ছয়
গরমের দিন এসে গেছে তখন। শীত কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্ৰ পক্ষের বিমান হানার তোড়জোড়ও কমে এসেছে বলে মনে হলো। মাঝে মাঝে দু’চারটে শেল ফাটার শব্দ শুনতে পাওয়া গেলেও ওর বেশীর ভাগই ফাটতো আকাশে। জীবন বা সম্পত্তির হানি বিশেষ কিছুই ওতে হতো না।
এই সময়টায় জার্মাণদের ভিতরে একটা বিশেষ কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। সর্বত্রই দেখতে পেলাম সাজানো গোছানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবার ধুম লেগে গেছে। হাসপাতালের ময়লা চাদর ও মশারীগুলোকে ধুইয়ে সাফ করে নিয়ে আসা হলো। ডিসপেনসিং-রুম, অপারেশন থিয়েটার, সর্বত্রই সাফ সাফাই আরম্ভ হয়ে গেল।
শুনতে পেলাম—উপরের হুকুম।
কিন্তু কেন এই হুকুম?
এই সময় এলফন্স একদিন আমাকে বললো যে, জার্মাণ সম্রাট কাইজার আসছেন আমাদের হাসপাতাল দেখতে।
—তাই নাকি? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
এলফন্স বললো— চেষ্টা করুন না, তারিখ আর সময়টা জানতে!
আমি বললাম—সে কথা আর বলতে?
“কাইজার আসবে” “জার্মাণ সম্রাট কাইজার!” “এই যুদ্ধের জন্য ঐ লোকটাই দায়ী” এই কথাই আমার মনে হলো তখন। ভাবলাম—”যদি সময় মত এই মহামূল্য সংবাদটি পাঠাতে পারি, তাহলে ….”
তাহলে যে কি হতে পারে সে কথা চিন্তা করতেই আমার ধমনীর রক্ত গরম হয়ে উঠলো।
ক্যান্টিন মা’র হাত দিয়ে লিপি পেলাম—
“কাইজার আসছে। তারিখ আর সময় জানতে চায় ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট।”
জমকালো পোষাক পরা বহু “হাইর্যাঙ্ক অফিসিয়েল” এসে গেছে রুলারস। ওদের সবাই যেন মিলিটারী মেজাজ। রাস্তায় কেউ সেলাম দিলেও কট্ মট্ করে তাকায় ওরা।
এই সময় একদিন এক কর্ণেলকে আমাদের হাসপাতালের ওবার্তাজের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে দেখলাম। ওবার্তাজ আমাকে ডেকে বললেন—হের কর্ণেলকে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো দেখিয়ে দাওতো ফ্ৰাউলিন।
ওবার্তাজের হুকুম মত কর্ণেলকে সঙ্গে নিয়ে আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওয়ার্ডগুলো দেখাতে লাগলাম।
একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় এলে কর্ণেল হঠাৎ বলে বসলো—আগামী কাল আপনি আমার সঙ্গে ‘লাঞ্চ’ এ এলে সুখী হবো ফ্রাউলিন।
আমি বললাম—এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।
কর্ণেল বললো—আপনার মত সুন্দরী আর শিক্ষিতা তরুণীর সঙ্গে আলাপ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি আমি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আরও একটা অনুরোধ করতে চাই আপনাকে!
—কি বলবেন বলুন।
–দু’ একদিন ব্রুসেলস-এ গিয়ে ছুটি উপভোগ করে আসবার সুবিধে হবে কি আপনার?
কর্ণেল যে কি বলতে চায় ত। আমি ভালই বুঝতে পারলাম, কিন্তু সব বুঝেও আমি ওর প্রস্তাবে রাজী হওয়াই স্থির করলাম। কর্ণেলের মত উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের কাছ থেকে অনেক কিছু খবর জানা যেতে পারে। হয়তো কাইজারের গতিবিধির খবরও জানতে পারবো। এই সব চিন্তা করেই আমি বলে বসলাম —ব্রুসেলস যাবার ইচ্ছা আমারও অনেকদিন থেকেই আছে। ওখানে আমার দিদিমা আছেন, যেতে পারলে তাঁকেও একবার দেখে আসতে পারতাম।
–বেশ, আমি তাহলে আপনার পাশের ব্যবস্থা করছি। হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবে তো আপনাকে?
আমি বললাম সে ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারবো।
কথা বলতে বলতে হাসপাতালের সদর দরজার কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম আমরা। ওখানে তখন লোকজন নাই দেখে কর্ণেল আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে একটা চুমো দেবার চেষ্টা করতেই দরজার বাইরে মিলিটারী বুটের আওয়াজ শোনা গেল। কর্ণেল তাড়াতাড়ি আমার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুইজন মিলিটারী অফিসার গেটের সামনে এসে পড়লো। কর্ণেলকে দেখে ওরা সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই কর্ণেল বললো—কাল দশটার আগেই আপনার পাশ পাঠিয়ে দেবো। আবার আমাদের দেখা হবে তাহলে কি বলেন?
লক্ষ্য করলাম ওর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু, হাসি।
আমি বললাম—নিশ্চয়ই।
কর্ণেল তখন আমার সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলো।
ও চলে যেতেই আমার মনে হলো—কাজটা কি ভাল করলাম। কিন্তু তখন আর উপায় নেই।
পরদিন ঠিক সময়মত ব্রুসেলস্ যাবার পাশ এসে গেলো আমার কাছে। লাঞ্চে বসে কর্ণেল আমাকে জানালো যে সে একদিন আগেই ওখানে যাচ্ছে সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখতে। আমাকে একদিন পরে রওয়ানা হ’তে বললো সে।
পরদিন কর্ণেল চলে গেল। আমিও হাসপাতাল থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে ব্রুসেলসের ট্রেনে উঠে বসলাম, নির্দিষ্ট দিনটিতে।
ব্রুসেলস্ ষ্টেশনে এসে গাড়ী থেকে নামতেই একজন সোফেয়ার আমার কাছে এসে অভিবাদন করে বললো—কর্ণেল সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।
আমি বললাম—তিনি কোথায়?
সোফেয়ারটি বললো-—একটা বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় তিনি আসতে পারলেন না তাই তিনি এই চিঠিখানা দিয়েছেন আপনাকে।
এই বলেই পকেট থেকে একখানা লেপাফা বের করে আমার হাতে দিল। কর্ণেল লিখেছিল—
“হঠাৎ বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় ষ্টেশনে এসে আপনার সঙ্গ-সুখ উপভোগ করবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হ’ল বলে অত্যন্ত দুঃখিত। ভবিষ্যতে এ রকম ব্যাপার আর যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করবো। আমার মোটর পাঠাচ্ছি। সোফেয়ারের সঙ্গে চলে আসবেন।”
“এ আমি কোথায় চলছি? আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হয়তো আমার “কুমারী” জীবনের চরম সন্ধিক্ষণ এসে যাবে! মোটরে বসে ভাবলাম।
কাইজার! লোকটিকে আমি দেখিওনি আগে, কিন্তু পৃথিবীতে যদি সবচেয়ে ঘৃণা করি কাউকে, সে হলো এই লোকটি জার্মাণ সম্রাট কাউজার। এর গতিবিধির সংবাদ লোকটি—জার্মাণ জানতে যদি আমার কুমারী জীবনের সবকিছু হারাতেও হয়, তাতেও আমি প্রস্তুত!
কয়েক মিনিটের ভিতরেই সোফেয়ার আমাকে একটা প্রসিদ্ধ হোটেলের সামনে নিয়ে এলো! ব্রুসেলস সহরের সবচেয়ে সৌখিন হোটেল সেটি। একমাত্র বিলাসী ধনী আর উচ্চপদস্থ অফিসাররাই এ হোটেলে বাস করে।
হোটেলের যে কামরায় আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল সেটি অত্যন্ত মূল্যবান আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ছিল। প্রীংযুক্ত খাটে বকের পালকের মত মসৃণ ও সাদা সিল্কের চাদরে ঢাকা নরম গদীর উপরে বসে মনে হ’ল যে ধনীর দুলালী- আর রাজনন্দিনীদের ভাগ্যেই কেবল এ রকম দামী শয্যায় শোওয়া সম্ভব।
অনভ্যস্ত সুখদায়ক শয্যায় গা ঢেলে দিলাম আমি। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম— আজ রাত্রির মত তো নিশ্চিন্ত
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই হোটেলের একটি ‘বয়’ বেশ কায়দা-দরস্তভাবে একখানা ট্রে হাতে করে এগিয়ে এলো আমার কাছে! ট্রের উপরে একখানা ফিকে নীল রঙের বন্ধ করা খাম। খামের উপরে আমার নাম লেখা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা যেন যন্ত্রচালিতের মত হাতমুখ ধুয়ে পোষাক বদলে ফেললাম, ডাইনিং রুমে যাবার জন্য।
ডাইনিং রুমে যেতেই কর্ণেল উঠে এসে স্বাগত জানালো আমাকে। গল্পগুজবের ভেতর দিয়ে সকালের ‘ব্রেকফাষ্ট’ পর্ব শেষ করে কর্ণেলের কাছে বিদায় নিলাম আমি। আমি বললাম- আমাকে একবার মার্কেটিংয়ে বের হতে হবে।
বাঙ্গার করতে বেরিয়ে সহরের অবস্থা দেখে হতাশ হলাম! কোথায় সেই চমৎকার পিচ ঢালা পরিচ্ছন্ন রাস্তা! কোথায় নয়ন ভোলানো বিপণি শ্রেণী? ‘ব্রুসেলস’ এর সব চেয়ে সৌখিন আর সুসজ্জিত রাস্তা ছিলো “রো রয়াল”। কিন্তু সেই “রো রয়াল” এর দশা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এই দিকটাকে লোকে ‘খুদে প্যারিস’ বলতো। ভারী ভারী মিলিটারী গাড়ীর অবিরাম যাতায়াতে রাস্তাগুলো ক্ষত বিক্ষত। রাস্তা চলতে পদে পদে হোচট খেতে হয়। এখানে ওখানে ফেলে রাখা হয়েছে মিত্র পক্ষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কামানগুলো। হয়তো জনসাধারণের কাছে জার্মাণ সৈন্যদলের বীরত্ব প্রকটিত করাই এর উদ্দেশ্য।
রাস্তার ধারে বড় বড় দোকানের শো-কেসগুলো খাঁ খাঁ করছিল। পয়সা দিলেও পণ্যদ্রব্য মেলে না। জিনিসপত্রের দাম শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হবার উপক্রম হয়।
চলতে চলতে দেখলাম একদল ইংরেজ যুদ্ধবন্দীকে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলছে রাইফেল ধারী জার্মাণ সৈন্যরা। ওদের রাইফেলের মুখে লাগানো রয়েছে বেয়নেট। একখানা ট্রাম চলে গেলো পাশ দিয়ে। ট্রামখানা ব্রিটিশ বন্দীদের পাশ দিয়ে যাবার সময় ভিতর থেকে সিগারেট আর চকলেট বৃষ্টি হতে লাগলো বন্দীদের উপরে।
যে সব জিনিস কিনবো ভেবেছিলাম তার সামান্য মাত্র কেনা হলো।
দুপুর বেলা কর্ণেলের সঙ্গে যখন লাঞ্চে বসেছি এই সময় দূর থেকে অস্পষ্ট শ্লোগানের আওয়াজ কানে এলো! অস্পষ্ট আওয়াজ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে এলো। শুনতে পেলাম জনতার আওয়াজ বেলজিয়াম জিন্দাবাদ! ইত্তেহাদি ফৌজ জিন্দাবাদ!
ট্রামগুলোও যেন হঠাৎ ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘণ্টা বাজাতে লাগলো—ঠন, ঠন, ঠন্ ঠন্, ঠনাঠন, ঠন্। মোটর গাড়ীগুলো একসঙ্গে একতালে হর্ণ বাজাতে লাগলো। হঠাৎ আমার মনে পড়লো যে একুশে জুলাই!
বেলজিয়ামের স্বাধীনতা দিবস!
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই আনন্দে বুক ভরে উঠলো আমার।
হাজার হাজার গ্যাস-বেলুন আকাশে উড়ছে—বেলুনগুলির উপরে আঁকা ইংরেজ, ফরাসী আর বেলজিয়ামের জাতীয় পতাকা
কর্ণেল হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। উত্তেজিত ভাবে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে জানালার সামনে গিয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলো সে—বন্ধ করো, বন্ধ কর এসব? গুলী করে ফাটিয়ে দাও বেলুনগুলোকে!
এইভাবেই ব্রুসেলস পালন করলো তার স্বাধীনতা দিবস।
কর্ণেলের রাগ কিছুটা কমে আসতে ওর বোধহয় আমার কথা মনে পড়ে গেল। ও তখন ফিরে এসে আমার পাশে বসে এ কথা সে কথা বলতে আরম্ভ করে দিল! কথায় কথায় ও আমাকে বললো “আজ আপনাকে অপেরায় নিয়ে যাবো। ওখানে আজ বিরাট ‘গালা নাইট’। তা’ছাড়া আজ আমাদের ‘অল হাইয়েষ্ট’ আসছেন ওখানে।
অল হাইয়েষ্ট! কাইজার! —কাইজার আসবে অপেরায়? —তাহলে যে আমাকে যেতেই হবে!
অপেরা।
একখানি বিশেষ ভাবে নির্দিষ্ট আসনে বসে আছেন জার্মাণ সম্রাট কাইজার।
অপেরার দিকে দৃষ্টি নেই আমার। পাগলের মত আমি তাকিয়ে আছি কাইজারের দিকে।
“মাত্র কয়েক গজের ব্যবধান! যদি একটা রিভলভার এই সময়!”
কর্ণেল আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললো—সেকি সুন্দরী! আপনার দৃষ্টির সবটুকু মাধুর্যই যে ‘অল হাইয়েষ্ট’ এর দিকে ঢেলে দিয়েছেন! এ গরীবের দিকেও একবার তাকান!
কিছুক্ষণ পরেই কাইজার চলে গেলেন।
এত কাছে পেয়েও কিছুই করতে পারলাম না আমি।
অপেরা থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। এইবার
আমার ভয় হতে লাগলো। কর্ণেলের হাত থেকে কি করে নিজেকে অর্থাৎ আমার দেহকে রক্ষা করি এই চিন্তাতেই অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে কর্ণেল আমার কোমর জড়িয়ে চলতে লাগলো। বাধা দেবার পথ বন্ধ। আমি যে স্বেচ্ছায় এসেছি।
আমাকে ঘরের দরজায় পৌছে দিয়ে কর্ণেল বললো— আপনি ততক্ষণ পোষাক বদলে নিন, আমি একটু পরেই আসছি।
ওর দুই চোখে তখন কামনার আগুন জ্বলছে।
ও চলে যেতেই মনে মনে ঠিক করলাম যে আমি পালাবো। এই সুযোগ ছেড়ে দিলে আর রক্ষা নেই আমার।
ঘরে গিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য দরজা খুলতেই দেখি—কি সর্বনাশ! কর্ণেল একেবারে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে কর্ণেল যেন হকচকিয়ে গেল।
–কি ব্যাপার! কোথায় চলেছেন আপনি?–কর্ণেল জিজ্ঞাসা করলো।
আমি বললাম—আমাকে ক্ষমা করুন। ও আমি পারবো না। না বুঝে যা বলে ফেলেছিলাম তার জন্য ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।
কর্ণেল তখন আমার একখানি হাত ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে এসে কোমল ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলো—কি হয়েছে বলো তো? তুমি তো আমার সঙ্গে থাকবে বলে নিজে থেকেই কথা দিয়েছিলে—এখন এসব কি ছেলেমানুষী হচ্ছে?
আমি বললাম—আমাকে আপনি ছেড়ে দিন। দয়া করে ছেড়ে দিন আমাকে ও আমি পারবো না, কিছুতেই পারবো না।
হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠে কর্ণেল বললো—এ কিছুতেই হতে পারে না, তোমাকে আমার চাই-ই আজ!
এই বলেই ও আমাকে খাটের দিকে টেনে নিয়ে চললো। আমি তখন মরিয়া হয়ে সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে মুক্ত করে নিলাম নিজেকে। কর্ণেল অত্যন্ত বেশী মদ খেয়েছিল বলেই বোধ হয় এটা সম্ভব হয়েছিল।
ও আমার দিকে আবার এগুতে চেষ্টা করতেই আমি ছুটে গিয়ে আবার ধাক্কা মারলাম ওকে। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে খাটের রেলিং-এর উপরে ছিটকে পড়লো ও। আঘাত লেগেছিল কারণ খাটের রেলিং উপর পড়ে যেতে দেখলাম ওকে। ওর বোধ হয় মাথায় থেকে গড়িয়ে মেঝের আমার তখন নষ্ট করবার মত এক মিনিট সময়ও নেই। চট করে আমার হাত ব্যাগটি তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিরে এসে দরজায় চাবি বন্ধ করে প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম আমি।
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় দারোয়ান আমাকে ঐ ভাবে ছুটতে দেখে মুচ্ কে হেসে অভিবাদন করলো!
ওকি ভাবলো কে জানে!
ভোর হবার আগেই রুলার্স ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম! রুলার্সের মত জায়গায় ঐ সময় একাকিনী কোন মেয়ের পক্ষে রাস্তা চলা এক রকম অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কিন্তু কর্ণেলের সেই পাশ যা আমার পকেটে তখনও ছিল, তারই কল্যাণে কোন বিপদ ঘটলো না আমার।
বাড়ীতে এসে দেখি সবাই তখন ঘুমোচ্ছে কেবল মা জেগে উঠেছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই দু’হাত বাড়িয়ে মা আমাকে বুকে টেনে নিয়ে চুপি চুপি বললেন—ক্যান্টিন মা তোমার জন্য খবর রেখে গেছে।
পড়ে দেখলাম–”কোন বিশেষ কাজে তেষট্টি নম্বরের কয়েক- দিনের জন্য বাহিরে যেতে হয়েছে। ইতিমধ্যে কোন সংবাদ পাঠাতে হলে আপনি ভ্যানরুট ফার্ম হাউসে যাবেন। দরজায় প্রথমে ছ’বার একটু থেমে তিনবার করাঘাত করলে একজন মোটামত স্ত্রীলোক খবর নেবে।“
ব্রুসেলস থেকেই একটু কানাঘুসা শুনেছিলাম যে, শনিবারের আগে কাউজার আসবে না। সঠিক তারিখ বা সময় না জানতে পারলেও যেটুকু জেনেছিলাম সে খবরই আমি পাঠিয়ে দিলাম। ভ্যানরুট ফার্ম রুলার্স থেকে অনেক দূরে। ওখানে যেতে দুবার রাস্তায় জবাবদিহি করতে হয়েছিল আমাকে কিন্তু আমার কাছে ‘নাইট পাশ’ থাকায় বিশেষ কোন বিপদ হয় নি আমার।
সপ্তাহের শেষের দিকে এলফন্স খবর দিল যে; কাইজারের রুলার্স পরিদর্শনের কার্য্যসূচী বাতিল হয়েছে কারণ গত কয়েকদিন ধরেই আকাশে ব্রিটিশ এয়ার-ক্রাফ্ট’এর ‘সাত বোনকে’ দেখা যাচ্ছিলো।
এই ‘সাত বোন’ নামটি জার্মাণরা দিয়েছিল, কারণ যখনই ব্রিটিশ এরোপ্লেন আকাশে দেখা যেতো তখনই দেখতে পাওয়া যেতো যে, সাতখানি এরোপ্লেন একসঙ্গে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে।