পাঁচ
এরপর কয়েকটি দিন চুপচাপ কাটলো। বাড়ী থেকে হাসপাতাল আর হাসপাতাল থেকে বাড়ী। এছাড়া আমার যেন আর কোন কাজই নেই।
এই সময় একদিন ক্যান্টিন মা আমার হাতে একটু করো কাগজ দিয়ে গেল। ঘরে গিয়ে পড়ে দেখলাম—
“আমাদের অনেক খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। জার্মাণ বন্দীদের কাছে খবর পাওয়া গেছে, যে ‘বার্জ’ জেলায় ‘রাদারব্রুক’ সহরের উপকণ্ঠে, জার্মাণদের এক গোপন টেলিফোন লাইনের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাদলের ঠিক পেছনে কোথাও যোগাযোগ আছে। বহু চেষ্টা করেও এদিকের লাইন কোথা আছে জানতে পারিনি। সম্ভব হ’লে খবর নিতে চেষ্টা করবেন।”
নির্দেশ পড়ে হতাশ হয়ে পড়লাম। ‘রাদারব্রুক’ রুলারস্ থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে। এতদূরে থেকে কি করে রাদার- ব্রুকের খবর সংগ্রহ করবো, সে কথা ভেবেই ঠিক করতে পারলাম না। চিন্তা করতে করতে আশার একটা ক্ষীণ আলোক দেখতে পেলাম যেন! আমার এক কাকা থাকতেন রাদারব্রুকে। তাই মনে হ’ল কাকার বাড়ী যাবো বলে একখানা পাশ যদি কোন রকমে জোগাড় করতে পারা যায়, তাহলে হয়তো খবরটা বের করা যায়!
সুযোগও একটা জুটে গেল। এই সময় সহরে গুজব রটেছিল যে, অসামরিক লোকদের সব রুলারস্ থেকে চলে যেতে হবে। ‘ফ্যাসুজেল’ নামে জার্মাণ মেসিনগান কোম্পানী’র একজন কমাণ্ডার সেই সময় আমাদের ‘কাফে’তে বাস করছিল। সেই কেমিষ্ট ভদ্রলোক গ্যাস আক্রমণের পরেই চলে গিয়েছিল, আর কমাণ্ডার ফ্যাসুজেল এসে সেই ঘর দখল করেছিল, সে চলে যাবার পরেই।
অটোভন, যার কথা এর আগেও বলেছি সে কিন্তু ওখানে শিকড় গেড়ে বসেছিল। লোকটার অন্তরে যাই থাক, মুখে ছিল মধুভরা। সব সময়ই ও দেখাতে চেষ্টা করতো যে ওর মত অকৃত্রিম সুহৃদ আমাদের আর কেহ নেই। ওর ব্যবহারে অবিশ্বাস করবার মতও কিছু ছিল না। যাই হোক, একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হ’তে পেরেছিলাম যে, আমাকে ও কিছুমাত্র সন্দেহ ক’রতে পারে নি।
মেসিনগান কোম্পানীর সেই কমাণ্ডার ফ্যাজেলের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। একবার ও সাংঘাতিক রকমে আহত হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে ছিল; তখন থেকেই ও আমাকে চিনতো। তারপর আমাদের কাফেতে আসবার পর সেই পূর্ব পরিচয় আরও একটু ঘনিষ্ট হয়েছিল। আমার সঙ্গে ও খুবই ভাল ব্যবহার করতো।
সুযোগ বুঝে একদিন আমি ফ্যাজেলকে বললাম—চারদিকে যা শুনছি, তাতে তো মনে হচ্ছে যে আমাদের এখান থেকে চলেই যেতে হবে!
ফ্যাজেল—কে বলেছে এ কথা? ওটা একটা বাজে গুজব। আমি বললাম—-গুজব বাজেই হোক আর যাই হোক, সত্যিই যদি আমাদের কোথাও চলে যেতে হয় তাহলে তো আমাদের সব কিছুই এখানে ফেলে রেখে যেতে হবে। তাই ভাবছি যে সুযোগ পেলে আমাদের কিছু কিছু আসবাবপত্র রাদারব্রুকে আমার কাকার বাড়ীতে রেখে আসবো।
আমি জানতাম যে চলাফেরার ব্যাপারে অন্যান্য কোম্পানী- গুলির চেয়ে জার্মাণ মেশিনগান কোম্পানীগুলি অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। তাই আমি ফ্যাজেলকে অনুরোধ করে বললাম—আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন তাহলে আমি মনে করি যে আমাদের জিনিষপত্র রাদারব্রুকে সরিয়ে রেখে আসা অসম্ভব হবে না।
একটু চিন্তা করে ফ্যাজেল বললো—আমি হয়তো আপনাকে একখানা ওয়াগন দিতে পারি দু’একদিনের জন্য। আচ্ছা আপনি এক কাজ করবেন, যে যে জিনিষপত্র পাঠাতে চান সেগুলো জড়ো করে পেছনের ঘরে রেখে দেবেন। আমি কাল সন্ধ্যার পরে সেগুলোকে ওয়াগনে তুলে নেবার ব্যবস্থা করবো। ভাল কথা! কোথায় দিয়ে আসতে হবে ওগুলো বলুন তো?
আমি ইচ্ছে করেই বোকা সেজে গেলাম। আম্তা আম্ তা করে বললাম—তাই তো! কাকার বাড়ীর ঠিকানাটা তো মনে পড়ছে না, তবে আমি তাঁর নামটা বলে দিতে পারি। ওখানে সবাই চেনে তাঁকে।
ফ্যাজেল বললো—তাহলে তো বড়ই মুস্কিলে ফেললেন, ফাউলিন। জার্মাণ মেসিনগান কোম্পানীর ওয়াগন ড্রাইভার ওখানে একজন বেলজিয়ামের বাড়ীর খোজ খবর নেওয়া শুরু করলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে। প্রথমতঃ এইভাবে ওয়াগন দেওয়াটাই বেআইনী, এর উপর মালপত্তর নিয়ে ধরা পড়লে তো কেলেঙ্কারীর একশেষ হবে।
আমি বললাম—আমাকে যদি সঙ্গে নিয়ে যান তাহলে কোনই গোলমালের ভয় থাকে না।
কিন্তু মুস্কিল তো হয়েছে আপনি মেয়ে হয়ে! আপনি যদি জার্মাণ সৈনিকের ছদ্মবেশে যেতে রাজী থাকেন তাহলে এক হয়।
আমি বললাম পোষাক পেলে নিশ্চয়ই পারবো।
ফ্যাসুজেল বললো—বেশ? তাহলে সেই কথাই থাকলো। আপনার চেহারাও বেশ লম্বা চওড়া আছে। সৈনিকের পোষাক পরে মুখে একটা পাইপ গুঁজে দিলেই দিব্যি মানিয়ে যাবে! চুলটা হেলমেটের নীচেই ঢাকা পড়ে যাবে! আপনি তাহলে পাস্তুত হয়ে থাকবেন। আপনার পোষাকের ব্যবস্থা আমি করবো। আপনার সঙ্গে যেই ড্রাইভারটিকে দেবো তার নাম ‘সাইলেন্ট উইলি’। তাকে আপনি আমার মতই বিশ্বাস করতে পারেন।
কথাটা ফ্যাজেল কি জন্য বললো তা বুঝতে দেরী হলো না আামার। কোন মেয়েকে একলা পেলে জার্মাণ সৈনিকরা কি রকম ব্যবহার করে, ওয়েষ্টরুজবেক থাকতে সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।
পরদিন সন্ধ্যার একটু পরেই একখানা ওয়াগন এসে ‘কাফে’র পেছনের দরজার সামনে দাঁড়াতেই আমি দরজা খুলে বাইরে এলাম। ড্রাইভার একটা পোষাকের বাণ্ডিল আমার হাতে তুলে দিয়ে বললো—কমাণ্ডার পাঠিয়েছেন!
বাণ্ডিলটা ওর হাত থেকে নিয়েই আমি ঘরের ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করলাম। ট্রাউজার, হেলমেট, বুট সবই ঠিকমত লাগলেও মুস্কিল হলো ‘টিউনিক’ নিয়ে। আমার উঁচু স্তন যুগলকে কিছুতেই যেন চেপে রাখতে পারছিলাম না ওদিয়ে। অবশেষে বুকে ব্যাণ্ডেজের মত করে কাপড় জড়িয়ে সে বিপদ থেকে ‘রেহাই পেলাম। যেটুকু বেমানান হয়েছিলো একটা মোটা ‘গ্রেটকোট’ চাপিয়ে সেটুকু সহজেই ঢেকে ফেললাম। একবার ইচ্ছা হলো এই অপরূপ পোষাকে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে, আয়না দিয়ে দেখতে। কিন্তু ঘরে আয়না না থাকায় আর এই পোষাকে কাফের ভিতরে যাওয়া বিপজ্জনক মনে করে, সে কৌতুহল আমি বাধ্য হয়েই দমন করলাম।
পোষাক পরে তৈরী হয়ে এসে দেখি যে, ততক্ষণ ড্রাইভারটি অনেকগুলি আসবাব গাড়ীতে তুলে ফেলেছে। আমি তখন ওর সঙ্গে ধরাধরি করে বাকি জিনিষগুলো গাড়ীতে তুলে তেরপল চাপা দিয়ে ঢেকে রেখে নিঃশব্দে ড্রাইভারের পাশে এসে বসে পড়লাম। আমি উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ী ছেড়ে দিল। ফ্যাজেলের কাছে শুনেছিলাম—ওর নাম ‘সাইলেন্ট উইলি’। সত্যিই লোকটি ‘সাইলেন্ট’। সেই যে পোষাকের বাণ্ডিলটা দেবার সময় আমার সঙ্গে একবার মাত্র কথা বলেছিল, তারপর কোন দ্বিতীয় কথা আর শুনতে পেলাম না, ওর মুখ থেকে।
দেখতে দেখতে সহর ছেড়ে গেঁয়ো রাস্তায় পড়লাম আমরা। কিছুদূর যেতেই একদল ভ্রাম্যমান মিলিটারী পুলিশ গতিরোধ করলো আমাদের। কিন্তু “বায়ান্নো নম্বর মেশিনগান কোম্পানীর ওয়াগন” শুনবার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা আমাদের ছেড়ে দিল। ‘মেসিনগান কোম্পানী’ এই কথাটাই যেন যাদুমন্ত্রের মত কাজ করতে লাগলো। এর পরেও কয়েকবার আমাদের থামতে হয়েছিল, কিন্তু প্রত্যেকবারেই ঐ কথাতেই কাজ হলো। আরও খানিকটা যাবার পর নীল রঙের উদীপরা দু’জন নৌ-সেনা আমাদের গতিরোধ করে দাঁড়ালো।
‘সাইলেন্ট উইলি’ ইশারায় আমাকে চুপ করে থাকতে ব’লে হঠাৎ তার বেল্ট থেকে রিভলভারটা টেনে বের করে চীৎকার করে উঠলো—দেখতে পাচ্ছো না বায়ান্নো নম্বর মেসিনগান কোম্পানীর ওয়াগন। কি চাও তোমরা?
ওর হাতের রিভলভার দেখে আর মুখের চীৎকার “বায়ান্নো নম্বর মেসিনগান কোম্পানীর ওয়াগন” শুনে নৌ-সেনা দু’জন মুখ কাচুমাচু করে বললো— আমরা ভেবেছিলাম—মানে—সিগ্রেট খাবেন আপনারা?
এই বলেই পকেট থেকে দু’জনে দু প্যাকেট সিগারেট বের করে আমাদের হাতে দিয়ে চট করে সরে পড়লো ওখান থেকে।
.
প্রায় ভোরের সময় আমাদের গাড়ীখানা কাকার বাড়ীর দরজায় এসে থামলো। কাকা সেই ভোর বেলাতেই বাইরে এসে দাড়িয়েছেন দেখলাম। হঠাৎ মিলিটারী ওয়াগন থেকে দু’জন জার্মাণ সৈনিককে নামতে দেখে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। আমি কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে কাকা বললেন—তোমাকে হঠাৎ এই পোষাকে দেখে আমি খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম মার্থা। কাকা আমার হাত ধরে নিয়ে চললেন বাড়ীর ভিতরে। সাইলেন্ট উইলিকেও সাদরে আমন্ত্রণ করলেন তিনি।
কাকার ওখানে সেদিনের আহার-পর্বটি বেশ ভাল রকমেই হলো। অনেকদিন পরে নানারকম চর্ব্য, চোস্য খেয়ে সাইলেন্ট উইলিকে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে তামি তার কাছে এই বলে বিদায় নিলাম যে—অনেকদিন শরে এসেছি এখানকার চেনাশুনা লোকদের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। ভাল বিছানা পেয়ে সাইলেন্ট উইলি তখনই সটান শুয়ে পড়লো।
কাকার কাছে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম যে ডকের ধারে একটা ছোট বনভূমি আছে বটে, তবে সেখানটায় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কাকার কাছে আরও খবর পেলাম যে সেই ডকে একটা সাবমেরিন এসেম্বলি আছে। কিছুদিন যাবৎ নাকি অনেক গোলাবারুদ মজুদ করা হচ্ছে সেখানে।
আরও একটা খবর জেনে নিলাম কাকার কাছে। শুনলাম যে ময়দানের পাশে যে ছোট্ট জঙ্গলটা আছে, সেখানে একখানা ছোট্ট কুটীরে দুজন জার্মাণ সৈনিক সর্বদা পাহারায় থাকে। ওরা ওখানে কি করে সে কথা কেউ জানে না, তবে ওরা নাকি দুজনে একসঙ্গে কখনও বের হয় না।
আমি বললাম—আমি একবার ওখানে যাব কাকা!
কাকা বললেন—কি সর্বনাশ! ওখানে যাবে কি! শুধু শুধু বিপদ ডেকে এনে কোন লাভ আছে?
আমি বললাম—আমাকে যেতেই হবে। আপনি আমাকে খানিকটা তুলো, ব্যাণ্ডেজ আর একটা ‘আই-শিল্ড’ জোগাড় করে দিন। ওখানে যাবার জন্যই এতটা এসেছি আমি।
কাকা বললেন—তুমি কি পাগল হয়েছো মার্থা! এ রকম কাজে কত বিপদ সে কি তুমি বোঝনা? তাছাড়া এখানে তোমার কোন বিপদাপদ ঘটলে দাদা-বৌদিই বা কি বলবেন আমাকে?
আমি বললাম—আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন, যেতে আমাকে হবেই।
আমার জিদ দেখে কাকা বোধ হয় আমার আসল কাজের সম্বন্ধে কিছুটা আঁচ করে নিতে পেরেছিলেন।
তিনি বললেন—বড় বিপদের পথে পা বাড়িয়েছো মার্থা।
আমি বললাম—আপনি তাহলে তুলো ব্যাণ্ডেজ আর একটা ‘আই-শিল্ড’ এনে দিন আমাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জিনিসগুলি এনে দিলেন কাকা।
আমি তখন মুখে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে এবং চোখে ‘আই-শিল্ড’ এটে হাসপাতালের রুগীর মত মেক্আপ, নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ী থেকে বের হলাম! যাবার সময় কাকার একখানি শক্ত লাঠিও সঙ্গে নিলাম আমি! তাছাড়া এক শিশি ‘ক্লোরোফর্ম আর একখানা রুমালও সঙ্গে নিয়েছিলাম। ঐ দুটো জিনিস আমি রুলারস্ থেকেই নিয়ে এসেছিলাম।
নির্দিষ্ট বনের কাছে যেতেই দেখতে পেলাম সেই কুটিরটা। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল তখন। একজন মোটা মত লোক ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়ে সহরের দিকে চলে গেল। লোকটা আমার পাশ দিয়ে গেলেও আমাকে সে লক্ষ্য করলো না।
আমি পকেট থেকে একটা পাইপ বের করে মুখে গুঁজে দিয়ে সেই কুটির খানির দিকে এগিয়ে চললাম।
কুটিরের কাছে যেতেই দেখতে পেলাম একজন বুড়ো মত সৈনিক একখানা টেবিলের সামনে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা টেলিফোনের রিসিভার। ঘরে আর কোন লোক দেখতে না পেয়ে আমি সোজা ঢুকে পড়লাম লাঠিখানা ঠক্ ঠক্ করতে করতে।
বৃদ্ধ সৈনিকটি খেঁকিয়ে উঠলো! কে তুমি? কি চাই এখানে?
আমি কোন কথা না বলে একবার আমার ব্যাণ্ডেজের দিকে আর একবার জিহ্বার দিকে আঙুল দিয়ে সংকেতে জানালাম যে আমি কথা বলতে অক্ষম।
টেবিলের উপরে একখানা খাতা আর একটা পেন্সিল ছিল। সেইদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ইশারায় জানলাম যে কথা বলতে না পারলেও লিখতে পারি আমি।
বৃদ্ধ তখন আমাকে বসতে বললো। আমি বসলে সে নোট বই থেকে কয়েকখানা কাগজ ছিঁড়ে আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো—কি চাই তোমার লিখে জানাও।
আমি লিখলাম হাসপাতাল থেকে বেড়াতে বের হ’য়ে চলতে চলতে পথ ভূল করে এ দিকে এসে পড়েছি। আমার ‘বৌল’ এর তামাক ফুরিয়ে গেছে। এখন তাই এখানে কুটির দেখে এলাম যদি একটু, তামাক পাই।
লোকটা তার থলে থেকে খানিকটা তামাক বের কয়ে দিলো আমাকে। আমি তখন ও থেকে বেশীট। ‘বৌল’ এ রেখে একটু খানি পাইপে সেজে আগুন ধরিয়ে টানতে শুরু করলাম। ভয় হ’তে লাগলো যে আমার পাইপ সাজাবার আর তামাক খাবার নমুনা দেখে ও আমাকে সন্দেহ না করে।
আনি তখন আবার সেই কাগজে লিখলাম—এই বনের মধ্যে কি করেন আপনি?
বৃদ্ধ জানালো যে এক বিশেষ কাজের ভার নিয়ে সে ওখানে আছে। টেলিফোনটি দেখিয়ে সে বললে—যদি বলি এটার অন্য প্রান্ত আছে ব্রিটিশ ফ্রন্ট লাইনের পেছনে কোন ধর্মযাজকের বাড়ীতে, বিশ্বাস হবে সে কথা? ওখান থেকে যে সব দামী খবরগুলো আসে আমরা সেগুলোকে নোট করে ‘হেড-কোয়ার্টার’এ পাঠিয়ে দিই।
আমি আবার লিখলাম–আপনি তো দেখছি একা। কে খবর ধরে আর কে-ই বা নিয়ে যায়? তাছাড়া আপনি বাইরে গেলে যদি কোন খবর আসে, সে খবরই বা কে ধরবে?
বৃদ্ধ জানালো যে সে একা নয়। ওরা ওখানে দু’জন আছে। একজন বাইরে গেলে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আর একজন ঘরে থাকে। এইতো কিছুক্ষণ হলো তার সঙ্গীটি ‘হেড কোয়ার্টার’ এ গেছে, তার ফিরতে এখনও ঘণ্টা দুই দেরী আছে। এর মধ্যে যা কিছু খবর আসবে সে সব সেই নোট করে রাখবে।
মনে মনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। “তা হলে অন্ততঃ দু’ঘণ্টা কেউ আসবে না এখানে!“
মতলব ঠিক করে ফেললাম।
বৃদ্ধকে ধন্যবাদ লিখে বিদায় নিয়ে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
কিছুদূর গিয়েই পকেট থেকে ‘ক্লোরোফর্ম’ এর শিশিটা বের করে রুমালে ঢেলে রুমালখানা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার আমি ফিরে গেলাম সেই ঘরে।
আমাকে আবার ফিরে আসতে দেখে বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো— কি ব্যাপার? আবার ফিরে এলে যে
আমি লিখে জানালাম যে অন্ধকারে পথ চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি যদি দয়া করে আমাকে হাসপাতাল যাবার পথটা দেখিয়ে দেন তাহলে বড়ই উপকার হয়।
“এসো আমার সঙ্গে” বলে লোকটা আমার দিকে পেছন ফিরে দরজার দিকে যেতেই আমি আমার হাতের লাঠিখানা বাগিয়ে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করলাম। লাঠিটা বেশ শক্ত ছিল। এক আঘাতেই ও পড়ে গেল। লোকটা পড়ে যেতেই আমি পকেট থেকে ‘ক্লোরোফর্মে ভেজানো রুমালখানা বের করে ওর নাকের উপরে চেপে ধরলাম। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো লোকটা
আমি তখন ওর দেহটাকে টানতে টানতে কোন রকমে চৌকির উপরে তুলে ওর মুখ হাত পা কসে বেঁধে ফেললাম বিছানার চাদর দিয়ে।
এতসব কাণ্ড কারখানা করতে আমার কিন্তু দশ মিনিটের বেশী সময় লাগলো না।
বাঁধা-ছাঁদা শেষ করে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের পাশে টেলিফোনটা যেখানে ছিল, তার কাছে বসে পড়লাম। রিসিভারটা তুলে কানে দিয়ে ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা জানতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন সাড়াই পেলাম না আমি।
বাধ্য হয়েই আমাকে তখন অপেক্ষা করতে হলো ওদিক থেকে কোন খবর আসে কিনা তার আশায়। আধঘণ্টা—পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ক্রমে এক ঘণ্টাও কেটে গেল। আমি অধীর হয়ে উঠলাম। ভয়ও হ’তে লাগলো। ঘরের অন্য লোকটি এসে পড়লেই তো গেছি!
এমন সময় হঠাৎ ঝন ঝন করে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে কানে দিয়ে বললাম——’ওয়েল’! কি খবর আপনার?
সন্দেহশঙ্কিত কণ্ঠে ওদিক থেকে উত্তর এলো—আপনি কে? আপনাকে যেন নূতন লোক বলে মনে হচ্ছে?
আমি বললাম-আপনি ঠিকই ধরেছেন। কিছুক্ষণ আগে বোমা ফেলে আমাদের পুরানো ঘাটিটাকে উড়িয়ে দিয়েছে ওরা। এখানকার দু’জন লোকের ভিতর একজন মারা গেছে আর একজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা লাইনটিকে অন্য এক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে সাময়িকভাবে সেখান থেকেই কথা বলছি। আমি একজন অফিসার। আপনি আগে আমার কথাগুলো নোট করে নিন।
উত্তর এলো—বলুন, আমি নোট করে নিচ্ছি।
আমি বললাম—ইংরেজেরা ওদিকের লাইনের খোঁজ পেয়ে গেছে। আপনি এখনই ওখান থেকে লাইন কেটে অন্য কোন সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন। তা না হলে আপনাদের ধরা পড়বার বিশেষ সম্ভাবনা।
উত্তর পেলাম—কি সর্বনাশ। এখন তাহলে কি করা যায়?
আমি বললাম—”লাইনটা কোথায় নিলে সুবিধা হয় বলুন তো? ভাল কথা আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমরা তাহলে ‘প্যারাট্রপ’ এর সাহায্যও পাঠাতে পারি। আপনার কাছে ‘ম্যাপ’ আছো তো?—বেশ, ঐ ম্যাপ দেখে আপনি কোন নির্জন জায়গার নাম বলুন যেখানে আমাদের ‘প্যারাট্রপ’ এর লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারে। মনে রাখবেন, আজ থেকে চারদিন পরে ভোর চারটেয়!”
ওদিক থেকে আমাকে একটা জায়গার নাম বললো। নামটা সযত্নে নোট বইতে লিখে নিয়ে আমি বললাম—”আর বেশীক্ষণ আপনাকে ধরে রেখে আপনার বিপদ বাড়াতে ইচ্ছা করি না, “গুড্ বাই।”
রিসিভারটি রেখে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখি যে, লোকটার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে বাঁধন খুলে ফেলতে।
আমি তখন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললাম—”বিদায় বন্ধু! আপনার তামাকের জন্য অশেষ ধন্যবাদ!”
কাকার বাড়ীতে যখন ফিরলাম রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলাম বলে কেউ আমাকে দেখতে পায়নি। আমি তাড়াতাড়ি মুখের ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলে, তুলো ব্যাণ্ডেজ রুমান্স সব কিছু দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে ফেলে হাত মুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে আসতেই সাইলেন্ট উইলি জিজ্ঞাসা করলো— কোথায় ছিলেন আপনি এতক্ষণ?
আমি বললাম—কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এলাম। বহুদিন পরে এসেছি কিনা…..
আমার কথায় বাধা দিয়ে ও বললো—সর্বনাশ করেছেন! এই পোষাক পরে আপনি গিয়েছিলেন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে! মজালেন দেখছি।
আমি বললাম—তাইতো, এটা আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।
এই সময় কাকা এসে বললেন—খাবার তৈরী, তোমরা এসো।
খাবার দাবারের ব্যবস্থাটা বেশ ভাল রকমেই করেছিলেন কাকা। রসনা তৃপ্তিকর রকমারি খাদ্য টেবিলে সাজানো দেখে আমার ড্রাইভার বন্ধুটির মেঘলা মুখ অচিরেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে কাকার কাছে বিদায় নিয়ে আবার গাড়ীতে চেপে বসলাম আমরা। কাকা কয়েক বোতল জ্যাম, জেলী আর সসেজ উপহার দিলেন সাইলেন্ট উইলিকে। রাস্তায় আর কোন বিপদ ঘটলো না আমাদের। ভোর হবার আগেই আমি কাফের দরজায় এসে গাড়ী থেকে নামলাম।
বলা বাহুল্য পর দিনই আমি ‘টেলিফোন লাইন’ এর খবরটা তেষট্টি নম্বরের হাতে পৌঁছে দিলাম।
এর পরের কয়েকটা দিন আমার খুবই চিন্তায় কাটলো। কাকার কোন বিপদাপদ হলো কিনা তার কোন খবর পেলাম না। সপ্তাহের শেষদিকে একদিন সকালে হাসপাতালে যাওয়া মাত্ৰ একজন ড্রেসার আমাকে বললো—ওবার্তাজ আপনাকে ডেকেছেন ফ্রাউলিন!
ভয়ে পা কেঁপে উঠলো আমার। “ওবার্তাজ ডেকেছেন!” নিশ্চয়ই আমার লীলাখেলা সব ফাঁস হয়ে গেছে!
ভয়ে ভয়ে ওবার্তাজ-এর ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। আমি দেখতে পেলাম যে, টাউন কমাণ্ড্যন্ট স্বয়ং বসে আছেন ওবার্তাজের পাশের চেয়ারে। খুনী আসামী যেমন ফাঁসের হুকুম শুনতে বিচারকের সামনে দাঁড়ায়, আমিও সেইরকম ভাবে দাঁড়ালাম ওঁদের সামনে।
হঠাৎ ওবার্তাজ দাঁড়িয়ে উঠে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি ফ্রাউলিন! টাউন কমাণ্ড্যান্টও এসেছেন তোমাকে অভিনন্দন জানাতে।
আমি ভাবলাম “এ আবার কোন তামাসা।”
ওবার্তাজ বললেন— মহামহিমান্বিত সম্রাট তোমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে জার্মাণ মেডিক্যাল সার্ভিস-এর সর্বোচ্চ সম্মান-পদক “জার্মাণ আইরণ ক্রশ” দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করেছেন।
অভিভূত হয়ে পড়লাম আমি এই সংবাদ শুনে। হিষ্টিরিয়া রুগীর মত অকারণে হি হি করে হেসে উঠে ধপাস্ করে বসে পড়লাম আমি একখানা চেয়ারের উপরে।
ঐ একই দিনে বাড়ীতে ফিরে এসে ‘ক্যান্টিন মা’র হাত দিয়ে অন্য তরফ থেকেও চিরকুট পেলাম—
“বহুমূল্য সংবাদের জন্য ধন্যবাদ।”