এই হল সিলেব্রিটির স্বরূপ।
তাই ভাবছিলাম, আজকের কলকাতার রাজপথে, চৌরঙ্গির উপর দিয়ে যদি আইনস্টাইন—রাসেল অথবা রামমোহন—বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমচন্দ্র হেঁটে যেতেন, তাহলে কী দৃশ্য আমরা দেখতাম! মহানগরের রাজপথের কিছু যাযাবর কুকুর, ভ্রাম্যমাণ ষাঁড় ও ফুটপাতের ভিখিরি তাঁদের পেছন পেছন যাচ্ছে, এ ছাড়া আর একটি লোকও নেই। কারণ তাঁরা চিত্রতারকা, খেলোয়াড়, রাজনৈতিক নেতা অথবা ভজহরি মণ্ডলের মতো স্বনামধন্য নন।
……
* এই গ্রন্থের বিজ্ঞাপন ও মন’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।