স্ত্রী-ভাগ্য

স্ত্রী-ভাগ্য

ধীরাজের বিবাহ ও দাম্পত্যজীবন একটা হাসির ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

ধীরাজ আমার ছেলেবেলার বন্ধু; তারপর বড় হইয়া কলিকাতার একই মেসে একই ঘরে বাস করিয়াছি, এবং একই শেয়ার-দালালের অফিসে কেরানীগিরি করিয়াছি। সুতরাং তাহার হৃদয়-মনের একটা স্পষ্ট চিত্র আমার মনে থাকা উচিত। কিন্তু এখন মনে হয় তাহার হৃদয়ের মধ্যে একটা গোপন চোর-কুঠুরি ছিল; সেখানে সে কী রাখিত আমি কোনোদিন জানিতে পারি নাই।

অথচ সে চাপা প্রকৃতির লোক ছিল না। তাহার ছিপ্‌ছিপে লম্বা চেহারা দেখিলে ও ধারালো মুখের শাণিত কথাবাতা শুনিলে মনে হইত সে বিজ্ঞানের ছাত্র; তাহাকে কেরানীশ্রেণীর মানুষ বলিয়া একেবারেই মনে হইত না। সাধারণ মানুষ যে-সকল প্রসঙ্গ সংকোচবশে এড়াইয়া যায় সে তাহা খেলাখুলিভাবে আলোচনা করিত। তখন আমরা দুজনেই অবিবাহিত, সম্পূর্ণ আত্মীয়স্বজনহীন এবং দরিদ্র কেরানী। আমি এখনো দরিদ্র কেরানীই রহিয়া গিয়াছি, কিন্তু ধীরাজের জীবনে এই কয় বছরে এত উন্থানপতন ঘটিয়াছে যে বিস্মিত হইতে হয়।

ধীরাজের বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর, কিন্তু তাহার দেহটা ছিল ঠিক সেই পরিমাণে অলস ও নিষ্কমা। ছুটির দিনে সারাদিন বিছানায় পড়িয়া থাকিত; ঘরে আড্ডা বসিলে সে বিছানায় শুইয়া শুইয়াই আড্ডায় যোগ দিত। অফিসে না গেলে চাকরি থাকিবে না তাই অফিসে যাইত। তাও অফিসের কাজ এমন বেগার-ঠেলা ভাবে করিত যে আমি তাহার অর্ধেক কাজ করিয়া না দিলে চাকরি থাকিত কিনা সন্দেহ।

ধীরাজের বিবাহ একটি বিচিত্র ঘটনা। একটা ছুটির দিনে সকালবেলা আমি বাজারে গিয়াছিলাম, তেল সাবান টুথ-পাউডার প্রভৃতি কিনিবার ছিল। বেলা দশটা নাগাদ ফিরিয়া আসিয়া দেখি, ধীরাজ শয্যাত্যাগ করিয়াছে, দাড়ি কামাইয়াছে, কাপড়-চোপড় পরিয়া তৈরি হইয়া আছে। আমাক দেখিয়া বলিল, ‘চল্, এখনি বেরুতে হবে।’

আমি হাঁ করিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিলাম, ‘তোর আজ হল কি! কোথায় যেতে হবে?’

সে বলিল, ‘পরে শুনিস্। এখন চট্‌ করে ভালো কাপড়-চোপড় প’রে তৈরি হয়ে নে।’

পনরো মিনিটের মধ্যে বাহির হইলাম। রাস্তায় চলিতে চলিতে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে সেটা এবার জানতে পারি কি?’

ধীরাজ বলিল, ‘আমি যাচ্ছি বিয়ে করতে। সিভিল ম্যারিজ্। তুই আমার সাক্ষী।’

রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়াইয়া পড়িলাম, ‘বিয়ে! কার সঙ্গে? কোথায়?’

সে আমার বাহু ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল, ‘বেশী দূর নয়, পাঁচ মিনিটের রাস্তা।’

‘কিন্তু পাত্রী কে? কার মেয়ে?’

‘কার মেয়ে জানি না। পাত্রীকে জানি; নাম ঊষা পাঠক। স্বাধীন মেয়ে, ইন্সিওরেন্সের দালালি করে।’

আবার দাঁড়াইয়া পড়িলাম।

‘কে দালালি করে?’

‘পাত্রী।’

অতঃপর আর কিছু বলিবার রহিল না। বীমার দালালি করে এমন মেয়ে নিশ্চয় আছে, নচেৎ ধীরাজ তাহাকে বিবাহ করিবে কেমন করিয়া? কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর বলিলাম, ‘বিয়ের কথা আগে বলিসনি কেন?

সে বলিল, ‘কী এমন মহামারী ব্যাপার যে ঢাক পিটোতে হবে?’

নানা প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন প্রবলতর হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কোথায় তোদের দেখাশুনো হল তাও জানি না। তা—প্রেম নাকি? প্রেমে পড়েছিস?’

ধীরাজ প্রশ্নের উত্তর দিল না, ঠোঁট টিপিয়া একটু হাসিল।

ইতিমধ্যে আমরা একটি তিনতলা বাড়ির সামনে আসিয়া পোঁছিলাম, সুতরাং আর প্রশ্ন করাও হইল না। ধীরাজ আমাকে লইয়া তিনতলা বাড়ির ডগায় উঠিল।

ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটি ফ্ল্যাট। যে যুবতীটি ফ্ল্যাটের দরজা খুলিয়া দিল সেও বেশ ছিমছাম। সুন্দরী নয়, মুখখানা টিয়াপাখির মতো; কিন্তু চোখে আছে চটুল কটাক্ষ, পরিপক্ক অধরে আছে খুনখারাবি রঙের হাসি। বেশবাস পরিবার ভঙ্গিতে দেহকে আচ্ছাদন করার চেয়ে উন্মোচন করার চেষ্টাই বেশী।

ধীরাজ পরিচয় করাইয়া দিল, ‘আমার বন্ধু মানিক ঘোষ। ঊষা পাঠক— আমার—’

ঊষা পাঠক আমার পানে চোখ বাঁকাইয়া হাসিল।

সুসজ্জিত ঘরে গিয়া বসিলাম। ঘরের সাজসজ্জা দেখিয়া মনে হয় ধীরাজের ভাবী স্ত্রীর পয়সা আছে, বীমার দালালি করিয়া নিশ্চয় অনেক টাকা রোজগার করে।

ঘরে আরও দুটি মানুষ আছে। বিলাতি পোশাক-পরা ফিটফাট দুটি যুবক। একজন বাঙালী, অন্যটি মাড়োয়ারী। ইহারা পাত্রীর বন্ধু, বিবাহে সাক্ষী দিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে।

অল্পক্ষণ পরেই বিবাহের পুরোহিত, অর্থাৎ রেজিস্ট্রার মহাশয় চাপরাসীর হাতে বিরাট খাতা লইয়া উপস্থিত হইলেন। পাত্র-পাত্রীকে দু’একটি সওয়াল-জবাব, খাতায় নাম লেখা, সাক্ষীদের সহি-দস্তখত। ব্যস্‌, বিবাহ হইয়া গেল। ঢাক-ঢোল নাই, বরযাত্রী-কন্যাযাত্রীর কামড়া-কামড়ি নাই, উলু সাতপাক কুশণ্ডিকা নাই, অথচ পাকা বিবাহ। রেজিস্ট্রার মহাশয় দক্ষিণা লইয়া প্রস্থান করিলেন। খাসা বিবাহ।

অতঃপর আমরা সাক্ষীরা জলযোগপূর্বক প্রস্থান করিলাম। নববধূ বঙ্কিম কটাক্ষপাত করিয়া খুনখারাবি রঙের হাসি হাসিল। ধীরাজ বলিল, ‘আচ্ছা, কাল অফিসে দেখা হবে।’

বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। মনটা খারাপ হইয়া গেল। একে তো বিবাহের পদ্ধতিটা নিতান্তই অনভ্যস্ত, তার উপর ঊষা পাঠক মেয়েটাকেও ভাল লাগিল না। তাহার বন্ধু দুটিকে ভাল লাগিল না। তাহাদের চালচলন ভাবভঙ্গি খুবই পরিমার্জিত, তবু ভাল লাগিল না।

ছুটির দিনে বাসার অন্য অধিবাসীরা সকলেই বাসায় ছিলেন, পাশের ঘরে আড্ডা বসিয়াছিল। আমি ফিরিয়া আসিলে দুই-তিন জন আমাদের ঘরে আসিলেন। একজন বলিলেন, ‘কি ব্যাপার বলুন দেখি! ধীরাজবাবু আজ দুপুরের আগেই বিছানা ছেড়ে কোথায় গেলেন?’

মনের দুঃখে ধীরাজের বিবাহের কথা বলিলাম। শুনিয়া সকলে চেঁচামেচি করিতে লাগিলেন, ‘এ কি রকম কথা! ধীরাজবাবু বিয়ে করলেন অথচ আমাদের একবার জানালেন না! না হয় বরযাত্রী না-ই যেতাম, রসগোল্লা না-ই খেতাম’—ইত্যাদি।

সুশীলবাবু নামক এক ভদ্রলোক বলিলেন, ‘বোধ হয় অসবর্ণ বিবাহ। পাত্রীর নাম কি?’

বলিলাম, ‘ঊষা পাঠক।’

সুশীলবাবুর ভ্রুযুগল গুণছেঁড়া ধনুকের মতো লাফাইয়া উঠিল, ‘ঊষা পাঠক! বলেন কি মশাই! সে যে নামজাদা মেয়ে!’

‘নামজাদা মেয়ে! আপনি তাকে চেনেন নাকি?’

সুশীলবাবু বলিলেন, ‘পরিচয় নেই। তবে কীর্তিকলাপ জানা আছে। ছি ছি ছি, ধীরাজবাবু শেষে ঊষা পাঠককে বিয়ে করলেন! এইজন্যই বুঝি কাউকে খবর দেননি।’

‘ঊষা পাঠকের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?’

সুশীলবাবু অরুচিসূচক মুখভঙ্গি করিয়া বলিলেন, ‘অনেক কিছুই জানি; শুধু আমি নয়, আরো অনেকে জানে। ঊষা পাঠক যখন কলেজে পড়ত তখন একটা ছেলের সঙ্গে নটঘট করেছিল, পরে জানাজানি হয়ে যায়; কলেজ থেকে দু’জনকেই তাড়িয়ে দেয়। তারপর ঊষা বীমার দালালি আরম্ভ করে। বীমার দালালিটা ছুতো, আসলে বড়মানুষের ছেলেদের মাথা খাওয়াই ওর পেশা।’

সুশীলবাবুরা চলিয়া যাইবার পর গুম হইয়া বসিয়া রহিলাম। ধীরাজ কি জানিয়া-শুনিয়া একটা নষ্ট-মেয়েকে বিবাহ করিল? কিন্তু কেন? এই লইয়া মেসে ঢিঢিক্কার পড়িয়া যাইবে ভাবিয়া মনটা বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল।

পরদিন ধীরাজ আসিল না। মেসেও ফিরিল না। তারপর মাস-দুয়েক আর তাহার দেখা নাই। তাহার কাপড়-চোপড় বাক্স-বিছানা সবই বাসায় পড়িয়া আছে। তাহার চরিত্র যতদূর জানি তাহা হইতে অনুমান করিলাম সে নব-পরিণীতা স্ত্রীর বাসায় বিছানায় শুইয়া পরমানন্দে দিন কাটাইতেছে। রোজগেরে বৌ যখন পাইয়াছে তখন আর কাজ করিবে কেন? বলা বাহুল্য, চাকরি রহিল না।

আমি ইচ্ছা করিলে তাহার স্ত্রীর বাসায় গিয়া খোঁজখবর লইতে পারিতাম। কিন্তু তাহার স্ত্রীর সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছিলাম তাহার পর আর সেদিকে যাইবার উৎসাহ ছিল না। যাক্‌ গে, মরুক গে, আমার কী,—এইরূপ মনোভাব লইয়া বসিয়া ছিলাম। বাসায় আমার ঘরে ধীরাজের বদলে অন্য লোক আসিয়াছিল।

একদিন বিকালে অফিস হইতে বাহির হইয়া ফুটপাথে পা দিয়াছি, একটি ঝকঝকে নূতন মোটর আসিয়া ফুটপাথ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল। গাড়ির মধ্যে বসিয়া আছে ধীরাজ। তাহার চেহারাও মোটরের মতোই ঝকঝক করিতেছে; পরিধানে পুরু সিল্কের প্যান্টুলুন ও মিহি সিল্কের বুশ-শার্ট, মাথার চক্‌চকে চুল ব্যাক্‌ব্রাশ করা। গাড়ি চালাইতেছে একজন ছোকরা শিখ। দেখিয়া শুনিয়া আমি কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খাইয়া গেলাম।

ধীরাজ গাড়ির দরজা খুলিয়া দিয়া বলিল, ‘আয়, তোকে বাসায় পৌঁছে দিই।’

মনের আড়ষ্টতা দূর হইবার পূর্বেই গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম। গাড়ি চলিতে আরম্ভ করিল।

ধীরাজ আমার পানে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিল, সোনার সিগারেট-কেস আমার সামনে খুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘তুই কি ঘাব্‌ড়ে গেলি নাকি?’

দামী সিগারেট। আমি যে-সিগারেট খাই তাহার এক প্যাকেটের চেয়েও এই একটা সিগারেটের দাম বেশী। ধীরাজ লাইটার জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইয়া দিল। আমি নীরবে দুই-তিন টান দিয়া বলিলাম, ‘কার গাড়ি?’

ধীরাজ ভ্রূ তুলিয়া বলিল, ‘আমার গাড়ি। আর কার?’

প্রশ্ন করিলাম, ‘টাকা কোথায় পেলি?’

ধীরাজের চক্ষু উত্তেজিত হইয়া উঠিল, ‘টাকা—রোজগার করেছি। পাঁচ হপ্তায় সাঁইত্রিশ হাজার টাকা রোজগার করেছি। বিশ্বাস হয়?’

‘বিশ্বাস করা শক্ত। কিসে এত টাকা রোজগার করলি?’

‘শেয়ার-মার্কেটে। এতদিন মিছেই কেরানীগিরি করে মরেছি। যদি গোড়া থেকে ফাট্‌কা খেলতাম—এতদিনে লাখপতি হয়ে যেতাম।’

তাহার মুখচোখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, হঠাৎ অনেক টাকা রোজগার করার উত্তেজনা সে এখানো কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। মনে মনে একটু ঈর্ষা যে অনুভব না করিলাম এমন নয়। বলিলাম, ‘শেয়ার-মার্কেটে জুয়া খেলতে হলে মূলধন দরকার। তুই মূলধন পেলি কোথায়?’

ধীরাজ তখন সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল। বিবাহের পর তাহার স্ত্রী বলিয়াছিল, ‘কেরানীগিরিতে কি পয়সা আছে? তুমি শেয়ার-মার্কেটে যাতায়াত আরম্ভ করো।’

এই বলিয়া তাহাকে দু’হাজার টাকা দিয়াছিল। ধীরাজা শেয়ার-দালালের অফিসে চাকরি করিয়া শেয়ার বেচাকেনা সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জানিত, কিন্তু নিজে কখনো শেয়ারের খেলা খেলে নাই। সে ভয়ে ভয়ে অগ্রসর হইল। কিন্তু এমনি তাহার জোর বরাত, প্রথম হইতেই সে লাভ করিতে আরম্ভ করিল। বৌ তাহাকে শেয়ার সম্বন্ধে ‘টিপ’ সংগ্রহ করিয়া আনিয়া দিত। ক্রমে এমন দাঁড়াইল, সে যে-শেয়ার কেনে সেই শেয়ারের দাম চড়চড় করিয়া চড়িয়া যায়। গত পাঁচ হপ্তায় সে সাঁইত্রিশ হাজার টাকা লাভ করিয়াছে; তারপর মোটর কিনিয়াছে, দেড়শো টাকা মাহিনা দিয়া ড্রাইভার রাখিয়াছে। এখন আরো কিছু টাকা হস্তগত করিতে পারিলেই বালিগঞ্জে বাড়ি কিনিবে।

কাহিনী শেষ করিয়া ধীরাজ বলিল, ‘একেই বলে পুরুষস্য ভাগ্যং।’

মনে মনে ভাবিলাম, স্ক্রিয়াশ্চরিত্রং-ও বটে। মুখে বলিলাম, ‘খাসা বৌ যোগাড় করেছিস। কথায় বলে স্ত্রী-ভাগ্যে ধন। তা তুই তো আর আমাদের পচা মেসে ফিরে আসবি না; তোর জিনিসপত্র আমার কাছে পড়ে রয়েছে, সেগুলো নিয়ে যা।’

ধীরাজ তাচ্ছিল্যভরে বলিল, ‘ও আর এখন কী হবে, তোর কাছেই থাক। পরে দেখা যাবে।’

গাড়ি আসিয়া মেসের সামনে থামিল। আমি নামিবার উপক্রম করিতেছি, ধীরাজ বলিল, ‘তুই একটা লাইফ ইন্সিওরেন্স পলিসি নে না।’

ফিরিয়া বলিলাম, ‘লাইফ ইন্সিওরেন্স পলিসি!’

সে বলিল, ‘হ্যাঁ। আমি পঞ্চাশ হাজারের নিয়েছি। তুই অন্তত দশ হাজারের নে। বিশ বছর পরে টাকা পাবি।’

বলিলাম, ‘তা তো পাব, কিন্তু ততদিন খাব কি? যা মাইনে পাই, প্রিমিয়াম দিয়ে কিছু বাঁচবে কি?’

সে হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা, পাঁচ হাজারের নিস। বেশী প্রিমিয়াম দিতে হবে না, আমার বৌ সব ঠিকঠাক করে দেবে। একদিন আসিস আমার বাসায়।’

আমি উত্তর দিলাম না, গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলাম। গাড়ি চলিয়া গেল। ধীরাজের কপাল খুলিয়াছে, কিন্তু আমার তো খোলে নাই। পেটে ভাত নাই—পাঁচ হাজার টাকার ইন্সিওরেন্স!

মেসের দোরগড়ায় সুশীলবাবুর সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। তিনি ভুরু তুলিয়া বলিলেন, ‘ব্যাপার কি! কার মোটরে চড়ে অফিস থেকে ফিরলেন?’ তিনি পদব্রজে অফিস হইতে ফিরিতেছিলেন।

বলিলাম, ‘ধীরাজের মোটরে চড়ে।’

তাঁহার মুখে বিস্ময় ও অবিশ্বাসের সঙ্গে গভীর অসন্তোষ ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন, ‘তাই নাকি! ধীরাজাবাবু তাহলে এখন স্ত্রীর রোজগারে মোটর হাঁকাচ্ছেন?’

বলিলাম, ‘পুরুষস্য ভাগ্যং। কি করবেন, বলুন।’

সুশীলবাবু হঠাৎ দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন, ‘ঝ্যাঁটা মারি অমন ভাগ্যের মুখে। ইজ্জতের বদলে মোটর গাড়ি! ছ্যাঃ।’ তিনি ঘৃণাভরে পদদাপ করিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। বুঝিলাম, ধীরাজের বিবাহের সংবাদে তিনি যতটা ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন তাহার ভাগ্যোদয়ের সংবাদে ততোধিক অসুখী হইয়াছেন। আমাদের মতো সামান্য সাধারণ মানুষের পক্ষে ইহাই বোধ হয় স্বাভাবিক। ধর্মের জয় এবং অধর্মের ক্ষয় দেখিবার জন্য আমাদের মন সর্বদাই উৎসুক; ইহার ব্যতিক্রম দেখিলে মন খারাপ হইয়া যায়।

ধীরাজের ভাগ্যোন্নতির খবর মেসে প্রচারিত হইল। ধীরাজের অনুপস্থিতিতে আমাকে লক্ষ্য করিয়াই বাক্যবাণ নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল; কারণ আমিই ছিলাম তাহার নিকটতম বন্ধু এবং সম্প্রতি তাহার মোটরগাড়িতে চড়িয়াছি। আমি কিন্তু ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিচলিত হইলাম না, বরং ব্যঙ্গকারীদের দলে ভিড়িয়া গেলাম। তাহাতে প্রতিপক্ষের অভাবে ব্যঙ্গবীরেরা একটু ভগ্নোদ্যম হইলেন বটে, কিন্তু পাঁয়তাড়া কষা একেবারে বন্ধ হইল না। বিশেষত সুশীলবাবু উদ্যোগী পুরুষ, তিনি মাঝে মাঝে বাহির হইতে নূতন খবর সংগ্রহ করিয়া আনিয়া স্তিমীয়মান জল্পনাকে চাঙ্গা করিয়া তুলিলেন।

একদিন তিনি অফিস হইতে ফিরিয়া আমার ঘরে আসিলেন, তক্তপোশের পাশে বসিয়া বলিলেন, ‘আজ এক জবর খবর শুনলাম। ঊষা পাঠক, মানে ধীরাজবাবুর সহধর্মিণী এখন এক মাড়োয়ারী ছোকরার সঙ্গে ধর্মকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। রাত্রে বাড়ি থাকেন না, মাড়োয়ারীর সঙ্গে হোটেলে রাত্রি যাপন করেন। মাড়োয়ারী ছোকরাটি নেহাত হেঁজিপেঁজি নয়, তার বাপ বুলিয়ন-মার্কেটের একজন দিকপাল।’

বিবাহের সময় মাড়োয়ারী সাক্ষীকে দেখিয়াছিলাম মনে পড়িল; ইনি সম্ভবত তিনিই। কিন্তু সুশীলবাবুকে সে-কথা বলিয়া তাঁহার রসদ বাড়াইতে ইচ্ছা হইল না, হাসিয়া বলিলাম, ‘তবেই দেখুন। ধীরাজের বৌকে জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সবাই ভালবাসে। এমনকি মাড়োয়ারী পর্যন্ত।’

সুশীলবাবু বলিলেন, ‘বলিহারি যাই! ছোঁড়াগুলো কি দেখে মজেছে তাও বুঝি না। দাঁত উঁচু, ঠোঁট মোটা—রূপের ধুচুনি!’

বলিলাম, ‘রূপ দেখে কেউ মজে না, সুশীলবাবু! যা দেখে মজে তার খাস বিলিতি নাম হচ্ছে—‘যৌন আবেদন’।’

‘ঝ্যাঁটা মারি!’ বলিয়া সুশীলবাবু উঠিয়া গেলেন।

এইভাবে দিন কাটিতে লাগিল। সুশীলবাবু মাঝে মাঝে বাহির হইতে খবর আনিয়া শোনান; ঊষা পাঠক কোন্ পার্টিতে কত পেগ্ হুইস্কি টানিয়াছে, কাহার সহিত কতবার নাচিয়াছে,—এই ধরনের খবর। কিন্তু যতই দিন কাটিতে লাগিল, ঊষা-ধীরাজের কেচ্ছা ততই বাসী হইয়া পড়িতে লাগিল। ধীরাজের ভাগ্যোদয়ও গা-সওয়া হইয়া গেল। ধীরাজ আমাকে তার বাসায় যাইতে বলিয়াছিল, আমি অবশ্য যাই নাই; সেও আর আসে নাই। ধীরাজ আমাদের জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। ভালই হইয়াছে; ক্ষুদ্র কেরানী আমরা, বড়মানুষের সঙ্গে আমাদের কিসের সম্পর্ক!

অতঃপর প্রায় দুই বছর পরে তাহার সহিত দেখা হইল। এবার আর মোটরগাড়ি নাই; আমার অফিসের সামনে একটা ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। তাহার চেহারার সেই গিল্‌টি-করা চাকচিক্য আর নাই; মুখে একটা শুষ্ক বিবর্ণ ভাব।

আমাকে দেখিয়া ফ্যাকাসে হাসিল, ল্যাম্পপোস্ট হইতে মেরুদণ্ড বিযুক্ত করিয়া বলিল, ‘কি রে, কেমন আছিস?’

আমি এদিক-ওদিক চাহিলাম, ‘তোর মোটর কোথায়?’

‘মোটর—’ সে কথা পাল্‌টাইয়া বলিল, ‘তুই বাসায় ফিরবি তো? বাসে যাবি, না হেঁটে?’

‘হেঁটে। এখন বাসে চড়া অসাধ্য।’

‘চল্ তবে, আমিও খানিকদুর তোর সঙ্গে হাঁটি।’

দু’জনে পাশাপাশি চলিলাম। কথাবার্তা নাই। তাহার সহিত যেন মনের সংযোগ ছিঁড়িয়া গিয়াছে। শেষে সে নিজেই বলিল, ‘মোটরটা বিক্রি করে ফেলতে হল। তিন মাস ধরে ক্রমাগত লোকসান চলেছে। বাজারের ধার শোধ করতে হবে তো।’

‘নগদ টাকাও শেষ হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। নগদ বেশী ছিল না। বৌ—’ বলিয়া ধীরাজ থামিয়া গেল।

চকিতে তাহার পানে চাহিলাম, ‘বৌ কোথায়?’

ধীরাজ কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘বৌ এখানে নেই। ব্যাঙ্কে জয়েন্ট-অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল, সে সব টাকা নিয়ে গেছে।’

‘কোথায় গেছে? কদ্দিন গেছে।’

‘মাস-তিনেক হল। বোধহয় বোম্বাই গেছে।’

‘বোধহয় বোম্বাই গেছে—তার মানে? তোকে কিছু বলে যায়নি?’

ধীরাজ চুপ করিয়া রহিল। বুঝিলাম বৌ টাকাকড়ি হস্তগত করিয়া পালাইয়াছে। হয়তো মাড়োয়ারী নাগর সঙ্গে আছে।

মনটা নিষ্ঠুর হইয়া উঠিল; বলিলাম, ‘কার সঙ্গে পালালো? মাড়োয়ারীর সঙ্গে?’

ধীরাজ আমার পানে একটা গুপ্ত কটাক্ষ হানিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল; অস্পষ্টস্বরে বলিল, ‘না, না, তুই ভুল শুনেছিস। মাড়োয়ারী নয়। বৌ ইন্সিওরেন্সের কাজে গেছে, বম্বেতে ওদের হেডঅফিস—’

‘তুই এখন আছিস কোথায়?’

‘বৌ-এর বাসাতেই আছি। বছরখানেকের ভাড়া আগাম দেওয়া ছিল, এখনো ছ’মাসের মেয়াদ আছে।’

‘তাই সেখানেই পড়ে আছিস? তোর মতো বেহায়া দেখিনি। তুই যদি মানুষ হতিস, বৌকে ডিভোর্স করতিস।’ বলিয়া আমি সবেগে পা চালাইলাম। রাগে আমার গা জ্বালা করিতেছিল।

ধীরাজ কিন্তু আমার সঙ্গ ছাড়িল না, সেও পা চালাইল। কিছুদূর চলিবার পর হঠাৎ বলিল, ‘আমাকে পাঁচ-শো টাকা ধার দিতে পারিস?’

প্রথমটা ধাঁধা লাগিয়া গিয়াছিল, তারপর হাসিয়া উঠিলাম, ‘ও—এইজন্যেই আমাকে মনে পড়েছে! টাকা ধার চাই! তা আমি কত মাইনে পাই তো জানিস। পাঁচ-শো টাকা জলে ফেলে দেবার মতো অবস্থা আমার নয়।’

সে বলিল, ‘আমি বম্বে থেকে ফিরেই তোর টাকা শোধ করে দেব।’

‘বুঝেছি, বম্বে যাওয়ার জন্যে টাকা দরকার। বৌকে ফিরিয়ে আনবি! তা—ভাল কথা। কিন্তু আমি টাকা ধার দিতে যাব কেন? আমার টাকা অত সস্তা নয়।’

আমি আরো জোরে পা চালাইলাম। এবার ধীরাজ আমার সঙ্গে তাল রাখিবার চেষ্টা করিল না, আস্তে আস্তে পিছাইয়া পড়িল। আমি কিছুদূর গিয়া ঘাড় ফিরাইলাম। সে ফুটপাথের মাঝখানে দাঁড়াইয়া যেন কি চিন্তা করিতেছে। তারপর পিছু ফিরিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

বাসায় ফিরিতেই সুশীলবাবু ঘরে আসিয়া বসিলেন, ‘আপনার বন্ধুপত্নীর নতুন খবর শুনেছেন?’

বলিলাম, ‘শুনেছি, বম্বে পালিয়েছে। খবর কিন্তু নতুন নয়, তিন মাসের পুরনো।’

সুশীলবাবু একটু নিরাশ হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, ‘তা যেন শুনেছেন। কিন্তু কার সঙ্গে পালিয়েছে তা জানেন কি?’

‘না। কার সঙ্গে?’

সুশীলবাবু বিজয়দর্পিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘ওটাই তো আসল খবর। পালিয়েছে ধীরাজবাবুর ড্রাইভারের সঙ্গে!’

‘ড্রাইভার! মানে মোটর-ড্রাইভার?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা ঝুঁটি-বাঁধা শিখ ছোঁড়া ছিল, তার সঙ্গে ভেগেছে। গলায় দড়ি—গলায় দড়ি! একটা বাঙালী জুটল না, শেষকালে শিখ! বাঙালীর মুখে চুনকালি পড়তে আর কী বাকি রইল?’

ঊষা যদি শিখের বদলে বাঙালীর সঙ্গে পালাইত তাহা হইলে কিরূপে বাঙালীর গৌরব বৃদ্ধি হইত বুঝিলাম না। যাহোক, সুশীলবাবু উষ্ণ ক্ষোভ প্রকাশ করিতে করিতে প্রস্থান করিলে আমি ধীরাজের কথাই ভাবিতে লাগিলাম। যে-বৌ শিখ-ড্রাইভারের সঙ্গে কুলত্যাগ করিয়াছে, ধীরাজ তাহাকে খুঁজিতে যাইতেছে। যদি খুঁজিয়া পায় তাহাকে ঘরে ফিরাইয়া আনিবে। পতিব্রতা নারীর গল্প শুনিয়াছি, পঙ্গু স্বামীকে কাঁধে তুলিয়া বেশ্যালয়ে গিয়াছিলেন; কিন্তু পুরুষ সম্বন্ধে এরূপ রূপকথা শুনিয়াছি বলিয়া মনে পড়িতেছে না। ধীরাজ একটা নূতন আদর্শ সৃষ্টি করিল।

কিন্তু কেন? প্রেম? নিকষিত হেম? ইহাই যদি প্রেম হয় তবে ঝাড়ু মারি আমি প্রেমের মুখে।

মাস-তিনেক পরে সুশীলবাবুই আবার নূতন খবর আনিলেন। লোকটির সংবাদ সংগ্রহ করিবার ক্ষমতা অসামান্য। কেন যে সংবাদপত্রের রিপোর্টার না হইয়া কেরানীগিরি করিতেছেন তাহা তিনিই জানেন। বলিলেন, ‘ধীরাজবাবু শিখ-ড্রাইভারের হাত ছাড়িয়ে বৌকে ফিরিয়ে এনেছেন, মনের সুখে ঘরকন্না করছেন।’

‘তাই নাকি! অবস্থা কেমন?’

‘অবস্থা খুবই উন্নত। কিন্তু শিখ-ড্রাইভারকে বোধহয় ফিরিয়ে আনেননি, এখন নিজেই মোটর হাঁকাচ্ছেন। আবার নূতন গাড়ি, কাঁচপোকার মতো রঙ!’

আমার বন্ধুর তালিকা হইতে ধীরাজের নাম কাটিয়া দিয়াছি। আমি যদি কোনোদিন বিবাহ করি, পাড়া-গাঁ হইতে একটা হাবাগোবা মেয়ে দেখিয়া বিবাহ করিব। তথাপি যদি সে কাহারও সহিত পলায়ন করে, তাহাকে ত্যাগ করিয়া আর একটা হাবাগোবা মেয়ে বিবাহ করিব। আমার জীবনাদর্শের সহিত ধীরাজের জীবনাদর্শের কোনও মিল নাই।

মাসখানেক পরে একদিন ধীরাজ-দম্পতিকে স্বচক্ষে দর্শন করিলাম। সিনেমা দেখিতে গিয়াছিলাম, ছবি শেষ হইলে ভিড়ের মধ্যে গুঁতাগুঁতি করিতে করিতে পথে বাহির হইয়াছি, দেখি ধীরাজ একটা কাঁচপোকা-রঙের চকচকে নূতন গাড়িতে স্টীয়ারিং হুইলের পিছনে উঠিয়া বসিল, তাহার স্ত্রী পাশে বসিল। ধীরাজের চেহারা এবং বেশভূষায় আবার লক্ষ্মীশ্ৰী ফুটিয়া উঠিয়াছে। কাঁচপোকা-রঙের মোটর মোলায়েম সুরে হর্ন বাজাইয়া চলিয়া গেল। আমাকে বোধ হয় দেখিতে পায় নাই।

তারপর আরো দেড় বছর কাটিয়া গিয়াছে, ধীরাজকে প্রায় ভুলিয়া গিয়াছি। সে বালিগঞ্জে বাড়ি কিনিল কিনা খবর রাখি নাই। সুশীলবাবুর অনুসন্ধিৎসাও আর নাই, মেসে ধীরাজকে লইয়া ঠাট্টা-তামাসাও থামিয়া গিয়াছে। একই কেচ্ছা লইয়া মানুষ কতকাল ঘাঁটাঘাঁটি করিতে পারে? অনেক নূতন কেচ্ছা আসিয়া পুরাতনকে স্থানচ্যুত করিয়াছে।

একদিন রবিবার দুপুরবেলা দিবানিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিয়া দেখি ধীরাজ তক্তপোশের পাশে বসিয়া আছে। আবার সেই পুনর্মুষিক অবস্থা। বেশবাস অপরিচ্ছন্ন, চুলে তেল নাই, মুখ শুষ্ক।

কোনও কথা না বলিয়া উঠিয়া গেলাম। চোখেমুখে জল দিয়া আসিয়া তাহার পাশে বসিলাম।

‘কী, আবার বৌ পালিয়েছে! এবার আর সঙ্গে পালাল? গুজরাতী না মাদ্রাজী?’

সে উত্তর দিল না, মুখখানা কেমনধারা করিয়া বসিয়া রহিল। বলিলাম, ‘তা মুখ বুজে বসে যাকলে কি হবে, কোমর বেঁধে বেরিয়ে পড়্‌, বৌকে খুঁজে ঘরে নিয়ে আয়। আমি কিন্তু টাকা ধার দিতে পারব না।’

ধীরাজ আস্তে আস্তে বলিল, ‘ঊষা কলকাতাতেই আছে…তাকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এল না—’ পকেট হইতে একটুকরা কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিল।

কাগজের ভাঁজ খুলিয়া দেখিলাম, তাহাতে মেয়েলি অক্ষরে লেখা আছে—‘তোমার সঙ্গে আর আমার পোযাচ্ছে না, আমি আর একজনের সঙ্গে চললাম। তুমি এই চিঠির জোরে ডিভোর্স নিতে পার। —ঊষা।’

চিঠি ফেরত দিয়া বলিলাম, ‘তবে তো রাস্তা খোলা। কার সঙ্গে পালিয়েছে?’

ধীরাজ পূর্ববৎ ম্রিয়মাণ সুরে বলিল, ‘শিরাজ ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তার ছেলের বাড়িতে আছে। বাড়ির ফটকে দারোয়ানের পাহারা, আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’

‘তাহলে আবার বৌকে ফিরিয়ে আনতে চাস্! ধন্যি তুই। ধন্যি তোর ভালবাসা!

সে ক্লান্তস্বরে বলিল, ‘তুই সবই ভুল বুঝেছিস। ভালবাসা নয়। কিন্তু যাক। আমাকে পুরনো চাকরিটা আবার জুটিয়ে দিতে পারিস? টাকাকড়ি সব গেছে, বাসাটাও হপ্তাখানেকের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।’

বলিলাম, ‘চাকরি খোয়ানো যত সহজ, জোটানো তত সহজ নয়। চেষ্টা করে দেখতে পারি।’

‘দেখিস। বাক্স-বিছানা সব আছে তো? আচ্ছা, আজ উঠি, কাল দেখা করব। —ঊষা বড় পয়মন্ত ছিল।’

চাপা নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরাজ চলিয়া গেল।

পরদিন বিকালে অফিস হইতে বাহির হইয়া দেখি ধীরাজ ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আমাকে দেখিয়া মুখে হাসি আনিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল। ধীরাজের জীবন-প্রহসন যে এমন ট্র্যাজিক সুরে পরিসমাপ্তি লাভ করিবে তাহা কল্পনা করিতে পারি নাই।

সবেমাত্র অফিস-আদালতের ছুটি হইয়াছে, রাস্তা দিয়া বাস ও মোটরের উদ্দাম স্রোত বহিয়া যাইতেছে। আমি ফুটপাথে তাহার পাশে গিয়া দাঁড়াইয়াছি, হঠাৎ রাস্তায় একটা বিশেষ রকমের মোটর-হর্নের আওয়াজ শুনিয়া ধীরাজ তীরবিদ্ধের ন্যায় ঘুরিয়া দাঁড়াইল। তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম, একটা প্রকাণ্ড মোটর-গাড়ি মন্থর গতিতে যাইতেছে; গাড়িতে বিলাতি বেশধারী মালিক-চালকের পাশে বসিয়া আছে ধীরাজের স্ত্রী ঊষা। তাহাদের গাড়ি আমাদের ছাড়াইয়া কিছুদূর গিয়াছে, ধীরাজ চিৎকার করিয়া ফুটপাথ হইতে রাস্তায় নামিয়া গাড়ির পিছন পিছন ছুটিল। তারপর—

বিকাল সাড়ে-পাঁচটার সময় সদর রাস্তা দিয়া পাগলের মতো ছুটিলে যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহাই ঘটিল।

একটা দ্রুতগামী বাস তাহাকে ধাক্কা দিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দিল, বিপরীত দিক হইতে অন্য একটা বাস তাহাকে মাড়াইয়া চলিয়া গেল—

ধীরাজের মনস্তত্ত্ব বুঝিবার চেষ্টা করি। সে বলিয়াছিল—ভালবাসা নয়। তবে কী? সে বুদ্ধিমান ও অলসপ্রকৃতির মানুষ ছিল। তাহার মনে টাকার ক্ষুধা ছিল, ভোগবিলাসের লোভ ছিল। বিবাহের পর তাহার কপাল খুলিয়াছিল; আবার বৌ পালাইবার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার দারুণ অবনতি হইয়াছিল। ধীরাজের বিশ্বাস জন্মিয়াছিল বৌ তাহার ভাগ্যদাত্রী; তাই সে প্রাণপণে নষ্ট-চরিত্র স্ত্রীকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিল। ইহাই কি তাহার মনস্তত্ত্ব? এ ছাড়া আর কি হইতে পারে? কিংবা—হয়তো—

ঊষা পাঠক ধীরাজকে কেন বিবাহ করিয়াছিল সে-রহস্য আমি ভেদ করিতে পারি নাই। স্বৈরিণী নারীর মন বোঝা আমার কর্ম নয় তবে ঊষা যে ভাগ্যবতী নারী তাহাতে সন্দেহ নাই। ধীরাজের জীবনবীমার পঞ্চাশ হাজার টাকা সে পাইয়াছে।

১৪ শ্রাবণ ১৩৬৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *