স্ত্রী কি পুরুষ? (অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ চিহ্নবিশিষ্ট লাসের টুকরার ভয়ানক আশ্চর্য্য রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রায় এক মাস হইতে উপর্যুপরি কয়েকটি খুনি মোকদ্দমায় অনুসন্ধান করিয়া নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি। একাদিক্রমে যে কয়েকটি খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর অর্পিত হইয়াছিল, তাহা শেষ হইবার পর একদিবস প্রাতঃকালে স্থিরভাবে বসিয়া আছি, এমন সময় হঠাৎ আমার মনে উদয় হইল, যখন খুন হইতে আরম্ভ হয়, তখন কেবল খুনই হয় কেন? এক খুনি মোকদ্দমায় লিপ্ত হইয়াছি, অমনি অপর একস্থানে আর একটি খুন হইল, সেইস্থানে উপস্থিত হইতে না হইতেই অন্যস্থান হইতে অপর হত্যাকাণ্ডের সংবাদ আসিল। এইরূপে যখনই খুন হইতে আরম্ভ হয়, তখনই একাদিক্রমে উপর্যুপরি কেবল খুনই হইতে থাকে। আবার কোন সময়ে একবারে খুনের নাম—মাত্রও শুনিতে পাওয়া যায় না।
কেবল খুনই বা বলি কেন, দেখিতে পাইতেছি, যখন যে অপরাধ আরম্ভ হয়, উপর্যুপরি সেই অপরাধ কতকগুলি না ঘটিলে তাহার আর নিবৃত্তি হয় না। যে সকল ব্যক্তি নিয়মিতরূপে সংবাদপত্র পাঠ করিয়া থাকেন, তাঁহারা একবার সবিশেষ লক্ষ্য করিলেই দেখিতে পাইবেন যে, যে সময়ে উদ্বন্ধনে মৃত্যু হওয়ার একটি সংবাদ পাওয়া যায়, অমনি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ কেবল সেই সংবাদই আসিতে থাকে। জলে ডুবিয়া মৃত্যু, অহিফেন সেবনে মৃত্যুও প্রায় সেইরূপেই হইয়া থাকে। যখন বিষ খাওয়ান আরম্ভ হয়, তখন বিষপ্রয়োগে অজ্ঞান করিয়া চোরে যথাসর্ব্বস্ব চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে, এইরূপ সংবাদ এক সময়ে অনেক পাওয়া যায়। যখন সিঁদ হইতে আরম্ভ হয়, তখন চতুৰ্দ্দিক হইতে কেবল সিঁদের সংবাদই আইসে। এইরূপ যখন যেরূপ ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ হয়, তখন কেবল সেইরূপ ঘটনাই ঘটিয়া থাকে; ইহার কারণ কি?
হয়ত কেহ বলিবেন, “সিঁদেল চোরের আমদানী হইলে তাহারা ক্রমাগত সিঁদ ত দিবেই। যে সকল অপরাধী বিষপ্রয়োগ করে, তাহারা যে পর্য্যন্ত ধৃত না হইবে, সেই পর্য্যন্ত তাহাদিগের কৃত দুষ্কর্ম্ম সকলের সংবাদ ত উপর্যুপরি আসিবেই। কোন হত্যা-ব্যবসায়ী লোকের আবির্ভাব হইলে উপর্যুপরি কেবল হত্যাই ত হইতে থাকিবে; সুতরাং ইহাতে নূতনত্ব আর কি আছে?”
যাঁহারা এইরূপ বলিবেন, আত্মহত্যা-সম্বন্ধে তাঁহাদিগের সেই মত মিলে কই? ভিন্ন ভিন্ন স্থানের ভিন্ন ভিন্ন লোক পরামর্শ করিয়া কি একই সময়ে উদ্বন্ধন করিয়া আপন-আপন দেহ বিসর্জ্জন করেন, না বিষ ভক্ষণ করিয়া ইহজগৎ হইতে অন্তর্হিত হইয়া থাকেন। পূৰ্ব্বকথিত তাপরাধ সম্বন্ধেও দেখিয়াছি, অনেক সময়ে উপর্যুপরি সিঁদ হইয়াছে, এবং যাহারা সিঁদ দিয়াছে, তাহারাও ধৃত হইয়াছে। কিন্তু একজন বা একদল সিঁদেলের সহিত অপর এক সিঁদেলের যে কোনরূপ সংশ্রব আছে, তাহা জানিতে পারা যায় নাই। হত্যাকারীর মধ্যেও সেইরূপ কেহ অর্থের জন্য হত্যা করিয়াছে, কেহ ক্রোধের বশীভূত হইয়া অপরকে শমন সদনে প্রেরণ করিয়াছে। কেহ বা প্রণয়ে মজিয়া অপরের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছে, অথচ একজন হত্যাকারীর সহিত অপর হত্যাকারীর যে কোনরূপ সংশ্রব আছে, তাহাও কেহই বলিতে পারেন নাই। এরূপ অবস্থায় একই সময়ে, একই প্রকারের অপরাধ সকল যে কেন ঘটিয়া থাকে, তাহার কারণ বলিয়া দেওয়া নিতান্ত সহজ নহে।
যে সকল নৈসর্গিক কারণে পীড়ার উৎপত্তি হয়, অর্থাৎ বসন্ত হইতে আরম্ভ হইলে, যেমন চতুদিক্ হইতে বসন্তের সংবাদ পাওয়া যায়; বিসূচিকা হইতে আরম্ভ হইলে, যেমন চতুর্দিক্ বিসূচিকা রোগেই আচ্ছন্ন হয়; গ্রামের একস্থান হইতে ম্যালেরিয়া আরম্ভ হইলে, যেমন ম্যালেরিয়াতেই গ্রাম আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে; ততদূর না হউক, সেইরূপ নৈসর্গিক কারণের কোনরূপ সামান্য কারণ বশতঃ অপরাধ সকল কি ঘটিয়া থাকে?
এইরূপ অনেক চিন্তা মনে আসিয়া উদিত হইতেছে, এবং আমিও বসিয়া বসিয়া সেই চিন্তায় বিভোর আছি, এমন সময় সংবাদ পাইলাম, ভবানীপুরের একটি পুষ্করিণীতে মৃতদেহের কতকগুলি টুকরা পাওয়া গিয়াছে। সেই সংবাদ পাইবার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তরের পূর্ব্বোক্ত সমস্ত চিন্তা দূরে পলায়ন করিল। যে স্থানে বসিয়াছিলাম, তখন সেইস্থান হইতে ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করিলাম, ও আবশ্যকীয় পরিধেয় বস্ত্র প্রভৃতি সঙ্গে লইয়া সেই সময়েই ভবানীপুর অভিমুখে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিলাম।
ভবানীপুরের যে স্থানে এখন জলের কল প্রস্তুত হইয়াছে, এবং উক্ত জলের কলের চতুর্দ্দিকে যে সকল ময়দান এখন ধূ ধূ করিতেছে, আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন তাহার কিছুই ছিল না। সেই সময়ে সেইস্থানে একটি বিস্তৃত বস্তি ছিল, ও নানাজাতীয় দরিদ্র লোকের দ্বারা সেইস্থান পূর্ণ ছিল। কথিত এই বস্তির ভিতর কয়েকটি বৃহৎ বৃহৎ পুষ্করিণীও ছিল।
ভবানীপুরে গমন করিয়াই জানিতে পারিলাম যে, এই বস্তির ভিতরেই লাসের টুকরা পাওয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র, আমি সেই বস্তির ভিতরস্থিত একটি বৃহৎ পুষ্করিণীর নিকট গমন করিয়া দেখিতে পাইলাম যে, সেই পুষ্করিণীর পশ্চিম পার্শ্ব পুলিস-কৰ্ম্মচারীর দ্বারা পরিপূর্ণ। আমিও সেইস্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে মৃতদেহের সাতটি টুকরা রাখিয়াছে, আরও কয়েকটি টুকরা পুষ্করিণীর মধ্যে জলের উপর ভাসিতেছে। দেখিতে দেখিতে তিনটি টুকরা পুষ্করিণী হইতে উঠাইয়া আনা হইল। সৰ্ব্বশুদ্ধ দশটি টুকরা হইল। সেই সময়ে এই টুকরাগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম।—
প্রথম টুকরা—মস্তকের পশ্চাদ্ভাগের একটি অংশ বলিয়া বোধ হইল, উহাতে লম্বা লম্বা চুল সংলগ্ন। চুলগুলির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হস্ত পরিমিত হইবে।
দ্বিতীয় টুকরা—গালের কিয়দংশ সহিত একটি বামপার্শ্বের কাণ। উহাতে আট দশটি ছিদ্র আছে। স্ত্রীলোকগণ মাকড়ি প্রভৃতি পরিবার নিমিত্ত কাণে যে প্রকারের ছিদ্র সকল করিয়া থাকে, ইহাও সেই প্রকারের ছিদ্র।
তৃতীয় টুকরা—আর একটি কাণ, উহা দক্ষিণ পার্শ্বের। কিন্তু উহাতে ছিদ্রাদি কিছুই নাই।
চতুর্থ টুকরা—পাঁচটি অঙ্গুলি সহিত দক্ষিণহস্ত কব্জা হইতে বিচ্ছিন্ন। উহা অল্প হরিদ্রাবর্ণে রঞ্জিত।
পঞ্চম টুকরা—বক্ষের উপরিস্থিত মাংস। পুরুষ মানুষের যেরূপ স্তন হইয়া থাকে, উহাতে সেইরূপ স্তন আছে। কিন্তু স্ত্রীলোকের স্তনের সহিত ইহার কোনরূপ সাদৃশ্য নাই।
ষষ্ঠ টুকরা –দেখিয়া বোধ হয়, উহা তলপেটের এক স্থানের অংশ।
আর কয়েকটি টুকরা দেখিয়া সেই সময় স্থির করিতে পারিলাম না যে, উহা শরীরের কোন্ স্থানের অংশ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
লাসের পূর্ব্বোক্ত টুকরা সকল উত্তমরূপে দেখিয়া ভাবিলাম, এই সকল টুকরা পুষ্করিণীর ভিতর আসিল কি প্রকারে? এই সময় আরও মনে হইল, হয় ত হইতে পারে, কোন ব্যক্তি কাহাকেও হত্যা করিয়া সেই মৃতদেহ একবারে টুকরা টুকরা করিয়া, এই পুষ্করিণীর ভিতর নিক্ষেপ করিয়াছে। অস্থি সকল মাংস হইতে বিচ্ছিন্ন থাকায় উহা জলের ভিতর পড়িয়া গিয়াছে, মাংস সকল ভাসিয়া উঠিয়াছে। শরীরের অধিকাংশ মাংস এই পুষ্করিণীস্থিত মৎস্য, কচ্ছপ প্রভৃতিতে ভক্ষণ করিয়াছে। কতক বা পক্ষীতে লইয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট যাহা ছিল, তাহাই আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি।
যদি আমার এই অনুমানই প্রকৃত হয়, তাহা হইলে এ হত্যা কে করিল, বা কোন ব্যক্তিই বা হত হইল? এদিকে যেরূপ মাংসের টুকরা পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে যে হত হইয়াছে, সে “স্ত্রী, কি পুরুষ?”
প্রথম টুকরা দেখিলে কে বলিবে যে, এ চুল স্ত্রীলোকের নহে। যদিও পুরুষের লম্বা লম্বা চুল হওয়া অসম্ভব নহে, কিন্তু দ্বিতীয় টুকরার সহিত যদি একত্র দেখা হয়, তাহা হইলে কে বলিবে যে, এই দুই টুকরা স্ত্রীলোকের নহে—পুরুষের। এ পর্যন্ত এ প্রদেশে কোন পুরুষ মাড়ি পরিবার নিমিত্ত বা তাপর কোন কারণে আপনার কাণে কি সারি সারি ছিদ্র করিয়াছে? ইহা ব্যতীত চতুর্থ টুকরা অর্থাৎ হস্ত ঈষৎ হরিদ্রাবর্ণে, অথবা মেদী বা সেই প্রকার কোন দ্রব্য দ্বারা রঞ্জিত। ইহা কি কখন পুরুষে করিয়া থাকে? এই তিনটি টুকরা দেখিলে কে বলিবে, ইহা স্ত্রীলোকের দেহ নহে?
আবার এদিকে তৃতীয় টুকায় অর্থাৎ অপর কাণটিতে একটিমাত্রও ছিদ্রনাই কেন? কোন স্ত্রীলোক কি অলঙ্কার পরিবার মানসে কেবলমাত্র একটি কাণে ছিদ্র করিয়া থাকে? বিশেষতঃ পঞ্চম টুকরা দেখিয়া কে বলিবে, উহা স্ত্রী শরীরের অংশ বিশেষ? ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব, এ টুকরা কোনরূপেই স্ত্রীলোকের হইতে পারে না।
এই সকল ব্যাপার দেখিয়া তখন মনে বড়ই চিন্তা হইল। অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত ভাবিলাম, যাহার দেহের কয়েকটিমাত্র অংশ পাওয়া গিয়াছে, সে “স্ত্রী, কি পুরুষ?”
এই সময়ে হঠাৎ আমার মনে হইল, যদি হত্যাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই হত হইয়াছে। উভয়ের দেহই পূর্ব্ব-কথিত-মত টুকরা টুকরা করিয়া এই পুষ্করিণীর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। এই সকল তাহাদিগের উভয়েরই দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশ।
আমার এই অনুমানই যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে কি ভয়ানক ব্যাপারই ঘটিয়াছে! একবারে দুই দুইটি লোক নরঘাতকের হস্তে পতিত হইয়াছে! কি সৰ্ব্বনাশ!
যদি দুই দুইটি হত্যাকাণ্ডই একবারে হইয়া থাকে, একই সময়ে একটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ হত হইয়া যদি এই পুষ্করিণীর ভিতরে নিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে এ হতব্যক্তিদ্বয় কাহারা? এই বস্তির ভিতর যদি এইরূপ দুই দুইটি হত্যা একবারে সংসাধিত হইত, তাহা হইলে সে কথা কি এ পর্য্যন্ত গুপ্ত থাকিত? এরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়া সে বিষয় কোনরূপে গুপ্ত রাখিতে পারে, সে প্রকারের লোক এই দরিদ্র বস্তির ভিতর আছে বলিয়া আমার বোধ হয় না।
এই প্রকার নানারূপ ভাবিয়া কোন্ পন্থা অবলম্বনে এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, সেই সময়ে তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু ইহা সাব্যস্ত হইল যে, সেই পুষ্করিণীর ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখা উচিত,—যদি মৃতব্যক্তির অস্থি বা শরীরের অপর কোন অংশ তাহার মধ্যে পাওয়া যায়।
এই বিষয় স্থির হইলে তৎক্ষণাৎ কয়েকজন ডুবুরি আনাইয়া সেই পুষ্করিণীর ভিতর নামাইয়া দিলাম। তাহারা প্রায় দুই ঘণ্টাকাল সেই পুষ্করিণীর ভিতর সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিল, কিন্তু আর কিছুই প্রাপ্ত হইল না। সেই পুষ্করিণীর ভিতর অস্থির চিহ্নমাত্র না পাওয়ায়, মনে মনে এক প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু একটু চিন্তার পর আর সে সন্দেহ মনে স্থান পাইল না। ভাবিলাম, ইহা বহুকালের পুরাতন পুষ্করিণী, এবং পঙ্কে একেবারে পরিপূর্ণ। এরূপ অবস্থায় সেই পঙ্ক বিপর্যস্ত করিতে থাকিলে অস্থি প্রভৃতি কোনরূপ কঠিন দ্রব্য পাওয়ার পরিবর্তে প্রায়ই উহা পঙ্কের ভিতর যখন প্রবিষ্ট হইয়া পড়ে, তখন কিরূপে অস্থি পাওয়া যাইতে পারে? অথচ প্রকৃতরূপে যে সেই পুষ্করিণীর ভিতর অনুসন্ধান করা হইল, তাহাও বোধ হইল না। কারণ, পুষ্করিণীতে জল নিতান্ত কম ছিল না, মধ্যস্থলে বোধ হয়, দশহস্ত জল হইবে।
আমাদিগের এই সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইলে ভাবিলাম, এরূপ অবস্থায় এখন এ মোকদ্দমার কি প্রকার অনুসন্ধান হইতে পারে? প্রথমতঃ স্থির করিতে পারিতেছি না যে, এই মৃতদেহের অংশ সকল স্ত্রীলোকের—কি পুরুষের, অথবা উভয়ের। ইহা ব্যতীত এই কয় টুকরা মাংস পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের নিকট প্রেরিত হইলে তিনিই বা ইহার কি পরীক্ষা করিবেন, এবং কি প্রকারেই বা কহিবেন যে, ইহা আত্মহত্যা, কি হত্যা, কি অপর কোন প্রকারের মৃত্যু? ডাক্তারের পরীক্ষায় যদি কিছুই স্থির না হয়, তাহা হইলে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান কেবল পণ্ডশ্রম ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। পণ্ডশ্রম হউক বা না হউক, নিয়মিত কাৰ্য্য সকল আমাদিগকে করিতে হইবেই। এই ভাবিয়া সেই অনুসন্ধানে আমাদিগকে প্রবৃত্ত হইতে হইল।
এই সময় হঠাৎ আমার মনে একটি পুরাতন কথার আবির্ভাব হইল। কি কথা যে হঠাৎ আমার মনে উদিত হইল, তাহা পাঠকগণ সবিশেষরূপেই অবগত আছেন। পূর্ব্বে একবার যেরূপ গোলযোগে পতিত হইয়াছিলাম, “নিরুদ্দেশ ভাই” পাঠ করিয়া তাহা আপনারা বিশিষ্টরূপেই জানিতে পারিয়াছেন। সেই পুরাতন কথা এখন আমার মনে আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, ইহাও যদি সেই প্রকারের ঘটনা হয়, তাহা হইলে আমাদিগকে আর বিশেষ কষ্ট পাইতে হইবে না। এই সকল টুকা সম্বন্ধে পূর্ব্বে যাহা আমি মনে করিয়াছিলাম, তাহা অপেক্ষা ইহাই অধিক সঙ্গত বলিয়া বিবেচনা হয়। কারণ, কলিকাতার ভিতর যে স্থানেই অনুসন্ধান করা যায়, সেইস্থানেই ডাক্তারি-বিদ্যা শিক্ষা করিতেছে, এরূপ কোন না কোন যুবকের সন্ধান পাওয়া যায়। সেইরূপ কোন যুবক হাসপাতাল হইতে যদি মৃতদেহের দুই চারিটি টুকরা, অথবা দুইটি মৃতদেহ আনিয়া কাটিয়া কুটিয়া দেখিয়া, পরিশেষে এই পুষ্করিণীর ভিতর ফেলিয়া দিয়া থাকে, তাহা হইলে এরূপভাবে টুকরা সকল প্রাপ্ত হওয়া কোনরূপেই অসম্ভব হইতে পারে না। সুতরাং এই বিষয় সম্বন্ধে প্রথমেই অনুসন্ধান করা আমার কর্তব্য।
আমার মনে এখন যে ভাবের উদয় হইল, তাহা সেইস্থানে অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের নিকট প্রকাশ করিলাম। দেখিলাম, সকলেই আমার প্রস্তাবে অনুমোদন করিলেন, এবং সেই পুষ্করিণীর নিকটবর্তী কোনস্থানে ডাক্তারি-বিদ্যা শিক্ষাকারী কোন যুবক অবস্থিতি করিয়া থাকে কি না, তাহারই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন।
সেইস্থানে অনেক কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, সকলেই এক একদিকে গমন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; সুতরাং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই অনুসন্ধান প্ৰায় শেষ হইয়া গেল। এক এক করিয়া ক্রমে প্রায় সকলেই প্রত্যাবৰ্ত্তন করিলেন ও কহিলেন, “এই বস্তির ভিতর সেই প্রকারের কোন যুবক যে বাস করে, তাহার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।” কর্মচারীগণের কথা শুনিয়া ভাবিলাম,—আমরা যে অনুমানের বশবর্তী হইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, সেই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে না হইতে দেখিতেছি, তাহার শেষ হইয়া গেল। যাহা হউক, এখন অন্য কোন প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এখন কোন সূত্র অবলম্বন করিয়া আমরা এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, তাহাই ভাবিতেছি, এমন সময় অপর আর একজন কর্ম্মচারী আসিয়া আমাদিগকে কহিলেন, “ডাক্তারিবিদ্যা শিক্ষা করিতেছে, এরূপ কোন যুবক যে এই বস্তির ভিতর অবস্থিতি করে, তাহার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। কিন্তু এই বস্তির সংলগ্ন অপর বস্তির একস্থানে একটি বাসায় কয়েকটি যুবক বাস করিয়া থাকে, তাহাদিগের মধ্যে দুইজন ডাক্তারি-বিদ্যা শিক্ষা করিতেছে।”
কর্ম্মচারীর নিকট এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া ভাবিলাম, সেইস্থানে গমন করিয়া এ বিষয়ে একটু অনুসন্ধান করা কর্তব্য। ইহা স্থির করিয়া পূর্ব্বকথিত কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
জানিতে পারিলাম, সেই বাসায় দুইজন যুবক প্রকৃতই ডাক্তারি শিখিতেছে। কিন্তু প্রায় এক সপ্তাহ অতীত হইল, তাহাদিগের কলেজ বন্ধ হওয়ায় তাহারা আপন আপন দেশে চলিয়া গিয়াছে; এই সংবাদ প্রাপ্ত হওয়ায় সেই যুবকদিগের সম্বন্ধে আর অধিক অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হইল না। যে সূত্র অবলম্বন করিয়া আমরা এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতেছিলাম, তাহা এইস্থানেই ছিন্ন হইয়া গেল। আমরা বিষণ্নমনে সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিয়া, অতঃপর কোন পন্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। পরিশেষে ইহা সাব্যস্ত হইল যে, সেই বস্তির ভিতরের কোন ব্যক্তি সম্প্রতি অনুপস্থিত হইয়াছে কি না, তাহার অনুসন্ধান করা। এই পরামর্শ যেমন স্থির হইল, কার্য্যেও তখনি তাহা পরিণত হইল। আমরা সকলে মিলিয়া সেই বস্তির ভিতর প্রত্যেক বাড়ীতে বাড়ীতে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, কিন্তু হঠাৎ যে কোন ব্যক্তি নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তাহার কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম না। এইরূপ নিরর্থক পরিশ্রম করিয়া দিবসের অবশিষ্টাংশ গত হইয়া গেল, ও ক্রমে রাত্রিও অধিক হইল। তখন অনন্যোপায় হইয়া কৰ্ম্মচারী সকল আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন, আমিও আপনার স্থানে আগমন করিলাম।
সমস্ত দিবসের পর সেই রাত্রিতে আপন বাসায় আসিয়া আহারাদি করিয়া শয়ন করিলাম; কিন্তু এই মোকদ্দমার অবস্থা ঘটিত নানারূপ চিন্তায় মন আকৃষ্ট হওয়ায় ভালরূপ নিদ্রা হইল না। প্রাতঃকালে যখন শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, তখন শরীর যেন একটু অসুস্থ বোধ হইতে লাগিল। বোধ হইল, রাত্রিতে যে সকল দ্রব্য আহার করিয়াছিলাম, তাহার কিছুই জীর্ণ হয় নাই। তখন মনে মনে করিলাম, যে অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত আছি, সেই অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার পূর্ব্বে কোন ডাক্তারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাওয়াই কর্তব্য। এই ভাবিয়া আমার পরিচিত একজন ডাক্তারের বাসায় গমন করিলাম।
যে ডাক্তারের বাসায় আমি গমন করিলাম, তিনি আমার নিয়মিত পারিবারিক ডাক্তার না হইলেও বহুদিবস হইতে তাঁহার সহিত আমার পরিচয় ছিল। আমি সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ডাক্তারবাবু তাঁহার নিয়মিত বসিবার স্থানে বসিয়া রোগী দেখিতেছেন। হঠাৎ আমাকে সেইস্থানে উপস্থিত হইতে দেখিয়া তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “অসময়ে কি মনে করিয়া এখানে আগমন করিয়াছেন?” যে নিমিত্ত আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, উত্তরে আমি তাহার প্রকৃত কারণই কহিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি সেইস্থানেই একটি ঔষধ আনাইয়া আমাকে সেবন করিতে দিলেন ও কহিলেন, “এই ঔষধটি সেবন করিয়া আপনি এইস্থানে উপবেশন করুন, আপনার সহিত আমার অনেক কথা আছে। আপনি এখানে আসিয়াছেন, ভালই হইয়াছে; নতুবা আমিই বোধ হয়, আপনার নিকট গমন করিতাম। এই উপস্থিত রোগীগণকে দেখিয়া ও ইহাদিগের ঔষধের ববস্থা করিয়া দিয়া, আমি আপনাকে সকল কথা বলিতেছি।”
ডাক্তারবাবুর কথানুযায়ী তাঁহার প্রদত্ত ঔষধটি সেবন করিয়া সেইস্থানে স্থিরভাবে বসিয়া রহিলাম। তিনি নিয়মিতরূপে সেইস্থানে সমাগত রোগীগণকে দেখিয়া তাহাদিগের ঔষধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করিয়া দিতে লাগিলেন। এইরূপে প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টাকাল অতীত হইয়া গেলে, তাঁহার কার্য্য শেষে হইল। অপরাপর সমস্ত ব্যক্তি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। তখন ডাক্তারবাবু আমাকে কহিলেন, “আজ সংবাদ পত্রে দেখিলাম, কোথায় না মৃতদেহের কতকগুলি টুকরা পাওয়া গয়াছে?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “হাঁ, পাওয়া গিয়াছে। ভবানীপুরে একটি পুষ্করিণীর মধ্য হইতে কয়েক টুকরা বাহির হইয়াছে। গত কল্য আমি সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম বলিয়া অনেকরূপ অনিয়ম হয়, ও সেই নিমিত্তই আজ আমাকে আপনার নিকট আসিতে হইয়াছে।”
“অনুসন্ধানে ত নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু তাহার কি ফল ফলিয়াছে?”
“ফল কিছুই পাই নাই, পরেও যে পাইব, তাহারও কোন আশা নাই।”
“আমি যদি এ সম্বন্ধে আপনাকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারি, তাহা হইলে কি হইতে পারে?”
“বিশেষ উপকার হয়;—এই ভয়ানক রহস্য উদ্ঘাটিত হয়, এবং দোষীগণ উপযুক্ত দণ্ড প্রাপ্ত হয়।”
“যে ব্যক্তি আপনাকে এ সম্বন্ধে কিছু সংবাদ প্রদান করিবে, তাহাকে লইয়া আপনারা ত টানাটানি করিবেন?”
“যে ব্যক্তি আমাকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিয়া থাকেন, তাঁহাকে লইয়া আমি কিরূপ টানাটানি করিয়া থাকি, তাহা ত আপনি বিশেষরূপেই অবগত আছেন!”
“অবগত আছি বলিয়াই আপনাকে বলিতেছি, নতুবা একথা আমি আর কাহাকেও কহি নাই। সম্প্রতি আমি আমার একটি রোগীর প্রমুখাৎ যাহা শ্রবণ করিয়াছি, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে এই মোকদ্দমা-সম্বন্ধীয় অনুসন্ধান করিবার কতকসূত্র, বোধ হয় আপনি পাইলেও পাইতে পারিবেন।”
“কিরূপে সংবাদ পাইয়াছেন এবং কি সংবাদই বা প্রাপ্ত হইয়াছেন?”
ডাক্তার বলিলেন;—“কি সংবাদ পাইয়াছি, তাহা আমি আপনাকে বলিব না। আমি যাঁহার নিকট শ্রবণ করিয়াছি, আপনি তাঁহারই নিকট হইতে তাহা শুনিতে পাইবেন। তবে যেরূপে আমি সংবাদ পাইয়াছি, তাহা আমি আপনাকে বলিতেছি। কল্য প্রাতঃকালে একটি পীড়িত ব্যক্তিকে দেখিবার নিমিত্ত একটি লোক আমাকে ডাকিতে আসিল। আমরা ডাক্তার, সুতরাং ভিজিটের টাকার লোভ সম্বরণ করা আমাদিগের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে; একথা বোধ হয়, আপনাকে আর বলিতে হইবে না। আমি সেই লোকটির সঙ্গে সেই পীড়িতের বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম, পীড়িত ব্যক্তির নাম কেশবচন্দ্র কর্ম্মকার, বাসস্থান জোড়াতালাও। দেখিলাম, কেশবচন্দ্র তাহার বাড়ীর মধ্যস্থিত একটি কক্ষে শয়ন করিয়া রহিয়াছে; ব্যারাম অপর কিছুই নাই, কেবল দুই হাঁটুতে অতিশয় আঘাত লাগিয়াছে। সেইস্থানের হাড় যদিও ভাঙ্গিয়া যায় নাই কিন্তু হাড়ের উপরস্থিত আঘাত নিতান্ত সামান্য নহে। ইহা ব্যতীত মস্তকেও একটি বিশেষ আঘাতের চিহ্ন আছে; সেইস্থানের হাড় যদিচ ভাঙ্গিয়া যায় নাই, তথাপি ক্ষত নিতান্ত সামান্য নহে; এবং উক্ত ক্ষতস্থান দিয়া নিতান্ত সামান্য রক্ত নির্গত হয় নাই।
“কেশবচন্দ্রের চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে কিরূপে তিনি এই সকল ভয়ানক আঘাত প্রাপ্ত হন, তাহা জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত সেই সকল কথা শ্রবণ করিয়াছিলাম। কিন্তু সেই সময় ইহার বিন্দুমাত্রও সত্য বলিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছিল না; সুতরাং একথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিলাম না। অদ্য প্রাতঃকালে সংবাদপত্র পাঠ করিয়া যখন জানিতে পারিলাম, ভবানীপুরের একটি পুষ্করিণীতে কতকগুলি মাংসের টুকরা পাওয়া গিয়াছে, তখন আমার মনে কেশবচন্দ্রের কথা উদয় হইল। ভাবিলাম, তিনি আমাকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা প্রকৃত হইলেও হইতে পারে। আরও ভাবিলাম, আপনার নিকট গমন করিয়া এই সংবাদ আমি আপনাকে প্রদান করিয়া আসিব। যাহা হউক, ভাগ্যক্রমে আপনি নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। আমি এখনই কেশবচন্দ্রকে দেখিবার নিমিত্ত তাঁহার বাড়ীতে গমন করিতেছি, আপনিও আমার সহিত আসুন। তিনি আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছেন, আপনি তাঁহার নিজমুখেই শুনিয়া লউন, এবং বিবেচনা করিয়া দেখুন। এই সংবাদে আপনার কোন উপকার হইতে পারিবে কি না, জানি না; কিন্তু দেখিবেন, এই পীড়িত অবস্থায় কেশবচন্দ্রকে লইয়া যেন কোনরূপ টানাটানিতে ফেলিবেন না।”
ডাক্তারবাবুর এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম, এবং তাঁহারই সহিত তাঁহার গাড়িতে কেশবচন্দ্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
গমন-কালীন পথিমধ্যে ডাক্তারবাবুকে কহিলাম, “আমি যখন আপনার নিকট বহুদিবস হইতে পরিচিত, এবং আমার স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার প্রভৃতি আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন, তখন আমি পীড়িত কেশবচন্দ্রকে টানাটানিতে ফেলিব কি না, একথা আপনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন? আমার উপর যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তাহা হইলে এরূপ প্রশ্ন আপনার নিকট হইতে যে শ্রবণ করিব, তাহা কখন স্বপ্নে ভাবি নাই।
আমার কথা শ্রবণ করিয়া ডাক্তারবাবু যেন একটু লজ্জিত হইলেন বোধ হইল। কিন্তু তিনি আপন ভাব গুপ্ত করিয়া কহিলেন, “আপনাকে বিশ্বাস করি বটে; কিন্তু পুলিসকে সকল সময় বিশ্বাস হয় না বলিয়াই, এই কথা বলিতে হইয়াছে। এখন বোধ হয়, আপনি আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়াছেন। আপনাকে উদ্দেশ করিয়া আমি কোন কথা বলি নাই। যাহা বলিয়াছি—তাহা পুলিসকে।”
আমাদিগের উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথোপকথন হইতে হইতে গাড়ি কেশবচন্দ্রের বাড়ির সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। ডাক্তারবাবু গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া কেশবচন্দ্রের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। যে গৃহে কেশবচন্দ্র শয়ন করিয়াছিলেন, আমরা উভয়েই সেই গৃহে গিয়া কেশবচন্দ্রের নিকট উপবেশন করিলাম। রোগী দেখিতে গিয়া যে সকল কাৰ্য্য চিকিৎসকের পক্ষে কর্তব্য হয়, ডাক্তারবাবু প্রথমে তাহা সারিয়া লইলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “কেশববাবু! আপনার এই সকল আঘাতের কারণ সম্বন্ধে যে সকল বিষয় গত কল্য আপনি আমাকে বলিয়াছিলেন, তাহা আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে পারি নাই। সেই সময় আমার মনের ভিতর অন্য আর একটি প্রবল চিন্তা থাকায়, আপনার সকল কথা আমার অন্তরের ভিতর উত্তমরূপে প্রবিষ্ট হয় নাই। এখন আমার হস্তে বিশিষ্ট কোন কার্য্যও নাই, এবং কোন বিশিষ্ট ভাবনাতেও আমার মন অস্থির হয় নাই। এইসময় যদি আপনার সমস্ত অবস্থা আমার নিকট আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে সমর্থ হই।”
ডাক্তারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া কেশবচন্দ্র তাঁহার অবস্থা সবিশেষ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ডাক্তারবাবু এবং আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত তাঁহার কথা শ্রবণ করিতে লাগিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কেশবচন্দ্র বলিলেন, “মহাশয়! আমরা পুরুষানুক্রমে এই বাড়ীতে বাস করিয়া আসিতেছি। বাল্যকালে আমার পিতামাতা পরলোক গমন করায় উত্তমরূপে লেখাপড়া শিক্ষা আমার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে নাই বলিয়া, আমার জাতি—ব্যবসা আরম্ভ করি। পিতামাতা বর্তমান থাকিতে আমি আমার জাতীয় ব্যবসা শিক্ষা করিবার কোন চেষ্টাই করি নাই। কিন্তু হঠাৎ তাঁহাদিগের মৃত্যু হওয়ায় সংসার চলাচলের অপর কোন উপায় না দেখিয়া, আমি আমাদের কর্ম্মকারের ব্যবসা আরম্ভ করিবার বাসনা করি। কিন্তু এই কার্য্যে আমি একেবারে অনভিজ্ঞ থাকায়, প্রথমে অপর আর একজন কর্ম্মকারের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহারই দোকানে প্রথমে কাৰ্য্য শিক্ষা করি, এবং পরিশেষে বেতনভোগী হইয়া তাঁহারই নিকট কিছুদিবস অতিবাহিত করি।
“এইরূপ কিছুদিবস অতিবাহিত হইলে যখন আমি বুঝিতে পারিলাম, নিজে দোকান করিয়া স্বাধীনভাবে কৰ্ম্ম করিতে আমি সক্ষম হইয়াছি, তখন পূৰ্ব্বকথিত কর্ম্মকারের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া আমি নিজেই একখানি দোকান খুলিলাম, ও নিতান্ত সামান্য মূলধনেই সেই দোকানের কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে লাগিলাম। আমি যে দোকান করিলাম, তাহা কর্ম্মকারের দোকান সত্য; কিন্তু ইহা স্বর্ণকারের দোকান নহে, লৌহকারের দোকান। সুতরাং কেবল কতকগুলি যন্ত্রাদি ক্রয় ব্যতীত অপর মূলধনের আর প্রয়োজন হইল না।
“প্রথমতঃ আমি ছুরি কাঁচি গড়াইতে আরম্ভ করিলাম। আমার নির্ম্মিত দ্রব্যাদি দেখিয়া ক্রমে সকলেই সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন, এবং পরিশেষে তাঁহাদিগের পরামর্শ মত সেই কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া, ডাক্তারদিগের ব্যবহারোপযোগী অস্ত্রাদি নির্ম্মাণ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ক্রমে আমার নির্ম্মিত অস্ত্র সকল বিলাতী অস্ত্রের সমকক্ষ হইয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু বিলাতী অস্ত্র অপেক্ষা আমার নির্ম্মিত অস্ত্র সকলের নির্ম্মাণ করিবার খরচা অধিক হইতে লাগিল। এই নিমিত্ত আমার নির্ম্মিত অস্ত্র সকলের কাটতি কম হইয়া গেল; সুতরাং এ ব্যবসায় আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল।
“এই সময় নানাকারণে আমার দোকান উঠিয়া গেল। অনন্যোপায় হইয়া আমি পুনরায় চাকরী করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। কলিকাতার ভিতর একজন প্রধান ইংরাজ লৌহকারের দোকানে এবার আমার চাকরী হইল, এবং আজ পৰ্য্যন্তও সেইস্থানে কর্ম্ম করিতেছি। দোকানদার সাহেব অতি অল্প দিবসের মধ্যেই আমার কার্য্যের পরিচয় পাইয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন, ও ক্রমেই আমার বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিতে লাগিলেন। কারখানার যে অংশে যন্ত্রাদি নিৰ্ম্মিত হয়, আমি সেই তাংশে কর্ম্ম করিতে লাগিলাম। যন্ত্রাদি মেরামত করার ভার প্রথমে আমার উপর অর্পিত ছিল, ক্রমে সেই সকল যন্ত্র নির্ম্মাণ করিতেও শিখিলাম। এই সময় বিলাত হইতে আনীত যন্ত্র সকলের সমকক্ষ যন্ত্র সকল আমি নিজে প্রস্তুত করিয়া দিয়া, সাহেবের মনস্তুষ্টি করিতে লাগিলাম।
“এইরূপ কাজ-কর্ম্ম করিয়া আমি বহুদিবস অতিবাহিত করিয়াছি। ভাল ভাল যন্ত্র সকল আমি যে উত্তমরূপে মেরামত এবং প্রস্তুত করিতে পারি, ক্রমে সেই সংবাদ সহরের মধ্যে প্রচারিত হইয়া পড়িল, আমার কার্য্য আরও বাড়িয়া গেল। সকাল-সন্ধ্যা সেই প্রকার কার্য্য উপলক্ষ করিয়া আমাকে নানাস্থানে গমন করিতে হইত। কাহারও সেলাই কল খারাপ হইয়া গিয়াছে, কাহারও ঢালাই কলে উত্তমরূপ কার্য্য হইতেছে না; এইরূপ সংবাদ প্রায় প্রত্যহই কেহ না কেহ লইয়া আসিত, এবং আমাকে সেইস্থানে গমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিত। সময়-মত আমিও সেই সকল স্থানে গমন করিয়া সেই সকল যন্ত্রাদি মেরামত করিয়া দিতাম। আমার সাহেব বাড়ীর চাকরী ব্যতীত এই সকল কার্য্য করিয়াও আমি বিলক্ষণ দশ টাকা উপার্জ্জন করিয়া আসিতেছিলাম
“মহাশয়! এইরূপ যন্ত্রাদি নিৰ্ম্মাণ এবং মেরামত করিতে শিখিয়াছিলাম বলিয়াই, আমার এই দুরবস্থা হইয়াছে। টাকার লোভে পড়িয়া এখন প্রাণবিসর্জ্জন করিতে বসিয়াছি! মহাশয়! যদি এই কার্য্য করিতে না শিখিতাম, অর্থের লোভে পড়িয়া যদি অপরিচিত লোকের সহিত গমন না করিতাম, তাহা হইলে কি আমার এইরূপ শোচনীয় অবস্থা হইত? কখনই না।”
এইরূপ বলিতে বলিতে কেশবচন্দ্র যেন একটু অধীর হইয়া উঠিলেন; তাঁর কণ্ঠ যেন রোধ হইয়া আসিল, চক্ষু দিয়া জলধারা বাহির হইল!
ডাক্তারবাবু কেশবের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কহিলেন, “তুমি এত ভীত হইতেছ কেন? তুমি যে কিরূপ আঘাত পাইয়াছ, তাহা তুমি নিজে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছ না বলিয়াই তোমার মনে এইরূপ ভয় হইতেছে। কিন্তু আমি দেখিতেছি, তোমার আঘাত অতিশয় সামান্য। এ প্রকার আঘাত প্রাপ্ত হইলে কেহই ইহজীবন পরিত্যাগ করে না; তবে দুই চারি দিবস কষ্ট পায় মাত্র। তুমি আমার কথার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করিতে পার, তোমার কোন ভয় নাই। দেখিবে—পাঁচ সাত দিবসের মধ্যে তুমি তোমার পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হইবে, এবং ইচ্ছামত তোমার কার্য করিতেও সমর্থ হইবে।”
ডাক্তারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া কেশবচন্দ্র কহিলেন, “আমি যেরূপ ভাবিতেছি, ইহা কি তবে ততদূর সাংঘাতিক নহে? তবে কি আমি শীঘ্র আরোগ্যলাভ করিতে সমর্থ হইব?”
উত্তরে ডাক্তারবাবু কহিলেন, “আমি ত পুনঃ পুনঃ কহিতেছি, ইহাতে তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। বাহির হইতে দেখিয়া বোধ হয়, তুমি সাংঘাতিকরূপে আহত হইয়াছ, কিন্তু তাহা নহে। যে আঘাত মাংস ভেদ করিয়া অস্থি পর্য্যন্ত পৌঁছে নাই, তাহাকে আমরা আঘাতের মধ্যেই ধরি না। কারণ, এইরূপ আঘাতে কোনরূপে অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। তোমার আঘাতই সেই প্রকার। অস্থির সহিত তোমার এই আঘাতের কোনরূপ সংশ্রব ঘটে নাই, সুতরাং বিপদেরও কোনরূপ সম্ভাবনা দেখি না। কিন্তু তোমার অদৃষ্টে যে কয়েক দিবস কষ্টভোগ আছে, তাহা তোমাকে ভুগিতেই হইবে; আর আমার বিবেচনায় সে ভোগও অধিককাল স্থায়ী নহে। বোধ হয়, পাঁচ সাত দিবসের মধ্যে তুমি উত্তমরূপে আরোগ্যলাভ না করিতে পারিলেও যে নিজের কর্ম্ম-কার্য্য করিতে সমর্থ হইবে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”
ডাক্তারবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া কেশবচন্দ্রের অন্তরে যেন সাহসের সঞ্চার হইল। তাহার শুষ্ক মুখ পূর্ব্বরূপ ধারণ করিল, চক্ষুজল নিবৃত্ত হইয়া গেল, মুখে যেন আনন্দের রেখা প্রভাসিত হইতে লাগিল। তখন তিনি ডাক্তারবাবুকে পুনরায় কহিলেন, “আপনার উপর আমার যেরূপ বিশ্বাস, সেইরূপ বিশ্বাস আমি অপর কোন চিকিৎসককে করিয়া থাকি কি না, তাহাতে সন্দেহ আছে। আপনি যখন কহিতেছেন, এ অতি সামান্য আঘাত, ইহাতে কোনরূপ অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা নাই, তখন আপনার কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ দেখি না। আমি আমার যে অবস্থা বর্ণন করিতেছিলাম, তাহা পুনরায় শ্রবণ করুন।” এই বলিয়া কেশবচন্দ্র তাঁহার কাহিনী পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
“চারিদিবস অতীত হইল, একদিবস সন্ধ্যার সময় একটি অপরিচিত লোক আসিয়া আমার বাড়ীতে উপস্থিত হইল। ইহাকে ইতিপূর্ব্বে আমি আর কখনও দেখি নাই। ইহার বয়ঃক্রম প্রায় চল্লিশ বা পঁয়তাল্লিশ বৎসর হইবে, বর্ণ কৃষ্ণ, দোহারা এবং দেখিলে বেশ বলবান বলিয়া বোধ হয়। দুই সহস্র লোকের মধ্যেও যদি আমি পুনরায় তাহাকে দেখিতে পাই, তাহা হইলে অনায়াসেই আমি তাহাকে চিনিতে পারিব। তাহার নাম জিজ্ঞাসা করায় সে আমাকে কহিয়াছিল, তাহার নাম—তারাপ্রসন্ন। কিন্তু সত্য বলিয়াছিল, কি মিথ্যা বলিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না।
“কৰ্ম্ম স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার অতি অল্প সময় পরেই তারাপ্রসন্ন আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। সম্মুখে আমাকে দেখিতে পাইয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘মহাশয় বলিতে পারেন, কেশবচন্দ্র কর্ম্মকারের কোন বাড়ী?’
“উত্তরে আমি কহিলাম, ‘কেশবচন্দ্রের নিকট আপনার কি প্রয়োজন? আমারই নাম কেশবচন্দ্র কর্ম্মকার।’
“আপনার নামই কেশবচন্দ্র কর্ম্মকার, আপনিই কি কল মেরামত করিতে পারেন?’
“আমিই যন্ত্রাদি নিৰ্ম্মাণ এবং মেরামত করিয়া থাকি। আপনার কোন যন্ত্র মেরামত করাইবার প্রয়োজন আছে?”
“তারাপ্রসন্ন। একটি যন্ত্র মেরামত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়াই, আপনার অনুসন্ধান করিতেছি। কারণ, লোক-পরম্পরায় শুনিয়াছি যে, যন্ত্রাদি ভালরূপ মেরামত করিতে আপনার সদৃশ অপর আর কোন দেশীয় লোক কলিকাতার ভিতর নাই। এই নিমিত্তই মহাশয়ের নিকট আগমন করিয়াছি। যদি আপনি একটি যন্ত্র মেরামত করিয়া দেন, তাহা হইলে আমি সবিশেষ উপকৃত হই। এজন্য আমি মহাশয়কে উপযুক্ত পারিতোষিক দিতে প্রস্তুত আছি।
“কিসের যন্ত্র মেরামত করিতে হইবে?’
“তারাপ্রসন্ন। আমাদিগের একটি হরপ ঢালাই কল আছে, এই কল নিয়মিতরূপ চলিতে চলিতে হঠাৎ চলিতেছে না। উহার ভিতর কোন্ স্থানে যে কি হইয়াছে, তাহাও আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই নিমিত্তই মহাশয়ের নিকট আসিতে হইয়াছে।
“এ অতি সামান্য কথা। আপনাদিগের ঠিকানা আমার নিকট লিখিয়া দিয়া যাউন, কল্য প্রাতঃকালে আমি সেইস্থানে গমন করিয়া সেই কল দেখিয়া আসিব, এবং সময়মত মেরামত করিয়া দিব।’
“তারাপ্রসন্ন। মহাশয়! যে কলটির কথা আমি বলিলাম, তাহা আমার নিজের নহে—আমার মনিবের। অতি অল্প দিবস হইল, কয়েক সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিয়া সেই কলটি তিনি বিলাত হইতে আনাইয়া কৰ্ম্ম করিবার নিমিত্ত আমার হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। আমিও সেই কল ব্যবহার করিয়া নিয়মিতরূপে হরপ ঢালাই করিয়া আসিতেছি; কিন্তু অদ্য বৈকালে হঠাৎ সেই কল বিগড়াইয়া গিয়াছে। অনেক চেষ্টা করিয়াও কোনরূপে সেই কল চালাইতে সমর্থ হই নাই। এই নিমিত্তই আমি দ্রুতপদে মহাশয়ের নিকট আগমন করিয়াছি। মহাশয়। আমি যে মনিবের নিকট কার্য্য করি, তাহার সদৃশ দুৰ্দ্দান্ত লোক কলিকাতার ভিতর অপর আর কেহ আছে কি না সন্দেহ। যদি তিনি কোনরূপে জানিতে পারেন, তাহার সেই নূতন কল আমা কর্তৃক নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহা হইলে আমার যে কি দুর্দ্দশা হইবে, তাহা আমি মহাশয়ের নিকট বর্ণন করিতে অসমর্থ। বৈকালে তিনি কখনও কারখানায় আসেন না, ইহাই আমার পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু কল্য প্রাতঃকালে যখন তিনি কারখানায় আসিবেন, তাহার পূর্ব্বে যদি আমি এই কল মেরামত করিয়া না রাখিতে পারি, তাহা হইলে তিনি আমার সর্ব্বনাশ ঘটাইবেন। এই নিমিত্ত মহাশয়ের নিকট আমার এই অনুরোধ যে, যে প্রকারেই হউক রাত্রির ভিতর সেই কল মেরামত করিয়া দিয়া এই বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা করুন। এই প্রকার কার্য্য করিয়া আপনি যাহা গ্রহণ করিয়া থাকেন, রাত্রির নিমিত্ত আমি তাহার দ্বিগুণ মূল্য পর্যন্তও প্রদান করিতে সম্মত আছি!
“তারাপ্রসন্নের কথা শ্রবণ করিয়া এবং বিনতি মিনতি দেখিয়া, আমার মনে অতিশয় দয়া হইল। সমস্ত দিবস পরিশ্রমের পর পুনরায় রাত্রিকালে তাঁহার কার্য্য সমাপন করিয়া দিতে সম্মত হইলাম ও কহিলাম, ‘এই কার্যের নিমিত্ত আপনি আমাকে কি প্রদান করিবেন?’ উত্তরে তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘আপনি বিবেচনা-মত যাহা চাহিবেন, আমি তাহাই প্রদান করিব। কিন্তু যাহাতে রাত্রির মধ্যেই মেরামত কার্য্য শেষ হইয়া যায়, তাহা আপনাকে করিতে হইবে।’ আমি কহিলাম, ‘এই প্রকার কার্য্য দিনমানে করিতে হইলে আমি কুড়ি পঁচিশ টাকার কম লই না; কিন্তু রাত্রির নিমিত্ত আমি তাহার দ্বিগুণ মূল্য গ্রহণ করিব।’ আমার কথা শ্রবণ করিয়া তারাপ্রসন্ন কহিল, “তাহাই হইবে মহাশয়! আমি আপনাকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিব; কিন্তু রাত্রির ভিতরই কার্য শেষ করার প্রয়োজন।’
“একেবারে পঞ্চাশ টাকার লোভ সম্বরণ করা নিতান্ত সামান্য নহে। বিশেষতঃ চারি পাঁচ সহস্র টাকা মূল্যের নূতন যন্ত্র এরূপে কখনই খারাপ হইয়া যাইতে পারে না যে, উহা মেরামত করিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হইবে। সুতরাং আমার মনে মনে বেশ ধারণা হইল যে, দুই এক ঘণ্টার মধ্যে আমি অনায়াসেই সেই কাৰ্য্য সমাপন করিয়া দিতে পারিব। এই ভাবিয়া তাহাকে কহিলাম, ‘আপনি সন্ধ্যার পর একখানি গাড়ি লইয়া এইস্থানে আগমন করিবেন। আহারাদি করিয়া একেবারে আমি আপনার সহিত গমন করিয়া, আপনার কার্য শেষ করিয়া দিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিব। ফিরিতে কত রাত্রি হইবে বলা যায় না, সুতরাং একেবারে আহারাদি করিয়া গমন করাই কর্তব্য।’ আমার কথা শ্রবণ করিয়া তারাপ্রসন্ন সম্মত হইল, এবং সন্ধ্যার পর একেবারে গাড়ি লইয়া আগমন করিবে বলিয়া আমার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।
“সন্ধ্যার পর আহারাদি করিয়া আমি তারাপ্রসন্নের অপেক্ষায় বসিয়া রহিলাম; কিন্তু কথিত সময়ে তারাপ্রসন্ন আসিল না, ক্রমে রাত্রি অধিক হইতে লাগিল। আমি ভাবিলাম, তারাপ্রসন্ন বোধ হয় আর আসিল না। বোধ হয়, অন্য কোনস্থানে অপর কোন সুযোগ করিয়া আপনার কার্য্য শেষ করিয়া লইয়াছে। এইরূপ ভাবিয়া আমি শয়ন করিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় দেখিলাম, একখানি গাড়ি আসিয়া আমার দ্বারে উপস্থিত হইল। তখন রাত্রি প্রায় দশটা। তারাপ্রসন্ন উক্ত গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া আমার নিকট আগমন করিল এবং কহিল, ‘কেমন মহাশয়! আপনার আহারাদি হইয়াছে? যদি হইয়া থাকে, তাহা হইলে চলুন গাড়ি প্রস্তুত।’ উত্তরে আমি কহিলাম, ‘আহারাদি অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে। আপনার বিলম্ব দেখিয়া আমি ভাবিতেছিলাম, আপনি আর আসিলেন না, এই নিমিত্তই আমি শয়নের উদযোগ করিতেছিলাম।’ আমার কথা শ্রবণ করিয়া তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘আপনার আহার যে এত শীঘ্র হইবে, তাহা আমি পূর্ব্বে বুঝিতে পারি নাই। এই নিমিত্ত একটু বিলম্ব করিয়াই আসিয়াছি। যাহা হউক, রাত্রি প্রায় দশটা হইয়াছে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই, গাড়ি প্রস্তুত—চলুন, এবং যাহাতে রাত্রি ভিতরেই আমাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করিতে পারেন, তাহার উপায় করুন।
“আমি একরূপ প্রস্তুত হইয়াই বসিয়াছিলাম, সুতরাং আর কালবিলম্ব না করিয়া তারাপ্রসন্নের সহিত সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলাম। আমরা গাড়িতে উঠিবামাত্রই গাড়োয়ান গাড়ি চালাইয়া দিল। বুঝিলাম,—কোথায় যাইতে হইবে, তাহা তারাপ্রসন্ন পূৰ্ব্বেই উহাকে বলিয়া দিয়াছে। সেই অন্ধকার রাত্রিতে ক্রমে অন্ধকারময় পথ অবলম্বনে সেই শকট আমাদিগকে লইয়া দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। কিন্তু কোন্ পথ দিয়া কোথায় যে গমন করিতেছে, আমি তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
“ক্রমে সেই গাড়ি গিয়া একটি পুরাতন বাড়ীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তারাপ্রসন্ন প্রথমেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন ও পরিশেষে আমাকেও নামিতে কহিলেন। আমিও নামিলাম। কোচমান গাড়ি লইয়া চলিয়া গেল। তারাপ্রসন্ন আমাকে সঙ্গে লইয়া অন্ধকারের মধ্য দিয়া সেই ইষ্টক-নির্ম্মিত ভগ্ন অট্টালিকার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। যখন আমরা একটি প্রকোষ্ঠের ভিতর গমন করিলাম, সেই সময় তারাপ্রসন্ন আমাকে কহিলেন, ‘এইস্থানে আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আলো লইয়া এখনই এইস্থানে আগমন করিতেছি।’ এই বলিয়া সেই নিবিড় অন্ধকারের ভিতর আমাকে একাকী রাখিয়া তারাপ্রসন্ন কোথায় গমন করিলেন। আমি প্রায় দশ মিনিটকাল সেইস্থানে একাকী দণ্ডায়মান রহিলাম। সেই সময় আমার মনে কেমন যেন এক প্রকার ভয়ের উদয় হইল। ভাবিলাম, এই ঘোর অন্ধকারের ভিতর সহায়হীন অবস্থায় আমি একাকী আসিয়া ভাল করি নাই। ঈশ্বর না করুন, এইস্থানে যদি আমাকে কোনরূপ বিপদে পতিত হইতে হয়, তাহা হইলে এই অপরিচিত স্থানে আমার দশাই বা কি হইবে? আমার বিপদের সংবাদই বা কে আমার পরিবারবর্গকে জানাইবে? আবার ভাবিলাম, যখন আমি বিনাসম্বলে এইস্থানে আসিয়াছি, তারাপ্রসন্ন যখন উত্তমরূপে অবগত আছে যে, আমার সহিত কপদকমাত্র নাই, তখন আমার বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি, তাহা সমাপন করিয়া প্রস্থান করিব। প্রস্তাবিত অর্থ যদি উহারা আমাকে প্রদান করে, ভালই; নতুবা এক রাত্রির অতিরিক্ত পরিশ্রমে আমার সবিশেষ কি ক্ষতিহইবে? আমি সেই অন্ধকারের ভিতর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় একটি স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর হঠাৎ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। বোধ হইল, নিকটবৰ্ত্তী কোনস্থান হইতে আমাকেই লক্ষ্য করিয়া সে অতিশয় নিম্নস্বরে কহিতেছে, ‘তোমার অমঙ্গল নিকটবর্তী; কারণ, যাহাদিগের হস্তে তুমি পতিত হইয়াছ, তাহাদিগের নিকট হইতে কোনরূপ উপকারের প্রত্যাশা করা যায় না, বরং অপকারের সম্ভাবনাই অধিক। এইরূপ অবস্থায় আমি পূর্ব্বেই তোমাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি। তুমি আমার পরামর্শ অনুযায়ী কার্য্য কর, এখনই এইস্থান হইতে প্রস্থান কর।’ বামাকণ্ঠ হইতে হঠাৎ এইরূপ কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে প্রকৃতই ভয়ের উদয় হইল, এবং ভাবিলাম, এই সময় এইস্থান হইতে আস্তে আস্তে প্রস্থান করাই আমার পক্ষে মঙ্গ লকর। এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই অন্ধকারময় গৃহ হইতে প্রস্থান করিবার উদযোগ করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ সেই গৃহ আলোকে পূর্ণ হইল। একটি স্ত্রীলোক ছায়ার ন্যায় সেই গৃহ হইতে অন্য গৃহে গমন করিল। পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলাম, অপর আর এক ব্যক্তির সহিত তারাপ্রসন্ন আলো লইয়া সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তিনি আমাকে চিত্তিত দেখিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়! বাড়ীর সকল আলো একেবারে নিবিয়া গিয়াছিল, তাই আলো জ্বালিতে এত বিলম্ব হইল। অন্ধকারে মহাশয় অতিশয় কষ্ট পাইয়াছেন, এই জন্য নিবেদন—আমার এই ত্রুটি মার্জ্জনা করিবেন। এখন আমাদিগের সহিত আসুন, ও যন্ত্রটি পরীক্ষা করিয়া দেখুন, উহার কি দোষ হইয়াছে।’ এই বলিয়া তারাপ্রসন্ন ও তাহার সমভিব্যাহারী আমাকে সঙ্গে লইয়া সেই বাড়ীর ভগ্ন কক্ষের মধ্য দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের হস্তস্থিত সামান্য প্রদীপালোকে আমি যতদূর দেখিতে পাইলাম, তাহাতে আমার বেশ বোধ হইল যে, এক সময় এই বাড়ীর অবস্থা অতি উত্তমই ছিল। কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ধ্বংস হইয়া এখন নিতান্ত ভগ্নাবস্থায় পরিণত হইয়াছে। বাড়ীর প্রাঙ্গন সকল আবৰ্জ্জনায় পরিপূর্ণ, দেওয়াল সকল ফাটিয়া গিয়াছে, কোন স্থান বা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, গৃহের ছাদ সকল স্থানে স্থানে পড়িয়া গিয়াছে! এই প্রকার অবস্থা দেখিতে দেখিতে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। একটি অর্দ্ধভগ্ন সোপানাবলীর সাহায্যে ক্রমে তাহারা আমাকে একটি দ্বিতল প্রকোষ্ঠের ভিতর লইয়া গেল। সেইস্থানে ছোট একটি যন্ত্র ছিল; সেই যন্ত্রটি আমাকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, ‘এই যন্ত্রটি মেরামত করিয়া লইবার অভিপ্রায়ে আপনাকে এইস্থানে আনয়ন করিয়াছি।’
“গৃহের অবস্থা এবং যন্ত্রের অবস্থা দেখিয়া, আমার মনে কেমন এক প্রকার সন্দেহের উদয় হইল। তাহার উপর সেই অন্ধকার গৃহের মধ্যস্থিত স্ত্রীলোকের কথা মনোমধ্যে জাগরূক ছিল। ভাবিলাম, এরূপ নিৰ্জ্জন স্থানে এই ভগ্ন বাড়ীর ভিতর হরপের কারখানা কোন প্রকারেই থাকিতে পারে না। এ কার্য্যের নিমিত্ত প্রকাশ্য স্থানের আবশ্যক। বিশেষতঃ এই ভগ্ন গৃহের ভিতর কখনও যে কোনরূপ হরপ ঢালাই হইয়াছে, তাহা আমার বোধ হয় না। এই কার্য্যের নিমিত্ত যে পরিমাণ লোকের আবশ্যক, এবং যে পরিমিত স্থানের প্রয়োজন, তাহা এই গৃহের ভিতর কেন—এই বাড়ীর ভিতরেই কই? যাহা হউক, সে বিষয়ে অধিক ভাবিবার আমার প্রয়োজন নাই। এ কার্য্যের নিমিত্ত এই রাত্রিকালে এইস্থানে আগমন করিয়াছি, তাহাই সম্পন্ন করিয়া চলিয়া যাই। এই ভাবিয়া সেই কলটির নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তারাপ্রসন্ন আমাকে যাহা বলিয়াছিল, তাহা একবারে অপ্রকৃত নহে; কলটি প্রকৃতই মূল্যবান্ এবং নূতন। তারাপ্রসন্ন ও তাহার অনুচরের হস্তস্থিত আলোকের সাহায্যে এই কলটি খুলিয়া ফেলিলাম। উহার কোনস্থান অপরিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল না। উহা নিয়মিতরূপে প্রত্যহই চলিয়া থাকে, কলের কোনস্থানে কিছুমাত্র ব্যতিক্রমও ঘটে নাই। কেবল উহার মধ্যস্থিত একটি স্কুপ ঢিলা হইয়া পড়িয়াছে বলিয়াই, সেই কল দস্তুর মত চলিতেছে না; দুই এক দিবস বন্ধ হইয়াছে মাত্র। সেই স্ক্রুপটি উত্তমরূপে আঁটিয়া দিলেই আমার কার্য্য শেষ হইয়া গেল। কলটি পুনরায় পূর্ব্ব অবস্থা প্রাপ্ত হইল, পূর্ব্বের ন্যায় চলিতে লাগিল। এই সকল কাৰ্য্য সমাপন করিতে বোধ হয়, এক ঘণ্টার অধিক সময় লাগিল না। তখন আমি উহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ‘আমার বিবেচনায় এই কলটি উত্তমরূপ মেরামত হইয়াছে। এখন অঙ্গীকৃত অর্থ আমাকে প্রদান করিলে বোধ হয়, আমি আপন স্থানে প্রস্থান করিতে পারি।’ আমার কথার উত্তরে তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘ভাল করিয়া না দেখিয়া এতগুলি টাকা আপনাকে কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি?’
“তারাপ্রসন্নের কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, ‘এই কলে আপনারা হরপ বা অপর যে কোন দ্রব্য ঢালাই করিয়া থাকেন, তাহা ঢালিয়া দেখুন। পূর্ব্বের ন্যায় উত্তমরূপে যদি উহাকে আপনাদিগের কার্য্য হয়, তাহা হইলে আমাকে আমার প্রাপ্য টাকা প্রদান করিবেন। নতুবা যে পর্য্যন্ত উহা ঠিক্ কার্য্যের উপযোগী না হইবে, সেই পৰ্য্যস্ত আমি কিছুই গ্রহণ করিব না।’
“আমার কথা শ্রবণ করিয়া তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘আপনার কথা শুনিয়া বোধ হয়, আমরা হরপ ঢালাই করি না। যদি হরপ ঢালাই না করি, তাহা হইলে কিসের নিমিত্ত আমরা এই কল ব্যবহার করিয়া থাকি?”
“কিসের নিমিত্ত ব্যবহার করেন, তাহা আপনারাই বলিতে পারেন। এ কাল পর্যন্ত আমি যত যন্ত্র দর্শন করিয়াছি, তাহাতে এরূপ যন্ত্রে যে হরপ ঢালা যাইতে পারে, তাহা কখন দর্শন করি নাই, শ্রবণ পর্য্যন্তও করি নাই। সে যাহা হউক, আপনারা যাহাই ঢালাই করুন না কেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। আমি আমার কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিয়াছি কি না, তাহাই আপনারা দেখিয়া লউন। যদি মনোনীত হয়, প্রস্তাবিত অর্থ আমাকে প্রদান করুন। আর যদি মনোনীত না হইয়া থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট বলুন। যাহাতে আপনাদিগের মনোনীত হয়, তাহাই আমি করিয়া দিব।’
“আমার কথা শ্রবণ করিয়া তারাপ্রসন্ন কহিল, “উত্তম কথা। আপনি অন্য গৃহে একটু অপেক্ষা করুন, আমরা এই যন্ত্র চালাইয়া দেখি, উহা ঠিক্ চলিতেছে কি না।’
“উত্তরে আমি কহিলাম, ‘আমার অন্য গৃহে যাওয়ার কি প্রয়োজন? আমি সম্মুখে যন্ত্র চলিলে আমি বেশ বুঝিতে পারিব, উহাতে এখনও কোন প্রকার দোষ আছে কি না। আমার নিমিত্ত আপনাদিগের কোনরূপ ভয় নাই। আপনারা অনায়াসেই এই যন্ত্র আমার সম্মুখে চালাইতে পারেন। কোন্ যন্ত্র কি কার্য্যে ব্যবহৃত হয়, তাহা যে বুঝিতে না পারে, সেই যন্ত্র তাহা কর্তৃক কোনরূপেই মেরামত হইতে পারে না।’
“জানি না, কি কুক্ষণে এই কথা আমার মুখ হইতে বাহির হইল! আমার কথা শ্রবণ করিয়া উহারা একবার আমার মুখের দিকে দেখিতে লাগিল, আবার পরস্পর পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগল। এইরূপে দুই চারি মিনিট গত হইয়া গেল। তখন তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘আপনি যখন বলিতেছেন, এই যন্ত্র উত্তমরূপে মেরামত হইয়াছে, তখন আপনার কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ দেখি না; আপনি আমার সহিত আগমন করুন। আমি আপনার প্রাপ্য সমস্ত টাকা প্রদান করিতেছি।’ এই বলিয়া একটি প্রদীপহস্তে আমাকে লইয়া সেই গৃহের নিকটবর্তী অপর আর একটি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই গৃহে প্রবেশ করিবামাত্রই তাহার হস্তস্থিত প্রদীপ নির্ব্বাণ হইয়া গেল। এই প্রদীপ নির্ব্বাণের অর্থ আমি তখন কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু পরে বুঝিয়াছিলাম যে, এই প্রদীপ আপনি নিৰ্ব্বাপিত হয় নাই, তারাপ্রসন্ন ইচ্ছা করিয়াই উহা নির্ব্বাপিত করিয়া দিয়াছিল। প্রদীপ নিৰ্ব্বাপিত হইবামাত্র তারাপ্রসন্ন আমাকে কহিল, ‘প্রদীপটি নিবিয়া গেল? আপনি এইস্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি এখনই এই প্রদীপ জ্বালিয়া আনিয়া আপনার প্রাপ্য টাকাগুলি দিয়া, আপনাকে বিদায় করিয়া দিতেছি।’
“এই কথা বলিয়া সেই অন্ধকার গৃহের মধ্যে আমাকে রাখিয়া তারাপ্রসন্ন যেমন বাহির হইল, অমনি বাহির হইতে গৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সেই অপরিচিত নির্জ্জন পুরীর মধ্যস্থিত একটি অন্ধকারময় গৃহমধ্যে আমি বন্দী হইলাম। সামান্য অর্থের লোভে পড়িয়া সেই রাত্রিকালে অপরিচিত লোকের সহিত যেমন একাকী বাহির হইয়াছিলাম, এখন তাহার উপযুক্ত পুরস্কার প্রাপ্ত হইলাম!
সপ্তম পরিচ্ছেদ
“তারাপ্রসন্ন আমার নিকট হইতে বহির্গত হইয়া তাহার অনুচরের নিকট গমন করিল। উহাদিগের মধ্যে সেই সময়ে যে কথাবার্তা হইতে লাগিল, তাহা আমি স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম। উহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে অতিশয় ভয়ের উদ্রেক হইল। ভাবিলাম, টাকা ত পরের কথা, এখন যদি কোনরূপে এই দুর্বৃত্তদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারি, তাহা হইলেই মঙ্গল; নতুবা আমার প্রাণ বাঁচান ভার হইবে! এই নিভৃত কক্ষেই আমার জীবন লীলা শেষ হইবে!
“তারাপ্রসন্ন কহিল, ‘কৌশল করিয়া উহাকে গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়াছি। এখন কি কথা কৰ্ত্তব্য?’
“উত্তরে তাহার সঙ্গী কহিল, ‘কর্তব্য আর কি? আমি পূর্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছিলাম, এই যন্ত্র ভাল কারিকরের হস্তে পতিত হইলে সে তখনই বুঝিতে পারিবে—কি কার্য্যের নিমিত্ত ইহা ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এখন বুঝিতে পারিলে ত? দেখিলে, আমার কথা প্রকৃত কি না?’
“তারাপ্রসন্ন। এ ব্যক্তি প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছে বলিয়া বোধ হয়।
“সঙ্গী। এখনও আবার সন্দেহ? ও ত স্পষ্টই বলিল, ইহাতেও তোমার মনে সন্দেহ হয়?
“তারাপ্রসন্ন। সন্দেহ না হইলে উহাকে এরূপভাবে আবদ্ধ করিব কেন?”
“সঙ্গী। আবদ্ধ ত করিলে; কিন্তু উহাকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখিবে, কি অপর কোন উপায় করিবে?
“তারাপ্রসন্ন। কিছু না কিছু করিতেই হইবে। কারণ, এ অবস্থায় ইহাকে ছাড়িয়া দিলেই সৰ্ব্বনাশ ঘটাইবে।
“সঙ্গী।” উহাকে একেবারে নিকাশ করিয়া দিলে হয় না?
“তারাপ্রসন্ন। এখন নহে। আজ এইরূপ অবস্থায় আবদ্ধ থাক্, কাল যখন কর্তা মহাশয় আসিবেন, তখন তাহাকে সমস্ত কথা বলিব। যাহা বিবেচনা হয়, তিনিই করিবেন। আমাদিগের এত ঝঞ্ঝাটে প্রয়োজন কি?
“সঙ্গী। তাহাই উত্তম। ও ঐরূপ অবস্থায় আবদ্ধ থাকুক, এদিকে আমরা কিছু কার্য্য করিয়া লই।
“উভয়ের মধ্যে এইরূপ ভাবে কথাবার্তার পর, তাহারা ক্রমে সমস্ত সরঞ্জাম প্রস্তুত করিয়া লইয়া সেই কল চালাইতে আরম্ভ করিল। আমি অন্ধকার গৃহে, আর উহারা প্রজ্বলিত আলোকে কর্ম্ম করিতেছে। গৃহের পুরাতন জানালা ও দরজার ফাঁক দিয়া আমি উহাদিগের কার্য্যের কিছু কিছু দেখিতে পাইলাম। কিন্তু যাহা দেখিলাম, তাহাতেই বুঝিলাম, আমার অনুমান সত্য। সেই যন্ত্রের সাহায্যে উহারা রাশি রাশি কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুত করিতেছে।
“এই সকল ব্যাপার দেখিয়া এবং আমা-সম্বন্ধীয় পরামর্শ সকল শ্রবণ করিয়া আমার মনে যে কি ভয়ানক চিন্তার আবির্ভাব হইল, তাহা আপনারাই বুঝিয়া দেখুন। আমার বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল, বিবেচনা দূরে পলাইল, আমি একরূপ সংজ্ঞাহীন হইয়া সেইস্থানে শুইয়া পড়িলাম। ভরসার মধ্যে কেবল ঈশ্বর। এইরূপ অবস্থায় সেই গৃহের ভিতর আমি যে কতক্ষণ ছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু হঠাৎ সেই গৃহের অপর পার্শ্বস্থিত আর একটি দ্বার খুলিবার অতি মৃদুশব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। বুঝিলাম, দুরাত্মাগণ আমাকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে সেই দ্বার খুলিয়া ধীরে ধীরে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতেছে। সেইস্থান হইতে পলায়ন করিবার যখন উপায় নাই, তখন আর কি করিব? প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া স্থির মনে কেবল ভগবানকে ডাকিতে লাগিলাম। সেই সময় নিতান্ত মৃদুপদ-বিক্ষেপে কে যেন সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং আস্তে আস্তে আমার নিকটে আসিয়া কহিল, “তুমি কোথায়?” হঠাৎ এই স্বর শুনিয়া বোধ হইল, পূর্ব্বে কোথায় যেন এই স্বর শ্রবণ করিয়াছি। তখনই আমার মনে হইল যে, এই স্ত্রীস্বর পূর্ব্বে আমাকে এইস্থান হইতে পলায়ন করিতে কহিয়াছিল।
“সেই সময় সেই কণ্ঠস্বরে পুনরায় কহিলেন, ‘তুমি কোথায়? আমার সহিত আইস, এখনই পলায়ন কর; নতুবা মৃত্যু নিশ্চয়। বিলম্ব করিও না, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আইস।’ এই বলিয়া যে দ্বার দিয়া তিনি ভিতরে আসিয়াছিলেন, সেইদিকে গমন করিলেন। মুক্তদ্বার পথে অল্প আলোক গৃহের ভিতর প্রবিষ্ট হওয়ায় আমি সেই স্ত্রীমূৰ্ত্তি সম্পূর্ণরূপ দেখিতে না পাইলেও, তাঁহার ছায়ামূর্তি আমার নয়নগোচর হইল। আমিও ঈশ্বরের নাম স্মরণ করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম।
“গৃহের বাহিরে আসিবামাত্র তিনি আমার বস্ত্র ধরিলেন, ও অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন, এবং গমনকালীন অতি মৃদুস্বরে কহিলেন, ‘সিঁড়ির দ্বার বদ্ধ, কোনরূপে নীচে যাইবার উপায় নাই। যাইবার চেষ্টা করিলেও উহারা জানিতে পারিবে।’ এইরূপে সেই ঘোর অন্ধকারের ভিতর দিয়া কয়েকটি প্রকোষ্ঠ অতিক্রম পূর্ব্বক একস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে তিনি আমাকে কহিলেন, ‘কেবল এইস্থান ভিন্ন এই বাড়ী হইতে পলাইবার আর কোন উপায় নাই। যদি সাহসের উপর নির্ভর করিয়া এই দ্বিতল গৃহ হইতে লম্ফপ্রদান পূর্ব্বক পলায়ন করিতে পার, তবেই তোমার মঙ্গল; নতুবা মৃত্যু নিশ্চয়। সেই অন্ধকারে যদিও তুমি কিছুই দেখিতে পাইতেছ না; কিন্তু আমি এইস্থানের অবস্থা উত্তমরূপে অবগত আছি। তুমি এইস্থান হইতে লম্ফপ্রদান করিয়া যদি ঠিক পড়িতে পার, তাহা হইলে অল্প নীচেই একটি ছাদের উপর গিয়া পতিত হইবে, এবং সেইস্থান হইতে লম্পপ্রদান করিলে মৃত্তিকা পাইবে। সুতরাং দুই লম্ফে একতলা হইতে অবতরণ করিলে, কোনরূপ কষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই, অনায়াসেই পলায়ন করিতে পারিবে। এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ বিবেচনা নাই, লম্ফপ্রদান করিয়া এখনই এইস্থান হইতে প্রস্থান কর।’
“স্ত্রীমূর্ত্তির এই কথা শ্রবণ করিয়া ভাল মন্দ ভাবিবার আর সময় পাইলাম না। দুর্বৃত্তদিগের পরামর্শ সকল নিজ কর্ণেই শ্রবণ করিয়াছি; সুতরাং এখানে থাকিলে মৃত্যু নিশ্চয়। এদিকে যদি কোনরূপে পলাইতে পারি, ভালই; নচেৎ সেই মৃত্যু। এইরূপ অবস্থায় পলায়নের চেষ্টা করাই কর্তব্য। এই ভাবিয়া মনে মনে ঈশ্বরের নাম ধ্যান করিয়া সেইস্থান হইতে অলক্ষিত ভাবে ছাদের উদ্দেশে লম্ফপ্রদান করিলাম। দেখিলাম, স্ত্রীলোকটি যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রকৃতই। অনায়াসেই একটি ছাদের উপর গিয়া দণ্ডায়মান হইলাম। এইরূপে ছাদের উপর গিয়া দণ্ডায়মান হইলে মনে সাহস হইল, আমি পুনরায় সেই ছাদের উপর হইতে অলক্ষিত মৃত্তিকার উপর লম্ফপ্রদান করিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ মৃত্তিকার উপর পতিত না হইয়া, সেইস্থানের স্তূপীকৃত কতকগুলি ইষ্টকের উপর গিয়া পতিত হইলাম। ইষ্টকের উপর পদদ্বয় স্থির থাকিতে না পারায়, উহা স্থানভ্রষ্ট হইয়া গেল; আমি সেইস্থানে সবলে পতিত হইলাম। উভয় হাঁটুতে অতিশয় চোট লাগিল, এবং মস্তক কাটিয়া সবেগে রক্তধারা বাহির হইল। দুর্বৃত্তগণ আমার পতনের শব্দ পাইয়া পাছে আমার অনুসন্ধানে আগমন করে, এবং এইস্থানে আমাকে প্রাপ্ত হইয়া পাছে আমাকে ধৃতপূর্ব্বক পুণরায় আবদ্ধ করে, এই ভয়ে সেই প্রবল আঘাতের দিকে ক্ষণকালের নিমিত্ত দৃষ্টিপাত না করিয়া অতিকষ্টে আমি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, এবং যে দিক্ সম্মুখে পাইলাম, সেইদিকেই অতিশয় কষ্টের সহিত চলিতে লাগিলাম। মস্তক—নিঃসৃত রক্তস্রাবে আমার সমস্ত শরীর ভিজিয়া গেল। তথাপি তাহার দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া, প্রাণভয়ে চলিতে লাগিলাম। এইরূপে কতক্ষণ গমন করিলাম, বা কত পথ অতিবাহিত করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু বোধ হইল, মধ্যে মধ্যে জঙ্গলে পরিপূর্ণ একটি ময়দানের ভিতর আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। সেইস্থান হইতে চলিবার আরও অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোনরূপেই আর চলিতে পারিলাম না; অনন্যোপায় হইয়া সেইস্থানে আমি বসিয়া পড়িলাম। সেই সময় আমি আমার জ্ঞান হারাইলাম, অজ্ঞান অবস্থায় সেইস্থানে পড়িয়া রহিলাম।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
“এইরূপে কতকক্ষণ আমি সেইস্থানে অচেতন অবস্থায় পড়িয়াছিলাম, বলিতে পারি না। কিন্তু যখন আমার সংজ্ঞা লাভ হইল, তখন দেখিলাম—জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, ভাবিলাম, আর অধিক রাত্রি নাই। মনে করিলাম, কোন প্রকারে যদি উঠিতে পারি, তাহা হইলে যতদূর পারি, এইস্থান হইতে গমন করিব। এই ভাবিয়া গাত্রোত্থান করিয়া উপবেশন করিবার চেষ্টা করিলাম; কিন্তু উঠিতে পারিলাম না। এই সময় আমার নিকটবর্তী একটি ভয়ানক দৃশ্যের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম—আমি যে প্রকারে পিশাচের হস্তে পতিত হইয়াছিলাম, আমা অপেক্ষাও কোন হতভাগ্য সেইরূপ পিশাচের হস্তে পতিত হইয়া জীবন হারাইয়াছে।
“একবার ভাবিলাম, ইনি হয় ত আমারই সেই শত্রুদ্বয় কর্তৃক নিহত হইয়াছে। আমি পলায়ন করিবার পর শত্রুদ্বয় আমারই অনুসরণ করে, এবং সম্মুখে কোন হতভাগ্যকে দেখিতে পাইয়া আমি বিবেচনায় উহারই সর্ব্বনাশ-সাধন করিয়াছে। এই ভাবিয়া মৃতের ন্যায় আমি সেইস্থানে পড়িয়া রহিলাম। কিন্তু শুইয়া শুইয়া দেখিতে লাগিলাম, সেইস্থানে বসিয়া দুই ব্যক্তি উক্ত মৃতদেহটি এরূপভাবে টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়া ফেলিল যে, তাহা দেখিলে হঠাৎ কেহই বলিতে পারিবে না, উহা মনুষ্যের দেহাবশিষ্ট! যাহা হউক, পরিশেষে এই টুকরাগুলি একত্র করিয়া বাঁধিয়া লইল, ও সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।—“
এই সময় আমি কেশবচন্দ্র কর্ম্মকারের কথায় প্রতিবন্ধক দিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ সেই পিশাচদ্বয় যখন সেইরূপে নরদেহকে খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন করিতেছিল, তখন তাহারা আপনাদিগের মধ্যে কোনরূপ কথাবার্তা কহিতেছিল কি না? যদি কোন কথা কহিয়া থাকে, তাহা হইলে যতদূর আপনার মনে থাকিবার সম্ভাবনা, তাহা এই সঙ্গে বলিয়া যাউন।”
আমার কথার উত্তরে কর্ম্মকার মহাশয় কহিলেন “ সেই সময় আমি যেরূপ ভীত হইয়াছিলাম, তাহাতে সকল কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করে নাই। যতদূর শুনিতে পাইয়াছি, বা যতদূর মনে করিয়া আনিতে পারি, তাহাই আপনাদিগের নিকট বর্ণন করিতেছি। আমার যেন মনে হয় যে, সেই দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন বলিয়াছিল, ‘যাহাই করি না কেন, এতদিবস পর্য্যন্ত একত্র বাস করিয়া এরূপ কার্য্য করা আমাদিগের ভাল হয় নাই।’ উত্তরে অপর ব্যক্তি কহিল, ‘চিরকাল ভিক্ষা করিতে করিতে জীবন অতিবাহিত হইল, কিন্তু ভিক্ষালব্ধ-দ্রব্য পৰ্য্যন্ত কখনও উপভোগ করিতে পারিলাম না। তিনজন মিলিয়া যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়া আনিব, তাহার সমস্ত সে-ই একাকী গ্রহণ করিবে! এক মুষ্টি পেটের অন্ন ভিন্ন অপর আর কিছুরই আমরা প্রত্যাশী নহি? এরূপ অবস্থায় আমরা যাহা করিয়াছি, তাহা ভালই করিয়াছি। এখন আমরা উহার যথাসর্ব্বস্ব গ্রহণ করিয়া এইস্থান হইতে প্রস্থান পূর্ব্বক, অপর কোন সহরে গিয়া সুখভোগ করিব। ঈশ্বর একে আমাদিগকে সংসারের সমস্ত সুখ হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন, তাহার উপর যদি দুইবেলা উদর পুরিয়া আহার করিতেও না পাইব, তবে আর আমাদিগের বাঁচিয়া লাভ কি? এই দেহের বন্দোবস্ত করিয়া উহার সঞ্চিত যাহা কিছু আছে, তাহা গ্রহণপূর্ব্বক অদ্যই আমরা এইস্থান হইতে পলায়ন করিব। আমাদিগের সদৃশ লোকের কেই বা সংবাদ লইবে, এবং সন্ধান করিয়া কেই বা আমাদিগকে ধরিতে পারিবে? এ জগতে যাহাদিগের কিছুই বা কেহই নাই, তাহাদিগের কিসের ভয়?’ এইরূপ আরও দুই চারিটি কথা বলিয়া সেই মৃতদেহের টুকরাগুলি লইয়া উহারা উভয়েই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।
“আমি স্বয়ং যেরূপ ভয়ানক বিপদে পতিত হইয়াছিলাম, তাহার উপর আবার এই সকল ব্যাপার অবলোকন করিয়া আমি যে কতদূর শঙ্কিত হইয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। উহারা প্রস্থান করিবার পর, সমর্থহীন হইলেও আমি অতিকষ্টে সেইস্থান হইতে প্রাণভয়ে গাত্রোত্থান করিলাম, এবং যে দিকে এই পিশাচদ্বয় প্রস্থান করিল তাহার বিপরীতদিকে গমন করিতে লাগিলাম। জানি না, আমি এতক্ষণ কোথায় ছিলাম এবং এখনই বা কোথায় যাইতেছি। যাহা হউক, আমি প্রাণভয়ে সেই ময়দান দিয়া ক্রমে চলিতে লাগিলাম। কিয়দ্দূর গমন করিতে করিতেই রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল, তখন দেখিতে পাইলাম, আমি যে স্থান দিয়া যে দিকেগমন করিতেছি, সেই দিকেই একটি পথ রহিয়াছে, যেমন রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল, আমার অন্তঃকরণের ভয়ও অনেক কমিয়া গেল, আমি ধীরে ধীরে সেই পথের উপর উঠিয়া তাহার একপার্শ্বে উপবেশন করিলাম। ক্রমে দুই একজন করিয়া মনুষ্যগণ সেইপথে যাতায়াত আরম্ভ করিল, দুই একখানি গাড়িও ক্রমে সেই পথ দিয়া চলিতে লাগিল। আমাকে বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিবার নিমিত্ত আমি দুই একজন কোচমানকে কহিলাম, কিন্তু আমার অবস্থা দেখিয়া কেহই আমাকে তাহার গাড়িতে উঠাইতে সম্মত হইল না। আমি সেইস্থানে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত বসিয়া রহিলাম, পরিশেষে অধিক ভাড়ার লোভেই হউক বা দয়াপরবশ হইয়াই হউক, আমার কথায় একজন সম্মত হইল। আমার বাড়ীর ঠিকানা বলিয়া দিলে, পরিশেষে তাহার গাড়িতে করিয়া সে আমাকে আমার বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিল। ইহার পর ডাক্তারবাবু আপনাকে সংবাদ দেওয়া হয়, এবং আপনি স্বচক্ষে আঘাতের চিহ্ন সকল পরীক্ষা করিয়া যেরূপভাবে চিকিৎসা করিতেছেন, তাহা আপনিই সবিশেষ অবগত আছেন।” এই বলিয়া কেশবচন্দ্র কর্ম্মকার চুপ করিল।
আমি কেশবচন্দ্রের আত্মবিবরণী শ্রবণ করিয়া যে কিরূপ বিস্ময়াবিষ্ট হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। এই কলিকাতা সহরের মধ্যে বা তাহার নিকটবর্তী স্থানে এইরূপ লোমহর্ষণকর ঘটনা যে ঘটিতে পারে, তাহা ইতিপূৰ্ব্বে অতি অল্পই শ্রবণ করিয়াছি, এবং কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুতকারীগণ এইরূপে দলবদ্ধ হইয়া প্রভূত অর্থব্যয় পূৰ্ব্বক যন্ত্র স্থাপন করিয়া অবলীলাক্রমে এই ঘৃণিত ব্যবসা চালাইয়া আসিতেছে, অথচ আমরা ইহার বিন্দুবিসর্গ পর্য্যন্ত অবগত হইতে পারি নাই, ইহা আমাদিগের পক্ষে সামান্য লজ্জাকর বিষয় নহে।!*
অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়া যে মোকদ্দমার কূল কিনারা কিছুই দেখিতে পাইলাম না, আজ ডাক্তারবাবুর অনুগ্রহে সেই মোকদ্দমার বিষয় রহস্য যে উদ্ঘাটন করিতে পারিব, এবং অল্প পরিশ্রম করিলেই যে দোষীগণকে রাজদ্বারে আনিতে সমর্থ হইব, তাহার অনেক আশা হইল। যাহা হউক, তৎপরে ডাক্তারবাবু নিজ কার্য্যে গমন করিলেন। “অন্য সময় আসিয়া পুনরায় সাক্ষাৎ করিব” এই বলিয়া আমিও ডাক্তারবাবুর নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক ভবানীপুরাভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
ভবানীপুরে গমন করিবার সময় আমার মনে নানা প্রকার চিন্তার পুনরায় আবির্ভাব হইল। সেই মৃতদেহ ছিন্নকারী ব্যক্তিদ্বয়ের কথাগুলি সম্বন্ধে বিশেষরূপে চিন্তা করিলাম। বুঝিলাম :—
১ম। হতব্যক্তি অপর দুই ব্যক্তির সঙ্গী।
২য়। উহারা তিনজনেই একই গৃহে একত্র বাস করিত।
৩য়। ভিক্ষাই উহাদিগের উপজীবিকা।
৪র্থ। ভিক্ষালব্ধ সমস্ত দ্রব্যই হতব্যক্তি গ্রহণ করিত। হত্যাকারীদ্বয় কেবল এক এক মুষ্টি অন্ন পাইত মাত্ৰ।
৫ম। হত্যা করিয়া হত্যাকারীদ্বয় হতব্যক্তির সঞ্চিত সমস্ত অর্থ অপহরণ করিয়া, অন্য স্থানে পলায়ন করিয়াছে।
৬ষ্ঠ। এ জগতে উহাদিগের কিছুই নাই বা কেহই নাই।
৭ম। সংসারের সমস্ত সুখ হইতে ঈশ্বর উহাদিগকে বঞ্চিত করিয়াছেন।
৮ম। এদিকে যখন একটি মৃতদেহ কাটিয়া ছিন্ন ভিন্ন করা হইয়াছে, ওদিকে তখন স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই মৃতদেহ পাওয়া যাইতেছে কি প্রকারে?
এই শেষ চিন্তায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মস্তিষ্ক বিলোড়িত করিল, কিন্তু পরিশেষে মনে এক অভিনব ভাবের আবির্ভাব হইল। ভাবিলাম, ইহা কি স্ত্রী ও পুরুষ চিহ্ন বিশিষ্ট কোন নপুংসকের দেহ হইতে পারে না? অনেক নপুংসকই সৰ্ব্বদা স্ত্রীবেশে সজ্জিত থাকিতে বাসনা করে, এই নিমিত্তই উহার অঙ্গ-বিশেষে অলঙ্কার পরিবার উপযুক্ত ছিদ্রের চিহ্ন সকল বর্তমান রহিয়াছে, এবং এই নিমিত্তই সে মেদি বা অন্য কোনরূপ অঙ্গবাস দ্রব্য ব্যবহার করিত।
যদি আমার এই অনুমানই প্রকৃত হয়, তাহা হইলে হত্যাকারীদ্বয়ের কথার সহিত ইহা কতক মিলিতেছে বলিয়া বোধ হয়। কারণ, উহারাও যদি নপুংসক হয়, তাহা হইলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গী, পরস্পরের একত্র বাস করিবার সম্ভাবনা, ভিক্ষাই পরস্পরের উপজীবিকা। এ জগতে নপুংসকের আর কি আছে ও উহাদিগের আত্মীয়ই বা কে? এবং ঈশ্বর যে উহাদিগকেই সংসারের প্রায় সমস্ত সুখ হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন, তাহার আর কিছুমাত্র ভ্রম নাই।
এই কলিকাতা সহরের ভিতর নপুংসকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প না হইলেও কিন্তু এত অধিক নহে যে, অনুসন্ধানে কতকগুলি নপুংসক আছে, তাহা স্থির হইবে না।
এই ভাবিয়া যে স্থানে মৃতদেহের টুকরা সকল পাওয়া গিয়াছিল, তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেক পাড়ায় কোন্ কোন্ নপুংসকের বাস, তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। এইরূপে অনুসন্ধান করিতে জানিতে পারিলাম যে, বেগ বাগানের একস্থানে তিনজন নপুংসক বহুদিবস হইতে বাস করিত; দুই দিবস হইতে তাহারা কোথায় চলিয়া গিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম, এইরূপ ভাবে তাহারা মধ্যে মধ্যে প্রায়ই ভিক্ষা করিবার নিমিত্ত বাহির হইয়া যায়, ও সময় সময় দশ পনের দিবস পরেও প্রত্যাগমন করে। এই তিন ব্যক্তির মধ্যে কেবল একজনের নাম সকলে জানিত, উহার নাম—“নছিবন”।
আমি যে অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া এখন অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহার কতক অংশ এখন প্ৰকৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। কিন্তু যাহাদিগের গমনের বা অবস্থানের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই, অনুসন্ধান করিয়া এখন তাহাদিগকে কোথায় পাইব, এখন সেই চিত্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। এবং পাইলেই বা তাহাদিগের উপর আইন অনুযায়ী এমন কি প্রমাণ আছে যে, সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া উহাদিগকে ধৃত করিতে সমর্থ হইব?
এই প্রকার নানা ভাবনা ভাবিতে ভাবিতে সহরের নানাস্থানে উহাদিগের অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম; কিন্তু কোনস্থানে উহাদিগের কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে আপনার বাসাভিমুখে গমন করিলাম।
আহারান্তে উহাদিগের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত পুনরায় বহির্গত হইলাম। এবার রেলওয়ে ষ্টেশন ও ষ্টীমার ঘাটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, যদি দুইটি নপুংসককে কোনস্থানে একত্র গমন করিতে কেহ দেখিয়া থাকে।
এই প্রকার অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম, আমার উদ্দেশ্য কিয়ৎ পরিমাণে সফল হইল। ষ্টীমার ঘাটের একটি লোক আমাকে বলিল, দুই কি তিন দিবস অতীত হইল, দুইজন নপুংসককে সে ষ্টীমারে উলুবেড়িয়ার অভিমুখে গমন করিতে দেখিয়াছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমিও আর কাল বিলম্ব করিলাম না, দ্রুতগামী একখানি ছোট নৌকা লইয়া আমি উলুবেড়িয়া অভিমুখে গমন করিলাম।
যখন আমি সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি প্রায় দশটা অতীত হইয়া গিয়াছে; সুতরাং কাহাকেও কিছু না বলিয়া একটি দোকানে আমি সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। সেই সময় দুইটি নপুংসক সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করায় জানিতে পারিলাম। দুইদিবস হইতে দুইটি নপুংসক কোথা হইতে আসিয়া সেইস্থানের বাজারে অবস্থিতি করিতেছে। এই সংবাদ পাইবামাত্র বাজারে গমন করিলাম, এবং উহাদিগকেও দেখিতে পাইলাম।
“সঙ্গীকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিলে যদি বাঁচিতে পারা যাইত, তাহা হইলে আর ভাবনা কি?” একেবারে এই কথা বলিয়াই উহাদিগকে ধৃত করিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া উহাদিগের একেবারেই বাঙনিষ্পত্তি হইল না। উহাদিগের নিকট যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা ব্যতীত প্রায় পাঁচশত নগদ টাকাও বাহির হইল। উহাদিগকে ধৃত করিয়া একেবারে কলিকাতায় আনিলাম।
কলিকাতায় আসিয়া উভয়েই আপন দোষ স্বীকার করিল ও কহিল, যাহাতে কোনরূপে মৃতদেহ পাওয়া না যায়, তাহারই নিমিত্ত হত্যা করিবার পর, উহার মৃতদেহ খণ্ডে খণ্ডে কর্ত্তন করিয়া কয়েকটি পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করা হয়। কারণ, এক পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করিলে পাছে সমস্ত গুলিই বাহির হইয়া পড়ে! অথচ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে মাংস খণ্ড সকল পতিত হইলে কচ্ছপ, মৎস্য প্রভৃতির দ্বারা উহা সহজেই বিনষ্ট হইবার সম্ভাবনা।
আসামীগণ আমাদিগের নিকট সকল কথা স্বীকার করিল সত্য। কিন্তু মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট সমস্তই একেবারে অস্বীকার করিল ও কহিল, “নছিবন আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া কয়েক দিবস হইতে কোথায় পলায়ন করিয়াছে। পরিশেষে আমরাও ভিক্ষা করিবার নিমিত্ত উলুবেড়িয়ায় গমন করিয়াছিলাম। সেইস্থানে অন্যায়রূপে অভিযুক্ত হইয়া আমরা পুলিস কর্তৃক ধৃত হইয়াছি।
হত্যা-অপরাধে আসামীগণের কিছুই হইল না। কিন্তু তাহাদিগের নিকট যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল, তাহার মধ্যে কতকগুলি দ্রব্য নছিবনের প্রমাণ হওয়ায়, উহারা কেবল দুই দুই বৎসরের নিমিত্ত কারারুদ্ধ হইল।
[শ্রাবণ, ১৩০২]