দুই
রুলারসএ এসে আমরা যখন পৌঁছলাম, বেলা তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। অভিভাবকহীনা একদল মেয়েকে গ্র্যাণ্ড প্লেসের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বেলজিয়ান মহিলা আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন– তোমরা বুঝি রিফ্যুজী?
আমি বললাম—হ্যাঁ, এইমাত্র আমরা ‘ওয়েষ্টরুজবেক’ থেকে এসে পৌঁছেছি। সেই মহিলাটি আবার বললেন—তাহলে তো তোমাদের থাকবার জায়গা ঠিক নেই, তাই না?
আমি বললাম—আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমাদের কোনই আশ্রয় নেই।
মহিলাটি বললেন— আমার বাড়ীতে তোমাদের দু’জনের মত থাকবার জায়গা দিতে পারি। আর যদি দরকার মনে কর তাহলে অন্যদেরও আমার বন্ধুবান্ধবের বাড়ীতে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আমরা আশ্রয় লাভ করলাম সেই দয়াশীল। মহিলাটির সাহায্যে। মা আর আমি তাঁর বাড়ীতেই আশ্রয় নিলাম, আর অন্য মেয়েদেরও তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই।
আমাদের জন্য একখানা বড় শোবার ঘর ছেড়ে দিলেন তিনি। বাবার খোঁজও এনে দিলেন সে মহিলা। ওয়েষ্টরুজবেকে থাকতেই আমরা শুনেছিলাম যে বাবা রুলারসএ আছেন। তিন চার দিন পরেই বাবা এসে দেখা করলেন আমাদের সঙ্গে। ওঁর শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে দেখলাম। বাবা জানালেন যে সামান্য একটা নিয়মভঙ্গ করবার অপরাধে অনেকদিন জেল খাটতে হয়েছিল তাঁকে। জেল থেকে খালাস পেয়ে এখন তিনি একটা ফার্মে চাকরি করছেন—ওঁর থাকবার জায়গাও দিয়াছে সেই ফার্মের মালিকই। বহুদিন পরে আবার বাবাকে পেয়ে কি যে আনন্দ হলো সে কথা আর কি লিখবো!
রুলারসএ এসে আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওয়েষ্টরুজবেক থেকে মাত্র ছ’মাইলের ব্যবধান। কিন্তু দূরত্ব ছাড়া আর সব দিকের ব্যবধান যেন আকাশ আর পাতাল– না, আকাশ আর পাতাল বললেও ঠিক বলা হলো না—যেন স্বর্গ আর নরক!
ওয়েষ্টরুজবেক ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত আর রক্তস্নাত। দিনরাত মিলিটারীর আনাগোনা, গোলা, গুলী আর শেল ফাটবার শব্দ আর রুলারস্! তুলনাই হয় না ওয়েষ্টরুজবেকএর সঙ্গে। সবাই এখানে চলাফেরা করছে নিশ্চিন্তে। সবাই কাজকর্ম করছে।
ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করেছে। কান্না আর দুঃখের রাজ্য থেকে আমরা যেন হাসি আর সুখের স্বর্গরাজ্যে এসে গেছি!
কয়েকটা দিন নিশ্চিন্ত বিশ্রামে কাটিয়ে দেবার পর আমার মনে হলো যে এভাবে শুয়ে বসে কাটালে তো চলবে না আমাদের! আমাকে কাজ করতে হবে। বেঁচে থাকবার জন্য রোজগার করতে হবে।
আসবার সময় ওয়েষ্টরুজবেকএর কমাণ্ডান্ট আর ওখানকার হাসপাতালের সার্জেন আমাকে সার্টিফিকেট আর চিঠি দিয়েছিলেন।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম যে, সার্জেনের সেই চিঠি নিয়ে রুলারস্ হাসপাতালের ওবার্তাজএর সঙ্গে দেখা করবো।
সেদিন সকাল সকাল দুটি খেয়ে নিয়ে কমাণ্ডান্টের দেওয়া পরিচয় পত্র আর সার্জেনের চিঠি নিয়ে আমি রুলারস মিলিটারী হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। ওবার্তাজএর সঙ্গে দেখা করবো বলতেই একজন আর্দালী আমাকে সঙ্গে করে একখানা কামরার সামনে নিয়ে এসে বলল—ভেতরে যান!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম একখানা ডেস্কের পেছনে একজন সৌম্য চেহারার জার্মাণ ভদ্রলোক বসে আছেন। ভদ্রলোকের বয়স যৌবনের সীমা পার হয়ে গিয়েছিল। বুঝলাম ইনিই ওবার্তাজ।
সুপ্রভাত জানিয়ে সার্জেনের চিঠি আর কমাণ্ডান্টের পরিচয়
পত্র দুখানা ওঁর হাতে নিলাম। চিঠি দুখানা পড়ে দেখে ওবার্তাজ বললেন—ভালই হয়েছে! আমি এখানে নার্সের অভাবে খুবই অসুবিধা বোধ করছিলাম। এখানে এখন একজন নার্সও নেই। তুমিই হবে এই হাসপাতালের প্রথম নার্স।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওবার্তাজ বললেন—দাঁড়িয়ে কেন মা! ঐ চেয়ারথানায় বসো। একটু দরকারী কাজ আছে, সেটা সেরে নিয়েই আমি তোমাকে হাসপাতালটি দেখিয়ে আনছি। অন্যান্য ডাক্তারদের সঙ্গেও তোমার পরিচয় করে দিতে হবে তো?
হাসপাতালটি ঘুরে দেখে খুবই খুশী হলাম। এখানকার সবচেয়ে যা ভাল লাগলো আমার, সে হচ্ছে হাসপাতালের “সিভিলিয়ান ক্লিনিক”। এই “ক্লিনিক” থেকে রুলারস্ এর গরীব মানুষরা সত্যিকারের সুচিকিৎসা লাভ করতো।
কথা হলো সোমবার সকাল সাতটা থেকে আমি কাজে “জয়েন” করবো। “টাউন-কমাণ্ডাণ্ট’কে অনুরোধ করে ওবার্তাজ
চিঠি লিখে দিলেন, আমাকে “রাত্রির পাশ” দিতে। কারণ কোন “এমার্জেন্সী কেস” এলে রাত্রিতেও আমাকে আসতে হ’তে পারে।
রুলারসএ তখন সন্ধ্যা সাতটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত “কারফিউ” চলছিলো।
যতই দিন যেতে লাগলো ততই বুঝতে লাগলাম যে প্রথম দৃষ্টিতে বাইরে থেকে রুলারসের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যতটা সহজ মনে হয়েছিল আসলে মোটেই তা নয়। এখানকার অসামরিক মানুষরা সব সময় সন্ত্রস্ত হ’য়ে থাকতো,—বার্লিন ভ্যাম্পায়ারদের ভয়ে। “স্পাই ফোবিয়া” এখানেও পেয়ে বসেছিল জার্মাণদের। প্রত্যেক বেলজিয়ানকেই ওরা সন্দেহ করতো স্পাই বলে।
অনেক রিফ্যুজী মেয়ে এখানে বালির বস্তা (Sand Bag ) তৈরী করে বেশ দু’পয়সা রোজগার করতো। স্মৃতি, পশম, রেশম, সব রকম কাপড় দিয়েই তৈরি করা হ’তো এই স্যাণ্ডব্যাগগুলো। সিল্ক চুরি করে জেলও খাটতো অনেক মেয়ে। যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ও কয়েকটি মেয়ে জেল খাট্ছিলো সিল্কের কাপড় চুরি করে। ওদের নাকি কিছু সিল্কের কাপড় দেওয়া হয়েছিলো ব্যাগ তৈরি করতে, কিন্তু মেয়েদের স্বভাবসুলভ পরিচ্ছদপ্রীতির জন্য ও থেকে কিছু কাপড় সরিয়ে ফেলতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় ওরা।
স্থানীয় উৎপন্ন দ্রব্যের প্রায় সবটাই দিতে হ’তো মিলিটারী কর্তৃপক্ষকে। যেটুকু অবশিষ্ট থাকতো তাই নিয়ে চলতো কাড়াকাড়ি মারামারি জনসাধারণের মধ্যে। সেই নিদারুণ অভাবের সময় “মার্কিন রিলিফ মিশন” কিন্তু খুবই সাহায্য করতে।। এই রিলিফ মিশনটি পরিচালনা করতেন মিঃ “হুভার”। সত্যি কথা বলতে কি, আমেরিকার সাহায্য না পেলে আমাদের অবস্থা যে -কি হ’তো তা বলা কঠিন। হয়তো দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে। মার্কিণ পতাকা উড়িয়ে যে জাহাজ আসতো রিলিফের পণ্যসম্ভার নিয়ে, সেই জাহাজগুলোকে জার্মাণরা বাধা দিতো না।
মার্কিণ ‘বেকন’কে লোকে নাম দিয়েছিলো ‘উইলসন’ আর চাল, চিনি ও বজরা মেশানো যে পদার্থটি আসতো- মার্কিণরা যাকে বলতো ‘ক্রিয়েলিং’—ওখানকার মানুষরা তাকে বলতো ‘হুভারি খিঁচুড়ি’। (কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে সুরাবর্দি-মণ্ডের কথা মনে পড়ে—অনুবাদক)
নামকরণ যাই হোক, আমরা কিন্তু তাকিয়ে থাকতাম ঐ ‘উইলসন’ আর ‘হুভারি-খিচুড়ি’র পথের দিকে।
কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন আমি ‘নাইট ডিউটি সেরে সবে বাড়ী ফিরেছি। সময় তখন বোধ হয় সকাল সাতটা। রান্নাঘরে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছি—হঠাৎ কে যেন দরজায় টোকা মারলো।
দরজা খুলতেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম— দেখি লাসেল দাঁড়িয়ে।
বহুদিন পরে লাসেলকে আবার দেখতে পেয়ে বললাম – কি ব্যাপার লাসেল- …
“হিস্–স্–” শব্দ করে ঠোঁটের উপরে তর্জনিটা চেপে ধরে কথা বলতে নিষেধ করলো লাসেল। নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার পাশে বসে ফিসফিস্ করে বললো সে—আমি এসেছিলাম একথা কেউ যেন না জানতে পারে! অনেক চেষ্টায় তোমাদের খোঁজ পেয়েছি! তুমি আর তোমার মা ছাড়া এঘরে আর কেউ নেই, জানালা দিয়ে দেখেই সাহস করে ঢুকেছি আমি।
লাসেলের কথা বলবার ধরণ-ধারণ দেখে কেমন যেন সন্দেহ- জনক মনে হলো। মা এই সময় একটা গ্লাসে খানিকটা ব্রাণ্ডি ঢেলে এনে লাসেলকে দিয়ে বললেন – আমরা কিন্তু ভেবেছিলাম যে তুমি আর বেঁচে নেই! কোথায় ছিলে তুমি এতদিন?
লাসেল বললো সে অনেক কথা। যাক্ সে কথা, শোনো! যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তোমাদের জন্য কিছু খবর এনেছি–মানে তোমার ভাইদের খবর! শেষের কথা ক’টি আমার দিকে তাকিয়ে বললো লাসেল।
মা বললেন—ওরা বেঁচে আছে তো? ভাল আছে ওরা?
লাসেল—হ্যাঁ ভালই আছে—এই নিন তাদের চিঠি।
তিনখানি চিঠি বের করে মা’র হাতে দিল সে।
চিঠি ক’খানা দিয়ে লাসেল আবার বললে—কিন্তু আমি সেই চিঠি ক’খানা দিতে তোমাদের কাছে আসিনি! হল্যাণ্ড সীমান্ত থেকে চল্লিশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে হাজার বিপদ মাথায় নিয়ে আমি এসেছি। এখনও আমাকে দশ মাইল পথ যেতে হবে। ওরা যদি ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারে যে, আমি এসেছিলাম তাহলে বুঝছো…
এই বলেই হঠাৎ চুপ করে যায় সে।
একটু চুপ করে থেকে আবার বলে সে, আমার আর দেরী করবার উপায় নেই। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুশী হলাম।
যাবার জন্য উঠে দাড়ালো সে। দরজার দিকে দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বললো কিন্তু মনে থাকে যেন, আমি এখানে এসেছিলাম একথা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পায়।
আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্য্যন্ত এসেছিলাম। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে লাসেল বললো মার্থা! তুমি যুবতী, শক্তি আছে তোমার দেহে, তুমি কি তোমার দেশের জন্য কিছুই করতে চাও না?
লাসেলের মুখে এই কথা শুনেই আমি বুঝতে পারলাম কি বলতে চায় সে। ‘স্পাই’ এই কথাটা মনে হ’তেই ভয়ে পা দুখানি যেন কেঁপে উঠলো বলে মনে হলো আমার। বেলজিয়ামে ‘স্পাই’ আছে জানতাম; দেশের জন্য তারা কাজ করে তাও জানতাম… কিন্তু…
কথা বললেন মা। আমাকে একেবারে আশ্চর্য করে দিয়ে মা বললেন–মার্থা যদি ও কাজ করতে চায় তাহলে আমি সগর্বে সম্মতি দেবো।
মা! স্বর্গাদপি গরীয়সী মা আমার!—দেশকে কতখানি ভালবাসলে যে কোন মা এই কথা বলতে পারে এই ভেবে গর্বে বুক ভরে উঠলো আমার।
আমি বললাম— আমি রাজি আছি লাসেল!
—ভালো করে ভেবে বলো মার্থা! বিপদ এ কাজে পদে পদে -এমন কি প্রাণের ভয়ও আছে এতে!
—পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছি। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম আমি।
লাসেল বললো—এখনই আমার কোন নির্দেশ নেই তোমাকে জানাবার মত। আমি ‘বৃটিশ ইনটেলিজেন্স কমিশন’ এর একজন ‘মেম্বর’। কর্তৃপক্ষকে তোমার খবর না জানিয়ে কিছুই বলতে পারছি না। আমাদের উপরে যা কিছু নির্দেশ সবই সেখান থেকে আসে। কয়েক দিনের ভিতরেই—যে কোন দিন যে কোন সময়, যে কোন লোকের হাত দিয়ে আমার কাছ থেকে খবর পাবে তুমি। যে অবস্থায় আর যার কাছেই খবর পাও, তাতে মোটেই আশ্চর্য হয়ো না। আচ্ছা আজ তা’হলে আসি—’গুডবাই।’
নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল লাসেল।
ও চলে যেতেই আমার বুকের ভিতরটা যেন অকারণেই দুরু দুরু করে উঠলো। আমার মনে হ’লো যেন জীবনের এক চরম সন্ধিক্ষণে এসে গেছি আমি! বিশ মিনিট আগের আমি আর তখনকার ‘আমি’র মধ্যে যেন ‘আসমান জমিন ফারক্’!
প্রায়ই দেখতে পেতাম, সদাহাস্যময়ী এক বুড়ী আসতো আমাদের পাড়ায়, তার ছোট্ট ঠেলাগাড়ীতে নানারকম ফলমূল আর শাকশব্জী বোঝাই দিয়ে। বুড়ীকে পাড়া র সবাই ভালোবাসতো এমন কি জার্মান সৈন্যরাও বুড়ীকে ভালবাসতো। ওরা আদর করে বুড়ীকে ডাকতো ‘ক্যান্টিন মা’ বলে। ক্রমে সকলেই বুড়ীকে ‘ক্যান্টিন মা’ বলে ডাকতে আরম্ভ করে এবং ঐ নামেই সে সর্বত্র পরিচিত হয়ে উঠে। মিলিটারি ক্যান্টিনে ফলমূল সরবরাহের কন্ট্রাক্ট থাকায় বুড়ীর ছিল সর্বত্র অবাধে যাতায়াতের অধিকার।
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দাড়াতেই দেখতে পেলাম যে আপন মনে গুন্ গুন্ করে গান করতে করতে ‘ক্যান্টিন মা’ আমাদের বাড়ীর দিকেই আসছে। বাড়ীর সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ী তাঁর ঠেলাগাড়ীখানা থামিয়ে বললো—সুপ্রভাত মাদাময়সেল—চমৎকার তাজা বীন আছে, নেবে কিছু? খুব সস্তা! এই বলেই গাড়ী থেকে এক মুঠো বিন্ তুলে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ আমার হাতে একখানা ভাঁজ করা কাগজ গুঁজে দিয়ে ফিস ফিস করে বললো—”শোবার ঘরে গিয়ে পড়ে দেখো” কেমন। সিমগুলো চমৎকার নয়?
——’শব্জী চাই গো—তাজা শব্জী’ হাঁকতে হাঁকতে ক্যান্টিন মা চলে গেল। আমার হাতের মধ্যে তখনও সেই ভাঁজ করা সাংঘাতিক কাগজখানা। হাত কেঁপে উঠলো আমার। এই আমার ‘স্পাই’ জীবনের প্রথম নির্দেশ। তাড়াতাড়ি শোবার ঘরে গিয়ে দরজা জানালা ভাল করে বন্ধ করে কাগজখানা খুলে পড়লাম আমি—
“জুভেজল যাবার রাস্তার ডানদিকে দুই নম্বর গোলাবাড়ীতে আজ রাত ন’টায় লিসেটির সঙ্গে দেখা করবে।”
কাগজখানায় কারো সই নেই। বার্লিন ভ্যাম্পায়ারদের ফাঁদ হতেও পারে তো! যাই হোক্ আমি কিন্তু যাওয়াই ঠিক করলাম।
রাত প্রায় আটটার সময় বাড়ী থেকে বের হলাম আমি। ভয়ে পা কাঁপছে। যদি ধরা পড়ি কি বলবো তাহলে? মনে মনে ঠিক করলাম, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবো যে আমার এক পরিচিতা মহিলার খুব বেশী অসুখ, তাঁকে দেখতে যাচ্ছি। আমার কাছে রাত্রির পাশ ছিল। টাউন কমাণ্ডাণ্টের সই করা পাশ দেখলে নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলবে না।
জার্মাণ সৈন্যরা লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে বড় রাস্তা ছেড়ে মেঠো পথ ধরে চলতে শুরু করলাম আমি। মেঠো পথ পার হতেই জুভেজল্ যাবার রাস্তায় এসে পড়লাম। সামনেই দেখা যাচ্ছে দুই নম্বর গোলাবাড়ীটা। আবার একবার বুকটা কেঁপে উঠলো আমার। সদর দরজা ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়ীর পেছনের দরজায় গিয়ে ভয়ে ভয়ে কঁড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো—কাকে চাই?
‘লিসেটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি’ বলতেই দরজটা খুলে গেল। অন্ধকারে কে যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো আমাকে সেই বাড়ীর ভেতরে। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগলো আমার সারা গা-হাত-পা।
লোকটা আমাকে একখানা রুদ্ধদ্বার ঘরের সামনে নিয়ে এসে দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। লাসেলই এসে দরজা খুলে দিল। যে লোকটা আমাকে নিয়ে এসেছিল, লাসেল তাকে বললো—কেউ এলে সংকেত করো, বুঝলে?
লোকটা চলে যেতেই লাসেল আমাকে বললো—তুমি এসেছো দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি মার্থা! আজ থেকে তুমি নিজের ইচ্ছায় তোমার দেশের শত্রুদের যারা শত্রু তাদের স্পাই’ হলে। সময় সময় তোমার উপরে যে নির্দেশ আসবে, তুমি তা পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। রুলারস মিলিটারী হাসপাতালের নার্সের কাজের সুযোগে তুমি বহু জার্মাণ সৈনিক আর অফিসারের সংস্পর্শে আসবে। সৈন্যদলের গতি বিধি আর্টিলারীর নিশানা, সরবরাহ কেন্দ্রের ঠিকানা এবং আরও যে সব খবর তুমি জানতে পারবে—তা সে যত নগণ্য সংবাদই হোক না কেন, সব জেনে নিয়ে ভাল করে মনে রাখবে! মনে রেখো তোমার আমার কাছে যে সংবাদ নগণ্য তারও অসামান্য মূল্য থাকতে পারে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—কিন্তু কি ভাবে খবর পাঠাবো আমি?
লাসেল বললো—আর একটু ধৈর্য ধরো মার্থা, সবই জানতে পারবে। ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স দপ্তরে তোমার নাম হয়েছে ‘লুরা’ তোমার প্রেরিত প্রত্যেকটা খবরের শেষে তাই “এল” এই অক্ষরটি সই করবে। আরও শোনো! তোমাকে যে ‘সিক্রেট কোড’ দিচ্ছি—সুযোগ মত পড়ে ওটা কণ্ঠস্থ করে ফেলে কাগজখানা পুড়িয়ে তার ছাইটা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলবে। এমন ভাবে এই ‘কোডট’। মুখস্থ করবে, যাতে কোন রকমেই ভুল না হয়।
কাগজখানা লাসেলের হাত থেকে নিয়ে আমি মোজার ভেতরে রাখতে যাচ্ছি দেখে লাসেল বাধা দিয়ে বলে উঠলো—না না ওখানে নয়! কেউ তোমাকে সন্দেহ করে তল্লাসী করলে সব চেয়ে আগে দেখবে তোমার মোজা। ওটাকে তুমি তোমার চুলের মধ্যে লুকিয়ে রাখো।
চুলের মধ্যে কাগজখানাকে ভাল করে গুজে দিতেই লাসেল বললো—হ্যাঁ এইবার ঠিক হয়েছে। একটু চুপ করে থেকে সে আবার বললো—তোমার যা কিছু নির্দ্দেশ সবই তুমি ক্যান্টিন মার হাত দিয়ে পাবে। যদি দেবার মত কোন সংবাদ থাকে তাহলে যে ‘কোড’ তোমাকে দিলাম, ঐ কোডে লিখে সই করে ‘গ্রাণ্ড প্লেস’ এর কাছাকাছি ‘রাউভিলা প্লেস’ এর ডানদিকে দু’নম্বর বাড়ীর পঞ্চম জানালার সামনে গিয়ে প্রথমে তিনবার টোকা দিয়ে একটু থেমে আবার টোকা দেবে দু’বার। ওখানে আমাদের এজেন্ট “তেষট্টি নম্বর” তোমার হাত থেকে খবর নেবে। তারপর সেই খবর ভলান্টিয়ার রানাররা কয়েক হাত বদলে হল্যাণ্ড সীমান্তে পৌঁছে দেবে—বুঝেছো?
আমি বললাম হ্যাঁ।
–আর একটা কথা সব সময় মনে রেখো! যে খবর পাবে বা দেবে তা পড়বার বা পাঠিয়ে দেবার পরেই নষ্ট করে ফেলবে। কোনও চিহ্নই আর যেন না থাকে তার।
বললাম—তাই হবে।
হঠাৎ লাসেল তার কোটের কলারের ভাঁজটা উল্টিয়ে ধরলো। দেখতে পেলাম কলারের নীচে দুটি সেফটিপিন কোণা- কোণী ভাবে গুণচিহ্নের মত করে গাঁথা রয়েছে। লাসেল বললো— এই হচ্ছে আমাদের নিদর্শন। কিন্তু সাবধান! গুণচিহ্নের মত না দেখলেই বুঝবে গলদ আছে। —— হ্যাঁ, আরও একটা কথা! কয়েকদিনের মধ্যেই একজন লোক আসবে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। যদি সে আমাদের নিদর্শন দেখায় তাহলে যথাসাধ্য সাহায্য করে। তাকে। এই লোকটি কোন বিশেষ কাজের ভার নিয়ে আসছে। খুব কম সময়ই সে রুলারস্-এ থাকবে। যদি পারো তার থাকবার একটা ব্যবস্থাও করে দিও।
একটু চুপ করে থেকে লাসেল আবার বললো—দুর্ভাগ্যের বিষয়, জার্মাণ গোয়েন্দারা আমার আসবার কথা জানতে পেরেছে। তাই আজ রাত্রেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। যাবার আগে একটা ছোট্ট উপদেশ দিয়ে যাই তোমাকে মনে রেখো। যদি কখনও ধরা পড়ো তাহলে জানবে তোমার নিজের দোষেই পড়েছো। প্রতি কাজে প্রতি কথায়, প্রতিটি চালচলনে সব সময় সবাইকে বুঝতে দিও যে স্পাইদের তুমি ভীষণ ঘৃণা করো। এর মত নোংরা এবং ঘৃণ্য কাজ আর কিছুই নেই দুনিয়ায়। তোমার পাশেই হয়তো আরও কোন স্পাই থাকতে পারে কিন্তু তাদের কাজের খবর নিতে কখনও চেষ্টা করবে না। বার্লিন ভ্যাম্পায়াররা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, এই কথাটা সর্বদা মনে রেখো। আমি তা’হলে এখন চললাম, ভগবান তোমার সহায় হোন্ গুডবাই!
.
দিনকয়েক পরের কথা।
হাসপাতাল থেকে ফিরছি, হঠাৎ একজন অচেনা লোক রাস্তায় আমাকে বললো—গুড় ডে মাদামসিয়েল—আপনারই নাম কি মার্থা নোকার্ট?
আমি বললাম—হ্যাঁ, কি দরকার বলুন?
লোকটি . বললো—দু’একদিন থাকবার ব্যবস্থা হতে পারে এখানে? লাসেলের কথাগুলো মনে পড়ে গেল আমার। বললাম—আসুন আমার সঙ্গে, দেখি কতদূর কি করতে পারি।
লোকটা আমার সঙ্গে বাড়ীর ভিতরে ঢুকেই তাঁর কোটের কলারটা উল্টিয়ে ধরলো আমার সামনে-
সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম—দুটি চক্চকে সেফটিপিন গুণচিহ্নের মত গাঁথা আছে সেখানে।
সিঁড়ির উপরের চিলে কোঠায় ওর থাকবার কথা বলায় বাড়ীর কর্ত্রী যখন মৃদু আপত্তি তুললেন যে, ‘ওঘরে মানুষ বাস করতে পারে না, ও তখন তাঁর সেই আপত্তি কানেই তুললো না। ও বললো কি যে বলছেন ম্যাডাম ঘর পাচ্ছি, এই তো যথেষ্ট; ওসব আপনার ভাবতে হবে না। সিঁড়ির উপরের ঘর তো দূরের কথা, এমন কি সিঁড়ি হলেও আমার আপত্তি ছিল না। তাছাড়া ক’দিনই বা আর থাকবো!
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ও দিব্বি জমিয়ে তুললো বাড়ীর অন্যান্য ভাড়াটেদের সঙ্গে। দোতালায় যে দু’জন অফিসার থাকতো তাদের পর্য্যন্ত জমিয়ে ফেললো ও। অনেকগুলো ভাষায় অনর্গল কথা বলতো ও—জার্মাণ, ফ্রেঞ্চ এমন কি স্পেনিশ ভাষাতেও তার দখল দেখে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি।
একদিন সেই প্রথম দেখা হবার পর ও আর আমার সঙ্গে বিশেষ কথা বললে না। ক’দিনের মধ্যেই দেখতে পেলাম যে, ও সেই জার্মাণ অফিসার দু’জনের একেবারে প্রাণের বন্ধু হয়ে পড়েছে। এমন কি রোজই সে ওদের সঙ্গে বাইরে যেতো, আর ফিরে আসতো অনেক রাত্রে মাতাল হয়ে।
দিন সাতেক পরে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ীতে আমাকে একলা দেখতে পেয়ে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো— বাইরে বড্ড ঠাণ্ডা আজ! তাই নয়?
এই বলেই চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে লোকটা তার সিগারেট কেশ খুলে একখানা ভাঁজ করা ছোট্ট কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো—পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা ক’রবেন।
আমি বললাম—আজ রাত্রেই যাবে।
ওখানে তখন কোন লোক ছিল না দেখে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম—এখানে কি করছেন আপনি?
একটু হেসে ও বললো—”সিক্রেট সার্ভিস”।
লাসেলের উপদেশ মনে পড়লো—’অন্যের কাজ সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নেবার চেষ্টা করো না।’
আমিও তাই আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না, বা সে-ও আর কোন কথা বললো না।
এই সময় জার্মাণ অফিসার দু’জনকে আসতে দেখে ও তাড়াতাড়ি আমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
সন্ধ্যা থেকেই আমার বুকটা টিপ টিপ করছিলো। আজই আমি প্রথম সংবাদ পাঠাতে যাচ্ছি! যদিও নিজের জোগাড় করা সংবাদ নয় তবুও আমার হাত দিয়ে এই প্রথম খবর যাচ্ছে। রাত আটটার সময় বাড়ী থেকে বের হলাম আমি। লাসেলের কথামত কাগজখানাকে ভাঁজ করে চুলের মধ্যে গুঁজে নিলাম বের হবার আগেই!
নির্দিষ্ট বাড়ীখানার সামনে এসে লাসেলের নির্দেশমত পঞ্চম জানালাটার ধারে এসে দাঁড়ালাম। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে প্রথমে তিনটি টোকা ও পরে দুটি টোকা দিতেই জানালাটা নিঃশব্দে খুলে গেল, এবং ততোধিক নিঃশব্দে বের হয়ে এলো একখানি হাত। বুঝলাম এই আমাদের “তেষট্টি নম্বর।” কাগজখানা হাতে দিতেই নিঃশব্দে হাতখানা ঘরের মধ্যে চলে গেল আর জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
কে এই তেষট্টি নম্বর! মেয়ে না পুরুষ?