স্নায়ু – সন্তোষ কুমার ঘোষ
কপালের ওপর পরিশ্রমের অবসাদ ফোঁটা ফোঁটা ঘাম হয়ে জমে ছিল, মিঃ দাশ বাঁ হাতে তর্জনী দিয়ে সেগুলো মুছে ফেললেন। আজ কী গরম! ফ্যানটাও কোন কাজের নয়।
স্পিডটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে কোনও ফল হবে না। সমস্ত পৃথিবীটাই আজ তেতে আছে। ঘরের বাতাস, বাইরের হাওয়া, দুটোই সমান।
একটা নক্সা আঁকতে হবে। মিঃ দাশ ড্রয়ারটা ঘাঁটলেন, পেন্সিলটা পাওয়া গেল না। কাজের সময় হাতের কাছে জিনিস না পেলে এমন রাগ হয়! চেঁচিয়ে বেয়ারাকে ডাকবেন, হঠাৎ ফাইলের কোনে নজর পড়ল। এই যে, পেন্সিলটা ওখানেই আছে। আশু দেহক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচবার নিষ্ফল চেষ্টায় আত্মগোপন করেছে।
ব্লেডটা বার করে মিঃ দাশ পেন্সিলটা কাটতে শুরু করলেন, জোরে জোরে। আজকের অভদ্র গরম মিঃ দাশের স্বভাবমৃদু মেজাজকেও অবিবেচক করে তুলেছে।
কতকাল বৃষ্টি হয় না! গরম হবে না কেন? সংক্রামক ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই ভয়াবহভাবে স্ফীতকায় হয়ে উঠেছে। মিঃ দাশ আজকের সকালের কাগজে দেখেছেন, গেল সপ্তাহে কলেরায় মরেছে একশো চুয়াল্লিশ।
আজ কিন্তু বৃষ্টি হলে বেশ হত! আকাশের দিকে মিঃ দাশ চাইতে গেলেন, কিন্তু খসখসের নিষেধে তাঁর দৃষ্টি নিরস্ত হল। আজ বৃষ্টি হলে বেশ হত! টেম্পারেচার কত হয়েছে, কে জানে! হয়তো কাচের সমস্ত শাসন অগ্রাহ্য করে পারদ খালি ওপরেই উঠছে। কাগজে দেখেছেন কালকের তাপ ছিল চুরানব্বই। আলীপুর অফিস থেকে খবর দিয়েছে।
অবিশ্যি ওসব খবরে মিঃ দাশের কোন আস্থা নাই। চোখের ওপর প্রমাণ না পেলে তাঁর সতর্ক মন তৃপ্তি পায় না। আবহাওয়া অফিসের কোন খবরটা আজ পর্যন্ত ঠিক মতো ফলেছে?
সেই যে, সেবার খবর দিলে, কলকাতায় ভূমিকম্প হবে, বিহারের মতো না হোক তার কাছাকাছি একটা ছোট খাটো প্রলয় ঘটবেই,—কই ফলেছিল ওদের সে কথা? সেদিন যে ভূমিকম্পের ভয়ে মিঃ দাশ তিন ঘন্টা আগেই অফিস ছুটি দিয়ে দিলেন, (যার ফলে মুর্শিদাবাদ মেডিকেলের লোভনীয় অর্ডারটা হাত ছাড়া হয়েই গিয়েছিল আর কি) তার ক্ষতিপূরণ কে করবে?
আজকের গরম মিঃ দাশের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে থাকবে, —মিঃ দাশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। হাতের পেন্সিলটার দিকে নজর পড়ায় মিঃ দাশের একটু লজ্জা হল। সর্বনাশ, এতক্ষণ তাঁর মনের শিথিল অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ব্লেডটা পেন্সিলটার ওপর যথেচ্ছ অস্ত্রাঘাত করেছে। সুগোল ছুঁচোলো মুখের পরিবর্তে এমন একটা হাস্যকর চেহারা হয়েছে পেন্সিলটা মিঃ দাশের নিজের হাতের কাটা।
বিলের ওপর সই করে মিঃ দাশ ফাইলের তাড়াটা টেনে নেন। ‘প্রিমিয়ার ড্রাগিস্ট’-দের অর্ডারটার ওপর সই করতে গিয়ে মিঃ দাশ একবার থামলেন। থাক, ওটা এখন সাপ্লাই না করাই ভাল। ওদের ওখানে দুটো বিলের দরুণ দেড় শো টাকা পাওনা আছে। ওদের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের যাচ্ছে না। কথাটা জেনেও প্রিমিয়ারকে মাল জোগানো লোকসানকে নিমন্ত্রণের শামিল।
আরও কিছু কাজ ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, কাজ করতে মিঃ দাশের ভাল লাগছেনা। আজ সকাল থেকেই তাঁর মনটা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। শরীর বোধ হয় ভাল নেই। কপালে হাতখানা রেখে মিঃ দাশ ভাবলেন, শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক যা নিবিড়! হাইজিন হাজার হলেও বিজ্ঞান তো, একেবারে বাজে কথা লেখে না।
শরীর ভাল নেই। শরীর খারাপ, মিঃ দাশের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। স্বাস্থ্যের কী অপরিমিত স্বাচ্ছল্যই না ছিল, মিঃ দাশের দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহে। কাজ করতে কোনও দিন তিনি আলস্য বোধ করেননি।
শরীর খারাপ, অথচ দেহে কোনও অসুখ নেই। এর মানেই কি বার্ধক্য? বার্ধক্য, —মিঃ দাশের কানের কাছের চুলগুলো সাদা হয়ে এসেছে, একদিন সমস্ত চুলই সাদা হয়ে যাবে; দেহের এমন চমৎকার বাঁধুনি মিঃ দাশের, —সব যাবে শিথিল হয়ে। সেদিন মিঃ দাশ আর অফিসে আসবেন না; যাঁর জন্য অফিসটার সর্বত্র একটা ত্রস্ত ভয় সতর্ক হয়ে আছে, তিনি আসবেন না, সামর্থ্যরহিত মিঃ দাশ সেদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকবেন। সূর্য উঠবে, এমনি গাঢ়। দুপুর হবে, বিকেলে ছাদের কোণ ছায়াস্তিমিত হয়ে আসবে, মিঃ দাশকে কোনও কাজ করতে হবে না। হয়তো ঘরের নিরাপদ কোণে বসে তিনি তখন খুক খুক কাশবেন। যৌবনের দীপ্ত তেজস্বিতা হারিয়ে মিঃ দাশ তখন পূজো-অর্চনাতেই মন দেবেন কি-না, তার ঠিক নেই।
ফাইলটা সম্মুখেই খোলা। লজ্জিত হয়ে মিঃ দাশ আবার কলমটা তুলে ধরলেন। আজ কী যে হয়েছে! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনের ওপর শাসন করবার ক্ষমতাও যেন তাঁর রহিত! খালি খালি বাজে কতকগুলো চিন্তাকে তিনি তাঁর ব্যস্ত মস্তিষ্কে স্থান দিয়েছেন।
বাঁ হাতের মধ্যমা দিয়ে মিঃ দাশ কপালের ওপরটা ঘসে নিলেন। জোরে জোরে। কপালটায় অনেকগুলো রেখা পড়েছে। আগেকার সেই মসৃণ সৌকুমার্য তাঁর মুখে যে আর নেই, কিছুদিন থেকেই সেটা তিনি আরশিতে লক্ষ করছেন।
এখন আর আরশিরও প্রয়োজন হয় না। হাত বুলোলেই রেখাগুলা স্পষ্ট বোঝা যায়। রেখা পড়ে কেন? বয়সের জন্যই। বিধাতা কি রেখা দিয়ে মুখের ওপর বয়সের হিসাব করেন?
বয়স বেড়ে চলেছে। থামাবার জো নেই। ঠেকাবার উপায় নেই। মিঃ দাশ এখানে স্ত্রীলোকের চেয়েও অসহায়। ফল পাকে, মিঃ দাশও পাকতে চলেছেন। এই প্রকৃতি, অদৃশ্য অদৃষ্ট। তোমার, আমার, সকলের। সময় আর স্রোত কারও জন্যে অপেক্ষা করে না,—কারও জন্যে নয়। মিঃ দাশই বা ব্যতিক্রম হবেন কেন?
অথচ তাঁর এখনও কত কাজ বাকি! সৌভাগ্যের, সুখ্যাতির কয়েকটা সোপান মাত্র তিনি আরোহণ করেছেন, যশের ঢেউয়ের চূড়া এখনও অনেক দূরে। নতুন কত কারবারের কথা তিনি মনে মনে ছকে রেখেছেন, ভেবেছেন শুরু করবেন। কিন্তু এমন দ্রুত, এমন অবুঝভাবে বয়স বাড়লে মিঃ দাশ কী করে তাঁর কল্পনাকে দেবেন রূপ?
একটা ব্যবসা শিগগিরই আরম্ভ করা যায়, একটা পত্রিকার। ওষুধের প্যামফ্লেটের জন্যে একটা প্রেস তো তাঁকে এমনিতেই করতে হয়েছে। মিঃ দাশ ভেবেছেন ওটাকে আর একটু বাড়িয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ করবেন। বিজ্ঞাপন দিতেই মাস মাস দুশো আড়াইশো টাকা বেরিয়ে যায়, নিজেদের পত্রিকা হলে সেই টাকাটা তো বাঁচবে!
মিঃ দাশ উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। আলো, খালি শুকনো আলো। আলো নয়তো, আগুন। শরীর পুড়ে যায়।
এটা কী মাস? মিঃ দাশ দেয়ালে টাঙানো দিনপঞ্জিটার দিকে তাকালেন, মার্চ মাস। বাংলা তা হলে কী হ’ল? বোধ হয় ফালুন। চৈত্রও হতে পারে।
ফাল্গুন কি চৈত্র। এটা তো তা হলে বসন্ত কাল। আশ্চর্য, বসন্ত নামে যে একটা ঋতু আছে, মিঃ দাশের এতকাল সেটা খেয়ালই ছিল না।
তাই। এটা বসন্তই। সমুখের রাস্তার বড় গাছগুলোর দিকে তাকালেই সে কথা স্পষ্ট বোঝা যায়। পুরনো পাতা ঝরে গেছে, কচি পাতা সন্তপর্ণ ভীরুতায় সবে ফুটেছে। বৃষ্টি পেলে হয়তো গাছগুলো এতদিন সবুজ হাসিতে ভরে যেত।
হ্যাঁ, সেই পত্রিকাটা। এতদিন যে প্ল্যানটাকে তিনি কাজের ভেতর তর্জমা করেননি তার কারণ এ নয়, যে কল্পনাটার সাফল্য সম্পর্কে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ ছিল। সন্দেহ নেই। সন্দেহ নিয়ে কোনও কাজে হাত দেবার অভ্যাস মিঃ দাশের নেই। ভবিষ্যৎ তাঁর নখদর্পণে প্রায়।
পত্রিকাটার ভার কার উপরে দেবেন, মিঃ দাশের সেইটেই হয়েছে ভাবনা। নিশীথের ওপর দেওয়া চলত। ছোকরা বেশ চটপটে ছিল, সপ্রিতভও, —সাহিত্যে কিছু রসও পেত বোধ হয়। অন্ততঃ চেহারা দেখে তো তাই মনে হত।
চেহারা দেখে মনে হত। কিন্তু মনে করাটা ভুল বোধ হয় হত না। বলতে গেলে, ওই জন্যেই—ওই জন্যই তো ওর চাকরিটা গেল!
কাঁচা মন, ভিজে মন, ওতে কাজ চলে না। সেই জন্যে মিঃ দাশ কিছুদিন থেকে নিশীথের ওপর চটেই ছিলেন। মিঃ দাশ অন্নসত্র খোলেননি। মানুষের মন এখানে টাকার মাপে পরিমিত। নিশীথের ওপর তাই তিনি অসন্তুষ্ট হতেন—কেন ছেলেটা কাজ করতে করতে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যাবে?
বলতে কী, ওই জন্যেই নিশীথের চাকরিটা গেল। মিঃ দাশের সব সয়, কিন্তু কাজে অবহেলা নয়।
একদিন অফিসের সময় তিনি নিশীথের টেবিলের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কনুইটা টেবিলের ওপর রেখে নিশীথ কপালের দু’ধারের রগ দুটো আঙুলে চেপে ধরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথাটা নুইয়ে দিয়েছে।
মিঃ দাশ পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মুখে ক্রূর হাসি। সমস্ত অফিসটাতে একটা আতঙ্ক শিউরে উঠেছে, নিশীথের চাকরিটা তা হলে খসল!
নিশীথের যে চুলগুলো কপালের ওপর এসে পড়েছিল, মিঃ দাশ আস্তে আস্তে সেগুলো সরিয়ে দিলেন। নিশীথ ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
—‘ঘুমুচ্ছিলে? মাধ্যাহ্নিক বিশ্রাম, কী বলো, য়্যা? মিঃ দাশ যে এমন নিষ্ঠুর নির্লজ্জ গলায় হাঁকতে পারেন, কে জানত, —বালিশ দেব নাকি, কিম্বা বিছানা? —’
অপ্রতিভ এবং করুণ মুখে নিশীথ কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে তিনি জানালেন, —চুপ! বললেন, —আধ ঘণ্টা পরে আমার ঘরে গিয়ে দেখা কোরো।
রাজকীয় ঔদ্ধত্যে মিঃ দাশ ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন, আর সমস্ত অফিস ঘরটা একটা ব্যস্ত গুনে ভরে উঠেছে।
ঘণ্টা পর নিশীথ একজন কর্মচারীকে নিয়ে এল।
‘স্যার!’
তেমনি একটা অননুকরণীয় হাসি মুখের ওপর অঙ্কিত করে মিঃ দাশ চোখ তুলেছেন, ‘কি? ঘুম ভেঙেছে?’
‘স্যার’, অপর কর্মচারীটি এগিয়ে এল, —‘ওর কোনও দোষ নেই, —ওর স্ত্রীর, মানে wife-এর বড্ড অসুখ, —তাই রাত জাগতে—’
‘থামো’, তাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে মিঃ দাশ গর্জে উঠলেন, —‘you must not plead for him. I say, you must not.’ নিশীথের দিকে তাকিয়ে, —‘এই slip টা নিয়ে Cashier-এর কাছে যাও। এমাসের মাইনেটা পুরোপুরিই দেওয়া গেল। কাল থেকে তোমাকে আর এসে কাজ নেই। It is unfortunate, our office is not meant for charity.’।
নিশীথের মুখখানা বিরস হয়ে উঠেছে। মিঃ দাশ কৌতুক অনুভব করেছেন। নিশীথ আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিল, মিঃ দাশ তাকে বলতে দেননি, ফাইলটা চোখের সমুখে টেনে নিয়ে ব্যস্ততার অভিনয় করেছেন।
সব মিঃ দাশের একে একে মনে পড়ছে। নিশীথের শুকনো মুখ সেদিন তাঁর মন গলাতে পারেনি। অতোটা কঠোর না হলেও বোধ হয় চলত? একবার ধমকে দিলেই যথেষ্ট হত? হাজার হলেও মানুষ তো, সুখ-দুঃখ আছেই। কি জানি, হয়তো ওর স্ত্রীর সত্যিই খুব অসুখ!
স্ত্রীর অসুখ! মিঃ দাশের মনটা হঠাৎ চমকে উঠল। পনেরো বছর আগেকার এই রকম একটা দুপুরে তিনিও একটা টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন। ‘শিপ্রা মরাণাপন্ন। শীঘ্র এসো।’
মরণাপন্ন, অর্থাৎ ভেঙে নিলে যাকে বলা যেত, ‘বাঁচবে না।’ মিঃ দাশের মস্তিষ্ক সেদিন কেমন একটা অজ্ঞাত ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল, বেশি কিছু ভাবতে পারেননি।
শিপ্রা বাঁচবে না। শিপ্রা বলে কাউকে মিঃ দাশ চিনতেন নাকি?
চিনতেন। শিপ্রা তাঁরই স্ত্রী। বিয়ের সময় মিঃ দাশের ছিল যৌবনের প্রত্যুষ, তখনকার জীবন আজকের মতো কর্তব্যঅভিশপ্ত, রুটিনশাসিত ছিল না। তখনও মিঃ দাশ আজকের মতো এমন ক্ষমতার তুঙ্গ শীর্ষে আরোহণ করেননি, এমন অযাচিত যশ তাঁর দু’পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়েনি।
অনেক দূরের একখানা বাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ছাতের ওপর ছোট্ট চিলেকুঠি, কার্নিসে কাপড় শুকনো। মিঃ দাশের চোখদুটো যেন মায়ায় জড়িয়ে এল।
ওই রকম একটা নিরালা ছোট্ট বাড়ির নিভৃতিতে তিনি শিপ্রাকে আপনার করে পেয়েছিলেন, —রুটিনশাসিত জীবনের পরিধির বাইরে। আজকের মতো এমন গম্ভীর প্রকৃতি ছিল না মিঃ দাশের—কত ছেলেমানুষি, কত অবুঝ আবদারই যে তিনি তখন করেছেন।
শিপ্রা হাঁফিয়ে উঠত। বলতো—বাইরে বুঝি একেবারে মন টেঁকে না কেমন? তাই দু’দণ্ড যেতে না যেতেই বাড়ি ফেরা হয়। এমনি করে কাজে ফাঁকি দিয়েই তুমি সংসার চালাবে? তবেই হয়েছে।
কৌতুকের হাসি হেসেছিলেন মিঃ দাশ! অসংযত আগ্রহে হাত দু’খানা দিয়ে শিপ্রার গলা জড়িয়ে ধরে কাছে এনে বলেছেন, —‘ভয় করে পাছে তুমি হারিয়ে যাও। তোমাকে হারাতে পারব না!’
দুপুরবেলা, তবু রাস্তায় লোকের ভিড় কম নয়! ট্রামে সস্তা ভাড়া, বাসে সস্তা অ্যাক্সিডেন্ট, কলকাতায় এত লোকও থাকে?
—কিন্তু হারিয়ে ফেলেছেন। বাইরে ক্রমে ক্রমে মিঃ দাশের প্রতিপত্তি বেড়েছে, সংসারের নিরালা আশ্রয় থেকে ছিটকিয়ে পড়েছেন যশ আর ঐশ্বর্যের হট্টগোলে। শিপ্রা ফাইলের অরণ্যে, অনেক ডেস্ক, ড্রয়ার আর ডিসকাউন্টের আড়ালে হারিয়ে গেছে।
তারপর—আর কিছু মিঃ দাশের মনে পড়ে না। কোথায় গেল, কখন গেল, সেই সুখে পর্যাপ্ত, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বহীন পরিমিত জীবন? —মনে পড়ে না। তারপরটা একেবারে আকাশের মতো ফাঁকা—অথচ যশের তারায় ছাওয়া।
একদিন আফিস থেকে ফিরে দেখেছেন শিপ্রা আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। শিপ্রার অসুখ নাকি? কুন্ঠিত ব্যস্ততায় মিঃ দাশ শিপ্রার মাথায় হাত রেখেছেন।
‘ক’দিন থেকে জ্বর হল?’
‘ও কিছু নয়, ক’দিন থেকেই একটু —’
‘ক’দিন থেকেই?’ মিঃ দাশ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন,—‘ক’দিন থেকেই?’ আর তুমি আমাকে মোটে জানাওনি?’
শিপ্রা কোনও উত্তর দেয়নি। শীর্ণ ঠোঁটের প্রান্তে কৃশ হেসেছে। তখন সে হাসির মানে বোঝেননি, এখন বুঝেছেন বইকী! শিপ্রার হাসির আড়ালে এই কয়টি কথা ছিল, —‘কিন্তু তুমিই কি খবর নিয়েছিলে?’
ডাক্তার ডেকেছেন। পরীক্ষা করে তাঁর মুখ আরও পাথুরে গম্ভীর হয়ে উঠেছে। —বলেছেন, অনেক দিনের অসুখ, সন্দেহ হয়। এতদিন যে কোনও খবর দেননি, তা-ই আশ্চর্য।
ডাক্তার চলে গেলে, আস্তে আস্তে শিপ্রার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছেন, —‘ডাক্তার কী বলে গেল, শুনলে তো? তোমাকে এখন দেখা-শোনা করবার লোক দরকার। আমি বলি কী, তুমি দু’দিন না হয় তোমার বাবার ওখানে গিয়েই সেরে এসো কেমন?’
তারপর? তারপর আর কিছু নই। তারপর আবার সেই কাজের হিংস্র ঢেউ, আবার খ্যাতির শীর্ষাবরোহণ। তারপর কিছু নয়, একখানা টেলিগ্রাম—‘শিপ্রা মরণাপন্ন। শীঘ্র এসো।’
মিঃ দাশ ভেবেছিলেন যাবেন। কিন্তু যাওয়া হয়নি। বিকেলে ডিরেক্টরদের মিটিং, রাত্রে বগুরা আর বরিশাল মনোপলাইজ করবার জন্য ওখানকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করা: মিঃ দাশের যাওয়া আর ঘটে উঠল না। কর্তব্য যখন ডাকছে, তখন নিজের ব্যক্তিগত সুখদুঃখের প্রশ্ন তোলা সংকীর্ণতা।
সেই টেলিগ্রাম, তারপর আর একখানা—‘শিপ্রা নেই।’ ছোট দু’টো শব্দ, আর মিঃ দাশের মাথা যেন খালি লাগল। শিপ্রা মরেছে। নার্ভাস ব্রেকডাউন। নার্ভ মানে কী? আর কোনও বাধা নেই, আর কোনও পিছনের টান নেই। এবার তিনি অনায়াসে যশের শৃঙ্গে আরোহণ করতে পারবেন, দুর্গম থেকে দুর্গমতমে—খ্যাতি প্রতিপত্তি তাঁর দরজায় এসে ধরা দেবে।
দূরের কোনও গাছ থেকে একটা কোমল অথচ তীক্ষ্ম শব্দ ভেসে এল। কোকিল নাকি? কলকাতায়ও কোকিল ডাকে? কোকিল নয়, বোধ হয় মিলের বাঁশি। এখানে কোকিল ডাকে না, অন্তত ডাকলেও মিঃ দাশের কানে তা যায় না।
মিঃ দাশ লজ্জিত হলেন। আজ তাঁর কি-ই যে হয়েছে। সস্তা ভাববিলাসিতার চূড়ান্ত করছেন। মনের এই অবস্থায় তিনি যদি রাস্তার একটা ভিখিরি ডেকেও সর্বস্ব বিলিয়ে দেবার মতো কাজও করেন তা হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিংবা নিশীথকে ফের চাকরিতে—
নিশীথ! ছেলেটির চেহারা মনে ভেসে উঠতেই মিঃ দাশের মন আজকের এই অপরাহ্নের মতো কোমল হয়ে উঠল। নিশীথের কী দোষ ছিল? স্ত্রীর অসুখ, এতে বিচলিত হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষতঃ ওর মতো বয়সের ছেলের পক্ষে। সবাই তো আর তাঁর মতো হৃদয়হীন নয় যে স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ পাবার পরও ডিরেক্টরদের মিটিং-এ যোগ দেবে।
সেদিন মিটিং-এ মিঃ দাশ আরও অদ্ভুত বাগ্মিতার পরিচয় দিয়াছেন। সূক্ষ্ম বিচারে নির্ভুল যুক্তিতে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছেন, সকলকে মুগ্ধ করেছেন। তারপর বাড়ি ফিরে—
হঠাৎ ঘড়িটার দিকে নজর পড়াতেই মিঃ দাশ সচেতন হয়ে উঠলেন, —সাড়ে চারটা। সর্বনাশ, সওয়া পাঁচটার সময় এস কে চ্যাটার্জির বাসায় আজ একটা মিটিং আছে যে! জরুরি মিটিং মিঃ দাশ সেখানে কয়েকটা কার্যকরী স্কিম উপস্থাপিত করবেন। পাশ হবেই তাঁর জানা। এতে কোম্পানির কোনও লোকসান নেই, বরং প্রচুর লাভেরই সম্ভাবনা।
মিঃ দাশ তাঁর নিজস্ব সহকারীকে ডাকলেন।
গাড়িটা ঠিক করতে বলুন, মিটিং-এ যেতে হবে। আর পাঁচ নম্বর ফাইলটা নিয়ে আপনিও আসুন।
বিকেলের সৌন্দর্য কী অদ্ভুত! মিঃ দাশ উদ্গ্রীব চোখে দু’পাশের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। কাতারে কাতারে এই যে পিঁপড়ের সারির মতো লোক চলেছে, আশ্চর্য, ভিড়ের মধ্যে এদের সমষ্টিগতভাবে ছাড়া আর কোনও ভাবে দেখা সম্ভব না হলেও এদের প্রত্যেকের একটা স্বতন্ত্র একান্ত নিজস্ব জীবন আছে। প্রত্যেকের জীবনে পৃথক আশা, আকাঙক্ষা, অনুভূতির স্পন্দন। এখন যারা পাশাপাশি ঘেঁসাঘেঁসি করে চলেছে, তাদের প্রত্যেকের মনোবৃত্তি অপরের থেকে স্বতন্ত্র।
কেউ চলেছে ক্ষুধার তাড়নায়, কারুর হাতে বা চমৎকার আহার্য। তার জন্যে, কে জানে কোন গলির অন্তঃপুরে উৎসুক দুটি চোখ উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় আছে। কারুর হাতে ওষুধের শিশি, হয়তো ছেলেপুলের অসুখ কিম্বা স্ত্রীর—
স্ত্রীর অসুখ! মিঃ দাশ আবার চমকে ওঠেন, আবার তাঁর হৃৎপিন্ডে হাতুড়ির ঘা পড়ে।
হঠাৎ পার্শ্ববর্তী অ্যাসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নিশীথের কোনও খবর জানেন? ওর কী করে চলছে এখন?’
মাথা চুলকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলে, ‘কী করে আবার চলবে। কষ্টে, এর ওর কাছ থেকে চেয়ে চালায়। চাকরি জোটানো এ বাজারে—’
‘আর ওর স্ত্রী—’
সেদিন দেখা হ’তে বললে, একটু ভাল হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার নাকি চেঞ্জে নিয়ে যেতে বলেছে, —বলছিল ফলটলও তো খাওয়ানো দরকার। কিন্তু টাকা কই?
আর কিছু বলতে হল না। মিঃ দাশ ততক্ষণ ফের অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। মনে পড়েছে একখানা পাণ্ডুর, রুগ্ণ মুখ, একটু ক্লান্ত সে মুখ, একটু বিষণ্ণ যেন, একটু রহস্যময়। তারপর একটা টেলিগ্রাম—‘শিপ্রা মরণাপন্ন’, তারপর আর একখানা; ‘শিপ্রা নেই।’নার্ভাস ব্রেক ডাউন।—নার্ভ মানে কী?
আর কিছু বলতে হল না। মিঃ দাশ গাড়ির মধ্যেই একবার চঞ্চল হয়ে বসলেন। তারপর বললেন, ‘নিশীথের ঠিকানা জানেন আপনি? গাড়িটা সেখানে নিতে বলুন।’
অ্যাসিস্ট্যান্ট বিস্মিত চোখে তাকাল। ওখানেই মিঃ দাশ যাবেন নাকি? এদিকে যে ডিরেক্টারদের মিটিং-এর সময়…
‘জানি’, মিঃ দাশ কেমন অদ্ভুত আচ্ছন্ন গলায় বললেন, ‘কিন্তু যাওয়া আর হল কোথায়? নিশীথের ওখানে না গেলেই যে নয়!’
তারপর?
তারপর তো আপনারা অনুমানই করেছেন।
মিঃ দাশ নিশীথের বাসায় গেলেন। তাকে বিস্মিত, অভিভূত করে হেসে উঠলেন; বললেন, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না নিশীথ? কিন্তু তোমাকেই আবার চাই যে।
নিশীথের কানের কাছে মুখ নিয়ে হেসে ওঠেন, প্রগল্ভ গলায় বলেন, ‘ভেবে দেখলাম নিশীথ, তোমাকে ছেড়ে আফিসের চলে না।’
চাপা গলায় বলেন, একটা কাগজ করছি, তোমাকেই তার Editor করে দেব। আস্চে মাস থেকেই join করতে হবে, এই নাও তোমার advance, বলে একশো পঞ্চাশ টাকারই চেক তার হাতের মধ্যে গুঁজে দিলেন।
নিশীথ কৃতজ্ঞ গলায় কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে ব্যস্ত গলায় মিঃ দাশ বলেন, ‘কিন্তু ওসব পরে হবে নিশীথ, চলো, তোমার স্ত্রীকে দেখে আসি।’
তারপর নিশীথের হাত ধরে বাড়ির মধ্যে এগিয়ে গেলেন, যেখানে নিশীথের স্ত্রী তার দুর্বল শরীরে বিকেলের চা জলখাবার তৈরি করছে, সেখানে গিয়ে একেবারে পিঁড়ি পেতে বসেই পড়লেন হয়তো।
অনাবৃত সরল গলায় হেসে উঠলেন; বললেন, খালি বরের জন্যই চা করলে তো হবে না মা লক্ষ্মী, এই বুড়ো ছেলেটির জন্যও এক কাপ চাই যে!
কিন্তু এসব কিছুই হয়নি।
মোটর থেকে নেমে মিঃ দাশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। নোংরা রাস্তা, এখানে ওখানে আবর্জনা জমা হয়ে আছে। এটা মিঃ দাশের অজ্ঞাত, অপরিচিত জগৎ, নিঃশ্বাস ফেলতেও তাঁর রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল। দুই একবার আছাড় খেতে খেতে কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়েছেন। চার পাশের নীরব আবহাওয়া মিঃ দাশকে বাস্তবের বন্দরে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে।
যেমন অতর্কিতে নেমে গিয়েছিলেন, তেমনি অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে মোটরে উঠেছেন। কাজ নেই নিশীথের কাছে গিয়ে। অমন ঢের দুঃস্থ আছে। কেবল একজনের দারিদ্র দূর করা ভাববিলাসিতা। মিঃ দাশ চারধারে তাকালেন, —ভাগ্যিস, কেউ তাঁকে এখানে দেখে ফেলেনি!নইলে তিনটে বড় বড় মিল যাঁর হাতের মুঠোয়, সেই মিঃ দাশকে এই দুর্বল স্নায়ুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখলে কী ভাবত!
মিঃ দাশ মোটরে এসে উঠলেন। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পাঁচটা দশ। যাক, বেশি দেরি হয়নি। এখনও ডাইরেকটারদের মিটিংএ যোগ দেবার সময় আছে।
সমাজের ওপর-নীচের পার্থক্য অনেক, দুর্বল মুহূর্তের মধ্যস্থতায়ও তার মীমাংসা হয় না।
৩০.০৭.১৯৩৯
লেখক পরিচিতি
সন্তোষকুমার ঘোষ : ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরে জন্ম। পেশায় সাংবাদিক এই লেখকের ছোটগল্পও অসামান্য। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ‘কিনু গোয়ালার গলি’ তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে আনন্দ পুরস্কার। ‘শ্রীচরণেষু মাকে— শেষ নমস্কার’ গ্রন্থের জন্য ১৯৭২-এ অকাদেমি পুরস্কার। মৃত্যু: ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫।