স্পাই
আপনারা সকলেই যে আমার কথা বিশ্বাস করবেন এতটা আমি আশা করি না। সত্যি কথা বলতে কী আপনাদের মধ্যে অনেকেই ভগবানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করেন না, ভূতের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তবে সত্যি কথা কখনো বিশ্বাস অবিশ্বাসের অপেক্ষায় বসে থাকে না, এই ভরসাতে এই কাহিনী প্রকাশ করলাম।
নানা কারণে নামধাম গোপন করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু তাতে মূল কাহিনীর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। ব্যাপারটা ঘটেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে এবং ফ্রান্সের উত্তর উপকূলে। সেসব জায়গা আপনারাও দেখেননি, আমিও দেখিনি, তবে আমার ছোট মামার মুখে যেমন শুনেছিলাম, সেইরকম বিবৃত করে যাচ্ছি।
ছোট মামা বলেছিলেন—
মিলিটারিতে চাকরি করে করে যে চুল পাকিয়ে ফেলেছি সে কথা তো তোরা সকলেই জানিস। দুনিয়াতে এমন জায়গাই নেই যেখানে নানারকম সামরিক কাজে কোনো না কোনো সময়ে আমি যাইনি। গত মহাযুদ্ধের শেষে যাদের কাজ ছিল ফ্রান্সের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে, যত সব বিশ্বাসঘাতক বকধার্মিকরা দেশপ্রেমিকের ভেক নিয়ে নিশ্চিন্তে গা ঢাকা দিয়ে নিজের দেশের সর্বনাশের মধ্যে থেকে বেশ দু-পয়সা করে খাচ্ছিল, তাদের ধরিয়ে দেওয়া; পাকেচক্রে পড়ে আমিও তাদের দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম।
এই সময়ে যে কতরকম অভাবনীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল সে তোরা কল্পনাও করতে পারবি না।
ভয় কাকে বলে জানিস? এমন ভয় যে মুহূর্তের মধ্যে হিমের মতো ঠান্ডা ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে সপসপে হয়ে যায়? তবে শোন।
একবার একটা ভূতের বাড়ির সন্ধান পেয়ে হেডকোয়ার্টারের ভারী সন্দেহ হল। সমুদ্রের ধারে নির্জন জায়গায়, বহুদিনের পুরোনো কালো পাথরের এক বিরাট বাড়ি। কতকাল যে কেউ ওখানে বাস করেনি তার ঠিক নেই। বড়ই দুর্নাম বাড়িটার। দিনের বেলাতেও সেখানে কেউ বড় একটা যাতায়াত করে না। জানিসই তো, পৃথিবীর সর্বত্রই পাড়াগাঁয়ে লোকদের মনে এই ধরনের কুসংস্কার থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা শুধু গেঁয়ো গুজবে থেমে গেল না। সামরিক বিভাগের দুজন অফিসার জলঝড়ে সন্ধেবেলায় ওইখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাড়িটার সম্বন্ধে কানাঘুষো তাঁরাও শুনেছিলেন এবং আমারই মতো তাঁরাও ঘোর নাস্তিক ও ভূত বা পরলোকে অবিশ্বাসী ছিলেন। সেইজন্য দিনের আলো থাকতে থাকতে গোটা বাড়িটা তাঁরা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও দেখেছিলেন। বলা বাহুল্য ধুলোয় ঢাকা ঘরগুলোর মধ্যে ঘুরে ঘুরে কিংবা বাইরে বালি ও বেঁটে বেঁটে আগাছায় ভর্তি বাগানের দিকে চেয়ে-চেয়ে কোথাও অস্বাভাবিক কিছু তাঁদের চোখে পড়ল না।
চারিদিক অন্ধকার করে রাত নেমে এল, বাড়িটার হাবভাব কেমন যেন বদলে গেল। ধরাছোঁয়ার মধ্যে তেমন কিছু নয়। কিন্তু সমুদ্রের ও বাতাসের উদ্দাম গর্জনকে ছাপিয়ে বাড়ির ভিতরকার ছোটোখাটো নানান শব্দ যেন বেশি করে তাঁদের কানে আসতে লাগল।
প্রথমটা তাঁরা অতটা গা করেননি, কিন্তু ক্রমশ তাঁদের অস্বস্তির ভাবটা এমনই বেড়ে গেল যে, একটা শক্তিশালী টর্চের আলোতে গোটা বাড়িটা আর একবার পরীক্ষা করে দেখলেন এবং শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হলেন যে বাড়িতে নিশ্চয়ই আর কেউ আছে। হাতে হাতে যে প্রমাণ পেলেন তাও নয়। কিন্তু কীরকম জানিস, এই মনে হল স্নানের ঘরে কলের জল পড়ছে; দোরগোড়ায় পৌঁছলেই কে যেন চট করে কল বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল অথচ দরজা ঠেলে বাইরে প্যাসেজে বেরিয়ে দেখা গেল কেউ কোথাও নেই, সব ভোঁ ভোঁ।
আবার শোবার ঘরের মধ্যে স্পষ্ট দেশলাই জ্বালবার খসখস শব্দ শুনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে দেখেন কিচ্ছু নেই, মেঝের উপর দুই ইঞ্চি পুরু হয়ে বহু দিনের জমানো ধুলো পড়ে রয়েছে।
অবশেষে দুই বীরপুরুষ অন্ধকারের মধ্যে জলঝড় মাথায় করে ছুটে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে দিনের আলোতে ব্যাপারটাকে খানিকটা হাস্যকর মনে হলেও ঐরকম পরিস্থিতিতে যখন চারদিকে স্পাই খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে তখন, এ বিষয়ে আর একটু অনুসন্ধান করাই উচিত বলে সকলের মনে হল।
এই ব্যাপারে তদন্ত করবার জন্য আমরা জনা পাঁচেক সামরিক বিভাগের ঘুঘু অফিসার, সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র, চোর ধরার নানারকম ফঁদ আর ফাঁসজাল, বড় বড় টর্চ ও শেড লাগানো লণ্ঠন আর বলা বাহুল্য ঝুড়ি ভরে আহার্য ও পানীয় নিয়ে, সন্ধ্যা নামবার পর রওনা হলাম।
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে জিপ গাড়িটা রেখে, পায়ে হেঁটে, নিঃশব্দে ও যথাসম্ভব গোপন ভাবে ভূতের বাড়িতে উপস্থিত হলাম।
ভয়টয় পাওয়ার ছেলেই ছিলাম না আমরা। পৌঁছেই ঢাকা আলো নিয়ে সারা বাড়িটাকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। তার পর একতলায় সিঁড়ির পাশের বড় ঘরটার এক ধারের খানিকটা ধুলো ঝেড়ে নিয়ে, মেঝের উপরেই পা মেলে দিয়ে বসে পড়লাম। বিরাট ঘর, উঁচু ছাদ দেখাই যায় না, কার্নিশে কারিকুরি করা, মস্ত গুহার মতো চিমনি, তাতেও কত কারুকার্য, আর তার মধ্যেই চারটে মানুষ অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারে। বদমাইসদের আস্তানা গাড়বার এমন উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া দায়।
পাছে ভয় পেয়ে চোর পালায়, তাই নড়ছি চড়ছি পা টিপে টিপে; নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে রেখেছি, একটা সিগারেট পর্যন্ত ধরাচ্ছি না, আলোতে বা গন্ধে পাছে জানান দেয়। এমনি ভাবে বসে আছি তো বসেই আছি।
এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, এমন সময় খট্ করে কে যেন দোতলার একটা দরজা খুলল, সঙ্গে-সঙ্গে হঠাৎ হাত থেকে দরজা ফসকে গেলে বাতাসে যেমন দড়াম্ করে বন্ধ হয় সেইরকম একটা আওয়াজ হল। আমরা সতর্ক হয়ে উঠলাম। সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে অতি সাবধানে কে যেন নেমে আসছে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ালাম। সিঁড়ির শেষ দুটো ধাপ ক্যাঁচ কোঁচ করে উঠল, তারপর স্পষ্ট দেশলাই জ্বালবার শব্দ। অন্ধকার ভেদ করে আমাদের পাঁচ জোড়া চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল, আবছায়াতে যেন দেখতে পেলাম সে হাত আড়াল করে চুরুট ধরাচ্ছে। পাঁচজনে হঠাৎ টর্চ জ্বেলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
সিড়ির গোড়ায় ফ্যাকাশে মুখে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক। হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তার পরনে চেক-কাটা ছাই রঙের ঝোলাঝালা একটি ড্রেসিং গাউন। মাথায় একটা কালোমতো তেলচিটে ভেলভেটের গোল টুপি, পায়ে তালি দেওয়া পুরোনো স্লিপার, মুখে একটা সরু লম্বা জঘন্য ময়লা পাইপ, এক হাতে তামা দিয়ে বাঁধানো একটা দেশলাইয়ের বাক্স, অন্য হাতে লাঠি।
নিরীহ গোবেচারি ভদ্রলোক, হাত দুখানি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, চোখে হঠাৎ অত আলো পড়াতে যেন ধাঁধা লেগে গেছে, সর্বাঙ্গে ভয়ের ছাপ।
আমরা পাঁচজনে কাণ্ড দেখে অট্টহাস্য করে উঠলাম। ঘাড় ধরে তাকে টেনে ঘরের মধ্যে এনে, উজ্জ্বল সব আলো জ্বেলে তাকে প্রশ্ন করতে লেগে গেলাম। এতক্ষণ পর স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে পেরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
লোকটি কিন্তু বোকা সেজে রইল। আম্তা আম্তা করে নাম বললে, ফিলিপ বারো। বার বার বললে, এই বাড়িতেই বাস করে। তার চেয়ে বেশি কিছু বের করা গেল না, কেমন যেন হকচকিয়ে গেছে, পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে না।
তখন আমরা বুদ্ধি করে খাবারের ঝুড়ি খুললাম। অত খাবার দেখে তার চোখ দুটো চক্চক্ করে উঠল। যুদ্ধের মধ্যে ও পরে ও সব দেশের লোকেদের সে যে কী কষ্ট, সে আর তোদের কী বলব। হয়তো দু-তিন বছরের মধ্যে এত খাবার একসঙ্গে দেখেইনি। তার সারা মুখে দারুণ একটা খিদে-খিদে ভাব।
তবুও লোকটা যে একটা স্পাই এ বিষয়ে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এইরকম ভীতু চেহারার মানুষরাই ভালো স্পাইগিরি করতে পারে। তাদের আসা যাওয়া কারো নজরে পড়ে না, কেউ তাদের সন্দেহ করে না। কিন্তু এইরকম একটা ক্ষুধার্ত ক্যাংলা স্পাই জন্মে কেউ দেখিনি।
যাক, ভূতের বাড়ির রহস্যটা এতক্ষণে খানিকটা খোলসা হল বলে সকলে মহা খুশি হয়ে তাকে পেড়াপীড়ি করে খাওয়াতে লাগলাম। আর সেও অকাতরে থাক থাক স্যান্ডউইচ বিস্কুট আর ফ্লাস্ক থেকে চা গিলতে লাগল। অবিশ্যি আমরা নিজেরাও যে উপোস করে রইলাম তা নয়। বাইরে সমুদ্রের উপর দিয়ে হু হু করে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, মস্ত-মস্ত ঢেউ এসে পাহাড়ের উপর আছড়ে পড়ছে আর ঘরের ভিতর লণ্ঠনের কোমল আলোতে খাবারদাবার নিয়ে সকলে গোল হয়ে বসে দিব্যি একটা মজলিসি আবহাওয়া গড়ে তুলেছে।
লোকটার কাছ থেকে কিন্তু সত্যিই বিশেষ কিছু খবর পাওয়া গেল না। তার পিছনে কে আছে, কী ধরনের তাদের কাজের পদ্ধতি সে বিষয়ে হ্যাঁ না কিছুই বলে না। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন লুই বললেন, “ব্যাটা হয় নিরেট বোকা, নয় দারুণ চালাক। ওকে হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া ছাড়া তো উপায় দেখছি না।”
আমার নিজের লোকটার উপর কেমন যেন মায়া পড়ে যাচ্ছিল। এরকম একটা অসহায় নিরবলম্ব ভাব কখনো আমার চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। নিরীহ! পাড়াগেঁয়ে বেচারা, ভয়েই আধমরা। যদি সত্যিই স্পাইও হয়, তবুও সে যে নিজের তাগিদে হয়নি, অপর কেউ ভয় দেখিয়ে জোর-জবরদস্তি করে দলে বাগিয়ে নিয়েছে, এইরকম আমার মনে হতে লাগল। আর সেইজন্যেই ওকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া দরকার, সেটাও বুঝতে পারলাম।
শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন লুই বললেন, “তুমি তো নিজের কোনো পরিচয় দিতে পারছ না। নাম বলছ অথচ কী করে তোমার দিন চলে বুঝি না; আত্মীয়স্বজন কে কোথায় বলতে পারছ না।” লোকটা দুহাতে মখ ঢেকে বললে, “নেই, তারা কেউ নেই।” তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগল। ক্যাপ্টেন লুই-এর দয়া-মায়া ছিল, তিনি তাকে বুঝিয়ে বললেন, “তা বললে চলবে না, তুমি যে স্পাই নও তাই-বা কে বলবে?”
সে হঠাৎ মাথা তুলে অনেকখানি স্পষ্ট করে বলল— “স্পাই? কার স্পাই? কে আছে যার জন্য স্পাই হব?”
“আচ্ছা, এখন হেডকোয়ার্টারে চলো তো। যদি স্পাই নাই হও তবে তো ভালোই। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।”
কিন্তু সে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ অন্ধভাবে সিঁড়ির দিকে দৌড় মারল। ক্যাপ্টেন লুইও সঙ্গে সঙ্গে ‘আরে, ধর ধর’, করে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। সে একবার চারিদিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে, “না, না, এটা আমার বাড়ি। এখান থেকে আমি কোথাও যাব না”, এই বলে, কী আর বলব তোদের, সেই আমাদের পাঁচজনের ঔৎসুক্য-ভরা চোখের সামনে, সেই লণ্ঠনগুলির উজ্জ্বল আলোতে, মুহূর্তের মধ্যে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন লুই-এর মনে হল বুঝি বাতাসকে আলিঙ্গন করছেন।
বুঝতেই পারছিস আমরা আর এক দণ্ডও অপেক্ষা না করে, জিনিসপত্র সব সেখানে ফেলে রেখে, টলতে-টলতে কোনোরকমে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
মিলিটারি ব্যাপার ওইখানে শেষ হয়ে যেতে পারে না। পরদিন লোকজন গিয়ে জিনিসপত্র উদ্ধার করে আনল। বহু অনুসন্ধানের পর জানা গেল যে ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে ও বাড়ি খালি পড়ে আছে। মালিকরা ওই সময়ে নির্বংশ হয়ে গিয়েছিলেন।