1 of 2

স্ত্রী—মানেই ইস্ত্রি? – শিবরাম চক্রবর্তী

স্ত্রী—মানেই ইস্ত্রি? – শিবরাম চক্রবর্তী

স্ত্রী তো আসলে ইস্ত্রিই। সংসারের পাটরানী। ধোলাই করার পর দুরমুশ করে পাট করা কাজ যেমন ইস্ত্রির, স্ত্রীরও প্রায় ঠিক তাই। স্বামীর যাতে পাট না ভাঙে, তাকে পরিপাটি রাখা। কমনীয় নববধূ যে ক্ৰমে কি করে, দুর্দমনীয় ইস্ত্রি হয়ে ওঠে—জীবনের সেই এক রহস্য।

কুমারীর হ্লাদিনী রূপ একদিন জল্লাদিনীরূপে দেখা দেয়।

অনুপমের জীবনে কিন্তু এর ব্যতিক্রম দেখা গেছল।

কথিত আছে যে, বিয়ের প্রথম বছরে বউ স্বামীর কথা শোনে, দ্বিতীয় বছরে স্বামী শোনে বউয়ের কথা। তৃতীয় বছরে পাড়া-পড়শীরা সবাই তাদের কথা শুনতে পায়।

কিন্তু বিয়ের আজ দশ বছর বাদেও অনুপমদের ঘরোয়া কথা বাড়ি ছাড়িয়ে যায়নি কখনো। ছড়ায়নি গিয়ে পাড়ায়। তাদের দাম্পত্যে কলহ নাস্তি—এতদিনেও।

অনুপমের গার্হস্থ্য-জীবনকে অনুপমই বলতে হয়। মীরার সঙ্গে এই দশ বছরে কখনও যে তার মতভেদ ঘটেনি তা নয় ; মীরার অন্ধ সংস্কার প্রায়ই তাকে পীড়িত করেছে। কিন্তু তাহলেও ‘শুভ বিবাহের পর তারা সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল’ বলে উপকথার উপসংহারে যে রমণীয় বিবৃতি থাকে তার জীবনে যেন সেটাই ঠিক ঘটেছিল। কলকাতার কোনো সদাগরী আপিসের সামান্য কেরানী হয়েও অনুপম সেই উপকথারই নায়ক।

শহরতলির স্টেশন থেকে সকাল ৮-৩০-এর ট্রেন ধরে সারাদিন ক্লাইভ স্ট্রিটের আপিসঘরে কাটিয়ে সন্ধে সাড়ে ছ’টায় বাড়ি ফিরে রোজই সে দেখেছে বউয়ের হাসিমুখ। দুটি চোখ অভ্যর্থনায় উৎসুক। হাত-মুখ ধোবার জলের টব এগুনো, মুখ হাত ধুতে না ধুতেই চা-জলখাবার। ফুলকো লুচি আর আলুভাজা তৈরী ।

কিন্তু সেদিন আপিস থেকে ফিরে অনুপম যেন তার ব্যতিক্রম দেখল।

জলের টব, ঘটি আর তোয়ালে যথাস্থানে নেই, নেই তাদের পাশে তার পুরনো স্লিপার জোড়া। বউ এগিয়ে এল না হাসিমুখে, লুচি ভাজার মিষ্টি গন্ধও তাকে স্বাগত জানাল না। ব্যাপার কি, স্বগতোক্তি করে ভেতরে উঁকি মেরে দেখল, তোলা উনুনে তখনো আঁচ পড়েনি। খাটের পায়ায় ঠেস দিয়ে গোমড়া মুখে বসে তার বউ।

এরকমটা দেখতে সে অভ্যস্ত নয়। গত দশ বছরে এ দৃশ্য সে দেখেনি। দশ বছর স্লিপারের জায়গায় স্লিপার, বউয়ের মুখে মিঠে হাসি সে দেখে এসেছে এবং আরো বিশ-ত্রিশ বছর, মানে যাবৎ তাদের জীবদ্দশা, তাই দেখবে আশা করেছিল। এখন তার অন্যথা দেখে একটু বিচলিত হল বইকি!

‘ঐখেনে অমন করে বসে যে!’ অনুমপ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালো।

‘এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হল তোমার? ঝঙ্কার দিয়ে উঠল তার বউ।

তার মানে? আপন মনেই প্রশ্ন করল অনুপম। সপ্রশ্ন নেত্রে তাকালো নিজের হাতঘড়ির দিকে। কানে দিয়ে দেখল চলছে কিনা ঘড়িটা। কেন, টিকটিক করছে তো ঠিক ঠিকই।

‘সাড়ে ছ’টা তো বেজেছে ঘড়িতে।’ বলল অনুপম : ‘রোজ তো আমি ঠিক এই সময়েই বাড়ি আসি। গত দশ বছর ধরে আসছি।’

‘এবার একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথাটা মনে রেখ’, কড়া গলায় জানাল মীরা।

জবাব দেবার কিছু না পেয়ে চুপ করে রইল অনুপম।

‘সেই সাড়ে আটটায় তুমি বেরিয়ে যাও, আর ঠিক দশ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফেরো। সারাটা দিন খালি বাড়িতে একলাটি আমি পড়ে থাকি সে কথাটা তো ভাবতে হয় একবার! এর মধ্যে আমি বেঁচে আছি, না, মারা গেলাম। কী ঘটলো না ঘটলো আমার। কিন্তু সেকথা কি তুমি কোনোদিন ভেবেছ? আর তুমি ভাববেই বা কেন? আসা মাত্রই তোমার হাতের কাছে জলের ঘটি তৈরি চাই, আর পায়ের কাছে চটিজুতো! আর সঙ্গে সঙ্গে খাবার যেন তৈরি থাকে। এই তো খালি চাও তুমি। আমার কী হল না হল সে কথা তুমি ভাবতে যাবে কেন! তোমারটি ঠিক ঠিক হলেই হল।’

অনুপম একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। সম্ভবত তার বউয়ের হয়ে।

‘সারাদিন আপিসে বসে একবারটিও কি আমার কথা মনে পড়ে তোমার!’ ওর বউ ফোঁস করে ওঠে।—‘আমার কথা ভাবো তুমি?’

‘ভাবিনে? বসে বসে ব্লটিং পেপারে সার দিন তো খালি তোমার ছবিই আঁকি!’

‘বলে যাও! বলতে তো তোমাদের মুখে কিছু বাধে না।’ গুমরে ওঠে মীরা—কিন্তু আমাকে অত বোকা পাওনি। তোমার কথায় ভুলব না আর। দশ বছর ধরে কথায় ভুলিয়ে আমাকে তুমি বোকা বানিয়ে রেখেছ কিন্তু আর তুমি তা পারবে না। এই শেষ।’

দম নেবার জন্য মীরা একটু থামল। আবার নব উদ্যমে তার শুরু করার আগে অনুপম মুখ খোলার ফুরসত পেল একটু।

‘এক মিনিট চুপ করবে? ঠাণ্ডা হবে একটু?’ বলল সে ; ‘বলি হয়েছেটা কি, যে আমি আসতে না আসতেই এমন তুলকালাম শুরু করেছ! পাগল হয়ে গেছ নাকি?’

‘পাগল হবার কিছু বাকি আছে আমার? নাও, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। আমার গায়ে হাত দিয়ো না বলছি। আমাকে খুব ঠকিয়েছ। অ্যাদ্দিন আমি বুঝতে পারিনি। এবার আমার চোখ ফুটেছে।’

অনুপমের ধারণা ছিল মেয়েদের চোখ সর্বদাই প্রস্ফুটিত—সেই কিশোরী বয়সের থেকেই। তার নজরকে কখনই ফাঁকি দেয়া যায় না। কারো ওপর যদি কোন মেয়ের নেকনজর পড়ে তখন তার ঘাড় বাঁচানো দায়—সেই ঘাড়ে তাঁর আবির্ভাব অনিবার্যই। কিন্তু এতদিন পরে এইবার তার চোখ ফুটেছে, কোন মেয়ে যদি ভূয়ঃ ভূয়ঃ এই কথা জাহির করতে থাকে বুঝতে হবে তার ভূয়োদর্শনের মধ্যে ভুয়োর ভাগটাই বেশি।

‘কেন তোমার ফিরতে দেরি হয় তা কি আমি আর জানিনে? বুঝতে পারিনে আমি এতই বোকা তুমি ভাব? এখানে আমি একলাটি হাপিত্যেশে বসে। ওধারে তুমি মজা করে কফি হাউসে ফুর্তি লুটছ!’

ফুর্তিই বটে! ফুর্তির সময়ও বুঝি অঢেল! সাড়ে পাঁচটায় আপিসের ছুটি হয়, কোনরকমে বাস ধরে শিয়ালদায় এসে ট্রেন ধরতেই ছ’টা বেজে যায়—এর ভেতর ফাঁক আছে বটে কোথাও বসে কফি খাবার! কথাটা গলা পর্যন্ত ঠেলে আসে অনুপমের, কিন্তু তার বেশি আর সে গলায় না।

বরং বউকেই গলাবার চেষ্টা করে। ‘কী পাগলের মতন যা-তা বকছো⋯’ নরম সুরে বলতে যায়।

‘পাগলই তো বটে আমি! দশ বছরের পুরানো বউয়ের কাছে ফিরতে মন উঠবে কেন তোমার?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মীরা—‘তার চেয়ে নিত্য নতুন⋯বলি হ্যাঁ, সেই মেয়েটির খবর কি? তাকে নিয়েই বুঝি কফি হাউসে বেশ জমানো হয় আজকাল?’

‘কোন্ মেয়েটি?’

‘ন্যাকা সাজছেন। কফি হাউসের গায়েপড়ে ভাব জমানো সেই মেয়ে গো⋯!’

‘গায়ে পড়ে ভাব জমানো তো নয়।’ একটু প্রতিবাদের সুরেই বলে বুঝি অনুপম : ‘সে তো এক কলেজে পড়ত আমার সঙ্গে। আমার সহপাঠিনী তো! কিন্তু তার কথা আজ কেন আবার! সে তো আমাদের বিয়ের আগেই চুকেবুকে গেছে।’

‘বুঝেছি, এড়াতে চাচ্ছো কথাটা! সেই তোমার পুতুল গো! সেই তোমার প্রাণের…আহা, তা কি আমি আর জানিনে। সেই পুতুলের জন্যেই ব্যাকুল হয়ে আপিসের পর বসে থাকো তুমি কফি হাউসে! পুতুলখেলার বয়েস তো তোমার যায়নি এখনও।’

‘থামো! চুপ করো!’ গর্জন করে ওঠে অনুপম : ‘কী যা-তা বকছো পাগলের মতন! পুতুলের সঙ্গে আমার এক যুগ দেখা হয়নি। কোথায় আছে কী করছে কিছু জানি না। তার কথা আবার টেনে আনছ কেন এখানে?⋯এখন বল তো—আমায় খোলসা করে বল, কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ এমন কালববাশেখীর নৃত্য কেন শুনি? আমার নামে কেউ এসে লাগিয়েছে তোমার কাছে?’

‘না ।’

‘না? তাহলে এই রণরঙ্গিণী মূর্তি কেন? কিসের জন্যে? কী হয়েছে?’

‘কিছুই হয়নি। কিচ্ছু না। এসব ভুলে যাও…’ মৃদু মধুর হেসে এগিয়ে এল মীরা। আগের মতই আবার। হঠাৎ মিরাকল দেখা গেল যেন, অনুপম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না—‘ভুলে যাব বলছ?’

‘হ্যাঁ, ভুলে যাও লক্ষ্মীটি! এসব কিছু না।’ গায়ে এসে গড়িয়ে পড়ে বউ : ‘কেমন, মিটে গেল তো সব ?’

‘মিটে গেল!’

‘তুমি কিছু মনে কোরো না। আজ ভোরবেলায় ভারি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখলাম কি জানো, তোমার সঙ্গে আমার দারুণ ঝগড়া বেধেছে। তখন থেকে মনটা আমার ভার হয়ে আছে। ভোরের স্বপ্ন তো ফলবেই। খারাপ স্বপ্ন আবার না ফলে যায় না। তাই স্বপ্নটা যাতে চট করে কেটে যায়, তাড়াতাড়ি ঝগড়ার পালাটা সেরে নিলাম আগে। স্বপ্ন ফলে গেল, চুকে গেল।’ হাসিমুখে জানাল মীরা : ‘যাক্‌ এখন তো সব মিটে গেছে। হাত-মুখ ধুয়ে জলখাবার খাও এখন।’

‘জলখাবার?’

‘আজকে বাইরের খাবার খেতে হবে। বাজার থেকে ভালো মিষ্টি আনিয়ে রেখেছি। নাও, হাতমুখ ধোও এখন, লক্ষ্মীটি!’

জলের বালতি, তোয়ালে, সাবান, স্লিপার সব এনে সে হাজির করে : ‘আমি চট করে গা ধুয়ে নিয়ে উনুনে আঁচ দিই গে। কেমন?’

১৩৬৯ (১৯৬২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *