স্ত্রী না রাক্ষসী

স্ত্রী না রাক্ষসী

প্রথম পরিচ্ছেদ 

কাৰ্ত্তিক মাস; কিন্তু বেশ শীত পড়িয়াছে। কলিকাতায় মহাধূম। কি একটা যোগ উপলক্ষে বিদেশ হইতে দলে দলে যাত্রীর সমাগম হইতেছে। যেখানে যত খালি বাড়ী ছিল, প্রায় সকলগুলিই ভাড়া হইয়া গিয়াছে। কলিকাতায় আর লোকের স্থান হইতেছে না। মিউনিসিপ্যাল কর্ম্মচারিগণ সহরের সুবন্দোবস্তের জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছেন। যোগের পূর্ব্বদিন বেলা নয়টার সময় আমি স্নান করিতেছি, এমন সময়ে সংবাদ পাইলাম, একজন বৃদ্ধ আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান। তাঁহার বাড়ীতে খুন হইয়াছে। সেই সময় আমি ভবানীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী। যতশীঘ্র পারিলাম, স্নান সমাপন করিয়া অফিস-ঘরে গমন করিলাম। দেখিলাম, এক বৃদ্ধ ঘরের মধ্যস্থলে নিশ্চল নিস্পন্দবৎ দণ্ডায়মান রহিয়াছেন। তিনি এত গভীর চিন্তায় নিমগ্ন, যেন তাঁহার বোধ হইল, বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হইয়াছে। তিনি নির্নিমেষনয়নে অফিস ঘরের টেলিফোনের যন্ত্রটির দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন। বুদ্ধের বয়স প্রায় সত্তর বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, কিন্তু তাহাতে লাবণ্য নাই। তাঁহার মস্তকের সমস্ত কেশ শুভ্র; শরীরের মাংস শিথিল, চক্ষু কোটরগ্রস্ত এবং জ্যোতিহীন। বৃদ্ধের পরিধানে একখানি মোটা ধুতি, গায়ে একখানা নামাবলী, তাহার উপরে একখানা লাল বনাত, পায়ে ঠঠনের চটিজুতা। বৃদ্ধ যেরূপ ভাবে অফিস ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে উন্মাদ বলিয়া বোধ হইল। 

আমার জুতার শব্দে বৃদ্ধের চমক ভাঙ্গিল, তিনি আমার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। পরে কৃতাঞ্জলি হইয়া অতি করুণস্বরে বলিলেন, “মহাশয়, রক্ষা করুন! রক্ষা করুন! আমার সর্বনাশ হইয়াছে, রক্ষা করুন! এই গরিব ব্রাহ্মণকে রক্ষা করুন।” 

বৃদ্ধ যে বিষম বিপদে পড়িয়াছেন, তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম। আমি মিষ্টকথায় তাঁহাকে কিয়ৎপরিমাণে শান্ত করিলাম। পরে তাঁহার হাত ধরিয়া নিকটস্থ একখানি বেঞ্চের উপর বসাইয়া দিলাম। কলের পুত্তলিকার মত বৃদ্ধ সেইখানে বসিয়া পড়িলেন। আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম “মহাশয়ের কোথা হইতে আসা হইতেছে? আপনার কি করিতে হইবে বলুন?” 

বৃদ্ধ অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন “আমার বাড়ী কালীঘাটে। সেখানে একটা খুন হইয়াছে। আপনি আমাকে সেই খুনের দায় হইতে মুক্ত করুন।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম; ভাবিলাম, কালীঘাটে ভদ্রলোকের ঘরে খুন! তীর্থস্থানে নরহত্যা!! কলিকালে আর কিছু বাকী রহিল না দেখিতেছি। প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার বাড়ীতেই কি খুন হইয়াছে?” 

বৃ। আজ্ঞে হাঁ। আমারই বাড়ীতে খুন হইয়াছে। এইবার দেখিতেছি, আমার নাম গেল, যশ গেল, শেষে আমার একমাত্র উপজীবিকা পর্যন্ত নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে। 

আ। কে খুন হইয়াছে? আপনার সহিত তাহার সম্বন্ধ কি? 

বৃ। আমার একজন ভাড়াটিয়া। 

আ। আপনার বাড়ীতে ক’জন ভাড়াটীয়া আছে? 

বৃ। আমার বাড়ীটি দ্বিমহল। ভিতর মহলে আমি সপরিবারে বাস করি, বাহির মহলে ভাড়া দিয়া জীবিকা উপার্জ্জন করি। কালীঘাটে প্রত্যহই অনেক যাত্রীর সমাগম হইয়া থাকে। আমি সেই যাত্রী সকলকেই বাড়ীর বাহির মহল দৈনিক হিসাবে ভাড়া দিয়া থাকি। এই যোগ উপলক্ষে বিদেশের অনেক যাত্রী আদিগঙ্গার স্নান করিবার জন্য কালীঘাটে সমবেতে হইয়াছে। অনেক লোকের সমাগম হওয়ায়, আমার বাহির মহলের সমস্ত ঘরগুলিই তিন চারি দিনের মত ভাড়া হইয়া গিয়াছে। এই সকল ভাড়াটিয়ার মধ্যে বোধ হয় একজন খুন হইয়াছে। 

আমি তাঁহার কথায় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “বোধ হয় কেন? আপনি কি না জানিয়াই এখানে আসিয়াছেন?” 

বৃদ্ধ আমার কথায় বিরক্ত হইলেন না। বলিলেন “আমার মন বড় চঞ্চল, আমি সকল কথা ভাল করিয়া বলিতে পারিতেছি না।” 

এরূপ নম্র ভাবে বৃদ্ধ এই কথাগুলি বলিলেন, যে তাঁহার কথায় আমার কোন সন্দেহ হইল না। বলিলাম “আপনি স্থির হইয়া আমায় সকল কথা গুছাইয়া বলুন। যদি আপনি বাস্তবিক নির্দোষী হন, তাহা হইলে আপনার ভয়ের কোন কারণ নাই। যেরূপে পারি, আপনাকে রক্ষা করিব।” 

আমার কথা শুনিয়া বৃদ্ধ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে বসিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন, “জগদীশ্বর আপনার মঙ্গল করিবেন। আমি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ – আপনার পিতার সদৃশ। দেখিবেন, আমার কথা নিষ্ফল হইবে না।” 

বৃদ্ধের আশীর্ব্বাদে আমার মনে কেমন এক প্রকার অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল। আমি অতি বিনীত ভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। তিনি বলিলেন “গত কল্য বেলা প্রায় চারিটার সময় এক ভদ্রলোক সস্ত্রীক আমার বাড়ীতে উপস্থিত হন এবং বাড়ীর একটি ঘর ভাড়া লইবার প্রস্তাব করেন। সর্ব্বশুদ্ধ ষোলখানি ঘর আমি ভাড়া দিয়া থাকি। উপরে আটখানি, নীচে আটখানি। ঘরগুলি ছোট হইলেও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আলোক ও বায়ুনির্গমনের সুব্যবস্থা আছে। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, নীচের সমস্তগুলি ও উপরের ছয়খানি মধ্যে একখানি মনোনীত করিলেন। তিনদিনের জন্য ঘরখানির পাঁচ টাকা ভাড়া হইল। তিনি ভাড়া অগ্রিম দিলেন। ঘরখানির চাবি তাঁহার হস্তে দিয়া আমি চলিয়া আসিলাম। আজ বেলা সাতটার পর আমি তাঁহার ঘরের সম্মুখস্থ বারান্দার ভিতর দিয়া বাহিরে আসিতেছি, দেখিলাম, গৃহের দ্বার তখনও আবদ্ধ। আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, ইঁহারা তীর্থে গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়াছেন, বেলা সাতটা বাজিয়া গেল, সকলের একবার দর্শন হইয়া গেল, তাঁহারা কি না তখনও নিদ্ৰা যাইতেছেন! পরক্ষণেই মনে হইল, তিনি অনেক দূর হইতে আসিয়াছেন, বোধ হয়, পথশ্রমে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। শীতকালের বেলা, সাতটা বাজিলেও এখনও বেশ পরিষ্কার হয় নাই, সুতরাং তাঁহাদের নিদ্রা দূষণীয় বা নিন্দনীয় হইতে পারে না। এই স্থির করিয়া চলিয়া আসিতেছি, এমন সময়ে দরজার চৌকাটের নিম্নে জলনির্গমনের ছিদ্রপথে রক্তের চিহ্ন দেখিতে পাইলাম। আমার কেমন সন্দেহ হইল। আমি সেইখানে বসিয়া ভাল করিয়া সেই ছিদ্রটি পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, ঘরের ভিতর হইতে একটি রক্তস্রোত সেই ছিদ্রপথ দিয়া প্রবাহিত হইয়া বারান্দায় পতিত হইতেছে। আমার ভয় হইল। দরজায় ধাক্কা দিয়া আমি তাঁহাদিগকে ডাকিতে লাগিলাম, কিন্তু ভিতর হইতে কোন উত্তর পাইলাম না। দেখিতে দেখিতে অনেক লোক সেই দরজার নিকট উপস্থিত হইল, অনেকেই তাঁহাদিগকে চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল। বাড়ীতে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। অন্দরে পর্যন্ত এই সংবাদ পঁহুছিল। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ঘরের ভিতর হইতে কোন উত্তর পাওয়া গেল না। কেহ কেহ দরজা ভাঙ্গিয়া ঘরে প্রবেশ করিবার পরামর্শ দিল। কিন্তু আমার বড় ভয় হইল, আমি দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে সাহস করিলাম না। ভাবিলাম, আপনারা আসিয়া যাহা ইচ্ছা করিবেন। এখন আপনিই ভরসা, যেরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহাতে ভবিষ্যতে আমার বাড়ীতে যে আর কোন লোক ভাড়া আসিবে, তাহা বোধ হয় না।” 

এই বলিয়া ব্রাহ্মণ নিস্তব্ধ হইলেন। আমি তখনই কয়েকজন কর্মচারীর সহিত কালীঘাট অভিমুখে গমন করিলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যখন আমরা বৃদ্ধের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা এগারটা বাজিয়া গিয়াছে। নকুলেশ্বর-তলা হইতে বৃদ্ধের বাড়ী প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ। বাড়ীখানি দেখিতে প্রকাণ্ড কিন্তু পুরাতন। তাহার উভয় পার্শ্বে উদ্যান। 

বাড়ীখানি দেখিয়া বোধ হইল, বহুকাল তাহার সংস্কার হয় নাই। বাহিরের দেওয়ালগুলিতে একটুও বালি নাই। অধিকাংশ স্থানে ইষ্টকগুলি পৰ্য্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে। কোন কোন স্থানে শৈবাল হইয়াছে, কোথাও বা অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি অমর বৃক্ষাবলী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। 

বাড়ীখানি দ্বিমহল। বাহির মহলে সর্ব্বশুদ্ধ ষোলখানি ঘর। সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র ব্রাহ্মণ আমাকে উপরে লইয়া গেলেন এবং যে গৃহের দ্বার দিয়া রক্ত নির্গত হইতেছিল, তাহা দেখাইয়া দিলেন। 

আমি কিছুক্ষণ সেই রক্তচিহ্ন লক্ষ্য করিয়া দ্বারে আঘাত করিলাম, ভিতর হইতে কোন উত্তরু পাইলাম না। তখন আর কালবিলম্ব না করিয়া সমভিব্যাহারী কর্মচারিগণকে দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে আদেশ করিলাম। 

পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, ব্রাহ্মণের বাড়ীখানি পুরাতন, দরজা ভাঙ্গিতে বিশেষ কষ্ট হইল না। আমি তখনই ভিতরে প্রবেশ করিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, ঘরের মেজের উপর এক সম্ভ্রান্ত যুবক চিৎ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে; তাঁহার বক্ষে একখানি ক্ষুদ্র ছোরা আমূল বিদ্ধ। সেই ক্ষতস্থান দিয়া রক্তস্রোত প্রবাহিত হইয়াছে, এবং ঘরের মধ্য দিয়া দরজায় চৌকাটের নিম্নে যে জলনির্গমনের পথ ছিল, সেই পথে প্রবেশ করিয়াছে। 

ঘরখানি ক্ষুদ্র; দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আট হাতের অধিক নহে। প্রায় প্রত্যহই নূতন ভাড়াটীয়া বাস করে বলিয়া বড়ই অপরিষ্কার। ঘরে মেজেয় ধূলা জমিয়া রহিয়াছে। আবাবের মধ্যে একটি ট্রাঙ্ক, একখানি গামছা, দুইখানি কাপড়, একখানি আলোরান ও একটি বনাতের কোর্ট। ঘরের একপার্শ্বে একটি মাদুর, তাহার উপর একখানা সতরঞ্চ ও দুইটা বালিস। যুবক সেই বিছানায় চিৎ হইয়া পড়িয়া ছিলেন। 

ক্ষুদ্র হইলেও ঘরখানিতে দুইটি জানালা ছিল। দেখিলাম, তাহার একটি খোলা, অপরটি বন্ধ 

ঘরের চারিদিক এইরূপে লক্ষ্য করিয়া আমি যুবককে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, তিনি অনেক পূৰ্ব্বেই ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে, ক্ষতমুখ দিয়া রক্তনির্গমন বন্ধ হইয়াছে। যুবকের গলদেশ একগাছি রজ্জু দ্বারা আবদ্ধ। যুবকের মুখের ভয়ানক আকৃতি দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইল যে, সেই দড়িতেই তাঁহার শ্বাসরুদ্ধ হইয়াছিল। 

দেখিতে দেখিতে ঘরে অনেক লোকের সমাগম হইল। বাড়ীতে খুন হইয়াছে শুনিয়া, চারিদিক হইতে দলে দলে লোক আসিতে লাগিল। আমি দুইজন কনেষ্টবলকে ভিড় সরাইতে আদেশ করিলাম। তাহারা অতি কষ্টে আমার আদেশ পালন করিতে সক্ষম হইল। 

বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ব্যতীত আর সকলকে সেই ঘর হইতে বাহির করিয়া আমি দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলাম। পরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “দেখুন সদানন্দবাবু! আপনি ভিন্ন এখানে আপনার আর কে আছে?” 

স। আমার স্ত্রী, আমার পুত্র ও এক বিধবা কন্যা। ইহা ভিন্ন একজন চাকর ও পাঁচজন দাসীও এখানে থাকে।

আ। আপনার পরিবার তত বড় নহে, পাঁচজন দাসীর প্রয়োজন কি? 

স। তাহারা কেবল আমার সেবার জন্য নহে; আমার প্রজা বা ভাড়াটীয়াদিগের কার্য্য করিয়া থাকে। আমি কেবল চাকরের মাহিনা দিয়া থাকি। দাসীদিগকে বেতন দিতে হয় না। তাহারা কেবল আমার বাড়ীতে দুইবেলা আহার করিয়া থাকে মাত্র। যাত্রীদিগের কার্য্য করিয়া তাহারা বেশ দু-পয়সা উপার্জ্জন করিয়া থাকে। 

আ। দাস-দাসীগণ কোথায় রাত্রিবাস করে? 

স। এই বাড়ীতেই। যে সকল যাত্রী প্রায় আমার এখানে আসিয়া থাকেন, তাঁহাদের অধিকাংশই আহারাদি করিয়া সায়ংকালে প্রস্থান করেন। সুতরাং পাঁচ ছয়জনের বাসোপযোগী যথেষ্ট স্থান থাকে। 

আ। এই যুবকের নাম কি জানেন? 

স। আজ্ঞে হাঁ-যখন তিনি আমাকে ভাড়া দেন, তখন তাঁহাকে একখানি রসিদ দিতে হইয়াছিল। সেই সময়ে তাঁহার নাম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তাঁহার নাম বগলাচরণ মিত্র। জাতিতে কায়স্থ। ভাল কতা, এতক্ষণ আমার স্মরণ ছিল না, ইঁহার সঙ্গিনী কোথায় গেলেন? 

আ। সঙ্গিনী কে? 

স। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, এই বাবু সস্ত্রীক এখানে আসিয়াছিলেন। তিনি গেলেন কোথায়? ইতিপূব্বেই আমার ওই প্রশ্ন মনোমধ্যে উদিত হইয়াছিল। যুবক যে সস্ত্রীক এখানে আসিয়াছিলেন, তাহা আমি ভুলি নাই। সে কথা আমার বেশ স্মরণ ছিল। 

কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমি ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহার বয়স কত?”

স। আন্দাজ সতের বৎসর। বেশ সুন্দরী। লোকজন সঙ্গে না লইয়া যোগে গঙ্গাস্নানের জন্য কলিকাতায় আগমন করিয়াছিলেন, এখন সেই রমণী কোথায় গেলেন? 

আ। এই হত্যাকাণ্ড বড় সামান্য ব্যাপার মনে করিবেন না। ইহার মধ্যে কোন গূঢ় রহস্য আছে। যুবতী হয় পলায়ন করিয়াছে; নচেৎ কোন শত্রু কর্তৃক কৌশলে অপহৃত হইয়াছে। 

স। হত্যাকারী কি করিয়া ঘর হইতে বাহির হইল, বুঝিতে পারিলাম না। কোন্ পথ দিয়াই বা সে রমণীকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। আপনি স্বয়ং দেখিয়াছিলেন যে, ঘরের দরজা ভিতর হইতে আবদ্ধ ছিল, আপনি স্বয়ংই দরজা ভাঙ্গিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছেন। 

আমি পূৰ্ব্বেই একথা ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু কোন কার্য্য করিতে হইলে প্রথম হইতে আরম্ভ করাই কর্তব্য। বিশৃঙ্খলভাবে কার্য্য করিলে শেষে বিষম বিড়ম্বনায় পতিত হইতে হয়। 

সে যাহা হউক, ব্রাহ্মণের কথায় কোন উত্তর না করিয়া আমি ঘরের মেজে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম, মেজের উপর তিন প্রকার পদচিহ্ন! ঘরে যকন দুইজনের 

অধিক লোক ছিল না, তখন তৃতীয় পদচিহ্ন কোথা হইতে আসিল? 

ঘরের সকল স্থানে ধূলা ছিল না বটে, কিন্তু তাহার অধিকাংশই ধূলিময়। সেই স্থানে তিনপ্রকার পদচিহ্ন স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম। হতব্যক্তির পদচিহ্ন আমি চিনিতে পারিলাম। তদপেক্ষা ক্ষুদ্র পদচিহ্নকে তাঁহার সঙ্গিনীর বলিয়া বোধ হইল। এই দুই প্রকার পদচিহ্ন ভিন্ন আর একপ্রকার পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম। সেগুলি হতব্যক্তির পদচিহ্ন অপেক্ষা কিছু বড় ও স্থূল। এ চিহ্ন কোথা হইতে আসিল? ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, সে ঘরে ওই দুইজন ভিন্ন আর কোন লোক ছিল না। রমণীই বা কোথায় গেল? তবে কি সেই স্বামীকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে? কি করিয়াই বা সে গৃহ হইতে পলায়ন করিবে? যখন ঘরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তখন সে পথ দিয়া যে কেহ বাহির হয় নাই, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। তবে কোন্ পথে হত্যাকারী পলায়ন করিয়াছে, দেখিতে হইবে। আগেই বলিয়াছি, ঘরটিতে দুইটি জানালা ছিল। এই দারুণ শীতে ঘরের জানালা খুলিয়া কেহ শয়ন করে না। ইহারাই বা একটি জানালা খুলিয়া রাখিয়াছিলেন কেন, জানিবার কৌতূহল জন্মিল। আমি তখন আস্তে আস্তে খোলা জানালাটির নিকট গমন করিলাম, যাহা দেখিলাম, তাহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, হত্যাকারী সেই পথ দিয়া পলায়ন করিয়াছে। দেখিলাম, জানালার একটি গরাদ আল্গা। ইচ্ছা করিলে সেটিকে খোলা যায়, এবং তাহার মধ্য দিয়া অনায়াসে একজন লোক বাহির হইয়া যাইতে পারে। একগাছি দৃঢ় রজ্জু সেই জানালায় বাঁধা ছিল। দড়িগাছটি সাধারণ নহে, ইহার মধ্যে মধ্যে গ্রন্থি দেওয়া ছিল। এই রজ্জু অবলম্বন করিয়া নিশ্চয়ই বাহির হইতে কোন লোক ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিল। হতব্যক্তির পদচিহ্ন অপেক্ষা বৃহদাকার পদচিহ্নগুলি যে তাহারই, তাহাও বুঝিতে পারিলাম। কারণ সেইরূপ অনেকগুলি চিহ্ন জানালার নিকটে দেখিতে পাইলাম। তাহাদের কতকগুলি ঘরের ভিতরে আসিবার, অপরগুলি ঘর হইতে বাহিরে যাইবার। সেই সকল চিহ্নের নিকট রমণীরও কতকগুলি পদচিহ্ন রহিয়াছে দেখিলাম। দেখিলাম, রমণীও সেই পথে বাহির হইয়া গিয়াছে। 

বাড়ীখানি দ্বিতল বটে কিন্তু অতি পুরাতন। আজ কাল একতলা বাড়ী যত উচ্চ হয়, এই দ্বিতল বাড়ীখানিও প্রায় সেইরূপ উচ্চ। সুতরাং সেই ঘর হইতে সেই রজ্জুর সিঁড়ির সাহায্যে যে কোন লোক অনায়াসে বাহির হইতে পারে। জানালার পার্শ্বেই বাগান। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বাড়ীর দুইপার্শ্বে দুইখানি বাগান ছিল। দড়িগাছটি জানালা হইতে সেই বাগান স্পর্শ করিয়াছিল। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া, আমি বিবেচনা করিলাম যে, হত্যাকার বাবুটিকে হত্যা করিয়া, তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া সেই রজ্জুর সাহায্যে বাড়ীর পার্শ্বস্থ বাগানে উপস্থিত ___ (?) হইতে কোনরূপে পলায়ন করিয়াছে। 

এই সিদ্ধান্ত করিয়া বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এই বাগানখানিও কি আপনার?” 

বৃদ্ধ সম্মতিসূচক উত্তর প্রদান করিলেন। আমি একবার সেই বাগানে গিয়া তত্রস্থ স্থানগুলি পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা করিলাম। বৃদ্ধ আমাকে বাগানে লইয়া গেলেন। অপর আর একজন কর্মচারী সেই ঘরের সম্মুখে রহিল। 

বাগানে গিয়া দেখিলাম, তাহার অবস্থা অতি শোচনীয়। বাগানে অনেকগুলি ফলের বৃক্ষ আছে বটে, কিন্তু তাহাদেরও অবস্থা বড় ভাল নহে। মধ্যে একটা পুষ্করিণী ছিল, তাহার ঘাট ও সিঁড়িগুলির অবস্থা আরও ভয়ানক। পুষ্করিণীতে অতি সামান্যই জল ছিল; কিন্তু তাহাও অব্যবহাৰ্য্য। 

বাগানের চারিদিকে রাংচিত্রের বেড়া। কিন্তু তাহাও মধ্যে মধ্যে ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। বাগান হইতে পলায়ন করা কিছুমাত্র কষ্টকর নহে। 

বাগানের চারিদিক একবার ভাল করিয়া লক্ষ্য করিয়া আমি জানালার নিম্নে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, দড়িগাছাটি সেই জানালা হইতে বাগানের ভূমি স্পর্শ করিয়াছে। সেই দড়ির মূলদেশে অনেকগুলি পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম। হতব্যক্তি ও তাঁহার স্ত্রীর পদচিহ্ন ভিন্ন আর যে প্রকার পদচিহ্ন ঘরের ভিতর দেখিতে পাইয়াছিলাম, বাগানেও সেই প্রকার পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম। সেই চিহ্নগুলি যে হত্যাকারীর পায়ের, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। হতব্যক্তির স্ত্রীরও পদচিহ্ন বাগানে রহিয়াছে। যদি সে স্ব-ইচ্ছায় হত্যাকারীর সহিত না যাইত, তাহা হইলে বাগানে তাহার পদচিহ্ন পাইতাম না। রমণী যে এই হত্যাকাণ্ডের ভিতর আছে, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ রহিল না। 

জানালার দড়ি দেখিয়া এবং হতব্যক্তি ও তাঁহার স্ত্রীর পদচিহ্ন ভিন্ন আর একপ্রকার পদচিহ্ন দেখিয়া, আমি বুঝিলাম, হত্যাকারী নিশ্চয়ই সেই জানালা দিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। যদি হতব্যক্তির স্ত্রী তাহাকে সাহায্য না করিত, তাহা হইলে সে চীৎকার করিয়া বাড়ীর অপর সকলকে জাগ্রত করিতে পারিত। সেই বাড়ীর অপরাপর যাত্রীদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছিলাম যে, বাড়ীর আর কেহ রাত্রে সেই ঘর হইতে কোন প্রকার শব্দ শুনিতে পায় নাই। সুতরাং সেই রমণীই হত্যাকারীর সহায়। যদি তাহাকে কেহ বলপূৰ্ব্বক লইয়া যাইত, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই চীৎকার করিত। যদি কেহ কোন কৌশলে তাহাকে অজ্ঞান করিয়া লইয়া যাইত, তাহা হইলে জানালার নিকট ও বাগানে তাহার পদচিহ্ন দেখিতে পাইতাম না। 

এই স্থির করিয়া আমি পুনরায় হতব্যক্তির নিকট আগমন করিলাম। বৃদ্ধও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া আমি হতব্যক্তির আাবগুলি পরীক্ষা করিলাম। অগ্রে তাঁহার কাপড় জামাগুলি দেখিলাম, কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোন ফল হইল না। দুই একটা রক্তের চিহ্ন ছাড়া তাঁহার পোষাকে আর কিছু নূতনত্ব ছিল না। 

কাপড়গুলি পরীক্ষা করিয়া তাঁহার ট্রাঙ্ক দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইলাম। কিন্তু উহার চাবী পাওয়া গেল না। অগত্যা ট্রাঙ্কটি ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, তাহার মধ্যে দুইখানি শাড়ী, একখানি নূতন গামছা, কয়েকখানা চিঠির কাগজ, দশ-বারখানি খাম ও টিকিট এবং একটা ছোট ক্যাস-বাক্স। ক্যাস-বাক্সটি খোলাই ছিল; দেখিলাম, তাহার ভিতরে একটি পয়সাও নাই। বাবুটি যখন স্বদেশ স্বগ্রাম ত্যাগ করিয়া তীর্থে স্নানের জন্য আসিয়াছিলেন, তখন তিনি যে শূন্যহস্তে আসেন নাই, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে তাঁহার অর্থ কোথায় গেল? বৃদ্ধের মুখে শুনিয়াছিলাম, রমণীর গাত্রে খানকয়েক অলঙ্কার ছিল, বাবুটির ঘড়ী চেন ও আংটী ছিল, সে সকলই বা কোথায় গেল? নিশ্চয়ই সেই রমণী সমস্ত লইয়া পলায়ন করিয়াছে। 

হতব্যক্তির জিনিষপত্র তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়া আমি ঘরে চারিদিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। 

কিছুক্ষণ পরীক্ষা করিবার পর ঘরের একটি কোণে একটি বাতির দগ্ধাবশিষ্ট ও কয়েকটা অর্দ্ধদগ্ধ দিয়াশালাইর কাটি দেখিতে পাইলাম। তাহারই নিকটে কয়েকখানি পোড়া কাগজ দেখিলাম। কাগজগুলি অতি সন্তর্পণে তুলিয়া লইয়া জানালার নিকট গমন করিলাম ও সেগুলি বিশেষরূপে দেখিতে লাগিলাম। কিন্তু তাহাতেও বিশেষ কোন ফল হইল না; তবে বুঝিতে পারিলাম, কোন যন্ত্রের সাহায্যে দেখিলে উহার কতক অংশ পড়া যাইতে পারে। 

ব্রাহ্মণ আমার কার্য্য দেখিয়া স্তম্ভিত হইলেন এবং আমাকে বারম্বার নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু আমি তখন ব্রাহ্মণের কোন কথার উত্তর দিতে পারিলাম না। বলিলাম “এখন আমায় কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না; শীঘ্রই এই রহস্য ভেদ করিব। তখন সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। তবে এখন এই পর্যন্ত জানিয়া রাখুন যে, যে রমণী এই ব্যক্তির সহিত এখানে আসিয়াছিলেন, যাহাকে আপনি হতব্যক্তির স্ত্রী বলিয়া জানেন, তিনি বড় সামান্য রমণী নহেন। তিনি হয় স্বয়ং নতুবা অপর কোন লোকের সাহায্যে এই ভীষণ হত্যাকাণ্ড করিয়াছেন।” 

ব্রাহ্মণ অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইলেন। বলিলেন “বলেন কি মহাশয়! রমণীর বয়স অধিক নহে, তাহাকে বালিকা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তাহার দ্বারা যে এই ভয়ানক কাৰ্য্য সাধিত হইতে পারে, তাহা আমার ধারণাই হয় না।”

আমি বৃদ্ধের কথার কোন প্রতিবাদ না করিয়া তৎক্ষণাৎ মৃতদেহ সরকারী ডাক্তারের নিকট পরীক্ষার্থে পাঠাইয়া দিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

এই সকল কার্য্যে একটা বাজিয়া গেল। যে ঘর বগলাচরণ ভাড়া লইয়াছিলেন, তাহার পাশ্বের ঘরে একজন পূর্ব্ববঙ্গের লোক ছিলেন। শুনিলাম, তিনি গত রাত্রিতে কালীঘাটে পঁহুছিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিয়া আরও জানিতে পারিলাম যে, তাঁহার সহিত বগলাচরণের সাক্ষাৎ হয় নাই। তিনিও স্ত্রী, বৃদ্ধা জননী ও বিধবা ভগিনী লইয়া যোগে গঙ্গাস্নানে আসিয়াছিলেন। বগলাচরণের ঘরের ঠিক পার্শ্বের ঘরে ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, কিন্তু আমাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই তাঁহারা বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। মৃতদেহ সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত হইবার পর তাঁহারা ফিরিয়া আসেন। তিনি আসিবা মাত্র আমি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে তাঁহাকে ডাকিয়া দিতে অনুরোধ করিলাম। 

ব্রাহ্মণ তদনুসারে তাঁহাকে সেইখানে ডাকিয়া আনিলেন। আমাকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী জানিয়া প্রথমত তাঁহার ভয় হইল। তিনি তখনই সেখান হইতে প্রস্থান করিতে মনস্থ করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া বলিলাম “মহাশয়! আপনার ভয়ের কোন কারণ নাই। গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়েই আপনাকে এখানে আসিতে বলিয়াছিলাম।” 

তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার নাম?” 

তিনি ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে উত্তর করিলেন “আমার নাম সুধীরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।” 

আ। নিবাস? 

সু। পলাশবাড়ী, ঢাকা। 

বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ আমার নিকটেই দাঁড়াইয়াছিলেন; তিনি শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বলিলেন মহাশয়! পলাশবাড়ী!” 

সু। আজ্ঞে হাঁ, কেন বলুন দেখি, আপনি আমার কথায় এত আশ্চর্যান্বিত হইলেন? 

বৃ। এই ঘরে যে ব্যক্তি ছিলেন, তাঁহারও বাড়ী ওই গ্রামে। আমার বোধ হয়, তিনি আপনার পরিচিত। সুধীরবাবু আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “বাবুটির নাম কি?” 

বৃদ্ধ সাগ্রহে উত্তর দিলেন “বগলাচরণ মিত্র।” 

সুধীরবাবু স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন, “বগলাচরণ খুন হইয়াছে? কি সর্ব্বনাশ! তিনি যে সম্প্রতি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করিয়াছেন।” 

বৃ। তবে কি তাঁহার সঙ্গে যে রমণী এখানে আসিয়াছিলেন, তিনি তাঁহার প্রথম পক্ষের স্ত্রী নয়?

সু। আজ্ঞে না। 

বৃ। আমিও পূর্ব্বে সেইরূপ মনে করিয়াছিলাম। 

আমি তখন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার ওই প্রকার সন্দেহের কারণ কি?” 

বৃ। যুবকের বয়সের সহিত তাঁহার স্ত্রীর বয়সের অনেক প্রভেদ, যুবকের বয়স চল্লিশ বৎসর, কিন্তু যুবতীর বয়স সতের বৎসরের অধিক নহে। তাই মনে করিয়াছিলাম, তিনি যুবকের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। 

সুধীরবাবু আশ্চয্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি তাঁহার স্ত্রীও এখানে আসিয়াছিলেন?” 

বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ উত্তর করিলেন “হাঁ,-–বগলাচরণের সহিত কি আপনার সদ্ভাব ছিল?” 

সুধীরবাবু সম্মতিসূচক উত্তর দিলেন। বলিলেন “আমাদের উভয়েরই বাড়ী এক পাড়ায়। সদ্ভাব না থাকাই আশ্চৰ্য্য।” আমি এই সকল কথা শুনিয়া মনে মনে আনন্দিত হইলাম। ততক্ষণে একটা সূত্র পাইলাম মনে করিয়া, সুধীরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “গত রাত্রে এই ঘর হইতে কোন প্রকার শব্দ শুনিতে পাইয়াছিলেন?” 

সু। আজ্ঞে না। আমরা সকলেই পথশ্রমে এত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, সামান্য মাত্র জলযোগ করিয়া বিশ্রাম করিয়াছিলাম। আজ প্রাতে যখন বাড়ীওয়ালার চীৎকার শব্দ শুনিতে পাই, তখনই আমার মনে কেমন একপ্রকার সন্দেহ হয়। কিন্তু যে কার্য্যের জন্য এই ভয়ানক কষ্ট স্বীকার করিয়া এতদূর আসিয়াছি, তাহাতেই মনঃসংযোগ করিলাম। গতরাত্রে যখন কালীঘাটে উপনীত হই, তখন মহামায়ার দরজা বন্ধ ছিল। কাল রাত্রে আর দর্শন হয় নাই, সেই জন্য আজ শয্যাত্যাগ করিয়াই মায়ের মন্দিরে গমন করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখনও মায়ের দ্বার খোলা হয় নাই। কিছুক্ষণ দাঁড়াইবার পর মন্দিরের দরজা খোলা হইল, আমি মায়ের চরণ দর্শন করিয়া চরিতার্থ হইলাম। 

আ। বগলাচরণের শ্বশুরবাড়ী কোথায় জানেন? 

সু। প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়ী আমাদেরই গ্রামে। দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুরবাড়ী কলিকাতা হইতে প্রায় ছয় মাইল দূরে-গ্রামে। 

আ। কতদিন পূর্ব্বে বগলাচরণ দেশ হইতে রওনা হইয়াছেন? 

সু। প্রায় দশদিন। 

আ। আপনাদের গ্রাম হইতে কলিকাতায় আসিতে কতদিন লাগে? 

সু। তিন দিন মাত্র; কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিলে দুইদিনেও আসা যায়। তবে তাহাতে অত্যন্ত কষ্ট হইয়া থাকে।

আ। শুনিলাম, বগলাচরণও গত কল্য বেলা চারি পাঁচটার সময় এখানে পঁহুছিয়াছিলেন, যদি তিনি দশদিন পূর্ব্বে আপনাদের গ্রাম হইতে রওনা হইয়া থাকেন, তবে তিনি এতদিন ছিলেন কোথায়? 

সু। তাঁহার শ্বশুরবাড়ীতেই থাকাই সম্ভব। 

আ। কেমন করিয়া জানিলেন? 

সু। যখন তাঁহার স্ত্রী তাঁহার সঙ্গে ছিল, তখন তিনি নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ীতে গিয়াছিলেন। কারণ দেশে তাঁহার স্ত্রী ছিল না। তিনি একাই সেখান হইতে আসিয়াছিলেন। 

আ। তাঁহার এই স্ত্রী কি আপনাদের দেশে যায় নাই? 

সু। হাঁ গিয়াছিল বৈ কি। কিন্তু সেখানে অধিক দিন ছিল না। 

আ। কতবার সেখানে গিয়াছিল? 

সু। দুইবার মাত্র। কিন্তু বোধ হয়, প্রতিবারে একমাসের অধিক ছিল না। 

আ। কতদিন হইল বগলাচরণ এই বিবাহ করিয়াছেন? 

সু। দুই বৎসর মাত্র। 

আ। শুনিলাম, তাঁহার স্ত্রীর বয়স প্রায় সতের বৎসর। যদি দুই বৎসর আগে তাঁহার বিবাহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে বগলাচরণ পনর বৎসরের এক যুবতীকে বিবাহ করিয়াছিলেন? 

সু। আপনার অনুমান যথার্থ। দেশে তাঁহার এই স্ত্রীকে দেখিয়া, অনেকেই অনেক কথা বলিয়াছিলেন। 

আ। তাঁহার চরিত্র কেমন শুনিয়াছেন? 

সু। যাহা শুনিয়াছি, তাহা বড় ভয়ানক। শুনিয়াছি, তাহার দোষের জন্য তাঁহার পিতার মুখ দেখাইবার যো ছিল না। কন্যার বিবাহ হইয়া গেলে পাড়ার অনেকেই অনেক প্রকার উপহাস করিয়াছিল। 

আ। সে সকল কথা আপনি কেমন করিয়া জানিলেন? 

সু। আমি স্বয়ং বরযাত্রী হইয়া ওই গ্রামে আসিয়াছিলাম। পল্লীর লোকদিগের উপহাস শুনিয়া আমরা সকলেই স্তম্ভিত হইয়াছিলাম। তাঁহারা তখন যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা আমি মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিব না। 

আ। কেন? এমন কি কথা যাহা আপনি আমার সাক্ষাতে বলিতে পারিবেন না। 

সু। সে সকল অশ্লীল ভাষা ভদ্রসন্তানের বক্তব্য নহে। তবে আপনি এই পর্য্যন্ত জানিয়া রাখুন যে, বগলাচরণের স্ত্রীর চরিত্র অতি জঘন্য। 

“আমিও সেইরূপ মনে করিয়াছি।” এই বলিয়া আমি সুধীরবাবুকে সঙ্গে লইয়া সেই সময় সেই মৃতদেহ যে স্থানে ছিল, সেই স্থানে গমন করিলাম। তিনি মৃতদেহ দেখিবা মাত্রই চিনিতে পারিলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

বগলাচরণের ঘরে যে সকল দগ্ধ কাগজ পাওয়া গিয়াছিল, সেগুলি একত্র করিয়া আমি পকেটে রাখিলাম এবং ঘর বন্ধ করিয়া কনেষ্টবলকে সেখানে রাখিয়া, আমি ব্রাহ্মণের নিকট বিদায় লইলাম। আসিবার সময় ব্রাহ্মণ আমার হাতে ধরিয়া অনেক অনুনয়-বিনয় করিলেন। আমিও তাঁহাকে বিনীত ভাবে সান্ত্বনা করিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলাম। 

যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা। বলা বাহুল্য, তখনও পর্যন্ত আমার আহার হয় নাই। কাপড় ছাড়িয়া অগ্রে আহার করিলাম, পরে সেই দগ্ধ কাগজগুলি লইয়া, পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। 

ইত্যবসরে সরকারী ডাক্তারের রিপোর্ট আসিল। রিপোর্ট পাঠ করিয়া দেখিলাম, ছোরাখানি বগলাচরণের হৃদয় ও ফুস্ ফুস্ ভেদ করিয়াছিল। বগলাচরণ সেই এক আঘাতেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। আঘাত এত জোরে হইয়াছিল যে, ছোরাখানি বক্ষ ভেদ করিয়া একেবারে হৃদয়ে গিয়া স্পর্শ করিয়াছিল। এক সামান্য রমণীর দ্বারা সেইরূপ আঘাতের সম্ভাবনা নাই। নিশ্চয়ই কোন পুরুষ বগলাচরণকে হত্যা করিয়াছে। সে কে? রমণী যে তাহাকে সাহায্য করিয়াছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সুতরাং সে যে রমণীর পরিচিত, তাহাতেও বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। এমন লোক কে? নিশ্চয়ই সে রমণীর উপপতি। কিন্তু সে বগলাচরণকে হত্যা করিল কেন? উপপতি হইলেই যে রমণীর স্বামীকে হত্যা করিতে হইবে, তাহার কোন কারণ নাই। বিশেষতঃ, যখন সেই রমণী শ্বশুরালয়ে যাইত না, তখন তাহার স্বামী থাকিতেও তাহার উপপতির বিশেষ কোন ক্ষতি ছিল না। তবে সে কেন বগলাচরণকে হত্যা করিল? এ রহস্য বড়ই অদ্ভুত। 

কনেষ্টবলকে বিদায় দিয়া, আমি সেই অৰ্দ্ধদগ্ধ কাগজগুলি পরীক্ষা করিলাম। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অনেক কষ্টে কিছু কিছু পড়িতে পারিলাম। যাহা বুঝিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, রমণীই এই হত্যাকাণ্ডের মূল। 

সৰ্ব্বশুদ্ধ দুইখানি কাগজ ছিল। একখানির লেখা একেবারে পুড়িয়া গিয়াছিল, সুতরাং তাহা আর পড়িতে পারিলাম না। অপরখানির অর্দ্ধেকটা পুড়িয়াছিল, অবশিষ্টাংশ অতি কষ্টে পড়িলাম। পত্রগুলি যে রমণীর উপপতি বা হত্যাকারীর লেখা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রহিল না। 

যে অংশ পাঠ করিতে পারিলাম, তাহাতে লেখা ছিল।— 

* * * * * বাসা আমার জানা আছে, 
* * * * * ধারের ঘর ভাড়া পাইয়া 
* * * * * ভালই হইয়াছে। আর
* * * * * আজই রাত্রি একটার সময়
* * * * * হইবে। আমি প্রস্তুত হইয়া
* * * * * নি তুমি আমায় দিয়াছিলে,
* * * * * উদ্ধার হইবে। ছোরাখানি
* * * * * কিন্তু তুমি যাহা বলিয়াছ,
* * * * * কারণ যদি টাকা না পাওয়া 
* * * * * থ্যা নরহত্যা করিয়া লাভ 
* * * * * শুর বাড়ী ঘর করিবে না। 
* * * * *  * হানি হইবে না। একগাছি 
* * * * *  ** খুব গোপনে রাখিবে।
* * * * *  *** ঘুমাইলে দড়ি
* * * * *  * * * দিকে ঝুলাইয়া 
* * * * *  * * * * * ঘরে যাইব, 
* * * * *  * * * * * ভুলিও না, 
* * * * *  * * * * * তোমার 
* * * * *  * * * * * * * সুধাংশু 

পত্রাংশ পাঠ করিয়া আমি অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু কি করিয়া অবশিষ্ট অংশ প্রাপ্ত হইব, তাহার চিন্তা করিতে লাগিলাম। অনেকক্ষণ ভাবিয়াও কোন উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলাম না। 

পত্রখানির দগ্ধাবশিষ্ট অংশ বারবার পাঠ করিলাম। ভাবিলাম, এই সুধাংশুই যে বগলাচরণকে হত্যা করিয়াছে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহাকে পাওয়া যায় কোথা? সুধীর বাবুর মুখে যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে সেই রমণীর পিত্রালয়–গ্রামে বলিয়াই বুঝিয়াছি। কিন্তু ওই গ্রাম একটু সামান্য স্থান নয়। বিশেষতঃ যখন সেই রমণীর নাম আমার জানা নাই, তখন তাহার সন্ধান কিরূপে হইতে পারে? স্ত্রীলোকের নাম জানিলেও সহজে তাহাকে অন্বেষণ করিয়া বাহির করা অসম্ভব। এ স্থলে তাহার যখন নামই জানা নাই, তখন তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা অসম্ভব। 

তাহার পর মনে করিলাম, যেখানে সেই রমণীর বাসস্থান, সুধাংশুবাবুও যে সেই স্থানে বাস করে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, পত্রের ভাব দেখিয়া বোঝা যায়, তাহাদের এই অবৈধ প্রণয় এক আধ দিনের নহে—বহুদিন হইতে তাহারা এই ব্যাপারে লিপ্ত আছে। যদি সুধাংশুর বাসস্থান এই রমণীর বাড়ী হইতে অধিক দূরে হইত, তাহা হইলে তাহাদের এই প্রণয়ব্যাপার কোন না কোন লোকের কর্ণ গোচর হইত তাহারা এত সাহসের সহিত এই ভয়ানক কাৰ্যে লিপ্ত হইতে পারিত না। 

এইরূপ স্থিত করিয়া আর একবার সুধীরবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা হইল। বেলা প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে, সূর্য্যদেব পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার আর সে তেজ, সে উগ্রমূৰ্ত্তি নাই। পক্ষী সকল আপন আপন বাসায় ফিরিতেছে। আমি আর কালবিলম্ব করিলাম না; তখনই সুধীরবাবুর বাসায় গমন করিলাম। সুধীরবাবু তখন সেখানে ছিলেন না, আরতি দেখিতে গিয়াছিলেন। 

শীতকাল না হইলেও বেশ শীত পড়িয়াছে। বেলাও ছোট হইয়া গিয়াছে। শুনিলাম, রাত্রি আটটার সময় মহামায়ার আরতি হইয়া থাকে। রাত্রি তখন সাড়ে সাতটা। আরও একঘণ্টা কি করিয়া অতিবাহিত করিব, স্থির করিতে পারিলাম না। 

আমি সেই স্থানে কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর সুধীরবাবু সপরিবারে বাসায় ফিরিয়া আসিলেন। আমাকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন “কি মহাশয়! হত্যাকারীর কোন সন্ধান পাইয়াছেন?” 

আমি বলিলাম “শীঘ্রই পাইবার আশা করি। এখন আপনার নিকট দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।” সুধীরবাবু আশ্চয্যান্বিত হইলেন। বলিলেন “আমার নিকট! এমন কি কথা আপনি জানিতে চান বলুন, জানিলে আমি অবশ্যই বলিব।” 

আমি বলিলাম “আপনি তখন বলিয়াছিলেন যে, আপনি বগলাচরণের দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুরবাড়ী জানেন। কোনরূপে আমাকে বাড়ীটি দেখাইয়া দিতে পারেন?” 

সুধীরবাবু উত্তর করিলেন “যদি আমার কার্য্যের কোনরূপ ব্যাঘাত না হয়, তাহা হইলে আমি অনায়াসে আপনাকে সেখানে লইয়া যাইতে পারি। কাল যোগ, যে কার্য্যের জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া এখানে আসিয়াছি, অগ্রে সে কার্য্য সমাধা করিয়া, মহামায়ার পূজা দিয়া, আহারাদির পর আপনার সহিত যাইতে পারি।” 

আমাকে বাধ্য হইয়া যোগের দিন অপেক্ষা করিতে হইল। যোগের পরদিবস সুধীরবাবুকে সঙ্গে লইয়া আমি সেই গ্রামে গমন করিলাম। সুধীরবাবু আমাকে বগলাচরণের শ্বশুরবাড়ী দেখাইয়া দিলেন। সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, কয়েকদিবস পূর্ব্বে বগলাচরণ সেই স্থানে আসিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার শ্বশুরবাড়ীতে কয়েকদিবস থাকিয়া তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া কালীঘাট গিয়াছেন। সেই স্থানে যোগে স্নান করিয়া পরিশেষে স্ত্রীকে লইয়া আপন দেশে গমন করিবেন। 

সেই গ্রামে গোপনে অনুসন্ধান করিয়া আরও জানিতে পারিলাম যে, বগলাচরণের স্ত্রী অতিশয় দুশ্চরিত্রা, তাহার চরিত্রের কথা ওই গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই অবগত আছেন। 

সুধাংশু নামক একটি দুশ্চরিত্র যুবকের সহিত তাহার কিছু প্রণয় অধিক। উভয়ে উভয়ের জন্য এক রকম পাগল বলিলেও হয়। আরও জানিতে পারিলাম, যেদিন হইতে বগলাচরণ তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া চলিয়া গিয়াছেন, সেইদিন হইতে সুধাংশুশেখরকে সেই গ্রামে আর কেহ দেখে নাই। 

এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া আমার মনে আর কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। এখন বেশ বুঝিতে পারিলাম, বগলাচরণের হত্যাকারী তাহার আপন স্ত্রী ও সুধাংশুশেখর, অপর কেহই নহে। এখন উহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলেই এই মোকদ্দমার কিনারা হইতে আর বাকী থাকিবে না। এখন কিরূপ উপায়ে উহাদিগকে ধরিতে পারিব, মনে মনে তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম। 

আমার মনে হইল, এরূপ অবস্থায় ওই স্ত্রীলোকটিকে লইয়া সুধাংশুর কলিকাতায় থাকাই খুব সম্ভাবনা; কারণ এরূপ অবস্থায় কলিকাতায় লুকাইয়া থাকা যেরূপ সহজ, এরূপ আর কোন স্থানে নহে। কারণ এখানে একব্যক্তি অপর ব্যক্তির কোনরূপ সন্ধানই রাখে না, ও রাখিবার চেষ্টাও করে না; সকলেই আপনাকে লইয়াই ব্যস্ত। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া উহাদিগের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমি কলিকাতায় আগমন করিলাম। 

কলিকাতায় সকল স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে জানিতে পারিলাম যে, কলিকাতার একটি প্রসিদ্ধ বদমায়েসের উপপত্নীর একটি পাকা বাড়ীতে কোথা হইতে একজন একটি স্ত্রীলোককে লইয়া আসিয়াছে ও তাহাকে উপরের একখানি ঘরে রাখিয়াছে। সেই ঘরের দরজা প্রায়ই খোলা হয় না, ও অপর কোন ব্যক্তি তাহাদিগকে দেখিতেও পায় না। ওই বাড়ীর উপরে কেবল মাত্র দুইখানি ঘর, তাহার একখানিতে সেই বদমায়েসের উপপত্নী বাস করে, অপরখানিতে আগন্তুকেরা বাস করিতেছে। নিচের ঘরে কোন লোক থাকে না, উহা রন্ধনাদির নিমিত্ত ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ওই বাড়ীর ভিতর লোক পাঠাইয়া আগন্তুকদিগের সন্ধান লইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলাম কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। 

একবার ভাবিলাম, প্রকাশ্যভাবে ওই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া দেখি যে, উহাতে কাহারা বাস করিতেছে। আবার ভাবিলাম, যাবার বাড়ীতে প্রবেশ করিব, সে নিজে বদমায়েস, তাহার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া যদি কাহাকেও না পাই, তাহা হইলে পরিশেষে সে নানারূপ গোলযোগ করিতে পারে। আর যদি মাজিষ্ট্রেটের নিকট হইতে ওই বাড়ী অনুসন্ধান করিবার ওয়ারেন্ট লইবার চেষ্টা করি, তাহা হইলে সে কথা রাষ্ট্র হইয়া পড়িবে; একবার যদি সে কোনরূপে উহা জানিতে পারে, তাহা হইলে তাহাদিগকে আর কোনরূপেই ধরা যাইবে না। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ওই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার একটি উপায় স্থির করিলাম। ভাবিলাম, ইহাতেও যদি কৃতকাৰ্য্য হইতে না পারি, তাহা হইলে পরিণামে যাহাই হউক, প্রকাশ্য ভাবে ওই বাড়ীতে প্রবেশ করিব। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, অপর একজন পুলিস-কর্মচারীর সাহায্যে একটি বিশেষ বুদ্ধিমতী ও চালাক বারবনিতার যোগাড় করিলাম। তাহাকে কিছু অর্থ প্রদান করিয়া যাহা যাহা করিতে হইবে, তাহা উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলাম। সে আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলে তাহাকে লইয়া আমি ছদ্মবেশে একখানি গাড়িতে আরোহণ করিয়া সেই বাড়ীর দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। কয়েকজন কনেষ্টবলকে ওই বাড়ীর সন্নিকটে এরূপভাবে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থান করিতে কহিলাম, যেন আবশ্যক হইলে তাহারা আমায় সাহায্য করিতে সমর্থ হয়। তখন রাত্রি প্রায় ১০টা বাজিয়া গিয়াছিল। 

গাড়ি হইতে নামিয়া আমি সেই বাড়ীর দরজার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলাম। আমাকে অপরিচিত লোক দেখিয়া সেই বদমায়েস আমার নিকট দৌড়িয়া আসিল। জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে কি মনে করিয়া মহাশয়?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি। একজন যুবতীকে তাহার পিত্রালয় হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছি, কিন্তু এই রাত্রে কোথাও বাসোপযোগী স্থান পাইতেছি না। যদি একটু স্থান দাও, তাহা হইলে আজিকার রাত্রি কোনরূপে অতিবাহিত করিতে পারি। পূর্ব্বে জানা থাকিলে অগ্রেই বাড়ী ঠিক করিয়া রাখিতে পারিতাম। কিন্তু রমণী যে আজই আমার সঙ্গে আসিবে, তাহা আমার জানা ছিল না।” 

“আমার কথা শুনিয়া সে হাসিয়া উত্তর করিল যদি একরাত্রি থাকা হয়, তাহা হইলে দশ টাকার কমে হইবে না।”

আ। রমণীর বাসোপযোগী স্থান আছে ত? 

ব। নিশ্চয়ই আছে। নতুবা এত টাকা চাহিব কেন? আপনি স্বয়ং সেই ঘর দেখিয়া আসিবেন চলুন। কিন্তু সে ঘরে আরও একজন ভদ্রমহিলা আছে। দুইজনে একঘরে থাকিতে হইবে। 

আ। সে ত উত্তম কথা। আমার পরম সৌভাগ্য যে, এখানে এখন আর একজন রমণী আছে। তবে চলুন, একবার ঘরটি দেখিয়া আসি। 

ঠিক এই সময়ে সেখানে আর একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল, বলিল “সে ঘরে অন্য কোন রমণীর স্থান হইবে না। যখন আমি অগ্রে টাকা দিয়াছি, তখন সে ঘর আমার। আমার বিনা অনুমতিতে তোমরা অপর লোককে সে ঘরে রাখিতেছ কেন?”

লোকটার কথা শুনিয়া সে হাসিয়া উঠিল। বলিল “সুধাংশুবাবু! তোমার জন্য কি আমরা লোকসান করিব? ইনিও আমাদিগকে একরাত্রির জন্য দশ টাকা দিতে স্বীকৃত আছেন। 

বাধা দিয়া আমি বলিলাম “দশ টাকা কেন, যদি আজ রাত্রি নিরাপদে অতিবাহিত করিতে পারি, যদি রমণীর বাড়ীর কোন লোক এখানে আসিয়া উৎপাত না করে, তাহা হইলে আমি ২০ টাকা দিতে স্বীকৃত হইলাম।” 

আমার কথায় বাড়ীওয়ালা অত্যন্ত আনন্দিত হইল। বলিল, “আপনার কোন চিন্তা নাই। আমি সমস্ত রাত্রি জাগিয়া বসিয়া থাকিব। এখান হইতে—এই বাঘের গহ্বর হইতে রমণীকে লইয়া যায়, কাহার সাধ্য? যখন আশ্রয় দিয়াছি, তখন আপনি নিঃসন্দেহে বাস করুন। কিন্তু টাকা-” 

“অগ্রিম দিতে হইবে? বেশ কথা।” এই বলিয়া আমি তখনই পকেট হইতে দুই কেতা দশ টাকার নোট দিলাম বাড়ীওয়ালা টাকা পাইয়া সুধাংশুর দিকে চাহিল। বলিল “সুধাংশুবাবু! দুইজনই স্ত্রীলোক। ইহাতে তোমার বিশেষ ক্ষতি হইবে না, অথচ আমারও একরাত্রির জন্য কিছু লাভ হইবে।” 

সুধাংশু আর কোন কথা কহিল না। বাড়ীওয়ালা আমাকে সেই ঘর দেখাইয়া দিল। আমি সেখানে গিয়া দেখি, এক অতি সুন্দরী যুবতী সেই ঘরে বসিয়া আছে। 

আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সুধাংশুও গিয়াছিল। সে রমণীকে বলিল, তোমার আর এক সঙ্গিনী আসিয়াছে। বাড়ীওয়ালার ইচ্ছা, আজ রাত্রে তোমরা উভয়েই এই ঘরে থাক। যেরূপ দেখিতেছি, আমাদিগকে কালই এখান হইতে প্রস্থান করিতে হইবে। 

রমণী শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করিল “কোথায়? পিত্ৰালয় কিম্বা পলাসবাড়ী ছাড়া আমাকে যেখানে লইয়া যাইবে, আমি সেইখানেই যাইব।” 

সুধাংশু হাসিয়া উঠিল। বলিল “না, না, তোমাকে আর বগলাচরণের বাড়ীতে যাইতে হইবে না। বিশেষতঃ, যখন তোমার স্বামী মরিয়া গিয়াছে, তখন আর সে ভয় কেন?” 

রমণী শান্ত হইল। আমি ঘরটি দেখিয়া পুনরায় বাহিরে আসিলাম এবং গাড়ির ভিতর হইতে যুবতীকে হাত ধরিয়া নামাইয়া পুনরায় সেই ঘরে গমন করিলাম। আমার সঙ্গিনী অতি চতুরা, সে যেভাবে কার্য্য করিতে লাগিল, তাহাতে সকলেই আমার কথায় বিশ্বাস করিল, কোনপ্রকার সন্দেহ করিল না। 

রমণীকে সেই ঘরে রাখিয়া আমি একবার বাড়ীটার চারিদিক লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, দুইজন রমণী ও সুধাংশু, বাড়ীওয়ালা ও তাহার উপপত্নী ভিন্ন আর কোন লোক সেই স্থানে নাই। 

বাহিরে যে সকল কর্মচারী আমার আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল, আমার সঙ্কেত পাইবামাত্র তাহারা সকলে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল ও সেই স্বামীঘাতিনী রমণী ধৃত হইল। 

উহাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ সংগ্রহ হইল, তাহাতে তাহারা বিনা-দণ্ডে অব্যাহতি পাইল না, উভয়েই চিরদিনের নিমিত্ত দ্বীপান্তরে প্রেরিত হইল। 

যে যে ব্যক্তি আমাকে এই কার্য্যে সাহায্য করিয়াছিলেন, তাঁহারা গবর্ণমেণ্ট হইতে উপযুক্তরূপে পারিতোষিক প্রাপ্ত হইলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ শ্রাবণ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *