স্বখাত সলিল

স্বখাত সলিল

যৌবনের দৃঢ় অসন্দিগ্ধ চিত্তবল অন্য বয়সে দেখা যায় না। যৌবনে সমগ্র বস্তুকে হয়তো আমরা সম্পূর্ণরূপে দেখিতে পাই না, কিন্তু যেটুকু দেখি খুব স্পষ্টভাবে দেখি। তাই, চল্লিশ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে যখন ‘চাল্‌শে’ ধরে, মনও তখন স্পষ্ট দেখার নিঃসংশয় দৃঢ়তা হারাইয়া ফেলে। হয়তো দৃষ্টি ধোঁয়াটে হওয়ার সঙ্গে দৃষ্টির ক্ষেত্র কিছু বিস্তৃত হয়; কিন্তু মোটের উপর একরোখা ভাবে নিজেকেই নির্ভুল মনে করিবার অকুণ্ঠিত সাহস আর থাকে না।

দেবব্রতের কথা যখন মনে পড়িত, তখন ভাবিতাম তাহার বয়সও তো চল্লিশ পার হইয়া গেল; যৌবনের অদম্য দুঃসাহসিকতায় একদিন সে যাহা করিয়াছিল, আজ কি সেজন্য তাহার অনুশোচনা হয় না? বিদ্রোহীর রক্ত-রাঙা ঝাণ্ডা কি এখনও সে তেমনি খাড়া রাখিতে পারিয়াছে?

কারণ, যে দুর্গম পথে সে একাকী যাত্রা শুরু করিয়াছিল, আদর্শের বৈজয়ন্তী কাঁধে লইয়া সে পথে চলা যে কত কঠিন, তাহা তো আর কাহারও অবিদিত নাই। পদে পদে নূতন সমস্যার সৃষ্টি হয়, অথচ তাহাদের জট ছাড়াইবার সময় যৌবনের কল্পনা-উদ্ভূত আদর্শ কোনও কাজে লাগে না।

তারপর দেবব্রতের সঙ্গে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হইয়া গেল। ব্যবসার উপলক্ষে মধ্য-প্রদেশের এক অখ্যাতনামা ক্ষুদ্র শহরে গিয়াছিলাম। সেখানে যে বাঙালী কেহ থাকিতে পারে, এ সম্ভাবনা আদৌ মনে আসে নাই; ইচ্ছা ছিল ধর্মশালায় দু’দিন থাকিয়া কাজ শেষ করিয়া ফিরিব।

স্টেশনে নামিয়া গাড়ির খোঁজ করিতে গিয়া দেখি, দেবব্রত একখানা চক্‌চকে আট সিলিন্ডার মোটর হইতে নামিতেছে।

ক্ষণকালের জন্য নির্বাক হইয়া গেলাম। তারপর বলিয়া উঠিলাম, ‘দেবব্রত! তুমি এখানে?’

দেবব্রত আমাকে দেখিতে পাইয়াছিল, সে এক লাফে আসিয়া আমাকে দু’হাতে জড়াইয়া ধরিল— ‘মন্মথ! তুমি হঠাৎ এখানে? উঃ কতদিন পরে দেখা!’ বলিতে বলিতে তাহার গলাটা ভারী হইয়া আসিল।

দেখিলাম তাহার চেহারা বিশেষ বদলায় নাই, একটু মোটা হইয়াছে; কিন্তু মুখের সেই ধারালো তীক্ষ্ণতা এখনও তেমনি অম্লান আছে। মাথার ছোট-করিয়া-ছাঁটা কোঁকড়া চুল রগের কাছে পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে।

দেবব্রত আমাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, ‘কাজে এসেছ নিশ্চয়। কি কাজ পরে শুনব, এখন ক’দিন আছ?’

‘দু’দিন। কাল সন্ধ্যের গাড়িতে যেতে হবে।’

‘থাকবার কোনও আস্তানা নেই তো?’

‘ধর্মশালায় থাকব ঠিক আছে।’

‘ওসব চালাকি চলবে না, আমার বাড়িতে থাকতে হবে।’

আমার স্যুটকেসটা হাত হইতে কাড়িয়া মোটরে রাখিয়া আসিল, তারপর সপ্রশ্ননেত্রে আমার পানে তাকাইল।

আমি বলিলাম, ‘কিন্তু—’

‘কিন্তু কি? আপত্তি আছে?’

মনটাকে একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিলাম, ‘না—চল।’

দেবব্রত আমার হাতটা চাপিয়া প্রায় গুঁড়া করিয়া দিবার উপক্রম করিল, তারপর বলিল, ‘তুমি গাড়িতে বস। আমি পার্শেল অফিসে একবার খোঁজ নিয়ে আসি, একটা পার্শেল আসবার কথা আছে।’

গাড়িতে গিয়া বসিলাম। দেবব্রতের মনের ভিতর অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে; আগে তাহার একটা স্বাতন্ত্রের ভাব ছিল, যেন নিজেকে দূরে দূরে রাখিত, এখন সেটা নাই। বোধ হয় বয়সের গুণ। ভাবিতে লাগিলাম, বয়সের গুণে আমারও কি এমনি অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। হয়তো হইয়াছে, নচেৎ এত সহজে তাহার আতিথ্য স্বীকার করিলাম কি করিয়া? আর একদিনের কথা মনে পড়িল, যেদিন তাহার সহিত এক ট্যাক্সিতে যাইতে সম্মত হই নাই।

মিনিট পাঁচ-ছয় পরে দেবব্রত ফিরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে একজন কুলি একটা মাঝারি গোছের বাক্সেট মাথায় করিয়া আনিয়া গাড়িতে তুলিয়া দিল।

দেবব্রত নিজেই গাড়ি চালাইয়া আসিয়াছিল, কুলিকে বিদায় করিয়া গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়ি চলিতে আরম্ভ করিল।

বেলা তখন সাড়ে দশটা। ক্ষুদ্র গলিবহুল শহরের ভিতর দিয়া দেবব্রত সাবধানে গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল। আমি কি সম্ভাষণ করিব কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া চুপ করিয়া রহিলাম।

শহরের ঘিঞ্জি অংশ পার হইয়া দেবব্রত জোরে মোটর চালাইয়া আমার দিকে চাহিয়া আসিল। মনে হইল, আমাকে পাইয়া সে অকৃত্রিম ভাবে খুশি হইয়াছে। হাসিতে এই আনন্দের প্রতিবিম্ব পড়িল।

কি বলিব কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া শেষে বাজে প্রশ্ন করিলাম, ‘বাস্কেটে কি আছে?’

‘গলদা চিংড়ি। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে আনাই। ভালই হল, ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছে।’ বলিয়া আবার স্নিগ্ধচোখে আমার পানে চাহিয়া হাসিল।

আমি বলিলাম, ‘তুমি এইখানেই স্থায়ীভাবে বাস করছ তাহলে?’

‘হ্যাঁ। শহর থেকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় একখানা বাড়ি কিনে আছি।’

‘কলকাতার বাস তুলে দিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কতদিন এখানে আছ?’

‘বার বছর। কেয়ার বয়স।’

চমকিয়া তাহার দিকে চাহিলাম।

সে সহজভাবে বলিল, ‘কেয়া আমার বড় মেয়ে, তার বয়স এই বার চলেছে।’

বাহিরের দিকে চোখ ফিরিয়া রহিলাম। বড় মেয়ের বয়স বার। হয়তো আরও সন্তানাদি হইয়াছে। তাহার স্ত্রী,—অনেকগুলা প্রশ্ন মনের মধ্যে গজগজ করিতে লাগিল, কিন্তু জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হইল না।

দেবব্রতের বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিলাম। পাঁচিল-ঘেরা বিস্তৃত বাগানের মাঝখানে ভিলা-জাতীয় বাড়ি; আশেপাশেও ঐ রকম বাগান-যুক্ত বাড়ি রহিয়াছে। বুঝিলাম, এটি সৌখীন ধনী ব্যক্তিদের পাড়া।

দেবব্রত আমাকে একটা সুসজ্জিত ঘরে বসাইয়া ভিতরে প্রস্থান করিল; কিয়ৎকাল পরে আবার ফিরিয়া আসিয়া বসিল, বলিল, ‘তোমার কাজ কি খুব জরুরী? এখনই বেরুতে হবে?’

আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ। খেয়ে-দেয়ে বেলা বারটা নাগাদ বেরুলেই চলবে।’

পর্দা সরাইয়া একটি স্ত্রীলোক ঘরে প্রবেশ করিল। চমকিয়া মুখ তুলিয়াই চিনিতে পারিলাম; যোল বছর আগে একবার মাত্র রাস্তার গ্যাসের আলোয় দেখিয়াছিলাম, তবু চিনিতে কষ্ট হইল না। পরিধানে সাধারণ শাড়ি, শেমিজ, সিঁথিতে সিন্দূর জ্বল জ্বল করিতেছে। যে বয়সে গৃহিণী, সচিব, সখী, প্রিয় শিষ্যা ও জননীর একই দেহে সম্মিলন হয় এ সেই বয়স; যৌবনের উদ্দাম বর্ষা আর নাই, নির্মল শারদ স্বচ্ছতার ভিতর দিয়া তল পর্যন্ত দেখা যায়।

সে আমার সম্মুখে অবিচলিত থাকিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহার মুখখানা রাঙা হইয়া উঠিল। এই লজ্জাকর লজ্জা ঢাকিবার জন্যই যেন তাড়াতাড়ি নত হইয়া আমাকে একটা প্রণাম করিল। আমি বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া বলিলাম, ‘থাক, থাক।’

সে উঠিয়া দাঁড়াইল, জোর করিয়া আমার চোখের উপর চোখ রাখিয়া বলিল, ‘ভাল আছেন?’ এই কথা দুইটা কণ্ঠ হইতে বাহির করিতে তাহাকে যে কতখানি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করিতে হইল, তাহা তাহার স্বর শুনিয়া বুঝিলাম।

কুণ্ঠিত অপরাধীর মতো একটা ‘হ্যাঁ’ বলিয়া আমি আর কিছু বলিতে পারিলাম না। দেবব্রতের উপর রাগ হইতে লাগিল। আমার সম্মুখে এমনভাবে স্ত্রীকে টানিয়া আনিবার কি দরকার ছিল? আমি কে? দু’দিনের অতিথি বই তো নয়। কিন্তু তবু ভাবিয়া দেখিতে গেলে দেবব্রতের পক্ষে ইহাই একান্ত স্বাভাবিক, সে যে কোনও অবস্থাতেই পর্দাপ্রথা মানিবে, তাহা কল্পনা করাও দুষ্কর।

দেবব্রত এতক্ষণ জানালার দিকে মুখ ফিরাইয়া ছিল, এবার ফিরিয়া স্ত্রীকে বলিল, ‘মন্মথ খেয়ে-দেয়ে কাজে বেরুবে—ওর জন্যে—’

বাড়ির গৃহিণী যেন এতক্ষণে নিজ অধিকারের গণ্ডীর মধ্যে ফিরিয়া আসিল; তাহার গলার স্বর শুনিয়া বুঝিলাম মিথ্যা কুণ্ঠার কুয়াশা কাটিয়া গিয়াছে। সে বলিল, ‘রান্না তৈরি আছে। উনি নেয়ে নিন। তুমিও নেয়ে নাও না, একসঙ্গে বসে খাবে।’ বলিয়া ক্ষিপ্রচরণে আহারের ব্যবস্থা করিতে চলিয়া গেল।

স্নানাদি সারিয়া একসঙ্গে আহারে বসিলাম। পাচক ব্রাহ্মণ পরিবেশন করিল, দেবব্রতের স্ত্রী দাঁড়াইয়া আমাদের খাওয়াইল। দেবব্রত হাসিয়া গল্প করিতে লাগিল, স্ত্রীকে আমার জন্য এটা-ওটা আনিয়া জোর করিয়া খাওয়াইবার উপদেশ দিল। তাহাদের কথায় আচরণে কোথাও একটু কুণ্ঠার চিহ্ন প্রকাশ পাইল না। তবু আমি নিঃসঙ্কোচে তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া যাইতে পারিলাম না। মনের ভিতরটা আড়ষ্ট ও অস্বচ্ছন্দ হইয়া রহিল।

কাজ সারিয়া ফিরিতে বেলা সাড়ে চারিটা বাজিয়া গেল।

বারান্দার উপর দেবব্রত দাঁড়াইয়া আছে; তাহার পাশে তাহার একটা হাত জড়াইয়া ধরিয়া একটি মেয়ে।

দেবব্রত বলিল, ‘আমার মেয়ে কেয়া। —কেয়া, এঁকে প্রণাম কর।’

বাপের উগ্র সৌন্দর্যের সহিত মায়ের কোমল লাবণ্য মিশিয়া কেয়ার রূপ হইয়াছে অপরূপ! এখনও যৌবন বহুদূরে, কচি মেয়ের মুখের একটি অচপল শান্তশ্রী মনকে মুগ্ধ করে।

কেয়া আমাকে প্রণাম করিল; আমি বলিলাম, ‘তোমাকে আজ সকালে দেখিনি কেন?’

হাস্যোজ্জ্বল চোখে কেয়া বলিল, ‘আমরা ইস্কুলে গিয়েছিলুম।’

তারপর ঘরে বসিয়া চা পান করিতে করিতে দেখিলাম একটি ছয়-সাত বছরের ছেলে ভীরু মৃগশিশুর মতো দূর হইতে আমাকে দেখিতেছে। সারঙ্গচক্ষুর মতো বিস্ফারিত কালো চোখ দুটিতে অসীম কৌতূহল; কিন্তু সে কাছে আসিতেছে না, একবার এ-দরজা একবার ও-দরজা হইতে উঁকি মারিতেছে।

আমি তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিলাম, সে ছুটিয়া পলাইয়া গেল।

কেয়া বাপের চেয়ারের পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়াইয়া ছিল, কহিল, ‘মন্টুর বড্ড লজ্জা, নতুন মানুষ দেখলে ও কিছুতেই কাছে আসে না! না বাবা?’

মন্টুর চেহারায় মায়ের ছাপ বসানো, কাজেই পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে হইল না। দেবব্রত, ‘মন্টু, এদিকে আয়’ বলিয়া দু’বার ডাকিল, কিন্তু মন্টুর সাড়া পাওয়া গেল না।

ঘরের তৈয়ারি রসগোল্লায় কামড় দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার ক’টি ছেলে মেয়ে?’ কথাটা এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয় নাই।

দেবব্রত বলিল, ‘এই দু’টি।’

নীরবে জলযোগ শেষ করিলাম।

রুমালে মুখ মুছিতেছি, শুনিতে পাইলাম কেয়া তাহার বাপের কানে কানে বলিতেছে, ‘বাবা, ইনি আমাদের কে হন?’

দেবব্রত বলিল, ‘উনি তোমাদের বাবার বন্ধু হন?’

কেয়া একটু নিরাশ হইল। ক্ষণেক চুপ করিয়া থাকিয়া সে আবার ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘ওঁকে আমি কি বলে ডাকব?’

দেবব্রত স্নিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি বলে ডাকতে চাও তুমি?’

কেয়া একবার চকিতে আমার দিকে তাকাইয়া বাপের গলা জড়াইয়া কানে কানে কি বলিল, শুনিতে পাইলাম না; কিন্তু দেবব্রতের মুখের যে পরিবর্তন হইল তাহা দেখিতে পাইলাম। সে একবার মাথা নাড়িয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল, আমাকে বলিল, ‘তুমি বিশ্রাম কর, একবার বাজারটা ঘুরে আসি। আধ ঘন্টার মধ্যেই ফিরব।’ বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

তাহার এই হঠাৎ উঠিয়া চলিয়া যাওয়ার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে কেয়া একটু আহত ও অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। আমিও তাহাদের চুপি চুপি কথাবার্তায় কেমন অস্বস্তি বোধ করিতেছিলাম, কেয়াকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি ইস্কুলে কি পড়?’

কেয়া বলিল, ‘বাংলা আর সংস্কৃত।’

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘ইংরিজি পড় না?’

‘না, মা ইংরিজি পড়া ভালবাসেন না।’

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম, শেষে বলিলাম, ‘সংস্কৃত কি পড়?’

‘ব্যাকরণ আর কাব্য।’

‘কোন্ কাব্য?’

‘কুমারসম্ভব।’

অবাক হইয়া বলিলাম, ‘কুমারসম্ভব বুঝতে পার?’

কেয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ। যেখানে বুঝতে পারি না, পণ্ডিতজী বুঝিয়ে দেন!’

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কুমারসম্ভবের কোন্ সর্গ সব চেয়ে ভাল লাগে?’

কেয়া উৎসাহে দুই করতল যুক্ত করিয়া উজ্জ্বল চোখে বলিল, ‘সপ্তম সর্গ—যেখানে উমার সঙ্গে মহাদেবের বিয়ে হল।’

‘আর, পার্বতীর তপস্যা ভাল লাগে না?’

‘হ্যাঁ, তাও খুব ভাল লাগে।’ তারপর আমার চেয়ারের হাতলে বসিয়া আমার কাঁধের উপর হাত রাখিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, মহাদেব পার্বতীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কেন বলুন তো?’

আমি একটু চিন্তা করিয়া বলিলাম, ‘বোধহয় পার্বতীকে কষ্ট দেবার লোভ মহাদেব সামলাতে পারেননি।’

খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কেয়া বলিল, ‘যাঃ—তা কেন হবে?’

‘তবে?’

মুখ গম্ভীর করিয়া সে বলিল, ‘কষ্ট না পেলে মহাদেবের মতো বর পাওয়া যায় না, তাই।’

কেয়ার মতো মেয়ে দেখি নাই। বার বছর বয়স, কিন্তু মনটি তপোবন-কন্যার মতো। বুঝিলাম কথাগুলা তাহার নিজের নয়। তাহার কোঁকড়া নরম চুলে হাত বুলাইয়া বলিলাম, ‘ও—তাই হবে বোধ হয়।’

হঠাৎ কেয়া বলিল, ‘আচ্ছা, আপনি এতদিন আসেননি কেন?’

কি উত্তর দিব ভাবিয়া পাইলাম না, শেষে বলিলাম, ‘তোমাকে তো জানতুম না, তাই আসিনি।’

‘বাবাকে, মাকে তো জানতেন, তবে আসেননি কেন?’

কঠিন প্রশ্ন, এড়াইয়া গেলাম। বলিলাম, ‘আমি এসেছি বলে তুমি খুশি হয়েছ?’

মাথাটি হেলাইয়া সে বলিল, ‘হ্যাঁ, খুব খুশি হয়েছি। আমাদের বাড়িতে কক্‌খনো কেউ আসেন না, আমরাও কোথাও যেতে পাই না। আমার ইস্কুলের বন্ধু রূপকুমারী ছুটি হলে মামার বাড়ি যায়—’ কেয়ার কণ্ঠ ম্রিয়মাণ হইয়া আসিল—‘মা বলছিলেন কালই আপনি চলে যাবেন। আবার কবে আসবেন?

আমি সহসা কেয়ার মুখ কাছে টানিয়া আনিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেয়া, তখন তোমার বাবার কানে কানে কি বলছিলে? আমাকে কি বলে তুমি ডাকতে চাও?’

কেয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘সে—সে কিছু না—’ তারপর মুখ তুলিয়া বলিল, ‘ঐ মন্টু উঁকি মারছে! ওকে ধরে নিয়ে আসি, দাঁড়ান। একবার ভাব হয়ে গেলে ওর আর লজ্জা থাকে না।’

কেয়া মন্টুর পিছনে ছুটিয়া গেল। আমি অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলাম কিন্তু তাহারা ফিরিয়া আসিল না। বোধ হয় মন্টুকে ধরিতে পারে নাই।

রাত্রে আমি শয্যা আশ্রয় করিলে দেবব্রত খাটের পাশে একটা ইজি-চেয়ার টানিয়া বসিল। আলোটা ঘরের কোণে আবছায়াভাবে জ্বলিতেছিল; এই প্রায়ান্ধকারের মধ্যে আমরা অনেকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলাম।

শেষে দেবব্রত জিজ্ঞাসা করিল, ‘কালকেই যাওয়া ঠিক তাহলে? আর দু’দিন থাকতে পারবে না?’

বলিলাম, ‘না, অনেক কাজ ফেলে এসেছি, গিন্নীরও শরীরটা ভাল নয়। —কেন বল দেখি?’

‘তোমাকে পেয়ে কেয়া আর মন্টু ভারি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তুমি ছাড়া ওদের মুখে অন্য কথা নেই। ওদের জীবনে এ একটা নূতন অভিজ্ঞতা কিনা!’

আবার দীর্ঘকাল দু’জনে নীরব রহিলাম।

তারপর আমি বলিলাম, ‘দেবব্রত, তোমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’

সে বলিল, ‘হ্যাঁ, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সকলেরই হয়। তোমারও হয়েছে।’

‘আমার? কি জানি—’

কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলাম, ‘তুমি কলকাতার বাস তুলে দিলে কেন? এখানে তো বাঙালীর মুখ দেখতে পাও না।’

‘কেন, বুঝতে পারছ না?’

‘ছেলে-মেয়ের জন্যে?’

‘হ্যাঁ। ওদের দোষ কি? ওরা কেন শাস্তি পাবে?’

‘কিন্তু এখানে লুকিয়ে থেকে কি ওদের বাঁচাতে পারবে? সমাজ বড় কঠোর, বড় ছিদ্রান্বেষী।’

‘তা জানি বলেই তো এই স্বজাতিহীন বিদেশে লুকিয়ে থেকে সমাজকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছি। সমাজ আমাদের প্রতি অন্যায় পীড়ন করতে চায়, আমি তা করতে দেব না।’

‘সমাজ অন্যায় পীড়ন করতে চায়, একথা তুমি কি করে বল?’

‘পুরনো তর্কে দরকার নেই। কিন্তু বাপ-মায়ের কল্পিত অপরাধ সন্তানের ঘাড়ে চাপানোটাও সুবিচার নয়।’

আমি প্রশ্ন করিলাম, ‘তোমার ছেলেবেলার মতগুলো এখনো বদলায়নি?’

‘কিছু বদলেছে, সব বদলায়নি।’

‘বিবাহ সম্বন্ধে?’

‘বিশেষ বদলায়নি। বিবাহের একটা লৌকিক উপকারিতা আছে। কিন্তু তবু বলব, বিবাহ কৃত্রিম বন্ধন। যেখানে প্রেম আছে সেখানে বিবাহ নিষ্প্রয়োজন, যেখানে তা নেই, সেখানে বিবাহ একটা বীভৎস পাশবিকতা।’

একবার ইচ্ছা হইল, জিজ্ঞাসা করি সে নিজে কেন বিবাহ করিয়াছিল। প্রশ্ন অরুচিকর হইলেও সে সোজা উত্তর দিবে জানিতাম, কারণ দেবব্রতের মনে কোথাও ফাঁকি ছিল না। কিন্তু তাহাকে আঘাত করিতে সঙ্কোচ বোধ হইল।

বলিলাম, ‘ঘুম পাচ্ছে, এবার শোও গে।’

দেবব্রত উঠিয়া দাঁড়াইয়া আমার অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দিল, ‘দ্বিজু রায়ের একটা হাসির গান আছে, ‘তারেই বলে প্রেম’। গানটা হাসির নয়, অত্যন্ত করুণ। কিন্তু একথাও ঠিক যে মানুষ একলা থাকতে পারে না; তাই সমাজ যত অবিচারই করুক, তাকে নিয়ে কারবার করতে হয়। আমি সমাজকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছি; তার জন্য আমার মনে বিন্দুমাত্র গ্লানি নেই; আমি আজ পর্যন্ত জেনে বুঝে কোনও অন্যায় কাজ করিনি; আর কাউকে করতেও বলিনি। নিজের কাছে আমি খাঁটি আছি। এখন কথা হচ্ছে, যাদের আমি বন্ধু বলে মনে করি তারা আমায় সাহায্য করবে কি না।’

শেষ কথাটার মধ্যে যে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছিল তাহা আমার কানে বাজিল। কিন্তু উত্তর দিতে পারিলাম না। দেবব্রত কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, বোধ হয় একটা কিছু প্রত্যাশা করিল। তারপর ‘ঘুমোও’ বলিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।

ইহার পর অনেকক্ষণ ঘুম আসিল না; দেবব্রতের কথাগুলা মনের মধ্যে ওলট-পালট করিতে লাগিলাম। মাঝে মাঝে কেয়ার শিশু-মুখ ও মন্টুর হরিণ-চোখ দৃষ্টিপটের উপর ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।

হঠাৎ মনে হইল, দেবব্রতের স্ত্রী যে গৃহত্যাগিনী একথা আমি ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে আর কে জানে?

সকালবেলা মন্টু নিজে আসিয়া ভাব করিয়া ফেলিল। তখনও শয্যাত্যাগ করি নাই, সে মুখখানি অতিশয় করুণ করিয়া নিজের একটি আঙুল দেখাইয়া বলিল, ‘কেটে গেছে।’

আমি উঠিয়া বসিয়া আঙুল পরীক্ষা করিলাম, কিন্তু ক্ষতচিহ্ন এতই আণুবীক্ষণিক যে চোখে দেখা গেল না। বলিলাম, ‘তাইতো, বড্ড লেগেছে। এস, জলপটি বেঁধে দিই।’

পটি বাঁধা হইলে মন্টু বলিল, ‘আমার একটা কোকিল আছে।’

বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘তাই না কি! কই আমাকে দেখালে না?’

মন্টু জানালার বাহিরে একটা গাছের দিকে নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ঐ গাছে বসে রোজ ডাকে, আবার উড়ে যায়। ওটা আমার কোকিল। দিদির কোকিল নেই।’

বনের পাখির উপর এমন অবাধ স্বত্বাধিকার প্রচার করিতে দেখিয়া আমি থতমত খাইয়া গেলাম, বলিলাম, ‘তোমার আর কি আছে?’

অত্যন্ত রহস্যপূর্ণভাবে মন্টু পকেট হইতে একটি ফলাভাঙা ছুরি বাহির করিয়া দেখাইল, প্রশ্ন করিল, ‘তোমার ছুরি আছে?’

বিষন্নভাবে বলিলাম, ‘না। তোমার ছুরিটা আমায় দেবে?’

দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া মন্টু বলিল, ‘না। তোমাকে একটা লাট্টু দেব।’

‘কিন্তু আমি যে লাট্টু ঘোরাতে জানি না।’

‘আমি শিখিয়ে দেব।’

এইরূপ আলাপ আলোচনার মধ্যে সে ধীরে ধীরে আমার কোলের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল, এখন আমার জানুর উপর উপবেশন করিয়া এক প্রচণ্ড প্রশ্ন করিয়া বসিল, ‘তুমি আমার, না দিদির?’

কোকিলের মতো আমাকেও নিশ্চয় মন্টু ইতিমধ্যে নিজের খাস-সম্পত্তি করিয়া লইয়াছে, মহা দ্বিধায় পড়িয়া গিয়া বলিলাম, ‘তাইতো, একথা তো ভেবে দেখিনি। দু’জনেরই হওয়া কি চলে না?’

এমন সময় মন্টুর দিদি প্রবেশ করিল। মন্টু লাফাইয়া আমার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ‘না তুমি আমার, দিদির নয়—দিদির নয়।’

দিদিও ছাড়িবার পাত্রী নয়, পিছন হইতে আমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ‘কক্খনো না। তুই কাল কেন আসিসনি, উনি আমার।’

এ বিবাদের মীমাংসা সহজে হইত না, কিন্তু এই সময় তাহাদের মা দরজার পর্দা সরাইয়া এই দৃশ্য দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ও কি হচ্ছে! ছেড়ে দে, ওঁকে জ্বালাতন করিসনি। আপনি চা খাবেন আসুন।’

হৃদয়ের মধ্যে অদ্ভুত পূর্ণতা লইয়া চা খাইতে গেলাম।

তারপর যতক্ষণ বাড়িতে রহিলাম, মন্টু ও কেয়া আমার সঙ্গ ছাড়িল না; আমাকে ছাড়িয়া যাইতে হইবে বলিয়া স্কুলেও গেল না। আমাকে লইয়া তাহাদের শিশুচিত্তের এই অপূর্ব আনন্দ-সমারোহ যেন আমারও মনে নেশা জাগাইয়া তুলিল।

কাজে বাহির হইতে বেলা একটা বাজিল। তিনটার সময় ফিরিয়া আসিলাম। কাজ শেষ হইল না; কিন্তু সে যাক।

সন্ধ্যার ট্রেনে যাইব। তার আগে যতটুকু সময় পাইলাম কেয়া ও মন্টুর সঙ্গেই কাটাইলাম। দেবব্রত আমার ইচ্ছা বুঝিয়া আলগোছে রহিল।

ক্রমে যাবার সময় উপস্থিত হইল। আমি উঠিয়া দেবব্রতকে বলিলাম, ‘আমি একবার অণিমার সঙ্গে দেখা করে আসি। তুমি বস।’ দেবব্রত চকিতভাবে আমার দিকে তাকাইয়া ঘাড় নাড়িল।

পাঁচ মিনিট পরে ফিরিয়া আসিয়া মোটরে উঠিলাম। কেয়া ও মন্টু আগে হইতেই গাড়িতে উঠিয়া বসিয়াছিল; দেবব্রত নিজে গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল। আমার গলাটা এমন বুজিয়া গিয়াছিল যে, প্রথম খানিকক্ষণ কথা কহিতে পারিলাম না। একটি কৃতজ্ঞ নতজানু নারীর অশ্রুপ্লাবিত মুখ চোখের সম্মুখে ভাসিতে লাগিল।

মন্টু ও কেয়া আমার পাশ ঘেঁষিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। স্টেশনে পৌঁছিতে যখন আর দেরি নাই, তখন কেয়া চুপি চুপি আমার পকেটে হাত দিয়া কি রাখিয়া দিল। জিনিসটি বাহির করিয়া দেখিলাম, একটি ছোট্ট রুমাল, কোণে লাল রেশমী সুতায় কেয়ার নাম লেখা। আমি কেয়ার মাথা টানিয়া আনিয়া কপালে চুম্বন করিলাম।

মন্টু ম্লানমুখে একটি রং-চটা প্রাচীন লাট্টু আমার হাতে গুঁজিয়া দিল। আমি তাহাদের দু’জনের মুখ কাছে আনিয়া বলিলাম, ‘আমি তোমাদের কে জান? আমি তোমাদের মামা।’

একটু অবিশ্বাস ও অনেকখানি আনন্দ চোখে ভরিয়া দু’জনে আমার মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

আমি বলিলাম, ‘সত্যি, তোমাদের মা জানেন। তিনি আমার বোন হন; বাড়ি গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করো। আর, এবার ছুটি হলে তোমরাও রূপকুমারীর মতো মামার বাড়ি যাবে।’

ট্রেন ছাড়িলে জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেবব্রতকে বলিলাম, ‘মাসখানেকের মধ্যে আবার আসছি। কাজটা শেষ হল না।’

দেবব্রত বুঝিল। বাষ্পোজ্জ্বল চোখে একবার ঘাড় নাড়িল।

৭ ভাদ্র ১৩৪২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *