এগার
কয়েকদিন পরে। বেলা ঠিক দশটার সময় ‘সেল’এর দরজার বাইরে অনেক লোকের বুটের আওয়াজ শুনতে পেয়ে বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো আমার।
‘সেল’এর দরজা খোলা হলো।
একজন ‘আণ্ডার-অফিসার’ আমার সামনে এসে হুকুমের সুরে বললো—’কোর্ট মার্শাল’এর সামনে যাবার জন্য প্রস্তুত হও!
“মৃত্যু!”
এইবার তাহলে আসছে আমার মৃত্যু!
‘রাইফেল’এর কঠিন গুলী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
যন্ত্রচালিতের মতই উঠে দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে চললাম আমি।
কোর্ট মার্শাল। মিলিটারী ধর্মাধিকরণ।
একখানা লম্বা টেবিলের ওধারে বসে আছেন জমকালো মিলিটারী পোষাক পরা নয়জন বিচারক। মাঝখানে প্রেসিডেন্ট আর ‘প্রেসিডেন্ট’এর দুই পাশে চারজন করে অফিসার।
—হায়রে! একজন অসহায়া নারীকে হত্যা করতে কতই না আয়োজন!
প্রসিকিউটার উঠে দাঁড়িয়ে একবার আমাকে দেখে নিয়েই তার বক্তৃতা শুরু করলো।
“এই আসামী মার্থা নোকার্ট – বেলজিয়ামের প্রজা। কিন্তু বেলজিয়াম এখন ‘জার্মাণ ইম্পিরিয়েল গভর্ণমেন্ট’এর অধীনস্থ হওয়ার ‘জার্মাণ মিলিটারী কোড’এর ধারা অনুযায়ী এ এখন আদালতে বিচারযোগ্য।
“এর অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর। দেশদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধিনী এ। আর এই অপরাধের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু।”
“আমি আজ বহুবিধ সাক্ষ্য প্রমাণ সহযোগে প্রমাণ করে দিচ্ছি যে এই নারী হাসপাতালের ‘নার্স’এর পবিত্র কর্তব্যে রত থাকা অবস্থায় এমন সব সাংঘাতিক কাজ করেছে, যার ফলে আমাদের বহু মূল্যবান জীবন এবং সামরিক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নষ্ট হয়েছে।”
“এরই চেষ্টায় এর বাবা ‘ক্যারিলন কাফে’ নামে একটা আবাসিক হোটেল কিনে নিয়ে বাইরে থেকে ব্যবসায়ের ঠাট বজায় রেখে এর কাজের সুবিধে করে দিয়েছিল। হাসপাতালের নার্স -এর চাকরি জোগাড় করে নেওয়াটাও এরই ফন্দি।”
“আমরা এমন সব গুরুতর সংবাদ রেডিওতে ধরেছি যে খবরগুলো পার্শ্ববর্তী নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হল্যাণ্ড থেকে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে ব্রডকাষ্ট করা হ’তো। এইসব খবরগুলোর ভেতরে এমন অনেক খবর আমরা ধরেছি, যেগুলো ‘এল’ ছদ্মনামে পাঠ হ’তো। এই ‘এল’ যে কে প্রথমে আমরা তা বুঝতে পারি নাই। আমরা মনে করেছিলাম যে এই ‘এল’ বোধ হয় লাসেল। কিন্তু পরে আমরা জানতে পারি যে এই আসামীই হচ্ছে সেই ‘এল’, কারণ ঐ ‘এল’ স্বাক্ষর করা একটা মারাত্মক সংবাদ পাওয়া যায় এই আসামীর শয়নকক্ষ তল্লাসী করে। “এই দেখুন ‘এল’ সেই সইকরা খবরটা!”
এই বলে প্রসিকিউটার আমার শয়নকক্ষে পাওয়া সেই কাগজখানা প্রেসিডেন্ট-এর হাতে দিল।
একটু পরে সে আবার বললো –”এ থেকেই নিঃসন্দেহে প্রমাণ হচ্ছে যে এই আসামী মার্থা নোকার্টই হচ্ছে সেই ‘এল’।”
প্রেসিডেন্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—”এ বিষয়ে তোমার কিছু বলবার আছে?
বলবার কিছুই ছিল না, তাই আমি চুপ করে রইলাম।
প্রসিকিউটার বললো—এ প্রশ্নের উত্তর ও দেবে না, কারণ দেবার মত কোন উত্তর ওর নেই। এই বলে একটু দম নিয়ে সে আবার বললো—এইবার কোর্ট যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি সাক্ষীদের হাজির করতে পারি।”
কোর্ট সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিল।
প্রসিকিউটার তখন ইঙ্গিত করতেই যে অফিসারটি আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল সে উঠে এসে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাড়ালো।
কোর্টের প্রশ্নের উত্তরে সে বললো— আমি রুলার্স এরিয়ার ‘ব্রিগেড হেডকোয়াটার’এর অধীনস্থ একজন ‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’। কিছুদিন আগে সন্দেহক্ৰমে একজন রানারকে গ্রেপ্তার করে তার কাছে ‘এল’ স্বাক্ষর করা একখানা সাংকেতিক লিপি পাই।
প্রথমে আমার সন্দেহ হয় যে এই ‘এল’ বোধ হয় লাসেল ডেলডস্ক। লাসেল যে ব্রিটিশ-এর স্পাই এ খবর আমরা জানতাম। এরপর লাসেল সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে ‘ওয়েষ্ট রুজবেক’এ থাকবার সময় এই আসামীর পরিবারের সঙ্গে লাসেলের খুব হৃদ্যতা ছিল।
এর পরেই আমি জানতে পারি যে এই আসামী রুলার্স মিলিটারী হাসপাতালে নার্সের কাজ করছে। হাসপাতালের খবর নিয়ে অবশ্য ওর সম্বন্ধে খুব ভাল রিপোর্টই পেয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারি নাই যে এই আসামীই হচ্ছে ‘এল’।
কিন্তু রুলাস-এর ‘এ্যামুনিশন ডাম্প ধ্বংস হবার পর আবার আমার সন্দেহ হয় এর উপরে। সন্দেহটা হয় একটা ছোট্ট ঘটনা উপলক্ষ করে। ঘটনাটা হচ্ছে এই যে কয়েকটি শিশু ঐ বিস্ফোরণের জায়গাটার কাছে খেলা করতে করতে হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পায়। এই খবর পেয়েই আমরা সেই সুড়ঙ্গ পথটা পরীক্ষা করি। পরীক্ষায় জানতে পারা যায় যে ঐ সুড়ঙ্গ পথের একদিকে একটা ফুকর আছে। সুড়ঙ্গটা পরীক্ষা করে আমরা কাঠের সিঁড়ি, ছেনী, হাতুড়ী, সাবল, একটা পোষাকের বাণ্ডিল এবং আরও কতকগুলো সন্দেহজনক জিনিস পাই।’
যে জিনিসগুলি আমরা পেয়েছিলাম তার প্রত্যেকটি জিনিসই এই আদালতে উপস্থিত করা হয়েছে। ঐ দেখুন সেই জিনিসগুলি।
এই বলে ঘরের এক কোণে রাখা আমাদের ব্যবহার্য সেই জিনিসগুলি দেখিয়ে দিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলো —
আমরা তখন আরও ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখতে পাই যে ঔ সুড়ঙ্গটার আর একটা ফুকরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। গ্যাস আক্রমণের সময় যে ‘টেম্পোরারি সিভিলিয়ান ক্লিনিক’ তৈরি করা হয়েছিল ঐ ফূকরটি ছিল সেই ঘরের মেঝের ঠিক নীচেই।”
“এই ব্যাপারে আমার আর একবার সন্দেহ হয় এই আসামীর উপরে, কিন্তু হাসপাতালে এর সম্বন্ধে খোঁজ নিতে গেলে ওখানকার ওবার্তাজ আমাকে জানান যে এর চরিত্রে সন্দেহ করবার মত কিছু নেই।”
এর দুই দিন পরে আমার এক সহযোগী একটি সোনার ‘রিষ্টওয়াচ’ আমার হাতে দিয়ে বলে যে ঐ ঘড়িটা বিস্ফোরণের জায়গার কাছাকাছি সুড়ঙ্গের মধ্যে পাওয়া গেছে। ঘড়িটা পরীক্ষা করে আমি দেখতে পাই যে ওর পিছনের ‘কেস’এ ‘এম, সি’ এই অক্ষর দুটো ‘এনগ্রেভ’ করা আছে।
“মার্থা নোকার্ট (Martha Cnockart) -এর নামের প্রথম অক্ষর দুটোও এই ‘এম সি’। আমার তখন আমি একবার সন্দেহ হয় এই আসামীর উপরে।”
“আমি তখন ‘টাউন কমাণ্ডান্ট’এর সহযোগিতায় একটা ফাঁদ পাতি। কতগুলো চোরাই জিনিষ পাওয়া গেছে বলে একটি বিজ্ঞাপন লিখে ‘টাউন কমান্ডান্ট’এর অফিসের বাইরে রাস্তার ধারে লটকিয়ে দিই আমরা। ঐ ঘড়িটার বিবরণও লিখে দেওয়া হয় সেই তালিকার মধ্যে।”
“দুদিনের মধ্যেই আমাদের ফাঁদ পাতা সার্থক হয়। এই আসামী বিজ্ঞাপনটা দেখতে পেয়ে নিজে এসে ‘টাউন কমাণ্ডাণ্ট’- এর সামনে সেই ঘড়িটা সনাক্ত করে নিয়ে যায়।”
“এর পরেই আমি এদের বাড়ী তল্লাসি করি। এর শোবার ঘর তল্লাসি করে আমি ‘এল’ সই করা ঐ সাংকেতিক লিপিটা পাই—যেখানা আগেই আপনাদের হাতে দেওয়া হয়েছে। এরপর আমার আর কোন সন্দেহই থাকে না যে, এই আসামীই সেই ‘এল’।”
‘ইনটেলিজেন্স অফিসার’ এর সাক্ষ্য শেষ হতেই প্রেসিডেন্ট আমার দিকে তাকিয়ে জবদগম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন—আসামী মার্থা নোকার্ট! তোমার কিছু বলবার আছে?
বুঝতে পারলাম যে আর আমার রক্ষা নেই, তাই ভাবলাম মরতে যখন হবেই তখন বীর নারীর মতই মরবো।
আমি বললাম—”আপনাদের কাছে আমার বলবার কথা বললে যে কোনই লাভ হবে না তা আমি খুব ভাল করেই জানি। তবুও বলছি যে আমাকে বিচার করবার অধিকার আপনাদের নেই 1 আমি বেলজিয়াম আর আপনারা জার্মাণ। আপনারা অত্যাচারী আর আমি—আমার দেশ অত্যাচারিত। দেশের একজন সন্তান হিসাবে আমি মনে করি যে আপনাদের যেমন দেশের জন্য যুদ্ধ করবার অধিকার আছে, আমারও তেমনি আছে আমার দেশকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে যে কোন পন্থা গ্রহণ করবার অধিকার।”
“আপনারা আমাকে হত্যা করতে পারেন, কারণ আমি নিরস্ত্র, একা অসহায়া নারী, আর আপনাদের হুকুমের অপেক্ষায় তৈরী হয়ে আছে হাজার হাজার রাইফেল!’
“কিন্তু এ বিচার নয়। বিচারের নামে এটা একটা প্রহসন মাত্র। আপনারা মনে রাখবেন যে এই বিচার প্রহসনের সংবাদ গোপন থাকবে না। মনে রাখবেন আমার একটা প্রাণের জন্য আপনাদের অনেক বেশী মূল্য দিতে হবে। আমার আর কিছু বলবার নেই। বেলজিয়াম জিন্দাবাদ!
কোর্ট এর চার দিক থেকে আওয়াজ এলো—
“বেলজিয়াম জিন্দাবাদ!
ইত্তেহাদি ফৌজ–জিন্দাবাদ!”
প্রেসিডেন্ট উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন –বন্ধ করো! বন্ধ করো ঐ চীৎকার।
এমন সময় একজন ‘আণ্ডার অফিসার’ এসে প্রেসিডেন্ট-এর হাতে একখানা কাগজ দিল।
কাগজখানা পড়ে দেখে প্রসিকিউটারের হাতে দিয়ে তিনি বললেন—হের ডক্টর হার্বাট ষ্টোন আসামী পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চান। আমরা তার বক্তব্য শুনবো।
“ওবাৰ্তাজ!”
“ওবার্তাজ আসছেন আমার হয়ে সাক্ষ্য দিতে!”
আমার হিতৈষী ওবার্তাজ।
ধীর পদক্ষেপে ওবার্তাজ গিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন।
প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করলেন- কি বলতে চান আপনি? জেনে রাখুন, আসামী নিজমুখে তার অপরাধ স্বীকার করেছে।
ওবার্তাজ বললেন—আসামী দোষ স্বীকার করেছে কি করেনি আমার তাতে কিছু আসে যায় না, আমি শুধু বলতে এসেছি যে, আমার অধীনে ও যতদিন কাজ করেছে, কর্তব্যকর্মে কোন গাফিলতিই আমি ওর পাইনি। ওর ব্যবহার, কর্তব্যপরায়ণতা, সেবা, সবকিছুই ছিল অনিন্দনীয়। এই আসামী মার্থা বহুবার বহু ক্ষেত্রে নিজের জীবন বিপন্ন করেও সেবা ধর্ম পালন করেছে।”
“একে গুপ্তচর বৃত্তি গ্রহণ করবার অপরাধে অপরাধী বলছেন আপনারা। হ’তে পারে। সে তার দেশকে ভালবাসে আর সেই জন্যই সে হয়তো এই বিপদসঙ্কুল পথে পা দিয়েছিল। আপনারাও কি আপনাদের দেশের জন্যই এই যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন নি?”
“যাক, ওসব কথা বলে কোন লাভ নেই। আমি শুধু এই কথাটা বলতে এসেছি যে, আসামী মার্থা নোকার্ট কোন রকম উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সেবার কাজ করে নাই। মনুষ্যত্বের তাগিদেই এ কাজ করেছে ও।”
এই সময় প্রসিকিউটার হঠাৎ বলে উঠলো –”এই আসামীর উপরে আপনার দরদটা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে! অন্য কোন সম্বন্ধ ছিল কি এর সঙ্গে?”
এই কথায় ওবার্তাজ একটু হেসে বললেন–”সুবিজ্ঞ প্রসিকিউ- টার হয়তো আমাকে চেনেন না। তিনি যদি ভেবে থাকেন যে এই আসামীকে আমি ভালবাসতাম তার উত্তরে আমি বলবো সে সত্যিই আমি ওকে ভালবাসতাম, এবং এখনও বাসি। তবে সে ভালবাসা পিতা-পুত্রীর ভালবাসা। আসামী মার্থাকে আমি নিজের মেয়ের মতই ভালবাসি।”
“প্রসিকিউটার হয়তো জানেন না যে আমার বিশেষজ্ঞ জীবনে বহু সুন্দরী নার্সের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। কোর্ট ইচ্ছা করলে আমার ‘প্রফেসনাল ক্যারিয়ার’ সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েও দেখতে পারেন। তাছাড়া আমি বিবাহিত এবং আমার পারিবারিক জীবনও সুখের।”
“যাই হোক। প্রসিকিউটা’র কি মনে করেন না করেন তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমি শুধু শেষ একটি কথা কোর্টকে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। কথাটা হচ্ছে, এই আসামী মাথা নোকার্ট ‘জার্মাণ মেডিক্যাল ডিপার্টমেণ্ট’এর সর্বোচ্চ সম্মান-পদক “জার্মাণ আইরণ ক্রশ” লাভ করেছিল মহিমান্বিত জার্মাণ সম্রাটের কাছ থেকে।”
“হিজ রয়েল হাইনেস্ দি ডিউক অব উইটেনবার্গ জার্মাণ সম্রাটের পক্ষে এই সর্বোচ্চ সম্মান পদক দিয়ে ভূষিত করেছিলেন এই আসামীকে।”
“আমার আর কোন কথা বলবার নেই। কোর্ট অনুমতি দিলে আমি এবার যেতে পারি।”
“এই বলেই ওবার্তাজ কাঠগড়া থেকে নেমে শেষবারের মত আমার দিকে তাকিয়ে যেমন ভাবে এসেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই ধীরে ধীরে কোর্ট থেকে বের হয়ে গেলেন।
ওবার্তাঙ্গ চলে যেতেই প্রেসিডেন্ট কিছুক্ষণ তার সহকর্মীদের সঙ্গে চুপি চুপি কি সব পরামর্শ করে বললেন— চারদিন পরে ‘জাজমেন্ট’ দেওয়া হবে।
আদালতের কাজ সেদিনের মত শেষ হয়ে গেল।
আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হল জেলখানায়।
চারদিন দিন পরে, আবার আমাকে নিয়ে আসা হলো সেই আদালতের সামনে।
সবাই সেই আগের দিনের মত।
সেই টেবিল, সেই প্রেসিডেন্ট আর সেই সব অফিসাররাই বসে আছেন জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক পরে।
আজ আমার ‘জাজমেন্ট।’
হঠাৎ ‘জোয়ান অব আর্ক’ এর কথা মনে হলো আমার।
মনে মনে বললাম—মহিমাম্বিতা জোয়ান দি মেইড, আজ আমি যেন তোমারই মত মরতে পারি।
“জাজমেন্ট শুনবার জন্য প্রস্তুত হও।” একজন “আতার অফিসার” বলে উঠলো।
জাজমেন্ট পড়তে আরম্ভ করলেন তিনি-
“It is a terrible thing to condemn a follow creature, specially when that creature is a women; but you have been the cause of death of my countrymen during the many months of your nefarious activities. The sentence is therefore that at an hour and place to be appointed latter, you will taken out and shot to death.”
“কোন প্রাণীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বেদনাদায়ক, বিশেষ করে সেই প্রাণী যদি আবার স্ত্রীলোক হয়। কিন্তু তুমি তোমার এতদিনের গুপ্ত কার্যাবলী দ্বারা আমার বহু স্বদেশবাসীর মৃত্যুর কারণ হয়েছ। অতএব তোমাকে এই দণ্ড দেওয়া হচ্ছে যে এরপর কোন এক নির্ধারিত দিনে তোমাকে গুলী করে মেরে ফেলা হবে।”
রায় দেওয়া শেষ হতেই পূর্বোক্ত আণ্ডার অফিসারটি চীৎকার করে উঠলো–
“Judgement in the name of His Imperial Majesty. Present Arms!”
রায় শুনিয়ে দেবার পর আবার আমাকে সেই কারাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমি তখন ‘কনডেমড প্রিজনার’।
মৃত্যুর জন্য দিন গুণতে লাগলাম আমি।
মৃত্যু! হিমশীতল মৃত্যু! অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এক ধর্মযাজক এসে খানিকটা, ধর্ম কথা শুনিয়ে গেলেন একদিন।
পাদ্রী সাহেবের শুভাগমন হতেই বুঝলাম যে আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। পরদিন সকাল বেলা সেই আণ্ডার-অফিসার এলো আমার সেলের সামনে।
বুঝতে দেরী হলো না এবার কোথায় যেতে হবে আমাকে। আজই তাহলে আমার শেষ।
যাবার আগে মা বাবাকেও দেখতে পেলাম না একবার।
বিদায়। বিদায় তোমাদের কাছে। ওগো সুন্দর পৃথিবী, আমার জন্মভূমি বেলজিয়াম, ওয়েষ্টরুজবেক, মা, বাবা—বিদায়!
কিন্তু একি! আবার যে কোর্টের সামনে নিয়ে এলো আমাকে! আবার কেন এই অনুষ্ঠানের বালাই? শেষ করে ফেললেই তো হয়!
প্রেসিডেন্ট আবার সেদিনের মত দাঁড়িয়ে উঠে সেই ‘জাজমেন্ট’টাই পড়ে যেতে লাগলেন। রায় পড়া হয়ে গেলে আমার দিকে তাকিয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন-—শুনতে পাচ্ছো! কি বলছি আমি? অধিকৃত এলাকার ‘কমাণ্ডার-ইন চীফ” দয়া করে তোমার মৃত্যুদণ্ড মকুব করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়াছেন। জার্মাণীর সর্বোচ্চ সম্মানপদক “জার্মাণ আইরণ ক্রশ” পেয়েছিলে বলেই তোমার প্রতি এই অনুকম্পা।”
এই পর্যন্ত বলেই প্রেসিডেন্ট বসে পড়লেন।
আমার তখন মাথা ঘুরছে।
.
এর পরের ঘটনা একটানা—একঘেয়ে কারাজীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে পেতাম এক কাপ রঙ করা মিঠে গরম জল যাকে বলা হ’তো চায়ের বদলি।
তারপরই আসতো ‘ব্রেকফাষ্ট’। সেও ঐ ‘চায়ের বদলি’ আর একখণ্ড রুটি।
জেলখানার সেই রুটী যে কি চীজ দিয়ে তৈরি হতো তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।
দুপুরের আর রাত্রের খাবার যা দেওয়া হ’তো সেও এক আহামরি চী। সে হচ্ছে খানিকটা বিট্সিদ্ধ আর একটু খানি নুন! এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটতে লাগলো আমার!
হঠাৎ একদিন বাইরে চীৎকার আর ছুটাছুটির আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে এ রকম চীৎকার চেঁচামেচি তো শোনা যায় না?
একজন কারারক্ষী ছুটতে ছুটতে আসছে দেখতে পেলাম।
আমার ‘সেল’এর দরজার সামনে এসে ও বললো—যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ফ্রাউলিন! এবার আপনি মুক্ত!
“যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে—তাহলে কি জার্মাণরা জয়লাভ করেছে?
“ওরা কি প্যারিস দখল করেছে?”
“সত্যই কি মুক্তি পাবো আটি?”
“আবার বাইরের আলো দেখতে পাবো আমি?”
কিছুক্ষণের মধ্যেই কারারক্ষীরা এসে জেলখানার প্রত্যেক ‘ওয়ার্ড’ আর ‘সেল’এর দরজা খুলে দিতে লাগলো।
আমার ‘সেল’এর দরজাও খুলে দিয়ে গেল।
পাগলের মত ছুটতে ছুটতে বাইরে এলাম আমি!
রাস্তায় তখন চলছে বিরাট চীৎকার, হল্লা আর ছুটাছুটি। সামরিক, অসামরিক, ছেলে, মেয়ে, যুবক, যুবতী—সবাই ছুট্ছে। সবারই মুখে এক কথা—যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে!
আমি তাহলে সত্যিই মুক্ত!
মুক্তি! মুক্তি! কি আনন্দ!
উত্তেজনায় শরীর কাঁপছিল আমার, তবুও ছুটছিলাম। সামনে যে রাস্তা দেখলাম সেই রাস্তা দিয়েই ছুটতে লাগলাম আমি।
থর থর করে পা কাঁপছিল আমার। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একদল ব্রিটিশ সৈন্য হল্লা করতে করতে আসছে। কোন রকমে টলতে টলতে ওদের দিকে চলতে লাগলাম আমি। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। মনে হলো কে যেন আমার পতনোন্মুখ দেহটিকে ধরে ফেললো।
জ্ঞান ফিরে এলে দেখি যে রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় শুয়ে আছি আমি।
একটু পরে একখানা ফরাসী ট্রাক আসতে দেখে হাত তুলে দাড়াতে বললাম আমি ট্রাকখানাকে।
ট্রাকে যে অফিসার ছিলেন তাঁকে আমার পরিচয় দিতেই তিনি বললেন—কি আশ্চর্য! আমি যে আপনাকেই নিতে এসেছি! ঘেণ্ট থেকে টেলিফোনে আপনার মুক্তির সংবাদ পেয়েই আমি আসছিলাম।
আমাকে সযত্নে গাড়ীতে তুলে নিলেন তিনি।
একঘণ্টার মধ্যেই ট্রাকখানা ‘ক্যারিলন কাফে’র দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো! আমি গাড়ী থেকে নামতেই পাড়ার লোকে ঘিরে ধরলো আমাকে।
খবর পেয়েই মা ছুটে এলেন।
আমাকে দেখতে পেয়েই দুই বাহু বাড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন আমাকে।
মা—মাগো!
সমাপ্ত