স্ফিংক্স
নিউইয়র্কে যখন ভয়াবহ কলেরার মড়ক চলছে, তখন আমার এক আত্মীয়ের নেমন্তন্ন রাখতে তাঁর বাড়ি গিয়ে দিন পনেরো কাটিয়ে এসেছিলাম। বাড়িটা কটেজ প্যাটার্নের। হাডসন নদীর পাড়ে।
গ্রীষ্মবকাশ কাটানোর সমস্ত আয়োজনই মজুদ ছিল সে অঞ্চলে। ইচ্ছেও ছিল হেসেখেলে ছুটির দিনগুলো কাটিয়ে দেবো। চারপাশের জঙ্গল দেখা, বসে বসে ছবি আঁকা, নৌকা নিয়ে অভিযানে বেরোনো, ছিপ ফেলে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, গান গাওয়া আর বই পড়া–গ্রীষ্মবকাশ পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যেত এতগুলো মজার মধ্যে থাকলে।
কিন্তু তা তো পারছিলাম না। রোজই লোক-গিজগিজ শহর থেকে গা কাঁপানো খবর পৌঁছাচ্ছিল কটেজে। চেনা জানাদের মধ্যে কেউ না কেউ পরলোক চলে যাচ্ছেন রোজই–এ খবর কানে শুনলে আর স্থির থাকা যায়? মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে প্রতিদিনই খবর পেতাম, একজন না একজন বন্ধু মায়া কাটাচ্ছেন।
এরপর থেকে খবর নিয়ে কাউকে আসতে দেখলেই শিউরে উঠতাম। দক্ষিণের বাতাসেই যেন মরণের বিষ ঢুকে বসে আছে। মৃত্যু ছাড়া আর কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। মৃত্যু চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে থাকতাম সর্বক্ষণ। এমন কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখতাম মরণকে।
আমার গৃহস্বামী আত্মীয়টি অবশ্য অন্য ধাচের মানুষ। আমার মতো সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন না। রোজ রোজ চেনাজানাদের চলে যাওয়ার খবর শুনতে শুনতে বেশ মুষড়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যেই তিনি মেধাবী বলে নাম কিনেছিলেন–তাই বলে অবাস্তবতাকে পাত্তা দিতেন না। আতঙ্ক যখন কায়া গ্রহণ করত, তখন তিনি তার মোকাবিলা করার জন্যে কোমর বেঁধে লেগে যেতেন–কিন্তু বিচলিত হতেন না আতঙ্কের ছায়া দেখলে।
আমার গুম-মেরে-থাকা অবস্থাটা কাটিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টাই উনি। করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। পারবেন কী করে? ওঁকে না জানিয়ে ওঁরই। লাইব্রেরি থেকে এমন কয়েকখানা বই এনে রোজ পড়তাম–যা আমার মনের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কুসংস্কারের বীজগুলোকে পরম পুষ্টি জুগিয়ে চলেছিল। দিনরাত এত উদ্ভট কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকতাম সেই কারণেই। কারণটা উনি ধরতে পারেননি।
আমার বাতিক ছিল অনেক। তার মধ্যে একটার কথা বলা যাক। অশুভ ঘটনার পূর্বলক্ষণে আমি বিশ্বাস করতাম। এই সংকেত আসে আচমকা এবং তারপরে সত্যি সত্যিই তা ঘটে যায়। এই কটেজে আসার পর এইরকমই একটা অশুভ পূর্বলক্ষণ আমি দেখেছিলাম যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। ঘটনাটার মধ্যে ভাবী অমঙ্গলের স্পষ্ট ইঙ্গিত লক্ষ্য করেছিলাম বলে তাকে ভিত্তিহীন কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি। ভয়ে কাঁটা হয়ে। থাকতাম সর্বক্ষণ; মাথার মধ্যেও যেন সব ঘোঁট পাকিয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে অষ্টপ্রহর থ হয়ে থাকতাম বলে আত্মীয় বন্ধুকে এ বিষয়ে বলার মুরোদও হয়নি।
সেদিন খুব গরম পড়েছিল। বিকেল নাগাদ কোলের ওপর একটা বই রেখে খোলা জানালা দিয়ে দেখছিলাম দূরের পাহাড়। নদীর পাড়ের ওপারে এই পাহাড়ের গায়ে ধস নামার ফলেই বোধহয় গাছপালার বালাই আর নেই। একদম ন্যাড়া হয়ে রয়েছে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখেও আমি ভাবছিলাম শহরের কথা-মৃত্যুরাজ সেখানে রোজই নৃত্য করে চলেছেন–মন থেকে তা কিছুতেই তাড়াতে পারছিলাম না। তাই চোখ উঠে গিয়েছিল বইয়ের পাতা থেকে–দৃষ্টি মেলে ধরেছিল নদীর পাড়ের ওপর দিয়ে দূরের নগ্ন পাহাড়ের দিকে।
কদাকার চেহারার একটা জীবন্ত দৈত্যকে দেখতে পেয়েছিলাম ঠিক সেই সময়ে। পাহাড় চুড়া থেকে সরসরিয়ে নেমে এসে নিচের ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল মিনিট কয়েকের মধ্যে।
বিকট সেই জীবকে প্রথমে দেখেই ভেবেছিলাম বুঝি পাগল হয়ে গেছি নির্ঘাৎ। অথবা চোখের গন্ডগোল হয়েছে–ভুল দেখছি নিশ্চয়।
বেশ কয়েক মিনিট ঠায় সজীব আতঙ্ককে নজরে রাখার পর বিশ্বাস ফিরে এসেছিল চোখ আর মাথার সুস্থতায়। আমি পাগলও হইনি, দৃষ্টিবিভ্রমেও ভুগছি না। যা দেখছি সত্যি। কুৎসিত সেই দানবের বর্ণনা শোনবার পর পাঠক অবশ্য আমাকে পাগলই বলবেন–অথবা বলবেন স্বপ্ন দেখেছি নিশ্চয়। অথচ বিকটাকারকে অনেকক্ষণ ধরে ধীরস্থির শান্তভাবেই চোখে চোখে রেখেছিলাম–উত্তেজনাকে প্রশ্রয় দিইনি। সুতরাং ভুল দেখার প্রশ্নই ওঠে না।
জঙ্গলের সব গাছ তো ধস নামার ফলে ধ্বংস হয়নি-কয়েকটা মহীরুহ মাথা তুলে ছিল রাজার মতোই। এদের পাশ দিয়ে চলমান দুঃস্বপ্ন অদৃশ্য হয়েছিল বলেই তার সাইজটা আন্দাজ করে নিতে পেরেছিলাম। সমুদ্রের সবচেয়ে বড়ো জাহাজের চেয়েও অনেক বড়ো তার কলেবর। জাহাজের উপমা দেওয়ার কারণ আছে। জাহাজের খোলের সঙ্গে অনায়াসেই তুলনা করা যায় সেই ভয়ঙ্করকে। তার মুখখানা বসানো রয়েছে ষাট সত্তর ফুট লম্বা একটা শুড়ের ডগায় হাতির শরীর যত মোটা, গুঁড়ের ব্যাসও তাই। শুড়ের গোড়ায় থুথুক করছে বিস্তর কালো চুল–এক কুড়ি মোষের গা থেকেও অত কালো লোম পাওয়া যায় না। লোমশ অঞ্চল থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসে মাটি মুখো হয়ে রয়েছে দুটো প্রকাণ্ড দাঁত-বুনো শুয়োরের দাঁতের চেয়েও অনেক বড়ো আর নৃশংস। পড়ন্ত রোদ ঠিকরে যাচ্ছিল এই গজাল দাঁত থেকে। প্রকাণ্ড অঁড়ের সমান্তরালে সামনের দিকে এগিয়ে রয়েছে ঝকঝকে, স্বচ্ছ কৃস্টাল দিয়ে তৈরি দুটো অদ্ভুত জিনিস; রয়েছে সঁড়ের দুপাশে–ঠিক যেন দুটো প্রিজম–খাঁটি কৃস্টাল দিয়ে তৈরি। লম্বায় প্রতিটা তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট। পড়ন্ত রোদ তা থেকে ঠিকরে এসে এত দূরেও চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে আমার। ধড়খানা তৈরি হয়েছে গোঁজের মতো। গোঁজের মাথা রয়েছে মাটির দিকে। দুপাশ দিয়ে বেরিয়েছে দুজোড়া ডানা। রয়েছে ওপর-ওপর। ধাতুর আঁশ দিয়ে ছাওয়া প্রতিটা ডানা। প্রতিটা আঁশের ব্যাস দশ থেকে বারো ফুট। শক্ত শেকল দিয়ে আটকানো রয়েছে ওপরের আর নিচের ডানা।
লোমহর্ষক এই জানোয়ারটার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য তার বুকজোড়া একটা ছবি। মড়ার মাথার ছবি। চোখ ধাঁধানো সাদা রঙ দিয়ে যেন নিপুণভাবে আঁকা হয়েছে মস্ত কালো বুক জুড়ে। বাহাদুরি দিতে হয় শিল্পীকে।
বীভৎস জীবটাকে মিনিট কয়েক দেখার পর, বিশেষ করে বুকজোড়া মড়ার খুলি আমার গা-হাত-পা ঠান্ডা করে দেওয়ার পর–আতঙ্কে আমি হিম হয়ে গিয়েছিলাম। সমস্ত সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করছিলাম, খুব শিগগিরই একটা অকল্পনীয় বিপদ আসছে। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে অমূলক আশঙ্কাটাকে মন থেকে তাড়াতে তো পারিইনি–উলটো আমাকে স্থাণু করে রেখেছিল ওই কয়েকটা মিনিট।
বিমূঢ় চোখে বীভৎস সেই আকৃতি দেখতে দেখতে আর একটা ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা হাঁ হয়ে গেল শুড়ের ডগায় বসানো দানব-মুখের দুই চোয়াল–ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এমনই একটা বিকট নিনাদ যা নিরতিসীম শোকবিষণ্ণ–যে শব্দের তুলনীয় হাহাকার বিশ্বব্রহ্মান্ডে আর কোথাও কেউ শুনেছে বলে আমার জানা নেই।
ওই একখানা অপার্থিব হাহাকারই যেন গজাল ঠুকে বসিয়ে দিল আমার বিকল স্নায়ুমন্ডলীর গোড়ায়। জঙ্গলের আড়ালে তার দানব-দেহ বিলীন হতে না হতেই জ্ঞান হারিয়ে আমি লুটিয়ে পড়লাম মেঝের ওপর।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর প্রথমেই ভেবেছিলাম–যা দেখেছি, যা শুনেছি–সবই বলব বন্ধুকে। কিন্তু তারপর ঠিক করলাম–দরকার নেই।
দিন তিন চার পরে আরেক বিকালে জানালার ধারে একই চেয়ারে বসে ন্যাড়া পাহাড়ের দিকে চেয়েছিলাম আমি। পাশে আমার প্রিয় বন্ধু। পরিবেশ আর সময়ের প্রভাব আগল খুলে দিয়েছিল আমার মনের। বলেছিলাম, কী দেখেছি কি শুনেছি কদিন আগে। শুনে অট্টহাসি হেসেছিল বন্ধুবর। তারপর বড্ড বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় ভাবছিল, নির্ঘাৎ গোলমাল দেখা দিয়েছে আমায় মাথায়।
আর ঠিক তখনি ভয়াবহ সেই প্রাণীটাকে আবার দেখতে পেলাম ন্যাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে নিচের জঙ্গলের দিকে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম। আঙুল তুলে বন্ধুকে দেখতে বলেছিলাম। সে কিছুই দেখতে পায়নি। শুধু আমিই দেখেছিলাম, একই রকম রক্ত জমানো গতিভঙ্গিমায় মূর্তিমান আতঙ্ক এগিয়ে চলেছে নিচের মহীরুহগুলোর দিকে।
কী ভয় যে পেয়েছিলাম, তা ভাষা দিয়ে লিখে বোঝাতে পারবো না। স্পষ্ট বুঝেছিলাম, বিকট বিভীষিকা পর-পর দুবার আমাকেই চেহারা দেখিয়ে গেল শুধু একটা আসন্ন ঘটনারই পূর্বাভাস দিতে। আমার মৃত্যুর আর দেরি নেই। অথবা বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার চাইতে বেশি যন্ত্রণা পাবো পাগল হয়ে গিয়ে। এ তারই দানবীয় সংকেত! এলিয়ে পড়েছিলাম চেয়ারে। দুহাতে মুখ ঢেকে ধরে করাল সংকেতকে আর দেখতে চাইনি। চোখ থেকে একটু পরে হাত সরিয়ে নেওয়ার পর তাকে আর দেখতেও পাইনি–বনতলে বিলীন হয়েছে অমঙ্গলের আগন্তুক।
আমার বন্ধু কিন্তু আরো শান্ত হয়ে গেল এই ঘটনার পর। খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল, বিকট জীবটাকে দেখতে কীরকম। হুবহু বর্ণনা দিয়েছিলাম। তারপর আমাকেই শুনতে হলো তান জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা। যার সারবত্তা এই : সব মানুষই এক জায়গায় ভুল করে বসে; দূরের জিনিসকে কাছে এনে আর কাছের জিনিসকে দূরে রেখে দেখার তফাৎ ধরতে পারে না। হয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ধারণা করে নেয়-না হয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বসে। বর্তমান গণতন্ত্রই তার প্রমাণ।
বলতে বলতে উঠে গিয়ে বুককেস থেকে একটা বই নামিয়ে এনেছিল বন্ধু। প্রাকৃতিক ইতিহাস-এর বই। পড়তে সুবিধে হবে বলে, এসে বসেছিল আমার চেয়ারে–আমাকে বসিয়েছিল ওর সোফায়। জানালার ধারে পড়ন্ত আলোয় বই খুলে ধরে প্রথমেই লেকচার দিয়েছিল এইভাবে : তোমার বিশদ বর্ণনা না শুনলে, দানবটা আসলে কী–তা কোনওদিনই আঁচ করতে পারতাম না। যাক সে কথা, আগে শোনো একটা পোকার শরীরের বর্ণনা। স্ফিংক্স প্রজাতির পোকা, ইনসেকটা শ্রেণির, লেপিডোপটেরা গোষ্ঠীর, ক্রিপসকিউলেরিয়া ফ্যামিলির এই পোকার কথা সব স্কুলের বইতেই আছে। শোনো :
চারটি ডানা ধাতু রঙের আঁশ দিয়ে ছাওয়া; চোয়াল লম্বা হয়ে গিয়ে অঁড়ের আকার নিয়েছে–মুখ আছে তার ডগায়; এর দুপাশে আছে ম্যানিবল আর প্যালপি-র দুটো অবশিষ্টাংশ; নিচের ডানার সঙ্গে ওপরের ডানা লেগে থাকে একটা লম্বা চুলের মাধ্যমে; অ্যান্টেনা দেখতে লম্বাটে গদার মতো–ঠিক যেন একটা প্রিজম্; উদর ছুঁচালো; বুকে আঁকা মড়ার খুলি দেখে আর করুণ কাতরানি শুনে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ভয় পায়।
এই পর্যন্ত পড়ে, বই মুড়ে রেখে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল বন্ধুবর–ঠিক যেভাবে যে কায়দায় বসে একটু আগে আমি দেখেছি লোমহর্ষক ভয়াবহকে।
সোল্লাসে বলল তারপরেই–এই তো…স্পষ্ট দেখছি…পাহাড় বেয়ে ফের উঠছে আশ্চর্য প্রাণী ঠিকই–তবে যতটা বড়ো আর যত দূরে আছে বলে মনে করেছিলে–কোনওটাই ঠিক নয়। জানালার কাঁচে ঝুলছে মাকড়সার জালের সুতো। সুতো ধরে ওপরে উঠছে। আমার চোখের কনীনিকা থেকে তার এখনকার দূরত্ব এক ইঞ্চির ষোলভাগের একভাগ; গোটা শরীরটাও লম্বায় এক ইঞ্চির ষোলোভাগের একভাগের বেশি নয়।